রজনী – ২

দ্বিতীয় খণ্ড
অমরনাথের কথা

প্রথম পরিচ্ছেদ

আমার এই অসার জীবনের ক্ষুদ্র কাহিনী লিখিবার বিশেষ প্রয়োজন আছে। এ সংসারসাগরে, কোন চরে লাগিয়া আমার এই নৌকা ভাঙ্গিয়াছে, তাহা এই বিশ্বচিত্রে আমি আঁকিয়া রাখিব ; দেখিয়া নবীন নাবিকেরা সতর্ক হইতে পারিবে।
আমার নিবাস-অথবা পিত্রালয় শান্তিপুর-আমার বর্তমান বাসস্থানের কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। আমি সৎকায়স্থকুলোদ্ভূত, কিন্তু আমার পিতৃকুলে একটি গুরুতর কলঙ্ক ঘটিয়াছিল। আমার খুল্লতাতপত্নী কুলত্যাগিনী হইয়াছিলেন। আমার পিতার ভূসম্পত্তি যাহা ছিল-তদ্দ্বারা অন্য উপায় অবলম্বন না করিয়াও সংসারযাত্রা নির্বাহ করা যায়। লোকে তাঁহাকে ধনী বলিয়া গণনা করিত। তিনি আমার শিক্ষার্থ অনেক ধন ব্যয় করিয়াছিলেন। আমিও কিঞ্চিৎ লেখাপড়া শিখিয়াছিলাম-কিন্তু সে কথায় কাজ নাই। সর্পের মণি থাকে; আমারও বিদ্যা ছিল।
আমার বিবাহযোগ্য বয়স উপস্থিত হইলে আমার অনেক সম্বন্ধ আসিল-কিন্তু কোন সম্বন্ধই পিতার মনোমত হইল না। তাঁহার ইচ্ছা, কন্যা পরম সুন্দরী হইবে, কন্যার পিতা পরম ধনী হইবে এবং কৌলীন্যের নিয়ম সকল বজায় থাকিবে। কিন্তু এরূপ কোন সম্বন্ধ উপস্থিত হইল না। আসল কথা, আমাদিগের কুলকলঙ্ক শুনিয়া কোন বড় লোক আমাকে কন্যাদান করিতে ইচ্ছুক হয়েন নাই। এইরূপ সম্বন্ধ করিতে করিতে আমার পিতার পরলোকপ্রাপ্তি হইল।
পরিশেষে পিতার স্বর্গারোহণের পর আমার এক পিসী এক সম্বন্ধ উপস্থিত করিলেন। গঙ্গাপার, কালিকাপুর নামে এক গ্রাম ছিল। এই ইতিহাসে ভবানীনগর নামে অন্য গ্রামের নাম উত্থাপিত হইবে ; এই কালিকাপুর সেই ভবানীনগরের নিকটস্থ গ্রাম। আমার পিসীর শ্বশুরালয় সেই কালিকাপুরে। সেইখানে লবঙ্গ নামে কোন ভদ্রলোকের কন্যার সঙ্গে পিসী আমার সম্বন্ধ উপস্থিত করিলেন।
সম্বন্ধের পূর্বে আমি লবঙ্গকে সর্বদাই দেখিতে পাইতাম। আমার পিসীর বাড়ীতে আমি মধ্যে মধ্যে যাইতাম। লবঙ্গকে পিসীর বাড়ীতেও দেখিতাম-তাহার পিত্রালয়েও দেখিতাম। মধ্যে মধ্যে লবঙ্গকে শিশুবোধ হইতে “ক”য়ে করাত, “খ”য়ে খরা শিখাইতাম। যখন তাহার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ হইল, তখন হইতে সে আমার কাছে আর আসিত না। কিন্তু সেই সময়েই আমিও তাহারে দেখিবার জন্য অধিকতর উৎসুক হইয়া উঠিলাম। তখন লবঙ্গের বিবাহের বয়:ক্রম উত্তীর্ণ হইয়াছিল-লবঙ্গ কলিকা ফোট ফোট হইয়াছিল। চক্ষের চাহনি চঞ্চল অথচ ভীত হইয়া আসিয়াছিল-উচ্চ হাস্য মৃদু এবং ব্রীড়াযুক্ত হইয়া উঠিয়াছিল-দ্রুত গতি মন্থর হইয়া আসিতেছিল। আমি মনে করিতাম, এমন সৌন্দর্য তাদৃশ নহে। যৌবনে বসনভূষণের ঘটা, হাসি চাহনির ঘটা,-বেণীর দোলনি, বাহুর দোলনি, গ্রীবার হেলনি, কথার ছলনি-যুবতীর রূপের বিকাশ একপ্রকার দোকানদারি। আর আমরা যে চক্ষে সে সৌন্দর্য দেখি, তাহাও বিকৃত। যে সৌন্দর্যের উপভোগে ইন্দ্রিয়ের সহিত সম্বন্ধযুক্ত চিত্তভাবের সংস্পর্শ মাত্র নাই, সেই সৌন্দর্যই সৌন্দর্য।
এই সময়ে আমাদের কুলকলঙ্ক কন্যাকর্তার কর্ণে প্রবেশ করিল-সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া গেল। আমার হৃদয়পতত্রী সবে এই লবঙ্গলতায় বসিতেছিল-এমত সময় ভবানীনগরের রামসদয় মিত্র আসিয়া লবঙ্গলতা ছিঁড়িয়া লইয়া গেল। তাহার সঙ্গে লবঙ্গলতার বিবাহ হইল। লবঙ্গলাভে নিরাশ হইয়া আমি বড় ক্ষুণ্ণ হইলাম।
ইহার কয় বৎসর পরে এমন একটি ঘটনা ঘটিল যে, তাহা আমি বলিতে পারিতেছি না। পশ্চাৎ বলিব কিনা, তাহাও স্থির করিতে পারিতেছি না। সেই অবধি আমি গৃহত্যাগ করিলাম। সেই পর্যন্ত নানা দেশে ভ্রমণ করিয়া বেড়াই। কোথাও স্থায়ী হইতে পারি নাই।
কোথাও স্থায়ী হই নাই, কিন্তু মনে করিলেই স্থায়ী হইতে পারিতাম। মনে করিলে কুলীন ব্রাহ্মণের অপেক্ষা অধিক বিবাহ করিতে পারিতাম। আমার সব ছিল-ধন, সম্পদ, বয়স, বিদ্যা, বাহুবল-কিছুরই অভাব ছিল না; অদৃষ্টদোষে, একদিনের দুর্বুদ্ধিদোষে, সকল ত্যাগ করিয়া, আমি এই সুখময় গৃহ-এই উদ্যানতুল্য পুষ্পময় সংসার ত্যাগ করিয়া, বাত্যাতাড়িত পতঙ্গের মত দেশে দেশে বেড়াইলাম। আমি মনে করিলে আমার সেই জন্মভূমিতে রম্য গৃহ রম্য সজ্জায় সাজাইয়া, রঙ্গের পবনে সুখের নিশান উড়াইয়া দিয়া, হাসির বাণে দু:খরাক্ষসকে বধ করিতে পারিতাম। কিন্তু-
এখন তাই ভাবি, কেন করিলাম না। সুখদু:খের বিধান পরের হাতে, কিন্তু মন ত আমার। তরঙ্গে নৌকা ডুবিল বলিয়া, কেন ডুবিয়া রহিলাম-সাঁতার দিয়া ত কূল পাওয়া যায়। আর দু:খ-দু:খ কি? মনের অবস্থা, সে ত নিজের আয়ত্ত। সুখদু:খ পরের হাত, না আমার নিজের হাত? পর কেবল বহির্জগতের কর্তা-অন্তর্জগতে আমি একা কর্তা। আমার রাজ্য লইয়া আমি সুখী হইতে পারি না কেন? জড়জগৎ জগৎ, অন্তর্জগৎ কি জগৎ নয়? আপনার মন লইয়া কি থাকা যায় না? তোমার বাহ্য জগতে কয়টি সামগ্রী আছে, আমার অন্তরে কি বা নাই? আমার অন্তরে যাহা আছে, তাহা তোমার বাহ্য জগৎ দেখাইবে, সাধ্য কি? যে কুসুম এ মৃত্তিকায় ফুটে, যে বায়ু এ আকাশে বয়, যে চাঁদ এ গগনে উঠে, যে সাগর এ অন্ধকারে আপনি মাতে, তোমার বাহ্য জগতে তেমন কোথায়?
তবে কেন, সেই নিশীথকালে, সুষুপ্তা সুন্দরীর সৌন্দর্যপ্রভা-দূর হৌক! একদিন নিশীথকালে-এই অসীম পৃথিবী সহসা আমার চক্ষে শুষ্ক বদরীর মত ক্ষুদ্র হইয়া গেল-আমি লুকাইবার স্থান পাইলাম না। দেশে দেশে ফিরিলাম।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

কালের শীতল প্রলেপে সেই হৃদয়ক্ষত ক্রমে পূরিয়া উঠিতে লাগিল।
কাশীধামে গোবিন্দকান্ত দত্ত নামে কোন সচ্চরিত্র, অতি প্রাচীন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে আমার আলাপ হইল। ইনি বহুকাল হইতে কাশীবাস করিয়া আছেন।
একদা তাঁহার সঙ্গে কথোপকথনকালে পুলিসের অত্যাচারের কথা প্রসঙ্গক্রমে উত্থাপিত হইল। অনেকে পুলিসের অত্যাচারঘটিত অনেকগুলিন গল্প বলিলেন-দুই একটা বা সত্য, দুই একটা বক্তাদিগের কপোলকল্পিত! গোবিন্দকান্ত বাবু একটি গল্প বলিলেন, তাহার সারমর্ম এই।
“হরেকৃষ্ণ দাস নামে আমাদিগের গ্রামে একঘর দরিদ্র কায়স্থ ছিল। তাহার একটি কন্যা ভিন্ন অন্য সন্তান ছিল না। তাহার গৃহিণীর মৃত্যু হইয়াছিল, এবং সে নিজেও রুগ্ন। এজন্য সে কন্যাটি আপন শ্যালীপতিকে প্রতিপালন করিতে দিয়াছিল। তাহার কন্যাটি কতকগুলিন স্বর্ণালঙ্কার ছিল। লোভবশত: তাহা সে শ্যালীপতিকে দেয় নাই। কিন্তু যখন মৃত্যু উপস্থিত দেখিল, তখন সেই অলঙ্কারগুলি সে আমাকে ডাকিয়া আমার কাছে রাখিল-বলিল যে, ‘আমার কন্যার জ্ঞান হইলে তাহাকে দিবেন-এখন দিলে রাজচন্দ্র ইহা আত্মসাৎ করিবে |’ আমি স্বীকৃত হইলাম। পরে হরেকৃষ্ণের মৃত্যু হইলে সে লাওয়ারেশ মরিয়াছে বলিয়া, নন্দী-ভৃঙ্গী সঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেব দারোগা মহাশয় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হরেকৃষ্ণের ঘটী বাটী পাতর টুকনি লাওয়ারেশ মাল বলিয়া হস্তগত করিলেন। কেহ কেহ বলিল যে, হরেকৃষ্ণ লাওয়ারেশ নহে–কলিকাতায় তাহার কন্যা আছে। দারোগা মহাশয় তাহাকে কটু বলিয়া, আজ্ঞা করিলেন, ‘ওয়ারেশ থাকে, হুজুরে হাজির হইবে |’ তখন আমার দুই একজন শত্রু সুযোগ মনে করিয়া বলিয়া দিল যে, গোবিন্দ দত্তের কাছে ইহার স্বর্ণালঙ্কার আছে। আমাকে তলব হইল। আমি তখন দেবাদিদেবের কাছে আসিয়া যুক্তকরে দাঁড়াইলাম। কিছু গালি খাইলাম। আসামীর শ্রেণীতে চালান হইবার গতিক দেখিলাম। বলিব কি? ঘুষাঘুষির উদ্যোগ দেখিয়া অলঙ্কারগুলি সকল দারোগা মহাশয়ের পাদপদ্মে ঢালিয়া দিলাম, তাহার উপর পঞ্চাশটাকা নগদ দিয়া নিষ্কৃতি পাইলাম।
“বলা বাহুল্য যে, দারোগা মহাশয় অলঙ্কারগুলি আপন কন্যার ব্যবহারার্থ নিজালয়ে প্রেরণ করিলেন। সাহেবের কাছে তিনি রিপোর্ট করিলেন যে, ‘হরেকৃষ্ণ দাসের এক লোটা আর এক দেরকো ভিন্ন অন্য কোন সম্পত্তিই নাই ; এবং সে লাওয়ারেশা ফেতি করিয়াছে, তাহার কেহ নাই’|”
হরেকৃষ্ণ দাসের নাম শুনিয়াছিলাম। আমি গোবিন্দ বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, “ঐ হরেকৃষ্ণ দাসের এক ভাইয়ের নাম মনোহর দাস না?”
গোবিন্দকান্ত বাবু বলিলেন, “হাঁ। আপনি কি প্রকারে জানিলেন?”
আমি বিশেষ কিছু বলিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, “হরেকৃষ্ণের শ্যালীপতির নাম কি?”
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, “রাজচন্দ্র দাস |”
আমি। তাহার বাড়ী কোথায়?
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, “কলিকাতায়। কিন্তু কোন্ স্থানে, তাহা আমি ভুলিয়া গিয়াছি |”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে কন্যাটির নাম কি জানেন?”
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, “হরেকৃষ্ণ তাহার নাম রজনী রাখিয়াছিলেন |”
ইহার অল্প দিন পরেই আমি কাশী পরিত্যাগ করিলাম।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

প্রথমে আমাকে বুঝিতে হইতেছে, আমি কি খুঁজি। চিত্ত আমার দু:খময়, এ সংসার আমার পক্ষে অন্ধকার। আজি আমার মৃত্যু হইলে, আমি কাল চাহি না। যদি দু:খ নিবারণ করিতে না পারিলাম, তবে পুরুষত্ব কি? কিন্তু ব্যাধির শান্তি করিতে গেলে আগে ব্যাধির নির্ণয় চাহি। দু:খ নিবারণের আগে আমার দু:খ কি, তাহা নিরুপণের আবশ্যক।
দু:খ কি? অভাব। সকল দু:খই অভাব। রোগ দু:খ ; কারণ, রোগ স্বাস্থ্যের অভাব। অভাবমাত্রই দু:খ নহে, তাহা জানি। রোগের অভাব দু:খ নহে। অভাববিশেষই দু:খ।
আমার কিসের অভাব? আমি চাই কি? মনুষ্যই চায় কি? ধন? আমার যথেষ্ট আছে।
যশ? পৃথিবীতে এমন কেহ নাই, যাহার যশ নাই। যে পাকা জুয়াচোর, তাহারও বুদ্ধি সম্বন্ধে যশ আছে। আমি একজন কশাইয়েরও যশ শুনিয়াছি-মাংস সম্বন্ধে সে কাহাকেও প্রবঞ্চনা করিত না। সে কখন মেষমাংস বলিয়া কাহাকেও কুক্কুরমংস দেয় নাই। যশ সকলেরই আছে। আবার কাহারও যশ সম্পূর্ণ নহে। বেকনের ঘুষখোর অপবাদ-সক্রেতিস অপযশহেতু বধদণ্ডার্হ হইয়াছিলেন। যুধিষ্ঠির দ্রোণবধে মিথ্যাবাদী-অর্জুন বভ্রুবাহন কর্তৃক পরাভূত। কাইসরকে যে বিথীনিয়ার রাণী বলিত, সে কথা অদ্যাপি প্রচলিত;-সেক্সপিয়রকে বল‍্‍টের ভাঁড় বলিয়াছেন। যশ চাহি না।
যশ সাধারণ লোকের মুখে। সাধারণ লোক কোন বিষয়েরই বিচারক নহে-কেন না, সাধারণ লোক মূর্খ এবং স্থূলবুদ্ধি। মূর্খ স্থূলবুদ্ধির কাছে যশস্বী হইয়া আমার কি সুখ হইবে? আমি যশ চাহি না।
মান? সংসারে এমন লোক কে আছে যে, সে মানিলে সুখী হই? যে দুই চারি জন আছে, তাহাদিগের কাছে আমার মান আছে। অন্যের কাছে মান-অপমান মাত্র। রাজদরবারে মান-সে কেবল দাসত্বের প্রাধান্যচিহ্ন বলিয়া অগ্রাহ্য করি। আমি মান চাহি না। মান চাহি কেবল আপনার কাছে।
রূপ? কতটুকু চাই? কিছু চাই। লোকে দেখিয়া, না নিষ্ঠীবন ত্যাগ করে। আমাকে দেখিয়া কেহ নিষ্ঠীবন ত্যাগ করে না। রূপ যাহা আছে তাহাই আমার যথেষ্ট।
স্বাস্থ্য? আমার স্বাস্থ্য অদ্যাপি অনন্ত।
বল? লইয়া কি করিব? প্রহারের জন্য বল আবশ্যক। আমি কাহাকেও প্রহার করিতে চাহি না।
বুদ্ধি? এ সংসারে কেহ কখন বুদ্ধির অভাব আছে মনে করে নাই-আমিও করি না। সকলেই আপনাকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান বলিয়া জানে, আমিও জানি।
বিদ্যা? ইহার অভাব স্বীকার করি, কিন্তু কেহ কখন বিদ্যার অভাবে আপনাকে অসুখী মনে করে নাই। আমিও করি না।
ধর্ম? লোকে বলে, ধর্মের অভাব পরকালের দু:খের কারণ ইহকালের নহে। লোকের চরিত্রে দেখিতে পাই, অধর্মের অভাবই দু:খ। জানি আমি সে মিথ্যা। কিন্তু জানিয়াও ধর্মকামনা করি না। আমার সে দু:খ নহে।
প্রণয়? স্নেহ? ভালবাসা? আমি জানি, ইহার অভাবই সুখ-ভালবাসাই দু:খ। সাক্ষী লবঙ্গলতা।
তবে আমার দু:খ কিসের? আমার অভাব কিসের? আমার কিসের কামনা যে, তাহা লাভে সফল হইয়া দু:খ নিবারণ করিব? আমার কাম্য বস্তু কি?
বুঝিয়াছি। আমার কাম্য বস্তুর অভাবই আমার দু:খ। আমি বুঝিয়াছি যে, সকলই অসার। তাই আমার কেবল দু:খ সার।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

কিছু কাম্য কি খুঁজিয়া পাই না? এই অনন্ত সংসার, অসংখ্য রত্নরাজিময়, ইহাতে আমার প্রার্থনীয় কি কিছু নাই? যে সংসারে এক একটি দুরবেক্ষণীয় ক্ষুদ্র কীট পতঙ্গ অনন্ত কৌশলের স্থান, অনন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার, যে জগতে পথিস্থ বালুকার এক এক কণা, অনন্তরত্নপ্রভব নগাধিরাজের ভগ্নাংশ, সে জগতে কি আমার কাম্য বস্তু কিছু নাই? দেখ, আমি কোন্ ছার! টিণ্ডল, হক‍্সলী, ডার্বিন, এবং লায়ল এক আসনে বসিয়া যাবজ্জীবনে ঐ ক্ষুদ্র নীহারবিন্দুর, ঐ বালুকাকণার বা ঐ শিয়ালকাঁটাফুলটির গুণ বর্ণনা করিয়া উঠিতে পারেন না-তবু আমার কাম্য বস্তু নাই? আমি কি?
দেখ, এই পৃথিবীতে কত কোটি মনুষ্য আছে, তাহা কেহ গণিয়া সংখ্যা করে নাই। বহু কোটি মনুষ্য সন্দেহ নাই-উহার এক একটি মনুষ্য অসংখ্য গুণের আধার। সকলেই ভক্তি, প্রীতি, দয়া, ধর্মাদির আধার-সকলেই পূজ্য, সকলেই অনুসরণীয়। আমার কাম্য কি কেহ নাই? আমি কি?
আমার এক বাঞ্ছনীয় পদার্থ ছিল-আজিও আছে। কিন্তু সে বাসনা পূর্ণ হইবার নহে। পূর্ণ হইবার নহে বলিয়া তাহা হৃদয় হইতে অনেক দিন হইল উন্মূলিত করিয়াছি। আর পুনরুজ্জীবিত করিতে চাহি না। অন্য কোন বাঞ্ছনীয় কি সংসারে নাই?
তাই খুঁজি। কি করিব?
কয় বৎসর হইতে আমি আপনা আপনি এই প্রশ্ন করিতেছিলাম, উত্তর দিতে পারিতেছিলাম না। যে দুই একজন বন্ধুবান্ধব আছেন, তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলে বলিতেন, তোমার আপনার কাজ না থাকে, পরের কাজ কর। লোকের যথাসাধ্য উপকার কর।
সে ত প্রাচীন কথা। লোকের উপকার কিসে হয়? রামের মার ছেলের জ্বর হইয়াছে, নাড়ী টিপিয়া একটু কুইনাইন দাও। রঘো পাগলের গাত্রবস্ত্র নাই, কম্বল কিনিয়া দাও। সস্তার মা বিধবা, মাসিক দাও। সুন্দর নাপিতের ছেলে ইস্কুলে পড়িতে পায় না-তাহার বেতনের আনুকূল্য কর। এই কি পরের উপকার?
মানিলাম, এই পরের উপকার। কিন্তু এ সকলে কতক্ষণ যায়? কতটুকু সময় কাটে? কতটুকু পরিশ্রম হয়? মানসিক শক্তিসকল কতখানি উত্তেজিত হয়? আমি এমত বলি না যে, এই সকল কার্য আমার যথাসাধ্য আমি করিয়া থাকি ; কিন্তু যতটুকু করি, তাহাতে আমার বোধ হয় না যে, ইহাতে আমার প্রভাব পূরণ হইবে। আমার যোগ্য কাজ আমি খুঁজি, যাহাতে আমার মন মজিবে, তাই খুঁজি।
আর একপ্রকারে লোকের উপকারের ঢং উঠিয়াছে। তাহার এক কথায় নাম দিতে হইলে বলিতে হয় “বকাবকি লেখালেখি |” সোসাইটি, ক্লব, এসোসিয়েশন, সভা, সমাজ, বক্তৃতা, রিজলিউশ্যন, আবেদন, নিবেদন, সমবেদন,-আমি তাহাতে নহি। আমি একদা কোন বন্ধুকে একটি মহাসভার ঐরূপ একখানি আবেদন পড়িতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম যে, কি পড়িতেছ? তিনি বলিলেন, “এমন কিছু না, কেবল কাণা ফকির ভিক মাঙ্গে |” এ সকল আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে তাই-কেবল “কাণা ফকির ভিক মাঙ্গে রে বাবা |”
এই রোগের আর এক প্রকার বিকার আছে। বিধবার বিবাহ দাও, কুলীন ব্রাহ্মণের বিবাহ বন্ধ কর, অল্প বয়সে বিবাহ বন্ধ কর, জাতি উঠাইয়া দেও, স্ত্রীলোকগণ এক্ষণে গোরুর মত গোহালে বাঁধা থাকে-দড়ি খুলিয়া তাহাদিগকে ছাড়িয়া দাও, চরিয়া খাক। আমার গোরু নাই, পরের গোহালের সঙ্গেও আমার বিশেষ সম্বন্ধ নাই। জাতি উঠাইতে আমি বড় রাজি নহি, আমি ততদূর আজিও সুশিক্ষিত হই নাই। আমি এখনও আমার ঝাড়ুদারের সঙ্গে একত্রে বসিয়া খাইতে অনিচ্ছুক, তাহার কন্যা বিবাহ করিতে অনিচ্ছুক, এবং যে গালি শিরোমণি মহাশয় দিলে নি:শব্দে সহিব, ঝাড়ুদারের কাছে তাহা সহিতে অনিচ্ছুক। সুতরাং আমার জাতি থাকুক। বিধবা বিবাহ করে করুক, ছেলেপুলেরা আইবুড়ো থাকে থাকুক, কুলীন ব্রাহ্মণ এক পত্নীর যন্ত্রণায় খুসি হয় হউক, আমার আপত্তি নাই; কিন্তু তাহার পোষকতায় লোকের কি হিত হইবে, তাহা আমার বুদ্ধির অতীত।
সুতরাং এ বঙ্গসমাজে আমার কোন কার্য নাই। এখানে আমি কেহ নহি-আমি কোথাও নহি। আমি, আমি, এই পর্যন্ত ; আর কিছু নহি। আমার সেই দু:খ। আর কিছু দু:খ নাই-লবঙ্গলতার হস্তলিপি ভুলিয়া যাইতেছি।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

আমার এইরূপ মনের অবস্থা, আমি এমত সময়ে-কাশীধামে গোবিন্দ দত্তের কাছে রজনীর নাম শুনিলাম। মনে হইল, ঈশ্বর আমাকে বুঝি একটি গুরুতর কার্যের ভার দিলেন। এ সংসারে আমি একটি কার্য পাইলাম। রজনীর যথার্থ উপকার চেষ্টা করিলে করা যায়। আমার ত কোন কাজ নাই-এই কাজ কেন করি না। ইহা কি আমার যোগ্য কাজ নহে?
এখানে শচীন্দ্রের বংশাবলীর পরিচয় কিছু দিতে হইল। শচীন্দ্রনাথের পিতার নাম রামসদয় মিত্র ; পিতামহের নাম বাঞ্ছারাম মিত্র; প্রপিতামহের নাম কেবলরাম মিত্র। তাঁহাদিগের পূর্বপুরুষের বাস কলিকাতায় নহে-তাঁহার পিতা প্রথমে কলিকাতায় বাস করেন। তাঁহাদিগের পূর্বপুরুষের বাস ভবানীনগর গ্রামে। তাঁহার প্রপিতামহ দরিদ্র নি:স্ব ব্যক্তি ছিলেন। পিতামহ বুদ্ধিবলে ধনসঞ্চয় করিয়া তাঁহাদিগের ভোগ্য ভূসম্পত্তিসকল ক্রয় করিয়াছিলেন।
বাঞ্ছারামের এক পরম বন্ধু ছিলেন, নাম মনোহর দাস। বাঞ্ছারাম মনোহর দাসের সাহায্যেই এই বিভবের অধিপতি হইয়াছিলেন। মনোহর, প্রাণপাত করিয়া তাঁহার কার্য করিতেন, নিজে কখন ধনসঞ্চয় করিতেন না। বাঞ্ছারাম তাঁহার এই সকল গুণে অত্যন্ত বাধ্য ছিলেন। মনোহরকে সহোদরের ন্যায় ভালবাসিতেন ; এবং মনোহর বয়োজ্যেষ্ঠ বলিয়া জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় তাঁহাকে মান্য করিতেন। তাঁহার পিতার সঙ্গে পিতামহের তাদৃশ সম্প্রীতি ছিল না। বোধ হয়, উভয় পক্ষেরই কিছু কিছু দোষ ছিল।
একদা রামসদয়ের সঙ্গে মনোহর দাসের ঘোরতর বিবাদ উপস্থিত হইল। মনোহর দাস বাঞ্ছারামকে বলিলেন যে, রামসদয় তাঁহাকে কোন বিষয়ে সহনাতীত অপমান করিয়াছেন। অপমানের কথা বাঞ্ছারামকে বলিয়া, মনোহর তাঁহার কার্য পরিত্যাগ করিয়া সপরিবারে ভবানীনগর হইতে উঠিয়া গেলেন। বাঞ্ছারাম মনোহরকে অনেক অনুনয় বিনয় করিলেন ; মনোহর কিছুই শুনিলেন না। উঠিয়া কোন্ দেশে গিয়া বাস করিলেন, তাহাও কাহাকে জানাইলেন না।
বাঞ্ছারাম রামসদয়ের প্রতি যত স্নেহ করুন বা না করুন, মনোহরকে ততোধিক স্নেহ করিতেন। সুতরাং রামসদয়ের উপর তাঁহার ক্রোধ অপরিসীম হইল। বাঞ্ছারাম অত্যন্ত কটূক্তি করিয়া গালি দিলেন, রামসদয়ও সকল কথা নি:শব্দে সহ্য করিলেন না।
পিতা পুত্রের বিবাদের ফল এই দাঁড়াইল যে, বাঞ্ছারাম পুত্রকে গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দিলেন। পুত্রও গৃহত্যাগ করিয়া, শপথ করিলেন, আর কখনও পিতৃভবনে মুখ দেখাইবেন না। বাঞ্ছারাম রাগ করিয়া এক উইল করিলেন। উইলে লিখিত হইল যে, বাঞ্ছারাম মিত্রের সম্পত্তিতে তস্য পুত্র রামসদয় মিত্র কখন অধিকারী হইবেন না। বাঞ্ছারাম মিত্রের অবর্তমানে মনোহর দাস, মনোহর দাসের অভাবে মনোহরের উত্তরাধিকারিগণ অধিকারী হইবেন; তদভাবে রামসদয়ের পুত্রপৌত্রাদি যথাক্রমে, কিন্তু রামসদয় নহে।
রামসদয় গৃহত্যাগ করিয়া প্রথমা স্ত্রীকে লইয়া কলিকাতায় আসিলেন। ঐ স্ত্রীর কিছু পিতৃদত্ত অর্থ ছিল। তদবলম্বনে, এবং একজন সজ্জন বণিক সাহেবের আনুকূল্যে তিনি বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হইলেন। লক্ষ্মী সুপ্রসন্না হইলেন; সংসার প্রতিপালনের জন্য তাঁহাকে কোন কষ্ট পাইতে হইল না।
যদি কষ্ট পাইতে হইত, তাহা হইলে বোধ হয়, বাঞ্ছারাম সদয় হইতেন। পুত্রের সুখের অবস্থা শুনিয়া, বৃদ্ধের যে স্নেহাবশেষ ছিল, তাহাও নিবিয়া গেল। পুত্র অভিমানপ্রযুক্ত, পিতা না ডাকিলে, আর যাইব না, ইহা স্থির করিয়া, আর পিতার কোন সম্বাদ লইলেন না। অভক্তি এবং তাচ্ছল্যবশত: পুত্র এরূপ করিতেছে বিবেচনা করিয়া, বাঞ্ছারাম তাঁহাকেও আর ডাকিলেন না।
সুতরাং কাহারও রাগ পড়িল না; উইলও অপরিবর্তিত রহিল। এমতকালে হঠাৎ বাঞ্ছারামের স্বর্গপ্রাপ্তি হইল।
রামসদয় শোকাকুল হইলেন; তাঁহার পিতার মৃত্যুর পূর্বে তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎলাভ করিয়া যথাকর্তব্য করেন নাই, এই দু:খে অনেকদিন ধরিয়া রোদন করিলেন। তিনি আর ভবানীনগর গেলেন না, কলিকাতাতেই পিতৃকৃত্য সম্পন্ন করিলেন। কেন না, এক্ষণে ঐ বাটী মনোহর দাসের হইল।
এদিকে মনোহর দাসের কোন সম্বাদ নাই। পশ্চাৎ জানিতে পারা গেল যে, বাঞ্ছারামের জীবিতাবস্থাতেও মনোহরের কেহ কোন সম্বাদ পায় নাই। মনোহর দাস ভবানীনগর হইতে যে গিয়াছিল, সেই গিয়াছিল ; কোথায় গেল, বাঞ্ছারাম তাহার অনেক সন্ধান করিলেন ; কিছুতেই কোন সম্বাদ পাইলেন না। তখন তিনি উইলের এক ক্রোড়পত্র সৃজন করিলেন। তাহাতে বিষ্ণুরাম সরকার নামক একজন কলিকাতানিবাসিনী আত্মীয় কুটুম্বকে উইলের একজিকিউটর নিযুক্ত করিলেন। তাহাতে কথা রহিল যে, তিনি সযত্নে মনোহর দাসের অনুসন্ধান করিবেন। পশ্চাৎ ফলানুসারে সম্পত্তি যাহার প্রাপ্য, তাহাকে দিবেন।
বিষ্ণুরাম বাবু অতি বিচক্ষণ, নিরপেক্ষ, এবং কর্মঠ ব্যক্তি। তিনি বাঞ্ছারামের মৃত্যুর পরেই মনোহর দাসের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। অনেক পরিশ্রম ও অর্থব্যয় করিয়া যাহা বাঞ্ছারাম কর্তৃক অনুসন্ধান হয় নাই, তাহার নিগূঢ় কথা পরিজ্ঞাত হইলেন। স্থূল বৃত্তান্ত অনুসন্ধানে এই জানা গেল যে, মনোহর ভবানীনগর হইতে পলাইয়া কিছু কাল সপরিবারে ঢাকা অঞ্চলে গিয়া বাস করেন। পরে সেখানে জীবিকানির্বাহের জন্য কিছু কষ্ট হওয়াতে, কলিকাতায় নৌকাযোগে আসিতেছিলেন, পথিমধ্যে বাত্যায় পতিত হইয়া সপরিবারে জলমগ্ন হইয়াছিলেন। তাঁহার আর উত্তরাধিকারী ছিল, এমন সন্ধান পাইলেন না।
বিষ্ণুরাম বাবু এসকল কথার অকাট্য প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া রামসদয়কে দেখাইলেন। তখন বাঞ্ছারামের ভূসম্পত্তি শচীন্দ্রদিগের দুই ভ্রাতার হইল; এবং বিষ্ণুরাম বাবুও তাহা তাঁহাদের হস্তে সমর্পণ করিলেন।
এক্ষণে এই রজনী যদি জীবিত থাকে, তবে যে সম্পত্তি রামসদয় মিত্র ভোগ করিতেছে, তাহা রজনীর। রজনী হয়ত নিতান্ত দরিদ্রাবস্থাপন্না। সন্ধান করিয়া দেখা যাউক। আমার আর কোন কাজ নাই।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

বাঙ্গালায় আসার পর একদা কোন গ্রাম্য কুটুম্বের বাড়ী নিমন্ত্রণে গিয়াছিলাম। প্রাত:কালে গ্রাম পর্যটনে গিয়াছিলাম। এক স্থানে অতি মনোহর নিভৃত জঙ্গল ; দয়েল সপ্ত স্বর মিলাইয়া আশ্চর্য ঐক্যতানবাদ্য বাজাইতেছে ; চারিদিকে বৃক্ষরাজি ; ঘনবিন্যস্ত, কোমল শ্যাম পল্লবদলে আচ্ছন্ন ; পাতায় পাতায় ঠেসাঠেসি মিশামিশি, শ্যাম রূপের রাশি রাশি ; কোথাও কলিকা, কোথাও স্ফুটিত পুষ্প কোথাও অপক্ক, কোথাও সুপক্ক ফল। সেই বনমধ্যে আর্তনাদ শুনিতে পাইলাম। বনাভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, একজন বিকটমূর্তি পুরুষ এক যুবতীকে বলপূর্বক আক্রমণ করিতেছে।
দেখিবামাত্র বুঝিলাম, পুরুষ অতি নীচজাতীয় পাষণ্ড-বোধ হয় ডোম কি সিউলি-কোমরে দা। গঠন অত্যন্ত বলবানের মত।
ধীরে ধীরে তাহার পশ্চাদ্ভাগে গেলাম। গিয়া তাহার কঙ্কাল হইতে দাখানি টানিয়া লইয়া দূরে নিক্ষিপ্ত করিলাম। দুষ্ট তখন যুবতীকে ছাড়িয়া দিল-আমার সম্মুখীন হইয়া দাঁড়াইল। আমাকে গালি দিল। তাহার দৃষ্টি দেখিয়া আমার শঙ্কা হইল।
বুঝিলাম, এ স্থলে বিলম্ব অকর্তব্য। একেবারে তাহার গলদেশে হস্তার্পণ করিলাম। ছাড়াইয়া সেও আমাকে ধরিল। আমিও তাহাকে পুনর্বার ধরিলাম। তাহার বল অধিক। কিন্তু আমি ভীত হই নাই-বা অস্থির হই নাই। অবকাশ পাইয়া আমি যুবতীকে বলিলাম যে, “তুমি এই সময় পলাও-আমি ইহার উপযুক্ত দণ্ড দিতেছি |”
যুবতী বলিল,-“কোথায় পলাইব? আমি যে অন্ধ! এখানকার পথ চিনি না |”
অন্ধ! আমার বল বাড়িল। আমি রজনী নামে একটি অন্ধ কন্যাকে খুঁজিতেছিলাম।
দেখিলাম, সেই বলবান পুরুষ আমাকে প্রহার করিতে পারিতেছে না বটে, কিন্তু আমাকে বলপূর্বক টানিয়া লইয়া যাইতেছে। তাহার অভিপ্রায় বুঝিলাম, যেদিকে আমি দা ফেলিয়া দিয়াছিলাম, সেই দিকে সে আমাকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। আমি তখন দুষ্টকে ছাড়িয়া দিয়া, অগ্রে গিয়া দা কুড়াইয়া লইলাম। সে এক বৃক্ষের ডাল ভাঙ্গিয়া লইয়া, তাহা ফিরাইয়া আমার হস্তে প্রহার করিল, আমার হস্ত হইতে দা পড়িয়া গেল। সে দা তুলিয়া লইয়া, আমাকে তিন চারি স্থানে আঘাত করিয়া পলাইয়া গেল।
আমি গুরুতর পীড়াপ্রাপ্ত হইয়াছিলাম। বহু কষ্টে আমি কুটুম্বের গৃহাভিমুখে চলিলাম। অন্ধ যুবতী আমার পদশব্দানুসরণ করিয়া আমার সঙ্গে সঙ্গে আসিতে লাগিল। কিছু দূর গিয়া আর আমি চলিতে পারিলাম না। পথিক লোকে আমাকে ধরিয়া আমার কুটুম্বের বাড়ীতে রাখিয়া আসিল।
সেই স্থানে আমি কিছুকাল শয্যাগত রহিলাম-অন্য আশ্রয়াভাবেও বটে, এবং আমার দশা কি হয়, তাহা না জানিয়া কোথাও যাইতে পারে না, সেজন্যও বটে, অন্ধ যুবতীও সেইখানে রহিল।
বহু দিনে, বহু কষ্টে, আমি আরোগ্যলাভ করিলাম।
মেয়েটি অন্ধ দেখিয়া অবধিই আমার সন্দেহ হইয়াছিল। যেদিন প্রথম আমার বাক‍্শক্তি হইল, সে আমার রুগ্নশয্যাপার্শ্বে আসিল, সেই দিনই তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি গা?”
“রজনী |”
আমি চমকিয়া উঠিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি রাজচন্দ্র দাসের কন্যা?”
রজনীও বিস্মিতা হইল। বলিল, “আপনি বাবাকে কি চেনেন?”
আমি স্পষ্টত: কোন উত্তর দিলাম না।
আমি সম্পূর্ণরূপে আরোগ্যলাভ করিলে, রজনীকে কলিকাতায় লইয়া গেলাম।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

কলিকাতায় গমনকালে আমি একা রজনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলাম না। কুটুম্বগৃহ হইতে তিনকড়ি নামে একজন প্রাচীনা পরিচারিকা সমভিব্যাহারে লইয়া গেলাম। এ সতর্কতা রজনীর মন প্রসন্ন করিবার জন্য। গমনকালে রজনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “রজনী-তোমাদের বাড়ী কলিকাতায়-কিন্তু তুমি এখানে আসিলে কি প্রকারে?”
রজনী বলিল, “আমাকে কি সকল কথা বলিতে হইবে?”
আমি বলিলাম, “তোমার যদি ইচ্ছা না হয়, তবে বলিও না |”
বস্তুত: এই অন্ধ স্ত্রীলোকের বুদ্ধি, বিবেচনা, এবং সরলতায় আমি বিশেষ প্রীত হইয়াছিলাম। তাহাকে কোন প্রকার ক্লেশ দিবার আমার ইচ্ছা ছিল না। রজনী বলিল, “যদি অনুমতি করিলেন, তবে কতক কথা গোপন রাখিব। গোপাল বাবু বলিয়া আমার একজন প্রতিবাসী আছেন। তাঁহার স্ত্রী চাঁপা। চাঁপার সঙ্গে আমার হঠাৎ পরিচয় হইয়াছিল। তাহার বাপের বাড়ী হুগলী। সে আমাকে বলিল, ‘আমার বাপের বাড়ী যাইবে?’ আমি রাজি হইলাম। সে আমাকে একদিন সঙ্গে করিয়া গোপাল বাবুর বাড়ীতে লইয়া আসিল। কিন্তু তাহার বাপের বাড়ী আমাকে পাঠাইবার সময় আপনি আমার সঙ্গে আসিল না। তাহার ভাই হীরালালকে আমার সঙ্গে দিল। হীরালালও নৌকা করিয়া আমায় হুগলী লইয়া চলিল |”
আমি এইখানে বুঝিতে পারিলাম যে, রজনী হীরালাল সম্বন্ধে কথা গোপন করিতেছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি তাহার সঙ্গে গেলে?”
রজনী বলিল, “ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু যাইতে হইল। কেন যাইতে হইল, তাহা বলিতে পারিব না। পথিমধ্যে হীরালাল আমার উপর অত্যাচার করিতে লাগিল। আমি তাহার বাধ্য নহি দেখিয়া, সে আমাকে বিনাশ করিবার জন্য, গঙ্গার এক চরে নামাইয়া দিয়া নৌকা লইয়া চলিয়া গেল |”
রজনী চুপ করিল-আমি হীরালালকে ছদ্মবেশী রাক্ষস মনে করিয়া, মনে মনে তাহার রূপ ধ্যান করিতে লাগিলাম।-তার পর রজনী বলিতে লাগিল, “সে চলিয়া গেলে, আমি ডুবিয়া মরিব বলিয়া জলে ডুবিলাম |”
আমি বলিলাম, “কেন? তুমি কি হীরালালকে এত ভালবাসিতে?”
রজনী ভ্রূকুটী করিল। বলিল, “তিলার্ধ না। আমি পৃথিবীতে কাহারও উপর এত বিরক্ত নহি |”
“তবে ডুবিয়া মরিতে গেলে কেন?”
“আমার যে দু:খ, তাহা আপনাকে বলিতে পারি না |”
“আচ্ছা। বলিয়া যাও |”
“আমি জলে ডুবিয়া ভাসিয়া উঠিলাম। একখানা গহনার নৌকা যাইতেছিল। সেই নৌকার লোক আমাকে ভাসিতে দেখিয়া উঠাইল। যে গ্রামে আপনার সহিত সাক্ষাৎ, সেইখানে একজন আরোহী নামিল। সে নামিবার সময়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি কোথায় নামিবে?’ আমি বলিলাম, ‘আমাকে যেখানে নামাইয়া দিবে, আমি সেইখানে নামিব |’ তখন সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমার বাড়ী কোথায়?’ আমি বলিলাম, ‘কলিকাতায় |’ সে বলিল, ‘আমি কালি আবার কলিকাতায় যাইব। তুমি আজ আমার সঙ্গে আইস। আজি আমার বাড়ী থাকিবে। কালি তোমাকে কলিকাতায় রাখিয়া আসিব |’ আমি আনন্দিত হইয়া তাহার সঙ্গে উঠিলাম। সে আমাকে সঙ্গে লইয়া চলিল। তার পর আপনি সব জানেন |”
আমি বলিলাম, “আমি যাহার হাত হইতে তোমাকে মুক্ত করিয়াছিলাম, সে কি সেই?”
“সে সেই।”
আমি রজনীকে কলিকাতায় আনিয়া, তাহার কথিত স্থানে অন্বেষণ করিয়া, রাজচন্দ্র দাসের বাড়ী পাইলাম। সেইখানে রজনীকে লইয়া গেলাম।
রাজচন্দ্র কন্যা পাইয়া বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিল। তাহার স্ত্রী অনেক রোদন করিল। উহারা আমার কাছে রজনীর বৃত্তান্ত সবিশেষ শুনিয়া বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিল।
পরে রাজচন্দ্রকে আমি নিভৃতে লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার কন্যা গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছিল কেন জান?”
রাজচন্দ্র বলিল, “না। আমি তাহা সর্বদাই ভাবি, কিন্তু কিছুই ঠিকানা করিতে পারি নাই |”
আমি বলিলাম, “রজনী জলে ডুবিয়া মরিতে গিয়াছিল কি দু:খে জান?”
রাজচন্দ্র বিস্মিত হইল। বলিল, “রজনীর এমন কি দু:খ, কিছুই ত ভাবিয়া পাই না। সে অন্ধ, এটি বড় দু:খ বটে, কিন্তু তার জন্য এত দিনের পর ডুবিয়া মরিতে যাইবে কেন? তবে, এত বড় মেয়ে, আজিও তাহার বিবাহ হয় নাই। কিন্তু তাহার জন্যও নয়। তাহার ত সম্বন্ধ করিয়া বিবাহ দিতেছিলাম। বিবাহের আগের রাত্রেই পলাইয়াছিল |”
আমি নূতন কথা পাইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে পলাইয়াছিল?”
রা। হাঁ।
আমি। তোমাদিগকে না বলিয়া?
রা। কাহাকেও না বলিয়া।
আমি। কাহার সহিত সম্বন্ধ করিয়াছিলে?
রা। গোপাল বাবুর সঙ্গে।
আমি। কে গোপাল বাবু? চাঁপার স্বামী?
রা। আপনি সবই ত জানেন। সেই বটে।
আমি একটু আলো দেখিলাম। তবে চাঁপা সপত্নীযন্ত্রণাভয়ে রজনীকে প্রবঞ্চনা করিয়া ভ্রাতৃসঙ্গে হুগলী পাঠাইয়াছিল। বোধ হয়, তাহারই পরামর্শে হীরালাল উহার বিনাশে উদ্যোগ পাইয়াছিল।
সে কথা কিছু না বলিয়া রাজচন্দ্রকে বলিলাম, “আমি সবই জানি। আমি আরও জানি, তোমায় বলিতেছি। তুমি কিছু লুকাইও না |”
রা। কি-আজ্ঞা করুন।
আমি। রজনী তোমার কন্যা নহে।
রাজচন্দ্র বিস্মিত হইল। বলিল, “সে কি! আমার মেয়ে নয় ত কাহার?”
“হরেকৃষ্ণ দাসের |”
রাজচন্দ্র কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিল। শেষে বলিল, “আপনি কে, তাহা জানি না। কিন্তু আপনার পায়ে পড়ি, এ কথা রজনীকে বলিবেন না |”
আমি। এখন বলিব না। কিন্তু বলিতে হইবে। আমি যাহা জিজ্ঞাসা করি, তাহার সত্য উত্তর দাও। যখন হরেকৃষ্ণ মরিয়া যায়, তখন রজনীর কিছু অলঙ্কার ছিল?
রাজচন্দ্র ভীত হইল। বলিল, “আমি ত তাহার অলঙ্কারের কথা কিছু জানি না। অলঙ্কার কিছুই পাই নাই |”
আমি। হরেকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তুমি তাহার ত্যক্ত সম্পত্তির সন্ধানে সে দেশে আর গিয়াছিলে?
রা। হাঁ, গিয়াছিলাম। গিয়া শুনিলাম, হরেকৃষ্ণের যাহা কিছু ছিল, তাহা পুলিসে লইয়া গিয়াছে।
আমি। তাহাতে তুমি কি করিলে?
রা। আমি আর কি করিব? আমি পুলিসকে বড় ভয় করি, রজনীর বালাচুরি মোকদ্দমায় বড় ভুগিয়াছিলাম। আমি পুলিসের নাম শুনিয়া আর কিছু বলিলাম না।
আমি। রজনীর বালাচুরি মোকদ্দমা কিরূপ?
রা। রজনীর অন্নপ্রাশনের সময় তাহার বালা চুরি গিয়াছিল। চোর ধরা পড়িয়াছিল। বর্ধমানে তাহার মোকদ্দমা হইয়াছিল। এই কলিকাতা হইতে বর্ধমানে আমাকে সাক্ষ্য দিতে যাইতে হইয়াছিল। বড় ভুগিয়াছিলাম।
আমি পথ দেখিতে পাইলাম।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *