০৮. আজ রেবুর বিয়ে

আজ রেবুর বিয়ে। আয়োজনের হইচই ধরনের বিয়ে না। নিয়মরক্ষা বিয়ে। মগবাজারের কাজি অফিস থেকে কাজি সাহেব আসবেন। বরপক্ষে কিছু লোকজন থাকবে। পাঁচ লক্ষ এক টাকা কাবিন। অর্ধেক গয়নাপাতিতে উসুল। আজমল সাহেব প্রায় জীবন দিয়ে দিচ্ছেন মিসির আলি যাতে কনের দিকের একজন উকিল হন। মিসির আলি কাটান দিয়ে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত কাটান দিতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।

বিয়ের কনে রেবুর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। সে সকালবেলা নতুন পাঞ্জাবি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আজমল সাহেব পাঞ্জাবি পাঠিয়েছেন। তিনি চান মিসির আলি বিয়ের আসরে এই পাঞ্জাবি পরে উপস্থিত হবেন। আঁখিতারাও এই উপলক্ষে লাল পাড় ডুরে লাল শাড়ি পেয়েছে। বিয়ে হবে সন্ধ্যায়, আঁখিতারা সকাল থেকেই শাড়ি পরে সেজেগুজে বেড়াচ্ছে। মিসির আলিকে বলেছে, তাকে কাচের চুড়ি কিনে দিতে হবে। কাচের চুড়ি না পেলে সে বিয়েতে যাবে না।

রেবু মিসির আলির পা ছুঁয়ে সালাম করল। মিসির আলি বললেন, আজ তোমার জন্য বিশেষ দিন।

পাঞ্জাবি টেবিলে রেখে রেবু কিছু বলল না।

মিসির আলি বললেন, উন্নত একটা দেশে যাচ্ছ। তাদের চিকিৎসাব্যবস্থা খুব ভালো। অবশ্যই সেখানে তুমি ভালো ডাক্তার দেখাবে। সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তোমার ভালো চিকিৎসা দরকার।

রেবু ঘাড় কাত করল।

মিসির আলি বললেন, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?

রেবু বলল, না।

মিসির আলি বললেন, তোমার কাছে আমার একটা প্রশ্ন ছিল।

রেবু সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসল। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। অতিরিক্ত টেনশনে তার নাক ফুলে ফুলে উঠছে। মিসির আলি বললেন, তুমি ঘাবড়ে গেছ কেন? জটিল কোনো প্রশ্ন না। হিন্দি ছবি দেখেছিলাম তোমাকে সঙ্গে নিয়ে। সেই ছবি নিয়ে প্রশ্ন

কী প্ৰশ্ন?

নায়ক যখন মারামারি করছিল তখন দেখলাম তার শার্টের একটা বোতাম নেই। কিন্তু মৃত্যুদৃশ্যের সময় দেখলাম শার্টের সবগুলো বোতামই আছে। এটা কী করে সম্ভব?

রেবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মৃত্যুদৃশ্যটা তারা আগে করেছে। তখন শার্টের বোতাম ছিল। মারামারি দৃশ্যের সময় বোতাম খুলে গেছে।

মিসির আলি বললেন, এত জটিল সমস্যার এত সহজ সমাধান? আমি বুঝতেই পারি নি।

রেবু বলল, আপনি ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। আমার কাছে বুঝতে না পারার ভাব করেছেন।

তোমার সঙ্গে এটা কেন করব?

আমাকে বোঝানোর জন্য যে, আপনার বুদ্ধি কম। আপনার যে খুব বুদ্ধি এটা আমি জানি। এত বুদ্ধি থাকা ভালো না।

মিসির আলি আচমকা অন্য একটা প্রশ্ন করলেন। তিনি রেবুর দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, তোমাদের বাড়ির বারান্দার দিক থেকে আমার এই বাসায় ঢোকার একটা দরজা আছে। দরজাটা তোমাদের দিক থেকে তালাবদ্ধ থাকে। সেই তালার চাবি কি তোমার আছে?

রেবু কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, আছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন?

মিসির আলি বললেন, না।

রেবু তাকিয়ে আছে। তার চোখ বড় বড়। মিসির আলির ধারণা ছিল তিনি মানুষের চোখের ভাষা পড়তে পারেন। তিনি হঠাৎ লক্ষ করলেন, রেবুর চোখের ভাষা তিনি পড়তে পারছেন না। এর চোখের ভাষা অচেনা হয়ে গেছে।

.

রাত ন’টা বাজে। আজমল সাহেব দুইবার মিসির আলিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠিয়েছেন। মিসির আলি যেতে পারছেন না। কারণ মনসুর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সে সঙ্গে করে অনেকগুলো তাজা দোলনচাঁপা নিয়ে এসেছে। মিসির আলি দোলনচাপার নাম পড়েছেন নজরুলের কবিতার বইয়ে। দোলনচাপা আগে কখনো দেখেন নি। ফুল দেখে এবং ফুলের গন্ধে তিনি মুগ্ধ হলেন। পুরো বাড়িতেই মিষ্টি সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে। মিসির আলি বললেন, বাহ্!

মনসুর বলল, স্যার, ফুলগুলো আপনার পছন্দ হয়েছে?

মিসির আলি বললেন, খুব পছন্দ হয়েছে। থ্যাঙ্ক য়্যু।

মনসুর পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বলল, স্যার, মাঝে মাঝে আমি আপনার সামনে বেয়াদবি করি। সিগারেট খাই। আপনি কিছু মনে করবেন না। টেনশনের সময় আমি সিগারেট না খেয়ে থাকতে পারি না।

মিসির আলি বললেন, সামনে সিগারেট খাওয়া-না-খাওয়া নিয়ে আদবের সম্পর্কটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তুমি যত ইচ্ছা সিগারেট খাও। কোনো সমস্যা নেই।

মনসুর কয়েকবার চেষ্টার পর তার লাইটারটা ধরাল। মিসির আলি হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেললেন।

মনসুর অবাক হয়ে বলল, আপনি হাসছেন কেন?

মিসির আলি বললেন, লাইটারের শব্দ শুনে হাসলাম। লাইটারটা তুমি বাঁ হাতে ধরিয়েছ, এটা দেখেও হাসলাম।

মনসুর বলল, আমি লেফটহ্যান্ডার। স্যার, এটা কি কোনো হাসির ব্যাপার। আমি যতদূর জানি, এই পৃথিবীর দুই পারসেন্ট মানুষ লেফটহ্যান্ডার।

মিসির আলি বললেন, আমি কেন হেসেছি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। একবার আমার বাসায় গভীর রাতে কেউ একজন ঢুকেছিল। সেটা খুব বৃষ্টির রাত ছিল। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। যে ঢুকেছিল সে চাচ্ছিল আমি যেন টের পাই কেউ একজন এসেছে, কিন্তু কে এসেছে সেটা যেন বুঝতে না পারি।

আপনি বুঝে ফেলেন কে এসেছে?

হ্যাঁ। তুমি এসেছিলে।

মনসুর শান্ত গলায় বলল, আমি লেফটহ্যান্ডার এটা জেনেই আপনি টের পেলেন আমি আপনার ঘরে ঢুকেছি? লেফটহ্যান্ডাররা গভীর রাতে মানুষের বাড়িতে ঢোকে? মিসির আলি বললেন, তুমি পুরোটা না শুনেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছ। আগে পুরোটা শোনো। নার্ভ ঠাণ্ডা কর। আরেকটা সিগারেট ধরাও।

মনসুর আরেকটা সিগারেট ধরাল। আর তখনই ব্যস্ত ভঙ্গিতে আঁখিতারা ঘরে ঢুকে বলল, বড় বাবা, আপনি যাবেন না?

মিসির আলি বললেন, তুমি বিয়ে বাড়িতে চলে যাও, আমি আসছি।

আঁখিতারা বলল, আমি আপনেরে না নিয়া যাব না।

তা হলে অপেক্ষা কর। সুন্দর করে দু’কাপ চা বানিয়ে দিয়ে যাও।

আঁখিতারা চলে গেল। মিসির আলি মনসুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওই রাতে তুমি কিছুক্ষণ আমার ঘরে হাঁটাহাঁটি করলে। আমার ঘুমভাঙা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে! তারপর ঘর থেকে বের হলে। যতক্ষণ ঘরে ছিলে ততক্ষণ টেনশনে তোমার স্নায়ু আড়ষ্ট ছিল। স্মোকাররা টেনশন কমাতে সিগারেট টানে। ঘর থেকে বের হয়েই তুমি সিগারেট ধরালে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল বলেই পুরো সিগারেটটা তুমি আমার বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শেষ করলে। সিগারেটের গন্ধে আমি তোমাকে চিনলাম না। তোমাকে চিনলাম লাইটারের শব্দে। তোমার লাইটারের শব্দ আমি চিনি।

মনসুর চুপ করে আছে। সে এখন আর সিগারেটে টান দিচ্ছে না। তবে তাকিয়ে আছে সিগারেটের ধোঁয়ার দিকে।

মিসির আলি বললেন, তুমি লেফটহ্যান্ডার এটাও কিন্তু একটা ইন্টারেস্টিং কো-ইনসিডেন্স। শুনলে তুমি মজা পাবে। বলব?

বলুন।

তুমি আঁখিতারার বিছানায় বসেছ। তার ঘাড়ের ডান দিকে চিমটি দিয়েছ। আঁখিতারা উত্তর দিকে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল। এই অবস্থায় তার ঘাড়ের ডান দিকে একজন লেফটহ্যান্ডার চিমটি দেবে। রাইটহ্যান্ডার চিমটি দেবে ঘাড়ের বাঁ দিকে। ব্যাপারটা বুঝতে না পারলে আমি একটা কাজ করি, আঁখিতারাকে বিছানায় শুইয়ে তার পাশে বসে দেখাই কেন একজন ঘাড়ের বাঁ দিকে চিমটি দেবে, আরেকজন দেবে ডান দিকে।

দেখাব?

মনসুর শান্ত গলায় বলল, দেখাতে হবে না। আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি।

আঁখিতারা চা নিয়ে ঢুকেছে। মনসুর সহজভাবেই চায়ের কাপে চুমুক দিল। মিসির আলি বললেন, মনসুর শোনো। লজিক হচ্ছে সিঁড়ির মতো। লজিকের একটি সিঁড়িতে পা দিলে অন্য সিঁড়ি দেখা যায়। তুমি আমার ঘরে ঢুকেছ এটা জানার পর বুঝতে পারলাম রেবু মেয়েটির সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে।

কীভাবে বুঝলেন?

আমার বাসার একটা দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। সেই তালা খুলে এ বাসায় ঢোকা যায়। তালার চাবি রেবুর কাছে আছে। সেই চাবির একটা নিশ্চয়ই তোমার কাছেও আছে। আছে না?

হ্যাঁ আছে।

রেবুদের বাড়ির ঠেলিফোন নাম্বারও তুমি জানো। তুমি আমাকে ওই বাড়িতে টেলিফোন করেছিলে। মনে আছে?

আছে।

আমি একটা নতুন পাঞ্জাবি পরে সেজেগুজে বসে আছি। আমার কাজের মেয়েটা আমাকে তাড়া দিচ্ছে বের হওয়ার জন্য। তুমি একবারও জিজ্ঞেস করলে না আমরা কোথায় যাচ্ছি। জিজ্ঞেস কর নি কারণ তুমি জানো আমরা কোথায় যাচ্ছি। রেবুর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে তা জানা সম্ভব না। তুমি কি জানো আজ রেবুর বিয়ে?

মনসুর বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল।

মিসির আলি বললেন, তুমি এই বাসায় একসময় ভাড়াটে ছিলে। আমার এই অনুমান কি ঠিক আছে?

মনসুর চমকে উঠে বলল, এই তথ্য আপনাকে কে দিয়েছে?

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, রান্নাঘর দিয়েছে। রান্নাঘরের দেয়ালে হাজি আজমত আলি নামের এক ভদ্রলোকের নাম এবং টেলিফোন নাম্বার লেখা। তোমার হাতের লেখা আমি চিনি।

আপনি কি আমার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য হাজি আজমত আলিকে টেলিফোন করেছিলেন?

না, টেলিফোন করি নি। তুমি এই বাড়িতে কতদিন ছিলে?

তিন মাস।

আমার ধারণা রেবুর সঙ্গে তখনই তোমার পরিচয় এবং প্রণয়। রেবু কি নিশিরাতে তালা খুলে তোমার ঘরে আসত?

হ্যাঁ।

অবস্থাটা তো তোমার জন্য ভালোই ছিল। তুমি তিন মাসের মধ্যে চলে গেলে কেন? রেবুর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বলে?

হুঁ।

মিসির আলি বললেন, আমার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে, একটা সিগারেট দাও। মনসুর সিগারেট দিল। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিল। মিসির আলি বললেন, মনসুর তুমি কি মানুষ খুন করেছ?

মনসুর বলল, জি না।

রেবুকে পরামর্শ দিয়েছিলে তার স্বামী-সন্তানকে খুন করতে?

জি না।

তুমি যদি কিছু বলতে চাও বল। আমি তোমার কথা খুব মন দিয়ে শুনব।

স্যার, রেবুর বাচ্চা হওয়ার পর তার সংসারে খুব অশান্তি শুরু হল। রেবুর স্বামীর ধারণা হল বাচ্চাটা তার না। রেবু একদিন স্বীকারও করল বাচ্চার বাবা অন্য একজন তারপর দু’জনকেই বঁটি দিয়ে কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলল।

তুমি আমার ঘরে কেন আসতে?

স্যার, আমি আপনাকে ভয় দেখিয়ে এই বাসা থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম। কারণ, রেবু প্রায়ই বলত সে আপনাকে খুন করতে চায়। সে অসুস্থ একটা মেয়ে। ভয়ঙ্কর অসুস্থ। আপনাকে এই কথাই বারবার বলার চেষ্টা করেছি। আপনার বেঁচে থাকা আমার জন্য দরকার।

কেন?

স্যার, একমাত্র আপনিই রেবুকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন। আর কেউ পারবে না। স্যার, আমি এই অসুস্থ মেয়েটাকে ভয়ঙ্কর ভালবাসি।

মনসুর তাকিয়ে আছে। এই চোখের ভাষা মিসির আলি পড়তে পারছেন না। এই চোখ মমতা এবং ভালবাসায় আর্দ্র।

মনসুরের চোখে পানি জমতে শুরু করছে। মিসির আলি অপেক্ষা করছেন চোখ থেকে পানির ফোঁটাটা কখন টেবিলের ওপর পড়ে। মনসুর যেভাবে বসে আছে পানির ফোঁটা টেবিলে পড়ার কথা। অশ্রু চোখেই মানায়। কাঠের টেবিলে মানায় কি না এটা তার দেখার ইচ্ছা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *