২৬-২৮. আমি, লিও, আর জব

২৬.

আমি, লিও, আর জব গায়ে গায়ে সেঁটে দাঁড়িয়ে আছি। আয়শা সম্ভবত মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারো মুখে কথা নেই।

তারপর, মনে হলো অনেক দূর থেকে ভেসে এলো প্রথম শব্দটা। ক্রমশ বাড়ছে এবং এগিয়ে আসছে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে আয়শা দ্রুতহাতে খুলে ফেললো তার পোশাক। কোমরের দুমাথাওয়ালা সোনার সাপটা একটু উঁচু করে ধরে শরীরে একটা ঝাকি দিতেই ঢিলে পোশাকটা পিছলে নেমে গেল পায়ের কাছে। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আয়শা, সম্পূর্ণ নগ্ন। তার সাদা শরীরের প্রতিটি অংশ দেখতে পাচ্ছি আমরা। একটা মাত্র শব্দে সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে পারি আমি স্বর্গীয়।

বজ্রগর্জনের মতো হয়ে উঠেছে শব্দ। ঘুরতে ঘুরতে মাথা তুলছে বর্ণিল উজ্জ্বল আগুনটা। এগিয়ে এসে লিওর গলা জড়িয়ে ধরলো আয়শা।

প্রিয়তম, প্রিয়তম! বিড়বিড় করে বললো সে। কোনোদিন কি বুঝবে কতটা ভালোবাসি তোমাকে? আলতো চুমু খেলো ওর কপালে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল আগুনের ভেতর।

বাড়ছেই গুরুগম্ভীর শব্দটা। আগুনও ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে। লকলকে শিখা ঘিরে ধরলো আয়শাকে। ওর সাদা শরীর আগুনের রঙধনু রঙে রঙিন হয়ে উঠলো। এই দেখতে পাচ্ছি ওর অসম্ভব সুন্দর মুখটা, পরমুহূর্তে হারিয়ে যাচ্ছে আগুনের আড়ালে। ঘুরেফিরে হাত-পা নেড়ে শরীরের সব জায়গায় আগুন স্পর্শ করানোর চেষ্টা করছে সে। কিন্তু আশ্চর্য। কোনো জ্বালা যন্ত্রণা বা কষ্টের ছাপ নেই তার মুখে বা আচরণে। বরং পরম পরিতৃপ্তির একটা ভঙ্গি আয়শার চেহয়।

তারপর হঠাৎ আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই অবর্ণনীয় এক পবির্তন লক্ষ্য করলাম ওর মুখে। পরিতৃপ্তির ভাবটা মিলিয়ে গেছে, সেখানে টে উঠেছে শুকনো কাঠোর একটা অভিব্যক্তি। ওর লাবণ্যও কি ম্লান হয়ে গেছে একটু? চোখের অপূর্ব উজ্জ্বলতা মিইয়ে এসেছে। ভুল দেখছি না তো? দুহাতে চোখ ডললাম আমি। ইতিমধ্যে শব্দ কমে আসতে শুরু করেছে। আগুনের উজ্জ্বলতাও ক্রমে ম্লান হয়ে আসছে। কয়েক মুহূর্তের ভেতর মিলিয়ে গেল দুটোই।

লিওর সামনে এসে দাঁড়ালো আয়শা। আমার মনে হলো, ঝরনার সেই সাবলীল ছন্দ যেন নেই তার হাঁটায়! দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে গেল লিওকে, কিন্তু ওর হাতের সেই সৌন্দর্য কোথায়? সরু কাঠির মতো হয়ে গেছে। আর তার মুখ-ও, ঈশ্বর!-আমার চোখের সামনে বুড়োটে হয়ে যাচ্ছে আয়শার মুখ! লিও-র চোখে পড়েছে এই পরিবর্তন; ছিটকে দুপা পেছনে সরে গেল ও।

কি ব্যাপার, প্রিয়তম ক্যালেক্রেটিস? বললো আয়শা, কিন্তু কোথায় সেই মধুর সঙ্গীতের মতো কণ্ঠস্বর? কেমন ফ্যাসফেসে কর্কশ শোনালো গলাটা।

আরে, এ কি-একি? বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বললো সে। এমন ঝিমুনি আসছে কেন? আগুনের গুণ নিশ্চয়ই বদলে যায়নি? ক্যালিক্রেটিস, ও ক্যালিক্রেটিস! আমার চোখে কি হয়েছে? সব কিছু ঝাঁপসা হয়ে আসছে কেন? দুহাতে মাথা আঁকড়ে ধরলো সে। কিন্তু ওই—ওহ! তার আজানুলম্বিত চুলগুলো খসে পড়েছে মাটিতে! সবগুলো! একটাও নেই মাথায়! কুৎসিত একটা টাক যেন ভেংচাচ্ছে আমাদের।

ওহ, দেখুন, স্যার!-দেখুন!–দেখুন! তীক্ষ্ণ্ণ স্বরে চিৎকার করে উঠলো জব। আতঙ্কে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর চোখ দুটো, ঠোঁটের কোনায় ফেনা জমে গেছে। দেখুন!-দেখুন! ও কেমন কুঁচকে যাচ্ছে! বানর হয়ে যাচ্ছে। আর একটা কথাও উচ্চারণ করতে পারলো না জব, গোঁ গোঁ করতে করতে পড়ে গেল মাটিতে।

আমার অবস্থাও মোটেই ভালো নয়। চোখেব সামনে সেই আয়শার এ কি চেহারা হলো? এখনো সঙ্কুচিত হচ্ছে ওর দেহ। সোনার সাপটা পিছলে নেমে গেছে সুগঠিত কোমর থেকে। সাদা ত্বকের রঙ বদলে ময়লা ময়লা হলদেটে বাদামী হয়ে গেছে। নিখুঁত হাত দুটোয় হাড় আর চামড়া ছাড়া কিছু নেই। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না আয়শা। পড়ে গেল মেঝেতে। তারপর রক্তহিম করা তীক্ষ্ণ্ণ কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠলো একবার, ওহ!

ছোট্ট একটা বানরের চেয়ে ছোট হয়ে গেছে আয়শার আকৃতি। মুখটার দিকে তাকালে ভয় করে। শরীরের দিকে তাকালে ঘেন্না লাগে। এই কি সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ, অনন্ত যৌবনা আয়শা?

কঙ্কালসার হাত দুটোয় ভর দিয়ে অনেক কষ্টে শেষ বারের মতো উঠে বসলো সে। কচ্ছপের মতো ধীরে ধীরে এপাশে ওপাশে মাথা দোলালো। কিছু দেখতে পাচ্ছে না আয়শা, সাদাটে চোখ দুটোর ওপর ঘষা কাচের মতো একটা পর্দা পড়ে গেছে।

ক্যালিক্রেটিস, খসখসে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো সে। আমাকে ভুলো না, ক্যালিক্রেটিস। আমার লজ্জায় দুঃখবোধ করো। আমি মরবো না, আমি আবার আসবো, অন্তত আর একবার আমি সুন্দর হবো, শপথ করে বলছি! ওহ-হ-হ- মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে।

কুড়ি শতাব্দী আগে আয়শা যেখানে হত্যা করেছিলো আইসিসের পুরোহিত ক্যালিক্রেটিসকে, ঠিক সেখানেই মারা গেল সে।

তীব্র আতঙ্কের ধাক্কাটা সামলাতে পারলাম না আমরা। প্রথমে লিও পরে আমি পড়ে গেলাম মাটিতে। তারপর আর কিছু মনে নেই।

.

এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানি না। যখন চোখ মেললাম, দেখলাম, জব আর লিও তখনও পড়ে আছে মাটিতে। সেই গোলাপী আলোয় তখনো ভরে আছে গুহা। কিছুদূরে বানরের মতো অবয়বটা পড়ে আছে। হায়, এককালে ওটাই ছিলো মহামহিমাময়ী অপরূপা আয়শা!

কেন এমন হলো? রহস্যময় প্রাণদায়ী আগুনের প্রকৃতি কি বদলে গেছে? মাঝে মাঝে ওটা প্রাণের বদলে মৃত্যুর নির্যাস বয়ে আনে? নাকি একবার যে ওতে স্নান করে দ্বিতীয়বার সে ওতে ঢোকার ক্ষমতা হারায়—অর্থাৎ প্রথমবারে যে প্রাণশক্তি পাওয়া যায় দ্বিতীয়বারে তা-ই আবার নষ্ট হয়ে যায়? হতে পারে। এটাই সম্ভব বলে মনে হলো আমার কাছে। সত্যি সত্যি যদি আয়শা ওতে স্নান করেই অন্তত যৌবন লাভ করে থাকে তাহলে এছাড়া আর কোনো কারণ থাকতে পারে না তার অমন পরিণতি হওয়ার।

জ্ঞান ফেরার পর কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে ভাবলাম এসব। তারপর উঠে বসলাম ধীরে ধীরে। স্বাভাবিক শারীরিক শক্তি ফিরে পেতে শুরু করেছি। উঠে প্রথমে যে কাজটা করলাম তা হলো, আয়শার সাদা পোশাকটা কুড়িয়ে নিয়ে ঢেকে দিলাম বানরের মতো দেহটা। পাছে লিও জেগে উঠে ওটা দেখে আবার জ্ঞান হারায় তাই খুব তাড়াতাড়ি করলাম কাজটা।

তারপর আয়শার সুগন্ধি চুলের গোছা ডিঙিয়ে জবের কাছে গেলাম। মুখ মাটিতে দিয়ে পড়ে আছে বেচারা। ঝুঁকে চিৎকার করতেই অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে আছড়ে পড়লো ওর একটা হাত। শিরশির করে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল আমার শরীর বেয়ে। তীক্ষ্ণ্ণ চোখে তাকালাম ওর মুখের দিকে। এবং একবার দেখেই বুঝে নিলাম যা বোঝার। আমাদের পুরানো বিশ্বস্ত ভূত জব মারা গেছে। আতঙ্কের প্রচণ্ডতা সামলাতে পারেনি বেচারার স্নায়ু। গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুক চিরে। কিন্তু এ নিয়ে বেশিক্ষণ আক্ষেপ করার অবসর পেলাম না। জ্ঞান ফিরেছে লিওর। জবের মৃত্যুসংবাদ দিলাম ওকে। ওহ! এ ছাড়া আর কিছু বলতে পারলো না সে। আয়শার ভয়ানক পরিণতি দেখে স্নায়ুগুলো কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে আমাদের।

উঠে গিয়ে লিওর পরিচর্যায় লাগলাম আমি। জবের মতো ও-ও আতঙ্কে মরে যায়নি দেখে কি স্বস্তি যে পেলাম তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। কিছুক্ষণের ভেতর উঠে বসলো ও। এবং তারপর আরেকটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার আমার নজরে পড়লো। এই ভয়ানক জায়গায় যখন ঢুকি তখনও লিওর কোঁকড়া চুলগুলো সোনালি ছিলো। এখন দেখছি ধীরে ধীরে ছাইরঙা হয়ে যাচ্ছে সেগুলো। আরো কিছুক্ষণ পর তুষারের মতো সাদা হয়ে গেল সব। দেখে মনে হচ্ছে বিশ বছর বেড়ে গেছে ওর বয়েস।

এবার কি করবো আমরা? ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো লিও।

ভাগার চেষ্টা! অবশ্য তুমি যদি ওর ভেতর যেতে চাও তাহলে আলাদা কথা। আগুনের স্তম্ভটার দিকে ইশারা করলাম আমি, ইতিমধ্যে আবার উদয় হয়েছে সেটা।

যদি জানতাম ওর ভেতর ঢুকলে নিশ্চিত মরবো তাহলে সত্যি যেতাম, একটু হেসে জবাব দিলো লিও। আমার দ্বিধাই কাল হয়েছে। আমি যদি ইতস্তত না করতাম তাহলে হয়তো প্রমাণ করার জন্যেও ঢুকতে না ওতে, এই করুণ পরিণতি-ও হতো না। আমিই দায়ী ওর মৃত্যুর জন্যে। তবে হ্যাঁ, ওর শেষ কথা মনে আছে আমার, আবার ও আসবে। আমি ওকে খুঁজবো। আর বেশি দিন হয়তো বাঁচবো না–কিন্তু যে কদিনই, ওর খোজেই থাকবো।

সম্ভবত কথাগুলোর সঠিক অর্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হলো আমার মস্তিষ্ক। জবাবে শুধু বললাম, চলো, লিও, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে হবে এই ভয়ঙ্কর জায়গা থেকে।

.

২৭.

কোনো ঝামেলা ছাড়াই গুহাগুলো পেরিয়ে এলাম আমি আর লিও। ওল্টানো চোঙের মতো ঢালটার কাছে পৌঁছে দেখা দিলো সমস্যা। একটা নয় দুটো। প্রথমত, কোন পথে যাবো; দ্বিতীয়ত, আলোর অভাব। প্রদীপ দুটো এমন টিম টিম করে জ্বলছে যে, সে আলোয় পথ ঠাওরানো দুষ্কর। তিন-চারবার বিভিন্ন দিকে মুখ করে উঠে গেলাম ঢাল বেয়ে, কিন্তু যে সরু সিঁড়ি বেয়ে নেমেছিলাম সেটার খোঁজ পেলাম না। দিশেহারা অবস্থা। ক্লান্ত হয়ে পড়ছি ক্রমশ। অবশেষে এক জায়গায় বসে ভাবার চেষ্টা করলাম নামার সময় কি কি দেখেছিলাম, সেগুলোর চেহারা কেমন। অস্পষ্টভাবে মনে পড়লো কয়েকটা জিনিসের কথা। একটা হলো বিশাল একটা পাথর। কিছুদূর নামার পরই ওটার পাশ কাটিয়ে এসেছিলাম। সেই সাথে এ-ও মনে পড়লো, শেষবার যখন ওঠার চেষ্টা করেছিলাম তখন ওটার পাশ দিয়ে গেছি একবার, তবে সমকোণে। অর্থাৎ এখন যদি আবার ওটার কাছে পৌঁছতে পারি তাহলে পথ চিনে নিতে পারবো।

উঠলাম আবার। না, এবার আর ভুল হলো না, ঠিক পৌঁছে গেলাম পাথরটার কাছে। এবং কয়েক মিনিটের ভেতর সেই সরু সিঁড়িটার কাছে। একটু পরেই বৃদ্ধ দার্শনিক লুটের কুঠুরিতে উঠে এলাম আমরা।

কিন্তু এবার কি করবো? তক্তা নেই, খাদ পেরোবো কি করে?

দুটো মাত্র বিকল্প এখন আমাদের সামনে: হয় লাফিয়ে পেরুতে হবে ফাঁকা জায়গাটা, নয়তো, এখানেই না খেয়ে শুকিয়ে মরতে হবে। পাথর আর সেতুর মাঝের দূরত্ব খুব বেশি না, এগারো কি বারো ফুট হবে। কলেজে থাকতে লিওকে দেখেছি, বিশ ফুট দূরত্ব অনায়াসে লাফিয়ে পার হতে। আমিও কম নই এ ব্যাপারে, বিশ ফুট না হলেও পনেরো ষোলো ফুট সহজেই লাফিয়ে পেরোতে পারি। কিন্তু এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দুজন মানুষ; যেখানে লাফাতে হবে সে জায়গাটাও ভয়ঙ্কর; এক পাশে টলমলে একটা পাথর, অন্য পাশে সরু একটা প্রাকৃতিক সেঁতু, তার ওপর তীব্র বাতাস। একটু এদিক ওদিক হলেই পড়তে হবে অতল গহ্বরে। তবে এটাও ঠিক এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। অনাহারে মরতে না চাইলে ঝুঁকিটা নিতেই হবে।

লিওকে বললাম কথাটা। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলো ও। ও-ও বুঝতে পেরেছে আর কোনো পথ নেই। কিন্তু জায়গা মতো যাচ্ছি কিনা অন্ধকারে বুঝবো কি করে? যাওয়ার সময় যেমন ছিলো, এখনো তেমনি অন্ধকার জায়গাটা। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম আপাতত অপেক্ষা করবো। ফোকর গলে আবার যখন অস্তায়মান। সূর্যের আলো এসে পড়বে তখন চেষ্টা করবো। ইতিমধ্যে একটু বিশ্রামও নেয়া হয়ে যাবে। এমন সময় খেয়াল করলাম নিবু নিবু অবস্থা একটা প্রদীপের, অন্যটা নিবে গেছে আগেই।

তাড়াতাড়ি নুটের কুঠরি থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে পড়লাম বিশাল চোঙাকৃতি পাহাড়ের মাথায় পাথরের চাইটার ওপর। নুটের গুহার মেঝে থেকে পাথরটার উপরিভাগের উচ্চতা হবে, খুব বেশি হলে, আট কি নফুট। লাফ দিয়ে দুহাতে ওটার কিনারা ধরলাম প্রথমে, তারপর আরেক লাফে উঠে গেলাম ওপরে।

আমরা উঠলাম প্রদীপটাও নিবে গেল।

বিশাল পাথরটার ওপর বসে আছি আমরা। সময় বয়ে যাচ্ছে। তীব্র বাতাস শোঁ-শোঁ শব্দে বইছে। একটু পর পরই মনে হচ্ছে, এই বুঝি উড়িয়ে নিয়ে গেল। শুয়ে পড়লাম আমি। এবার বাতাসের ঝাঁপটা তত লাগছে না। একটু পরে লিও-ও আমার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করলো।

কত ঘণ্টা যে এভাবে কেটে গেল জানি না। হঠাৎ, বিন্দুমাত্র পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই লাল আলোর ছুরি ফালা ফালা করে ফেললো অন্ধকার। তড়াক করে উঠে বসলাম আমরা।

এখনই! বলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো লিও।

আমিও উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কে আগে?

তুমি, বুড়ো। পাথরটা যাতে স্থির থাকে সেজন্যে ঐ দিকটায় বসে থাকবো আমি। যতটা সম্ভব দ্রুত দৌড়ে যাবে, আর একটু উঁচু করে লাফ দেয়ার চেষ্টা করবে। বাকিটা ঈশ্বরের হাতে।

মেনে নিলাম আমি। তারপর এমন একটা কাণ্ড করলাম যা লিও যখন ছোট্ট বাচ্চা ছিলো তখনও করিনি। ঘুরে দাঁড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম, এবং আলতো করে চুমু খেলাম ওর কপালে। আমি নিশ্চিত ভাবেই ধরে নিয়েছি, ওর সাথে আর দেখা হবে না কোনো দিন।

তাহলে যাই, লিও, বললাম আমি। আশা করি আবার দেখা হবে আমাদের, সে যেখানেই হোক না কেন।

পাথরের যেদিকে খাদ তার বিপরীত প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালাম। তেত্রিশ কি চৌত্রিশ ফুট লম্বা পাথরটা। এই দূরত্ব দৌড়ে গিয়ে লাফ দিতে হবে। বাকিটা আমার কপাল। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে শুরু করলাম দৌড়। প্রান্তে পৌঁছুলাম, তারপরই ঝাঁপ দিয়ে উঠে গেলাম শূন্যে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, ঠিক মতো হয়নি লাফটা। শূন্যে উড়ন্ত অবস্থায়ই আতঙ্কের একটা স্রোত বয়ে গেল আমার শরীর বেয়ে।

সেকেণ্ডেরও কম সময়ের মধ্যে নেমে এলো আমার শরীর। এবং ঠিকই। সেতুর কিনারা স্পর্শ করতে পারলো না আমার পা। নেমে যাচ্ছি খাদের ভেতর। এমন সময় কিনারা ছুঁলো আমার হাত ও দেহের কিছুটা অংশ। সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলাম কিনারাটা। এক হাতে ঠিকই ধরতে পারলাম, অন্যটা গেল ফসকে।

এক হাতে সেতুর কিনারা ধরে ঝুলে আছি আমি। যেখান থেকে লাফিয়ে এসেছি সেদিকে মুখ। ভীষণ বেকায়দা অবস্থা। দু’এক সেকেণ্ডের বেশি থাকতে পারবো না এভাবে। প্রাণপণে চেষ্টা করলাম অন্য হাতটা দিয়েও কিছু একটা ধরার। ভাগ্য ভালো, সফল হলাম। মাথা বের করা একটা পাথরের টুকরো ধরে ফেলতে পারলাম। কিন্তু যেটাকে এক মুহূর্ত আগে মনে করেছিলাম সৌভাগ্য সেটাই দুর্ভাগ্য হয়ে দেখা দিলো এখন। সরু সেতুটার দুপাশে দুহাত দিয়ে ঝুলে আছি আমি। এখনো আমার মুখ সেই পাথরটার দিকে। হাজার চেষ্টা করলেও, ওপরে তো দূরের কথা, এক ইঞ্চিও উঠতে পারবো না। যতক্ষণ হাতে সইবে ঝুলে থাকবো, তারপর পড়ে যাবো।

সেই নিরুপায় মুহূর্তটার অপেক্ষায় আছি, এমন সময় একটা চিৎকার শুনলাম লিওর। পরমুহূর্তে পাথর আর সেতুর মাঝখানের ফাঁকে মাঝ আকাশে দেখলাম ওকে। দুসেকেণ্ড পর বলিষ্ঠ দুটো হাত ধরলো আমার ডান হাত। এ যাত্রা বেঁচে গেলাম আমি। কয়েক সেকেণ্ড পর অদৃশ্য হয়ে গেল লালচে আলোটা।

প্রায় আধ ঘণ্টা মরার মতো শুয়ে রইলাম আমরা সরু জায়গাটায়। কেউ কোনো কথা বললাম না। তারপর উঠে গুড়ি মেরে এগোলাম সুড়ঙ্গের দিকে। বেড়ালের মতো তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছি, তবু অত্যন্ত ঝাঁপসা একটা আভাস ছাড়া পথের কিছু দেখতে পাচ্ছি না। এভাবেই এগিয়ে চললাম, অবশেষে পৌঁছুলাম সুড়ঙ্গের মুখে।

কবরের মতো অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর। আসার সময় আলো থাকা সত্ত্বেও কেমন হোঁচট খেতে হয়েছিলো মনে পড়লো। কিন্তু, কিছু করার নেই, এবারও চার হাত পায়ে ভর দিয়ে অন্ধের মতো এগোলাম। আমাদের একমাত্র অবলম্বন, সুড়ঙ্গের এক পাশের দেয়াল। কতবার যে পাথরের সাথে বাড়ি খেলাম, হুমড়ি খেয়ে পড়লাম গর্তের ভেতর, কোন হিসেব নেই তার। রক্তাক্ত হয়ে গেল শরীরের বিভিন্ন অংশ। এদিকে প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে দেহের সমস্ত শক্তি। কয়েক পা এগোনোর পরই পাঁচ-দশ মিনিট বিশ্রাম না নিলে চলছে না। আগেরবার বিশ মিনিটে সুড়ঙ্গের এ মাথা থেকে ও মাথায় গিয়েছিলাম, এবার লাগলো কয়েক ঘণ্টা। যাহোক শেষ পর্যন্ত ওটা পেরোতে পারলাম আমরা। বাইরে তখন ভোর হচ্ছে।

একই রকম হামাগুড়ি দিয়ে সরু কার্নিসের মতো জায়গাটাও পেরিয়ে এলাম। এবার নামতে হবে। কিন্তু বেঁকে বসতে চাইছে আমাদের শরীর। আর এক ইঞ্চি এগোনোর শক্তিও অবশিষ্ট নেই। লিওর অবস্থা আরো খারাপ, মাথা-ই তুলতে পারছে না বেচারা।

আরেকটু চেষ্টা করো, লিও, হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোরকমে বললাম আমি, যতটা না লিওর উদ্দেশে তার চেয়ে বেশি নিজের উদ্দেশেই। কোনোমতে ঢালের কাছে পৌঁছুতে পারলেই হয়, বিলালি আছে ওখানে। এসো, হাল ছেড়ে দিও না।

আমার কথায় একটু যেন আশার আলো দেখলো লিও। উঠে একজন আরেক জনের গায়ে হেলান দিয়ে টলতে টলতে নেমে যেতে লাগলাম। কেমন যেন ঘোর। লাগা অবস্থা। কিছুই গুছিয়ে ভাবতে পারছি না।

কেমন করে নামলাম, গড়িয়ে পড়ে গেলাম না কেন, কিছুই জানি না। হঠাৎ সফেদ বৃদ্ধ বিলালিকে দৌড়ে আসতে দেখে সংবিৎ ফিরলো আমার।

ওহ, বেবুন! আমার বেবুন! চিৎকার করলো সে। তুমি আর সিংহ-ই তাহলে? কিন্তু ওর পাকা ধানের মতো চুলগুলো অমন তুষারের মতো সাদা হয়ে গেছে কেন? কোত্থেকে এলে তোমরা? শূকরছানা কোথায়? সে-ই বা কোথায়?

মরে গেছে, দুজনই মরে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোরকমে জবাব দিলাম আমি। কিন্তু ওসব কথা থাক এখন, খাবার-পানি কিছু থাকলে দিন দয়া করে।

মরে গেছে। ঢোক গিলে বললো বৃদ্ধ। অসম্ভব! অমর সে–মরে গেছে, কি করে তা সম্ভব?

ইতিমধ্যে আয়শার বাহকরা এগিয়ে এসেছে। সম্ভবত ওদের দেখেই সামলে নিলো বিলালি। ইশারায় জানালো, আমাদের বয়ে নিয়ে যেতে হবে ঝোপের

আড়ালে। সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ পালন করলো তারা।

ঝোপের আড়ালে তখন আগুনের ওপর ঝোল তরকারি রান্না হচ্ছে। বিলালি খাইয়ে দিলো, নিজের হাতে খাওয়ার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই আমাদের গায়ে। কোনোমতে খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লাম আমরা। তারপর আর কিছু মনে নেই।

.

২৮.

পুরো এক দিন, এক রাত ঘুমালাম আমি। জেগে উঠে দেখলাম বিলালি ঝুঁকে আছে আমার মুখের ওপর। লিও এখনো ঘুমোচ্ছে।

অমর সে-যাকে-মানতেই-হবে কি করে মারা গেল, জানতে চাইলো বিলালি। সঙ্গে সঙ্গে এ-ও জানালো, সত্যিই যদি সে মরে গিয়ে থাকে, সমূহ বিপদ আমাদের সামনে। আমাহ্যাগাররা চরম ভাবে খেপে আছে, সে নেই জানতে পারলেই আমাদের বিশেষ করে লিওকে গরম পাত্র করে খাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠবে ওরা। ওদের বিশ্বাস, আমাদের কারণেই শাস্তি পেয়েছে ওদের জাতভাইরা।

যা হোক, ঘটনাটা আগে বলো, শুনি, বললো সে। তারপর দেখবো কি করা যায়।

বললাম আমি। অবশ্যই পুরোপুরি নয়, যতটুকু বললে বৃদ্ধের বিশ্বাস হবে সত্যিই আয়শা আগুনে পুড়ে মারা গেছে, এবং তাতে আমাদের কোনো দায় নেই। ততটুকু বললাম। কি কষ্ট করে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি তা-ও বললাম। কিন্তু মুখ দেখেই বুঝলাম, আয়শা মরে গেছে এ কথা বিশ্বাস করেনি সে। তার ব্যাখ্যা হলো, কিছুক্ষণ বা কিছুদিনের জন্যে অদৃশ্য হয়েছে সে। সময় হলেই আবার ফিরে আসবে।

এবার কি করবে তোমরা, বেবুন? জানতে চাইলো বিলালি।

জানি না, পিতা, আমি বললাম। এদেশ থেকে পালাতে পারি না আমরা?

মাথা নাড়লো বৃদ্ধ। কাজটা খুবই কঠিন, পুত্র। কোর-এর ওপর দিয়ে যেতে পারবে না। তোমাদেরকে একা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপিয়ে পড়বে পশুগুলো। তারপর একটু চুপ করে থেকে বললো, তবে হ্যাঁ, ঐ পাহাড়ের ওপর দিয়ে একটা পথ আছে। তোমাকে বোধহয় একবার বলেছিলাম পথটার কথা? ও পথে ওরা পশুর পাল নিয়ে যায় চারণভূমিতে। চারণভূমি পেরিয়ে জলার ওপর দিয়ে। তিনদিনের পথ। তারপর আর কিছু জানি না আমি। শুনেছি, ওখান থেকে সাত দিনের পথ পেরোলে বিরাট এক নদী পড়ে। ঐ নদী চলে গেছে কালো পানি। পর্যন্ত।

পিতা, বললাম আমি। আমি একবার প্রাণ বাঁচিয়েছি আপনার, এবার প্রতিদান দিন। এ পথেই নিয়ে চলুন আমাদের। জলাভূমিটা পার করে দিন, বাকিটা আমরাই চলে যেতে পারবো।

পুত্র, আমাকে অকৃতজ্ঞ ভেবো না। আমার প্রাণের প্রতিদান আমি দেবো। কাল ভোর নাগাদ তৈরি হয়ে থাকবে। আমি এখন যাচ্ছি, কয়েকটা পালকি জোগাড় করে আনতে পারি কিনা দেখি। আশা করি পিরবো, ওদের বলবো, সে যাকে-মানতেই-হবের নির্দেশ এটা, যে এ নির্দেশ মানবে না সে হায়েনার খাদ্য হবে। এ কথা শুনলে ওরা রাজি না হয়ে পারবে না। জলা পেরোনোর পর দরকার। হলে ওদের নিহত করে পালাতে হবে তোমাদের। এখন দেখ, সিংহ বোধহয় জাগলো। তোমরা খাওয়া-দাওয়া করে নাও। আমি যাই।

চলে গেল বিলালি। দীর্ঘ ঘুম দিয়ে মোটামুটি তাজা হয়ে উঠেছে লিও। দুজন গোগ্রাসে খেয়ে নিলাম পাঁচ জনের খাবার। তারপর কাছের এক ঝরনায় গিয়ে গোসল করে এলাম। তারপর আবার ঘুম।

একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমোলাম। তারপর আবার খেয়ে নিয়ে আবার ঘুম।

ভোর রাত নাগাদ পাকি বেহারা এবং দুজন পথ প্রদর্শক নিয়ে হাজির হলো। বিলালি।

‘সে’র ভয় দেখানোতে কাজ হয়েছে, বললো বৃদ্ধ। তোমরা তৈরি হয়ে নাও। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়তে হবে। আমিও যাবো তোমাদের সাথে।

বৃদ্ধের শেষ কথাটায় অত্যন্ত স্বস্তি বোধ করলাম। যত-ই সের ভয় দেখানো হোক না কেন, মানুষখেকোগুলোকে বিশ্বাস নেই। বিলালির জন্যে গভীর এক শ্রদ্ধাবোধে পূর্ণ হয়ে গেল অন্তর।

ভোরের প্রথম আলো ফুটবার সঙ্গে সঙ্গে সামান্য কিছু খেয়ে নিয়ে পাকিতে চাপলাম আমরা। সমভূমির ওপর দিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর শুরু হলো পাহাড়ের উঁচু নিচু ঢাল বেয়ে ওঠা। ঝাকুনির চোটে অস্থির হয়ে উঠলাম।

দুপুর নাগাদ পাহাড়টার সমতল চূড়ায় পৌঁছুলাম। এখানে কিছু খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলো বাহকরা। আমরাও খাওয়া সেরে নিলাম। তারপর আবার পথ চলা। আগ্নেয়গিরির মতো দেখতে পাহাড়টার ঢাল বেয়ে ক্রমশ নেমে যাচ্ছি। জলাভূমির দিকে।

সন্ধ্যার একটু আগে জলাভূমির কিনারে পৌঁছুলাম। রাতটা এখানেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো বিলালি। পরদিন সকাল এগারোটা নাগাদ আবার শুরু হলো আমাদের যাত্রা, সেই ভয়ানক জলাভূমির ওপর দিয়ে।

পুরো তিন দিন কাদা আর দুর্গন্ধের ভেতর দিয়ে পালকি বয়ে নিয়ে গেল বাহকরা। চতুর্থ দিন সকালে আমাদের বিদায় জানালো বিলালি।

বিদায়, পুত্র বেবুন, বললো সে। বিদায় তোমাকেও, সিংহ। তোমাদের আর কোনো সাহায্য আমি করতে পারবো না। তবে একটা পরামর্শ দি-ই, যদি ভালোয় ভালোয় দেশে ফিরে যেতে পারে, আর কখনো এমন অজানা অচেনা দেশের পথে পা বাড়িও না। পরের বার হয়তো আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না, একটু থামলো বৃদ্ধ। তোমার কথা আমার মাঝে মাঝেই মনে পড়বে, বেবুন, তুমিও সম্ভবত ভুলবে না আমাকে, কারণ আমি বুঝেছি, তুমি কুৎসিত হলেও, মনটা তোমার খাঁটি।

আর কিছু বললো না বুড়ো। ঘুরে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করলো। অনুসরণ করলো দীর্ঘ বলিষ্ঠ আমাহ্যাগারগুলো। আমরা দেখতে লাগলাম, আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে শূন্য পাকির মিছিলটা। একটু পরেই হারিয়ে গেল একটা বাকের আড়ালে।

মাত্র তিন সপ্তাহ আগে কোর-এর জলাভূমিতে ঢুকেছিলাম আমরা। তখন চারজন ছিলাম। তিন সপ্তাহ পর আজ যখন বেরিয়ে এলাম, দুই-এ নেমে এসেছে আমাদের সংখ্যা। মাত্র তিন সপ্তাহে কত কিছু ঘটেছে একবার কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। থই পেলাম না কোনো। মনে হলো, শেষ যখন আমাদের তিমি নৌকাটা দখেছিলাম, ত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে তারপর।

এবার নদীটা খুঁজে বের করতে হবে, বললাম আমি।

নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকিয়ে পা বাড়ালো লিও। গায়ের পোশাক ছাড়া আমাদের সঙ্গে এখন একটা ছোট কম্পাস, দুটো রিভলভার, দুটো এক্সপ্রেস রাইফেল আর শদুয়েক গুলি ছাড়া আর কিছু নেই। এখানেই শেষ আমাদের কাহিনি।

এরপর কি করে আমরা ইংল্যাণ্ডে পৌঁছুলাম, সে আর এক ইতিহাস। অমানুষিক পরিশ্রম করে নদীটার কাছে পৌঁছতে পেরেছিলাম। এ জন্যে বিলালি যেখানে ছেড়ে যায় সেখান থেকে প্রায় একশো সত্তর মাইল দক্ষিণে আসতে হয়েছিল আমাদের। ওখানে জংলী এক উপজাতির হাতে বন্দী হই। লিওর অসম্ভব সুন্দর চেহারা আর তুষারশুভ্র চুল দেখে ওকে অতিপ্রাকৃত কোনো জীব মনে করেছিল ওরা। ছমাস পর ওদের হাত থেকে পালাতে পারি আমরা। তারপর সাঁতরে নদী পার হয়ে আরো দক্ষিণে এগোতে থাকি। এক পর্যায়ে অনাহারে মৃত্যু যখন নিশ্চিত তখন এক পর্তুগীজ হাতি শিকারি দেখতে পায় আমাদের। তার সাহায্যে অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম করে ডেলাগোয়া উপসাগরে পৌঁছাই। সেখান  থেকে অন্তরীপ ঘুরে চলাচল করে যে স্টীমবোটগুলো তার একটাতে করে ইংল্যাণ্ড। যেদিন রওনা হয়েছিলাম তার ঠিক দুবছর পর আমরা পা রাখলাম। সাউদাম্পটন বন্দরের জেটিতে।

.

দুহাজার বছরেরও আগে যে কাহিনির শুরু তা শেষ হলো এভাবে। কিন্তু সত্যিই কি শেষ হয়েছে? কেন জানি না, আমার কেবলই মনে হয়, না, শেষ হয়নি। দূর ভবিষ্যতের গর্ভে হয়তো এর শেষ লুকিয়ে আছে।

সেই প্রাচীন ক্যালিক্রেটিস কি সত্যিই লিও হয়ে পুনর্জন্ম নিয়েছে পৃথিবীতে? নাকি দুজনের চেহারার অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখে ভুল করেছিল আয়শা? আরেকটা প্রশ্ন: পুনর্জন্মের এই নাটকে উস্তেনের ভূমিকা কি? প্রাচীন মিসরীয় রাজকুমারী আমেনার্তাসের সঙ্গে কি কোনো সাদৃশ্য আছে ওর? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা নেই আমার। শুধু এটুকু আমার মনে হয়, লিওর ব্যাপারে কোনো ভুল। করেনি সে।

আজকাল প্রায় রাতেই আমি একা বসে বসে ভাবি, এই নাটকের শেষ দৃশ্যের অভিনয় হবে কবে? এবং মিসরীয় রাজকন্যা সুন্দরী আমেনার্তাস কি ভূমিকা নেবে তাতে?

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *