০৫. দুঃসাহসের ডাকে

ব্যাপারটি যেমন গুরুতর, তেমনি দুঃসাহসিক। অসম্ভব বললেও চলে। অগ্রপশ্চাৎ নাভেবে দুঃসাহসের ডাকে এভাবে সাড়া না-দিলেই ভালো করতেন ফগ। এ-কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লে কে জানে বিপক্ষের হাতে তাকে মরতে হবে কি-না! অন্তত চিরকালের জন্যে বন্দী হবেন কি না, তা-ই বা কে জানে? তাহলেই তো সব খতম হয়ে গেলো। যেজন্যে এত পরিশ্রম করে তিনি এতদূর এসেছেন, তা ব্যর্থ হবে। আশিদিনে সারা পৃথিবী ঘুরে আসবার জন্যে যে-বাজি ধরেছেন, তাহলে সেই বাজিতে হারতে হবে তাকে। কিন্তু তার হৃদয় কোনো বাধাই মানলো না। তিনি দেখলেন, এ-কাজে সার ফ্রান্সিস একজন শক্তিশালী সহযোগী। পাসপার্তুও যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। ভাবনা একটাই, সেটি এই পার্শি মাহুতের জন্যে।

সে যদি সাহায্য না-করে, না-করলো—কিন্তু দেখতে হবে সে যাতে বিপক্ষের দলে না-যায়।

সার ফ্রান্সিস তাই সোজাসুজি মাহুতকে সে-কথা জিগেস করলেন। মাহুত জবাব দিলে, আমি পার্শি। আপনারা যাঁকে উদ্ধার করতে চাচ্ছেন, তিনিও পার্শি। আপনারা যা বলবেন, আমি তা-ই করবো। সে আরো বললে : আপনারা মনে রাখবেন, আমাদের সামনে মস্ত-একটা বিপদ পাহাড়ের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। এ-কাজে শুধু-যে আমাদের জীবনের আশঙ্কা আছে, তা-ই নয়—যদি আমরা ধরা পড়ি, তবে মৃত্যুর আগে যন্ত্রণারও কমতি হবে না।

ফিলিয়াস ফগ জবাব দিলেন : সে-সব বিপদ ঘাড়ে নিতে আমরা তৈরি আছি। সন্ধে অব্দি অপেক্ষা করা যাক, রাতের অন্ধকারে কাজ শুরু করা যাবে। ভদ্রমহিলাটি কে, তুমি জানো?

মাহুত বললে, ভদ্রমহিলার নাম আউদা। বম্বাইয়ের একজন ধনী বণিকের মেয়ে। তিনি উচ্চশিক্ষিতা। দীর্ঘকাল বিদেশে কাটিয়েছেন। মা-বাবা কেউ নেই। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বুড়ো রাজার সঙ্গে আজ তিন মাস হলো তার বিয়ে হয়েছে। ভয়ানক দুরদৃষ্টের কথা ভেবে তিনি পালিয়ে যাবারও চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। রাজার কয়েকজন নিকটআত্মীয় আছেন। তারা রাজসম্পত্তির ভোগদখল চান। আউদা বেঁচে থাকলে তাদের সুবিধে হবে না বলে তারা জোর করে তাকে পুড়িয়ে মারছেন।

মাহুতের কথা শুনে ফিলিয়াস ফগের সংকল্প আরো-দৃঢ় হলো। মাহুতকে বললেন : কোনো সাড়াশব্দ না-করে পিল্লাজির মন্দিরের যত কাছে পারো, তত কাছে নিয়ে চলো।

কিউনি আধঘণ্টার মধ্যেই তাদের নিয়ে মন্দিরের প্রায় আধমাইল দূরে এসে দাঁড়ালে। গাছপালার আড়াল থেকে তখন সেই তুমুল শোরগোল শোনা যেতে লাগলো।

মাহুত বললে : রানী আউদা নিশ্চয়ই এখন মন্দিরের মধ্যে বন্দিনী।

সকলেই ভাবতে লাগলেন, কী করে তাকে উদ্ধার করা যায়। রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে, তখন কি মন্দিরে প্রবেশ করা ঠিক হবে, না দেয়াল ভেঙে সেই ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকলে সুবিধে হবে? মন্দিরের কাছে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে না দেখলে এ-প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না।

তারা উদগ্রীব হয়ে রাত্রির প্রতীক্ষ্ণ করতে লাগলেন। সন্ধে ছ-টার সময় বন অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেলো। প্রহরীদের অতিক্রম করে মন্দিরের কাছে যাওয়ার সেটাই একমাত্র সুসময় দেখে মাহুত তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। তারা ধীরে-ধীরে খুব সাবধানে বনপথে হামাগুড়ি দিয়ে এগুলেন। একটু যাওয়ার পরই ছোট্ট একটা ঝর্নার কাছে এসে পৌঁছুলেন তারা। মশালের আলোয় দেখলেন, রাশি-রাশি চন্দনকাঠ দিয়ে একটা মস্ত চিতা তৈরি হয়েছে। সেই চিতায় শোয়ানো হয়েছে বুড়ো রাজার মৃতদেহ। রানী আউদার সঙ্গে পরদিন ভোরবেলাতেই তা ভস্মসাৎ হবে। চিতা থেকে মন্দিরটি একশো হাতেরও বেশিদূর হবে না। মন্দিরের গম্বুজটা সন্ধের অন্ধকারে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছিলো।

মাহুতের ইঙ্গিত-মতো বড়ো-বড়ো ঘাসের আড়ালে লুকিয়ে-লুকিয়ে তারা আরো

সাবধানে রুদ্ধনিশ্বাসে নিঃশব্দে এগুতে লাগলেন।

খোলা মাঠের কাছে এসে মাহুত থামলো। সিদ্ধি খেয়ে বিভোর হয়ে প্রহরীরা সেখানে শুয়ে ছিলো। দু-একজন তখনও টলতে টলতে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। কাছেই গোটা-কয়েক মশাল জ্বলছিলো কম্পিত শিখায়। মশালের ছায়া-আলোয় তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন, সবলদেহ রাজপুত প্রহরীরা খোলা তলোয়ার হাতে মন্দিরের সামনে পায়চারি করে পাহারা দিচ্ছে।

মাহুত আর এগুলো না। বুঝলো, বিনা বাধায় এ-পথে এগুনো অসম্ভব! সার ফ্রান্সিস আর ফগেরও সেই একই ধারণা হলো। তারা মৃদুস্বরে পরামর্শ করতে লাগলেন। সার ফ্রান্সিস বললেন : আরো-খানিকক্ষণ অপেক্ষা করা যাক। এই-তো সবে আটটা বাজলো। বেশি রাতে প্রহরীরা নেশাভাঙ করে ঘুমিয়ে পড়তে পারে।

তারা তখন একটা গাছের নিচে শুয়ে উত্তেজিতভাবে সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলেন। সময় যেন আর কাটতেই চায় না। মাহুত মধ্যে-মধ্যে এদিক-ওদিক গিয়ে খবর নিতে লাগলো। দেখলো, প্রহরীরা আগের মতোই পাহারা দিচ্ছে। মশালও আগের মতোই জ্বলছে। মন্দিরের ভিতর থেকেও তখন জানলা দিয়ে কম্পিত আলোকরেখা দেখা যাচ্ছিলো।

রাত গভীর হলো, কিন্তু অবস্থার আদপেই কোনো বদল হলো না। তখনও অতন্দ্ৰচোখে পাহারা দিচ্ছিলো প্রহরীরা। মনে হলো, তারা যেন সারারাতই এ-ভাবে জেগে কাটিয়ে দেবে। এ-পথ ছেড়ে মন্দিরের দেয়াল ভেঙে ভিতরে ঢোকবার চেষ্টাই তখন যুক্তিযুক্ত বলে মনে হলো। তাই মাহুত ফের সন্তর্পণে সব দেখে আসতে অগ্রসর হলো। ফগ, পাসপার্তু আর সার ফ্রান্সিস মাহুতকে অনুসরণ করলেন।

অন্ধকার এমনই গাঢ় গভীর-ঘন যে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। দূরের মশালগুলো যেন চারপাশের অন্ধকারকে আরো গাঢ় করে তুলেছিলো। তারা ভাবলেন, আর-কিছু চাই না, কোনোরকমে একবার মন্দিরের দেয়ালের সন্ধান পেলেই হলো। প্রবেশের পথ থাকলে তো ভালোই-না-থাকলে পথ বের করে নিতে হবে।

একটু বাদেই মন্দিরের ইটের দেয়াল গায়ে ঠেকলো। সেদিকে কোনো দরজা বা জানলা ছিলো না। ফগ আর সার ফ্রান্সিস অন্য-কোনো সরঞ্জাম না-থাকায় পকেট ছুরির সাহায্যে ইট খুলতে লাগলেন। মাহুত আর পাসপার্তু সেই আলগা ইটগুলো ধীরে-ধীরে খুলে নিতে লাগলো।

খান-কয়েক ইট খোলবার সঙ্গে-সঙ্গেই মন্দিরের ভিতর হঠাৎ কে যেন চেঁচিয়ে উঠলো! সঙ্গে-সঙ্গে বাইরে কোলাহল উঠলো। পাসপার্তু আর মাহুত থামলো। সেখানে আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না মনে করে সার ফ্রান্সিস সকলকে নিয়ে চট করে দূরে সরে গেলেন। ভাবলেন, পরে সুযোগ পেলে আবার আসবেন। কিন্তু সে সুযোগ আর হলো না। খোলা তলোয়ার হাতে প্রহরীরা তক্ষুনি মন্দিরটি ঘিরে দাঁড়ালে।

রাগে সার ফ্রান্সিস ফুলতে লাগলেন। পাসপার্তু খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলো। অনেক চেষ্টায় আত্মসংবরণ করলো মাহুত। শুধু ফিলিয়াস ফগ তখনও অবিচলিত ও অকম্পিত রইলেন।

সার ফ্রান্সিস বললেন : আর কেন? চলুন, এবার ফিরে যাওয়া যাক।

ধীরকণ্ঠে ফগ জবাব দিলেন : অত তাড়া কীসের? আমি যদি কাল দুপুরবেলা এলাহাবাদ পৌঁছুতে পারি, তাহলেই হবে। দেখাই যাক না শেষপর্যন্ত। শেষমুহূর্তেও তো আমাদের কোনো-একটা সুযোগ ঘটতে পারে।

সার ফ্রান্সিস ফিলিয়াস ফগের এই অবিচলিত ধৈর্য দেখে বিস্মিত হলেন। ভাবলেন, শেষমুহূর্তে তার আর কী-সুযোগ ঘটবে? ইনি কি তবে জ্বলন্ত চিতায় লাফিয়ে পড়ে রানী আউদাকে উদ্ধার করবেন? এ-বকম উম্মাদ প্রয়াস যে বিফল ও বিপজ্জনক হবে, সে তো সকলেই জানে। ফিলিয়াস ফগের মতো ধীর-স্থির-স্থিতধী ইংরেজ যে অবোধের মতো এমন-একটা কাজ করবেন, এ-কথা সার ফ্রান্সিসের মোটেই বিশ্বাস হলো না। তবু এই ভয়ানক দৃশ্যের যবনিকাপাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি হলেন তিনি। মাহুত আবার পথ দেখিয়ে তাদের বনের বাইরে মাঠের কিনারে নিয়ে গেলো। তারা সেখানেই লুকিয়ে থেকে, দূর থেকে, সেই নৃশংস হত্যার আয়োজন দেখতে লাগলেন। সতী মানেই জীবন্ত নারীদেহে অগ্নি-সংযোগ।

পাসপার্তু মনে-মনে একটা মৎলব করে নিয়েছিলো। সকলের অলক্ষ্যে সে কোথায় চলে গেছে, কেউ তা জানতেও পারলেন না। অন্ধকারে পাসপার্তু গাছের তলা দিয়ে খুবই সাবধানে সেই চিতা-শয্যার দিকে এগুতে লাগলো। সে-যে কোথায় যাচ্ছে, তা শুধু সেই জানে!

আস্তে-আস্তে ভোর হয়ে এলো। প্রসন্ন প্রভাতের সোনালি আলো আকাশের কোলে মৃদু হাসির মতো ফুটে উঠলো; কিন্তু মন্দিরের চারদিকে তখনও ঘন অন্ধকার ছেয়ে আছে। এই আলো-অন্ধকারের সন্ধিক্ষণই সতীদাহের সময় বলে ঠিক করা হয়েছিলো। আস্তে-আস্তে সবাই ঘুম থেকে উঠলো। তাদের চঁচামেচিতে আর ঢাক-ঢোলের প্রচণ্ড আওয়াজে বন-প্রান্তর কেঁপে উঠলো। ক্রমশ সতীদাহের সময় এসে উপস্থিত হলো।

হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেলো মন্দিরের দরজা খোলা দরজা দিয়ে মন্দিরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো সুতীব্র আলোর ঝলক। দেখা গেলে, দুজন পুরোহিত দু-দিক থেকে ধরে সেই মৃত্যুপথযাত্রিণীকে মন্দিরের বাইরে টেনে আনলে। বার-কয় পলায়নের চেষ্টা করে আফিঙের ধোঁয়ায় আবার নেতিয়ে পড়েছিলেন ভদ্রমহিলা। পুরোহিতেরা রানী আউদাকে নিয়ে চিতার দিকে এগুলো। প্রভাতের অর্ধস্ফুট আলোয় সেই ভয়ানক গায়েকাঁটা-দেয়া দৃশ্য অপলক চোখে দেখতে লাগলেন ফিলিয়াস ফগ।

চিতার উপর বুড়ো রাজার মৃতদেহ পড়ে। রনী আউদাকে তার মৃত স্বামীর পাশে শুইয়ে রাখা হলো। স্তুপীকৃত চন্দন কাঠে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো—অমনি ধোঁয়ায়ধোঁয়ায় ভরে উঠলো চারদিক। তুমুল শব্দে বেজে উঠলো বাজনা-ঢাকঢোল জগঝম্প।

ছুরি হাতে ফগ সেই অগ্নিকুণ্ডের দিকে এগুবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সার ফ্রান্সিস আর মাহুত অনেক কষ্টে তাকে ধরে আটকালেন। ফিলিয়াস ফগ তাদের ধাক্কা দিয়ে ফের তার পা বাড়াবেন, এমন সময় এক অভাব্য অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে হতচকিত হয়ে পড়লেন; স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, পাথরের মতো।

সতীদাহ করতে যারা এসেছিলো তারা ভীতস্বরে উঠলো চেঁচিয়ে। আশঙ্কায় উদ্বেগে বিস্ময়ে-বিস্ফারিত চোখে তারা তাকিয়ে দেখলো, বৃদ্ধ রাজা নবজীবন লাভ করেছেন। রানী আউদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রাজা। তারা ভয়ে তাদের পুনরুজ্জীবিত রাজার দিকে আর তাকাতে পারলে না, প্রণত হয়ে মাটিতে মাথা ছোঁয়ালে।

চক্ষের পলকে জ্বলন্ত চিতা ছেড়ে রাজার প্রেতাত্মা ফিলিয়াস ফগের কাছে এসে বললো : আর দেরি নয়; চলুন, চলুন শিগগির! জলদি!

সবিস্ময়ে সবাই তাকিয়ে দেখলেন, অচৈতন্য আউদাকে কাঁধে নিয়ে পাসপার্তু দাঁড়িয়ে! ধোঁয়ায় যখন চারদিক ভরে গিয়েছিলো তখন সেই ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে পাকার কাঠের উপর উঠে সে রক্ষা করেছে মৃত্যুপথযাত্রিণীকে!

আর একমুহূর্তও সময় নষ্ট করলেন না তারা। তক্ষুনি ছুটতে ছুটতে প্রবেশ করলেন বনের গহনে। দ্রুতগামী কিউনি তাদের নিয়ে এলাহাবাদের দিকে ছুটলো।

নিস্তব্ধ অরণ্য খানিকক্ষণের মধ্যেই কোলাহলে কলরবে চঞ্চল ও চকিত হয়ে উঠলো। বন্দুকের আওয়াজে চারদিক কেঁপে উঠলো। হাতির পাশ দিয়ে শোঁ-শোঁ করে গুলি ছুটে যেতে লাগলো। সতীদাহ করতে যারা এসেছিলো, তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে পাগলের মতো পিছু-পিছু ছুটে এলো বটে, কিন্তু বনের সেই গভীর-গহনে হাতি কিংবা তার সোয়ারদের আর নাগাল পেলে না।

এই দুঃসাহসিক প্রয়াস সফল হয়ে যাওয়ায় হাতির পিঠে বসে হাসছিলো পাসপার্তু। সার ফ্রান্সিস তো খুশি হয়ে তার সঙ্গে বার-কয় হ্যাণ্ডশেক করে ফেললেন, আর ফিলিয়াস ফগ শুধু বললেন : বেশ করেছে। তার মতো গম্ভীর-মেজাজ লোকের কাছ থেকে এই ছোট্ট প্রশংসাটুকুই যথেষ্ট। পাসপার্তু তার প্রশংসার জবাবে বললো : এ-কাজের যা-কিছু গৌরব, যা-কিছু প্রশংসা—সবই তো আপনার প্রাপ্য—আমি শুধু উপলক্ষ মাত্র।

মৃত্যুর কবল থেকে রেহাই পেলেও আউদার জ্ঞান তখনও ফেরেনি। তার দিকে তাকিয়ে সার ফ্রান্সিস বললেন : এঁর বিপদের এখানেই শেষ নয়। যদ্দিন ইনি ভারতবর্ষে থাকবেন, তদ্দিন এর জীবন নিরাপদ নয়। ভারতবর্ষের যেখানেই থাকুন না কেন, এঁর ক্রুদ্ধ শত্রুরা এর সন্ধান করবেই, আর সুযোগ পেলেই পুড়িয়ে মারতে ছাড়বে না। ইংরেজের আইন ইংরেজের পুলিশ কিছুতেই একে রক্ষা করতে পারবে না। দিন-কয়েক আগেই এমনি-একটা ঘটনা ঘটে গেছে। ইনি যদি একবার ভারতবর্ষের বাইরে অন্যকোনো দেশে যেতে পারেন, তবেই নিশ্চিন্ত হতে পারবেন।

ফিলিয়াস ফগ বললেন : এ-কথার জবাব এত চটপট দেয়া যাবে না, ভেবে দেখতে হবে।

বেলা দশটার সময় তারা এলাহাবাদে এসে পৌঁছুলেন। আউদার তখন ক্রমশ জ্ঞান ফিরে আসছিলো—ধীরে-ধীরে তিনি চোখ খুললেন। তাঁকে ওয়েটিং-রুমে রেখে ফগ তার জন্যে কতগুলো দরকারি জিনিশপত্র কিনতে পাসপার্তুকে বাজারে পাঠালেন।

এলাহাবাদ থেকে ট্রেন ছাড়বার সময় হলো। ফিলিয়াস ফগ সেই পার্শি মাহুতকে তার পাওনা-গণ্ডা চুকিয়ে দিয়ে বললেন : তুমি আমাদের জন্য যথেষ্ট করেছে। সেজন্যে হাতিটা দিতে চাই তোমায়। নেবে তো?

মাহুতের চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

ট্রেনে উঠতে উঠতে ফগ বললেন : হাতিটা নিয়ে যাও। কিন্তু এতেও আমি তোমার ঋণ শোধ করতে পারলুম না।

ট্রেন ছেড়ে দিলে। আউদার তখন পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে এসেছে। সব শুনে তিনি কেঁদে ফেললেন। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালেন সবাইকে। কিন্তু পরমুহূর্তেই ভবিষ্যতের চিন্তা তাঁকে ব্যাকুল করে তুললো।

তার মনোভাব বুঝতে পেরে ফগ বললেন : আপনার ভয় নেই। আমি হংকং যাচ্ছি। বাধা না-থাকলে আপনাকেও সেখানে নিয়ে যেতে পারি।

কৃতজ্ঞ হৃদয়ে অভিভূত আউদা বললেন : হংকং-এ আমার এক ধনী আত্মীয় ব্যাবসা করতেন। বোধহয় এখনও তিনি সেখানেই আছেন।

তাহলে তো খুব ভালো হলো। ফগ বললেন। আমরা তাহলে তাকে খুঁজে বার করবো।