2 of 8

রসুন

রসুন

কবিরাজ কুলতিলক শ্রীযুক্ত শিবকালী ভট্টাচার্য মহোদয়ের সাজানো বাগানে অনুপ্রবেশ করবার এ কোনও ব্যর্থ প্রয়াস নয়।

এই হাস্যকর নিবন্ধমালায় রসুন অন্তর্ভুক্ত করে আমি আমার পচা তরকারি বা মাছ-মাংসে কিঞ্চিৎ উত্তেজনা আনতে চাচ্ছি, এমন কথা যদি কোনও নবীন পাঠক কিংবা প্রবীণা পাঠিকা ভেবে বসেন, এবং বক্র হাসেন শুধু তাঁর এবং তাঁদের নিতান্ত অবগতির জন্যে জানাই এ শুধু অলস মায়া। শুধুই ডাক্তারবাহিনী আর রোগীর কাহিনীর অন্তে অন্তত একটি ওষুধ বা একটি ভেষজ, অথবা একটি নিরোগদায়িনী লতা নিয়ে আলোচনা থাকা উচিত তাই রসুন নিয়ে এই নিবন্ধ।

রসুনের উপকারিতা এবং রোগ নিরাময় ক্ষমতা নিয়ে সম্প্রতি কিছুদিন হল খুব শোরগোল উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা হল যে এখন যখন শরীরে শরীরে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদয়ে হৃদয়ে দুর্বলতা, গৃহে গৃহে স্নায়ু বৈকল্য সেইসময় রসুন এই সমস্ত রোগের প্রতিষেধকরূপে চিহ্নিত হয়ে বহুপ্রিয় হয়েছে।

নানারকম শোনা যাচ্ছে। যেমন এক কোয়াযুক্ত রসুন, দু’কোয়া বা ততোধিক কোয়াযুক্ত রসুনের চেয়ে বেশি উপকার দেয়। সুযোগ বুঝে হাটে-বাজারে, বিবাদী বাগের ফুটপাতে এক কোয়া রসুনের ঝুড়ি নিয়ে ব্যাপারি দাঁড়িয়ে গেছে, এবং সে রসুনের দামও পঁচিশ-ত্রিশ টাকা কেজি।

দায়ে পড়ে, রসুনের গুণ বিশ্বাস করে বহু লোক কিনছেন। অতি শৌখিন ব্যক্তিও, যিনি ইনটিমেট সৌরভ এবং ওল্ড স্পাইস সেভিং লোশনে আসক্ত, তিনি পর্যন্ত ঘুম থেকে উঠে এই কটুগন্ধ পদার্থটা চিবিয়ে গলাধঃকরণ করছেন। সারাদিন গন্ধে তাঁর কাছে এগোনো যাচ্ছে না।

একদা কথা ছিল যে দৈনিক একটি করে আপেল খেলে ডাক্তার দূরে থাকবে। আপেল স্বাস্থ্যের এবং শরীরের পক্ষে কতটা ভাল ও প্রয়োজনীয় এটা বোঝানোর জন্যেই একথা বলা হত।

আজকাল আপেলের আর সে মর্যাদা নেই। তার স্থান নিয়েছে রসুন। এবং সে শুধু এই আয়ুর্বেদের দেশেই নয় সাহেবদের দেশেও। এখন আপেলের ওই প্রবাদ বাক্যের স্থলে যে রসিকতা বিলেতে চালু হয়েছে সেটি হল, ‘প্রতিদিন একটা করে আপেল খেলে ডাক্তার দূরে থাকবে আর প্রতিদিন একটা করে রসুন খেলে শুধু ডাক্তার নয় সবাই দূরে থাকবে।’

অর্থাৎ, রসুনের গন্ধে কেউই কাছে ঘেঁষবে না। সবাই দূরে দূরে থাকবে।

এই সূত্রে একটি সর্বাধুনিক ডায়েটিংয়ের গল্প মনে পড়ছে। কিঞ্চিৎ স্থূলাঙ্গিনী এক মেমসাহেবকে ডাক্তার ওজন কমানোর জন্যে রসুনের ডায়েটিং করান। সকালে ব্রেকফাস্টের সঙ্গে এক কোয়া রসুন, দুপুরে লাঞ্চের সময় রসুন বাটা মিশিয়ে স্যান্ডউইচ আবার রাতে ডিনারের সময় রসুন ফ্রাই। কয়েকদিন পরে মেমসাহেবের এক বান্ধবী তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, ‘ওজন কিছু কমল?’ সুরসিকা মেমসাহেব জবাব দিলেন, ‘না ওজন তেমন কমেনি। তবে প্রেমিকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।’

রসুন দিয়ে অতিরিক্ত রসিকতা করার আগে দু’-একটি তথ্য স্বীকার করে নিই।

যদিও এই সেদিন পর্যন্ত বর্ণ-হিন্দুর রান্নাঘরে রসুনের প্রবেশাধিকার ছিল না। সারা পৃথিবীতে এখন প্রায় দুশো কোটি কিলোগ্রাম রসুন খাওয়া হয়। তার মানে এই যে মাথা প্রতি দু’দিনে এক কোয়া করে রসুন খাওয়া হয়।

সম্প্রতি এক ধরনের গন্ধহীন রসুনের বড়ি বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রস্তুত করে জাপান সেটা মার্কিন দেশের বাজারে ছেড়েছে এবং প্রথম বছরেই আমেরিকায় তিরিশ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে।

বলা বাহুল্য এ ধরনের গন্ধমুক্ত রসুনের বড়ি আমাদের দেশেও এখন চলছে, যে কোনও ওষুধের দোকানেই দু’-চার রকম এ ধরনের ওষুধের শিশি পাওয়া যায়। তার দামও বেশ চড়া। তবুও ভাল বিক্রি হচ্ছে সেটা যে কোনও কাগজে এ সম্পর্কে বিজ্ঞাপনের বহর দেখলেই বোঝা যায়।

শুধু আমাদের সুপ্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে নয়, সোয়া শো বছর আগে লুই পাস্তুরের মতো মহান বিজ্ঞানী রসুনের অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষমতা ধরতে পেরেছিলেন। রসুনের মধ্যে গন্ধকের উপাদান রয়েছে। রসুন সংক্রমণ প্রতিহত করে। রক্তে কোলেস্টরল কমায়, মেদ বৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখে।

বৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসকেরা রসুনের নানা গুণের কথা এখন বলছেন। একজন আয়ুর্বেদ চিকিৎসক আমাকে বলেছিলেন যে রসুন শব্দের সন্ধি হল রস+উন, উন মানে কম যেমন ঊনত্রিশ মানে ত্রিশের এক কম। এতে অম্লরস ছাড়া আর সব রসই রয়েছে বলে এর নাম হয়েছে রসুন, মূল শব্দটি দেশজ বা বিদেশি নয় প্রকৃত সংস্কৃত।

অভিধান থেকে ব্যাপারটা যাচাই করতে গিয়ে সুবলচন্দ্র মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’ দেখে ব্যাপারটা প্রত্যয় হল। রসুন রান্নাঘরে যতই ব্রাত্য হোক, আলু কপি এ সমস্তের ঢের আগে থেকে রসুন ভারতবর্ষে রয়েছে।

সে যা হোক, অভিধানের সূত্রে অন্য একটি অপ্রাসঙ্গিক গল্প মনে পড়ছে। এক গ্রাম্য ব্যক্তি ইংরেজি থেকে বাংলা অভিধান দেখে স্বচেষ্টায় ইংরেজি শেখে। দুঃখের বিষয় সেই ইংলিশ টু বেঙ্গলি ডিকশনারিতে দু’-একটা ছাপার ভুল ছিল। সেই বইয়ে ইংরেজি গারলিক শব্দের অর্থে রসুন ছাপতে গিয়ে র শব্দটির নীচের বিন্দুটি বাদ পড়ে যায় ফলে রসুনের জায়গায় বসুন ছাপা হয়। তাই ওই ব্যক্তি ধরে নিয়েছিল গারলিক মানে বসুন। ফলে একদিন যখন এক সাহেব তার বাড়িতে বেড়াতে এল, সে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে সাহেবকে বলল, ‘গারলিক স্যার, গারলিক।’ অর্থাৎ বসুন স্যার, বসুন।’

এই গল্পটি নিতান্ত গোপাল ভাঁড় মার্কা। বহুদিন আগে বটতলার রসিকতার বইতে পড়েছিলাম। রসুন বিষয়ে একটা পুরনো মজার গল্প দিয়ে এই আখ্যান শেষ করব। তার আগে, সম্প্রতি একটি পত্রিকায় রসুন বিষয়ে কিছু তথ্য পেয়েছি সেটা জানাই।

আড়াইশো বছর আগে ফরাসি দেশে প্লেগ মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছিল। মৃতদেহ সৎকারের জন্যে লোক পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন বন্দিকে ওই মৃতদেহ সৎকারের কাজে নিয়োগ করা হয়। তারা কিন্তু প্লেগে আক্রান্ত হয়নি। পরে অনুসন্ধান করে জানা। যায় তারা দু’বেলা রসুনের ঝোল খেত। ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে ক্ষয়রোগ পর্যন্ত সব অসুখেই রসুন উপকারী, বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত চিকিৎসকেরা এ ধরনের মত দিয়েছেন। বলা হয়, বুলগেরিয়ার লোকেরা যে দীর্ঘজীবী তার কারণ হল তারা নিয়মিত প্রচুর পরিমাণে রসুন খায় বলে।

তা হলে আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা যে বলতেন রসুন শরীর গরম করে, রসুন বেশি খেতে নেই। সেটা কেন বলতেন? বহুকাল ধরে যে ধারণা যুগপরম্পরায় চলে আসে তারও তো কোনও ভিত্তি থাকে।

সে যাক, আমরা মজার গল্পে ফিরে যাই। গল্পটি এর আগে যদি কেউ শুনে বা পড়ে থাকেন ক্ষমা করবেন।

এক বড় সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারি দৈনিক লাঞ্চের সময় এক বোতল বাংলা মদ খেয়ে আসতেন। তারপর সাহেব যাতে গন্ধ না পান সেইজন্যে খুব কড়া জর্দা দিয়ে পান খেয়ে কাজে ফিরতেন। তাঁর মাথায় হঠাৎ ঢুকল রসুনের চিন্তা। রসুন খেলে অসুখ হয় না, স্বাস্থ্য ভাল থাকে ইত্যাদি। তিনি রসুন চিবিয়ে খাওয়া শুরু করলেন এবং ঠিক করলেন দুপুরে মদ খেয়ে আসার সময় আর জর্দা পান খাবেন না তার বদলে রসুন চিবিয়ে আসবেন, সাহেব মদের গন্ধ টের পাবেন না।

সাহেব কিন্তু ঠিকই টের পেলেন এবং যা বললেন সেটা ভয়াবহ, ‘দ্যাখো গত পনেরো বছর ধরে আমি তোমার ধেনো মদের সঙ্গে জর্দার গন্ধ সহ্য করে গেছি, কিন্তু এই যে এখন শুরু করেছ ধেনো মদের সঙ্গে রসুনের গন্ধ এটা আর সহ্য হচ্ছে না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *