বন্ধু

বন্ধু

দুটো দিন কাটতে-না-কাটতেই দীপের বেজায় একঘেয়ে লাগতে থাকে। মা আর মাসির সঙ্গে দীপ দাদু-দিদার কাছে বেড়াতে এসেছে। সঙ্গে এসেছে দীপের দিদি টিংকু আর মাসতুতো দিদি পিংকু। দীপের বয়স বারো। পিংকু-টিংকুর বয়স পনেরো-ষোলো।

দীপের দাদু-দিদা থাকেন মেদিনীপুরে এক গ্রামে। একসময় ওই অঞ্চলের জমিদার ছিলেন এই চৌধুরীরা। এখন জমিদারি নেই বটে তবে পুরনো দাপট আর ঐশ্বর্যের রেশ বেশ খানিকটা রয়ে গেছে।

বিশাল তিন-মহলা চৌধুরীবাড়ি এখন খাঁ খাঁ করে। মহলগুলি দোতলা। একতলা দোতলায় সার সার ঘরের পর ঘর বন্ধ। সামনে টানা রেলিং দেওয়া বারান্দা। ছোটোখাটো ফুটবল মাঠের মতো গোটা তিনেক ছাদ। সব নিঝুম, বিশেষত দোতলার অংশগুলি। এখন এ বাড়িতে চৌধুরী বংশের স্থায়ী বাসিন্দা বলতে কেবল দীপের দাদু ভবানন্দ চৌধুরী, দিদিমা, আর দাদুর এক ছোটো ভাই। এছাড়া আছে একপাল কাজের লোক। দীপের মা মাসি মামা অনেকবার চেয়েছেন, দীপের দাদু-দিদাকে নিজেদের কাছে শহরে নিয়ে রাখতে। কিন্তু দাদু-দিদা রাজি হননি। শহরে নাকি তাঁদের দমবন্ধ হয়ে আসে। এতকাল খোলা হাওয়ায় বাস।

দীপের মা-মাসি-মামা আর তাদের জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোনরা একটু বড়ো হতেই এ গ্রাম ছেড়ে শহরে হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করেছে। বাড়ি অবশ্য আসত তখন ছুটিতে ছুটিতে। এখন আবার অনেক দিন ধরে শহরে বাস করার ফলে পুরোপুরি শহুরে হয়ে গেছে। গ্রামে আসতে তাদের আর ভালো লাগে না। নেহাতই বাবা-মায়ের টানে যেটুকু আসা।

এসব কথা দীপ তার মায়ের কাছে শুনেছে।

দীপ আগে বার তিনেক এ বাড়িতে এসেছে, কিন্তু রাতে থাকেনি। দিনে কয়েক ঘণ্টা মাত্র কাটিয়ে ফিরে গেছে।

এ গ্রামে তো আগে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। লন্ঠন আর হ্যাজাকই ভরসা ছিল অন্ধকারে। ফাঁকা বিরাট বাড়িটা তখন সন্ধের পর বড্ড ভুতুড়ে ঠেকত। শহরবাসী মা মাসি মামারা তাই এলেও রাত কাটাত না। দিনে দিনে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে ফিরে যেত। ছোটো ছেলেমেয়েদেরও আনত না সবসময়। একদিনে এতখানি আসা-যাওয়ার ধকল তো কম নয়।

বছর খানেক আগে এ গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। চৌধুরীবাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নিয়েছে! ফলে অন্ধকারে ছমছমানি অনেকটা কমেছে। গরমে পাখা ঘোরার ব্যবস্থা হয়েছে। তাই এবার ছেলেমেয়েদের স্কুলে গরমের ছুটি পড়তে মা মাসি এসেছেন— বাবা-মায়ের কাছে কটা দিন কাটিয়ে যেতে। সঙ্গে ছেলেমেয়েদেরও এনেছেন।

সকালসন্ধে দীপ খানিক সময় ক্লাসের হোমটাস্ক করে। বাকি সকাল আর বিকেল যেন তার কাটতে চায় না। বিশেষত বিকেল বেলাটা।

মা বলেন, ‘দিদিদের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেল।’

—‘দূর দূর, ওদের সাথে খেলা মোটে জমে না।’

বাড়ির ভিতরে পাঁচিল ঘেরা বাঁধানো উঠোনে কায়দা করে ব্যাডমিন্টনের নেট টাঙানো হয়েছে। দিদিরা র‍্যাকেট হাতে কেডস মোজা স্কার্ট পরে খেলতে চায় বটে, কিন্তু খেলে কতটুকু? দীপের সঙ্গে দু গেম খেললেই তারা বেদম হয়ে পড়ে। তখন রেস্ট চাই। বসে বসে জিরোয়। অমনি শুরু হয় তাদের নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব। মাঝে মাঝে হি হি হু হু হাসি। উঠে যে ফের খেলবে, তার কোনো চাড়ই নেই। একে তো দুই দিদিই অতি বাজে খেলে, তার ওপর দু-এক গেম খেলেই রেস্ট। সকালে যদি বা কিছুক্ষণ খেলে, বিকেলে দিদিরা খেলেই না প্রায়। কেবল ছাদে বেড়ায় আর আড্ডা দেয়। বেজার হয়ে দীপ আর খেলতে চায় না দিদিদের সঙ্গে। তার চেয়ে একা একা ঘোরা ভালো।

গ্রামের ছেলেরা ফুটবল খেলে মাঠে। মাঠটা গ্রামের সীমানায়। চৌধুরী বাড়ি থেকে দূরে। দীপের ইচ্ছে ছিল যে ওদের সঙ্গে গিয়ে ফুটবল খেলে। সে ক্লাবে আর ক্লাস টিমে চান্স পায় ফুটবলে। কিছু কায়দা দেখাতে পারত গাঁয়ের ছেলেদের। কিন্তু মা বারণ করলে, ‘না না, ওদের সাথে খেলা ঠিক নয়। কী সব আজেবাজে ছেলেরা খেলে। মাঠটাও দেখেছি আমি। একদম চষা ক্ষেত। খেলতে গিয়ে পা মচকাবে। ওসব এখানকার ছেলেদের পোষায়।’

মাঠটা ভালো নয় ঠিকই। কিন্তু অতগুলো ছেলে যদি সেখানে রোজ রোজ দিব্যি খেলে, দীপ পারবে না কেন? অমন এবড়োখেবড়ো মাঠে দীপ কত টুর্নামেন্ট খেলেছে কলকাতায়।

মায়ের আসল ইচ্ছেটা বোঝে দীপ। ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে খেলা তাঁর পছন্দ নয়। এই গ্রাম একদা চৌধুরীদের প্রজা ছিল। আজও সেটা মুছে যায়নি মা-মাসি-দাদু-দিদাদের মন থেকে। তাই চৌধুরীবংশের লোকেরা আজও পারতপক্ষে মেশেন না এই গ্রামের লোকেদের সঙ্গে। শুকনো ভদ্রতা করেন বড়োজোর, কিন্তু ঘনিষ্ঠ হন না।

ওই মাঠে যারা ফুটবল খেলে তাদের কয়েকজনের বাবা মা চৌধুরীবাড়িতে কাজ করেন। চাষবাসের কাজ। ধোপা নাপিত মিস্ত্রির কাজ। তাদের ছেলেদের সঙ্গে দীপকে খেলতে দিতে মায়ের আপত্তি।

মায়ের এই মনের ভাবটা দীপের ভালো লাগেনি। কলকাতায় তাদের ক্লাস টিমে, তাদের ক্লাব টিমে যারা খেলে, তাদের বাবা মা-রা কী কাজ করে, কেউ কি তাই নিয়ে মাথা ঘামায়? যে বাড়ির ছেলেই হোক, ভালো খেললেই তার খাতির। তা এখানে তাই নিয়ে মা-মাসির এত মাথাব্যথা কেন?

বাধ্য হয়ে দীপ একদিন গ্রামে বেড়াতে বেরুলো। একা একাই। দাদু রঘুদা বলে একজনকে সঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দীপ রাজি হয়নি। ধুততেরি, আধবুড়ো রঘুদাকে নিয়ে কি বেড়িয়ে সুখ? খুটখুট করে চলে। গম্ভীর মুখ। আর দীপ কি ছেলেমানুষ যে এই ছোট্ট গ্রামে পথ হারাবে? না তাকে কেউ ধরে নিয়ে যাবে? কলকাতায় যে কত ভিড়ের বাসে চাপে। একাই চলে যায় কত দূর দূর।

একদিনেই কিন্তু দীপের গ্রামে ঘোরার শখ মিটে গেল।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গোটা গ্রাম দেখা শেষ। গাছে চড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে গাছে চড়ায় তেমন পোক্ত নয়। মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ গ্রামের ছেলেদের ফুটবল খেলা দেখল। পা নিসপিস করছিল, দূর দূর, এরা ঠিকমতো শটই মারতে পারে না। এলোপাথাড়ি পিটছে বল। ওদের কয়েকটা পাসিংয়ের কায়দা আর কিকিং দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া যেত। মনমরা হয়ে দীপ বাড়ি ফেরে।

নাঃ, একা একা গ্রামে ঘোরায় সুখ নেই। দীপ পরদিন থেকে চৌধুরীবাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরতে লাগল।

এটা বেশ রোমাঞ্চকর ঠেকল তার কাছে।

পাক খাওয়া সরু সরু সিঁড়ি দিয়ে কখনো ওঠে। কখনো নামে। নির্জন বারান্দা দিয়ে হাঁটে। এক উঠোন পেরিয়ে আর-এক উঠোনে যায়। কোনো অচেনা দরজা খোলা পেলেই সেখান দিয়ে এক নতুন জগতে যেন হাজির হয়। দোতলা তো বেবাক ফাঁকা। একতলায় কেউ কেউ সামনে পড়ে। তারা হেসে বলে— ‘কীগো খোকাবাবু, বাড়ি দেখছ বুঝি?’

তবে সব রহস্য আবিষ্কারে ভরসা হয় না। এমন সব অন্ধকার সিঁড়ি রয়েছে যে তাতে উঠতে নামতে ভয় হয়। যদি পথ হারায়! অনেক ঘুপচি আধো অন্ধকার উঠোনে উঁকি মেরে পেছিয়ে আসা।

দ্বিতীয় দিন বিকেলে এমনি ঘুরতে ঘুরতে দীপ কানুর দেখা পেল।

একতলার ভেজানো একটা দরজা ফাঁক করে বাইরে তাকিয়ে দীপ দেখল যে ঠিক সামনে চারদিক ঘেরা ছোট্ট এক টুকরো জমি। তার ভিতর দীপেরই বয়সি একটি ছেলে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে কী জানি খেলছে। আর ছেলেটার কাছে থাবা গেড়ে বসে ইয়া তাগড়াই একটা মেটে রঙের দেশি কুকুর।

অচেনা ছেলেটি প্রথমে দীপকে দেখতে পায়নি। কিন্তু কুকুরটা টের পেল। সে দীপের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে গরগর করে উঠল। অমনি ছেলেটিও খেলা থামিয়ে তাকায় দীপের দিকে। দীপ বেরিয়ে এল দরজার বাইরে। ছেলেটি মৃদু স্বরে কী জানি বলতে কুকুরটা গরগরানি থামাল বটে, কিন্তু সন্দিগ্ধ চোখে নজর রাখল দীপের ওপর।

এ জায়গাটা বাড়ির একটা সীমানা। সামনে আর দুপাশে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হাত তিরিশেক লম্বা আর প্রায় পনেরো হাত চওড়া একটা জায়গা। দাদুর বাড়ির গা দিয়ে সরু এক চিলতে টানা রোয়াক চলে গেছে। সামনে পাঁচিলের মাথা ছাড়িয়ে দেখা যাচ্ছে একটা দোতলা বাড়ি। দীপ চিনল যে ওটা তার দাদুর ছোটো ভাইয়ের মহল। ছোটোদাদু বাতের জন্য দোতলায় ওঠেন না। তাই ও-বাড়িতে দোতলাটা বন্ধই থাকে। টানা রোয়াকটুকু ছাড় দিয়ে দুপাশের পাঁচিল জায়গাটাকে আড়াল করে রেখেছে। জায়গাটার এক কোণে একটা কুয়ো। কুয়োর মুখ দুটো বড়ো বড়ো তক্তা দিয়ে চাপা। বোধহয় এই কুয়োতে লোকে চান-টান করে বা করত কখনো। তাই জায়গাটা এভাবে আড়াল করা হয়েছে। ঘেরা জায়গাটার জমি বেশ সমান। তাতে ঘাস নেই, আগাছা নেই।

এক নজরে চারিপাশটা দেখে নেয় দীপ।

ছেলেটির রং কালো। মুখখানা মিষ্টি। ভাসা ভাসা বড়ো বড়ো চোখ। এক-মাথা রুক্ষ চুল। পাতলা গড়ন। পরনে ময়লা হাতকাটা গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট। খালি পা। সে দীপের দিকে চেয়ে লাজুক হাসল। দীপের ভারি ভালো লাগল ওর হাসিটি। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খেলছিলে?’

—‘এক্কাদোক্কা।’ একটু থতমত খেয়ে মৃদু কোমল গলায় জবাব দেয় ছেলেটি।

—’ধুস। ও তো মেয়েদের খেলা। ক্রিকেট জানিস?’ বলল দীপ।

—‘না।’ ছেলেটা মাথা নাড়ে।

—‘ফুটবল?’

—‘হুঁ।’

—‘ফুটবল আছে?’

—‘না।’

দীপ ভাবল, এখন ফুটবল জোগাড় করি কোত্থেকে? তাছাড়া এইটুকু জায়গায় ফুটবল কি জমবে? আর মাত্র দুজনে?

ছেলেটা টপ করে বুঝে ফেলে দীপ খেলতে চাইছে। সে বলে ওঠে, ‘গুলি খেলবে?’

—‘গুলি? আগে তো খেলতাম। ঠিক আছে তাই খেলব। কই গুলি?’

—‘আনছি’ বলে ছেলেটা খোলা দরজা দিয়ে সুড়ুৎ করে দাদুদের মহলের ভিতরে ঢুকে যায়। কুকুরটাও লাফ দিয়ে ছেলেটার পিছু নেয়।

দাদুর বাড়ির এইদিকে নিচুতলায় একসার ছোটো ছোটো ঘর। তাদের দরজা ভিতরের উঠোনের দিকে, জানলাগুলো এপাশে বাইরের দিকে। বোঝা মুশকিল ঘরগুলোয় লোক থাকে কিনা।

দীপরা আগে যে পাড়ায় ভাড়া থাকত সেখানে ছেলেরা ফুটপাতে আর একটা ছোটো মাঠে গুলি লাট্টু খেলত। ফুটবল ক্রিকেটও চলত। বছর দুই হল দীপরা অন্য পাড়ায় নিজেদের কেনা ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে। এখানে গুলি লাট্রু খেলার চল নেই। দীপ এখন কাছেই একটা ক্লাবে ভর্তি হয়েছে। সেখানে শুধু ফুটবল ক্রিকেট খেলা হয়। গুলির টিপ তার এখন কেমন আছে কে জানে?

একটু বাদেই পোষা কুকুর সমেত ফিরে আসে ছেলেটা। তার হাতে চারটে কাচের গুলি। গুলিগুলোর অবস্থা শোচনীয়। বেশ পুরনো। খেলে খেলে গা চটে গেছে। এর চাইতে ভালো গুলি বোধহয় নেই ছেলেটার। যাহোক এতেই খেলা যাক।

দীপ জিজ্ঞেস করে, ‘তোর নাম কী রে?’

ছেলেটি বলল— ‘কানু।’

—‘আমার নাম দীপ। ভালো নাম দীপংকর।’

—‘তুমি বুঝি বেড়াতে এসেছ?’ জিজ্ঞাসা করে কানু।

—‘হ্যাঁ, কলকাতা থেকে। এটা আমার দাদুর বাড়ি। মায়ের সঙ্গে এসেছি। কয়েকদিন থাকব। মাসি আর দিদিরাও এসেছে। বুঝলি, না খেলে সময় কাটছে না। বড্ড বোর লাগছে। তুই আমার সাথে খেলবি তো?’

—‘হুঁ।’ কানু খুশি হয়ে ঘাড় দোলায়।

দীপ সমবয়সি কানুকে দিব্যি তুইতোকারি চালালেও সে লক্ষ্য করে যে কানু ‘তুমি’র নীচে নামে না। ও বোধহয় এ বাড়ির কোনো কর্মচারীর ছেলে। বাবুদের ছেলেকে তুই বলতে তাই সংকোচ।

যাহোক খেলা শুরু হয়ে যায়।

বাপরে, কানুর হাতের টিপ দেখে দীপ থ। একে তো তার অভ্যাস নেই অনেক দিন, তার ওপর ভাঙা গুলিগুলো আঁটে বসে না ঠিকমতো। সে স্রেফ গো-হারা হারে। তবে সহজে হার মানবার পাত্র সে নয়। খানিকক্ষণ খেলার পর দীপ কানুকে বলে, ‘এখানে গুলি কিনতে পাওয়া যায়?

কানু বলল, ‘হ্যাঁ যায়। এগরা বাজারে।’

দীপ বলে, ‘এখন চলি। কাল ফেরত খেলতে আসব। এখানে খেলবি তো?’ —হ্যাঁ।’ সায় দেয় কানু।

—‘কখন খেলবি?’

‘মা কাজে চলে গেলে। বিকেলে চারটের পর।’

—‘তোর মা কী করে?’ জিজ্ঞেস করে দীপ।

কানু মুখ নামিয়ে সংকোচের সাথে বলে, ‘এই ঘরের কাজ। ঘর পৌঁছা। বাসন মাজা এইসব।’

—‘তোর বাবা কী করে?’

—‘বাবা নেই।’ বিষণ্ণ ভাবে জানায় কানু

—‘তোর ভাইবোন আছে?’

—‘আছে। ছোটো বোন।’

—‘তুই কোথায় থাকিস?’

—‘ওইখানে।’ দাদুর বাড়ির এই পাশে নীচুতলার ছোটো ছোটো যে ঘরের সারি সেইদিকে আঙুল দেখায় কানু।

দীপু ভাবল, ‘যাকগে, ওর মা কী করে তাতে আমার বয়ে গেছে। ছেলেটা কিন্তু ভারি ভদ্র। শহুরে অনেক চালিয়াত ছেলের চেয়ে ঢের ভালো। তবে মা-মাসিরা না জানতে পারে। তাহলে ঠিক বারণ করবে ওর সঙ্গে খেলতে। বরং এখানে লুকিয়ে খেলব।’

পরদিন সকালে দীপ দাদুর বাড়ির একজন কাজের লোককে পাঠাল মাইল পাঁচেক দূরে বাজারে গুলি কিনতে।

বিকেলে সেই পাঁচিল ঘেরা গোপন জায়গাটিতে দীপের চারটে ঝকঝকে লাল নীল নতুন কাচের গুলি দেখে কানুর চোখ চকচক করতে থাকে। হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে গুলিগুলো। বিড়বিড় করে, ‘ইস কী সুন্দর!’

দীপ নতুন দুটো গুলি কানুকে দিয়ে, নিজে অন্য দুটো নিল। তারপর খেলা শুরু হল।

কিন্তু নতুন গুলিতেও দীপ কানুর সঙ্গে মোটেই এঁটে উঠতে পারল না। উঃ, ছেলেটার মারাত্মক টিপ।

শেষে হতাশ হয়ে দীপ খেলা থামিয়ে বলে ফেলল, ‘নাঃ গুলিতে জুত হচ্ছে না। অনেকদিন প্র্যাকটিস নেই কিনা। আর তোর যা টিপ। জমছে না খেলা।’

একটু লজ্জিত ভাবে কানু বলল, ‘আমি কেবল এক্কাদোক্কা আর গুলি খেলি। তাই খেলে খেলে টিপ বেড়ে গেছে। কদিন খেললে তোমারও হয়ে যাবে।’

দীপ ভাবে, নাঃ সে গুড়ে বালি। অমন টিপ বানানো এটা কটা দিনেই অসম্ভব। গুলি চলবে না, অন্য খেলা ভাবতে হবে।

পরদিন বিকেলে দীপ তাদের খেলার জায়গায় একটা টেনিস বল নিয়ে হাজির হল। এখানে খেলার মতলবে একটা ক্রিকেট ব্যাট আর একটা টেনিস বল সঙ্গে এনেছিল। আসল ফুটবলে না হোক, টেনিস বলেই ফুটবল খেলা যাক।

কিন্তু মাত্র দুজনে কি ফুটবল জমে?

দীপ ভেবে বের করল— পেনাল্টি কম্পিটিশন হোক।

পাশে একদিকে দেয়ালের নীচে ইটের টুকরো রেখে দুই গোলপোস্টের মার্কা হল। উল্টোদিকের দেয়াল ঘেঁষে বল বসিয়ে শট মারা হবে। প্রত্যেকে এক-একবার পর পর পাঁচটা শট মারবে। তারপর অন্যজন পাঁচটা। দেখা যাক কে কেমন পেনাল্টি বাঁচায়।

এবার যে কানু পারবে না দীপ নিশ্চিত। ক্লাবে ফুটবল ক্রিকেট ব্যাডমিন্টনে দীপের কত নাম। এখানে এক পাড়াগেঁয়ে ছেলের কাছে গুলিতে বারবার হেরে দীপের বেশ মনে লেগেছে।

পেনাল্টি কম্পিটিশনের ব্যাপারটা কানুকে বুঝিয়ে দিল দীপ।

কানুকে গোলে দাঁড় করিয়ে শট মারার জন্য বল হাতে যাচ্ছে দীপ, এমন সময় পায়ের শব্দ শোনা গেল। কেউ দাদুর বাড়ির গা ঘেঁষে রোয়াক দিয়ে এদিকে আসছে।

কে আসে? একবার কান পেতে তারপর পেছনে তাকিয়ে দীপ দেখে কানু নেই। শুধু তার কুকুরটা রয়েছে।

যে মাঝবয়সি লোকটি ঘেরা জায়গাটার মধ্যে হাজির হয় তাকে আগে দেখেছে দীপ। সে দাদুর যে চাষের জমি আছে তাতে কাজ করে। নাম- গোবিন্দ।

গোবিন্দ এই নিরালায় দীপককে দেখে অবাক হয়ে থমকে গিয়ে বলল, ‘খোকাবাবু এখানে কী কোচ্চো?’

—‘বল খেলছি।’ গম্ভীরভাবে হাতের বলটা দেখিয়ে দীপ বলে, ‘জায়গাটা বেশ ঘেরা। বল বাইরে যায় না।’

—‘তা বটে। আরে বাঘাও দেখছি জুটেছে।’ কানুর কুকুরটাকে দেখায় গোবিন্দ। তারপর বলে, ‘কুয়োয় ঝুঁকো না যেন।’

—‘না না।’ দীপ ভরসা দেয়।

আর কথা না বাড়িয়ে গোবিন্দ হনহন করে সরু রোয়াকটা দিয়ে হেঁটে অপর প্রান্তের পাঁচিলের ধার দিয়ে অদৃশ্য হচ্ছিল।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল দীপ। কিন্তু কানু কোথায় গেল? ভাবতে ভাবতেই দেখে যে কুয়োপাড়ের আড়াল থেকে কানুর মাথা জাগছে। একগাল হেসে উঠে দাঁড়ায় কানু।

যাক, ছেলেটার বুদ্ধি আছে। ঠিক সময়ে লুকিয়েছে। এখানে বাসনমাজা ঝিয়ের ছেলের সঙ্গে দীপ খেলছে খবরটা যদি গোবিন্দ মারফত মা-মাসির কানে যায় তাহলে কানুর সঙ্গে দীপের খেলার বারোটা বেজে যাবে। অমনি নিষেধ আসবে। হয়তো বা কানুকেও বকুনি খেতে হবে। ব্যাপারটা আঁচ করে ছেলেটা গা ঢাকা দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছে। এধার দিয়ে লোক চলাচল করে কদাচিৎ। তবু সাবধান থাকতে হবে।

পেনাল্টি প্রতিযোগিতায় সত্যি কানু দীপের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। বেচারি জানে না কেমন করে ঠিকমতো বল কিক করতে হয়। কেমন করেই বা গোল আটকাতে হয়, প্রথমদিকে সে গোলকিপার হয়ে দীপের একটাও শট রুখতে পারছিল না। আর তার বেশির ভাগ শটই দীপ গোলকিপার হয়ে অনায়াসে আটকে দিচ্ছিল। কানুর অনেক শট আবার স্রেফ গোলপোস্টের বাইরে চলে যাচ্ছিল।

বারবার হেরে কানুর কিন্তু বিকার নেই। সে মহা উৎসাহে নতুন খেলায় মাতে। বরং গুলিতে হেরে মনমরা দীপ এখন বল খেলায় জিতে খুশিতে চনমনে দেখে কানুও ভারি খুশি।

এ খেলাটায় সবচাইতে খুশি হয় বাঘা।

বলটা দেয়ালে লেগে ছিটকে গেলেই সে দৌড়ে গিয়ে সেটা মুখে ধরে। খুব চালাক কুকুর। বারকয়েক বোঝাবার পরই সে আর বলটা মুখে নিয়ে চক্কর খায় না। বরং বল আলতো করে দাঁতে চেপে এনে যে শট মেরেছে তার পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে চকচকে চোখে ঘনঘন ল্যাজ নাড়ে।

বাঘার ফিল্ডিংয়ে দীপদের খাটুনি কমে যায়।

ঘণ্টাখানেক খেলার পর দীপকে দেখে দেখে কানু বল কিক করা আর গোলকিপিংয়ের কায়দা অনেকটা রপ্ত করে ফেলে। শেষের দিকে সে দীপের কাছে হারছিল বটে, তবে আগের মতন গোহারা নয়। ভালোই হল, তাতে খেলাটা জমছিল। নইলে একতরফা হয়ে যায়। তেমন খেলে সুখ নেই।

পরদিন কিন্তু খেলতে এসে দীপ খানিকক্ষণের মধ্যেই রীতিমতো হকচকিয়ে গেল। পেনাল্টি কম্পিটিশনে কানু সেদিন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চালিয়ে দেয় দীপের সঙ্গে। কখনো কানু জেতে, কখনো বা দীপ। দীপ বোঝে যে ছেলেটা জাত খেলোয়াড়, খেলা দারুণ জমে।

বাঘার ফুর্তি দেখে কে! সে পাঁই পাঁই করে দৌড়য় বলের পেছনে পেছনে।

একবার গোল করার আনন্দে দীপ চেঁচিয়ে উঠতেই কানু ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারা করে— চুপ!

ঠিক তো। খেয়াল হয় দীপের। তার উত্তেজিত গলা পেয়ে কেউ যদি হাজির হয় এখানে? ফলে খেলার উত্তেজনা গলায় প্রকাশ করা চলে না।

ক্রমে হাঁপিয়ে পড়ে দুজনে। খেলা থামায়। দীপ অল্পের জন্যে জিতে যায়। কুয়োপাড়ে বসে জিরোতে জিরোতে দীপ বলে কানুকে, ‘তুই বড়ো মাঠে ফুটবল খেলতে যাস না কেন? প্র্যাকটিস করলে তুই দারুণ খেলবি।’

কানু চুপ করে থাকে।

—‘কেন যাস না?’ ফের জিজ্ঞেস করে দীপ।

—‘ওরা নেয় না।’ করুণ স্বরে জানায় কানু।

—‘কেন?’

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ইতস্তত করে কানু বলল, ‘ওখানে খেললে চাঁদা চায়।’

দীপ বোঝে। গরিব কানুর চাঁদা দেবার ক্ষমতা নেই। মনে মনে সে ঠিক করে ফেলে, যাবার সময় কানুকে কয়েকটা টাকা দিয়ে যাবে, তার নিজের জমানো টাকা থেকে।

হঠাৎ একটা কথা মনে হতে সে প্রশ্ন করে কানুকে, ‘হ্যারে, তুই ইস্কুলে যাস?’

—‘না।’ মাথা নাড়ে কানু।

—‘কেন?’

কানু কাঁচুমাচু ভাবে শুধু বলে, ‘আগে যেতাম।

—‘তা এখন যাস না কেন?’

কানু নতমুখে চুপ করে থাকে। জবাব দেয় না।

দীপ ভাবে, এর কারণও হয়তো পয়সার অভাব। বইখাতা কিনতে পারে না, তাই ও পড়া ছেড়েছে। কিংবা স্কুলের সময় অন্য কোনো কাজ ক’রে টাকা রোজগারের জন্যে। কৌতূহল হলেও এ নিয়ে সে আর কানুকে খোঁচায় না। বলে, ‘কানু, তোকে আমি ক্রিকেট শিখিয়ে দেব। ব্যাট এনেছি, দেখবি কেমন ইন্টারেস্টিং খেলা।’

শুনে খুশিতে কানুর মুখ চকচকে করে ওঠে।

ঘরে ফিরে যেতে যেতে দীপ ভাবল, শুধু বিকেলে কেন? সকালেও তো খেলা যায়। দশটার পর। বলে দেখব কানুকে। ও কি সকালে কোনো কাজ-টাজ করে? কানুর মতো চমৎকার খেলার সাথী জুটে যাওয়ায় এখন আর দীপের মন দাদুর বাড়ি থেকে পালাই পালাই করছে না।

কিন্তু কানুকে ক্রিকেট শেখাবার সুযোগ আর মেলে না।

কারণ সেই রাতেই দীপ জ্বরে পড়ল।

দীপের মা রাগ করেন, ‘দুপুরে অতক্ষণ ঝাঁপাই জুড়লি, পুকুরে, ঠা ঠা রোদে। বারণ করলাম, শুনলি না। এখন বোঝ ঠ্যালা। ওইজন্যেই জ্বর এসেছে।’

যাহোক, পরদিন ডাক্তার আসেন। ওষুধ পড়ে। সুখের বিষয় জ্বর তেমন বাড়ে না। দুদিনেই ছেড়ে যায়। তবু আরও একটা দিন দীপ দোতলায় তার শোবার ঘর থেকে বেরুতে পায় না।

জ্বর হবার পরদিন সকালে দীপ দেখে বারান্দার দিকে জানলার কোণে কানুর মুখ। উদ্‌বিগ্ন চোখে সে দেখছে দীপকে। কেন খেলতে আসেনি? তাই বুঝি খোঁজ নিতে এসেছে লুকিয়ে।

ঘরে তখন আর কেউ ছিল না। বিছানায় বসেই দীপ কানুকে বলল, ‘একটু জ্বর হয়েছিল ভাই। ভয় নেই, কমে গেছে।’

কানু একটু হেসে সরে যায়।

জ্বর হবার চারদিন বাদে দীপ নীচে নামে দুপুরে খেতে। মায়ের ইচ্ছে ছিল ঘরেই খাবার দেওয়া হোক। দীপ জেদ ধরল যে নীচে যাবে। একখানা ঘরে বন্দী হয়ে তিনদিন কাটিয়ে তার অসহ্য লাগছে।

একতলার মস্ত খাবারঘর। কলকাতার বাড়ির মতো টেবিল চেয়ারে খাওয়ার ব্যবস্থা নয়। তকতকে মেঝেতে আসন পেতে বসে পাশাপাশি খায় সবাই।

দীপ পৌঁছে গেছে খাবার ঘরে। দিদিরা আর মা-মাসিমা আসছেন খেতে। ঘরের এককোণে ম্যানেজার মশাই বসেছিলেন তক্তপোশে। খাবার তদারকি করতে। দীপও ওই তক্তপোশে বসেছিল। একটি মাঝবয়সি বিধবা মেঝে মুছে আসন দিল।

একে দীপ আগেও দেখেছে কাজকম্ম করতে। তবে নামটা খেয়াল করেনি। আজ ম্যানেজারবাবু তাকে ডেকে বললেন, ‘কানুর মা, ঠাকুরকে বলে দিয়ো খোকাবাবুকে কোনো ঝালমশলার রান্না না দিতে। দিদিমণি বলে দিয়েছেন।’

দীপের হঠাৎ খেয়াল হল নামটা।

সে ম্যানেজার মশাইকে জিজ্ঞেস করল, ‘কাকাবাবু, ওর ছেলে বুঝি কানু?’

—হ্যাঁ।’ ম্যানেজার মশাই জবাব দেন।

দীপ ফট করে বলে বসল, ‘আচ্ছা কানু কী করে?’

ম্যানেজার অবাক হয়ে বললেন, ‘কী করে মানে?’

—‘মানে কাজ-টাজ করে কিছু?’

ম্যানেজার হাঁ করে খানিক দীপের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘কী

বলছ? কানু কাজ করবে কী? কানু যে মারা গেছে বছর দুই হল।’

শুনে দীপ হতভম্ব।

ইতিমধ্যে কানুর মা কী যেন কাজে ঘরে ঢুকেছিল।

ম্যানেজার মশায়ের কথাগুলো কানে যেতেই সে চোখে আঁচল দিল।

—‘সত্যি?’ কোনোমতে উচ্চারণ করে দীপ।

ম্যানেজার মশাই বেশ জোর দিয়ে বললেন, ‘সত্যি নয়তো কী?’

কানুর মা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

মানেজার একটু ধমকে বললেন, ‘কানুর মা, তুমি এখন যাও। সবাই খেতে আসছেন। আর কেঁদে কী করবে বলো? সবই নিয়তি।’

কানুর মা বেরিয়ে যায়।

খানিকক্ষণ কাঠ হয়ে বসে থেকে দীপ জিজ্ঞেস করে ম্যানেজার মশাইকে, ‘আচ্ছা কানুর একটা কুকুর ছিল? বাঘা?’

ম্যানেজার বললেন, ‘হ্যাঁ, আছে তো বাঘা। ভারি ন্যাওটা ছিল কানুর। কানু মারা যেতে কেমন জানি হয়ে গেছে। দুবেলা শুধু খেতে আসে এখানে। আর কোথায় কোথায় যে ঘোরে? দেখতেই পাই না।’

দিদি মা-মাসিরা এসে পড়লেন।

কোনোরকমে দীপ দুটি মুখে দিয়ে উঠে পড়ে আনমনা ভাবে। মা-মাসিদের কথায় সে বুঝেছে যে তারা আসছে কালই কলকাতায় ফিরছে। পাছে দীপ ফের জ্বরে পড়ে সেই ভয়ে এখানে থাকতে আর ভরসা পাচ্ছে না তার মা।

মা দীপকে বারণ করলেন, ‘বিকেলে আজ বাড়ির বাইরে যাবিনে। ছাদে থাকবি। সন্ধের আগে ঠিক ঘরে ঢুকবি। এ কদিন বড্ড বেশি টো টো করেছিস।’

দুপুরে মা আর মাসি দিদার ঘরে গল্প করতে গেছে। দিদিরা অন্য ঘরে ঘুম দিচ্ছে। এই সুযোগে দীপ পা টিপে টিপে বেরুলো বন্ধু কানুর দেখা পাবার আশায়। বিকেলে তো আজ নীচে যাবার উপায় নেই।

নিঝুম বাড়ি। শুধু পায়রার বকবকম আর পাখার ঝটপটানি কানে আসে।

নীচতলার সেই পাঁচিল ঘেরা জায়গাটাতে যাবার দরজার কাছে পৌঁছে দীপ দেখল যে ওখানে একটা ঘরের দরজা খোলা। ওই ঘরের ভিতর থেকে কানুর মায়ের গলা পাওয়া গেল। আর একটা কচি মেয়ের গলা। ও হয়তো কানুর বোন।

দরজা খুলে ঘেরা চত্বরে উঁকি দিয়ে দীপ দেখল যে কানু সেখানে নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়েও সে কানুর দেখা পেল না।

কানু বোধহয় এখানে আসে না যতক্ষণ না কানুর মা কাজে যায়। যতক্ষণ না জায়গাটা একেবারে নিরালা হয়ে যায়। সেই বিকেলে আসবে।

দীপ তাহলে খেলার জায়গাটিতে এগিয়ে যায় নিঃশব্দে। পকেট থেকে বের করে চারটে নতুন কেনা কাচের গুলি। সেগুলো রাখে মাটিতে, গুলি খেলার গাব্বুর ভিতর। তারপর একই জায়গায় গুলিগুলোর ওপরে রাখে টেনিস বলটা।

কানু বিকেলে এসে ঠিক পাবে বলটা আর গুলিগুলো। তখন ওর খুশিভরা অবাক মুখখানা সে মনে মনে কল্পনা করে। এগুলো সে যাবার আগে কানুকে দান করে যাবে ঠিকই করেছিল। তবে উপহারগুলো হাতে হাতে দিতে পারলে ভারি ভালো লাগত। বলটা শুধু কানুর খেলার জন্যে নয়। কানু-বাঘা দুজনেরই। ইস বাঘার দেখাও যদি একবার মিলত। ও এখন কানুর সঙ্গে কোথায় ঘুরছে কে জানে?

পরদিন সকালে দীপ, মা-মাসি-দিদিদের সঙ্গে মোটরে উঠেছিল। এখান থেকে যাবে স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা।

গাড়ি স্টার্ট দিতেই মা-মাসি-দিদিরা গাড়ি থেকে হাত নাড়তে লাগল দাদু-দিদা আর যারা বিদায় জানাতে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের উদ্দেশে।

দীপও হাত নাড়ছে। কিন্তু সে বিদায় জানাচ্ছে শুধু একজনকে লক্ষ্য করে কানু।

দূরে সবার পেছনে সদর বাড়ির বারান্দায় মোটা একটা থামের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া কানুর ম্লান মুখখানি সে দেখতে পেয়েছে ঠিক গাড়ি ছাড়ার আগে।

অন্যদের লুকিয়ে কানুও একবার হাত নেড়ে বিদায় জানাল দীপকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বন্ধু

বন্ধু

বন্ধু

হাওড়ার ফ্যাক্টরি থেকে সোজা গেছি আমহার্স্ট স্ট্রিটে। সেখান থেকে ভবানীপুর। রবিন আজ ছুটিতে। আমিই ড্রাইভ করেছি সবটা। দোতলার দালান পর্যন্ত পৌঁছোতে আজ আমার দম বেরিয়ে গেল। পায়ে যেন জোর নেই। দালান অবধি পৌঁছোতেই কালোমানিক গুড়গুড় গুড়গুড় করতে করতে এগিয়ে এল। পায়ের কাছটায় ফোঁস ফোঁস করছে, যেন প্রণাম করছে। আজ মনমেজাজ এতই খারাপ যে পা-টা ছুঁড়তে গিয়েছিলাম। সামলে নিলাম। ড্যাসুনটার কী দোষ! ও তো। আমার ছেড়ে যায়নি, যাবেও না ওর আয়ুষ্কাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত। জানোয়ার মানুষের চেয়ে অনেক বিশ্বস্ত, অনেক বৎসল। উঃ, টুকটুক যে কোথায় গেল! ওর বোঝা উচিত গাড়ির শব্দ পাওয়া গেছে, অতএব আমি এসেছি। কোথায় কী এমন রাজকর্মটা করছে! ঠিক আছে। করো তুমি তোমার রাজকর্ম। আমিও কিচ্ছুটি বলব না। জুতো খুললাম না। জামা-কাপড়, ধড়াচুড়ো যা পরা ছিল, রইল। দালানের সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। পাখাটা চলছে ফুল স্পিডে। তবু ঘামছি।

অমিতের ব্যবহার বরাবরই বড়ো শীতল। একেক সময় মনে হত ওর বোধশক্তি হয় নেই, নয় ভোঁতা। অথচ ও যে আমাকে কী টানে টেনেছিল! চিরকালই আমার অনুভতি তীক্ষ্ণ, তীব্র। অমির পেট ব্যথা করলে, মাসিমা অনেক সময়ে কাকে ওষুধ খাওয়াবেন ঠিক করতে পারতেন না। হয়তো এত অনুভূতিপ্রবণ বলেই আমি মানুষটা লোকের চোখে মেয়েলি বলে প্রতিভাত হই। অনুভূতি-টুতি সব নারীজাতির একচেটিয়া কি না! যারা এসব মনে করে তারা অবশ্য ইচ্ছে হলে টুকটুককে দেখে যেতে পারে। যাই হোক, মেয়েলি বলুক, বাড়াবাড়ি বলুক, আদিখ্যেতা বলুক, সব সহ্য করতে রাজি আছি, কিন্তু ন্যাকামি বললে মেনে নিতে পারব না। ন্যাকা শব্দটার মধ্যে একটা হিপক্রিসির ব্যাপার আছে। আমার আর অমির সম্পর্কের মধ্যে কোনো খাদ নেই। অমির আদ্যন্ত নির্লিপ্ততা সত্ত্বেও এই দুর্লভ বন্ধুত্ব টিকে আছে, আমি সে কথা হাজার মুখে বলব, অমি অবশ্য বলবে না, হাসবে। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া যদি করাও যায়, অমিকে পিটিয়ে তার মুখ থেকে কথা বার করা সহজ নয়। প্রচণ্ড মুখচোরা। ওই হাসিটাই ওর জবাব। ওর মতামত।

পাখা চলছে। তবু ঘামছি অস্বাভাবিক। দোষ নেই। যত জীবন এগোচ্ছে ততই বুঝতে পারছি প্রয়াত সেই কবির কথাই ঠিক, চতুর্দিকে মুখোশ, শুধু মুখোশ। তুমি কথা বলো, অপরপক্ষের ঠোঁট নড়বে হৃদয় নড়বে না, তুমি কিছু শোনালে কানগুলো শুনবে, কিন্তু মর্মে পৌঁছোবে না। হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব—এ একেবারে কাব্যকথা। কবি-বাক্যে বিশ্বাস করে আমরা সারাটা জীবন একটার পর একটা ভুল জায়গায় নিজেকে সমর্পণ করি।

পেছনে একটা শব্দ হল। নিশ্চয় টুকটুক। পনেরো মিনিট কেটে গেল, এতক্ষণে বাবুর আসবার সময় হয়েছে। পেছন থেকে সামনে এল। একটা সবুজ সিল্কের রাজস্থানি পোশাক পরেছে। ভারী সিল্কের ওপর দিয়ে হাওয়া কাটলে একটা অদ্ভুত আকর্ষক শব্দ হয়। সেই শব্দটাই আমি শুনতে পেয়েছিলুম। টুকটুকের জামাকাপড়ের শখ ভাষণ, কত রকমের যে পোশাক করায়। পরে, বাড়িতেও পরে থাকে।

কতক্ষণ এসেছো? একেবারে অলস টু-দা পাওরার ইনফিনিটি। হাতটা পড়ে রয়েছে সোফার হাতলে। নখগুলো লাল, হাতের পাতায় কোথাও কোনো শিরা জেগে নেই। যেন নেতিয়ে পড়া কেয়াফুলের স্তবক। বাপের বাড়ির হতদরিদ্র ঘরে টুকটুক এমন হাত টিকিয়ে রেখেছিল কী করে—এটা একটা লাখ টাকার প্রশ্ন। আমি যে জবাব দিলাম না, আমার মেজাজটা যে একটু অন্যরকম, ভঙ্গিতে বিষাদসিন্ধু এসব টুকটুক লক্ষই করল না। আপন মনে নিজের আঙুল দেখছে। হাতের কাঁকন দেখছে। পা তুলে একবার সোনালি চটি নাকি তার অভ্যন্তরে নিজের সাদা মসৃণ পায়ের পাতা দেখল। নার্সিসাস!

খাবে? নাকি বাইরে খেয়েছো?, আমার খাওয়া না-খাওয়া ওর কাছে সমান। এবারেও উত্তর না পেয়ে বোধহয় মেমসাহেবের বোপোদয় হল। বলল, কী ব্যাপার? কথা বলছ না যে! কিছু হয়েছে?

জবাব দিলাম না। টুকটুক এবার উঠে পড়ল। আমার কাছে চলে এল। নীচু হয়ে সোফার পেছনে দু হাত রাখল, আবারও বলল, কিছু হয়েছে?

 অমিত অস্ট্রেলিয়া চলল ফর গুড—আমি অনেক কষ্টে শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারলাম।

তো কী?—বুকের ওপর দু-হাত আড়াআড়ি রেখে চূড়ান্ত নির্বেদের সঙ্গে টুকটুক বলল।

আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। প্রায় কাঁপছি এত উত্তেজনা। বলছি, টুকটুক তুমি বলছ কী? অমিত অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে বরাবরের মতো আমাকে ছেড়ে। আর তুমি বলছ,-তো কী? তো তুমি কী?

টুকটুক আড়াআড়ি হাতদুটো নামাল। ঝট করে পেছন ফিরল, ওদিকের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ ঘাড়টা ফেরাল, তারপর মুখটা সামান্য বেঁকিয়ে আমাকে আমূল কাঁপিয়ে দিয়ে বলল, ন্যাকা।

এই অসহ্য রকমের ঘৃণ্য শব্দটা আমার দিকে ছুড়ে দিল আমার স্ত্রী যাকে আমি কাদা থেকে তুলে এনে রাজসিংহাসনে বসিয়েছি, প্রতিদিন যার সাংস্কৃতিক শিক্ষাদীক্ষা এবং বিলাসের খাতে আমার আয়ের অঙ্কে রীতিমতো একটা বিয়োগ হয়। যার বাবা-মা, দুটি ছোটো ভাইবোনের দায়ও আমি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছি। কোনোরকম প্রার্থনা অনুরোধ উপরোধ বা প্রত্যাশার দায় মেটাতে নয়। এটাই আমার পক্ষে সবচেয়ে স্বাভাবিক, এটাই সবচেয়ে মানবিক বলে। আমাদের নিজেদের মানুষ বলে পরিচয় দিতে হবে তো!

এই মনুষ্যত্ব রক্ষার তাগিদেই না অমির কাঁধে হাত রেখেছিলাম! তখন বাল্য পেরিয়ে কাঁচা কৈশোর। বই আনেনি এই অপরাধে ভূগোলের ক্লাসে সেবারের সেকেন্ড বয় সাংঘাতিক মার খেল। ভূগোলের মাস্টারমশাই প্রফুল্লবাবু বড়ো নিষ্ঠুর স্বভাবের ছিলেন। মেরে-ধরে ছেলেটিকে আধমরা করে উগ্রচণ্ডা দুর্বাসার মতো বেরিয়ে গেলেন প্রফুল্লবাবু, আমি বললাম, চল, আমরা হেডসারের কাছে কমপ্লেন করতে যাই। কয়েক জন ছেলে সঙ্গে সঙ্গে তৈরি। অমিত অর্থাৎ মার-খাওয়া ছেলেটি বলল, না।

যাব না? সে কী? কেন?

সত্যিই তো, গতকাল উনি বারবার করে আনতে বলেছিলেন টেক্সটটা।

ঠিক আছে, কিন্তু এই সামান্য ভুলের জন্য ওই রকম মার? অমিত তোমার যে পিঠ লাল হয়ে গেছে। কানের পাশ দিয়ে রক্ত পড়ছে।

ও কিছু না। ওঁর বাড়ি থেকে চলে গেলেই উনি আর মারবেন না।

আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসার পর জিজ্ঞাসায় জানলাম—অমিত এবং তার মা প্রফুল্লবাবুর বাড়ির নিচের তলায় ভাড়া থাকেন। ওর বাবা বছরখানেক হল হঠাৎ মারা যাওয়ায় ওরা একেবারে অকুলে পড়েছে। ভাড়া দিতে পারছে না মাসছয়েক হল। প্রফুল্লবাবুর মারের পেছনের আসল ইতিহাস এই।

অত সহজে, অন্যান্য ছেলেদের সামনে অবশ্য অমি এত কথা বলেনি। আস্তে আস্তে টিফিন পিরিয়ডে মাঠে বেড়াতে বেড়াতে গাছতলায় বসে মুড়ি চিবোতে চিবোতে অনেক জেরার পর একটু একটু করে বেরিয়েছে কথাগুলো অমির পেট থেকে।

আমি বললাম, আজ ছুটির পর অমিত আমাদের বাড়ি চলো প্লিজ।

আজ নয়।

তবে কাল।

ঠিক আছে, দেখা যাক।

দেখা যাক নয়, কাল আসছই।

বাড়ি গিয়ে বাবাকে সব কথা বললাম। আমার মা নেই। বাবা অত্যন্ত উদারচরিত্রের মানুষ। বললেন, আমাদের একতলার দক্ষিণ দিকে দু-খানা ঘর তো এমনিই পড়ে রয়েছে, ওঁদের আসতে বলে দাও। আমি বারান্দাটা ঘেরার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

পরের দিন অমিকে বাড়িতে আনলাম, বাবা কারখানা থেকে ফিরে ওকে দেখলেন, আদর করে বললেন, বাঃ, বেশ ব্রাইট ছেলে মনে হচ্ছে!

কিন্তু আমাদের বাড়ির একতলায় থাকার কথায় অমিত ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়ল। খালি গোঁয়ারের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে থাকে। শেষে ওদের বাড়িতে গিয়ে ওর মার কাছে কথাটা পাড়লাম। উনি বললেন, প্রফুল্লবাবুর ছ-মাসের বাকি ভাড়া না দিয়ে কী ভাবে যাই বলো! তা ছাড়া তোমাদের বাড়ির ভাড়াও তো অনেক হওয়ার কথা।

আমি ছেলেমানুষ। মায়ের মতো এক মহিলার মুখের ওপর আর কী বলব। বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি ভাড়ার পরিমাণ পাঁচশো চল্লিশ টাকা। আমার হাত খরচের টাকা জমেছিল হাজারের সামান্য ওপরে। তার থেকে পাঁচশো চল্লিশ প্রফুল্লবাবুর হাতে দিয়ে রসিদ নিয়ে অমির মার কাছে গেলাম। হাত ধরে বললাম, চলুন না মাসিমা, আমার মা নেই। কেউ আমাকে দেখে না।

এই শেষের তিরটাই বোধহয় অব্যর্থ হয়ে থাকবে। তাই ওদের বাড়িতে আনতে পারলাম। অমির মা আমার নিজের মায়ের মতো হলেন। ওঁদের একতালার ঘরই হল বলতে গেলে আমার আসল বাসস্থান। রাজশয্যা ছেড়ে ধূলিশয্যা, অনেকেই বলল।–মাসিমার সেলাই-মেশিন এবং অমির কাগজ বিক্রি চলতে লাগল আড়ালে আমাদের বাড়ির ভাড়া এবং আমার পাঁচশো চল্লিশ টাকার ঋণ মেটাবার জন্যে। এবং কোনোক্রমেই আমি অমিকে আমার খাবার টেবিল বা শয্যার ভাগ দিতে পারলাম না, একমাত্র কোনো জন্মদিন-টিনের মতো বিশেষ উৎসবের দিন ছাড়া। এবং মাসিমাও কোনো দিন তাঁর ভাড়া-করা দুখানা ঘর-বারান্দার সীমা অতিক্রম করলেন না।

টুকটুক এসে বলল, যদি খেয়ে এসে না থাকো, তো চলো খাবার দিতে বলেছি। আমি নিজে বেঁধেছি আজ।

এটা নতুন। রান্না করতে টুকটুক খুব ভালোই পারে। কিন্তু একদম ভালোবাসে কাজটা করতে। বললে বলে, ভালো রাঁধতে পারি, তো কী? তুমি কী রান্নার জন্যে আমার বিয়ে করেছিলে? তা হলে আমার মাকে বিয়ে করলেই পারতে, মা আরও অনেক অনেক ভালো রাঁধে।

টুকটুক! কী অসভ্যতা! কী বিশ্রী!

আমার যদি দিনরাত শুয়ে থাকতে, কী গল্পের বই পড়তে, কী টিভি দেখতে ভালো লাগে আমি তা করতে পারব না। এরকম তো কথা ছিল না!

কথা কী ছিল তা অবশ্য আমি আদৌ জানি না। কিন্তু টুকটুক যখন পরম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এই প্রশ্নটা উচ্চারণ করে আমি প্রাণ ধরে পালটা বলতে পারি না—কী কথা ছিল? আমার খারাপ লাগে। আমি বুঝতে পারি টুকটুক রান্না করতে করতে, রান্না করতে করতে হাঁপিয়ে গেছে এখন ওর তাই রাঁধতে আর ভালো লাগে না। জীবনে কোনোদিন লাগবে না। আর আমি এত হ্যাংলা নই যে রান্নায় বীতস্পৃহ স্ত্রীকে দিবারাত্র এটা করো ওটা করো বলে নাজেহাল করে তুলব। এমনকী আমাদের আদ্যিকালের বামুনঠাকুরের রান্না খেয়ে টুকটুক যখন নাক কুঁচকে বলে, তোমরা ঘটিরা সব তাতে এত মিষ্টি খাও। তোমাদের বামুনঠাকুর কি মাছের ঝোলেও চিনি দেয়? তখনও আমি বলি না, নিজে রাঁধলেই তো পার, কিংবা নিজের পছন্দটা দেখিয়ে দিলেও তো পার! কোনো কথা ছিল অথবা ছিল না বলে যে একথা আমি বলতে পারি না তা নয়। আসলে এভাবে বলা আমার স্বভাবে নেই। বিশেষত যখন টুকটুকের ব্যাপারটা আমি আগাগোড়াই বুঝতে পারি।

তো সেই টুকটুক আজ রান্না করেছে। জামাকাপড় বদলে, হাত-মুখ ধুয়ে নিতে হল। অমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে, সেই খবর বুকের ভেতর নিয়ে আজ আমি টুকটুকের রান্না পোলাও, চিতল মাছের কোপ্তা খাচ্ছি, ঠিক সেই দিনেই, এ কেমন নিষ্করুণ কাকতালীয়? আমাকে অন্যমনস্ক দেখে টুকটুক দু আঙুল জিভ দিয়ে চেটেচুটে নিয়ে বলল, কেমন, ভালো হয়নি বুঝি?

আমি বললাম, ভালো হয়নি মানে? দারুণ হয়েছে, সাংঘাতিক হয়েছে। শুধু তোমার এই একটি গুণের জন্যও আমি পত্নীগর্বে গর্বিত হতে পারি।

থাক—টুকটুক বলল, তো বন্ধুকে একদিন ডাকো, খাইয়ে দাও। টুকটুক কি অমিকে ডাকবার প্রসঙ্গ তুলতেই আজ নিজে হাতে রান্না করেছে। ও কী জানে না, অমিকে নিয়ে আমি প্রায়ই বাইরে খাই, কিন্তু বাড়িতে না। বাড়িতে ডেকে অমিকে কোনো কষ্ট বা অপ্রিয় পরিস্থিতির মধ্যে ফেলবার নিষ্ঠুরতা আমি কেমন করে করব?

কী প্রস্তাবটা পছন্দ হল না বুঝি?, টুকটুকের কাটা কাটা কথা। অমিকে যেমন বাঁচিয়ে চলি, টুকটুককেও তেমনি সত্যি কথাটা বলতে পারি না। আজকে বলে ফেললাম, তুমি তো জানো অমি আজকাল আর আমার বাড়ি একেবারে আসতে চায় না। তা ছাড়া ও তো কালই চলে যাচ্ছে।

উত্তরে টুকটুক একটা অদ্ভুত মুখভঙ্গি করল। এই বিচিত্র মুখভঙ্গির মানে কী বোঝবার চেষ্টা করতে করতে আমি খাওয়া শেষ করলাম। হাত মুখ ধুয়ে, সিগারেট ধরিয়ে জানলার পাশে দোলনা চেয়ারে বসলাম। এক হতে পারে—বয়েই গেল। অমি যদি আসতে না চায় ওর জন্যেই নিশ্চয় চাইছে না, সেটা ওর পক্ষে যথেষ্ট অপমানকর। তাই সেটাকে ও উড়িয়ে দিতে চাইছে, আসবে না তো বয়েই গেল। দ্বিতীয় হতে পারে আমার কথা ও বিশ্বাস করেনি। অর্থাৎ অমিকে আমি আসতে বলেছি অথচ সে আসতে চাইছে না। এটা আমার রচনা। টুকটুকের মধ্যে অবিশ্বাসের শেকড় খুব গভীর। আমার এখনও পর্যন্ত সাধ্যে কুলোয়নি যে তাকে উপড়োই। আস্তে আস্তে হবে। আমি অপেক্ষা করতে পারি। তাড়াহুড়োয় কী লাভ?

অমির জন্যেও তো আমায় অপেক্ষা করতে হয়েছে। কত দিন, কত মাস, কত বছর। তব ওর মনের তল পেয়েছি কি কোনোদিন? বড্ড চাপা স্বভাব। একমাত্র যখন আমার বসন্ত হল, তখন, সেই ভয়ংকর সময়টায় অমি আমার ঘরে শুয়েছিল। এক মশারিতে আমি, আরেক মশারিতে ও। কষ্টে ছটফট করছি, ঘুম আসছে না। অমি উঠে এসেছে, নীল আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, মশারি সামান্য তুলে অমির সেই মৃদু গলার প্রশ্ন এখনও আমায় কানে বাজে—বড্ড কষ্ট হচ্ছে না রে গোপাল? শোন, একদম চুলকাবি না। আমি আস্তে আস্তে ফু দিয়ে দিচ্ছি। এইভাবে ফু দিয়ে দিয়ে, মৃদু গলায় গল্প করে, গান করে আমার অন্যমনস্ক রাখত, ঘুম পাড়াত অমি। সে বছর ঠিক তিন নম্বরের তফাতে আমি সেকেন্ড হয়ে গেলাম। মাস্টারমশাইরা প্রকাশ্যেই বললেন, প্রশংসনীয় প্রতিযোগিতা। তবে কিছুতেই অমিতকে এর চেয়ে কম মার্কস দেওয়া গেল না। গোপাল তুমি ইচ্ছে করলে খাতাগুলো দেখতে পারো। খাতা দেখেছিলাম। সেই বয়সেই মনে হয়েছিল অসাধারণ। সেদিনটা আমার রাস্তায় রাস্তায় কেটে গেল একা, ভাবছি অমিটা কী সাংঘাতিক মেধা লুকিয়ে রেখেছিল। ওর জন্য অনেক বড়ো কিছু অপেক্ষা করছে। আমাদের স্কুল কলকাতার গর্ব। আমিও অহংকার করছি না, যা-তা ছেলে নই। সেই আমার এতদিনের রেকর্ড ভেঙে যে বেরিয়ে যেতে পারে তাকে তো শাবাশ জানাতেই হয়।

সে রাত্রে আর মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারিনি, পরদিন স্কুল যাবার আগে গিয়ে প্রণাম করতে মাসিমা কেঁদে ফেললেন, বললেন, কাল আসিসনি কেন রে গোপাল, দুঃখ হয়েছিল খুব, না রে?

আমি বললাম, সে কী? দুঃখ হতে যাবে কেন? আমার আসলে ভীষণ…

না, না, আমি ঠিক জানি এতো দিনের ফার্স্টবয় তুই, মন দিয়ে লেখাপড়া করিস, ফাঁকি তো দিস না, তোর দুঃখ হয়েছে কি না তুই না বুঝলেও আমি বুঝি রে? মাত্র তো তিনটে নম্বর, পার হতে পারবি না! এতো ভালোবাসতেন আমাকে মাসিমা।

মাসিমার প্রেরণাতেই আর কোনোদিন আমার সেকেন্ড হতে হয়নি। কিন্তু আমি তাতে খুশি হতে পারিনি। অমি ঠিক আমার পেছন-পেছন এসেছে। বরাবর। নয় কি দশ নম্বর পেছনে, যেন পা টিপে টিপে। এই ধরে ফেলল, এই ধরে ফেলল। কিন্তু ধরতে পারছে না। তাতে ওর কোনো বিকারও নেই। যতই বলি না কেন —অমি, বাক আপ ম্যান, কেন পারছিস না? এরকম কমপিটিশন আমার ভালো লাগে না। আমার মাস্টারমশাইদের কাছে পড়।

অমি নরম করে হাসে—না পারলে কী করব বল গোপাল! আর কী-ই বা এসে যায় এতে। সত্যিই ওর মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের কথা।

অনেকক্ষণ বসে আছি। উঠলাম। জল খেলাম। পায়ে ঝিঝি ধরে গেছে টুকটুক, টুকটুক! শিবুদা এসে ধরল। এইসা ঝিঝি ধরেছে যে নড়তে পারছি না। শিবুদা বলল, বাঁ পা দিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল এমনি করে চেপে ধরো।

দু পা-ই ধরে গেছে যে!

শিবুদা তখন নীচু হয়ে আস্তে আস্তে পা মালিশ করে দিতে লাগল। একটু পরে ঝিনঝিনে হাসি শুনে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি টুকটুক। হেসে গড়িয়ে পড়ছে একেবারে।

বললাম, কী হল? শিবুদা তোমার পায়ে ধরে অত সাধছে কেন?

পায়ে ধরতে যাবে কেন? আচ্ছা তো! ওই জন্যেই তো তোমাকে ডাকছিলাম, তা তোমার পাত্তা পেলে তো!

কেন ডাকছিলে! পায়ে ধরে সাধতে? এরপর কি সকালবেলা বুড়ো আঙুল ধধায়া জল খেতেও ডাকবে?—টুকটুকের হাসি বেড়েই যাচ্ছে।

বিরক্ত হয়ে বললাম, ঝিঝি ধরেছে প্রচণ্ডকী যে বাজে কথা বল।

উঃ। কত ন্যাকামিই যে জানো! টুকটুকের প্রস্থান। ওকে সাবধান করে দিতে হবে এই কথাটা ও যেন আর ব্যবহার না করে। আমার অ্যালার্জি হয়ে যাচ্ছে কথাটায়। টুকটুক যেন মনে না করে ওকে যে আমি বিয়ে করেছি এটা একটা ফেরানো-যায়-না গোছের ব্যাপার। আজকালকার দিনে হতে পারে না। এটা ওর জানা উচিত। অমিকেও কয়েকদিন আগেই বলছিলাম, টুকটুকের বাইরের রূপ গুণ দেখে আকৃষ্ট হওয়াটা বোকামি কি বল! ভেতরের মানুষটা ঠিক। …

অমি চুপ করে রইল। আমি হেসে বললাম, তুই আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। অলটার ইগো বলতে গেলে। তুই এ বিষয়ে মতামত দিলে আমি কিছু মনে করব না।

অমিত বলল—না…মানে……ঠিক…..।

না…মানে…ঠিক…? তুই ইয়ার্কি পেয়েছিস! তুই নিজে ওর মধ্যে কী দেখেছিলি?

অমিত বলল, দূর, তুই ও যেমন! ছাড় তো!

ব্যাস। বিষয় পরিবর্তন। আর একটি কথাও ওকে দিয়ে বলাতে পারিনি।

অমি আমাদের বাড়ির একতলা ছাড়ল মাসিমার মৃত্যুর পর। সে এক মর্মান্তিক ব্যাপার। মনে করলে এখনও আমার গা শিউরে ওঠে। মানুষকে ক্ষমা করতে পারি না। মাসিমা কোনোদিন নিজেদের ঘরের সীমানার বাইরে পা বাড়াতেন না, কিন্তু আমার বাবা নানা প্রয়োজনে মাঝে-মধ্যেই যেতেন। এই নিয়ে আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশী মহলে একটা চাপা গুজগুজ আরম্ভ হল। আমাদের তখন ফাইনাল ইয়ার। রটনা শুনে রাগে আগুন হয়ে গেলাম। আমারই মাথায় আগুন জ্বলছে,তা হলে ওদের না জানি কী হচ্ছে! ঘরে গিয়ে দেখি মাসিমা যেমন অবিশ্রান্ত সেলাই করে যান তেমনি করছেন, অমিত ছাত্র পড়াবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। অমিকে ঝাঁকিয়ে বললাম, তোর কী দেহে মাছের রক্ত, এইসব রটনা শুনেও তুই নির্বিবাদে ছাত্র পড়াতে যাচ্ছিস?

মাসিমার মুখটা লাল হয়ে গেল। অমির মুখটা একেবারে নীলবর্ণ। আমি টেবিলে চাপড় মেরে বললাম। এইসব জঘন্য শয়তানির উচিত জবাব কী জানিস?–বাবার সঙ্গে মাসিমার বিয়ে দিয়ে দেওয়া।

মাসিমার সেলাই-কল দুম করে বন্ধ হয়ে গেল। তিনি যেন একটা উদগত চিৎকার চাপলেন। অমিত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, গোপাল তুমি বলছ কি, ছিঃ। এসব কথা চিন্তা করলেও ওদের নোংরা ধারণাকে মেনে নেওয়া হয়। বোঝ না?

আমি বললাম, ভুল। ভুল। সমাজ চিরকাল একভাবে চলবে না অমিত, চলতে দেবো না, সমাজের মুখে থাবড়া দেব, এ আমি করেই ছাড়ব। আজই বাবাকে বলছি।

অমিত বলল, হঠকারীর মতো কথা বোলো না, হঠকারীর মতো কাজ কোরো না। যাও তো এখন এখান থেকে, যাও।

একরকম ঠেলে আমাকে নিজেরই বাড়ির ঘর থেকে বার করে দিল অমিত। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। মা-ছেলের মধ্যে কী কথা হয়েছিল জানি না। পরদিন এক বীভৎস দৃশ্য দেখা গেল। আমাদের পরমপূজ্য মাসিমার কুসুমকোমল শরীরটা সিলিং থেকে…।

অমিত ঘরের কোণে বসেছিল। আছড়ে পড়ে বললাম, এ কী করলেন মাসিমা, এ কী করলি অমি? কী বলেছিলি মাসিমাকে?…

অমিত ঘর ছেড়ে চলে গেল।

মাসিমার শেষ কাজ হয়ে যাবার পর আমাকে বা বাবাকে একটা কথাও না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে গেল অমিত। একদিন ভোররাতে উঠে শুধু দেখলাম, দালানে শ্বেতপাথরের টেবিলে সে মাসের ভাড়ার টাকাটা, ঘরের চাবিটা তলায় চাপা দেওয়া রয়েছে। একটা চিঠি না, কিছু না।

টুকটুক বলল, শুতে চলল। অনেক রাত হয়েছে।

সত্যিই রাত হয়ে গেছে। শুয়ে পড়লাম। কিন্তু সত্যিই ঘুম আসছে না। সামনের জানলার পর্দা সরানো দু-পাশে। চাঁদটা একেবারে ঠিক চোখের ওপর। টুকটুক বলল, একটা জিনিস করেছি, দেখবে?

এখন? এই এত রাতে?

ঘুমোচ্ছ না বলে বলছি।

টুকটুক উঠল, আলো জ্বালল, আলমারি খুলল। ভেতর থেকে দুটো প্যাকেট টেনে বের করল। একটা প্যাকেটে হাত-কাটা খুব সুন্দর একটা স্লিপোভার, ধবধবে সাদা। আর একটা প্যাকেটে ঠিক ওইরকম আরেকটা স্লিপোভার, কুচকুচে কালো।

টুকটুক বলল, তুমি ফর্সা, তোমাকে কালোটা মানাবে, আর তোমার বন্ধু কালো, ওকে সাদাটা…।

হেসে বললাম, তোমার কালার-ম্যাচিং সম্পর্কে ধারণা খুব পুরোনো টুকটুক। এখন সবাই জানে ফর্সা রঙে সাদা পরতে হয়। যাই হোক ওটা একটা ব্যাপারই না। বেশ সুন্দর হয়েছে।

টুকটুক বলল, অস্ট্রেলিয়া যাবার আগে এটা তোমার বন্ধুকে দিয়ে দিয়ো।

বাঃ, তুমি উপহার দিচ্ছ, তুমিই দেবে, আমি দিতে যাব কেন? আমি পাশ ফিরে শুলাম। টুকটুক তা হলে এখনও অমির জন্য ভাবে। আশ্চর্য!

অমিকে সেবার খুঁজে বার করলাম ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে। পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠল। বললাম, ভূত দেখলি নাকি?

ফিকে হাসল। বললাম, ও বাড়িতে থাকতে আর না-ই যাস। আমাকে তোর ঠিকানাটা অন্তত দে। আমি যে তোকে ছেড়ে খেতে শুতে পারি না, একথাটা তো এতদিনে জানিসই!

ঠিকানাটা খসখস করে লিখে দিল। আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটা মেসের ঠিকানা। এরপর আমাদের জীবন, আলাপ, অন্তরঙ্গতা সব একেবারেই লেখাপড়া-কেন্দ্রিক হয়ে উঠল। মাস্টারমশাইরা অর্থাৎ সায়েন্স কলেজের মাস্টারমশাইরা নিত্য আসতেন বাড়িতে। ওঁরা বলতেন কে যে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবে আর কে যে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হবে বোঝা যাচ্ছে না। আমি বলতাম, অমিত হবে, অমি বলত—গোপাল হবে। পাঁচ নম্বর, মাত্র পাঁচ নম্বরের জন্য সেকেন্ড হয়ে গেল অমিত।

সেইজন্যেই মনোদুঃখে কী না জানি না আমি একটা চাকরি নিয়ে বসল। ভালো চাকরি, কিন্তু গবেষণার সুযোগ নেই। শুধু সেলস। অনেক বোঝালাম, শেষে ইনস্টিটুটে যোগ দিতে ও রাজি হল। তারপর আমাদের যুগ্ন গবেষক-জীবনের শুরু। কী পরিশ্রম করছে অমি, আমি বুঝতে পারছি ও এবার কিছু করবে। করবেই। প্রাণপণে ওকে সাহায্য করে যাচ্ছি। ওর নির্দেশমতো চলছি। পেপার বার হচ্ছে আমাদের উভয়ের নামে। তারপর? তারপর ভাগ্যের সেই অদ্ভুত খেলা। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সেই আবিষ্কার যা অদ্ভুতভাবে শেষ পর্যন্ত আমার হাত দিয়েই হল। নেশায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। রাতে সবাই চলে যাবার পর আবার গেলাম ল্যাবে। দারোয়ানকে দিয়ে চাবি খুলিয়ে, সারারাত কাজ করছি, খুঁজছি তারপর হঠাৎ আলোর ঝলক। পর দিন সকালে চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেল খবর। প্রেস কনফারেন্স ডাকলেন ডক্টর বর্মা, আমি জোর করেছিলাম আমাদের দুজনের নামই থাক। অমি রাজি হল না। রিসার্চ ছাড়ল অমি। অবশ্য ছাড়ল বলা ঠিক না। চাকরি তো রিসার্চেরই। কিন্তু ওর সেইসব মূল্যবান গবেষণা তো আর ওর ব্যক্তিগত থাকবে না। অনেক বারণ করেছিলাম। কিছুতেই শুনল না। ওর নাকি টাকার দরকার। আমারও আর ভালো লাগল না। ছেড়ে দিলাম ইনসটিটিউট। সেই সময়ে বাবা মারা গেলেন, আমাকে হাল ধরতে হল বাবার ব্যাবসার। মনে অশান্তি নিজের পছন্দমতো কাজ পাচ্ছি না। বাবার ইলেকট্রিক্যাল পার্টস-এর ব্যাবসা, বাঁধা খদ্দের সরকার, কাজের মধ্যে রস পাই না। একদিন এসপ্লানেড়ে গাড়ি থেমে আছে ট্রাফিক সিগন্যালে, দেখলাম ওদের দুজনকে। অমি তখনও পুরনো মেস ছাড়েনি, বলে, বেশ তো আছি, নিজস্ব বাড়ি মানেই নানান ঝামেলা। মনে মনে হাসলাম, ও এইজন্য তোমার টাকার দরকার। এইবার তুমি বাড়ির ঝামেলায় যাবে। গাড়ি ঘুরিয়ে তুলে নিলাম। পরিচয় হল। হেসে বললাম, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবি কেন? আমার বাড়িটা কী তোর নয়?

পরের রবিবারই ডাকলাম ওদের দুজনকে। আলোয় ফুলে ভরে দিলাম বাড়ি। ইনটিরিয়র ডেকোরেটর ডেকে ঘর সাজালাম। ওরা এল। সারাটা মুগ্ধ সম্মোহিত সন্ধ্যা খালি গান আর গল্প, গল্প আর ছবি, যেখানে যা ভালো খাদ্য আছে, অমি যা ভালোবাসে, ওর পক্ষে ভালোবাসা সম্ভব—সবই জড়ো করেছিলাম।

চিকমিকে সব জরির ঝালর। টুংটাং ঘন্টার মধ্যে দিয়ে বড়ো বড়ো চোখ কপালে তুলে টুকটুক বলছিল, এত বড়ো, এত সুন্দর বাড়ি, এই বিশাল গাড়ি, এত সম্পদ সব আপনার একার?—কোনো দ্বিতীয় ভাগীদার নেই?

আমি হেসে বলছিলাম, আর এইসব রোশনি, এই খুশবু, এই সমস্ত আপ্যায়ন আয়োজন আপনার। আপনার একার। কোনো ভাগীদার নেই।

স্বপ্নালু চোখে টুকটুক বলছিল, কথা বলাও কি আপনি মাস্টারমশাই রেখে শিখেছিলেন?

আমি বলছিলাম, চলতে ফিরতে হাসতে যদি আপনি মাস্টারমশাই রেখে শিখে না থাকেন, তা হলে কথা বলতে শিখতেও আমার মাস্টারের দরকার হয়নি।

আমার বাড়ি ওদের জন্যে খোলা রইল। চাবি দিয়ে দিলাম একটা-অমির হাতে। আমি সেটা টুকটুকের হাতে চালান করে দিল।

দু-তিন দিন পর টুকটুক এল একা একা। অমি নাকি কাজে ব্যস্ত। আরও কয়েক দিন পর টুকটুক আবার এল একা, অমি ট্যুরে গেছে। আরও কয়েকদিন পর টুকটুক আমার দেওয়া চাবিটা ব্যবহার করল। অর্থাৎ আমি বাড়ি এসে দেখলাম টুকটুক–দালান আলো করে সোফায় এলিয়ে আছে। তারপর একদিন টুকটুক এসে কান্নায় ভেঙে পড়ল। অমি নাকি বিয়ে করতে চাইছে না। প্রায় দু বছর এত মেলামেশার পর…আমি মুখ দেখাতে পারব না বাড়িতে, টুকটুক দু হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছিল। অমির অফিসে গেলাম। খুব উত্তপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। ওর ঘরে আরও দুজন কর্মী বসে। গ্রাহ্য করলাম না। যা বলার বললাম। অমি বলল, আমি ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো মেলামেশা করেছি, বিয়ে করব কথা দিইনি তো!

 বাঃ চমৎকার। তুই যে এত বড়ো স্কাউন্ট্রেল তা আমার জানা ছিল না। কথা দিসনি তো ও ভাবল কী করে? এই সময়ে সহকর্মী দুটি উঠে বাইরে চলে গেল।

অমিত মৃদু হেসে বলল, তাই তো? ভাবল কেন? আমার বাঁধা পড়বার ইচ্ছে নেই, কাজ অনেক কাজ, আচ্ছা গোপাল, দ্যাখ না ও যদি তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়!

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ওকে যখন এভাবে পরিত্যাগ করেছ, তখন ও এরপর কাকে বিয়ে করতে রাজি হবে সে কথা ভেবে আর নাই মাথা ঘামালে!

যাক গে, সে সব দিনও গত হয়ে গেছে। গত মাস কয়েক ধরেই আমার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে দুজনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। আমার এই লোহা-লক্কড় আর ভালো লাগছে না, ওটা আছে থাক। ওষুধের ফ্যাক্টরি করব। আমি অনেক প্ল্যান ট্যান ছকে দিল, এসবে ওর মাথা তো পরিষ্কার! আমি বললাম, তোকে কিন্তু আসতে হবে আমার সঙ্গে।

কী ভাবে?

কেন? তুই ওয়ার্কিং পার্টনার, ল্যাবরেটরির ভার তোর ওপর।

অমিত যেন কী ভাবছে। অনেকক্ষণ পরে বলল, দেখা যাক।

তারপর কালকে ওই ঘোষণা। আগে থেকে কোনো খবর না, কিছু না। দুম করে—কাল আমি মেলবোর্ন যাচ্ছি। হ্যাঁ ওখানেই চাকরি নিয়েছি। কবে ফিরব ঠিক নেই। খুব সম্ভব কোনোদিন না।

ভোর হয়ে গেছে। সারা রাত এক ফোঁটাও ঘুমোতে পারিনি।

বলেছিলাম, আমার ওষুধের কারখানার কী হবে?

তুই একটা ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ডি এস সি বায়োকেমিস্ট গোপাল, তোর ভাবনা হওয়া উচিত নয়। অমিত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।

বোধহয় আধ ঘন্টার মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। টুকটুক জাগিয়ে দিল।–রেডি হবে না? প্লেন তো নটায়।

ঠিক। তা তুমিও যাচ্ছো নাকি?

বাঃ, তুমিই তো বললে উপহার নাকি আমার নিজে গিয়ে দিতে হবে।

এই ফ্যান্সি ড্রেসটা পরেই?

টুকটুক গোঁয়ারের মতো বলল, হ্যাঁ।

কালকের সেই রাজস্থানি পোশাকটা পরেছে ও, এটা পরলে ওকে রানা প্রতাপ সিংহের যুগের রাজপুতানি সুন্দরীদের মতো দেখায়। দারুণ সেজেছে টুকটুক। আপাদমস্তক রঙিন। ম্যাচিং গয়না ঝকমক করছে। পারফিউমের গন্ধে ঘর ভরে যাচ্ছে।

আমি উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। ইচ্ছে ছিল, অমির সঙ্গে দিল্লি পর্যন্ত গিয়ে সি-অফ করবার। কিন্তু এত দেরিতে খবরটা জানায় সেটা সম্ভব হল না। টুকটুকের হাতে মস্ত ব্যাগের মধ্যে প্যাকেট। আমি মনে করিয়ে দিয়েছিলাম একবার। কিন্তু টুকটুকের ভুল হয়নি। খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল ও কোনটা দিচ্ছে অমিকে। সাদাটা না কালোটা। ব্যাগ ফাঁক করে দেখাল টুকটুক। গোঁয়ারের মতো মুখ। সাদাটাই। ওই সাদাটার সুতোয় সুতোয় ও বোধকরি অমি সংক্রান্ত ভাবনাগুলো বুনে রেখেছে।

অমিটা স্টেটস থেকে ঘুরে আসতে পারত। জার্মানি। ফ্রান্স কিংবা ইউ কে হলেও কিছু বলার ছিল না। ওর কোম্পানি না পাঠাক, আমি পাঠাতাম। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া! ওকি চিজ-রুটি, আর ভেড়ার মাংস, কিংবা ক্রিকেট-ট্রিকেটের লোভে অস্ট্রেলিয়া চলল নাকি? কথাটা মনে করে হাসি পেল আমার। কিন্তু এয়ারপোর্ট যতই এগিয়ে আসছে, হাসি মুছে যাচ্ছে, আমার মন থেকে। মুখ থেকে। অমি চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে, আমি কেমন করে বাঁচব? আর দুজনে পাশাপাশি কাজ করতে পাব না। আর হবে না সেইসব আচ্ছা, তর্ক, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা যেগুলো আমার জীবনে অপরিহার্য ছিল, আমার ধারণা অমিতের জীবনেও ছিল। এখন সে ধারণা আমি পরম অভিমানে পালটে নিতে বাধ্য হচ্ছি। একা একা অমি মেলবোর্ন চলল। এখনও ভীষণ মুখচোরা। প্রয়োজনের কথা কাউকে বলতে পারে না। বিদেশি শহরে ওর একাকিত্ব যেন আমার।

ওই তো অমি। লাউঞ্জে ঢুকেই দেখতে পেলাম অমি একটা দলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে। সব ওর সহকর্মী সহকর্মিণী। আমাদের দেখতে পেয়ে হাসল। টুকটুক বলল, পালিয়ে যাচ্ছেন বেশ! বাঃ!

অমি হেসে বলল, যঃ পলায়তি স জীবতি মিসেস সেন। ওর অফিসের কলিগরা দেখলাম খুব বিচলিত, একটি অল্পবয়সি উৎসাহী ছেলে বলল, এখনও ভেবে দেখুন অমিতদা। আপনি না থাকলে আমাদের পুরো টিমটাই কানা হয়ে যাবে।

অমি তার পিঠে হাত রেখে বলল, কথাটা ঠিক বললে না অরূপ। কারো জন্য কিছু পড়ে থাকে না। নেচার অ্যাভ আ ভ্যাকুয়াম, জানো না!

যতই প্রবাদ প্রবচন বলুন, আমাদের ব্যাবহারিক অভিজ্ঞতা হল যে স্থান একবার শূন্য হয় তা আর কখনও পোরে না।

বিশ্বাস করো এ ছাড়া আমার উপার ছিল না। এই অবিশ্বাস্য কথাটা আমাদের দিকে ছুড়ে দিয়ে অমি হঠাৎ একটি সহকর্মিণীর দিকে এগিয়ে গেল, চলতে চলতে হঠাৎ পেছন ফিরে বলল, গোপাল, মিসেস সেন আলাপ করানো হয়নি। এই আমার স্ত্রী অর্পিতা। মেয়েটি দুহাত জড়ো করে ফিরে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ করছিলাম–এখন ভালো করে দেখলাম স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ বুদ্ধির শ্রী মেয়েটির মুখে। ঝকঝকে দাঁতে নির্মল হাসি। ধবধবে সাদা একটা দেশি সিল্ক পরেছে, ছোটো চুল পেছনে গোছা করে বাঁধা। তার পাশে কটকটে দিনের আলোয় টুকটুক যেন যাত্রাদলের রং মাখা সং।

আমাদের বিমূঢ় রেখে ওরা দুজন এগিয়ে গেল। এবোডড্রামের টারম্যাকের ওপর দিয়ে ওরা হাঁটছে। প্লেনের সিঁড়ি থেকে একবার হাত তুলে বিদায় জানাল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সিঁড়ি ফিরে আসছে। প্লেন গতি নিল বলে।

পেছন ফিরে দেখি টুকটুক দু-হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। অমি কবে বিয়ে করল? অস্ট্রেলিয়া যাবার ব্যবস্থার মতো বিয়ের ব্যাপারটাও চুপিচুপি সেরেছে। কেন? আমাকে জানায়নি কেন? কয়েকটা বিদ্যুৎ নির্মমভাবে ঝলকাচ্ছে। আমি অমিকে মেঘের মধ্যে একবার দেখতে পাচ্ছি, একবার পাচ্ছি না। ও কি আমাকে ভয় পেয়েছে? কেন? ও কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেনি? কত কাল? ও কি আমাকে কোনোদিনই…!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *