ফ্রুট ফ্লাই

ফ্রুট ফ্লাই

মিসির আলি সাহেবের পেটমোটা ফাইল আছে। ফাইলের ওপর ইংরেজিতে লেখা— Unsolved. যেসব রহস্যের তিনি মীমাংসা করতে পারেন নি তার প্রতিটির বিবরণ। আমি কয়েকবার তাঁর ফাইল উল্টেপাল্টে দেখেছি। কোনো কিছুই পরিষ্কার করে লেখা নেই। নোটের মতো করে লেখা। উদাহরণ দেই—একটি অমীমাংসিত রহস্যের (নম্বর ১৮) শিরোনাম ‘BRD’. ‘BRD’ কী জিজ্ঞেস করে জানলাম BRD হল বেলা রানী দাস। মিসির আলি লিখেছেন—–

বয়স ১৩

বুদ্ধি ৭

বটগাছ ১০০

বজ্ৰপাত ২

BRD বটগাছ Union

কপার অক্সাইড

আমি বললাম, যা লিখেছেন এর অর্থ কী? বয়স ১৩ বুঝতে পারছি। বেলা রানী দাসের বয়স তের। বুদ্ধি ৭-এর অর্থ কী?

মিসির আলি বললেন, বুদ্ধি মাপার কিছু পরীক্ষা আছে। IQ টেস্ট। এই টেস্ট আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না। আইনস্টাইনের মতো মানুষ IQ টেস্টে হাস্যকর নাম্বার পেয়েছিলেন। আমি নিজে এক ধরনের পরীক্ষা করে বুদ্ধির নাম্বার দেই। সেই নাম্বারের সর্বনিম্ন হল এক সর্বোচ্চ দশ। আমার হিসাবে বেলা রানীর বুদ্ধি ছিল সাত।

আমি বললাম, আপনার হিসাবে আমার বুদ্ধি কত?

মিসির আলি হাসতে হাসতে বললেন, ছয়ের কাছাকাছি। তবে এতে আপসেট হবেন না। মানুষের গড় বুদ্ধি পাঁচ। তা ছাড়া আপনি লেখক মানুষ। ক্রিয়েটিভ মানুষদের সাধারণ বুদ্ধি কম থাকে।

আমি বললাম, আমার বুদ্ধি কম এটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। ‘বটগাছ ১০০- এর অর্থ কী?’

একটা বটগাছের কথা বলেছি যার আনুমানিক বয়স ধরেছি ১০০ বছর।

বজ্রপাত ২ মানে?

বটগাছে দু’বার বজ্রপাত হয়েছিল। শেষ বজ্রপাতে বটগাছটা মারা যায়।

BRD বটগাছ Union-টা ব্যাখ্যা করুন

বেলা রানীর বাবা-মা তাদের মেয়েটাকে একটা বটগাছের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। হিন্দুদের কিছু বিচিত্র আচার আছে। গাছের সঙ্গে বিয়ে তার একটা। এখন যদিও এই প্রথা নেই। তারপরেও বেলা রানীর বাবা-মা কাজটা করেছিলেন।

কপার অক্সাইড কী?

কপার ধাতুর সঙ্গে অক্সিজেনের যৌগ—CuO.

গল্পটা বলুন।

না।

না কেন?

কিছু কিছু গল্প আছে বলতে ইচ্ছা করে না। এটা সেরকম এটা গল্প। সব গল্প জানানোর জন্য না।

আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি এই গল্প আমি কোথাও লিখব না। কাউকে বলবও না।

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, না।

তাঁর ‘না’ বলার বিশেষ একটা ভঙ্গি আছি। এই ভঙ্গিতে যখন না বলে ফেলেন তখন তাঁকে আর হ্যাঁ বানানো যায় না। আমি হাল ছেড়ে দিলাম।

মিসির আলি বললেন, অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে গল্প করা ঠিক না। এতে মানুষ Confused হয়ে যায়। ঘটনার ওপর নানান আধ্যাত্মিকতা আরোপ করে। চলে আসে ভূত-প্রেত। সাধু-সন্ন্যাসী।

আমি বললাম, ভূত-প্রেত বাদ দিলাম, সাধু-সন্ন্যাসীরা তো আছেন। নাকি তাঁদের অস্তিত্বেও আপনার অবিশ্বাস?

মিসির আলি বললেন, অবিশ্বাস। ধর্ম হল পরিপূর্ণ বিশ্বাস। আর বিজ্ঞান হল পরিপূর্ণ অবিশ্বাস। ধর্মের বিশ্বাস শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই থাকে। বিজ্ঞানের অবিশ্বাস কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বদলায়। কিছু কিছু অবিশ্বাস বিশ্বাসে রূপ নেয়।

আপনি তো একজন সাইকোলজিস্ট, বিজ্ঞানী না।

মিসির আলি বললেন, মানুষ মাত্রই বিজ্ঞানী। অবিশ্বাস করা তার Nature-এর অংশ। সে জঙ্গলে হাঁটছে। একটা সাপ দেখল। সে শুরু করল অবিশ্বাস দিয়ে দড়ি না তো? নাকি সাপ?

আবার সে পথে হাঁটতে হাঁটতে একটা দড়ি দেখল। সে শুরু করল অবিশ্বাস দিয়ে—সাপ না তো? নাকি দড়ি। চা খাবেন?

খাব।

ঘরে শুধু চা পাতা আছে। আর কিছুই নেই। লিকার চা চলবে?

চলবে।

মিসির আলি রান্নাঘরে ঢুকলেন এবং বের হয়ে এসে জানালেন, চা পাতাও নেই। চলুন কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে চা খেয়ে আসি।

আমি বললাম, রেস্টুরেন্টে যেতে ইচ্ছা করছে না। আপনার সঙ্গে নিরিবিলি গল্প করছি এই ভালো।

সময় রাত আটটা। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। মিসির আলির ঘরের চাল টিনের। চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে ভালো লাগছে। ঢাকা শহরে সেই অর্থে কখনো বৃষ্টির শব্দ কানে আসে না। শহরের কোলাহল বৃষ্টির শব্দ গিলে ফেলে।

মিসির আলি বললেন, হাবলু মিয়ার গল্প শুনবেন?

আমি বললাম, গল্পটা যদি আপনার Unsolved খাতায় থাকে তা হলে শুনব। আপনার মতো মানুষ রহস্যের কাছে ধরা খেয়ে গেছেন ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং।

মিসির আলি বললেন, হাবলু মিয়ার গল্প আমার Unsolved ফাইলে আছে। ৩৮ নম্বর।

সব গল্পের নাম্বার আপনার মনে থাকে?

তা থাকে। ফাইলটা নিয়ে আমি প্রায়ই বসি। রহস্যের কিনারা করা যায় কি না তা নিয়ে ভাবি। এখনো হাল ছাড়ি নি। হাল ধরে বসে আছি। অকূল সমুদ্র। নৌকা কোন দিকে নিয়ে যাব বুঝতে পারছি না।

হাবলু মিয়ার গল্পটা শুরু করুন।

মিসির আলি গল্প শুরু করলেন। সাধারণত দেখা যায় শিক্ষকরা ভালো গল্প বলতে পারেন না। তাঁদের গল্প ক্লাসের বক্তৃতার মতো শোনায়। যিনি গল্প শোনেন কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর হাই ওঠে। এক পর্যায়ে শ্রোতা বলেন, ভাই, বাকিটা আরেক দিন শুনব। আজ একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। এখন না গেলেই না।

মিসির আলি শিক্ষক গল্পকথকের দলে পড়েন না। তাঁর বর্ণনা সুন্দর। গল্পের কোন জায়গায় কতক্ষণ থামতে হবে তা জানেন। পরিবেশ এবং চরিত্র বর্ণনা নিখুঁত। আমার প্রায়ই মনে হয় মিসির আলির মুখের গল্প CD আকারে বাজারে ছেড়ে দিলে ভালো বাজার পাওয়া যাবে। যাই হোক, তাঁর জবানিতে গল্পটা বলার চেষ্টা করি।

.

হাবলু মিয়ার বয়স কত বলতে পারছি না। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসিমুখে বলল, জানি না স্যার। বাপ-মা কিছু বইলা যায় নাই। মুরুক্কু পিতামাতা। এইসব জানেও না। আপনে একটা অনুমান কইরা নেন।

আমি অনুমান করতে পারলাম না। কিছু মানুষ আছে যাদের বয়স বোঝা যায় না। হাবলু মিয়া সেই দলের। তার বয়স পঁচিশ হতে পারে, আবার চল্লিশও হতে পারে। অতি রুগ্‌ণ মানুষ। খকখক কাশি লেগেই আছে। গায়ের রঙ একসময় ফর্সা ছিল। রোদে ঘুরে রঙ জ্বলে গেছে। মাথা সম্পূর্ণ কামানো। গায়ে কড়া নীল রঙের পাঞ্জাবি। পরনের লুঙ্গির রঙ একসময় খুব সম্ভবত সাদা ছিল। ময়লার আস্তর পড়ে এখন ছাইবর্ণ। পায়ে চামড়ার জুতা। জুতাজোড়া নতুন। চকচক করছে। লোকটার গা থেকে বিকট গন্ধ আসছে। আমি বললাম, গাঁজা খাবার অভ্যাস আছে?

হাবলু মিয়া আবার দাঁত বের করে হাসিমুখে বলল, জি স্যার।

আজ খেয়েছেন?

জে না। দিনে খাই না। সবকিছুর নিয়ম আছে। গাঁজা খাইতে হয় সূর্য ডোবার পরে। চরস খাইতে হয় দুপুরে।

লেখাপড়া কিছু করেছেন?

ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি। ক্লাস ফাইভ পাস করার ইচ্ছা ছিল। একদিন হেডস্যার বললেন, তোর আর লেখাপড়া লাগবে না। তুই চলে যা।

চলে যেতে বললেন কেন?

সেটা উনারে জিগাই নাই। শিক্ষক মানুষরে তো আর জিজ্ঞাসা করা যায় না। উনাদের কথা মান্য করতে হয়। উনাদের আলাদা মর্যাদা।

আপনার পায়ের জুতাজোড়া তো নতুন মনে হচ্ছে।

হাবলু মিয়া আনন্দিত গলায় বলল, চুরির জুতা স্যার। আমি নিজেই চুরি করেছি। কীভাবে চুরি করেছি শুনলে মজা পাবেন। স্যার বলব?

বলুন।

আমারে স্যার তুমি কইরা বলবেন। আমি অতি নাদান লোক। আপনের নাকের সর্দির যোগ্যও না। তার চেয়েও অধম। জুতাচুরির গল্পটা কি শুরু করব?

শুরু কর।

জুম্মার নামাজ শুরু হইছে। আমি সোবাহান মসজিদের কাছে। রাস্তা বন্ধ কইরা নামাজ। শেষ সারিতে দেখি এক লোক তার সামনে নয়া জুতা রাইখা নামাজ পড়তাছে। আমি তার সামনে থাইকা জুতাজোড়া নিলাম। সে নামাজের মধ্যে ছিল বইলা আমারে কিছু বলতে পারল না। একবার তাকাইলো। আমি ঝাইড়া দৌড় দিলাম। আমার ভাগ্য ভালো জুতাজোড়া ভালো ফিটিং হইছে। চুরির জুতা ফিটিং-এ সমস্যা।

জুতা কি প্রায়ই চুরি কর?

জে। একেকবার একেক মসজিদে যাই। বনানী মসজিদ থেকে একজোড়া স্যান্ডেল চুরি করেছিলাম। বিলাতি জিনিস, দুইশ’ টাকায় বিক্রি করেছি। এখন আপশোস হয়।

আপশোস হয় কেন?

নিজের ব্যবহারের জন্য রেখে দিতে পারতাম। স্যান্ডেলে আরাম বেশি। একটু পানের ব্যবস্থা কি করা যায় স্যার? জর্দা লাগবে না। জর্দা আমার সঙ্গে আছে। গোপাল জর্দা। গোপাল জর্দা ছাড়া অন্য জর্দা আমার মুখে রুচে না।

দিনে কয়টা করে পান খাও?

তার কি স্যার হিসাব আছে। ভাতের হিসাব থাকে। দৈনিক দুই বার কি তিন বার। পান এবং চা এই দুইয়ের হিসাব নাই।

পানের ব্যবস্থা করছি, এখন বল তুমি যে জুতা চুরি কর খারাপ লাগে না।

খারাপ লাগে না স্যার, মজা পাই। ইন্টারেস্ট পাই। বাঁইচা থাকতে হইলে ইন্টারেস্ট লাগে। ঠিক বলেছি স্যার?

হুঁ।

পানের ব্যবস্থা তো স্যার এখনো করেন নাই? অস্থির লাগতেছে।

সে পান ছাড়াই বেশ খানিকটা জর্দা মুখে দিয়ে চিবুতে লাগল।

.

হাবলু মিয়ার সঙ্গে আমার যোগাযোগের বিষয়টা এখন পরিষ্কার করি। তাকে পাঠিয়েছে আমার এক ছাত্র। হাবলু মিয়ার নাকি অদ্ভুত এক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা। যে কোনো ফলের নাম বললেই সে দুই হাত মুঠিবদ্ধ করে। মুঠি খুললেই সেই ফল হাতে দেখা যায়। যে মুঠিবদ্ধ করে ফল আনতে পারে সে পানও আনতে পারে। পানটা সে কেন আনছে না, বুঝলাম না।

আমি আমার ছাত্রের কথায় কোনোই গুরুত্ব দেই নি। সহজ হাতসাফাই বোঝাই যাচ্ছে। যেসব ফলের নাম চট করে মানুষের মাথায় মনে আসে সেই সব বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয়। যথাসময়ে বের করা হয়।

ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করে বলি। একজন বুজরুক আমাকে বলল, স্যার যে কোনো একটা ফুলের নাম বলুন। যে ফুলের নামই বলবেন সেই ফুল আমি পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে দেব।

আমি বললাম, দুপুরমণি ফুল। তুমি বের কর।

সে বলল, স্যার পারলাম না। দুপুরমণি ফুলের নামই শুনি নাই। আজ প্রথম শুনলাম।

আমি বললাম, তোমার পাঞ্জাবির পকেটে আছে গোলাপ ফুল। তুমি এই খেলাটা গোলাপ ফুল নিয়েই দেখাও। কারণ দশজন মানুষের মধ্যে সাতজনই বলবে গোলাপ ফুলের কথা।

বুজরুক মাথা চুলকে বলল, স্যার কথা সত্য বলেছেন। মাটি খাই। তয় স্যার শুধু গোলাপ রাখি না। রজনীগন্ধাও রাখি। আজকাল অনেকেই রজনীগন্ধার কথা বলে।

যাই হোক, আমাদের হাবলু মিয়াকে আমি সেই দলেই ফেলেছি। লোকটার চোখই বলে দিচ্ছে সে মহাধূর্ত। অনেককে ধোঁকা দিয়ে এখন সে এসেছে আমার কাছে।

ঘরে পান ছিল না। দোকান থেকে পান আনিয়ে তাকে দিয়েছি। দুই খিলি পান একসঙ্গে মুখে পুরে সে জড়ানো গলায় বলল, স্যার কী খেতে চান বলেন, এনে দেই। সে হাত মুঠি করল।

আমি বললাম, একটা আখরোট এনে দাও।

হাবলু মিয়া বিস্মিত গলায় বলল, আখরোট কী জিনিস?

এক ধরনের বাদাম।

জীবনে স্যার নাম শুনি নাই।

আমি বললাম, আমাকে তা হলে খাওয়াতে পারছ না?

হাবলু মিয়া বলল, কেন পারব না স্যার! আপনি খাবেন। আমিও একটু খায়া দেখব। তবে স্বাদ পাব বলে মনে হয় না। পান-জর্দা খায়া জিবরা নষ্ট। যাই খাই ঘাসের মতো লাগে। একবার নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি খাওয়ার শখ হল। খায়া দেখি সেইটাও ঘাসের মতো। মিষ্টির বংশ নাই। আমার কাছে এখন চিনিও যা, লবণও তা।

কথা শেষ করে হাবলু মিয়া হাতের মুঠি খুলল। তার হাতে দু’টা আখরোট। সে বিস্মিত হয়ে আখরোট দেখছে। আমি মোটামুটি হতভম্ব। হাবলু মিয়া বলল, জিনিসটা ভাঙে ক্যামনে? দাঁত দিয়া?

হাবলু মিয়া কামড়াকামড়ি শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আখরোটের শক্ত খোসা ভাঙল। হাবলু মিয়া বাদাম ভেঙে মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, কোনো স্বাদ নাই। শুকনা খড়ের মতো।

আমি বললাম, এখন কি অন্য কোনো ফল আনা যাবে?

হাবলু বলল, অবশ্যই। ফলের নাম বলেন। তবে স্যার হাতের মুঠার চেয়ে বড় ফল হইলে পারব না। তরমুজ আনতে পারব না। কলা পারব না।

আমি বললাম, আম আনতে পারবে? ছোট সাইজের আম তো আছে।

আম পারব। আম অনেকবার আনছি।

হাবলু মিয়া দুই হাত (ডান হাতের উপর বাম হাত রেখে) মুঠির মতো করল। চোখ বন্ধ করল। সামান্য ঝাঁকি দিয়ে মুঠি খুলল—আম সেখানে আছে। সে আমার হাতে আম দিতে দিতে বলল, খেয়ে দেখেন স্যার মিষ্টি আছে কি না। মধুর মতো মিষ্টি হওয়ার কথা। মাঝে মাঝে টকও হয়। একবার একটা আম আসছে—’কাক দেশান্তরী’ আম। এমন টক যে কাক খাইলে দেশান্তরী হবে। স্যার, আমার খেলা দেখে খুশি হয়েছেন?

খুশি হয়েছি। এটা কি কোনো খেলা?

স্যার দুনিয়াটাই তো খেলা। বিরাট খেলা। ক্রিকেট খেলা। কেউ সেঞ্চুরি করতেছে, কেউ আমার মতো শূন্য পায়া আউট। আবার কেউ কেউ আছে ব্যাটিং করার সুযোগ পায় না। না খেইলাই আউট।

ফলগুলো আসে কীভাবে?

স্যার, বললাম না খেলা। খেলার মাধ্যমে আসে।

খেলছে কে?

সেটা তো স্যার বলতে পারব না। জ্ঞান-বুদ্ধি নাই। ক্লাস ফাইভ পাস করার শখ ছিল। পারলাম না। স্যার, ঘরে কি ছুরি আছে?

ছুরি দিয়ে কী করবে?

আমটা কাইট্যা একটা ছোট্ট পিস খায়া দেখতাম। মিষ্টি কি না। যদিও মন বলতেছে মিষ্টি। তয় মনের কথা বনে যায়।

আমি ছুরি আনলাম। এক পিস হাবলু মিয়া খেল। এক পিস আমি খেলাম। আম মিষ্টি। কড়া মিষ্টি।

হাবলু আনন্দিত গলায় বলল, ইজ্জত রক্ষা হইছে। আম মিষ্টি। টক হইলে আপনের কাছে বেইজ্জত হইতাম। স্যার, ইজাজত দেন, উঠি?

আরেকবার আসতে পারবে?

কেন পারব না! যেদিন বলবেন সেদিন আসব। শুক্রবারটা বাদ দিয়া। ঐ দিন জুতা চুরি করি। স্যার কিছু খরচ দিবেন। খেলা দেখাইলাম এই জন্য খরচ।

তোমার এই খেলা দেখিয়ে তুমি টাকা নাও?

জে নেই। আমার কোনো দাবি নাই। যে যা দেয় নেই।

সবচেয়ে বেশি কত পেয়েছ?

পাঁচশ একবার পাইছিলাম। স্যারের নাম ভুইল্যা গেছি। মুসুল্লি মানুষ। নুরানি চেহারা। সেই মুরুব্বি ভাবছে আমি জিনের মাধ্যমে আনি। আমি স্বীকার পাইছি। তার ভাবনা সে ভাববে। আমার কী?

মুরুব্বি বলল, হাবলু মিয়া তোমার কি জিন আছে?

আমি বললাম, জে স্যার আপনের দোয়ায় আছে।

মুরুব্বি বলল, জিন কয়টা।

আমি বললাম, দুইটা। একটা মাদি আরেকটা মর্দ। মদটার নাম জাহেল। ফল- ফুরুট সেই আনে।

মুরুব্বি আমার কথা সবই বিশ্বাস পাইছে। আমারে বখশিশ দিছে পাঁচশ টেকা।

আমি বললাম, তুমি জিনের মাধ্যমে আনো না?

জে না।

কীভাবে আনো?

স্যার আপনারে তো আগে বলেছি। এইটা একটা খেলা।

খেলাটা তোমাকে কে শিখিয়েছে?

নিজে নিজেই শিখছি। কীভাবে শিখলাম সেটা শুনেন। ফার্মগেটের সামনে দিয়ে যাচ্ছি, দেখি এক লোক পিয়ারা বিক্রি করতেছে। হাতে টাকা নাই। টাকা থাকলে কিনতাম। হঠাৎ কী মনে করে হাত মুঠা করলাম। মুঠা খুলে দেখি পিয়ারা। স্যার কিছু খরচ কি দেবেন? যা দিবেন তাতেই খুশি। পঞ্চাশ একশ দুইশ…।

আমি তাকে এক হাজার টাকা দিলাম। পাঁচশ টাকার দু’টা নোট পেয়ে সে হতভম্ব। তাকে বললাম পরের বুধবারে আসতে। সে বলল, সকাল দশটা বাজার আগেই বান্দা হাজির থাকবে। যদি না থাকি তাইলে মাটি খাই। কব্বরের মাটি খাই।

আমি বললাম, ফল ছাড়া অন্য কিছু আনতে পারো না?

হাবলু বলল, জে না।

চেষ্টা করে দেখেছ?

অনেক চেষ্টা নিয়েছি। লাভ হয় নাই। একবার জর্দার শর্ট হইল। হাতে নাই পয়সা। জর্দা কিনতে পারি না। জর্দা বিনা পানও খাইতে পারতেছি না। শরীর কষা হয়ে গেছে। তখন অনেকবার হাত মুঠা করলাম। মনে মনে বললাম, আয় জর্দা আয়। মুঠা খুইল্যা দেখি কিছু না। সব ফক্কা।

.

মিসির আলি থামলেন। আমি বললাম, ঐ লোক উপস্থিত থাকলে ভালো হত। হাত মুঠি করত। বাগানের ফ্রেশ চা চলে আসত। চা খাওয়া যেত। এমন জমাটি গল্প চা ছাড়া চলে না। ঘরে ফ্লাস্ক আছে? ফ্লাস্ক দিন আমি দোকান থেকে চা নিয়ে আসছি।

মিসির আলি বললেন, চা আনতে হবে না। চা চলে আসবে।

আমি বললাম, শূন্য থেকে আবির্ভূত হবে? হাবলু মিয়ার মতো?

মিসির আলি বললেন, না। চা-শিঙাড়া বাড়িওয়ালা পাঠাবেন। একটা বিশেষ দোকানের শিঙাড়া তাঁর খুবই পছন্দ। প্রায়ই গাদাখানিক কিনে আনেন। আমাকে পাঠান। তাঁকে শিঙাড়ার ঠোঙা নিয়ে এইমাত্র বাসায় ঢুকতে দেখলাম।

মিসির আলির কথা শেষ হবার আগেই একটা কাজের ছেলে ফ্লাস্কভর্তি চা এবং ছয়টা শিঙাড়া নিয়ে ঢুকল। শিঙাড়া সাইজে ছোট। অসাধারণ স্বাদ। যে দোকানে এই জিনিস তৈরি হয় তার কোটিপতি হয়ে যাবার কথা।

আমি চা খেতে খেতে বললাম, তারপর? বুধবার ঐ লোক এল?

না।

কবে এসেছিল?

আর আসেই নি।

বলেন কী?

আমার ধারণা মারা গেছে। পত্রিকায় একটা নিউজ পড়েছিলাম—মুসল্লিদের হাতে জুতাচোরের মৃত্যু। সেই জুতাচোর আমাদের হাবলু মিয়া তাতে সন্দেহ নেই।

আমি বললাম, আপনি তো গল্পের শেষটা জানতে পারলেন না।

না।

গল্প কি এখানেই শেষ?

এখানে শেষ না। কিছুটা বাকি আছে।

আর বাকি কী থাকবে? গল্পের যে কথক সে-ই মৃত। গল্প কি থাকবে?

মিসির আলি বললেন, আমটা তো আছে। পাখি চলে গেছে কিন্তু পাখির পালক তো ফেলে গেছে। আমটা হল পাখির পালক।

আমি বললাম, পাখির পালক, অর্থাৎ আমটা দিয়ে কী করলেন?

মিসির আলি বললেন, একজন ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। আম তৈরিতে হয়তো ম্যাজিকের কিছু গোপন কৌশল আছে যা আমার জানা নেই। আটলান্টিক সিটিতে একবার একটা ম্যাজিক শো দেখেছিলাম। সেখানে ম্যাজিশিয়ান ফুলের টবে একটা আমের আঁটি পুঁতলেন। রুমাল দিয়ে ঢাকলেন। রুমাল সরালেন, দেখা গেল আম গাছের চারা বের হয়েছে। আবার সেই চারা রুমাল দিয়ে ঢাকলেন। রুমাল সরালেন, দেখা গেল গাছভর্তি আম। এই ধরনের কোনো কৌশল কি হাবলু মিয়া করেছে?

আমার ম্যাজিশিয়ান বন্ধু আমের পুরো ঘটনা শুনে বললেন, হিপনোটিক সাজেশান হতে পারে। হিপনোটিক সাজেশান মাঝে মাঝে এত গভীর হয় যে সামান্য মাটির দলাকে আম বা অন্য যে কোনো ফল মনে হবে। হিপনোটিস্ট যদি বলেন আমটা মিষ্টি তা হলে মাটির দলা মুখে দিলে মিষ্টি লাগবে। হিপনোটিস্ট যদি বলেন, আমটা টক তা হলে মাটির দলার স্বাদ হবে টক। তবে এই অবস্থা বেশি সময় থাকবে না। Trance অবস্থা কেটে গেলে মাটির দলাকে মাটির দলাই মনে হবে।

আমাকে দেয়া আমটা মাটির দলা বা অন্যকিছু হয়ে গেল না। আমই রইল। তৃতীয় দিনে আমি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আবিষ্কার করলাম।

সেটা কী?

মিসির আলি বললেন, Fruit fly বিষয়ে আপনার কোনো জ্ঞান আছে?

আমি বললাম, পাকা ফলের উপর ছোট ছোট যেসব পোকা ওড়ে তার কথা বলছেন?

মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ। এরা এক ইঞ্চির আট ভাগের এক ভাগ লম্বা। চোখ লাল। শরীরের প্রথম অংশ লালচে, শেষ অংশ কালো। পাকা ফল যা Farmented হচ্ছে তার উপর এরা ডিম পাড়ে। এক একটি স্ত্রী ফ্রুট ফ্লাই পাঁচশ’র মতো ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বাচ্চা হতে সময় নেয় এক সপ্তাহ। আমার গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটা হচ্ছে তিন দিন পার হবার পরেও আমের উপর কোনো ফ্রুট ফ্লাই উড়ছে না। অর্থাৎ আমে পচন ধরছে না।

যে সময়ের কথা বলছি তখন আমের সিজন না। তবে ফল চাষে হয়তো কোনো বড় ধরনের বিপ্লব হয়েছে। সব ঋতুতেই সব ধরনের ফল পাওয়া যায়। আমি বাজার থেকে একটা পাকা আম কিনে আনলাম। জাদুর আম থেকে এক ফুট দূরে সেটা রাখলাম। এক ঘণ্টা পার হবার আগেই কেনা আমকে ঘিরে ফ্রুট ফ্লাই ওড়াউড়ি শুরু করল। এদের কেউ ভুলেও জাদুর আমের কাছে গেল না।

মিসির আলি বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন। আমি বললাম, গল্প কি শেষ?

মিসির আলি বললেন, একটু বাকি আছে। আজই শুনবেন নাকি অন্য একদিন আসবেন? বৃষ্টি থেমে গেছে। এখন চলে যাওয়াই ভালো। রাত অনেক হয়েছে।

আমি বললাম, শেষটা শুনে যাব। তার আগে না।

মিসির আলি বললেন, আন্টার্কটিকা মহাদেশে একবার উল্কাপাত হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে NASA-র জনসন স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের বিজ্ঞানীরা সেই উল্কা পরীক্ষা করেন। উল্কার নম্বর হচ্ছে ALIT৪4001.

আমি বললাম, নাম্বার মনে রাখলেন কীভাবে?

মিসির আলি বললেন, জাদুর আম নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এইসব জানতে হয়েছে। আমার Unsolved খাতায় নাম্বার লেখা আছে।

আমি বললাম, উল্কার সঙ্গে আপনার জাদুর আমের সম্পর্ক কী?

মিসির আলি বললেন, ঘটনাটা বলে শেষ করি। তারপর আপনি বিবেচনা করবেন সম্পর্ক আছে কি না।

বলুন।

বিজ্ঞানীরা সেই উল্কার কিছু Organic অণু পেলেন। জটিল কোনো অণু না। Polycyclic arormatic hydrocarbon. বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করলেন এই অণুগুলো পৃথিবী নামক গ্রহের না, গ্রহের বাইরের। কারণ এরা ছিল Levorotatory. পৃথিবী নামক গ্রহের সব Organic অণু হয় Dextrorotator. অর্থাৎ এরা Plain polarized light ডান দিকে ঘুরায়। বিজ্ঞানীরা অতি সহজ একটা পরীক্ষা থেকে বলতে পারেন কোনো বস্তু এই পৃথিবীর নাকি পৃথিবীর বাইরের।

আমি বললাম, আপনি আমটি পৃথিবীর না পৃথিবীর বাইরের এই পরীক্ষা করলেন?

মিসির আলি বললেন, এই ধরনের পরীক্ষা করার মতো যোগ্যতা বা যন্ত্রপাতি কোনোটাই আমার নেই। তবে আমি আমের শাঁস সিল করা কৌটায় ইতালির এন্থন ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়েছিলাম। তারা জানালেন এই ফলটির রস Levorotatory. অর্থাৎ এর Origin পৃথিবী নামক গ্রহ না।

বলেন কী?

মিসির আলি বললেন, একটা ছোট্ট পরীক্ষা অবিশ্যি আমি নিজেই করলাম। একটা টবে যত্ন করে আমের আঁটিটা পুঁতলাম। সেখান থেকে গাছ হয় কি না তাই দেখার ইচ্ছা।

হয়েছিল?

মিসির আলি বললেন, সেটা বলব না। কিছু রহস্য থাকুক। রহস্য থাকলেই গল্পটা আপনার মনে থাকবে। মানুষ রহস্যপ্রিয় জাতি। সে শুধু রহস্যটাই মনে রাখে, আর কিছু মনে রাখতে চায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *