০৪. সারাটা দিন ছাদে

সারাটা দিন তিন্নি ছাদে কাটাল।

এক বার এ-মাথায় যাচ্ছে, আরেক বার ও-মাথায়। মাঝে-মাঝে বিড়বিড় করে নিজের মনে কথা বলছে এবং হাসছে। শীতের দিনের রোদ দুপুরের দিকে খুব বেড়ে যায়। সারা গা চিড়বিড় করে। কিন্তু মেয়েটি নির্বিকার। হাঁটছে তো হাঁটছেই। রহিমা দুপুরে ছাদে এসে ভয়ে ভয়ে বলেছিল, ‘ভাত দিছি, খেতে আসেন।’ তিন্নি কোনো কথা বলে নি। রহিমা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছে। তিন্নি বুঝতে পারছে, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় রহিমা মনে মনে বলছে, ‘পিশাচ, পিশাচ। মানুষ না, পিশাচ!’ তিন্নির খানিকটা রাগ লাগছিল। কিন্তু সে সামলে নিল। সব সময় রাগ করতে ভালো লাগে না। তার নিজেরও কষ্ট হয়। চোখ জ্বালা করে।

রহিমা চলে যাবার পরপরই বরকত সাহেব এলেন। তিনি কোনো কথা বললেন না। চিলেকোঠার কাছে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিন্নির মন-খারাপ হয়ে গেল। বাবা আগে তাকে ভয় পেতেন না। এখন পান। খুবই ভয় পান। অথচ সে বাবাকে এক দিনও ব্যথা দেয় নি। কোনো দিন দেবেও না।

‘তিন্নি।’

‘কি বাবা?’

‘ভাত খেতে এস।’

‘আমার খিদে নেই বাবা। যেদিন খুব রোদ ওঠে, সেদিন আমার খিদে হয় না।’ বরকত সাহেব ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। সেই নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে তিন্নির আরো মন-খারাপ হয়ে গেল।

‘তিন্নি।’

‘কি বাবা?’

‘যে-ভদ্রলোক এসেছেন, তাঁর সঙ্গে কি তোমার কথা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, হয়েছে।’

‘তাঁকে তোমার কেমন লেগেছে?’

‘ভালো।’

‘তাহলে তাঁকে ব্যথা দিলে কেন? আমি কিছুক্ষণ আগে একতলায় গিয়েছিলাম, ভদ্রলোক মড়ার মতো পড়ে আছেন।’

তিন্নি জবাব দিল না। বরকত সাহেব বললেন, ‘তুমি জান, তিনি কী জন্যে এসেছেন?’

‘জানি। তিনি আমাকে বলেছেন।’

‘তুমি লক্ষ্মী মেয়ের মতো তোমার যত কথা আছে, সব ওঁকে বলবে। কিছুই লুকোবে না।’

‘আচ্ছা।’

‘তোমার স্বপ্নের কথাও বলবে।’

‘তিনি বিশ্বাস করবেন না, হাসবেন।’

‘না, হাসবেন না। উনি একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। তোমার সব কথা উনি বুঝবেন। আমি যা বুঝতে পারি নি, উনি তা পারবেন।’

তিন্নি বলল, ‘উনি কি গাছের মতো জ্ঞানী?’

বরকত সাহেব মৃদুস্বরে বললেন, ‘তোমার গাছের ব্যাপারটা আমি জানি না তিন্নি। কাজেই বলতে পারছি না গাছের মতো জ্ঞানী কি না। আমার ধারণা, গাছের জীবন থাকলেও তা খুব নিম্ন পর্যায়ের। জ্ঞান-বুদ্ধির ব্যাপার সেখানে নেই।’

‘বাবা।’

‘বল মা।’

‘আমার স্বপ্নের ব্যাপারটা কি আজই ওঁকে বলব?’

‘না, আজ না-বললেও হবে। কাল বল। আজ ভদ্রলোক ঘুমুচ্ছেন! আমার মনে হয় সারা দিনই ঘুমুবেন! তুমি ব্যথা দেবার পর উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’

তিন্নি লজ্জিত হল। কিছু বলল না। বরকত সাহেব বললেন, ‘তুমি কি ছাদেই থাকবে?’

‘হ্যাঁ। তুমি যাও, ভাত খাও।’

বরকত সাহেব নেমে গেলেন। তিন্নি ছাদের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত আবার হাঁটতে শুরু করল। সে নেমে এল সন্ধ্যাবেলায়। তার গা ঝিমঝিম করছে। হাত-পা কাঁপছে। আজ সে আবার স্বপ্ন দেখবে। এসব লক্ষণ তার এখন চেনা হয়ে গেছে। তার ভয়ভয় করতে লাগল। স্বপ্ন এত বাজে ব্যাপার, এত কষ্টের!

ঘুমুবার আগে তিন্নি একবাটি দুধ খেল। রহিমা কমলা এনেছিল খোসা ছাড়িয়ে। তার দু’টি কোয়া মুখে দিল। রহিমা বলল, ‘আমি এই ঘরে ঘুমাইব আপা?’ তিন্নি কড়া গলায় বলল,—’না।’ রহিমা প্রতি রাতেই এই কথা বলে। প্রতি রাতেই তিন্নি একই উত্তর দেয়। একা–থাকা তার অভ্যেস হয়ে গেছে। অথচ কেউ সেটা বুঝতে চায় না। বাবাও মাঝে মাঝে এসে বলেন, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে ঘুমুবে মা?’

একবার খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। ঘন-ঘন বাজ চমকাচ্ছিল। বাবা এসে জোর করে তাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে কত বার বলেছে, ‘আমি কাউকেই ভয় করি না।’ বাবা শোনেন নি। বাবা-মারা কোনো কথা শুনতে চায় না। মার কথা সে অবশ্যি বলতে পারে না, কারণ মার কথা তার কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে মাথাভর্তি চুলের একটি গোলগাল মুখ তার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। তিন্নি ভাবতে লাগল, মা বেঁচে থাকলে এখন কী করত? তাকে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়ে যেত। হয়তো রোজ রাতে তার সঙ্গে ঘুমুত। কান্নাকাটি করত। আচ্ছা, সে এ রকম হল কেন? সে অন্য সব মেয়েদের মতো হল না কেন?

রহিমা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সরাসরি তিন্নির দিকে তাকাচ্ছে না। কিন্তু মনে-মনে চাচ্ছে তাড়াতাড়ি এ-ঘর থেকে চলে যেতে। তিন্নি ভেবে পেল না, যে চলে যেতে চাচ্ছে, সে চলে না—গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

‘রহিমা।’

‘জ্বি আপা?’

‘তুমি আজ সকালে আমাকে পিশাচ ডাকছিলে কেন?’

রহিমার মুখ সাদা হয়ে গেল। দেখতে-দেখতে কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমল।

’পিশাচরা কী করে রহিমা?’

রহিমা তার জবাব দিল না। তার পানির পিপাসা পেয়ে গেছে। বুক শুকিয়ে কাঠ।

’আর কোনো দিন আমাকে পিশাচ ডাকবে না।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

‘এখন যাও।’

আজ বোধহয় স্বপ্নটা সে দেখবেই। বিছানায় শোয়ামাত্র চোখ জড়িয়ে আসছে ঘুমে। অনেক চেষ্টা করেও চোখ মেলে রাখা যাচ্ছে না। ঘরের বাতাস হঠাৎ যেন অনেকখানি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছে দূরে। এই দূর অনেকখানি দূর! গ্রহ-নক্ষত্র ছাড়িয়ে দূরে, আরো দূরে। তিনি ছটফট করতে লাগল। সে ঘুমুতে চায় না, জেগে থাকতে চায়। কিন্তু ওরা তাকে জেগে থাকতে দেবে না। ঘুম পাড়িয়ে দেবে। এবং ঘুম পাড়িয়ে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখাবে।

তিন্নি সেই রাতে যে-স্বপ্ন দেখল তা অনেকটা এ রকম : একটি বিশাল মাঠে সে দাঁড়িয়ে আছে। যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু গাছ আর গাছ। বিশাল মহীরুহ। এইসব গাছের মাথা যেন আকাশ স্পর্শ করেছে। গাছগুলি অদ্ভুত। লতানো ডাল। কিছু-কিছু ডাল আবার বেণী পাকানো। তাদের গায়ের রঙ সবুজ নয়, হলুদের সঙ্গে লাল মেশানো। হালকা লাল। এইসব গাছ একসঙ্গে হঠাৎ কথা বলে উঠছে। নিজেদের মধ্যে কথা। আবার কথা বন্ধ করে দিচ্ছে। তখন চারদিকে সুনসান নীরবতা। শোনা যাচ্ছে শুধু বাতাসের শব্দ। ঝড়ের মতো শব্দে বাতাস বইছে। আবার সেই শব্দ থেমে যাচ্ছে। তখন কথা বলছে গাছেরা। কত অদ্ভূত বিষয় নিয়ে কত অদ্ভূত কথা! তার প্রায় কিছুই তিনি বুঝতে পারছে না। একসময় সমস্ত কথাবার্তা থেমে গেল। তিন্নি বুঝতে পারল সব ক’টি গাছ লক্ষ করছে তাকে। তাদের মধ্যে একজন বলল, ‘কেমন আছ ছোট্ট মেয়ে?’

‘ভালো।’

‘ভয় পাচ্ছ কেন তুমি?’

‘আমি ভয় পাচ্ছি না।’

‘অল্প-অল্প পাচ্ছ। কোনো ভয় নেই।’

‘কোনো ভয় নেই’–বলার সঙ্গে-সঙ্গে সব ক’টি গাছ একত্রে বলতে লাগল, ‘ভয় নেই। কোনো ভয় নেই।’

ভয়াবহ শব্দ! কানে তালা লেগে যাবার মতো অবস্থা। তিন্নি তখন কেঁদে ফেলল, তার কান্নার সঙ্গে-সঙ্গে সমস্ত শব্দ থেমে গেল। কথা বলল শুধু একটি গাছ।

‘ছোট্ট মেয়ে তিন্নি।’

‘কি?’

‘কাঁদছ কেন?’

‘জানি না কেন। আমার কান্না পাচ্ছে।’

‘ভয় লাগছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কোনো ভয় নেই। তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।’

কথা শেষ হবার সঙ্গে আলো কমে এল। সব ক’টি গাছ একত্রে মাথা দুলিয়ে কী-সব গান করতে লাগল। এই গানে মনে অদ্ভুত এক আনন্দ হয়। শুধু মনে হয় কত সুখ চারদিকে। শুধু বেচে থাকতে ইচ্ছে করে। আনন্দ করতে ইচ্ছা করে।

‘ঘুম আসছে ছোট্ট মেয়ে তিন্নি?’

‘আসছে।’

‘তাহলে ঘুমাও। আমাদের গান তোমার ভালো লাগছে?’

‘লাগছে।’

‘খুব ভালো?’

‘হ্যাঁ, খুব ভালো।’

গাঢ় ঘুমে তিন্নির চোখ জড়িয়ে এল। স্বপ্ন শেষ হয়েছে। কিন্তু শেষ হয়েও যেন হয় নি। তার রেশ লেগে আছে তিন্নির চোখে-মুখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *