7 of 8

লক্ষপতি

লক্ষপতি

আমরা সকলেই লক্ষপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখি। চোখের সামনে কেউ কেউ লক্ষপতি হয়ে যায়, তখন তাকে আমরা ঈর্ষা করি। তার অর্থাগমের পথটি যে ক্লেদাক্ত এবং কালিমালিপ্ত, সে লোকটি যে জোচ্চোর এবং প্রতারক সেটা যে ধনবান হওয়ামাত্র আমরা বুঝে ফেলি।

লক্ষপতি কথাটা কথার কথা। আসলে লাখ টাকার আজকাল আর কোনও দাম নেই। বাড়ি তৈরির দু’ কাঠা ভাল জমি লাখ টাকায় পাওয়া যায় না। এমনকী ভাল করে মেয়ের বিয়ে দিতে গেলে এক লাখ টাকায় গায়ের সোনার গয়না হওয়াই কঠিন। যদি আপনি কোনও গর্হিত ফৌজদারি অপরাধ করে ফেলেন, তবে আজকের বাজারে লাখ টাকা ঘুষ দিলে খালাস হওয়া দূরের কথা জামিনের বন্দোবস্ত করতে পর্যন্ত পারবেন না। এ বক্তব্য আমার নয়, এ বিষয়ে প্রকৃত ভুক্তভোগীর কথা।

অনেকদিন আগে আমারই মতো হতদরিদ্র আমার এক সুহৃদ পরিহাস করে বলেছিলেন, ‘লাখপতি কোনও ব্যাপার নয়! এক লাখ টাকা ব্যাপারটা বোঝো?’ আমি অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকায় তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি দৈনিক তিনশো টাকা করে ব্যাঙ্কে রেখে যাও, এক বছরে তুমি লাখপতি হয়ে যাবে।’

অবশ্য এর চেয়ে অনেক ভাল বুঝেছিলেন এক সাংবাদিক। কী এক সংবাদের গোলমালে কে এক মাননীয় ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা এনেছিলেন এক লাখ টাকা খেসারত দাবি করে। আদালতের কাঠগড়ায় বিপক্ষের উকিলবাবু তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এক লাখ টাকা? বোঝেন?’ রীতিমতো আঁতে ঘা দিয়ে প্রশ্ন, কিন্তু সেই সাংবাদিক মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘খুব ভাল বুঝি। আমি যদি আজ আমার স্ত্রীকে এক লাখ টাকা দিই আর তিনি যদি তার থেকে দৈনিক শ পাঁচেক টাকা নিয়ে এই টুকিটাকি, শাড়ি, সেন্ট, আমার হাফ ডজন রুমাল, তাঁর ভাইপোর দুটো টিনটিনের বই, সেই সঙ্গে একটু ট্যাক্সি, সামান্য চিনেখাবার, কোল্ড ড্রিঙ্ক, বেশি দূর নয় এই গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেট,…’ বিপক্ষের উকিলবাবু ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন, ‘আপনি কী আবোলতাবোল বলছেন। এটা আদালত।’ সাংবাদিক অধিকতর মোলামেয় হেসে বললেন, ‘আগে শেষ করতে দিন কথাটা। আমার স্ত্রী যদি ওই রকম নিউমার্কেট-গড়িয়াহাট, এই সামান্য শ-পাঁচেক টাকা সকালে বা বিকেলে, দু’বেলা নয় একবেলাই, বেরোন তা হলে ঠিক ছয় মাস কুড়ি দিন পরে, মানে আজ হল তিরিশে মার্চ তিনি অক্টোবর মাসের থার্ড উইকে আমার কাছে আবার টাকা চাইবেন।

প্রথমে যে কথা বলছিলাম, এই চূড়ান্ত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দুর্দিনে লাখপতি কথাটা বেশ খেলো হয়ে গেছে। দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর প্রবল মুদ্রাস্ফীতির ইতালি দেশে একটা গল্প চালু হয়েছিল যে, আগে পকেটভরতি টাকা নিয়ে এসে ব্যাগভরতি বাজার করে নিয়ে যেতাম আর এখন ব্যাগভরতি টাকা নিয়ে এসে পকেটভর্তি বাজার নিয়ে যাই। অবশ্য আমাদের টাকার অবস্থা এখনও ও রকম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছোয়নি কিন্তু লাখপতি কথাটার আর কোনও গুরুত্ব নেই, এখন বলা উচিত ক্রোড়পতি বা কোটিপতি।

সাহেবরা বলেন মিলিওনের, বিলিওনের। মিলিওনের মানে দশ লক্ষের মালিক, তাও দশ লক্ষ টাকা নয়, দশ লক্ষ পাউন্ড অথবা ডলার অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রামূল্যে দেড় কোটি বা এক কোটি টাকা। আর বিলিওনের তো সাংঘাতিক, আমেরিকায় আর ফ্রান্সে এক হাজার মিলিয়নে অর্থাৎ একশো কোটিতে এক বিলিয়ন। আর ইংরেজরা তো বাহাদুর, এক মিলিয়ন এক মিলিয়নে অর্থাৎ এক লক্ষ কোটিতে হবে এক বিলিয়ন। যদি কোনওদিন কোথাও কোনও ইংরেজ বিলিওনের চাক্ষুষ করেন, জানবেন যে এঁর অন্তত পনেরো লক্ষ কোটি টাকা আছে।

হিসেবটা বড় গোলমেলে হয়ে গেল। তার চেয়েও গোলমেলে ব্যাপার হল লোকে এত টাকা করে কী করে এবং করেই বা কী? ঈশ্বর জানেন আর জানে সেই উপকথার ভিখারি যে বলেছিল, ‘আমি যদি বড়লোক হতাম দৈনিক সব ভাত গুড় দিয়ে খেতাম।’

কলকাতা ময়দানে প্রাতঃভ্রমণের সুযোগে আমার সঙ্গে এক কুবেরলালের আলাপ হয়েছে। তিনি বিলিওনের কিনা জানি না, কিন্তু মিলিওনের নিশ্চয়ই, অবশ্যই ক্রোড়পতি।

শীতের এক কুয়াশাভরা সকালে সেদিন উত্তর থেকে হিমসিম হাওয়া বইছে, দূরে টাটা সেন্টারের মাথা ছুঁয়ে সাদা চাঁদের মতো ঠান্ডা সূর্য কলকাতার আকাশে উঠে আসছে, ময়দানে ঘাসের উপর ব্রিগ্রেড প্যারেডের ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডের সবুজ আঙিনায় আমি কুবেরলালজি। সেই শীতপ্রভাতের শিহরণে, কী যেন ছিল না হলে এক প্রৌঢ় ধনকুবের পাকা ব্যবসায়ী তাঁর সাফল্যের মূলসূত্রটি আমার মতো হাভাতের কাছে বলে বসলেন কেন? কুবেরলালজি হঠাৎই কথায় কথায় বললেন, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং কঠোর পরিশ্রম ছাড়াও প্রখর ব্যবসায়বুদ্ধিই তাঁর উন্নতির প্রধান কারণ। তিনি বললেন, কপর্দকশূন্য অবস্থায় আরম্ভ করেছিলেন আজ গণেশ ঠাকুর আর মা লছমির দয়ায় তাঁর কোনও রকমে বেশ চলে যাচ্ছে। আমাকে বললেন যে বছর পনেরো-কুড়ি আগে একদিন ক্যামাক স্ট্রিট, থিয়েটার রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল মালটিস্টোরিভ বিল্ডিং বানানো আরম্ভ করলে কেমন হয়, এসব পাড়ায় ফ্ল্যাট চাইলে ফ্ল্যাট, অফিস চাইলে অফিস, দোকান চাইলে দোকান দারুণ চলবে। বানিয়ে ফেললাম কয়েকটা হাইরাইজ বাড়ি, ক্রেতারা বাড়ি বয়ে কাঁচা টাকা পৌঁছে দিয়ে গেল।

আমি একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম, একবারও প্রশ্ন করতে সাহস পেলাম না অত হাহরাইজ বিল্ডিং বানানোর টাকাটা কোথায় পেলেন। কুবেরলালজির আত্মজীবনী তখনও শেষ হয়নি। তিনি বললেন, ‘এখন আমি এমন জিনিস ধরেছি যে কেউ ভাবতেই পারবে না। হঠাৎ মাথায় খেলে গেল ব্যপারটা, এবার যা করছি তার আর কোনও মার নেই।’ এই বলে তিনি মৃদু রহস্যময় হাসি হাসতে লাগলেন, তারপর তিনি যেন তাঁর কোনও গোপন মূল্যবান কথা আমাকে, শুধুমাত্র আমাকেই ফাঁস করে দিচ্ছেন, এই রকম মুখ চোখ করে প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘এবার পাঁচতারা হোটেল ভারতবর্ষের সব বড় শহরে একটা করে পাঁচতারা হোটেল। পাঁচতারা হোটেলের বড় অভাব দেশে পাবলিক লুফে নেবে।’

তারপর আমাকে পরামর্শ দিলেন, ‘আপনিও দু-একটা হোটেল বানান, পাঁচতারা না পারেন চারতারা, তিনতারা।’ এসব করতে গেলে যে টাকা লাগে, কুবেরলালজির কপর্দকশূন্যতা আর আমার কপর্দকশূন্যতা যে এক ব্যাপার নয়, সেটা তাঁকে কে বোঝাবে?

দু’-চারজন লোক নিতান্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে যে বড় হয় না, তা নয়। তাদের সংখ্যা নগণ্য। এক জন্মে এক ধাপ ওঠা যায়। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ-মধ্যবিত্ত, বড়জোর উচ্চবিত্ত। কিন্তু নিতান্ত হাঘরে অবস্থা থেকে কোটিপতি হওয়া, জালজোচ্চুরি বা ডাকাতি না করে, শুধু বুদ্ধি ও পরিশ্রম দ্বারা অসম্ভব। সেই যে এক হঠাৎ ধনবান ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘আমার এই আর্থিক উন্নতির মূলে রয়েছে ন্যায়নীতি, সততা, কঠোর পরিশ্রম আর বিপত্নীক এবং অপুত্রক অবস্থায় আমার বড়মামার মৃত্যু, যাঁর পঞ্চাশ লাখ টাকার সম্পত্তি আমি একাই পেয়েছি’, কথাটা খুবই খাঁটি।

এক বণিকসভার অধিবেশনে এক বিখ্যাত ধনপতি তাঁর কাল্পনিক কষ্টের জীবনের কথা বলছিলেন, ‘আমি যেদিন এই শহরে প্রথম আসি সেদিন কী দুর্যোগ, শীতের ঠান্ডা রাত্রি, ঝড়-বৃষ্টি, কনকনে হাওয়া, আমি কাউকে চিনি না, জানি না, গায়ে জামাকাপড় নেই, শুধু কেঁদে যাচ্ছি …’, এমন সময় এক প্রগল্‌ভ শ্রোতা বাধা দিলেন, ‘কিন্তু স্যার, আমরা যে শুনেছি আপনি এই শহরেই জন্মেছেন।’ থতমত খেয়ে বক্তা আমতা আমতা করে বললেন, ‘আমি আমার জন্মদিনের কথাই বলছি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *