ভগবদগীতা-সমালোচনা – ২য় পরিচ্ছেদ

ভগবদগীতা-সমালোচনা – ২য় পরিচ্ছেদ

কখন বা জ্ঞানের কখন বা কর্ম্মের প্রশংসা শুনিয়া অর্জ্জুনের মনে ঘোর সন্দেহ উপস্থিত হইল। তজ্জন্য তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, হে জনার্দ্দন, “তোমার মতে কর্ম্ম অপেক্ষা জ্ঞানই যদি শ্রেষ্ঠ হয়, তবে আমাকে কি নিমিত্ত অধর্ম্মকর কর্ম্মে নিযুক্ত করিতেছ?” কেশব বলিলেন, পুরুষ কর্ম্মানুষ্ঠান না করিলে জ্ঞান প্রাপ্ত হয় না; এবং জ্ঞান প্রাপ্ত না হইলে কেবল সন্ন্যাস দ্বারা সিদ্ধি লাভ হয় না। “কর্ম্মত্যাগ অপেক্ষা কর্ম্মানুষ্ঠানই শ্রেষ্ঠ। তদ্বিষয়ে অনেক গুলি নজিরও দেখাইলেন। (১ম) জনকাদি ঋষিরা নাকি কেবল মাত্র কর্ম্ম দ্বারাই সিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। (২য়) সৃষ্টির সময় প্রজাপতি এরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছেন যে, প্রজাগণ যজ্ঞ দ্বারা দেবতাগণকে সংবর্দ্ধিত করিবেন, এবং দেবতাগণও বৃষ্টি দ্বারা অন্নের উৎপত্তি করিয়া প্রজাদিগকে সংবর্দ্ধিত করিবেন। এইরূপ পরস্পর পরস্পরীর সংবর্দ্ধনা করিয়া পরম শ্রেয়ঃ লাভ করিবেন। এই ঘোর কলিকালে যজ্ঞকর্ম্ম যেরূপ লোপ প্রাপ্ত হইতেছে, তাহাতে দেবতাকুলের অন্ন-কষ্ট উপস্থিত না হয়, তদ্বিষয়ে দৃষ্টি রাখা হিন্দু মাত্রেরই কর্ত্তব্য। তেত্রিশ কোটী দেবতার ভরণপোষণের গুরুভার তাঁহাদের স্কন্ধেই ন্যস্ত। খ্রীষ্টীয়ান মুসলমানগণের নিকট, ইহা প্রত্যাশা করা যায় না। কেননা তাহারা এমন “চোর” যে পঞ্চ যজ্ঞাদি দ্বারা দেবঋণ পরিশোধ না করিয়াই দেবদত্ত অন্নাদি অম্লান বদনে ভক্ষণ করে!!!

কৃষ্ণ বলিলেন,–“যজ্ঞ হইতে মেঘের উৎপত্তি হয়, মেঘ হইতে বৃষ্টি এবং বৃষ্টি হইতে অন্নের উৎপত্তি হয়।” “কোন কোন পণ্ডিত কৃষ্ণের এই সংসার বর্ণনা শুনিয়া হাস্য করায়” গীতারহস্যজ্ঞ আর এক পণ্ডিত ইহার এক সুন্দর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বাহির করিয়া দিয়াছেন। তিনি বলেন, “যজ্ঞদগ্ধ ঘৃত কাষ্ঠাদি হইতে ধূম রাশি উৎপন্ন হইবে, এবং ঐ বাষ্প রাশি হিমালয়ের পার্শ্বে আবদ্ধ হইয়া মেঘের উৎপত্তি করিতে পারে। পরে মেঘ হইতে জল এবং জল হইতে শস্য এবং শস্য হইতে প্রাণিগণের উদ্ভব হইতে পারে।” এরূপ যুক্তির উত্তর দিবার আবশ্যকতা ছিল না, আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত (?) লোকের মুখেও এই সকল অসার কথা শুনা যায়। স্কুলের বালকেরাও অবগত আছে যে, কাষ্ঠাদি দগ্ধ করিলে কেবল মাত্র জলীয় বাষ্প বহির্গত হয় না, কার্ব্বনিক এসিড প্রভৃতি বাষ্প থাকে, তাহা শীতল হইলে জল হয় না। প্রভূত পরিমাণে কাষ্ঠ দগ্ধ করিলেও সামান্য পরিমাণ বৃষ্টি হইবার উপযুক্ত জলীয় বাষ্প বহির্গত হয় না। বাষ্প বহির্গত হইলেও, যে দেশে কাষ্ঠ দগ্ধ হইল, সেই স্থানেই বৃষ্টির সম্ভাবনা কোথায়?–কেননা বায়ুর সহিত বাষ্প দেশ দেশান্তরে চলিয়া যাইবে; যজ্ঞকারিগণের কোন উপকারে আসিবে না। আর যজ্ঞের জন্য না হউক, রন্ধনাদি কর্ম্মের জন্যও প্রতিদিনই প্রতি গৃহে যথেষ্ট কাষ্ঠ দগ্ধ হইতেছে। তাহা কি বৃষ্টিপাতের বিশেষ কিছু সহায়তা করে?

কৃষ্ণ পুনরায় বলিলেন–“শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যাহা আচরণ করেন, ইতর ব্যক্তিরা তাহার অনুসরণ করেন।(১) অতএব বিজ্ঞ ব্যক্তি, কর্ম্মাসক্ত অজ্ঞদিগের কর্ম্ম সকল নিষ্ফল ইত্যাদি বলিয়া, তাহাদের বুদ্ধিভেদ উৎপন্ন না করিয়া স্বয়ং সর্ব্বপ্রকার অনুষ্ঠান পূর্ব্বক তাহাদিগকে কর্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত করিবেন (৩অ–২৬-২৯)। অর্থাৎ অজ্ঞ ও মূর্খকে অজ্ঞ ও মূর্খ রাখিতে বিজ্ঞ ব্যক্তি বিধিমতে চেষ্টা করিবেন। পাছে মূর্খ লোকের, অর্থশূন্য বেদোক্ত কর্ম্মকাণ্ডের প্রতি সন্দেহ জন্মে, এবং তন্নিবন্ধন পুরোহিতবর্গের আধিপত্ত এবং অর্থলাভ কম হয়, তজ্জন্য বুদ্ধিমান লোকে এই সকল কর্ম্মকে নিষ্ফল জানিয়া ও তাহাদের প্রতারণার জন্য স্বয়ং আচরণ করিবে!!! এ সকল কথা কেবল ব্রাহ্মণ গীতাকারের ম্যখেই শোভা পায়। শ্রীধর স্বামী গীতার মত সমর্থনার্থ বলেন–তেষাম্‌ বুদ্ধি বিচালনে কৃতে সতি কর্ম্মসু শ্রদ্ধা নিবৃত্তেঃ জ্ঞানস্য চানুৎপত্তে স্তেষাম্‌ উভয় ভ্রংশঃস্যাৎ। অর্থাৎ “যদি তুমি অজ্ঞানীর মনে (উপদেশ দ্বারা) জ্ঞানোদ্রেক করিতে চাও, তাহার জ্ঞান লাভ ত হইবেই না, কিন্তু তাহাদের কর্ম্মের প্রতি অনাস্থা ও বিদ্বেষ জন্মিবে।” উপদেশ দ্বারাও যে অজ্ঞানীর মনে জ্ঞানের উদয় হইবে না, তাহা স্বামীজি জানিলেন কি প্রকারে? জ্ঞানী অজ্ঞানী দুইটী কি স্বতন্ত্র জীব? সকল লোকেই প্রথমাবস্থায় অজ্ঞানী থাকে, পরে শিক্ষা দ্বারাই জ্ঞানী হয়। স্বামীজি কি মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াই সুবোধিনী টীকা লিখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন? আর ভ্রমের বিনাশের নামই জ্ঞান। সুতরাং যজ্ঞ কর্ম্ম দ্বারা কোন উপকার হইবে না, জানিতে পারাই ত জ্ঞান!

কৃষ্ণের তৃতীয় সর্গের শেষ যুক্তি এই;–অর্জ্জুন ক্ষত্রিয়, যুদ্ধ করাই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম। তাহাতে তাহার পাত্রাপাত্র বিবেচনা করিবার আবশ্যক নাই। অতএব তিনি নিঃশঙ্ক চিত্তে জ্ঞাতি নিধনে নিযুক্ত হইতে পারেন। কারণ আপনার জাতিধর্ম্ম পালন করাই সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য।

শ্রেয়ান্‌ স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ।।
“সম্যক অনুষ্ঠিত পর ধর্ম্ম(২) অপেক্ষা কিঞ্চিত অঙ্গহীন স্বধর্ম্মও(৩) শ্রেষ্ঠ। স্বজাতির বিহিত ব্যবসায় অবলম্বন দ্বারা যদি মৃত্যুও হয়, তাহাও শ্রেয়ঃ, তত্রাচ অন্য জাতির ব্যবসায় অবলম্বন করা উচিত নয়।”

হাইকোর্টের শূদ্র বিচারপতি এবং উকিলগণের মধ্যে কেহ গীতাভক্ত থাকিলে, এই দণ্ডেই তাঁহাদের কার্য্য ছাড়িয়া দেওয়া উচিত। কারণ দ্বিজগণের পরিচর্য্যা করাই শূদ্রগণের স্বাভাবিক কর্ম্ম। পরিচর্য্যাত্মকং কর্ম্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজং। তিষক্‌ কুলতিলক পরিব্রাজক, কুমার শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন সেন ওরফে শ্রীকৃষ্ণানন্দ স্বামী আয়ুর্ব্বেদ পরিত্যাগপূর্ব্বক কিরূপে হিন্দুধর্ম্ম প্রচাররূপ ব্রাহ্মণোচিত কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইয়া গীতার অবমাননা করিতেছেন, তাহাও আমাদের বোধগম্য হয় না। তিনি ত স্বয়ং গীতার্থ সন্দীপনীব্যাখ্যায় লিখিয়াছেন যে, একের যাহা ঔষধ, অন্যের তাহা বিষ। সনাতন ধর্ম্মের গূঢ় তত্ত্ব প্রকাশ করা বিপ্রবর্গের স্বর্গ লাভের উপায় হইলেও বৈদ্যাদি শুদ্রগণের নরক গমনের হেতু। আজ হিন্দুধর্ম্মের কোনো রক্ষক থাকিলে, তিনি মনুর বিধানানুসারে ব্রাহ্মণগণকে ধর্ম্মোপদেশ প্রদানেচ্ছু মদগর্ব্বিত শূদ্রের কর্ণে তপ্ত তৈল ঢালিয়া দিতেন।

Monier Williams উল্লিখিত শ্লোকের ভাবার্থ, ইংরাজিতে অনুবাদ করিয়া এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন।
Better to do the duty of one’s caste,
Though bad and ill performed and fraught with evil,
Than undertake the business of another,
HOwever good it be.

Remembering the sacred character attributed to this poem and the veneration in which it has always been held throughout India, we may well understand that such words as these must have exerted a powerfull influence for the last 1800 years tending, as they must have done to rivet the fetters of caste institutions, which for several centuries preceding the Christian era, notwithstanding the efforts of the great liberator Buddha, increased year by year their hold upon the various classed of Hindu Society impeding mutual intercourse, preventing healthy interchange of ideas, and making national union almost impossible.

এই অধ্যায় এবং অষ্টাদশ অধ্যায়ে প্রত্যেক বর্ণের কর্ত্তব্য কর্ম্ম বিশদ রূপে বর্ণনা করিয়া জনার্দ্দন বলেন,–স্বে স্বে কর্ম্মণয়ভিরতঃ সংসিদ্ধিং লভতে নরঃ = মানব নিজ নিজ বর্ণাশ্রম ধর্ম্ম পালন দ্বারাই সিদ্ধি লাভ করে। সহজং কর্ম্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ = স্বভাবজাত স্বধর্ম্ম দোষযুক্ত হইলেও তাহা ত্যাগ করা উচিত নয়। অর্থাৎ নিজের জাতি ব্যবসায় পাপজনক হইলেও তাহা পরিত্যাগ করা উচিত নয়।

এ সম্বন্ধে Bishop Caldwell বলেন,–A soldier of the Kshatriya caste has no other duty superior to fighting. If fighting and slaying are lawful, simply because they are caste employments and the immutability of moral obligations is ignored, what shall we say Kellars, the thief caste of the South, the ancient (but now generally abandoned) employment of whose caste was to steal, and whose caste means simply thieves? Krishna’s teaching on these heads elevates the conventional duties of the institutions of a dark age, above the essentioal distinction between right and wrong.

পণ্ডিতবর শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে এই গুলি জাতিভেদ প্রথার ফল:–
(1) It has produced disunion and disorder.
(2) It has made honest manual labour contemptible in this country.
(3) It has checked internal and external commerce.
(4) It has brought on physical degeneracy by confining marriage within a narrow circle.
(5) It has been a source of conservatism in every thing.
(6) It has suppressed individuality and independence of character.
(7) It has helped in developing other injurious customs, such as early marriage, charging of heavy matrimonial fees &c.
(8) It has successfully restrained the growth and development of national worth, whilst allowing the opportunity of mental and spiritual culture only to a limited number of privileged people, it has denied these opportunities, to the majority fo lower classes consequently it has made the country negatively a loser.
(9) It has made the country fit for foreign slavery by previously enslaving the people by the most abject spiritual tyranny.

Sir Henry Maine জাতিভেদ প্রথাকে বলেন,–
The most disastrous and blighting of all human Institutions.

“পুরুষ ইচ্ছা না করিলেও কে তাহাকে বল পূর্ব্বক পাপাচরণে নিয়োজিত করে?” অর্জ্জুনের এই প্রশ্নের উত্তরে কেশব বলিলেন;–
“রজোগুণ সমুদ্ভব কাম এবং ক্রোধ।
ইহারা মুক্তিপথের বৈরী। অতএব হে ভরতর্ষভ, তুমি ইন্দ্রিয়গণকে সংযত করিয়া জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের বিনাশক এই কামকে জয় কর।”

চতুর্থ অধ্যায়ের প্রারম্ভে যোগের মাহাত্ম্য বৃদ্ধিত জন্য ভগবান বাসুদেব, এক আষাঢ়ে গল্পের অবতারণা করিয়া বলিলেন, আমিই প্রথমে সূর্য্য ঠাকুরকে যোগের বিষয়ে উপদেশ দিই। আদিত্য (বোধ হয় এক দিন মর্ত্ত্য-লোকে বেড়াইতে আসিয়া) মনুকে বলিয়া যান। মনু বলেন ইক্ষাকুকে; এবং নৈমি প্রভৃতি রাজগণ, ইক্ষাকু প্রমুখাৎ অবগত হন। কালক্রমে এই বিদ্যার লোপ হয়। তুমি আমার বিশেষ ভক্ত বলিয়া, আজ তোমার নিকট কীর্ত্তন করিলাম। ধনঞ্জয় শুনিয়া আশ্চর্য্যন্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,–হে মাধব, প্রভাকরের জন্ম হইবার অনেক পরে, তোমার জন্ম হইয়াছে। তুমি কিরূপে তাহার উপদেষ্টা হইলে?
গোবিন্দ বলিলেন, এই জন্ম হইবার পূর্ব্বে আমার অনেক জন্ম হইয়াছিল। সেই সময় বলি। এই উপলক্ষে শ্রীকৃষ্ণ তাহার পূর্ব্ব জন্মের দুই একটি বৃত্তান্ত শুনাইয়া দিলেন।
পরিত্রাণায় সাধূনাম্‌ বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।(৪)
ধর্ম্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
মধুসূদন কোন সময় দুষ্টদিগকে নিপাত করিয়া কোন স্থানে ধর্ম্মরাজ্য সংস্থাপন করিয়াছিলেন এবং তাহার পরিণামই বা কি হইল, তাহার উল্লেখ নাই। কিন্তু সুরধুণী কাব্য পাঠে জানা যায়, তাঁহারই পাশ্চাত্য শিক্ষার আক্রমণ হইতে স্বরাজ্যরক্ষা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে।
রাধার বচন শুনি মদন মোহন,
বলিলেন মৃদুস্বরে এই বিবরণ,
অজ্ঞানের অন্ধকারে ভ্রমের মন্দিরে,
আধিপত্য এত দিন উন্নত শরীরে,
করিয়াছি অনায়াসে এবে অবোধিনী,
জ্ঞানালোকে আলোময় হয়েছে মেদিনী;
গিয়াছে আঁধার দূরে ভেঙ্গেছে মন্দির,
কতক্ষণ ঢাকা রহে মেঘেতে মিহির?
বলিতে বলিতে শ্যাম বিরস বদনে,
ঝাঁপ দিলা কালীদহে সার ভেবে মনে;
কোথায় প্রাণের হরি বলি কমলিনী,
পড়িল জীবন মাঝে যেন পাগলিনী।।

এই অধ্যায়ে কর্ম্মবন্ধন এবং পুনর্জন্মের হস্ত হইতে মুক্ত হইবার এক সহজ উপায় বর্ণিত আছে। কৃষ্ণ বলিলেন, “হে অর্জ্জুন, আমার এই স্বেচ্ছাকৃত জন্ম এবং ধর্ম্মপালন ও অলৌকিক কর্ম্ম যিনি প্রকৃতরূপে জানিতে পারেন, তাঁহাকে দেহ পরিত্যাগ করিয়া আর পুনর্ব্বার জন্ম গ্রহণ করিতে হয় না। তিনি আমাকে প্রাপ্ত হন।” (৪অ–৯)। “কর্ম্ম আমাকে স্পর্শ করিতে পারে না, কর্ম্মফলেও আমার স্পৃহা নাই, যে ব্যক্তি আমারে এইরূপে অবগত হইতে পারেন, তাঁহাকে কর্ম্মবন্ধনে বদ্ধ হইতে হয় না।” (৪অ–১৪)। এই কথাগুলি সত্য হইলে মোক্ষলাভের জন্য কাহাকেও ভাবিতে হইবে না।
কর্ম্ম শব্দ গীতায় পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হইয়াছ, অথচ তাহার অর্থ কোন স্থানে পরিষ্কার রূপে বিবৃত নাই। শ্রীধরস্বামী বলেন, কর্ম্ম–যজ্ঞাদি, সন্ধ্যা-উপাসনাদি, নিত্যকর্ম্ম এবং শ্রাদ্ধাদি নৈমিত্তিক ক্রিয়া। একাদশ শ্লোকে যদুনন্দন স্বয়ং কর্ম্মতত্ত্বের মীমাংসায় প্রবৃত্ত হইয়া বলিলেন, “গহনা কর্ম্মণোগতিঃ,” “কর্ম্মের গতি দুরবগাহ এবং দুর্জ্ঞেয়।” ইহলোকে কর্ম্ম এবং অকর্ম্ম বিষয়ে বিবেকীগণও মোহিত হইয়া আছেন। কিন্তু তোমাকে কর্ম্ম বিষয়ে এমন এক সুন্দর উপদেশ দিতে ইচ্ছা করি, যাহা অবগত হইয়া তুমি অনায়াসে সংসারবন্ধন হইতে মুক্ত হইতে পারিবে।” (৪অ-১৬)। এইরূপ গৌর চন্দ্রিকা শ্রবণ করিয়া, অনেকে হয় ত ইহা ভাবিতে পারেন যে, শ্রীকৃষ্ণ এইবার বুঝি কর্ম্মের একটা চূড়ান্ত মীমাংসা করিয়া দিবেন। “তিনি বলিলেন, কর্ম্ম অর্থাৎ বিহিত কর্ম্ম, অকর্ম্ম অর্থাৎ বিহিত কর্ম্মের অকরণ এবং বিকর্ম্ম অর্থাৎ নিষিদ্ধ কর্ম্ম, এই ত্রিবিধ কর্ম্মের সকলেরই উত্তম রূপে জানা উচিত। যিনি কর্ম্মে অকর্ম্ম দর্শন করেন, এবং অকর্ম্মে কর্ম্ম দর্শন করেন, সমস্ত কর্ম্ম করিলেও তিনি মনুষ্য মধ্যে যোগী।” (৪অ–১৭-১৮)। শ্রীধর স্বামীর টীকায় উক্ত শ্লোকের এক সুন্দর ব্যাখ্যা আছে। তিনি বলেন, “কর্ম্ম করিলেই কর্ম্মবন্ধনে পড়িতে হয়, অর্থাৎ পুনর্জ্জন্ম হয়। কেবল মাত্র ঈশ্বরোদ্দেশ্যে যে সকল কর্ম্ম করা যায়, তাহাদের বন্ধন শক্তি নাই। তদ্দ্বারা জীব মুক্ত হইয়া যায়; সুতরাং বন্ধন শক্তির অভাবে সেই সকল কর্ম্ম অকর্ম্ম, অর্থাৎ কর্ম্মই নয়। আর বিহিত কর্ম্ম না করিলে প্রত্যবায় হয়, সুতরাং সংসারে বদ্ধ হইতে হয়। অতএব বিহিত কর্ম্মের অকরণেও কর্ম্মের ন্যায় বন্ধন শক্তি আছে; সুতরাং অকর্ম্মও কর্ম্ম।” মানবের পুনর্জন্মের প্রমাণ কিছুই নাই। “আত্মা অবিনশ্বর” স্বীকার করিলেও তাহাকে পুনরায় দেহান্তর পরিগ্রহপূর্ব্বক ইহ জগতে বিচরণ করিতে হইবে, তাহার প্রমাণ কি? কেহ কেহ ভাবেন, পুনর্জন্ম মানিয়া লইলে ইহ জন্মের সুখ সুঃখাদির কারণ বোঝা যায়। কেহ বা ধনী, কেহ বা দরিদ্র, কেহ বা সুখী, কেহ বা ঘোর দুঃখ-সাগরে নিমগ্ন হইয়া জন্ম গ্রহণ করেন। সেই সকল তাঁহাদের পূর্ব্বজন্মকৃত কর্ম্মের ফল। কিন্তু ইহাতেই কি সুখ দুঃখের কারণ বোঝা যায়? মনে করুন, পূর্ব্বজন্মকৃত কর্ম্মের ফল আমি এজন্মে ভোগ করিতেছি। পূর্ব্বার্জিত কর্ম্মফলে বাধ্য হইয়া এ জীবএন্র সমস্ত কার্য্য করিতেছি, অর্থাৎ আমার কার্য্য সকল আমার এ জন্মের স্বাধীন চেষ্টা সম্ভূত নয়। এ জন্মেই হউক, বা আর দুই এক জন্মেই হউক, পূর্ব্বকৃত কর্ম্মের ফল ক্ষয় প্রাপ্ত হইয়া যাইবে; তখন তাহার পরজন্মে আবার স্বাধীন ভাবে কার্য্য করতে হইবে। সুতরাং কর্ম্মফল মানিলেও কোন না কোন জন্মে স্বাধীন ভাবে কার্য্য করিতে হইবে মানিতে হইবে। আমাদের বর্ত্তমান জন্মও সেই জন্ম হইতে পারে; অর্থাৎ এ জন্মের সুখ দুঃখাদির সহিত পূর্ব্বজন্মকৃত কর্ম্মের কোনো সংশ্রব না থাকিতে পারে। অতএব “কর্ম্মফল” দ্বারা সকল সুখ দুঃখ বোঝান যায় না।

আর যদি পুনর্জন্মই থাকে, তবে নিষ্কাম ভাবে কর্ম করিলে, জন্ম হইবে না, কিন্তু সকাম ভাবে সেই কর্ম্ম করিলেই হইবে, ইহার যুক্তি কি?
শ্রীকৃষ্ণ, কর্ম্ম, অকর্ম্ম এবং বিকর্ম্মের তত্ত্ব কীর্ত্তন করিলেন বটে; কিন্তু তাহাতে আমাদের জ্ঞান লাভ কিছু মাত্র হইল না। সৎ কর্ম্মের অনুষ্ঠান এবং অসৎ কর্ম্ম পরিত্যাগ করা উচিত, সকলেই তাহা জানে। কিন্তু কোনটী সৎ কর্ম্ম এবং অসৎ কর্ম্মই বা কোন গুলি, তাহাই জানিবার জন্যে লোকে ধর্মশাস্ত্র পাঠ করে। গীতা পাঠে সে অভিলাষ পূর্ণ হইবার উপায় নাই। তবে স্থল বিশেষে (১৮ অধ্যায়) পাঠ করিলে এই রূপ বোধ হয় যে, মানব-ধর্ম্ম শাস্ত্রে, যে জাতির যে কর্ত্তব্য লিখিত আছে, তাহাই পালন করা গীতার মতে সকল লোকের উচিত। অর্থাৎ স্বদেশ রক্ষার্থ যুদ্ধ করা ব্রাহ্মণের পক্ষে অবিহিত; ক্ষত্রিয় তনয়ের বাণিজ্যাদিতে নিযুক্ত হওয়া, বা শূদ্রের বিদ্যা চর্চা করা অপেক্ষা, অধর্ম্মকর কার্য্য আর নাই। ইহাই গীতোপনিষদের শ্রেষ্ঠ উপদেশ!!!

১৮ শ্লোকের ব্যাখ্যা হইতে পণ্ডিতবর শ্রী প্রসন্নকুমার বিদ্যারত্ন শুষ্ক মাংসাদি নিষিদ্ধ দ্রব্যের আহারের এক উত্তম ব্যবস্থা বাহির করিয়া দিয়াছেন। তিনি বলেন,–“জ্ঞানী লোকে বিবেক জ্ঞান দ্বারা সকল কর্ম্মকেই আত্মার কর্ম্ম নয় বলিয়া জানেন। কর্ম্ম সকল দেহেন্দ্রিয়াদির ব্যাপার মাত্র। তাঁহাদের এইরূপ ধারণা, সুতরাং যদৃচ্ছা প্রাপ্ত কলঞ্জাদির (শুষ্ক মাংসাদির) ভক্ষণ তাহাদের দোষের জন্য হয় না। কিন্তু অজ্ঞ ব্যক্তিগণের ইহা দোষের জন্য হয়, কারণ তাহারা উহা নিজের কার্য্য বলিয়া ভাবেন।” শ্রীধর স্বামীরও এই মত। এখন গীতোক্ত এই মহোপদেশটী স্মরণ করিয়া জ্ঞানী হিন্দু মহোদয়বর্গ অম্লান বদনে ইংরাজের হোটেলে আহার করিতে পারেন। আর জ্ঞানী হওয়াও কিছু দুরূহ নয়। কেবল ভাবা যে, “মৃৎকৃত কর্ম্মের আমি কর্ত্তা নহি।” অজ্ঞানগণের বুদ্ধি কত স্থূল। তাহাদের হস্ত আহার্য্য দ্রব্য বদন মধ্যে নিক্ষেপ করে। দন্তচর্ব্বিত করিয়া পাকস্থলীতে প্রেরণ করে; তথায় হজম হইয়া যায়। অথচ তাহারা ‘আমরা আহার করিয়াছি’ ভাবিয়া অহঙ্কারে স্ফীত হয়। ঈদৃশ অহঙ্কারবিমূঢ় দুর্ব্বৃত্তগণের কর্ম্মবন্ধের বিষম নিগড়ই উপযুক্ত শাস্তি।

সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, সনাতন ধর্ম্মের পুনরুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু সমাজে উল্লিখিত জ্ঞানীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতেছে। নচেৎ বিলাতি হোটেলের দেশী গ্রাহক বাড়িতে কেন? এবং হিন্দু পল্লির মধ্যস্থিত প্রহ্লাদ চৈতন্যের হরিধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত রঙ্গভূমির সম্মুখে মিঁয়া সাহেবেরা ক্যারি ক্যাটলেটের দোকান করিয়া বিলক্ষণ দুদশ টাকা রোজগার করিতে সক্ষম হইবে কি প্রকারে?

অতঃপর কৃষ্ণ বলিলেন,–“হে অর্জ্জুন, যজ্ঞার্থ আচরিত কর্ম্ম সকলের বন্ধন শক্তি নাই। তৎ সমুদায় সহজেই বিলয় প্রাপ্ত হয়।” কেননা যজ্ঞের সকল অংশই ব্রহ্ম; যথা :–“সক্‌স্রবাদি (যদ্দারা ঘৃতাদি অগ্নিতে অর্পন করা হয়) পাত্র সকল ব্রহ্ম, হবণীয় ঘৃতাদি ব্রহ্ম, অগ্নি ব্রহ্ম, এবং যিনি হোম করে, তিনিও ব্রহ্ম।” (৪অ-২৪)। যজ্ঞের লুঢ্যাদি মিষ্টান্ন সকল মূর্ত্তিমান ব্রহ্ম কি না, গীতোপনিষদে লিখিত নাই; কিন্তু “যজ্ঞবশিষ্ট অমৃত তুল্য অন্ন ভোজন করিয়া যে অনায়াসে ব্রহ্ম-পদ লাভ করা যায়,” স্বয়ং ভগবানই তাহা স্বীকার করিয়াছেন। অতএব যিনি গীতার উপাসক হইয়া মধ্যে মধ্যে এইরূপ “ব্রহ্ম যজ্ঞের অনুষ্ঠান দ্বারা বন্ধুবান্ধবগণকে পরিতোষের” সহিত ভোজন না করান, তাঁহার ইহ লোকে সুখ নাই; এবং পরকালে অনন্ত দুঃখ ভোগ করিয়ে হয়।” নায়ং লোকোহস্ত্যযজ্ঞস্য কুতোন্যঃ কুরুসত্তম।

এই সকল জ্ঞানপ্রদ উপদেশাবলী শ্রবণ করিয়াও কুরুসত্তম সব্যসাচীর অজ্ঞানান্ধকার কিঞ্চিন্মাত্রও দূরীভূত হইল না, তখন ভগবান কেশি নিসূদন হরি, কাতরস্বরে বলিলেন, মহামতি পার্থ, আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি যে, তোমার জ্ঞানরাশি আজিও সম্যক প্রকারে পরিষ্ফুটিত হয় নাই। “প্রণিপাত, প্রশ্ন, এবং সেবা দ্বারা এখন কিছুকান ধরিয়া জ্ঞানার্জ্জন কর।” “জ্ঞানের উদয় হইলে আর তুমি বন্ধুবধজনিত মোহে অভিভূত হইবে না।” (৪অ–৩৫)। যেহেতু জ্ঞান দ্বারা পিতৃপিতামহিদিগকে আপনাতে অভিন্নভাবে দর্শন করিবে, এবং পরিশেষে আপনাকে আমাকে অভিন্নভাবে অবলোকন করিবে।” (৪অ–৩৫)। সুতরাং, তাহাদের হত্যা করিতে তোমার কিছুমাত্র সঙ্কোচ হইবে না। এইরূপ জ্ঞানকেই বোধ হয় চলিত ভাষায় টনটনে জ্ঞান বলে। উল্লিখিত অখণ্ডনীয় যুক্তি দ্বারা যুদ্ধের নির্দ্দোষতা পরিষ্কার রূপে সপ্রমাণ করিয়া কৃষ্ণ বলিলেন, হে ভরতর্ষভ, আর অধিক ভাবিবার আবশ্যক নাই; “জ্ঞানরূপ অসি দ্বারা হৃদয়স্থ সংশয়কে ছেদন করিয়া কর্ম্মযোগ অবলম্বন কর, এবং উপস্থিত যুদ্ধার্থে উত্থিত হও।” (৪অ–৪২)।

————–
(১) বৃন্দাবনের লীলার সময় কৃষ্ণের নিজের উপদেশটী স্মরণ রাখা উচিত ছিল।
(২) (৩) আর্য্য মিশন ইনিষ্টিটিউসন গীতার স্বধর্ম্ম এবং পর ধর্ম্ম শব্দদ্বয়ের অলীক অর্থ প্রচার করিয়া সাধারণকে প্রতারিত করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। স্বধর্ম=আত্মধর্ম্ম। পরধর্ম্ম=ইন্দ্রিয় ধর্ম্ম। বাচষ্পত্য, শব্দকল্পদ্রুম, প্রকৃতিবাদ প্রভৃতি অভিধানে, স্বধর্ম অর্থে স্বজাতি বিহিত আচার; এবং পর ধর্ম্ম=স্বোচিত বর্ণাশ্রম ধর্ম্মাদি ভিন্ন ধর্ম্মে। শঙ্কর মধুসূদন আদির টীকায় দেখা যায় :-যং বর্ণাশ্রমং প্রতি যো বিহিতঃ স তস্য স্বধর্ম্মঃ। উক্ত পুস্তকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়াদি বর্ণচতুষ্টয়েরও আজগুবী অর্থ লিখিত আছে। মিথ্যা কথা লেখা ভিন্ন কি গীতার সম্ভ্রম রক্ষার উপায় নাই?
(৪) আর্য্য মিশনের গীতায় “দুষ্কৃতাম” অর্থে “দুষ্কর্ম্মের” লেখা আছে। “দুষ্কৃতাম” শব্দের যথার্থ অর্থ “দুষ্টলোকদিগের।” দুষ্কৃতাম শব্দের অর্থ জানা নাই, অথচ শঙ্কর, শ্রীধরের অর্থ উল্টাইয়া দিয়া গীতার নূতন আধ্যাত্মিক অর্থ বাহির করিবার প্রয়াস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *