বংশধর

যেদিন আমার পিতামহের কাফন-মোড়া শরীরের ওপর
নশ্বর নক্সার মতো চাংবাঁশটায় পুঞ্জ পুঞ্জ শোক হয়ে কেবলি
ঝরে পড়ছিল কালো মাটির দলা,
তখনও আমি পৃথিবীর কেউ নই।

পিতামহের ডাক নদীর এক তীর থেকে অন্য তীরে
সহজে করতো যাত্রা, শুনেছি।
তাঁর সেই গম্‌গমে ডাক কবিতার সুরে যেতো মিশে-
এমন কোনো কিংবদন্তীর জন্ম হয়নি আমাদের পরিবারে।

পিতামহীর কথা যখনই ভাবি, শুধু একটি দৃশ্য
ভেসে ওঠে পুরোনো দিনের আরশি ছেড়ে বর্তমানের আয়নায়
ছায়াচ্ছন্ন ঘরে বার্নিশ-চটা পালংকে এগিয়ে-থাকা
বর্ষিয়সী এক মহিলা, চোখ দুটো ভরা দুপুরে
হারিকেনের আলোর মতো নিষ্প্রভ।
তাঁর সেই অনুজ্জ্বল এক-জোড়া চোখ
কোনোদিন কবিতার পংক্তির আভায় জ্বলজ্বলে
হয়েছিল কিনা, জানি না।

আমার মাতামহ সকালের চঞ্চল বেলায় বারংবার
বুক-পকেট থেকে চেন-বন্দি ঘড়িটা দেখতেন
আর দশটার আগেই ছাতা হাতে ছুটতেন
কাচারির দিকে-সেখানে প্রায়-অনুল্লেখ্য কোনো
কাজ করতেন তিনি। একটা টাইপরাইটার ছিল তাঁর;
মাঝে-মাঝে দেখতাম কয়েকটি অভিজ্ঞ আঙুল
ব্যালে নর্তকের মতো নেচে চলেছে কী-বোর্ডে।
যতদূর জানি, মাতামহের সেই অতি-পুরাতন শব্দসমূদয়
কাব্যের পাড়ার কেউ ছিল না।

আমার মাতামহী, সবার অলক্ষ্যে যিনি শাদা অথচ সুদীর্ঘ
চুল আঁচড়াতেন মধ্যদিনে কাঠের চিরুনি দিয়ে আর
সন্ধ্যা হলেই মুরগির বাচ্চাগুলোকে দর্বায় পোরার জন্যে
অস্থির পায়ে করতেন ছুটোছুটি-যত আন্দোলিত হতেন আমার
মাতামহের ডাকে ততটা আর কিছুতেই নয়।
বুঝি তাই কবিতার ডাক তাকে কখনও কাছে টানেনি।

আমার পিতা, সেই অমিতবিক্রম সিংহপুরুষ,
জীবনের দুটো শিং ধরে লড়তে লড়তে নিজেকে যিনি
ক্লান্ত করেছিলেন, যিনি ভালোবাসতেন হেঁটে যেতে
সুঘ্রাণ ভরা শস্য-ক্ষেতের আলের ওপর,
কোনোদিন পা বাড়াননি কাব্যের প্রান্তরে।

না, তাঁরা কেউ পা রাখেননি নিঃসঙ্গতার উথালপাথাল
সমুদ্র-ঘেরা কবিতার দ্বীপপুঞ্জে! কিন্তু ঐ পুণ্যজনের
স্মৃতির অজর শরীরে
কবিতার সোনালি রূপালি জল ছিটোচ্ছে
তাঁদেরই এক ফ্যাকাসে বংশধর
সময়ের হিংস্র আঁচড়ে ক্রমাগত জর্জর হতে হতে।