4 of 8

পৃথিবী

পৃথিবী

ধাঁধা অনেক রকমের হয়।

এক ধরনের ধাঁধা আছে যার প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর নিহিত। যেমন প্রশ্ন ছিল, সূর্যমুখীর বাপের বাড়ি কোন নগর? উত্তর কোন্নগর।

আমাদের বাল্যবয়সে ঠিক এ রকম আরেকটা মজার ধাঁধায় প্রশ্ন ছিল, পৃথিবীটা কার বশ?

খুব সহজ এর উত্তর। সোজা, সরল জবাব, পৃথিবী টাকার বশ। পৃথিবীটা ‘টা’ ‘কার’ শব্দের সঙ্গে ‘টাকার’ হয়েছে।

টাকার প্রসঙ্গে একালে এ রকম ধাঁধা আর রচিত হবে না, টাকার দিন আপাতত শেষ হয়ে আছে।

এখন ডলার, ইউরো ভলার, পাউন্ডের দিন। আমরা জ্ঞানত দেখেছি, এক ডলার পাঁচ টাকা, এক পাউন্ড পনেরো-ষোলো টাকা। এখন ডলারের দাম চল্লিশ পেরিয়ে ধীরস্থির পদক্ষেপে পঞ্চাশ টাকার দিকে এগোচ্ছে। বাংলাদেশি টাকা, পাকিস্তানি রুপি, ইন্দোনেশীয় রুপেয়া, তাদের অবস্থা আরও খারাপ।

টাকার সঙ্গে পৃথিবীর একটা মিল আছে। দুই-ই গোলাকার। কাগজের নোটের যুগে গোলাকার টাকার মুদ্রা অবশ্য অদৃশ্য হয়েছিল। এখন আবার সগৌরবে গোল মুদ্রা এসেছে। বরং এক টাকা, দু’টাকা, পাঁচ টাকার নোট বিদায় নিয়েছে।

শুধু গোলাকার নয়। টাকা আর পৃথিবী দুই-ই গোলমেলে। একদা এক বিশপ বলেছিলেন, এই পৃথিবীটা চৌকো আর গোল গর্তে ভর্তি। মানুষেরাও স্বভাবত চৌকো এবং গোল আকারের। অসুবিধে হল উক্ত বিখ্যাত বিশপের ভাষায়, গোলাকার লোকেরা চৌকো গর্তে, আর চৌকো লোকেরা গোল গর্তে রয়েছে। তাই এত গোলমাল।

এ বিষয়ে আমাদের গঙ্গারামের অভিজ্ঞতাও স্মরণীয়।

গঙ্গারাম সরকারি চাকরি করে। পে-কমিশনের দৌলতে তার মাইনে অনেকটা বেড়েছে। তার চেয়েও বড় কথা হাতে একটা থোক টাকা পেয়েছে, এরিয়ার অর্থাৎ বকেয়া পাওনা হিসেবে।

নিউ মার্কেটের সামনের রাস্তায় বড় বড় দরজির দোকান, কোনওটা বহুকালের পুরনো। সেই সেকালের সাহেব সুবোদের জামাকাপড় বানাত তারা।

বহুকাল গঙ্গারামের শখ ছিল নিউ মার্কেটের ওখান থেকে একটা স্যুট বানানোর।

অবশেষে এবার কিছু কাঁচা পয়সা হাতে পেয়ে নিউ মার্কেটের সামনে বার্ট্রাম স্ট্রিটের একটা প্রাচীন দোকানে একটা স্যুট বানাতে দিল।

বৃদ্ধ দরজি, তাঁর ঠাকুরদা চার্লস টেগার্টের কোট বানাতেন। তাঁর বাবা ডাক্তার বিধানচন্দ্রের নীচে-ওপরে চার পকেট শার্ট বানাতেন। তিনি উত্তমকুমারের গলাবন্ধ কোট বানিয়েছেন। সেই বৃদ্ধ ছাব্বিশ রকম মাপ নেওয়ার পর গঙ্গারামকে বললেন, ‘সামনের মাসের মাঝামাঝি এসে একবার ট্রায়াল দিয়ে যাবেন।’

গঙ্গারাম বিস্মিত হল, ট্রায়াল দিতে যদি এক মাসের বেশি লাগে তা হলে কোট প্যান্ট হাতে পেতে দেড়-দু’মাস লেগে যাবে! সেটা ছিল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। গঙ্গারাম হিসেব করে দেখল কোট পেতে পেতে জানুয়ারি শেষ হয়ে যাবে।

অর্থাৎ কলকাতার শীত কাবার, এ বছর আর ওই সাধের স্যুট পরা হবে না।

দরজি প্রবীণ ও রাশভারী। অনেক ভেবে চিন্তে গঙ্গারাম তাঁকে বলল, ‘দেখুন, এই এত বড় পৃথিবীটা বানাতে ভগবান মাত্র ছয় দিন সময় নিয়েছিলেন। আর আপনি একটা স্যুট বানাতে দেড় মাস সময় লাগিয়ে দেবেন।’

দ্বিধাহীন কণ্ঠে বদ্ধ বললেন, ‘ওসব শাস্ত্রের কথা শুনেছি। কিন্তু ভগবানের তৈরি পৃথিবীটার হাল কী হয়েছে দেখেছেন। আপনার কোট-প্যান্টের ওই রকম হাল হলে আপনি আমাকে ছেড়ে কথা বলবেন?’

সত্যি সাম্প্রতিক পৃথিবীটার হাল ভাল নয়। শোষণ-দূষণ-দারিদ্র্য-যুদ্ধ, পৃথিবীর এখন শোচনীয় অবস্থা। পঞ্চাশ বছর আগে যে তরুণ কবি এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি আজ স্বপ্ন দেখারও সাহস পেতেন না।

এদিকে সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র, কেন যে কী, কী সে উপকার, কী সে ক্ষতি। যিনি যাই বলুন, কোনও অঙ্কই ঠিকঠাক মেলে না।

একদল ডাক্তার মানুষকে বেশি করে হাসতে বলছেন, তাতে নাকি মন ও শরীর ভাল থাকবে। অন্য এক দল বেশি করে কাঁদতে বলছেন, মন ও শরীর ভাল থাকবে।

আবহাওয়াবিদরা পৃথিবীর পরিণাম নিয়ে চিন্তিত। এক দল বলছেন, পৃথিবী ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, অন্যেরা বলছেন পৃথিবী ক্রমশ গরম হয়ে যাচ্ছে।

ধনতন্ত্র-সমাজতন্ত্র, হাসি-কান্না, ঠান্ডা-গরম জানি না, কিন্তু আমি এটুকু জানি যে, এই পৃথিবীতে আমরা আর তেমন ভাল নেই। শরীর ভাল নেই। মন ভাল নেই।

এই সোনালি শরতে শেফালি-ঝরা সকালবেলাতে একথা বলতে ভাল লাগছে না, তবু সত্যি মন ভাল নেই।

হে পৃথিবী, হে আদি জননী বসুধা, তোমার সন্তানসন্ততি ভাল নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *