১.১২ বহ্নিশিখা

১.১২ বহ্নিশিখা

এতদূর পর্যন্ত আমরা মঁসিয় মোক্লের-এর বিবরণী অনুসরণ করে তিব্বতের পাদদেশে এসে দাঁড়িয়েছি। শীতকালটা তারা এখানেই শিবির করে কাটাবে। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে আমাদের গল্পের অন্য যে-পটটি উন্মোচিত হয়েছিলো এবার তার দিকেই একটু ফেরা যাক।

বেহেমথ যখন এলাহাবাদে পৌঁছোয়, তখন কী হয়েছিলো পাঠকদের নিশ্চয়ই তা মনে আছে। সেখানেই পঁচিশে মে-র একটি কাগজ থেকে কর্নেল মানরো নানাসাহেবের মৃত্যুর খবর পান। কিন্তু সত্যি কি অবশেষে এই অগ্নিগর্ভ পুরুষটি ছোট্ট একটি খণ্ডযুদ্ধে সাতপুরা পাহাড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন? না কি অন্য অনেকবার যেমন সত্যি-মিথ্যে গুজব। ছড়িয়েছিলো, এটা তেমনি কোনোকিছু? এটা অবশ্য আমরা নিজেরাই আন্দাজ করে নিতে পারবো যদি আবার সাতই মার্চের রাত্রিবেলায় অজন্তার গুহা থেকে বেরিয়ে-পড়া নানাসাহেব, বালাজি রাও ও তার অনুচরদের পিছন পিছন খানিকটা অনুসরণ করে আসি।

সুরাটের কাছে সমুদ্রে পড়েছে তাপ্তী নদী; কিন্তু যেখানে তার উৎস, সেখানে, তাকে ডিঙিয়ে, অজন্তা থেকে একশো মাইল দূরে, সাতপুরা পর্বতের এক গিরিখাতে। আশ্রয় নিয়েছিলেন নানাসাহেব—একটানা ষাট ঘন্টা ঘোড়া ছুটিয়ে এতদূরে এসেছেন তারা। জায়গাটা গণ্ডোয়ানার কাছে : গণ্ডোয়ানার পরিধি দুশো বর্গমাইল-তিরিশ লাখের উপর বাসিন্দা এখানকার—মূলত আদিবাসীদের দ্বারাই অধ্যুষিত। আর এরা এতদিন ছিলো বন্য, তবে ঈষৎ শান্ত হয়েছে ইদানীং—কিন্তু ঠিকমতো ফুলকি ছড়াতে পারলে বিস্ফোরণ ঘটাতে কতক্ষণ? ক্ষিপ্রতায় এদের তুলনা নেই, গেরিলা যুদ্ধে এদের জুড়ি মেলে না। এরা যদি একবার নানাসাহেবের সঙ্গে যোগ দিয়ে তার অঙ্গুলিহেলনে বিদ্রোহ করে, তাহলে সন্দেহ নেই ইংরেজদের বিষম বেগ পেতে হবে। গণ্ডোয়ানার উত্তরে বুন্দেলখণ্ড; বিন্ধ্য পাহাড়ের কোলে, যমুনার তীরে, এই পার্বত্য প্রদেশে নিবিড় অরণ্যে বাস করে আরেক দল প্রচণ্ড মানুষ—একদা টিপু সুলতানের হয়ে লড়াই করে এরা বিদেশীদের প্রতিরোধ করতে চেয়েছিলো। আর গণ্ডোয়ানার পূর্বে থাকে কোরা, পশ্চিমে ভীল উপজাতি। কাজেই এইসব পার্বত্য জাতির মধ্যে আগুন ছিটোতে হলে যেজায়গাটার আশ্রয় নিলে সবচেয়ে ভালো হয়, অনেক ভেবেচিন্তে শেষটায় নানাসাহেব এসে আশ্রয় নিয়েছেন সেখানেই।

পাশেই নর্মদার তীরে ছোট্ট একটা অজ পাড়াগাঁ ছিলো এককালে—এখন সেখানে কোনো বসতি নেই। সংকীর্ণ গিরিখাত দিয়ে ঘেরা সুরক্ষিত একটি অঞ্চল। গিরিজন আদিবাসীরা বলে সেখানে নাকি এক পাগলি ঘুরে বেড়ায় কেবল—তিন বছর ধরে ওই পাগলি ওখানে আছে-একা-একা থাকে, আপন মনেই বিড়বিড় করে সারাক্ষণ কী যেন বকে, লোকের সামনে চুপ করে থাকে—সে-যে কোনদেশী স্ত্রীলোক কেউ জানে না —রাতের বেলায় মশাল হাতে তাকে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় বলে লোকে তার নাম দিয়েছে বহ্নিশিখা।

তার সম্বন্ধে নানা আশ্চর্য গুজব শুনে বালাজি রাও অনেক খবর নিলেন। কিন্তু না, একেবারে উন্মাদিনী সে, চোখে শূন্য দৃষ্টি, কানে যেন কোনো অস্ফুটভাষা শোনে, বিড়বিড় করে কথা কয়, বদ্ধ উন্মাদ। এক অর্থে জীবস্মৃত। যেন কোনো অকথ্য বিভীষিকা তাকে স্বাভাবিক জগৎ থেকে কোনো অপার্থিব দুঃস্বপ্নের কোলে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে—যেখানে কোনো ভাষা নেই, দৃশ্য নেই, শব্দ নেই—যেটা নিতান্তই এক ইন্দ্রিয়হীন ভীষণ জগৎ যেন। এককালে রূপসী ছিলো, গৌরতনুতে তারই ক্ষীণ আভাস—কিন্তু সে-যে কোনকালে তা কেউ জানে না।

পাহাড়িরা নিরীহ গোবেচারিদের দয়া দেখায়। বহ্নিশিখাকেও কেউ কিছু বলে না। খেতে দেয়, আশ্রয় দেয়, ঘুরে বেড়াতে দেয় ইতস্তত। কিন্তু কে এই রহস্যময়ী? কতদিন ধরে সে এমনি উম্মাদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে? কোত্থেকে সে এসেছে? প্রথম কবে এলো সে গণ্ডোয়ানায়? কেন তার হাতে জ্বলন্ত মশাল থাকে সবসময়? কেউ এসব প্রশ্নের উত্তর জানে না। মাঝে-মাঝে কয়েক মাস আবার তার কোনো খোঁজই থাকে না। কোথায় যায় সে তখন? বিন্ধ্য-সাতপুরার পাহাড়ি জায়গা ছেড়ে চলে যায় সে? বুন্দেলখণ্ডে যায়? মালবে? কেউ জানে না। অনেক সময় আদিবাসীরা ভেবেছে বুঝি সে মরেই গিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ একরাতে আবার মশাল হাতে ফিরে এসেছে এই উম্মাদিনী। আসলে সে যেন কোনো চলন্ত প্রস্তরমূর্তি—তার মন মরে গেছে। কবেই-এখন কবে এই জীর্ণ মনুষ্যদেহ পোকায় কাটে, তা-ই বাকি আছে।

নানাসাহেবেরা যখন তাপ্তীর তীরে পৌঁছলেন, তখন বহ্নিশিখা আবার নিরুদ্দেশ। বালাজি রাও তার সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করলেন, কিন্তু শেষটায় সবটাই তার মনে হলো আদিবাসীদের ভয়ার্ত কল্পনার অমূলক বিলাস। কারণ এক মাস কেটে গেলো-তবু সেখানে তার কোনো খোঁজ নেই। সেইজন্যেই নানাসাহেবের কাছে বহ্নিশিখার কথা তিনি খুলে বললেন না।

+

পুরো একমাস—১২ই মার্চ থেকে ১২ই এপ্রিল পর্যন্ত—নানাসাহেব ওই সংকীর্ণ গিরিসংকটে আত্মগোপন করে ছিলেন। উদ্দেশ্য : ইংরেজরা যাতে তার কোনো হদিশ–পেয়ে ভাবে যে তিনি নিশ্চয়ই মারা গেছেন, আর নয়তো বুনো হাঁসের পিছনে অন্যদিকে ধাওয়া করে চলে যায়। দিনের বেলায় দুই ভাই ঘাঁটি ছেড়ে ককখনো বেরুতেন না : রাত্রে অন্ধকারে গা ঢেকে নর্মদার তীর ধরে দু-ভাই গ্রাম থেকে গ্রামে আদিবাসীদের মধ্যে আগুন ছিটোতে বেরুতেন—সকালে ফিরে এসে দু-ভাই আবার আলোচনায় বসতেন কেমন করে সাতপুরা ও বিন্ধ্যপর্বতের অগ্নিশিখা সমস্ত ভারতে ছড়িয়ে দেয়া যায়। পুরো সিন্ধিয়া রাজ্যে, আর ভোপাল, মালব ও বুন্দেলখণ্ডে যাতে এক বিপুল ব্যুৎসব শুরু হয় তারই প্রস্তুতি চললো ধীরে, গোপনে, নিয়তির মতোই অনিবার্য যেন তার বেগ। যাতে সমস্তটাই একসঙ্গে একটা বারুদের স্কুপের মতো বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে, এই ছিলো তার উদ্দেশ্য।

কেটে গেলো একটি মাস। ততদিনে বম্বাই প্রেসিডেন্সির রাজ্যপাল ধুন্ধুপন্থের কোনো হদিশ না-পেয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছেন, ভেবেছেন যে নিতান্তই একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি ধুন্ধুপন্থের মাথার দাম হেঁকেছেন। কোনো উশকানি বা নতুন জনরব না-পেয়ে লোকের উৎসাহও ধীরে-ধীরে স্তিমিত হয়ে গেলো। আর গুপ্তচরেরা যখন একদিন এই খবর এনে দিলে, নানাসাহেব বেরুলেন বিদ্রোহের বীজ ছিটোতে।

১১ই এপ্রিল তাঁকে দেখা গেলো ইন্দোরে; ১৯শে এপ্রিল শুয়ারিতে; ২৪শে এপ্রিল মালব প্রদেশের প্রধান শহর ভীলশায়; ২৭শে তারিখ গেলেন রাজঘর, ৩০শে সাগর-নগরে; নর্মদার উপত্যকায় ফিরে আসার আগে পুনে যেতে ভুললেন না; সব শেষে গেলেন ভোপালে।

ভোপাল মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল-সিপাহী বিদ্রোহের সময় এখানে আগুন জ্বলেনি। নানাসাহেব আর বালাজি রাও ভোপাল পৌঁছুলেন ২৪শে মে; সেদিন ছিলো মহরমের উৎসব; রাস্তায় মিছিল আর শোভাযাত্রা, তাজিয়া বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। হস্তিবাহিনী, হা হাসান! হা হোসেন! বলে চীৎকার উঠছে থেকে-থেকে। আর তারই মধ্যে গণ্ডোয়ানার জনা-বারো গিরিজন পরিবৃত হয়ে যোগীবেশে নানাসাহেব ও বালাজি রাও এগিয়ে যাচ্ছেন ভোপালের রাস্তা দিয়ে। সন্ধ্যা আসন্ন, অন্ধকার হয়ে আসছে। এমন সময় কে যেন নানাসাহেবের কাঁধে আস্তে আলত করে হাত রাখলে। ফিরে তাকিয়ে তিনি দ্যাখেন একটি বাঙালি দাঁড়িয়ে আছে; নানাসাহেব তাকে চিনতে পারলেন; বিদ্রোহের সময় এই বাঙালিটি একটি ছোট্ট বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়েছিলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন নানাসাহেব। বাঙালি যুবকটি ফিশফিশ করে বললে, কর্নেল মানরো কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন।

কোথায় আছে সে এখন?

তাকে কাল বারাণসীতে দেখেছি।

কোথায় যাচ্ছে?

নেপালের সীমান্তে।

মৎলব?

কয়েক মাস থাকবেন বোধহয় সেখানে।

আর তারপর?

বম্বাই ফিরবেন।

তীক্ষ্ণ একটা শিসের শব্দ শোনা গেলো। অমনি ভিড়ের মধ্য থেকে একটি লোক এসে নানাসাহেবের সামনে দাঁড়ালে। সে আর-কেউ নয়—কালোগনি।

এক্ষুনি যাও, বললেন নানাসাহেব, গিয়ে নেপালের পথে মানরোর দলে যোগ দাও। তার কোনো উপকার করো—দরকার হলে নিজের জীবন বিপন্ন করতেও পেছপা হোয়ো না। বিন্ধ্যপর্বতের কাছাকাছি না-আসা অব্দি কিছুতেই তার সঙ্গ ছেড়ো না। তারপর যখন সে নর্মদার উপত্যকায় এসে পৌঁছুবে–তখন—শুধু তখনই এসে আমাকে তার কথা জানিয়ে যাবে।

কালোগনি ঘাড় নেড়ে তক্ষুনি ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলো। দশ মিনিটের মধ্যে ভোপাল ছেড়ে সে বেরিয়ে পড়লো। আর নানাসাহেব ফিরে এলেন নর্মদার উপত্যকার দিকে-তার গোপন ঘাঁটির উদ্দেশে। পথে সারাক্ষণ নানাসাহেব চুপ করে কেবল ভাবলেন মানরোর কথা; না-জেনে সে কেমন করে ক্রমশ তার কবলে এসে পড়বে–যেমন করে ময়ালের টানে তার মুখের কাছে এগিয়ে আসে নিরীহ জীবজন্তু। বালাজি রাওকে পর্যন্ত এ-সম্বন্ধে এতক্ষণে কিছু বলেননি। তারপর যখন পাহাড়ের মাঝখানে পরিচিত বন্যপথে এসে বিশ্রামের জন্যে ঘোড়া থামিয়েছেন, তখন তিনি আস্তে-আস্তে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলেন।

মানররা কলকাতা থেকে বেরিয়েছে। বম্বাই আসবে নাকি শিগগিরই।

বম্বাইয়ের রাস্তা একেবারে ভারত মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে, বালাজি রাও বললেন।

এবার বম্বাইয়ের রাস্তা, নানাসাহেব স্পষ্ট করে জানালেন, বিন্ধ্য পর্বতে গিয়ে শেষ হবে।

এই উত্তর আর ব্যাখ্যা করার দরকার পড়ে না।

তখন সকালবেলা একটা পাহাড়ি নদীর কাছে তারা নেমেছেন; এবার নদীতীর ধরে উঠে যাবেন। অনুচররা ঘোড়াগুলো নিয়ে আগেই এগিয়ে গেছে। চারদিক এত স্তব্ধ যে নদীর জলের ছন্দ শুনে-শুনে পাহাড় যেন তখনও ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ এমন সময় গুড়ুম করে আওয়াজ হলো—তারপরেই এক সঙ্গে আরো-কতগুলো বন্দুক গর্জে উঠলো।

জনা-পঞ্চাশ গোরা সেপাই নিয়ে এক ইংরেজ অফিসার বন্দুক হাতে নেমে আসছে। ভাটির দিকে। কেউ যেন পালাতে না-পারে, গুলি চালাও, চেঁচিয়ে নির্দেশ দিলে বাহিনীর নেতা।

একসঙ্গে আরেকবার গর্জে উঠলো বন্দুকগুলো, মাটিতে ছিটকে পড়লো কয়েকটি অনুচর। মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই পাহাড়ি নদীর জলে-আর স্রোত তাদের মুহূর্তে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। কোলাহল করে এগিয়ে এলো গোরা সৈন্যরা। এমন সময় ওই মুহূর্ষুর স্কুপের মধ্য থেকে একজন মাথা তুলে ভাঙা গলায় অভিসম্পাত দিলে, বিদেশীরা নিপাত যাক! তার কষ বেয়ে রক্ত বেরিয়ে গেলো গলগল করে, আর অসাড় দেহটা পড়ে গেলো মাটিতে।

বাহিনীর নেতা এগিয়ে এলেন।

এই কি নানাসাহেব?

হ্যাঁ, এই-ই নানাসাহেব, দুটি ফিরিঙ্গি জানালে-তারা কানপুরে ছিলো এক সময়, নানাসাহেবকে চিনতো।

তাহলে এবার অন্যদের পাকড়াতে হবে।

পিছন ধাওয়া করে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেলো সেই সমরবাহিনী।

আর তারা জঙ্গলের মধ্যে মেলাতে না-মেলাতেই একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এক ছায়ামূর্তি-সে আর-কেউ নয়, বহ্নিশিখা।

আগের দিন সন্ধেবেলায় এই বহ্নিশিখাই নিজের আগোচরে ইংরেজ বাহিনীটির অচেতন পথপ্রদর্শক হয়েছিলো। নর্মদার উপত্যকায় সে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো একাকিনী, উদ্দেশ্যহীনা—আর উপজাতিরা যাকে বোকা ভাবতে বিড়বিড় করে বারেবারে সেই উম্মাদিনী আওড়াচ্ছিলো একটি নাম, জপমালার মতো : নানাসাহেব! নানাসাহেব। ফিরিঙ্গিদের নেতা সচমকে এই নাম শুনেই তাকে অনুসরণ করার আদেশ দেন। কিন্তু উম্মাদিনী যেন তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই সচেতন ছিলো না—তাদের কোলাহল যেন একবারও তার কানে পৌঁছোয়নি, তাদের বাহিনী তার চোখে পড়েনি—তার সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন সংহত হয়ে কেবল একটি নামই বারেবারে উচ্চারণ করে যাচ্ছে, নানাসাহেব! আর তার পিছন পিছন এসেই অবশেষে এই বাহিনী নানাসাহেবদের মুখোমুখি পড়ে, গর্জে ওঠে বন্দুক, ভাঙা গলায় সাতপুরা বিন্ধ্যের পাহাড়ের কোলে রক্তরাঙা কথা কটি শোনা যায় : বিদেশীরা নিপাত যাক।

এর বিবরণই এলাহাবাদে বসে ২৬শে মে সন্ধেবেলা খবরকাগজে পড়েছিলেন কর্নেল মানরো, কারণ খবরটা তারযোগে বম্বাই থেকে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে দমকা হাওয়ার মতো।

বহ্নিশিখার চোখের তারায় অদ্ভুত এক আলো জ্বলে উঠেছে; মৃতদেহের স্কুপের কাছে এসে সে ঝুঁকে দাঁড়ালে; তাকিয়ে দেখলে সেই মরণপণ-করা মানুষটির মৃতদেহ–তার সর্বাঙ্গ জুড়ে বিদেশীদের জন্য ঘৃণা। উম্মাদিনী পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো; বুকের যেখানে গুলি বিধেছে সেখানে হাত রাখলে; রক্তে তার ছিন্নবসন রাঙা হয়ে গেলো, কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই, অপলকে সে তাকিয়ে আছে সেই কুলিশকঠোর মরাঠা মুখটির দিকে। তারপর ধীরে-ধীরে সে উঠে দাঁড়ালে, মাথা নাড়ালে কয়েকবার, আপনমনেই—যেন গাছপালা পাহাড় জলের কাছে কিছু বলতে চায় সে, তারপর ধীরেধীরে হেঁটে গেলো জঙ্গলের কালো পথে। আবার এক গভীর ঔদাসীন্য তাকে ঢেকে ফেললে আগাগোড়া। আর শোনা গেলো না তার মুখ থেকে কানপুরের সেই রক্তরাঙা নামটা।