০৬. ক্যাথরিন সলোমন

৫১ অধ্যায়

ক্যাথরিন সলোমন বরাবরই ধীরস্থিরভাবে গাড়ি চালিয়ে থাকে, কিন্তু এই মুহূর্তে স্যুইটল্যাণ্ড পার্কওয়ে দিয়ে সে তার ভলভো নব্বইয়ের উপরে দাবড়ে নিয়ে যায়। তার কাঁপতে থাকা পা পুরো এক মাইল পর্যন্ত এক্সিলেটরের উপরে চেপে বসে থাকে তারপরেই কেবল তার আতঙ্ক কমতে শুরু করে।

আমি জমে যাচ্ছি।

ভাঙা জানালা দিয়ে শীতের ভারী বাতাস হু হু করে ভিতরে প্রবেশ করে, আঁর্কটিক হিম বায়ুর হিংস্রতায় তার শরীরকে আঘাত করছে। তার স্টকিং পরা পায়ে কোন সাড়া নেই, এবং সে প্যাসেঞ্জার সীটের নীচে সবসময়ে রাখা বাড়তি জুতো জোড়ার খোঁজ করে। জুতা খোঁজার সময়ে গলার ভিতরে কালশিটে থেকে আঁচমকা ব্যথার একটা প্রকোপ ছড়িয়ে যায়, দানবটা যেখানে তার ঘাড় গলার অংশ আঁকড়ে ধরেছিল।

ড. ক্রিস্টোফার অ্যাবাড্রন বলে সে যাকে চিনে তার সাথে জানালা ভেঙে হাত বাড়িয়ে দেয়া লোকটার বিন্দুমাত্র মিল নেই। তার মাথার ঘন সুবিন্যাস্ত চুল আর তামাটে ত্বক সব কোথায় হারিয়ে গেছে। তার কামান মাথা, খালি বুক আর প্রসাধন থেবড়ে যাওয়া মুখের নীচে উল্কির একটা ভয়ঙ্কর আল্পনা উঁকি দিয়েছে।

ভাঙা জানালার পাশে বাতাসের গর্জনের ভিতরে সে তার কানে দানবটার ফিসফিস করে বলা কথা আবার যেন শুনতে পায়। ক্যাথরিন, বহু বছর আগেই আমার উচিত ছিল তোমায় হত্যা করা…যে রাতে আমি তোমার মাকে হত্যা করেছিলাম।

ক্যাথরিন কেঁপে উঠে, তার মনে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সেই ছিল। তার চোখের সেই নগ্ন নির্মম হিংস্রতা সে কখনও ভুলে যায়নি। সে এমনকি তার ভাইয়ের পিস্তলের একবার গর্জে উঠার শব্দও ভুলতে পারেনি, লোকটাকে হত্যা করে, তাকে পাহাড়ের উঁচু কিনারা থেকে নীচের হিম শীতল নদীর স্রোতে আছড়ে ফেলেছিল, যেখানে সে বরফের নীচে তলিয়ে চিরতরের মত তলিয়ে গিয়েছিল এবং আর কখনও ভেসে উঠেনি। অনুসন্ধানী দল কয়েক সপ্তাহ ধরে লাশের জন্য তল্লাশি চালালেও, লাশটা কখনও খুঁজে পায়নি, এবং শেষ পর্যন্ত মেনে নেয়া হয়েছিল সেটা স্রোতের সাথে ভেসে চিসপিক উপসাগরে চলে গেছে।

তারা সবাই ভুল করেছিল, সে এখন হাড়ে হাড়ে জানে। লোকটা এখনও বেঁচে আছে।

আর সে ফিরে এসেছে।

স্মৃতির খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে পলাতক স্মৃতি ফিরে আসতে ক্যাথরিন উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগে বিচলিত হয়ে পড়ে। ঘটনাটা ঠিক দশ বছর আগের। বড়দিন। ক্যাথরিন, পিটার আর তাদের মা- তার পুরো পরিবার পোটোম্যাকে দুশো একর জমি নিয়ে গঠিত এস্টেটে, যার উপর দিয়ে এস্টেটের নিজস্ব নদী প্রবাহিত হয়েছে, তাদের বিশাল বাড়িতে সমবেত হয়েছিল।

সনাতন রীতি অনুযায়ী, তাদের মা বেশ শ্রম দিয়ে রান্নাঘরে কাজ করছিলেন, বড়দিন উপলক্ষ্যে নিজের দুই সন্তানের জন্য খাবার তৈরী করাটা তিনি উপভোগই করছেন। পঁচাত্তর বছর বয়সেও ইসাবেল সলোমন উৎসাহী রাধুনি আর আজ রাতে মুখে জল আনা হরিণের মাংস, সবজির ডিশ আর আদা দিয়ে ভর্তা করা আলুর সুগন্ধ পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে। মা যখন ভোজের রান্না নিয়ে ব্যস্ত, ক্যাথরিন আর তার ভাই তখন বাড়ির নাটমঞ্চে বসে আড্ডা দেয়, তারা ক্যাথরিনের নতুন আঁকৰ্ষণ-জ্ঞানের একটা নতুন ধারা নিওটিক বিজ্ঞান নিয়ে আলাপ করে। আধুনিক কণা পদার্থবিদা আর প্রাচীন মরমীবাদের অস্বাভাবিক সংশ্লেষণে সৃষ্ট নিওটিক ক্যাথরিনের কল্পনার রাজ্য পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে।

দর্শনের সাথে পদার্থবিদ্যার মিলন।

ক্যাথরিন তার কল্পনা করা কয়েকটা গবেষণার বিষয় পিটারকে খুলে বলে এবং সে তার ভাইয়ের চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারে সেও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এবারের বড়দিনে ভাইকে কোন ইতিবাচক চিন্তার খোরাক দিতে পেরেছে দেখে ক্যাথরিনের মনটাও ভাল হয়ে উঠে, কারণ তাদের জন্য এই ছুটির দিনটা একটা ভয়ঙ্কর দুর্ভাগ্যের যন্ত্রণাবিধূর স্মরণিকায় পরিণত হয়েছিল।

পিটারের ছেলে জাকারিয়া।

ক্যাথরিনের ভাইয়ের ছেলের একুশতম জন্মদিনই ছিল তার শেষ জন্মদিন। পুরো পরিবারটা সেসময়ে একটা দুঃস্বপ্নের ভিতর দিয়ে গিয়েছে এবং এখন মনে হচ্ছে তার ভাই আবার নতুন করে হাসতে শিখেছে।

জ্যাকারিয়া ছিল রোগা, আনাড়ি, বিদ্রোহী, অকারনে রাগী আর ধীরে বিকশিত হওয়া এক কিশোর। গভীর ভালবাসা এবং সব সুযোগসুবিধার ভিতরে বেড়ে উঠা সত্ত্বেও ছেলেটা কেন জানি নিজেকে সলোমন নামের প্রতিষ্ঠান থেকে একেবারে আলাদা করে নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। প্রেপ স্কুল থেকে বহিষ্কৃত, তার বেশিরভাগ সময় কাটত তারকাঁদের সাথে মচ্ছব করে, বাবা-মায়ের আপ্রাণ প্রয়াস তাদের কঠোর আর সমবেদনাপূর্ণ পরামর্শের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।

পিটারের মনটা সে ভেঙে দিয়েছিল।

জ্যাকারিয়ার আঠার বছরের জন্মদিনের কিছুদিন আগে, ক্যাথরিন তার মা আর ভাইয়ের সাথে বসে তাদের আলোচনা করতে শুনে জ্যাকারিয়ার উত্তরাধিকার তাকে দেয়া হবে নাকি তার আরেকটু পরিণত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে। সলোমন উত্তরাধিকার- শতবর্ষের পারিবারিক প্রথা- সলোমন পরিবারের প্রতিটা ছেলেকে তাদের আঠারতম জন্মদিনে সলোমন সম্পদের। একটা থোক অংশ উইলের মাধ্যমে দান করা হয়। সলোমনরা বিশ্বাস করে যে উত্তরাধিকার একজনের জীবনের শেষের চেয়ে শুরুতে অনেকবেশী সাহায্যকারী। আর তাছাড়া, সলোমন সম্পদের একটা বড় অংশ আগ্রহী তরুণ উত্তরপুরুষের হাতে সমর্পন করাটাই পরিবারটার রাজসিক সম্পদ অর্জনের পেছনে মূল চালিকা শক্তি।

এই ক্ষেত্রে, অবশ্য ক্যাথরিনের মায়ের যুক্তি ছিল যে পিটারের সমস্যাআঁকীর্ণ। ছেলের হাতে এত বিশাল পরিমাণ টাকা দেয়াটা বিপজ্জনক হতে পারে। পিটারের তা মনে হয় না। সলোমন উত্তরাধিকার তার ভাইয়ের যুক্তি একটা পারিবারিক প্রথা যা ভাঙা উচিত হবে না। এই টাকাটাই হয়ত জ্যাকারিয়াকে দায়িত্বশীল হতে সাহায্য করবে।

দুঃখের বিষয় তার ভাইয়ের বিশ্লেষন ভুল প্রমাণিত হয়।

জ্যাকারিয়া টাকাটা হাতে পাওয়া মাত্র, সে পরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে, নিজের কোন জিনিস না নিয়ে সে বাসা থেকে উধাও হয়ে যায়। তার খবর এরপরে তারা পায় কয়েক মাস পরে ট্যাবলয়েড থেকে: ট্রাস্ট ফাণ্ড প্লেবয়ের ইউরোপীয় উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন।

জ্যাকারিয়ার ভোগবিলাসিতায় পূর্ণ জীবনের কেচ্ছা ট্যাবলয়েড ফুর্তির সাথে ছাপিয়ে চলে। ইয়টে বুনো উদ্যাম পার্টি আর ডিস্কোতে মাতাল হয়ে সংজ্ঞাহীন হবার খবর সলোমনদের কাছে বেশ কঠিন ছিল মেনে নেয়া, কিন্তু কাগজে বখে যাওয়া কিশোরের ছবি দুঃখজনক থেকে আতঙ্কে রূপান্তরিত হয় যখন কোকেন নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার সময়ে পূর্ব ইউরোপে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে: সলোমন কোটিপতি তুরস্কের জেলখানায়।

জেলখানাটার নাম, তারা জানতে পারে, সোগালিক- একটা নির্মম এফ ক্লাস ডিটেনশন সেন্টার ইস্তাম্বুলের ঠিক বাইরে কার্টাল জেলায় অবস্থিত। পিটার সলোমন ছেলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে তুরস্কে আসেন তাকে মুক্ত করতে। ক্যাথরিনের বিহ্বল ভাই খালি হাতে ফিরে আসে, সে এমনকি ছেলের সাথে। দেখাও করতে পারেনি। একমাত্র আশার খবর যে ইউ.এস স্টেট ডিপার্টমেন্টে সলোমনদের প্রভাবশালী সম্পর্ক যত দ্রুত সম্ভব তাকে বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস নিয়েছে।

দুদিন পরে অবশ্য, পিটারের কাছে একটা ভয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক ফোন কল আসে। পরের দিনের খবরের কাগজের শিরোনামে ঘোষিত হয়: সলোমন উত্তরাধিকারী জেলখানায় খুন হয়েছে।

জেলখানার ছবি ভয়াবহ, এবং সংবাদ মাধ্যম উদাসীন হয়ে সবগুলো ছবিই ছাপতে থাকে, এমনকি সলোমনদের ব্যক্তিগত অন্তেষ্টিক্রিয়ার অনেক পরেও তা বজায় থাকে। পিটারের স্ত্রী জ্যাকারিয়াকে মুক্তি করতে না পারার জন্য তাকে কখনও ক্ষমা করতে পারেনি, এবং ছয়মাস পরে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। পিটার তারপর থেকে একাই বাস করে আসছে।

বহুবছর পরে এবার আবার সে, তার ভাই আর মা ইসাবেল নিরবে বড়দিনের জন্য একত্রিত হয়েছে। স্বজন হারাবার কষ্ট এখনও তাদের জর্জরিত করে কিন্তু আশার কথা বছরের পরে বছর সেটা যেন ধীরে ধীরে কিছুটা ফিকে হয়ে আসছে। রান্নাঘর থেকে আবার হাড়ি বাসনের মধুর শব্দ ভেসে আসছে মা আবার সনাতন ভোজ উৎসবের আয়োজন করায়। নাটমঞ্চে ক্যাথরিন আর পিটার লবণ দিয়ে বেক করা ব্রি চিজ খেতে খেতে গল্প করে।

তখনই একটা একেবারে অপ্রত্যাশিত শব্দ ভেসে আসে।

হ্যালো, সলোমনস,একটা ফ্যাসফেসে কণ্ঠ তাদের পেছন থেকে বলে উঠে।

চমকে উঠে ক্যাথরিন আর তার ভাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে একজন পেশীবহুল অতিকায় আঁকৃতির লোক নাটমঞ্চে প্রবেশ করছে। তার মুখে একটা। কালো স্কি মাস্ক যা তার চোখ দুটো বাদের পুরো মুখটা ঢেকে রেখেছে, যেখানে বীভৎস নৃশংসতা ঝলসায়।

পিটার সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। তুমি কে??! এখানে আসলে কি করে?!

জেলখানায় তোমাদের ক্ষুদে থোকা জ্যাকারিয়াকে আমি চিনতাম। সে আমাকে বলেছে চাবিটা কোথায় লুকান থাকে। আগন্তুক একটা পুরানো চাবি দেখিয়ে খিকখিক করে পশুর মত হাসে। আমি তাকে পিষে মারার আগে সে বলে গিয়েছে।

পিটারের চোয়াল স্কুলে যায়।

একটা পিস্তল বের করে লোকটা সরাসরি সেটা পিটারের বুকে তাক করে। বসো।

পিটার তার চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে।

লোকটা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে ক্যাথরিন জায়গায় জমে দাঁড়িয়ে থাকে। মাস্কের পেছনে লোকটার চোখ দুটো জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত বন্য পশুর মত দেখায়।

শোন! পিটার রান্নাঘরে তাদের মাকে যেন সতর্ক করে দিতে চায়। তুমি যেই হও, যা ইচ্ছে নিয়ে এখন বিদেয় হও।

লোকটা পিস্তলটা পিটারের বুক বরাবর নামিয়ে আনে। আর তোমার কি মনে হয় আমি কি চাই?

শুধু বল কত, সলোমন বলে। বাসায় আমরা টাকা রাখিনা কিন্তু আমি জোগাড় করতে পারব।

দানবটা হাসে। আমাকে অপমান কোরো না। আমি টাকার জন্য আসিনি। আমি আজ রাতে এখানে এসেছি জ্যাকারিয়ার আরেকটা জন্মগত অধিকার দাবী করতে। সে হাসে। সে আমাকে পিরামিডের কথা বলেছে।

পিরামিড? হতভম্ব আতঙ্কে ক্যাথরিন ভাবে। কিসের পিরামিড?

তার ভাই অবজ্ঞাপূর্ণ ভাব দেখায়। আমি জানি না তুমি কিসের কথা বলছো?

আমার সাথে ভাণ করোনা! জ্যাকারিয়া আমাকে বলেছে তোমার স্টাডির ভল্টে তুমি কি লুকিয়ে রেখেছো। আমি সেটা চাই। এখনই।

জানি না, জ্যাকারিয়া তোমাকে কি বলেছে, কিন্তু সে বিভ্রান্ত ছিল, পিটার বলে। আমি সত্যিই জানি না তুমি কিসের কথা বলছো!

না? আগন্তুক এবার পিস্তলটা ক্যাথরিনের মুখের দিকে তাক করে। এখন কি বলবে?

পিটারের চোখে আতঙ্ক ভর করে। আমার কথা বিশ্বাস কর! আমি জানি না। তুমি কি চাইছে!

আর একবার আমাকে মিথ্যা কথা বল, ক্যাথরিনের দিকে পিস্তলটা তাক করে রেখেই সে বলে, এবং আমি দিব্যি কেটে বলছি তোমার বোনকে তোমার কাছ থেকে আমি আলাদা করে দেবো। সে হাসে। আর জ্যাকারিয়ার কাছ থেকে আমি যা শুনেছি তোমার ছোট বোন তোমার সবকিছুর চেয়ে তোমার কাছে বেশি মূল্যবান।

হচ্ছেটা কি এখানে?? ক্যাথরিনের মা পিটারের ব্রাউনিং সিটোরী শটগান নিয়ে দুমদাম করে ভেতরে প্রবেশ করে- শটগানের নলটা সরাসরি লোকটা বুকের দিকে তাক করা। আগন্তুক তার দিকে ঘুরে তাকায় এবং পঁচাত্তর বছর বয়সী সাহসী মহিলা বিন্দুমাত্র কালক্ষেপন করে না। কানে তালা লাগিয়ে ছররার একটা ঝাক তার দিকে নিক্ষেপ করে। টলোমলো পায়ে আগন্তুক পিছিয়ে যায়, উন্মত্তের মত চারপাশে গুলি করতে করতে জানালার কাঁচ ভাঙে এবং সে কাঁচের দরজা ভেঙে বাইরে গিয়ে পড়ে, পড়ার সময়ে তার হাতের পিস্তল খসে পড়ে।

পিটার সাথে সাথে পড়ে থাকা পিস্তলটা লক্ষ্য করে লাফ দেয়। ক্যাথরিন বসে পড়ে এবং মিসেস সলোমন দ্রুত তার কাছে এসে হাটু মুড়ে বসে। ই ঈশ্বর, তুমি আঘাত পেয়েছো?!

ক্যাথরিন মাথা নাড়ে, আতঙ্কে বোবা হয়ে গেছে। ভাঙা কাঁচের দরজার বাইরে মাস্ক পরিহিত লোকটা টলমল করতে করতে উঠে দাঁড়ায় এবং বুকের একপাশে হাত চেপে ধরে বনের দিকে দৌড়ে যায়। পিটার সলোমন তার বোন আর মা ঠিক আছে কিনা দেখতে পেছনে তাকায় এবং তাদের সুস্থ দেখতে পেয়ে সে পিস্তলটা নিয়ে আগম্ভকের পিছনে ধাওয়া করে দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়।

ক্যাথরিনের মা কাঁপতে কাঁপতে তার হাত ধরে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তোমার কিছু হয়নি। তারপরে সহসা তার মা পিছিয়ে যায়। ক্যাথরিন? তোমার গা থেকে রক্ত পড়ছে! অনেক রক্ত! তুমি আঘাত পেয়েছো!

ক্যাথরিন রক্ত দেখে। অনেক রক্ত। তার সারা গায়ে লেগে আছে। কিন্তু সে কোন ব্যথা অনুভব করে না।

তার মা পাগলের মত ক্ষতস্থান খুঁজে। কোথায় ব্যথা করছে।

মা, আমি বুঝতে পারছি না, আমি কোন ব্যথা টের পাচ্ছি না!

তারপরে ক্যাথরিন রক্তপাতের উৎস দেখতে পায় এবং তার হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। মা আমি না…সে তার মায়ের স্যাটিনের সাদা ব্লাউজের পাশে হাত দিয়ে দেখায়, যেখান থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে এবং একটা ছোট ক্ষুদে গর্ত সেখানে দেখা যায়। তার মা নিজের দিকে তাকায়, তাকে কোন কিছুর চেয়ে বেশি বিভ্রান্ত দেখায়। সে মুখ কুচকে ব্যথায় কুকড়ে যায়, যেন একমাত্র সে ব্যথা অনুভব করেছে।

ক্যাথরিন? তার কণ্ঠস্বর সহসা শান্ত হয়ে আসে এবং পচাত্তর বছরের পুরো ওজন সেখানে ফুটে উঠে। আমার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে খবর দাও।

ক্যাথরিন দৌড়ে হলঘরের ফোন থেকে সাহায্য চেয়ে ফোন করে। সে নাটমঞ্চে ফিরে এসে মাকে রক্তের একটা ছোটখাট পুকুরের মাঝে নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখতে পায়। সে দৌড়ে তার কাছে আসে, উবু হয়ে তার পাশে বসে, মায়ের শরীরটা হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে।

ক্যাথরিন বলতে পারবে না কতক্ষণ পরে সে দূরে বন থেকে পিস্তলের গুলির একটা শব্দ ভেসে আসতে শুনেছিল। অবশেষে নাটমঞ্চের দরজা হাট হয়ে খুলে যায়, এবং পিস্তল হাতে চোখে বন্য দৃষ্টি নিয়ে তার ভাই পিটার ভিতরে প্রবেশ করে। তাদের মায়ের নিথর দেহ হাতে করে বসে, সে ক্যাথরিনকে যখন ফোপাতে দেখে তার মুখ বেদনায় ভেঙেচুরে যায়। নাটমন্দির থেকে প্রতিধ্বনিত হওয়া আর্তনাদের শব্দ ক্যাথরিন সলোমন কখনও ভুলতে পারবে না।

.

৫২ অধ্যায়

মাল’আখ পড় পাঁচের ভবনটা ঘুরে ফের খোলা দরজার দিকে দৌড়ে ফিরে যাবার সময়ে টের পায় তার পিঠের উল্কি আঁকা মাংসপেশী কিলবিল করছে।

তার ল্যাবে আমাকে প্রবেশ করতেই হবে।

ক্যাথরিনের পলায়নটা পূর্ব অনুমিত না…এবং সমস্যাসঙ্কুল। সে এখন মাল’আখ কোথায় বাস করে কেবল সেটাই জানে না, সে তার আসল পরিচয় জানে…এবং সেই এক দশক আগে তাদের বাসায় জোর করে প্রবেশ করেছিল সেটাও জেনে গেছে।

সেই রাতটার কথা মাল’আখ নিজেও ভুলেনি। সে পিরামিডটা আয়ত্বে নেয়ার কাছাকাছি চলে এসেছিল, কিন্তু নিয়তি সেবার তাতে বাধ সেধেছিল। আমি তখনও প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু এখন সে প্রস্তুত। অনেকবেশী ক্ষমতাধর। অনেকবেশী প্রভাবশালী। তার এই ফিরে আসবার জন্য প্রস্তুত হতে অচিন্তনীয় কষ্ট তাকে সহ্য করতে হয়েছে, আজ রাতে মাল’আখ তার নিয়তির লিখন সফল করতে বদ্ধপরিকর। সে নিশ্চিত আজ রাত শেষ হবার আগেই, মৃত্যু পথযাত্রী ক্যাথরিন সলোমনের চোখের দিকে তাকাবার সুযোগ আসবে।

মাল’আখ ফের দরজার কাছে পৌঁছালে, সে নিজেকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে ক্যাথরিন সলোমন সত্যিই পালাতে পারেনি; সে কেবল অনিবার্যকে দীর্ঘায়িত করেছে। সে খোলা স্থান দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে এবং আত্মবিশ্বাসী পায়ে। অন্ধকারে হেঁটে চলে যতক্ষণ পায়ের নিচে কার্পেটের স্পর্শ অনুভব না করে। তারপরে সে ডানে ঘুরে কিউবের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যায়। পড পাঁচের দরজায় আঘাত করা বন্ধ হয়েছে এবং মাল’আখ সন্দেহ করে গার্ড বোধহয় এবার সিকিটা বের করার চেষ্টা করছে যেটা কিবোর্ডের প্যানেলে ঢুকিয়ে দিয়ে সে পুরো সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে।

মাল’আখ কিউবে পৌঁছাবার দরজার কাছে আসতে সে বাইরের কিপ্যাড দেখতে পায় এবং সেখানে ত্রিশের কার্ড পাঞ্চ করে। প্যানেল আলোকিত হয়ে উঠে। সে ত্রিশের পিন লিখে ভেতরে প্রবেশ করে। আলো জ্বলছে এবং সে বীজাণুমুক্ত এলাকার দিকে প্রবেশ করে সেখানকার চৌকষসব অনুষঙ্গের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। প্রযুক্তির ক্ষমতার সাথে মাল’আখ পরিচিত; তার বাসার বেসমেন্টে সে নিজের উদ্ভাবিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা করে থাকে, এবং গতকাল রাতে সেই গবেষণা ফলপ্রসু প্রমাণিত হয়েছে।

সত্য সমাগত।

পিটার সলোমনের অনন্য বন্দিদশা- সন্ধিক্ষণে একাকী আটকে থাকা লোকটা সব গোপনীয়তা নিঙরে বের করে এনেছে। আমি তার আত্মা দেখতে সক্ষম। মাল’আখ অনুমান করেছিল এমন কিছু রহস্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়েছে এবং অন্য আরো সব রহস্য যার সম্বন্ধে তার কোন ধারণাই ছিল না, যার ভিতরে ক্যাথরিনের ল্যাব একটা এবং তার চমকে দেবার মত আবিষ্কার। বিজ্ঞান ক্রমশ এগিয়ে আসছে, মাল’আখ বুঝতে পারে। আর আমি ইতরজনদের কাছে সে আলো পৌঁছাতে দেব না।

প্রাচীন দার্শনিক প্রশ্ন আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে সমাধানের প্রয়াসে এখানে ক্যাথরিন কাজ শুরু করেছিল। আমাদের প্রার্থনা কি কেউ শুনতে পায়? মৃত্যুর পরে কি জীবন আছে? মানুষের আত্মা বলে কি কিছু আছে? অবাক করার মত ব্যাপার ক্যাথরিন সবগুলো প্রশ্নেরই উত্তর এবং আরো বেশি কিছু খুঁজে পেয়েছে। বৈজ্ঞানিকভাবে। সিদ্ধান্তমূলক। তার ব্যবহৃত পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্নের কোন অবকাশ নেই। তার গবেষণার ফলাফল চরম অবিশ্বাসীও মানতে বাধ্য হবে। গবেষণার এই ফলাফল প্রকাশিত হলে মানুষের চিন্তাধারায় একটা মৌলিক পরিবর্তন সূচীত হবে। তারা তাদের পথ খুঁজে পাবে। আজরাতে রূপান্তরের আগে সেটা যেন কখনও ঘটতে না পারে নিশ্চিত করাটাই মাল আখের শেষ কাজ।

ল্যাবের ভিতরে ঢুকে একটু তাকাতেই, মাল’আখ পিটারের বলা ডাটা রুমটা দেখতে পায়। ভারী কাঁচের দেয়ালের ভিতর দিয়ে সে দুটো হলোগ্রাফিক ডাটা সংরক্ষণ যন্ত্র দেখতে পায়। সে যেমন বলেছিল ঠিক সেরকমই। মাল’আখের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এই ছোট দুটো বাক্সের তথ্য মানুষের অগ্রগতির ধারা বদলে দিতে পারে আর সত্য সবসময়েই অন্য যেকোন নিয়ামকের চেয়ে শক্তিশালী।

হলোগ্রাফিক স্টোরেজ ইউনিটের দিকে তাকিয়ে মাল’আখ ত্রিশের কিকার্ড বের করে সেটা দরজার সিকিউরিটি প্যানেলে প্রবেশ করায়। সে অবাক হয়ে দেখে প্যানেল আলোকিত হয়নি। বোঝা যায় স্টোরেজ রুমে প্রবেশের বিশ্বাসযোগ্যতা কখনও লাভ করেনি। ক্যাথরিনের ল্যাবকোটের পকেটে পাওয়া কিকার্ডটা বের করে সেটা প্রবেশ করাতে প্যানেল আলোকিত হয়ে উঠে।

মাল’আখ এখন একটা সমস্যার পড়ে। ক্যাথরিনের পিন নাম্বার আমি জানি। সে ত্রিশের পিন চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। চোয়াল ঘষতে ঘষতে পিছিয়ে এসে সে তিন ইঞ্চি পুরু প্লেক্সিগ্নাসের দরজাটা পরীক্ষা করে দেখে। কুঠার দিয়ে কোপালেও সে ভিতরে প্রবেশ করে বাক্স দুটো করায়ত্ত্ব করতে পারবে না।

মাল’আখ অবশ্য এই পরিস্থিতিতে পড়তে পারে বলে আগেই ধারণা করেছিল।

পাওয়ার-সাপ্লাই ঘরের ভিতরে, পিটার ঠিক যেমন বলেছিল, মাল’আখ অনেকগুলো মেটাল সিলিণ্ডার রাখা একটা তাক দেখতে পায়, অনেকটা স্কুবা ট্যার মতই দেখতে। সিলিণ্ডারের গায়ে এলএইচ লেখা এবং দুই নম্বর দেয়া আর দাহ্য পদার্থের আন্তজাতিক চিহ্ন আঁকা। সিলিণ্ডারগুলোর ভিতরে একটা ল্যাবের হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের সাথে সংযুক্ত।

মাল’আখ সংযুক্ত ক্যানিস্তারাটা ধরে না এবং বাড়তি সিলিণ্ডারের একটা তাকের পাশে রাখা ডলিতে সাবধানে নামিয়ে রাখে। তারপরে সেটা সে পাওয়ার-সাপ্লাই রুমের বাইরে নিয়ে এসে ডাটা স্টোরেজ রুমের প্লেক্সিগ্নাসে দরজার সামনে রাখে। যদিও এই স্থানটা নিশ্চিতভাবেই অনেকটা কাছে, সে ভারী প্লেক্সিগ্নাসের দরজার একটা দূর্বলতা দেখতে পেয়েছে- তলদেশ আর দরজার বাজুর ভিতরে একটা ফাঁকা স্থান বিদ্যমান রয়েছে।

চৌকাঠের কাছে, ক্যানিস্তারাটা সাবধানে শোয়ায় এবং রবারের হোসপাইপটা দরজার নীচের সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়। সিলিণ্ডারের সেফটি সীল খুলে সে সেফটি ভাল্বটা ধরে খুব আস্তে করে মোচড় দেয়। প্লেক্সিপ্লাসের ভিতর দিয়ে সে পরিষ্কার দেখে স্টোরেজ রুমের ভিতরের মেঝেতে ফুটতে থাকা তরল ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। মাল’আখ তরলের লেইটাকে ধীরে ধীরে পুরো ঘরে ছড়িয়ে যেতে দেখে, ছড়াবার সাথে সাথে বাষ্প আর বুদবদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শীতল অবস্থায় কেবল হাইড্রোজেন তরল থাকে এবং উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সে ফুটতে শুরু করে দেয়। আর নির্গত গ্যাস তরলের চেয়ে অনেক বেশি দাহ্য।

হিণ্ডেনবার্গের কথা মনে নেই।

মাল’আখ এবার ল্যাবে এসে পাইরেক্সের জার ভর্তি বুনসেন বার্ণারের ফুয়েল নেয়-পিচ্ছিল, চিটচিটে, খুবই দাহ্য কিন্তু সহজে আগুন ধরে না এমন এক ধরণের তেল। সে জারটা প্লেক্সিগ্লাসের দরজার কাছে নিয়ে আসে, তরল হাইড্রোজেন তখনও ক্যানিস্তার থেকে বের হচ্ছে দেখে মনটা খুশী হয়ে যায়, তরল বুদবুদের লেইটা এখন পুরো কক্ষে ছড়িয়ে পড়েছে, হলোগ্রাফিক স্টোরেজ ইউনিটের পাটাতন ঘিরে ফেলেছে। একটা সাদা কুয়াশার মত ধোয়া লেইটা থেকে উঠতে শুরু করেছে যার অর্থ তরল হাইড্রোজেন গ্যাসে রূপান্তরিত হচ্ছে…ক্ষুদ্র স্থানটায় ছড়িয়ে পড়ছে।

মাল’আখ জারটা তুলে বেশ ভাল পরিমাণে বুনসেন বার্ণার ফুয়েল হাইড্রোজেনের সিলিণ্ডারে, টিউবে আর দরজার নীচে ফাঁকটায় ঢালে। তারপরে ধীরে ধীরে সে ল্যাব থেকে বের হয়ে আসে মেঝেতে তেলের একটা অবিচ্ছিন্ন ধারা ফেলতে ফেলতে।

.

ওয়াশিংটন ডি.সির ৯১১ কলের ডিসপ্যাঁচ অপারেটর আজ রাতটায় অস্বাভাবিক রকমের ব্যস্ত। ফুটবল, বীয়ার আর পূর্ণিমা, সে ভাবছে এমন সময় আরেকটা কল তার স্ক্রীনে ভেসে উঠে এটা এসেছে এনাকোশিয়ার সুইটল্যাণ্ড পার্কওয়েতে অবস্থিত গ্যাস স্টেশনের পে-ফোন থেকে। গাড়ি দুর্ঘটনা, সম্ভবত।

নাইন-ওয়ান-ওয়ান, সে বলে। আপনার জরুরী প্রয়োজনটা বলেন?

আমি এই মাত্র স্মিথসোনিয়ান সাপোর্ট সেন্টারে আক্রমণের শিকার হয়েছি, আতঙ্কিত এক মহিলা কণ্ঠ বলে। দয়া করে পুলিশ পাঠান! বিয়াল্লিশ দশ সিলভার হিল রোড!

ঠিক আছে, ধীরে, অপারেটর বলে। আপনার পরি-

আপনাকে কালোরামা হাইটসের একটা ম্যানসনে অফিসার পাঠাতে হবে যেখানে আমার ভাইকে বন্দি করে রাখা হয়েছে বলে আমার ধারণা!

অপারেটর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজ পূর্ণিমাই বটে।

.

৫৩ অধ্যায়

আমি এতক্ষণ ধরে তোমাকে যা বলতে চাইছি, বেল্লামি ল্যাংডনকে বলে, চোখে যা ধরা পড়ে তারাচেয়েও বেশি কিছু একটা এই পিরামিডে রয়েছে।

আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। ল্যাংডনকে স্বীকার করতেই হবে তার খোলা ডেব্যাগের ভিতরে বসে থাকা পাথরের পিরামিডটাকে এখন তার কাছে। আরও বেশি রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে। ম্যাসনিক গুপ্তলিপির পাঠোদ্ধার আপাতভাবে অর্থহীন আরেকটা বর্ণমালার গ্রিড তৈরী করেছে।

বিশৃঙ্খলা।

বিশৃঙ্খলা

কিছুক্ষণের জন্য, ল্যাংডন তন্নতন্ন করে গ্রিডটা পরীক্ষা করে, বর্ণগুলোর ভিতরে কোন সূত্র দেখা যায় কিনা- লুকান শব্দ, অ্যানাগ্রাম, কোন ধরণের সংকেত- কিন্তু সে কিছুই দেখতে পায় না।

দি ম্যাসনিক পিরামিড, বেল্লামি ব্যাখ্যা করে, বলা হয়ে থাকে অনেকগুলো অবগুণ্ঠনের আড়ালে নিজের গোপনীয়তা লুকিয়ে রেখেছে। প্রতিবার তুমি একটা করে আড়াল ছিন্ন করবে, আরেকটার মুখোমুখি হবে। তুমি এই শব্দগুলো খুঁজে পেয়েছে এবং তারা তোমাকে কিছুই বলবে না যতক্ষণ তুমি। আরেকটা আড়াল ছিন্ন না করছো। অবশ্য শিরোশোভাটা যার কাছে রয়েছে কেবল সেই সেটা করতে পারবে। শিরোশোভাটায়, আমার মনে হয়, আরেকটা ভাষ্য খোদাই করা আছে যা পিরামিডের গুপ্তলিপি পাঠোদ্ধারে সহায়তা করবে।

ল্যাংডন ডেস্কের উপরে রাখা চারকোনা বাক্সটার দিকে তাকায়। বেল্লামির কথা থেকে ল্যাংডন বুঝতে পারে পিরামিড আর তার শিরোশোভা হল খণ্ডিত গুপ্তলিপি- টুকরো করা সংকেত। আধুনিক ক্রিপ্টলজিস্টরা সবসময়ে খণ্ডিত গুপ্তভাষা ব্যবহার করে, যদিও প্রাচীন গ্রীসে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা প্রবর্তিত। হয়েছিল। গ্রীকরা যখন কোন তথ্য গোপনে সংরক্ষণ করতে চাইতো, তারা মাটির পাটায় সেটা লিখত তারপরে শুকিয়ে নিয়ে সেটা ভেঙে টুকরো করে প্রতিটা টুকরো আলাদা আলাদা স্থানে লুকিয়ে রাখত। সবগুলো টুকরো এক জায়গায় করলেই কেবল গোপন তথ্যটা পাওয়া যেত। এই ধরণের লেখণী যুক্ত মাটির টুকরোকে বলা হত সিম্বলন- যেটা থেকেই আধুনিক কালের সিম্বল শব্দটার উৎপত্তি।

রবার্ট, বেল্লামি বলে, পিরামিড আর ক্যাপস্টোন পুরুষানুক্রমে আলাদা রাখা হয়েছিল এই গোপনীয়তার নিরাপত্তা রক্ষার্থে। তার কণ্ঠস্বর অনুতপ্ত শোনায়। আজরাতে অবশ্য টুকরো দুটো বিপজ্জনক রকমে কাছাকাছি এসেছে। আমি নিশ্চিত আমার এটা বলার প্রয়োজন নেই…কিন্তু আমাদের দায়িত্ব এই পিরামিড় যেন সংযুক্ত না হয়।

ল্যাংডন অবশ্য বেল্লামির কথাটা অতিনাটকীয় মনে হয়। সে একটা পিরামিড আর তার শিরোশোভার কথা বলছে…নাকি আণবিক বোমা আর ডিটোনেটরের? সে তারপরেও বেল্লামির দাবী মানতে পারে না, কিন্তু সেটা ধর্তব্যের ভেতরে পড়ে বলে মনে হয় না। এটা যদি ম্যাসনিক পিরামিড হয়ও এবং এতে উত্তীর্ণ লিপি প্রাচীন জ্ঞানের অবস্থান প্রকাশও করে, তাহলেও যে জ্ঞান এর উন্মোচিত করার কথা সেটা কিভাবে সম্ভব হবে?

পিটার আমাকে সবসময়ে বলেছে তোমাকে বিশ্বাস করা কঠিন। একজন বুদ্ধিজীবি যে সম্ভাবনার উপরে যুক্তিকে স্থান দেয়।

আপনি বলছেন যে আপনি আসলেই সেটা বিশ্বাস করেন? ল্যাংডন জানতে চায়, সে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। আপনাকে সম্মান জানিয়েই বলছি…আপনি একজন আধুনিক, শিক্ষিত মানুষ। আপনি এসব কিভাবে বিশ্বাস করেন?

বেল্লামির মুখে প্রশ্রয় আর ধৈৰ্য মেশান হাসি ফুটে উঠে। ফ্রিম্যাসনারীর প্রাজ্ঞতা মানুষের বোঁধের বাইরে যা তার প্রতি আমাকে গভীর শ্রদ্ধাশীল করেছে। কেবল অলৌকিক বলে কোন ধারণাকে নিজের মন থেকে মুছে না দিতে শিখিয়েছে।

.

৫৪ অধ্যায়

এসএমএসসির চতুরে দায়িত্বরত প্রহরী পাগলের মত নুড়ি বিছান পথ দিয়ে ছুটে চলে যা ভবনের বাইরেটা ঘিরে রেখেছে। সে ভিতরের এক অফিসারের কাছ থেকে পাওয়া একটা কল থেকে জানতে পেরেছে যে পড পাঁচে ঢোকার কিপ্যাডে নাশকতামূলক তৎপরতা চালান হয়েছে এবং নিরাপত্তা বাতির স্কুলে থাকা দেখে বোঝা যাচ্ছে পড পাঁচের নমুনা বের দরজা খোলা।

এসব কিসের আলামত?!

নমুনা প্রবেশের বোতে পৌঁছাবার পরে সে নিশ্চিতভাবেই দরজাটা কয়েক ফিট ফাঁক হয়ে আছে দেখতে পায়। আজব, সে ভাবে। দরজাটা ভেতর থেকে তালা দেয়া থাকে। সে কোমড় থেকে ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে পডের ভেতরের পিচ কালো অন্ধকারে সেটা জ্বালায়। কিছুই দেখা যায় না। ভেতরের অজানা অঞ্চলে পা দেয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তার নেই সে কেবল এগিয়ে এসে চৌকাঠের সামনে দাঁড়ায় এবং ফ্ল্যাশলাইটটার খোলা মুখটা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে বামে আলো ফেলে আর তারপরে

একটা শক্তিশালী হাত তার কব্জি আঁকড়ে ধরে তাকে হিঁচড়ে অন্ধকারের ভিতরে নিয়ে আসে। নিরাপত্তা রক্ষী অনুভব করে একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে বনবন করে ঘুরাচ্ছে। সে ইথানলের গন্ধ পায়। ফ্ল্যাশলাইট তার হাত থেকে ছুটে যায় এবং কি হয়েছে বুঝে ওঠার আগেই পাথরের মত শক্ত মুষ্ঠাঘাত এসে তার বুকের পাজরে আঘাত করে। নিরাপত্তা কর্মী সিমেন্টের মেঝেতে নেতিয়ে পড়ে…ব্যথায় কোকাতে থাকলে একটা বিশাল কালো অবয়ব তার কাছ থেকে দুরে সরে যায়।

কাত হয়ে পড়ে থেকে নিরাপত্তা রক্ষী বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করে, জোরে শব্দ করে শ্বাস নেয়। তার ফ্ল্যাশলাইটটা কাছেই পড়ে আছে এবং তার আলোতে একটা ধাতব ক্যানের মত বস্তু উদ্ভাসিত হয়েছে। ক্যানটার লেবেলে লেখা কথা অনুযায়ী তাতে বুনসেন বার্ণারের ফুয়েল থাকবার কথা।

কোথাও একটা সিগারেটের লাইটার জ্বলে উঠে এবং কমলা আলোর আভায় যা দৃশ্যমান হয় তার সাথে মানুষের মুখের মিল সামান্যই। জেসাস ক্রাইস্ট! নিরাপত্তা প্রহরী কোন প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করার আগেই নগ্ন বুকের জটা হাটু ভেঙে বসে এবং জ্বলন্ত শিখাটা মেঝেতে স্পর্শ করে।

সাথে সাথে, আগুনের একটা লম্বা ফিতে জন্ম নিয়ে তাদের কাছ থেকে দূরে শূন্যতার দিকে দৌড়ে চলে। হতবিহ্বল প্রহরী পেছনে তাকিয়ে দেখে জন্তুটা ততক্ষণে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে রাতের অন্ধকারে বেড়িয়ে যাচ্ছে।

নিরাপত্তা রক্ষীটা কোন মতে উঠে বসে, ব্যথায় চোখ কুচকে দেখতে চেষ্টা করে আগুনের ফিতেটা কোথায় যাচ্ছে। আরে খোদা এটা কি? শিখাটা এত ছোট যে তাকে বিপজ্জনক বলে মনে হয় না কিন্তু সে তারপরেও প্রচণ্ড ভীতিকর কিছু একটা দেখে। আগুনটা এখন আর কেবল অন্ধকারই আলোকিত করছে না। সে পেছনের দেয়ালের কাছে পৌঁছে গেছে এবং সেখানে একটা বিশাল কাঠের তৈরী কাঠামোকে আলোকিত করে তুলেছে। নিরাপত্তা রক্ষী কখনও পড পাঁচের ভিতরে প্রবেশ করেনি কিন্তু তারপরেও সে ভাল করে জানে কাঠামোটা কিসের।

দি কিউব।

ক্যাথরিন সলোমনস ল্যাব।

.

শিখাটা সোজা ল্যাবের বাইরের দরজা লক্ষ্য করে ছুটে আসে। নিরাপত্তা কর্মী কোনমতে উঠে দাঁড়ায়, খুব ভাল করেই সে জানে তেলের ফিতা সম্ভবত দরজার নিজে দিয়েও বয়ে গেছে…আর শীই ভেতরে আগুন জ্বলে উঠবে। কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়িয়ে সাহায্যের জন্য দৌড় শুরু করবে এমন সময় অপ্রত্যাশিত

একটা বাতাসের ঝাঁপটা তাকে শুষে নেয়।

মুহূর্তের জন্য পড় পাঁচ আলোয় ঝলসে উঠে।

নিরাপত্তা প্রহরী হাইড্রোজেনের আগুনেগোলা উধ্বমুখী উঠে পড় পাঁচের ছাদ ফুটো করে কয়েকশ ফিট উপরে উঠে যেতে দেখেনি। কিংবা সে আঁকাশ থেকে টাইটেনিয়ামের ক্ষুদ্রকণা, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের টুকরো এবং হলোগ্রাফিক স্টোরেজ ইউনিটের সিলিকনের গলিত ফোঁটা বৃষ্টির আঁকারে ঝরে পড়তে দেখেনি।

ক্যাথরিন সলোমন উত্তর অভিমুখে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময়ে তার রিয়ার ভিউ মিররে সহসা আলোর একটা ঝলক দেখতে পান। রাতের আঁকাশ বিদীর্ণ করে একটা ভারী গর্জন তাকে চমকে দেয়।

আতশবাজি? সে ভাবে। রেডস্কীনদের খেলায় বিরতির সময় কি কোন শো হয়?

সে আবার রাস্তার দিকে তাকায় এখন নিঃসঙ্গ গ্যাস স্টেশনের পেফোন থেকে করা ৯১১ ফোনকলটা নিয়ে সে ভাবছে। ক্যাথরিন সাফল্যের সাথে ডেসপ্যাচারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে এসএমএসসিতে উল্কি আঁকা এক অবাঞ্ছিতকে খুঁজতে পুলিশ পাঠান প্রয়োজন এবং ক্যাথরিন আরো প্রার্থনা করে যেন তার সহকর্মী ত্রিসকে খুঁজে পাওয়া যায়। সে ডেসপ্যাচারকে আরো বলে কালোরামা হাইটসে ড. ক্রিস্টোফার অ্যাবানের বাসায় তল্লাশি চালাতে, তার ধারণা সেখানে তার ভাইকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

দুর্ভাগ্যবশত, ক্যাথরিন রবার্ট ল্যাংডনের সেলফোনের নাম্বার আনলিস্ট থাকায় খুঁজে পায়নি। অনন্যোপায় হয়ে সে লাইব্রেরী অব কংগ্রেসের দিকে রওয়ানা হয়, শেষবার রবার্টের সাথে কথা হবার সময়ে সে বলেছিল সেদিকেই যাবে।

ড. অ্যাবাড্ডনের আতঙ্কিত করে তোলার মত সত্যিকারের পরিচয় প্রকাশ পাবার পরে সবকিছু বদলে গেছে। ক্যাথরিন বুঝতে পারছে না কাকে বিশ্বাস করবে আর কাকে করবে না। সে কেবল নিশ্চিতভাবে একটা জিনিস জানে যে এই লোকটাই বহুবছর আগে তার মা আর আদরের ভাইপোকে হত্যা করেছিল এখন সে তার ভাইকে বন্দি করে এবং তাকে খুন করতে এসেছিল। এই উন্মাদটা কে? সে চায় কি? যে উত্তরটা তার মাথায় আসে সেটার কোন মানে সে বুঝতে পারে না। একটা পিরামিড? একই রকম বিভ্রান্তিকর লোকটার আজ রাতে তার ল্যাবে আসবার বিষয়টা। সে যদি তাকে আঘাত করতে চাইতো তবে সেটা সে আজ সকালে নিজের বাসাতেই করতে পারতো। টেক্সট ম্যাসেজ পাঠিয়ে তার ল্যাবে প্রবেশের ঝক্কি পোহাতে কেন গেল সে?

অপ্রত্যাশিতভাবে তার রিয়ারভিউ মিররের আগুনটা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠে, সাথে একটা অপ্রত্যাশিত দৃশ্য- একটা কমলা রঙের গনগনে আগুনের গোলা যা ক্যাথরিন দেখে গাছের মাথা ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। আজ এসব হচ্ছেটা কি? আগুনের গোলাটার পরে ধেয়ে আসে কালো ধোয়া…আর সেটা রেডস্কীনের ফেডএক্স ফিল্ডের ধারেপাশে কোথাও না। হতবিহ্বল চিত্তে সে ভাবতে চেষ্টা করে গাছপালার ওপাশে কিসের শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে…পার্কওয়ের ঠিক দক্ষিণ পূর্ব কোণে।

তারপরেই, আগুয়ান ট্রাকের সাথে মুখোমুখি ধাক্কা খাবার মত, সে বিষয়টা বুঝতে পারে।

.

৫৫ অধ্যায়

ওয়ারেন বেল্লামি দ্রুত সেলফোনের বাটনে চাপ দেয় যে তাদের সাহায্য করতে পারবে তার সাথে আবার যোগাযোগের চেষ্টা করে, সেটা যেই হোক না কেন।

ল্যাংডন যদিও বেল্লামির দিকে আছে কিন্তু তার মনে কেবল পিটারের কথা ঘুরতে থাকে, তাকে কিভাবে খুঁজে বের করা যায় সেটা ভাবতে চেষ্টা করে। উৎকীর্ণ লিপির পাঠোদ্ধার কর, পিটারের বন্দিকর্তা তাকে আদেশ দেয়, এবং সেটা তোমাকে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদের কথা বলবে…আমরা একসাথে যাব…এবং কাঙ্খিত বিনিময় করব।

ভ্রু কুচকে ফোন নামিয়ে রাখে বেল্লামি। এখন কোন উত্তর নেই।

আমি বলছি কোন জিনিসটা আমি বুঝিনি, ল্যাংডন বলে। আমি যদি অনেক কষ্ট করে হলেও মেনে নেই যে এই গোপন জ্ঞানর অস্তিত্ব রয়েছে…এবং এই পিরামিড কোন না কোনভাবে তার ভূগর্ভস্থ অবস্থান নির্দেশ করে…আমি তাহলে কি খুঁজছি? একটা ভল্ট? একটা বাঙ্কার?

বেল্লামি কথা না বলে চুপ করে থাকে। তারপরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে মেপে মেপে কথা বলে। আমি বহু বছর ধরে যা শুনে এসেছি সেটা অনুযায়ী এই পিরামিডটা একটা প্যাচান সিঁড়ির প্রবেশ পথে আমাদের পৌঁছে দেবে।

একটা সিঁড়িরধাপ?

ঠিক বলেছো। একটা সিঁড়ি যেটা দিয়ে পৃথিবীর অভ্যন্তরে নেমে যাওয়া যায়…কয়েকশ ফিট নীচে।

ল্যাংডন যা শোনে সেটা তার বিশ্বাস হয়না। সে সামনে ঝুঁকে আসে।

আমি বলতে শুনেছি যে প্রাচীন জ্ঞান অতলে প্রোথিত আছে।

ল্যাংডন উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে শুরু করে। একটা প্যাচান সিঁড়ি মাটির গভীরে কয়েকশ ফিট নেমে গেছে…এখানে এই ওয়াশিংটন ডি.সিতে। আর সেটা এতদিন কারো চোখে পড়েনি।

বলা হয়ে থাকে প্রবেশ পথের মুখটা একটা বিশাল পাথরের খণ্ড দিয়ে চাপা দেয়া আছে।

ল্যাংডন জোরে শ্বাস ফেলে। কবরের মুখে পাথর চাপা দেয়ার ধারণা এসেছে বাইবেলে বর্ণিত যীশুর কবর থেকে। এই আদিমৌলিক হাইব্রিড তাদের সবার উত্তরপুরুষ। ওয়ারেন তুমি কি আসলেই এমন রহস্যময় একটা সিঁড়ি মাটির গভীরে নেমে গেছে বলে বিশ্বাস কর?

আমি নিজে কখনও চোখে দেখিনি কিন্তু কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ ম্যাসন দিব্যি কেটে বলে যে সেটা আছে। আমি তাদেরই একজনকে এই মুহূর্তে ফোন করার চেষ্টা করছি।

ল্যাংডনের পায়চারি অব্যাহত থাকে, সে বুঝতে পারে না এরপরে তার কি বলা উচিত।

রবার্ট এই পিরামিডটা নিয়ে তুমি আমাকে বেশ মুশকিলে ফেলে দিয়েছো। রিডিং ল্যাম্পের মৃদু আলোতে দেখা যায় ওয়ারেন বেল্লামির চোখের দৃষ্টি কঠোর হয়ে উঠেছে। আমি কোন মানুষকে সে যেটা বিশ্বাস করতে চায় না। সেটা তাকে জোর করে বিশ্বাস করাতে পারি না। এবং তারপরেও আমি আশা। করছি পিটার সলোমনের প্রতি তোমার দায়িত্ব তুমি পালন করবে।

হ্যাঁ, আমার দায়িত্ব হল তাকে সাহায্য করা, ল্যাংডন ভাবে।

আমি চাই না এই পিরামিড কোন শক্তির উন্মোচন ঘটাতে পারে সেটা তুমি বিশ্বাস কর। আমি এও চাই না সিঁড়িটা আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে সেটা নিয়ে তুমি বিব্রত হও। কিন্তু আমি এটা চাই যে তুমি বিশ্বাস কর তুমি নৈতিকভাবে এই গোপনীয়তা রক্ষার জন্য…সেটা যাই হোক, দায়বদ্ধ। বেল্লামি ইশারা করে চারকোণা ছোট প্যাকেটটা দেখায়। পিটার তোমার কাছে শিরোশোভাটা রেখেছিল কারণ সে বিশ্বাস করতো তুমি তার ইচ্ছার মূল্য দেবে এবং গোপনীয়তা বজায় রাখবে। এবং এখন তোমার সেটাই করা উচিত তাতে যদি পিটারের জীবন বিপন্ন হয় তারপরেও।

ল্যাংডন পায়চারি বন্ধ করে ঘুরে তাকায়। কি?!

বেল্লামি বসেই থাকে তার মুখে অবিচল কিন্তু বেদনাদায়ক অভিব্যক্তি ফুটে থাকে। সে এটাই আশা করে তোমার কাছে। পিটারের কথা তোমাকে ভুলে যেতে হবে। সে চলে গিয়েছে। পিটার তার কাজ করেছে, পিরামিডটা রক্ষা করতে সে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। এখন আমাদের দায়িত্ব তার এই আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায় সেটার প্রতি লক্ষ্য রাখা।

আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তুমি এই কথা বলছো! ল্যাংডন চেঁচিয়ে উঠে, স্পষ্টতই বোঝা যায় সে ক্ষেপে গিয়েছে। তুমি যা যা বলেছো এই পিরামিডটা যদি আসলেও তাই তাই হয়, পিটার তোমার ম্যালনিক গুরুভাই। তাকে রক্ষা করার জন্য তুমি সব কিছুর বিনিময়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এমনকি সেটা তোমার মাতৃভূমি হলেও!

না, রবার্ট। একজন ম্যান সবকিছুর বিনিময়ে আরেকজন মসনকে রক্ষা করবে ঠিকই…কেবল একটা ব্যাতিক্রম- মানবজাতির জন্য আমাদের ভ্রাতৃসঙ্গ যে গোপনীয়তা রক্ষা করে আসছে। হারিয়ে যাওয়া এই জ্ঞানর সম্ভাবনায়, যেটা ইতিহাসে লেখা আছে, আমি বিশ্বাস করি বা না করি, আমি শপথ নিয়েছি এটাকে ইতরজনের হাত থেকে রক্ষা করতে। আর আমি সেটা ভাঙবো না, এমনকি পিটার সলোমনের জীবনের বিনিময়েও না।

আমি অনেক ম্যাসনকে চিনি, ল্যাংডন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, যাদের ভিতরে অনেকে উচ্চ মাত্রার এবং আমি নিশ্চিত জানি এই লোকগুলো একটা পাথরের পিরামিডের জন্য নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করবে না। আর আমি এটাও জানি পাতালে নেমে যাওয়া গোপন সিঁড়ি যা গুপ্তধনের কাছে পৌঁছে দেবে এসবে তারা বিশ্বাস করে না।

রবার্ট বৃত্তের ভিতরে আরও অনেক বৃত্ত আছে। সবাই সবকিছু জানে না।

ল্যাংডন সশব্দে শ্বাস ত্যাগ করে, চেষ্টা করে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে। সে অন্যদের মতই ম্যানদের অভিজাত চক্রের ভিতরে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চক্রের অস্তিত্বের গুজব শুনেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা সত্যি কিনা তার কোন গুরুত্ব নেই। ওয়ারেন এই পিরামিড আর শিরোশোভা যদি সত্যিই ম্যাসনদের চরম সত্যটা প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে, তাহলে পিটার কেন আমাকে এর সাথে সম্পৃক্ত করলো? আমি এমনকি তার কোন আত্মীয় নই…কোন গুপ্তচক্রের সদস্য হবার প্রশ্নই উঠে না।

আমি জানি আর সম্ভবত ঠিক এই কারণেই পিটার তোমাকে নির্বাচন করেছিল এটা রক্ষা করার জন্য। অতীতে অনেকবার চেষ্টা করা হয়েছে এটা ছিনিয়ে নেবার জন্য এমনকি আমাদের ভ্রাতৃসঙ্গে অনেকে যোগ দিয়েছিল এই উদ্দেশ্যে যোগও দিয়েছিল। ভ্রাতৃসঙ্রে বাইরে কারো কাছে এটা রেখে পিটার দারুণ বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে।

তুমি কি জানতে আমার কাছে শিরোশোভাটা রয়েছে? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করে।

না। এবং পিটার যদি কথাটা অন্য কাউকে বলে থাকে সেটা কেবল একজনই হওয়া সম্ভব।

বেল্লামি তার সেলফোন বের করে রিয়াল প্রেস করে। এবং এখন পর্যন্ত আমি তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। অপরপ্রান্তে একটা ভয়েস মেলের শুভেচ্ছা বাণী শোনা যেতে সে লাইন কেটে দেয়। বেশ, রবার্ট আপাতত মনে হচ্ছে যা করার তোমাকে আর আমাকেই করতে হবে। আর সেটা হল আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ল্যাংডন তার হাতের মিকি মাউস ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত ৯:৪২ মিনিট। তুমি কি এটা বুঝতে পেরেছে যে পিটারের বন্দিকর্তা আজরাতে এই পিরামিডের পাঠোদ্ধারের এবং সেটা তাকে জানাবার জন্য অপেক্ষা করছে।

বেল্লামি ভ্রু কুচকায়। ইতিহাসের পাতায় পাতায় মহান নেতারা প্রাচীন জ্ঞান ক্ষার্থে এর চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আমি আর তুমিও সেটাই করব। সে এবার উঠে দাঁড়ায়। আমাদের এবার বেড়িয়ে পড়তে হবে। আগে বা পরে নাটো ঠিকই বুঝতে পারবে আমরা কোথায় আছি।

ক্যাথরিনের কি হবে? ল্যাংড়ন বসে থেকে জানতে চায়, তার যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। ফোনে আমি তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না আর সেও ফোন করেনি।

নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে।

কিন্তু আমরা তাকে এভাবে ফেলে যেতে পারি না।

ক্যাথরিনের কথা ভুলে যাও! বেল্লামির কণ্ঠে এবার আদেশের দৃঢ়তা। পিটারকে ভুলে যাও! সবাইকে ভুলে যাও! রবার্ট তুমি কি এখনও বুঝতে পারছো না আমাদের সবার চেয়ে বড় একটা দায়িত্ব তোমার উপরে অর্পন করা হয়েছে-তুমি, পিটার, ক্যাথরিন, আমি? সে ল্যাংডনের চোখের দিকে তাকায়। আমাদের একটা নিরাপদ স্থান খুঁজে বের করতে হবে যেখানে এই পিরামিড আর শিরোশোভাটা তাদের নাগালের বাইরে লুকিয়ে রাখতে–

গ্রেট হলের দিক থেকে একটা প্রকট ধাতব শব্দ ভেসে আসে।

বেল্লামি ঘুরে তাকায় তার চোখে ভয়ের ছায়া। অনেক তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে।

ল্যাংডন দরজার দিকে তাকায়। টানেলের দরজা বন্ধ করতে বেন্নামি যে ধাতব বালতি ব্যবহার করেছিল সম্ভবত সেটারই শব্দ। তারা আমাদের খুঁজতে আসছে।

তারপর একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে উৎকট শব্দটার প্রতিধ্বনি হয় আবার।

এবং আবার।

তারপরে আবার।

.

লাইব্রেরী অব কংগ্রেসের সামনের বেঞ্চে শুয়ে থাকা গৃহহীন লোকটা তার চোখ কচলায় এবং চোখের সামনে ঘটতে থাকা অদ্ভুত দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

একটা সাদা ভলভো কার্বের উপর দিয়ে লাফিয়ে উঠে জনমানবহীন ফুটপাথের উপর দিয়ে দাবড়ে যায় এবং লাইব্রেরীর প্রধান ফটকের সামনে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ করে থেমে দাঁড়িয়ে পড়ে। কালো চুলের আকর্ষণীয় চেহারার একটা মেয়ে দ্রুত ভেতর থেকে বের হয়ে স্ত্রস্ত চোখে চারপাশে তাকায় এবং গৃহহীন লোকটাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে, তোমার কাছে সেলফোন আছে?

মেয়ে আমার বাম পায়ে জুতাই নেই।

আপাতভাবে সেটা বুঝতে পেরে, মেয়েটা লাইব্রেরীর সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে যায়। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে সে হাতল ধরে একে একে তিনটা অতিকায় দরজার সব কটাই খুলতে চেষ্টা করে।

মেয়ে, লাইব্রেরী বন্ধ হয়ে গেছে।

কিন্তু মেয়েটা ব্যাপারটাকে পাত্তাই দেয় না। সে ঢাউস বৃত্তাকার কড়া ধরে টানে পেছনে এনে সজোরে সশব্দে দরজার উপরে ছুঁড়ে মারে। তারপরে আবার। এবং আরেকবার। আরো একবার।

ওয়াও, গৃহহীন লোকটা ভাবে, মেয়েটার দেখছি বইটা খুবই দরকার।

.

৫৬ অধ্যায়

ক্যাথরিন সলোমন যখন শেষ পর্যন্ত গ্রন্থাগারের বিশাল ব্রোঞ্জের দরজা তার সামনে খুলে যেতে দেখে, তার মনে হয় সে বোধহয় কেঁদেই ফেলবে। আজ রাতের সব ভয় আর বিভ্রান্তি যা এতক্ষণ চাপা ছিল সব একসাথে বেরিয়ে আসতে চায়।

লাইব্রেরীর দরজায় যে লোকটা এসে দাঁড়ায় তিনি ওয়ারেন বেল্লামি, তার ভাইয়ের বিশ্বাসভাজন এবং বন্ধু। কিন্তু তার পেছনে ছায়ায় সে যাকে দাঁড়িয়ে। থাকতে দেখে তাকে দেখেই সে সবচেয়ে বেশি খুশী হয়। অনুভূতিটা আপাতভাবে উভয়দিকে একই। রবার্ট লাঙ্গডনের চোখে স্বস্তির বৃষ্টি নামে তাকে দরজা দিয়ে দৌড়ে ভিতরে ঢুকতে দেখে,,, সে সোজা গিয়ে তার বাহুতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

পুরানো বন্ধুর উষ্ণ আলিঙ্গনে ক্যাথরিন নিজেকে ডুবিয়ে দিতে, ওয়ারেন বেল্লামি সামনের দরজা আবার বন্ধ করে দেন। সে শুনতে পায় ভারী লকটা ক্লিক শব্দে নির্ভরতায় আটকে যায়, এবং শেষ পর্যন্ত সে নিজেকে নিরাপদ মনে করে। অপ্রত্যাশিতভাবে তার চোখ পানিতে ভরে উঠতে চাইলে সে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায়।

ল্যাংডন তাকে শক্ত করে ধরে থাকে। সব ঠিক আছে, সে ফিসফিস করে বলে। তুমি ঠিক আছো।

কারণ তুমি আমাকে বাচিয়েছে, ক্যাথরিন তাকে বলতে চায়। সে আমার ল্যাব পুড়িয়ে দিয়েছে…আমার সব কাজ নষ্ট হয়ে গেছে। বহু বছরের গবেষণা…সব ধোয়া হয়ে আকাশে উবে গেছে। সে তাকে সবকিছু খুলে বলতে চায়, কিন্তু সে ঠিকমত শ্বাস নিতেই পারে না।

আমরা পিটারকে ঠিকই খুঁজে বের করবো। ল্যাংডনের ভারী কণ্ঠস্বর বুকে স্পন্দিত হয়ে তাকে আজব একটা স্বস্তি দেয়। আমি কথা দিচ্ছি।

আমি জানি এসব কে করছে! ক্যাথরিন চিৎকার করে বলতে চায়। এই একই লোক আমার মা আর আদরের ভাইপোকে খুন করেছে। কিন্তু সে নিজের কথা বলার আগে লাইব্রেরীর নিরবতা একটা অপ্রত্যাশিত শব্দের আক্রমণে ভেঙে যায়।

তাদের নীচে সিঁড়ির প্রবেশকক্ষ থেকে একটা ভারী কিছু পতনের শব্দ ভেসে আসেটাইলসের মেঝেতে বিশাল ধাতব কিছু একটার পতনের শব্দের মত। ক্যাথরিন টের পায় ল্যাংডনের হাতের পেশী নিমেষে আড়ষ্ঠ হয়ে উঠে।

বেল্লামি সামনে এগিয়ে যায়, তার চোখে মুখে ভীষণ ভয়াবহ অভিব্যক্তি। আমরা এখান থেকে যাচ্ছি। এখনই। ( হতবিহ্বল ক্যাথরিন গ্রেট হলের উপর দিয়ে স্থপতি আর ল্যাংডনের পিছু পিছু দ্রুত লাইব্রেরীর বিখ্যাত রিডিং রুমের দিকে এগিয়ে যায়, যা আলোতে ঝলমল করছে। বেন্নামি দ্রুত তাদের পেছনে দুজোড়া দরজা বন্ধ করে দেয় প্রথমে বাইরেরটা পরে ভেতরেরটা।

ক্যাথরিন একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটতে থাকে বেল্লামি যখন তাদের প্রায়। তাড়িয়ে কামরার ঠিক মধ্যখানে নিয়ে আসে। তারা তিনজন একসাথে একটা রিডিং ডেস্কের কাছে আসে যেখানে একটা চামড়া ব্যাগ আলোর ঠিক নীচে রাখা আছে। ব্যাগের পাশে পড়ে আছে একটা ছোট চারকোনা প্যাকেট যা বেল্লামি ছো মেরে তুলে নিয়ে ব্যাগের ভিতরে ঢুকিয়ে রাখে, একটা ক্যাথরিনের ঘোর কেটে যায় সে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা পিরামিড?

সে যদিও আগে কখনও এই লিপি উৎকীর্ণ পিরামিডটা দেখেনি, তার পুরো দেহ জিনিসটা চিনতে পেরে গুটিয়ে যায়। কিভাবে যেন তার সহজাত প্রবৃত্তি সত্যটা বুঝতে পারে। ক্যাথরিন সলোমন এই মাত্র সেই জিনিসটার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে যা তার জীবনটা ছারখার করে দিয়েছে। সেই পিরামিড।

বেল্লামি চেন বন্ধ করে ব্যাগটা ল্যাংডনের হাতে দেয়। জিনিসটা সবসময়ে চোখে চোখে রাখবে।

একটা বিস্ফোরণে সহসা কামরার বাইরের দরজা কাপিয়ে দেয়। ভাঙা কাঁচ ঝনঝন শব্দে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

এই দিকে! বেল্লামি ঘুরে তাকায় তাকে ভীত দেখায় সে তাদের সেন্ট্রাল সার্কুলেশন ডেস্কের কাছে নিয়ে আসে-একটা বিশাল অষ্টভূজাকৃতি ক্যাবিনেট ঘিরে আটটা কাউন্টার। সে তাদের কাউন্টারের পেছনে নিয়ে আসে এবং তারপরে ক্যাবিনেটের একটা খোলা স্থান দেখায়। জলদি ভেতরে ঢুকে পড়!

এর ভেতরে? ল্যাংডন জানতে চায়। তারা সহজেই এখানে আমাদের খুঁজে পাবে!

ভরসা রাখো, বেল্লামি বলে। তুমি যা ভাবছ এটা তা নয়।

.

৫৭ অধ্যায়

মাল’আখ তার লিমোজিন উত্তর দিকে কালোরামা হাইটসের উদ্দেশ্যে বুলেটের মত ছোটায়। ক্যাথরিনের ল্যাবের বিস্ফোরণ সে যা আশা করেছিল তারচেয়েও ভয়ঙ্কর হয়েছে এবং কপালগুনে সে প্রাণে বেঁচে গেছে। এতে অবশ্য একটা সুবিধা হয়েছে হট্টগোলের ভিতরে সে তার গাড়িটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে গেটে টেলিফোনে জোরে কথা বলতে ব্যাস্ত একমাত্র নিরাপত্তা প্রহরীকে এড়িয়ে লিমোজিন বাইরে নিয়ে আসে।

আমাকে যত দ্রুত সম্ভব রাস্তা থেকে সরে পড়তে হবে, সে ভাবে। ক্যাথরিন যদি এতক্ষণে পুলিশকে ফোন নাও করে থাকে, বিস্ফোরণ নিশ্চিতভাবেই তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করবে। আর খালি গায়ে একটা লোক লিমোজিন চালাচ্ছে। সেটা কারো না কারো দৃষ্টি ঠিকই আকর্ষণ করবে।

এইসব কিছু যে রাতে শুরু হয়েছিল, তখন তার নাম মাল’আখ ছিল না। বস্তুতপক্ষে, যে রাতে এটা শুরু হয় তখন তার কোন নামই ছিল না। কয়েদি নাম্বার ৩৭। ইস্তাম্বুলের বাইরে নির্মম সোগানলিক কারাগারের অন্যসব। কয়েদিদের মত কয়েদি নাম্বার ৩৭ কেও মাদকের কারণে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল।

সিমেন্টের সেলে নিজের বাঙ্কে সে শুয়ে ছিল, ক্ষুধার্ত আর অন্ধকারের শীতলতার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো আর কতদিন তাকে এখানে বন্দি থাকতে। হবে। তার নতুন সেলমেট যার সাথে মাত্র চব্বিশ ঘন্টা আগে তার পরিচয় হয়েছে, উপরের বাঙ্কে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। কারাগারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পাড় মদ্যপ যে নিজের চাকরিটা প্রচণ্ড ঘৃণা করে আর তার রেশ মিটায় বন্দিদের নির্যাতন করে এই মাত্র রাতের জন্য সব আলো নিভিয়ে দিয়েছে।

রাত প্রায় দশটার দিকে কয়েদী নম্বর ৩৭ ভেন্টিলেশন শ্যাফট দিয়ে কথোপকথনের শব্দ ভেসে আসতে শুনে। প্রথম কণ্ঠস্বরটা পরিষ্কার কোনমতেই ভুল হবার নয়- কারাগারের প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাটা কাটা, যুদ্ধংদেহী বাচনভঙ্গি যে স্পষ্টতই গভীর রাতে আগত অতিথির কারণে অসন্তুষ্ট।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেক দূর থেকে আপনি এসেছেন, সে বলছে, কিন্তু প্রথম মাসে আমরা কোন দশনার্থীকে অনুমতি দেই না। রাষ্ট্রীয় আইন। কোন

ব্যাতিক্রম সম্ভব নয়।

প্রত্যুত্তরে যে কণ্ঠটা শোনা যায় সেটা নম্র, মার্জিত আর বেদনাক্লিষ্ট। আমার ছেলে কি নিরাপদে আছে?

সে একজন মাদকাসক্ত।

তার সাথে কি ভাল ব্যবহার করা হয়েছে?

যথেষ্ট ভাল, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলে। তবে এটা কোন হোটেল না।

একটা যন্ত্রণাসিক্ত নিরবতা। আপনি বুঝতে পারছেন ইউএস ডিপার্টমেন্ট প্রত্যাপণের জন্য অনুরোধ করবে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটা তারা সবসময়ে করে। অনুমতি পেতে অসুবিধা হবে না, যদিও কাগজপত্র তৈরী হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে…একমাসও লাগতে পারে…নির্ভর করছে।

নির্ভর করছে কিসের উপরে?

বেশ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলে, আমাদের এখানে লোকবল কম। সে চুপ করে। অবশ্য মাঝে মাঝে আপনাদের মত আগ্রহী ব্যক্তিরা, কারাগারের

স্টাফরা যাতে দ্রুত কাজ করে সেজন্য সামান্য ডোনেশন দিয়ে থাকেন।

দশনার্থী কোন উত্তর দেয় না।

মি. সলোমন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা নীচু স্বরে কথা চালিয়ে যায়, আপনার মত মানুষ টাকা যার কাছে কোন বিষয় না, তার জন্য অনেক পথই খোলা আছে। সরকারে আমার চেনা লোক আছে। আমি আর আপনি যদি একসাথে চেষ্টা করি তবে আপনার ছেলেকে আমরা এখান থেকে আগামীকাল নাগাদ…বের করতে সক্ষম হব, তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ খারিজ করে দেয়া হবে। দেশেও তাকে আইনের সম্মুখীন হতে হবে না।

উত্তরটা সাথে সাথে শোনা যায়। আপনার পরামর্শের আইনী দিকগুলো ভুলে গিয়ে, টাকা সব সমস্যার সমাধান করে বা জীবনে জবাবদিহিতার কোন স্থান নেই বিশেষ করে এমন গুরুতর বিষয়ে, এটা আমি আমার ছেলেকে শেখাতে চাই না।

আপনি তাকে এখানে রেখে যেতে চান?

আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। আর সেটা এখনই।

আমি আগেই বলেছি, আমাদের আইনকানুন আছে। আপনার ছেলের সাথে। আপনার দেখা হবে না…যদি না আপনি তার আশু মুক্তির জন্য সমঝোতায় না আসেন।

একটা শীতল নিরবতা কিছুক্ষণ বজায় থাকে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট আপনার সাথে কথা বলবে। জ্যাকারিয়া যেন নিরাপদে থাকে। এই সপ্তাহের ভিতরে আমি। চাই আমেরিকাগামী একটা উড়োজাহাজে তাকে উঠিয়ে দেয়া হোক। শুভরাত্রি।

দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে যায়।

কয়েদি নাম্বার ৩৭ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। এটা কেমন বাবা যে নিজের ছেলেকে এমন একটা নরকে ফেলে রেখে যায় তাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য? পিটার সলোমন এমনকি জ্যাকারিয়ার রেকর্ড পরিষ্কার করার সুযোগও প্রত্যাখান করেছেন।

সেইদিনই গভীর রাতে, নিজের বাঙ্কে শুয়ে শুয়ে কয়েদি নাম্বার ৩৭ অনুধাবন করে সে নিজেকে কিভাবে এখান থেকে মুক্ত করবে। একজন। কয়েদিকে যদি টাকাই মুক্তির বরাভয় থেকে আলাদা করে রাখে, তবে কয়েদি নাম্বার ৩৭ বলা যায় মুক্তিলাভ করেছে। পিটার সলোমন হয়ত টাকা খরচ করতে রাজি নয় কিন্তু ট্যাবলয়েড পড়ে এমন যে কেউ জানে তার ছেলে জাকারিয়াও বিপুল অর্থের মালিক। পরের দিন কয়েদি প্রশাসনিক কর্মকর্তার সাথে নিভৃতে আলাপ করে নিজের পরিকল্পনার কথা বলে একটা সাহসী, চৌকষ পরিকল্পনা যা তাদের দুজনকেই কাঙ্খিত বস্তুর অধিকারী করবে।

জ্যাকারিয়া সলোমনকে মরতে হবে পরিকল্পনা সফল করতে হলে, কয়েদি নাম্বার ৩৭ বলে। কিন্তু আমাদের দুজনকেই সাথে সাথে হারিয়ে যেতে হবে। তুমি গ্রীক আইল্যাণ্ডে চলে যাবে। এই জায়গায় তুমি আর কখনও ফিরে আসবে না।

আরও কিছুক্ষণ আলাপ করার পরে দুজনে হাত মিলায়।

জ্যাকারিয়া সলোমন শীঘ্রই মারা যাবে, কয়েদি নাম্বার ৩৭ ভাবে, ব্যাপারটা কত সহজ চিন্তা করতেই তার হাসি পায়।

দুই দিন পরে স্টেট ডিপার্টমেন্ট ভয়ঙ্কর খবরটা সলোমন পরিবারকে জানায়। জেলখানায় তোলা ছবিতে দেখা যায় বেধড়ক মার খেয়ে তাদের ছেলে প্রাণহীন দেহটা কুকড়ে তার সেলে পড়ে আছে। তার মাথাটা একটা লোহার রড দিয়ে মেরে থেতলে দেয়া হয়েছে আর তার বাকী দেহে এমন আঘাত আর ধ্বস্ত ধ্বিস্তির চিহ্ন যা কোন মানুষের পক্ষে চিন্তা করাটাই অকল্পনীয়। তাকে দেখে মনে হয় নির্যাতন করার পরে তাকে হত্যা করা হয়েছে। কারাগারের প্রশাসনিক কর্মকর্তাকেই প্রধানত সন্দেহ করা হয় যে সম্ভবত মৃত ছেলেটার সমস্ত টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে। জ্যাকারিয়া কাগজে সই করে তার বিপুল সম্পদ একটা নম্বরযুক্ত একাউন্টে ট্রান্সফার করেছে যা তার মৃত্যুর পরপরই খালি করে ফেলা হয়েছে। কারও পক্ষে বলা সম্ভব না টাকাটা এখন কোথায় আছে।

পিটার সলোমন একটা ব্যক্তিগত বিমানে তুরস্ক থেকে তাদের ছেলের কফিন নিয়ে আসেন, যা সলোমনদের পারিবারিক করবস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। কারাগারের প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাকে পাওয়াও যাবে না, কয়েদি নাম্বার ৩৭ সেটা ভাল করেই জানে। মারমারা সাগরের তলদেশে নাদুসনুদুস তূর্কীর দেহটা এখন চিরতরে ঘুমিয়ে আছে, বসফরাস প্রণালী থেকে অভিবাসনে আগত নীল রঙের ম্যান্না কাকড়ার খাদ্যে সে পরিণত হয়েছে। জ্যাকারিয়া সলোমনের বিপুল সম্পত্তি একটা আনট্রেসেবল নাম্বারড একাউন্টে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কয়েদি নাম্বার ৩৭ আবার একজন মুক্ত। মানুষ-বিপুল বৈভবের অধিকারী একজন মুক্ত মানুষ।

গ্রীক দ্বীপগুলো অনেকটা স্বর্গের মত। আলো। পানি আর মেয়েমানুষ।

টাকায় হয়না এমন কিছু পৃথিবীতে নেই-নতুন পরিচয়, নতুন পাসপোর্ট, নতুন আশা। সে একটা গ্রীক নাম পছন্দ করে- এঞিয়স দারিয়ুস- এস মানে যোদ্ধা আর দারিয়ুস মানে বিত্তশালী। কারাগারের অন্ধকার রাতগুলোকে সে ভয় পায় আর শপথ নেয় যে কখনও সেখানে ফিরে যাবে না। সে তার মাথার ঝাকড়া চুল কেটে ফেলে আর মাদকের দুনিয়াকে বিদায় জানায়। সে জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করে- আগে-কখনও-কল্পনা করেনি এমন ইন্দ্রিয়সুখে গা ভাসিয়ে দেয়। ইজিয়ান সাগরের গাঢ় নীল জলে একাকী নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ানটাই তার নতুন হেরোইনের আচ্ছন্নতায় পরিণত হয়; শিক থেকে সরাসরি রসাল আর্ণি সৌউভলাকিয়া চুষে খাওয়াটা তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরমানন্দে পরিণত হয়; আর মাইকোসের ফেনা পূর্ণ গিরিসঙ্কটের উপরের চূড়া থেকে লাফ দেয়া তার নতুন কোকেন।

আমার পূর্ণর্জন্ম হয়েছে।

সিরস দ্বীপে এণ্ডিয়স একটা বিশাল ভিলা কেনে এবং পসিডোনিয়ার এক্সকুসিভ শহরের বেলা জেনটের মাঝে বসবাস শুরু করে। এই নতুন পৃথিবীর লোকজন কেবল বড়লোকই নয় সংস্কৃতির আর দৈহিক সুষমায় পরিপূর্ণ। তার প্রতিবেশীরা নিজেদের শরীর আর মন নিয়ে গর্ব করে আর দেখা যায় জিনিসটা সংক্রামক। নতুন প্রতিবেশী সহসা নিজেকে বেলাভূমিতে জগিং করছে দেখতে পায়, সূর্যের আলোয় নিজের ধুসর চামড়া ঝলসে নেয় আর পুস্তক পাঠে মনোনিবেশ করে। এয়স হোমারের ওডিসি পড়ে, এইসব দ্বীপে যুদ্ধরত ব্রোঞ্জের শক্তিশালী মানুষেরা যুদ্ধ করছে এই বিষয়টা তাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলে। পরের দিনই, সে ওজন তোলা শুরু করে এবং তার বুক আর হাতের পেশী দ্রুত ফুলে উঠতে সে বিস্মিত চোখে সেদিকে তাকায়। ক্রমশ, মেয়েদের দৃষ্টি সে নিজের উপরে অনুভব করতে শুরু করে, আর এই মুগ্ধতা তাকে মাতাল করে তোলে। আরো শক্তিশালী হবার আঁকাঙ্খ তখনও তার ভিতরে জাগ্রত থাকে। এবং সে তাই করে। কালোবাজার থেকে কেনা গ্রোথ হরমোনের সাথে অতিরিক্ত মাত্রায় স্টেরয়েড সাথে অবিশ্রান্ত ওয়েট লিফটিং এর সাহায্যে, এয়িস নিজেকে এমন একটা কিছুতে পরিণত করে যা সে কখনও হতে পারে বলে কল্পনাও করেনি- এক নিখুঁত পুরুষ নিদর্শন। সে ওজন আর পেশীর বিন্যাস দুটোই বাড়াতে থাকে, ত্রুটিহীন বক্ষপেশী এবং অতিকায় পেষল পা যা সে যথাযথ ট্যান করে রাখে।

সবাই এখন তাকাতে শুরু করেছে।

এয়িসকে আগেই সাবধান করা হয়েছিল, স্টেরয়েড আর গ্রোথ হরমোনের অতিরিক্ত মাত্রা তার স্বরযন্ত্র প্রভাবিত করে তার কণ্ঠস্বর রহস্যময়, ফ্যাসফেসে গুঞ্জনে পরিণত করে যা তার রহস্যময়তা আরো বাড়িয়ে তোলে। তার কোমল, হেয়ালিপূর্ণ কণ্ঠস্বর, সাথে তার বিত্ত, নতুন শরীর এবং অতীত সম্পর্কে কথা বলতে রাজি না হবার ব্যাপারটা সবকিছু মিলিয়ে মেয়েদের কাছে তার আকর্ষণ

অদম্য করে তোলে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই সে তার কাছে ধরা দেয় আর সেও তাদের প্রত্যেককে সন্তুষ্ট করে- তার দ্বীপে ফটো সেশনে আসা মডেল থেকে শুরু করে ছুটি কাটাতে আসা কলেজের কিশোরী থেকে প্রতিবেশীর নিঃসঙ্গ স্ত্রী, আর মাঝে মাঝে রুচি বদলাতে তরুণ যুবক। তারা এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করতে পারে না।

আমি একটা শিল্পবস্তু।

বছর গড়াবার সাথে সাথে এণ্ডিয়সের ভোগ লালসা তার আঁকৰ্ষণ হারাতে শুরু করে। অন্য সবকিছুর মতই। দ্বীপের মুখরোচক খাদ্যের স্বাদ বিস্বাদ হয়ে উঠে, বই পড়তেও আজকাল আর তার ভাল লাগে না, এমনকি তার ভিলা থেকে দৃশ্যমান দারুণ সূর্যাস্তও শেষ পর্যন্ত মলিন লাগে। এটা কিভাবে সম্ভব? তার বয়স এখনও ত্রিশের কোঠায় কিন্তু এরই ভিতরে তার নিজেকে প্রৌঢ় মনে হয়। জীবনে আর কি আছে? সে তার শরীরকে একটা শিল্পবস্তুতে পরিণত করেছে; সে নিজেকে শিক্ষিত করেছে এবং মনকে সমৃদ্ধ করেছে সংস্কৃতির চর্চা করে; নিজের বাসাকে পরিণত করেছে স্বর্গে এবং সে তার কাঙ্খিত যেকোন মেয়ের ভালবাসা চাইলেই পাবে।

এবং এতকিছুর পরেও অবিশ্বাস্যভাবে তার নিজেকে রিক্ত মনে হয় তুরস্কের কারাগারে সময় কাটাবার কালে যেমন মনে হত।

আমি কি থেকে বঞ্চিত হচ্ছি?

উত্তরটা সে কয়েক মাস পরে খুঁজে পায়। সেদিন এঞিয়স তার ভিলায় একাকী বসে ছিল, রাতের বেলা উদ্দেশ্যহীনভাবে চ্যানেল সার্ফ করতে করতে সে ফ্রিম্যাসনদের সম্পর্কে একটা অনুষ্ঠান কোন একটা চ্যানেলে খুঁজে পায়। অনুষ্ঠানটার মান যাচ্ছেতাই রকমের, উত্তরের চেয়ে উপস্থাপক প্রশ্নই বেশি করে এবং তারপরেও সে এই ভ্রাতৃসঙ্ঘকে ঘিরে গড়ে ওঠা কন্সপিরেসী থিওরির আতিশয্য দেখে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠে। ধারাবর্ণনাকারী একটার পর একটা কিংবদন্তি বর্ণনা করে যায়।

ফ্রিম্যাসন আর নতুন বিশ্ব ধারা…

দি গ্রেট ম্যাসনিক সীল অব দি ইউনাইটেড স্টেটস…

দি পি টু ম্যাসনিক লজ…

ফ্রিম্যাসনারীদের হারিয়ে যাওয়া রহস্য…

দি ম্যাসনিক পিরামিড. ..

এণ্ডিয়স চমকে সোজা হয়ে বসে। পিরামিড। বর্ণনাকারী একটা রহস্যময় পাথরের পিরামিডের গল্প বলে যার গায়ে উৎকীর্ণ লিপি হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান আর অমিত শক্তির সন্ধান দিতে পারে। গল্পটা দৃশ্যত অবিশ্বাস্য, তার ভিতরে একটা অতীত স্মৃতির রেশ জাগিয়ে তুলে…অন্ধকার সময়ের ততোধিক ধুসর একটা স্মৃতি। এ্যায়িসের মনে পড়ে জ্যাকারিয়া সোমন তার বাবার কাছ থেকে রহস্যময় পিরামিড সম্পর্কে কি শুনেছিল।

২৪)

এটাই কি সেটা? এণ্ডিয়স আর কিছু মনে করতে চেষ্টা করে।

অনুষ্ঠান যখন শেষ হয়, সে ব্যালকনিতে গিয়ে বাইরের শীতল বাতাসে মাথাটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে। তার এখন আরো কিছু মনে পড়ে এবং সব কিছু মনে পড়ার পরে তার কেবলই মনে হয় এই কিংবদন্তিটা সত্যি হলেও হতে পারে। আর তাই যদি হয়, সলোমন জ্যাকারিয়া অনেক আগেই যে মারা গেছে- এখনও তার কাজে আসতে পারে।

আমার হারাবার কি আছে?

তিন সপ্তাহ পরে, খুব যত্ন নিয়ে সময় ঠিক করে, সলোমনদের পটোম্যাক এস্টেটের নাটমঞ্চের বাইরের হাঁড়কাঁপান ঠাণ্ডায় এণ্ডিয়স এসে দাঁড়ায়। জানালার কাঁচের ভিতর দিয়ে সে ভেতরে পিটার সলোমনকে বোন ক্যাথরিনের সাথে গল্প করতে দেখ। দেখে মনে হচ্ছে জ্যাকারিয়াকে তারা খুব সহজেই ভুলতে পেরেছে, সে ভাবে।

মুখের উপরে স্কিমাস্কটা টেনে দেবার আগে বহুদিন পরে সে আবার একটিপ কোকেন নেয়। পুরোনো সেই নির্ভয় অনুভূতি আবার নিজের মধ্যে অনুভব করে। একটা পিস্তল হাতে নিয়ে, পুরোনো একটা চাবি দিয়ে সে দরজা খুলে এবং ভেতরে প্রবেশ করে। হ্যালো, সলোমনস।

সেই রাতটা অবশ্য দুর্ভাগ্যবশত এ্যাণ্ডিয়সের অনুকূলে ছিল না। যে পিরামিডের জন্য সে এসেছিল সেটাতো সে পায়ই না বরং পাখি মারার ছররায় ছারখার হয়ে নিজেকে তুষারাবৃত বনের ভিতর দিয়ে প্রাণ ভয়ে দৌড়াতে আবিষ্কার করে। সে অবাক হয়ে দেখে পিস্তল হাতে পিটার সলোমন বনের মাঝে তাকে তাড়া করছে। বনের মধ্যে দিয়ে অন্ধের মত একটা ট্রেইল ধরে দৌড়ে সে একটা গিরিসঙ্কটের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়। অনেক নীচ থেকে জলপ্রপাতের শব্দ শীতের তাজা বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। সে ওক গাছের একটা সারি অতিক্রম করে বামে ঘুরে। নিমেষ পরেই সে বরফের উপরে কোন মতে পিছলে থামে, অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়েছে।

হা ঈশ্বর!

তার থেকে মাত্র একফুট দূরে, পথটা শেষ হয়েছে, এবং তারপরেই সোজা নীচের বরফ শীতল পানিতে নেমে গিয়েছে। পথের ধারে বিশাল পাথরে এক বালকের অপটু হাতে খোদাই করে লেখা রয়েছে:

Zah’s b Ridge

গিরিসঙ্কটের অপর পাশে পথটা আবার সামনে এগিয়ে গেছে। মরার ব্রীজটা কোথায়?! কোকেনের প্রভাব শেষ হয়েছে। আমি ফাঁদে পড়েছি। আতঙ্কে সে ঘুরে উল্টো দিকে দৌড়াতে গিয়ে দেখে সেখানে পিটার সলোমন দাঁড়িয়ে রয়েছে, হাতের পিস্তল তার দিকে তাক করা।

পিস্তলের দিকে তাকিয়ে এণ্ডিয়স একপা পেছনে আসে। তার পেছনে নিদেন পক্ষে পঞ্চাশ ফিট নীচে নদীটা প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর উজান থেকে ভেসে আসা কুয়াশা তাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে, ঠাণ্ডায় হাড় পর্যন্ত কাপিয়ে দিচ্ছে।

জ্যাকের ব্রীজটা অনেক আগেই পচে গিয়েছে, হাফাতে হাফাতে সে বলে। সেই কেবল এতদূর পর্যন্ত বেড়াতে আসত। পিটারের হাতের পিস্তল চোখে পড়ার মত নিষ্কম্প। আমার ছেলেকে তুমি কেন খুন করেছিলে?।

সে একটা অপদার্থ ছিল, এণ্ডিয়স উত্তর দেয়। মাদকাসক্ত। আমি তার উপকারই করেছি।

সলোমন আরো কাছে এগিয়ে আসে পিস্তলটা সরাসরি তার বুক বরাবর নিশানা করা। আমার হয়ত তোমাকে উপকারটা ফেরত দেয়া উচিত। তার কণ্ঠস্বরে বিস্ময়কর হিংস্রতা। তুমি আমার ছেলেকে গড়া দিয়ে পিটিয়ে মেরেছো। একজন কিভাবে অপরকে এভাবে হত্যা করে?

কোণঠাসা হয়ে পড়লে মানুষের পক্ষে অচিন্তনীয় কাজ করা সম্ভব।

তুমি আমার ছেলেকে খুন করেছে!

না, এবার এণ্ডিয়স ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে। তুমিই তোমার ছেলের হত্যাকারী। কেমন মানুষ সে যে তার ছেলেকে জেলখানায় ফেলে রেখে আসে যেখানে তাকে মুক্ত করা সম্ভব ছিল! তুমিই তোমার ছেলেকে হত্যা করেছে। আমি নই!

তুমি কিছুই জানো না! সলোমনের কণ্ঠস্বর যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট।

তুমি ভুল করছো, এণ্ডিয়স ভাবে। আমি সব কিছু জানি।

পিটার সলোমন আরো কাছে এগিয়ে আসে, এখন তাদের ভিতরে পাঁচ ফুট দূরত্ব, পিস্তল আগের মতই তাক করা। এ্যায়িসের বুক জ্বলে যায় এবং সে বুঝতে পারে রক্তপাত হচ্ছে। উষ্ণতাটা তার পাকস্থলীর উপর দিয়ে গড়িয়ে যায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে নীচের দূরত্বটা মাপে। সে সলোমনের দিকে শেষবারের মত তাকায়। তুমি যতটা মনে কর আমি তোমার সম্পর্কে তারচেয়েও বেশি। জানি, সে ফিসফিস করে বলে। আমি জানি যারা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে তুমি তাদের একজন নও।

সলোমন আরো কাছে এগিয়ে আসে, মৃত্যুদায়ী নিশানা স্থির করে।

আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, এণ্ডিয়স বলে, তুমি যদি ট্রিগারে চাপ দাও, আমি তোমাকে সারা জীবন তাড়া করবো।

তুমি এখনই তাই করছে, সলোমন কথাটা বলেই ট্রিগারে চাপ দেয়।

.

কালোরামা হাইটসের দিকে নিজের কালো লিমোজিনটা নিয়ে ফিরে আসবার সময়ে, আজকাল যে নিজেকে মাল’আখ বলে পরিচয় দেয় বরফাবৃত গিরিসঙ্কটের উপরে ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনা যা তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল মনে করে। সে চিরতরে বদলে যায়। পিস্তলের আওয়াজ নিমেষ পরেই মিলিয়ে গিয়েছিল কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া দশ বছর পরে আজও অনুভূত হয়। তার দেহ যা একটা সময়ে তামাটে আর নিখুঁত ছিল, আজ সেই রাতের ক্ষতে আচ্ছন্ন…তার নতুন পরিচয়ের উল্কি আঁকা প্রতাঁকের নীচে সে সেই ক্ষতচিহ্ন লুকিয়ে রেখেছে।

আমি মাল’আখ।

আগাগোড়া এটাই ছিল আমার নিয়তি।

সে আগুনের ভিতর দিয়ে হেঁটে গিয়েছে, ভস্মে পরিণত হয়ে তারপরে আবার জেগে উঠেছে…আরো একটা রূপান্তরিত হয়েছে। আজরাতই তার দীর্ঘ আর চমকপ্রদ যাত্রার শেষ পর্যায়।

.

৫৮ অধ্যায়

স্পেশ্যাল ফোর্সের দ্বারা বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত এই বিস্ফোরক বন্ধ দরজা ন্যনতম সহগামী ক্ষতি স্বীকার করে ভোলার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে যার নাম বিনয় করে রাখা হয়েছে কি-চার। মূলত সাইক্লোট্রিমিথাইলিনিট্রিনাইট্রামাইনের সাথে ডাইইথাইলিক্সিল প্লাস্টিসাইজার দ্বারা প্রস্তুতকৃত, এটা আসলে পাতলা কাগজে মোড়ান এক টুকরো সি-৪ দরজার বাজুতে ঢুকাবার সন্নিবিষ্ট করার জন্য। লাইব্রেরীর দরজার ক্ষেত্রে বিস্ফোরকটা দারুণ কাজ দেখায়।

অপারেশন দলনেতা এজেন্ট টার্নার সিমকিনস দরজার ধ্বংসস্তূপ টপকে ভেতরে প্রবেশ করে বিশার অষ্টভূজাকৃতি কামরাটায় তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় কোন নড়াচড়া চোখে পড়ে কিনা দেখতে। সব শান্ত।

আলো নিভিয়ে দাও, সিমকিনস বলে।

দ্বিতীয় এক এজেন্ট ওয়াল প্যানেল খুঁজে বের করে একঝাক সুইচ বন্ধ করতে পুরো ঘরে অন্ধকারের চাঁদর নেমে আসে। একসাথে চারজনই হাত তুলে নাইটভিশন গগলস নিজেদের চোখের উপরে এডজাস্ট করে। তারা নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে, পুরো ঘরটা তন্নতন্ন করে দেখে, যা এখন তাদের গগলসের ভিতর সবুজ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে।

দৃশ্যপট অপরিবর্তিত থাকে।

অন্ধকারে কেউ পাগলের মত ছিটকে দৌড় দেয় না।

ফেরারি তিনজনই সম্ভবত নিরস্ত্র এবং তারপরেও ফিল্ড টিম উদ্যত অস্ত্র হাতে ভিতরে প্রবেশ করেছিল। অন্ধকারে এখন তাদের হাতের অস্ত্র থেকে খাপখোলা তরবারিরমত লেজার আলোর চারটা ঝলক হিংস্র ভঙ্গিতে পুরো কামরাময় ঘোরাঘুরি করে। লোকগুলো চারপাশে আলোর বর্শা বিদ্ধ করে মেঝের, উপরে, দূরবর্তী দেয়াল, ব্যালকনি সব জায়গায় তারা খুঁজে দেখে। বেশিরভাগ সময়ে অন্ধকার কক্ষে লেজার আলোর এক ঝলক তাৎক্ষণিক আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করে থাকে।

আজ রাতে সেরকম কিছুই হয় না।

এখনও কোথাও কোন নড়াচড়া চোখে পড়ে না।

এজেন্ট সিমকিনস হাত উঁচু করে, তার লোকদের সামনের খোলা স্থান নির্দেশ করে। নিরবে তার লোকেরা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। রিডিং ডেস্কের মাঝের প্রধান চলাচলের পথটা দিয়ে সতর্ক ভঙ্গিতে সিমকিনস সামনে এগিয়ে যায় এবং তার গগলসে একটা সুইচ চালু করে সিআইএ অস্ত্রশালার নতুন সগ্রহ সক্রিয় করে তোলে। থারমাল ইমেজিং একটা পুরানো ব্যাপার, কিন্তু ক্ষুদ্রকরণের আধুনিক সাফল্য, পার্থক্যমূলক সংবেদনশীলতা, দ্বৈত-উৎসের সমন্বয় নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিবর্ধনকারী অনুষঙ্গের জন্ম দিয়েছে যা ফিল্ড এজেন্টদের দৃষ্টিশক্তি অতিমানবীয় পর্যায়ে উন্নীত করেছে।

আমরা অন্ধকারে দেখতে পাই। আমাদের দৃষ্টি দেয়ালের সীমানায় বাঁধা পায় না। এবং আমরা…এখন সময় পিছিয়ে নিয়েও দেখতে সক্ষম।

থারমাল ইমেজিং অনুষঙ্গ আজকাল এমন সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে যে এটা কেবল একজন লোকের অবস্থানই নির্ণয় করে না…তার পূর্ববর্তী অবস্থানও চিহ্নিত করে। অতীতে পিছিয়ে এসে দেখার ক্ষমতা খুবই কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। আর আজ রাতে, আরো একবার এটা নিজের মূল্য প্রমাণ করে। এজেন্ট সিমকিনস এবার একটা রিডিং ডেস্কের উপরে থারমাল সিগনেচার দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে। চামড়ার চেয়ার দুটো তার গগলসে উজ্জ্বল হয়ে উঠে, লালচে বেগুনী রঙ ফুটে উঠে, ঘরের অন্যসব চেয়ারের চেয়ে এই দুটো চেয়ার উষ্ণতর। ডেস্ক-ল্যাম্পের বাল্বও কমলা দেখায়। নিশ্চিতভাবে দুজন লোক এখানে এসে বসেছিল কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে তারা কোথায় কোনদিকে গেছে।

সে তার প্রশ্নের উত্তর রিডিং রুমের মধ্যেখানে বিশাল কাঠের কনসোল দ্বারা ঘেরা সেন্ট্রাল কাউন্টারে খুঁজে পায়। একটা ভৌতিক হাতের ছাপ লাল হয়ে আছে।

অস্ত্র উঁচিয়ে, সিমকিনস অষ্টভূজাকৃতি ক্যাবিনেটের দিকে এগিয়ে আসে, ক্যাবিনেটের উপরে লেজার আলো দিয়ে রেকি করে। সে ঘুরতে থাকে যতক্ষণ না কনসোলের পাশে একটা খোলা জায়গা চোখে পড়ে। তারা কি আসলেই একটা কেবিনেটে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে? এজেন্ট খোলা স্থানের চারপাশটা ভাল করে দেখে এবং আরেকটা হাতের ছাপ জ্বলজ্বল করতে দেখতে। স্পষ্টই বোঝা যায় ভেতরে প্রবেশ করার আগে কেউ চৌকাঠের বাজুতে হাত রেখে মাখা নীচু করেছে।

নিরবতা পালনের প্রয়োজনীয়তা শেষ।

থারমাল অবস্থিতি! সিমকিনস চিৎকার করে, খোলা মুখটা দেখায়। ফ্ল্যাঙ্কস কনভার্জ!

বিপরীত দুই দিক থেকে তার লোকেরা এগিয়ে এসে আক্ষরিক অর্থে অষ্টভূজাকৃতি কনসোলটা ঘিরে ফেলে।

সিমকিনস খোলা মুখটা লক্ষ্য করে এগিয়ে যায়। দশ ফিট দূরে থাকতেই ভেতরে আলোর উৎস সে দেখতে পায়। কনসোলের ভিতরে আলো দেখা যাচ্ছে! সে চিৎকার করে বলে, আশা করে তার কণ্ঠ সম্ভবত পরাজয় মেনে নিয়ে মি.  বেল্লামি আর মিল্যাংডন হাত উঁচু করে ভেতর থেকে বের হয়ে আসবে।

কিছুই ঘটে না।

খুব ভাল, আমরা তাহলে অন্যপন্থাই ব্যবহার করবো।

সিমকিনস খোলা মুখটার কাছে পৌঁছাতে সে ভেতর থেকে একটা অপ্রত্যাশিত গুঞ্জন ভেসে আসছে শুনতে পায়। অনেকটা যান্ত্রিক আওয়াজের মত। সে থমকে দাঁড়ায়, এত ক্ষুদ্র স্থানে কি থেকে এমন শব্দ বের হতে পারে চিন্তা করে। সে আরেকটু সামনে এগোয়, এখন যান্ত্রিক শব্দ ছাপিয়ে মানুষের কণ্ঠ শুনতে পায়। আর সে খোলা মুখটার কাছে পৌঁছাতেই ভেতরের আলো নিভে যায়।

ধন্যবাদ, সে ভাবে, নিজের নাইট ভিশন ঠিক করে নেয়। সুবিধা এখন আমাদের।

চৌকাঠে দাঁড়িয়ে, সে খোলা মুখটার ভিতরে উঁকি দেয়। ভেতর যা দেখে সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কনসোলটা আদতে কোন ক্যাবিনেট না বরং নীচের একটা ঘরে নেমে যাওয়া খাড়া সিঁড়ির ধাপের উপরে উত্তোলিত ছাদ। এজেন্ট এবার অস্ত্র নিচের দিকে তাক করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে। যান্ত্রিক গুঞ্জন সামনে এগোবার সাথে সাথে বাড়তে থাকে।

এটা কোন জায়গা?

রিডিং রুমের নীচের ঘরটা একটা ছোট দেখতে যান্ত্রিক জায়গা। সে যে গুঞ্জন শুনেছিল সেটা আদতেই যন্ত্রের, কিন্তু সে নিশ্চিত না সেটা চলছে বেল্লামি আর ল্যাংডন সেটা চালু করেছে বলে না যন্ত্রটা সবসময়েই চালু থাকে। অবশ্য যেটাই হোক তাতে কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না। ফেরারিদ্বয় ঘরটা থেকে বের হবার একমাত্র দরজায় তাদের স্পষ্ট উষ্ণতার ছাপ রেখে গেছে-একটা ভারী ইস্পাতের দরজার সামনে কিপ্যাডের উপরে চারটা আঙ্গুলের ছাপ জ্বলজ্বল করছে। দরজার চারদিকে কমলা রঙের আভা দরজার বাজুর নীচে দিয়ে জ্বলজ্বল করে, বোঝা যায় দরজার অন্যপাশে আলো জ্বলছে।

দরজা গুঁড়িয়ে দাও, সিমকিনস আদেশ দেয়। এখান দিয়েই তারা পালিয়েছে।

কি-চার বিস্ফোরক প্রবিষ্ট করিয়ে বিস্ফোরন ঘটাতে ঠিক আট সেকেণ্ড সময় লাগে। ধোয়া সরে যেতে ফিল্ড টিমের এজেন্টরা দেখে তারা আজব এক পাতাল জগতের দিকে তাকিয়ে আছে যাকে এখানকার সবাই বলে দি স্ট্যাকস।

লাইব্রেরী অব কংগ্রেসের মাইলের পর মাইল বুক শেলফ রয়েছে, বেশিরভাগই মাটির নীচে। শেষ না হওয়া তাকের সারি দেখে মনে হবে আয়না দিয়ে দৃষ্টি বিভ্রমের সৃষ্টি করা হয়েছে।

একটা লেখা চোখে পড়ে

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রির পরিবেশ
এই দরজাটা সবসময়ে বন্ধ রাখুন

সিমকিনস বিধ্বস্ত দরজার উপর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে যায় এবং ভেতরের শীতল বাতাসে প্রবেশ করে। সে না হেসে পারে না। এর চেয়ে সহজ আর কি হতে পারে? তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উষ্ণতার চিহ্ন সূর্যের আলোর মত দৃশ্যমান হয়, আর তার গগলসে এখনই সামনের একটা রেলিংএ সে লাল আভা দেখতে পাচ্ছে, বেল্লামি আর ল্যাংডন দৌড়বার সময়ে যা স্পর্শ করে গেছে।

তুমি দৌড়াতে পার, সে ফিসফিস করে নিজেকে শুনিয়ে বলে, কিন্তু লুকিয়ে থাকতে পারবে না।

বইয়ের র‍্যাকের গোলকধাঁধার ভিতরে সিমকিনস আর তার লোকেরা এগিয়ে গেলে সে টের পায় খেলার মাঠ তার এতটাই অনুকূলে যে গগলস চোখে না দিয়েই সে তার শিকারের পিছু নিতে পারবে। সাধারণ পরিস্থিতিতে বইয়ের শেলফ বেশ সম্মানজনক একটা লুকিয়ে থাকার জায়গা বলে হয়ত প্রতিয়মান হত কিন্তু লাইব্রেরীতে গতি সংবেদনশীল আলো ব্যবহৃত হয় যাতে বিদ্যুৎ কম খরচ হয় আর সে কারণে ফেরারিদের পালাবার পথটা একটা রানওয়ের মত উদ্ভাসিত হয়ে আছে। একটা সরু আলোকিত পথ একেবেকে সামনে এগিয়ে গেছে।

সব এজেন্ট তাদের গগলস খুলে ফেলে। সুঠাম পায়ের বরাভয়ে তারা, আলোর ধারা অনুসরণ করে বইয়ের শেষ না হওয়া সারির ভিতর দিয়ে একেবেকে সামনে এগোতে থাকে। সিমকিনস শীঘ্রই দূরের অন্ধকারে আলো জ্বলতে দেখে। আমরা কাছে চলে এসেছি। সে দ্রুত এগোতে থাকে আর কিছুক্ষণ পরেই সামনে থেকে দৌড়াবার আর হাপানর শব্দ ভেসে আসে। তারপরে তারা তাদের লক্ষ্যবস্তু দেখতে পায়।

আমি দেখতে পেয়েছি! সে চেঁচিয়ে উঠে বলে।

ওয়ারেন বেল্লামির লম্বা কৃশকায় অবয়ব আপাতদৃষ্টিতে ঝুঁকে রয়েছে। মার্জিত পোষাকে সজ্জিত আফ্রিকান আমেরিকান শেলফের মাঝ দিয়ে টলোমলো করতে করতে এগিয়ে চলেছে, স্পষ্টতই বোঝা যায় দম শেষ। বুড়ো খোকা কোন লাভ নেই।

মি বেল্লামি ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ন! সিমকিনস চিৎকার করে বলে।

বেল্লামি দৌড়ে চলে, তীক্ষ্ণ বাক নিয়ে বইয়ের সারির ভিতর দিয়ে একেবেকে এগোতে থাকে।

চারজনের দলটা বিশগজ কাছে চলে আসতে, তারা আবার তাকে থামতে বলে কিন্তু বেল্লামি পাত্তা দেয় না।

ওকে ধড়ে ফেল! সিমকিনস আদেশ দেয়।

দলের যে সদস্য ননলিথাল রাইফেল বহন করছিল সে সেটা তুলে তাক করে ট্রিগারে চাপ দেয়। নিক্ষেপকটা এইসেল দিয়ে ছুটে গিয়ে বোমির পায়ের চারপাশে জড়িয়ে যায় যাকে তারা সিলি স্ট্রিঙ বলে ডাকে, কিন্তু এর কিছুই সিলি না। সানডিয়া রাস্ট্রীয় গবেষণাগারে উদ্ভাবিত সামরিক প্রযুক্তি, এই ননলিথাল অচলকারী একটা আঠাল সুতার মত পলিইউরেথিন যা সংযুক্ত হওয়া মাত্র পাথরের মত শক্ত হয়ে গিয়ে, মাকড়সার জালের মত প্লাস্টিকের একটা দলা পলাতক ব্যক্তির হাটুর পিছনে সৃষ্টি করে। চলমান লক্ষ্যবস্তুতে এর প্রতিক্রিয়া অনেকটা দ্রুতগামী মোটর সাইকেলের সামনের চাকায় একটা লাঠি ঢুকিয়ে। দেবার মত। মানুষের পা মাঝপথেই আটকে যায় এবং সে সামনে এগিয়ে গিয়ে মেঝেতে ধ্বসে পড়ে। বেল্লামি আরও দশ ফিট অন্ধকারে এগিয়ে যায় পুরোপুরি থামবার আগে, মাথার উপরের আলো অনাড়ম্বর ভঙ্গিতে জ্বলে উঠে।

মি. বেল্লামির সাথে আমি কেবল কথা বলবো, সিমকিনস চিৎকার করে বলে। তোমরা ল্যাংডনের খোঁজ কর! সে নিশ্চয়ই সামনে কোথাও- দলনেতা থেমে দাঁড়িয়ে দেখে বেল্লামির সামনের বইয়ের সারি অন্ধকারাচ্ছন্ন। নিশ্চিত ভাবেই বেল্লামির সামনে কেউ দৌড়ে যাচ্ছে না। সে একা?

বেল্লামি এখনও বুকের উপরে ভর দিয়ে শুয়ে ভীষণভাবে হাপাচ্ছে, তার হাটু পায়ে শক্ত প্রাস্টিকের একটা জট পেচিয়ে আছে। এজেন্ট এগিয়ে গিয়ে পায়ের ডগা দিয়ে খোঁচা দিয়ে বুড়ো মানুষটাকে পিঠের উপরে উল্টে দেয়।

সে কোথায়?! এজেন্ট জানতে চায়।

পড়ে যাবার কারণে বেল্লামির ঠোঁট থেকে রক্ত পড়ছে। কোথায় কে?

এজেন্ট সিমকিনস তার পা এবার বেল্লামির নিখুঁত সিল্কের টাইপের উপরে এনে রাখে। তারপরে সে পায়ের চাপ বাড়িয়ে সামনে ঝুঁকে আসে। মি. বেল্লামি বিশ্বাস করেন আপনি এই খেলাটা আমার সাথে আসলে খেলতে চান না।

.

৫৯ অধ্যায়

রবার্ট ল্যাংডনের নিজেকে একটা লাশ বলে মনে হয়।

সে চিৎ হয়ে শুয়ে, হাত বুকের উপর ভাঁজ করে রাখা, নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে এক চিলতে জায়গার ভিতরে আটকে আছে। তার মাথার কাছেই ক্যাথরিন যদিও একই ভঙ্গিতে শুয়ে রয়েছে, ল্যাংডন তাকে দেখতে পায় না। সে নিজের চোখ শক্ত করে বন্ধ করে রেখেছে পাছে নিজের সীমাবদ্ধতার ক্ষিপ্র ঝলকও তাকে দেখতে না হয়।

তার চারপাশের জায়গা বড় আটসাটো।

খুবই ছোট।

ষাট সেকেণ্ড আগে রিডিং রুমের দরজা বিধ্বস্ত হবার সময়ে সে আর ক্যাথরিন বেল্লামিকে অনুসরণ করে এই অষ্টভূজাকৃতি কনসোলের কাছে এসে খাড়া সিঁড়ি দিয়ে নীচের অপ্রত্যাশিত ফাঁকা জায়গায় নেমে আসে।

ল্যাংডন সাথে সাথে বুঝতে পারে তারা কোথায় রয়েছে। লাইব্রেরীর বাতাস সঞ্চালন ব্যবস্থার কেন্দ্রে। একটা ছোট এয়ারপোর্টের মালামাল বিতরণ কেন্দ্রের মত দেখতে সঞ্চালক কক্ষ থেকে অনেকগুলো কনভেয়ার বেল্ট নানা দিকে ছড়িয়ে গেছে। লাইব্রেরী অব কংগ্রেস যেহেতু তিনটা ভিন্ন ভিন্ন ভবনের সমন্বয়ে গঠিত তাই রিডিং রুমে পেশ করা বইয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে বই অনেক সময় অনেক দূর থেকে ভূগর্ভস্থ টানেলের ভিতর দিয়ে কনভেয়ারের একটা জটিল ব্যবস্থার মাধ্যমে আনতে হয়।

বেল্লামি কক্ষটা সাথে সাথে অতিক্রম করে একটা ইস্পাতের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেখানে তার কিকার্ড প্রবেশ করায়, একগাদা কি নাগাড়ে চেপে চলে, এবং ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে। দরজার পেছনটা অন্ধকার কিন্তু দরজা খোলার সাথে সাথে গতি সংবেদনশীল আলো দপ দপ করে জ্বলে উঠতে শুরু করে।

ল্যাংডন যখন পিছনে কি আছে দেখতে পায়, সে বুঝতে পারে সে এই মুহূর্তে এমন একটা জিনিষের দিকে তাকিয়ে আছে যা খুব কম মানুষেরই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। দি লাইব্রেরী অব কংগ্রেসের স্টাকস। বেল্লামির পরিকল্পনা শুনে তার মনে হয় কাজ হবে। এই বিশাল গোলকধাঁধার চেয়ে লুকিয়ে থাকার আর ভাল জায়গা কি হতে পারে?

বেল্লামি অবশ্য তাদের শেলফের দিকে নিয়ে আসে না। তার বদলে, সে একটা বই দিয়ে দরজাটা খুলে রেখে তাদের মুখোমুখি হয়। আমি আশা করেছিলাম আরো অনেক কিছু তোমাকে খুলে বলবো কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই। সে ল্যাংডনকে নিজের কিকার্ডটা দেয়। রাখো, এটার প্রয়োজন হবে।

তুমি আমাদের সাথে যাবে না? ল্যাংডন বুঝতে না পেরে জানতে চায়।

বেল্লামি মাথা নেড়ে যাবে না জানায়। আমরা আলাদা না হলে তুমি কখনও তাদের এড়াতে পারবে না। গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হল পিরামিড আর শিরোশোভাটার নিরাপত্তা।

ল্যাংডন রিডিংরুমে উঠে যাওয়া সিঁড়িটা ছাড়া বের হবার দ্বিতীয় কোন রাস্তা দেখতে পায় না। আর তুমি কোথায় যাবে?

আমি তাদের ভুলিয়ে বইয়ের সারির ভিতরে নিয়ে যাব তোমাদের থেকে দূরে, বেল্লামি বলে। আমি এটুকুই করতে পারি তোমাদের পালানর ব্যাপারে সাহায্য করতে।

সে আর ক্যাথরিন কোথায় যাবে ল্যাংডন তাকে জিজ্ঞেস করার আগেই বেল্লামি কনভেয়ারের উপর থেকে বইয়ের একটা ডাই তুলে নেয়। বেল্টের উপরে শুয়ে পড়, বেল্লামি বলে। হাত গুটিয়ে রাখবে।

ল্যাংডন বেকুবের মত তাকিয়ে থাকে। তুমি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছে। কনভেয়ার বেল্ট সামান্য কিছুদূর গিয়ে দেয়ালে গর্তের ভিতরে হারিয়ে গেছে। খোলা মুখটা বইয়ের স্তূপ পার হবার মত যথেষ্ট চওড়া কিন্তু তার বেশি না। ল্যাংডন চোখে আশা নিয়ে বইয়ের তাকের দিকে তাকায়।

ভুলে যাও, বেল্লামি বলে। গতি সংবেদনশীল আলোর কারণে ওখানে। লুকিয়ে থাকা মুশকিল।

থারমাল চিহ্ন! ওপর তলায় একটা কণ্ঠ চেঁচিয়ে বলে। ফ্ল্যাঙ্কস কনভার্জ?

ক্যাথরিনের যতটুকু শোনা দরকার বোঝা যায় সে ততটুকু শুনেছে। সে কনভেয়ার বেল্টের উপরে উঠে শুয়ে পড়ে তার মাথা দেয়ালের খোলা মুখ থেকে কয়েক ফিট দূরে রয়েছে। সারকোফেগাসে রাখা মমির মত সে এবার দুহাত বুকের উপরে ভাঁজ করে নেয়।

ল্যাংডন মূর্তির মত অনড় দাঁড়িয়ে থাকে।

রবার্ট, বেল্লামি দ্রুত কণ্ঠে বলে, আমার জন্য না হলেও পিটারের জন্য অন্তত এটা কর।

ওপরতলার কণ্ঠস্বর আর এগিয়ে এসেছে।

যেন স্বপ্নের ঘোরে রয়েছে এমন ভাবে ল্যাংডন কনভেয়ার বেল্টের দিকে এগিয়ে যায়। ডেব্যাগটা কোমরে ঝুলিয়ে নিয়ে সে তার মাথা ক্যাথরিনের পায়ের কাছে রাখে। রবারের শক্ত বেল্ট তার পিঠে শীতল অনুভূতি জাগায়। সে ছাদের দিকে তাকায় তার মনে হয় হাসপাতালে কেউ তাকে মাথা প্রথমে ভিতরে দিয়ে এমআরআই মেশিনে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

ফোন চালু রেখো, বেল্লামি মনে করিয়ে দেয়। খুব শীঘ্রই কেউ ফোন করবে…এবং সাহায্যের প্রস্তাব দেবে। তাকে বিশ্বাস করতে পার।

কেউ ফোন করবে? ল্যাংডন জানে বেল্লামি কাউকে ফোন করছিল, শেষে না পেয়ে একটা ম্যাসেজ রেখে দিয়েছিল। আর কিছুক্ষণ আগে তারা যখন দ্রুত বৃত্তাকার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছে তখন শেষবারের মত ফোন করে তাকে লাইনে পায়, চাপা কণ্ঠে কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দেয়।

কনভেয়ারে করে একেবারে শেষ মাথা পর্যন্ত যাবে, বেল্লামি বলে। সেখানে কনভেয়ার ঘোরার সময়ে দ্রুত নেমে পড়বে। আমার কিকার্ড ব্যবহার করে বের হয়ে যেও।

বের হয়ে কোথায় যাব? ল্যাংডন জানতে চায়।

কিন্তু বেল্লামি ততক্ষণে লিভার টেনে দিয়েছে। ঘরের সবগুলো কনভেয়ার নিমেষে প্রাণ ফিরে পায়। ল্যাংডন টের পায় তার দেহ গতি লাভ করেছে এবং মাথার উপরে ছাদ পেছনে সরে যাচ্ছে।

খোদা এযাত্রা প্রাণে বাঁচিয়ে দাও।

ল্যাংডন দেয়ালের ফাঁকা স্থানটার দিকে এগোতে শুরু করতেই সে পেছনে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় দেখে বেল্লামি দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বইয়ের শেলফের আড়ালে হারিয়ে যায়। মুহূর্ত পরে ল্যাংডনকে অন্ধকার গ্রাস করে নেয়, লাইব্রেরীর কনভেয়ার ব্যবস্থা…আর সেই সময়েই সিঁড়ি বেয়ে লেজারের আলো লকলক করতে করতে নীচে নেমে আসে।

.

৬০ অধ্যায়

প্রেফার্ড সিকিউরিটি থেকে কম বেতনে নিয়োগ দেয়া মহিলা নিরাপত্তা রক্ষী তার কল-শীটে কালোরামা হাইটসের ঠিকানাটা দ্বিতীয়বার দেখে নেয়। তার সামনে বন্ধ ড্রাইভওয়ের পেছনে এলাকার সবচেয়ে বড় আর নির্জন আবাসিক এলাকা আর তাই ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত যখন ৯১১ এখান থেকে একটা জরুরী কল পায়।

অজ্ঞাতনামা ফোন কলের ক্ষেত্রে যা সচরাচর করা হয়ে থাকে, ৯১১ এলাকার একটা স্থানীয় এলার্ম কোম্পানীর সাথে প্রথমে যোগাযোগ করে পুলিশকে খবর দেবার আগে। রক্ষী প্রায়ই এলার্ম কোম্পানীর মূলনীতিটা ভাবে-তোমার প্রথম নিরাপত্তা বেষ্টনী-খুব সহজেই ফলস এলার্ম, ফাজলামো, কুকুর হারান, বা বেকুব প্রতিবেশীর কাজ প্রতিয়মান হতে পারে।

আজরাতেও, বরাবরের মতই নিরাপত্তা কর্মী নির্দিষ্ট কোন তথ্য ছাড়াই পর্যবেক্ষণ করতে এসেছে। আমার বেতনে এটা পড়ে না। তার কাজ হল হলুদ আলো জ্বালিয়ে সম্পত্তিটা ঘুরে দেখা আর অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লে রিপোর্ট করা। সাধারণত, দেখা যায় কোন ফালতু কারণে এলার্ম বেজে উঠেছে সে তখন তার ওভাররাইড কি ব্যবহার করে এলার্ম পুনরায় সেট করে দেয়। এই বাসাটা অবশ্য চুপচাপ আছে। কোন এলার্ম বাজছে না। রাস্তা থেকে যেটুকু দেখা যায় তাতে অন্ধকার আর শান্তিপূর্ণ বলেই মনে হয়।

নিরাপত্তা কর্মী প্রধান ফটকের কাছের ইন্টারকম টেপে, কিন্তু কোন উত্তর পায় না। সে তার ওভাররাইড কোড দিয়ে গেট খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। গাড়ির ইঞ্জিন চালু রেখেই সে গাড়ি থেকে নেমে সদর দরজায় গিয়ে বেল চাপে কোন উত্তর নেই। সে কোথাও কোন আলো জ্বলতে বা কিছু নড়াচড়া করতেও দেখে না।

অনীহার সাথে নিয়ম পালনের খাতিরে, সে তার ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে বাড়ির চারপাশের দরজা জানলা পরীক্ষা করে দেখে কেউ বলপূর্বক ভেতরে প্রবেশ করেছে কিনা। সে বাক নেয়ার সময় দেখে একটা কালো স্ট্রেচ লিমোজিন বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময়ে একটু গতি হ্রাস করে তারপরে আবার সোজা চলে যায়। নাকগলান প্রতিবেশীর দল।

একটু একটু করে সে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখে কোথাও অস্বাভাবিক কিছুই। তার চোখে পড়ে না। বাসাটা যে যেমন ভেবেছিল তারচেয়েও বিশাল, এবং সে। যখন পেছনে পৌঁছে ততক্ষণে সে শীতে কাঁপতে শুরু করেছে। বোঝাই যাচ্ছে বাসায় কেউ নেই।

ডেসপ্যাঁচ? সে তার রেডিও অন করে। আমি কালোরমা হাইটস। দেখতে এসেছি? মালিকরা কেউ বাসায় নেই। ঝামেলারও কোন চিহ্ন কোথাও নেই। চারপাশটা ঘুরে দেখেছি। জোরপূর্বক প্রবেশের কোন চিহ্ন চোখে পড়েনি। ফলস এলার্ম।

রজার দ্যাট, ডেসপ্যাচার বলে। শুভ রাত্রি।

নিরাপত্তা রক্ষী তার রেডিও বেল্টে খুঁজে রেখে ফিরে আসতে শুরু করে যত তাড়াতাড়ি সে তার গাড়ির উষ্ণ পরিবেশে ফিরে যেতে চায়। ফিরতে শুরু করে সে অবশ্য কিছু একটা দেখে যা আগে তার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল-একটা নীলচে আলোর কণা বাসার পেছনে দেখা যায়।

বিভ্রান্ত হয়ে, সে সেদিকে হেঁটে যায় আলোটার উৎস দেখতে পেয়েছে একটা নীচু ট্রান্সসম জানালা, যা আপাত দৃষ্টিতে বাড়ির বেসমেন্টে অবস্থিত। জানালার কাঁচে কালো রঙ দেয়া। বোধহয় কোন ধরণের ডার্করুম হবে? সে যে নীল আলোটা জ্বলতে দেখেছে সেটা কাঁচের একটা ক্ষুদ্র স্থান দিয়ে নির্গত হয়েছে যেখানে কালো রঙ উঠতে শুরু করেছে।

সে উবু হয়ে বসে সেই ক্ষুদ্র স্থানটা দিয়ে ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করে কিন্তু জায়গাটা বড় ছোট হওয়াতে সে কিছুই দেখতে পায় না। সে কাঁচে টোকা দেয়, কেউ বোধহয় নীচে কাজ করছে।

হ্যালো, সে চিৎকার করে ডাকে।

কেউ কোন উত্তর দেয় না কিন্তু কাঁচে টোকা দেবার কারণে রঙের টুকরোটা সহসা খুলে পড়ে এবং ভেতরের পুরোটা দেখার সুযোগ তাকে করে দেয়। সে সামনে ঝুঁকে মুখটা কাঁচের সাথে ঠেকিয়ে সে বেসমেন্টটা জরিপ করে। সাথে সাথে তার মনে হয় না করলেই ভালো ছিল।

ঈশ্বরের দিব্যি এসব কি?!

হতচকিত হয়ে সে উবু হয়েই কিছুক্ষণ বসে থাকে, তার চোখের সামনের ভীতিকর দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে। অবশেষে কাঁপা কাঁপা হাতে সে তার রেডিও বের করার জন্য হাত বাড়ায়।

সে তখন রেডিও খুঁজে পায়নি।

তার গলার পেছনে হিসহিস শব্দে এক জোড়া তাশের শূল গেঁথে যায় এবং পুরো দেহে তীব্র যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ে। তার মাংসপেশী আড়ষ্ঠ হয়ে যায় সে সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে, তার মুখ যখন মাটি স্পর্শ করে তখনও তার চোখ খোলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *