অনীশ – ০২

চার শ’ ন’ নম্বর কেবিনের ভোল পুরোপুরি পাল্টে গেছে। দেয়াল ঝকঝক করছে, কারণ প্লাস্টিক পেইন্ট করা হয়েছে। এ্যাটাচ্‌ড্ বাথরুমের দরজায় ঝুলছে হাল্কা নীল পর্দা। বাথরুমের কমোডের ফ্ল্যাশ ঠিক করা হয়েছে। পানির ট্যাপও সারানো হয়েছে। মেঝেতে পানি জমে থাকত—এখন পানি নেই।

কেবিনের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বুড়ি বিছানায় শুয়ে শুয়ে গভীর মনোযোগে খাতায় কী-সব লিখছে। লেখার ব্যাপারটি যে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা যাচ্ছে হাতের কাছে বাংলা অভিধান দেখে। সে মাঝে-মাঝেই অভিধান দেখে নিচ্ছে। লেখার গতি খুব দ্রুত নয়। কিছুক্ষণ পরপরই খাতা নামিয়ে রেখে তাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম করতে দেখা যাচ্ছে। এই সময় টেবিল ল্যাম্পটি সে নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে দিচ্ছে। টেবিল-ল্যাম্পটা খুব সুন্দর। একটিমাত্র ল্যাম্প ঘরের চেহারা পাল্টে দিয়েছে।

বুড়ি লিখছে—

গত পরশু মিসির আলি নামের একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। পরিচয় বলা ঠিক হচ্ছে না—কারণ আমি তাঁর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। তিনিও আমার সম্পর্কে কিছু জানেন না। মানুষটি বুদ্ধিমান, নিশ্চয়ই এটা চমৎকার একটা গুণ। কিন্তু তাঁর দোষ হচ্ছে, তিনি একই সঙ্গে অহঙ্কারী। অহঙ্কার–বুদ্ধির কারণে, যেটা আমার ভালো লাগে নি। বুদ্ধির খেলা দেখিয়ে তিনি আমাকে অভিভূত করতে চেয়েছেন। কেউ আমাকে অভিভূত করতে চাইলে আমার ভালো লাগে না। রাগ হয়। বয়স হবার পর থেকেই দেখছি আমার চারপাশে যারা আসছে, তারাই আমাকে অভিভূত করতে চাচ্ছে। এক-এক বার আমার চেঁচিয়ে বলার ইচ্ছা হয়েছে—হাতজোড় করছি, আমাকে রেহাই দিন। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। পৃথিবীতে অসংখ্য মেয়ে আছে— যাদের জন্মই হয়েছে অভিভূত হবার জন্যে। তাদের কাছে যান। তাদের অভিভূত করুন, হোয়াই মি?

এই কথাগুলি আমি মিসির আলি সাহেবকে বলতে পারলে সবচেয়ে খুশি হতাম—তাঁকে বলতে পারছি না। কারণ উনি আমাকে সত্যি-সত্যি অভিভূত করেছেন। চমকে দিয়েছেন। ছোট বালিকারা যেমন ম্যাজিক দেখে বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়, আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। আমি হয়েছি বাক্যহারা। মজার ব্যাপার হচ্ছে—আমার এই বিস্ময়কে তিনি মোটেই পাত্তা দিলেন না। ম্যাজিশিয়ানরা অন্যের বিস্ময় উপভোগ করে। তিনি করেন নি।

সবুজ রঙের দেয়ালের লেখা প্রসঙ্গে যখন আমি যা জেনেছি তা তাঁকে বলতে গেলাম, তিনি কোনো আগ্রহ দেখালেন না। আমি যখন তাঁর বিছানার পাশের চেয়ারে বসলাম, তিনি শুকনো গলায় বললেন, ‘কিছু বলতে এসেছেন?’

আমি বললাম, ‘না। আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।

তিনি বললেন, ‘ও।’ তাঁর চোখ-মুখ দেখেই মনে হল, তিনি বিরক্ত–মহাবিরক্ত। নিতান্ত ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারছেন না। চেয়ারে বসেছি, চট করে উঠে যাওয়া ভালো দেখায় না। কাজেই মিসির আলি সাহেবের অসুখটা কি, কত দিন ধরে হাসপাতালে আছেন—এই সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। তিনি নিতান্তই অনাগ্রহে জবাব দিলেন। আমি যখন বললাম, ‘আচ্ছা তাহলে যাই?’ তিনি খুবই আনন্দিত হলেন বলে মনে হল। সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, ‘আচ্ছা—আচ্ছা।’ ‘আবার আসবেন’–এই সামান্য বাক্যটি বললেন না। এটা বলাটাই স্বাভাবিক ভদ্রতা।

তাঁর ঘর থেকে ফিরে আমার বেশ কিছু সময় মন খারাপ রইল। আমার জন্যে এটাও একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। আমার একধরনের ডিফেন্স মেকানিজম আছে—অন্যের ব্যবহারে আমি কখনো আহত হই না—কারণ এ-সবকে আমি ছেলেবেলা থেকেই তুচ্ছ করতে শিখেছি।

মিসির আলি সাহেব আমার কিছু উপকার করেছেন, তাঁর নিজের কেবিন ছেড়ে দিয়েছেন। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাই বলে তিনি আমাকে অপমান করতে পারেন না। এই অধিকার তাঁর নেই। ঘন্টা দুই আগে তিনি যা করলেন তা অপমান ছাড়া আর কী। উনি রেলিং ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি ব্লাড ম্যাচিং নাকি কি হাবিজাবি করে উপরে এসেছি। আমার পায়ের শব্দে তিনি তাকালেন।

আমি বললাম, ‘ভালো আছেন?’

তিনি কিছু বললেন না। তাকিয়েই রইলেন।

আমি বললাম, ‘চিনতে পারছেন তো? আমি বুড়ি।’

তিনি বললেন, ‘‘ও—আচ্ছা।

‘ও—আচ্ছা’ কোনো বাক্য হয়? এত তাচ্ছিল্য করে কেউ কখনো আমাকে কিছু বলে নি। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার উচিত ছিল আর কোনো কথা না-বলে নিজের কেবিনে চলে আসা। তা না-করে আমি গায়ে পড়ে বললাম, ‘আজ আপনার শরীরটা মনে হয় ভালো, হাঁটাহাঁটি করছেন।’ তার উত্তরে তিনি আবারও বললেন, ‘ও—আচ্ছা।’

তার মানে হচ্ছে আমি কি বলছি না-বলছি তা নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই। দায়সারা ‘ও—আচ্ছা’ দিয়ে সমস্যা সমাধান করছেন। আমি তো তাঁকে বিরক্ত করার জন্যে কিছু বলি নি। আমি কাউকে বিরক্ত করার জন্যে কখনো কিছু করি না। উল্টোটাই সবসময় হয়। লোকজন আমাকে বিরক্ত করে। ক্রমাগত বিরক্ত করে।

মিসির আলি নামের আপাতদৃষ্টিতে বুদ্ধিমান এই মানুষটি আমাকে অপমান করছেন। কে জানে, হয়তো জেনেশুনেই করছেন। মানুষকে অপমান করার সূক্ষ্ম পদ্ধতি সবার জানা থাকে না, অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান মানুষরাই শুধু জানেন এবং অকারণে প্রয়োগ করেন। সেই সুযোগ তাদের দেওয়া উচিত না। আমি শীতল গলায় বললাম, ‘মিসির আলি সাহেব!’

উনি চমকে তাকালেন। আমি বললাম, ‘ঠিক করে বলুন তো আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

‘চিনব না কেন?’

‘আমি যা–ই জিজ্ঞেস করছি আপনি বলছেন—’ও আচ্ছা’। এর কারণটা কি আপনি আমাকে বলবেন?’

‘আপনি কী বলছেন আমি মন দিয়ে শুনি নি। শোনার চেষ্টাও করি নি। মনে হয় সে-জন্যেই ‘ও আচ্ছা’ বলছি।’

‘কেন বলুন তো?’

‘আমি প্রচণ্ড মাথাব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি। এই উপসর্গ নতুন হয়েছে, আগে ছিল না। আমি মাথাব্যথা ভুলে থাকার জন্যে নানান কিছু ভাবছি। নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি।’

আমি বললাম, ‘মাথাব্যথার সময় আপনাকে বিরক্ত করবার জন্যে দুঃখিত। কিছু মনে করবেন না।’

আমি নিজের ঘরে চলে এলাম, কিন্তু ভদ্রলোকের মাথাব্যথার গল্প বিশ্বাস করলাম না। প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে এমন শান্ত ভঙ্গিতে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে না, এবং প্রচণ্ড মাথাব্যথায় এত সুন্দর যুক্তিভরা কথাও মনে আসে না। ভদ্রলোকের মানসিকতা কী তা মনে হয় আমি আঁচ করতে পারছি। কিছু-কিছু পুরুষ আছে, যারা রূপবতী তরুণীদের অগ্রাহ্য করে একধরনের আনন্দ পায়। সচরাচর এরা নিঃসঙ্গ ধরনের পুরুষ হয়, এবং নারীসঙ্গের জন্যে তীব্র বাসনা বুকে পুষে রাখে।

মিসির আলি সাহেব যে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, তা এই দু’ দিনে আমি বুঝে ফেলেছি। এই ভদ্রলোককে দেখতে কোনো আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব এখন পর্যন্ত আসে নি। আমাদের দেশে গুরুতর অসুস্থ একজনকে দেখতে কেউ আসবে না তা ভাবাই যায় না। একজন কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে তার আত্মীয়স্বজন আসে, বন্ধুবান্ধব আসে, পাড়া-প্রতিবেশী আসে, এমনকি গলির মোড়ের যে মুদীদোকানি—সে-ও আসে। এটা একধরনের সামাজিক নিয়ম। মিসির আলির জন্যে কেউ আসছে না।

অবশ্যি আমাকে দেখতেও কেউ আসছে না। আমার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যায়। আমি কাউকেই কিছু জানাই নি। যারা জানে তাদের কঠিনভাবে বলা হয়েছে তারা যেন আমাকে দেখতে না-আসে। তারা আসছে না, কারণ আমার নিষেধ অগ্রাহ্য করলে তাদেরই সমস্যা।

আচ্ছা, আমি এই মানুষটিকে নিয়ে এত ভাবছি কেন? নিতান্ত অপরিচিত একজন মানুষকে নিয়ে এত চিন্তা-ভাবনা করার কোনো মানে হয়! আমি নিজে নিঃসঙ্গ বলেই কি একজন নিঃসঙ্গ মানুষের প্রতি মমতাবোধ করছি?

ভদ্রলোক আমার প্রতি অবহেলা দেখিয়েছেন, আমি তাতে কষ্ট পাচ্ছি। আমরা অতি প্রিয়জনদের অবহেলাতেই কষ্ট পাই। কিন্তু এই ভদ্রলোক তো আমার অতি প্রিয় কেউ নন। আমরা দু’ জন দু’ প্রান্তের মানুষ। তাঁর জগৎ ভিন্ন, আমার জগৎ ভিন্ন। হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাবার পর আর কখনো হয়তো তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবে না।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এই হাসপাতালে যে-ক’টা দিন আছি সেই ক’টা দিন ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্পটল্প করলে আমার ভালো লাগবে। কারো সঙ্গে কথা বলেই আমি আরাম পাই না। যার সঙ্গেই কথা বলি, আমার মনে হয় সে ঠিকমতো কথা বলছে না। ভান করছে। নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছে। যেন সে পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ। সে ধরেই নিচ্ছে তার কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে আমি মনে-মনে তার সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা করছি, অথচ আমি যে মনে-মনে অসংখ্য বার বলছি হাঁদারাম, হাঁদারাম, তুই হাঁদারাম, সেই ধারণাও তার নেই।

মিসির আলি নিশ্চয়ই সে-রকম হবেন না। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিশ্চয়ই আমি কখনো মনে-মনে বলব না—’হাঁদারাম’। আমার নিজের একটি নিতান্তই ব্যক্তিগত গল্প আছে, যা আমি খুব কম মানুষকেই বলেছি। এই গল্পটাও হয়তো আমি তাঁকে বলতে পারি। আমার এই গল্প আমি যাঁদেরকে বলেছি তাঁদের সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে শুনেছেন, তারপর বলেছেন-আপনার মানসিক সমস্যা আছে। ভালো কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যান।

মানুষ এই এক নতুন জিনিস শিখেছে, কিছু হলেই সাইকিয়াটিস্ট। মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। সাইকিয়াট্রিস্ট সেই এলোমেলো মাথা ঠিক করে দেবেন। মানুষের মাথা কি এমনই পলকা জিনিস যে সামান্য আঘাতেই এলোমেলো হয়ে যাবে? এই কথাটিও মিসির আলি সাহেবকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। ভদ্রলোক মাস্টার মানুষ, কাজেই ছাত্রীর মতো ভঙ্গিতে খানিকটা ভয়ে ভয়ে যদি জিজ্ঞেস করা যায়—আচ্ছা স্যার, মানুষের মাথা এলোমেলো হবার জন্যে কত বড় মানসিক আঘাতের প্রয়োজন? তখন তিনি নিশ্চয় এই প্রশ্নের জবাব দেবেন। সেই জবাবের গুরুত্ব থাকবে। কারণ মানুষটির ভেতর লজিকের অংশ বেশ শক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *