সামনে কুয়াশা

সামনে কুয়াশা (এরকুল পোয়ারো)
(আগাথা ক্রিস্টির ডায়েরি থেকে তার প্রথম রহস্য কাহিনী)

০১.

 দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে।

আকাশে সূর্য হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে ইতিমধ্যে পশ্চিমের দিগন্ত রেখায়। কিছুটা সময় পরেই বড় এক লাল টমোটার মতো আকার নিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে যাবে দিগন্তের অপর পারে। তার আগেই অবশ্য ছড়িয়ে পড়বে অমলিন রক্তাভা। ভারী সুন্দর দেখতে হবে দৃশ্যটি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এসব দৃশ্য দেখার মতো সময় নেই মানুষের। মানুষ এখন নিরন্তর ছুটে চলেছে অর্থ আর যশের পেছনে। ইট, কাঠ, পাথরের বেড়াজালে বাস করে মানুষের মনটাও কেমন বরফ আর কঠিন হয়ে গেছে। না হয়েই বা উপায় কি। সমস্যার নাগপাশে বন্দী সাবই। নিজেকে ছাড়িয়ে দৃষ্টি একটু দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখার মতো কোন উপায় নেই তার। মনটা কেঁদে ওঠে। ইচ্ছে হয় মায়াবী এই জালটা ছিঁড়ে কোথাও পালিয়ে যাই, দুখণ্ড প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিয়ে আলাপন সারি। সেখানে আকাশ অল্প বিস্তৃত প্রান্তরে সাথে, কথা বলি ঝর্নার সাথে, স্নান করি তটিনী তরঙ্গে, মেতে উঠি আনন্দে। আলোর একটি কণা, হাসির টুকরো আনন্দের পথ, ফুল কুড়িয়ে নিই। ধরে রাখি চিরদিন নিজের কাছে।

হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিলো লীনা।

লীনা স্যাণ্ডর্স। সেকেণ্ডারী স্কুলের ইংলিসের টিচার। মনটা ভালো নেই। অনর্থক ধমক খেয়েছে হেডমিস্ট্রেসের কাছে। হ্যাঁ, অনর্থক বৈ কি। লীনা জানে, ওর কোন দোষ নেই। মেয়েরা যদি রেজাল্ট ভালো না করে তার জন্যে কি সে দায়ী হবে? সে কি সবকিছু করতে পারে একা? কেউ ক্লাসে তার লেকচার ফলো করে না। পড়ার বইয়ের বদলে মন দেয় ফিল্ম ম্যাগাজিনে। হলিউডের তারকাদের দিকে তাকিয়ে থাকে দিনরাত। টিচার কি করবে তবে? তাছাড়া রেজাল্ট খারাপ তার ক্লাসের মেয়েদেরই। অন্যেরা মোটেই এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। কিন্তু হেডমিস্ট্রেস কেমন ভাবে ওকেই শুধু কথাগুলো শোনালেন, কথাগুলো এখনও কানে লেগে আছে লীনার। কানদুটো জ্বালা করছে তখন থেকে।

থার্ড পিরিয়ডটা অফ ছিল লীনার। কমনরুমে বসে ছিলেন একাই। বেয়ারা এসে খবর দিলো, বড় দিদিমণি ডাকছেন।

বড় দিদিমণি মানে হেডমিস্ট্রেস শীলা কাউড্রে। নাম শুনলে মনে হয় স্বাভাবিক যে কোন স্লিম ফিগারের সুন্দরী হবেন বুঝি। কিন্তু আদপে তা নয়। পৃথুলা চেহারা। বয়েস হয়েছে বেশ। রূঢ় স্বভাবের জন্যে ছাত্রীরা তো বটেই, টিচাররাও পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে তাকে। সেই তিনি হঠাৎ কি কারণে…স্বাভাবিক ভাবেই মনটা চিন্তিত হয়ে যায় লীনার। তবু সামান্য চাকরি করে সে। হেডমিস্ট্রেসের ডাকে তাকে তো সাড়া দিতেই হবে।

-বসুন। দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়নি।

 কি গলা। যেন হাঁড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে শব্দগুলো, কি ছিড়ি কথার। রসকসের কোন বালাই নেই। কানদুটো ঝা ঝাঁ করছে লীনার। তবু বসলো।

-বলুন কি বলবেন?

-হ্যাঁ, বলছি। গত দুটো এগজামিনেই মেয়েদের ইংলিশের রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে। টেস্টে তত দশজন অ্যালাউ হলো না। শুধু ইংলিশে পুওর মার্কসের জন্যে। ছিঃ ছিঃ, মিসেস স্যাণ্ডার্স, ভেরী ডিসগ্রেসফুল। ছাত্রীদের মাতৃভাষা ইংলিশ। অথচ সেই সাবজেক্টটাতেই যদি তারা এমনি করে তাহলে আর আপনি….

কথাটা শেষ করলেন না শীলা কাউড্রে। কিন্তু লীনা বুঝতে পারলো–তাহলে আর আপনি আছেন কেন?

আছি কেন? থেকেই বা কি করা যায়? তুমিই বা কতটুকু পারছো শুনি? তোমার নিজেরও তো মাতৃভাষা ইংরেজি। অথচ এক মিনিটের ভাষণেই কতগুলো বিদেশী শব্দ ব্যবহার করে ফেললে। মাতৃভাষার প্রতি যদি সামান্য দরদ থাকতো তাহলে এই অবস্থা হতো না তোমার।

কথাগুলো অবশ্য সে মনে মনে বলল। আর সামনে বলল–আমি দেখছি ম্যাডাম, কি করা যায়। সামনের বার আশাকরি ভালোই হবে।

–আশা করি-টরি নয়। হতেই হবে। যেন মেঘ গর্জন, ইউ মাস্ট, আচ্ছা। ডান হাতের তর্জনীটা সামান্য ওপরে তুললেন হেডমিস্ট্রেস। যেন নির্দেশ করলেন দরজার দিকে। উঠে দাঁড়ানো লীনা। ওল্টানো পেপার কাটিংটা আবার চোখের সামনে মেলে ধরলো কাউড্রে। তার চোখে লীনা দেখলো, শার্লক হোমস।

সেই থেকে মেজাজটা খারাপ হয়েছে লীনার। বাকি ক্লাসগুলো কি করে যে নিয়েছে মনে করতে পারছে না ও।পিরিয়ড শেষ হতে যেন নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচেছিল। আর এক মুহূর্তে দেরী না করে ছুটতে ছুটতে নেমে এসেছিলো নীচের রাস্তায়। আর তখনই তার মেজাজটা ফের তেতো হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ।

সেই লোকটা। সামনের পানের দোকানে দাঁড়িয়ে ঝুলানো আগুন থেকে সিগারেট ধরাচ্ছে পরনে দামী স্টেটলনের প্যান্ট। রঙটা অন্য। ক্রিম কালারের হাওয়াই শার্টটা ঠিকই আছে। সিগারেট ধরিয়ে লোকটা যেন চোরা চোখে একবার দেখে নিলো লীনাকে।

বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে উঠলো লীনার। অজানা আতঙ্কের একটা হিমেল স্রোতে মেরুদণ্ড বেয়ে ওপরে উঠে আসতে থাকে ক্রমশঃ। ঠিক একটা তৈলাক্ত সরীসৃপের মতোই। ভয়ে আর বিতৃষ্ণার যুগপৎ আক্রমণে কেমন যেন হয়ে পড়ে লীনা। আজ প্রথম নয়। পর পর তার তিনদিন এরকম হলো। কে লোকটা। কি চায়? কেন এমন ভাবে লীনাকে অনুসরণ করছে? লীনা স্যাণ্ডার্স নামের এই সাধারণ মেয়েটার সঙ্গে ওর কি প্রয়োজন? তবে কি কোন রহস্যের বেড়াজালে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ছে নাকি লীনা? এই বিরাট বিচিত্র শহর লণ্ডন। তার হরেক পাপচক্রের কোন একটির মধ্যে কুক্ষিগত করতে চাইছে লীনাকে? সন্ধ্যের আবছা আলো ক্রমেই ঘন হয়ে নামছে পৃথিবীর বুকে। স্ট্রীটল্যাম্পগুলো জ্বলে গেছে ইতিমধ্যেই। অন্ধকার একেবারে দূর হয়নি। কেমন একটা মায়াবী আলো-আঁধারির খেলা।

সত্যি সত্যি পেছন ফিরে তাকালো লীনা। লোকটা আসছে। ঠিক, একই ভাবে, গত দুদিনের মতো, বাঁ-হাতে একটা বড়সড় ফোলিও ব্যাগ। ডান হাতে দুআঙুলে ধরা সিগারেট, মাঝে মাঝে সিগারেট ধরা হতটা ওপরে উঠে আসছে। দুঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরছে সিগারেট। অল্প অল্প ধোঁয়া ছাড়ছে। আর আশ্চর্যের বিষয়, এই অন্ধকারেও কালো চশমার আড়ালে ঢেকে রেখেছে চোখদুটো। এই জিনিষটা ভারী অদ্ভুত লাগছে লীনার। লোকটির কি কোন দোষ হয়েছে? নাকি ধরা দিতে চায় না?

লোকটির আকৃতি, চলার ভঙ্গী দেখে হঠাৎই একটা কথা মনে হলো লীনার। একটুকরো আশার ফুলকি। কিন্তু তাও কি সম্ভব। মাত্র একমাসের পরিচয়। তাও দশ বছর আগে।…ভাবতে ভাবতেই জোরে পা চালালো লীনা। হাইড ব্রিজটা পার হয়ে, নীচু রাস্তার বাঁ দিকে। কয়েকটা আঁকাবাঁকা গলিপথ। শেষ গলিটার শেষ প্রান্তে তিনতলা বাড়িটার দোতলায় দেড় কামরার ফ্ল্যাট লীনার, গত দশ বছর এই তার আশ্রয়। আর স্কুলমাস্টারী।

ঘরে ঢুকলো, সুইচ টিপে আলো জ্বালালো। মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রকটা পাল্টে নিলো। এবার একটু রেস্ট। লীনা শরীরটা ছেড়ে দিলো বিছানার ওপর।

.

০২.

 –আসতে পারি?

 চমকে ওঠে লীনা। তাড়াতড়ি উঠে বসে বিছানার ওপর। দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে। পর্দা দুলছে। ওপরে অস্পষ্ট ছায়া।

–কে? লীনার গলায় স্বর ফুটলো না ভালো করে।

উত্তর এলো না। তার বদলে এক আগন্তুক নিজেই ভেতরে ঢুকে এলো। ঘরের একটি মাত্র চেয়ারে বসলো সে। হাতের ফোলিও ব্যাগটা সাবধানে নামিয়ে রাখলো মেঝেতে।

-কে, কে আপনি? লীনার স্বরে উত্তেজনা। না, এভাবে না বলে-কয়ে ঘরের ভেতর।

হাত তুলে বাধা দিলো আগন্তুক। চোখ থেকে কালো চশমাটা খুললো। হেসে বললো–সত্যিই আমাকে তুমি চিনতে পারো নি লীনা?

লীনা একদৃষ্টিতে দেখছিলো আগন্তুককে। কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর এগিয়ে এলো সে। আশা-নিরাশার দোলায় দুলছে মন।

–তুমি…তুমি পিটার। সত্যি তুমি।

বিস্ময়ে অবরুদ্ধ হয়ে আসে তার গলা। আশা আর আনন্দটা যেন একসঙ্গে আক্রমণ করেছে তাকে। চেতনারা হারিয়ে গেছে অবচেতনায়।

-হ্যাঁ, আমি। আগন্তুক এবার বেশ ছড়িয়ে হাসলো। ভালো করে চেয়ে দেখো।

 দেখলো লীনা।

 হ্যাঁ, ঠিক সেই মুখ সেই চোখ। কপালের ওপর সেই কাটা দাগ পর্যন্ত স্পষ্ট।

তবু সন্দেহ আর বিশ্বাসের পর্দা সরে গেল না একেবারে। কণ্ঠে দ্বিধা জড়িয়ে লীনা বলল–তাহলে সেই ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট!

না, মরিনি! দেখতেই পাচ্ছে। তবে পুরো একটা মাস অজ্ঞান হয়েছিলাম। তারপরেও বেশ কিছুদিন পুরনো কথা কিছু মনে করতে পারতাম না।

মুখ উঁচ করলো পিটার।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললল লীনা। বড্ড রোগা হয়ে গেছে পিটার।–তা এততদিন ছিলে কোথায়?

-কোথায় ছিলাম না তাই বলো। বিষণ্ণ হাসি হাসলো পিটার। দশ-দশটা বছর পার হয়ে গেল, তাই না লীনা। দীর্ঘসময় টেমসের কত জল বয়ে গেছে বলো তো! এখন আসছি নিউইয়র্ক থেকে। খাস আমেরিকায় কি করছি জিজ্ঞেস করলে না?

-বলল শুনি।

—বিজনেস।

-বিজনেস-কিসের?

–টয় গুডসের।

–মানে পুতুল-টুতুল?

–অনেকটা তাই বলতে পারো।

–সেটা কি এখান থেকে হতো না?

–হত। কিন্তু মুশকিল কি জানো। এখনো অনেকের মোহ আছে আমেরিকা নামটার প্রতি।

–তাই নাকি?

–মেটেরিয়ালস আমরা পাঠিয়ে দিই। জিনিসটা তৈরী হয় ওদেশে।

–তুমি এখানে কিছুদিন থাকবে তো?

–হ্যাঁ, আমি এদেশেই থাকবো। আমি এখানকার চীফ এজেন্ট।

একটু চুপ করে থাকে পিটার, মাথা নিচু করে কি যেন ভাবে। তারপর বলে, তোমাকে একটা কাজের ভার দেবো লীনা। সেজন্যেই আমি এসেছি আজ।

-কাজ? তোমার বিজনেসে?

–ধরো তাই। কেন পারবে না?

-না পারার কি আছে। একটু যেন লজ্জা পায় লীনা। তারপরে সহজেই বলে-কাজটা কি, তাতো বলোনি!

-বলছি।

ফোলিও ব্যাগটা মেঝের ওপর থেকে তুলে নিয়ে হাঁটু দুটোর ওপর রাখে পিটার। চেন খুলে ভেতর থেকে একটা প্রাচীন মডেল বের করে রাখে টেবিলের ওপর।

লম্বায় প্রায় ফুটখানেক হবে মূর্তিটা। চওড়ায় ইঞ্চি আড়াই। আগাগোড়া সোনালী রঙে মোড়া।

লীনা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। লণ্ডনের যে কোন অভিজাত স্টেশনারী সপে এরকম মূর্তি দুর্লভ নয়। তবু এই মূর্তিটির যেন বিশেষত্ব আছে। অপূর্ব ফিনিশ। কি মনে করে মূর্তিটা হাতে তুলে নেয় লীনা। বেশ ভারী। কেজি দেড়েক ওজন হবে। বিস্মিত লীনা। মূর্তিটা নামিয়ে রাখে টেবিলের ওপর।

পিটার ওর দিকে তাকিয়ে হাসে–খুব ভারী তাই? নিরেট পাথরের তৈরী।

-পাথরের এমন রং করা যায় নাকি? সোনালী পাথর? লীনা অবাক হয়ে ভাবে।

এটা কাল তার আটটার সময় ডেলিভারি দিয়ে আসতে হবে একজনকে। পিটার বলে, অথচ কাল সকালেই একটা জরুরী কাজে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে ডোভারডাই।

–তাই আমার কথা মনে পড়লো, কেমন, ঠিক কিনা?

–না, তা ঠিক নয়। পিটার বুঝি একটু অপ্রস্তুত। আমাকে ভুল বুঝো না।

-ঠিক আছে। লীনা হাসে।সময় তো বললে। এখন স্থান আর পাত্র বলে। অর্থাৎ কোথায় কার কাছে দিয়ে আসতে হবে।

-বলছি। পিটার সিগারেট ধরায় একটা। একমুখ ধোঁয়া ছাড়ে। তারপর বলে, কাল রাত ঠিক আটটার সময় হোটেল প্যারাডাইসে মিঃ স্টুয়ার্টের হাতে দিয়ে আসতে হবে এট। হোটেলটা তুমি চেনো তো? জিজ্ঞাসা করে পিটার।

লীনা ঘাড় নাড়ে! অর্থাৎ সে চেনে।

সিলিং-এর দিকে মুখ করে পর পর কয়েকটা রিং ছাড়ে পিটার। তারপর আবার বলে–একেবারে কোণের দিকে একটা টেবিলে একা থাকবেন মিঃ স্টুয়ার্ট ছাইরঙের স্যুট থাকবে পরনে। চোখে কালো চশমা, জামার বটম হোলে লাল গোলাপ। আশাকরি চিনতে কোন অসুবিধা হবে না।

–বেশ। তুমি মূর্তিটা শুধু তাকে দিয়ে বলবে, এ গিফ্ট ফ্রম পিটার।

–শুধু এইটুকু। আর কিছু না?

–হ্যাঁ, আর সামান্য একটু বাকি আছে, তিনি একটা মুখআঁটা লেফাফা দেবেন তোমাকে তুমি সেটা নিয়ে চলে আসবে। তারপর আমাকে দিয়ে দেবে।

-তোমাকে তখন পাবো কোথায়?

–আমি কাছেই থাকবো।

–সেকি? অবাক হলো লীনা। এই যে বললে ডোভার যাবে।

-ও হ্যাঁ হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি যেন নিজের ভুল শুধরে নিলো পিটার। তবে রাত্রিতে ফিরবো তো, এসেই দেখা করবো তোমার সঙ্গে।

আর একদফা অবাক হলো লীনা। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।

পিটার উঠলো চেয়ার ছেড়ে। আজ তাহলে চলি লীনা। আবার কাল দেখা হবে।

–রাতে থাকবে না?

-না। এক বন্ধুর মেসে থাকবো। কথা দেওয়া আছে। বলল পিটার। ভয় নেই। দু-একদিনের মধ্যেই পাকাপাকি ভাবে এসে উঠছি এখানে। এ ঘর তোমার।

-তা জানি না। তবে তুমি আমার। লীনা আমার, লীনা।

লীনার চিবুকে হাত দিয়ে একটু আদর করলো পিটার। তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। লীনাও পেছনে গেল পাশাপাশি নামতে লাগলো সিঁড়ি দিয়ে।

.

০৩.

 ডাবল ডেকারটা পিটারকে নিয়ে চলে গেল। যতক্ষণ না দৃষ্টির একেবারে বাইরে চলে গেল ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো লীনা।

পিটার তার স্বামী। কতদিন পর দেখা। কতদিন? নিজেকে জিজ্ঞাসা করলো লীনা।

 নিজেই নিজের উত্তর দিলো–দশ বছর।

দীর্ঘ দশটা বছর কেটে গেছে এর মধ্যে। সেই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা। সবাই বলেছিল, পিটার মারা গেছে। কিন্তু লীনা বিশ্বাস করেনি। ও জানতো, পিটার বেঁচে আছে। ফিরে আসবে একদিন। তাই তো এতদিন পর ঠিক ফিরে এসেছে পিটার তার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখে।

হঠাৎ চমক ভাঙালো লীনার। কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছে আকাশপাতাল। স্মৃতির গোলকধাঁধায় শাক খাচ্ছে অন্ধের মতো। বাসটা তো চলে গেছে অনেকক্ষণ। ভয়ঙ্কর কথাটা হঠাৎ চাবুক মারলো যেন। মনে পড়লে তাড়াতাড়িতে ঘরে দরজাটা বন্ধ করে আসা হয়নি। সর্বনাশ! দরজা খোলা পেয়ে কেউ যদি চুরি করে নিয়ে যায় মডেলটা! পিটার বলেছিল, ওর দাম নাকি অনেক। বডোলোকেরা ড্রয়িংরুম সাজানোর জন্যে অবিশ্বাস্য দামে কিনে নেয় ওদের কোম্পানির জিনিস। এলাকাটাও ভালো নয়। চুরি, ছিনতাই লেগেই আছে।

দ্রুতপায়ে ঘরের দিকে এগোতে লাগল লীনা।

ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় সে। দরজার পর্দা উড়ছে হাওয়ায়। ওপরে সিঁড়ির দিকে তাকালো। তেতলায় উঠবার মুখে দাঁড়িয়ে হেলেনা।

লীনাকে দরজার সামনে থমকে দাঁড়াতে দেখে তাড়াতাড়ি নেমে এলেন তিনি।

-দরজা খোলা রেখে বাইরে বেরিয়ে ছিলে লীনা। কি ভুলো মন তোমার! আমি তখন থেকে পাহারা দিচ্ছি। দেখো তো সব ঠিক আছে কিনা। হেলেনার কাথায় চাপা উদ্বেগ।

কথা না বলে ভেতরে ঢুকলো লীনা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অস্ফুটে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো তার গলা দিয়ে। টেবিলের ওপর মূর্তিটা নেই!

–কি হলো, লীনা?

হেলেনা ঢুকে পড়লেন ঘরের ভেতর।–কিছু চুরি গেছে নাকি?

–হ্যাঁ। লীনার চোখ ফেটে জল আসছিল তখন, একটা পুতুল।

পুতুল? হেসে উঠলেন হেলেনা। আমি ভাবলাম, না জানি কি। টাকা পয়সা, সোনা রুপা বা মণি মুক্তো। ভালো করে মনে করো। কোথায় রেখেছে পুতুলটা। চোর কি আর পুতুল নিতে আসবে।

হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন হেলেনা।

নিজের ঘরের মধ্যে বসে রইলো লীনা। যেন পাথর। সমস্ত চেতনা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার কোন অনুভূতি আর জেগে নেই। এরপর কি করবে লীনা? কাল রাতে মিঃ স্টুয়ার্টের হাতে কি তুলে দেবে সে? আর পিটার? তাকে যে অনেকদিন পর ফিরে পেয়েছে লীনা? তবে কি পেয়েও হারাবে তাকে।

হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মনে হলো তার। আছে, একজন আছে, যে পারে লীনাকে এই সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে।–পোয়ারো, এরকুল পোয়ারো।

নিরাশার ভাবটা কেটে গেল লীনার।

 দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়লো আবার।

পোয়ারোর বাড়ি কাছে। আস্তে হাঁটলেও মিনিট পনেরোর বেশি লাগে না। সামান্য সময়টুকু যেন ধৈর্য ধরতে পারছে না লীনা। ব্যস্ত পায়ে সামনের টেলিফোন বুথটার দিকে এগোল সে।

.

০৪.

 প্রাইভেট ডিটেকটিভ এরকুল পোয়ারো বিছানার ওপর আড় হয়ে শুয়ে একটা ক্রাইম নভেলের মধ্যে ডুবে ছিলো। সামনে সোফার ওপর বসে ওর সখা বনাম সচিব অ্যাণ্ডজ। সিগারেট পুড়ছে একের পর এক। সামনের টেবিলে সেদিনের ইংরেজি দৈনিকটা।

অ্যাণ্ড্রুজ হঠাৎ আধপোড়া সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে বলল–আজকের সবচেয়ে ইমপর্টেন্ট নিউজটা পড়েছে, এরকুল?

ইমপর্টেন্ট নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের ওপর। তোমার কাছে হয়তো যা ইমপর্টেন্ট, আমার কাছে তা একেবারেই

বাধা দিল অ্যাণ্ড্রুজ।–আঃ, তোমার দর্শন থামাও। এখন দেখছে দেশের গোল্ড স্মাগলিং কেমন বেড়ে গেছে।সোনার দাম কিন্তু তার জন্যে একটুকুও কমেনি। এই তো পাশের বাড়ির মিসেস অ্যান্ড্রু সেদিন দুঃখ করছিলেন।

-আঃ, কি বাজে বকছো।

 অ্যাণ্ড্রুজকে বেশ বিষণ্ণ মনে হয়। এতবড় একটা সিরিয়াস ব্যাপার।

–কি বলবো, বন্ধু। হাতের বইটা মুড়ে রেখে বিছানার ওপর সোজা হয়ে বসে এরকুল–কেউ যদি আমাদের না ডাকে।

-সত্যি, বহুদিন একেবারে বেকার, তাই না?

–হ্যাঁ, মিসেস লিসার সেই ব্যাপারটার পর থেকে হাতে তো কোন কেস নেই।

–আচ্ছা, সেটাও তো সোনাদানার ব্যাপার ছিল।

 –ঠিক, তবে সেটা স্মাগলিং-এর নয়। এরকুল একটা আড়মোড়া ভাঙে।

 অ্যান্ড্রুজের দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে বলে-একটা সিগারেট ছাড়ো তো।

 অ্যাণ্ড্রুজ প্যাকেটটা ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে।

এরকুল সিগারেট ধরায়। গলগল করে একরাশ ধোঁয়া ছাড়ে নাক-মুখ দিয়ে।

টেলিফোনটা বেজে ওঠে ঐসময়। অ্যাণ্ড্রুজ বলে–ঐ শোন। ডাক এলো বোধ হয়।

-তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।

এরকুল বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে যায় দূরাভাষ যন্ত্রের দিকে। ক্রেডেল থেকে রিসিভার তোলে।

তারপর মিনিট তিনেক ধরে ওদের সংলাপ চলে।

অ্যাণ্ড্রুজ বুঝতে পারে যে সত্যিসত্যিই একটা কেস এসেছে এবার।

কে এই লীনা?

 ওপারের কণ্ঠস্বর আর শোনা যায় না।

–আচ্ছা, তাই নাকি।

–ভারী আশ্চর্য লতা।

-না না, কোন ভয় নেই। আমি আসছি এখুনি। হ্যাঁ, মুহূর্তে রওনা দিচ্ছি। চিন্তা করো না। তুমি।

অ্যাণ্ড্রুজ যেন অবাক হয়ে গাত্রোখান করে বলে–এই লীনা নামের মহিলাটি কি?

-সেকি।

এবার অবাক হওয়ার পালা এরকুলের। গত দশ বছর ধরে যার সাথে তুমি বহন করে চলেছো বন্ধুত্বের সম্পর্ক, যে তোমাকে গিফট পাঠায়, তার কথা ভুলে গেলে?

-ও তোমার সেই পাতানো বোন।

সবকিছু মনে পড়ে গেল অ্যাণ্ড্রুজের।

–পাতানো হলেও বোন বোনই। তার আর পরিচয়ের দরকার নেই। তাছাড়া মনে রেখো, সে কিন্তু তোমারও বোন হয়ে গেছে।

হঠাৎ যেন গম্ভীর হয়ে যায় এরকুল।

–এক্সকিউজ মি।

বেশ লজ্জিত মনে হয় অ্যাণ্ড্রুজকে।

-চলো আমি তৈরী।

–হ্যাঁ, চলো। ক্যাজুয়াল ড্রেস পরে এরকুল। দরজার তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ে দুজনে।

.

০৫.

 লীনার মুখে সব কথা শুনে এরকুল বলে–তাহলে এই তোমার কাহিনী?

-সংক্ষেপ। এরকুল, যা যা ঘটেছে তা আগাগোড়া বলে গেলাম আপনাকে।

 –হুঁ।

এরকুল সিগারেটে টান দেয়–যাইহোক। একটা নীট লাভ তো হয়েছে তোমার। তোমার হারানো স্বামীকে তো ফিরে পেয়েছে।

–পেয়েছি। কিন্তু ভয় হয়। পেয়েও না হারাই।

 লীনার চোখে জল।

এরকুল অভয় দেয়–ভয় নেই। আমি তো এসে গেছি। তবে আগে একবার ঐ হেলেনার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

–এখনই?

–হ্যাঁ। দেরী করে কি লাভ?

.

-আপনি তাহলে কাউকে দেখেননি।

–না। বললাম তো। কিছুতেই না। কাউকে না।

–আচ্ছা, আপনি হঠাৎ ঐ নীচে নেমে আসছিলেন কেন?

–একলা ঘরে ভালো লাগছিল না। তাই ভাবলাম, লীনার সঙ্গে গল্প করে আসি।

তারপর সিঁড়ির বাঁকের মুখে এসে থমকে দাঁড়ালাম। দেখলাম লীনার ঘরের দরজাটা খোলা। পর্দার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে।

–এই দেখে আপনি আর এগোলেন না, তাই তো?

–ভাবলাম, ঘরে হয়তো তোক আছে তাই।

–কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন ঐভাবে?

–মিনিট তিন-চার হবে।

–তারপর?

–তারপর যখন কারো সাড়াশব্দ পেলাম না। তখন কেমন সন্দেহ হলো। তবে কি লীনা ঘরে নেই।

–লীনা ফিরলো কখন?

-একটু বাদেই। তখনই বকাবকি করি তাকে। এভাবে দরজা খুলে যাওয়া উচিত হয়নি। এরকুল বুঝলো, এর কাছে থেকে আর কোন কাজের কথা পাওয়া যাবে না। সে বলল- আজ আসি মিসেস হেলেনা। অনেক ধন্যবাদ। দরকার হলে আবার আসবো।

নিশ্চয়ই। একশোবার। লীনার একটা পুতুল নাকি খোয়া গেছে। দেখুন তো কি কাণ্ড।

–হ্যাঁ, জিনিসটা লীনার যথেষ্ট সখের। চিন্তিতভাবে বলে এরকুল। তারপর নেমে আসে নিচে, লীনার ঘরে।

লীনা বলল–কি করবো, এরকুল?

–কি আবার করবে? হাসলো এরকুল। কাল রাত ঠিক আটাটায় হোটেল প্যারাডাইসে মিঃ স্টুয়ার্টের সঙ্গে দেখা করো।

-খালি হাতে?

–বোকা মেয়ে। ঐ পুতুলের অভাব আছে কোন। কিনে দেবো একটা।

 –কিনে দেবে?

নিশ্চয়ই। তারপর সেটা মিঃ স্টুয়ার্টের হাতে দিয়ে বলবে, এ গিফট ফ্রম পিটার। যেমনটি পিটার বলে দিয়েছিল।

–আমার কেমন যেন ভয় করছে এরকুল। কোন রকম বিপদ হবে না তো?

গম্ভীর স্বরে এরকুল বলে–লীনা, তোমার এই দাদাটি থাকতে তোমার কোন ভয় নেই।

-দাদাটি কেন? দাদারা বলো। বাধা দেয় অ্যাণ্ড্রুজ–কিংবা দুটি দাদা।

ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে এরকুল-বদলা নিলে বুঝি। বেশ, বেশ।

 ভারী গুমোট আবহাওয়া লঘু হয়ে গেল নিমেষে।

এরকুল সস্নেহে লীনার মাথায় হাত রাখে–আজ তাহলে উঠি, বোন।

দরজা আগলে দাঁড়ালো লীনা।কফি না খাইয়ে আজ ছাড়বোই না।

এরকুল বলে কিন্তু দুধ চলবে না, ব্ল্যাক কফি।

জবাব দেয় অ্যাণ্ড্রুজ–সেই ভালো। তোমার ব্ল্যাক কফির সঙ্গে কড়া সিগারেট। জমবে ভালো। প্যাকেটটা আনতে ভোলোনি তো?

–পাগল হয়েছে। নিজেকে ভুলতে পারি। কিন্তু সিগারেটের প্যাকেট ভুলবার জোটি নেই। অতএব আরো কিছুক্ষণ সেখানে কাটলো।

অ্যাণ্ড্রুজ জিজ্ঞাসা করে–কিরকম মনে হলো?

এরকুল চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লো–লীনার স্টেটমেন্টে ভুল নেই কোন। মিথ্যে বলেনি ও, তবে একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগছে। লীনার স্বামী দশ বছর আগে ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে বলেই জানি। যে ফার্স্টক্লাস কামরায় ভদ্রলোক ছিলেন সে কামরায় কেউই প্রাণে বাঁচেনি।

–তবে এই ভদ্রলোকটি কে? মানে, লীনার কাছে যিনি স্বামী সেজে এসেছেন?

–সেটাই তো প্রশ্ন, কে ঐ লোকটি? কি ওর উদ্দেশ্য?

–মিসেস হেলেনাকে কেমন দেখলে?

–গভীর জলের মাছ একটি। ঠোঁটের কোণে চোরা হাসি হেসে বলে এরকুল।

–জানো অ্যাণ্ড্রুজ, পুতুলটার মডেলটি যে মিসেস হেলেনার কাছেই আছে এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।

-জেনেও কিছু বললে না কেন?

-ধীরে, বন্ধু ধীরে। এরকুল বলে। তাছাড়া হয়তো তেমন প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। কেউ কি তাকে জিনিসটা নিতে দেখেছে।

-তুমি যে বললে? অ্যাণ্ড্রুজ যেন জানতে চায়।

–কারণটা তবে শোন। তোমাকে সব খুলেই বলি।

এরকুল বলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে নিজেকে নিমজ্জিত করে সে চেতনার অন্তরালে।

নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি এর মধ্যে লীনার ডান হাতে আর তালুতে সোনালী রঙ দেখে জিজ্ঞেস করতে ও বলেছিল, হয়তো মডেলটা ধরবার সময় রঙ লেগে গেছে। হয়তো পরে। আমি জানি নিশ্চয়ই তাই। হেলেনার সঙ্গে কথা বলার সময় লক্ষ্য করলাম ওর আঙুল আর তালুতে সোনালী রঙ। একটু থামলো। এরকুল তারপরে বলল, দুই আর দুইয়ে চারই হয়, অ্যাণ্ড্রুজ।

–কিন্তু কি আছে ঐ মডেলটার মধ্যে?

–তা এখনও আমি জানি না। বোধ হয় হেলেনাও জানেন না। তবে তিনি নিয়েছেন নিছক লোভের বশেই। আসলে তিনি লীনার সঙ্গে গল্প করতেই আসছিলেন। দরজা খোলা দেখে উঁকি মারেন ভেতরে। টেবিলের ওপর অমন সুন্দর মূর্তিটি দেখে আর লোভ সামলাতে পারেননি ভদ্রমহিলা। লীনা ঘরে ছিল না। সুবিধাই হলো তাঁর।

একটু চুপ করে থেকে বলতে লাগলো–চুরি একটা ক্রাইম, সন্দেহ নেই। দেখতে হবে এর পেছনে কোন মোটিভ আছে কিনা। এ কেসটার কিন্তু তা নেই। মিসেস হেলেনা ওটা নিয়েছেন নিছক জিনিসটার সৌন্দর্যের লোভে। ক্ষণিকের চপলতাও বলতে পারো। এমন হলেও আশ্চর্য হবো না যদি শুনি তিনি নিজেই ওটা ফিরিয়ে দিয়েছেন।

অ্যাণ্ড্রুজ জিজ্ঞসা করে-বলো কি?

এরকুল আত্মমগ্ন হয়ে বলে চলে, আসল নাটক শুরু হবে কাল হোটেল প্যারডাইসে। দেখা যাক, আমাদের জন্যে কি উপহার সাজানো আছে। নরকের বিভীষিকা না কি স্বর্গের পুষ্পউদ্যান।

কথা বলতে বলতে হ্যান স্ট্রীটের মোড়ে এসে পড়েছিল দুজনে। এবার ছাড়াছাড়ি হবার পালা। বিদায় নেবার আগে এরকুল একবার অ্যাণ্ডজকে মনে করিয়ে দিলো কালকের প্রোগ্রামের কথা।

হোটেল প্যারাডাইস।

.

০৬.

 হোটেল প্যারাডাইস। নিয়ম আলোটা জ্বলছে নিভছে। দরজা ঠেলে ঢুকলো, লীনা, তার ভ্যানিটি ব্যাগটার মধ্যে মার্কেট থেকে কিনে আনা মডেল।

ভেতরে তখন জমজমাট আসর। আসনগুলো প্রায় ভর্তি।

একেবারে পশ্চিমকোণের টেবিলটা খালি রয়েছে এখনও। অবশ্য বেশিক্ষণ খালি থাকবে না নিশ্চয়ই।

আজ আবার স্পেশ্যাল অ্যাট্রাকসন আছে–সুন্দরী লোলার ড্যান্স।

লোকমুখে শোনা, লোলার দিকে একবার তাকালেই নাকি পাঁচ ইঞ্চি হুইস্কির বোতলের থেকেও বেশি নেশা হয়। তার অঙ্গের একটু পরশ যদি শরীরে লাগে তবে আর দেখতে নেই। নির্ঘাত মূৰ্ছা। এ হেন রূপসীর নাচ দেখতে যে শহর ভেঙে পড়বে তাতে আশ্চর্য কি।

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো এক দীর্ঘকায় পুরুষ। অ্যাশ কালারের স্যুট। চোখে কালো চশমা। জামার বাটন হোলে লাল গোলাপ। দীর্ঘকায় পুরুষ এগিয়ে গেল কোণের টেবিলটার দিকে।

দুটো টেবিল পরে এক মুসলমান ভদ্রলোক ওর সঙ্গীকে বললেন–আমাদের মহামান্য

অতিথি তো এলেন, লীনাও এসেছে। এবার দেখা যাক।

বলা বাহুল্য এরকুল আর আজ অবশ্যই ছদ্মবেশে।

লীনা ততক্ষণে স্টুয়ার্টের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে। কি কথা হলো দুজনের মধ্যে শুনতে পেলো না এরকুল। তবে আড়চোখে একটা মডেল আর মুখবদ্ধ লেফাফা হাত বদল হতে দেখলো।

লেফাফাটি ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে রেখে দিয়ে দাঁড়ালো লীনা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

অ্যাণ্ড্রুজ বললো–লীনা যে চলে গেল।

এরকুল নির্বিকার ভাবে বলে–যাবেই তো। ও তো থাকতে আসেনি এখানে।

–আমরা কি করবো এখন?

–কি আর করবো, নাচ দেখবো, ভুলে যেওনা একটু পরেই শুরু হবে লোলার ড্যান্স। সেই লোলা–যার কটাক্ষপাতে…

অ্যাণ্ড্রুজ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ওর কথাগুলো।

-তুমি দেখবে ঐ নাচ? ঐ আধা ন্যাংটো?

 এরকুল কথা না বলে শুধু হাসলো। আর অ্যাণ্ড্রুজ বুঝে নিলো, এরকুলের কিছু একটা অভিসন্ধি আছে। যেটা ও মুখে বলতে চায় না।

মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, লেডিস অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, নাউ উই ইনট্রোডিউসড লাভলি লোলা।

হলের আলোগুলো নিভে গেল একে একে। পর্দা সরে গেল। নীলাভ আলো জ্বলে ওঠে। স্বল্পবাস নর্তকী অভিবাদন জানালো সবাইকে।

আধো অন্ধকারে মধ্যে এরকুল দেখলো, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন মিঃ স্টুয়ার্ট। এগোচ্ছেন দরজার দিকে। মুগ্ধ চোখে এরকুল তাকিয়ে রইলো সেদিকে। হঠাৎ তীক্ষ্ণ শীসের মতো শব্দ একটা। আর্ত চিৎকার। ভারী কিছু পতনের আওয়াজ। দরজা ঠেলে কে যেন বেরিয়ে গেল বাইরে।

উঠে পড়লো এরকুল। অ্যান্ড্রুজের হাত টেনে বলল–তাড়াতাড়ি এসো।

তারপর যা হয়ে থাকে। হইহই চিৎকার। হট্টগোল। হলের আনোগুলো আবার জ্বলে উঠলো একে একে।

আলোয় ওরা দেখলো মেঝের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছেন মিঃ স্টুয়ার্ট, বুকের কাছটা রক্তে ভেজা। রক্তের একটা ক্ষীণ ধারা জামা ভিজিয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ছে। আর মিঃ স্টুয়ার্টের ব্যাগটা নেই।

হাঁটু গেড়ে বসে স্টুয়ার্টের ডান হাতটা তুলে নিলে এরকুল। নাড়ী দেখলো। নাঃ প্রাণ নেই।

চকিতে উঠে দাঁড়ালো এরকুল। অ্যাণ্ড্রুজকে বলল–বেরিয়ে পড়ি। এক্ষুনি পুলিশ আসবে। দুজনে বেরিয়ে এলো বাইরে।

.

০৭.

 ফুটপাত থেকে আমননে হাঁটছিল লীনা। একটা ট্যাক্সি এসে সজোরে ব্রেক কষলো প্রায় ওর গায়ের ওপরে। চমকে উঠেছিল সে। কিন্তু তারপরে ট্যাক্সির দরজা খুলে যখন পিটার নেমে এলো তখন মুখে হাসি ফুটলো ওর।

পিটার ওকে হাত ধরে তুলে নিলো ট্যাক্সিতে। প্রায় দশ মিনিট পর, একটা প্রায় অন্ধকারে গলির মধ্যে জীর্ণ একতলা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো ট্যাক্সি। অন্ধকারে প্রেতের মতো দেখাচ্ছে বাড়িটাকে। একটু দূরে স্ট্রীটল্যাম্প জ্বলছে। কিন্তু তাতে অন্ধকার দূর হচ্ছে না।

ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিলো পিটার। বলল–এই তো আমার ডেরা। ভয়ে করছে? সত্যি ভয় করছে লীনার। কিন্তু মুখে বলল–না, তুমি তো রয়েছে সঙ্গে। পিটারের একটা হাত সজোরে আঁকড়ে ধরলো লীনা।

ঘরে ঢুকে পিটার বলল-খামটা দেখি লীনা।

 ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে খামটা বের করে পিটারের হাতে দিলো লীনা।

খামের মুখ ছিঁড়ে ফেললো পিটার। বের করলো নোটগুলো।

একশো পাউণ্ডের দশখানা নোট।

লীনা বলল–এত টাকা। আমার আড়াই মাসের মাইনে।

কেমন বিচিত্র হাসলো পিটার। এটা তো তুচ্ছ। আমার কাছে আরো আছে, এই দেখ। ফোলিও ব্যাগটা খুলে মডেলটা বের করলো পিটার। আবার হাসলো সে বিচিত্র হাসি।

-এই সে মডেল যা তুমি অল্প কিছুক্ষণ আগে মিঃ স্টুয়ার্টের হাতে তুলে দিয়েছিলে।

–ওটা তোমার কাছে এলো কি করে? লীনা বিমূঢ়।

–মিঃ স্টুয়ার্টের কাছ থেকেই পেয়েছি। অবশ্য স্বেচ্ছায় তিনি দেন নি।

–তবে?

লীনার কৌতূহল আর বাধ মানে না।

মিঃ স্টুয়ার্ট আর বেঁচে নেই। কেমন যেন নির্মম শোনায় পিটারের গলা।

একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠে লীনা। তারপর প্রায় মরিয়া হয়ে বলে–ভুল, তুমি ভুল করছো পিটার। যে মূর্তিটা আমায় তুমি দিয়েছিলে সেটা চুরি হয়ে গেছে কাল রাতেই। এটা একটা নকল মূর্তি। দোকান থেকে কেনা।

-সেকি! পিটার লাফিয়ে ওঠে চেয়ার ছেড়ে।

 এবার লীনার পালা। খুব সূক্ষ্ম হাসির একটা ফালি ঠেটের কোণে ছড়িয়ে রাখে লীনা।

–কে নিয়েছে তাও জানি।

–কে নিয়েছে? কে?

পিটারের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে ভয় পায় লীনা। কেমন পাগলের মতো আচরণ করছে পিটার। তাড়াতাড়ি বলে–প্রমাণ নেই। তবু আমি জানি এ কাজ মিসেস হেলেনার ছাড়া কারোর নয়।

–কে এই মিসেস হেলেনা?

–ওপরের ফ্ল্যাটে থাকে।

রুমাল দিয়ে ঘাম মোছে পিটার। ভাঙা গলায় বলে–সব পণ্ড হয়ে গেল লীনা। সব ভুল। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।

প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটের ফাঁকে রাখে পিটার।

এ-পকেট ও-পকেট হাতড়ায়, দেশলাই-এর খোঁজ নেই।

 পিটার বলে–তুমি বসো, আমি এখুনি আসছি।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে আসে পিটার। এখন ওর মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। ধোঁয়ার কয়েকটা রিং শূন্যে ছুঁড়ে দেয় আলগোছে। ওকে অনেকটা স্বাভাবিক লাগছে এবার।

-এবার বলো লীনা, কিভাবে চুরি গেল মডেলটা।

লীনা সমস্ত কিছু গুছিয়ে বলে পিটারকে।

 হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে ওঠে পিটার।–কি অভদ্র আমি দেখছো লীনা। কতক্ষণ ধরে তুমি এসেছো অথচ এক কাপ চা খাওয়ানো হয়নি।

বাধা দেয় লীনা–এত রাতে আবার কাকে চা আনতে পাঠাবে?

পিটার শান্ত গলায় বলে–চিন্তার কোন কারণ নেই। ঐ মিটসেফের মধ্যে চা, চিনি, দুধ সবই মজুত আছে। কেরোসিন স্টোভ আছে। আর আমি তো আছিই তোমার সামনে। নিজের বুকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পিটার।

লীনাও যোগ দেয়–কখনো না। মহিলাদের উপস্থিতিতে কোন পুরুষ রান্নার ভার নিলে সেই মহিলার অকল্যাণ হয়, জানো তো।

.

০৮.

 লীনা যখন বাড়ি ফিরলো তখন দশটা বেজে গেছে।

গুন গুন করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিল। নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো হঠাৎ।

মিসেস হেলেনার ঘরে আলো জ্বলছে। দরজা নিশ্চয়ই খোলা। না হলে সিঁড়িতে আলো আসছে কি করে। কি মনে করে ওপরে উঠতে লাগলো লীনা। সিঁড়ির বাঁক ঘুরেই দেখলো দরজাটা হাট করে খোলা। ব্যাপার কি?

খোলা দরজা দিয়ে উঁকি মারলো লীনা। একটা তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার করে পেছিয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে।

বীভৎস দৃশ্য। ঘরের ঠিক মাঝখানে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন মিসেস হেলেনা। চোখ দুটো খোলা, একটা ভয়ানক আতঙ্ক ফুটে আছে চোখের মণিতে। মুখের বাঁ-দিকে একটা ক্ষত দিয়ে রক্তের ক্ষীণ ধারা তখনও গড়িয়ে পড়ছে। যত তাড়াতাড়ি ওপরে উঠেছিলো তার চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে নেমে আসে লীনা।

ফোন করতে হবে এরকুলকে।

.

এরকুল বলল–ঠিকানাটা তুমি ঠিক দেখেছো লীনা।

–হ্যাঁ বাড়িতে ঢোকার সময় চোখে পড়লো বেশ বড় নম্বর ‘ভালো’।

ভালো। অ্যাণ্ড্রুজ তুমি এখনি ও.সি.-কে আমার নাম করে বলো যত তাড়াতাড়ি পারে এই ঠিকানায় চলে আসতে।

ফোন করে ফিরে এলো অ্যাণ্ড্রুজ।-সর্বনাশ হয়েছিল, আর-একটু হলেই।

.

দরজায় ঢোকবার মুখে এরকুল পোয়ারো দেখলো পুলিশের জীপ এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। ও.সি.-কে নামতে দেখলো এরকুল। ইশারায় ওকে আসতে বলে ঘরে ঢুকে গেল।

সুটকেস গোছাচ্ছিল পিটার।

এরকুল বলল–কোথায় যাচ্ছেন পিটার? যাওয়া তো হবে না।

হেসে ওঠে পিটার। তারপর লীনাকে দেখে বলল–একি লীনা, তুমি এখানে? কি ব্যাপার?

ব্যাপার সামান্যই। এগিয়ে গেল এরকুল। সুটকেসের ভেতর হাত ঢুকিয়ে শার্ট প্যান্ট পাজামার তলা থেকে বের করল এক ফুট লম্বা আড়াই ইঞ্চি চওড়া সোনালী মডেল।

–এটা কি মিঃ পিটার?

পিটারের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে একেবারে। তবু বলল–কি আবার? দেখতেই তো পাচ্ছেন। সাধারণ মডেল একটা।

-সাধারণ মডেল নয়।

 মডেল তুলে মেঝেতে আছাড় মারে এরকুল। মাটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সেটা। ঘরময় করা মাটির টুকরো আর গোটা চারেক পুরু সোনার বাট।

এরকুল হাসে। পিটার ওরফে ক্লাইভ।

ও.সি. এগিয়ে গেল ক্লাইভের দিকে। পেছনে একজন কনস্টেবল।

লীনা বললো-ক্লাইভ কাকে বলছেন এরকুল? ও তো আমার পিটার।

করুণ হাসলো পিটার–সরি লীনা। তোমার স্বামী পিটার মারা গেছেন ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে দশ বছর আগে।

–ও। যেন ঘুমের ঘোরে কথা বলছে লীনা। আমি যাই এরকুল।

 চমকে ওঠে এরকুল–সেকি, এত রাতে যাবে কি করে। একটু দাঁড়াও। এক গাড়িতে যাবো আমরা।

-না, এরকুল আমি একাই যাই। হাঁটতে আমার ভালো লাগে।  পায়ে পায়ে বাড়ির বাইরে চলে আসে লীনা। হঠাৎ কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারদিক। কোন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবু সেই কুয়াশায় মধ্যেই একা একা হাঁটতে থাকে লীনা। অনেকটা পথ পার হতে হবে তাকে। যেতে হবে অনেক দূরের রাস্তায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *