• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Bookmarks
  • My Account →
  • বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Bookmarks
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

যশোহর খুলনার ইতিহাস ১ – সতীশচন্দ্ৰ মিত্ৰ

লাইব্রেরি » সতীশচন্দ্র মিত্র » যশোহর খুলনার ইতিহাস ১ – সতীশচন্দ্ৰ মিত্ৰ
যশোহর খুলনার ইতিহাস ১

যশোহর খুলনার ইতিহাস ১ – সতীশচন্দ্ৰ মিত্ৰ

১ম সংস্করণ : ১৯১৪
২য় সংস্করণ : ১৯২৮
৩য় সংস্করণ : ১৯৬৩

.

প্রাককথন

সতীশচন্দ্র মিত্র মহাশয় কর্তৃক লিখিত বিখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে ১৯১৪ সালে। সেই থেকে ২০০১ অবধি গ্রন্থটির তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতীয় বাংলাভাষী এলাকার বহু গ্রন্থাগারে বইটি পাওয়া যায়— এমনকি অনেক বিদ্বান ব্যক্তির ব্যক্তিগত পাঠাগারেও এখনও এটি সযত্নে রক্ষিত দেখা যায়। এতে বুঝতে অসুবিধা নেই যে শতাব্দী প্রাচীন গ্রন্থটি এখনও সমান পাঠকপ্রিয়।

গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশের সাথে সাথে লেখক একটি কপি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উপহার দেন। উল্লেখ্য, লেখক বিশ্বকবির স্নেহধন্য ছিলেন। যাহোক কবি তাঁর শত ব্যস্ততার মাঝেও গ্রন্থটি পাঠ করেন এবং লেখককে একটি পত্র লিখেন। সেই পত্রে কবি বলেন, ‘ইতিহাস জাতির গৌরব ঘোষণার জন্য নহে— সত্য প্রকাশের জন্য’ বস্তুত সেই কাজটিই লেখক অত্যন্ত যত্ন সহকারে পত্রটি অনেক আগেই সম্পন্ন করেছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যে ভূ-ভাগে বসবাস করেন; তাদের অধিকাংশেরই নানান সীমাবদ্ধতার কারণে ঐ জায়গাটুকুকে সারা জীবনেও ভালোভাবে জানা হয় না। অতীত কালের চেয়ে বর্তমান সময়ে সাধারণ মানুষের কৃচ্ছ্রতা বর্ধিত হবার ফলে আপন জীবিকার জন্য সংগ্রামরত মানুষ এখন আর দেশ ভ্রমণের মতো বিলাসিতার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না। অথচ অজানাকে জানার স্পৃহা মানুষের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষারই অংশবিশেষ। নিজের দেশ ও নিজের অঞ্চল সম্পর্কিত গ্রন্থটিকে কে না জানতে চায়? সার্থক মানুষ পরিচয়ে পরিচিত হতে হলে ঐ অনুষঙ্গটি বাদ দিয়ে তা কোনোভাবে সম্ভব নয়। সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নেই যাদের; সেইসব মানুষ জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য ভ্রমণ কাহিনী এবং ইতিহাসের দ্বারস্থ হন বিশেষভাবে ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থটি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের বাংলাভাষী সকল অধিবাসীর সেই মনের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে।

বর্তমান সময়ের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর স্বাভাবিক পরিবেশ ও ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে অর্থাৎ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে গেলে প্রতিটি দেশের মোট ভূমির ২৫% স্থান জুড়ে বনভূমি থাকতে হবে। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের যে জায়গাটুকু নিয়ে আমাদের বাংলাদেশ তার বৃহত্তম বনরাজি সেই যশোহর খুলনা এলাকায় অবস্থিত যার নাম ‘সুন্দরবন’। এটাও বাস্তব সত্য যে, নিজের দেশের সেই বিশ্ববিখ্যাত ম্যানগ্রোভ বনভূমিকেও বা আমরা কতটুকু জানি। আর্থিক দিকে সুবিধাভোগী দেশবাসীর অনেকেই সারা জীবনেও সুন্দরবনের দর্শন লাভের সময় করে উঠতে পারেননি। লেখক পেশায় একজন শিক্ষক হয়েও নিজের সঞ্চিত শেষ কপর্দকটুকু ব্যয় করে, অমানুষিক পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য সমৃদ্ধ এই গ্রন্থটি শুধু দেশবাসীর জন্য নয়- পৃথিবীময় ছড়ানো সমস্ত বাংলাভাষীর সামনে হাজির করেছেন। কাজটি করতে গিয়ে তিনি নানা প্রকার বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন, এমন কি কোনো কোনো সময়ে খাদ্য এবং পানীয়ের অভাবে তাঁকে নির্জলা উপবাসও করতে হয়। এসব ক্লেশ তাঁর সুদৃঢ় সংকল্প থেকে এক চুলও বিচ্যুত করতে পারেনি।

তিনি সাধারণ ঐতিহাসিকদের মতো ঘরে বসে রেফারেন্স বইয়ের সাহায্য নিয়ে এ গ্রন্থ রচনা করেননি। একজন কৃষক আপন জমিতে বুকের সমস্তটুকু মমতা ঢেলে যেমন ফসল ফলান সতীশচন্দ্র মিত্র মহাশয় ঠিক যেন সেই কাজটিই করে গেছেন। কাজের প্রতি তিনি কতটুকু একনিষ্ঠ ছিলেন, সৃষ্টিশীলতার প্রতি তাঁর কেমন দরদ ছিল গ্রন্থটির প্রতিটি ছত্রের বাক্য বিন্যাসে তা ফুটে উঠেছে।

‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ নামটির মধ্যে একটি সীমাবদ্ধতা, একটি আঞ্চলিকতার ঘ্রাণ কি কারো নাসিকারন্ধ্রে প্রবেশ করে? প্রকৃত অর্থে একেবারেই তা নয়। কেননা এই ইতিহাস সমস্ত প্রাচীন বাংলার বিশাল পটভূমিকায় রচিত। অতীত কালের ভূতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক হেন কোনো বিষয় নেই যা লেখক তুলে ধরতে অক্ষম হয়েছেন। একবার পাঠে বসলে পাঠক অতীত কালের সকল বিষয় ছবির মতো মনের পর্দায় অবলোকনে সমর্থ হন। ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ নামের আড়ালে লেখক নিপুণ হাতে মেঘনা ভাগীরথীর অন্তর্বর্তী বিস্তীর্ণ ভূভাগের বিশদ ইতিহাস রচনা করেছেন এবং সেকালের বাংলার সমাজ চিত্রকে নিপুণ বর্ণনায় তুলে এনে বর্তমানের সামনে দাঁড় করে দিয়েছেন।

যে জাতি তার অতীত জানেনা তার গর্ব করার মতো কিছু থাকেনা- এটা ধ্রুব সত্য। আজ সমগ্র পৃথিবীর সভ্য জাতি গুলির দিকে যখন আমরা তাকাই- দেখি, তাদের সুশীল সমাজ সেই বিশেষ দিকটির পরিশীলনে সবিশেষ যত্ন ও মনোযোগী হয়েছেন। তাঁদের তুলনায় দেখা যায় আমাদের মনন ও মেধার যথেষ্ট পরিমাণে ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী জনপদের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের আজ উন্নয়নকামী হিসেবে বিশ্বের দরবারে নিজেদের পরিচয় দিতে হচ্ছে। আমাদের উত্তর প্রজন্মকে এহেন সংকট থেকে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে। সীমাবদ্ধতা সাধারণ মানুষের যতটুকুই থাক না কেন; সমাজের সচেতন মানুষ এ মনে বিশেষ অবদান রাখলে সে অমানিশার অন্ধকার দূর হয়ে যাবে বলে আমরা আশা করি।

বাংলাদেশে ঐতিহাসিক অবদানের কোনো অভাব নেই। কিন্তু তারপরেও ভাবলে হতবাক না হয়ে উপায় নেই যে বিগত পঁয়ত্রিশ বছর সময় কালের মধ্যে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লিখতে পারিনি।

লেখক তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে গ্রন্থখানির প্রথম সংস্করণে যে কথা বলেছিলেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য— ‘আমাদের দেশে প্রায় সকলেই দূরে বসিয়া ইতিহাস লেখেন। যিনি প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধীয় যাবতীয় বিবরণ সম্পর্কিত পুস্তক প্রণয়ন করিয়াছেন তিনি প্রতাপাদিত্যের লীলাক্ষেত্রে (জন্মভূমিতে) পদার্পণ করেন নাই। প্রতাপাদিত্যের সম্বন্ধে নভেল নাটকের তো কথাই নাই উহার সবগুলি কলিকাতার দ্বারবদ্ধ ত্রিতল গৃহে বসিয়া লেখা হইয়াছে। চাক্ষুষ প্রমাণের মতো প্রমাণ নাই। কোনো দেশের ইতিহাস রচনার প্রথম স্তরে এই প্রমাণ সংগৃহীত হইলে তাহার উপর ভিত্তি রাখিয়া ঐতিহাসিক সমালোচনা চলিতে পারে কিন্তু আমাদের দেশে দেখিতে পাই গবেষণা মুলতুবি রাখিয়া সমালোচনাই অগ্রে চলে। আমি এ রীতির অনুসরণ করি নাই। ‘

আর তাই একথা জোর দিয়ই বলা যায় যে, তিনি তাঁর এই গবেষণা কর্মে গভীর মমত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং অন্তরের তাগিদ থেকেই পরিশ্রমলব্ধ বিশাল গ্রন্থ রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। একথা অনস্বীকার্য যে, দেহের ক্লেশ, পথের কষ্ট, প্রাণের ভয় কিংবা অর্থাভাব তাঁকে তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এখানেই আর দশজন ঐতিহাসিকের সাথে তাঁর মৌলিক পার্থক্য। সত্যকে তিনি উদঘাটন করেছেন নিষ্পৃহ ও নিরাসক্ত চিত্তে। ঐতিহাসিক মর্যাদা রক্ষার্থে তিনি সর্বদাই সজাগ ও সচেতন ছিলেন বলেই কোনো স্বার্থবোধ, ভেদবুদ্ধি, পক্ষপাত বা একদেশদর্শিতা তাকে আদর্শভ্রষ্ট করতে পারেনি। এখানেই তাঁর মহত্ব। সেকালের সুন্দরবনের মতো দুর্গম ও গহীন অরণ্যে প্রতিপদে ভয়াল বাঘ, সাপের ছোবল এবং কুমিরের হামলা ‘অবধারিত’ জেনেও অসাধারণ মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তিনি সবগুলিকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন এবং গ্রন্থ রচনায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর সেই নিরলস জ্ঞান সাধনা ও ইতিহাস চর্চার প্রশংসা আমাদের করতেই হবে।

এই ইতিহাস গ্রন্থের লেখক প্রথাগত গবেষণা-পদ্ধতিতেও, অর্থাৎ যাকে বলে ‘Research Methodology’ তে প্রশিক্ষিত ছিলেন না- তা তিনি অকপটে স্বীকারও করেছেন। তিনি বিমুগ্ধচিত্তে বলেছেন, আমি যাহা দেখিয়া শুনিয়া শিখিয়া বুঝিয়াছি তাহারই কতক আভাষ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সহিত সম্বন্ধ রাখিয়া লিপিবদ্ধ করিয়াছি। সুন্দরবনের প্রাচীন মনুষ্যবাসের চিহ্নগুলির অধিকাংশ নিজে দেখিয়া লিখিয়াছি। ঐতিহাসিক বিবরণী দিতে গিয়া আমি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অসম্বন্ধ প্রবাদমালাকে ইতিহাস বলিয়া ব্যাখাত করি নাই। সর্বত্রই কাল পর্যায় ও সমগ্র বঙ্গ ইতিহাসের উপর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখিয়াছি।’

‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’-এর পরিধি সমতট ও তদসন্নিহিত অঞ্চল বলে উল্লিখিত হলেও তার বিষয়বস্তু বঙ্গীয় তথা ভারতীয় ইতিহাসের সাথে প্রবলভাবে সম্বন্ধযুক্ত। পাঠকমাত্রই যে এই গ্রন্থ পাঠে উপন্যাসের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবেন না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

আরও একটি বিষয় স্মর্তব্য, ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস রচনায় সাধারণত রাজ রাজড়াদের কাহিনী বর্ণনায় ব্যস্ত থাকার কারণে সাধারণ জনগণের বর্ণনা উপেক্ষা করে থাকেন। তবে এখানে প্রচলিত প্রথাটি ভাঙ্গার সযত্ন চেষ্টাটি চোখে পড়ার মতো। গ্রামীণ সমাজের উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি চাষি, মজুর, কামার, কুমোর, ধোপা, নাপিত, পঞ্চায়েত, চৌকিদার, দফাদারদের জীবন যাত্রা নিপুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে এখানে। আর গতানুগতিক ঐতিহাসিকদের সাথে লেখকের তফাৎটা সেখানেই নিহিত রয়েছে।

বিশ্ববরেণ্য তিন জন বাঙালি— বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্পর্কিত অজানা অনেক তথ্য গ্রন্থটিতে সন্নিবেশিত করা হয়েছে— যা বহু বাঙালির অজানা। প্রথমজন শ্বশুর বাড়ি সূত্রে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় জন জন্মসূত্রে যশোহর-খুলনার মাটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

এই গ্রন্থটি, গবেষক, ছাত্র, শিক্ষক, ঐতিহাসিক, রাজনীতিক এবং রসজ্ঞ পাঠকের সমূহ উপকারে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গ্রন্থটি প্রকাশ করে পাঠকের মনের খোরাক নিরূপণে জাতীয় দায়িত্ব পালন করলো ‘লেখক সমবায়’ প্রকাশনা সংস্থা। আর যদি তাই হয় তবে নানা কারণে আমরা আমাদের শ্রম সার্থক বলে মনে করবো।

ড. তসিকুল ইসলাম
সিকদার আবুল বাশার
ঢাকা
১ জুলাই ২০০৬

.

প্রথম সংস্করণের ভূমিকা

আজ বহু বৎসরের কল্পনা ও সাধনার কতক ফল প্রকাশিত হইল। ঠিক বিশ বৎসর পূর্ব্বে আমি এক সময়ে সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিচন্দ্রের সর্ব্বজাতীয় পুস্তকগুলি বিশেষভাবে অধ্যয়ন করি। কিন্তু তন্মধ্যে বঙ্গদর্শনের বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধীয় প্রবন্ধগুলি যেভাবে আমার মর্ম্মস্থল ভেদ করিয়াছিল, তেমন আর কিছুই নহে। ঐ জাতীয় একটি প্রবন্ধের এক স্থানে আছে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই। কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙ্গালী, তাহাকেই লিখিতে হইবে। মা যদি মরিয়া যান, তবে মা’র গল্প করিতে আনন্দ! আর এই আমাদের সর্বসাধারণের মা জন্মভূমি বাঙ্গালা দেশ, ইহার গল্প করিতে কি আমাদের আনন্দ নাই? আইস, আমরা সকলে মিলিয়া বাঙ্গালার ইতিহাসের অনুসন্ধান করি।’ সেই উদ্দীপনায় যেভাবে আমার হৃদয়তন্ত্রী বাজিয়াছিল, ভাষায় তাহা প্রকাশ করিতে পারি না। আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম, আমার যদি কিছু শক্তি থাকে, তাহা বাঙ্গালার ইতিহাস-সঙ্কলনের সাধনায় ব্যয়িত করিব। কিন্তু আমাকে উৎসাহ দিবার বা সাহায্য করিবার কাহাকেও খুঁজিয়া পাইলাম না।

কিছুদিন নানাস্থানে ঘুরিতে লাগিলাম; ক্রমে বঙ্গদেশ ও ভারতবর্ষের স্কুলপাঠ্য ইতিহাস প্রকাশ করিলাম। তৃপ্তি সাধিত হইল না। অবশেষে দৌলতপুর কলেজের গুরুতর কার্য্যে যোগদান করিয়া, তাহার সর্ব্বাঙ্গীণ উন্নতির চেষ্টায় এবং ইতিহাস অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় জীবন উৎসর্গ করিলাম। স্বদেশীয় মহাত্মগণের ধারাবাহিক জীবন-চরিত লিখিব সংকল্প করিয়া তাহার একখানি পুস্তক প্রকাশ করিলাম; কিন্তু অন্য কেহ সে প্রস্তাবে আমার সহযোগী হইলেন না। তখন আমি যশোহর-খুলনার কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্য নানাভাবে সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। প্রতাপাদিত্য ও সীতারামের জীবনী লিখিব বলিয়া কিছু উপাদান সংগ্রহ করিয়াছিলাম বটে, কিন্তু মাসিক পত্রে দুই একটি প্রবন্ধ ব্যতীত অন্যভাবে তাহার সদ্ব্যবহার হইল না। এমন সময়ে আমার কতকগুলি শোকাবেগময়ী এবং ধর্মতত্ত্ববিষয়িণী রচনা “উচ্ছ্বাস’ নামে প্রকাশ করিলাম। যাঁহার জন্মলাভে আমার খুলনা জেলা পবিত্র হইয়াছে, যাঁহার বিজ্ঞান- সেবায় পাশ্চাত্যমণ্ডল মুগ্ধ হইয়াছে, যাঁহার আদর্শ জীবন ও জীবনব্যাপী সাধনা দেশে বিদেশে কীৰ্ত্তিমণ্ডিত হইয়াছে, সেই স্বনামধন্য স্বদেশপ্রেমিক প্রফুল্লচন্দ্র (Dr. P. C. Ray ) আমার দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের বিলীয়মান মনোরথ ও তদুদ্দিষ্ট চেষ্টার কথা জানিতেন। আমি তাঁহাকে একখানি ‘উচ্ছ্বাস’ উপহার দিয়েছিলাম। উহারই উত্তরে এক অদ্ভুত ধরণে আমাকে উদ্বোধিত করিবার জন্য তিনি আর কিছুমাত্র না লিখিয়া এই কয়েক পংক্তিমাত্র লিখিয়া পাঠান :

And the goddess Saraswati appeared in a dream and said. “my child! Why dost thou waste they energies on such things as আবেগ বা উচ্ছ্বাস? Enough of it. For 2000 years the Hindus have been dreaming idle dreams and indulging in উচ্ছ্বাস। I have endowed thee with noble gifts. Do not take thyself to day-dreams. Thee I have chosen for a better work. Devote thyself assiduously to the noble task of writing a ‘History of Jessore-Khulna.’ That will make thy name remembered by the lat- est posterity, Awake, arise!” বাণীপুত্রের এই আশ্বাসবাণী কিভাবে আমার হতাশ জীবনকে আশ্বস্ত করিয়াছিল, তাহা বুঝাইতে পারি না। ১৯১০ খৃষ্টাব্দের ১৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে এই পত্ৰ পাই; আমার চিরসম্পোষিত আশার অঙ্কুরোদ্গম দেখিয়া, আমি সেই দণ্ডে বদ্ধপরিকর হইলাম। পত্রের উত্তর না দিয়া কলিকাতায় গিয়া মহাত্মার সহিত দেখা করিলাম, তিনি আমাকে অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দ্বারা কার্য্যে অবতীর্ণ করাইলেন। ক্রমে এ কার্য্যের জন্য তাঁহার ভাণ্ডার উন্মুক্ত রাখিয়া, অর্থের ভাবনা হইতে আমাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করিয়া, আমাকে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করিয়াছেন। তাঁহার সে আগ্রহের অনুরূপ সামর্থ বা সুযোগ আমার নাই, আমি তাঁহার অযাচিত দানের প্রকৃত সদ্ব্যবহার করিতে পারিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। যদি কিছু করিয়া থাকি, তাহা তাঁহারই সাহিত্যানুরাগের ফল; যাহা কিছু ভ্রম-প্রমাদ বা অসম্পূর্ণতা রহিয়া গিয়াছে, তজ্জন্য একমাত্র আমিই দায়ী এবং অপরাধী।

মহামতি বিভারিজ (H. Beveridge B.C.S.) তাঁহার ‘বরিশালের ইতিহাসে’র ভূমিকায় লিখিয়া গিয়াছেন :— ‘My idea always has been that the proper person to write the his- tory of a district is one who is native of it, who has lived all his life in it and who has abundance of leisure to collect information. It is only a Bengali who can treat satis- factorily of the productions of his country, or of its social condition-its castes, lead- ing families, peculiarities of language, customs etc. ‘ইহাই আমার একমাত্র ভরসা এবং সাহসের কথা। আমি খুলনার অধিবাসী এবং এ জীবনের অধিকাংশ কাল সেখানেই কাটাইয়াছি। গত ১৭ বৎসর কাল অল্পবিস্তরভাবে ইহার ইতিহাসের জন্য উপকরণ সংগ্রহ করিয়াছি। গত পাঁচ বৎসরকাল এজন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করিয়াছি। ফল কি হইয়াছে, তাহা ক্ৰমে ক্রমে পাঠকগণই বিবেচনা করিবেন।

আমাদের দেশে প্রায় সকলেই দূরে বসিয়া ইতিহাস লিখেন। যিনি প্রতাপাদিত্য-সম্বন্ধীয় যাবতীয় বিবরণসম্বলিত প্রকাণ্ড পুস্তক প্রকাশ করিয়াছেন, তিনিও প্রতাপাদিত্যের লীলাক্ষেত্রে পদার্পণ করেন নাই। প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে নভেল নাটকের ত কথাই নাই, উহার সবগুলিই কলিকাতার দ্বারবদ্ধ ত্রিতল গৃহে বসিয়া লেখা হইয়াছে। চাক্ষুষ প্রমাণের মত প্রমাণ নাই; কোন দেশের ইতিহাস রচনার প্রথম স্তরে এই প্রমাণ সংগৃহীত হইলে, পরে তাহার উপর ভিত্তি রাখিয়া ঐতিহাসিক সমালোচনা চলিতে পারে; কিন্তু আমাদের দেশে দেখিতে পাই, গবেষণা মুলতবি রাখিয়া সমালোচনাটাই অগ্রে চলে। আমি এই রীতির অনুসরণ করি নাই। যশোহর-খুলনা সম্বন্ধে যাহা কিছু লিখিত বিবরণী আছে, তাহা চক্ষুর সম্মুখে উন্মুক্ত রাখিয়া কার্য্য করিয়াছি বটে, কিন্তু কিছু লিখিবার পূর্ব্বে নিজে না দেখিয়া বা কতিপয় স্থল অন্য দ্বারা এই কার্য্যের জন্য না দেখাইয়া, কিছু লিখি নাই। আমার দৃষ্ট-প্রমাণগুলি পূর্ব্ববর্ত্তী লেখকদিগের বিবরণীর সহিত মিলাইয়া, তৎপরে আমার যাহা অনুমান হইয়াছে, অসঙ্কোচে প্রকাশ করিয়াছি। বলবত্তর প্রমাণ দ্বারা কেহ আমার ভ্রম প্রদর্শন করিলে, তাহা অবনতমস্তকে গ্রহণ করিব এবং তজ্জন্য কৃতজ্ঞতাসূত্রে আবদ্ধ থাকিব।

নিজে দেখিয়া প্রমাণ সংগ্রহ করিবার জন্য আমাকে যে কিরূপ কষ্ট স্বীকার করিতে হইয়াছে, তাহা বলিবার নহে। কোন প্রকার শারীরিক ক্লেশ, পথের কষ্ট, প্রাণের ভয়, অর্থের অভাব, কার্য্যের অসুবিধা আমাকে বিচলিত করিতে পারে নাই। দুর্গম সুন্দরবনে ভ্রমণ করিয়াছি, যেখানে প্রতি পলকে বা প্রতি পদবিক্ষেপে ব্যাঘ্রের ভয়, সেখানেও আমি নির্ভয়ে সঙ্গিগণসহ ঐতিহাসিক চিহ্নের সন্ধানে অগ্রসর হইয়াছি, গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া তথ্য সংগ্রহ করিয়াছি, নানাস্থানে বনে জঙ্গলে তন্ন তন্ন করিয়াছি, পদব্রজে দূর পথ অতিক্রম করিয়া স্ফূর্ত্তি রক্ষা করিয়াছি, অনাহারে অনিদ্রায় যে কত দিন গিয়াছে, বলিতে পারি না। কিন্তু যতই করি না কেন, আমার চেষ্টা বা যত্ন যে পৰ্য্যাপ্ত হইয়াছে, তাহা কখনও বোধ করিতে পারি নাই।

স্থানীয় লোকের নিকট কাজের সাহায্য অতি কমই পাওয়া যায়। কারণ গ্রামবাসীরা ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধানে এতই অনভ্যস্ত, স্থানীয় প্রত্নতত্ত্বে এতই অনভিজ্ঞ, যে অনেক সময়ে দূর হইতে গিয়া তাঁহাদের গ্রামের কথা নূতন করিয়া তাঁহাদিগকে শুনাইতে বা দেখাইতে হইয়াছে। অনেক স্থলে তাঁহাদের অনভিজ্ঞতার ফলে প্রতিবন্ধক যে উপস্থিত না হইয়াছে, তাহা নহে। কখনও আমাকে ডিটেকটিভ সন্দেহ করিয়া লোকে দূরে সরিয়া গিয়াছেন; কখন আমাকে ফিতা ধরিয়া কোন স্থান মাপ করিতে দেখিলে, সাধারণ জমির খাজনা বৃদ্ধি হইবে আশঙ্কা করিয়াছেন; কখনও বা ইন্কমট্যাক্সের ভয়ে স্থানীয় প্রকৃত অবস্থা গোপন করিয়াছেন। অনেক যত্নে আমার উদ্দেশ্য বুঝাইয়া দিলেও লোকে বুঝিতে পারেন নাই, এই জন্য কিরূপে লোকে পয়সা খরচ করিয়া ব্যাগ ঘাড়ে করিয়া দেশে দেশে ঘুরিয়া বেড়ায়। এইজন্য কোন স্থানে যাইবার সময় একজন স্থানীয় শিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষাভিমানী লোকের অনুসন্ধান করিয়াছি। যাহা হউক, সৰ্ব্বত্র এ অবস্থা নহে। যেখানে শিক্ষিত ভদ্রলোকের বাস, সেখানে ঐতিহাসিক তত্ত্বে যতই যিনি অজ্ঞ হউন না কেন, তাঁহাদের নিকট হইতে সাহায্যের অভাব দেখিলেও প্রাণের অভাব দেখি নাই। লোকে প্রাণ খুলিয়া যত্ন করিয়া, আতিথেয়তার চরম সীমা দেখাইয়া, অবশেষে আশীর্ব্বাদ করিয়া আমাকে অপরিমিত ভাবে উৎসাহিত করিয়াছেন। সেইজন্য আশা হয়, যশোহর খুলনাবাসী যে উৎসাহ আমাকে দিয়াছেন, আমার পুস্তক প্রকাশে বিলম্ব দেখিয়া যে উদ্বেগের পরিচয় দিয়াছেন, আমার এই পরিশ্রমের ফল সেইরূপ আগ্রহে ও উৎসাহে পাঠ করিয়া আমাকে কৃতার্থ করিবেন। এই পুস্তক প্রকাশের সম্পূর্ণ ব্যয় শ্রীযুক্ত ডাক্তার রায় বহন করিলেও ইহার জন্য আনুষঙ্গিক ভ্রমণ ও অন্যান্য ব্যাপারে আমার মত দরিদ্র শিক্ষকতা-ব্যবসায়ীর স্বল্প-বৃত্তির যাহা কিছু অবশেষ, সমস্তই নিঃশেষ হইয়াছে।

ভগবানের কৃপায় আমাকে পুস্তক-প্রকাশের জন্য অর্থাভাব ভোগ করিতে হয় নাই, সুতরাং পয়সার খাতিরে বা পরের অনর্থক মনস্তুষ্টির প্রত্যাশায় আমাকে কিছু লিখিতে হয় নাই। আমি যাহা কিছু লিখিয়াছি, কৰ্ত্তব্যবুদ্ধিতে ঐতিহাসিক মর্য্যাদা রক্ষা করিবার জন্যই লিখিয়াছি। বোধ হয় সাহস করিয়া বলিতে পারি কোন প্রকার স্বার্থ, স্বজাতিপ্রীতি, ভয় বা অসুয়া আমাকে কর্তব্যভ্রষ্ট করিতে পারে নাই এবং কোন জাতি বা ব্যক্তি-বিশেষের অযৌক্তিক নিন্দা দ্বারা এ পুস্তক কলঙ্কিত হয় নাই। নিশ্চয়ই আমি পদে পদে ভ্রমপ্রমাদে পতিত হইতে পারি, কিন্তু তাহা সমস্তই অজ্ঞানকৃত, কোন উদ্দেশ্যমূলক নহে। উপযুক্ত কারণ নির্দ্দেশপূর্ব্বক কেহ আমার ভ্রম নিরসন করিলে পরবর্ত্তী সংস্করণে উহা সংশোধন করিয়া কৃতজ্ঞতা জানাইব।

আমি এই পুস্তক রচনা আরম্ভ করিলে, প্রথমেই একটা কথা উঠিয়াছিল, আমি যশোহর- খুলনার বিবরণী একত্র করিয়া লিখিতেছি কেন? যশোহরের ইতিহাসের ভার অন্যের উপর দিয়া আমি খুলনার ইতিহাস পৃথক ভাবে লিখিবার চেষ্টা করি না কেন? আমি প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারি নাই; কারণ যশোহর ও খুলনা পৃথক করা যায় না। আজ ত্রিশ বৎসর কাল ইংরাজ গভর্ণমেন্ট খুলনাকে নূতন জেলা করিলেও, খুলনা রীতিনীতি, সমাজবন্ধন ও প্রত্নতত্ত্বে যশোহরই আছে; যশোহর বাদ দিলে খুলনা ভিত্তিশূন্য হয়, খুলনা বাদ দিলে যশোহর প্রাচীন গৌরবশূন্য হয়। ভৈরব- কপোতাক্ষ, যমুনা-ইচ্ছামতী, মধুমতী-বলেশ্বর প্রভৃতি নদ নদীর যেমন প্রথমাংশ যশোহরে প্রবাহিত হইয়া, তাহাদের শেষাংশ খুলনার মধ্যে আসিয়া প্রকাণ্ড ও বলবান্ হইয়াছে, ঐতিহাসিক ঘটনার স্রোতও তেমনি যশোহর হইতে খুলনার মধ্যে আসিয়া কায়পরিগ্রহ করিয়া গৌরবান্বিত হইয়াছে। খাঁ জাহান যশোহর হইতে আসিয়া খুলনায় আত্মপ্রতিষ্ঠা করিয়াছেন, যশোরাধিপতি প্রতাপের রাজধানী খুলনার সম্পত্তি হইয়াছে। এই দুই জেলার যে পৃথক পৃথক সরকারী বিবরণী প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে অধিকাংশ স্থলেই এককথা দুইবার লিখিত হইয়াছে। সুতরাং উভয় জেলা পৃথক্ করিলে ঐতিহাসিক-সূত্র ছিন্ন হইয়া যায়।

আমি প্রস্তাবিত যশোহর-খুলনার ইতিহাসকে চারি অংশে বিভক্ত করিয়াছি, (১) প্রাকৃতিক- ইহাতে ভৌগোলিক বিবরণী থাকিবে। (২) ঐতিহাসিক— ইহাতে ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত থাকিবে। (৩) বৈষয়িক— ইহাতে যাবতীয় বিবরণী ও হিসাবপত্র (Statistics) থাকিবে এবং (৪) আভিধানিক ( Gazetteer) – ইহাতে (ক) প্রধান প্রধান স্থানের ইতিহাস, (খ) প্রধান প্রধান বংশের বিবরণ, ও (গ) প্রধান প্রধান কৃতী পুরুষের জীবনবৃত্ত থাকিবে। অনেকেই যেরূপ খণ্ডবিবরণী বা Statistics দিয়া প্রাদেশিক ইতিহাসের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত করিয়াছেন, আমি তাহা করি নাই।

অদ্য যশোহর-খুলনার ইতিহাস প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হইল। ইহাতে প্রাকৃতিক অংশ সম্পূর্ণ এবং ঐতিহাসিক অংশের অর্দ্ধেক আছে। আমি ঐতিহাসিক অংশকে চারিভাগে বিভক্ত করিয়াছি। (১) হিন্দু-বৌদ্ধ যুগ, (২) পাঠান রাজত্ব, (৩) মোগল আমল ও (৪) ইংরাজ শাসন। তন্মধ্যে বর্ত্তমান খণ্ডে প্রাচীন যুগ হইতে পাঠান রাজত্বের শেষ পর্য্যন্ত ইতিহাস আছে। দ্বিতীয় খণ্ডে মোগল ও ইংরাজ আমলের ইতিহাস থাকিবে এবং তৃতীয় খণ্ডে খণ্ড-বিবরণী ও আভিধানিক অংশগ্রহণ করা যাইবে। এই তিন খণ্ডে সম্পূর্ণ পুস্তক শেষ হইবে। দ্বিতীয় খণ্ড সঙ্গে সঙ্গেই যন্ত্ৰ স্থ হইতেছে। উহাতে প্রথমেই বারভুঞার আবির্ভাবের কথা দিয়া পরে প্রতাপাদিত্যের দীর্ঘ কাহিনী আরব্ধ হইবে। পরে যথাস্থানে সীতারামের ইতিহাস, চাঁচড়া, নলডাঙ্গা প্রভৃতি রাজবংশ এবং নড়াইল, সাতক্ষীরা প্রভৃতি জমিদার বংশের বিবরণ থাকিবে। বলা বাহুল্য, আমাকে প্রতাপাদিত্যের বিবরণ সংগ্রহজন্যই অধিকতর চেষ্টা এবং সুন্দরবনে দুঃসাহসিক অনুসন্ধান করিতে হইয়াছে।

বৰ্ত্তমান খণ্ডে আমি প্রথমেই প্রাকৃতিক বিবরণী দিয়াছি বটে, কিন্তু উহাতে নদ-নদী খাল- বিল প্রভৃতির ভৌগোলিক বিষয়ের ধারাবাহিক নীরস তালিকা দিয়া পুস্তকের কলেবর বৃদ্ধি করি নাই। সরকারী রিপোর্ট হইতে ভাষান্তরিত করিয়া সেরূপ তালিকা দেওয়া কঠিন নহে। কিন্তু সেরূপ নীরস ও সুদীর্ঘ তালিকা দেখিলে পাঠকেরা বিরক্তির সহিত পত্রোত্তোলন করিয়া চলিয়া যান। আমি ঐ সকল বিষয়ের অনাবশ্যক সংখ্যাবৃদ্ধির দিকে নজর না দিয়া, নীরস জিনিষকে সরস করিবার চেষ্টা করিয়াছি; তজ্জন্য কি পন্থা অবলম্বন করিয়াছি এবং তাহাতে কিছুমাত্র সফলকাম হইয়াছি কিনা, তাহা পাঠকগণই বিচার করিতে পারেন।

এই প্রাকৃতিক অংশের মধ্যে সুন্দরবনের এক বিবরণী দিয়াছি। উহাতেও বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ খুলিয়া জীবজন্তু বা বৃক্ষলতার বিবরণী দেই নাই। আমি যাহা নিজে দেখিয়া শুনিয়া শিখিয়া বুঝিয়াছি, তাহারই কতক আভাস বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সহিত সম্বন্ধ রাখিয়া লিপিবদ্ধ করিয়াছি। বৃক্ষলতা প্রভৃতির বেলায় উহা দ্বারা মানুষের কতটুকু প্রয়োজন সিদ্ধি হয়, সেই দিকেই দৃষ্টি রাখিয়াছি। সুন্দরবনের প্রাচীন মনুষ্যাবাসের চিহ্নগুলি অধিকাংশই নিজে দেখিয়া লিখিয়াছি; যেখানে অন্যের সাহায্য লইয়াছি, সেখানে যাঁহার কথা নিজের কথার মত বিশ্বাস করিতে পারি, এমন লোকেরই সাহায্য লইয়াছি। ঐ অংশের বিবরণী সংগ্রহজন্য আমি রায়সাহেব শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত রায়চৌধুরী মহাশয়ের নিকট অপরিশোধ্য ঋণজালে জড়িত। ইনি ডাক্তার প্রফুল্লচন্দ্রের অগ্রজ- তেমনি বিদ্যোৎসাহী, তেমনি অনুসন্ধিৎসু এবং তেমনি উদারহৃদয়। সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণজন্য তাঁহার অধিকাংশ জীবন কাটিয়াছে; সুন্দরবন তাঁহার নখদর্পণস্বরূপ। তাঁহার সাহায্য না পাইলে আমি সুন্দরবনে যাইতে পারিতাম না, বোধ হয় কেহই পারেন না। ডাক্তার প্রফুল্লচন্দ্রের অর্থ ও উৎসাহ যে কার্য্যের প্রাথমিক বল, রায়সাহেব নলিনী বাবুর কার্যক্ষেত্রে সাহায্য, ঐকান্তিক স্নেহ ও সহানুভূতি এবং বহুবৎসরের অভিজ্ঞতা সেই কার্য্যের প্রধান সহায়ক হইয়াছে। তাঁহার নিকট আমার কৃতজ্ঞতা ভাষার বিষয়ীভূত হইতে পারে না; আমি তাঁহাকে প্রণাম করিয়া পুস্তক প্রকাশিত করিতেছি।

ঐতিহাসিক বিবরণী দিতে গিয়া আমি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অসম্বন্ধ প্রবাদমালাকেই ইতিহাস বলিয়া ব্যাখ্যাত করি নাই। সর্ব্বত্রই কালপর্যায় ও সমগ্র বঙ্গেতিহাসের উপর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখিয়াছি। এই উভয়ের সামঞ্জস্য রাখিয়া যশোহর-খুলনার ইতিহাসের কথা বলিতে গিয়া, আমাকে সৰ্ব্বত্রই বঙ্গেতিহাসের ঘটনা পরম্পরারও ধারাবাহিক উল্লেখ করিতে হইয়াছে। এমন কি, স্থানে স্থানে দিল্লীর কথাও চক্ষুর অন্তরালে রাখিতে পারি নাই। দেশের ইতিহাসের সহিত যশোহর-খুলনার যে একটু আধটু সম্পর্ক আছে, পারিপার্শ্বিক ঘটনার সহিত মিল রাখিবার জন্য, আমাকে সেই সম্পর্কে স্থানে স্থানে দেশের কথাও বলিতে হইয়াছে। পাঠকগণ ইহাতে বিরক্ত হইবেন কিনা জানি না, তবে আমার বিশ্বাস এই যে, বঙ্গের অঙ্গ হইতে ছিন্ন করিলে যশোহর- খুলনার মত স্থানের বিচ্ছিন্ন কাহিনীর মূল্য অতি কম, আর ঐতিহাসিকতা দুৰ্ব্বোধ্য হইলে, প্ৰবাদকাহিনী বৃদ্ধ সৈনিকের গল্পকথায় পর্যবসিত হয়। যাঁহারা জেলার ইতিহাস লিখিতেছেন, বাঙ্গলার ইতিহাসই তাঁহাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। “বাঙ্গালার ইতিহাস চাই; নইলে বাঙ্গালী কখনও মানুষ হইবে না।’ এ লক্ষ্য হইতে ভ্রষ্ট হইলে চলিবে না। সুতরাং বাঙ্গালাকে বাদ দিয়া কোন জেলারই অধিবাসী বাঙ্গালীর ইতিহাস লেখা যায় না।

আমি অনেক জিনিস যশোহর-খুলনায় টানিয়া লইয়াছি। টানিয়া লইবার কি কারণ বা অধিকার আছে, আমার অনুমানের কি ভত্তি আছে, তাহা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই সংযোজিত করিয়াছি। কোন কোন স্থানে একটা লোভনীয় প্রত্ন-কীৰ্ত্তি দ্বারা যশোহরকে যশোভূষিত করিবার জন্য হয়ত সাধারণ দৃষ্টিতে যশোহরের সীমা বর্দ্ধিত করিয়া দিয়াছি। কিন্তু বর্ত্তমান যশোহর জেলা ও প্রাচীন যশোহর রাজ্য উভয়ের সীমার একটা বিশেষ আভাস দিয়া থাকিলে, আমি হয়ত ক্ষমার্হ হইব। সম্পত্তি বৃদ্ধি করিতে হইলে, কিছু টানিয়া লওয়ার একটা রীতি আছে; আমি হয়ত সেই ভাবে টানিয়া লইয়াছি। বিভিন্ন জেলার ঐতিহাসিকগণ এইভাবে টানিয়া লইবার জন্য জাল পাতিলে মোটের উপর যে নূতন তথ্য উঠিবে, উহা বাঙ্গালার ইতিহাস-লেখক বিনা গণ্ডগোলে স্বচ্ছন্দে ভোগ করিবেন। আমি যাহা টানিয়া লইয়াছি, সঙ্গত আপত্তি উত্থাপন করিয়া প্রত্নতত্ত্ববিদের নিকট স্বত্বের মোকদ্দমা করিয়া, অন্য কেহ তাহা স্বচ্ছন্দে নিজের করিয়া লইতে পারেন। আমি তজ্জন্য বিন্দুমাত্রও দুঃখিত হইব না। যদি কোন সম্পত্তিকে লাভের সম্পত্তি বলিয়া প্রমাণ করিতে পারিয়া থাকি, তবে তাহা যে কেহ ভোগ করেন, তাহাতেই বাঙ্গলার লাভ।

নূতন ঘর বাঁধিবার মত নূতন ঐতিহাসিক পুস্তক প্রকাশ করিবার জন্য বহুলোকের নিকট হইতে সাহায্য গ্রহণের প্রয়োজন হয়। যশোহর-খুলনার ইতিহাসের জন্য আমি যে কতজনের নিকট সাহায্য পাইয়াছি এবং কতজনের নিকট আমি যে অল্পবিস্তর ঋণী, তাহা বলিবার নহে। সকলের ঋণ উপযুক্তভাবে এখানে স্বীকার করিবার স্থান নাই। আশা করি তজ্জন্য কেহ ক্ষুব্ধ না হইয়া আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি সকলের নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি। তন্মধ্যে কয়েকজন মহাত্মার নিকট আমি অপরিমিত ভাবে ঋণী। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের একমাত্র আশ্রয়স্থলস্বরূপ মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয়ের নিকট আমি সময়ে সময়ে উপদেশ পাইয়াছি; রামচন্দ্র খাঁনের পুত্র ভুবনানন্দের সংবাদ আমি তাঁহারই নিকট জানিতে পারি। সাহিত্যরথী সুহৃদয় শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন ও বিশ্বকোষ-সম্পাদক প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু উপদেশ ও পুস্তকাদির সাহায্য দ্বারা আমাকে চিরকৃতজ্ঞতা-পাশে আবদ্ধ করিয়াছেন। প্রত্নতত্ত্ববিশারদ শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়, এম. এ. এবং আর্য্যাবর্ত্ত-সম্পাদক ও বহু গ্রন্থ-লেখক শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্ৰপ্ৰসাদ ঘোষ, বি. এ.-এই দুই জনের নিকট হইতে আমি যে কত ভাবে উপকৃত ও উৎসাহিত হইয়াছি, তাহা বলিবার নহে। ইঁহারা উভয়েই যশোহরের অধিবাসী এবং যশোহরবাসীর গৌরবস্থল। আমি ইঁহাদের ঋণ হইতে মুক্ত হইতে চাহি না। মহারাজ বসন্তরায়ের বংশধর সুলেখক রাজা যতীন্দ্রমোহন রায়, বনগ্রাম স্কুলের হেড্‌ মাষ্টার সুপণ্ডিত শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বি. এ. এবং যশোরেশ্বরীর সেবক কৃতবিদ্য শ্রীযুক্ত শ্রীশচন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায়— ইঁহারা তিন জনে আমাকে কনিষ্ঠ ভ্রাতার মত স্নেহ করিয়া অকৃত্রিমভাবে তথ্যসংগ্রহে সাহায্য করিয়া চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন। অমৃতবাজার পত্রিকার শ্রীযুক্ত পীযূষকান্তি ঘোষ, সুহৃদ্বর শ্রীযুক্ত শৈলেশনাথ মুখোপাধ্যায়, বি. এ. শ্রীযুক্ত যদুনাথ চক্রবর্ত্তী, বি. এল. শ্রীযুক্ত জ্ঞানেন্দ্রনাথ দত্তচৌধুরী, বি. এল. মঘিয়ার বিখ্যাত রাজবংশীয় শ্রীযুক্ত বাবু হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, জয়দিয়া নিবাসী শ্রীযুক্ত রাজমোহন মুখোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র দত্ত ওভারসিয়ার, তালানিবাসী শ্রীযুক্ত রাজকুমার বসু, মৌভোগনিবাসী শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ বসু, সেখহাটিনিবাসী শ্রীযুক্ত অবিনাশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি বন্ধুবর্গের নিকট হইতে আমি যে সকল সাহায্য পাইয়াছি, তজ্জন্য চিরবাধিত রহিব। খুলনার পূৰ্ব্বতন ম্যাজিষ্ট্রেট বিখ্যাত লেখক শ্রীযুক্ত ব্রাডলী-বার্ট মহোদয় আমাকে কোন কোন ভাবে উৎসাহ দিয়া সুন্দরবনের বিবরণী সংগ্রহের সহায়ক হইয়াছিলেন; আমি তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি। কলিকাতা যাদুঘরের প্রত্নতত্ত্ববিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সুপারিন্টেণ্ডেন্ট মহাশয় আমাকে খলিফাতাবাদের মুদ্রা ও একটি বুদ্ধ মূর্ত্তির ফটো লইতে অনুমতি দিয়া বিশেষভাবে ধন্যবাদার্হ হইয়াছেন। শিবানন্দকাটি নিবাসী বন্ধুবর শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকৃত যশোরেশ্বরীর বর্ণচিত্রের ছবি লইতে দিয়া আমাকে অনুগৃহীত করিয়াছেন। বিখ্যাত শিল্পী কে ভি সেন মহোদয় আমার সমস্ত ছবি ও কয়েকখানি মানচিত্র প্রস্তুত করিয়া দিয়াছেন; আমি তাঁহাকে ধন্যবাদ দিতেছি। মদীয় প্রিয়তম ছাত্র পল্লীচিত্র সম্পাদক শ্রীমান্ শরচ্চন্দ্র মিত্র নানাস্থানে আমার সঙ্গে গিয়া পুরাকীর্তির ফটো তুলিয়া দিয়া আমাকে বিশেষভাবে উপকৃত করিয়াছেন। রাডুলী নিবাসী শ্রীযুক্ত যামিনীকান্ত রায়চৌধুরী মহাশয় সর্পের ইতিহাস সম্পর্কীয় প্রামাণিক বিবরণ সংগ্রহে সাহায্য করিয়া, নানাস্থানে আমার সহচররূপে পুরাকীর্তির সংবাদ দিয়া আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছেন। শ্ৰীমান সুরেন্দ্রনাথ দে সুন্দরবন ভ্রমণ কালে আমার জীবন রক্ষা করিয়াছেন। আমি পুস্তকের ভিতর তাঁহার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়াছি। শ্রীমান শরচ্চন্দ্র বসু ও শচীন্দ্রভূষণ ঘোষ, আমার সঙ্গে বা পৃথকভাবে নানাস্থানে ঘুরিয়া তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করিয়াছেন। আমার চিরবন্ধু শ্ৰীযুক্ত অক্ষয়কুমার রায়চৌধুরী মহাশয় বহুস্থানে দূর-দুর্গম পথে আমার সহচর হইয়া, বহু কায়ক্লেশের অংশীদার হইয়া, নানাভাবে তথ্য সংগ্রহ করিয়া সূচীপত্রাদি প্রস্তুত করিয়া দিয়া যে ভাবে আমায় সাহায্য করিয়াছেন ভাষায় তাহার পর্য্যাপ্ত আভাস দিতে পারি না। তাঁহার ঋণ অপরিশোধ্য। ইহা ব্যতীত আমার কত প্রিয়তম ছাত্রের নিকট যে আমি ঋণী আছি, তাহা বলিতে পারি না। নানাভাবে তাহাদের নামের তালিকা দিতে না পারিয়া আমি ক্ষুব্ধ হইতেছি।

পরিশেষে বক্তব্য এই, দশমাসব্যাপী মুদ্রাযন্ত্রের নানা যন্ত্রণার পর পুস্তকখানি বাহির হইল। মফস্বলে বসিয়া প্রুফ্ দেখিয়া কলিকাতার প্রেস হইতে পুস্তক বাহির করা কি কঠিন ব্যাপার, তাহা ভুক্তভোগী ব্যতীত অন্য কেহ বুঝিবেন না। আমি প্রাণান্ত চেষ্টা করিয়াও অসংখ্য ভ্রম প্রমাদ হইতে পুস্তকখানিকে রক্ষা করিতে পারি নাই। পাঠক তজ্জন্য আমাকে ক্ষমা করিবেন। যদি ভগবানের কৃপায় এ পুস্তকের কখনও দ্বিতীয় সংস্করণ হয়, তখন ইহাকে নির্ভুল করিবার চেষ্টা করিব I

শ্রীসতীশচন্দ্র মিত্র
দৌলতপুর কলেজ
দৌলতপুর খুলনা
২৪শে ভাদ্র, ১৩২১

.

দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা

প্রায় ১৪ বৎসর পরে, ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাসে’র ১ম খণ্ডের এই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইল। ১২ বৎসরমধ্যেই প্রথম সংস্করণের সকল পুস্তক নিঃশেষ হইয়া যায়; ইতিহাসবিমুখ পাঠকের দেশে, উপন্যাস-প্লাবিত বাঙ্গলায় ইহাও প্রাদেশিক ঐতিহাসিক গ্রন্থের কম সৌভাগ্যের বিষয় নহে। গত দুই বৎসর কাল একখানি পুস্তকও ছিল না, অথচ নানাস্থান হইতে অনেক বিশিষ্ট পাঠক এই পুস্তক চাহিতেছিলেন; এমন কি, অনেকে প্রথম খণ্ড না পাওয়ায় ২য় খণ্ড ক্রয় করা স্থগিত রাখিয়াছিলেন।

আমার এই ইতিহাসের ১ম ও ২য় উভয় খণ্ডের প্রথম সংস্করণের প্রকাশের অধিকাংশ ব্যয় দানবীর স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বেচ্ছায় অবলীলাক্রমে বহন করিয়াছিলেন; উভয় গ্রন্থের ভূমিকায় ও উৎসর্গ-পত্রে তাহার পরিচয় দিয়াছি। দ্বিতীয় সংস্করণের ব্যয়ের সাহায্য তাঁহার নিকট চাহিতে পারি না। বিশেষতঃ তিনি দেশের ও দশের কার্য্যে, নিজের যাহা কিছু ছিল, মুক্তহস্তে দান করিয়া এখন একপ্রকার সর্ব্বস্বান্ত; বর্ষান্তে বর্ষণলঘু শ্বেতাভ্রের মত নির্মুক্ত সেই দীব্রত তাপসকে বিরক্ত করিতে অগ্রসর হই নাই। অথচ পুনরায় পুস্তকখানি প্রকাশ করিবার কোন অর্থসামর্থ্যও আমার ছিল না। প্রথম সংস্করণের বহু পুস্তক আমাকে উপহার দিতে হয়; তদ্ব্যতীত অবশিষ্ট পুস্তক দ্বাদশ বৎসর বসিয়া ক্রমে ক্রমে বিক্রীত হইলে প্রকাশকের কমিশন ও বিজ্ঞাপন বাদে গ্রন্থকারের লভ্যাংশ সামান্য অর্থ দরিদ্রজীবনের তপ্তবালুকায় বিশুষ্ক হইয়াছে। সহৃদয় ব্যক্তির ইহা বুঝিতে বাকী থাকে না। প্রকৃত অবস্থা আমি স্থানীয় সংবাদপত্রে আমার দেশবাসীকে জানাইয়াছিলাম। কিন্তু একমাত্র সাড়া পাইয়াছিলাম কপিলমুনিনিবাসী প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী রায় সাহেব বিনোদবিহারী সাধু মহাশয়ের পত্রে। তিনি নিজে খুলনাবাসী, ‘খুলনা- বাসী’ পত্রে আমার প্রবন্ধ পড়িয়া স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া বর্তমান সংস্করণের আংশিক কোন ব্যয়নির্ব্বাহ করিতে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। তাঁহার দানব্রত এবং সহৃদয়তার পরিচয় আমি স্থানীয় ঐতিহাসিক ভাবে লক্ষ্য করিতেছিলাম। অবশেষে গত বৎসর তাঁহার মাতৃনামে উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে আমি আর একবার কপিলমুনিতে গিয়া স্বচক্ষে তাহার কীর্তিরাজি দেখিয়া আসিয়াছি, আর দেখিয়াছি তিনি পরের মুখে বিশেষণের অপেক্ষা না করিয়া স্বীয় জন্মপল্লীর কল্যাণার্থ প্রকৃত ত্যাগীর মত নিঃশব্দে দান করিতে জানেন। হয়ত আমি এখানে কর্তব্যবোধে এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনজন্য যে প্রসঙ্গ তুলিলাম, তাহা তিনি চান না। কিন্তু একটি কথা না বলিয়া থাকিতে পারিতেছি না। এই পুস্তকে প্রসঙ্গক্রমে তাঁহার সম্বন্ধে আমি যাহা লিখিয়াছি, তাহা তুলাদণ্ডের সূক্ষ্ম বিচারে লিখিয়াছি, তাহাতে অতিরঞ্জন বর্ণমাত্র নাই। আমি ঐতিহাসিকের কার্য্য করিয়াছি মাত্র, তজ্জন্য রায় সাহেব আমাকে ক্ষমা করিবেন।

আমার সংকল্প ছিল, তিন খণ্ডে যশোহর-খুলনার ইতিবৃত্ত শেষ করিব। উহার দুইখণ্ড প্রকাশিত হইয়াছে। প্রথম খণ্ডের প্রারম্ভে প্রাকৃতিক বিবরণী আছে, তৎপরে প্রাচীন যুগের ইতিহাসের জীর্ণকঙ্কাল আছে এবং সেন রাজত্বের সময় হইতে পাঠান আমলের শেষ পর্য্যন্ত যাহা কিছু ঐতিহাসিক তথ্য বা প্রমাণচিহ্ন পাওয়া যায়, তাহা দিয়া প্রথম খণ্ড শেষ করিয়াছি। দ্বিতীয় খণ্ডে মোগল ও ইংরাজ রাজত্বের বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছি। উহার মধ্যে প্রধান কথা মহারাজ প্রতাপাদিত্য ও রাজা সীতারাম রায়ের বীরত্বকাহিনী; শুধু খুলনা-যশোহরের নহে, সমগ্ৰ বাংলার ইতিহাসে ইঁহাদের কাহিনী এক গৌরবের যুগের প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে; আমি প্রাণপণ চেষ্টায় এই বঙ্গবীরযুগলের প্রামাণিক ইতিবৃত্ত এবং তাৎকালিক নলডাঙ্গা, চাঁচড়া প্রভৃতি রাজবংশের ইতিহাস দিয়াছি। পরে ইংরাজ আমলে নীলবিদ্রোহের যথাসাধ্য দীর্ঘ বিবরণীর সহিত জমির স্বত্ব শাসন ব্যবস্থা, স্থানীয় বাণিজ্য, সামাজিক চিত্র ও শিল্পসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত বিবৃতির সহিত আমার সংকল্পিত উভয় জেলার ইতিহাস সমাপ্ত করিয়াছি। পুস্তকের মূল ও প্রধান বিষয় শেষ হইয়াছে, এক্ষণে বাকী আছে একখানি ক্ষুদ্র পরিশিষ্ট খণ্ড। উহাতে মনুষ্যগণনা প্রভৃতি বিষয়ক খুঁটিনাটি হিসাবপত্রের সঙ্গে একটি আভিধানিক অংশে প্রধান প্রধান স্থানের ইতিহাস, বংশের বিবরণ ও কৃতী পুরুষের জীবনবৃত্ত দিবার কল্পনা ছিল। বোধ হয় ২০০/২৫০ পৃষ্ঠায় সে খণ্ড সম্পূর্ণ হইতে পারে এবং মূল্য ২ টাকার অতিরিক্ত না হইতে পারে। এই খণ্ডের জন্য অনেক উপাদান আমার সংগৃহীত আছে এবং রচনার কার্যারম্ভের সঙ্গে আরও কতক বিবরণ সংগ্রহ করিতে হইবে। বিলম্বে সংকল্প অপূর্ণ থাকিয়া যাইবারই সম্ভব, কারণ, বয়সাধিক্যে শরীর ক্রমেই অবসন্ন হইতেছে, অকর্ম্মণ্য হওয়া বিচিত্র নহে। নূতন কোন উদ্যমশীল স্থানীয় লেখক কাৰ্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলে, আমি সংকল্প হইতে অবসর গ্রহণ করিতে পারিতাম। কিন্তু তাঁহার কোন সূচনা দেখিতেছি না। আমাকে ব্রতী হইতে হইলে প্রথমেই সুধীবর্গের অভিমত হইতে আমাকে বুঝিয়া লইতে হইবে, এই পরিশিষ্ট খণ্ডের আবশ্যকতা তাঁহারা বোধ করেন কিনা; দ্বিতীয়তঃ আমার মত দরিদ্রের পক্ষে এই পুস্তক নিজব্যয়ে প্রকাশিত করিবার সামর্থ্য যখন একেবারেই নাই, তখন ব্যয় নির্ব্বাহের ব্যবস্থা কি? আমার কথা আমি অকপট ভাবে বলিলাম; আমার দেশবাসীর কোন কথা থাকিলে, তাহা শুনিবার জন্য উৎকর্ণ হইয়া থাকিব।

এই দ্বিতীয় সংস্করণ আমূল পরিশোধিত ও কিছু পরিবর্দ্ধিত হইয়া প্রকাশিত হইল। প্রথম প্রকাশের পর হইতে বহুজনের পত্রে ও প্রবন্ধে যে সকল মতের প্রত্যাহার করিবার জন্য আলোচনা হইয়াছে, আমি বিশেষ সতর্কতার সহিত নূতন প্রমাণগুলি বিচার করিয়া এই সংস্করণে কোন কোন স্থলে সানন্দে নিজমতের পরিবর্ত্তন করিয়াছি। মত থাকিলেই পরিবর্তিত হইতে পারে, ইহা সত্য কথা। পূর্ব্বমত পরিহারের জন্য আমি কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ বা অপ্রতিভ হই নাই। বৰ্ত্তমান সময়ে জাতিতত্ত্বের বহুল তর্ক উপস্থিত হইয়াছে, কোন কোন পক্ষের নিরপেক্ষতার অভাবে সমস্যার সমাধানের সময় আসে নাই। আমার পুস্তকের কোন কোন মতের জন্য বহু প্রতিবাদ ও তীব্র সমালোচনা হইয়াছে। আমি তাহাতে বিচলিত হই নাই। তবে যে স্থলে প্রমাণ বলে নিজের ভ্রান্তি বুঝিতে পারিয়াছি, সেখানে পরাজয় স্বীকার করিয়া পূর্ব্বমত প্রত্যাহার কর্তব্যবোধেই করিয়াছি।[১] অজ্ঞানকৃত ভ্ৰম ক্ষমার্হ; যখনই কেহ ভুল প্রদর্শন করিয়া দিবেন, আমি বিচার করিয়া নতমস্তকে তাহা গ্রহণ করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিব। কোন ব্যক্তি বা জাতিবিশেষের প্রতি কোন প্রকার বিদ্বেষ বা পূর্ব্ব সংস্কার লইয়া এ পুস্তক লিখিত হয় নাই। আমি লোকমুখে বা সংবাদপত্রে যে সকল নূতন তথ্য জানিয়া সত্য নির্ণয় করিতে পারিয়াছি, তাহা এই সংস্করণে প্রকাশিত হইতেছে। ঈশ্বরীপুরের গঙ্গামূর্তি, সেখহাটির ভুবনেশ্বরী, যশোহরের নবাবিষ্কৃত বিষ্ণুমূর্ত্তি, শ্রীরূপসনাতনের জন্মস্থান ও শ্রীরূপকর্তৃক প্রেমভাগের সম্পত্তি বিতরণ, হরিদাসের শিক্ষালাভ ও ভ্রমণক্রম এবং খাঁ জাহানের আরও কিছু কিছু কীৰ্ত্তিচিহ্ন, যাহা কিছু নূতন পাইয়াছি, যথাস্থানে তাহার সদ্ব্যবহার করিয়াছি। জঙ্গলা ভাষার শব্দের তালিকাও আর কিছু বাড়িয়াছে। পূর্ব্ববার আমি জানিতাম না যে, শ্রীবৃন্দাবনের প্রসিদ্ধ লোকনাথ গোস্বামী যশোহরের অন্তর্গত তালখড়ির ভট্টাচার্য্য বংশীয়, এবার তাহার সংক্ষিপ্ত পিতৃপরিচয় ও জীবনী দিবার জন্য একটি পৃথক্ পরিচ্ছেদ লিখিয়াছি।

[১. দৃষ্টান্ত স্থলস্বরূপ ১২১, ১৫৫-১৫৬, ১৮২-১৮৫ পৃষ্ঠা দেখিবেন।]

প্রথমবার এই পুস্তক প্রকাশিত হইবার সময়েই ইয়োরোপীয় মহাসমর উপস্থিত হয়। তজ্জন্য কাগজ, কালী বা পুস্তক বাঁধাইবার উপকরণের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি হয়। এজন্য এই খণ্ডের বিজ্ঞাপিত মূল্য ৩ টাকা স্থলে পরে মূল্যবৃদ্ধি করিয়া ৪ টাকা করা হয়। এবার পুস্তকের আকার মোটের উপর ৫/৬ ফর্ম্মা বাড়িলেও মূল্য ৪ টাকাই রহিল। পুস্তকের আকার, কাগজ, বহুসংখ্যক ছবি, কয়েকখানি ম্যাপ, বাঁধাই, বিজ্ঞাপন ও প্রকাশকের চতুর্থাংশ কমিশন প্রভৃতি ব্যয় ধরিলে এই মূল্য অধিক বলিয়া বোধ হইবে না। বিলাতে এই জাতীয় এই আকারের পুস্তকের দাম সচরাচর ইহার দ্বিগুণ হইয়া থাকে। সকলে পুস্তক কিনিয়া পড়েন না, কেহ কেহ কিনিতে পারেন না, তাহা সত্য কথা। আমি গরিবের কথা বলিতেছি না; তবে যাহারা স্বচ্ছন্দে এই পুস্তকের মূল্য ব্যয় করিতে কিছুমাত্র ক্লেশ বোধ করেন না, এমন যাঁহারা অন্ততঃ যশোহর- খুলনার অধিবাসী, তাঁহারাই মাত্র যদি পুস্তক কিনিয়া নিজেরা পড়েন ও অন্যকে পড়ান, তাহা হইলেও গ্রামে গ্রামে অন্ততঃ ২/১ খানি পুস্তক থাকিবার এবং গরিব পাঠকের পক্ষে পুস্তক পড়িয়া দেশের কথা ভাবিবার সুযোগ হইত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেকে পুস্তক না পড়িয়াই সহানুভূতি প্রকাশ করেন বা সমালোচনা করেন, সম্পন্ন বন্ধুবর্গ বা দশজনের চেষ্টাবলে পুষ্ট গ্ৰাম্য লাইব্রেরীতে উপহারস্বরূপ পুস্তক পাইবার প্রত্যাশা করেন। আমি যতদূর জানিয়াছি, খুলনা অপেক্ষা যশোহরে, যশোহর-খুলনা অপেক্ষা অন্য কোন কোন জেলায় এই পুস্তক অধিকতর সংখ্যায় বিক্রীত হইয়াছে; সুধীবর্গ ইহার কারণ অনুসন্ধান করিবেন।

স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জ্যেষ্ঠমধ্যম ভ্রাতা রায়সাহেব নলিনীকান্ত রায় চৌধুরীর কথা আমার সুন্দরবন-কাহিনীর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে বিজড়িত। তিনি আমার সুন্দরবন ভ্রমণের প্রধান সহায় ও সহযাত্রী ছিলেন। তাঁহার অভিজ্ঞতা, গ্রন্থলব্ধ জ্ঞান, সূক্ষ্মানুসন্ধান ও অনেক তথ্যের সমাধান এমন ভাবে আমাকে চমকিত ও উৎসাহিত করিয়াছিল যে, তাঁহার সাহায্য ব্যতীত আমার পুস্তক জন্মলাভ করিত কিনা সন্দেহ। আমাদের ভ্রমণকালে তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র যামিনীকান্ত আমাদের সহচর হইতেন। এই দিব্যচরিত্র যুবক কোন পরীক্ষায় পাশ না হইলেও বেশ সুশিক্ষিত, দেশভুক্ত ও সেবাব্রত ছিলেন। খুল্লতাতের মত তিনি অকৃতদার ও বিলাসবর্জ্জিত। খুল্লতাত জগদ্বিখ্যাত রাসায়নিক, পিতা দেশবিখ্যাত শিকারী এবং তিনি ছিলেন সর্পের শিকারী ও বিষধর সর্পদংশনের অত্যদ্ভুত চিকিৎসক। সে কথা পুস্তকে আছে (১০২ পৃ, ১ ও ২ নং পাদটীকা দ্রষ্টব্য)। সর্পের চিকিৎসক সর্পদংশনেই জীবনলীলা সাঙ্গ করেন ইহা প্রবাদ, কিন্তু যামিনীবাবুর বেলায় তাহা বর্ণে বর্ণে খাঁটিয়াছে। গত ১৩২৭ সালের আষাঢ় মাসে তাঁহার অকাল মৃত্যু হয়। তাঁহার পিতা রায়সাহেব পূর্ব্ব হইতে হৃদরোগে ভুগিতেছিলেন, জ্যেষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুর পর তিনি ৩ বৎসর মাত্র জীবিত ছিলেন (১০২ পৃ, ৩নং পাদটীকা দ্রষ্টব্য)। এই পিতাপুত্রের অন্তর্ধানে আমি শোকে মুহ্যমান হইয়াছি; অনেক সময়ে কৃতজ্ঞ হৃদয়ে তাঁহাদের কথা ভাবি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করি। একটা বিশেষ ক্ষতি এই হইয়াছে যে, আমি যে ভাবে সুন্দরবনে ভ্রমণ করিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম, অন্যের ত দূরের কথা, আমারও সে সুযোগ আর হইবে না, নূতন তথ্যাবিষ্কারের পক্ষেও বিষম ক্ষতি হইবে। আমার কার্য্যের সহায়ক বলিয়া আমার আর যে সকল বিশিষ্ট ব্যক্তির নামোল্লেখ পূর্ব্ববার করিয়াছিলাম, তন্মধ্যে কয়েক বৎসর হইল আর একজন পরলোক গমন করিয়াছেন, তিনি বনগ্রাম স্কুলের ভূতপূর্ব্ব হেডমাষ্টার চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি অপটু দেহ লইয়াও প্রাদেশিক ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে সুনিপূণ ও সূক্ষ্মদর্শী ছিলেন। অন্যের পরলোকগমনের সংবাদ হয়ত আর আমাকে না দিতে হইতেও পারে। তবে একটা বড় সাধ আছে, যে ভাবে এই প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণ আমার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হওয়ায় আমি নিজ মত পুনর্বিচার করিবার অবসর পাইলাম, সেই ভাবে দ্বিতীয় খণ্ডখানিরও আর একবার সংস্কার করিয়া যাইতে পারিলে পরম তৃপ্তিলাভ করিতাম। কারণ বারংবার সংস্কারই ঐতিহাসিক গ্রন্থের পুষ্টিকর ঔষধ। শ্রীভগবান জানেন, তাহা হইবে কিনা।

পূর্ব্ববার অনেক মুদ্রাকর ভ্রম ছিল, এবার সতর্ক হইলেও কিছু কিছু যে না থাকিল, তাহা নহে। মফস্বলে বসিয়া প্রুফ দেখিলে এবং মুদ্রণারম্ভের পূর্ব্বে একবার দেখিয়া শেষ অর্ডার না দিলে, ভ্রম থাকিয়াই যায়। তবুও এ সংস্করণে ভ্রম যাহা আছে, তাহা খুব কম, ইহাই সুখের বিষয়।

শ্রীসতীশচন্দ্র মিত্র
দৌলতপুর কলেজ
১লা বৈশাখ, ১৩৩৫

.

তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা

পুণ্যস্মৃতি সতীশচন্দ্র মিত্রের জীবনাবসানের পরবর্তীকালে বাংলাদেশ নানা ঝটিকাবৰ্ত্তে আলোড়িত হইয়াছে। অবশেষে দেশ স্বাধীন হইবার পর আপন দেশের ইতিহাস পাঠে আসক্তি জাগরূক হইবার সঙ্গে সঙ্গে এই গ্রন্থ নিঃশেষিত হইয়া যায়। এই গ্রন্থ দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ। তৃতীয় খণ্ড বা একখানি আভিধানিক পরিশিষ্ট খণ্ড লিখিবার বাসনা ও পরিকল্পনা গ্রন্থকারের ছিল। কালের করালে তাঁহার অকাল মৃত্যুতে তাহা অপূর্ণ থাকিয়া যায়। মাত্র ৬০ বৎসর বয়সে তাঁহার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। (জন্ম, ১৪ই ডিসেম্বর, ১৮৭২ : মৃত্যু, ৭ই জুন, ১৯৩১)।

প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হইলে তদানীন্তন ঐতিহাসিক মহলে যেমন উদ্দীপনা দেখা যায়, তেমনই কিছু তর্কজাল সৃষ্ট হয়। কারণ, আলোচ্য বিষয়ের পরিধি ইংরাজ আমলের যশোহর- খুলনা হইলেও, সুদূর অতীতের বকদ্বীপ, সমতট ও বাগড়ী, পাঠান আমলের মামুদাবাদ, ফতেয়াবাদ ও খালিফাতাবাদ এবং মোগল আমলের যশোর রাজ্য বা যশোর সমাজ আধুনিক যশোহর-খুলনার সীমাবন্ধনে সীমিত ছিল না। গ্রন্থকার অমানুষিক পরিশ্রমলব্ধ ঐতিহাসিক সাক্ষ্য ও প্রমাণ উত্থাপনান্তে এমন কতকগুলি দুঃসাহসিক প্রস্তাবনা ও অনুমান করেন, যাহা বাঙলার ও বাঙালীর ইতিহাসে নূতন আলোকপাত করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে গঙ্গারিডির গঙ্গে বা গঙ্গারেজিয়া, সমতটে বৌদ্ধধর্ম্মের কেন্দ্র ও প্রসার, লক্ষণসেনের শঙ্খনট্, দনুজমর্দ্দনের রাজত্বকাল, খাঁ জাহান আলির পরিচয় ও কার্য্যাবলি, হুসেন শাহের বাল্যপরিচয়, হরিদাসের ও বৈষ্ণব ভাবধারার আদিবৃত্তান্ত, এমনই আরও অনেক বিষয়ে। কাজেই তর্ক অনিবার্য্যরূপে আসে। যুক্তির অখণ্ডতার জন্য মৌলিক বিষয়গুলি পরিবর্তনের কোন প্রশ্ন আসে নাই; কিন্তু কতকগুলি গৌণ বিষয়ে মত পরিবর্তনের কথা আসে। গ্রন্থকার তাঁহার জীবদ্দশায় তাহা গ্রহণ করিয়া প্রথম খণ্ডের পরিবর্দ্ধিত সংস্করণ (১৯২৮) প্রকাশিত করিয়া যাইতে সক্ষম হন। দ্বিতীয় খণ্ডের অর্থাৎ মোগল ও ইংরাজ আমলের অন্তর্ভুক্ত কতকগুলি তর্কমূলক প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। মহামতি বিভারিজ সাহেব, শ্রদ্ধেয় যদুনাথ সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। গ্রন্থকারের একান্ত ইচ্ছা ছিল অনুরূপভাবে দ্বিতীয় খণ্ডের সংশোধিত ও পরিবর্দ্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত করিবেন। কিন্তু কাল এ বিষয়ে বাদ সাধিল। পরম-শ্রদ্ধেয় যদুনাথ সরকারের সহিত বর্ত্তমান সম্পাদকের সেই সকল প্রশ্নগুলি সম্পর্কে আলোচনা করিবার সৌভাগ্য হইয়াছিল এবং তাঁহারই নির্দেশমত দ্বিতীয় খণ্ডের সম্পাদনা মনস্থ রহিয়াছে।

এই গ্রন্থ সম্পাদনা কালে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে কতকগুলি বিষয় স্মরণে রাখিয়া অগ্রসর হইতে হইয়াছে। প্রশ্ন উঠিয়াছিল ইহার কলেবর লইয়া। বাঙলাদেশের এক চিরপরিবর্তনশীল অঞ্চলের ইতিহাসের ভিত স্থাপন করিতে হইয়াছে গ্রন্থকারকে। তিনি নিজেই দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকা বলিয়া গিয়াছেন, “ভিত্তি পত্তনের জন্য একটু বিস্তৃত আলোচনা, অনুযোগ বা অসহিষ্ণুতার বিষয় হওয়া উচিত নয়। সৌধ-প্রাচীরের ভিত্তি মৃত্তিকা নিম্নে একটু বিস্তৃতই হইয়া থাকে।’ বঙ্গীয় ও ভারতীয় ইতিহাসের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখিয়া সময় ও তথ্যের সমন্বয় করিয়া তাঁহাকে অগ্রসর হইতে হইয়াছে। জেলার ইতিহাস লিখিতে গিয়া কোথায়ও দেশের ইতিহাস দৃষ্টি-ছাড়া করেন নাই। ইহা ভিন্ন তিনি নিজেই ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন যে, তাঁহার এই ইতিহাস প্রণয়নের প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল, দেশের ইতিহাসের সঙ্গে দেশবাসীর ‘ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা’ সংস্থাপন করা। কাজেই আসিয়া পড়িয়াছে এই ইতিহাসের বেষ্টনের মধ্যে অগণিত মানুষ, অগণিত শ্রেণী, অগণিত বৰ্ণ ও সমাজ। রাজা-বাদশাহের বংশ ইতিহাসের মধ্যে এই গ্রন্থ সীমাবদ্ধ হইয়া থাকে নাই। হইয়া উঠিতে চাহিয়াছে সমতটের সমগ্র মানুষের ইতিহাস। ইতিহাসের এমন কলেবরকে অঙ্গহানি করিবার কাহারও অধিকার নেই।

মেঘনা ও ভাগীরথীর অন্তবর্ত্তী সমতট, বাড়ী বা দক্ষিণ ও পূর্ব্ববঙ্গের ইতিহাসের মূল কথাও আমাকে স্মরণ রাখিতে হইয়াছে। আধুনিক কালের গোয়ালন্দের ষ্টীমার ঘাট দেখিলে এই মূল কথা সহজেই ধরা পড়ে। এই আছে, এই নাই। আজ হয়ত দেখা যাইবে, কত লোক, কত দোকান-পাট, কত মানুষের কান্না-হাসির গঞ্জ; কালই হয়ত দেখা যাইবে, মানুষের সে পাট কোথায় উবিয়া গিয়াছে, তরঙ্গবিক্ষুব্ধ জলরাশি সেখানে থৈ থৈ করিতেছে। আবার নূতন তীরভূমিতে নূতন গঞ্জের পালা। সমতটের ইতিহাসও তাহাই। এই আছে, এই নাই। সুন্দরবনের উত্থান ও অবনমন, কালের শতকে শতকে ভয়াবহ ঝটিকাবর্ত ও অতি ভীষণ প্লাবন এদেশের মানুষকে ইতিহাসের কোনও পর্ব্বে এযাবৎ অধিকদিন স্থিতিশীল হইতে দেয় নাই। স্থিতিশীল নয় বলিয়া এ অঞ্চলে শত শত বর্ষব্যাপী বংশগৌরবে সমুজ্জল রাজবংশ দেখা পাওয়া দুষ্কর। এ দেশে যুগে যুগে রাজা বা রাজবংশ নির্বাচিত হইয়াছেন। এদেশে সামান্য একজন বৌদ্ধ গোপালদেবকে রাজটিকা পরাইয়া সিংহাসনে আরোহণ করান হয়; এ দেশে গোপালন- নিরত হুসেন শাহকে শাসক নির্ব্বাচিত করিয়া মসনদে আসীন করান হয়। ইতিহাসের এই যুগে এরূপ শাসক নির্ব্বাচন এদেশেই সম্ভব। ভাটি-বাঙলার মানুষ পুরাতনকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতে অভ্যস্ত; আবার নূতনকে গ্রহণ করিয়া নূতন সমাজ ও বসতি গড়িয়া তুলিতেও তাহাদের উৎসাহের অভাব নাই। ইহা যেন তাহাদের প্রকৃতিগত। এক একটি প্রাকৃতিক বিপ্লব আসিয়াছে, আর অমনই ভাটির মানুষ উত্তরে সরিয়া পড়িয়াছে; আবার গঙ্গা ও পদ্মার পলিমাটি- সৃষ্ট নূতন দ্বীপাঞ্চল দেখা দিলেই এদেশের মানুষ বাদা কাটিয়া আবাদ করিয়া নূতন জনপদ গড়িয়া তুলিয়াছে। পূর্ব্ববঙ্গের মানুষেরা সেকারণেই বোধহয় পুরাতন ভাবধারাকে পরিত্যাগ করিতে যেমন কুণ্ঠিত হয় না, তেমনই নূতন ভাবধারায় পুষ্ট হইয়া উঠিতেও তাহাদের আগ্রহের অন্ত নাই।

এই প্রাকৃতিক ভাঙা-গড়ার ইতিহাস মানুষের সমাজের ইতিবৃত্তেও প্রতিফলিত। আদিকাল হইতে ভারতবর্ষে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ ব্যবস্থা ছিল। এই গ্রামীণ ব্যবস্থার রাজনৈতিক রূপ হইতেছে আদিম-গণতান্ত্রিকতা। যাহার প্রকাশ গ্রাম-পঞ্চায়তী ব্যবস্থায়। কোনও কেন্দ্ৰীয় অর্থনৈতিক ও শাসনব্যবস্থা যখন এই পঞ্চায়তী মণ্ডলগুলির উপর আধিপত্য করিতে চেষ্টা করিয়াছে, তখন তাহারা বাধা দিয়াছে নানা উপায়ে। তাহাতে অক্ষম হইলে, তাহারা অনাবাদী অঞ্চলে নূতন বসতি ও সমাজ পত্তন করিয়া সরিয়া পড়িয়াছে। এই সরিয়া পড়িবার গতি ও ধারা বৰ্ত্তমান ছিল দক্ষিণবঙ্গের ইতিহাসে যেন সেদিন অবধিও। সরিয়া আসিয়া তাহারা বিল- বাওড়কে অবহেলা করিয়া, ‘বাঘ ও কুমিরের সঙ্গে লড়াই’ করিয়া, বনজঙ্গল কাটিয়া অমানুষিক পরিশ্রমে কত ‘নলডাঙ্গা’ ‘গোবরডাঙ্গা’, কত ‘বাঘবুনে’ ‘কুমিরা’, কত ‘মামুদকাটি’ ‘ঝালকাটি’ ‘কলসকাটি’ পত্তন করিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নেই; তবু তাহাদের পঞ্চায়তী মনোভাব, স্বাধীন- চেতা মনোভাব সহসা ছাড়িতে চাহে নাই। বালা, চন্দ্রদ্বীপ, ফতেয়াবাদ, খালিফাতাবাদ, অথবা যশোর রাজ্যের ইতিহাসের পশ্চাতে এই কথাই মূল কথা। কই, আর কোনও দেশে তো সহসা এমন ‘বারভুঞার’ রাজ্য সৃষ্টি হইতে দেখি না। কাজেই এদেশে শুধু শুদ্ধ রাজরক্ত অনুসরণ করিয়া ইতিহাস রচনা করা অবাস্তবতা।

এমন দেশের ইতিহাস লিখিতে গিয়া গ্রন্থকারকে অগণিত মানুষ, শ্রেণী ও বর্ণকে বর্ণনার মধ্যে আনিতে হইয়াছে। শুধু তাহাই নহে, এমন ক্ষণভঙ্গুর দেশে প্রকৃতিও সহজে ইতিহাসের কোনও বিশেষ নিদর্শন রাখিতে দেয় নাই। পুরাতন পুঁথি, তাম্রশাসন, মৃতফলক, শিলালিপি, মন্দির-মসজিদ- সবই দুষ্প্রাপ্য এই অঞ্চলে। ঝড়-ঝাপটা, প্লাবন ও অবনমন অতিক্রম করিয়া যদিও বা কিছু নিদর্শন থাকিবার কথা, তাহাও নিস্তার পায় নাই এদেশের লোনা মাটি, জল ও বায়ুতে। এমন কি, একযুগে বিস্তৃত ও খরস্রোতা নদীসঙ্গমে যে ‘নলদী’ ‘ধূমঘাটে’র মত বিশাল জনপদ সৃষ্টি হইয়াছিল, পরবর্ত্তী যুগে তাহার চিহ্নও মেলা দায়; সেই খরস্রোতা নদীর খাতও আজ দৃষ্টি-পথে আনা দুরূহ।

অতএব ইতিহাসের সন্ধানে গ্রন্থকারকে বাহির হইতে হইয়াছে মানুষের কাছে। কেননা, এমন দেশে মানুষের ভাবের আদান-প্রদানে, প্রবাদে, কথায়, বংশকারিকায় ইতিহাসের অকাট্য সাক্ষ্য না মিলিলেও, ইতিহাসের ইঙ্গিত অবধারিত ভাবে বাঁচিয়া থাকা সম্ভব। তিনি নিজেই লিখিয়াছেন, ‘দেশমাতৃকার প্রতি পদরেণুর সহিত পরিচিত হইতে প্রাণপণ চেষ্টা ও প্রার্থনা করিয়াছি।’ এই প্রচেষ্টায় যশোহর-খুলনার এমন কোন গ্রাম নাই, এমন কোন ক্ষুদ্র জনপদ নাই, এমন কোন দুর্ভেদ্য ব্যাঘ্র-সঙ্কুল বনাঞ্চল নাই, যেখানে সতীশচন্দ্রের পদরেণু না পড়িয়াছে। রাজা-বাদশা, জমিদার-ভূঞা, উচ্চ-বংশ, যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস তো আছেই, কিন্তু তাহার উপর আছে এই গ্রন্থের প্রতি ছত্রে মাটির মানুষের গন্ধ। খালিফাতাবাদ বা বাগেরহাট অঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে আবহমান কাল এক রীতি আছে, তাহারা একা কখনও মাঠে লাঙল-চাষ করিতে যায় না; অন্ততঃ দুই জনকে একত্র যাইতেই হইবে। কেন? এ রীতির কি ভিত্তি? এই রীতির সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক ইতিহাসের কি যোগ আছে, –তাহাও অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু হইয়া উঠিয়াছে সতীশচন্দ্রের। বাঙলা সাহিত্যে এমন ইতিহাস দুর্লভ।

অতএব, এমন পুস্তকের মূলে কোনও হাত দিবার দুঃসাহস করি নাই; করিবার অধিকার ও নাই।

কিন্তু ইতিমধ্যে ত্রিংশবৎসরাধিক কালে বাঙলার ইতিহাসে নূতন চর্চ্চা ও নূতন আলোকপাত কিছু হইয়াছে। পাদটীকায় সম্পাদকের নামাঙ্কিত করিয়া সেই সকল বিষয়ের সংক্ষিপ্তসার এই সংস্করণে সংযোজিত হইল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,—যশোহর-খুলনার আদিবাসী, গঙ্গারিডি, টিকানগর, বর্ম্মারাজবংশ, সেনরাজত্ব, ডোম্মনপাল, দনুজমৰ্দ্দন প্রভৃতি বিষয়।

নানা তথ্য ও সাক্ষ্যের সমাবেশ করিয়া সতীশচন্দ্র তাঁহার অনুমান ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, দেগঙ্গা বা দ্বিগঙ্গাই ছিল টলেমি উল্লিখিত গঙ্গারিডির রাজধানী গঙ্গারেজিয়া। বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও খননের দ্বারা উহারই অতিসন্নিকটে চন্দ্রকেতুগড়ে যে সব অতিপুরাতন নিদর্শন আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা সতীশচন্দ্রের উক্ত অনুমানের দৃঢ়তর সাক্ষ্য দিতেছে। ইহার গুরুত্ব অনুভব করিয়া, উক্ত অনুসন্ধান ও খননকার্য্যের অধিকর্তা এবং আমার শিক্ষক ও আশুতোষ মিউজিয়ামের কিউরেটর, অধ্যাপক দেবপ্রসাদ ঘোষ মহাশয়কে অনুরোধ করিবামাত্র অতি সাগ্রহে দেগঙ্গা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখিয়া দেন। উহা এবং তৎসহ কিছু ছবি পরিশিষ্টে সংযোজনের অনুমতি দিয়া শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক বর্তমান সংস্করণের যেমন গুরুত্ব বৃদ্ধি করিলেন, তেমনই আমাকে চিরকৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করিলেন।

সম্পাদনার নিয়ম অনুযায়ী এই গ্রন্থে যত পাদটীকা আছে অথবা যাহা কিছু উদ্ধৃতি এবং প্রমাণস্বরূপ উল্লিখিত হইয়াছে, তাহার সমুদয়ই সম্ভবমত পূনর্ব্বার পরীক্ষা করিয়া দেওয়া হইল। অতি পুরাতন পুস্তক ও পত্রিকার অভাবে যৎসামান্য মাত্র করা যায় নাই। তবে, প্রধান ও মূল বিষয়ে কিছু বাদ পড়ে নাই। পূর্ব্ববর্তী সংস্করণে গ্রন্থকার মফস্বলে বসিয়া একবার মাত্র প্রুফ দেখিয়া মুদ্রণের নির্দ্দেশ দিতে বাধ্য হওয়াতে কিছু কিছু ভুল ত্রুটি থাকিয়া গিয়াছিল। হস্তলিখিত মূল কপির অভাবে সেই সকল ভুল নির্দ্দিষ্ট করা যথেষ্ট শ্রমসাধ্য ও দায়িত্বপূর্ণ কাজ। তাহাও পালন করিতে চেষ্টার ত্রুটি করি নাই। এতদ্ব্যতীত বৰ্ত্তমান সংস্করণে জঙ্গলা-ভাষার তালিকা অল্পবিস্তর বর্দ্ধিত করা হইয়াছে এবং গ্রন্থকারের ব্যক্ত ইচ্ছানুযায়ী কয়েকটি স্থলে ক্রিয়াপদের সম্মান-সূচক রূপ ব্যবহার করা হইয়াছে মাত্র।

বর্ণানুক্রমিক সূচী বা নির্ঘণ্ট সৰ্ব্বাত্মক না হইলে এইরূপ প্রামাণিক পুস্তকের পূর্ণ সদ্ব্যবহার সীমিত হইয়া পড়ে। এই কথা স্মরণে রাখিয়া এইবার বিষয় ও নামের নির্ঘণ্টের কলেবর প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি করা হইয়াছে।

চিত্ৰসমূহ লইয়া নানা অসুবিধায় পড়িতে হইয়াছে। মূল ব্লকগুলি উদ্ধার করিতে সক্ষম হই নাই। সুতরাং পুস্তকের মুদ্রিত ছবি হইতেই ব্লক করিতে হইয়াছে। এই সংস্করণে কয়েকটি নূতন ছবি দেওয়া হইল।

পূর্ব্ববর্ত্তী সংস্করণের রেনেল ও সসনের ম্যাপ এবং খালিফাতাবাদের মানচিত্রের ব্লক করা সম্ভব হইলেও, অন্য দুইখানি মানচিত্রের অনুলিপি নূতন করিয়া অঙ্কিত করা হইয়াছে। ইহার জন্য শিল্পী শ্রীঅনিল মুখোপাধ্যায়ের নিকট এবং প্রচ্ছদপটের জন্য শিল্পী শ্রীচারু খান-এর নিকট বাধিত রহিলাম।

দেশের ও বিদেশের বহু প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক এই গ্রন্থের মূল্যায়ন ও সমালোচনা করিয়াছেন; কিন্তু রবীন্দ্রনাথও যে এই গ্রন্থের সমাদর জানাইতে বিন্দুমাত্র দেরী করিবেন না, এমন কথা পূৰ্ব্বে কোনদিন ভাবিতে পারি নাই। কবিগুরুর স্বহস্তে লিখিত লিপিখানি এক অমূল্য সম্পদ। ইহা উদ্ধার করিবার আশা ছিল না। ভাগ্যবশে মিলিয়া গেল এবং ইহার অনুলিপি গ্রন্থের প্রারম্ভপত্রের পূর্ব্বে সন্নিবিষ্ট হইল। ইহাতে উল্লিখিত গুরুদেবের প্রথম পত্রখানি উদ্ধার করিতে সক্ষম হই নাই। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কবিগুরুর বংশধারা অর্থাৎ পীরালি-ব্রাহ্মণভুক্ত পিঠাভোগের কুশারী বংশের কথা এবং তাঁহার এক উর্দ্ধতন পুরুষ বহুগ্রন্থ-রচয়িতা মহাপণ্ডিত পুরুষোত্তমের কথা এই খণ্ডে আলোচিত হইয়াছে।

সর্ব্বোপরি এমন বৃহৎ পুস্তকদ্বয়ের প্রকাশনার জন্য অর্থের প্রশ্ন বিড়ম্বিত করিতেছিল। কেহই সহসা একাজে অগ্রসর হইতে চাহেন না। আদিতে গ্রন্থকারও এই প্রশ্নের সম্মুখীন হইয়াছিলেন। কিন্তু তখন ছিল বাঙলাদেশে স্বর্ণযুগ, মহামানুষের যুগ। তখন যে দেশপ্রেমের মূর্ত্ত প্রতীক ‘ঋষিতুল্য ও দান-শৌণ্ডিকতায় দ্বিতীয় দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর’ আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্ৰ জীবিত ছিলেন। তাঁহার দান-ভাণ্ডার উন্মুক্ত হইয়াছিল গ্রন্থকারকে নিশ্চিন্ত করিবার জন্য। কিন্তু এইবার! পার্ক সার্কাসের ময়দানে রবীন্দ্র-শতবার্ষিকীর মেলার ভিড়ে বসিয়া অধুনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রধান অধ্যাপক ডক্টর প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত মহাশয়ের নিকট এই গ্ৰন্থ প্রকাশনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলে, আমাকে নানা উপদেশে কৃতার্থ করিয়া অবশেষে তিনি গভর্ণমেণ্টের নিকট প্রস্তাব করিতে পরামর্শ দিলেন এবং বিশেষ করিয়া বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও সংস্কৃতি-দপ্তরের মাননীয় মন্ত্রী হুমায়ুন কবিরকে সমগ্র বিষয় জ্ঞাপন করিতে বলিলেন। ইহার পর শ্রী কবিরের উপদেশ ও শুভেচ্ছা পাইতে বিলম্ব হয় নাই। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম কর্ণধার ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এবং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী রায় হরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর নিকটও সমগ্র বিষয় নিবেদন করি। ইঁহাদের সকলের শুভেচ্ছায় বর্তমান সংস্করণের আত্মপ্রকাশ সম্ভব হইল। এই বিষয়ে আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নাই।

সম্পাদনার কার্য্যে সর্ব্বাপেক্ষা ঋণী রহিলাম আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, অধ্যাপক ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ের নিকট। প্রতি পদে তাঁহার উপদেশ ও নির্দ্দেশ গ্রহণ করিয়া আমি অগ্রসর হইয়াছি। তাঁহার জ্ঞানভাণ্ডার ও অভিজ্ঞতা আমার জন্য উন্মুক্ত ছিল। ‘বাঙালীর ইতিহাস’ লেখকের নিকট ঋণী হইয়া থাকাও গৌরব। সে গৌরব হইতে আমি কোনদিনই বঞ্চিত হইতে চাহি না।

এই গ্রন্থের জন্য যখনই যাঁহার নিকট গিয়াছি, সকলেরই সহানুভূতি ও সহযোগিতা পাইয়াছি। তাঁহাদের সকলেরই নিকট কৃতজ্ঞ হইয়া রহিলাম। আমার কর্ম্মক্ষেত্র কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রমীলচন্দ্র বসু এবং আমার সহকর্মীদের কত অনুরোধ ও উপরোধের দ্বারা বিড়ম্বিত করিয়াছি, তাহার শেষ নাই। তাঁহাদের সাহায্য ও আনুকূল্যের জন্য চিরঋণী হইয়া রহিলাম।

বিশ্বভারতীর সহিত সংশ্লিষ্ট শ্রদ্ধেয় কবি কানাই সামন্তের উপদেশ অনুযায়ী পুরাতন বানান- পদ্ধতিই রক্ষিত হইল। তাঁহার ন্যায় প্রকাশনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট হইতে আরও অনেক বিষয়ে মতামত পাইয়া কৃতার্থ হইয়াছি এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাহা স্মরণ করিতেছি।

নাভানা প্রকাশনের প্রাণস্বরূপ কবি বিরাম মুখোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে না আসিলে, প্রকাশন ও মুদ্রণ জগতের নূতন ভাবধারার বিষয়ে অজ্ঞই থাকিয়া যাইতাম। ব্যবসায়ী-বৃত্তিকে ম্লান করিয়া প্রকাশন-কাৰ্য্যকে যে পুস্তক-প্রীতি ও পুস্তক-মমতা এমনভাবে বিধৃত করিতে পারে, তাহা এতদিন কল্পনার বাহিরে ছিল। এই পুস্তকের সৌষ্ঠবের জন্য সর্ব্ব কৃতিত্ব ও ধন্যবাদ তাঁহারই প্রাপ্য। গ্রন্থকারের সমগ্রজীবনব্যাপী পরিশ্রমের, চিন্তার ও ধ্যানের ফলস্বরূপ এইরূপ গ্রন্থ তাঁহার সংক্ষিপ্ত জীবনী সম্বলিত না হইলে অপূর্ণ থাকিয়া যায়। সাধারণ নিয়মানুযায়ী তাহা গ্রন্থ-শেষে, অর্থাৎ দ্বিতীয় খণ্ডের পরিশিষ্টে প্রদত্ত হইবে।

শিবশঙ্কর মিত্র
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার
২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩

Book Content

প্রথম অংশ - প্রাকৃতিক
১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপক্রমণিকা
২. বাহ্য প্রকৃতি ও বিভাগ
৩. নদী-সংস্থান
৪. ব’দ্বীপের প্রকৃতি
৫. অন্যান্য প্রাকৃতিক বিশেষত্ব
৬. সুন্দরবন
৭. সুন্দরবনের উত্থান ও পতন
৮. সুন্দরবনে মনুষ্যাবাস
৯. সুন্দরবনের বৃক্ষলতা
১০. সুন্দরবনের জীবজন্তু
১১. সুন্দরবনে শিকার ও ভ্রমণ
১২. সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা
দ্বিতীয় অংশ - ঐতিহাসিক (১. হিন্দু-বৌদ্ধ যুগ)
১. প্রথম পরিচ্ছেদ – উপবঙ্গে দ্বীপমালা
২. দ্বীপের প্রকৃতি
৩. আদি হিন্দু-যুগ
৪. জৈন-বৌদ্ধ যুগ
৫. গুপ্ত-সাম্রাজ্য
৬. সমতটে চীন-পৰ্য্যটক
৭. মাৎস্য-ন্যায়
৮. বৌদ্ধ-সংঘারাম কোথায় ছিল
৯. সেন-রাজত্ব
১০. সেন-রাজত্বের শেষ
১১. আভিজাত্য
দ্বিতীয় অংশ - ঐতিহাসিক (২. পাঠান রাজত্ব)
১. তামস যুগ
২. বসতি ও সমাজ
৩. দনুজমৰ্দ্দন দেব
৪. খাঁ জাহান আলি
৫. খাঁ জাহানের কার্য্যকাহিনী
৬. পয়োগ্রাম কসবা
৭. খালিফাতাবাদ
৮. খাঁ জাহানের শেষ জীবন
৯. হুসেন শাহ
১০. রূপ-সনাতন
১১. লোকনাথ
১২. হরিদাস
১৩. রামচন্দ্র খাঁ
১৪. গাজীর আবির্ভাব
১৫. মুকুট রায়
১৬. দক্ষিণরায় ও গাজীর কথার শেষ
১৭. পাঠান আমলে দেশের অবস্থা
পরিশিষ্ট ।। ক – সুন্দরবনের বিনষ্ট নগরী নলদী
পরিশিষ্ট ।। খ – ভরত-ভায়না স্তূপ
পরিশিষ্ট ।। গ – দেগঙ্গা ও বালাণ্ডা
পরিশিষ্ট ।। ঘ – বংশাবলী
লেখক: সতীশচন্দ্র মিত্রবইয়ের ধরন: ইতিহাস ও সংস্কৃতি
অদ্বৈতপ্রকাশ - ঈশান নাগর

অদ্বৈতপ্রকাশ – ঈশান নাগর

যশোহর খুলনার ইতিহাস ২ - সতীশচন্দ্ৰ মিত্ৰ

যশোহর খুলনার ইতিহাস ২ – সতীশচন্দ্ৰ মিত্ৰ (অসম্পূর্ণ)

Reader Interactions

Comments

  1. Lubaba Marjan

    April 11, 2025 at 12:33 pm

    বইয়ের কয়টা অংশ? আর কতটুকু অসম্পূর্ণ আছে? অর্থাৎ কত পৃষ্ঠা বাকি আছে? বাকিটুকু কি দিবেন?

    Reply
    • বাংলা লাইব্রেরি

      April 11, 2025 at 12:49 pm

      মোট দুই খণ্ড। প্রথম খণ্ডে দুইটা অংশ। সবে প্রথম অংশ দেয়া হয়েছে। দুইটি বইই দেয়ার ইচ্ছে আছে।

      Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Lost Your Password?
Bangla Library Logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Registration confirmation will be emailed to you.