উপন্যাস

০৭. মেরিপিট হাউসের স্টেপলটনরা

মেরিপিট হাউসের স্টেপলটনরা

বাস্কারভিল হলে এসেই একটা কৃষ্ণকুটিল ছায়াপাত অনুভব করেছিলাম মনের মধ্যে মনের সতেজ সৌন্দর্য কিন্তু অনেকটা মুছে নিয়ে গেছে সেই অভিজ্ঞতা। প্রাতরাশ টেবিলে এসে বসলাম আমি এবং স্যার হেনরি। গরাদ দেওয়া সুউচ্চ জানলা দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়ল ঘরে, জানলা-ঢাকা কুলমর্যাদার নকশা আঁকা ঢাল থেকে ছাপকা ছাপকা জলরং ভাসিয়ে দিল ঘরের সব কিছু। দেওয়ালের গাঢ় রঙের কাঠের তক্তাগুলো সোনালি রশ্মিতে ঝকঝক করতে লাগল ব্রোঞ্জধাতুর মতন, দেখে বোঝা ভার যে এই ঘরেই গত সন্ধ্যায় মন মুষড়ে পড়েছিল আমাদের নামহীন বিষণ্ণতায়।

ব্যারনেট তো বলেই ফেললেন, দোষটা দেখছি বাড়ির নয়, আমাদের! একে পথকষ্ট, তার ওপর কনকনে ওই ঠান্ডা ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ে ধরে নিয়েছি বাড়ির জন্যেই মন অত মুষড়ে পড়ছে। এখন দেখুন শরীর ঝরঝরে, বাড়িও বেশ প্রসন্ন।

জবাবে বললাম আমি, সবটাই কিন্তু কল্পনা নয়। কাল রাতে একজন মেয়েছেলের ফুঁপিয়ে কান্না শুনেছিলাম?

তন্দ্রার মধ্যে ওই ধরনের কী একটা যেন শুনেছিলাম। অদ্ভুত কাণ্ড! কিছুক্ষণ কান খাড়া করে রইলাম। কিন্তু আর কোনো আওয়াজ না-পেয়ে ভাবলাম নিশ্চয় স্বপ্ন দেখছি।

আমি কিন্তু শব্দটা স্পষ্ট শুনেছি। সত্যিই ফুঁপিয়ে কাঁদছিল একটা মেয়ে।

তাহলে জিজ্ঞেস করে দেখা যাক।

ঘণ্টা বাজালেন স্যার হেনরি। ব্যারিমুরকে জিজ্ঞেস করলেন আমাদের এই অভিজ্ঞতার কোনো ব্যাখ্যা তার জানা আছে কিনা। আমার মনে হল, খাস চাকরের পাণ্ডুর মুখ যেন আরও একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেল প্রশ্নটা শুনে। কিন্তু বেশ মন দিয়ে শুনল কান্নার বিবরণ।

বললে, স্যার হেনরি, এ-বাড়িতে স্ত্রীলোক বলতে দু-জন। একজন রান্নাঘরের পেছনের ঘরে বাসন ধোয়। ঘুমোয় বাড়ির ওদিককার অংশে আপনাদের দিকে নয়, আরেকজন আমার স্ত্রী। আওয়াজটা যে তার দিক থেকে আসেনি, সেটুকু আমি বলতে পারি।

কথাটা কিন্তু মিথ্যে। কেননা ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর লম্বা করিডরে পূর্ণ সূর্যালোকে মিসেস ব্যারিমুরকে দেখবার সুযোগ আমার হয়েছিল। রোদ পড়েছিল মুখে। দোহারা চেহারা, ভারী গড়ন, অনুভূতিহীন মুখচ্ছবি, দৃঢ়সংবদ্ধ কঠিন ঠোঁট। ঠোঁট টেপা হলে কী হবে, চোখ দুটোয় তো কিছু গোপন নেই। চোখের পাতা ফোলা, চোখও লাল। কাল রাতে তাহলে কেঁদেছে ওই স্ত্রীলোকটিই, কেঁদেই যদি থাকে দেবতার তো তা জানা উচিত। ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে জেনেও মিথ্যে বলার ঝুঁকি নিয়েছে সে! কেন? এ কাজ সে করল কেন? মিসেস ব্যারিমুরই-বা কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে কেন? পাণ্ডুর মুখ, সুদর্শন, কালো দাড়িওলা এই ব্যক্তিটিকে ঘিরে কিন্তু রহস্য দানা বেঁধেছে এরই মধ্যে, সেইসঙ্গে জড়ো হয়েছে বিষণ্ণতা। স্যার চার্লসের মৃতদেহ সে-ই প্রথম আবিষ্কার করেছে। বৃদ্ধের মৃত্যু সম্পর্কে যে-পরিস্থিতির বর্ণনা পাওয়া গেছে, সেটাও তারই কথা। এই ব্যারিমুরকেই রিজেন্ট স্ট্রিটে ছ্যাকড়াগাড়ির মধ্যে দেখেছি, এমনও তো হতে পারে? দাড়িটা বোধ হয় এইরকমই! গাড়োয়ান অবশ্য বলেছিল, মাথায় একটু খাটো–তবে সেটা চোখের ভুলও হতে পারে। বিষয়টা যাচাই করা যায় কীভাবে? গ্রিমপেন পোস্টমাস্টারের সঙ্গে দেখা করলেই হল। জিজ্ঞেস করব পরীক্ষামূলক টেলিগ্রামটা সত্যিই ব্যারিমুরের হাতে হাতে দেওয়া হয়েছে কিনা। জবাব যাই হোক না কেন, শার্লক হোমসকে জানানোর মতো কিছু একটা পাওয়া তো যাবে।

ব্রেকফাস্টের পর অসংখ্য কাগজপত্র দেখতে বসলেন স্যার হেনরি। আমি দেখলাম, মোক্ষম সুযোগ পাওয়া গেছে–অভিযান সেরে আসা যাক। মাইল চারেক হাঁটতে হল জলার কিনারা ঘেঁষে। বেশ লাগল হাঁটতে। পৌঁছোলাম একটা ছোট্ট ধূসর গাঁয়ে। ছোটো কুঁড়েঘরগুলোর মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে দুটি বড়ো বাড়ি একটা নিশ্চয় সরাইখানা, আর একটা ডক্টর মর্টিমারের আবাসস্থান। পোস্টমাস্টার লোকটা গাঁয়ের মুদিও বটে। টেলিগ্রামের কথা স্পষ্ট মনে আছে দেখলাম।

বললে, যেভাবে বলা হয়েছিল, সেইভাবেই টেলিগ্রামটা তো পৌঁছে দিয়েছি ব্যারিমুরকে।

কে দিয়েছে?

আমার এই ছেলেটা। জেমস গত সপ্তাহে বাস্কারভিল হয়ে মি. ব্যারিমুরকে টেলিগ্রামটা তুই দিয়েছিলিস?

হ্যাঁ বাবা, আমি দিয়েছিলাম।

ব্যারিমুরের নিজের হাতে? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

মি. ব্যারিমুর মাচায় উঠেছিল বলে মিসেস ব্যারিমুরের হাতে দিয়েছিলেন। বলল, এখুনি দেবে মি, ব্যারিমুরকে।

ব্যারিমুরকে দেখেছিলে?

আজ্ঞে না; বললাম তো মাচায় উঠেছিল।

নিজের চোখে না-দেখে থাকলে জানলে কী করে মাচায় উঠেছে?

খিটখিটে গলায় পোস্টমাস্টার বললে, সে কোথায় আছে না-আছে সেটা তার নিজের স্ত্রীই ভালো জানে। টেলিগ্রাম কি পায়নি বলতে চান? ভুল যদি কোথাও হয়ে থাকে, নালিশ যা করবার মি. ব্যারিমুরই করবে।

অসম্ভব, এ-তদন্ত নিয়ে আর এগোনো যাবে না। তবে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল। হোমসের ধোঁকাবাজিতে কাজ হয়নি। ঠিক ওই সময়ে ব্যারিমুর লন্ডনে ছিল কিনা, সেটা প্রমাণ করা যাবে না। যদি ধরা যায়, স্যার চার্লসকে সর্বশেষ যে-ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় দেখেছে, সেই লোকই নতুন উত্তরাধিকারী ইংলন্ডে পা দিতে না-দিতেই ফেউয়ের মতো পেছন পেছন ঘুরছে? তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? তবে কি সে অন্যের চর? না, নিজেই ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে? বাস্কারভিল বংশকে নির্বংশ করায় তার স্বার্থ? টাইমস প্রবন্ধ থেকে কাঁচি দিয়ে কেটে অদ্ভুত হুঁশিয়ারির কথা মনে পড়ল। এ কাজও কি তার? নাকি পৈশাচিক এই চক্রান্ত বানচাল করায় উদ্যোগী হয়েছে অন্য এক ব্যক্তি? একটা মোটিভই কল্পনায় আনা যায় স্যার হেনরি নিজেই তো বলেছিলেন, ভয় দেখিয়ে যদি ফ্যামিলির সবাইকে ভাগিয়ে দেওয়া যায়, পুরো বাড়িটা স্থায়ীভাবে ভোগে লাগবে ব্যারিমুর দম্পতির। কিন্তু অদৃশ্য যে-জাল ধীরে ধীরে ঘিরে ধরছে তরুণ ব্যারনেটকে, তার পেছনে যে সুগভীর চক্রান্ত বিরাজমান–এ-সিদ্ধান্ত দিয়ে তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হয় না হোমস নিজেই স্বীকার করেছে, জীবনে অনেক চাঞ্চল্যকর তদন্ত সে করেছে, কিন্তু এ-রকম জটিল কেস সে কখনো দেখেনি। ধূসর, নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে যাজ্ঞা করলাম, বন্ধুবর যেন ঝটপট হাতের কাজ শেষ করে এখানে এসে ওই গুরুর দায়িত্ব থেকে আমায় মুক্তি দেয়।

আচম্বিত চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল পেছনে ধাবমান পদশব্দে–সেইসঙ্গে শুনলাম কে যেন নাম ধরে ডাকছে আমায়। ডক্টর মর্টিমারকে দেখব আশা করেই পেছন ফিরলাম, কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম এক অচেনা ভদ্রলোককে আমার পেছনে ছুটে আসতে দেখে। আকারে ছোটোখাটো, ছিপছিপে, দাড়ি-গোঁফ পরিষ্কার কামানো, চোখ-মুখ নিখুঁত, শনের মতো একমাথা চুল, পাতলা চোয়াল, বয়স তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, পরনে ধূসর স্যুট, মাথায়-হ্যাট। গাছগাছড়ার নমুনা সংগ্রহের একটা টিনের বাক্স ঝুলছে কাঁধে। হাতে একটা সবুজ রঙের প্রজাপতি ধরবার জাল।

হাঁপাতে হাঁপাতে কাছে এসে বললেন, মাপ করবেন, আপনিই তো ডক্টর ওয়াটসন। জলাভূমিতে আমরা সবাই কাজের মানুষ আনুষ্ঠানিকভাবে কারো পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় থাকি না–আলাপটা গায়ে পড়েই করে নিই। আমাদের দুজনের বন্ধু মি. মর্টিমারের মুখে নিশ্চয় শুনেছেন আমার নাম। আমিই মেরিপিট হাউসের স্টেপলটন।

বললাম, আপনার জাল আর বাক্স দেখেই তা বোঝা যায়। মিঃ স্টেপ্লটন যে একজন প্রকৃতিবিদ–এইটুকু আমি জানি। কিন্তু আমাকে আপনি চিনলেন কী করে?

মর্টিমারের ওখানে গেছিলাম। আপনি তখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সার্জারি-ঘরের জানালা থেকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। একই পথে যেতে হবে দু-জনকে, তাই ভাবলাম দৌড়ে এসে নাগাল ধরে ফেলি যেতে যেতে পরিচিত হই। স্যার হেনরি এতটা পথ এসে ভালো আছেন তো?

খুবই ভালো আছেন। ধন্যবাদ।

সবাই ভেবেছিলাম, স্যার চার্লসের শোচনীয় মৃত্যুর পর ব্যারনেট আর বুঝি এখানে থাকতে চাইবেন না। এ-রকম একটা জায়গায় এসে কোনো বড়োলোকই নিজেকে শেষ করতে চায় না। কিন্তু এলে যে পল্লিঅঞ্চলের কতখানি ভালো হয়, তা আর নাই-বা বললাম। এব্যাপারে স্যার হেনরির মনে কুসংস্কার বা ভয়-টয় নেই তো?

মনে তো হয় নেই।

পিশাচ কুকুরের কাহিনি শুনেছেন নিশ্চয়? ভৌতিক উপদ্রব চলছে এ-ফ্যামিলির প্রত্যেকের ওপর।

শুনেছি।

আশ্চর্য এখানকার চাষিরা কিন্তু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে গল্পটা! সরল মানুষ তো, সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে। যাকেই জিজ্ঞেস করুন, সে-ই দিব্যি গেলে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এ-রকম একটা প্রাণী সে জলায় দেখে বটে, হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেও ভদ্রলোকের চোখ দেখে মনে হল ব্যাপারটাকে উনি হাসির ব্যাপার হিসেবে নেননি। এইসব গল্প শুনেই স্যার চার্লস মনে মনে অনেক কল্পনা করে ফেলেছিলেন, ফলে মৃত্যু আসে শোচনীয়ভাবে।

কিন্তু কীভাবে?

ধকল সইতে সইতে স্নায়ু শেষ হয়ে এসেছিল, হৃৎপিণ্ডের অবস্থাও ভালো ছিল না–যেকোনো কুকুরের ছায়া দেখলেও তাই হয়তো আঁতকে উঠতেন। এইভাবেই নিশ্চয় হার্টফেল করেছেন। আমার মনে হয়, আগের রাতে ইউ-বীথিতে সত্যিই কিছু একটা দেখেছিলেন উনি। বৃদ্ধকে ভালোবাসতাম, জানতাম ওঁর হার্টের অবস্থা ভালো নয়। তাই এইরকম একটা বিপর্যয়ের ভয় কিন্তু বরাবরই ছিল আমার মনে।

হার্টের অবস্থা ভালো নয় জানলেন কী করে?

বন্ধু মর্টিমার বলেছেন।

আপনার বিশ্বাস তাহলে কুকুরের তাড়া খেয়ে স্রেফ ভয়ের চোটে মারা গেছেন স্যার চার্লস?

এর চাইতে ভালো ব্যাখ্যা আর কিছু দিতে পারেন?

কোনো সিদ্ধান্তেই আসিনি আমি।

মি. শার্লক হোমস এসেছেন কি?

কথাটা শুনেই মুহূর্তের জন্যে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। কিন্তু সঙ্গী ভদ্রলোকের শান্ত মুখ আর ধীরস্থির চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম চমকে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে তার নেই।

বললেন, ডক্টর ওয়াটসন, আপনাকে জানি না, ভান করে তো লাভ নেই। আপনার ডিটেকটিভের কীর্তিকাহিনি এদেশেও পৌঁছে গেছে। নিজেকে বাদ দিয়ে তার গুণগান তো গাইতে পারেন না। মর্টিমার আপনার নাম বলতেই বুঝেছি আপনি কে, অস্বীকার করতে পারেননি, মর্টিমার। আপনি এখানে এসেছেন মানে মি. শার্লক হোমসও এ-কেসে আগ্রহী, সেইজন্যই জানতে চাইছিলাম এ-ব্যাপারে তিনি কী মত পোষণ করছেন।

এ-প্রশ্নের জবাব দিতে পারব বলে মনে হয় না।

উনি কী নিজে এসে ধন্য করবেন আমাদের?

এই মুহূর্তে শহর ছেড়ে বেরোতে পারবে না। হাতে অন্যান্য কেস রয়েছে।

কী কপাল দেখুন! আমাদের কাছে যা অন্ধকার, উনি এলে তা পরিষ্কার হয়ে যেত। আমাকে দিয়ে যদি আপনার গবেষণায় কোনো সাহায্য হয় তো নির্দ্বিধায় বলবেন। কাকে সন্দেহ করছেন, অথবা কীভাবে তদন্ত শুরু করবেন যদি আঁচ দেন তো আমার দিক থেকে সাহায্য অথবা উপদেশ পেতে পারেন।

শুনুন, আমি এসেছি আমার বন্ধু স্যার হেনরির সঙ্গে দিন কয়েক থাকতে–তদন্ত করতে নয়। কাজেই সাহায্য বা উপদেশ কোনোটারই দরকার হবে না।

চমৎকার? বললেন স্টেপলটন। ঠিকই তো, এখনই তো বিচক্ষণ এবং সতর্ক থাকতে হবে আপনাকে। অনধিকার চর্চার জন্যে ধমক দিয়ে ভালোই করেছেন। কথা দিচ্ছি, এ নিয়ে আর জিজ্ঞেস করব না।

সরু একটা ঘাস-ছাওয়া রাস্তার সামনে এসে গেছি কথা বলতে বলতে। মূল রাস্তা থেকে এ-রাস্তাটা বেরিয়ে এঁকেবেঁকে ঢুকে পড়েছে জলার মধ্যে। ডান দিকে, গোলাকার পাথর সমাকীর্ণ একটা খাড়াই পাহাড়–বিস্মৃত অতীতে গ্রানাইট পাথর কেটে আনা হত ওখান থেকে। বুক কাঁপানো মলিন অতীতে চুড়োর দিকে দাঁড়িয়ে আমরা খাঁজে খাঁজে ফার্ন আর কাটাঝোপ। তারও ওদিকে দূরে উঁচু জায়গায় একরাশ পালকের মতো ভাসছে ধোঁয়া।

স্টেপলটন বললেন, জলার এই রাস্তা দিয়ে একটু হাঁটলেই মেরিপিট হাউস। ঘণ্টাখানেক সময় যদি হাতে থাকে তো আসুন, আমার বোনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

স্যার হেনরির পাশে পাশে আমার থাকা দরকার, প্রথমেই এই চিন্তাটা লাফিয়ে উঠল মনের মধ্যে। তারপরেই চোখের সামনে ভেসে উঠল পড়ার ঘরের টেবিলে স্থূপীকৃত কাগজপত্র নিয়ে বসে আছেন তিনি। এ অবস্থায় তার কোনো সাহায্যেই আমি আসছি। হোমসও পইপই করে বলে দিয়েছে, জলার প্রতিবেশীদের ওপর যেন মনটা থাকে আমার তাদের হালচাল লক্ষ করতে হবে, খবর সংগ্রহ করতে হবে। তাই স্টেপল্টনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ঘেসো পথটার দিকে ফিরলাম।

ঢেউ খেলানো প্রান্তর, দীর্ঘ সবুজ উত্তাল তরঙ্গ, মাঝে মাঝে খোঁচা খোঁচা গ্রানাইট পাথরের প্রচণ্ড তরঙ্গাকার উত্থান-পতন—সব মিলিয়ে সত্যিই বড়ো অপূর্ব জায়গা এই জলাভূমি। হাজার বার দেখেও ক্লান্তি আসে না। কত আশ্চর্য রহস্যই না লুকিয়ে রয়েছে এর খানাখন্দে। আকারে যেমন বিরাট, তেমনি অনুর্বর আর রহস্যময়।

আপনার নখদর্পণে নিশ্চয়?

আমি তো এখানে এসেছি মাত্র দু-বছর, স্যার চার্লস আসবার কিছুদিন পরেই। এখানকার বাসিন্দাদের কাছে আমি নবাগত। তবে আমার নেশা টোটো টোটো করে বেড়ানো। শখের তাগিদে এ-তল্লাটের কোথায় না গেছি বলুন। আমি যা জানি, এখানকার খুব কম লোকই তা জানে।

জানাটা কি খুব কঠিন?

খুবই কঠিন। উত্তরে বিরাট প্রান্তরটা দেখেছেন, মাঝে মাঝে অদ্ভুত পাহাড় মাথা চাড়া দিয়েছে। অসাধারণ কিছু লক্ষ করছেন?

ঘোড়া হাঁকানোর পক্ষে এমন জায়গা দুর্লভ।

স্বভাবতই তাই মনে হয়। এই কারণেই অনেক ঘোড়া, অনেক মানুষ জীবন দিয়েছে ওখানে। ঝকঝকে সবুজ কতকগুলো জায়গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লক্ষ করেছেন?

করেছি। অন্য অংশের চাইতে এই জায়গাগুলোই বেশি উর্বর মনে হচ্ছে।

হেসে উঠলেন স্টেপলটন। বললেন, ওই হল বিখ্যাত গ্রিমপেন পঙ্কভূমি। একটু ভুল পা ফেলেছেন কি আর দেখতে হবে না। মানুষ তোক কি জানোয়ার হোক–মৃত্যু অনিবার্য। কালকেই তো আমার চোখের সামনে তলিয়ে গেল একটা টার্টু ঘোড়া। জলারই ঘোড়া। ঘাসের খোঁজে গেছিল ভেতরে। বেরিয়ে আর আসেনি। পাঁকভরতি জমিতে মুণ্ডুখানা কেবল দেখলাম–ঘাড় লম্বা করে চেষ্টা করছিল উঠে আসবার। কিন্তু টেনে নিল ভেতর থেকে। শুকনো ঋতুতেও অঞ্চল পেরোনো বিপজ্জনক–শরতের বর্ষায় অত্যন্ত ভয়ংকর। আমি কিন্তু এরই মধ্যে দিয়ে পথ করে ঠিক মাঝখানে যেতে পারি, জ্যান্ত ফিরেও আসতে পারি। আরে সর্বনাশ! শুনুন, আর একটা টাট্টু মরতে চলেছে।

সবুজ নলখাগড়ার মধ্যে বাদামি মতো কী যেন একটা গড়াগড়ি দিচ্ছে, পাকসাট খাচ্ছে দেখলাম। তারপরেই বিষম যন্ত্রণায় তেউড়ে গিয়ে একটা লম্বা গলা ছটফটিয়ে উঠল ওপর দিকে এবং একটা ভয়াবহ আর্তনাদ প্রতিধ্বনির ঢেউ তুলে ভেসে গেল জলার ওপর দিয়ে দূরে। বিষম আতঙ্কে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল আমার, কিন্তু সঙ্গী ভদ্রলোকটির স্নায়ুর জোর দেখলাম আমার চাইতে বেশি।

বললেন, তলিয়ে গেল! গিলে নিল গ্রিমপেন পঙ্ক! দু-দিনে দুটো, হয়তো আরও অনেক–জানছে কে? শুকনোর সময়ে নানা দিক থেকে ভেতরে ঢোকে–পাঁকে পা দেওয়ার আগে টের পায় না কোথায় ঢুকেছে। বড়ো বিপজ্জনক জায়গা এই গ্রিমপেন পঙ্কভূমি।

এর মধ্যে আপনি ঢুকতে পারেন?

পারি। দু-একটা পথ আছে–চটপটে লোক সে-পথে যেতে পারে। সে-পথের সন্ধান আমি পেয়েছি।

কিন্তু এ-রকম ভয়ানক জায়গায় যান কেন?

দূরের ওই পাহাড়গুলো দেখছেন? ঠিক যেন দ্বীপ–যুগ যুগ ধরে দুর্গম পাঁক দিয়ে ঘেরা। অনেক দুর্লভ গাছগাছড়া আর দুষ্প্রাপ্য প্রজাপতির আস্তানা ওই পাহাড়গুলো। বুদ্ধি যদি থাকে, গিয়ে জানা যায়।

কপাল ঠুকে একদিন দেখবখন।

বিস্মিত মুখে আমার পানে তাকালেন স্টেপলটন। বললেন, দোহাই আপনার, ওই ইচ্ছেটি মনে ঠাঁই দেবেন না। আপনার অপঘাত মৃত্যুর জন্যে শেষে কি আমি দায়ী হব? বিশ্বাস করুন, প্রাণ নিয়ে ফিরে আসার সুযোগ পাবেন না। জমির ওপর জটিল কতকগুলো চিহ্ন দেখে আমিই কেবল যেতে পারি।

আরে! আরে! ও আবার কী? বললাম সবিস্ময়ে।

জলার ওপর দিয়ে প্রতিধ্বনির ঢেউ তুলে ভেসে গেল একটানা একটা গোঙানি–অবর্ণনীয় ভাবে করুণ। আকাশ বাতাস ভরে গেল সেই হাহাকারে অথচ বোঝা গেল না কোত্থেকে আসছে শব্দটা। প্রথম অনুচ্চ গজরানি, তারপর গভীর গর্জন, শেষে আবার সেই চাপা বিষণ্ণ অস্ফুট ঘড় ঘড় শব্দ–হৃদঘাতের মতো নিয়মিত ছন্দে স্পন্দিত হতে হতে এক সময়ে মিলিয়ে গেল গোঙানি। কীরকম যেন হয়ে গেল স্টেপলটনের মুখের চেহারা। অদ্ভুত চোখে তাকালেন আমার পানে।

বললেন, বড়ো বিচিত্র জায়গা এই জলা।

কিন্তু আওয়াজটা কীসের?

চাষিরা বলে, বাস্কারভিল কুকুরের গর্জন–শিকার খুঁজছে। এর আগেও বার দুয়েক এ-ডাক আমি শুনেছি কিন্তু এত জোরালো কখনো হয়নি।

ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করছিল আমার চেয়ে দেখলাম বিশাল ঢেউখেলানো প্রান্তরের দিকে মাঝে মাঝে সবুজ নলখাগড়ার ছোপ-ছোপ দাগ। কোথাও কোনো স্পন্দন নেই–নিথর নিস্তব্ধ চারিদিক দিগন্তবিস্তৃত সেই ধু-ধু প্রান্তরের ওপর উড়ছে কেবল একজোড়া মিশমিশে কালো দাঁড়কাক আমাদের ঠিক পেছনেই একটা অদ্ভুত দর্শন এবড়োখেবড়ো পাহাড়ে বসে সহসা কা-কা শব্দে ডেকে উঠল কর্কশ গলায়।

বললাম, আপনি তো মশাই শিক্ষিত মানুষ। এইসব আজগুবি ব্যাপার বিশ্বাস করেন নাকি? অদ্ভুত আওয়াজটা কীসের বলে মনে হয়?

পাঁকের গর্তে মাঝে মাঝে অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়। হয় কাদা থিতিয়ে যাচ্ছে, নয় জল ঠেলে উঠছে, অথবা ওইরকম কিছু একটা ঘটছে।

না, না, এ-আওয়াজ সে-আওয়াজ নয়। এ তো জীবন্ত প্রাণীর ডাক।

তবে হয়তো তাই। জলার বকের গভীর ডাক কখনো শুনেছেন?

না, কখনো শুনিনি।

ইংলন্ডে এ-পাখি খুবই দুস্পাপ্য প্রায় লোপ পেতে বসেছে বললেই চলে। তবে কি জানেন, এ-জলায় সবই সম্ভব। আওয়াজটা এই বকবংশের শেষ কোনো বংশধরের ডাক হলে খুব একটা অবাক হব না। আমি।

জীবনে এমন পিলে চমকানো, ভূতুড়ে, বিকট ডাক আমি শুনিনি।

জায়গাটাও যে সেইরকম অলৌকিক গা ছমছম করে। দূরের পাহাড়গুলো দেখুন! কী মনে হয়?

ধূসর বর্ণের বিস্তর প্রস্তর-বলয় ছেয়ে রয়েছে পাহাড়ের ঢাল। সংখ্যায় গোটা কুড়ি তো বটেই।

কী ওগুলো? ভেড়ার খোঁয়াড়?

না, অনেক গুণ ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের—এগুলো তাদের বাড়ি। এককালে প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের ঘনবসতি ছিল এই জলায়। তারপর থেকে কেউ আর এখানে থাকেনি। বাড়িঘরদোর পড়ে আছে ঠিক এইভাবেই। রেড ইন্ডিয়ানদের কুঁড়ের মতোই এইগুলি ছিল তাদের মাথা গোঁজার আস্তানা–ছাদগুলো কেবল উড়ে গেছে। কৌতূহল চরিতার্থ করতে ভেতরে যদি যান, আগুনের চুল্লি আর বসবার কৌচ পর্যন্ত দেখবেন রয়েছে ওখানে।

কিন্তু এ তো দেখছি একটা শহর বললেই চলে। মানুষ থাকত কোন সময়ে? প্রস্তর যুগের সময়ে সঠিক তারিখ নেই। কী করত? গরু ভেড়া চরাত পাহাড়ের ঢালে, তারপর যখন পাথরের কুঠারের বদলে ব্রোঞ্জের তলোয়ারের যুগ এল–মাটি খুঁড়ে টিন বার করতে শিখল। উলটোদিকের পাহাড়ে সারি সারি বিরাট খাতগুলো দেখছেন? ওদের কীর্তি, ডক্টর ওয়াটসন, অনেক অসাধারণ ব্যাপারই নজরে আসবে এই জলায়। আরে! আরে! নিশ্চয় সাইক্লোপাইড়স! আসছি দাঁড়ান।

ছোট্ট একটা মাছি বা মথ পোকার মতো কী যেন পত পত করে উড়ে গেল সরু পথের উপর দিয়ে। চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতে অসাধারণ ক্ষিপ্র বেগে এবং উদ্যমে তাড়া করলেন স্টেপলটন। সোজা সুবিখ্যাত পঙ্ক অভিমুখে প্রাণীটা উড়ছে দেখে হতাশ হলাম আমি, স্টেপলটন কিন্তু থামলেন না। সবুজ জাল শূন্যে দুলিয়ে এতটুকু দ্বিধা না-করে এক ঘাসের চাপড়া থেকে আর এক ঘাসের চাপড়ায় লাফিয়ে ধেয়ে চললেন পেছন পেছন। ধূসর পোশাক আর ঝুঁকি মেরে এঁকাবেঁকা অনিয়মিত গতিপথের দরুন মনে হল যেন নিজেই একটা অতিকায় মথ-পোকা। সভয়ে বিস্ময়ে সপ্রশংস চোখে চেয়ে রইলাম সেইদিকে। ভয় হল যেকোনো মুহূর্তে পা ফসকে বিশ্বাসঘাতক পাকে পড়তে পারেন ভেবে; প্রশংসা করলাম অসাধারণ তৎপরতার জন্যে; বিস্মিত হলাম ভয়হীনতা দেখে। এমন সময়ে পেছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দেখি সরু রাস্তা বেয়ে আসছে একজন মহিলা। একরাশ পালকের মতো ধূম্রপুঞ্জ ভাসছে যেদিকে এবং যেদিকে রয়েছে মেরিপিট হাউস মেয়েটি আসছেন সেইদিক থেকে জলার উঁচু-নীচু জমির আড়ালে থাকায় কাছাকাছি না-হওয়া পর্যন্ত দেখতে পাইনি।

দেখেই বুঝলেন ইনিই মিস স্টেপলটন–যাঁর কথা আগেই শুনেছি। জলাভূমিতে ভদ্রমহিলা সংখ্যার বেশি নেই নিশ্চয়। তা ছাড়া, আগেই শুনেছিলাম মিস স্টেপলটন নাকি রূপসী। এ-মহিলাও রূপসী এবং অনন্যা বললেই চলে। এ ধরনের রূপ বড়ো একটা দেখা যায় না। ভাইবোনের মধ্যে দেখলাম আসমান-জমিন ফারাক। স্টেপলটনের গায়ের রং না-ফর্সা না-ময়লা, চুল হালকা রঙের, চোখ ধূসর। কিন্তু তার বোনটির মতো শ্যামা মেয়ে সারা ইংলন্ডে আর দেখিনি–চামড়া কালো, চুল কালো, চোখ কালো। তন্বী দীর্ঘাঙ্গী, মার্জিত। নিখুঁত সুচারু সম্রান্ত মুখাবয়ব–কোথাও এতটুকু ত্রুটি নেই বলেই হয়তো আবেগহীন মনে হতে পারে কিন্তু অনুভূতি সচেতন ঠোঁট, কৃষ্ণকালো চোখ আর সাগ্রহ চাহনি দেখে সে-ধারণা মনে ঠাঁই পায় না। বেশভূষায় সূক্ষ্ম রুচির ছাপ, ফিগার নিখুঁত। নিরালা জলপথে এ-মূর্তি যেন একটা অদ্ভুত প্রেতচ্ছায়া। আমি যখন ঘুরে দাঁড়ালাম, উনি তখন তাকিয়ে ভাইয়ের দিকে। পরক্ষণেই দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। মাথার টুপি তুলে বুঝিয়ে বলতে যাচ্ছি আমি কে এবং কোথায় চলেছি এমন সময়ে ভদ্রমহিলা নিজেই যা বলে বসলেন, তাতে সম্পূর্ণ অন্য খাতে বয়ে গেল আমার চিন্তাধারা।

বললেন, ফিরে যান। সোজা লন্ডনে ফিরে যান! এক্ষুনি যান!

আকাট মূর্খের মতো বোবা বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম তার পানে।

চোখ জ্বলে উঠল ভদ্রমহিলার। অধীরভাবে পা ঠুকলেন মাটিতে।

জিজ্ঞেস করলাম, কেন ফিরে যাব?

তা বলতে পারব না, ব্যর্থ, খাটো গলায় বললেন মিস স্টেপলটন–উচ্চারণটা অদ্ভুত—আধো আধো, অস্ফুট। দোহাই আপনার, যা বলি তাই করুন। চলে যান এখান থেকে–এ-জীবনে আর পা দেবেন না জলায়।

কিন্তু এই তো এলাম আমি।

কী বিপদ! আপনার ভালোর জন্যে সাবধান করা হচ্ছে বুঝছেন না কেন? ফিরে যান লন্ডনে! আজ রাতেই রওনা দিন! যত ক্ষতিই হোক–এ-জায়গা ছেড়ে চলে যান এখুনি! চুপ, আমার ভাই আসছে! যা বললাম, তার একটা কথাও ওকে বলবেন না। দূরের ওই অর্কিডটা দয়া করে এনে দেবেন? হরেকরকম অর্কিডে ঠাসা আমাদের জলা–কিন্তু আপনি এসেছেন বড়ো দেরিতে অর্কিডের বাহারটা দেখতে পেলেন না।

পলায়মান প্রাণীর পেছন ছেড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আরক্ত মুখে ফিরে এলেন স্টেপলটন।

আরে, বেরিল দেখছি! কেন জানি আমার মনে হল, স্বাগত সম্ভাষণে প্রাণের সাড়া যেন নেই। বরং তার উলটো।

জ্যাক, তুমি দেখছি তেতে লাল হয়ে গেছ।

সাইক্রোপাইডের পেছনে ছুটেছিলাম। খুবই দুষ্প্রপ্য, শরতের শেষে কদাচিৎ চোখে পড়ে। ইস, একটুর জন্য ফসকে গেল!

কথাগুলো নির্লিপ্তস্বরে বললেন স্টেপলটন, ছোটো ছোটো হালকা রঙের চোখ দুটোর চাহনি কিন্তু বিরামবিহীনভাবে পর্যায়ক্রমে ঘুরতে লাগল আমার আর মেয়েটির ওপর। নিজেরাই আলাপ পরিচয় করে নিয়েছ দেখছি।

তা নিয়েছি। স্যার হেনরিকে বলছিলাম বড়ো দেরি করে এলেন, জলার আসল সৌন্দর্য এখন বিদায় নিয়েছে।

আরে, উনি কে বলে মনে হয় তোমার?

নিশ্চয় স্যার হেনরি বাস্কারভিল।

আরে না, না, বললাম আমি। খুবই সাধারণ মানুষ আমি, তবে ওঁর বন্ধু। আমার নাম ডক্টর ওয়াটসন।

মেয়েটির ভাবব্যঞ্জক মুখের ওপর দিয়ে বিরক্তির লাল আভা ভেসে যায়।

কথায় কথায় দেখছি ভুল করে ফেলেছি, বললেন মিস স্টেপলটন।

কিন্তু বেশি কথা বলার মতো সময় তো পাওনি, আগের মতোই সন্ধানী চোখে তাকিয়ে মন্তব্য করেন ভাই।

বোন বললেন, ডক্টর ওয়াটসন যে বেড়াতে এসেছেন বুঝিনি, আমি ভেবেছিলাম উনি ও-বাড়িতেই থাকেন। অর্কিডের সময় চলে গেছে, কি, সবে শুরু হয়েছে তা নিয়ে ওঁর খুব একটা মাথাব্যথা নেই। যাই হোক, আসুন। মেরিপিট হাউসে পায়ের ধুলো দিয়ে যান।

একটু হাঁটতেই একটা নির্জন নিরাপদ জলাভূমি ভবনের সামনে এসে পৌঁছোলাম। এক সময়ে এখানে যে থাকত, সে গোরু ছাগল খাইয়ে রোজগার করত। তখন এ-অঞ্চল অনেক সমৃদ্ধ ছিল। এখন সেদিন গিয়েছে। একটু মেরামত করে বাড়িটাকে বসতবাড়িতে পরিণত করা হয়েছে। ফলফুলের একটা বাগান ঘিরে রয়েছে বাড়ির চারধারে, কিন্তু জলাভূমির সব গাছের মতোই এ-বাগানের গাছও মাথা চাড়া দিতে পারেনি মাথা হেঁট করে রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে জায়গাটা নিম্নমানের এবং বিষাদাচ্ছন্ন। অদ্ভুত ধরনের শুষ্কবদন একজন পরিচারক এসে দরজা খুলে ধরলে। গায়ে সেকেলে ধাঁচের কোট, মুখের চামড়া কুঞ্চিত, এ-বাড়ির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো মূর্তি। ভেতরের ঘরগুলো বেশ বড়ো; রুচিসম্মত আসবাবপত্র দিয়ে সাজানোভদ্রমহিলার রুচি-সুন্দর হাতের ছোঁয়া রয়েছে সর্বত্র। জানলা দিয়ে গ্রানাইট সমাকীর্ণ দিগন্ত বিস্তৃত জলাভূমির একঘেয়ে তরঙ্গায়িত প্রান্তরের পানে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবলাম, উচ্চশিক্ষিত এই ভদ্রলোক এবং পরমাসুন্দরী এই মহিলা কীসের আকর্ষণে রয়েছেন এখানে।

আমার মনের চিন্তা পাঠ করে নিয়েই যেন বললেন স্টেপলটন, এ-রকম একটা জায়গা বসবাসের জন্য পছন্দ করলাম ভেবে অবাক হচ্ছেন তো? যত অদ্ভুতই হোক না, আমরা কিন্তু বেশ সুখে আছি, তাই না বেরিল?

খুবই সুখে, বললেন মিস স্টেপলটন, কিন্তু কথাটা প্রাণ থেকে যেন বললেন না–আত্মপ্রত্যয় ধ্বনিত হল না কণ্ঠস্বরে।

স্টেপলটন বললেন, একটা স্কুল খুলেছিলাম উত্তর অঞ্চলে। আমার মতো মেজাজের লোকের পক্ষে কাজটা যন্ত্রবৎ আগ্রহ জায়গায় না। কিন্তু ছোটোদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাওয়াটা কম নয়। নিজের চরিত্র আর আদর্শ অনুযায়ী ছোট্ট মানুষগুলোকে গড়ে তুলতে কী ভালোই না লাগত। কিন্তু নিয়তি তা চাইলেন না। সাংঘাতিক মড়ক লাগল স্কুলে মারা গেল তিনটে ছেলে। আঘাত সামলে উঠতে পারল না স্কুল–আমার বেশ কিছু মূলধন জলে গেল এইভাবে। ছেলেগুলোর মিষ্টি সঙ্গ যদি পেতাম, লোকসান সত্ত্বেও প্রাণে ফুর্তি থাকত। কেননা উদ্ভিদতত্ত্ব আর প্রাণীবিদ্যা দুটোতেই আমার ঝোঁক প্রচণ্ড কাজ করার অসীম সুযোগ রয়েছে এখানে, আমার বোনটিও আমার মতোই প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। ডক্টর ওয়াটসন, ঘরের জানলা দিয়ে জলাভূমির চেহারা দেখে এইসব কথাই ভিড় করে আসছে আপনার মাথার ভেতরে।

সত্যিই তাই জায়গাটা এত মনমরা আপনার চেয়ে আপনার বোনের কাছে হয়তো আরও বেশি মনমরা।

না, না, মনমরা আমি কখনোই নই, ঝটিতি জবাব দিলেন ভদ্রমহিলা!

বই রয়েছে, পড়াশুনো রয়েছে, ইন্টারেস্টিং প্রতিবেশীরা রয়েছেন। স্বক্ষেত্রে ডক্টর মর্টিমার অত্যন্ত পণ্ডিত মানুষ। স্যার চার্লস বেচারাও সঙ্গী হিসেবে প্রশংসার পাত্র ছিলেন। খুবই খাতির ছিল আমাদের সঙ্গে ওঁর মৃত্যু যে আমাদের কাছে কতখানি, তা বলে বোঝাতে পারব না। আজ বিকেলেই স্যার হেনরির সঙ্গে আলাপ করতে গেলে বিরক্ত হবেন বলে মনে হয়?

খুশিই হবেন।

তাহলে দয়া করে বলবেন আমি আসতে পারি। উনি যাতে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারেন, সব কিছুই সহজভাবে নিতে পারেন আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সে-চেষ্টা করব। ডক্টর ওয়াটসন, আসুন না, ওপরতলায় এসে আমার লেপিডটেরা-র সংগ্রহটা দেখে যান। ইংলন্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে এর চাইতে সম্পূর্ণ সংগ্রহ আর নেই বলেই আমার বিশ্বাস। দেখতে দেখতেই লাঞ্চ তৈরি হয়ে যাবে।

আমি কিন্তু তখন ছটফট করছি ফিরে যাওয়ার জন্য যে-দায়িত্ব নিয়ে এসেছি, তা ফেলে এখানে লাঞ্চ খাওয়া যায় না। মন ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে টাট্টুর শোচনীয় মৃত্যু, জলার বিষণ্ণতা এবং বাস্কারভিল বংশের ভয়ংকর কিংবদন্তির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ভৌতিক ডাকের দরুন। সব মিলিয়ে যেন দমে গিয়েছে কিছু ভালো লাগছে না। সবার ওপরে রয়েছে মিস স্টেপলটনের সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট হুঁশিয়ারি সুগভীর আন্তরিকতায় ব্যাকুল সেই হুঁশিয়ারি ভোলবার নয়–আমার দৃঢ় বিশ্বাস নিশ্চয় গুরুতর এবং গভীর একটা কারণ আছে। তাই খেয়ে যাওয়ার সব অনুরোধ ঠেলে ফেলে দিয়ে তৎক্ষণাৎ ঘাস-ছাওয়া পথে রওনা হলাম বাস্কারভিল হল অভিমুখে।

কিন্তু সোজা রাস্তা নিশ্চয় একটা ছিল–সবাই তা জানে না। কেননা, মূল রাস্তায় পৌঁছে অবাক হয়ে গেলাম মিস স্টেপলটনকে দেখে। আমার আগেই উনি পৌঁছেছেন এবং রাস্তার পাশে একটা পাথরের ওপর বসে আছেন। মুখটি সুন্দরভাবে রাঙা হয়ে গিয়েছে হাঁপিয়ে যাওয়ায়।

বললেন, ডক্টর ওয়াটসন, আপনাকে ধরব বলে দৌড়ে এলাম। টুপি পর্যন্ত পরবার সময় পাইনি। দাঁড়াতে পারব না–ভাই ধরে ফেলবে। আপনাকে স্যার হেনরি ভেবে যে-বোকামি করেছি, তার জন্যে দুঃখিত। যা বলেছি, তা ভুলে যান। আপনার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

কিন্তু ভোলা কি যায়, মিস স্টেপলটন, বললাম আমি। স্যার হেনরির বন্ধু আমি। তার ভালোমন্দ নিয়ে খুবই উদবিগ্ন। স্যার হেনরি লন্ডনে ফিরে যান–এই আপনি চান। কিন্তু এত ব্যগ্রতা কেন আপনার?

মেয়েলি খেয়াল, ডক্টর ওয়াটসন। কারণ ছাড়াই অনেক সময়ে অনেক কাজ করে ফেলি, অনেক কথা বলে ফেলি আমি–আর একটু মিশুন~ তাহলেই বুঝবেন।

না, না, আপনার গলা কাঁপছিল কথা বলতে বলতে স্পষ্ট মনে আছে। মনে আছে আপনার চাহনি। আমার কথা রাখুন মিস স্টেপলটন, দয়া করে মন খুলে কথা বলুন–এখানে এসে ইস্তক চারপাশে একটা অশুভ ছায়ার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি বলেই এত করে বলছি যা জানেন সব বলুন। মহাকুটিল ওই গ্রিমপেন পঙ্কর মতোই জীবন এখানে বিপদসংকুল–ছোটো ছোটো সবুজ ছোপ চারিদিকেই যেকোনো মুহূর্তে পা ফসকে ড়ুবে যাওয়ার সম্ভাবনা–অথচ কেউ নেই যে বলে দেয় কোন পথ দিয়ে গেলে জীবনটা রক্ষে পাবে। তাই বলছি, কী বলতে চাইছেন খুলে বলুন–কথা দিচ্ছি আপনার প্রতিটি কথা স্যার হেনরির কানে পৌঁছে দেব।

ক্ষণেকের জন্যে একটা দোটানার ভাব খেলে গেল মিস স্টেপলটনের মুখের ওপর দিয়ে, কিন্তু আবার শক্ত হয়ে এল চোখের দৃষ্টি।

বললেন, ডক্টর ওয়াটসন, আপনি দেখছি তিলকে তাল করছেন। স্যার চার্লসের মৃত্যুতে আমরা ভাই বোন দু-জনেই দারুণ আঘাত পেয়েছি। খুবই অন্তরঙ্গ ছিলাম আমরা ওঁর বেড়ানোর প্রিয় পথ ছিল জলার ওপর দিয়ে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত। বংশের মাথার ওপর এই যে-অভিশাপটা ঝুলছে, এটা খুব বেশি নাড়া দিয়েছিল ওঁকে। তাই তাঁর শোচনীয় মৃত্যুর পর মনে হয়েছিল, উনি তাহলে খামোকা দুশ্চিন্তায় ভোগেননি নিশ্চয় একটা কারণ ছিল। তাই বংশের আর একজন অভিশপ্ত এই ভিটেয় এসে উঠতেই আমার মন বলল তাকে সাবধান করে দিতে বিপদ এখানে পদে পদে প্রাণের মায়া থাকলে যেন পালান। এই উদ্দেশ্য নিয়ে বলেছিলাম কথাগুলো।

কিন্তু বিপদটা কীসের?

হাউন্ডের গল্প তো শুনেছেন?

এসব রাবিশ গল্প আমি বিশ্বাস করি না।

কিন্তু আমি করি। স্যার হেনরির ওপর যদি আপনার তিলমাত্র প্রভাব থাকে, এ-জায়গা থেকে ওঁকে সরিয়ে নিয়ে যান–মনে রাখবেন এখানে এলেই একটা মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েছেন এবং বংশের প্রত্যেকে কেউ পার পায়নি। পৃথিবীটা অনেক বড়। এ-রকম। বিপদের জায়গায় উনি থাকতে চান?

কারণ এটা বিপদের জায়গা বলে। স্যার হেনরির প্রকৃতি এইরকমই। এর বেশি সঠিক কিছু খবর যদি দিতে না-পারেন, এখানে থেকে তাকে নড়াতে আমি পারব না–অসম্ভব।

সঠিক কিছুই বলতে পারব না–কারণ আমি নিজেই সঠিক কিছু জানি না।

মিস স্টেপলটন, আর একটা প্রশ্ন করব। এখন যা বললেন, প্রথমবারেও যদি এর বেশি কিছু মনে করে না-থাকেন তো ভাইকে বলতে বারণ করলেন কেন? পাছে ভাই কিছু শুনে ফেলে বলে কথা ঘুরিয়ে নিলেন কেন? এমন কিছু ছিল না কথার মধ্যে যা শুনে ফেললে তিনি অথবা অন্য কেউ আপত্তি জানাবেন?

আমার ভাই অন্তর দিয়ে চায় বাস্কারভিল হলে যেন লোকজন থাকে–জলার সাধারণ মানুষ তাতে উপকৃত হবে বলে তার বিশ্বাস। স্যার হেনরিকে চলে যাওয়ার মতো প্ররোচনা দিয়ে কথা বলেছি শুনলে ভীষণ রেগে যাবে সে। যাক, আমার কর্তব্য আমি করেছি, আর কথা বলব না। আর দাঁড়াবও না বেশিক্ষণ আমাকে না-দেখলেই ভাই ভাববে আপনার সঙ্গে দেখা করেছি। আসি!

পেছন ফিরেই দেখতে দেখতে বিক্ষিপ্ত বিশালাকার প্রস্তররাশির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। নামহীন আতঙ্কে কানায় কানায় ভরে রইল আমার অন্তর। দ্রুত পা চালালাম বাস্কারভিল হল অভিমুখে।