০২. আমার ডাক নাম টুলু

‘আমার ডাক নাম টুনু। আমার একটা ছোট্ট বোন ছিল, ওর নাম ছিল নুটু। টুনু উল্টো করলে হয় নুটু। বাবা এই নাম রাখলেন। কারণ ওর স্বভাব ছিল আমার একেবারে উল্টো। আমি ছোটবেলা থেকেই খুব শান্ত প্রকৃতির। কারো সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলতাম না। কেউ ধমক দিয়ে কিছু বললে সঙ্গে-সঙ্গে কেঁদে ফেলতাম। আর নুটু ছোটবেলা থেকেই হৈচৈ স্বভাবের মেয়ে। আমাদের বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া একটা জামগাছ ছিল। নুটু ঐ জামগাছ বেয়ে ছাদে উঠে যেতে পারত। আমাদের বাড়িটা ছিল পুরনো ধরনের, ছাদে ওঠার কোনো সিঁড়ি ছিল না। ছাদে কোনো রেলিং ছিল না। বর্ষাকালের ভেজা ছাদে সে দৌড়াত, লাফালাফি করত। কারো কোনো কথা শুনত না। আমার মা এই জন্যে তাকে খুব মারধোর করতেন। তাতে কোনো লাভ হত না। শেষ পর্যন্ত এক বর্ষাকালে আমার মা কাঠমিস্ত্রি লাগিয়ে জামগাছটা কেটে ফেললেন।’

এই পর্যন্ত বলতেই মিসির আলি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি তো নিতান্তই পারিবারিক গল্প শুরু করেছেন। আপনার যে-সমস্যা, তা তো আমার মনে হচ্ছে বর্তমান সময়ের সমস্যা। শৈশব থেকে শুরু করেছেন কেন বুঝতে পারছি না। এর কি দরকার আছে?’

‘জ্বি স্যার, আছে।’

‘বেশ, বলুন।’

আমাদের বাসা ছিল নেত্রকোণায়। বাবা ছিলেন নেত্রকোণা কোর্টের উকিল। তাঁর খুব পসার ছিল। সকালবেলা এবং সন্ধ্যাবেলায় আমাদের বাংলাঘরে মক্কেল বসে থাকত। কেউ-কেউ রাতে থাকত। তাদের জন্যে আলাদা থালাবাটি ছিল, গামছা ছিল, খড়ম ছিল। মামলা করতে মহিলারাও আসতেন। তাঁদের জায়গা হত ভেতরের বাড়িতে। ভেতরের বাড়িতে তাঁদের জন্যেও আলাদা ঘর ছিল।

‘আমরা ভাইবোন বাবার দেখা পেতাম না বললেই হয়। আমাদের সঙ্গে কথা বলার মতো অবসর তাঁর ছিল না। তবে রাতে ঘুমুবার সময় আমাদের দুই ভাইবোনকে দু’পাশে নিয়ে ঘুমুতেন। অর্ডার দিয়ে বিশাল একটা খাট বানিয়েছিলেন। রেলিংঘেরা খাট। আমরা যাতে গড়িয়ে পড়ে যেতে না পারি সেই ব্যবস্থা। বাবা আমাদের দু’ জনের পা তাঁর গায়ের উপর তুলে দিয়ে ঘুমুতেন। তাঁর ঘুমও ছিল খুব সজাগ। আমরা কেউ পা নামিয়ে ফেললে তিনি সেই পা আবার তুলে দিতেন।…

‘বাবা খুব খরচে স্বভাবের মানুষ ছিলেন। আমার মনে আছে, আমাদের দু’ ভাইবোনের একসঙ্গে আকিকা হয়। আমার বয়স তখন নয়, নুটুর সাত।

‘আকিকা উপলক্ষে নেত্রকোণা শহরের প্রায় সবাইকে তিনি নিমন্ত্রণ করেন। দুপুর বারটা থেকে খাওয়া শুরু হল, চলল রাত বারটা পর্যন্ত। রান্নার জন্য ডেকচি আর বাবুর্চি আনা হয়েছিল ময়মনসিং থেকে। শম্ভুগঞ্জ থেকে এসেছিল হালুইকার। আমার মনে আছে, সারাদিন বাবা অত্যন্ত হৃষ্টচিত্তে ছোটাছুটি করলেন। নিমন্ত্রিত অতিথিদের বললেন, মাঘ মাসে গ্রামের বাড়িতেও একটা অনুষ্ঠান করবেন। গ্রামের লোকদের বঞ্চিত করার কোনো মানে হয় না। ওরা মনে কষ্ট পাবে। টাকাপয়সা তো খরচের জন্যেই।…

‘আকিকা উপলক্ষে আমাদের নাম বদলে গেল। আমার নাম হল মনিরুল ইসলাম চৌধুরী। আর নুটুর নাম হল ফুলেশ্বরী। নাম নিয়ে খুব আপত্তি উঠল। মৌলানা সাহেব বললেন–এটা হিন্দু নাম। হিন্দু নাম রাখা যাবে না।

‘বাবা বললেন, ‘‘নামের আবার হিন্দু-মুসলমান কি? এইটা আমার খুব পছন্দের নাম। এই নামই রাখতে হবে। আপনি আপত্তি করলে অন্য কাউকে ডাকি।’’

‘মৌলানা সাহেব আপত্তি করলেন না। আমরা অসংখ্য বিচিত্র ধরনের উপহারের সঙ্গে নতুন নাম পেলাম। উপহার দিয়ে বাংলাঘরের একটা বিশাল চৌকি ভর্তি হয়ে গেল। পেতলের কলসি, ছাতা, কাঁসার বাসন, গায়ের চাদর–এইসব ছিল উপহার বাবা আকিকার পরপর ঘোষণা করলেন, ‘‘এখন থেকে এদের ডাকনামে কেউ ডাকবে না। যদি কেউ ডাকে কঠিন শাস্তি হবে।’’

‘আমি ক্লাস নাইনে পড়বার সময় বাবা মারা গেলেন। স্কুল থেকে এসে শুনি বাবা অসুস্থ। সকাল-সকাল কোর্ট থেকে চলে এসেছেন। শুয়ে আছেন তাঁর বিশাল খাটে। মশারি ফেলা। বাবা উহ্ আহ্ করছেন। বাবার মাথার পাশে ঘোমটা দিয়ে মা বসে আছেন। বাবার বন্ধু ইদরিস চাচা বসে আছেন চেয়ারে। তাঁর হাতে পানের বাটা। তিনি একটু পরপর পান মুখে দিচ্ছেন। ইদরিস চাচা বললেন, ‘‘পেটের নিচে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাক। এটা হচ্ছে অম্বলের ব্যথা। বদহজম থেকে হয়েছে। নিবারণকে খবর দিয়েছি, এসেই ব্যথা নামিয়ে ফেলবে।’’…

‘নিবারণ হচ্ছেন তখনকার নেত্রকোণার খুব নামী কবিরাজ। তাঁর পসার ছিল সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার সাহেবের চেয়েও অনেক বেশি। নিবারণ কাকা এসে এক চামচ ‘আনন্দভৈরব রস’ খাইয়ে দিলেন। আনন্দভৈরব রস তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি করতে হয়। বিস্তর আয়োজন করে জিনিসপত্র জোগাড় করা হল। হিন্টুল এক তোলা, গোলমরিচ এক তোলা, সোহাগা এক তোলা, পিপুল চূর্ণ এক তোলা, জীরকচূর্ণ এক তোলা এবং শোধিত মিঠা বিষ এক তোলা।…

‘আনন্দভৈরব রস’ খাওয়াবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাবার পেটব্যথা অনেকখানি কমে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন।…

‘রাত এগারটার দিকে তাঁর ঘুম ভাঙল। তীব্র ব্যথায় তাঁর শরীর কাঁপছে। তিনি কয়েক বার বমিও করলেন। ফুলেশ্বরীকে ডেকে বললেন, ‘ওরে বেটি, মরে যাচ্ছি রে। আমার সময় শেষ।’’…

‘এক জন এমবিবিএস ডাক্তারকে ডেকে আনা হুল। ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘‘এটা তো অ্যাপেণ্ডিসাইটিস। খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। এই মুহূর্তে অপারেশন দরকার।’’…

‘অপারেশন করতে পারেন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। তাও হাসপাতালে সব ব্যবস্থা আছে কি না কে জানে। সরকারি ডাক্তারের খোঁজে লোকজন ছুটে গেল। তারা ফিরে এল মুখ শুকনো করে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার সাহেব এক ঘন্টা আগে ময়মনসিং রওনা হয়ে গেছেন।…

বাবা মারা গেলেন রাত একটা পঁচিশ মিনিটে।’…

মুনির থামল। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। ক্লান্ত গলায় বলল, ‘স্যার, এক গ্লাস পানি দিতে পারেন?’

মিসির আলি পানি এনে দিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, মুনির তৃষ্ণার্তের মতো পানির গ্লাসটি শেষ করবে। তা সে করল না। দুই চুমুক দিয়ে রেখে দিল। মুখ বিকৃত করল, যেন তিক্ত স্বাদের কিছু মুখে চলে গিয়েছে।

‘স্যার, আমি উঠি?’

‘আপনার যা বলার তা কি বলেছেন?’

‘জ্বি-না স্যার, ভূমিকাটা বলেছি। এখন মূল জিনিসটা বলতে পারব, তবে আজ না। আজ আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। অন্য এক দিন এসে বাকিটা বলব।’

‘ঠিক আছে। এখনি উঠবেন?’

‘জ্বি।’

‘বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু।’

‘অসুবিধা হবে না। আমি খুব কাছেই থাকি।’

‘আপনি যাবার আগে একটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনি যে-গল্প বললেন, তার এক জায়গায় আমার একটু খটকা লেগেছে। এই খটকার কারণে আমার ধারণা হচ্ছে গল্পটা বানানো।’

মুনির বিস্মিত হয়ে তাকাল। শীতল গলায় বলল, ‘কোথায় খটকা লেগেছে?’

‘আপনি যখন ক্লাস নাইনের ছাত্র তখন আপনার বাবা মারা যান। তার মানে আপনি নিতান্তই বাচ্চা একটি ছেলে। ঘটনাগুলি আপনি ঘটতে দেখেছেন এই পর্যন্তই। অথচ কবিরাজ নিবারণের ‘আনন্দভৈরব রস’ কিভাবে তৈরি হল তার নিখুঁত বর্ণনা দিলেন। হিন্টুল এক তোলা, গোল মরিচ এক তোলা, সোহাগা এক তোলা ইত্যাদি। এসব তো আপনার জানার কথা নয়। এক জন কবিরাজ তাঁর ওষুধ তৈরিতে কি কি অনুপান ব্যবহার করেন তা বলেন না। আর বললেও ক্লাস নাইনের একটি ছেলে তা মুখস্থ করে রাখে না। কাজেই আমার ধারণা, গল্পের এই অংশটি বানানো। একটা অংশ যদি বানান হয়, অন্য অংশগুলিও কেন হবে না?’

মুনির ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাবার মৃত্যুর পর সবার ধারণা হয়েছিল, কবিরাজ নিবারণ কাকুর অষুধ খেয়ে এটা হয়েছে। সবাই নিবারণ কাকুকে চেপে ধরল। তিনি অসংখ্যবার বললেন কোন কোন অনুপান দিয়ে তাঁর এই অষুধটি তৈরি হয়েছে। সেই জন্যেই নামগুলি মনে গেঁথে আছে। এখন কি আপনার কাছে মনে হচ্ছে আমি সত্যি কথা বলছি?’

‘হ্যাঁ, মনে হচ্ছে।’

‘তা ছাড়া মিথ্যা কথা বললে আমার গলার স্বর কেঁপে যেত। চোখের পাতা দ্রুত পড়তে থাকত। কিছুটা ব্লাশ করতাম। তা কি করেছি?’

মিসির আলি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আপনার কথা শুনেছি অন্ধকারে। কাজেই চোখের পাতা দ্রুত পড়ছে কি না, ব্লাশ করছেন কি না—তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। তবে গলার স্বর কেঁপে যাচ্ছিল বারবার। তা হচ্ছিল আবেগজনিত কারণে।’

মুনির বলল, ‘আপনি স্যার আমাকে তুমি করে বলবেন। আপনি আমার বাবার বয়েসী। আমাকে ‘আপনি’ করে বললে খুব খারাপ লাগবে।’

‘বেশ, এখন থেকে তাই বলব। তুমি একটা ছাতা নিয়ে নাও। ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে।’

‘ছাতা লাগবে না।’

মুনির বৃষ্টির মধ্যেই নেমে গেল। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না। বৃষ্টির মধ্যে সবাই সাধারণত একটু দ্রুত হাঁটে। সে তাও করছে না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটছে। মিসির আলি ছেলেটির প্রতি তীব্র কৌতূহল অনুভব করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *