কৃষ্ণচরিত্র

কৃষ্ণচরিত্র*

বঙ্গদর্শনের দ্বিতীয় খণ্ডে মানস বিকাশের সমালোচনায় কথিত হইয়াছে যে, যেমন অন্যান্য ভৌতিক, আধ্যাত্মিক বা সামাজিক ব্যাপার নৈসর্গিক নিয়মের ফল, কাব্যও তদ্রূপ। দেশভেদে ও কালভেদে কাব্যের প্রকৃতিগত প্রভেদ জন্মে। ভারতীয় সমাজের যে অবস্থার উক্তি রামায়ণ, মহাভারত সে অবস্থার নহে; মহাভারত যে অবস্থার উক্তি, কালিদাসাদির কাব্য সে অবস্থার নহে। তথায় দেখান গিয়াছে যে বঙ্গীয় গীতিকাব্য, বঙ্গীয় সমাজের কোমল প্রকৃতি, নিশ্চেষ্টতা, এবং গৃহসুখনিরতির ফল অদ্য সেই কথা স্পষ্টীকরণে প্রবৃত্ত হইব।
বিদ্যাপতি, এবং তদনুবর্তী বৈষ্ণব কবিদিগের গীতের বিষয়, একমাত্র কৃষ্ণ ও রাধিকা। বিষয়ান্তর নাই। তজ্জন্য এই সকল কবিতা অনেক আধুনিক বাঙ্গালির অরুচিকর। তাহার কারণ এই যে, নায়িকা, কুমারী বা নায়কের শাস্ত্রানুসারে পরিণীতা পত্নী নহে, অন্যের পত্নী; অতএব সামান্য নায়কের সঙ্গে কুলটার প্রণয় হইলে যেমন অপবিত্র, অরুচিকর, এবং পাপে পঙ্কিল হয়, কৃষ্ণলীলাও তাঁহাদের বিবেচনায় তদ্রূপ—অতি কদর্য পাপের আধার। বিশেষ এ সকল কবিতা অনেক সময় অশ্লীল, এবং ইন্দ্রিয়ের পুষ্টিকর—অতএব ইহা সর্বথা পরিহার্য। যাঁহারা এইরূপ বিবেচনা করেন, তাঁহারা নিতান্ত অসারগ্রাহী। যদি কৃষ্ণলীলার এই ব্যাখ্যা হইত, তবে ভারতবর্ষে কৃষ্ণভক্তি এবং কৃষ্ণগীতি কখন এত কাল স্থায়ী হইত না। কেন না অপবিত্র কাব্য কখন স্থায়ী হয় না। এ বিষয়ের যাথার্থ্য নিরূপণ জন্য আমরা এই নিগূঢ় তত্ত্বের সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইব।

কৃষ্ণ যেমন আধুনিক বৈষ্ণব কবিদিগের নায়ক, সেইরূপ জয়দেবে, ও সেইরূপ শ্রীমদ্ভাগবতে। কিন্তু কৃষ্ণচরিত্রের আদি, শ্রীমদ্ভাগবতেও নহে। ইহার আদি মহাভারতে। জিজ্ঞাস্য এই যে, মহাভারতে যে কৃষ্ণচরিত্র দেখিতে পাই, শ্রীমদ্ভাগবতেও কি সেই কৃষ্ণের চরিত্র? জয়দেবেও কি তাই? এবং বিদ্যাপতিতেও কি তাই? চারি জন গ্রন্থকারই কৃষ্ণকে ঐশিক অবতার বলিয়া স্বীকার করেন, কিন্তু চারি জনেই কি এক প্রকার সে ঐশিক চরিত্র চিত্রিত করিয়াছেন? যদি না করিয়া থাকেন, তবে প্রভেদ কি? যাহা প্রভেদ বলিয়া দেখা যায়, তাহার কি কিছু কারণ নির্দেশ করা যাইতে পারে? সে প্রভেদের সঙ্গে, সামাজিক অবস্থার কি কিছু সম্বন্ধ আছে?

প্রথমে বক্তব্য, প্রভেদ থাকিলেই তাহা যে সামাজিক অবস্থাভেদের ফল, আর কিছু নহে, ইহা বিবেচনা করা অকর্তব্য। কাব্যে কাব্যে প্রভেদ নানাপ্রকারে ঘটে। যিনি কবিতা লিখেন, তিনি, জাতীয় চরিত্রের অধীন; সামাজিক বলের অধীন; এবং আত্মস্বভাবের অধীন। তিনটিই তাঁহার কাব্যে ব্যক্ত হইবে। ভারতবর্ষীয় কবি মাত্রেরই কতকগুলিন বিশেষ দোষ গুণ আছে যাহা ইউরোপীয় বা পারসিক ইত্যাদি জাতীয় কবির কাব্যে অপ্রাপ্য। সেগুলি তাঁহাদিগের জাতীয় দোষ গুণ। প্রাচীন কবি মাত্রেরই কতকগুলি দোষ গুণ আছে, যাহা আধুনিক কবিতে অপ্রাপ্য। সেইগুলি তাঁহাদিগের সাময়িক লক্ষণ। আর কবি মাত্রের শক্তির তারতম্য এবং বৈচিত্র্য আছে। সেগুলি তাঁহাদিগের নিজগুণ।

অতএব, কাব্যবৈচিত্র্যের তিনটি কারণ—জাতীয়তা, সাময়িকতা, এবং স্বাতন্ত্র্য। যদি চারি জন কবি কর্তৃক গীত কৃষ্ণচরিত্রে প্রভেদ পাওয়া যায়, তবে সে প্রভেদের কারণ তিন প্রকারই থাকিবার সম্ভাবনা। বঙ্গবাসী জয়দেবের সঙ্গে মহাভারতকার বা শ্রীমদ্ভাগবতকারের জাতীয়তাজনিত পার্থক্য থাকিবারই সম্ভাবনা; তুলসীদাসে এবং কৃত্তিবাসে আছে। আমরা জাতীয়তা এবং স্বাতন্ত্র্য পরিত্যাগ করিয়া, সাময়িকতার সঙ্গে এই চারিটি কৃষ্ণচরিত্রের কোন সম্বন্ধ আছে কি না ইহারই অনুসন্ধান করিব।

মহাভারত কোন্ সময়ে প্রণীত হইয়াছিল, তাহা এ পর্যন্ত নিরূপিত হয় নাই। নিরূপিত হওয়াও অতি কঠিন। মূল গ্রন্থ একজন প্রণীত বলিয়াই বোধ হয়, কিন্তু এক্ষণে যাহা মহাভারত বলিয়া প্রচলিত তাহার সকল অংশ কখন একজনের লিখিত নহে। যেমন একজন একটি অট্টালিকা নির্মাণ করিয়া গেলে, তাঁহার পরপুরুষেরা তাহাতে কেহ একটি নূতন কুঠারি, কেহ বা একটি নূতন বারেণ্ডা, কেহ বা একটি নূতন প্রাচীন নির্মাণ করিয়া, তাহার বৃদ্ধি করিয়া থাকেন, মহাভারতেও তাহাই ঘটিয়াছে। মূলগ্রন্থের ভিতর পরবর্তী লেখকেরা কোথাও কতকগুলি কবিতা, কোথাও একটি উপন্যাস, কোথাও একটি পর্বাধ্যায় সন্নিবেশিত করিয়া বহু সরিতের জলে পুষ্ট সমুদ্রবৎ বিপুল কলেবর করিয়া তুলিয়াছেন। কোন্ ভাগ আদি গ্রন্থের অংশ, কোন্ ভাগ আধুনিক সংযোগ, তাহা সর্বত্র নিরূপণ করা অসাধ্য। অতএব আদি গ্রন্থের বয়ঃক্রম নিরূপণ অসাধ্য। তবে উহা যে শ্রীমদ্ভাগবতের পূর্বগামী ইহা বোধ হয় সুশিক্ষিত কেহই অস্বীকার করিবেন না। যদি অন্য প্রমাণ নাও থাকে, তবে কেবল রচনাপ্রণালী দেখিলে বুঝিতে পারা যায়। ভাগবতের সংস্কৃত অপেক্ষাকৃত আধুনিক ; ভাগবতে কাব্যের গতি অপেক্ষাকৃত আধুনিক পথে।

অতএব প্রথম মহাভারত। মহাভারত খ্রীষ্টাব্দের অনেক পূর্বে প্রণীত হইয়াছিল, ইহাও অনুভবে বুঝা যায়। মহাভারতে পড়িয়া বোধ হয়, ভারতবর্ষীয়দিগের দ্বিতীয়াবস্থা, অথবা তৃতীয়াবস্থা ইহাতে পরিচিত হইয়াছে। তখন দ্বাপর, সত্য যুগ আর নাই। যখন সরস্বতী ও দৃষদ্বতী তীরে, নবাগত আর্য বংশ, সরল গ্রাম্য ধর্ম রক্ষা করিয়া, দস্যুভয়ে আকাশ, ভাস্কর, মরুতাদি ভৌতিক শক্তিকে আত্মরক্ষার্থ আহ্বান করিয়া, অপেয় সোমরস পানকে জীবের সার সুখজ্ঞান করিয়া আর্য জীবন নির্বাহ করিতেন, সে সত্য যুগ আর নাই। দ্বিতীয়াবস্থাও নাই। যখন আর্যগণ সংখ্যায় পরিবর্ধিত হইয়া, বহু যুদ্ধে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করিয়া দস্যুজয়ে প্রবৃত্ত, সে ত্রেতা আর নাই। যখন আর্যগণ, বাহুবলে বহু দেশ অধিকৃত করিয়া শিল্পাদির উন্নতি করিয়া, প্রথম সভ্যতার সোপানে উঠিয়া, কাশী, অযোধ্যা, মিথিলাদি নগর সংস্থাপিত করিতেছেন, সে ত্রেতা আর নাই। যখন আর্যহৃদয়ক্ষেত্রে নূতন জ্ঞানের অঙ্কুর দেখা দিতেছে, সে ত্রেতা আর নাই। এক্ষণে দস্যু জাতি বিজিত, পদানত, দেশপ্রান্তবাসী শূদ্র, ভারতবর্ষ আর্যগণের করস্থ, আয়ত্ত, ভোগ্য, এবং মহাসমৃদ্ধিশালী। তখন আর্যগণ বাহ্য শত্রুর ভয় হইতে নিশ্চিন্ত, আভ্যন্তরিক সমৃদ্ধি সম্পাদনে সচেষ্ট, হস্তগতা অনন্তরত্নপ্রসবিনী ভারতভূমি অংশীকরণে ব্যস্ত। যাহা সকলে জয় করিয়াছে তাহা কে ভোগ করিবে? এই প্রশ্নের ফল আভ্যন্তরিক বিবাদ। তখন আর্য পৌরুষ চরমে দাঁড়াইয়াছে। যে হলাহল বৃক্ষের ফলে, দুই সহস্র বৎসর পরে জয়চন্দ্র এবং পৃথ্বীরাজ পরস্পর বিবাদ করিয়া উভয়ে সাহাবুদ্দিনের করতলস্থ হইলেন, এই দ্বাপরে তাহার বীজ বপন হইয়াছে। এই দ্বাপরের কার্য মহাভারত। (১) **

এই মহাভারতীয় কৃষ্ণচরিত্রকাব্য সংসারে তুলনারহিত। যে ব্রজলীলা জয়দেব ও বিদ্যাপতির কাব্যের একমাত্র অবলম্বন, যাহা শ্রীমদ্ভাগবতেও অত্যন্ত পরিস্ফুট, ইহাতে তাহার সূচনাও নাই। ইহাতে শ্রীকৃষ্ণ অদ্বিতীয় রাজনীতিবিদ্—সাম্রাজ্যের গঠন বিশ্লেষণে বিধাতৃতুল্য কৃতকার্য—সেই জন্য ঈশ্বরাবতার বলিয়া কল্পিত। শ্রীকৃষ্ণ ঐশিক শক্তিধর বলিয়া কল্পিত, কিন্তু মহাভারতে ইনি অস্ত্রধারী নহেন, সামান্য জড় শক্তি বাহুবলে ইঁহার বল নহে ; উচ্চতর মানসিক বলই ইঁহার বল। যে অবধি ইনি মহাভারতে দেখা দিলেন, সেই অবধি এই মহতেতিহাসের মূল গ্রন্থি রজ্জু ইঁহার হাতে—প্রকাশ্যে কেবল পরামর্শদাতা—কৌশলে সর্বকর্তা। ইঁহার কেহ মর্ম বুঝিতে পারে না, কেহ অন্ত পায় না, সে অনন্ত চক্রে কেহ প্রবেশ করিতে পারে না। ইঁহার যেমন দক্ষতা তেমনই ধৈর্য। উভয়েই দেবতুল্য। পৃথিবীর বীরমণ্ডলী একত্রিত হইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত; যে ধনু ধরিতে জানে সেই কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিল; কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ, পাণ্ডবদিগের পরমাত্মীয় হইয়াও, কুরুক্ষেত্রে অস্ত্র ধরেন নাই। তিনি মানসিক শক্তি মূর্তিমান, বাহুবলের আশ্রয় লইবেন না। তাঁহার অভীষ্ট, পৃথিবীর রাজকুল ক্ষয় প্রাপ্ত হইয়া, একা পাণ্ডব পৃথিবীশ্বর থাকেন; স্বপক্ষ বিপক্ষ উভয়ের নিধন না হইলে তাহা ঘটে না; যিনি ঈশ্বরাবতার বলিয়া কল্পিত, তিনি স্বয়ং রণে প্রবৃত্ত হইলে, যে পক্ষাবলম্বন করিবেন, সেই পক্ষের সম্পূর্ণ রক্ষা সম্ভাবনা। কিন্তু তাহা তাঁহার উদ্দেশ্য নহে। কেবল পাণ্ডবদিগকে একেশ্বর করাও তাঁহার অভীষ্ট নহে। ভারতবর্ষের ঐক্য তাঁহার উদ্দেশ্য। ভারতবর্ষ তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত; খণ্ডে খণ্ডে এক একটি ক্ষুদ্র রাজা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজগণ পরস্পরকে আক্রমণ করিয়া পরস্পরকে ক্ষীণ করিত, ভারতবর্ষ অবিরত সমরানলে দগ্ধ হইতে থাকিত। শ্রীকৃষ্ণ বুঝিলেন যে, এই সসাগরা ভারত একচ্ছত্রাধীন না হইলে ভারতের শান্তি নাই; শান্তি ভিন্ন লোকের রক্ষা নাই; উন্নতি নাই। অতএব এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরস্পরবিদ্বেষী রাজগণকে প্রথমে ধ্বংস করা কর্তব্য, তাহা হইলেই ভারতবর্ষ একায়ত্ত, শান্ত, এবং উন্নত হইবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাহারা পরস্পরের অস্ত্রে পরস্পরে নিহত হয়, ইহাই তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। ইহারই পৌরাণিক নাম পৃথিবীর ভারমোচন। শ্রীকৃষ্ণ, স্বয়ং যুদ্ধ করিয়া, এক পক্ষের রক্ষা চেষ্টা করিয়া, কেন সে উদ্দেশ্যের বিঘ্ন করিবেন? তিনি বিনা অস্ত্রধারণে, অর্জুনের রথে বসিয়া, ভারতরাজকুলের ধ্বংস সিদ্ধ করিলেন।

এইরূপ, মহাভারতীয় কৃষ্ণচরিত্র যতই আলোচনা করা যাইবে, ততই তাহাতে এই ক্রূরকর্মা দূরদর্শী রাজনীতিবিশারদের লক্ষণ সকল দেখা যাইবে। তাহাতে বিলাসপ্রিয়তার লেশ মাত্র নাই—গোপবালকের চিহ্ন মাত্র নাই।

এদিকে দর্শন শাস্ত্রের প্রাদুর্ভাব হইতেছিল। বৈদিক ও পৌরাণিক দেবগণের আরাধনা করিয়া আর মার্জিতবুদ্ধি আর্যগণ সন্তুষ্ট নহেন। তাঁহারা দেখিলেন যে, যে সকল ভিন্ন ভিন্ন নৈসর্গিক শক্তিকে তাঁহারা পৃথক পৃথক দেব কল্পনা করিয়া পূজা করিতেন, সকলেই এক মূল শক্তির ভিন্ন ভিন্ন বিকাশ মাত্র। জগৎকর্তা এক এবং অদ্বিতীয়। তখন ঈশ্বরতত্ত্ব নিরূপণ লইয়া মহাগোলযোগ উপস্থিত হইল। কেহ বলিলেন ঈশ্বর আছেন, কেহ বলিলেন নাই। কেহ বলিলেন ঈশ্বর এই জড় জগৎ হইতে পৃথক্, কেহ বলিলেন এই জড় জগৎই ঈশ্বর। তখন, নানা জনের নানা মতে, লোকের মন অস্থির হইয়া উঠিল; কোন্ মতে বিশ্বাস করিবে? কাহার পূজা করিবে? কোন্ পদার্থে ভক্তি করিবে? দেবভক্তির জীবন নিশ্চয়তা—অনিশ্চয়তা জন্মিলে ভক্তি নষ্ট হয়। পুনঃ পুনঃ আন্দোলনে ভক্তিমূল ছিন্ন হইয়া গেল। অর্ধাধিক ভারতবর্ষ নিরীশ্বর বৌদ্ধমত অবলম্বন করিল। সনাতন ধর্ম মহাসঙ্কটে পতিত হইল। শতাব্দীর পর শতাব্দী এইরূপে কাটিয়া গেলে শ্রীমদ্ভাগবতকার সেই ধর্মের পুনরুদ্ধারে প্রবৃত্ত হইলেন। ইহাতে দ্বিতীয় কৃষ্ণচরিত্র প্রণীত হইল।

আচার্য টিণ্ডল এক স্থানে ঈশ্বর নিরূপণের কাঠিন্য সম্বন্ধে বলিয়াছেন যে, যে ব্যক্তি একাধারে উৎকৃষ্ট কবি, এবং উৎকৃষ্ট বৈজ্ঞানিক হইবে, সেই ঈশ্বর নিরূপণে সক্ষম হইবে। প্রথম শ্রেণীর বৈজ্ঞানিকতা এবং প্রথম শ্রেণীর কবিত্ব, একাধারে এ পর্যন্ত সন্নিবেশিত হয় নাই। এক ব্যক্তি নিউটন ও সেক্ষপীয়রের প্রকৃতি লইয়া এ পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করেন নাই। কিন্তু বৈজ্ঞানিক কবি কেহ না থাকুন, দার্শনিক কবি অনেক জন্মগ্রহণ করিয়াছেন—ঋগ্বেদের ঋষিগণ হইতে রাজকৃষ্ণবাবু পর্যন্ত ইহার দৃষ্টান্তের অভাব নাই। দার্শনিক কবিগণ আপনাদিগকে ঈশ্বর নিরূপণে সমর্থ বিবেচনা করেন। শ্রীমদ্ভাগবতকার দার্শনিক এবং শ্রীমদ্ভাগবতার কবি। তিনি দর্শনে ও কাব্যে মিলাইয়া, ধর্মের পুনরুদ্ধারে প্রবৃত্ত হইলেন। এবং এই ভূমণ্ডলে এরূপ দুরূহ ব্যাপারে যদি কেহ কৃতকার্য হইয়া থাকেন, তবে শাক্যসিংহ ও শ্রীমদ্ভাগবতকার হইয়াছেন।

দার্শনিকদিগের মতের মধ্যে একটি মত, পণ্ডিতের নিকট অতিশয় মনোহর। সাংখ্যকার, মানস রসায়নে জগৎকে বিশ্লিষ্ট করিয়া আত্মা এবং জড় জগতে ভাগ করিয়া ফেলিলেন। জগৎ দ্বৈপ্রকৃতিক—তাহাতে পুরুষ এবং প্রকৃতি বিদ্যমান। কথাটি অতি নিগূঢ়—বিশেষ গভীরার্থপূর্ণ। ইহা প্রাচীন দর্শন শাস্ত্রের শেষ সীমা। গ্রীক্ পণ্ডিতেরা বহুকষ্টে এই তত্ত্বের আভাসমাত্র পাইয়াছিলেন। অদ্যাপি ইউরোপীয় দার্শনিকেরা এই তত্ত্বের চতুঃপার্শ্বে অন্ধ মধুমক্ষিকার ন্যায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। কথাটির স্থূল মর্ম যাহা তাহা সাংখ্যদর্শন বিষয়ক প্রবন্ধে বুঝাইয়াছি। এই প্রকৃতি ও পুরুষ সাংখ্য মতানুসারে পরস্পরে আসক্ত, স্ফটিকপাত্রে জবাপুষ্পের প্রতিবিম্বের ন্যায়, প্রকৃতিতে পুরুষ সংযুক্ত, ইহাদিগের মধ্যে সম্বন্ধ বিচ্ছেদেই জীবের মুক্তি।

এই সকল দুরূহ তত্ত্ব দার্শনিকের মনোহর, কিন্তু সাধারণের বোধগম্য নহে। শ্রীমদ্ভাগবতকার ইহাকেই জনসাধারণের বোধগম্য, এবং জনসাধারণের মনোহর করিয়া সাজাইয়া, মৃত ধর্মে জীবন সঞ্চারের অভিপ্রায় করিলেন। মহাভারতে যে বীর ঈশ্বরাবতার বলিয়া লোকমণ্ডলে গৃহীত হইয়াছিলেন, তিনি তাঁহাকেই পুরুষ স্বরূপে স্বীয় কাব্যমধ্যে অবতীর্ণ করিলেন, এবং স্বকপোল হইতে গোপকন্যা রাধিকাকে সৃষ্ট করিয়া, প্রকৃতিস্থানীয় করিলেন। প্রকৃতি পুরুষের যে পরস্পরাসক্তি, বাল্যলীলায় তাহা দেখাইলেন; এবং তদুভয়ে যে সম্বন্ধে বিচ্ছেদ, জীবের মুক্তির জন্য কামনীয়, তাহাও দেখাইলেন। সাংখ্যের মতে ইহাদিগের মিলনই জীবের দুঃখের মূল—তাই কবি এই মিলনকে অস্বাভাবিক এবং অপবিত্র করিয়া সাজাইলেন। শ্রীমদ্ভাগবতের গূঢ় তাৎপর্য, আত্মার ইতিহাস—প্রথমে প্রকৃতির সহিত সংযোগ, পরে বিয়োগ, পরে মুক্তি।

জয়দেবপ্রণীত তৃতীয় কৃষ্ণচরিত্রে এই রূপক একেবারে অদৃশ্য। তখন আর্যজাতির জাতীয় জীবন দুর্বল হইয়া আসিয়াছে। রাজকীয় জীবন নিবিয়াছে—ধর্মের বার্ধক্য আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। উগ্রতেজস্বী, রাজনীতিবিশারদ আর্য বীরেরা বিলাসপ্রিয় এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণ হইয়াছেন। তীক্ষ্ণবুদ্ধি মার্জিতচিত্ত দার্শনিকের স্থানে অপরিণামদর্শী স্মার্ত এবং গৃহসুখবিমুগ্ধ কবি অবতীর্ণ হইয়াছেন। ভারত দুর্বল, নিশ্চেষ্ট, নিদ্রায় উন্মুখ, ভোগপরায়ণ। অস্ত্রের ঝঞ্ঝনার স্থানে রাজপুরী সকলে নূপুর নিক্কণ বাজিতেছে—বাহ্য এবং আভ্যন্তরিক জগতের নিগূঢ়তত্ত্বের আলোচনার পরিবর্তে কামিনীগণের ভাবভঙ্গীর নিগূঢ় তত্ত্বের আলোচনার ধূম পড়িয়া গিয়াছে। জয়দেব গোস্বামী এই সময়ের সামাজিক অবতার; গীতগোবিন্দ এই সমাজের উক্তি। অতএব গীতগোবিন্দের শ্রীকৃষ্ণ কেবল, বিলাসরসে রসিক কিশোর নায়ক। সেই কিশোর নায়কের মূর্তি, অপূর্ব মোহন মূর্তি; শব্দভাণ্ডারে যত সুকুমার কুসুম আছে, সকলগুলি বাছিয়া বাছিয়া চতুর গোস্বামী এই কিশোর কিশোরী রচিয়াছেন; আদিরসের ভাণ্ডারে যতগুলি স্নিগ্ধোজ্জ্বল রত্ন আছে, সকলগুলিতে ইহা সাজাইয়াছেন; কিন্তু যে মহা গৌরবের জ্যোতি মহাভারতে ও ভাগবতে কৃষ্ণচরিত্রের উপর নিঃসৃত হইয়াছিল, এখানে তাহা অন্তর্হিত হইয়াছে। ইন্দ্রিয়পরতার অন্ধকার ছায়া আসিয়া, প্রখর সুখতৃষাতপ্ত আর্য পাঠককে শীতল করিতেছে।

তার পর, বঙ্গদেশ যবনহস্তে পতিত হইল। পথিক যেমন বনে রত্ন কুড়াইয়া পায়, যবন সেইরূপ বঙ্গরাজ্য অনায়াসে কুড়াইয়া লইল। প্রথমে নাম মাত্র বঙ্গ দিল্লীর অধীন ছিল, পরে যবনশাসিত বঙ্গরাজ্য সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হইল। আবার বঙ্গদেশের কপালে ছিল যে জাতীয় জীবন কিঞ্চিৎ পুনরুদ্দীপ্ত হইবে। সেই পুনরুদ্দীপ্ত জীবন বলে, বঙ্গভূমি রঘুনাথ ও চৈতন্যদেব অবতীর্ণ হইলেন। বিদ্যাপতি তাঁহাদিগের পূর্বগামী,—পুনরুদ্দীপ্ত জাতীয় জীবনের প্রথম শিখা। তিনি জয়দেবপ্রণীত চিত্রখানি তুলিয়া লইলেন—তাহাতে নূতন রঙ্ ঢালিলেন। জয়দেব অপেক্ষা বিদ্যাপতির দৃষ্টি তেজস্বিনী—তিনি শ্রীকৃষ্ণকে কিশোরবয়স্ক বিলাসরত নায়কই দেখিলেন বটে, কিন্তু জয়দেব কেবল বাহ্য প্রকৃতি দেখিয়াছিলেন—বিদ্যাপতি অন্তঃপ্রকৃতি পর্যন্ত দেখিলেন। যাহা জয়দেবের চক্ষে কেবল ভোগ তৃষা বলিয়া প্রকটিত হইয়াছিল—বিদ্যাপতি তাহাতে অন্তঃপ্রকৃতির সম্বন্ধ দেখিলেন। জয়দেবের সময় সুখভোগের কাল, সমাজে দুঃখ ছিল না। বিদ্যাপতির সময় দুঃখের সময়। ধর্ম লুপ্ত, বিধর্মিগণ প্রভু, জাতীয় জীবন শিথিল, সবেমাত্র পুনরুদ্দীপ্ত হইতেছে—কবির চক্ষু ফুটিল। কবি, সেই দুঃখে, দুঃখ দেখাইয়া, দুঃখের গান গাইলেন। আমরা বঙ্গদর্শনের দ্বিতীয় খণ্ডে মানসবিকাশের সমালোচনা উপলক্ষে বিদ্যাপতি ও জয়দেবে প্রভেদ সবিস্তারে দেখাইয়াছি; সেই সকল কথার পুনরুক্তির প্রয়োজন নাই। এস্থলে, কেবল ইহাই বক্তব্য যে, সাময়িক প্রভেদ, এই প্রভেদের একটি কারণ। বিদ্যাপতির সময়ে, বঙ্গদেশে চৈতন্যদেবকৃত ধর্মের নবাভ্যুদয়ের, এবং রঘুনাথকৃত দর্শনের নবাভ্যুদয়ের পূর্বসূচনা হইতেছিল; বিদ্যাপতির কাব্যে সেই নবাভ্যুদয়ের সূচনা লক্ষিত হয়। তখন বাহ্য ছাড়িয়া আভ্যন্তরিকে দৃষ্টি পড়িয়াছে। সেই আভ্যন্তরিক দৃষ্টির ফল ধর্ম ও দর্শন শাস্ত্রের উন্নতি।

আমরা যে গ্রন্থকে উপলক্ষ করিয়া, এই কয়টি কথা বলিলাম, তৎসম্বন্ধে এক্ষণে কিছু বলা কর্তব্য। শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও শ্রীযুক্ত বাবু সারদাচরণ মিত্র “প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ” প্রকাশ করিতেছেন। যে দুই খণ্ড আমরা দেখিয়াছি, তাহাতে কেবল বিদ্যাপতির কয়েকটি গীত প্রকাশিত হইয়াছে। বিদ্যাপতি প্রভৃতি উৎকৃষ্ট প্রাচীন কবিদিগের উৎকৃষ্ট প্রাচীন কবিদিগের রচনা এক্ষণে অতি দুষ্প্রাপ্য। যাহাতে উহা পাওয়া যায়, তাহাতে এত ভেজাল মিশান যে, খাঁটি মাল বাছিয়া লইতে কাহারও প্রবৃত্তি হয় না। অক্ষয় বাবু ও সারদা বাবু উৎকৃষ্ট গীত সকল বাছিয়া শ্রেণীবদ্ধ করিয়া প্রকাশ করিতেছেন। বিদ্যাপতির রচনা পাঠ পক্ষে সাধারণ পাঠকের একটি প্রতিবন্ধক এই যে, তাঁহার ভাষা আধুনিক প্রচলিত বাঙ্গালা নহে—সাধারণ পাঠকের তাহা বুঝিতে বড় কষ্ট হয়। প্রকাশকেরা টীকায় দুরূহ শব্দ সকলের সদর্থ লিখিয়া সে প্রতিবন্ধকের অপনয়ন করিতেছেন। যে কার্যে ইঁহারা প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাহা গুরুতর, সুকঠিন, এবং নিতান্ত প্রয়োজনীয়। ইঁহারা সে কার্যের উপযুক্ত ব্যক্তি। উভয়েই কৃতবিদ্য এবং অক্ষয় বাবু সাহিত্যসমাজে সুপরিচিত। তিনি কাব্যের সুপরীক্ষক, তাঁহার রুচি সুমার্জিত, এবং তিনি বিদ্যাপতির কাব্যের মর্মজ্ঞ। দুরূহ শব্দ সকলের ইঁহারা যে প্রকার সদর্থ করিয়াছেন, তাহাতে আমরা বিশেষ সাধুবাদ করিতে পারি। ভরসা করি, পাঠকসমাজ ইঁহাদিগের উপযুক্ত সহায়তা করিবেন।

—‘বঙ্গদর্শন’, চৈত্র ১২৮১, পৃ. ৫৪৭-৫৪।

—————————
* প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ। শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার কর্তৃক সম্পাদিত। চুঁচুড়া-সাধারণী যন্ত্র।
** পাঠক বুঝিতে পারিবেন যে কতিপয় শতাব্দীকে এখানে “যুগ” বলা হইতেছে।