জেরুসালেম : ওয়ান সিটি থ্রি ফেইস (এক নগরী তিন ধর্ম) – ক্যারেন আর্মস্ট্রং
নোট/রেফারেন্সগুলোর প্রুফরীড করা হয়নি
অনুবাদ – মোহাম্মদ হাসান শরীফ
প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা ২০১৯
Jerusalem : One City, Three Faiths by Karen Armstrong
Published by: Md. Monir Hossain Pintu
অনুবাদ উৎসর্গ
শিক্ষকতুল্য জনাব দীন মোহাম্মদকে
কৃতজ্ঞতাস্বীকার
লেখালেখি একটি নিঃসঙ্গ ও অনেক সময় একাকী চলার পেশা হলেও সমর্থন ও উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমার এজেন্ট ফেলিসিটি ব্রায়ান, পিটার গিনসবার্গ ও অ্যান্ড্রু নুর্নবার্গ এবং সেইসাথে সম্পাদক জেন গ্যারেট ও স্টুয়ার্ট পোফিটকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিশেষজ্ঞসুলভ মূল্যায়ন, ধৈর্য, পরামর্শ ও সহায়তার জন্য রজার বোয়স, ক্লেয়ার ব্র্যাডলি, জুলিয়েট ব্রাইটমোর, ক্যাথেরিন হরিগান, টেড জনসন, অ্যানথিয়া লিঙ্গম্যান, জোনাথন ম্যাগোনেট, টবি মান্ডি ও মেলভিন রোসেনথালের প্রতিও কৃতজ্ঞ। সবশেষে ধন্যবাদ জানাব ব্যালান্টাইনে আমার পূর্বতন সম্পাদক জুলি ডেলবারগোকে। তিনিই আমাকে এ নিয়ে বই লিখতে প্রথম পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি সবসময় আমাকে বিপুল উদ্দীপনা আর উৎসাহ দিয়ে উদ্বুদ্ধু করেছেন।
বাংলা সংস্করণ নিয়ে কিছু কথা
জেরুসালেম। সম্ভবত ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় থেকে শব্দটি আমার পরিচিত। সময় গড়ানোর সাথে সাথে নানাভাবে নগরীটি সম্পর্কে ধারণা বাড়তে থাকে। পরে সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়লে এ সম্পর্কে আগ্রহ আরো বাড়ে। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন রূপে ধরা দিতে থাকে এই নগরী। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে জেরুসালেমের ইতিহাস এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। প্রতিনিয়তই জেরুসালেম থাকছে খবরের পাতায়। ফলে জেরুসালেম : দি বায়োগ্রাফি কিংবা জেরুসালেম : ওয়ান সিটি থ্রি ফেইথস বইগুলো আমাকে স্বাভাবিকভাবেই মন্ত্রমুগ্ধ করে।
জেরুসালেমের প্রতি যত শ্রদ্ধা, ভক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে কিংবা একে নিয়ে যত বিতর্ক, বিরোধ, যুদ্ধ হয়েছে- তা অন্য কোনো নগরীর ক্ষেত্রে ঘটেনি। তিন ইব্রাহিমি ধর্মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই নগরী। ইতিহাসের আগে থেকেই এই নগরী আলোচনায় থাকলেও এখনকার সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে জেরুসালেম প্রবলভাবে আলোর মধ্যে থাকছে।
ফলে জেরুসালেম নিয়ে লেখা যেকোনো বইই যথেষ্ট গুরুত্ব পাবে। তবে লেখক যদি ক্যারেন আর্মস্ট্রংয়ের মতো কেউ হন, তবে এটি আরো বেশি আকর্ষণ সৃষ্টি করে। তার লেখা হিস্টোরি অফ গড, দি ব্যাটল ফর গড, হলি ওয়ার, ইসলাম, বুদ্ধ, এন্ড দি গ্রেট ট্রান্সফরম্যাশন এবং দুটি স্মৃতিকথা: থ্রু দ্য ন্যারো গেইট এবং দি স্পাইরাল স্টেয়ারকেস ইত্যাদি বইগুলো বিশ্বজুড়ে বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। এ বইটি তারই লেখা। আরো আগেই এটি অনুবাদ হওয়া উচিত ছিল।
লেখক বস্তুনিষ্ঠভাবে একেবারে শুরু থেকেই জেরুসালেমের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সত্য প্রকাশে তিনি বেশ কঠোরতাই অবলম্বন করেছেন। কে খুশি হলো, কে নাখোশ হলো- সে দিকে পরোয়া করেছেন সামান্যই। জেরুসালেমের নামটি কিভাবে এলো, কিভাবে ইহুদি সম্প্রদায়ের সাথে এই নগরী সম্পৃক্ত হলো, তাদের আগে এখানে কারা বসবাস করত, এখনকার অধিবাসীদের সাথে তাদের সম্পর্ক কী, খ্রিস্টানরা কিভাবে নগরীর সাথে যুক্ত হলো, মুসলিমরা কেন নগরীর প্রতি এত আকর্ষণ অনুভব করে, সবই তিনি সামনে নিয়ে এসেছেন।
হানাহানির এই সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায় কিভাবে, বিশেষ করে জেরুসালেমে শান্তি কিভাবে আসতে পারে। সে দিকেই পাঠককে নিয়ে যেতে চেয়েছেন তিনি। বলতে চেয়েছেন, জেরুসালেমই হতে পারে শান্তির মডেল। যুগে যুগে নবী, স্বপ্নদ্রষ্টারা আসলে শান্তির বাণীই প্রচার করতে চেয়েছেন। তারা ধর্মের কথা বলেছেন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, ধর্ম অশান্তির বাহন নয়। বরং স্বার্থন্বেষী কিছু লোক ধর্মের অপব্যাখ্যা করে অশান্তি সৃষ্টি করেছে।
তিনি জোরালোভাবে বলেছেন, প্রাচীন দুনিয়ায় ন্যায়বিচারের মতবাদ কোনো ধার্মিক স্বপ্ন নয়, বরং সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারণার মধ্যেই তা নিহিত ছিল। সামাজিক অস্থিরতার কারণে রাজ্যের পতন ঘটত। প্রজাদের ওপর বিপুল বোঝা চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থার কারণে সেই খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতকে উগারিতের পতন ঘটেছিল।
তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, প্রবল শক্তি নিয়ে জেরুসালেমের ওপর আছড়ে পড়েছিল ক্রুসেড বাহিনী। কিন্তু তাদের পতন হলো কেন? তারা যিশুখ্রিস্টের ভালোবাসার বাণীকে গ্রহণ করেনি। তারা ভয়ঙ্কর খুনি মনোবৃত্তি নিয়ে মুসলিমদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। জয়ও তারা পেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। তার মতে, ক্রুসেড ছিল ভয়ানক, ভীতিকর, বিপজ্জনক ও ব্যয়বহুল। তাতে লাভ হয়নি কিছুই, কিন্তু ক্ষতি হয়েছে বিপুল।
তিনি বর্তমান ইহুদি রাষ্ট্রটিকেও একইভাবে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, তারা যদি সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ না করে, তবে তাদের পতন অনিবার্য। আপস করার মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ।
তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে হজরত ওমর ও গাজী সালাহউদ্দিনের উদারতার কথা তুলে ধরেছেন। বিপুল বিজয়ের পরও তারা যে শান্তি আর সবাইকে নিয়ে সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করেছিলেন, কেবল জেরুসালেম কেন, পৃথিবীর ইতিহাসেই তা বিরল। তিনি দেখিয়েছেন, হজরত ওমরের সময় খ্রিস্টানরা আত্মসমর্পণ করার পর কোনো হত্যাকাণ্ড, সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়নি, প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মীয় নিদর্শনে অগ্নিসংযোগ করা হয়নি, কোনো বহিষ্কার বা সম্পত্তির বাজেয়াপ্তকরণ হয়নি, অধিবাসীদের বলপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয়নি। নগরীর পূর্ববর্তী অধিবাসীদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন যদি একেশ্বরবাদী শক্তির পূর্ণাঙ্গ প্রকাশক হয়ে থাকে, তবে বলতে হবে জেরুসালেমে ইসলাম তার দীর্ঘ শাসনকাল ঠিক সেভাবেই শুরু করেছিল।
সালাহউদ্দিনের কথাও তিনি বলেছেন মুগ্ধভাবে। তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, মুসলিমেরা ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর যখন নবীর মিরাজ ও ইসরা উদযাপন করছিল তখন সালাহউদ্দিন ও তার সৈন্যরা বিজয়ী বেশে জেরুসালেমে প্রবেশ করলেন। সুলতান তার প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। একজন খ্রিস্টানকেও হত্যা করা হয়নি। ব্যারনরা সহজেই তাদের মুক্তিপণ আদায় করেছিল, তবে গরিব মানুষরা পারেনি। তারা যুদ্ধবন্দি হয়। অবশ্য বিপুলসংখ্যককে মুক্তি দেওয়া হয়। কারণ দাসত্বের কারণে আলাদা হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর দুর্দশা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন সালাহউদ্দিন। সালাহউদ্দিনের ভাই আল-আদিলও এত বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন যে তার নিজের ব্যবহারের জন্য রাখা এক হাজার বন্দিকে তিনি সাথে সাথে মুক্ত করে দেন। প্রতিটি মুসলমান কল্পনাতীত কষ্ট পেয়েছিলেন এটি দেখে যে ধনী খ্রিস্টানরা তাদের স্বদেশী লোকদের মুক্তিপণ দেওয়ার কোনো চেষ্টা না করেই তাদের ধন-সম্পদ নিয়ে পালাচ্ছে। মুসলিম ইতিহাসবিদ ইমাদ উদ্দিন যখন দেখলেন যে প্যাট্রিয়ার্ক হেরাক্লিয়াসের গাড়ির ঘোড়াগুলো তার সম্পদের ভারে গোঙাচ্ছে, তখন তিনি সালাহউদ্দিনের কাছে অনুনয় করেছিলেন ওইসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে বাকি বন্দিদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সালাহউদ্দিন তা করতে অস্বীকার করেন এই যুক্তিতে যে শপথ ও চুক্তি অবশ্যই আক্ষরিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ‘খ্রিস্টানরা সবখানে তাদের প্রতি দেখানো দয়ার কথা স্মরণ করবে।’ সালাহউদ্দিন ঠিক কথাই বলেছিলেন। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা অস্বস্তিকরভাবে অবগত ছিলেন যে তাদের নিজস্ব ক্রুসেডারেরা জেরুসালেম জয়ের সময় যা করেছিল এই শাসক তাদের সাথে তার চেয়ে অনেক বেশি ‘খ্রিস্টান’ আচরণ করেছেন। তারা নানা কিংবদন্তি সৃষ্টি করে তাকে নিয়ে।
জেরুসালেমের কথা বলতে বলতে লেখক ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম- এই তিন ধর্মের উৎস, বিবর্তন চমৎকারভাবে সামনে নিয়ে এসেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে জেরুসালেম বারবার ধ্বংস হয়েছে, সেই ধ্বংস্তুপ থেকে আবারো জেগে ওঠেছে। শান্তির বাণী ঘোষণা করেছে।
আমাদের কী শিক্ষা দেয় জেরুসালেম? এই ঐশী নগরী আমাদের শিক্ষা দেয় হাল না ছাড়ার। যতই শক্তিশালী উৎপীড়ক হোক না কেন, তার পতন অনিবার্য। কেবল শান্তি, সহানুভূতি, দয়ার শক্তিই চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়। সব ধর্ম এই শিক্ষাই দেয়। কেবল এটিই আনতে পারে পরম শান্তি।
এই অনুবাদে দি কোরআনকে পবিত্র কোরআন, মোহাম্মদকে মুহাম্মদ (সা.), সালাদিনকে সালাহউদ্দিন হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। প্রচলিত দামেস্ক না লিখে দামাস্কাস লেখা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মানুষের একটি বড় অংশ নগরীটিকে জেরুজালেম নামে চেনে। অথচ নগরীর নাম ‘জেরুসালেম’।
বইটির বাংলা সংস্করণ প্রকাশ করার জন্য প্রকাশককে ধন্যবাদ। এ ধরনের বই যত বেশি প্রকাশ পাবে, ততই মঙ্গল।
বইটি উৎসর্গ করার মাধ্যমে দীন মুহাম্মদ ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তার সাথে যখন আমার পরিচয়, তখন তিনি সরকারি চাকরি জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন, আর আমিও কর্মজীবনের মাঝামাঝি পর্যায়ে। তবুও তার কাছ থেকে নানাভাবে উপকৃত হয়েছি। কিন্তু হঠাৎ করে এবং অপ্রত্যাশিতভাবে যোগসূত্রটি ছিন্ন হয়ে যাওয়া আমার জন্য ছিল খুবই কষ্টদায়ক। অনুমতি চাইলে দেবেন না- কাজেই বিনা অনুমতিতেই তার নামে বইটি উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বইটি অনুবাদের কাজ করার সময় সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে কঠিন কিছু অধ্যায় অতিক্রম করেছি। ফলে এসবের ছায়াও অবচেতনভাবে এতে পড়ে থাকতে পারে। বিষয়টিকে ক্ষমাসুন্দরভাবে দেখার জন্য সবিনয় অনুরোধ করছি।
মোহাম্মদ হাসান শরীফ
সূচনা
আমি অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে জেরুসালেমেই সবচেয়ে বেশি সফর করেছি, এই স্থানেই ইতিহাস থাকে বর্তমানের ব্যাপ্তিতে। যেকোনো বিরোধপূর্ণ এলাকার ক্ষেত্রেই বিষয়টি সম্ভবত প্রযোজ্য। তবে ১৯৮৩ সালে আমি যখন কাজ করতে প্রথমবারের জেরুসালেম যাই, তখনই নগরীটি আমাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল। প্রথমত এর প্রতি নিজের প্রতিক্রিয়ার শক্তি দেখে অবাক হয়েছিলাম। একেবারে শৈশব থেকে দাউদ নবী (কিং ডেভিড) বা যিশু সম্পর্কে যেসব কাহিনী শুনে আসছিলাম, আমার জীবনের কল্পণাপ্রবণ বাস্তবতায় থাকা সেই স্থানে হাঁটতে পারাটা ছিল অবাক করা বিষয়। তরুণ নান হিসেবে ধ্যানমগ্ন থাকার সময় মনে গেঁথে থাকা বাইবেলের ছবি ভাবার শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল আমাকে। ফলে গেথসেম্যান গার্ডেন, মাউন্ট অলিভেস কিংবা ভায়া ডোলোরোসা মনের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। এখন প্রতিদিন ওইসব এলাকা দিয়ে যাতায়াতের সময় আবিষ্কার করেছিলাম যে প্রকৃত স্থানটি অনেক বেশি বিশৃঙ্খল ও বিভ্রান্তিকর। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আমাকে হজন করতে হলো যে জেরুসালেম ইহুদি ও মুসলিমদের কাছেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢোলা হাতার জামা পরা ইহুদিদের বা কঠোর দর্শন ইসরাইলি সৈন্যদের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের পাথরে চুমু খেতে দেখে কিংবা মুসলিম পরিবারগুলোকে সবচেয়ে ভালো পোশাক পরে হারাম আল-শরিফে জুমার নামাজ পড়তে যেতে দেখে আমি প্রথবারের মতো ধর্মীয় বহুত্ববাদের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন হলাম। লোকজন একই নিদর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখতে পারে। আমার জেরুসালেমে তারা ছিল পুরোপুরি অনুপস্থিত, অথচ এসব লোকের প্রত্যেকেই যে তাদের পবিত্র নগরীর সাথে সম্পৃক্ত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও নগরীটি আমারও হয়ে গেছে। ২০ শতকের জেরুসালেমের সাথে আমার প্রথম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সময় আমার পুরনো বাইবেলিক ছবি সার্বক্ষণিক মিশে ছিল। যেভাবেই হোক না কেন, আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর সাথে সম্পৃক্ত জেরুসালেম আমার স্বকীয় পরিচিতিও গড়ে দিয়েছিল।
অবশ্য ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে নগরীর ওপর আমার কোনো রাজনৈতিক দাবি ছিল না। অবশ্য জেরুসালেমে আমার নতুন সহকর্মী ও বন্ধুদের তা ছিল। আবারো বলছি, ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিরা আমার সামনে যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করার সময় অতীত ঘটনাবলীর তরতাজাভাবে বিরাজ করতে দেখে হতবাক হয়েছি। সবাই, অনেক সময় একেবারে নিখুঁতভাবে, ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টি, ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনাগুলো বলতে পারত। আমি প্রায়ই লক্ষ করেছি যে অতীত নিয়ে এসব ভাষ্য কেন্দ্রভূত রয়েছে এই প্রশ্নের ওপর যে ওই প্রথম কাজটি কে করেছে? কারা প্রথম সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছিল : জায়নবাদীরা না আরবরা? কারা প্রথম ফিলিস্তিনের সম্ভাবনা দেশটিকে উন্নত করার সম্ভাবনা লক্ষ করেছিল? জেরুসালেমে প্রথমে কারা বাস করত : ইহুদিরা না ফিলিস্তিনিরা? গোলযোগপূর্ণ বর্তমান নিয়ে আলোচনা ওঠলেই ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি উভয় পক্ষই সহজাতভাবেই অতীতের দিকে ফিরে যায়, বিতর্ক চলে ব্রোঞ্জ যুগ থেকে মধ্য যুগ হয়ে বিশ শতকে। আবারো বলছি, ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিরা বেশ গর্বভরেই আমাকে তাদের নগরী দেখিয়েছিল, প্রতিটি স্মারক সৌধই সঙ্ঘাত সৃষ্টি করছিল।
জেরুসালেমে আমার প্রথম সকালে আমাকে আমার ইসরাইলি সহকর্মীরা দেখিয়ে দিয়েছিল অনেক নিচুতে থাকা বিশেষ ধরনের খাড়া প্রাপ্ত দেখে রাজা হেরডের ব্যবহার করা পাথরগুলো চেনা যায়। এসব পাথরই দৃশ্যপটে ইসলামের আগমনের অনেক অনেক আগে সেই খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে জেরুসালেমে ইহুদিদের অস্তিত্ব থাকার সর্বব্যাপী ও স্থায়ী প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পুরনো নগরীর নির্মাণকর্মীদের অতিক্রম করার সময় আমাকে বারবার বলা হয়েছে, উসমানিয়ারা তাদের শাসনকালে কত চরমভাবে নগরীটিকে অবহেলা করেছিল। ১৯ শতকে নগরীটি আবার প্রাণ ফিরে পায়। আর এর পেছনে অবদান ছিল প্রধানত ইহুদি বিনিয়োগের। এর প্রমাণ হলো স্যার মোজেজ মন্টেফিয়রের তৈরি উইন্ডমিল ও রথচাইল্ড পরিবারের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল। আর ইসরাইলের কারণেই নগরীটি এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ।
আমার ফিলিস্তিনি বন্ধুরা আমাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জেরুসালেম দেখিয়েছেন। তারা জেরুসালেমের প্রতি মুসলিমদের দায়বদ্ধতার প্রমাণ হিসেবে হারাম আল- শরিফের চমৎকারিত্ব, এবং এর চারধারে মামলুকদের নির্মিত নান্দনিক মাদরাসার দেখায়। তারা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে জেরুসালেমকে রক্ষার জন্য জেরিকোর কাছে নবী মুসার উপাসনালয়, কাছাকাছি নির্মিত উমাইয়া আমলের প্রাসাদগুলোও দেখায়। আমরা যখন একবার বেথলেহেম যাচ্ছিলাম, তখন আমার ফিলিস্তিনি মেজবান গাড়িটি রাস্তার পাশে অবস্থিত রাচেলের কবর দেখাতে থামালেন। তিনি আবেগপূর্ণভাবে বললেন, ফিলিস্তিনিরা কয়েক শত বছর ধরে এই ইহুদি উপাসনালয়ের পরিচর্যা করেছে। তাদের এই পূণ্য কাজের বিনিময়ে কেবল তিরষ্কার পেয়েছেন।
একটি কথা বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল। এমনকি চরম সেক্যুলার ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিরা পর্যন্ত উল্লেখ করছিল, জেরুসালেম তাদের জনসাধারণের কাছে ‘পবিত্র’। ফিলিস্তিনিরা নগরীটিকে বলে আল-কুদস বা ‘পবিত্র নগরী’। কিন্তু ইসরাইলিরা তাচ্ছিল্যভরে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলে, জেরুসালেম প্রথমে ইহুদিদের কাছেই পবিত্র নগরী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল, এটি মুসলিমদের কাছে মক্কা ও মদিনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়নি কখনোই। তাহলে এই প্রেক্ষাপটে ‘পবিত্র’ শব্দটির মানে কী? ভ্রমপ্রবণ মানুষে পরিপূর্ণ এবং সবচেয়ে অপবিত্র কর্মকাণ্ডে ভরপুর স্রেফ একটি নগরী কিভাবে পবিত্র হতে পারে: কেন ঘোষিত যুদ্ধংদেহি নাস্তিক ইহুদিরাও পবিত্র নগরী নিয়ে ভাবে, ওয়েস্টার্ন ওয়াল পুরোপুরি দখল করার ব্যাপারে এত আগ্রহী? অবিশ্বাসী কোনো আরব যখন মসজিদ আল-আকসায় প্রথমবারের মতো দাঁড়ায়, তখন কেন সে কান্নায় ভেঙে পড়ে? খ্রিস্টানদের কাছে নগরীটি কেন পবিত্র তা আমি আনায়াসেই দেখতে পারি। কারণ জেরুসালেমেই যিশুর মৃত্যু ও সমাধি থেকে উত্থান হয়েছিল : এই নগরী এই বিশ্বাসের জন্ম প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু ইহুদি ও ইসলাম উভয় ধর্মের গঠনমূলক ঘটনাগুলো ঘটেছে জেরুসালেম থেকে অনেক অনেক দূরে : সিনাই উপত্যকায় কিংবা আরবের হিজাজে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেখানে ঈশ্বর মুসাকে কিতাব দিলেন এবং ইসরাইলের সাথে তার চুক্তি করলেন সেই মাউন্ট সিনাইয়ের বদলে কেন জেরুসালেমের মাউন্ট জায়ন ইহুদিদের কাছে পবিত্র হলো? স্পষ্টভাবেই বলা যায়, এটি ধরে নেওয়া ভুল হবে যে পাপমোচন ইতিহাসের ঘটনাবলীর সাথে তথা মানুষের সাথে ঈশ্বরের যোগাযোগের পৌরাণিক ভাষ্যের সাথে সম্পৃক্ততার ওপর কোনো নগরীর পবিত্রতা নির্ভর করে। পবিত্র নগরী বলতে কী বোঝায় তা খুঁজতেই আমি এই বইটি লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আমি যা আবিষ্কার করেছি তা হলো, জেরুসালেমের সাথে ‘পবিত্র’ শব্দটি তেমন ভাবনা চিন্তা না করে অবাধে সংযুক্ত করা হলেও (স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নিয়ে), বাস্তবে বিষয়টি বেশ জটিল। তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রতিটিই যেসব ঐতিহ্য বিনির্মাণ করেছে, সেগুলোর মধ্যে ব্যাপক মিল রয়েছে। তাছাড়া, কোনো পবিত্র স্থান বা কোনো পবিত্র নগরীর প্রতি ভক্তি প্রায়-সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য। ধর্মের ইতিহাসবিদেরা বিশ্বাস করেন, সব সংস্কৃতিতেই এটি হলো বিশ্বাসের আদিতম প্রকাশ। লোকজন যেটিকে পবিত্র ভূগোল হিসেবে অভিহিত করে, বিশ্বের বৈজ্ঞানিক মানচিত্রে এর কিছুই করার নেই, বিষয়টি আসলে অন্তরের ব্যাপার। পার্থিব নগরী, উপবন, পর্বতমালা এই আধ্যাত্মিকতার নিদর্শনে পরিণত হয়। ‘ঈশ্বর’ বা অতিপ্রাকৃতিক দুনিয়া সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, এগুলো এতই প্রবলভাবে উপস্থিত থাকে যে মনে হয়, এটি মানুষের অনিবার্য প্রয়োজন পূরণের নিমিত্ত। নানা কারণে জেরুসালেম ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের পবিত্র ভূগোলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে নগরীটিকে দেখা খুবই কঠিন করে তুলেছে। কারণ ওই বিশ্বাস তাদের নিজেদের সম্পর্কে ধারণা এবং আমাদের নশ্বর দুনিয়াকে অর্থ ও মূল্য প্রদানকারী ‘ঈশ্বর’ বা ঐশী সত্তা হিসেবে অভিহিত চূড়ান্ত বাস্তবতাকে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে।
তিনটি পরস্পরভাবে সংযুক্ত ধারণা পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে বারবার আসবে। প্রথমটি হলো ঈশ্বর বা ঐশী সত্তা-সম্পর্কিত সামগ্রিক ধারণা। পাশ্চাত্য বিশ্বে আমরা ঈশ্বরকে মনুষ্যমূলক ও ব্যক্তিকভাবে দেখতে অভ্যস্ত হওয়ায় ঐশী-সম্পর্কিত পুরো ধারণাটি প্রায়ই অসংলগ্ন ও অবিশ্বাস্য হিসেবে আবির্ভূত হয়। ‘ঈশ্বর’ শব্দটিতে অতি সরলতা এবং তার’ নামে অনেক অগ্রহণযোগ্য কাজ হয় বলে অনেকের কাছে প্রত্যাখ্যাত। এ কারণে এর বদলে ‘ঐশী সত্তা’ পরিভাষাটির ব্যবহারই অনেক সহজ। বিশ্ব নিয়ে বিশ্লেষণের সময় মানুষ সবসময়ই অস্তিত্বের কেন্দ্রে থাকা অতিলৌকিক ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মুখে পড়ে। তারা মনে করে, পরিভাষাটি তাদের সাথে এবং প্রাকৃতিক বিশ্বের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তাদের মতে, পরিভাষাটি কেবল এখানেই সীমিত না থেকে আরো অনেক দূর ছাড়িয়ে যায়। আমরা তাকে ঈশ্বর, ব্রাহ্মণ বা নির্বাণ- যে নামেই ডাকি না কেন, অতিলৌকিকতা মানবজীবনেরই অংশবিশেষ। আমাদের ধর্মতাত্ত্বিক মতামত যা-ই হোক না কেন, আমরা সবাই এ ধরনের কিছু জিনিসের অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, কখনো সুন্দর কোনো কবিতা পড়ে, কখনো চমৎকার গান শুনে আমরা নিজেদের মধ্যে থেকেই ক্ষণিকের জন্য নিজেদের ছাড়িয়ে গেছি। আমরা এই অভিজ্ঞতা খুঁজে ফিরি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চার্চ বা সিনাগগ বা অন্য কোথাও এই অভিজ্ঞতা না পেলে অন্য স্থানে যাই। ঐশী সত্তার অভিজ্ঞতা লাভ করা যায় অনেকভাবে : ভয়, ভীতি, উদ্দীপনা, শান্তি, ভয়ঙ্কর কিছু ও নৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তা জেগে ওঠে। এটি আমাদের সম্পূর্ণভাবে আরো পূর্ণাঙ্গ, সম্প্রসারিত অভিজ্ঞতার প্রতিনিধিত্ব করে, আমাদেরকে পূর্ণাঙ্গ করে তোলে। এটি কেবল ‘চরম বা অতি অস্বাভাবিক’ শক্তিই নয়, এটি আমাদের নিজের ভেতরে অনেক গভীরে লুকিয়ে আছে। তবে নান্দনিক অভিজ্ঞতার মতো, ঐশী সত্তাকে অনুভব করার জন্যও পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। আমাদের আধুনিক সেক্যুলার সমাজে এটি সবসময় অগ্রাধিকার না পাওয়ায় অনেক অব্যবহৃত সামর্থ্যের মতো এটিও শুকিয়ে যায়। যেসব সমাজ অনেক বেশি ঐতিহ্যবাদী, সেখানে ঐশী সত্তাকে উপলব্ধি করার সামর্থ্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। সত্যিকার অর্থে, ঐশী অনুভূতি ছাড়া লোকজন অনেক সময়ই বেঁচে থাকাকেই মূল্যহীন মনে করে।
এর আংশিক কারণ হলো, মানুষ সবসময়ই দুনিয়াকে বেদনাপূর্ণ স্থান হিসেবে মনে করে। আমরা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মৃত্যু, বিলুপ্ত হওয়া, অপরদের অবিচার ও নৃশংসতার শিকার হই। ধর্মীয় অনুসন্ধানে সবসময়ই শুরু করা হয় এই ধারণা দিয়ে যে, কিছু একটা ভুল হচ্ছে। বৌদ্ধ এ কথাটিই বলেছিলেন ‘অস্তিত্বই অস্বাভাবিক বিষয়।’ আমাদের কষ্ট দেয়, এমন অভিন্ন আঘাত ছাড়াও আমরা সবাই ব্যক্তিগত মর্মপীড়ায় আক্রান্ত হই, যা অগুরুত্বপূর্ণ বিপর্যয় মনে হলেও পুরোপুরি বিধ্বস্ত করে দেয়। পরিত্যক্ত হওয়ার অনুভূতি যেমন ঘনিষ্ঠ স্বজনের মৃত্যু, বিবাহবিচ্ছেদ, বন্ধুত্বের অবসান কিংবা এমনকি প্রিয় বস্তুকে হারানোও অনেক সময় অপরিহার্য ও সার্বলৌকিক সঙ্কটের মতো অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। অনেক সময় এই ভেতরের রোগটি বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি হিসেবে প্রকট হয়ে ওঠে। মনে হয়, আমাদের জীবন থেকে কিছু হারিয়ে যাচ্ছে; অস্তিত্ব মনে হয় একেবারে তুচ্ছ বিষয়, অসম্পূর্ণ ব্যাপার। আমাদের মধ্যে এমন অপরিণত অনুভূতিও থাকে যে জীবনের কোনো মানেই নেই এবং মৃত্যুর মধ্যেই আমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে, এমনকি যদিও বিষয়টি যৌক্তিকভাবে বোঝাতে পারি না। হারানোর এই অনুভূতি বিভিন্নভাবে সামনে আসে। যমজ আত্মাবিষয়ক প্লেটোনিক ধারণা সৃষ্টি হয় এ নিয়ে। আমাদের মনে হতে থাকে, জন্মগ্রহণ করার মাধ্যমে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, হারানো স্বর্গের সার্বজনীন কল্পকথায় আমরা মজে থাকি। আগের শতকগুলোতে নারী- পুরুষেরা এই বেদনা থেকে মুক্তি পেতেই ধর্মের দিকে চলেছিল, ঐশী সত্তার মধ্যেই মুক্তির উপদান খুঁজেছে। পাশ্চাত্যে আজ লোকজন অনেক সময় মনোসমীক্ষণের আশ্রয় নিয়ে থাকে। এতে আরো বৈজ্ঞানিক অবয়বে আদি বিচ্ছিন্নতার এই অনুভূতি প্রকাশ করে। ফলে এটি গর্ভকালীন স্মৃতি এবং জন্মের বেদনাদায়ক কষ্টের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়। অবশ্য নিজেরাই এটিকে বেছে নিয়েছি। পবিত্র স্থানের প্রতি ভক্তি নিবেদনের কেন্দ্রে যা রয়েছে তা হলো আলাদা হওয়ার ও কারো সাথে পুনঃমিলনের আকাঙ্ক্ষা।
দ্বিতীয় যে ধারণাটি নিয়ে আমরা অবশ্যই আলোচনা করব, তা হলো মিথের প্রশ্নটি। লোকজন যখন ঐশী সত্তা নিয়ে বা মানব-অস্তিত্বের বেদনা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে, তারা তখন যৌক্তিক, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না, বরং তারা পৌরাণিক কাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করে। এমনকি আত্মা অনুসন্ধানের কথাকথিত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পথিকৃত হিসেবে পরিচিত ফ্রাউড ও জাঙ পর্যন্ত অন্তরাত্মার বিষয়াদি প্রকাশের চেষ্টার সময় ক্লাসিক্যাল জগতের মিথ বা ধর্মের দ্বারস্থ হয়েছেন। তারা আসলে তাদের নিজেদের মতো করে নতুন মিথ গড়ে নিয়েছেন। বর্তমান ‘মিথ’ শব্দটি আমাদের সংস্কৃতিতে মূল্য অনেক হারিয়ে ফেলেছে। অনেক সময়ই এটি সত্য নয়, এমন ঘটনা বোঝাতে এ পরিভাষা প্রয়োগ করা হয়। ‘স্রেফ’ মিথ বলেই ঘটনাগুলোকে খারিজ করে দেওয়া হয়। জেরুসালেম নিয়ে বিতর্কের ক্ষেত্রে বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই সত্য। ফিলিস্তিনিরা দাবি করে, রাজা দাউদের প্রতিষ্ঠিত ইহুদি রাজ্যের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই এবং সোলায়মানের টেম্পলের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ইসরাইল রাজ্যের উল্লেখ সমসাময়িক কোনো গ্রন্থে নেই, আছে কেবল বাইবেলে। ফলে এটি যে স্রেফ ‘মিথ’ তাই মনে হতে থাকে। ইসরাইলিরাও জেরুসালেমের হারাম আল-শরিফ থেকে নবী মুহাম্মদের (সা.) সপ্তম আসমানে যাওয়ার কাহিনী প্রত্যাখ্যান করে। তারা বলে এই কাহিনীর উৎস আল-কুদসের প্রতি মুসলিম ভক্তির মধ্যে নিহিত রয়েছে। তাদের মতে, মিরাজের কাহিনীর পুরোটাই নির্জলা মুর্খতা। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি, এখানে একটি বিষয় বিবেচনা করা না করার কারণেই এমনটি ঘটছে। সত্যিই ঘটেছে এমন ঐতিহাসিকভাবে সত্যায়িত ঘটনাগুলো বর্ণনা করার কোনো পরিকল্পনা পুরানতত্ত্বের কখনোই থাকে না। এটি হলো তাদের অন্তরাত্মাকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রকাশের প্রয়াস কিংবা জোরালো যুক্তিতে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, এমন বাস্তবতাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা। পুরানকে প্রাচীন কালের মনোস্তাত্ত্বিক বিষয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। কারণ অন্তরাত্মা এর মাধ্যমে নিজেকে বর্ণনা করে, যা খুবই রহস্যজনক হলেও আমাদের মোহাবিষ্ট করে। অর্থাৎ ‘ঐশী সত্তার ভূগোল’-এর মিথগুলো অন্তরাত্মা সম্পর্কে সত্য কথা বলে। এগুলো মানব বেদনা ও আকাঙ্ক্ষার অস্পষ্ট উৎসগুলো স্পর্শ করার মাধ্যমে অত্যন্ত শক্তিশালী আবেগকে প্রকাশ করে। ‘কেবল’ মিথ হওয়ার কারণেই জেরুসালেম- সম্পর্কিত কাহিনীগুলোকে খারিজ করে দেওয়া উচিত নয়। মিথ হওয়ার কারণেই এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৌরাণিক মর্যাদা লাভ করার কারণেই জেরুসালেম প্রশ্নটি বিস্ফোরক হয়েছে। বর্তমানে সঙ্ঘাতের উভয় পক্ষে থাকা লোকজনের ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রায়ই অধিকার ও সার্বভৌমত্ব, আবেগপূর্ণ কাহিনী থেকে দূরে গিয়ে যৌক্তিক হওয়ার আহ্বান জানানোর মধ্যে বিস্ময়কর কিছু নেই। যৌক্তিক হওয়া সম্ভব হলে খুবই ভালো হতো। কিন্তু আমরা পৌরাণিক কাহিনীর ঊর্ধ্বে ওঠতে পারব, এমন কথা বলা কখনো নিরাপদ হবে না। অতীতে লোকজন অনেকবারই ধর্ম থেকে কল্পকথাকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছে। উদাহরণ হিসেবে প্রাচীন ইসরাইলের নবী ও সংস্কারকদের কথা বলা যায়। তারা আদি কেনানবাসীর পৌরাণিক কাহিনী থেকে তাদের বিশ্বাসকে আলাদা করা নিয়ে চরমভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু তারা সফল হননি। কাব্বালাহর পুরাণতত্ত্বে পুরনো কাহিনী ও কিংবদন্তিগুলো আবারো শক্তিশালী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই প্রক্রিয়াকে ধর্মের আরো যৌক্তিক আকারের ওপর কল্পকথার চরম জয় হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। জেরুসালেমের ইতিহাসে আমরা দেখব, জীবন যখন বিশেষ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে, অধিকতর জানা দর্শনে কোনো ধরনের সান্ত্বনা না পায়, তখন লোকজন সহজাতভাবে কল্পকথার দিকে ছোটে। অনেক সময় বাইরের ঘটনাবলী লোকজনের মনের বাস্তবতাকে এত নিখুঁতভাবে প্রকাশ করে যে তারা সাথে সাথে তাতে পৌরাণিক মর্যাদা আরোপ করে, পৌরাণিক উদ্দীপনায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। এই ধরনের দুটি ঘটনা হলো চতুর্থ শতকে খ্রিস্টের কবর আবিষ্কার এবং ১৯৬৭ সালে ইসরাইলের জেরুসালেম জয়। উভয় ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট লোকজন মনে করেছিল যে তারা আদি ধারণা অনেক পেছনে ফেলে এসেছে, কিন্তু ঘটনার ফলাফল তাদের ওই বিশ্বাস গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। আমাদের নিজেদের শতকে ইহুদি ও ফিলিস্তিনি জনগণ এমনসব বিপর্যয়ে পড়েছে যে তাতে করে কল্পকথার পুনরাগমন না হওয়াটাই ছিল বিস্ময়কর। ভালো বা খারাপ যা-ই হোক না কেন, এ ধরনের আধ্যাত্মিকতায় আক্রান্ত লোকজনের আকাঙ্ক্ষা ও আচরণ বুঝতে চাইলে জেরুসালেমের পৌরাণিক বিবেচনা অপরিহার্য
জেরুসালেমের ইতিহাস শুরুর আগে আমাদেরকে শেষ যে পরিভাষাটি অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে তা হলো প্রতীকবাদ বা নির্দশনবাদ। আমাদের বৈজ্ঞানিকমনস্ক সমাজে স্বাভাবিকভাবেই এখন আর ছবি ও প্রতীকের পরিভাষায় চিন্তা করি না। আমরা চিন্তা করার অনেক বেশি যৌক্তিক ও এক বিষয় থেকে অন্যটিতে যাওয়ার পদ্ধতি বিকশিত করতে পেরেছি। বস্তুগত প্রপঞ্চ কাল্পনিকভাবে দেখার বদলে আমরা আবেগগত সবকিছু ঝেড়ে ফেলে জিনিসটির দিকেই পুরো মনোযোগ দেই। এটি পাশ্চাত্যের অনেকের কাছে ধর্মীয় অভিজ্ঞতা বদলে দিয়েছে, আমরা দেখতে পাব যে এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে ষোড়শ শতকে। আমাদের মধ্যে এ কথা বলার ঝোঁক সৃষ্টি হয়েছে, কোনো কিছু কেবলই একটি প্রতীক, এটিকে প্রতিনিধিত্বকারী আরো রহস্যজনক বাস্তবতা থেকে এটি অনিবার্যভাবেই আলাদা। অবশ্য প্রাক-আধুনিক বিশ্বে এমনটি ছিল না। প্রতীক বা নিদর্শন যে বিষয়টি দেখাতে চায়, সেটিকে বাস্তবতায় দেখানো হতো। এ কারণেই কোনো ধর্মীয় প্রতীক উপাসনকারীদেরকে কাছে পবিত্র এলাকার সাথে পরিচয় ঘটানোর ক্ষমতা থাকত। অতি ব্যতিক্রমধর্মী গুটিকতেক লোক ছাড়া ইতিহাসজুড়ে কখনো ঐশী সংস্পর্শ কখনো সরাসরি পাওয়া যায়নি। একে সবসময়ই সরাসরি না দেখে অন্য কিছুর মাধ্যমে অনুভূত হয়েছে। ফলে ঐশী সত্তাকে নারী বা পুরুষ যেভাবেই হোক না কেন মানবীয় অবয়বে দেখা হয়ে ঐশী অবতারে পরিণত হয়েছে। একে পবিত্র গ্রন্থে, আইনি বিধান কিংবা মতবাদেও দেখতে পাওয়া যায়। ঐশী সত্তার প্রাচীনতম ও সবচেয়ে সর্বব্যাপী প্রতীক হলো স্থান। লোকজন পর্বতমালা, উপবন, নগরী ও মন্দিরে ঐশী সত্তার অনুভূতি পেত। তারা যখন এসব স্থানে হাঁটত, তখন তাদের মনে হতো যে তারা ভিন্ন এক মাত্রায় প্রবেশ করেছে। তাদের এ মাত্রাটি আলাদা হলেও স্বাভাবিকভাবে যে বাহ্যিক জগতের সাথে তারা অভ্যস্ত তার সাথে এর মিল ছিল। ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের কাছে জেরুসালেম হলো এ ধরনের ঐশী প্ৰতীক!
এটি এমন কিছু নয়, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে। একবার কোনো স্থান কোনো না কোনোভাবে ঐশী সত্তার সংস্পর্শ পেয়ে গেলে এবং সেটি যদি লোকজনকে ঐশী সত্তায় প্রবেশের সুযোগ দিতে পারে বলে প্রমাণ করতে পারে, তবে উপাসকেরা এই সর্বোকৃষ্ট অনুভূতি পরিচর্যায় অন্যদের সহায়তার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিপুল পরিমাণে সৃষ্টিশীল শক্তি ব্যয় করে। আমরা দেখতে পাবো, মন্দির, চার্চ ও মসজিদের স্থাপত্য প্রতীকীভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হলো তীর্থযাত্রীর ঈশ্বরের কাছে পৌছানোর জন্য অন্তরাত্মাকে যে পথ পাড়ি দিতেই হবে, তার বিস্তারিত বিবরণ প্রায়ই তাতে থাকে। প্রার্থনা ও শাস্ত্রাচারও এই ঐশী স্থানের অনুভূতিকে উচ্চকিত করে। প্রটেস্ট্যান্ট পাশ্চাত্যে লোকজন প্রায়ই ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার প্রতি অবিশ্বাসের ঐতিহ্য লালন করে। তারা একে মনে করে বিভ্রান্ত করার ধর্মীয় চাতুরি। তবে সম্ভবত আরো বেশি নিখুঁত হবে উপাসনার স্তোতবাক্যকে থিয়েটারের আকারে বিবেচনা করা। এটি এমনকি পুরোপুরি সেক্যুলার প্রেক্ষাপটেও শক্তিশালী ঐশী অভিজ্ঞতার ব্যবস্থা করতে পারে। পাশ্চাত্যে নাটকের ধর্মীয় উৎস রয়েছে : তা দেখা যায় প্রাচীন গ্রিসের পবিত্র উৎসবে, চার্চে ইস্টার উদযাপনে, মধ্যযুগীয় ইউরোপের ক্যাথেড্রালে। কল্পকথাগুলো জেরুসালেম ও এর বিভিন্ন ধর্মস্থানগুলো অন্তরের অর্থ প্রকাশ করার ব্যবস্থাও।
এসব কল্পকথনের একটিকে পরলোকগত রোমানিয়ান-আমেরিকান বিশেষজ্ঞ মিরসিয়া ইলিয়াড শ্বাশত কল্পকথনের প্রত্যাবর্তন হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি প্রায় সব সংস্কৃতিতেই এটি দেখতে পেয়েছেন। এসব চিন্তার পদ্ধতিতে ধরে নেওয়া হয় যে এই দুনিয়ায় আমরা যেসব বস্তুর মুখোমুখি হই, তার ঠিক প্রতিরূপ ঐশী জগতে রয়ে গেছে। এই কল্পকথনকে এই অনুভূতি প্রকাশের প্রয়াস হিসেবে দেখা যেতে পারে যে এখানে এই দুনিয়ায় আমাদের জীবনটি আসলে অন্য কোথাও থাকা কোনো স্থানের পূর্ণাঙ্গ ও পরিতৃপ্ত অভিজ্ঞতা থেকে অনেকটাই অসম্পূর্ণ ও আলাদা। সব মানবীয় তৎপরতা ও দক্ষতাও ঐশী প্রতিকৃতি : ঈশ্বরদের তৎপরতার অনুকরণ করে লোকজন তাদের ঐশী জীবন লাভ করতে পারে। ঈশ্বরের এই অনুসরণ বর্তমানেও অনুসৃত হয়। লোকজন এখনো সাবাথে বিশ্রাম নেয়, চার্চে রুটি খায় ও মদ্য পান করে। এসব কাজের এমনিতে কোনো অর্থ নেই। কিন্তু তারা এ কারণে করে যে ঈশ্বরও একদিন এ কাজটি করেছিলেন। পবিত্র স্থানে শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানও ঈশ্বরদের অনুকরণের আরেকটি প্রতীকী উপায় ও অস্তিত্বের আরো পূর্ণাঙ্গ ও আরো বিপুল শক্তির প্রবেশের ব্যবস্থা। পবিত্র নগরীর মতবাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানেও স্বর্গে ঈশ্বরদের আবাসের প্রতিফলন ঘটে বলে মনে করা হয়। এতে কোনো একটি মন্দিরকে বিবেচনা করা হয় বিশেষ কোনো দেবতার স্বর্গীয় প্রাসাদের প্রতিকৃতি। এর স্বর্গীয় আদিরূপ নিখুঁতভাবে অনুকরণ করা সম্ভব হলে মন্দিরও হতে পারে দুনিয়ায় ঈশ্বরের বাড়ি।
যুক্তিবাদী আধুনিকতার স্বল্প আলোকে এ ধরনের কল্পকথনগুলো উদ্ভট মনে হতে পারে। কিন্তু এসব ধারণা প্রথমে কিছুতে পরিণত হয়, পরে বিশেষ ‘পবিত্র’ স্থানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। এগুলো হলো একটি অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করার প্রয়াস। ধর্মে, অভিজ্ঞতা সবসময়ই আসে ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার আগে। লোকজন প্রথমে অনুভব করে যে তারা কোনো উপবন কিংবা পর্বত চূড়ার ঐশী সত্তাকে অনুধাবন করতে পেরেছে। অনেক সময় স্থাপত্য, সঙ্গীত, প্রার্থনার (এগুলো তাদেরকে তাদের নিজেদের ছাড়িয়ে নিয়ে যায়) নান্দনিক অবয়বও ঐশী সত্তাকে অনুভব করতে সহায়তা করে। পরে এটিই তাদেরকে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। তারপর তারা এই অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে পৌরাণিকের কাব্যিক ভাষায় কিংবা পবিত্র ভূগোলের প্রতীকের মাধ্যমে। ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের জন্য ‘কাজ করতে পারে’ এমন স্থানগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে জেরুসালেম। কারণ এ স্থানটি তাদেরকে ঐশী সত্তার সামনে উপস্থিত করে।
এ নিয়ে আরেকটি মন্তব্য প্রয়োজনীয়। ধর্মচর্চার অনুশীলন শিল্পকলার অনুশীলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। ত্রুটিপূর্ণ ও মর্মান্তিক দুনিয়াকে শিল্পকলা ও ধর্ম উভয়টিই এক ধরনের চূড়ান্ত অনুভূতিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ধর্মে নৈতিক মাত্রা থাকতেই হয় বলে শিল্পকলার চেয়ে ধর্ম ভিন্ন জিনিস। ধর্মকে নৈতিক নান্দনিকতা হিসেবেও সম্ভবত অভিহিত করা যায়। ঐশী বা অতিলৌকিকতার সংস্পর্শ লাভই যথেষ্ট নয়। সংস্পর্শ অবশ্যই অন্যদের প্রতি আমাদের আচরণে মূর্ত হতে হবে। সব মহান ধর্মই জোর দিয়ে বলে, সত্যিকারের আধ্যাত্মিকতার পরীক্ষা হলো বাস্তব সহানুভূতি। বৌদ্ধ একবার বলেছিলেন যে আলোকসম্পাতের অভিজ্ঞতার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অবশ্যই পর্বতশীর্ষ ত্যাগ করে বাজারে যেতে হবে, সব জীবন্ত প্রাণীর প্রতি সমব্যথী হতে হবে। পবিত্র স্থানের আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। জেরুসালেম কান্টের জন্য বাস্তব দানশীলতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের গুরুত্ব পুরোপুরিই অপরিহার্য বিষয়। দুর্বল ও অরক্ষিতদের প্রতি ন্যায়বিচারপূর্ণ ও সমব্যথী না হলে নগরীটি পবিত্র হতে পারে না। কিন্তু দুঃখের কথা হলো, এই নৈতিক নির্দেশনা প্রায়ই এড়িয়ে যাওয়া হয়। সবচেয়ে জঘন্য কিছু নৃশংসতা ঘটেছে এখানে। আর তা হয়েছে ন্যায়বিচার ও দানশীলতার অভীষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনের আগে যখন লোকজন জেরুসালেমের বিশুদ্ধতা প্রয়োগ করেছে এবং এর মহা পবিত্রতায় প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা করেছে। এই সব মূলগত স্রোত জেরুসালেমের দীর্ঘ ও টালমাটাল ইতিহাসে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করেছে। জেরুসালেমের ভবিষ্যত নিয়ে বিধিবিধান প্রণয়নের উদ্দেশে এই গ্রন্থ লেখা হয়নি। তা করা হবে অসঙ্গত। এই বইতে স্রেফ এই চেষ্টাই করা হয়েছে যে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমরা যখন বলে, নগরীটি তাদের কাছে ‘পবিত্র’ তখন তারা আসলে কী বুঝাতে চায় এবং এই ধর্মগুলোর প্রতিটির কাছে রুসালেমের কিছু অর্থ সামনে নিয়ে আসা। নগরীতে কারা প্রথমে ছিল এবং এর ফলে কাদের এখানে থাকা উচিত, বিশেষ করে জেরুসালেমের উৎস গোলকধাঁধার মোড়া থাকার কারণে, তা ফয়সালা করার মতোই তা গুরুত্বপূর্ণ।
Leave a Reply