০৬. জটিল হইচই

বদরুল সাহেবের বাড়ির সামনে জটলা। হইচই হচ্ছে। বদরুল সাহেবের স্ত্রীর তীক্ষ্ণ গলা শোনা যাচ্ছে। মিসির আলি ইয়াসিনকে বললেন, কী হয়েছে রে?

ইয়াসিন বলল, জানি না। মনে হয় চোর ধরছে।

সন্ধ্যার দিকে ঐ বাড়িতে রোজই হইচই হয়। এতে গুরুত্ব দেবার কিছু নেই। কিন্তু মহিলার তীক্ষ্ণ গলার স্বর কানে লাগছে।

মিসির আলি ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার জন্যে মাথা ধরার ট্যাবলেট নিয়ে এস। খুব মাথা ধরেছে।

ইয়াসিন বলল, মাথা বানায়া দেই।

মিসির আলি বললেন, মাথা বানাতে হবে না। মাথা বানানোই আছে। তুমি মাথা ধরার ট্যাবলেট কিনে এনে খুব কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে দাও।

ইয়াসিন চলে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফতে ঘরে ঢুকল। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আপনার ঘরে কি লুনা লুকিয়ে আছে?

মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, নাতো।

ফতে বলল, মেয়েটারে পাওয়া যাচ্ছে না। চুপিচুপি এসে খাটের নিচে হয়তো লুকিয়ে আছে। স্যার একটু খুঁজে দেখি?

হ্যাঁ দেখ।

ফতে সবগুলি ঘর খুঁজল। বাথরুমে উঁকি দিল। খাটের নিচে দেখল। ফতের সঙ্গে সঙ্গে মিসির আলিও খুঁজলেন।

ফতে বলল, নাহ এদিকে আসে নাই।

মিসির আলি বললেন, ফতে তোমাকে একটা কথা বলি শোন। তুমি মেয়েটাকে খুঁজতে এসেছ—খাটের নিচে উঁকি দিয়েছ—কিন্তু তুমি কিন্তু মেয়েটাকে খুঁজছিলে না।

ফতে শান্ত গলায় বলল, স্যার এটা কেন বললেন?

মিসির আলি বললেন, আমার খাটের নিচে দুটা বইভর্তি ট্রাংক আছে। সত্যি সত্যি মেয়েটাকে খুঁজলে তুমি অবশ্যই ট্রাংকের ওপাশে কী আছে দেখার চেষ্টা করতে। তা ছাড়া তুমি বাথরুমে উঁকি দিয়েছ? বাথরুমের ভেতরটাও তুমি দেখ নি। বাথরুমের দরজা খুলে তুমি তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে।

ফতে বলল, স্যার আপনি ঠিক ধরেছেন। আমি আসলে খুঁজি নাই। কারণ আমি জানি লুনা এই দিকে আসে নাই। সে নিজে নিজে কোনোদিকে যায় না। তার মা’র মনের শান্তির জন্যে আমি এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করতেছি। ছাদে গিয়েছি দুইবার। ছাদের পানির টাংকির মুখ খুলে ভিতরে দেখেছি।

মিসির আলি বললেন, ফতে তুমি একটু বস তো। এই চেয়ারটায় বস।

ফতে বসল।

মিসির আলি বললেন, বাচ্চা একটা মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়ের মা কান্নাকাটি করছে—আমি কিন্তু তোমার ভেতর কোনো উত্তেজনা লক্ষ করছি না। তোমাকে খুবই স্বাভাবিক লাগছে।

ফতে বলল, সব মানুষ তো একরকম না স্যার। আমি যেরকম, আপনি সেরকম না। কিছু কিছু মানুষ উত্তেজিত হলেও বাইরে থেকে বোঝা যায় না। স্যার কী করে বুঝলেন যে আমি খুব স্বাভাবিক আছি? আমার কপাল ঘামে নাই, আমার কথাবার্তা জড়ায়ে যায় নাই এই জন্যে।

‘না, তা না। তুমি খুব স্বাভাবিক আছ এটা বুঝেছি সম্পূর্ণ অন্য একটা ব্যাপার থেকে। তুমি লেফট হ্যান্ডার। বাঁহাতি মানুষ। বাঁহাতি মানুষ উত্তেজিত অবস্থায় ডান হাত ব্যবহার করতে শুরু করে। তুমি তা করছ না। তুমি বাঁ হাতই ব্যবহার করছ। অথচ তোমাদের বাড়িতে আজ ভয়ঙ্কের ঘটনা ঘটেছে।

ফতে মনে মনে বলল, শাবাশ বেটা। তুই মানুষের মাথার ভিতর ঢুকতে পারিস না। তার পরেও তুই অনেক কিছু বুঝতে পারিস। তোর সাথে পাল্লা দিতে পারলে খারাপ হয় না। আমি তোকে চিনে ফেলেছি, তুই কিন্তু এখনো আমাকে চিনস নাই।

মিসির আলি বললেন, ফতে শোন তুমি এতই স্বাভাবিক আছ যে আমার সন্দেহ হচ্ছে মেয়েটা কোথায় আছে তুমি জান। এবং আমার ধারণা মেয়েটাকে তুমিই সরিয়েছ।

ফতে আবারো মনে মনে বলল, শাব্বাশ। শাব্বাশ। আয় দুইজনে একটা খেলা খেলি। বাঘবন্দি খেলা। তুই একটা চাল দিবি। আমিও একটা চাল দিব।

মিসির আলি বললেন, ফতে কিছু একটা বল। চুপ করে আছ কেন? মেয়েটাকে তুমি সরাও নি?

ফতে বলল, গেটে দারোয়ান আছে। লুনাকে নিয়ে গেট থেকে বের হলে দারোয়ান দেখত না?

মিসির আলি বললেন, তোমার গায়ে ভারী চাদর। এই চাদর দিয়ে ঢেকে মেয়েটাকে সরিয়ে নিলে কারোর সন্দেহ করার কিছু নেই। চাদরের নিচ থেকে মেয়েটাও কোনো শব্দ করবে না। কারণ সে তোমাকে খুব পছন্দ করে। তাকে চাদরের নিচে ঢুকিয়ে তুমি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছ এই দৃশ্য আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি।

ফতে মনে মনে বলল, তুই বাঘবন্দি খেলা খেলতে চাস, আয় খেলি। তুই তিন- চারটা ভালো চাল দিয়ে ফেলেছিস। আমি কোনো চাল দেই নাই। এখন দেব।

মিসির আলি বললেন, ফতে কথা বল। চুপ করে থেক না। বাচ্চা মেয়েটাকে তুমি সরিয়েছ?

‘জি।’

‘মেয়েটা কোথায় আছে?’

‘খুব ভালো জায়গায় আছে, স্যার কোনো সমস্যা নেই। আপনি এত দুশ্চিন্তা কইরেন না স্যার। নেন একটা সিগারেট খান।’

‘তুমি এই কাজটা কেন করলে?’

ফতে হেসে ফেলে বলল, মামা করতে বলেছে। এই জন্যে করেছি।

‘বদরুল সাহেব বলেছেন?’

‘জি। মামার হুকুমে লুনাকে এক বাসায় রেখে এসে এমন ভাব করতেছি যেন আমি খুব পেরেশান হয়ে খুঁজতেছি।’

মিসির আলি বললেন, তোমার মামা এই কাজটা কেন করছেন?

ফতে হাই তুলতে তুলতে বলল, মামিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে কাজটা করেছেন। মামি এই বাচ্চাটাকে মাঝে মাঝে মারে। এটা মামার ভালো লাগে না। অসুস্থ একটা বাচ্চা। একে তার মা মারবে কেন? এই জন্যে মামা ঠিক করেছে লুনাকে তিন-চার ঘণ্টা লুকিয়ে রাখবে—যাতে মামি বুঝতে পারে সন্তান কী জিনিস। ঘটনাটা কি এখন বুঝেছেন স্যার?

‘হ্যাঁ বুঝেছি। বাচ্চাটা আছে কোথায়?’

‘বুড়িগঙ্গা নদীতে—নৌকার ভিতরে। সে খুব মজায় আছে। স্যার একটা কাজ করবেন?’

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, বল কী কাজ?

ফতে বলল, আপনি আমার সঙ্গে চলেন। নৌকা থেকে দুজনে মেয়েটাকে নিয়ে আসি।

মিসির আলি বললেন, চল যাই।

ফতে বলল, দুজন একসঙ্গে বের হলে মামি সন্দেহ করবে। স্যার আপনি আগে চলে যান। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের সামনে চায়ের দোকান আছে। ঐখানে বসে চা খান আমি মামিকে বলি লুনাকে খোঁজার জন্যে বের হচ্ছি। এই বলে চলে আসব। আমার পৌঁছতে দশ মিনিটের বেশি দেরি হবে না। স্যার যাবেন?

মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ।

.

এক ঘণ্টার বেশি হয়েছে মিসির আলি অপেক্ষা করছেন। ফতের কোনো দেখা নেই। তিনি দুশ্চিন্তা করা শুরু করেছেন। ফতে লুনা সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে মিসির আলির কাছে মনে হয়েছে এই ব্যাখ্যা ঠিক না। ফতে তাৎক্ষণিকভাবে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। মানসিকভাবে অসুস্থ একটা মেয়েকে রাতের বেলা বুড়িগঙ্গায় নৌকার উপর রাখার কোনো যুক্তি নেই। মেয়েটিকে লুকিয়ে রাখলে তার বাবা তাকে খুব কাছাকাছি কোথাও রাখবে। বুড়িগঙ্গায় নৌকার উপর পাঠাবে না। মিসির আলির মনে হল লুনা মেয়েটি বিপদে আছে। সহজ কোনো বিপদ না। জটিল ধরনের বিপদ। বিপদ ঘটতে খুব দেরিও নেই। মিসির আলি ইয়াসিনের দিকে তাকালেন। ইয়াসিন কী মনে করে যেন তাঁর সঙ্গে এসেছে। ইয়াসিনকে কি লুনার বাবার কাছে চিঠি দিয়ে পাঠাবেন? তিনি অপেক্ষা করবেন ফতের জন্যে—ইয়াসিন চিঠি নিয়ে চলে যাবে বদরুল সাহেবের কাছে। চিঠিতে লেখা থাকবে—আপনার মেয়ের মহাবিপদ। পুলিশে খবর দিন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কী তাঁর মাথায় আসছে না। মাথায় এলে সেটাও চিঠিতে লিখে দিতেন।

স্যার অনেক দেরি করে ফেলেছি?

মিসির আলি চমকে দেখলেন ফতে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

‘জামে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম—এমন জাম শেষে বেবিট্যাক্সি রেখে হেঁটে চলে এসেছি। স্যার চলেন যাই—।’

মিসির আলি কিছু বললেন না, নিঃশব্দে ফতেকে অনুসরণ করলেন। ফতে বলল, সঙ্গে সিগারেট আছে স্যার? না থাকলে নিয়ে নেই। নদীর মাঝখানে সিগারেট টান দিতে বড়ই মজা।

‘সিগারেট সঙ্গে আছে?’

মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, সিগারেট সঙ্গে আছে।

.

ইঞ্জিন লাগানো নৌকা। বেশ বড়সড়। অনেকটা বজরার মতো দরজা-জানালা আছে। নৌকায় কোনো মাঝি নেই। ফতে নিজেই ইঞ্জিন চালু করে নৌকা ছেড়ে দিয়ে বলল— স্যার আপনি ভিতরে যান। লুনা ভেতরে আছে। এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল—এখন মনে হয় জেগেছে।

মিসির আলি বললেন, মেয়েটা একা ছিল নাকি?

ফতে বলল, একাই ছিল। তার কাছে একা যে কথা দোকা তিকাও সেই কথা। যান স্যার মেয়েটার সঙ্গে কথা বলেন—এর মধ্যে আমি নৌকা ঐ পারে নিয়ে যাই।

‘নৌকা ঐ পারে নেবার দরকার কী?’

‘দরকার আছে স্যার। ফতে বিনা প্রয়োজনে কোনো কাজ করে না। ঐ পারে ভিড় নাই।

মিসির আলি দরজা খুলে নৌকার ভেতরে ঢুকলেন। লুনা বসে আছে। তার সামনে লজেন্সের দুটা প্যাকেট। সে প্যাকেট থেকে সব লজেন্সের খোসা ছাড়িয়ে এক পাশে রাখছে। কাজটায় সে খুবই আনন্দ পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে লুনা হাসল। একটা লজেন্স মিসির আলির দিকে বাড়িয়ে দিল।

মিসির আলি বললেন, খুকি তুমি কেমন আছ?

লুনা বলল, ভালো।

‘কী কর?’

‘খেলি।’

‘এই খেলার নাম কী?

‘জানি না।’

লুনা আরেকটা লজেন্স ইয়াসিনের দিকে বাড়িয়ে দিল। ইয়াসিন লজেন্স নিল না। লুনা হাত বাড়িয়েই থাকল। মিসির আলি বুঝতে পারছেন লজেন্স হাত থেকে না নেওয়া পর্যন্ত এই মেয়ে হাত নামাবে না। মেয়েটা খুবই অসুস্থ। তার মস্তিষ্কের কোনো একটা অংশ জট পাকিয়ে গেছে। এই জট কে খুলতে পারে? এমন কোনো বুদ্ধি যদি থাকত মাথার ভেতর ঢুকে জট খোলা যেত। মিসির আলির হঠাৎ করে প্রতিমার কথা মনে পড়ল। প্রতিমা কি এই মেয়েটার জন্যে কিছু করতে পারে।

নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। ফতে দরজা খুলে নৌকায় ঢুকেই দরজা বন্ধ করে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে হাসল। মিসির আলির বুক ধক করে উঠল। এই হাসি তো মানুষের হাসি না। এই হাসি পিশাচের হাসি। ফতে মিসির আলির চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলল—স্যার আপনার তো খুবই বুদ্ধি। বুদ্ধি খাটায়ে বলেন তো—লুনা মেয়েটাকে নিয়ে আমি মাঝনদীতে কেন এসেছি। বলতে পারলে আমি আপনাকে একটা প্রাইজ দিব।

মিসির আলি এখন জানেন ফতে কেন লুনাকে মাঝনদীতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন তার সেই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তিনি ফতের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ইয়াসিনকে বললেন, ‘ইয়াসিন তুমি মেয়েটার হাত থেকে লজেন্সটা নাও। লজেন্স না নেওয়া পর্যন্ত সে হাত উঁচু করে রাখবে।’ ইয়াসিন লজেন্স নিল। লুনা মিষ্টি করে হেসে আবারো লজেন্সের খোসা ছাড়ানোয় মন দিল।

ফতে সিগারেট ধরিয়ে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, স্যার যে কাজটা করতে যাচ্ছি এই কাজ এর আগে আমি আরো চারবার করেছি।

মিসির আলি বললেন, কেন করেছ?

‘করতে খুব মজা লাগে স্যার। আমার হাতের কাজ যে দেখে সে খুবই ভয় পায়। কেউ ভয় পেলে আমি খুব সহজে তার মাথার ভিতর ঢুকে পড়তে পারি। অনেক দূর যেতে পারি। তার মাথা লণ্ডভণ্ড করে ফেলতে পারি। তখন কী যে আনন্দ হয়!’

‘ফতে তুমি যে খুব অসুস্থ একজন মানুষ তা কি তুমি জান?’

‘জানি। তার জন্যে আমার খারাপ লাগে না। আল্লাই আমাকে অসুস্থ করে পাঠিয়েছেন। আমি কী করব।’

‘এক অর্থে তোমার কথা ঠিক। তোমার জিনে কোনো গণ্ডগোল আছে। যে কারণে ভয়াবহ কাণ্ডগুলি হাসিমুখে করছ। তোমার সুস্থ হবার কোনো সুযোগ আছে বলেও আমার মনে হয় না।’

‘আপনার ভয় লাগছে না?’

‘না, ভয় লাগছে না। যে ভয়ঙ্কর ঘটনা তুমি ঘটাবে বলে ভাবছ সেই ঘটনা তুমি ঘটাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না?’

ফতে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, স্যার আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই। আমি যে কোনো মানুষের মাথার ভেতর ঢুকে পড়তে পারি। এখন আপনার এই কাজের ছেলের মাথার ভেতর আমি ঢুকে বসে আছি। এর পকেটে একটা কাচের বোতল আছে। বোতল ভর্তি নাইট্রিক এসিড। আমি যখনই তাকে বলব—ইয়াসিন বোতলের জিনিসটা মিসির আলি সাহেবের গায়ে ঢেলে দে—সে গায়ে ঢেলে দেবে।

ফতে ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে বলল, কীরে ইয়াসিন ঢালবি না? যে মেয়েটার গায়ে ঢালার জন্যে বোতল ভর্তি এসিড নিয়ে ঘুরছিস সে যখন নেই তখন স্যারের গায়ে ঢালবি। পারবি না?

ইয়াসিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ক্ষীণ স্বরে বলল, পারব।

ফতে বলল, তা হলে বোতলটা পকেট থেকে বের করে মুখটা খুলে রাখ।

ইয়াসিন তাই করল। ফতে হাসতে হাসতে বলল, একটু ভয় ভয় লাগছে না স্যার?

মিসির আলি বললেন, না।

‘একটুও লাগছে না?’

‘না।’

মিসির আলি নিজেও বিস্মিত হচ্ছেন। ভয়ঙ্কর একজন মানুষ তাঁর সামনে বসে আছে অথচ তিনি বিচলিত হচ্ছেন না। প্রচণ্ড ভয়ের কোনো কারণ ঘটলে রক্তে এন্ড্রোলিন নামের এনজাইম প্রচুর পরিমাণ চলে আসে। ভয় কেটে যায়। সেরকম কিছু কি ঘটেছে? তিনি ইয়াসিনের দিকে তাকালেন। এসিডের বোতল হাতে সে শক্ত হয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি পুরোপুরি ফতের দিকে। ফতে তাকিয়ে আছে ইয়াসিনের দিকে। মিসির লক্ষ করলেন ফতে যখনই তার দৃষ্টি মিসির আলির দিকে দিচ্ছে—ইয়াসিন তখনই নড়ে উঠছে। তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে ফতে যে দাবি করছে সে মানুষের মাথার ভেতর ঢুকে পড়তে পারে—মাথার ভেতর ঢুকতে তার কি চোখ নামক পথের প্রয়োজন হয়। ইয়াসিন যদি চোখ বন্ধ করে ফেলে তা হলেও কি ফতে তার মাথার ভেতর ঢুকে বসে থাকতে পারবে।

মিসির আলিকে অতিদ্রুত যে কাজটা করতে হবে তা হল ইয়াসিনের হাত থেকে এসিডের বোতলটা নিয়ে নিতে হবে। মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ডাকলেন— ইয়াসিন!

ইয়াসিন তাঁর দিকে তাকাল না। ফতের দিকেই তাকিয়ে রইল। ফতের ঠোঁটের কোনায় ক্ষীণ হাসির রেখা। মিসির আলি দ্রুত চিন্তা করছেন। ফতেকে এক্ষুনি বিভ্রান্ত করতে হবে। চমকে দিতে হবে। মিসির আলি হালকা গলায় বললেন, ফতে শোন তুমি যে ক্ষমতার কথা বলছ এই ক্ষমতা যে আমার নেই তা কী করে বুঝলে?

ফতে চমকে তাকাল।

মিসির আলি বললেন, এস আমার মাথার ভেতর ঢুকে দেখ।

ফতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ তীক্ষ্ণ ও তীব্র। তার মুখ হাঁ হয়ে আছে। ঠোঁট বেয়ে লালার মতো কিছু গড়িয়ে পড়ল। ফতে মিসির আলির মাথার ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছে। অনেকক্ষণ থেকেই করছে। পারছে না। তার নিজেরই সামান্য ভয় ভয় লাগছে। ভয় পাওয়া ঠিক হবে না। সে ভয় পেলে মাথায় ঢুকতে পারবে না। খুব বেশি ভয় পেয়ে গেলে হয়তো উল্টো ব্যাপার ঘটবে। মিসির আলিই তর মাথায় ঢুকে পড়বেন। ফতে ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগল।

মিসির আলি বললেন, তুমি আমার সঙ্গে যে খেলা খেলতে চেয়েছ এই খেলাটা খেলতে পারবে না। আমি খেলায় কয়েকটা দান এগিয়ে আছি।

ফতে বলল, কীভাবে?

আমি এক ঘণ্টা লঞ্চঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলাম না। আমি পুলিশে খবর দিয়েছি।

আপনি মিথ্যা কথা বলছেন।

ফতে আমি তো বোকা না। তুমি আমাকে বোকা ভাবলে কেন? তোমার মতো ক্ষমতা আছে এমন একজন রোগীর আমি চিকিৎসা করেছিলাম, সেও আমাকে বোকা ভাবত। এখনো ভাবে। এজাতীয় ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের প্রধান দুর্বলতা হল এরা অন্য সবাইকে বোকা ভাবে। তুমি কি এখনো আমাকে বোকা ভাবছ?

ফতে শীতল গলায় বলল, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন, আপনি পুলিশকে খবর দেন নাই।

মিসির আলি বললেন, ফতে তুমি বোধ হয় লক্ষ কর নি ইয়াসিনের হাতে যে বোতলটা ছিল—সে বোতলটা এখন আমার হাতে। পুলিশের বাঁশির আওয়াজ তুমি এক্ষুনি শুনবে।

মিসির আলির কথা শেষ হবার আগেই—পরপর দুবার বাঁশি বেজে উঠল। নৌকা দুলে উঠল। ফতে ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল।

মিসির আলি বললেন, এটা পুলিশের বাঁশির শব্দ না। লঞ্চ ছাড়ছে—ভেঁপু দিচ্ছে। ফতে তুমি ভয়ঙ্কর ভয় পেয়েছ।

ফতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আপনি পুলিশে খবর দেন নাই।

মিসির আলি বললেন, তুমি ঠিকই বলছ। আমি পুলিশে খবর দেই নি। পুলিশের কথা বলেছি তোমার ভিতর ভয়ের বীজ ঢুকিয়ে দেবার জন্যে। ভয়ের বীজ ঢুকে গেছে। সত্যি করে বল ফতে তোমার ভয় লাগছে না?

‘না।’

মিথ্যা কথা বলার দরকার নেই ফতে। আমি যেমন সত্যি কথা বলছি তুমিও সত্যি কথা বল। তীব্র ভয়ে অস্থির হলে মানুষের যেসব শারীরিক পরিবর্তন হয় তার সবই তোমার হচ্ছে। তোমার শরীর কাঁপছে। তোমার চোখের মণি বড় বড় হয়ে গেছে। পুলিশকে তো আমি খবর দেই নি। তুমি কাকে ভয় পাচ্ছ?

‘আপনাকে।’

আমার হাতে এসিডের বোতল এই জন্যে ভয় পাচ্ছ? শোন ফতে আমার পক্ষে কোনো অবস্থাতেই কারো গায়ে এসিড ছুড়ে ফেলা সম্ভব না। এই দেখ বোতলটা আমি পানিতে ফেলে দিচ্ছি। তাতেও কিন্তু তোমার ভয় কমবে না।

ফতে ঢোক গিলল। মিসির আলি নামের মানুষটা সত্যি সত্যি বোতলটা ফেলে দিয়েছে। মানুষটার দুর্দান্ত সাহস। এত সাহস সে পেল কোথায়। ফতে যেখানে বসেছে তার নিচেই বড় একটা ধারালো ছুরি আছে। হাত নামিয়ে সে কি ছুরিটা নেবে।

‘ফতে!’

‘জি।’

‘তুমি ভয়ঙ্কর অসুস্থ একজন মানুষ। তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার। প্রতিমার সাহায্য নিয়ে আমি তোমার চিকিৎসা করার চেষ্টা করতে পারি। তুমি কি চাও আমি তেমার চিকিৎসা করি?’

‘না।’

‘তোমাকে তো ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না ফতে। তোমাকে ছেড়ে দিলে তুমি ভয়ঙ্কর সব অপরাধ করবে। আমি তা হতে দিতে পারি না।’

লুনা আরেকটা লজেন্সের খোসা ছাড়িয়ে ফতের দিকে ধরে আছে। মিসির আলি বললেন, ফতে লজেন্সটা ওর হাত থেকে নাও। লজেন্স না নেওয়া পর্যন্ত সে হাত উঁচু করেই রাখবে।

ফতে লজেন্স নিল।

মিসির আলি বললেন, চল নৌকার পাটাতনে গিয়ে দাঁড়াই। তুমি বলেছিলে মাঝনদীতে সিগারেট টানতে খুব মজা—দেখি আসলেই মজা কি না। ফতে কোনোরকম আপত্তি করল না, মিসির আলির সঙ্গে নৌকার পাটাতনে এসে দাঁড়াল।

মিসির আলি বললেন, ফতে তুমি কি পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার কথা চিন্তা করছ? ফতে চমকে উঠে বলল, আপনি কীভাবে বললেন?

মিসির আলি বললেন, অনুমান করে বলছি। আমার কারো মাথায় ঢোকার ক্ষমতা নেই। তবে আমি খুব ভালো অনুমান করতে পারি। সেই অনুমানটা মাথায় ঢোকার মতোই। ফতে তুমি পানিতে ঝাঁপ দিও না। পানি অতিরিক্ত ঠাণ্ডা হবার কথা।

আর স্রোতও বেশি। তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। ফতে ঠিকই বলেছে মাঝনদীতে সিগারেট ধরাবার আনন্দই আলাদা। আনন্দের সঙ্গে তিনি গাঢ় বিষাদও অনুভব করছেন। বিষাদের কারণটা তিনি ধরতে পারছেন না। নৌকার ভেতরে লুনা মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। আশ্চর্য প্রতিমাও ঠিক এ রকম করেই হাসে।

3 Comments
Collapse Comments

I love misir Ali series!it’s very amazing to get some good authors’ books for free!I am very delighted

Thanks for your feedback. <3

সিমান্ত জয় July 22, 2022 at 6:31 pm

গল্পটি বেশ ভালো ছিল।বাংলা লাইব্রেরিকে অবশ্যই অনেক ধন্যবাদ।তবে আমি আশা রাখব তারা যেন তাদের লেখার মান আরোও উন্নত করে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *