১১. নিউ জার্সি শহরে বাঙালি

নিউ জার্সি শহরে আড়াইশ’র মতো বাঙালির বাস।

এই আড়াইশ’র একজন আমার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল। কাজ করে বেল ল্যাবরেটরিতে। নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট। গবেষণার বিষয় ফাইবার অপটিকস বা এই ধরনের কিছু। তারচেয়ে বড় পরিচয় সে বাংলা সাহিত্যের একজন লেখক এবং উঁচুমানের লেখক। তাঁর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এবং শিশুদের জন্যে লেখা গ্রন্থগুলি আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়ি, মাঝে মাঝে খানিকটা ঈর্ষাও যে করি না তা না।

নিউ অরলিন্স থেকে সরাসরি তার বাসায় গিয়ে উঠলাম। তার দুই বাচ্চা নাবিল এবং ইয়েসিম। দুজনই এয়ারপোর্টে খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল বড় চাচা আসবেন। তাদের ধারণা বড় চাচা মানে সাইজে যিনি বড়। দুজনই আমার আকৃতি দেখে মনোক্ষুণ্ণ হলো। নাবিল নিখুঁত ইংরেজিতে বলল, তোমরা একে বড় চাচা কেন বলছ–He is small.

নাবিলের বয়স পাঁচ। ইংরেজি-বাংলা দুই-ই চমৎকার বলে। তার বোনের বয়স তিন, সে মিশ্র ভাষা ব্যবহার করে। উদাহরণ–Give my জামা খুলি অর্থাৎ আমার জামা খুলে দাও।

বাচ্চা দুটি একা একা থাকে। নিকট আত্মীয়স্বজনদের দেখা বড় একটা পায়। আমাকে এবং গুলতেকিনকে পেয়ে তাদের আনন্দের সীমা রইল না। তাদের আগ্রহ ও আনন্দের প্রধান কারণ আমরা বাংলাদেশের। বাচ্চা দুটিকে তাদের বাবা মা এমন এক ধারণা দিয়েছে যাতে তাদের কাছে বাংলাদেশ হচ্ছে স্বপ্নের দেশ। বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্নের মানুষ। আমি তাদের সেই ধারণা উসকে দেবার প্রাণপণ চেষ্টা করলাম। ইয়েসিম যখন তার রান্নাবাটি খেলার কাগজের খাবার আমাকে এনে দিল আমি কপ কপ করে সেই কাগজ খেয়ে দুই ভাই-বোনের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করলাম।

ওদের বাবা-মা দেখি বাচ্চা দুটিকে খুবই আধুনিক নিয়মে বড় করার চেষ্টা করছে। বাবা-মা দু’জনই পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং দীর্ঘদিন আমেরিকা প্রবাসী হলে এই বোধহয় হয়। ঘরে বাচ্চাদের জন্যে আইন-কানুন লেখা। যেমন

প্রথম আইন : কাঁদলে কোনো জিনিস পাওয়া যাবে না। কাজেই কেঁদে লাভ নেই।

দ্বিতীয় আইন : খেলনা কারোর একার নয়। খেলনা শেয়ার করতেই হবে।

আমি ইকবালকে বললাম, তোর কায়দা-কানুন তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো একটা কিছু নিয়ে কেঁদে বাড়ি মাথায় না তুললে আর বাচ্চা কি! তোর নিয়মে তুই তো বাচ্চাদের বড়ো বানিয়ে ফেলছিস।

সে হেসে বলল, অনেক ভেবেচিন্তে এটা করছি। এক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট। তোমরা হঠাৎ দেখছ বলে অন্য রকম লাগছে।

তাই হয়তো হবে। তাদের এক্সপেরিমেন্টে আমি এবং গুলতেকিন বাধা দিলাম না তবে একবার বেশ খারাপ লাগল। এদের নিয়ে খেলনার দোকানে গিয়েছি–নাবিলের একটা খেলনা পছন্দ হলো। তার বাবা বলল, নাবিল তিন নম্বর

আইনটি কি বলো তো?

নাবিল গড়গড় করে বলল, মাসে একটির বেশি খেলনা পাওয়া যাবে না।

তুমি কি এই মাসে খেলনা পেয়েছ?

তাহলে এটি চাচ্ছ কেন।

আমার খুব পছন্দ হয়েছে।

তিন নম্বর আইন কি বলে? পছন্দ হলেই পাওয়া যাবে?

নাবিল ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল।

কাদলে লাভ হবে না ব্যাটা। এক নম্বর আইন কি বলে?

সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এক নম্বর আইন বলে কাঁদলে কিছু পাওয়া যাবে না।

তাহলে কাঁদছ কেন?

কান্না থামাতে পারছি না তাই কাঁদছি।

আমি আর থাকতে পারলাম না। বললাম, বাংলাদেশের একটা কঠিন আইন আছে। সেই আইন বলে–বড় ভাইরা ইচ্ছে করলে ছোট ভাইদের আইন ভাঙতে পারে। সেই বাংলাদেশী বিশেষ আইনে তোমাদের প্রথম আইন ভঙ্গ করা হলো। এখন তোমাকে তোমার প্রিয় জিনিস কিনে দেয়া হবে। এসো আমার সঙ্গে।

নাবিল আশা ও নিরাশা নিয়ে তাকাল তার বাবার দিকে। তার বাবা বলল,

বাংলাদেশী বিশেষ আইনের ওপর তো আর কথা চলে না। যাও তোমার বড় চাচার সঙ্গে।

আমেরিকায় যা দেখে আমি সবচে’ কষ্ট পেয়েছি তা হলো প্রবাসী বাঙালিদের ছেলে-মেয়ে। তারা বড়ই নিঃসঙ্গ। হ্যাঁ, বাবা-মা তাদের আছে, বন্ধুবান্ধব আছে, কিন্তু দু’কূল ভাসানো আদর কোথায়? পরিষ্কার মনে আছে আমার শৈশবের একটি বড় অংশ কেটেছে আত্মীয়স্বজনদের কোলে কোলে। আদরে মাখামাখি হয়ে। নানার বাড়ির কথা। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মা’কে ডেকে তুলে বললাম ঘুম আসছে না। কোলে করে মাঠে হাঁটলে ঘুম আসবে। মা বিরক্ত মুখে বললেন, কি যন্ত্রণা। দিব পাখা দিয়ে এক বাড়ি। খালারা চেঁচিয়ে উঠলেন–আহা আহা আহা। তিন মামা বের হয়ে এলেন কোলে নিয়ে মাঠে হাঁটার জন্যে। শুধু হাঁটলে হবে না। হাঁটতে হাঁটতে গল্প বলতে হবে। আকাশ ভরা ফকফকা জোছনা। মাঠ ভর্তি জোছনার ফুল। সেই শৈশব এরা কোথায় পাবে?

নিউ জার্সির প্রবাসী বাঙালিদের ছেলেমেয়েদের অবস্থা অবশ্যি ভত খারাপ নয়। এরা একসঙ্গে হেসে-খেলেই বড় হচ্ছে। বাংলা শেখার স্কুল আছে, নাচের স্কুল আছে। গানের স্কুল আছে। প্রবাসী বাঙালিদের বৃদ্ধ বাবা-মারা দেশ থেকে নাতি-নাতনিদের দেখতে যাচ্ছেন। তিন মাস, তিন মাস করে থাকছেন।

প্রবাসী বাঙালিদের অভিমত হলো–প্রথম জেনারেশনেই শুধু প্রবাসে থাকার কষ্ট ভোগ করবে। দ্বিতীয় জেনারেশন করবে না, কারণ তাদের বাবা, মা, ভাই, বোন সব এই দেশেই থাকবে। তৃতীয় জেনারেশনে এরা শুধু যে বাবা-মা পাবে তাই না, খালা-খালু চাচা-চাচী সবই পেয়ে যাবে।

আমি তাদের যুক্তি মেনে নিলাম, অবশ্যি মনে মনে বললাম, সবই পাবে। শুধু পাবে না ‘দেশ’।

পরে ভেবে দেখলাম আমার এই কথাও তো ঠিক নয়। দেশ কেন পাবে না? দেশ হবে আমেরিকা। তাতে ক্ষতি কি। আসলে আমরা কি বিশ্ব নাগরিক নই। পৃথিবী হচ্ছে আমাদের জন্মভূমি–এটা ভাবলেই সব সমস্যার সমাধান।

যখন বয়স কম ছিল তখন বিদেশে থেকে যাওয়া বাংলাদেশীদের কথা ভাবলে খানিক মন খারাপ হতো। এখন হয় না। এখন মনে হয় কর্ম এবং জীবিকার খাতিরে দেশত্যাগে ক্ষতি কি? বাংলাদেশের মানুষ ছড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীময়। জনসংখ্যার ভারে পর্যুদস্ত বাংলাদেশের এতে লভি বই ক্ষতি হবে না। প্রবাসী ইহুদিদের কল্যাণেই তো আজ ইসরাইল এত ক্ষমতাবান একটি দেশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হবে।

আমি নিউ জার্সিতে তার লক্ষণও দেখলাম। বাংলাদেশ সমিতি নামে নিউ জার্সির যে সমিতি তা দেশের জন্যে ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছে। দেশের যে কোনো বিপদে যে পরিমাণ অর্থ তারা দান করছে তার পরিমাণ শুনলে মাথা ঘুরে যায়। একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকার কথাও তো আজ আমাদের জানতে বাকি নেই।

প্রসঙ্গক্রমে প্রবাসী বাঙালি পরিবারের একজনের কথা বলি। তিনি ছেলের জন্মদিন করবেন। দাওয়াতের চিঠি পাঠালেন। চিঠিতে লেখা আমার ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে উপহার কেনা বাবদ যে পরিমাণ অর্থ আপনি বরাদ্দ করে রেখেছিলেন দয়া করে সেই অর্থ–বাংলাদেশ সাহায্যকল্প প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান সেবায় দান করুন।

বাংলাদেশ সোসাইটি শিল্প-সাহিত্যের ধারাটি তাদের মধ্যে প্রবাহিত রাখার অংশ হিসেবে দেশের নামি কবি-সাহিত্যিক দাওয়াত করে নিয়ে যাচ্ছেন। অনুষ্ঠান করছেন। এই তো কিছুদিন আগে ঘুরে গেলেন কবি শামসুর রাহমান।

আমি থাকতে থাকতেই সঙ্গীত অনুষ্ঠান হলো কাদেরী কিবরিয়ার। সবার মধ্যে কত আনন্দ, কত উৎসাহ।

ষোলই ডিসেম্বরে বিজয় দিবস উৎসব হবে। দীর্ঘদিন ধরে চলছে তার রিহার্সেল। কত না উত্তেজনা সবার মধ্যে। দেখে বড় ভালো লাগল। অসহায় বাংলা মা’কে এরা ভুলেন নি–এই জীবনে ভুলতে পারবেনও না। বাংলাদেশ আর কিছু পারুক না পারুক এক দল পাগল ছেলে তৈরি করে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিয়েছে। যারা বাংলাদেশ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *