১.১০ ক্যাপ্টেন হুডের পরাক্রম

১.১০ ক্যাপ্টেন হুডের পরাক্রম

সেদিন সারাদিন আমরা গত রাতের ধকল কাটিয়ে ওঠবার জন্যে বিশ্রাম নিলুম এখানে, রাতটাও তাই। এই দুর্যোগ, বিপৎপাত আর অবসাদের পর বিশ্রাম আমাদের পক্ষে নিতান্তই জরুরি হয়ে পড়েছিলো।

অযোধ্যা রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে এসেছি অবশেষে; এখন আমরা যাবো উর্বর ও শ্যামল রোহিলখণ্ডের মধ্য দিয়ে। দিল্লি পুনরুদ্ধারের পর এইখানে সিপাহী বিদ্রোহের শেষ আগুন জ্বলে উঠেছিলো-পরে সার কলিন ক্যামবেল তার বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ সংঘর্ষে লিপ্ত হন; অনেকক্ষণ পর্যন্ত, একেবারে শেষ রক্ত বিন্দুটুকু দিয়ে, বিদ্রোহীরা সার কলিনকে রুখেছিলো।

রাস্তা এখানে সমতল ও সোজা; অনেক স্রোতস্বিনী ও ছোটো-ছোটো শাখানদী আছে বটে, অনেকগুলোই তাদের সেচের সুবিধের জন্যে কৃত্রিম উপায়ে মনুষ্যনির্মিত–কিন্তু সেগুলো অনায়াসেই পেরুতে পারবে বেহেমথ। অল্পক্ষণের মধ্যেই যে নেপালের পর্বতগাত্র আমাদের চোখে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিশ্রামের ব্যবস্থা করে আরেকদিক থেকে ভালোই করেছিলাম আমরা। গৌমির বাঁ-পায়ের অসাড় ভাবটা ছিলো সাময়িক; সেবা ও সংবাহনের ফলে সে আবার সুস্থ হয়ে উঠলো—সেই মারাত্মক দুর্ঘটনার কোনো চিহ্নই আর রইলো না। শুধু দুর্যোগের কিছু চিহ্ন রইলো বেহেমথের লম্বা কানে-মনে আছে, বাজ পড়েছিলো গর্জন করে, রেগে; আমরা ভেবেছিলুম বুঝি হাওদার উপরেই এসে পড়েছে! তখন বেহেমথ তার লম্বা কানের ডগা দিয়ে সব বিদ্যুৎ শুষে নিয়েছিলো আর তার ওই ইস্পাতের কানে কতগুলো ছোটো-বড়ো ছ্যাঁদা হয়ে গিয়েছিলো কেবল।

আটই জুন সকালবেলায় রোহিলখণ্ডের একটা ছোট্ট গ্রাম ছেড়ে আবার আমরা ধীরেধীরে রেওয়ার দিকে এগিয়ে চললুম; রেওয়া তখন মাত্র পঁচিশ মাইল দূরে। রাস্তা বৃষ্টি-ভেজা, পিছল, সেইজন্যেই দ্রুতবেগে যাবার উপায় ছিলো না।

হুড আগের দু-দিন তার শিকারি কুকুর ফ্যান আর নাইজারকে নিয়ে বন্দুক হাতে বেরিয়েছিলো বটে, কিন্তু এমন-কোনো হিংস্রভীষণ প্রবল জন্তু তার চোখে পড়েনি যাতে তার শিকারের ক্ষুধা আর রোমাঞ্চলিপ্সা এতটুকু তৃপ্ত হয়। হয়তো সেইজন্যেই সে এতই বিরক্ত ও হতাশ হয়ে পড়েছিলো যে আট তারিখে শিকারের একটা মস্ত সুযোগ তার হাতছাড়া হয়ে গেলো।

বেহেমথ তখন যেখান দিয়ে যাচ্ছে, তার দু-পাশে ঘন বাঁশবন দেখেই বোঝা যায় গ্রাম বা লোকালয় কাছেই। আর বাঁশবনের আশপাশে শতরঞ্জের ছকের মতো আলবাঁধা পড়ে আছে জলা ধানখেত। স্টর বসে ছিলো হাওদায়, বেহেমথ আস্তে গজেন্দ্রগমনে চলেছে, শুঁড় থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে হালকা সুন্দর ধোঁয়ার রাশি–আশপাশের বাঁশবনের উপরে ছিড়ে-ছিড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী।

হঠাৎ এমন সময় আশ্চর্যসুন্দর ক্ষিপ্রতায় কী-একটা জানোয়ার একলাফে হাতির ঘাড়ে উঠে বসলো।

চিতাবাঘ! চিতাবাঘ? চেঁচিয়ে উঠলো স্টর।

চীৎকার শুনে হুড একলাফে বন্দুক হাতে বেরিয়ে এলো বারান্দায়। চিতাবাঘ! তারও গলা থেকে চীৎকার উঠলো।

চেঁচিয়ে বললুম, দেখছো কী? গুলি করো!

গুলি করার সময় ঢের পাবো, বলে হুড বন্দুক তুলে তাগ করে ধরলো।

কর্নেল মানরো, ব্যাঙ্কস আর আমি তখন বারান্দায় বেরিয়ে এসেছি। চিতাবাঘ আসলে বাংলাদেশের গরীয়ান রাজাবাঘের মতো অত-বড়ো নয়, তেমন মহিমা তার নেই; কিন্তু ক্ষিপ্রতায়, গায়ের জোরে আর হিংস্রতায় সে মোটেই কম যায় না। আমাদের হাতি দেখে নিশ্চয়ই ঠকে গিয়েছে চিতাটা 1 সাহসে ভর করে লাফিয়ে পড়েছে মুহুর্তে, ভেবেছে জ্যান্ত মাংসেই বুঝি বসাবে থাবা আর দাঁত, কিন্তু তার বদলে-এ কী কাণ্ড!–এ যে লোহার হাতি! দাঁত-নখই বরং ভেঙে যাবার জোগাড়। চিতাটা যেন এভাবে ঠকে গিয়ে আরো খেপে গেলো, নকল হাতিটার মস্ত কান দুটো আঁকড়ে ঝুলে থাকলো সে একটু, এক্ষুনি আবার লাফিয়ে পড়ে বাঁশবনে ঢুকে যাবে বুঝি।

হুড তার বন্দুক ধরে তেমনি তাগ করেই আছে-ভঙ্গিটা : ও আর কী, গুলি করলেই হলো। হঠাৎ চিতাটা তাকে দেখতে পেলে; গর্জন করে উঠলো সে একবার, তারপর আবার উঠে বসলো হাতির কাঁধে। নিয়তির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, এটা তার অজানা নেই; কিন্তু তাই বলে সে পালিয়ে যাবার কোনো চেষ্টাই করলে না। বরং বারান্দায় লাফিয়ে পড়ারই মৎলব বুঝি তার।

হুড চিতাটার গা থেকে চোখ না-সরিয়েই আমাকে জিগেস করলে, মোক্লের, তুমি কখনও চিতাবাঘ মেরেছো?

না।

মারতে চাও একটা?

বললুম, হুড, আমি চাই না যে তুমি এ-রকম একটা বাঘ মারার গৌরব থেকে বঞ্চিত হও—

ফুঃ, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি হুডের, এ আবার একটা বাঘ নাকি। নাও, একটা বন্দুক তুলে নিয়ে চিতাটার কাধ লক্ষ্য করো; তাগ ফশকালে আমি না-হয় চিতাটা লাফাবার সঙ্গে-সঙ্গে গুলি করবো–

তাহলে তা-ই হোক।

ফক্স আমার হাতে একটা দোনলা বন্দুক তুলে দিলে। বন্দুকটা তুলে নিয়ে চিতাটার কাধ লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লুম। গুলিটা তার কাধ ঘেঁসে চলে গেলো—খুব বেশি হলে একটু ছড়ে গিয়ে থাকবে সম্ভবত, সঙ্গে-সঙ্গে চিতাটা হুড়মুড় করে লাফিয়ে পড়লো মাটিতে।

এঞ্জিন থামাও, এঞ্জিন থামাও! চেঁচিয়ে নির্দেশ দিলে ব্যাঙ্কস, আর স্টর তক্ষুনি ব্রেক কষে বেহেমথকে থামিয়ে দিলে। বারান্দা থেকে লাফিয়ে নামলে হুড আর ফক্স, ঝোপটার দিকে ছুটে গেলো বন্দুক উঁচিয়ে। রুদ্ধশ্বাস ও উৎকর্ণ কয়েকটা মিনিট কেটে গেলো, কিন্তু সব চুপচাপ, গুলির কোনো আওয়াজই পাওয়া গেলো না। একটু পরেই শিকারি দুজন ফিরে এলো।

হাওয়া হয়ে গেছে। কোথাও কোনো পাত্তা নেই, হুড চেঁচিয়ে জানালে, ঘাসের উপর এমনকী রক্তের একটা ফোঁটা অব্দি নেই।

বললুম, আমারই দোষ। তুমি নিজে, চিতাটাকে গুলি করলে এমনভাবে পালাতে পারতো না। তোমার তো আর তাগ ফশকাতো না!

বাজে বোকো না! বললে হুড, আমি ঠিক জানি তোমার গুলি ওর গায়ে লেগেছিলো—তবে ঠিক কাঁধে লাগাতে পারোনি!

আমার ঊনচল্লিশ কি আপনার একচল্লিশ নম্বর হওয়া ওর কপালে লেখা ছিলো না, ফক্স কিঞ্চিৎ মনমরাভাবে জানালে।

দূর-দূর! চেষ্টা করে হুড তার গলায় ঔদাসীন্য আনলে, চিতা তো আর সত্যিকার বাঘ নয়—মার্জারকুলের সেরা জীব হলে কি আর আমি অমনভাবে মোক্লেরকে গুলি করতে দিতুম!

যাক, যা হবার হয়েছে, সার এডওয়ার্ড মানরো বললেন, এদিকে ছোটোহাজরি তৈরি-সবাই টেবিলে এসে বোসো, টাটকা খাবারের চেয়ে সান্ত্বনা কি আর কিছুতে আছে!

ছোটোহাজরিতেই সান্ত্বনা মিলবে, আশা করি, বললে ম্যাক-নীল, তবে সব দোষ আসলে ফক্সের?

আমার? ফক্স হকচকিয়ে গেলো।

নিশ্চয়ই! বললে ম্যাক-নীল, মোক্লেরকে যে-দোনলাটা তুমি দিয়েছিলে তার টোটা ছিলো ছ-নম্বর-ওতে কি আর পাখি ছাড়া আর-কিছু মেলে? বলে ম্যাক-নীল দোনলাটার ভিতর থেকে দ্বিতীয় টোটাটা বের করে আনলে। দেখা গেলো, তার কথাই সত্যি।

ফক্স! হুড ডাক দিলে।

বলুন।

দিন-দুই বন্দী থাকতে হবে তোমায়।

আচ্ছা, ক্যাপ্টেন! বলে ফক্স নিজের কামরার দিকে চলে গেলো-আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে আর মুখ দেখাবার ইচ্ছে নেই তার। নিজের এই ভুলে লজ্জায় তার প্রায় মাথা কাটা গেছে।

পরদিন ক্যাপ্টেন ইড, গৌমি আর আমি রাস্তার ধারে সমভূমিটার উপর শিকার করতে বেরুলুম। কয়েক ঘণ্টার জন্য থেমেছে বেহেমথ, সেই ফাঁকেই এই সফরি। সারা সকালটা ঝমঝম বৃষ্টি পড়েছে, কিন্তু দুপুরবেলায় আকাশ একেবারে ঘন-নীল-হালকা শাদা নির্জল মেঘ ছাড়া আর কিছু নেই আকাশে। এই শিকারের প্রেরণা অবিশ্যি মঁসিয় পারাজারের–ছোটাহাজরির সময় সে জানিয়েছিলো তার ভাড়ার নাকি প্রায় ফাঁকা। তাই ফ্যান আর নাইজারকে নিয়ে আমরা তিনজনে শিকারে বেরিয়েছি।

কিন্তু দু-ঘণ্টা ধরে এদিক-ওদিক ঘুরেও কোনো লাভ হলো না। কেবল কয়েকটা খরগোশ আমাদের দেখে ভয়ে কানখাড়া করে শাঁৎ করে ছুটে মিলিয়ে গেলো দূরে। জায়গাটা আসলে এত ফাঁকা যে শিকারের সন্ধান পাওয়াই দুষ্কর। না আছে জঙ্গল, না-বা কোনো ঝোপঝাড়–কেবল দূরে-দূরে চাষীদের গ্রাম আর গোলাবাড়ি কালো ফুটকির মতো দেখা যায়। হুড অবিশ্যি কোনো হিংস্র জন্তুর আশায় বেরোয়নি, মঁসিয় পারাজারের শূন্য ভাড়ার পূর্ণ করাই তার উদ্দেশ্য। কিন্তু বেলা চারটে অব্দি যে আমরা একবারও কোনোকিছুকে গুলি করতে পারলুম না, তা অবশ্য মোটেই আমাদের দোষ নয়।

কিন্তু হুড তবু এমনি আপশোশ প্রকাশ করতে লাগলো যে আমি তার পানি শুনে বার-বার তাকে সান্ত্বনা আর আশা দিলুম।মিলবে, শিকার মিলবে-আলবৎ মিলবে। এখন না-মিলুক, পাহাড়ি জায়গায় জঙ্গলে তো মিলবেই!

তা অবিশ্যি ঠিক। নেপালের জঙ্গলে যদি কিছু না-মেলে তো হাত কামড়ানো ছাড়া আর-কিছুই করার থাকবে না….কটা বাজে এখন?

প্রায় পাঁচটা।

পাঁচটা! অথচ কিছুই পেলুম না এখনও!

সাতটার আগে শিবিরে ফেরার দরকার নেই। ততক্ষণে হয়তো–

উঁহু, আমাদের কপালটাই খারাপ। আর জানো, মোক্লের, কপালই হলো সব সাফল্যের মূল!

পরিশ্রম, ধৈর্য বা অধ্যবসায়ও। আমি বললুম, খালি হাতে ফিরবো না, এ-রকম একটা প্রতিজ্ঞা করলে হয় না? তোমার কী মনে হয়?

কী মনে হয়? হুড যেন অত্যন্ত বিস্মিত হলো এ-কথা শুনে, সেটাই তো মনোভাব হওয়া উচিত শিকারিদের!

তখন অবশ্য আমরা তিনজনে সামনে যা পেতুম, তাকেই আক্রমণ করতুম—মেঠো ইঁদুর কি কাঠবেড়ালিও বোধহয় ছাড়তুম না কিছুতেই। আসলে এখানকার সব পশুপক্ষীই বোধহয় আমাদের মৎলব জেনে গিয়েছিলো আগেভাগে, তাই সবাই পালিয়েছে—এমনকী একেবারে নিরীহ গোবেচারা পাখিগুলো অব্দি চোখে পড়ছে না।

ধানখেত ধরেই আমরা এগুলুম। একবার রাস্তার এপাশ ধরে গেলুম খানিকটা, আবার ওপাশের ধানখেত ধরে ফিরে এলুম। উদ্দেশ্য, যাতে শিবির ছেড়ে খুব-একটা দূরে গিয়ে না-পড়ি। কিন্তু সবই বৃথা হলো। বন্দুকের বদলে হাতে শৌখিন বেড়াবার ছড়ি থাকলেও হতো-আমাদের অবস্থার কিছু উনিশ-বিশ হতো না। এদিকে প্রায় সাড়ে ছটা বেজে গেলো!

হুডের দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না। বিড়বিড় করে কী যেন বকছে আপন মনে, বোধহয় সমস্ত পশুপক্ষীকেই অভিসম্পাত দিচ্ছে। সত্যি, কোনো শিকারির এমন, অবস্থার কথা কল্পনাও রা যায় না।

আমরা তখন শিবির থেকে মাইল তিনেক দূরে। বাঁশবনের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা ঘোরা পথে আমরা শিবিরের দিকে ফিরে আসছি। তখনও সূর্য ডোবেনি দিগন্তে, তবে মেঘের তলায় চ পা পড়ে গেছে। সেইজন্যেই পথটা একটু ঝাঁপসা ঠেকছে।

হঠাৎ এমন সময় আচম্বিতে আমাদের ডানপাশের ঝোপে গররর করে একটা বিষম গর্জন শোনা গেলো। আমার বুকটা এমনভাবে ধ্বক করে কেপে উঠলো যে আমি থমকে থেমে গেলুম। হড় আমার হাতটা চেপে ধরলে। ফিশফিশ করে বললে

বাঘ! তারপরেই একটা বিশ্রী শপথ বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে, কিন্তু আমাদের বন্দুকে যে কেবল ছররা গুলি ভরা—একটাও বুলেট নেই!

কথাটা নিদারুণ সত্যি। আমাদের তিনজনের কারুর কাছেই একটাও টোটা নেই। তাছাড়া থাকতেও যদি, তবু তখন বন্দুকে নতুন করে টোটা ভরার সময় পাওয়া যেতো না। কারণ গর্জনটা শোনবার পরেই দেখি গুলতি থেকে বেরুনো মারবেলের মতো প্রচণ্ড বেগে বাঘটা ঝোঁপের আড়াল থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো—ঠিক আমাদের হাত বিশেক দূরে আঁকাবাঁকা রাস্তার মোড়ে এসে বসলো।

রাজা বাঘ; দৃঢ় প্রচণ্ড শরীর, তেজপূর্ণ, মস্ত, ভয়ানক, সুন্দর, নমনীয় পেশী, প্রকাণ্ড থাবা, ক্ষিপ্রতায় হিংস্রতায় তার তুলনা নেই।

এমন ভয়ংকর অবস্থায় কি এর আগে কেউ কখনও পড়েছিলো?

বাঘটাকে দেখবামাত্র আমার হাতটা বন্দুক সমেত কেঁপে উঠলো। লম্বায় ন-দশ ফুট হবে, বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে কালো আর হলদের ডোরাকাটা জ্বলন্ত-উজ্জ্বল এই বিরাট মার্জারবংশীয়ের মুখটায় সূর্যের লাল রশ্মি এসে পড়েছে : চোখ দুটো রয়েছে ছায়ায়–অন্ধকারে বেড়ালের চোখের মতো জ্বলে উঠেছে সবুজ-ভীষণ ভয়ানক দুটি পোকরাজ। ল্যাজটা নড়ে উঠছে চঞ্চল হিল্লোলে। এমনভাবে গুঁড়ি মেরে বসেছে যেন এক্ষুনি লাফিয়ে পড়বে।

হুড কিন্তু মোটেই চঞ্চল হয়নি। বন্দুকটা উঁচিয়ে ধরেছে সে ততক্ষণে, আর বিড়বিড় করে এক অদ্ভুত শুকনো গলায় বলে চলছে : ছ-নম্বর টোটা! ছ-নম্বর টোটা দিয়ে একটা বাঘকে গুলি করা! একেবারে চোখে গুলি করতে না-পারলে…

কথা শেষ করার আর সময় পেলে না হুড। বাঘটা লাফালো না। বরং আস্তে আস্তে রাজার মতো এগিয়ে এলো অরণ্যের সেই হিংস্র মহিমা। গৌমিও পিছন থেকে বন্দুক তুলে তাগ করে আছে-তারও বন্দুকে ছরার কার্তুজ ভরা।

একটুও নোড়ো না কেউ, কোনো শব্দ কোরো না, ফিশফিশ করে বললে হুড, তাহলেই বাঘটা লাফিয়ে এসে পড়বে আমাদের দিকে। আর লাফ দিলেই কোনো রক্ষা

নেই।

আমরা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম।

আস্তে পায়ে-পায়ে এগুতে লাগলো সেই ভোরা-কাটা বেড়াল, চোখ দুটো সে একবারও সরাচ্ছে না আমাদের উপর থেকে, ঝোলা চোয়ালটা যেন মাটি-ছোঁয়া। হুডের সঙ্গে তার দূরত্ব বুঝি দশ হাতও নেই। হুড কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে নির্ভীক ও নিষ্কম্প, যেন কোনো প্রস্তরমূর্তি-তার সারা প্রাণ যেন তার চোখের তারায় এসেই সংহত হয়েছে।

ভীষণ মুহূর্তটি আসন্ন, তিনজনের কেউই সম্ভবত আর বেঁচে থাকব না; কিন্তু এতেও হুডের বুক বোধহয় ধ্বক-ধ্বক করছে না। এক-এক করে পাঁচ পা এগিয়ে গেলো হুড। কেমন করে যে আমি নিজেকে সামলে রাখলুম জানি না, আরেকটু হলেই বোধহয় চেঁচিয়ে বলতুম তাকে গুলি ছুঁড়তে। কিন্তু না, হুড বলেছিলো, একমাত্র ভরসা চোখে গুলি করে বাঘটাকে অন্ধ করে ফেলতে পারলে, আর সেইজন্যে গুলি করার আগে তাকে খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে।

বাঘটা আরো তিন-পা এগিয়ে এলো, তারপর ধনুকের ছিলার মতো টান হয়ে গেলো তার সর্বাঙ্গ, এক্ষুনি লাফাবে

সজোরে গর্জে উঠলো বন্দুক, তার পরেই আরেকটা গুলির শব্দ : গুড়ুম, গুড়ুম!

দ্বিতীয় গুলিটা যেন বাঘের গায়ে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে-করা। বাঘটা কেবল বার দুয়েক গড়ালো মাটিতে, যন্ত্রণা আর ক্লেশ-মেশানো গর্জন উঠলো দু-তিন বার, তারপরেই স্থির হয়ে পড়ে রইলো মাটিতে।

চমৎকার! হুড উল্লসিত, বন্দুকটায় ছররা ছিলো না, জানো! না, ফক্সকে ধন্যবাদ দিতেই হয়?

তাও কি সম্ভব? আমি তো তাজ্জব।

নিজের চোখেই দ্যাখো, বলতে-বলতে সে ফাঁকা টোটাটা বার করে আনলে বন্দুক থেকে-সত্যি, সেই নতুন টোটা, যা ছিলো সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম কারণ, দাঁত দিয়ে চামড়া কেটে যে-টোটা বন্দুকে ভরতে হয়!

ব্যাখ্যা করার আর দরকার হলো না। সব বুঝতে পারলুম। দুটো দোনলা বন্দুক ছিলো হুডের—একই রকম দেখতে। ফক্স ভুল করে একটায় ছররা গুলি ভরেছিলো, আরেকটায় ভরে ছিলো শিশের গুলি! এই ভুলের দরুন আগের দিন বেঁচেছে চিতাবাঘের জীবন, আর আজকে বাঁচলো আমাদের!

সত্যি, হুড বললে, জীবনে আর-কোনো দিন মৃত্যুর এত কাছাকাছি এসে দাঁড়াইনি।

আধ ঘণ্টা পরে আমরা যখন শিবিরে ফিরে এলুম, ফক্সকে ডেকে পাঠালে হুড–তারপর কী হয়েছে, সব তাকে খুলে বললে।

শুনে ফক্স বললে, ক্যাপ্টেন, তাহলে দু-দিনের বদলে আমার চারদিন বন্দী হয়ে থাকা উচিত—কারণ আমি দু-দুটো ভুল করেছি।

আমারও তা-ই মত, হুড তক্ষুনি বললে, কিন্তু তোমার ভুলের জন্যেই যেহেতু একচল্লিশ নম্বর আমার হস্তগত হলো, সেইজন্যে আমার মতে এই মোহরটা তোমার প্রাপ্য–

আর আমারও মত হলো এই যে মোহরটা মুহূর্তে পকেটস্থ করে ফেলা,-সোনার টাকাটা পকেটে ঢোকাতে-ঢোকাতে বললে ফক্স।

১২ই জুন সন্ধেবেলায় একটা ছোট্ট গ্রামে গিয়ে পৌঁছুলুম আমরা; ভারতের সব পাড়াগাঁর মতোই এই গ্রামও দেখতে একই রকম : দুঃস্থ জলাশয়, মশা-মাছির উৎসব, কাদায়-ডোবা মোষ, পাঁজরা-ওঠা গোরু, বুভুক্ষু সংসারের ভাঙা কুঁড়ে ঘর, নিষ্ফল ডাঙায় রাঙা ধুলোর ওড়াউড়ি। এই গ্রাম থেকেই পরদিন সকালে আমরা রওনা হবো : আর নব্বই মাইল দূরে, উৎরাইয়ের কোলে নেপাল—আমাদের লক্ষ্য তারই অরণ্যদেশ।