১৩. সেই পুরাতন পৃথিবী

১৩. সেই পুরাতন পৃথিবী

জ্ঞান যখন ফিরলো তখন দেখতে পেলাম, হাস, এক হাতে আমাকে, অন্য হাতে কাকামণিকে ধরে রেখেছে, আর আমাদের সামনে পাহাড়টি সোজা নেমে গেছে নিচের দিকে। হা ধরে না রাখলে সেই উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে নিশ্চিতই মৃত্যু ঘটতো আমাদের।

অবসন্ন গলায় হান্‌স্‌ কে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কোথায়? আইসল্যাণ্ডে? হান্‌স্‌ ঘাড় নেড়ে বললে, না।

তবে কোথায়?

হান্‌স্‌ কোনো উত্তর দিলে না।

নিজের দেহের পানে তাকিয়ে দেখি, অর্ধনগ্ন দেহ, ধুলো-বালি-কালিতে ভূতের মতো দেখাচ্ছে। একটু দূরে পাঁচশো ফুট উঁচু একটি পর্বতশিখর থেকে পনেরো মিনিট অন্তর প্রচুর ধোঁয়া আর ছাই উঠছিলো তখন। আমাদের পাহাড়টি আর চারপাশের জমিও কাঁপছিলো বেশ।

ভালো করে চারদিকে তাকিয়ে দেখি, নিলীম নীল আকাশে পাজা-পাজা তুলোর মতো শাদা মেঘ, চারদিকে সূর্যের সোনালি। আকাশে, বাতাসে, মাটিতে অপর্যাপ্ত অজস্র আলো। সূর্যের প্রসন্ন আশীর্বাদকে যেন হৃদয়ের গহন প্রদেশে টেনে নিলাম আমি নিশ্বাসের সঙ্গে। কতদিন যে আকাশ দেখিনি!

বুঝতে পারলাম, আবার ফিরে এসেছি পৃথিবীতে। ফিরে এসেছি সেই পুরাতন পৃথিবীর কোনো এক দ্বীপে, যেখানে প্রাণ আছে, আলো আছে, প্রকৃতির সবুজ স্নেহ আছে। কিন্তু জায়গাটির নাম কী হতে পারে তা বুঝতে পারলাম না।

কাকামণি বললেন, কম্পাসের নির্দেশ অনুযায়ী জায়গাটা উত্তরমেরু হওয়া উচিত। কিন্তু তা যে নয়, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু জায়গাটার নাম যাই হোক, এখানে আর থাকা ঠিক হবে না, নিচে নামতে হবে আমাদের, এক্ষুনি।

ঘণ্টা-দুএক বাদে খুব আস্তে-আস্তে হেঁটে আমরা পাহাড়ের নিচে এসে দাঁড়ালাম। পাহাড়ের নিচে অজস্র ফল-মূলের গাছ। বোধহয় কারো বাগান। মালিকের অনুমতি নেবারও তর সইলো না। সেই ফল-মূল পেড়ে প্রাণ ভরে খেলাম আমরা। সামনেই একটা ঝরনা বন-হরিণীর মতো নৃত্যচপল ভঙ্গিতে ছুটে চলছিলো। আকণ্ঠ পান করলাম তার ঠাণ্ডা জল।

জল খেতে-খেতে লক্ষ্য করলাম, অদূরে একটি গাছের আড়াল থেকে একটি কিশোর ছেলে কৌতূহলী চোখে আমাদের দেখছে। ছেলেটি আমাদের দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। ভয় পাওয়ারই কথা। আমাদের তখন যা চেহারা, তাতে ভয় না পাওয়াটাই ছিলো তার পক্ষে অস্বাভাবিক। ছেলেটি প্রাণের ভয়ে দৌড় দেবার উপক্রম করতেই হানস তাকে পাকড়াও করলো।

কাকামণি ছেলেটিকে অনেক আদর করে প্রথমে জার্মান ভাষায় শুধোলন, এ জায়গাটার নাম কী থোক?

কোনো জবাব নেই।

বোঝা গেলো এটা জার্মানির কোনো এলাকা নয়। এবারে কাকামণি ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন, জায়গাটার নাম কী বলো তো? ছেলেটি তবুও কোনো উত্তর দিলে না দেখে ইতালীয় ভাষায় কাকামণি একই প্রশ্ন উচ্চারণ করলেন। তবুও সে চুপ করে রইলো।

এবারে কাকামণি চটে-মটে ধমক দিয়ে উঠলেন।

অমনি ছেলেটি রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠলো, স্ট্রম্বলি, স্ট্রম্বলি। আর তারপরেই সে কোনোমতে নিজেকে মুক্ত করে পড়ি কি-মরি করে দৌড় দিলো।

আমরা তিনজনেই সমস্বরে বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, স্ট্রম্বলি।

কোথায় আইসল্যাণ্ডের স্নেফেল পর্বত, আর কোথায় সিসিলির এটুনা আগ্নেয়গিরি। একশো কি দু-শো নয়, তিন হাজার মাইলের ব্যবধান! স্তম্ভিত হয়ে এটনার দিকে তাকালাম আমি।

কাকামণি বলে উঠলেন, কম্পাসটা ফেলে দে তো-ওটা আগাগোড়া আমাদের ভুল পথ দেখিয়েছে!

মাস-ছয়েক পরে জার্মেনির হামবুর্গের কনিগস্টাসের সেই ছোট্টো বাড়িটায়। অধ্যাপক হের লিডেনব্রকের পড়বার ঘরটা ঝেড়েমুছে সাজাচ্ছিলাম। এমন সময়ে হঠাৎ আমার চোখ পড়লো সেই পুরোনো কম্পাসটার উপর। পাতাল-ভ্রমণের সঙ্গী ছিল বলে ওটাকে আর ফেলে দিইনি। দেখতে পেলাম, কম্পাসের কাটা যাকে দক্ষিণ দিক বলে নির্দেশ করছে, তা আসলে উত্তর দিক।

অবাক হলাম আমি। কাকামণিকে খবর দিতেই তিনি আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, সত্যিই কম্পাসের কাটাটা দিক বদল করেছে। যেদিন আমরা এটনার মুখ দিয়ে বেরোই, সেদিনেও কাটাটা আসলে দক্ষিণ মুখেই ছিলো।

কিন্তু কী করে এমনটা হলো? বিস্মিত কণ্ঠে শুধোলাম আমি।

কাকামণি বললেন, পাতালের সমুদ্র পাড়ি দেবার সময় একটা বৈদ্যুতিক বল আমাদের ভেলায় ফেটেছিলো, তোর মনে আছে সে-কথা? সেদিন ভেলার সকল লোহাই চুম্বক হয়ে গিয়েছিলো। কম্পাসের কাটাটাও বাদ যায়নি। সেই থেকেই সব ওলোট-পালোট হয়ে গিয়েছিল। এই বলে হো-হহা করে হেসে উঠলেন তিনি।

আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, অন্তহীন পাতালসমুদ্রে খড়কুটোর মতো ভাসছে আমাদের ছোট্টো ভেলাটি, আর তার উপর ছুটোছুটি করছে শাদানীল একটি গোল অগ্নিচক্র; ঝড়ে সমুদ্র ফুশছে, উদ্দাম হাতে করতালি দিচ্ছে ঝড়।

আমি আর কাকামণি বারুদে আগুন দেবার জন্যে লম্বা শলতে তৈরি করতে লাগলাম। ক্রমে রাত্রি হয়ে এলো। তারপর যখন সকল আয়োজন শেষ করে বারুদ দিয়ে গর্ত ভরাট করে শলতের এক প্রান্ত বারুদের মধ্যে রেখে অন্য প্রান্ত সুড়ঙ্গের বাইরে আনলাম, তখন কাকামণি বললেন : আজ আর কাজ নেই, কাল দিনের আলোয় শলতেয় আগুন দেয়া যাবে।

পরদিন সকালবেলা ছটার সময় আমরা তৈরি হয়ে সুড়ঙ্গের মুখে এসে ঈাড়ালাম, কাকামণিকে বলে-কয়ে শলতেয় আগুন দেবার ভারটা আমিই নিলাম। কাকামণি আমাকে বারবার সতর্ক করে দিলেন : সাবধান, এক সেকেণ্ডও যেন দেরি না হয়, আগুন দিয়েই প্রাণপণে দৌড়ে এসে ভেলায় উঠবি! তুই ভেলায় এলেই আমরা সমুদ্রের মধ্যে ভেলা ঠেলে দেবো। পাহাড় যে কতোখানি ধ্বসে যাবে, কে জানে। শলতের আগুন বারুদের কাছে যেতে লাগবে প্রায় দশ মিনিট। এর মধ্যেই আমাদের নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে হবে।

আমাকে এইভাবে বারবার বুঝিয়ে-সুঝিয়ে হাসকে নিয়ে কাকামণি ভেলায় গিয়ে উঠলেন। ভেলাকে সমুদ্রপথে ঠেলে দেবার জন্য তৈরি হয়ে দাঁড়ালেন ওঁরা। একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে আমি শলতের কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর একহাতে লণ্ঠন ধরে অন্য হাতে শলতের আগা ধরলাম। একবার হাত কাঁপলো। কাকামণি হাঁকলেন : হুঁশিয়ার! দাও আগুন!

তক্ষুনি শলতেয় আগুন দিলাম। দপ করে জ্বলে উঠলো শলতেটি, তীব্রবেগে অগ্নিশিখা অগ্রসর হলো সুড়ঙ্গের দিকে। আমিও বিদ্যুদ্বেগে ভেলায় এসে উঠলাম। সঙ্গে-সঙ্গে কাকামণি আর হান্‌স্‌, কোনোরকমে ভেলাটিকে তীর থেকে প্রায় চল্লিশ গজ দূরে সরিয়ে নিলেন। আর, ঠিক তখনি–

ঠিক তখনি আকাশ-পাতাল কেঁপে উঠলো। বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম কি না মনে নেই, শুধু এইটুকুই মনে আছে যে, যেখানে পাথর ছিলো, পলকের মধ্যেই সেখানে একটি অতল গহ্বর দেখা দিল। সমুদ্রের জল ফুলে ফেঁপে ফুঁশে উঠলো। যে সাংঘাতিক ধাক্কায় আমরা তিনজনেই ভেলার উপরে ছিটকে পড়লাম, আর নিবিড় অন্ধকার এসে আমাকে ঢেকে ফেলবার আগে শুধু এটুকুই বুঝতে পারলাম যে, আমরা নিচের দিকে নামছি।

সম্বিত যখন ফিরলো, তখন বুঝতে পারলাম যে ঐ বিপুল পাথরটার ওপাশে ছিলো একটি অতল গহ্বর। বিস্ফোরণের ফলে পাথরটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলে বিপুল একটি আলোড়নের সৃষ্টি হয় এবং সেই কারণেই সমুদ্রের জল প্রবল একটি জলপ্রপাতের মতো সেই গহ্বরটির ভিতর প্রবেশ করতে থাকে। স্রোতের সেই প্রবল আকর্ষণ আমাদের ভেলাটিকেও রেহাই দেয়নি। জলস্রোতের সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের ভেলাও গহ্বরের ভিতর দিয়ে নামতে শুরু করে দিয়েছে। এবার যে আর বাঁচোয়া নেই, সে-কথা বুঝতে পেরে ভয়ে চোখ বুজে রইলাম। দুপাশের পাথরের গায়ে ঘা লাগলে ভেলার সঙ্গে-সঙ্গে আমরাও নিঃসন্দেহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবো।

প্রচণ্ড বেগে পাতালে নামতে লাগলাম। আশ্চর্য যে, একবারো পাথরের দেয়ালের সঙ্গে ভেলার সংঘর্ষ বাধলো না। বুঝলাম যে, গহ্বরের বিস্তার বিরাট বলেই এমন কোনো সংঘর্ষ ঘটলো না। স্যাকৃত্যুউজমের পাতালের পথে আমাদের দুবুদ্ধি একটি তীব্র জলস্রোতকে আমাদের অদৃষ্টের সঙ্গে গেঁথে নিয়ে এলো। যেরকম প্রবল বেগে হাওয়া আমাদের ঝাঁপটা মারছিলো, তাতে বুঝতে পারছিলাম যে দ্রুততম যানের চেয়েও অনেক বেশি দ্রুতগতিতে আমরা পাতালের দিকে নামছি। টর্চটা ভেঙে গিয়েছিলো বলে গহ্বরটা পরীক্ষা করতে পারছিলাম না অন্ধকারে।

কততক্ষণ ধরে যে নেমেছিলাম, আজকে তা আমি সঠিক বলতে পারবো না, তবে এ-কথা মনে আছে যে, অনেক অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খেয়ে ভেলাটা থেমে গেলো, তারপর একটা জলধারা তীব্রবেগে আমাদের উপর পড়তে লাগলো। বোধহয় মিনিটখানেক পড়েছিলো সেই জলধারা,–তারপরেই আবার ভেলাটা চলতে শুরু করে দিলে। এবার কিন্তু জলের গর্জন আর শোনা গেলো না।

এমন সময় কাকামণি আমাকে ডেকে বললেন : অ্যাকজেল, আমরা কিন্তু নামছি না, উপরে উঠছি।

বিস্মিত হয়ে শুধোলাম : উপরে উঠছি। কোথায়? কী করে?

কী করে জানি নে, কিন্তু সত্যিই উপরে উঠছি। বললেন কাকামণি। কোনোমতে যদি একটা আলো জ্বালা যায়, তবেই ভালো করে বোঝা যাবে।

একটামাত্র টর্চলাইটই তখন সম্বল ছিলে ভেলায়! হান্‌স্‌ অনেক চেষ্টা করে হাতড়ে হাতড়ে সেটা বার করে জ্বাললে। একটুখানি আলো অনেকখানি আশা আনলে মনে।

কাকামণি বললেন : যা ভেবেছিলাম! জলে গহ্বরের তলা ভরে যাওয়ায় জল এবারে অন্য পথ দিয়ে উপরে উঠছে, আমরাও সেই জলের সঙ্গে-সঙ্গে উপরে উঠে এলাম।

——–