০১. ভোরবেলায় মানুষের মেজাজ

ভোরবেলায় মানুষের মেজাজ মোটামুটি ভালো থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খারাপ হতে থাকে, বিকালবেলায় মেজাজ সবচে বেশি খারাপ হয়, সন্ধ্যার পর আবার ভালো হতে থাকে। এটাই সাধারণ নিয়ম।

এখন সকাল এগারটা, মেজাজের সাধারণ সূত্র মতে মিসির আলির মেজাজ ভালো থাকার কথা। কিন্তু মিসির আলির মন এই মুহূর্তে যথেষ্টই খারাপ। তিনি বসার ঘরে বেতের চেয়ারে পা তুলে বসে আছেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে আছে। তাঁর মেজাজ খারাপের দুটি কারণের প্রথমটা হল—একটা মাছি। অনেকক্ষণ থেকেই মাছিটা তাঁর গায়ে বসার চেষ্টা করছে। সাধারণ মাছি না—নীল রঙের স্বাস্থ্যবান ডুমো মাছি। আম-কাঁঠালের সময় এই মাছিগুলিকে দেখা যায়। এখন শীতকাল—এই মাছি এল কোত্থেকে? মাছিটা তার গায়েই বারবার বসতে চাচ্ছে কেন? তাঁর সামনে বসে থাকা মেয়েটির গায়ে কেন বসছে না?

মিসির আলির মেজাজ খারাপের দ্বিতীয় কারণ এই মেয়েটি। তাঁর ইচ্ছা করছে মেয়েটিকে একটা ধমক দেন। যদিও ধমক দেবার মতো কোনো কারণ ঘটে নি। মেয়েটি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। দেখা করতে আসার অপরাধে কাউকে ধমক দেয়া যায় না। ধমক দেয়ার বদলে মিসির আলি শব্দ করে কাশলেন। প্রচণ্ড শব্দে কাশলে, কিংবা কুৎসিত শব্দে নাক ঝাড়লে মনের রাগ অনেকখানি কমে। মিসির আলির কমল না বরং আরো যেন বাড়ল। মাছিটাও মনে হচ্ছে এই শব্দে উৎসাহ পেয়েছে। এতক্ষণ গায়ে বসতে চাচ্ছিল এখন উড়ে ঠোটে বসতে চাচ্ছে। কী যন্ত্রণা!

স্যার, আমার নাম সায়রা বানু। সায়রা বানু নামটা কি আপনার মনে থাকবে?

মিসির আলি বললেন, মনে থাকার প্রয়োজন কি আছে?

অবশ্যই আছে। আমি এত আগ্রহ করে আমার নামটা আপনাকে কেন বলছি, যাতে মনে থাকে সেই জন্যেই তো বলছি।

মিসির আলি রোবটের গলায় বললেন, মানুষের নাম আমার মনে থাকে না।

মেয়েটি তাঁর রোবট গলা অগ্রাহ্য করে হাসিমুখে বলল, আমারটা মনে থাকবে। কারণ একজন বিখ্যাত সিনেমা অভিনেত্রীর নাম সায়রা বানু।

মিসির আলি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। এখন তাঁর মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। অর্থহীন কথা শুনতে ভালো লাগছে না। তা ছাড়া শীতও লাগছে। চেয়ারটা টেনে রোদে নিয়ে গেলে হয়। তাতে কিছুক্ষণ আরাম লাগবে তারপর আবার রোদে গা চিড়বিড় করতে থাকবে। শীতকালের এই এক যন্ত্রণা। ছায়া বা রোদ কোনোটাই ভালো লাগে না। মিসির আলি মাছিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাছিটার কারণে নিজেকে এখন কাঁঠাল মনে হচ্ছে।

মেয়েটি খানিকটা মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আপনি দিলীপ কুমার, সায়রা বানু এদের নাম শোনেন নি?

দিলীপ কুমারের নাম শুনেছি।

সায়রা বানু হচ্ছে দিলীপ কুমারের বউ। আমার বন্ধুরা অবিশ্যি আমাকে সায়রা বানু ডাকে না, তারা ডাকে এস বি। সায়রার এস, বানুর বি―এস বি। এস বি-তে আর কী হয় বলুন তো?

বলতে পারছি না।

এস বি হচ্ছে স্পেশাল ব্রাঞ্চ। আমার বন্ধুদের ধারণা আমার চেহারায় একটা স্পাই স্পাই ভাব আছে। এই জন্যেই তারা আমাকে এস বি ডাকে। আচ্ছা আপনারও কি ধারণা আমার চেহারায় স্পাই স্পাই ভাব? ভালো করে একটু আমার দিকে তাকান না। আপনি সারাক্ষণ এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন কেন?

মিসির আলি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন না। মাছিটার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাছিটা এদিক-ওদিক করছে বলেই এদিক-ওদিক তাকাতে হচ্ছে। আচ্ছা পৃথিবীতে মোট কত প্রজাতির মাছি আছে?

এই যে শুনুন। তাকান আমার দিকে।

মিসির আলি মেয়েটির দিকে তাকালেন। অতিরিক্ত ফর্সা একটি মেয়ে। বাঙালি মেয়েদের গায়ের রঙের একটা মাত্রা আছে। কোনো মেয়ে যদি সেই মাত্রা অতিক্রম করে যায় তখন আর ভালো লাগে না। তার মধ্যে বিদেশী বিদেশী ভাব চলে আসে। তাকে তখন আর আপন মনে হয় না। সায়রা বানুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাকে পর পর লাগছে। মেয়েটির মাথা ভরতি চুল। সেই চুলেও লালচে ভাব আছে। অতিরিক্ত ফর্সা মেয়েদের ক্ষেত্রে তাই হয়। তাদের গায়ের রঙের খানিকটা এসে চুলে লেগে যায়। চুল লালচে দেখায়—খানিকটা এসে লাগে চোখে। চোখ তখন আর কালো মনে হয় না। মেয়েটির মুখ লম্বাটে। একটু বোঁচা ধরনের নাক। বোঁচা নাক থাকায় রক্ষা—বোঁচা নাকের কারণেই মেয়েটিকে বাঙালি মনে হচ্ছে। খাড়া নাক হলে মেডিটেরিনিয়ান সমুদ্রের পাশের গ্রিককন্যা বলে মনে হত। বয়স কত হবে? উনিশ থেকে পঁচিশের ভেতর। মানুষের বয়স চট করে ধরতে পারার কোনো পদ্ধতি থাকলে ভালো হত। গাছের রিং গুনে বয়স বলা যায়। মানুষের তেমন কিছু নেই। মানুষের বয়স তার মনে বলেই বোধ হয়। আচ্ছা, একটা মাছি কতদিন বাঁচে?

স্যার কথা বলছেন না কেন? আমাকে কি স্পাই মেয়ে বলে মনে হচ্ছে?

স্পাই মেয়েদের চেহারা আলাদা হয় বলে আমি জানি না।

একটু আলাদা হয়। স্পাই মেয়েদের মুখ দেখে এদের মনের ভাব বোঝা যায় না।

এদের মুখে এক রকম ভাব মনের ভেতর আরেক রকম।

তোমারও কি তাই?

জি। ও আপনাকে বলতে ভুলে গেছি এস বি ছাড়াও আমার আরেকটা নাম আছে। নাম ঠিক না খেতাব। নববর্ষে পাওয়া খেতাব। আমাদের কলেজে পহেলা বৈশাখে খেতাব দেয়া হয়। আমার খেতাবটা হচ্ছে সাদা বাঘিনী। এস বি-তে সাদা বাঘিনীও হয়। সাদা বাঘিনী টাইটেল কেন পেয়েছিলাম শুনতে চান? খুবই মজার গল্প।

মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন। তাঁর কিছুই শুনতে ইচ্ছা করছে না। মাথার যন্ত্রণা এবং শীত ভাব দুইই বাড়ছে। গায়ে পাতলা একটা চাদর দিয়ে শীত ভাবটা কমানো যেত। চাদরটা ধুপিখানায় দিয়েছেন। ধোয়া নিশ্চয়ই হয়ে গেছে, স্লিপের অভাবে আনতে পারছেন না। স্লিপটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না। কড়া এক কাপ চা খেলেও শীতটা কমত। ঘরে চায়ের পাতা আছে, চিনি, দুধও আছে। গতকালই কিনে এনেছেন। কিন্তু গ্যাসের চুলায় কী একটা সমস্যা হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগুন জ্বলেই হুস করে নিভে যায়। মিস্ত্রি ডাকিয়ে চুলা ঠিক করা দরকার। গ্যাস মিস্ত্রিরা কোথায় থাকে কে জানে?

সায়রা বানু মেয়েটি হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছে, তার কথা তিনি মন দিয়ে শুনছেন না। মাথায় দুশ্চিন্তা নিয়ে অন্য কিছুতে মন বসানো বেশ কঠিন। তবে মাছিটা এখন শান্ত হয়েছে। টেবিলের উপর চুপ করে বসে আছে। ডিম পাড়ছে না তো?

‘আমার সাদা বাঘিনী টাইটেল পাওয়ার ঘটনাটা খুব ইন্টারেস্টিং। শুনলে আপনি খুব মজা পাবেন। বলব?’

মিসির আলি কিছুই বললেন না। তিনি খুব ভালো করেই জানেন মেয়েটি তার গল্প বলবেই। তিনি বলতে বললেও বলবে, বলতে না বললেও বলবে।

‘হয়েছে কী শুনুন—সায়েন্স ল্যাবরেটরির সামনে দিয়ে আমি যাচ্ছি। আমার সঙ্গে আমার এক বন্ধু, রাকা। রাকা হচ্ছে বোরকাওয়ালী। বোরকা পরে। সউদি বোরকা। বেশ কয়েক টাইপ বোরকা পাওয়া যায় তা কি আপনি জানেন? সউদি বোরকা, পাকিস্তানি বোরকা। সউদি বোরকা ভয়াবহ, শুধু চোখ দুটো বের হয়ে থাকে। এমনিতে সে অবিশ্যি খুব স্টাইলিস্ট। বোরকার নিচে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে। যাই হোক বোরকাওয়ালী রাকা হঠাৎ বলল, সে একটা পেনসিল কিনবে। আমি তাকে নিয়ে একটা দোকানে ঢুকলাম পেনসিল কিনতে। স্টেশনারির দোকান তবে তার সঙ্গে কনফেকশনারিও আছে। চা বিক্রি হচ্ছে। কেক বিক্রি হচ্ছে। দোকানটায় বেশ ভিড়। ভিড়ের সুযোগ নিয়ে এক লোক করল কী বোরকাওয়ালীর গায়ে হাত দিল। গায়ে মানে কোথায় তা আপনাকে বলতে পারব না। আমার লজ্জা লাগবে। বোরকাওয়ালী এমন ভয় পেল যে প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে যাচ্ছিল। আমি বোরকাওয়ালীকে ধরে ফেললাম। তারপর বদমাশ লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি ওর গায়ে হাত দিলেন কেন? ষণ্ডাগণ্ডা টাইপের লোক। লাল চোখ। গরিলাদের মতো লোম ভরতি হাত। সে এমন ভাব করল যে আমার কথাই শুনতে পায় নি। দোকানদারের দিকে তাকিয়ে হাই তুলতে তুলতে বলল—দেখি একটা লেবু চা। তখন আমি খপ করে তার হাত ধরে ফেললাম। সে ঝটকা দিয়ে তার হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই আমি তার হাত কামড়ে ধরলাম। যাকে বলে কচ্ছপের কামড়। কচ্ছপের কামড় কী তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন। কচ্ছপ একবার কামড়ে ধরলে আর ছাড়ে না, আমিও ছাড়লাম না। আমার মুখ রক্তে ভরে গেল। লোকটা বিকট চিৎকার শুরু করল। ব্যাপারস্যাপার দেখে বোরকাওয়ালী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এর পর থেকে আমার টাইটেল হয়েছে সাদা বাঘিনী।’

গল্প শেষ করে সায়রা বানু খিলখিল করে হাসছে। মিসির আলি মেয়েটির হাসির মাঝখানেই বললেন, তুমি আমার কাছে কেন এসেছ?

‘গল্প করার জন্যে এসেছি। বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে গল্প করতে আমার খুব ভালো লাগে।’

‘আমি বিখ্যাত মানুষ?’

‘অবশ্যই বিখ্যাত। আপনাকে নিয়ে কত বই লেখা হয়েছে। আমি অবিশ্যি একটা মাত্র বই পড়েছি। ওই যে সুধাকান্ত বাবুর গল্প। একটা মেয়ে খুন হল আর আপনি কেমন শার্লক হোমসের মতো বের করে ফেললেন—সুধাকান্ত বাবুই খুনটা করেছেন। বই পড়ে মনে হচ্ছিল আপনার খুব বুদ্ধি কিন্তু আপনাকে দেখে সেরকম মনে হচ্ছে না।’

‘আমাকে দেখে কেমন মনে হচ্ছে?’

‘খুব সাধারণ মনে হচ্ছে। আপনার মধ্যে একটা গৃহশিক্ষক গৃহশিক্ষক ব্যাপার আছে। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি নিয়মিত বেতন পান না এমন একজন অংকের স্যার। আপনি রোজ ভাবেন আজ বেতনের কথাটা বলবেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহস করে বলতে পারেন না। আচ্ছা আপনি এমন গম্ভীর মুখে বসে আছেন কেন? মনে হচ্ছে আপনি আমার কথা শুনে মজা তো পাচ্ছেনই না উল্টো বিরক্ত হচ্ছেন। সত্যি করে বলুন আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?’

‘কিছুটা হচ্ছি।’

‘মাছিটা তো এখন আর বিরক্ত করছে না। কেমন শান্ত হয়ে টেবিলে বসে আছে। তারপরেও আপনি এত বিরক্ত কেন বলুন তো?

‘তুমি অকারণে কথা বলছ এই জন্যে বিরক্ত হচ্ছি। অকারণ কথা আমি নিজেও বলতে পারি না অন্যের অকারণ কথা শুনতেও ভালো লাগে না।’

‘আপনার সঙ্গে কথা বলতে হলে সব সময় একটা কারণ লাগবে? তা হলে তো আপনি খুবই বোরিং একটা মানুষ। এত কারণ আমি পাব কোথায় যে আমি রোজ রোজ আপনার সঙ্গে কথা বলব?’

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তুমি রোজ রোজ আমার সঙ্গে কথা বলবে?’

‘হুঁ।’

‘সে কী, কেন?’

সায়রা বানু খুব সহজ ভঙ্গিতে হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘এক বাড়িতে থাকতে হলে কথা বলতে হবে না?’

‘এক বাড়িতে থাকবে মানে? আমি বুঝতে পারছি না।’

‘আমি আপনার সঙ্গে কয়েকটা দিন থাকব। কদিন এখনো বলতে পারছি না। দু দিনও হতে পারে আবার দু মাসও হতে পারে। আবার দু বছরও হতে পারে। সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আপনার উপর।

মিসির আলি চেয়ার থেকে পা নামিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালেন। হচ্ছেটা কী? এই যুগের টিনএজার মেয়েদের ভাবভঙ্গি, কাণ্ডকারখানা বোঝা মুশকিল। তারা যে কোনো উদ্ভট কিছু হাসিমুখে করে ফেলতে পারে। মেয়েটি হয়তো অতি তুচ্ছ কারণে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। কিংবা তাকে ভড়কে দেবার জন্যে গল্প ফেঁদেছে। পরে কলেজে বন্ধুদের কাছে এই গল্প করবে। বন্ধুরা মজা পেয়ে একে অন্যের গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়বে। —ও মাগো বুড়োটাকে কী বোকা বানিয়েছি! সে বিশ্বাস করে ফেলেছিল যে আমি থাকতে এসেছি।

মিসির আলি নিজের বিস্ময় গোপন করে সহজভাবে বললেন, ‘তুমি এ বাড়িতে থাকবে?’

‘জি।’

‘বিছানা বালিশ নিয়ে এসেছ?’

‘বিছানা বালিশ আনি নি। আজকাল তো আর বিছানা বালিশ নিয়ে কেউ অন্যের বাড়িতে থাকতে যায় না। শুধু একটা স্যুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ এনেছি। আর একটা পানির বোতল।’

‘স্যুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ কোথায়?’

‘বারান্দায় রেখে এসেছি। শুরুতেই আপনি আমার স্যুটকেস দেখে ফেললে ঢুকতে দিতেন না। যাই হোক আমি এখন আমার স্যুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে আসছি। আচ্ছা আপনি এমন ভাব করছেন যেন আকাশ থেকে পড়েছেন। আকাশ থেকে পড়ার মতো কিছু হয় নি। বিপদগ্রস্ত একজন তরুণীকে কয়েকদিনের জন্যে আশ্রয় দেয়া এমন কোনো বড় অন্যায় না। আমি নিশ্চিত এরচে অনেক বড় বড় অন্যায় আপনি করেছেন।’

‘তুমি সত্যি সত্যি আমার এখানে থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছ?’

‘জি।’

মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন। এই মুহূর্তে তাঁর ঠিক কী করা উচিত তা মাথায় আসছে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মেয়েটির কাণ্ডকারখানা দেখাই মনে হয় সবচে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মেয়েটি বুদ্ধিমতী। এই পরিস্থিতিতে তিনি কী করবেন বা করতে পারেন সেই সম্পর্কে চিন্তাভাবনা সে নিশ্চয়ই করেছে। নিজেকে সম্ভাব্য সব রকম পরিস্থিতির জন্যে সে প্রস্তুত করে রেখেছে। মিসির আলির এমন কিছু করতে হবে যার সম্পর্কে মেয়েটির প্রস্তুতি নেই। সে কেন বাড়ি ছেড়ে এসেছে এই মুহূর্তে তা তাকে জিজ্ঞেস করা যাবে না। কারণ এই প্রশ্নটি স্বাভাবিক এবং সঙ্গত প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর মেয়েটি তৈরি করে রেখেছে। তাঁর বিস্মিত হওয়াও ঠিক হবে না। তাঁকে খুব সহজ এবং স্বাভাবিক থাকতে হবে। যেন এমন ঘটনা প্রতি সপ্তাহেই দুটা-একটা করে ঘটছে।

সায়রা বানু স্যুটকেস, হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকল। মিসির আলি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন সে গুনগুন করে কী একটা গানের সুরও যেন ভাজছে। কত সহজ স্বাভাবিক তার আচরণ।

‘কেক খাবেন?’

‘কেক?’

‘হুঁ। আমার নিজের বেক করা, ডিমের পরিমাণ বেশি হয়েছে বলে একটু ডিম ডিম গন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে ডিমের গন্ধ একেবারে সহ্য করতে পারে না। আমার কাছে অবিশ্যি খারাপ লাগে না। দেব আপনাকে এক পিস কেক?’

‘না।’

‘আপনাকে একটু বাজারে যেতে হবে, কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে। আমি অতি দ্রুত চলে এসেছি তো কাজেই অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস আনা হয় নি। টুথপেস্ট এনেছি, টুথব্রাশ আনি নি। আমার অভ্যাস হচ্ছে রাতে শোবার সময় কুটকুট করে কয়েকটা লবঙ্গ খাওয়া। লবঙ্গ খেলে শরীরের রক্ত পরিষ্কার থাকে, কখনো হার্টের অসুখ হয় না। সেই লবঙ্গ আনা হয় নি। আপনাকে লবঙ্গ আনতে হবে। পারবেন? আমি আপনাকে টাকা দিয়ে দেব। আমি সঙ্গে করে অনেক টাকা নিয়ে এসেছি। বলুন তো কত এনেছি?’

‘বলতে পারছি না।

‘অনুমান করুন। আপনি হচ্ছেন বিখ্যাত মিসির আলি। আপনার অনুমান হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুমান। বলুন আমার সঙ্গে কত টাকা আছে।’

‘পাঁচ হাজার টাকা।’

‘হয় নি। আমার সঙ্গে আছে মোট একান্ন হাজার টাকা। পাঁচ শ টাকার একটা বান্ডিল এনেছি আর এনেছি দশ টাকার একটা বান্ডিল। সেখান থেকে কিছু খরচ করেছি। বেবিট্যাক্সি ভাড়া দিয়েছি তিরিশ টাকা। ঠিক এই মুহূর্তে আমার কাছে আছে পঞ্চাশ হাজার নয় শ সত্তর টাকা। আপনাকে টুকটাক বাজারের জন্যে পাঁচ শ টাকা দিচ্ছি, যা লাগে খরচ করবেন বাকিটা ফেরত দেবেন। এই নিন।’

সায়রা বানু তার কাঁধে ঝুলানো কালো ব্যাগ খুলে টাকা বের করল। মিসির আলি টাকাটা নিলেন। মেয়েটি এক ধরনের খেলা শুরু করেছে। মিসির আলির মনে হল মেয়েটিকে সেই খেলা তার মতোই খেলতে দেয়া উচিত। এই মুহূর্তে এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে খেলা বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি মেয়েটিকে আগ্রহ নিয়ে দেখতে শুরু করেছেন-তার তাকানোর ভঙ্গি, হাঁটার ভঙ্গি, বসার ভঙ্গি। আপাতদৃষ্টিতে এইসব খুবই ছোটখাটো ব্যাপার থেকে অনেক কিছু জানা যায়।

সায়রা বানু চেয়ারে বসতে বসতে বলল, আমার খাওয়া নিয়ে আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না। যা খাওয়াবেন আমি তাই খাব। শুধু মাছ ছাড়া। মাছ আমি খেতে পারি না—গন্ধ লাগে। অবিশ্যি চিংড়ি মাছ খাই। চিংড়ি মাছ কেন খাই বলুন তো?

‘বলতে পারছি না।’

‘চিংড়ি মাছ খাই কারণ চিংড়ি মাছ হচ্ছে আসলে এক ধরনের পোকা। পোকা বলেই চিংড়ি মাছে আঁশটে গন্ধ নেই। ও আচ্ছা বলতে ভুলে গেছি। আরেকটা জিনিস খুব পছন্দ করে খাই। ইলিশ মাছের ডিম।’

‘মাছের ডিমেরও তো আঁশটে গন্ধ থাকে।’

‘ইলিশ মাছের ডিমে থাকে না। আপনি কেভিয়ার খেয়েছেন?’

‘না।’

‘কেভিয়ার হচ্ছে পৃথিবীর সবচে দামি খাবার। কালো রঙের মাছের ডিম। স্বাদ কী রকম জানেন?’

‘যেহেতু খাই নি স্বাদ কেমন তা তো জানার কথা না।’

‘স্বাদ কেমন আপনি জানেন। অনেকটা আমাদের শিং মাছের ডিমের মতো। তবে আঁশটে গন্ধ অনেক বেশি। নাক চেপে ধরে আমি একবার খানিকটা খেয়েছিলাম তারপর বমিটমি করে একাকার।’

মিসির আলি পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন। সঙ্গে দেয়াশলাই নেই। দেয়াশলাইয়ের খোঁজে রান্নাঘরে যেতে হবে। চেয়ার ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। মেয়েটাকে কি বলবেন দেয়াশলাই এনে দিতে? মিসির আলিকে কিছু বলতে হল না। তার আগেই সায়রা বানু বলল, ‘আপনার লাইটার লাগবে?’

‘আছে তোমার কাছে?’

‘আছে। আপনি সিগারেট মুখে দিন আমি ধরিয়ে দিচ্ছি।

মেয়েটা যে ভঙ্গিতে লাইটার ধরাল তাতে মনে হল সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে তার অভ্যাস আছে। সে নিজে সিগারেট খায় না তো? না খায় না, সিগারেটের ধোঁয়ায় সে নাক কুঁচকাচ্ছে।

‘এই লাইটারটা আপনি রেখে দিন। লাইটারটা আমি আপনার জন্যে এনেছি।’

‘থ্যাংক য়্যু।’

‘আর এক প্যাকেট সিগারেটও এনেছি। আপনার একটা বইয়ে পড়েছিলাম একজন কে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসত। যেদিনই আসত আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসত।’

মিসির আলি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘একটু আগে বলেছিলে তুমি আমার একটা বইই পড়েছ।’

‘মিথ্যা কথা বলেছিলাম। অনেকগুলি বই পড়েছি। সুধাকান্ত বাবুর উপর লেখা বইটা সবচে ভালো লেগেছে। ওইটা আমি পড়েছি তিনবার। না তিনবার না। আড়াইবার পড়েছি। দুবার পড়েছি পুরোটা। শেষ বার পড়েছি শুধু শেষের কুড়ি পাতা।’

‘ভালো।’

‘মিথ্যা কথা বললে কি আপনি রেগে যান?’

‘না।’

‘আমাকে কেউ মিথ্যা কথা বললে আমি অবিশ্যি খুব রেগে যাই। আর আমার এমনই কপাল যে সবাই শুধু আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলে। তবে আপনি বলবেন না সেটা আমি জানি। আপনার চেহারা দেখেই বোঝা যায় আপনি মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। আপনি কি জানেন যারা সব সময় মিথ্যা কথা বলে তাদের চেহারায় একটা মাইডিয়ার ভাব থাকে।’

‘তাই নাকি?’

‘জি।’

‘যেসব মেয়েকে দেখবেন খুব মায়া মায়া চেহারা, আপনি ধরেই নিতে পারেন তারা প্রচুর মিথ্যা কথা বলে।’

‘এই তথ্য জানতাম না।’

‘আপনি মিসির আলি আর আপনি এই সাধারণ তথ্য জানেন না? অথচ বইয়ে কত আশ্চর্য আশ্চর্য কথা যে আপনার সম্পর্কে লেখা হয়। যেমন কাউকে এক পলক দেখেই আপনি তার সম্পর্কে হড়বড় অনেক কথা বলে দিতে পারেন। আসলেই কি পারেন?’

‘না। পারি না।’

‘আচ্ছা চেষ্টা করে দেখুন না। আমার সম্পর্কে বলুন।’

‘কী বলব?’

‘আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে। এইসব। দেখি আপনার পাওয়ার অব অবজারভেশন।’

‘দেখ সায়রা বানু, আমি পরীক্ষা দেই না।’

‘পরীক্ষা ভাবছেন কেন? ভাবেন একটা খেলা। বলুন আমার সম্পর্কে বলুন।’

মিসির আলি হাতের সিগারেট ফেলে দিলেন। আরেকটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করছে। তিনি নিজের ওপর একটু বিরক্ত হচ্ছেন কারণ তাঁর টেনশান হচ্ছে। টেনশান হলেই একটা সিগারেট শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করে। তাঁর শরীর ভালো না। এখন কিছুদিন টেনশান ফ্রি জীবন যাপন করতে চান। অজানা- অচেনা একটা মেয়ে হুট করে উপস্থিত হয়ে তাতে বাধা দিচ্ছে।

মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘কী হল কিছু বলছেন না কেন?’

মিসির আলি খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘তোমার সম্পর্কে আমার প্রথম অবজারভেশন হচ্ছে তোমার নাম সায়রা বানু নয়।’

‘এরকম মনে হবার কারণ কী?’

‘মনে হবার কারণ হচ্ছে-সায়রা বানু যদি তোমার নাম হত তা হলে সায়রা বানু ডাকলে তুমি সহজ ভাবে রেসপন্স করতে। একটু আগে আমি বললাম, দেখ সায়রা বানু পরীক্ষা আমি দেই না। বাক্যটা আমি একবারে বলি নি। দেখ সায়রা বানু, বলে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করেছি। যখন দেখলাম তুমি হঠাৎ চমকে উঠলে তখনই আমি বাক্যটা শেষ করলাম। তোমার চমকে ওঠার কারণ হচ্ছে সায়রা বানু বলে যে তোমাকে সম্বোধন করা হচ্ছে তা তুমি শুরুতে বুঝতে পার নি। যখন বুঝতে পেরেছ তখনই চমকে উঠেছ। তোমার নাম কী?’

‘আমার নাম চিত্রা।’

‘তোমার সম্পর্কে আমার দ্বিতীয় অবজারভেশন হচ্ছে তোমাকে দীর্ঘদিন একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। সেই ঘরের জানালা পর্যন্ত বন্ধ ছিল। আলোহীন একটা ঘরে দীর্ঘদিন থাকলে গায়ের চামড়া ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তোমার তাই হয়েছে। তুমি আলোর দিকে ঠিকমতো তাকাতেও পারছ না। যতবার তাকাচ্ছ ততবার চোখের মণি ছোট হয়ে আসছে। ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে। আবার জানালা থেকে তুমি চোখ ফিরিয়েও নিতে পারছ না। বারবার বিস্মিত চোখে জানালা দিয়ে তাকাচ্ছ। কারণ অনেকদিন পরে তুমি জানালায় খোলা আকাশ দেখছ।’

‘আরো কিছু বলবেন?

‘দীর্ঘদিন ধরে তুমি ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছ। যে কোনো কারণেই হোক তোমাকে মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে। স্টোরি তৈরি করতে হচ্ছে। মিথ্যা বলাটা তোমার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি কি ঠিক বলেছি?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার হাত বাঁধা ছিল। মণিবন্ধে কালো দাগ পড়ে গেছে।’

‘হুঁ।’

‘তোমার ঘ্রাণশক্তি অতি প্রবল। তুমি কিছুক্ষণ পরপরই নাক কুঁচকাচ্ছ। এবং তাকাচ্ছ ঘরের দক্ষিণ দিকে। দক্ষিণ দিক থেকে নর্দমার দুর্গন্ধ আসছে। সেটা এত প্রবল না যে এমনভাবে নাক কুঁচকাতে হবে। এর থেকে মনে হয়–হয় তোমার ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত প্রবল আর নয়তো তোমাকে অনেক উঁচু কোনো ঘরে আটকে রাখা হয়েছে, ছ তলা-সাত তলায় যেখানে রাস্তার নর্দমার গন্ধ পৌঁছে না।’

চিত্রা চুপ করে রইল। সে খুব একটা বিস্মিত হল বলে মনে হল না। মিসির আলি বললেন, ‘এখন বল, তোমার ব্যাপারটা কী?’

‘আপনি তো কিছু না জেনেই অনেক কিছু বলতে পারেন। আপনি নিজেই বলুন।’

‘না আমি বলতে পারছি না।’

‘অনুমান করুন। দেখি আপনার অনুমানশক্তি আমার ঘ্রাণশক্তির মতো কি না।’

‘আমার ধারণা তুমি অসুস্থ। অসুস্থতাটা এমন যে রোগীকে ঘরে আটকে রাখতে হয়। তুমি কোনোক্রমে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে এসেছ।’

‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে আমি পাগল তাই আমাকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল? না আমি পাগল না। সুস্থ। ছিটেফোঁটা পাগলামি যা অন্যদের মধ্যে থাকে আমার তাও নেই। তবে আমাকে ঘরে আটকে রাখা হচ্ছিল তা ঠিক। ছাব্বিশ দিন হল ঘরে তালাবন্ধ। আমাকে সবাই মিলে ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছে। কারণটাও খুব সাধারণ এবং আপনার মতো বুড়োর কাছে হয়তো বা হাস্যকর। কারণটা বলব?’

মিসির আলি হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। মেয়েটির স্বভাব যা তাতে তিনি যদি বলেন হ্যাঁ বল—তা হলে সে নিশ্চিতভাবেই বলবে—না বলব না। তারচে চুপ করে থাকাই ভালো।

‘ব্যাপারটা প্রেমঘটিত। আমি একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাই। দরিদ্র ফালতু টাইপ ছেলে। কিছুই করে না। তার প্রেমে পড়ার কারণ নেই। তারপরেও আমি পড়ে গেছি এবং এবং

‘এবং কী?’

‘গোপনে বিয়ে করার জন্যে তার সঙ্গে পালিয়েও গিয়েছিলাম। আমাকে ধরে আনা হয়। আমি তো খুব জেদি মেয়ে, কাজেই আমি সবাইকে বলি—আমি আবারো পালিয়ে যাব। তোমাদের কোনো সাধ্য নেই আমাকে ধরে রাখার

‘ছেলেটার নাম কী?

‘ছেলেটার নাম দিয়ে আপনার দরকার কী?’

‘কোনো দরকার নেই। কৌতূহল বলতে পার।’

‘উনার নাম ফরহাদ।’

‘শুধুই ফরহাদ?’

‘ফরহাদ খান।’

‘তারপর?’

‘তারপর আবার কী?

‘তোমার কাছ থেকে এই কথা শোনার পর তারা তোমাকে তালাবন্ধ করে রাখল?’

‘তাই তো রাখবে। যে মেয়ে এ জাতীয় কথা বলে তাকে নিশ্চয়ই কেউ কোলে করে ঘুরে বেড়াবে না। ঘুমপাড়ানি গান গাইয়ে ঘুম পাড়াবে না।’

‘আজ তুমি ছাড়া পেয়েছ, আমার কাছে না এসে ওই ছেলেটির কাছে চলে যাচ্ছ না কেন?’

‘যাব তো বটেই। আপনার কি ধারণা আমি চিরকালের জন্যে আপনার সঙ্গে থাকব?’

‘মিসির আলি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, চিত্রা তুমি আবারো মিথ্যা কথা বলছ।’

‘বুঝলেন কী করে?’

‘ছেলেটার নাম কী বল জিজ্ঞেস করার পর—থতমত খেয়ে গেলে। চট করে বলতে পারলে না। একটা কোনো নাম ভাবার জন্যে সময় নিলে। তারপর বললে উনার নাম ফরহাদ। উনি বললে—যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছ তার প্রসঙ্গে উনি বলবে কেন? বলবে ওর নাম ফরহাদ।

‘তা হলে কি সত্যি কথা শুনতে চান?’

‘আমি এখন সত্যি-মিথ্যা কোনো কথাই শুনতে চাই না। তুমি আমার সাহায্য চাচ্ছ। যদি সত্যি চাও আমি তোমাকে সাহায্য করি, তা হলে তোমাকে সত্যি কথা বলতে হবে। তা তুমি পারবে না। মিথ্যা বলাটা তোমার রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। কিছুক্ষণ সত্যি বলার পর আবার মিথ্যা শুরু করবে।’

‘‘তাতে অসুবিধা কী? যেই মুহূর্তে আমি মিথ্যা বলব আপনি ধরে ফেলবেন। আপনার তো সেই ক্ষমতা আছে।’

মিসির আলি আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন—’চিত্রা শোন আমার পক্ষে তোমাকে এ বাড়িতে রাখা সম্ভব না। তোমাকে চলে যেতে হবে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যেতে হবে।’

‘আমার সমস্যা আপনি সমাধান করবেন না?’

‘মানুষের বেশিরভাগ সমস্যাই এরকম যে তা তারা নিজেরাই সমাধান করতে পারে। আমার ধারণা তোমার সমস্যার সমাধান তুমিই করতে পারবে।’

‘আমি আপনার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছি বলে কি আপনি রাগ করেছেন? ‘রাগ করার প্রশ্ন আসছে না। মিথ্যা কথা বলাটাকে সবাই যতবড় অন্যায় মনে করে আমি তা করি না। আমার কাছে মনে হয় মানুষের অনেক অদ্ভুত ক্ষমতার একটি হচ্ছে মিথ্যা বলার ক্ষমতা। কল্পনাশক্তি আছে বলেই সে মিথ্যা বলতে পারে। যে মানুষ মিথ্যা বলতে পারে না সে সৃষ্টিশীল মানুষ না—রোবট টাইপ মানুষ।’

‘আপনি কি মিথ্যা বলেন?’

‘না বলি না। মানুষ হিসেবে আমি রোবট টাইপের। শোন চিত্রা, তুমি এখন চলে যাও। চিত্রা বিস্মিত গলায় বলল, ‘চলে যাব?’

‘হ্যাঁ চলে যাবে।’

‘আপনি আমাকে খুব অপছন্দ করেছেন তাই না?’

‘আমি তোমাকে অপছন্দও করি নি আবার পছন্দও করি নি।’

‘আমার বিষয়ে আপনার কোনো কৌতূহলও হচ্ছে না?’

‘লোকজনের ধারণা আমার কৌতূহল খুব বেশি, আসলে তা না। আমার কৌতূহল কম। অনেক কম।’

‘নীল রঙের মাছিটার দিকে আপনি যতটা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়েছেন আমার দিকে তাও তাকান নি। আমি কি মাছির চেয়েও তুচ্ছ?’

মিসির আলি চুপ করে রইলেন।

চিত্রা ক্লান্ত গলায় বলল, আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু আপনি দয়া করে গম্ভীর হয়ে থাকবেন না। যাবার আগে হাসিমুখে থাকুন। আপনার হাসিমুখ দেখে যাই।

মিসির আলি হাসলেন। চিত্রা বলল, বাহ আপনার হাসি তো সুন্দর। যারা গম্ভীর ধরনের মানুষ তাদের হাসি খুব সুন্দর হয়। এরা হঠাৎ হঠাৎ হাসে তো এই জন্যে। আর যারা সব সময় হাসিমুখে থাকে তাদের হাসি হয় খুব বিরক্তিকর। তাদের কান্না হয় সুন্দর। আচ্ছা আমি তা হলে এখন উঠি।

চিত্রা উঠে দাঁড়াল। মেয়েটা এত সহজে চলে যেতে রাজি হবে তা মিসির আলি ভাবেন নি। তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

‘আচ্ছা শুনুন, আমি আমার ব্যাগগুলি রেখে যাই। ব্যাগ হাতে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আশ্রয় খোঁজার তো কোনো মানে হয় না, তাই না?’

‘বিছানা বালিশ নিয়ে যাওয়াই তো ভালো, সবাই ভাববে এই মেয়ের আসলেই আশ্রয় প্রয়োজন।’

‘আপনি কিন্তু সেরকম ভাবেন নি। আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। যাই হোক আমি জিনিসপত্র রেখে যাচ্ছি। একসময় এসে নিয়ে যাব।’

‘আচ্ছা।’

‘আপনি আসলেই রোবট টাইপ মানুষ। যাই কেমন?’

‘তুমি কি তোমার বাড়ির টেলিফোন নাম্বারটি দিয়ে যাবে?’

‘কেন? আচ্ছা দিচ্ছি। কাগজে লিখে দিচ্ছি। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে টেলিফোন করবেন না। আর যদি করেন আপনি ভয়াবহ বিপদে পড়ে যাবেন। এইবার কিন্তু আমি সত্যি কথা বলছি—কি বলছি না?’

‘মনে হচ্ছে বলছ।’

চিত্রা তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে কাগজ নিয়ে টেলিফোন নাম্বার লিখল। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, এই নিন নাম্বার। আবারো বলছি নিতান্ত প্রয়োজন না হলে টেলিফোন করবেন না।

‘নিতান্ত প্রয়োজন বলতে তুমি কী বুঝাচ্ছ?’

‘ধরুন আমি আপনার ঘর থেকে বের হলাম। আর হঠাৎ একটা ট্রাক এসে আমার গায়ের উপর দিয়ে চলে গেল তখন আপনি বাসায় টেলিফোন করে বলবেন—–চিত্রা মারা গেছে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

চিত্রা বেশ সহজ ভঙ্গিতেই বের হল। মিসির আলি উঠে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তিনি আজ আর ঘর থেকে বের হবেন না। তিনি জানেন ঘণ্টা দু-একের ভেতর চিত্রা ফিরে আসবে, তার জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। মেয়েরা তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র কোথাও রেখে স্বস্তি পায় না। কাজেই অপেক্ষা করাই ভালো।

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার মেয়েটি চলে যাবার পর মিসির আলির একটু মন খারাপ হয়ে গেল। পাখি উড়ে যাবার পর পাখির পালক পড়ে থাকে। মেয়েটা চলে গেছে তার পরেও কিছু যেন রেখে গেছে। স্যুটকেস এবং হ্যান্ডব্যাগ নয়, অন্য কিছু মেয়েটির রেখে যাওয়া ৫০০ টাকার নোটটা পকেটে। টাকাটা ফেরত দিতে ভুলে গেছেন। আশ্চর্য কাওমেয়েটি তার কালো ব্যাগও ফেলে গেছে। তার সব টাকা তো ওই ব্যাগে। বেবিট্যাক্সি নিয়ে যদি কোথাও যায় ভাড়া দিতে পারবে না।

মিসির আলি অস্বস্তি বোধ করছেন। মেয়েটাকে মাথা থেকে তাড়াতে পারছেন না। মাছিটা এখনো টেবিলে বসে আছে। মারা গেছে নাকি? না মারা যায় নি। কীট এবং পতঙ্গ জগতের নিয়ম হল মৃত্যুর পর উল্টো হয়ে থাকা। পিঠ থাকবে মাটিতে পা থাকবে শূন্যে। মাছির বেলাতেও নিশ্চয়ই সেই নিয়ম। মিসির আলি তার লাইব্রেরির দিকে এগুলেন—মাছি সম্পর্কে জানার জন্যে কোনো বই কি আছে লাইব্রেরিতে? থাকার তো কথা।

মাছি সম্পর্কে মিসির আলি তেমন কোনো তথ্য যোগাড় করতে পারলেন না। শুধু জানলেন পৃথিবীতে মোট ৮৫,০০০ প্রজাতির মাছি আছে। মৌমাছি যেমন মাছি, ড্রাগন ফ্লাইও মাছি। সবচে ছোট মাছি প্রায় অদৃশ্য আর সবচে বড় মাছি চড়ুই পাখি সাইজের। এদের সবারই দু জোড়া পাখা থাকে। এক জোড়া তারা ওড়ার কাজে ব্যবহার করে অন্য জোড়া ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যবহার করে। বেশিরভাগ প্রজাতির মাছিই মানুষের পরম বন্ধু—শুধু হাউস ফ্লাই নয়। এদের প্রধান কাজ অসুখ ছড়ানো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *