ভগবদগীতা-সমালোচনা – ১ম পরিচ্ছেদ

ভগবদগীতা-সমালোচনা – প্রথম পরিচ্ছেদ

আজ কাল গীতার বড় আদর। সকল গৃহেই প্রায় গীতা দৃষ্ট হয়। গীতার বহুবিধ সংস্করণ ও অনুবাদ হইয়াছে। গীতার প্রশংসা আর লোকের মুখে ধরে না। পদ্মনাভ-মুখপদ্ম বিনিঃসৃত এক মাত্র ভগবদগীতা পাঠ করিলে অন্য শাস্ত্র অধ্যয়ন করিবার আর আবশ্যক থাকে না, শ্রীধর স্বামী এ কথা বলিয়া গিয়াছেন। হিন্দু মাত্রেই এ কথা মুক্ত কণ্ঠে অনুমোদন করেন। ভারতবাসী আর্য্যসন্তানই কেবল গীতার গুণে মুগ্ধ নয়; ম্লেচ্ছ কুলোদ্ভব ডেলি-নিউসের (Daily News) ভূতপূর্ব্ব ইংরাজ সম্পাদক বলেন যে, ধর্ম্মপদ, বাইবেল এবং গীতা, এই তিন খানিই জগতের মধ্যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম্মপুস্তক। তাহাদের মধ্যে গীতাই আবার সর্ব্বোৎকৃষ্ট। গীতার সহিত তুলনা করিলে ইউরোপের রাজত্ব এবং সমস্ত পৃথিবীর ঐশ্বর্য্য তুচ্ছ বলিয়া বোধ হয়। নিত্য এবং অনিত্য পদার্থের পার্থক্য, স্বর্গ এবং পরলোকের কথা, কেবল মাত্র গীতা পাঠেই অবগত হওয়া যায়। গীতার এরূপ প্রশংসা করদূর যুক্তিসঙ্গত, তাহার সমালোচনা করাই এই পুস্তকের উদ্দেশ্য।(১)

বাঙ্গালা ভাষায় গীতার অনেক প্রকার অনুবাদ দেখিতে পাওয়া যায়; কিন্তু তাহার মধ্যে অনেক গুলিই ভ্রমপূর্ণ। নিজের মানসসম্ভূত হিন্দু ধর্ম্মের সংরক্ষণার্থ কেহ বা (২) কোন কোন স্থলে স্বকপোলকল্পিত অর্থ করিয়াছেন, কেহ বা (৩) অনুবাদ না করিয়া এরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন যে, যাহার সহিত মূলের অনেক স্থলে কিছু মাত্র সংশ্রব নাই। ভাষ্যকার শ্রীশঙ্করাচার্য্য এবং শ্রীধর স্বামীও গীতার অর্থ হৃদয়াঙ্গম করিতে পারেন নাই, শ্রীমান বঙ্কিম চন্দ্র এই কথা বলিতে কুণ্ঠিত হন নাই। হিন্দু ধর্ম্মের এরূপ দুরবস্থা উপস্থিত!!!

কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ সর্ব্বাপেক্ষা মূলানুযায়ী এবং উপরি উক্ত দোষ সকল বিবর্জিত। তাঁহার অনুবাদ শ্রীসত্যচরণ মিত্র মূলের সহিত প্রকাশ করিয়াছেন। পণ্ডিতবর শ্রীপ্রসন্নকুমার বিদ্যারত্ন, স্বামীকৃত টীকা অবলম্বন করিয়া গীতার এক সুন্দর অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা রচনা করিয়াছেন। এই পুস্তকে আমরা উল্লিখিত দুই খানি পুস্তকের অনুবাদ অবলম্বন করিব।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্র গীতার ঘটনা স্থল। উক্ত মহাযুদ্ধের প্রারম্ভে অর্জ্জুন গীতোক্ত উপদেশমালা প্রাপ্ত হন। কৌরব এবং পাণ্ডবগণ, সংগ্রামাভিলাষে ধর্ম্মক্ষেত্রে সমবেত হইয়াছেন। এক দিকে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ প্রমুখ কৌরব পক্ষীয় বীরগণ, ব্যূহরচনা করিয়া যুদ্ধার্থে প্রস্তুত; অপরদিকে পাণ্ডবীয়েরাও উপযুক্ত রূপে সজ্জিত হইয়া দণ্ডায়মান। তখন প্রতাপবান ভীষ্ম, দূর্য্যোধনের হর্ষবর্দ্ধনার্থ সিংহনাদসহকারে উচ্চৈঃস্বরে শঙ্খধ্বনি করিলেন। পরক্ষণেই শঙ্খ, পণব, আনক এবং গোমুখ সকল বাদিত হইয়া তুমুল শব্দ প্রাদুর্ভূত হইল। পাণ্ডবীয়েরাও নিরস্ত রহিলেন না। বাসুদেব, অর্জ্জুন, ভীমসেন, যুধিষ্ঠির, নকুল, সাত্যকি, অভিমন্যু প্রভৃতি বীরগণ, ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের হৃদয় বিদারিত করিয়া আপন আপন শঙ্খ-ধ্বনি করিতে লাগিলেন। তখন অর্জ্জুন-সারথি বাসুদেব, তাঁহার আদেশে উভয় পক্ষের বল নিরীক্ষনার্থ উভয় সেনার মধ্যস্থলে রথ সংস্থাপন করিলেন। কপিধ্বজ পাণ্ডব দেখহিলেন, উভয় সেনার মধ্যে তাঁহার পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য্য, মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, সখা প্রভৃতি সমস্ত আত্মীয়গণ যুদ্ধে জীবন সংকল্প করিয়া অবস্থান করিতেছেন। সমরাভিলাষী আত্মীয়গণকে দর্শন করিয়া অর্জ্জুনের মুখ শুষ্ক, দেহ অবসন্ন, কম্পিত এবং রোমাঞ্চিত হইতে লাগিল। গাণ্ডীব হস্ত হইতে খসিয়া পড়িতে লাগিল, এবং সমুদয় ত্বক দগ্ধ হইতে লাগিল। তখন তিনি কাতরস্বরে বলিলেন :-
“হে গোবিন্দ, এ সকল আত্মীয়গণকে নিহত করা শ্রেয়স্কর বোধ হইতেছে না। আমি জয় আকাঙ্খা করি না, রাজ্যসুখও চাহি না। যাঁহাদের নিমিত্ত রাজ-ভোগ ও সুখের কামনা করিতে হয়, সেই আচার্য্য, পিতা, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক প্রভৃতি আত্মীয়গণকে বধ করিয়া আমাদের রাজ্যে প্রয়োজন কি? ইহাঁরা আমাদের বধ করিলেও আমি ইহাঁদের বধ করিতে পারিব না। হে মাধব, আত্মীয়গণকে বধ করিয়ায় আমি কি প্রকারে সুখী হইব? কৌরবগণের চিত্ত লোভ দ্বারা অভিভূত হইয়াছে বলিয়াই, যেন ইহাঁরা কুলক্ষয় জনিত দোষ এবং মিত্রদ্রোহ জনিত পাপ দেখিতেছেন না। কিন্তু হে জনার্দ্দন, আমরা কুলক্ষয় দোষ অবগত হইয়াও কি নিমিত্ত এই পাপযুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইব না? কুলক্ষয় হইলে, কুলধর্ম্ম বিনষ্ট হয়। কুলধর্ম্ম বিনষ্ট হইলে, কুল অধর্ম্মে পরিপূর্ণ হয়। কুল অধর্ম্মে পূর্ণ হইলে, কুলস্ত্রীগণ ব্যভিচারিণী হয় এবং তাহা হইতে বর্ণশঙ্কর জন্মায়। কুলনাশকদিগের পিতৃগণের পিণ্ডোদক ক্রিয়া বিলুপ্ত হয়। সুতরাং তাহারা স্বর্গ হইতে পতিত হয়। হায়, কি কষ্ট, আমরা এই মহাশাপের অনুষ্ঠান করিতেছি! রাজ্যসুখলোভে স্বজনকে বধ করিতে উদ্যক্ত হইয়াছি! আমি অস্ত্র সকল পরিত্যাগ করিয়া রথের উপর উপবেশন করিলে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ যদি আমাকে বধ করে, তাহাও আমার পক্ষে কল্যাণকর হইবে।”

অর্জ্জুন ইহা বলিয়া শরাসন পরিত্যাগ পূর্ব্বক শোকাকুল চিত্তে রথের উপর উপবেশন করিলেন। অর্জ্জুনের উল্লিখিত বাক্য সকল শ্রবণ করিলে তাঁহাকে দ্বিতীয় যিশুখ্রিষ্ট্র বা শাক্যসিংহ বলিয়া বোধ হয়। যে কৌরবগণ অন্যায় পূর্ব্বক তাঁহাদের সমস্ত বিষয় অপহরণ করিয়া বিনা যুদ্ধে সূচাগ্র পরিমাণ ভূমি দান করিতে অস্বীকৃত হয়; যাঁহাদের জন্য দ্বাদশ বৎসর বনবাস এবং এক বৎসর, বিরাট-ভবনে অজ্ঞাত বাসের অশেষ কষ্ট সহ্য করিতে হইয়াছিল; তাহাদের প্রতি দয়া প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করিয়া অর্জ্জুন নিজ মনের মহত্ব দেখাইলেন। কৌরবগণ তাঁহাদের আজন্ম শত্রু। জতু-গৃহ দাহ ও সভা মধ্যে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা করিয়া তাহাদের কলুষিত হৃদয়ের পরিচয় দিয়াছে। অস্ত্র হস্তে উপস্থিত এরূপ শত্রুকে সম্মুখ সংগ্রামে নিহত করিতে কোনো বীরই পরান্মুখ হয় না। শত্রুকে শাস্তি প্রদান-করণ মানবের প্রকৃতি। কিন্তু ক্ষমা ঈশ্বরের ধর্ম্ম। অর্জ্জুনের হৃদয় সেই স্বর্গীয় ভাবে পূর্ণ হইয়া জ্ঞাতি নিধনে অনিচ্ছা প্রকাশ করিল।

পাঠক হয় ত ভাবিবেন যে, কৃষ্ণ যখন ঈশ্বরের অবতার বলিয়া পরিচয় দেন, তখন তিনি অর্জ্জুনের সাধু ইচ্ছার পোষকতা করিবেন; (৪) এবং তাঁহাকে নরহত্যা হইতে নিবৃত হইতে পরামর্শ দিবেন। ঈশার ন্যায় মহাশত্রুকেও ক্ষমা করিতে আদেশ করিবেন। কিন্তু কৃষ্ণের হৃদয় প্রতিহিংসা পূর্ণ। তিনি অর্জ্জুনের কাতরতা দর্শনে আশ্চর্য্যন্বিত হইয়া বলিলেন–“হে পরস্তপ, তুচ্ছ হৃদয়-দৌর্ব্বল্য দূরীকৃত করিয়া উত্থান কর। ঈদৃশ বিষম সমরে তোমার কি জন্য অনার্যজনোচিত, স্বর্গপ্রতিরোধকর এবং অকীর্ত্তিকর মোহ উপস্থিত হইল।” জ্ঞাতিবধই বোধ হয় কৃষ্ণের মতে আর্য্যজনোচিত কার্য্য, এবং গুরুহত্যা, পিতামহ হত্যাই স্বর্গ গমনের ও কীর্ত্তি স্থাপনের উপায়। পার্থের সহৃদয়তা দর্শনে মুগ্ধ হইয়া কোন বিদেশীয় পণ্ডিত বলেন :–
Arjun’s humanity,–it may be, well styled humane–compassion and generousity is far preferable to the stony hearted philosophy which Krishan professes to be divine. কৃষ্ণের আশ্বাস বাক্যে অর্জ্জুনের শোক দূর হইল না। তিনি দুঃখিতান্তঃকরণে বলিলেন :–“ভগবন্‌, আমি কি প্রকারে পূজনীয় ভীষ্ম এবং দ্রোণকে শরজাল দ্বারা বিদ্ধ করিব! গুরুজনদিগকে বধ না করিয়া যদি ভিক্ষান্ন ভোজন করিতে হয়, তাহাও শ্রেয়ঃ। এই যুদ্ধে জয় এবং পরাজয়ের মধ্যে কোনটীর গৌরব অধিক, তাহা বুঝিতে পারিতেছি না। কারণ যাঁহাদিগকে বধ করিলে ভূমণ্ডলের রাজ্য এবং সুরলোকের আধিপত্য প্রাপ্ত হইলেও আমার ইন্দ্রিয়গণ শোকে পরিশুষ্ক হইবে, সেই ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ যুদ্ধার্থে উপস্থিত।”
পরন্তপ জিতনিদ্র অর্জ্জন, ইহা বলিয়া এবং আমি যুদ্ধ করিব না বলিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন।
কৃষ্ণ দেখিলেন, যথোপযুক্ত উত্তর দিয়া অর্জ্জুনের ন্যায়সঙ্গত আপত্তির খণ্ডন করা দূরহ। যখন তর্কে পারা যায় না, তখন গম্ভীর ভাবে মুরুব্বিয়ানা চালে–“বাপু হে, তুমি বালক, তোমার বুদ্ধি উত্তমরূপে পরিস্ফুটিত হয় নাই; এ সকল শাস্ত্রীয় কথা, হৃদয়াঙ্গম করা অত্যন্ত কঠিন; তুমি বুদ্ধিমান হইয়া এরূপ কুতর্ক করিতেছ কেন?” ইত্যাদি বলিয়াও জয়ী হওয়া যায়। কৃষ্ণ তখন সেই পন্থাবলম্বন করিয়া উভয় সেনার মধ্যবর্ত্তী বিষন্ন-বদন-অর্জ্জুনকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন :–
“হে অর্জ্জুন, তোমার মুখ হইতে পণ্ডিতগণের ন্যায় বাক্য সকল বিনির্গত হইতেছে, অথচ তুমি অশোচ্য বন্ধুগণের নিমিত্ত শোক করিয়া মূর্খতা প্রদর্শন করিতেছ। পণ্ডিতগণ, কি জীবিত, কি মৃত কাহারও নিমিত্ত অনুশোচনা করে না।”(৫)
আরো দেখ, জীবের আত্মা নিত্য এবং অবিনাশী, তিনি শন্ত্রে ছেদিত বা অগ্নিতে দগ্ধ বা জলে ক্লেদ যুক্ত হন না। সুতরাং যুদ্ধার্থে উপস্থিত রাজন্যবর্গকে হনন করিলেও কোন ক্ষতি নাই, কেননা তাঁহারা যেমন জন্মের পূর্ব্বেও বিদ্যমান ছিলেন, মৃত্যুর পরেও তাঁহারা থাকিবেন।
যিনি মনে করেন, এই জীবাত্মা অন্যকে বিনাশ করেন, এবং যিনি মনে করেন, অন্যে এই জীবাত্মাকে বিনাশ করেন, তাঁহারা উভয়ই অনভিজ্ঞ; কেননা জীবাত্মা কাহাকেও বিনাশ করে না এবং জীবাত্মারেও কেহ বিনাশ করিতে পারে না। জাত ব্যক্তির মৃত্যু, এবং মৃত ব্যক্তির জন্ম অপরিহার্য্য। অতএব তুমি শোক পরিত্যাগ পূর্ব্বক আনন্দচিত্তে জ্ঞাতিবর্গকে সমূলে নির্ম্মূল কর। তাহাতে তাঁহাদের কেবল শরীর বিনষ্ট হইবে, আত্মার কিছুই হইবে না। সুতরাং তোমারও কোন পাপ হইবে না।”

বেশ কথা; এই যুক্তি অবলম্বন করিয়া অর্থের জন্য কেহ পিতৃহত্যা করিলেও গীতানুরাগী কৃষ্ণের উপাসকগণ তাহার কিছুমাত্র দোষ দিতে পারিবেন না।
এই সকল কথা শুনিলে Julius Ceasar নাটকের Cassiusএর উক্তি মনে পড়ে।
Cassius:-He that cuts off twenty years of life, cuts off twenty years of fearing death.
Brutus:- Grant that and then is death a benefit. So we are Caesar’s friends, that have abridged his time of fearing death.
Bishop Caldwell কৃষ্ণের এই যুক্তিগুলি সম্বন্ধে বলেন :– A man accused of murder neither denies his guilt,
nor pleads that he committed the act in self-defence, but addresses the Court in the language of Krishna: ‘ It is needless’, he says, * to trouble yourselves about the inquiry any further, for it is impossible that any murder can have taken place. The soul can neither kill nor be killed. It is eternal and indestructible. When driven from one body, it passes into another. Death is inevitable, and another birth is equally {inevitable. It is not the part, therefore, of wipe men like the judges of the court, to trouble themselves about such things5. Would the judges regard this defence as conclusive ? Certainly not. Nor would it be regarded as a conclusive defence by the friends of the murdered person, or by the world at large. The criminal might borrow from the Gita as many sounding nothings as he liked, but the moral sense of the community would continue to regard his murder as the crime. তৎপরে কৃষ্ণ অর্জ্জুনের আত্মগরিমাবৃত্তি উত্তেজিত করণাশায় বলিলেন যে, “তুমি এক জন মহারথী হইয়া যুদ্ধ না করিলে অন্যান্য বীরগণ তোমাকে ভীরু বলিয়া উপহাস করিবে। তোমার ন্যায় যশস্বী লোকের অকীর্ত্তি মরণাপেক্ষাও অধিকতর দুঃসহ।” আর যুদ্ধে লাভেরও বিলক্ষণ সম্ভাবনা আছে। কেননা “সমরে বিনষ্ট হইলে স্বর্গ প্রাপ্ত হইবে, এবং জয়ী হইলে পৃথিবী উপভোগ করিবে।” দুই দিকেই সমান লাভ। অতএব “জয়পরাজয় তুল্য জ্ঞান করতঃ যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উত্থান কর।” এই সকল “তত্ত্ব জ্ঞানের” কথা প্রকাশ করিয়া বাসুদেব “কর্ম্মযোগ বিষয়িণী বুদ্ধি” কীর্ত্তন করিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি বলিলেন, হে ধনঞ্জয়;–“তুমি আপত্তি পরিত্যাগ পূর্ব্বক একান্ত ঈশ্বর-পরায়ণ হইয়া সিদ্ধি এবং অসিদ্ধি উভয়েই তুল্য জ্ঞান করতঃ কর্ম্ম সকল অনুষ্ঠান কর।”(৬)

ইহাই গীতোক্ত সর্ব্বজন প্রশংসিত নিষ্কাম ধর্ম্ম। এই স্থানে বাসুদেব বেদোক্ত যজ্ঞাদি দ্বারা মোক্ষলিপ্সু দ্বিজবর্গের ভ্রম প্রদর্শনার্থ যাহা বলেন, বেদানুরক্ত হিন্দু মাত্রেরই তাহা স্মরণ রাখা উচিত।
“যাহারা আপাততঃ মহোহর শ্রবণরমণীয় বাক্য অনুরক্ত, বহুবিধ ফলপ্রকাশক বেদ বাক্যই যাহাদের প্রীতিকর, যাহারা স্বর্গাদি-ফল-সাধন কর্ম্ম ভিন্ন অন্য কিছুই স্বীকার করে না। যাহারা কামনা পরায়ণ, স্বর্গই যাহাদের পরম পুরুষার্থ; জন্ম, কর্ম্ম ও ফলপ্রদ ভোগ ও ঐশ্বর্য্য লাভের সাধনাভূত নানাবিধ যজ্ঞাদি ক্রিয়া প্রকাশক বাক্যে যাহাদিগের চিত্ত অপহৃত হইয়াছে; সেই বিবেক বিহীন মূঢ় ব্যক্তিদিগের বুদ্ধি সমাধি বিষয়ে (ঈশ্বরারাধনা বিষয়ে) সংশয় শূন্য হয় না। বেদ সকল ত্রিগুণাত্মক; হে অর্জ্জুন, তুমি ত্রিগুণের অতীত হও।” গীতার লেখক (ব্যাসদেব?) যে একজন reformed হিন্দু ছিলেন; হিন্দু ধর্ম্মের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, বেদের প্রতিও যে তাহার যথেষ্ঠ অশ্রদ্ধা ছিল, এই সকল শ্লোকই তাহার প্রমাণ। অথচ মনের দুর্ব্বলতা বশতঃ অথবা সমাজের ভয়ে বৈদিক যজ্ঞেরও মধ্যে মধ্যে প্রশংসা করিয়াছেন; যথা, “কর্ম্ম বেদ হইতে, বেদ ব্রহ্ম হইতে সমুদ্ভব হইয়াছে। অতএব এই সর্ব্বগত ব্রহ্ম নিয়তই যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন।” যাঁহারা যজ্ঞানুষ্ঠান না করেন, তাঁহাদের জীবন পাপময় ইত্যাদি। অথচ, ‘এই সকল কর্ম্ম, অজ্ঞ ব্যক্তিগণের জন্যে’; “ব্রহ্মোপাসকদিগের অনুষ্ঠান করিবার আবশ্যক নাই,” (তস্য কার্য্যং ন বিদ্যতে) ইহাও পুনঃ পুনঃ বলিতে ক্ষান্ত হন নাই।

এ সকল শাস্ত্রীয় কথা শুনিতে শুনিতে অর্জ্জুনের “সমাধিস্থ স্থিত-প্রজ্ঞ” ব্যক্তির লক্ষণ জানিতে বাসনা হইল। শ্রীকৃষ্ণ তাহা বলিয়া দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ করেন।
প্রজহাতি সদা কামা্ন সর্ব্বান্‌ পার্থ মনোগতান্‌
আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থীত প্রজ্ঞস্ততদোচ্যতে
দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ
বীতরাগ ভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্ম্মুনিরুচ্যতে। ২অ-৫৬।
“যিনি সর্ব্বপ্রকার মনোগত কামনা পরিত্যাগ করেন, যাঁহার আত্মা আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ। যিনি দুঃখে অক্ষুব্ধ চিত্ত, সুখে স্পৃহা শূন্য এবং অনুরাগ, ভয় ও ক্রোধ বিবর্জ্জিত সেই মুনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।”
কবিবর Goldsmithএর Deserted Village গ্রন্থেও একটী খ্রীষ্টীয়ান স্থিতপ্রজ্ঞের চিত্র পাওয়া যায়। উভয়টী তুলনা করিলে ইংরাজ এবং ভারতবাসীর স্বভাব এবং ধর্ম্মগত প্রভেদ বেশ বুঝা যায়। গীতার যোগী জিতেন্দ্রিয়, ঈশার ন্যায় ক্ষমাশীল। শত্রু এবং মিত্রেও তাঁহার সম দৃষ্টি। তিনি সকল বিষয়েই স্পৃহা শূন্য। আত্মাতেই তাঁহার প্রীতি, আত্মাতেই তাঁহার সন্তোষ। আত্মাতেই তাঁহার আনন্দ। সংসারের শুভাশুভ কর্ম্মে তাঁহার হস্তক্ষেপ করিবার আবশ্যক নাই। কর্ত্তব্য কর্ম্মের অনুষ্ঠান না করিলেও তাঁহার পাপ হয় না (৩অ-১৮) পুত্রকলত্রাদিতেও স্নেহ শূন্য (জিতসংঙ্গদোষাঃ)। তিনি কুর্ম্মের ন্যায় ইন্দ্রিয় সকল বিষয় হইতে প্রত্যাহরণ করিয়া, নাসিকার অগ্রভাবে দৃষ্টি সংস্থাপন পূর্ব্বক এক প্রকার জীবন্মৃত ভাবে কাওযাপন করেন। মুক্তির জন্যে তাঁহাকে ব্রহ্মোপাসনাও করিতে হয় না;–(ন চাস্য সর্ব্বভূতেষু কশ্চিদর্থব্যপাশ্রয়ঃ)। তিনি “আপনাতেই আপনি প্রীত” হইয়া বসিয়া থাকেন। তাঁহার এই “নিষ্কাম ধর্ম্মের” ভিতর ঘোর স্বার্থপরতা দৃষ্ট হয়, কেননা তিনি সর্ব্বদাই নিজের চিন্তায় মগ্ন।
পরহিতব্রতে উৎসর্গীকৃত জীবন খ্রীষ্টের পুরোহিতও নিজের শুভাশুভের প্রতি দৃষ্টি রাখিতেন না। ঈশ্বরের প্রতি নির্ভর করিয়া সংসারের দুঃখ মোচনে ব্যস্ত থাকিতেন।
Unpractised he to fawn, or seek for power,
By doctrines fashioned to the varying hour;
Far other aims his heart had learned to prize,
More skilled to raise the wretched than to rise.
His house was known to all the vagrant train,
He chid their wanderings but relieved their pain;
His ready smile a parent’s warmth exprest,
Their welfare pleased him, and their cares distrest:
To them his heart, his love, his griefs were given,
But all his serious thoughts had rest in Heaven.
As some tall cliff that lifts its awful form,
Swells from the vale, and midway leaves the storm,
Tho’ round its breast the rolling clouds are spread,
Eternal sunshine settles on its head.

Lord Macaulay প্রাচীন এবং আধুনিক দর্শনশাস্ত্র সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, Goldsmith এবং ব্যাসদেবের আদর্শ মনুষ্য সম্বন্ধে তাহা সুন্দররূপে বর্ত্তে।
The oboject of Bacon’s philosophy “was the multiplying of human enjoyment, and the mitigating of human sufferings. It was the relief of man’s estate. Two words form the key of the Baconian doctrines, Utility and Progress. The ancient philosophy disdained to be useful, and was content to be stationary. It dealt largely in theories of moral perfection, which were so sublime that they never could be more than theories ; in attempts to solve insoluble enigmas; in exhortations to the attainment of unattainable frames of mind. It could not condescend to the humble office of ministering to the comforts of human beings.” (Essay on Bacon)

বিষয় বাসনা মানবহৃদয়কে কিরূপে পাপপঙ্কে নিপতিত করে, তৎসম্বন্ধে এই অধ্যায়ে একটী সুন্দর উপদেশ আছে। ধ্যায়তো বিষয়ান্‌পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে (২অ-৬২)। এই জন্যই ঈশা বলিয়াছেন :–
It is easier for a camel to go through the eye of a needle, than for a rich man to enter into the kingdom of God.

——————
১. এই পুস্তকের কিংয়দশ ১৩০১ সালের পৌষ মাসের নব্যভারতে প্রকাশিত হইয়াছিল।
২. আর্য্যমিশন ইনষ্টিটিউশনের গীতা।
৩. শ্রীশশধর তর্কচূড়ামণির বঙ্গানুবাদ।
৪. হৃদ রাজ্য উদ্ধারার্থে যুদ্ধ করা পাণ্ডবগণের পক্ষে অন্যায় হইয়াছিল, এ কথা কেহ বলে না। এরূপ স্থলে যুদ্ধ করাই মানবের স্বাভাবিক কিন্তু যুদ্ধ না কইলেও যে বিশেষ পাপ হইত, তাহাও নয়। এমন লোকও বিরল নয়, যাহারা আত্মীয়বর্গকে হত্যা পর্য্যন্ত করিয়া বিষয় উদ্ধার করা অপেক্ষা, অক্ষুব্ধ চিত্তে ছাড়িয়া দিতে পারেন। কিন্তু এ সকল কথা অপ্রাসঙ্গিক, কারণ কৃষ্ণ গীতায় যে সকল যুক্তি দ্বারা অর্জ্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করিয়াছিলেন, তাহারই সমালোচনা করা এই পুস্তকের উদ্দেশ্য।
Bishop Caldwell বলেন, Krishna does not base his exhortations to Arjun on the justice of the war in, which he was engaged. That ground might have been taken with properety and Arjun was evidently persuaded of the justice of the Pandava’s cause. But Krishna’s arguments are based upon transcendental doctrines respecting the immortality and impassibility of the soul, which, if they proved his point, would equally prove the most unjust war that was ever waged to be innocent.গীতায় “ধর্মযুদ্ধ” শব্দ ইংরাজী just war-এর প্রতিশব্দ নয়। ধর্ম্মশাস্ত্রানুসারে যুদ্ধ করাকে ধর্ম্মযুদ্ধ কহে। তদ্বিপরীতকে অধর্ম্ম যুদ্ধ বলে। যথা, ভীম কর্তৃক দূর্য্যোধনের উরূভঙ্গ, সপ্তরথী কর্ত্তৃক অভুমন্যু বধ।
৫. স্বাভাবিক কারণে মৃত আত্মীয়বর্গের জন্য জ্ঞানবান শোক করিতে না পারেন। গতানুশোচনা পণ্ডিতের পক্ষে অনুপযুক্ত। কিন্তু যে পণ্ডিত স্বহস্তে গুরুজনকে বধ করিয়াও বিন্দুমাত্র দুঃখিত হন না, তাঁহার পাণ্ডিত্যের মহিমা বোঝা আমাদের পক্ষে অসম্ভব।
৬. ইতিপূর্ব্বে বাসুদেব রাজ্যলাভ এবং স্বর্গলাভের প্রলোভন দেখাইয়া যুদ্ধ করিতে পরামর্শ দেন। এখন আবার নিষ্কাম ভাবে তাহা করিতে বলিতেছেন। যে প্রকারেই হউক, অর্জ্জুনকে যুদ্ধ নিযুক্ত করাই তাঁহার উদ্দেশ্য। কেহ কেহ বলেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণার্জ্জুনের স্বার্থ নাই। ধর্ম্মের সংস্থাপন এবং অধর্ম্মের নাশই তাঁহাদের উদ্দেশ্য। বন্ধুদ্বয়ের কথাবার্ত্তায় কিন্তু স্পষ্টই দেখা যায় যে, অপহৃত রাজ্যের পুনরুদ্ধারই তাঁহাদের অভিপ্রায়। কৃষ্ণ বলিতেছেন, “তুমি রণে শত্রুগণকে হত্যা করিয়া সমৃদ্ধ রাজ্য ভোগ কর (১১অ–৩৩)। আর অর্জ্জুন বলতেছেন, হে গোবিন্দ, আত্মীয়গণকে হত্যা করিয়া রাজ্যলাভে আমার প্রয়োজন কি! বন্ধুগণকে বধ করিয়া স্বর্গের আধিপত্য পাইলেও আমি সুখী হইব না।

1 Comment
Collapse Comments

কার লেখা এটা?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *