এলেম শ্যামদেশে

এলেম শ্যামদেশে

শ্যামদেশের আমি নাম দিয়েছি ‘গা-টেপাটেপির দেশ’। যে-দেশের প্রধান পণ্য Massage, সে-দেশের এই নাম খুব খারাপ নাম না। ‘থাই ম্যাসাজ পৃথিবীর সেরা’ বলে কোনো জাতি সে অহঙ্কার করতে পারে এই ধারণাই আমার ছিল না। সব নাকবোচা জাতির কাছে কি এই দলাইমলাই অতি গুরুত্ত্বপূর্ণ? খাড়া নাকের মানুষদের মধ্যে তো এই প্রবণতা নেই।

মঙ্গোলীয় জাতি ঘোড়া নির্ভর ছিল। ঘোড়াকে প্রতিদিন দলাইমলাই করতে হতো। ব্যাপারটা কি সেখান থেকে এসেছে? ঘোড়ায় চড়ে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় শরীর ব্যথা। সেই ব্যথা সারাবার জন্যে ম্যাসাজ। ঘোড়ায় চড়ে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তার দলাইমশাই রেখে গেছে, ব্যাপারটা কি এরকম? পাখি চলে গেছে কিন্তু তার পালক রেখে গেছে।

শ্যামদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে আমাকে প্রথম যিনি আগ্রহী করতে চেষ্টা করেন তার নাম মাহফুজুর রহমান খান। আমার ক্যামেরাম্যান। ‘ব্যাংককের পাতায়া’ নামক জায়গার কথা বলতে গিয়ে তার চোখ সবসময় ভেতর থেকে খানিকটা বের হয়ে আসে। চেহারায় ‘আহা আহা’ ভাব চলে আসে।

কী জায়গা! স্যার, একবার যেতেই হবে। পাতায়া না গেলে মানব জীবনের বিরাট অংশই বৃথা। স্যার, বলেন কবে যাবেন পাতায়া? আমি যত কাজই থাকুক, আপনার সঙ্গে যাব।

এই ধরনের অতি উচ্ছ্বাসে কিছুটা আগ্রহ দেখানো দ্রতা। আমি দ্রতার ধারেকাছে না গিয়ে বলি-গা টেপার দেশে আমি যাব না।

মাহফুজুর রহমান খান বললেন, আপনি গী টেপাবেন না। সেখানে মসজিদ আছে। আপনি মসজিদে নফল নামাজ পড়বেন।

ব্যাংকক বিষয়ে দ্বিতীয় উচ্ছ্বাস পাওয়া গেল শাওনের কাছে। মাহফুজুর রহমান ‘পাতায়া। শাওন ফুকেট’। ফুকেটের নীল সমুদ্র, স্কুভা ডাইভিং, দূরের নীল পাহাড়, অতি সস্তায় কেনাকাটা! ইত্যাদি।

আমার কাছে একটি গ্রন্থ আছে, নাম ‘পৃথিবীর এক হাজার একটি অপূর্ব প্রাকৃতিক বিস্ময়, মৃত্যুর আগে যা দেখা তোমার অবশ্য কর্তব্য।’ (1001 Natural wonders you must see before you die) বইটি প্রায়ই আমি নেড়েচেড়ে দেখি। মৃত্যু তো ঘনিয়ে এল-এক হাজার একের কয়টায় ক্রস মার্ক দিতে পারলাম তার হিসাব। বইটিতে বাংলাদেশের একটি মাত্র এন্ট্রি ‘সুন্দরবন’। যেন সুন্দরবন ছাড়া আমাদের আর কিছু নেই। মাহফুজ-শাওনের প্রায় স্বপ্নপুরী শামদেশের ব্যাপারে বইটি কী বলছে দেখতে গিয়ে পাতা উল্টালাম। আমি হতভম্ব। শ্যামদেশের এন্ট্রি আছে তেত্রিশটি-কেয়ং সোফা জলপ্রপাত, ফু রুয়া রক ফার্মশন, দুই ইনখন পর্বত…। এর মধ্যে একটা এন্ট্রি আমার মন হরণ করল Naga Fireballs. এখানের ঘটনা হচ্ছে, প্রতিবছর এগারো চন্দ্রমাসের পূর্ণচন্দ্রের রাতে মেকং নদীর একশ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য জুড়ে নদীর ভেতর থেকে শত শত আগুনের গোলা উঠে আসে। অগ্নিগোলক টেনিস বল আকৃতির। সাড়ে তিনশ’ ফুট উঁচুতে উঠে মিলিয়ে যায়। যার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা দিতে পারছে না।

মৃত্যুর আগে আর কিছু দেখি না দেখি পূর্ণিমায় আগুনের গোলা দেখতেই হবে। আমি আমার ভ্রমণ বিষয়ক পোর্টফোলিওর প্রধান মাজহারকে ডেকে বললাম, ম্যাসাজ করাবে?

সে কাচুমাচু হয়ে বলল, জি-না। ম্যাসাজের অভ্যাস আমার নেই।

আমি বললাম, অভ্যাস নেই অভ্যাস করাবে। প্রথম প্রথম সিগারেট টানতে কুৎসিত লাগে। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে মহানন্দ। বিয়ারের ক্ষেত্রে একই ব্যাপার-প্রথম চুমুকে তিতা বিষের মতো এক বস্তু, তারপর ক্যায়া মজা! যাই হোক, ব্যাংককে যাব মনস্থ করেছি। ব্যবস্থা করো।

মাজহার একদিনের মধ্যে ব্যবস্থা করে ফেলল। প্যাকেজ প্রোগ্রাম। পৃথিবী প্যাকেজের আওতায় চলে এসেছে, সবকিছুতেই প্যাকেজ।

আমরা যথাসময় ব্যাংককের এয়ারপোর্টে নামলাম। দেশের বাইরে বাংলা নামের এয়ারপোর্ট ‘সুবর্ণভূমি’। বিদেশের মাটিতে পা দিয়ে আমাদের সফর সঙ্গীদের একজন আনন্দে এবং উত্তেজনার আধিক্যে বমি করে নিজেকে ভাসিয়ে ফেলল। এই সফরসঙ্গী সর্বকনিষ্ঠ, বয়স ছয়মাস। নাম অম্বয় মাজহার। ছয়মাস বয়েসি আমাদের আরেকজন সফরসঙ্গী আছে, তবে তার ছয়মাস মায়ের পেটে। শাওন তার সন্তান পেটে নিয়েই ঘুরতে বের হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে মায়ের আবেগ, অনুভূতি এবং উগ্লাস গর্ভস্থ সন্তান বুঝতে পারে। সেই অর্থে শাওনের সন্তান ও সফর অনুভব করছে ধরে নেয়া যায়। পেটের ভেতরে হয়তো আনন্দে খাবি খাচ্ছে।

আমি এখন পর্যন্ত যে কটি দেশ দেখেছি তার প্রতিটিকেই (একমাত্র নেপাল ছাড়া) বাংলাদেশ থেকে উন্নত মনে হয়েছে এবং মনটা খারাপ হয়েছে। মন খারাপের একমাত্র কারণ-আমরা এত পিছিয়ে কেন? আমার সব বিদেশ ভ্রমণ মন খারাপ দিয়ে শুরু। কী সুন্দর ঝকঝকে রাস্তা! বাই লেন, ট্রাই লেন। কী সুন্দর শৃঙ্খলা। ট্রাফিক আইন কঠিনভাবে মানা হচ্ছে। দেশে সামরিক শাসন অথচ একটি মিলিটারিও চোখে পড়ছে না। আমরা যাচ্ছি পাতায়ার দিকে। যতই যাচ্ছি। ততই মন খারাপ হচ্ছে। মন ভালো হয়ে গেল পাতায়া পৌঁছে। আমার দেশের কক্সবাজারের সমুদ্রের কাছে এইসব কী? অবশ্যই ওয়াক থু। ছি ছি! এর নাম সমুদ্র? এই সেই সমুদ্র সৈকত?

মনে হচ্ছে বড় এক দিঘি। সমুদ্র সৈকত নামের জায়গাটা বস্তিরমতো ঘিঞ্জি। সমুদ্র থেকে একহাত জায়গা ছেড়ে চেয়ারের গায়ে চেয়ার লাগানো চেয়ারের মাথায় ছাতা এক ঘন যে নিচটা অন্ধকার হয়ে আছে। শত শত ফেরিওয়ালা ঘুরছে। কাটা ফল, ভাজা শুঁটকি, ডাব। গা মালিশওয়ালারা তেলের শিশি নিয়ে ঘুরছে। উল্কি আঁকাওয়ালারা ঘুরছে উল্কির জিনিসপত্র নিয়ে। হাটবারের মতো মানুষ। এদের মধ্যে অসভ্য বুড়ো আমেরিকানরা কিশোরী পতিতাদের সবার সামনেই হাতাপিতা করছে। নিজ দেশে এই কাজ করলে তাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যেত। পয়সা খরচ করে মজা পেতে তারা এই দেশে এসেছে। তাদের চোখে এটা প্রসটিটিউটদের দেশ। সব মেয়েই প্রসটিটিউট।

পাতায়া থেকে হাজারগুণ সুন্দর আমার বাংলাদেশের সমুদ্র। কক্সবাজার, টেকনাফ, কুয়াকাটা, সেন্টমার্টিন। আর বেলাভূমি-আহারে কী সুন্দর!

পাতায়া দেখে এই কারণেই আমার মন ভালো হয়ে গেল। একবার মন ভালো হয়ে গেলে সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করে। আমি সফরসঙ্গীদের চমকে দিয়ে গায়ের শার্ট খুলে ফেললাম। এইখানেই থামলাম না, গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলাম, পেটে উল্কি আঁকব। আমাদের সামনে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকা বদ আমেরিকানটাকে দেখিয়ে বললাম, ঐ ব্যাটা পেটে যে ছবি আঁকাচ্ছে সেই ছবি।

সফরসঙ্গী কমল বলল, হুমায়ূন ভাই, ঐ ব্যাটা তো পেটে নেংটা মেয়েমানুষ আঁকাচ্ছে।

আমিও তাই আঁকাব। সেও বুড়ো আমিও বুড়ো।

যখন সফরসঙ্গীরা বুঝল আমি মোটেই রসিকতা করছি না, বাংলাদেশের লেখক ক্ষেপে গেছে তখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে রফা করা হলো-আমার পেটে বাঘের মুখের উল্কি আঁকা হবে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আমি পেটে বাংলার বাঘ নিয়ে ঘুরব। উল্কি আঁকা হলো। শুরু হলো আমার শ্যামদেশ ভ্রমণ। সন্ধ্যার মধ্যে চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে গেলাম। হোটেলে ফিরে ঘোষণা করলাম, এখানে যা আছে দেখা হয়ে গেছে। যৌনতা প্রদর্শনীর শহর। জীবনের আনন্দ যেখানে অতি স্কুল অর্থ গ্রহণ করেছে।

মাজহার বলল, পাতায়ায় আমাদের আরো তিনদিন থাকতে হবে।

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, কেন?

 আমরা প্যাকেজে এসেছি। প্যাকেজে এখানে তিনদিন থাকার কথা।

তিনদিন আমি কী করব?

সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। আসলেই তো তিনদিন কী করা যাবে? দ্বিতীয় দিন একই জায়গায় শুরু হলো। একই দৃশ্য। প্রাণহীন সমুদ্র, অতিরিক্ত প্রাণময় ইউরোপের বুড়োর দল। তরুণী থাই মেয়েদের সঙ্গে লটকা লটকিতে যারা অসম্ভব পারঙ্গম।

আমাদের দলে মহিলা আছে দু’জন-শাওন এবং মজহারের স্ত্রী স্বর্ণা। তারা শপিং-এ বের হলো। ফুটপাথ শপিং। তারাও যথেষ্ট বিরক্ত হলো। প্রতিটি দোকানে একই জিনিস। বাংলাদেশের মতো অবস্থা।

একটি জাতির মানসিকতা নাকি তাদের তৈরি খেলনা থেকে পাওয়া যায়। পথের দুপাশে কিছুদূর পরপরই রবারের যৌনাঙ্গ নিয়ে লোকজন বসে আছে। বিক্রি হচ্ছে। অদ্ভূত এই খেলনা দেখে মাজহার পুত্র অমিয় কেনার জন্যে ঘ্যানঘ্যান শুরু করে মা-বাবা দুজনের হাতেই মার খেল। বেচারা মার খাওয়ার কারণ বুঝতে পারল না। তার মন পড়ে রইল অদ্ভুত ঐ খেলনায়।

সন্ধ্যাবেলায় ওয়াকিং স্ট্রিট নামের এক রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্টে সবাই বসে আছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে শঙ্কিত আরো দু’রাত কাটাতে হবে এই ভেবে, মন থেকে শঙ্কা দূর করে আনন্দে আছি এমন এক ভাব করার চেষ্টা করছি। আমাদের একজন সফরসঙ্গী আর্কিটেক্ট ফজলুল করিম শুধু অনুপস্থিত। বেচারার মন খারাপ তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে গেছে। স্ত্রীকে নিয়ে এই পাতায়াতে সে অনেকবার এসেছে। এবার সে এসেছে একা। বাকি সবাই এসেছে সস্ত্রীক। ব্যক্তিগত পারিবারিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত। প্রায়ই দেখি সে দল ছেড়ে একা ঘুরছে। আমাদের খারাপই লাগে। আজ সে আমদেরকে চমকে দিয়ে হাসিমুখে উপস্থিত হলো আর সঙ্গে অতি রূপবতী এক থাই কন্যা। মায়াময় চোখ। উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল।

জানা গেল, করিম এই বান্ধবী জোগাড় করেছে। সে এখন থেকে করিমের সঙ্গেই থাকবে। প্রতিরাতে তাকে পাঁচশ বাথ দিতে হবে।

আমি অবাক হয়ে মেয়েটির নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দলের সবাই মেয়েটির সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করল। আমরা ভাব করলাম যেন সে করিমের দীর্ঘদিনের চেনা কোনো তরুণী। কিছুটা সময় আমাদের সঙ্গে কাটাতে এসেছে। মেয়েটিও সহজ-স্বাভাবিক। ছয়মাসের অন্বয়কে কোলে নিয়ে আদর করছে। গল্প করছে।

এর মধ্যে মাজহার পুত্র এক খেলনা কিনে নিয়ে এল। রিমোট কন্ট্রোলের গাড়ি। কিছুক্ষণ চলে, তারপর তালগোল পাকিয়ে যায়, আবার চলে। সবাই খেলনা দেখে মজা পাচ্ছি। থাই মেয়েটি জানতে চাইল, খেলনার দাম কত? মাজহার বলল, পাঁচশ’ বাথ।

মেয়েটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলল, Me and Toy same same 500 bath.

সরল বাংলায়-এই খেলনার সঙ্গে আমার কোনো প্রভেদ নেই। আমি এবং খেলনা একই মূল্য, পাঁচশ’ বাথ।

পাতায়া ভ্রমণ শেষে আমরা থাইল্যান্ডের অনেক সুন্দর জায়গায় গিয়েছি। এক হাজার এক প্রাকৃতিক লীলা সৌন্দর্যের ছটা দেখেছি। বইয়ে ক্রস মার্ক দিয়েছি। কিছুই কেন জানি আমাকে স্পর্শ করল না। কানে সারাক্ষণ থাই মেয়েটির করুণ গলা রেকর্ডের মতো বাজতে থাকল–Me and toy sarne same. মানবজীবনের কী করুণ পরাজয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *