০৩. শ্রদ্ধাষ্পদেষু

শ্রদ্ধাষ্পদেষু

জনাব আপনাকে কেমন ভড়কে দিলাম। সরাসরি চিঠিটা আপনার কাছে দিলে আপনি এত আগ্রহ নিয়ে পড়তেন না। কাজেই সামান্য নাটক করতে হল। আশা করি আমার এই ছেলেমানুষি নাটকে আপনি বিরক্ত হন নি।

আমি আপনাকে চিনি না। আপনার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয় নি। আপনার সম্পর্কে যা জানি বই পড়ে জানি। বইয়ে লেখকরা সবকিছু ঠিকঠাক লিখতে পারেন না। মূল চরিত্রগুলিকে তারা মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেন। আমি ধরেই নিয়েছি আপনার বেলাতেও তাই হয়েছে। বইয়ের মিসির আলি এবং ব্যক্তি মিসির আলি এক নন। কে জানে আপনি হয়তো বইয়ের মিসির আলির চেয়েও ভালো মানুষ।

আমি আপনার সম্পর্কে মনে মনে একটা ছবি দাঁড় করিয়েছি—আচ্ছা দেখুন তো সেই ছবিটার সঙ্গে কতটুকু মেলে। তারও আগে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নেই। আমার ধারণা আপনি এখন ভুরু কুঁচকে ভাবছেন, চিঠির মেয়ে এবং চিত্রা কি এক? ব্যাপারটা আমি ধীরে ধীরে পরিষ্কার করব। আপাতত আপনি এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনাকে লেখা চিঠিটা মন দিয়ে পড়ুন। এই চিঠি আমি দু বছর ধরে রাত জেগে লিখেছি। অসংখ্য বার কাটাকুটি করেছি। বানান ঠিক করেছি। যেন চিঠি পড়ে আপনি কখনো বিরক্ত হয়ে না ভাবেন—মেয়েটা এই সহজ বানানও জানে না! আশ্চর্য তো!

ভালো কথা আপনার সম্পর্কে আমার ধারণা কী এখন বলি, দেখুন তো মেলে কি না। আমার ধারণা আপনি হাসিখুশি ধরনের মানুষ। বইয়ে আপনার যে গম্ভীর প্রকৃতির কথা লেখা হয় সেটা ঠিক না। আপনার চেহারার যে বর্ণনা বইয়ে থাকে সেটাও ঠিক না। আপনার বিশেষত্বহীন চেহারার কথা লেখা হলেও আমি জানি আপনার চেহারা মোটেও বিশেষত্বহীন নয়। আপনার চোখ ধারালো ও তীব্র সার্চ লাইটের মতো। তবে সেই ধারালো চোখেও একটা শান্তি শান্তি ভাব আছে। আমার খুব ইচ্ছা কোনো একদিন আপনাকে এসে দেখে যাব। শান্ত ভঙ্গিতে আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকব। একসময় আপনাকে বলব, আমাকে একটা হাসির গল্প বলুন তো। আমার কেন জানি মনে হয় কেউ আপনার কাছে গল্প শুনতে আসে না। সবাই আসে ভয়ঙ্কর সব সমস্যা নিয়ে। দিনের পর দিন এইসব সমস্যা শুনতে কি আপনার ভালো লাগে? মাঝে মাঝে আপনার কি ইচ্ছা করে না সহজ স্বাভাবিক গল্প শুনতে এবং বলতে? যেমন আপনি একটা ভূতের গল্প শুনে ভয় পাবেন। ভুরু কুঁচকে ভাববেন—না, ভূত বলে কিছু নেই।

আমাদের চারপাশের জগৎটা সহজ স্বাভাবিক জগৎ, এই জগতে মাঝে মাঝে বিচিত্র এবং ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে। আমার নিজের জীবনেই ঘটে গেল। এবং আমি আপনাকে সেই গল্পই শুনাতে বসেছি। না শুনালেও চলত। কারণ আমি আপনার কাছ থেকে কোনো সাহায্য চাচ্ছি না। বা আপনাকে বলছি না আপনি আমার সমস্যার সমাধান করে দিন। তারপরেও সব মানুষেরই বোধহয় ইচ্ছা করে নিজের কথা কাউকে না কাউকে শুনাতে। আমার চারপাশে তেমন কেউ নেই।

এখন আমি আপনার একটা অস্বস্তি দূর করি। চিত্রা নামের যে মেয়েটি আপনার কাছে এসেছিল আমি সেই মেয়ে। কাজেই আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। চিত্রার সেদিন আপনাকে কেমন লেগেছিল তা আর আপনাকে কোনোদিন জানানো হবে না। কারণ চিত্রার সঙ্গে আপনার আর কোনোদিন দেখা হবে না। আপনাকে খানিকটা ধাঁধায় ফেলে চিত্রা বিদেয় নিয়েছে। আমিও বিদায় নেব। আমার দীর্ঘ চিঠি শেষ করার পর আপনি ভাববেন—আচ্ছা মেয়েটার কি মাথা খারাপ? সে এইসব কী লিখেছে? কেনই বা লিখেছে? দীর্ঘ লেখা পড়তে আপনার যেন ক্লান্তি না লাগে সে জন্যে আমি খুব চেষ্টা করেছি। চেষ্টা কতটুকু সফল হল কে জানে। চ্যাপ্টার দিয়ে দিয়ে লিখলাম। চ্যাপ্টারের প্রথম কয়েক লাইন পড়ে আপনি ঠিক করবেন আপনি পড়বেন কি পড়বেন না। সব চ্যাপ্টার যে পড়তেই হবে তা না।

পরিচয়

নাম : চিত্রা (নকল নাম)।

বয়স : ২৩ বছর। (যখন লেখা শুরু করেছিলাম তখন বয়স ছিল ২০ বছর তিন মাস)।

উচ্চতা : পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি।

আমার প্রিয় রঙ : চাঁপা।

আমার দেখতে ভালো লাগে : চাঁদ এবং পানি।

পড়াশোনা : এস. এস. সি. পাস করার পর আর পড়াশোনা করতে পারি নি। তবে আমি খুব পড়ুয়া মেয়ে। শত শত বই পড়ে ফেলেছি। শুধু গল্পের বই না। সব ধরনের বই। বাড়িতে আমি যেন পড়তে পারি সে জন্যে আমার একজন শিক্ষক আছেন। দর্শনবিদ্যার শিক্ষক। তবে দর্শন আমার প্রিয় বিষয় নয়।

আমি কেমন মেয়ে? ভালো মেয়ে। খুব ভালো মেয়ে। আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে হাসছেন। ভাবছেন এই মেয়েটা এমন ছেলেমানুষি করছে কেন? আমি তো আসলে ছেলে মানুষই। ২৩ বছর তো এমন কোনো বয়স না তাই না? তবে আমি কিন্তু আসলেই ভালো মেয়ে।

দূর ছাই লেখার এই ধরনটা আমার ভালো লাগছে না। আমি বরং ধারাবাহিকভাবে শুরু করি। পড়তে পড়তে আমার সম্পর্কে আপনার ধীরে ধীরে একটা ধারণা তৈরি হবে। তখন আর আমাকে বলতে হবে না যে আমি ভালো মেয়ে। আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।

খুব অল্প বয়সে রোড অ্যাকসিডেন্টে আমার মা মারা যান। বান্দরবান থেকে একটা জিপে করে আমরা আসছিলাম। আমার বাবা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। বাবার পাশে মা বসেছিলেন। মার কোলে আমি। হঠাৎ গাড়ির সামনে একটা ছাগল পড়ল। বাবা সেই ছাগল বাঁচাতে গিয়ে গাড়ি নিয়ে খাদে পড়ে গেলেন। মা তৎক্ষণাৎ মারা গেলেন। আমার এবং বাবার কিছু হল না। বান্দরবানের রাস্তাগুলি খুব নির্জন থাকে। অ্যাকসিডেন্টের অনেক পরে লোকজন এসে আমাদের উদ্ধার করল। আমার তখন বয়স মাত্র দেড় বছর। আমার কিচ্ছু মনে নেই।

আমার বাবা পরে আবার বিয়ে করেন। সেই বিয়ে সুখের হয় নি। ছোট মার মেজাজ খুব খারাপ ছিল। তিনি অল্পতেই রেগে যেতেন। তাঁর আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল। বাবার সঙ্গে রাগারাগি হলেই বলতেন, সুইসাইড করব। শেষ পর্যন্ত মা সুইসাইড করেন। এই নিয়ে খুব ঝামেলা হয়। মা পক্ষের লোকজন মামলা করেন। তারা বলার চেষ্টা করেন মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। যাই হোক মামলায় প্রমাণিত হয়, মা মানসিক রোগী ছিলেন। ছোট মা দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। গায়ের রঙ অবিশ্যি শ্যামলা ছিল। কিন্তু তার চেহারা এতই মিষ্টি ছিল—শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করত।

আপনি বুঝতেই পারছেন আমার শৈশবটা সুখের ছিল না। একটা বিরাট বাড়িতে আমি প্রায় একা একাই মানুষ হই। আমাদের বাড়িটা ছিল টু ইউনিট। একতলায় রান্নাঘর, খাবার ঘর, বসার ঘর, স্টাডি আর দোতলায় শুধুই শোবার ঘর আর ফ্যামিলি লাউঞ্জ। কাজের লোকদের দোতলায় ওঠা নিষেধ ছিল। তারা সবাই বাবাকে ভয় পেত বলে দোতলায় উঠত না। আমি স্কুল থেকে ফিরে একা একাই দোতলায় খেলতাম। আমার মতো বাচ্চারা মনে মনে একজন খেলার সাথী তৈরি করে নেয়, তার সঙ্গেই খেলে। আমিও তাই করলাম। একজন খেলার সাথী বানিয়ে নিলাম। সেই খেলার সাথী হল আমার মা। আমার ছোট মা। আমার আসল মাকে তো আমি দেখি নি, কাজেই তার সম্পর্কে আমার কোনো মমতা বা ভালবাসা কিছুই ছিল না। ছোট মা আমাকে খুবই আদর করতেন। সেই আদরের একটা ছোট্ট নমুনা দিলেই আপনি বুঝবেন। যেমন মনে করুন তিনি আমাকে ডাকছেন—চিত্রা খেতে এস। চিত্রা বলার আগে তিনি একগাদা আদরের নাম অতি দ্রুত বলে যাবেন। তারপর বলবেন খেতে এস। তাঁর আদরের নামগুলি হল—

ভিটভিটি খিটখিটি,
মিটমিটি ফিটফিটি
ভুভুন খুনখুন
সুনসুন ঝুনঝুন!
 এ্যাং বেঙ ঝেং, টেঙ টেঙ।

আদরের নাম ছাড়াও তাঁর নিজের কিছু কিছু বিচিত্র ছড়াও ছিল। ননসেন্স রাইমের মতো কোনো অর্থ নেই, কোনো মানে নেই। সেই সব ছড়া তিনি গানের সুরে বলতেন। সব সুর এক রকম। যেমন ধরুন—

ফানিম্যান হাসে তার
রং ঢং হাসি।
জানা কথা যে জানে না
না শুনে সে বাঁশি।

এইসব বিচিত্র ছড়া বলে তিনি খিলখিল করে হাসতেন। আমার খুবই মজা লাগত। মনে হত আহ কী আনন্দময় আমার জীবন।

.

অতি আদরের একজন মানুষ আমার খেলার সাথী হবে এটাই স্বাভাবিক। আমি নিজের মনে পুতুল খেলতাম, রান্নাবাটি খেলতাম এবং ক্রমাগত ছোট মায়ের সাথে কথা বলতাম, প্রশ্ন করতাম, ছোট মা উত্তর দিতেন। উত্তর তো আসলে দিতেন না। আমি উত্তরটা কল্পনা করে নিতাম। তখন আমার বয়স সাত। সাত বছরের বাচ্চারা এই ধরনের খেলা খেলে। এটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু একদিন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটল। সেদিন স্কুল ছুটি ছিল। বাবা গেছেন ঢাকার বাইরে। আমি সারা দিন একা একা খেলেছি।

সন্ধ্যাবেলা আমার শরীর খারাপ করল। গা কেঁপে জ্বর এল। আমি চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে আছি। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। খাট থেকে একটু দূরে আমার পড়ার টেবিল। টেবিলে বাবার এনে দেয়া মোটা একটা ইংরেজি ছবির বই। শুয়ে শুয়ে ছবি দেখতে ইচ্ছা করল। বিছানা থেকে নেমে যে ছবির বইটা আনব সেই ইচ্ছা করছে না। আমি অভ্যাসমতো বললাম, ছোট মা বইটা এনে দাও। কল্পনার খেলার সাথী মাকে এই জাতীয় অনুরোধ আমি প্রায়ই করি। সেই অনুরোধ আমি নিজেই পালন করি। তারপর বলি, থ্যাংক ইউ ছোট মা। ছোট মার হয়ে আমি প্রায়ই বলি, ইউ আর ওয়েলকাম।

সেদিন সন্ধ্যায় অন্য ব্যাপার হল। অবাক হয়ে দেখলাম ছোট মা টেবিলের দিকে যাচ্ছেন। বইটা হাতে নিয়ে বিছানার দিকে ফিরছেন। বইটা আমার দিকে ধরে আছেন। আমি এতই অবাক হয়েছি যে হাত বাড়িয়ে বইটা নিতে পর্যন্ত ভুলে গেছি। ছোট মা আমার বিছানার পাশে বইটা রেখে নিঃশব্দে বের হয়ে গেলেন। খোলা দরজাটা হাত দিয়ে ভিড়িয়ে দিয়ে গেলেন। ভয়ে আমার চিৎকার করে ওঠা উচিত ছিল। আমি চিৎকার করলাম না। ভয়ের চেয়ে বিস্ময়বোধই আমার প্রবল ছিল। চোখে ভুল দেখেছি এই জাতীয় চিন্তা আমার একবারও মনে আসে নি। বরং মনে হয়েছে আমি যা দেখছি ঠিকই দেখছি। ছোট মা আমাকে দেখতে এসেছেন। আমার শরীর ভালো না তো এই জন্যে আমাকে দেখতে এসেছেন।

নিঃসঙ্গ শিশুরা তার চারপাশের জগৎ সম্পর্কে অনেক ব্যাখ্যা নিজেরা দাঁড় করায়। আমিও একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেললাম। এই ব্যাখ্যায় অসুস্থ শিশুকে দেখতে মৃত মানুষ ফিরে আসতে পারেন।

যদিও আমি নিজেই একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করালাম তারপরেও আমার মনে হল এই ব্যাখ্যায় কিছু ফাঁকি আছে। ফাঁকির ব্যাপারটা আমি নিজে জানতে চাচ্ছিলাম না। কাজেই মাকে দেখতে পাওয়ার কথাটা কাউকে বললাম না। আমার মনে হল পুরো ব্যাপারটায় এক ধরনের গোপনীয়তা আছে। কেউ জেনে ফেললে মা রাগ করবেন, তিনি আর আসবেন না।

সেই রাতে আমার জ্বর খুব বাড়ল। মাথায় পানি দেয়া হল। তাতে কাজ হল না। বাথটাবে বরফ মেশানো ঠাণ্ডা পানিতে আমাকে ডুবিয়ে রাখা হল। ডাক্তার ডাকা হল। চিটাগাং-এ আমার বাবাকে জরুরি খবর পাঠানো হল। আমার খুব ভালো লাগতে লাগল এই ভেবে যে, যেহেতু আমার শরীর খুব খারাপ করেছে আমার ছোট মা নিশ্চয়ই আবারো আমাকে দেখতে আসবেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ছোট মা অবিশ্যি এলেন না।

আমার এই ঘটনা শুনে আপনি কী ভাবছেন তা আমি জানি। আপনি ভাবছেন হেলুসিনেশন। একটি নিঃসঙ্গ শিশু তার নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্যে নিজের মধ্যে একটি জগৎ সৃষ্টি করেছে। হেলুসিনেশনের জন্ম সেই জগতে। আপনারা সাইকিয়াট্রিস্টরা খুব সহজেই সবকিছু ব্যাখ্যা করে ফেলেন। আপনাদের কাছে রহস্য বলে কিছু নেই। আইনস্টাইন যখন বলেন সৃষ্টি রহস্যময়, সব রহস্যের জট এই মুহূর্তে খোলা সম্ভব না তখন আপনারা বলেন, ব্যাখ্যাতীত বলে কিছু নেই। সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায়। আমার এক জীবনে আমাকে অনেক সাইকোএনালিসিসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। আমি এই সব ব্যাপার খুব ভালো জানি। আপনাদের মতো মনোবিদ্যা বিশারদদের দেখলে আমার সত্যিকার অর্থেই হাসি পায়। আপনারা একেকজন কী গম্ভীর ভঙ্গিতে কথা বলেন, যেন পৃথিবীর সবকিছু জেনে বসে আছেন। অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর হয়। আপনাদের বিদ্যা শুধু যে অল্প তাই না, শূন্য বিদ্যা।

আপনি কি রাগ করছেন?

দয়া করে রাগ করবেন না। আমি জানি আপনি অন্যদের মতো না। আপনি আপনার সীমারেখা জানেন। প্রকৃতি মানুষের চারদিকে একটা গণ্ডি এঁকে দিয়ে বলে দেয়—এর বাইরে তুমি যেতে পারবে না। তোমার অতি উন্নত জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়েও তোমাকে থাকতে হবে এই গণ্ডির ভেতর। এই সত্য আপনার জানা আছে। আপনি গণ্ডির ভেতর থেকেও গণ্ডি অতিক্রম করতে চেষ্টা করেন। এইখানেই আপনার বাহাদুরি। বড় বড় কথা বলছি? হয়তো বলছি। তবে এগুলি আমার নিজের কথা না। অন্য একজনের কথা। সেই অন্য একজন প্রচুর জ্ঞানের কথা বলেন এবং খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেন। তিনি যে জ্ঞানের কথা বলছেন তা তখন মনে হয় না। একটু চিন্তা করলেই মনে হয় ওরে বাবারে—এ তো অসম্ভব জ্ঞানের কথা। এই প্রসঙ্গে আমি পরে বলব। তবে আপনি হচ্ছেন মিসির আলি, কে জানে ইতিমধ্যে হয়তো অনেক কিছু বুঝে ফেলেছেন।

আপনি কীভাবে চিন্তাভাবনা করে একটা সমস্যা সমাধানের দিকে এগোন তা আমার জানতে ইচ্ছা করে। চিন্তাশক্তি আমার নিজের খুবই কম। সহজ রহস্যই ধরতে পারি না। আমাদের স্কুলে একবার একজন ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাতে এসেছিলেন। বেচারি খুবই আনাড়ি ধরনের। যে ম্যাজিকই দেখান সবাই ধরে ফেলে। একমাত্র আমিই ধরতে পারি না। তিনি যা দেখান তাতেই আমি মুগ্ধ হই। আপনার সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিও হয়তো ম্যাজিকের মতো। সেই ম্যাজিক দেখে মুগ্ধ হতে ইচ্ছা করে। আচ্ছা এই এতগুলি পাতা যে পড়লেন এর মধ্যে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ইনফরমেশন দিয়ে দিয়েছি। বলুন তো ইনফরমেশনটা কী? যদি বলতে পারেন তা হলে বুঝব আপনার সত্যি বুদ্ধি আছে। বলতে না পারলে তেত্রিশ পৃষ্ঠায় দেখুন।

মিসির আলি পড়া বন্ধ করলেন। তেত্রিশ পৃষ্ঠা না দেখে মেয়েটির সম্পর্কে বিশেষ কী বলা হয়েছে বের করার চেষ্টা করলেন। যা বলা হয়েছে তার বাইরে কি কিছু আছে? হ্যাঁ আছে, মেয়েটা তার আসল নাম বলেছে। তার আসল নাম ফারজানা। ফানিম্যান ছড়াটির প্রতি লাইনের প্রথম অক্ষর নিলে ফারজানা নামটা পাওয়া যায়। এমন জটিল কোনো ধাঁধা না। এ ছাড়া আর কিছু কি আছে? আরেকবার পড়তে হবে। তবে যা পড়েছেন তাতে মেয়েটিকে খুঁজে বের করে ফেলার মতো তথ্য আছে। ফারজানা মেয়েটি বোধ হয় তা জানে না। যেমন মেয়েটির বাবার নামে একটি হত্যা মামলা হয়েছিল। সেই মামলা ডিসমিস হয়ে যায়। আদালতের নথিপত্র ঘাঁটলেই বের হয়ে পড়বে। ডেড বডির পোস্টমর্টেম হয়েছিল। হাসপাতাল থেকেও সেই সম্পর্কিত কাগজপত্র পাওয়া যাবে। একটু সময়সাপেক্ষ, তবে সহজ।

সেই সময়কার পুরোনো কাগজ ঘাঁটলেও অনেক খবর পাওয়া যাওয়ার কথা। ‘পাষণ্ড স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন’ জাতীয় খবর পাঠক-পাঠিকারা খুব মজা করে পাঠ করেন। পত্রিকাওয়ালারা গুরুত্বের সঙ্গে সেইসব খবর ছাপেন। প্রথম পাতাতেই ছবিসহ খবর আসার কথা। তারপরের কয়েকদিন খবরের ফলো আপ।

অবিশ্যি বাংলাদেশে পুরোনো কাগজ ঘাঁটা খুব সহজ ব্যাপার নয়। যে কবার তিনি পুরোনো কাগজ ঘাঁটতে গেছেন সে কবারই তাঁর মাথা খারাপ হবার যোগাড় হয়েছে। বিদেশের মতো ব্যবস্থা থাকলে ভালো হত। সবকিছু কম্পিউটারে ঢুকানো, বোতাম টিপে বের করে নেয়া।

মিসির আলি তার খাতা বের করলেন। কেইস নাম্বার দিয়ে ফারজানার নামে একটা ফাইল খোলা যেতে পারে। খাতার পাতায় ফারজানা নাম লিখতে গিয়ে মিসির আলি ইতস্তত করতে লাগলেন। ফাইল খোলার দরকার আছে কি? এখনো বোঝা যাচ্ছে না, ফারজানার লেখা সব কটা পাতা না পড়লে বোঝা যাবেও না। মিসির আলি পেনসিলে গোটা গোটা করে লিখলেন,

নাম : ফারজানা।

বয়স : ২৩

রোগ : স্কিজোফ্রেনিয়া???

স্কিজোফ্রেনিয়া লিখে তিনবার প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিলেন। ফারজানার লেখা যে কটি পাতা এখন পর্যন্ত পড়েছেন তা তিনি আরো তিনবার পড়বেন। তারপর ঠিক করবেন প্রশ্নবোধক চিহ্নগুলি রাখবেন, কি রাখবেন না। সে যা লিখেছে তা সত্যি কি না তাও দেখার ব্যাপার আছে। সত্যি কথা না লিখলে তথ্যে ভুল থাকবে। প্রথম পাঠে তা ধরা পড়বে না। যত বেশি বার পড়া হবে ততই ধরা পড়তে থাকবে। তার নিজের নামটা সে যেমন কায়দা করে ঢুকিয়ে দিয়েছে তার থেকে মনে হয় আরো অনেক নাম লেখার ভেতর লুকিয়ে আছে। সেগুলিও খুঁজে বের করতে হবে। তার মায়ের নাম কি চাঁপা? প্রিয় রঙ বলছে চাঁপা। আবার প্রিয় দুটি জিনিস চাঁদ এবং পানির প্রথম অক্ষর নিলেও চাঁপা হচ্ছে। এটা কাকতালীয়ও হতে পারে। যদি কাকতালীয় না হয় তা হলে মেয়েটি তার সঙ্গে রহস্য করছে কেন? এই রহস্য করার জন্য তাকে প্রচুর সময় দিতে হয়েছে। চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে। এটা সে কেন করছে? ব্যাপারটা ছেলেমানুষি তো বটেই। ফাইভ সিক্সে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা এইসব করতে পারে। ২৩ বছরের একটা মেয়ে তুচ্ছ ধাঁধা তৈরি করার জন্য সময় নষ্ট করবে কেন? ব্যাপার কী এমন যে মেয়েটার কিছু করার নেই। দিনের পর দিন যারা বিছানায় শুয়ে থাকে তারা ক্রসওয়ার্ড পাজল, বা ব্রেইন টিজলার জাতীয় খেলায় আনন্দ পেতে পারে। এমনকি হতে পারে যে মেয়েটিকে দিনের পর দিন শুয়ে থাকতে হচ্ছে। চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে হাতে পাতার পর পাতা লেখা কষ্টকর। সে লিখেছে ১০০ পৃষ্ঠা, লিখতে তার সময় লেগেছে ২ বছর। একটা পৃষ্ঠা লিখতে তার গড়পড়তা সময় লেগেছে সাতদিনের কিছু বেশি। লেখাগুলি লেখা হয়েছে কালির কলমে। চিৎ হয়ে শুয়ে কালির কলমে লেখা যায় না। তাকে লিখতে হয়েছে উপুড় হয়ে। উপুড় হয়ে যে লিখতে পারে সে বিছানায় পড়ে থাকার মতো অসুস্থ না। কাজেই সে শয্যাশায়ী একজন রোগী এই হাইপোথিসিস বাতিল।

মিসির তার খাতায় গুটিগুটি করে লিখলেন ফারজানা মেয়েটি শারীরিকভাবে সুস্থ।

তিনি আরেকটি কাজও করলেন—ফারজানার এক শ পৃষ্ঠার কোন অংশগুলি দিনে লেখা হয়েছে—কোন অংশগুলি রাতে লেখা হয়েছে—তা হলুদ মার্কার দিয়ে আলাদা করলেন। কাজটা জটিল মনে হলেও আসলে সহজ। রাতে আলো কমে যায় বলে রাতের লেখায় অক্ষরগুলি সামান্য বড় হয়। এবং লেখা স্পষ্ট করার জন্যে কলমে চাপ দিয়ে লেখা হয়। দিনের লেখা এবং রাতের লেখা আলাদা করার তেমন কোনো কারণ নেই। তারপরেও করে রাখা—হঠাৎ যদি এর ভেতর থেকে কিছু বের হয়ে আসে। খড়ের গাদায় হারিয়ে যাওয়া সুচও পাওয়া যায় যদি ধৈর্য ধরে প্রতিটি খড়—একটি একটি করে আলাদা করা হয়। মিসির আলি তাঁর অনুসন্ধানে ইনটিউশন যত না ব্যবহার করেন—পরিশ্রম তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যবহার করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *