০২. চিত্রা দু ঘণ্টার ভেতর ফিরে আসবে

চিত্রা দু ঘণ্টার ভেতর ফিরে আসবে এ ব্যাপারে মিসির আলি নিশ্চিত ছিলেন। নিশ্চিত ব্যাপারগুলি মানুষের জীবনে প্রায় কখনো ঘটে না। চিত্রা দু ঘণ্টা কেন দশ দিনের মাথাতেও ফিরে এল না। তার হ্যান্ডব্যাগ এবং স্যুটকেসে ধুলা জমতে লাগল। সে একটা টেলিফোন নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল। টেলিফোন নাম্বার লেখা চিরকুট তিনি ড্রয়ারে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। অযত্নে অবহেলায় রাখা কাগজপত্র সব সময় পাওয়া যায়। যত্নে রাখা কাগজ কখনো পাওয়া যায় না। মারফির এই সূত্র ভুল প্রমাণিত হল। মিসির আলি ড্রয়ার খুলেই চিরকুটটি পেলেন এবং সেই চিরকুট দেখে তিনি ছোটখাটো একটা চমক খেলেন। চিরকুটে টেলিফোন নাম্বার লেখা নেই। শুধু সুন্দর অক্ষরে লেখা Help me!

মিসির আলির একটু মন খারাপ হল। মেয়েটির সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনলেই হত। তিনি এতটা অধৈর্য হলেন কেন? বাড়িঘর ছেড়ে নিতান্ত অকারণে এই বয়সের একটা মেয়ে চলে আসে না। এই বয়সের মেয়েদের মাথায় নানান উদ্ভট ব্যাপার খেলা করে তারপরেও বাড়িঘর ছাড়ার ব্যাপারে তারা খুব সাবধানী হয়। আশ্রয় মেয়েদের কাছে অনেক বড় ব্যাপার। প্রকৃতি মেয়েদের সেই ভাবেই তৈরি করেছে। ভবিষ্যতে এরা সন্তানের জন্ম দেবে। সেই জন্যে তাদের নিরাপদ আশ্রয় দরকার। কাজেই ‘হে মাতৃজাতি তোমরা আশ্রয় কখনো ছাড়বে না’ এই হল ডি এন এ’র অনুশাসন। ডি এন এ অনুশাসনের বাইরে যাবার ক্ষমতা তাদের নেই।

মেয়েটি তার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো পথ রাখে নি। পথ রাখলে তিনি বলতেন— হ্যাঁ আমি এখন তোমার কথা শুনব। সত্যি-মিথ্যা সব কথাই শুনব। আগের বারে তোমার কথা শুনতে চাই নি। তোমার হাত থেকে রক্ষা পাবার ব্যাপারটাই আমার মাথায় প্রবলভাবে ছিল। তার জন্যে আমি দুঃখিত।

মেয়েটি তার হ্যান্ডব্যাগ বা স্যুটকেসে কোনো ঠিকানা কি রেখে গেছে?

স্যুটকেস খুললে কোনো গল্পের বই কি পাওয়া যাবে যেখানে তার নাম এবং বাড়ির ঠিকানা লেখা? বই পেলেও লাভ হবে না। এখনকার মেয়েরা বই-এ নিজের নাম লিখলেও বাড়ির ঠিকানা লেখে না। বাড়ির ঠিকানা লেখাটাকে গ্রাম্যতা বলে ধরা হয়। ডায়েরি পেলে সবচে ভালো হত। ডায়েরিতে নাম ঠিকানা থাকে। তবে ডায়েরি পাবার সম্ভাবনা অতি সামান্য। আজকালকার মেয়েদের ডায়েরি লেখার মতো সময় নেই। নিজেদের কথা তারা শুধু গোপন করতে চায়। লিখতে চায় না।

মিসির আলি মেয়েটির স্যুটকেস খুললেন। কয়েকটা শাড়ি, পলিথিনে মোড়া দু জোড়া স্যান্ডেল, হেয়ার ড্রায়ার, ট্রাভেলার্স আয়রন, কিছু কসমেটিকস, এক বোতল পানি, সুন্দর একটা চায়ের কাপ। একটা ফুলতোলা বেডশিট।

বই এবং ডায়েরি পাওয়া গেল না। তবে বেডশিটের নিচে একগাদা কাগজ পাওয়া গেল। দামি ওনিয়ন স্কিন পেপার। কাগজে চিকন নিবের কালির কলমে গুটিগুটি করে ঠাসবুনন লেখা। যত্ন করে কেউ অনেক দিন ধরে লিখেছে। মনে হচ্ছে দীর্ঘ কোনো চিঠি। কাকে লেখা? মিসির আলি ভুরু কুঁচকে সম্বোধন পড়লেন—

শ্রদ্ধাস্পদেষু

জনাব মিসির আলি সাহেব।

চিঠিতে তারিখ নেই। যে লিখছে তার নামও নেই। এর হাতের লেখা এবং চিত্রার হাতের লেখা কি এক? ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্ট ছাড়া বলা যাবে না। চিত্রা ইংরেজিতে লিখেছে হেল্প মি, আর এই দীর্ঘ চিঠি লেখা বাংলায়। ইংরেজি এবং বাংলা হাতের লেখায় মিল-অমিল চট করে চোখে পড়ে না। তার পরেও মিসির আলির মনে হল দীর্ঘ এই চিঠির লেখিকা এবং চিত্রা এক মেয়ে নয়।

মেয়েটি বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে তার ব্যাগ গোছায় নি। মেয়েরা ব্যাগ গুছানোর সময় অবশ্যই প্রথম নেবে আন্ডার গার্মেন্টস, পেটিকোট, ব্লাউজ, ব্রা, প্যান্টি। এইসব কাপড়ের ব্যাপারে তারা অতিরিক্ত সেনসেটিভ। ব্যাগে আগে এইসব গুছানো হবে তারপর অন্য কিছু। কিন্তু মেয়েটির স্যুটকেস বা হ্যান্ডব্যাগে এইসব কিছু নেই। টাওয়েলও নেই। মেয়েটি ঘর ছাড়ার জন্যে ব্যাগ গোছায় নি। তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্য কি তাকে দীর্ঘ চিঠিটা নাটকীয় ভঙ্গিতে দেয়া?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *