২য় খণ্ড – আসামীর লিখিত

দ্বিতীয় খণ্ড।
(আসামীর লিখিত।)

প্রথম পরিচ্ছেদ।

কেন খুন করিলাম? লোকে আমাকে খুনী মনে করে, এ আমি ইচ্ছা করি না। তাই এ হাজতে আমার জীবনের কয়েকটি কথা লিখিয়া রাখিয়া যাওয়া নিতান্ত আবশ্যক মনে করিয়াছি, এবং সেই জন্য লিখিতেছি।

ছেলেবেলা হইতেই আমার মা বাপ নাই। তাহাদের কথা এখন একেবারেই আমার মনে পড়ে না। শুনিয়াছি, আমি যখন মাতৃগর্ভে তখন আমার পিতার মৃত্যু হয়। সেই শশাকে আমার মা পীড়িত হন। আমার বয়স এক বৎসর হইতে না হইতে তিনিও আমাকে ছাড়িয়া পিতার সহিত মিলিতে স্বর্গে যান।

গুণবন্ত রাও নামে পিতার একজন বন্ধু ছিলেন। তিনিই অনুগ্রহ করিয়া আমায় লালন-পালন করিতে থাকেন। আমার মৃত্যু হইল, তাঁহার ও তাহার গুণবতী জননীর যত্নে আমি দিন-দিন বড় হইতে লাগিলাম।

নাসিকের নিকট সাতগাঁও নামে গ্রামে গুণবন্ত রাও বাস করি তেন। তিনি মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ছিলেন, কিছু জমীজারাত ছিল, তাহাই চাষবাস করিয়া তাহার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চলিত। তিনি দুরাত্মা সর্দার বালকিষণ রাওএর প্রজা ছিলেন। যখনকার কথা বলিতেছি, তখন বালকিষণ জমীদার হয় নাই, তাহার পিতা জমীদার ছিলেন।

যখন আমার বয়স পাঁচ বৎসর, তখন গুণবন্ত রাও বিবাহ করেন। দুই-তিন বৎসর পরে তাহার এক কন্যা হয়, তিনি এই কন্যার নাম রাখিয়াছিলেন, চন্দন বাঈ। চন্দন বাঈ ও আমি ভ্রাতা-ভগিনীর ন্যায় এক সঙ্গে লালিতপালিত হইয়াছিলাম। বলা অধিক, যে আমি প্রাণ অপেক্ষাও চন্দনকে ভালবাসিতাম।

যখন তাহার বয়স বার বৎসর, তখন মহা সমারোহে গুণবন্ত রাও আমার সহিত চন্দনের বিবাহ দিলেন। আমার সুখের মাত্রা পূর্ণ হইল। আমি জানিতাম, আমার ন্যায় সুখী আর ত্রিজগতে কেহ ছিল না। কিন্তু আমার অদৃষ্টে যে এ দুর্দশা ঘটিবে, কে জানিত! আমার চন্দনের যে পরিণামে কি ঘটিবে, তাহা আমি তখন স্বপ্নেও ভাবি নাই। চার পাঁচ বৎসর আমরা বড়ই সুখে কাটাইলাম।

এই সময়ে আমাদের জমীদারের মৃত্যু হইল। পাপাত্মা বালকিষণ আমাদের সর্দার হইল। আমাদের পূর্বের সর্দার মহাত্মা লোক ছিলেন, তাঁহার দয়া-দাক্ষিণ্যের প্রশংসা সকলেই করিত; কিন্তু এই দুরাত্মার নিন্দা চারিদিকেই শীঘ্র বিকীর্ণ হইল। সকলেই বলিতে লাগিল, বালকিষণ মহা দুর্দান্ত,-অর্তি পাশব চরিত্র লম্পট,-দয়ামায়া তাহার হৃদয়ে একেবারেই নাই। সে নানা প্রকারে তাহার প্রজা দিগের উপর অত্যাচার করিতে লাগিল। তাহার অত্যাচারে অনেকেই ঘরবাড়ী ছাড়িয়া অন্যত্রে পলাইতে লাগিল।

কিন্তু এ পর্যন্ত সে আমাদিগের উপর কোন অত্যাচার করে নাই; আমাদের গ্রামবাসীর উপরও কোন অত্যাচার হয় নাই, কিন্তু আমাদের সুখের দিন শীঘ্রই শেষ হইয়া আসিল। আমরা দেখিলাম, অসংখ্য লোক জন আসিয়া আমাদের গ্রামের প্রান্তভাগে অনেক তাম্বু ফলিল। শুনিলাম, সদ্দার বালকিষণ রাও কাল আমাদের গ্রামে আসিবেন। তিনি নিকটস্থ বনে শিকার করিতে আসিতেছেন।

পর দিবস বালকিষণ বহু লোকজন সমভিব্যাহারে আসিল। দুই তিন দিন শিকার করিল, তাহার লোকজন গ্রামের লোকের উপর নানা রকমে অত্যাচার করিতে লাগিল। খাদ্যদ্রব্যাদি কাড়িয়া লইতে লাগিল, এমন কি ভদ্রলোককে ধরিয়া কুলীর কাজও করাইতে লাগিল। শুনিলাম, স্ত্রীলোকদিগের উপর অত্যাচার করিতে ত্রুটি করিল না। গ্রামবাসিগণ স্থানে স্থানে গোপনে সমবেত হইয়া নানা কথা কহিতে লাগিল, কিন্তু দুর্দান্ত সর্দারের বিরুদ্ধে কোন কথা কহিতে বা সরকার বাহাদুরের নিকট নালিশ করিতে কাহারও সাহস হইল না।

একদিন সর্দারের একজন লোক আসিয়া গুণবন্ত রাওকে সর্দারের নিকট ডাকিয়া লইয়া গেল। গুণবন্ত রাও অতি বিষঃচিত্তে ফিরিয়া আসিলেন। আমি তাহার বিষণ্ণতার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি কেবলমাত্র বলিলেন, না, কিছু নয়।

পরদিন সর্দারের নিকট হইতে তাহাকে ডাকিতে পুনঃ পুনঃ লোক আসিলে ও তিনি গেলেন না নানা অজুহত দেখাইয়া তাহাদিগকে বিদায় করিলেন। আমি তাহাকে আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, আপ নাকে সর্দার এমন করিয়া ডাকিয়া পাঠাইতেছেন কেন?

তিনি প্রথমে নানা কথা বলিয়া আমার কথা উড়াইবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু শেষে আমি নিতান্ত পীড়াপীড়ি করায় তিনি বলিলেন, আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিও না।

আমি প্রাণে বড় কষ্ট পাইলাম। গুণবন্ত রাও আমাকে পুত্র। নিৰ্বিশেষ ভালবাসিতেন, আমাকে কোন কথা কখনও গোপন করি তেন না,কিন্তু আজ অতি বিষণ্ণভাবে বলিলেন, তোমার সে কথা শুনিবার আবশ্যক নাই। আমি তাহার ভাব দেখিয়া আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিলাম না।

এদিকে গুণবন্ত রাও নানা ওজরে সর্দারের সহিত সাক্ষাৎ না করিলেও সর্দার তাহাকে ছাড়িল না। বৈকালে তাহার প্রধান অনুচর পাণ্ডুরাং আমাদের বাড়ী আসিল; গোপনে কথাবার্তার জন্য ও বন্ত রাওকে অন্য একটা ঘরে লইয়া গেল। আমি আর কৌতূহলবৃত্তি দমন করিতে পারিলাম না, সেই গৃহের দরজার পাশ্বে লুকাইত থাকিয়া তাহাদের কথা শুনিতে লাগিলাম।

পাণ্ডুরাং বলিতেছেন, সর্দারকে তুমি এখনও চিনিতে পার নাই। তিনি রাগ করিলে তোমার সর্বনাশ হবে। তার যা সখ হয়, তা কে খাতে পারে।

গুণবন্ত রাও কাতরভাবে বলিলেন, তিনি আমাদের জমীদার, তিনি আমাদের মা বাপ। তিনি অত্যাচার করিলে কার কাছে আমরা দাঁড়াব।

পাণ্ড রাং। ও সব বাজে কথা এখন ছেড়ে দাও। যত টাকা চাও দিতেছি। তোমার মেয়ে রাজ-রাণী হয়ে থাকবে।

গুণবন্ত। ও কথা মুখে আবেন না। মনে করুন দেখি, যদি আপনার মেয়ে হত ত কি করতেন? সে বিবাহিত, তার স্বামী আছে।

পাণ্ডরাং। ভাল কথায় না শোন, তোমারই সর্বনাশ। সহজে সম্মত হওমেয়ে রাজরাণী হবে—নতুবা তোমার মেয়েকে চাকরাণীর অধম হয়ে থাকতে হবে।

গুণবন্ত। সংসারে কি ভগবান নাই। গরিবের বন্ধু ভগবান। ইংরেজ রাজও আছে।

পাওরাং হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, ভাল কথা শুলে না, আজ রাত্রেই তোমার মেয়েকে জোর করে নিয়ে যাব, কোন্ বাবা রাখে দেখা যাবে?

আমি আর সহ্য করিতে পারিলাম না। একেবারে সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া সিংহ-বলে মহাপাপীকে আক্রমণ করিলাম। সে আশ্চর্যান্বিত ও স্তম্ভিত হইয়া গেল। আমি তাহাকে বারংবার পদাঘাতে একেবারে বাড়ীর বাহিরে আনিয়া ফেলিলাম। সে দুই একেবার বল প্রকাশের চেষ্টা করিল, কিন্তু আমি তখন একেবারে মরিয়া। আমি তাহাকে পদাঘাতের উপর পদাঘাতে আমাদের বাটির সম্মুখস্থ নর্দমায় ফেলিলাম। কতক্ষণ পরে সে একটু প্রকৃতস্থ হইয়া নর্দমা হইতে উঠিল। ধূলা ও কদ্দমে আপ্লুত হইয়া অতি কষ্টে খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে সর্দারের তাম্বুর দিকে চলিল; একবার আমার দিকে বিকটভাবে চাহিল, আমি তাহা গ্রাহ্য করিলাম না।

সে দৃষ্টির বহির্ভূত হইলে আমি বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইলাম। দেখিলাম, গুণবন্ত রাও, তাহার স্ত্রী ও কন্যাকে লইয়া ম্লানমুখে বসিয়া আছেন। সকলেই ব্যাকুল ও বিষ। আমাকে দেখিয়া কাতর ভাবে বলিলেন, ত্ৰিষক, ভাল কাজ করিলে না?

আমি বলিলাম, হাঁ, ব্যাটাকে একবারে প্রাণে না মানায় কাজটা ভালই হয় নাই বটে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

বহুক্ষণ আমরা কেহ কোন কথা কহিলাম না। শেষে আমার শঠাকুরাণী বলিলেন,এখন চুপ করে বসে থাকলে আমাদের চন্দনকে আমরা কেমন করে রক্ষা করব?

আমি বলিলাম, আমি কি মরিছি? আমার শরীরে কি এক বিন্দুও মারাঠী রক্ত নাই। প্রাণ থাকিতে আমার স্ত্রীর গায় হাত দেয় এমন সাহস কার?

গুণবন্ত রাও বলিলেন, বাবা, তুমি যে পরম সাহসী তা কে না স্বীকার করে? কিন্তু আমরা দুজন, দুজনে সর্দারের লোকের সঙ্গে কত ক্ষণ লড়তে পারি?

আমি। যতক্ষণ প্রাণ থাবে লড় ব।

গুণবন্ত। ও সব পাগলের কথা। আর আমাদের এ গ্রামে তিলাৰ্ক থাকা উচিত নয়। তারা এখনও যে কিছু করে নাই, সে কেবল ইংরেজ রাজের ভয়ে। অনেক রাত্রে যখন গ্রামের সকলে ঘুমাবে, তখনই আসবে।

আমি। আপনি কি করতে চান?

গুণবন্ত। এখনই পালিয়ে ইংরেজ রাজের নাসিক সহরে যাওয়া। এখন থেকে রেল ষ্টেশন দশ ক্রোশ, কোন রকমে ষ্টেশনে পৌঁছিতে পারলে আর কোন ভয় নাই।

আমার শাশুড়ী বলিলেন, তবে আর দেরী কর না।

কি করি, অগত্যা আমি ও পলাইতে স্বীকার করিলাম। তখনই আমরা সকলে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। গুণবন্ত রাও তাহার মূল্যবান্ দ্রব্যাদি বাধিয়া একটা পোটলা করিলেন। টাকা কড়ি আমরা সব কোমরে বাঁধিলাম, কিছু বিছানা-পত্রও সঙ্গে লইলাম।

পাছে কেহ জানিতে পারে বলিয়া আমরা গাড়ী বা মুটে কিছুই সংগ্রহ করিলাম না। চারিজনে আমরা নিজেদের দ্রব্যাদি কাধে করিয়া লইয়া যাওয়া স্থির করিলাম।

রওনা হইবার সমস্ত বন্দোবস্ত স্থির হইলে আমার স্ত্রী আমাকে এক পাশে ডাকিয়া লইয়া বলিল, বোধ হয়, আমাদের এই শেষ দেখা। আমার মনে নিচ্ছে যে, তোমায় আমায় স্বর্গে না গেলে আর দেখা হবে না।

আমি বলিলাম, চন্দন, তুমি বৃথা ভয় করছ। সদ্দার আমাদের কিছুই করতে পারবে না। নিশ্চয় জেন, আমার প্রাণ থাকতে তোমার গায়ে কেহ হাত দিতে পাবে না।

চলন। আমাদের সহায় ভগবান্।

আমি। একবার ষ্টেশনে পৌছিতে পারলে আমাদের কে কি করে?

চন্দন । যাই হউক, ভগবান্ করুন আমাদের আর কোন বিপদ আপদ না হয়; কিন্তু যদি কিছু ঘটে, তবে আমার একটা কথা তোমায় বল্বার আছে।

আমি। বল।

চন্দন। আমার মাথায় হাত দিয়ে বল যে, তার কথা রাখবে।

আমি। নিশ্চয় রাখব। কবে না তোমার কথা রেখেছি?

চন্দন নিজ বাম কর্ণ হইতে তাহার সোণার সুন্দর ইয়ারিং আনার হাতে দিয়া বলিল, এই ইয়ারিংটা যত্নে রেখ। আমার কথা পাছে তুমি ভুলে–

আমি বাধা দিয়া বলিলাম, এ কথা কখনও মুখে এনো না।

চন্দন। তা নয়, তবে এটা তোমার কাছে থাকলে আমার কথা তোমার মনে থাকবে।

আমি। আমি দিনরাত এই ইয়ারিং বুকে বুকে রাখব। চন্দন। আমাকে যদি এরা কোন গতিকে জোর করে তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যায়, তা হলে আমি আর বাঁচব না। আত্ম হত্যা কব। এই দেখ।

এই বলিয়া চন্দন নিজ বস্ত্র মধ্য হইতে একখানি শাণিত ছুরিক বাহির করিল। আমি কোন কথা কহিলাম না। চন্দন বলিল,প্রথমে পাপাত্মা দের উচিত দণ্ড দেবার চেষ্টা করব। তা যদি না পারি, নিজে মরব।

আমি বলিলাম, তুমি মারাঠী রমণী, তোমার যা করা কর্তব্য তাই করো।

চন্দন। হাঁ, করব। আমি তোমার অনুপযুক্ত নই। তাই বলছি এই একটা ইয়ারিং আমার কাণে থাল। যদি আমি ফিরে আসি ভালই; না হলে জাবে আমি আর এ জগতে নাই। যদি এই ইয়ারিং তোমার হাতে আসে, তবে বুঝবে আমি পাপীর উপযুক্ত দণ্ড দিয়ে মরেছি। আর যদি এ ইয়ারিং ফিরে না আসে, তবে বুঝবে পাপীর দণ্ড হয় নাই। প্রতিজ্ঞা কর—

আমি। কি প্রতিজ্ঞা, বল। চন্দন। ভগবানের নামে প্রতিজ্ঞা কর—

আমি। বল।

চন্দন। যেমন করে হয়,এই পাপাত্মাদের দণ্ড দেবে,—কেবল দণ্ড নয়—প্রাণদণ্ড।

আর চন্দন কথা কহিতে পারিল না। সে অন্যদিকে মুখ ফিরাইল। আমার সর্ব শরীরে শিরায় শিরায় অগ্নি ছুটিল। আমি বলিলাম, চন্দন, তুমি বৃথা ভয় পাচ্ছ। যদি যথার্থই কেহ তোমার উপর অত্যাচার করে, তবে জেন, এই তোমায় ছুয়ে ভগবানের কাছে শপথ করে বছি, তার রক্ত না দেখে—তার মৃতদেহ না দেখে আমি নিশ্চিন্ত হব না।

চন্দন। তা হলে চল, আর দেরী করে কাজ নাই। বাবা মা ব্যস্ত হয়েছেন।

আমরা বাহিরে আসিলাম। তখন রাত্রি প্রায় নয়টা। গ্রাম অতি নিস্তব্ধ, রাস্তায় লোকের চলা-ফেরা প্রায় বন্ধ হইয়াছে, কোনদিকে কোন শব্দ নাই, আমরা সুযোগ বুঝিয়া ধীরে ধীরে চারি জনে বাহির হইলাম। আমাদের তীক্ষ্ণধার দুইখানি তরবারি সুদৃঢ়ভাবে কোমরে বাঁধিয়া লইলাম।

কোনদিকে কেহ নাই দেখিয়া আমরা নিঃশব্দে আমাদের দ্রব্যাদি লইয়া অন্ধকারে বাহির হইয়া পড়িলাম। দ্রুতপদে ষ্টেশনের পথে রওনা হইলাম। আমার বোধ হইল, যেন কে একজন আমাদের বাড়ীর সম্মুখস্থ গাছের পাশে লুকাইয়া ছিল; আমাদিগকে দেখিয়া ধীরে ধীরে সরিয়া গেল। আমি এ কথা গুণবন্ত রাওকে তখনই বলিলাম।

তিনি বলিলেন,পাণ্ডুরাং যে রকম লোক তাতে সে অপমান জীবনে ভুল বার লোক নয়। বোধ হয়, আমরা কি করি না করি, দেখবার জন্য পাহারায় লোক রেখেছিল?

গুণবন্ত। বলতে পারি না, চল শীঘ্র যাওয়া যাক।

আমি। যদি আমাদের উপর অত্যাচার করতে আসে, তা হলে দু-দশটাকে আর ঘরে ফিরে যেতে হবে না।  

গুণবন্ত রাও কোন কথা কহিলেন না। আমিও আর কোন কথা না কহিয়া সত্বরপদে চলিলাম। দুইটী স্ত্রীলোক আমাদের সঙ্গে সঙ্গে উৰ্দ্ধশ্বাসে ছুটিল।

এইরূপে রাত্রি প্রায় বারটা পর্যন্ত আমরা চলিলাম। পথে কোনই বিপদ-আপদ ঘটিল না। তখন আমরা সকলে মনে ভাবিলাম যে, এখন আমরা সর্দারের হাত হইতে উদ্ধার হইয়াছি, আর কোন ভয় নাই। এতক্ষণ আমরা একরপ ছুটিতে ছুটিতে আসিতেছিলাম, এখন একটু ধীরে ধীরে চলিলাম। এতক্ষণ অন্ধকার ছিল, এখন জ্যোৎস্নায় চারিদিক বেশ পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে।

গুণবন্ত রাও বলিলেন, বোধ হয় আর ভয় নাই?

আমি বলিলাম, বেটারা কি এতদূর এসেও ধরবে?

আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী বলিলেন, আমাদের সহায় ভগবান আছেন।

আমি আমার স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিলাম। সে ঘাড় নাড়িল। আমি তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝিলাম, সে বলিতেছে, ভয় যায় নাই। বিপদ এখনও আছে।

আমি কি বলিব, কিরূপে তাহাকে প্রবুদ্ধ করিব? আমি কোন কথায়ই কহিতে পারিলাম না। সকলে নীরবে পথতিবাহিত করিতে লাগিলাম।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

আমরা আরও প্রায় এক ক্রোশ পথ চলিলাম, তখন প্রায় একটা বাজিল। এই সময়ে সহসা পথিপাশ্বত একটা ঝােপের মধ্যে একটা বিকট শব্দ হইল। আমরা চারিজনই স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলাম। অমনই প্রায় বিশ-পঁচিশজন লোক আসিয়া আমাদের ঘেরিয়া ফেলিল। আমি মুহূৰ্ত্ত মধ্যে তরবারি খুলিলাম; কিন্তু গুণবস্তু ও তরোয়াল খুলিবার সময়ই পাইলেন না; এক দুরাত্মা তাহার মস্তক লক্ষ্য করিয়া তরবারি তুলিল। আমি লম্ফ দিয়া তাহাকে রক্ষা করিতে অগ্রসর হইলাম, কিন্তু তাহার নিকট পৌছিবার পূর্বেই তাঁহার মস্তকে তরবারি পড়িল। আমি দেখিলাম যে আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী আসিয়া স্বামীর উপর পড়িলেন, তৎপরে উভয়েই ভূমিশায়ী হইলেন।

আমি আর কিছুই দেখিতে পাইলাম না। অমনই দশ-বারজনে আমাকে ঘেরিল। আমি তাহাদিগের পাঁচ-ছয়জনকে আহত করিলাম। তখন একবার দেখিলাম, পাষণ্ড পাণ্ডুরাং চন্দনের হাতমুখ বাঁধিয়া তাহাকে একটা ঘোড়ার উপর তুলিতেছে। আমি উন্মত্তের ন্যায় সেই দিকে ছুটিলাম। আমি এইরূপে একটু অসাবধান হইবামাত্র দুই তিন জনে আমাকে আঘাত করিল; আমি চারিদিকে যেন হাজার হাজার সূর্যের আলো দেখিলাম; তৎপরে বোধ হইল, যেন কে আমাকে ঘোর অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করিল। তাহার পর আমি—তাহার পর কি হইল আর জানি না।

যখন আমার জ্ঞান হইল, তখন আমি দেখিলাম, আমি রাস্তার পাশে একটা নর্দমায় পড়িয়া আছি। উঠিতে চেষ্টা করিলাম, পারিলাম না। তখন দেখিলাম, আমি গুরুতররূপে আহত হইয়াছি, অনেক রক্ত পড়ায় নিতান্ত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি। দেখিলাম, তখন বেশ বেলা। হইয়াছে, চারিদিকে খুব রৌদ্র।

এখানে থাকিলে বাঁচিব না, ভাবিয়া আমি কষ্টে রাস্তায় উঠিবার চেষ্টা পাইলাম, কিন্তু পারিলাম না, চীৎকার করিয়া আবার পড়িয়া গেলাম। এই সময়ে সেই রাস্তা দিয়া কতকগুলি চাষা যাইতেছিল, তাহারা আমার চীৎকার শুনিয়া তাড়াতাড়ি নর্দামার নিকট আসিল। আমি বাঁচিয়া আছি দেখিয়া তাহারা তিনচার জন নর্দামার মধ্যে। নামিল, এবং অনেক কষ্টে ধরাধরি করিয়া আমাকে উপরে তুলিল।

আমি দেখিলাম, গুণবন্ত রাও রক্তাক্ত কলেবরে রাস্তার উপর পড়িয়া আছেন। আরও দেখিলাম, আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী স্বামীকে রক্ষা করিতে গিয়া নিজেই হত হইয়াছেন। চন্দনের কোন চিহ্ন নাই। এই লোমহর্ষণ ব্যাপার দেখিয়া আমার মাথা ঘুরিয়া গেল, দারুণ মানসিক উত্তেজনায় আমার ক্ষতবিক্ষত দেহে আবার রক্ত ছুটিল, আবার আমি অবসন্ন হইয়া পড়িলাম, আবার আমার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইল। তাহার পর কি হইল, আমার স্মরণ নাই।

যখন আমার সংজ্ঞা হইল, তখন আমি যে কোথায় আছি, তাহা কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। ক্রমে বুঝিলাম, আমি হাসপাতালে। পরে জানিলাম, আমি নাসিকের হাসপাতালে আসিয়াছি,। কৃষকেরা পুলিশে সংবাদ দেওয়ায় তাহারা আমাকে জীবিত দেখিয়া হাসপাতালে পাঠাইয়াছিল।

আমি দিন-দিন আরােগ্য লাভ করিতে লাগিলাম। শুনিলাম। আমাদিগকে ডাকাতে আক্রমণ করিয়াছিল, ডাকাতগণ গুণবন্ত রাও ও তাহার স্ত্রীকে খুন করিয়া আমাকে অর্ধমৃত অবস্থায় রাখিয়া সমস্ত কাড়িয়া লইয়া পলাইয়াছে,এই বলিয়া পুলিশ রিপোর্ট করিয়াছে। চন্দন বাঈকে ডাকাতের লইয়া গিয়াছে,পুলিশ অনেক চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু এখনও ডাকাতদের কোন সন্ধানই করিতে পারে নাই।

কেবল আমিই জানিতাম যে, আমরা ডাকাত কর্তৃক আক্রান্ত হই নাই। সর্দার বালকিষণ ও পাণ্ডুরাংই চন্দন বাঈকে লইয়া গিয়াছে। কিন্তু এ কথা হাসপাতালের কাহাকেও বলা আমি যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করিলাম না।

প্রায় এক মাস হাসপাতালে পড়িয়া থাকিয়া আমি আরোগ্য লাভ করিলাম। পরে শরীরে বল পাইলে একদিন হাসপাতাল হইতে বাহির হইলাম। সর্দার ও পাণ্ডুরাংএর সন্ধান করা এবং তাহাদের সমুচিত দণ্ড দেওয়াই আমার তখন জীবনে একমাত্র কর্তব্য। চন্দন বাঙ্গ কি এখনও বাঁচিয়া আছে? শেষ দিন সে আমাকে যাহা যাহা বলিয়া গিয়াছিল,তাহা আমার হৃদয়-কন্দরে জ্বলন্ত অক্ষরে লিখিত ছিল। আমি বস্ত্রাভ্যন্তরে হাত দিয়া দেখিলাম তাহার সেই ইয়ারিং তখনও তথায় আছে। সেই ইয়ারিং স্পর্শ করায় আমার শিরায় শিরায় অগ্নি ছুটিল, আমি উন্মত্তের প্রায় হইলাম। আমি উন্মাদের ন্যায় সমস্ত দিন নাসিক সহরের রাজপথে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইলাম।

এইরূপে দুইদিন কাটিয়া গেল। এই দুইদিন আহার নিদ্রা আমার কিছুই ছিল না। তিন দিনের দিন শরীর একেবারে অবসন্ন হইয়া পড়িল; আমি গোদাবরীর তীরে একটা বাঁধা-ঘাটে ইয়া পড়িলাম। দেখিতে দেখিতে ঘুমাইয়া পড়িলাম। কতক্ষণ যে আমি নিদ্রিত ছিলাম—তাহা জানি না।

কে আমার মাথা ধরিয়া নাড়া দেওয়ায় আমার ঘুম ভাঙিয়া গেল আমি চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিলাম। দেখিলাম, আমাদের গ্রামের বৃদ্ধ গঙ্গাধর রাও,-গুণবন্ত রাওয়ের সঙ্গে ইহার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। ইনি আমাকে পুত্র নির্বিশেষে ভালবাসিতেন। তিনি বলিলেন, এখানে কেন, কবে হাসপাতাল থেকে বেরুলে?

আমি। এই তিন দিন হল?

গঙ্গা। কোথায় আছ?

আমি। কোথাও নয়। যাবার স্থান কোথায়?

গঙ্গা। এস, আগে তোমার কিছু খাওয়া আবশ্যক।

আমি দ্বিরুক্তি না করিয়া উঠিলাম। তিনি আমাকে একটা দোকানে লইয়া গিয়া আহার করাইলেন। আহার করিয়া আমি শরীরে বল পাইলাম, মনেও পূৰ্ব্ব-তেজ দেখা দিল। বলিলাম, আপনি সর্দার বালকিষণের কোন সংবাদ রাখেন?

তিনি বলিলেন, সব বলিতেছি,—সঙ্গে এস।

আমি তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। আমরা উভয়ে সহরের বাহিরে একটা নির্জন ভাঙ্গা মন্দিরের নিকট আসিলাম। তিনি বলিলেন, এখানে কেহ নাই,-বস। সব বলিতেছি।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

গঙ্গাধর রাও কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, চন্দন আর নাই।

তিনি ভাবিয়াছিলেন, এ সংবাদে আমি নিতান্তই বিচলিত হইব, কিন্তু আমি তাহা না হওয়ায় তিনি বরং একটু বিচলিত হইলেন। আমি বলিলাম, আমি তা জানি।

তিনি বলিলেন, কেমন করিয়া জানিলে?

আমি। চলন আমাকে বলে গিয়েছিল।

গঙ্গা। বলে গিয়েছিল?

আমি। হাঁ,—সে আত্মহত্যা কবে বলে গিয়েছিল।

গঙ্গা। হাঁ, সত্য-সত্যই সে আত্মহত্যা করেছে।

আমি। আপনি যা কিছু জানেন, সব বলুন। আমি কিছুমাত্র কাতর হব না।

গঙ্গা। চন্দন বাঈকে নিয়ে তারা সেইদিন সর্দারের বাড়ী চলে যায়, কিন্তু সর্দার বা পাণ্ডুরাং যায় না। পাছে হঠাৎ চলে গেলে, লোকে সন্দেহ করে, সেজন্য দুজনে আরও তিন চারি দিন গ্রামে ছিল।

আমি। লোকে বা তারা এ বিষয়ে কি বলেছিল, বলতে পারেন?

গঙ্গা। হাঁ, ডাকাতে যে তোমাদের মেরে চন্দনকে কেড়ে নিয়ে গেছে, এই সকলের বিশ্বাস। পুলিশও তদন্ত করে তাই রিপোর্ট করেছে। এখনও তারা ডাকাত খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আমি। আমি তাদের বলে দেব, এ ডাকাত কে।

গঙ্গা। কিছুই হবে না, বাপু। কে করেছে তা তারা বেশ জানে। সর্দার তাদের বেশ খাইয়েছে।

আমি। আচ্ছা, এর সাজা আর কেউ না দেয়, আমি নিজের হাতেই দেব।

গঙ্গা। গ্রামের লোকে আমাকে ভক্তি-সম্মান করে, বলে আমাকে হাত করবার জন্য তার পর দিন সর্দার আমাকে ডেকে পাঠিয়ে চারী দিতে চায়। চারী নিলে কোন-না-কোন সুযোগে আমি চন্দনকে উদ্ধার করতে পারব বলে আমি তার চারী নিতে স্বীকার করলেম।

আমি। ভালই করেছিলেন।

গঙ্গা। আমি সর্দারের সঙ্গে তার বাড়ী এলেম। পরদিন সর্দা রের রাগ রাগ ভাব দেখে ভাবলেম যে, একটা কিছু কাণ্ড হয়েছে। আমি গোপনে গোপনে সন্ধান করতে লাগলেম।

আমি। কি জানতে পারলেন?

গঙ্গা। জালেম—অনেক কষ্টে যদিও জানতে পেরেছিলাম, জালেম, যে সর্দার সেই রাত্রেই চন্দনের সঙ্গে দেখা করে, কিন্তু শীঘ্রই তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। চন্দন তার সম্মুখেই নিজের বুকে নিজে চুরি বসিয়েছিল।

আমি। তা আমি জানি।

গঙ্গা। তার পর সেই রাত্রেই বালকিষণ ও পাণ্ডুরাং ধরাধরি করে চন্দনের মৃতদেহ বাড়ীর কাছে একটা জঙ্গলের মধ্যে কোথায় পুতে রেখে চলে আসে। বাড়ীর দুই-চারিজন দাস-দাসী ভিন্ন আর কেউ এ কথা জানে না।

আমি। ইয়ারিং।

গঙ্গা। ইয়ারিং কি?

আমি। ওঃ! আপনি তা জানেন না, আর শুনে কাজ নাই।

গঙ্গা। এখন কি করবে?

আমি। কৰ্তব্য—পাপীর দণ্ড।

গঙ্গা। পাপীর দণ্ড ভগবান দেবেন। এখন দেশে ফিরে যাও, ঘর-দরজা বিষয়-সম্পত্তি দেখবার কেউ নাই।

আমি। কার জন্য দেশে যাব? দেশে যাব না। পাপীর দণ্ড দিব। আপনি আমার একটা কাজ করবেন। আপনি আমাকে ছেলের মত ভালবাসেন, তাই বলি।

গঙ্গা। বল।

আমি। আমি ত্ৰিশখানা কাগজ আপনাকে দিব, আপনি কোন গতিকে এক-একখানা কাগজ এই পাপাত্মা সর্দারের বিছানায় রাত্রে রেখে দিতে পাবেন?

গঙ্গা। বোধ হয় পাব—চেষ্টা কব-কাগজ দেবার অর্থ কি?

আমি। কাগজে কিছু লিখে দিব। আমি এই পাপিষ্ঠকে কাপুরুষের মত সহসা খুন করে আমার হাত কলঙ্কিত করব না, সে ইচ্ছা আমার নাই। একমাস ওকে সময় দেব; দুজনে লড়ব, যে হয় একজন মরবে।

গঙ্গা। যদি না লড়তে চায়?

আমি। আমি বিষের বড়ী তয়েরী করতে জানি। একটা বিষ বড়ী আর একটা ঠিক সেই রকম দেখতে অবিষাক্ত বড় একটা কৌটায় রেখে তাকে যেটা ইচ্ছে বেছে নিয়ে খেতে বলব। অন্যটা আমিও খাব। হয় সে মরবে—না হয় আমি মরব।

গঙ্গা। যদি না খায়।

আমি। খাবে না! জোর করে খাওয়াব।

এই বলিয়া আমি লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। অমনি ঝর ঝর করিয়া আমার নাক মুখ দিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল; দেখিয়া গঙ্গাধর রাও ভীত ও স্তম্ভিত হইলেন। ছুটিয়া গিয়া নদী হইতে কাপড় ভিজাইয়া জল আনিয়া আমার নাকে মুখে মাথায় দিতে লাগিলেন। রক্ত বন্ধ হইল, আমিও প্রকৃতিস্থ হইয়া বসিলাম।

গঙ্গাধর রাও বলিলেন, তোমার শরীর এখনও ভাল হয় নাই। আমার কথা শোেন, দিন কত দেশে গিয়ে শরীর সুস্থ কর, তার পর যা হয় কয়রা।

আপনার সব কথা শুনব, কেবল ঐটা নয়।

তবে কি কবে?

সর্দার আর পাণ্ডুরাংএর সন্ধানে যাব।

তারা সব নাসিকে রয়েছে।

তা হলে ভালই হয়েছে, আর খুঁজতে যেতে হবে না।

কোথায় থাকবে মনে করেছ। আমার কাছে থাকলে ওরা আমাকে সন্দেহ করবে।

আমি একটা বাসা খুঁজে নেব।

টাকা কড়ি-কিছু সঙ্গে আছে?

কিছু না।

গঙ্গাধর রাও নিজ বন্ত্রের ভিতর হইতে কিছু টাকা বাহির করিয়া আমার হাতে দিলেন। বলিলেন, লও, এখন খরচ চালাও, পরে শোধ দিলেই চলবে।

আমার কাছে একটি পয়সাও ছিল না, সুতরাং আমি লইলাম। বলিলাম, আপনি দেশে চিঠী লিখে দিন, যেন তারাই আমার বিষয়-সম্পত্তি দেখ।

আচ্ছা তাই হবে। বোজ রাত্রি নটার সময় এখানে এলে আমার সঙ্গে দেখা হবে। যা হয় তা খবর দিব।

আমিও কাল আপনাকে কাগজ গুলো দিব। কোন গতিকে কেউ না টের পায়, বালকিষণের বিছানায় রেখে দিবেন।

তাই হবে।

তিনি বিদায় হইলেন। আমিও একটা বাসা ঠিক করিবার চেষ্টায় চলিলাম।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

নাসিকে বাসা পাওয়া শক্ত নয়। বাসা ঠিক করিয়া আমি কাগজ কলম দোয়াত কিনিলাম। পর দিন রাত্রে গঙ্গাধর রাওকে ত্রিশখানি কাগজ দিলাম। তাহাতে লিখিয়াছিলাম;–

বালকিষণ ও পাণ্ডুরাং!  

তোমাদের পাপের দণ্ড দিব। আজ হতে এক মাস সময় দিলাম। যদি সাহস থাকে, এক মাসের মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা কবে, হয় তোমরা মরবে, না হয় আমি মরব। আর যদি দেখা না কর, তবে কুকুর-শেয়ালের মত খুন করে মারব। আজ থেকে ত্রিশ দিন সময়।

পরের খানায় লিখিলাম,আজ থেকে ২৯ দিন সময়। তার পর ২৮ দিন সময়। ২৭ দিন সময়। এই রকম শিখানা। গঙ্গাধর কাগজগুলি লইয়া গেলেন। আমি বালকিষণ ও পাণ্ডুরাংএর সন্ধানে রহিলাম ।

দিনের পর দিন বালকিষণ আমার কাগজ পাইতে লাগিল। কোথা হইতে কে তাহার বিছানায় এই কাগজ রাখিয়া যায় জানিতে না পারিয়া, সে বড়ই ভীত হইয়া পড়িল, তাহার আহার নিদ্রা গেল। আমি এই সংবাদ পাইয়া প্রাণে বড়ই আনন্দ উপলব্ধি করিলাম।

সে টাকা দিয়া পুলিশকে হাত করিল। আমার বিরুদ্ধে নালিশ করিল। পুলিশ একদিন আমাকে ধরিল, আমিও পুলিশকে বলিলাম, সর্দার বালকিষণ আমার স্ত্রী ছিনাইয়া লইয়া গিয়াছে। পুলিশ আমার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিল, আমাকে বলিল, শীঘ্র এ সহর থেকে পালাও,না হলে জেলে দিব। আমি অগত্যা দিন কয়েক গা ঢাকা দিয়া রহিলাম। এই সময় হইতে ছদ্মবেশ ধরিতে আরম্ভ করিলাম। এ বিদ্যায় কতদূর পাকা হইয়াছি তা—গোবিন্দ বাবু তাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন।

আমার ভয়ে বালকিষণ ও পাণ্ডুরাং ক্রমে অস্থির হ উঠিল। ক্রমে যতই কাগজের দিন কম হইয়া আসিতে লাগিল, তত তাহার। উন্মত্তের ন্যায় হইল, শেষে দুজনে নাসিক ছাড়িয়া পন। কিন্তু পালাইবে কোথায়—পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত আন তাহাদের অনুসরণ করিতে প্রস্তুত।

আমি এ সংবাদ পাইয়া তাহাদের সঙ্গ লইলাম। তাহারা আমার। হাত এড়াইবার জন্য কলিকাতায় গেল, আমিও কলিকাতায় আসিলাম, নানারূপ ছদ্মবেশ ধরিয়া তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে রহিলাম, কিন্তু কিছুতেই তাহাদিগকে হাতে পাইলাম না।

তাহারা কলিকাতা হইতে কাশী, কাশী হইতে এলাহাবাদ, আগ্রা, দিল্লী হইয়া লাহোরে আসিল, আমিও সঙ্গে সঙ্গে আসিলাম। এক দিনের জন্য ও তাহাদের চক্ষের অন্তরাল হইতে দিলাম না।

লাহোরে আসিয়া তাহারা বাসা হইল । আমিও সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া তাহাদের বাসা দেখিলাম; কিন্তু লাহোরেও এই দুরাত্মার দণ্ড দিবার সুবিধা কিছুতেই পাইলাম না। এখানে আসিয়া তাহারা নিশ্চয় মনে করিয়াছিল যে,এ পর্যন্ত আর আমি তাহাদের সঙ্গ লই নাই। তাহারা আমার হাত এড়াইয়াছে। তাহারা এখানে আসিয়া ভারি সুখী হইল। বালকিষণ দিন রাত্রি প্রায় মাতাল হইয়া থাকিত।

তাহার যখনই বাহির হইত, তখনই গাড়ী করিয়া বাহির হইত, সুতরাং তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকা আমার পক্ষে বড়ই ক্লেশকর হইয়া উঠিল। গাড়ীর সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়, পাছে তাহারা আমার চোখের আড়াল হয়, এই ভাবিয়া আমি বড়ই চিন্তিত হইলাম। ভাবিয়া ভাবিয়া শেষে আমি একটা উপায় স্থির করিলাম।

একজন বড় এক্কাওয়ালার সঙ্গে দেখা করিলাম। তাহার অনেক একা ছিল। বন্দোবস্ত হইল, দিন হিসাবে এক টাকা লইয়া সে তাহার একা ও ঘোড় আমাকে ভাড়া দিবে। লোকে এক্কা লইয়া সমস্ত দিন ভাড়া খাটিয়া এক টাকার উপর যাহা পাইত লইত, এক টাকা তাহাকে দিত। আমিও এই বন্দোবস্তে তাহার নিকট হইতে একখানি একা লইলাম। তথন বালকিষণ ও পাণ্ডুরাংয়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকা আমার পক্ষে বড় সুবিধাজনক হইল।

আমি প্রায় এক্কা লইয়া তাহাদের বাসার নিকট ঘুরিতাম। এক দিন সন্ধ্যার সময় দেখি একখানা গাড়ী তাহাদের বাসার সম্মুখে দাঁড়াইল। তাহাদের জিনিষ-পত্র গাড়ীর ছাদে উঠিল। পরে বালকিষণ ও পাণ্ডুরাং গাড়ীতে আসিয়া বসিল। গাড়ী ষ্টেশনের দিকে চলিল, আমিও আমার একা ঐ গাড়ীর পিছনে পিছনে চালাইলাম।

তাহারা ষ্টেশনে আসিল, মুটেরা তাহাদের জিনিষ-পত্র নামাইয়া, কল। সামি মন একন এওয়ালাকে আমার এক্কা দেখিতে বলিয়া সত্বর তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে ষ্টেশনের ভিতর চলিলাম। পাণ্ডুরাং খবর লইয়া জানিল যে, তখনও গাড়ীর অনেক বিলম্ব আছে।

এই কথা শুনিয়া বালকিষণ তাহাকে বলিল, তবে তুমি এখানে অপেক্ষা কর, আমার একটা বিশেষ কাজ আছে, সেরে আসছি।

পাণ্ডুরাং ইহাতে আপত্তি করিল, কিন্তু বালকিষণ তখন বেশ মাতাল,-তাহাকে কুৎসিত গালি দিয়া উঠিল। পাণ্ডুরাং তাহার হাত ধরিতে গেলে সে তাহাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া ষ্টেশনের বাহিরে আসিল। আমি আমার এক্কায় উঠিবার আগেই সে সত্বর একখানা এক্কায় উঠিয়া হাঁকাইতে আজ্ঞা করিল। যো হুকুম বলিয়া এক্কাওয়ালা তাহার ঘোড়াকে সবলে চাবুক মারিল; ঘোড়া তীর বেগে ছুটিল। আমিও আমার এক্কা তাহার পশ্চাতে ছুটাইলাম।

বালকিষণের এক্কা পথে একটা মদের দোকানে থামিল। বালকিষণ নামিয়া গেল। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে সে টলিতে টলিতে আবার আসিয়া এক্কায় উঠিল—এক্কা চলিল। আমি দেখিলাম, এক্কা তাহাদের বাসার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। ভাড়া লইয়া এক্কাওয়ালা চলিয়া গেল। বালকিষণ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। আমি আমার একা লইয়া সেইখানে ঘুরিতে লাগিলাম।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

প্রায় আধঘণ্টা পরে সেই বাড়ীর ভিতর একটা গোলযোগের শব্দ পাই লাম। বুঝিলাম, দুই ব্যক্তিতে খুব মারামারি হইতেছে। পরে দেখি লাম, একব্যক্তি বালকিষকে গলা ধাক্কা দিতে দিতে সদর দরজার কাছে আনিল,-তৎপরে তাহার পিঠে সবলে এক পদাঘাত করিল, বালকিষণ রাস্তায় নিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল গেল, কিন্তু তখনই উঠিল। তখন সেই ব্যক্তি এক প্রকাণ্ড লাঠী লইয়া তাহাকে তাড়া করিল। বালকিষণ টলিতে টলিতে ছুটিল, নিকটে আমার একা দেখিয়া তাহাতে উঠিয়া বসিয়া বলিল, জদি হাঁকাও। আমিও বায়ুবেগে আমার এক্কা হাঁকাইলাম।

কিয়ৎক্ষণ পরে দেখিলাম, সে প্রায় নিদ্রিত হইয়াছে। এত দিন পরে পাপাত্মাকে হাতে পাইয়াছি ভাবিয়া, আমার প্রাণে যে কি আনন্দ হইল, তা বলা যায় না। আমি এই দুরাত্মাকে কোথায় গিয়া ইহার সমুচিত দণ্ড দিব, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম।

সহসা সেটী-মহল্লার খালি বাড়ীটা আমার সম্মুখে পড়িল। আমি এক্কা থামাইলাম। বাড়ীর দরজায় এক্কা দাড় করাইয়া এক্কা হইতে নামিলাম। বালকিষণকে ধাক্কা দিয়া তুলিলাম। সে বলিল, এটা ষ্টেশন?

আমি বলিলাম, হাঁ।

আমি তাহাকে ধরিয়া লইয়া সেই খালি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। সে বলিয়া উঠিল, কি বাবা, আজ আলো নাই কেন?

আমি বলিলাম, ভয় নাই,আলো জ্বলছি।

আমার পকেটে বাতি ও দেশলাই ছিল, আমি আলো জ্বালিলাম, তৎপরে তাহার মুখের উপর আলো ধরিয়া বলিলাম, বালকিষণ রাও, আমাকে চিনতে পার?

সে আমার স্বরে স্তম্ভিত হইল, বলিল,কে তুমি?

আমার তখন শিরায় শিরায় আগুন ছুটিয়াছে। আমি বলিলাম, আমি ত্রিম্বক রাও–চন্দন বাঈয়ের স্বামী। মনে পড়ে?

এই কথা শুনিয়া সে আমার দিকে বিস্ফারিত নয়নে চাহিল,–বোধ হইল, যেন এক নিমেষে তাহার সমস্ত নেশা ছুটিয়া গেল, তাহার সর্বাঙ্গ কপিতে লাগিল, সে অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে আমার দিকে চাহিয়া কম্পিতকণ্ঠে বলিল, মা তুমি—তবে কি আমাকে খুন কবে?

আমি বলিলাম, নিশ্চয়। তবে কুকুর শিয়ালের ন্যায় তোক মারব। যে কথা আগে তোকে বলেছিলাম, এখনও তাই বছি। এই কৌটায় দুটা বড়ী আছে, একটা বিষের বড়ী, খেলেই তৎক্ষণাৎ মৃত্যু আর একটায় বিষ নাই,খেলে কিছুই হবে না। তুমি একটা খাও,আমিও একটা খাব। দেখি ভগবানের রাজত্বে ন্যায় বিচার আছে কি না।

ভীতিবিহ্বল বালকিষণ যুক্ত করে বলিল,দয়া কর,ক্ষমা কর—এবার আমায় রক্ষা কর—প্রাণ ভিক্ষা দাও।

আমার সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ ছুটিতেছে, আমি বলিলাম, দয়-ক্ষমা তোকে দয়া-ক্ষম—কিছুতেই নয়,—অসম্ভব। গুণবন্ত রাওকে যখন খুন করেছিলি, তখন তোর দয়া কোথায় ছিল নরাধম! তার স্ত্রীকে যখন খুন করেছিলি, তখন তোর দয়া কোথায় ছিল পাষণ্ড?

বালকিষণ। আমি খুন করি নাই।

আমি। তোর হুকুমে যে কাজ হয়েছে, সে তোরই কাজ। আমার চন্দন বাঈকে যখন কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলি, তখন তোর দয়া কোথায় ছিল? দয়া! খা, এই বড়ী এখনি।

এই বলিয়া আমি আমার বস্ত্রের ভিতর হইতে এক শাণিত ছুরি বাহির করিয়া তাহার মাথার উপরে তুলিয়া ধরিয়া বলিলাম, বৃথা সময় নষ্ট আমি করি না,—খা বড়ী—যেটা ইচ্ছা হয় খা,-না হলে এই ছুরিতে কুকুর শিয়ালের মত তোকে মারব।

সে বংশপত্রের মত কাঁপিতে লাগিল। অবশেষে কম্পিত হস্তে কৌটা হইতে একটা বড়ী তুলিয়া লইয়া মুখে দিল,আমিও অন্যটা গিলিয়া ফেলিলাম। এক মিনিট খাইতে-না-খাইতে সে ভূমিসাৎ হইল, তাহার মুখ হইতে একটা কথাও বাহির হইল না। আমি তাহাকে নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিলাম, তার মৃত্যু হইয়াছে। এই উত্তে জনায় একদিন নাসিকে যেরূপ আমার নাক মুখ দিয়া রক্ত পড়িয়াছিল, আজও তেমনই হইল। রক্ত দেখিয়া আমার মনে একটা খেয়াল হইল। আমি তখনই আমার আঙ্গুল আমারই রক্তে ডুবাইয়া দেয়ালে লিখিলাম,–সাজা। কিন্তু এখন শুনিতেছি, সাজার আকার স্পষ্ট লিখিতে পারি নাই। তাড়াতাড়িতে কি লিখিলাম, ভাল করিয়া দেখি নাই।

তখন আমি সত্বর বাহিরে আসিয়া এক্কায় উঠিলাম। কিছু দূর আসিয়া কাপড়ের ভিতর হাত দিয়া দেখি, ইয়ারিংটি নাই। আমার চন্দনের ইয়ারিং, আজীবন যে ইহা আমি বুকে বুকে রাখিব তাহার নিকট প্রতিশ্রুত আছি! আমি একা ছাড়িয়া আবার সেই বাড়ীর দিকে চলিলাম। দেখি, বাড়ীতে তখন কনেষ্টবল আসিয়াছে, তাহারা আমাকে দেখিতে পাইয়াছে,তখন মাতালের ভাণ করিয়া মাতলামী করা তাহারা আমার দিকে আর দৃষ্টিপাত করিল না। আমি হতাশ হইয়া এক্কায় আসিয়া উঠিলাম।

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

তখন আমার সর্ব শরীরে বিদ্যুৎ ছুটিতেছিল। একজনের দণ্ড দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু এখনও পাপিষ্ঠ পাণ্ডুরাং বাকী। আমি সত্বর ষ্টেশনের দিকে চলিলাম। তথায় অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম যে, অনেকক্ষণ সে বালকিযণের জন্য অপেক্ষা করিয়া, সে আসিল না দেখিয়া মসাফের-থানায় গিয়া বাসা লইয়াছে। আমি তখনই মাফের-খানার দিকে চলিলাম।

তখন সেখানে সকলেই ঘুমাইয়াছিল। কেবল দেখিলাম, একটা ঘর হইতে আলো দেখা যাইতেছে। আমি সেই ঘরের জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম, পাণ্ডুয়াংই সেই ঘরে আছে। সে তখনও ঘুমায় নাই, একখানা বই লইয়া পড়িতেছে; আমার পায়ের শব্দে সে দরজার দিকে চাহিল। বোধ হয়, বালকিষণের প্রতীক্ষা করিতেছিল। তাহারই। ভাবনায় ঘুমাইতে পারে নাই।

আমি আস্তে আস্তে দরজায় হাত দিয়া দেখি, দরজা খোলা। আমি তিলার্ধ দেরী না করিয়া সত্বর তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া একেবারে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলাম। পাণ্ডুরাং লক্ষ দিয়া উঠিয়া বসিল। আমি বলিলাম, চেঁচাইও না, তা হলে কুকুর শিয়ালের ন্যায় মারিব। এই মাত্র বালকিষণকে খুন করে এসেছি।

পাওরাং চীৎকার করিতে যাইতে ছিল আমার কথায় সে ভয় পাইয়া নীরব রহিল। তাহার মুখ হইতে কোন শব্দ নির্গত হইল না, কেবল বলিল, মিথ্যা কথা।

আমি বলিলাম, মিথ্যা কথা আমি বলি না—সে অভ্যাসও আমার নাই। তোরও সময় উপস্থিত। কুকুর শিয়ালের মত মাব না, এই বড়ী বাছাই করে খা।

আমি বালকিষণকে যাহা বলিয়াছিলাম, ইহাকেও তাহা বলিলাম। তাহার দিকে বড়ীর কৌটাটা ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলাম; কিন্তু পর মুহূর্তেই পাণ্ডুরাং ক্ষিপ্ত কুকুরের ন্যায় আমার উপরে পড়িল। আমি পড়িয়া গেলাম, সে আমার উপরে পড়িল। সে এমনই বলে আমার গলা টিপিয়া ধরিল যে, আমার নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিল। আমি তখন অতি কষ্টে আমার কাপড়ের ভিতর হইতে আমার ছুরিখানা বাহির করিয়া তাহার হৃদয়ে আমূল বিদ্ধ করিলাম। যখন আমি ছুরি টানিয়া লইলাম, তখন সেই সঙ্গে পাণ্ডুরাংএরও প্রাণ বাহির হইয়া গেল। আমি তাহারই রক্তে দেয়ালে লিখিলাম, সাজা।

তাহার পর তাহারই লোটার জলে হাত ধুইয়া, তারই বিছানায় ছুরি পুছিয়া নিঃশব্দে সত্বর মোসাফের-খানা হইতে বাহির হইলাম। —তখন প্রায় ভোর হইয়াছে। লোকজন তখনও উঠে নাই। আমি আমার এক্কা লইয়া বাসায় আসিলাম।

পরদিন খুনের কথা সহময় রাষ্ট্র হইল, আমিও শুনিলাম। তখনই লাহোর ছাড়িয়া যাইবার ইচ্ছা হইল,—কিন্তু ভাবিলাম, পুলিশ চারিদিকে লোক রাখিয়াছে। এখন হঠাৎ আমি যদি লাহোর হইতে চলে যেতে চাই, তা হলে আমার উপরই তাদের সন্দেহ হবে। তাহার উপর ইয়ারিং ফেলে লাহোর ছাড়িয়া যাইতে আমার মন চাহিল না।

আবার ভাবিলাম, আমার বেঁচে থেকে লাভ কি? কিসের জন্য জীবনের মায়া! কাহার জন্য আর বাঁচিয়া থাকিব! কেন নিজেই পুলিশে গিয়ে সব কথা স্বীকার করি না? কিন্তু ফাঁসী—ফসীকাঠে ঝুলিয়া মরা, তাহা কখনই হইবে না।

এই সকল ভাবনায় আবার আমার নাক মুখ দিয়া অনর্গল রক্ত পড়িল। আমি নিজে স্পষ্ট বুঝিলাম যে, আমার জীবনের আর অধিক বিলম্ব নাই, সুতরাং ইচ্ছা করিয়া কেন পুলিশের হাতে যাই।

পরদিন কাগজে ডাক্তার বাবুর বিজ্ঞাপন দেখিয়া, বুড়ী সাজিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিলাম। বাহিরে আসিয়া দেখিলাম যে, আমার সে ইয়ারিং নয়। তখন আমি বুঝিতে পারিলাম যে, আমাকে ধরিবার চেষ্টা হইতেছে। কতকটা সন্দেহ হইল মাত্র; কিন্তু ভাবিলাম, বোধ হয় আর কেহ ইয়ারিং রাস্তায় ফেলে গিয়ে থাকবে। কারণ ডাক্তার বাবুর সঙ্গে পুলিশের সম্বন্ধ কি?

তাহার পর একটা ছোঁড়া আসিয়া আমাকে ভাড়ার জন্য ডাকিল। ভাড়ায় না গেলে পাছে কেহ সন্দেহ করে বলিয়া আমি এক্কা লইয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। তাহার পর যাহা যাহা হইয়াছে, আপনারা সকলই জানেন।

গোবিন্দ বাবু না হইলে পুলিশের সাধ্য ছিল না যে, আমাকে ধরে। আর দুচার দিন হইলে আমি দেশে ফিরিতে পারিতাম।

আবার সেই রক্ত,-হাত পা কঁপিতেছে, আমার সময় শেষ হইয়া আসিয়াছে,—রক্ত আর থামে না। আমি খুনী নই। ভগবান পাপীর দণ্ড দিয়াছেন,—আমার প্রতিহিংসা চরিতার্থ হইয়াছে। পাপীর সাজা হইয়াছে,-আমি এখন বড়ই সুখী। চলিলাম, স্বর্গে আমার চন্দনের সহিত মিলিতে চলিলাম। চন্দন–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *