2 of 2

বিস্কুট

বিস্কুট

রসিক বললে—দেখিস বাংলায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পরেই রসিক রায়ের নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। রঞ্জন এইমাত্র হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট মুখে লাগিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললে—লিখে রাখ আমার নামে, মাসকাবারে সব দিয়ে দেব। এক বান্ডিল লাল সুতোর বিড়ি দিয়ে দে, কেটে পড়ি, আজ আবার অগর যেতে হবে বালি আনতে। রঞ্জন ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বেরিয়ে গেল। রসিক খেরোর খাতার তেরোর পাতায় রঞ্জনের একাউন্টে সব লিখে নিল। বসন্ত এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল, একবার খাতার পাতায় উঁকি মেরে দেখল রঞ্জনের কাছে রসিকের পাওনা, এরই মধ্যে কুড়ির অংক ছাড়িয়েছে।

খাতা বন্ধ করে রসিক একটু মুচকি হাসল—দোকানটা সাতদিনেই বেশ জমেছে মাইরি। ঝটাপট মাল কাটছে। এইভাবে যদি চলে ভাবতে পারিস, বছর খানেকের মধ্যেই আর একটা নতুন কারবার ফেঁদে ফেলব। তারপর আর একটা, তারপর আরও একটা। বড় কিছুর শুরু কিন্তু ছোটতেই।

গজেন এক গ্লাস চা আর একটা কাপ দিয়ে গেল। চা-টা দুই ভাগ করে একভাগ বসন্তকে দিল, তারপর কাচের জারের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একমুঠো হাতি ঘোড়া বিস্কুট বের করে সেদিনের খবরের কাগজের ওপর ছড়িয়ে দিল।

বসন্ত এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। রসিকের কাণ্ডকারখানা দেখছিল। এক চুমুক চা খেয়ে এইবার সে মুখ খুলল—প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নাম তো রাখবি বেশ বুঝলাম, কিন্তু তোর এই দোকানদারির সাতদিনে আমদানি কটাকা হয়েছে?

কেন পুরোটাই তো আমদানি। আজ না পাই কাল তো পাব। মাসের শেষে আর কে টাকা দেবে বল। মাসের প্রথমে দেখবি শালা তহবিল উপছে পড়ছে।

বসন্তকী একটা বলতে যাচ্ছিল, বলা হল না, নিমেষে একটা লন্ডভন্ড কাণ্ড ঘটে গেল।

জগদীশ্বরবাবু একটা লাল লুঙ্গি পরে, গায়ে একটা হলদে গামছা ফেলে উগ্রমূর্তিতে দোকানের রকে এসে উঠলেন। একটা কাগজের মোড়ক দুম করে কাউন্টারের ওপর ছুড়ে ফেলে বললেন— ভেবেছ কী রসিক, রসিকতা পেয়েছ? আমি চাইলুম মানুষে খাবার বিস্কুট তুমি আমায় দিলে ডগ বিস্কুট। আমার বাচচা মেয়েটা রোজ সকালে বিস্কুট দিয়ে চা না খেলে সারাদিন সকলকে কামড়ে বেড়ায় আর আজ তোমার এই বিস্কুটের একটা খেয়েই সকাল থেকে কেঁউ কেঁউ করছে।

রসিক শিশুর মতো অবাক মুখে বলল—সে কী মেসোমশাই, এমন কেন হল। আগে কখনও কুকুরে কামড়ায়নি তো?

জগদীশ্বরবাবু মুখ ভেঙচে বললেন—আজ্ঞে না, তোমার এই বিস্কুট খেয়ে হয়েছে। আমি বলে রাখছি রসিক, ওই আমার একমাত্র মেয়ে সাত রাজার ধন এক মানিক ওর যদি কিছু হয় রসিক তোমাকে আমি হাজতবাস করাব। রসিক ইতিমধ্যে কাগজের ঠোঙা খুলে বিস্কুটগুলো কাগজের ওপর ঢেলে ফেলেছে। সেই হাতি ঘোড়া বিস্কুট। একটা বিস্কুট হাতে নিয়ে রসিক বলল—কেন কী হয়েছে মেলোমশাই, এই তো কী সুন্দর দেখতে, এই তো দেখুন না একটা খরগোশ, এই দেখুন আমি মাথাটা কামড়ে খাচ্ছি।

রসিক মাথাটা কামড়েই, মুখটা কেমন করল তারপর কোনওরকম ঢোঁক গিলে বলল—এই দেখুন ফাসক্লাস খেতে, এই তো আমি পুরোটাই খাচ্ছি। খরগোশটা তার পেটে চলে গেল। রসিক। এবার একটা হাতি তুলে বলল—এই দেখুন এটাকে আমি পুরো একগালে খাব। বলেই হাতিটা মুখে ফেলে মনে হল বেশ বেকায়দায় পড়েছে। খরগোশ ছিল নিরীহ প্রাণী, হাতি যেন মত্ত মাতঙ্গের মতো তার মুখের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় গুঁতোগুতি করতে করতে অবশেষে গলার গর্ত গলে উদরে চলে গেল। রসিককে তখন যথার্থই কাবু দেখাচ্ছে। তবুও সে ছাড়ার পাত্র নয়। এবার একটা কচ্ছপ হাতে নিয়ে বলল—এই দেখুন এটাকেও, এটাকেও আমি সাবড়ে দিচ্ছি। বিস্কুটটা হাতে নিয়ে বেশ বোঝা গেল সে একটু ইতস্তত করছে, তারপর একেবারে মরিয়া হয়ে সেটাকে মুখে পুরে ট্যাবলেট গেলার মতো গিলে নিল। গিলে নেওয়ার পর সে মুখ তুলে তাকাল, মুখে একটা অদ্ভুত করুণ হাসি, তারপরই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল রসিকের সমস্ত মুখটা কালো হয়ে গেল, দানবের মুখোশের মতো একটা অসাধারণ বিকৃতি ফুটে উঠল, তারপর একটা ওয়া শব্দ করে হুড়হুড় করে বমি করে ফেলল। জগদীশ্বরবাবু একলাফে চাতাল থেকে রাস্তায় পড়লেন, পড়েই বসন্তকে বললেন বসন্ত, ও বোধহয় বেশিক্ষণ বাঁচবে না। যদি মরে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচবে, আর যদি বাঁচে তাহলে ফাঁসিতেই মরবে। আমি এখন চললুম, দেখি আমার বাড়িতে আবার কী হচ্ছে।

বসন্তর পাঞ্জাবিতে বমির ছিটে লেগেছিল। রসিক ইতিমধ্যে টুলে বসে পড়েছে, মাথাটা লটকে পড়েছে কাউন্টারে। সামনে ছড়ানো বিস্কুট বমিতে ভাসছে। বসন্ত দুবার রসিক রসিক বলে ডাকল, কোনও সাড়া পেল না। মহা মুশকিল, রসিকের বাড়িতে খবর দিতে হবে; কিন্তু খোলা দোকানে কাউকে রেখে যাওয়া উচিত, তা না হলে মালপত্র সরে যাবার সম্ভাবনা। এই সময়। রসিক একবার ধনুকের মতো বেঁকে উঠল। গলা দিয়ে জেট প্লেনের মতো একটা আওয়াজ বেরোল।

বসন্তকে বেশিক্ষণ চিন্তা করতে হল না। কাপড়ের ওপর গামছার পাক মেরে আদুল গায়ে ভুড়ি ফুলিয়ে ভূষণ গোয়ালা এসে হাজির হল। তারও মারমূর্তি। বসন্ত আসতে আসতে জিগ্যেস করল–কী হয়েছে কী?

–কী হয়েছে? এখন কটা বাজে?

—প্রায় নটা।

—আমি সেই সকাল থেকে, ভোর পাঁচটা থেকে চেষ্টা করছি, এখনও পারলুম না।

—কী পারলে না?

—দুধ গুলতে পারলুম না। কাল রসিকের কাছ থেকে পাঁচশো মিল্ক পাউডার কিনেছিলুম, কার বাবার সাধ্য তাকে জলে গোলে! শালা, সমস্ত গুড়ো ভুসির মতো জলে ভেসে বেড়াচ্ছে আমরা বাপ-বেটায় মিলে চেপে ধরেও শালাদের ডোবাতে পারছি না, ফসফস করে পালাচ্ছে, আর ভেসে উঠছে। এটা কি দুধ? চালাকি পেয়েছ, আমরা চারটে দামড়া ঝাড়া চার ঘণ্টা হিমসিম খেয়ে। গেলুম; খদ্দের গেল, ইজ্জত গেল। এতক্ষণ রাগের চোটে কথা বলছিল। রসিকের দিকে নজর পড়েনি। হঠাৎ সামনে গড়ানো বমি আর তার পেছনে রসিকের লটকানো মুণ্ড দেখে ভূষণ লাফিয়ে উঠল—ছিঃ ছিঃ একি কাণ্ড! রাম রাম, সকালেই মাল খেয়ে, লুটোপুটি খাচ্ছে।

বসন্ত বললে—না না মাল খাবে কেন? হঠাৎ গা গুলিয়ে বমি করে ফেলেছে।

গা গুলিয়ে, তার মানে দোক্তা খেয়েছে?

না না দোক্তা নয়, গোটাকতক বিস্কুট খেয়েছিল, তাই খেয়ে!

বিস্কুট, ওই বিস্কুট, কী সর্বনাশ আমিও যে ওই বিস্কুট নিয়ে গেছি। কী মুশকিল। দেখি বাড়ি গিয়ে কেউ খেয়ে মরেছে কি না!

ভূষণ উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োল বাড়ির দিকে।

বসন্ত ভাবল ফাঁড়া কেটেছে। রসিকের সেই এক হাল, মাঝে মাঝে ধনুকের মতো বেঁকে উঠছে, আর গর্জন করছে। বসন্তর একবার মনে হল, কী এমন বিস্কুট, একটা খেয়ে দেখলে হয়। তারপর ভাবল দরকার নেই, রসিকের মতো হলেই মুশকিল। রসিককে দেখে মনে হল তার পেটের মধ্যে প্যাটন ট্যাঙ্ক চলেছে।

এর মধ্যে কখন রাখালবাবু এসে দাঁড়িয়েছেন বসন্ত লক্ষ করেনি।

এই যে বাবা বসন্ত, ব্যাটাকে শেষ করে দিয়েছ দেখছি। জানতুম ওইভাবেই একদিন অপঘাতে মরবে। পাড়াঘরে দোকান, বলি অ্যাাঁ, লোকঠকানো কারবার আর ক-দিন চলবে!

কী বলছেন আপনি? শেষ করব কেন, রসিক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

অসুস্থ, ও সুস্থ ছিল কবে? রাখালবাবু একটা জলে ভেজা সাবান বের করে বললেন—বাবা বসন্ত, এটা কী?

সাবান জ্যাঠামশাই।

কোথা থেকে কিনেছি? এই দোকান থেকে।

কী হয়েছে কী আপনার সাবানে?

আমার সাবান? রসিকের, রসিকের সাবান বাবা। জলে দিতেই শালা কেবল হলদে রং ছাড়ছে, সাবান ছাড়ছে কই?

হঠাৎ রাখালবাবু প্রচণ্ড রেগে চিৎকার করে বললেন—ভেবেছে কী রাসকেল? আমি ওর বাপের চেয়ে বয়সে দশ বছরের বড়, আমার পাঞ্জাবি গেল, গেঞ্জি গেল, আন্ডারওয়্যার গেল, শালা যেন জন্ডিসের রুগি, সব হলদে। চোখে সরষে ফুল দেখিয়ে দিলে!

বসন্ত ভয়ে ভয়ে সাবানটা হাতে তুলে নিল, জিনিসটা কী ভালো করে দেখার জন্যে। রাখালবাবু বললেন—ও মাল তোমার বোঝার ক্ষমতা নেই। তুমি কি কেমিষ্ট? এ হল রসিকের কারখানায় তৈরি।

বসন্ত রাখালবাবুকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করল—জ্যাঠামশাই, এটা রেখে আপনি বাড়ি যান। রসিক একটু সুস্থ হলেই আপনাকে সব জানাব। এখন আর ওকে গালাগাল দেবেন না।

মানে? সাবান রেখে বাড়ি যাব। তুমি ভেবেছ অত বোকা লোক আমি! আমি এই মাল নিয়ে থানায় যাব, আর তোমাকেও আমি ফাঁসাব। এডিং এন্ড এবেটিং এ ক্রাইম।

বসন্ত এতক্ষণ মেজাজ ঠিক রেখেছিল, আর পারল না, তেরিয়া হয়ে বলল—যান যান যা পারেন করে নিন। নিজেও তো একেবারে ধোঁয়া তুলসীপাতা। রেশনের দোকানের মাল পাচার করে দু পয়সা করেছেন, ভেবেছেন সব কিনে নিয়েছেন।

কী বললি!

বললি নয় বললেন।

তাই নাকি ছোকরা?

পন্টু কোথায় যাচ্ছিল সাইকেলে করে, ঝগড়া দেখে নেমে পড়ল।

কী হয়েছে রে বসন্ত। রাখাল শালা কী পিড়িক মারছে?

রাখালবাবু পন্টুকে দেখে ফ্যাকাশে মেরে গেলেন। পন্টু পাড়ার উঠতি মস্তান। রাখালবাবু কোনওমতে পালাতে পারলে বাঁচেন। রাখালের নাড়িনক্ষত্র পন্টুর জানা। পন্টু মুখের কাছে ডান হাতটা গোল করে লাগিয়ে পলাতক রাখাল সাধুখাঁকে একটা পুঁক দিল। এইবার চোখ পড়ল। রসিকের দিকে—এ কী রে, শালার এ কী অবস্থা? অ্যাঁ! উলটি কিয়া হায়। রসিকের মাথায় একটা গাট্টা মারল। মাথাটা ডান দিক থেকে বাঁ দিকে কাত হয়ে গেল।

কী করে এরকম হল রে? শালার যা অবস্থা যমেও ছোঁবে না।

বিস্কুট খেয়ে।

বিস্কুট! না খেলেই পারত। পেটে যখন সহ্য হল না।

খাব বলে খায়নি। খাবার ডেমনসট্রেশান দিচ্ছিল।

এখন যা হয় কিছু কর। চল চ্যাংদোলা করে পুকুরে চুবিয়ে আনি।

কী দরকার। মরে গেলে হাতে দড়ি। ও শালার বিস্কুটে নির্ঘাত কিছু আছে মাইরি। বোধহয় ডগ বিস্কুট।

—কী বিস্কুট দেখি? পন্টু হাত বাড়িয়ে কাচের জার খুলে একটা বিস্কুট তুলে নিল। বসন্ত হাঁ হাঁ করে উঠল—খাসনে পন্টু। একসঙ্গে জোড়া খাট আমি সামলাতে পারব না।

—দাঁড়ানা, কী মাল একবার মুখে দিয়ে দেখি। কী আর হবে। আমরা শালা যমেরও অরুচি। বসন্তর হাঁ-করা দৃষ্টির সামনে পন্টু টকাস করে একটা ক্যাঙ্গারু বিস্কুট মুখে ফেলে দিল। বিস্কুটটা এক সেকেন্ড মুখে রইল, তারপর পন্টু থু থু করে ফেলে দিয়ে ধেই ধেই করে নাচতে লাগল— শালা জানে মারা জানে মারা। প্রথমে দুপায়ে নাচছিল, তারপর এক পায়ে। মুখে হিন্দি ছবির গান—দিল মে চাকু মারা, হায় হায় ইয়াহু জনি মেরা নাম, হয় মারো হায় মারো। তারপর ফাটা রেকর্ডের মতো—মারো মারো মারো মারো করতে করতে টুইস্ট নাচতে লাগল আর মুখ-চোখ। জঙ্গলী ছবির শাম্মীকাপুর যেভাবে বিকৃত করেছিল সেইরকম করতে লাগল।

বসন্ত প্রথমে ভেবেছিল পন্টু ইয়ার্কি করছে, কিন্তু পন্টু যখন নাচতে নাচতে তিন ভাঁজ হয়ে পড়ে গেল, বসন্ত বুঝল ব্যাপার সিরিয়াস।

রসিকের দোকান থেকে বিশ গজের মধ্যে একজন ডাক্তার ছিলেন। যাঁর রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ফায়ার বিগ্রেডের কর্মী। বসন্ত হাতে-পায়ে ধরে সেই ভদ্রলোককে নিয়ে এল। বৃদ্ধ মানুষ, খিটখিটে চেহারা। প্রথমে দশ পা দূর থেকে ঝুঁকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেন, তারপর পকেট থেকে চশমা বের করে নাকের ডগায় লাগিয়ে বসন্তকে জিগ্যেস করলেন—বমির রংটা কীরকম হে, সরষের তেলের মতো, না মাছের পিত্তির মতো, না সাপের বিষের মতো?

বসন্ত বলল—হলদে হলদে।

পন্টু এদিকে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে, কাউন্টারে ঠেসান দিয়ে চোখ বুজিয়ে ক্রমান্বয়ে বলে চলেছে—ওরে বাবা মর গিয়া, ওরে বাবা মর গিয়া।

ডাক্তারবাবু পন্টুর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচে বললেন—এটা আবার কে? কেত্তন গাইছে না কি? দোহার দিচ্ছে। মূল গায়েন ওপরে মূৰ্ছা গেছে দোহারি ভাবের ঘোরে নীচে গড়াগড়ি; অ্যাাঁ। একেবারে নদের লীলা। তা, কী করে হল?

বসন্ত বলল—বিস্কুট খেয়ে।

সর্বনাশ, বিস্কুট খেয়ে? বলো কী হে? পয়েজনিং। দেখো তো মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে কি না?

বসন্ত বলল—আমিই যদি সব দেখব তা আপনাকে ডাকব কেন?

দেখবে না মানে? রোগী আমার না তোমার? আমার ই.এস.আই. আছে আমি পরোয়া করি না

কারওর।

আহা রাগছেন কেন? এই কি রাগ করবার সময়। বসন্ত সেই বুড়ো ডাক্তারকে একটু তোয়াজ করার চেষ্টা করল।

—শোনো, কী নাম তোমার? ও হ্যাঁ বসন্ত। শোনোবসন্ত, কেস খুব সিরিয়াস। আমার চিকিৎসার বাইরে। এ পেনিসিলিন-মেনিসিলিনে কিছু হবে না। কাফ মিক্সচার দিলেও যে হবে না সেটুকু জ্ঞান আছে। ক্রিমি থেকে বমি হলে আমি হেলমাসিড কি এন্টিপার দিতে পারতুম। মেয়েরা পোয়াতি হলে অনেক সময় বমি করে, এ সে কেসও নয়। বুঝেছ? ব্যাপারটা আসলে খুব জটিল। জলে ডোবা কেস হলেও কিছু করতে পারতুম, কারণ সে ট্রেনিং আমার আছে। পুড়ে গেলেও একটা যা হোক ব্যবস্থা হত—

বসন্ত বলল—সব বুঝেছি, এখন কী হবে তাই বলুন?

আরও বমি করতে হবে। হুড়মুড় করে বমি করতে হবে। বমি করে সব ভাসিয়ে দিতে হবে। বুঝেছ? তবেই পেট থেকে সব বিষ বেরিয়ে যাবে। শোনো তাহলে বলি, একটা ছোট্ট যৌগিক প্রক্রিয়া। তুমি শিখে রাখতে পারো, কাজে দেবে। আমরা করতুম যৌবনকালে।

পন্টু হঠাৎ দুম করে একটা লাথি ছুড়ে বলল—শালাকে হাটা। আর সহ্য হচ্ছেনা-আ-আন— বাবারে মর গিয়া।

ডাক্তারবাবু একলাফে পিছিয়ে গিয়ে, পন্টুর দিকে ঝুঁকে পড়ে, ব্যান্ড মাস্টারের মতো হাত নেড়ে নেড়ে বলতে লাগলেন বমি করো, বমি করো, আরও করো, বমিতেই মুক্তি, বমিতেই ধৌত।

পন্টু হঠাৎ তার ঘোরের মধ্যে লাফিয়ে উঠল—তবে রে শালা।

ডাক্তারবাবু আর এক ধাপ পিছিয়ে গেলেন শোনো বসন্ত, আমরা যৌবনকালে খুব খেতুম। আমি অক্ষয় হরিচরণ সব ডাকসাইটে খাইয়ে ছিলুম। বুঝেছ। এক বালতি লেডিকেনি, এক বালতি পোলাও, ষাটখানা মাছ, ওসব আমাদের কাছে নস্যি ছিল, নাথিং। তবে কী হত জানো? মাঝে মাঝে সকালে মানে একেবারে প্রাতঃকালে একটু-আধটু অম্বল হত, অম্বল অম্বল, আর কি? একটু চোঁয়া ঢেকুর ডুকরে উঠল। তখন আমরা এই প্রক্রিয়াটা করতাম, অব্যর্থ, সঙ্গে সঙ্গে ফল। জল খেতুম, এক গেলাস, দু-গেলাস, তিন গেলাস। পারছি না তাও আর এক গেলাস, আকণ্ঠ জল খেয়ে নর্দমার কাছে গিয়ে, সামনে এইভাবে ঝুঁকে, এই যে দেখো, এইভাবে ঝুঁকে গলায় এই। আঙুল, এই যে মধ্যমা আর তর্জনী সাঁদ করিয়ে দিয়ে সুড়সুড়ি দিতুম, একবার দুবার তিনবার, সঙ্গে সঙ্গে বমি, ওয়াক করে ব-ব-ব—

বলতে বলতেই ডাক্তারবাবু হুড় হুড় করে সত্যি সত্যি বমি করে ফেললেন। বমি করেই বসে। পড়লেন—ওরে বাবা রে, আমার মাথা ঘুরছে রে, ওই বমিটা দেখেই আমার গা গুলিয়ে গেল রে, আমার আবার হার্ট আছে রে!

ডাক্তারবাবু আবার বমি করলেন।

বসন্ত! ডাক্তার ডাকো বাবা। অ্যাম্বুলেন্স আনতে দেরি করে, তুমি বরং আমার নাম করে ফায়ার ব্রিগেডে ফোন করো, দমকলই আসুক। আগে হোসপাইপের জল দিয়ে আমাদের পরিষ্কার করে দিক। ওরে বাবা রে আমার ঘেন্না করছে রে।

ব্যাপার-স্যাপার দেখে বসন্তর চোখ কপালে উঠল। ছিল রসিক, এল পন্টু। যেমনই হোক একজন ডাক্তার এনেছিল, সেই ডাক্তারও কাত! সংক্রামক ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেল। বসন্ত ভাবছে কী করা যায়! বেলা বাড়ছে, সামনে বমিতে মাছি বসছে। রসিকের কী হল কে জানে? হয়তো মরেই গেল।

মরেনি, শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে। তাছাড়া বসন্তই বা কতক্ষণ আটকে থাকতে পারে। সকালে রসিকের দোকানে আড্ডা মারতে এসে, এ কী ফ্যাসাদ!

এমন সময় কুশলা এসে হাজির হল। রসিকের দোকানের সামনে হলুদ রঙের দোতলা বাড়ির ওপরের তলায় কুশলা থাকে। স্কুল ফাইনাল পাস করার পর নার্সিং-এর ট্রেনিং নিচ্ছে। কুশলা দোকানে পা রেখেই বলল—এ কী ব্যাপার?

পন্টু জড়িয়ে জড়িয়ে উত্তর দিল—আমরা মরে গেছি। আমাদের গলা জ্বলছে, বুক জ্বলছে, গলা জ্বলছে, বুক জ্বলছে

কুশলা বসন্তর দিকে তাকাল, ইশারায় প্রশ্ন করল—ব্যাপারটা কী?

বসন্ত কুশলাকে প্রথম থেকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। কুশলা বলল—তাহলে তো এখুনি কিছু করতে হয়। আমি এইমাত্র হাসপাতাল থেকে আসছি। চলুন সেখানেই নিয়ে যাই তাহলে। বসন্ত বলল—সবই তো হবে কিন্তু এই ডাক্তারের ডাক্তারি কে করবে?

ও কিছু নয়। চলুন ওঁকে পৌঁছে দিই আগে বাড়িতে। ওই তো ডিসপেন্সারির ওপরেই থাকেন। একটু শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে।

দোকানের এককোণে একটা ছেঁড়া কাগজের বাক্স পড়েছিল, বসন্ত তাইতে মোটামোটা করে লিখল—বিক্রয় বন্ধ।

কুশলা বলল—ওসব করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। কে আসবে এ দোকানে। একমাত্র ধারের খদ্দের ছাড়া। আর একটা সুবিধে ক্যাশেও কোনও টাকা নেই কারণ এ দোকানে লেখাই আছে— নগদে জিনিস কিনিয়া লজ্জা দেবেন না। কুশলার সুনিপুণ ব্যবস্থায় শেষ পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে গেল। অ্যাম্বুলেন্স এল, দমকল নয়। পন্টু আর রসিক হাসপাতালে গেল। কুশলা নিজের হাতে কাউন্টার সাফ করে, ফিনাইল দিয়ে দোকান পরিষ্কার করে বন্ধ করে আবার চলে গেল হাসপাতালে। বসন্তও রইল সঙ্গে সঙ্গে।

হাসপাতালে পুলিশ এল। পয়জনিং কেস। মারাত্মক কিছু একটা বিস্কুটে ঢুকেছে। বিস্কুটের স্যাম্পল সিজ করা হল।

সন্ধের দিকে জানা গেল রসিকের নামে ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে। রসিক নিজেকেই নিজে বিষাক্ত বিস্কুট খাইয়েছে। ওই হাসপাতালে অন্তত আরও তেরোটা ওই একই জাতীয় কেস এসেছে।

রসিক তখন একটু সামলেছে। কুশলাকে বলল—আমাকে এখানেই রাখার ব্যবস্থা করো। ছেড়ে দিলেই পুলিশে ধরবে।

পুলিশে না ধরুক, জনসাধারণ যার অন্য নাম পাবলিক তারাই পিটিয়ে মারবে। এখন আর ও নিয়ে মাথা ঘামিও না, আপাতত ঘুমোবার চেষ্টা করো। আমরা কাল সকালে আবার আসব। মাথার বালিশটা ঠিক করে দিয়ে কুশলা চলে গেল।

থানার বড়বাবু বললেন—রসিকবাবু, আপনি কী বলে জেনেশুনে ওই বিস্কুট বিক্রি করলেন? আপনি জানেন এই এলাকায় একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার খুব পাবলিসিটি হয়ে গেছে।

আরও হবে, যখন আপনি জেলে যাবেন। কিন্তু আমি জেলে যাবার আগে স্যার ওই প্রহ্লাদ যাবে। বিস্কুট আমি প্রহ্লাদের বেকারি থেকে কিনেছিলুম।

প্রহ্লাদবাবু কিছু বলার আছে?

প্রহ্লাদের গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, ঢোঁক গিলে বলল—স্যার আমি নাবালক। গোঁফটাই বেরিয়েছে, বুদ্ধি পাকেনি।

তার মানে?

মানে স্যার পৃথিবীতে যত বড় বড় মূখ জন্মেছে আমি তাদের মধ্যে একজন।

এই হল আপনার কনফেশান?

ইয়েস স্যার।

একটু ব্যাখ্যা করুন।

যেমন ধরুন আমি একটা বেকারি করেছি। তৈরি করি রুটি আর সস্তার বিস্কুট। আমার তৈরি রুটি স্যার চলে বেড়ায়। যেমন ধরুন টেবিলের এইখানে রাখলুম কিছুক্ষণ পরেই দেখবেন ওই ওইখানে হেঁটে হেঁটে চলে গেছে।

বাঃ বাঃ ভারী সুন্দর তো। ঐন্দ্রজালিক রুটি। আপনার রুটি তাহলে ম্যাজিশিয়ানরা কেনে?

না স্যার কেনে না। কেউ কেনে না বলেই হেঁটে হেঁটে নিজেরাই খদ্দেরের দিকে চলে যেতে চায়। রুটি তৈরির পর পড়ে থাকে—একদিন, দুদিন, তিনদিন, রুটিদের গায়ে স্যার লোম বেরোয়, আর নীচের দিকে ছোট ছোট পা, সারা কারখানায় তারা গুটি গুটি হাঁটে।

আর বিস্কুট?

বিস্কুট স্যার একবারই তৈরি হয়েছিল। বিস্কুটের ফর্মুলায় স্যার একটু গোলমাল হয়ে গেছে। বিস্কুটে অ্যামোনিয়াম-বাই-কার্বনেট দিতে হয়। আমি ভুল করে অ্যামোনিয়াম ফসফেট দিয়ে ফেলেছিলাম। অ্যামোনিয়াম ফসফেট হল সার। ভেবেছিলুম সারবান বিস্কুট স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালোই হবে। গাছেরা ওই সার খেয়ে কেমন হৃষ্টপুষ্ট হয়। মানুষও তাই হবে। কিন্তু স্যার এত তেজি হয়েছে যে সহ্য হল না।

বাঃ বাঃ বাঃ। প্রহ্লাদবাবু আপনাকে অতিথি হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত। রসিক আর কুশলা থানা থেকে বেরিয়ে এল।

দুজনে পাশাপাশি হেঁটে থানার কম্পাউন্ড অতিক্রম করে রাস্তায় এসে পড়ল। রাস্তায় দুজনে পাশাপাশি চুপচাপ হাঁটল কিছুক্ষণ। তারপর কুশলা হঠাৎ তাড়াতাড়ি দু-কদম এগিয়ে গিয়ে। রসিকের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল—দাঁড়াও। রসিক দাঁড়িয়ে পড়ল। কুশলা রসিকের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে একটু মুচকি হাসল; হেসে বলল–না!

কী না?

হবে না। ব্যবসা হবে না। তোমাকে আমি একটা নার্সারি করে দেব। ছোট ছোট কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে সারাদিন বেশ থাকবে। মাঝে মাঝে ম্যাজিক দেখাবে, হেঁটে বেড়ানো রুটি, জ্যান্ত বিস্কুট, ভেসে। বেড়ানো দুধ। মজায় থাকবে মজায় রাখবে।

তাতে তোমার একটু সুবিধে হবে, তাইনা। নিজের বাচচাকেও আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে সারাদিন নেচে বেড়াবে।

যাঃ ভারী অসভ্য।

দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *