২১-২৫. দেখ কোথায় আমি ঘুমিয়েছি

২১.

দেখ, কোথায় আমি ঘুমিয়েছি গত দু’হাজার বছর। লিওর হাত থেকে প্রদীপটা নিয়ে উঁচু করে ধরলো আয়শা। মেঝের ছোট্ট একটা গর্তে পড়লো আলো। সেরাতে এখানেই সেই লাফিয়ে ওঠা আগুন জ্বলতে দেখেছিলাম। আলো পড়লো পাথরের বিছানায় কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা মৃর্তিটার ওপর। সেদিন যেমন দেখেছিলাম, আজও তেমনি গুইয়ে রাখা। অন্য পাশের শূন্য বিছানাটা দেখলাম, এখনও তেমন শূন্য পড়ে আছে।

এখানে, শূন্য পাথরের ওপর হাত রেখে বলে যেতে লাগলো আয়শা, এখানেই আমি ঘুমিয়েছি যুগ যুগ ধরে রাতের পর রাত। আমার প্রিয়তম যেমন নিরেট পাথরের ওপর শুয়ে আছে আমিও তেমনি ওয়েছি, নরম বিছানার কথা ভাবতেও পারিনি। কতটা বিশ্বস্ত থেকেছি তোমার কাছে, ভেবে দেখ, ক্যালিক্রেটিস! তুমিই যে ক্যালিক্রেটিস এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না? তাহলে এসো, দেখাই, জীবিত তুমি, মৃত তোমাকে দেখবে। তৈরি তোমরা?।

জবাব দেয়ার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না আমরা, বিস্মিত দৃষ্টিতে আমি আর লিও তাকালাম একে অপরের দিকে।

ভয় পেও না। কাপড় ঢাকা মূর্তিটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে ধরলো কাপড়ের একটা কোনা। ১২০

ভয় পেও না, ক্যালিক্রেটিস, আবার বললো সে। সত্যিই তুমি বহু বছর আগে এক সময় হেসে খেলে বেরিয়েছে এই পৃথিবীতে, বুক ভরে টেনে নিয়েছো বাতাস। তারপর মরে গিয়েছিলে তুমি, তোমার আত্মা বেরিয়ে এসেছিলো তোমার দেহ ছেড়ে। দুহাজার বছর পর আবার তুমি জন্ম নিয়ে এসেছে এই পৃথিবীতে।

দেখ!

একটানে কাপড়টা সরিয়ে ফেললো আয়শা। প্রদীপের আলো ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়লো দেহটার ওপর। আমি দেখলাম, সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে এলাম আতঙ্কে। অবিশ্বাস্য সে দৃশ্য! পাথরের ওপর শুয়ে আছে লিও!-না, সাদা পোশাক পরা একটা মানুষ, হুবহু লিওর মতো দেখতে! লিওর দিকে তাকালাম আমি। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, জীবিত। আবার চোখ গেল পাথরের ওপর শোয়ানো মূর্তিটার দিকে-লিও, শুয়ে আছে, মৃত।

ঢাকো ওটা! চিৎকার করে উঠলো লিও। এখান থেকে নিয়ে চলো আমাকে!

না, ক্যালিক্রেটিস, দাঁড়াও, আবেদন জানালো আয়শা। দাঁড়াও, আরো দেখার আছে। আমার কোনো পাপই তোমার কাছে লুকিয়ে রাখবো না। হলি, মৃত ক্যালিক্রেটিসের বুকের কাপড়টা সরাও তো।

কম্পিত হাতে আয়শার নির্দেশ পালন করলাম আমি। উন্মুক্ত হয়ে গেল মৃত ক্যালিক্রেটিসের প্রশস্ত বুকটা। আতঙ্কিত চোখে দেখলাম, তার বাঁ পাশে ঠিক হৃৎপিণ্ড বরাবর গভীর একটা ক্ষত। বল্লম অথবা ছোরা দিয়ে আঘাত করেছিলো

দেখেছো, ক্যালিক্রেটিস, বললো আয়শা। আমিই তোমাকে হত্যা করেছিলাম। জীবনের বদলে দিয়েছিলাম মৃত্যু। মিশরীয় রাজকন্যা আমেনার্তাস-এর কারণে হত্যা করতে হয়েছিলো তোমাকে, ওকে তুমি ভালোবাসতে, নির্দয়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলে আমার ভালোবাসা। ওকেই আমি মারতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার চেয়ে ওর ক্ষমতা ছিলো বেশি। যা-ই হোক, তুমি ফিরে এসেছো আমার কাছে। এখন আবার কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াবে তোমার আমার মাঝে, কিছুতেই তা সহ্য করবো না আমি। শোনো, ক্যালিক্রেটিস, এখানে এসে কেমন ফিসফিসে আর স্বপ্নিল হয়ে উঠলো আয়শার গলা, আমি—আমি তোমাকে জীবন দেবো, অবশ্যই অনন্ত জীবন নয়-অনন্ত জীবন কেউ দিতে পারবে না, আমি যা দেবো তাতে তোমার বর্তমান যৌবন আর চেহারা নিয়ে হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকবে। শুধু তা-ই নয়, ধন, সম্পদ, ক্ষমতা—মোটকথা ভোগ করার মতো যাবতীয় জিনিস চলে আসবে তোমার হাতের মুঠোয়। আর একটা কথা, এখন থেকে বিশ্রাম নেবে তুমি, তৈরি হবে সেদিনের জন্যে, যেদিন নব জন্ম হবে তোমার।

থামলো আয়শা। একটু পরেই আবার অনেকটা আপন মনে বলে উঠলো, আমি তো জীবন্তকেই পেয়ে গেছি, মৃতকে আর ধরে রেখে লাভ কি? যে ধুলো থেকে এসেছিলো, তাতেই মিশে যাক!

অন্য পাথরের তাকটার কাছে চলে গেল সে। বড় একটা মুখ আঁটা দুই হাতলওয়ালাপাত্র তুলে নিয়ে আবার চলে এলো এপাশে। ঝুঁকে আলতো করে চুমু খেলো মৃত লোকটার কপালে। তারপর সাবধানে পাত্রের মুখ খুলে একটু একটু করে মৃত দেহটার ওপর ঢেলে দিতে লাগলো পাত্রের তরল পদার্থ। সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় ধোয়ার মতো ভাপ উঠতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্পূর্ণ গুহা ভরে গেল ধোয়ায়। খুক খুক করে কাশতে শুরু করলাম আমরা, চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বিজ-জ-জ-জ একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি কেবল।

কয়েক মিনিট কাটলো এভাবে। একটু একটু করে সরে যাচ্ছে সাদা ধোয়া। কিছুক্ষণের ভেতর পরিষ্কার হয়ে গেল গুহা। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, একটু আগেও যেখানে ছিলো ক্যালিক্রেটিসের মৃতদেহ সেখানে এখন খানিকটা সাদা গুঁড়ো ছাড়া আর কিছু নেই।

ধুলো মিশে গেল ধুলোর সঙ্গে। অতীত হারিয়ে গেল অতীতে!-মৃত ক্যালিক্রেটিস জন্ম নিয়েছে আবার! আপন মনে, কথাগুলো বললো আয়শা। তারপর আমাদের দিকে ফিরে, এবার যাও তোমরা। পারলে একটু ঘুমিয়ে নাও। কাল সন্ধ্যায় আমরা রওনা হবো; দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে।

.

ঘরে ফিরেই কান্নায় ভেঙে পড়লো লিও।

কি করবো আমি, হোরেস কাকা? আমার কাধে মাথা রেখে বললো সে। ওকে মেরে ফেললো, আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম! কিছু তো করতে পারলামই না, উপরন্তু পাঁচ মিনিটের ভেতর খুনী মেয়েলোকটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম! এত নীচে নেমে গেছি আমি! উহুঁ, ঈশ্বর! কিন্তু কি করবো? আমি তো ঠেকাতে পারছি না নিজেকে। পুরোপুরি ওর শক্তির অধীনে চলে গেছি। চুম্বক যেমন টানে লোহাকে, তেমনি ও-ও সারা জীবন পেছন পেছন টেনে নিয়ে বেড়াবে আমাকে। কি করবো আমি, হোরেস কাকা, বলো? আমি ওকে ঘৃণা করি, অন্তর থেকে ঘৃণা করি, তবু কেন মন থেকে তাড়াতে পারছি না ওর চিন্তা?।

কি বলবো আমি? আমারও যে একই অবস্থা! এবং এই প্রথম বারের মতো আমি লিওকে জানালাম সে কথা। দেখলাম, একটুও ঈর্ষাকাতর হলো না লিও, বরং নিজের দুঃখ ভুলে একটু সমবেদনা জানালো আমাকে।

পালানোর কথা ভাবলাম একবার। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল করে দিলাম সে চিন্তা। সম্ভব নয় পালানো। চেষ্টা করার আগেই টের পেয়ে যাবে আয়শা। তারপর কি ঘটবে ভেবে পেলাম না। তবে এটুকু বুঝলাম, ভয়ানক কিছুই ঘটবে।

নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বিচার করে দেখলাম আমাদের অবস্থা। কিন্তু কোনো থই পেলাম না। আমাদের হাতে কিছুই নেই, সব আয়শার নিয়ন্ত্রণে। সে যা করবে তা-ই হবে। সুতরাং ও নিয়ে আর না ভেবে শুয়ে পড়ার পরামর্শ দিলাম। লিওকে। আমিও শুয়ে পড়লাম নিজের বিছানায় গিয়ে।

.

২২.

পরদিন দুপুরের কিছু আগে বিলালি এসে জানালো সে ডেকেছে আমাদের। সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলাম আমরা। যতারীতি দুজন সুন্দরী পরিচারিকা পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। পরিচারিকা দুজন বেরিয়ে যেতেই মুখ থেকে আবরণ সরালো আয়শা। এগিয়ে এসে আলিঙ্গন করলো লিওকে। তারপর ওর মাথায় হাত রেখে বললো, জানো, ক্যালিক্রেটিস কখন তুমি সত্যিই আমার হবে? বলছি, শোনো, প্রথমে আমার মতো হতে হবে তোমাকে, অবশ্যই অমর নয়, কারণ আমিও অমর নই। তবে সময় যাতে তার ছাপ এঁকে দিতে না পারে তোমার চেহারায়, শক্তিতে; সে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে কখনোই আমরা মিলিত হতে পারবো না, কারণ তোমার আর আমার ভেতর পার্থক্য রয়েছে। আমার অস্তিত্বের তেজ তোমাকে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে ফেলবে। থামলো আয়শা। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে, আবার বলতে লাগলো, আজ বিকেলে, সূর্য ডোবার একঘণ্টা আগে আমরা রওনা হবো, এবং সবকিছু যদি ঠিক ঠাক থাকে, আমি যদি পথ ভুল না করিসে সম্ভাবনা অবশ্য খুবই কম, কাল সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছে যাবো জীবনের অগ্নিস্তম্ভের কাছে। সেই আগুনে স্নান করে তুমি পরিশুদ্ধ হবে। তারপর, প্রিয়তম ক্যালিক্রেটিস, তুমি আমার স্বামী হবে, আমি হবো তোমার স্ত্রী।

বিড়বিড় করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো লিও। কি তা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। ওর দ্বিধা দেখে একটু হাসলো আয়শা।

 আর তোমাকেও, হলি, বলে চললো সে, এই অনুগ্রহ দান করবো আমি। তুমিও স্নান করবে জীবনের আগুনে। তারপর দেখবে, চিরসবুজ হয়ে গেছ তুমি। তোমাকে এ সুযোগ দেবো, কারণ-কারণ তুমি খুশি করতে পেরেছে আমাকে।

ধন্যবাদ, আয়শা, যথাসম্ভব গাম্ভীর্য রক্ষা করে জবাব দিলাম। কিন্তু আমি চাই না অমন দীর্ঘ জীবন। আজকের পৃথিবীতে জীবন ধারণ করাটা খুব সুখের ব্যাপার নয়। হানাহানি, মারামারি, দুঃখ-বেদনা, এত বেড়ে গেছে; প্রাণ টিকিয়ে রাখা এত কষ্টকর হয়ে পড়েছে যে, আমার মনে হয় যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বিদায় নেয়া যায় ততই মঙ্গল।

দীর্ঘ জীবন এবং অপরিমেয় শক্তি আর সৌন্দর্য পেলে কোনো দুঃখ কষ্টই আর থাকবে না। দুনিয়ার যাবতীয় মহার্ঘ বস্তু তোমার হাতের মুঠোয় এসে যাবে।

তাতেই বা কি লাভ, আয়শা? উচ্চাকাঙ্ক্ষা জিনিসটা অসীম একটা মই ছাড়া তো কিছু নয়, উঠে যাও, উঠে যাও, উঠে যাও; তবু শেষ পাবে না কোনো। ফলে অতৃপ্তিও ঘুচবে না কোনোদিন। তারচেয়ে আমি যে জীবন নিয়ে জন্মেছি, সে জীবন নিয়েই থাকতে চাই। মৃত্যুর সময় হলে মরে যাবো, দুনিয়ার মানুষ আমাকে মনে রাখলো কি না রাখলো, তাতে কিছুই এসে যায় না।

মনে হচ্ছে তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, দীর্ঘ জীবন চাও না, একটু হাসলো আয়শা। কিন্তু একদিন তুমি আক্ষেপ করবে, হলি, আরেকটু যখন বয়স বাড়বে, দেহের চামড়া হাজার হাজার ভাজ পড়ে ঝুলে যাবে, মগজের ক্ষমতা কমে আসবে, মানুষের সাহায্য ছাড়া চলতে পারবে না, তখন–তখন তুমি হায়-হায় করবে, হলি; বলবে, কি সুযোগটা পেয়েও হারিয়েছি।

কোনো জবাব দিলাম না আমি। লিওর সামনে কি করে আয়শাকে জানাবো, কেন আমি দীর্ঘ জীবন চাই না? যে মুহূর্তে তার রূপ দেখেছি এবং নিঃসংশয়ে জেনেছি কোনোদিনই তাকে পাবো না, সে মুহূর্ত থেকে মৃত্যুই হয়ে উঠেছে আমার একমাত্র কামনা। কি করেই সত্যি কথাটা স্বীকার করবো আয়শার কাছে?

যাকগে, তোমার ভালোমন্দ তুমিই বুঝবে, বলে লিওর দিকে ফিরলো আয়শা। প্রিয়তম ক্যালিক্রেটিস, কাল রাতে কি যেন বলছিলে তুমি? মৃত ক্যালিক্রেটিস নাকি তোমার পূর্ব পুরুষ? কি করে, বলো দেখি।

বললো লিও, কারুকাজ করা রূপোর বাক্সের ভেতর পাওয়া পোড়ামাটির ফলক, তার উপর মিসরীয় রাজকন্যা আমেনার্তাসের লেখা আশ্চর্য আখ্যান, কি করে ওগুলো ওর হাতে পৌঁছেছে সব একে একে বলে গেল।

মনোযোগ দিয়ে শুনলো আয়শা। তারপর বললো, হুঁ, এরকমই হয়। ভালোর ভেতর থেকে কখন মন্দ, বা মন্দের ভেতর থেকে কখন যে ভালো বেরিয়ে আসবে কেউ বলতে পারে না। বীজ বোনার সঙ্গে সঙ্গে কি মানুষ বলতে পারে ফল কেমন হবে? দেখ, এই মিসরীয় রাজকন্যা আমেনার্তাস, ঘৃণা করতো আমাকে, আমিও ঘৃণা করতাম ওকে—এখনো করি। সে তার ছেলের উদ্দেশ্যে লিখে রেখে গেছিলো যেন পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়। কিন্তু বাস্তবে কি ঘটলো? তার ছেলে পারলো না প্রতিশোধ নিতে। বরং প্রায় দুহাজার বছর পরে তারই এক উত্তর পুরুষ; তারই লিখে রেখে যাওয়া পথের নিশানা অনুসরণ করে এলো, প্রতিশোধ নিতে নয়, রহস্য উন্মোচন করতে।

থামলো সে, তারপর আবার শুরু করলো, প্রিয়তম ক্যালিক্রেটিস, রহস্য উন্মোচিত হয়েছে, আবেগে উত্তেজনায় কাঁপছে তার গলা। এবার কি প্রতিশোধ নেবে? আমি যে ক্যালিক্রেটিসকে হত্যা করেছিলাম সে তোমার পূর্ব পুরুষ, এক হিসেবে তুমি তার পুত্র, মায়ের আদেশ অনুযায়ী তোমার উচিত আমাকে হত্যা করা। দেখ, হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো আয়শা। বুকের কাপড় টেনে নামিয়ে আনলো নিচে, একটা স্তন সম্পূর্ণ অনাবৃত হয়ে গেল। দেখ, ক্যালিক্রেটিস, এখানে-এখানে স্পন্দিত হচ্ছে আমার হৃৎপিণ্ড, আর ঐ যে ওখানে রয়েছে ছুরি, ভারি, লম্বা, ধারালো। এটা নিয়ে এসো, বিধিয়ে দাও এখানে! হত্যা করো আমাকে! অতীতের রায় কার্যকর হোক!

নিঃশব্দে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো লিও। তারপর এগিয়ে গিয়ে ধরলো ওকে। ওঠো আয়শা, গাঢ় স্বরে বললো লিও। ভালো করেই জানো, তোমাকে আঘাত করার সাধ্য আমার নেই। কাল রাতে যাকে তুমি হত্যা করেছে তার খাতিরেও না। পুরোপুরি তোমার শক্তির অধীন আমি, আমি তোমার দাস। কি করে তোমাকে হত্যা করবো?—হয়তো শিগগিরই আমি নিজেকেই হত্যা করবো!

এই তো, আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছো, ক্যালিক্রেটিস, মৃদু হেসে। বললো আয়শা। ঠিক আছে, এখন যাও তোমরা। যাত্রার জন্যে তৈরি হতে হবে আমাকে তোমরাও তৈরি হয়ে নাসতামাদের চাকরটাকেও সঙ্গে নিতে পারো। জিনিসপত্র বেশি নেয়ার দরকার নেই। খুব বেশি হলে তিন দিন আমরা বাইরে থাকবো। তারপর এই অভিশপ্ত কোর ছেড়ে রওনা হয়ে যাবো। তোমাদের দেশে বা অন্য কোনো সুন্দর জায়গায় গিয়ে বসতি করবো আমরা।

.

২৩.

তৈরি হতে খুব বেশিক্ষণ লাগলো না আমাদের। গায়ের কাপড়গুলো বদলে নিলাম, হাতব্যাগে ভরলাম কয়েক জোড়া অতিরিক্ত জুতো, ব্যস! এ ছাড়া আর যা সঙ্গে নিলাম তা হলো, আমার আর লিওর রিভলভার আর এক্সপ্রেস রাইফেল দুটো। গুলি নিলাম প্রচুর; বলা যায় না কি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় আগামী তিন দিনে।

নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট আগে আমরা আয়শার পর্দাঘেরা কুঠরিতে গেলাম। সে-ও তৈরি। স্বাভাবিক পোশাকের ওপর কালো আলখাল্লা চড়িয়েছে। মুখ যথারীতি ঢাকা।

তৈরি তোমরা? রওনা হওয়া যায় এখন? জিজ্ঞেস করলো সে।

হ্যাঁ, কিন্তু, আয়শা, এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তোমার এই…

আহ, হলি, তুমি সেই পুরানো দিনের ইহুদীদের মতোই অবিশ্বাসী, অজানা কোনো কিছু বিশ্বাস করতে চাও না। যাক সে, সময় হলেই দেখতে পাবে। এখন চলো নতুন জীবনের পথে রওনা হই আমরা—কোথায় গিয়ে শেষ হবে সে পথ কে জানে?

ঠিক, কোথায় গিয়ে শেষ হবে, কে জানে? প্রতিধ্বনি করলাম আমি।

বেরিয়ে এলাম আমরা আয়শার কুঠুরি ছেড়েবড় গুহার ভেতর দিয়ে বাইরে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালাম। একটা মাত্র পাকি রাখা গুহার মুখে। ছজন বাহক, সবাই বোবা-কালা। লক্ষ করলাম, ওদের সাথে অপেক্ষা করছে আমাদের পুরানো বন্ধু বিলালি। আমাদের সাথে সে-ও যাচ্ছে দেখে বেশ স্বস্তি বোধ করলাম মনে মনে। একটা মাত্র পালকি দেখে প্রথমে একটু ভুরু কোঁচকালেও পরে মনে হলো, নিশ্চয়ই কোনো ব্যাপার আছে, যে কারণে আয়শা ঠিক করেছে সে একাই পালকিতে যাবে আর বাকিরা যাবে হেঁটে। হেঁটে যেতে হবে ভেবে খুব একটা যে মুষড়ে পড়লাম তা অবশ্য নয়, গত কয়েকদিন শুয়ে বসে থেকে হাত-পায়ে জড়তা এসেছে। এখন হাঁটতে ভালোই লাগবে। ঘটনাক্রমে না সে-র নির্দেশে জানি না, গুহামুখের সামনে চত্বরটা ফাঁকা। বাহক ছ’জন আর বিলালি ছাড়া একটা লোকও নেই। সম্ভবত আয়শা চায়নি, কেউ দেখুক বা জানুক সে বাইরে যাচ্ছে। তার বোবা-কালা পরিচারক-পরিচারিকারা অবশ্য জেনেছে, তবে তাতে কিছু এসে যায় না। ওরা কাউকে কিছু বলতে পারবে না।

কয়েক মিনিটের ভেতর আমরা সবুজ শস্যক্ষেত্র আর সেই শুকিয়ে যাওয়া হ্রদের ওপর দিয়ে এগিয়ে চললাম। সূর্য এখনো ডোবেনি, তবে শিগগিরই ডুববে। প্রতিদিনের মতো আজও ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসছে কোর-এর সমভূমি। দূরে প্রাচীন কোর নগরীর ধ্বংসস্থূপ দেখালো আমাদের বিলালি। ধ্বংসস্তূপের বিস্তৃতি আর উচ্চতা দেখেই বুঝতে পারলাম, আসল নগরটা কেমন বিশাল, সুন্দর আর গগনচুম্বী ছিলো। প্রাচীন থিবি বা ব্যাবিলনের কথা মনে পড়ে গেল আমার। ওগুলোর মতোই বর্ধিষ্ণু নগর ছিলো এই কোর-ও। কালের করাল গ্রাসে আজ কি অবস্থা!

সূর্য পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার মিনিট দশেক আগে ধ্বংসস্তূপের প্রান্তে পৌঁছুলাম আমরা। প্রায় ষাট ফুট চওড়া পরিখা দিয়ে ঘেরা পোড়া নগরীটা। পরিখার বেশির ভাগ জায়গা-ই হেজে-মজে গেছে, তবে দু’এক জায়গায় পানি আছে এখনো। পরিখার ওপাশেই পাথরের দেয়াল। জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে। কোর-এর নির্মাতারা ভালোমতোই সুরক্ষিত করেছিলো তাদের নগরীকে।

পাড় ধরে কিছুদূর এগোনোর পর পরিখার এক জায়গায় দেখলাম স্তূপ হয়ে আছে ইট-কাঠ-পাথরের নানা আকারের টুকরো। এক কালে নিশ্চয়ই পুল ছিলো এখানে।

অনেক কষ্টে সেতুটা পেরোলাম আমরা। তারপর দেয়ালের ভাঙা একটা অংশ দিয়ে ঢুকে পড়লাম নগরে।

নগরীর রাজপথ ধরে এগিয়ে চলেছি। এখন অবশ্য আর রাজপথ বলে চেনা যায় না, ঘাস আর ঝোপ-ঝাড়ে ছেয়ে গেছে। দুপাশের বিশাল বিশাল সৌধগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়েছে পথের ওপর। যেগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে, দাঁত বের করা। মড়ার খুলির চেহারা হয়েছে সেগুলোর। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল আমার শরীরে-হাজার হাজার বছরের মধ্যে আমরাই হয়তো প্রথম হাঁটছি এই পথ দিয়ে!

অবশেষে বিরাট এক অট্টালিকার সামনে পৌঁছুলাম আমরা। কমপক্ষে আট একর জমির ওপর মাথা তুলে আছে দালালটা। চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম, এক কালে মন্দির ছিলো। সারি সারি বিশাল স্তম্ভ ধরে রেখেছে ছাদগুলো। অদ্ভুত আকৃতি সে সব স্তম্ভের। নিচের দি্কে সরু, মাঝখানে মোটা ওপর দিকে আবার সরু হয়ে গেছে ক্রমশ।

আয়শার নির্দেশে বিশাল মন্দিরটার সামনে থেমে দাঁড়ালো আমাদের ছোট্ট মিছিল। পালকি থেকে নামলো আয়শা।

নিশ্চিন্তে রাত কাটানোর মতো একটা জায়গা ছিলো এখানে, লিওর দিকে তাকিয়ে বললো সে। এখনও আছে না ভেঙে পড়েছে, কে জানে? দুহাজার বছর আগের কথা। তুমি আমি আর সেই মিসরীয় কালনাগিনী রাত কাটিয়েছিলাম ওখানে। চলো দেখা যাক।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো সে। আমরাও চললাম পেছন পেছন। অসংখ্য ধাপ সিঁড়িটার। কালের গ্রাসে ক্ষয়ে গেছে কোনো কোনো জায়গা। উঠতে উঠতে হাঁপ ধরে গেল। অবশেষে উপরে পৌঁছুলাম। বাঁ দিকে ঘুরে কিছুটা এগিয়ে গেল আয়শা। উঁকি দিলো অন্ধকারের ভেতর। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে আরো কয়েক পা এগোলো। তারপর ফিরলো আমাদের দিকে।

আছে এখনো, ভেঙে পড়েনি, বললো সে। তারপর দুই বেহারাকে ইশারায় বললো সব জিনিসপত্র নিয়ে উঠে আসতে।

জিনিসপত্র নিয়ে আসার পর বাহকদের একজন একটা প্রদীপ জ্বাললো। আমাহাগাররা যখন কোথাও যায়, সঙ্গে সবসময় ছোট্ট একটা পাত্রে খানিকটা আগুন বহন করে। মাঝে মাঝে তাতে জ্বালানী দিয়ে আগুনটা তাজা রাখে। এই আগুনের সাহায্যেই প্রদীপ জ্বাললো লোকটা। প্রদীপ জ্বলে উঠতেই আমরা ঢুকলাম সেখানে। বড় একটা কামরা। মাঝখানে বিরাট একটা পাথরের টেবিল।

ঝটপট কামরাটা পরিষ্কার করে শোয়ার বন্দোবস্ত করে ফেললাম। সঙ্গে আনা ঠাণ্ডা মাংস দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে নিলাম আমি, লিও আর জব। আয়শা ফল, ময়দার পিঠে আর পানি ছাড়া কিছু খেলো না। একটু পরেই চাঁদ উঠে এলো পাহাড়ের আড়াল থেকে। রূপালি আলোর বন্যায় প্লাবিত হয়ে গেল কোর-এর ধ্বংসস্তূপ।

আন্দাজ করতে পারো, হলি, এখানে কেন নিয়ে এসেছি তোমাদের? উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো আয়শা। শোনো—কিন্তু ক্যালিক্রেটিস, আশ্চর্য, এখন যেখানে তুমি শুয়ে আছো ঠিক ওখানেই তোমার মৃতদেহ পড়ে ছিলো, সেই কত বছর আগের কথা! আমি একা তোমার ঐ ভারি শরীরটা বয়ে নিয়ে গেছিলাম কোর-এর গুহায়। কি যে কষ্ট হয়েছিলো, মনে পড়লে এখনো শিউরে উঠি! সত্যি সত্যিই কেঁপে উঠলো তার শরীর।

শোনার সঙ্গে সঙ্গে লিও-ও যেন শিউরে উঠলো একটু। তাড়াতাড়ি উঠে জায়গা বদলে বসলো।

যাকগে, যা বলছিলাম, বলে চললো আয়শা, তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছি কারণ, এমন আশ্চর্য একটা জিনিস দেখাবো, যা কোনো মানুষের চোখ কখনো দেখেনি। আর্জপূর্ণিমা, আজই তো দেখার সময়! এই বিশাল মন্দির আর এখানে যাঁর পূজা হতো-দেখবে?

সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলাম আমরা। বিশাল মন্দিরের বিভিন্ন অংশ ঘুরিয়ে দেখালো আয়শা। আশ্চর্য এক গাম্ভীর্য তার নির্মাণশৈলীতে। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ছেয়ে গেল আমাদের মন। সুবিশাল, মহান কোনো কিছুর সামনে দাঁড়ালে যেমন অনুভূতি হয়, মাথা নোয়াতে ইচ্ছে করে, তেমন অনুভূতি। সারি সারি স্তম্ভ, ফাঁকা উঠোন, উঁচু উঁচু বিরাট কক্ষ-সবগুলো ফাঁকা, আর অন্তহীন নিস্তব্ধতা। ফিসফিস করে কথা বলছি আমরা, যেন জোরে বললেই জেগে উঠবে হাজার হাজার বছরের ঘুমন্ত মন্দির।

দেখছি আর দেখছি, কিন্তু তৃপ্ত হচ্ছে না চোখ, যত দেখছি ততই বেড়ে উঠছে দেখার আকাঙক্ষা।

এসো, অবশেষে বললো আয়শা। আসল জিনিস এখনো দেখা হয়নি।

সারি সারি থাম ঘেরা দুটো উঠোন পেরিয়ে মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে গেল সে আমাদের। লম্বায়-চওড়ায় পঞ্চাশ গজের মতো বর্গাকৃতির একটা চত্বর। এই উঠোনের চারদিকে যে দেয়াল আর থামগুলো তার কারুকাজ আরো সুন্দর, আরো নিখুঁত। যারা এ কাজ করেছে তারা যে বিশ্বের সর্বকালের সেরা শিল্পী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চত্বরের ঠিক মাঝখানে বিরাট একটা গোলক, কালো পাথর দিয়ে তৈরি। বিশফুট মতো হবে গোলকটার ব্যাস। তার ওপর অপূর্ব ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে ডানাওয়ালা এক মূর্তি। স্বর্গীয় সৌন্দর্য তার চোখে মুখে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় মূর্তিটা দেখে হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার অবস্থা হলো আমার।

শ্বেত মর্মরে তৈরি মূর্তিটা এত হাজার বছর পরেও এমন নিখুঁত আর চকচকে রয়েছে যে আমি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। ডানাওয়ালা মূর্তিটা নারীর সামান্য সামনে ঝুকে দাঁড়িয়ে আছে। গোটানো-ও নয়, ছড়ানো-ও নয়, মাঝামাঝি অবস্থায় রয়েছে ডানা দুটো। দুবাহু সামনে বাড়ানো, যেন অতি প্রিয় কোনো কিছুকে আলিঙ্গনের আহ্বান জানাচ্ছে। নিটোল, নিখুত মূর্তিটা সম্পূর্ণ নগ্ন—কেবল মুখটা ছাড়া। মুখটা এমন ভাবে তৈরি, দেখে মনে হয়, হালকা প্রায় স্বচ্ছ, কিন্তু পুরো স্বচ্ছ নয় এমন কোনো কাপড় দিয়ে ঢাকা। কাপড়টার দুই প্রান্ত ঝুলে আছে দুই স্তনের ওপর।

কার মূর্তি এটা? কোনো রকমে ওটার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

আন্দাজ করতে পারছে না, হলি? বললো আয়শা। তোমার কল্পনাশক্তি তাহলে কোথায়? সত্য দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর ওপর, সন্তানদের ডাকছে তার মুখের আবরণ উন্মোচন করার জন্যে। ভিত্তি প্রস্তরের ওপর কি লেখা রয়েছে দেখ।

দেখলাম সেই গুহার ভেতর যেমন দেখেছিলাম তেমন চীনা ছাঁদের লেখা। আয়শা অনুবাদ করে শোনালো:

আমার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করে আমার মুখের দিকে তাকানোর মতো মানুষ কি নেই পৃথিবীতে? খুবই সুন্দর আমার মুখ। যে আমার মুখাবরণ সরাতে পারবে, আমি তার হবো, এবং আমি তাকে শান্তি দেবো, জ্ঞানী পুণ্যবান সুকুমার সন্তান দেবো।

শুনে একটা কণ্ঠস্বর চিৎকার করে উঠলো, সবাই তোমার পেছন পেছন ছুটছে, তোমাকে কামনা করছে, দেখ! তবু তুমি কুমারী, আজীবন তুমি কুমারী-ই রইবে। কোনো মানবীর গর্ভে এমন কোনো মানুষ জন্মগ্রহণ করেনি যে তোমার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করার পরও বেঁচে থাকবে। একমাত্র মৃত্যুই তোমার মুখাবরণ সরাতে পারবে, হে সত্য!

এবং সত্য দুবাহু বাড়িয়ে দিয়ে কেঁদে উঠলো, কারণ, যারা তার প্রেমাকাক্ষী কথনোই তারা জয় করতে পারবে না তাকে, এমন কি তাকাতে পর্যন্ত পারবে না তার মুখোমুখি। বুঝতে পারছো? বললো আয়শা। প্রাচীন কোরবাসীদের দেবী ছিলো সত্য। তার উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছিলো এই মন্দির। ওরা নিঃসংশয়ে বুঝেছিলো, সত্যকে কোনো দিনই পাবে না তবু তারই উপাসনা করে গেছে সারা জীবন।

এবং তারপর, ভারাক্রান্ত গলায় বললাম আমি, আজ পর্যন্ত মানুষ খুঁজে চলেছে সত্যকে, কিন্তু পায়নি, এই উৎকীর্ণ লিপিতে যেমন বলা হয়েছে, পাবেও না, কারণ একমাত্র মৃত্যুর মাঝেই পাওয়া যায় সত্যকে।

আবার একটার পর একটা উঠোন পেরিয়ে ফিরে এলাম আমরা। আসার সময় একটা কথাই কেবল মাথার ভেতর ঘুরতে লাগলো আমার, পৃথিবী যে গোল তা অত বছর আগেও কি করে টের পেয়েছিলো কোরবাসীরা! আশ্চর্য! কতটা উন্নত হয়েছিলো ওদের বিজ্ঞান!

.

২৪.

পরদিন ভোর হওয়ার আগেই বোবা-কালা বাহকরা জাগিয়ে দিলো আমাদের। মন্দিরের বাইরে উঠোনের উত্তর কোনায় একটা মর্মর বাঁধানো ঝরনা থেকে এখনো পানি বেরোয়। কাপড়-চোপড় পরে সেটার কাছে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম আমরা। ফিরে এসে দেখি যাত্রার জন্যে তৈরি আয়শা। পালকির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বিলালি আর দুই বাহক তড়িঘড়ি বয়ে আনছে আমাদের জিনিসপত্র। যথারীতি মর্মর সত্যের মতো অবগুণ্ঠিত আয়শার মুখ। তবু কেন যেন-হয়তো ওকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই, আমার মনে হলো একটু বিন্দু হয়ে আছে সে।

আমাদের পদশব্দ শুনে মুখ তুলে তাকালো আয়শা। ভদ্রতাসূচক কুশল বিনিময় হলো। রাতে কেমন ঘুমিয়েছে, জিজ্ঞেস করলো লিও।

খারাপ ক্যালিক্রেটিস, জবাব দিলো সে, ভীষণ খারাপ! সারারাত আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছি। ওগুলোর অর্থ যে কি এখনো বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, অশুভ কিছুর ছায়া পড়েছে আমার ওপর। একটু থেমে কি যেন ভাবলো আয়শা। তারপর বললো, চলো রওনা হওয়া যাক। অনেক দূর যেতে হবে, আর দেরি করা উচিত হবে না।

পাঁচ মিনিটের ভেতর আবার পথে নামলাম আমরা। কোরনগরীর ধ্বংসাবশেষের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললাম। একেবারে সামনের পাকিতে আয়শা, তারপর বিলালি আর বদলি বাহক দুজন, তারপর আমি আর লিও এবং একেবারে শেষে জব। কেমন যেন মিইয়ে গেছে বেচারা। আসার আগে অনেক যুক্তি তর্কের জাল বিস্তার করে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো, ঐ ভয়ানক মেয়ে মানুষটার সঙ্গে যেন না আসি আমরা, কেমন যেন বিপদের গন্ধ পাচ্ছে ওর মন। পাত্তা দিইনি আমরা। বিপদের সম্ভাবনা আছে জানি, কিন্তু তাই বলে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবো তেমন লোক নই আমি, লিও তো নয়ই। এখনও বোধহয় সেই বিপদের বিভীষিকা দেখছে জব।

সূর্যের প্রথম রশ্মি পুব আকাশ আলোকিত করে তোলার আগেই নগরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম আমরা। আবার দেয়াল পেরিয়ে, একটা ভাঙা সেতু পেরিয়ে যখন সমভূমিতে উঠে এলাম তখন রাঙা হয়ে উঠছে পুব দিগন্ত।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর সকালের নাশতা সেরে নেয়ার জন্যে এক জায়গায় থামলাম আমরা। দিনের আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে আয়শার মনও ভালো হয়ে উঠেছে। দূরে দাঁড়ানো বিলালির দিকে ইশারা করে সে বললো, এই বর্বরগুলো অন্তর থেকে বিশ্বাস করে কোর-এর ওপর নাকি ভূতের আছর আছে। ওদের এই একটা কথা আমি সত্যিই বিশ্বাস করি। ওহ, এখনো স্পষ্ট দেখতে পাই, ক্যালিক্রেটিস, তুমি আমার পায়ের কাছে পড়ে আছো, প্রাণহীন! নাহ্, আর কখনো এ জায়গায় আসবো না, সত্যিই অশুভ জায়গাটা।

সামান্য সময়ের মধ্যেই নাশতা সেরে আবার রওনা হলাম আমরা। দুপুর দুটো নাগাদ পৌঁছে গেলাম বিশাল বিস্তৃত এক পাহাড়ী প্রাচীরের কাছে। সম্ভবত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে তৈরি হয়েছে প্রাচীরটা। দেড় থেকে দুহাজার ফুট উঁচু। প্রাচীরের গোড়ায় থামলাম আমরা।

এবার শুরু হবে আমাদের আসল যাত্রা, পালকি থেকে নেমে বললো আয়শা। ওদের এখানে রেখে পায়ে হেঁটে এগোবো আমরা। তারপর বিলালির দিকে ফিরে যোগ করলো, তুমি আর ঐ দাসগুলো থাকবে এখানে। অপেক্ষা করবে আমাদের জন্যে। আগামীকাল দুপুর নাগাদ ফিরে আসবো আমরা—যদি না-ও ফিরি অপেক্ষা করবে।

বিনীতি ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালো বিলালি, এবং জানালো, তাঁর মহান আদেশ পালিত হবে।

আর এই লোকটা, হলি, জবের দিকে ইশারা করে বললো আয়শা, ও-ও এখানে থাক। এখন থেকে যে পথে আমরা এগোবো, প্রচণ্ড মানসিক শক্তি আর সাহস না থাকলে খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে।

জবকে আমি অনুবাদ করে শোনালাম কথাটা। সঙ্গে সঙ্গে কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠলো ওর মুখ। অনুনয় করে বললো, আমরা যেন দয়া করে ওকে ফেলে রেখে না যাই। ইতিমধ্যে যা দেখেছে তার চেয়ে ভীতিজনক কিছু দেখতে হবে তা ওর বিশ্বাস হয় না। তাছাড়া এই বোবা-কালাদের কাছে রেখে গেলে ওকে হয়তো গরম-পাত্র করে খেয়েই ফেলবে।

আয়শাকে আবার অনুবাদ করে শোনালাম কথাগুলো।

কাঁধ ঝাঁকালো সে। ঠিক আছে, আমার কি? আসতে চাইলে আসুক। প্রদীপ আর ওটা বইতে হতো তোমাদের। এখন ও-ই পারবে। প্রায় সোল ফুট লম্বা সরু একটা তক্তা দেখালো আয়শা। পালকির ওপরে বাঁধা ছিলো, একটু আগে খুলে রেখেছে বাহকরা।

তক্তাটা উঁচু করে দেখলাম, অদ্ভুত হালকা, কিন্তু খুবই মজবুত। জবকে দেয়া হলো ওটা বইবার জন্যে, একটা প্রদীপও দেয়া হলো। অন্য প্রদীপটা দড়ি বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে নিলাম আমি, তেলের পাত্রটাও রইলো আমার কাঁধে। লিও নিলো খাবার-দাবার আর ছাগলের চামড়ার এক থলে ভর্তি পানি।

বিলালিকে ডাকলো আয়শা। শখানেক গজ দূরে একটা ম্যাগনোলিয়া ঝোপ দেখিয়ে বললো ছয় বেহারাকে নিয়ে সেটার পেছনে গিয়ে বসতে। মাথা নুইয়ে রওনা হলো তারা। বিলালি যাওয়ার আগে আমায় হাত দুটো ধরে একটু নেড়ে দিলো। এক মিনিটেরও কম সময়ের ভেতর ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকগুলো।

আমরা তৈরি কিনা একবার জিজ্ঞেস করে ঘুরে দাঁড়ালো আয়শা। খাড়া উঠে যাওয়া চূড়ার দিকে তার দৃষ্টি।

নিশ্চয়ই এই খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে যাচ্ছি না আমরা, কি বলো, লিও? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

আধা সম্মোহিত, আধা সচেতন অবস্থায় কাঁধ ঝাঁকালো লিও? পরমুহূর্তে চলতে শুরু করলো আয়শা, এবং ঐ খাড়া পাহাড় বেয়েই। উপায়ান্তর না দেখে এগোলাম আমরাও।

সত্যি চমৎকার এক দৃশ্য, কি অনায়াস দক্ষতায় এক পাথর থেকে অন্য পাথরে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে আয়শা। পা টিপে টিপে সাবধানে পেরিয়ে যাচ্ছে কিনারগুলো। নিচে থেকে যা ভেবেছিলাম তত কঠিন নয় পাথরের ধাপ টপকে উঠে যাওয়া। আয়শার মতো অনায়াসে না হলেও মোটামুটি স্বচ্ছন্দেই উঠছি আমরা। সমস্যা যা হচ্ছে তা বেচারা জবের, মোলটি তক্তাটা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ভাগ্য ভালো, ভাবি নয় ওটা। ভারি হলে ওটা নিয়ে অনেক আগেই উল্টে পড়তো জব।

প্রায় পঞ্চাশ ফুট মতো, ওঠার পর শিলাস্তরের কিনারায় সরু কার্নিসের মতো একটা জায়গায় পৌঁছলাম আমরা। জায়গাটা এত সরু যে কোনোমতে পা রেখে দাঁড়ানো যায়। পাথরে পিঠ ঠেকিয়ে পা টিপে টিপে পাশে হেঁটে এগোলো আয়শা। তার ভঙ্গি অনুকরণ করে আমরাও এগোলাম। প্রথমে খুব সরু থাকলেও যত এগোতে লাগলাম ততই চওড়া হতে লাগলো কার্নিস। পঞ্চাশ ষাট গজ মতো। যাওয়ার পর হঠাৎ একটা গুহার ভেতর গিয়ে শেষ হয়ে গেল কার্নিস। প্রথম দর্শনেই বুঝলাম গুহাটা প্রাকৃতিক।

গুহার মুখে থেমে দাঁড়ালো আয়শা। প্রদীপ দুটো জ্বালতে বললো। আমারটা জ্বেলে তার হাতে দিলাম, আর অন্যটা জবের কাছ থেকে নিয়ে জ্বেলে রাখলাম আমার কাছে।

প্রদীপ হাতে অন্ধকার গুহার ভেতর ঢুকলো আয়শা। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পেছন পেছন এগোলাম আমরা। হাতে আলো থাকলেও গুহার মেঝেটা এমন উঁচু নিচু যে একটু অসাবধান হলেই হোঁচট খেতে হবে।

পাক্কা বিশ মিনিট সময় লাগলো গুহার শেষ মাথায় পৌঁছুতে। অনেকবার বাক নিয়ে, চড়াই উত্রাই পেরিয়ে যে পথটুকু অতিক্রম করলাম লম্বায় তা কমপক্ষে সিকি মাইল হবে। এপাশেও একটা মুখ। মুখের কাছাকাছি আসতেই দমকা বাতাসে নিবে গেল প্রদীপ দুটো।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। গুহার বাইরে আলো প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং প্রদীপ নিবে যেতেই অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেলাম আমরা। অস্পষ্ট ভাবে একে অপরের অবয়ব শুধু দেখতে পাচ্ছি। আয়শা তার পেছন পেছন যেতে বললো আমাদের। পা টিপে টিপে, মেঝের উঁচু নিচু ঠাহর করে এগোলাম আমরা। গুহার বাইরে বেরিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তা এক কথায় অপূর্ব এবং ভীষণ। আমাদের সামনে বিশাল এক গহ্বর। তার এখানে ওখানে ফাটল, জায়গায় জায়গায় উঁচু হয়ে আছে বিরাট বিরাট পাথর। হাজার হাজার বছর আগে ভয়াবহ কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে হয়তো সৃষ্টি হয়েছিলো এই গহর। আমাদের থেকে কত নিচে যে মাটি তা বোঝার কোনো উপায় নেই, অন্ধকারের জন্যে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। গহরের চারদিকের দেয়াল উঁচু হয়ে উঠে গেছে অনেক দূর পর্যন্ত। দেড়-দুহাজার। ফুট হবে। তার ভেতর দিয়ে আকাশ দেখা যায় কি যায় না। সবচেয়ে আশ্চর্য যে ব্যাপারটা তা হলো, গুহামুখের সোজাসুজি সরু একটা সেতু মতো আড়াআড়ি ভাবে এগিয়ে গেছে গহ্বরের ও প্রান্তের দিকে। সেতু না বলে বাঁধ বলাই বোধহয় ভালো। নিরেট পাথর উঁচু হয়ে এসেছে গহ্বরের তলা থেকে। দুপাশে গভীর খাদ।

এর ওপর দিয়ে যেতে হবে আমাদের, বললো আয়শা। সাবধান, মাথা ঘুরে বা পা ফসকে পড়ে যেও না যেন; সত্যি কথা বলতে কি, এ গহুরের তল নেই কোনো।

আর কিছু বললো না সে। ভয় পাওয়ারও কোনো সুযোগ দিলো না আমাদের, হাঁটতে শুরু করলো সেই সরু পাথরের ওপর দিয়ে। অগত্যা আমরাও এগোলাম। পেছন পেছন।

কি সুন্দর সাবলীল ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে সে! যে দমকা বাতাসে প্রদীপ নিবে গিয়েছিলো তেমন ঝড়ো বাতাস বইছে এখনো, কিন্তু বিন্দুমাত্র ব্ৰিত করতে পারছে না আয়শাকে। তীব্র বাতাসের উল্টো দিকে শরীর হেলিয়ে দিয়ে নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে।

এদিকে আমরা, বাতাসের ঝাঁপটা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে বসে গুড়ি মেরে এগোচ্ছি। তবু ঠিকমতো তাল রাখতে পারছি না। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি উড়িয়ে নিয়ে গেল। আয়শার পেছনেই আমি, তারপর তক্তা হাতে জব, একেবারে পেছনে লিও। যত এগোচ্ছি ততই সরু হচ্ছে ভয়ানক সেতুটা।

মাত্র বিশ পা এগোতেই বেশ কয়েক মিনিট লেগে গেল। তারপর আচমকা আরো তীব্র হয়ে উঠলো বাতাস, যেন ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলবে প্রকাণ্ড গহুরটা। তাল রাখার জন্যে আরেকটু হেলে পড়লো আয়শা। হঠাৎ আমি দেখলাম, বাতাস ঢুকে ফুলে উঠলো তার আলখাল্লাটা, তারপরই সেটা আয়শার দেহ ছেড়ে উড়ে চলে গেল হাওয়ার মুখে। আহত পাখির মতো ঝটপষ্ট করতে করতে ক্রমশ নেমে যেতে লাগলো অন্তহীন গহরের ভেতর। পাথর আঁকড়ে ধরে চারপাশে তাকালাম আমি। সরু সেতুটা, বাতাসের ঝাঁপটায় না আমাদের ওজনে জানি না, কাঁপছে একটু একটু। শিসের মতো শব্দ তুলে বইছে বাতাস।

এসো, এসো, আমাকে থেমে পড়তে দেখে চিৎকার করে উঠলো আয়শা। এখন তার পরনে কেবল সাদা ঝুল পোশাকটা, আধো আলো আধো অন্ধকারে অশরীরী আত্মার মতো লাগছে দেখতে। তাড়াতাড়ি এসো, নইলে বাতাস আরো বাড়লে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

আবার এগোতে শুরু করলাম আমরা। জন্তুর মতো চার হাত পায়ে ভর দিয়ে কোনোরকমে ইঞ্চি ইঞ্চি করে সামনে যাচ্ছি। চোখ মুখ কুঁচকে তীব্র বাতাসের ঝাঁপটা সহ্য করছি। আরো কয়েক মিনিট এগোলাম এভাবে। সেতুর প্রান্তে পৌঁছে গেছি। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, তক্তাটা কেন আনা হয়েছে।

প্রাকৃতিক সেতু বা বাধটা যেখানে শেষ হয়েছে তার ওপাশে অনেক নিচ থেকে উঠে এসেছে একটা চূড়া। অনেকটা চোঙের মতো দেখতে। এই চূড়ার ওপর বিরাট একটা পাথর বসানো। অন্তত চল্লিশ ফুট হবে প্রস্থে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় চূড়াটাই হঠাৎ করে ভোঁতা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। কিন্তু আসলে, ওপরের পাথরটা আলগা। এমন মনে হওয়ার কারণ, এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি হাওয়ার ঝাঁপটায় একটু পর পরই সামান্য নড়ে উঠছে ওটা। এরকম আলগা একটা পাথর কি করে ওখানে এলো আর কি করে ওটা এমন সুন্দর ভারসাম্য বজায় রেখে বসলো কিছুতেই ভেবে পেলাম না। বিশাল চাঙড়টার এদিকের প্রান্ত আর সেতুর মাঝে এগারো কি বারো ফুটের মতো একটা ফাঁক। এই ফাঁকটুকু পার হওয়ার জন্যেই যে তক্তাটা আনা হয়েছে একবার দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তা বুঝতে পারলাম।

এবার একটু অপেক্ষা করতে হবে আমাদের, বললো আয়শা। একটু পরেই আলো পাওয়া যাবে, তারপর আবার রওনা হবো।

একটু আশ্চর্য হলাম আমি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এখন আবার আলো আসবে কোত্থেকে এই ভয়ানক জায়গায়? বসে বসে ভাবছি একথা, এমন সময় হঠাৎ দূরে অনেক নিচে পাহাড়ের গায়ে একটা ফোকরের ভেতর দিয়ে ছুটে এলো অস্তায়মান সূর্যের এক ঝলক সোনালি রশ্মি। মুহূর্তে আলোকিত হয়ে উঠলো সেতুর প্রান্ত আর ওপাশে পাথরের চাইটা।

তাড়াতাড়ি! বললো আয়শা, তক্তাটা-আলো থাকতে থাকতেই পার হয়ে যেতে হবে; এক্ষুণি অন্ধকার হয়ে যাবে আবার।

ও, স্যার! আর্তনাদ করে উঠলো জব। নিশ্চয়ই এই ঠুনকো জিনিসের ওপর দিয়ে এই ভয়ানক খাদ পেরোনোর কথা বলেনি ও

ঠিক তার উল্টোটা, জব, বললাম আমি। এই ভয়ানক খাদটা পেরোতে হবে আমাদের, এবং এই ঠুনকো তক্তার ওপর দিয়েই। তক্তাটা এগিয়ে দিতে ইশারা করলাম ওকে।

ও যতটা ভয় পেয়েছে আমি যে তার চেয়ে কম পেয়েছি তা মোটেই নয়। তবু নির্বিকার মুখে তক্তাটা ঠেলে দিলাম আয়শার দিকে। অনায়াস দক্ষতার সাথে সেও ঠেলে দিলো সেটা। ভাবলাম, এখানেই শেষ আমাদের এই অভিযান, এক্ষুণি গভীর খাদের অতলে তলিয়ে যাবে তক্তাটা। কিন্তু না, এক সেকেণ্ড পরেই অবাক হয়ে দেখলাম, ওপাশের চাঙড়টার ওপর গিয়ে বসেছে তক্তার ওমাথা।

শেষ যেবার এসেছিলাম তারপর অনেক বছর কেটে গেছে, বললো আয়শা। জানি না এখনো পাথরটার ভারসাম্য ঠিক আছে কি না। সুতরাং আমি আগে যাবো। আর কিছু না বলে হালকা পায়ে তক্তার ওপর দিয়ে হেঁটে গেল আয়শা। কয়েক সেকেণ্ড পরেই দেখলাম, ওপাশের টলমলে পাথরটার ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে।

হ্যাঁ, ঠিকই আছে, চিষ্কার করলো সে। এক এক করে চলে এসো তোমরা। তক্তাটা ভালো মতো ধরে একটু একটু করে এগোবে। তাড়াতাড়ি, হলি! এক্ষুণি আলো চলে যাবে। দুজনের ওজনে পাথরের ভারসাম্য যাতে নষ্ট না হয় সেজন্যে প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালো সে।

হাঁটুতে ভর দিয়ে কসরত শুরু করলাম, কিন্তু এক ইঞ্চি এগোতে পারলাম না। সত্যি কথা বলতে কি, এমন আতঙ্কিত জীবনে আর কখনো হইনি আমি।

কি ব্যাপার, হলি, ভয় পেয়েছো? অস্থির অথচ কৌতুক মেশানো স্বরে চিৎকার করলো আয়শা। তাহলে পিছিয়ে যাও তুমি, ক্যালিক্রেটিসকে আসতে দাও।

এই কথার পর আর ইতস্তত করা যায় না। এমন একজন মেয়ে মানুষের উপহাসের পাত্র হওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। দাঁতে দাঁত চেপে, দুনিয়ার আর সবকিছু ভুলে এগোলাম তক্তার ওপর দিয়ে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে যাচ্ছি। সমস্ত মনোযোগ তক্তা আর তার দুকিনারের দিকে। আমার ওজনে একটু বেঁকে গেছে তক্তা। হঠাৎ একবার চোখ পড়লো নিচের অন্তহীন গহ্বরের দিকে। ধড়াস করে উঠলো বুকের ভেতর। এলিয়ে আসতে চাইলো শরীর। এমন সময় মনে পড়ে গেল আয়শার বিদ্রূপ মাখা কণ্ঠস্বর। কোত্থেকে যে শক্তি পেলাম জানি না, পরবর্তী তিন সেকেরে মাথায় তার ওপ্রান্তে পৌঁছুলাম আমি।

এবার লিওর পালা। চেহারায় একটু সন্দিগ্ধ ভাব থাকলেও দড়াবাজ। সার্কাসওয়ালার মতো অনায়াস ভঙ্গিতে হেঁটে চলে এলো ও এপাশে। আয়শা এগিয়ে গিয়ে ধরলো ওর হাত। তারপর বললো, চমৎকার, প্রিয়তম প্রাচীন গ্রীকদের মতোই সাহস দেখিয়েছো?

জব কেবল রয়েছে এখন ওপাশে কোনো রকমে গুঁড়ি মেরে তক্তার ওপর উঠলো ও। তারপরই হাউমাউ করে উঠলো, আমি পারবো না, স্যার! পড়ে যাবে, পড়ে যাবো!

পারতেই হবে, জব, দৃঢ় গলায় বললাম আমি। পারতেই হবে। খুব সোজা কাজ, মাছি ধরার মতো সোজা। আমার ধারণা দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটা মাছি ধরা, তবু কেন যে বললাম একথা জানি না। তবে আয়শার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতে পেরে খুব শান্তি পেলাম মনে মনে।

পারবো না, স্যার, পারবো না!

আসলে আসুক, না হলে মরুক ও! আলো চলে যাচ্ছে, এক্ষুণি অন্ধকার হয়ে যাবে! বললো আয়শা।

যে ফোকর দিয়ে আলো আসছে, সেটার দিকে তাকালাম আমি। ঠিকই বলেছে আয়শা। ইতিমধ্যে লাল থালার মতো সূর্যটার অর্ধেক চলে গেছে ফোকরের আড়ালে।

জব, চিৎকার করলাম আমি। ওখানে বসে থাকলে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না তোমার। তাড়াতাড়ি এসো, আলো চলে যাচ্ছে।

এসো, জব! গর্জে উঠলো লিও, সাহস আনো বুকে! যত কঠিন ভাবছে আসলে তত কঠিন নয় কাজটা। কত সহজে আমরা চলে এলাম, দেখলে না?

এবার এগোতে শুরু করলো জব। অনবরত কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার করছে মাগো, গেলাম গো, আর একটু একটু করে এগোচ্ছে। ক্রমশ আলো কমে আসছে তবু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, থর থর করে কাঁপছে বেচারা।

মাঝামাঝি জায়গায় এসে হঠাৎ ওর একটা হাঁটু চলে গেল তক্তার বাইরে। ভয়ানক ভাবে ঝাঁকুনি খেলো তক্তাটা। তীব্র একটা আর্তনাদ করে কিনারা আঁকড়ে ধরলো জব। তারপর বসে রইলো স্থির হয়ে। এই সময় সূর্যের শেষ রশ্মিটাও চলে গেল ফোকরের নিচে। আবার অন্ধকার নেমে এলো চারদিকে।

চলো! তাড়া লাগালো আয়শা।

চলে এসো, জব, ঈশ্বরের দোহাই! না হলে তোমাকে ফেলেই চলে যেতে হবে আমাদের! আবার চেঁচালাম আমি।

ও, ঈশ্বর, দয়া করো, দয়া করো! অন্ধকারের ভেতর থেকে ভেসে এলো জবের গলা। ওহ, তক্তাটা পিছলে যাচ্ছে! তারপর ভীষণ একটা ধুপধাপ আওয়াজ। জব বোধহয় গেল!

কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ওর বাড়িয়ে দেয়া একটা হাত স্পর্শ করলো আমার হাত। খপ করে ধরে ফেলে টানলাম আমি। পরের মুহূর্তে আমার পাশে হুমড়ি খাওয়া অবস্থায় দেখলাম জবকে। কিন্তু, তক্তাটা! শক্ত কিছু পিছলে যাওয়ার খসখসে আওয়াজ শুনে বুঝলাম চলে গেল ওটা। কয়েক সেকেণ্ড পর নিচে থেকে ভেসে এলো ঠক করে একটা আওয়াজ।

হায় হায়! আমরা ফিরবো কি করে! কোনো মতে উচ্চারণ করলাম আমি।

জানি না, জবাব দিলো লিও! ভাগ্য ভালো আমরা এপাশে আসার আগেই ওটী পড়ে যায়নি!

আমার কাছে এগিয়ে এলো আয়শা। আমার হাত ধরে এসো।

.

২৫.

আয়শার কথা মতো তার হাত ধরলাম আমি। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কম্পিত বুকে শুধু অনুভব করছি, আমার হাত ধরে টলমলে পাথরটার কিনারে নিয়ে গেল সে। তার কথা মতো পা নামিয়ে দিলাম নিচে। কিন্তু কিছু ঠেকলো না পায়ে।

পড়ে যাবো তো! ঢোক গিলে বললাম।

না, হলি, বললো আয়শা। দুপা-ই নামিয়ে দাও, বিশ্বাস রাখো আমার ওপর, কিছু হবে না। পড়েই যদি যাবে, তাহলে ওকাজ করতে বলব কেন তোমাকে? যাও নেমে যাও!

কোনো উপায়ান্তর না দেখে তা-ই করলাম। শক্ত পাথরের ওপর দিয়ে দুতিন পা গড়িয়ে যাওয়ার পর আর কোনো অবলম্বন রইলো না আমার। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো, অতল কোনো খাদে পড়ে যাচ্ছি। কিন্তু না, মুহূর্ত পরেই শক্ত পাথরের সাথে পা ঠেকলো আমার। একটুও ব্যথা পেলাম না। স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কি করে সম্ভব হলো ব্যাপারটা ভাবছি, এমন সময় লিও-ও একই ভঙ্গিতে এসে দাঁড়ালো আমার পাশে।

কি খবর, বুড়ো! উৎফুল্ল গলায় বললো ও, তুমি আছো এখানে? ব্যাপারটা বেশ জমে উঠেছে, তাই না?

ঠিক সেই সময় ভয়ঙ্কর এক আর্তনাদ করে হাজির হলো জব, আমাদের ঠিক ওপরে। ওর সঙ্গে সঙ্গে আমি আর লিও-ও হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলাম মাটিতে। আমরা উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে আয়শাও এসে পড়লো। প্রদীপ দুটো জ্বালতে বললো সে। ভাগ্য ভালো এখনো অক্ষত আছে ওদুটো। তেলের পাত্রটাও। গুহার মুখে এসে নিবে যেতেই আবার ওগুলো পিঠে ঝুলিয়ে নিয়েছিলাম আমরা।

পকেট থেকে দেশলাই বের করে প্রদীপ দুটো জ্বাললাম আমি। আলো জ্বলে উঠতেই অদ্ভুত একটা দৃশ্য উন্মোচিত হলো আমাদের সামনে। পাথরের একটা কুঠুরিতে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। বর্গাকৃতির, লম্বায় চওড়ায় ফুট দশেক করে হবে। সেই টলমলে পাথরটা ছাদের কাজ করছে। কুঠুরিটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নয়। পেছন দিকে কিছুটা অংশ মানুষের হাতে খোদাই করা।

যাক! বললো আয়শা। নিরাপদে আসতে পেরেছি শেষ পর্যন্ত। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম, তোমাদের ওজনে খসেই না পড়ে পাথরটা। একটু থেমে জবের দিকে ইশারা করলো সে, তোমাদের ঐ উজবুকটা-শূকর ছানা, ঠিকই নাম দিয়েছে ওরা, শুয়োরের মতোই হাঁদা-ফেলে দিয়েছে তক্তাটা। ফেরার পথে খাদ পেরোনো সহজ হবে না। দেখি, ভেবে চিন্তে কিছু একটা বুদ্ধি বের করতে হবে। এখন একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও তোমরা। ইচ্ছে হলে ঘুরে ফিরে দেখতে পারো জায়গাটা। এটা কি জানো?

না, জবাব দিলাম আমি।

বললে বিশ্বাস করবে, হলি, এক সময় নিঃসঙ্গ এক লোক বাস করতো এখানে? বারো দিনে একবার সে বেরোতো এখান থেকে। খাবার পানি আর তেল নিয়ে আসতো। লোকেরা অর্ঘ্য হিসেবে নিবেদন করতো। সুড়ঙ্গের মুখে রেখে যেতো সে-সব।

অবাক চোখে তাকালাম আমরা তার দিকে।

লোকটা তার নাম দিয়েছিলো নুট, বলে চললো সে। একই সাথে সে ছিলো সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, এবং দার্শনিক। প্রকৃতির গোপন রহস্যগুলোর কার্যকারণ সূত্র বেশির ভাগই সে আয়ত্ত করেছিলো। তোমাদের যে আগুন দেখাবো, ক্যালিক্রেটিসকে যাতে স্নান করাবো, সেই আগুন তারই আবিষ্কার। কিন্তু সে স্নান করেনি ওতে। তোমার মতো, হলি, এই নুট লোকটাও অনন্ত জীবনের মাঝে কোনো আনন্দ খুঁজে পায়নি। সে বলতো, মৃত্যুবরণ করবে বলেই মানুষের জন্ম। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার অর্থ হবে অশুভকে ডেকে আনা। আর তাই সে তার গোপন কথা কারো কাছে প্রকাশ না করে এখানে এসে বাস করতে থাকে। তারপর আমি যখন প্রথম এলাম এদেশে–কি করে এসেছিলাম জালো ক্যালিক্রেটিস? এখন না, অন্য এক সময় বলবো সেই অদ্ভুত কাহিনী। যা বলছিলাম, তারপর আমি যখন এলাম এদেশে, শুনলাম এই জ্ঞানী দার্শনিকের কথা। তাকে খাবার দিতে আসতো যারা তাদের সঙ্গে একদিন চলে এলাম সুড়ঙ্গের মুখে। ওরা চলে যাবার পরও আমি রয়ে গেলাম সেখানে। তারপর নুট যখন এলো সেসব সগ্রহ করতে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে তার সাথে চলে এলাম এখানে। সেদিন ঐ খাদ পেরোতে কি ভয়ই না পেয়েছিলাম মনে পড়লে এখন হাসি পায়। আমার সৌন্দর্য, চাটুকারিতা এবং মোহিনী শক্তির সবটাই প্রয়োগ করে প্রলুব্ধ করলাম তাকে। শেষ পর্যন্ত সে দেখাতে বাধ্য হলো সেই রহস্যময় আগুন। অবশ্য একথাও জানিয়ে দিলো, কিছুতেই আামকে ওতে স্নান করতে দেবে না। প্রয়োজন হলে হত্যা করবে আমাকে, তবু না। সে মুহূর্তে আমি মেনে নিয়েছিলাম তার কথা। কারণ দেখতে পাচ্ছিলাম লোকটা বৃদ্ধ হয়েছে, আর বেশি দিন বাঁচবে না। ও মরলেই আবার আমি আসবো এখানে, এই সংকল্প করে, পৃথিবী, প্রকৃতি এবং জীবন সম্পর্কে আরো যে সব জ্ঞান সে অর্জন করেছিলো তা জেনে নিয়ে ফিরে গেলাম কোর-এ।

এর কদিন পরই তোমার সাথে আমার দেখা হয়, প্রিয়তম ক্যালিক্রেটিস। মিসরীয় সুন্দরী আমেনার্তাসকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিলে এখানে। সেই প্রথম এবং সেই শেষ-ভালোবাসা কাকে বলে জানলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে সংকল্প করলাম, তোমাকে নিয়ে আসবো এখানে এবং প্রাণের উপহার গ্রহণ করবো দুজনে একসাথে। অনেক চেষ্টা করলাম মিসরীয় মেয়েলোকটাকে রেখে আসার, কিন্তু পারা গেল না। শেষ পর্যন্ত ওকে সহ তোমাকে নিয়ে এলাম এখানে। দেখলাম বৃদ্ধ নুট পড়ে আছে মাটিতে, কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে।

নিশ্চিন্ত মনে তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলাম সেখানে। তারপর আমার সমস্ত সাহস এক জায়গায় করে ঢুকে পড়লাম সেই অসীম জীবনের অগ্নিশিখার ভেতর। যখন বেরোলাম তখন হাজার গুণে বেড়ে গেছে আমার সৌন্দর্য। আর জীবন? দেখতেই পাচ্ছো, তারপর দুহাজার বছরেরও বেশি কেটে গেছে, কিন্তু এক বিন্দু ম্লান হয়নি আমার রূপ-যৌবন।

তারপর আমি দুহাত বাড়িয়ে তোমাকে আহ্বান করলাম, ক্যালিক্রেটিস, অনন্ত যৌবনা বধূকে আলিঙ্গন করতে বললাম। কিন্তু, নিশ্চয়ই আমার সৌন্দর্য তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছিলো, আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তুমি জড়িয়ে ধরলে আমেনার্তাসকে। সঙ্গে সঙ্গে কি যে হলো আমার, ঈর্ষা এবং ক্রোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আমার বুকের ভেতর। তোমার হাত থেকে তোমারই বর্শা কেড়ে নিয়ে বিধিয়ে দিলাম তোমার বুকে। একবার মাত্র আর্তনাদ করে মারা গেলে তুমি। তখনো জানতে পারিনি, ঐ আগুনে স্নান করে আসার ফলে চোখের চাউনি এবং ইচ্ছাশক্তি দিয়েই হত্যা করার ক্ষমতা অর্জন করেছি আমি।*

তারপর, আহ্! তোমার মৃত্যুর পর কি কাঁদাটাই না কাঁদলাম—আমি বেঁচে আছি, আর তুমি মরে গেছ, কি করে যে সেদিন সহ্য করেছিলাম সে বেদনা, জানি না। তারপর সেই মিসরীয় মেয়েমানুষটা, তার দেবতাদের দোহাই দিয়ে অভিশাপ দিলো আমাকে। ওসিরিস, আইসিস, নেপথিস, আনুবিস, বিড়ালমুখো মেখেত সব দেবতার নাম করে জঘন্য ভাষায় শাপশাপান্ত করতে লাগলো। প্রতিহিংসায় কেমন কালো হয়ে উঠেছিলো তার মুখ, যদি দেখতে! তবে হ্যাঁ, সে আমাকে আঘাত করার কোনো চেষ্টা করেনি, আমিও না। দুজনেরই শোক কিছুটা প্রশমিত হলে, দুজনে ধরাধরি করে নিয়ে গেলাম তোমার মৃতদেহ। কোর-এ পৌঁছে প্রথম কাজ যেটা করলাম, মিসরীয়টাকেজলা পার করে পাঠিয়ে দিলাম সাগর পাড়ে। ওখান থেকে পারলে দেশে ফিরে যাক, নয়তো মরুক, কিছু এসে যায় না আমার।

এই হলো কাহিনী, প্রিয়তম, কোনো কিছুই লুকোইনি তোমার কাছে, যা যা ঘটেছিলো সব বললাম। এখন সেই অনন্তু প্রাণের উৎসের কাছে যাবো আমরা, তার আগে বলো, ক্যালিক্রেটিস, তুমি আমাকে ক্ষমা করেছে? এখন তুমি অন্তর থেকে ভালোবাসতে পারবে আমাকে? অনেক পাপ করেছি আমি, তোমাকে হত্যা করেছি, মাত্র দুদিন আগে সেই মেয়েটাকে হত্যা করেছি। কিন্তু কেন, ক্যালিক্রেটিস? আমার অপরাধটাই শুধু দেখবে? কেন করেছি তা দেখবে না? তোমাকে ভালোবাসতে গিয়েই এ পাপ করতে হয়েছে আমাকে। মিসরীয় আমেনার্তাসকে নিয়ে দুনিয়ার যেখানে খুশি যেতে, এখানে কেন এসেছিলে?

ক্যালির্কেটিস, ও ক্যালিক্রেটিস, বলো, ক্ষমা করেছে আমাকে? সারা জীবনে যে পাপ আমি করেছি, তা থেকে পরিত্রাণ পাবার একটাই মাত্র উপায়, তোমার প্রেম, ক্যালিক্রেটিস, একমাত্র তোমার প্রেমই এই পাপের গহ্বর থেকে উদ্ধার করতে পারে আমাকে।

থামলো সে। দুচোখে টলটল করছে অশ্রু, এক্ষুণি নেমে আসবে বিশাল দুটো ফোঁটা হয়ে পরিপূর্ণ অথচ অতি সাধারণ একটা নারীর মতো লাগছে এখন আয়শাকে।

তাড়াতাড়ি লিও গিয়ে ধরলো ওকে। তারপর ওর চোখে চোখ রেখে বললো, আয়শা, সত্যিই আমি তোমাকে অন্তর থেকে ভালোবাসি। আর উস্তেনের মৃত্যুর ব্যাপারে, মানুষের পক্ষে যতদূর সম্ভব ততদূর ক্ষমা করেছি তোমাকে। বাকিগুলোর ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। শুধু এটুকু জানি, আমি তোমাকে ভালোবাসি, পৃথিবীর কোনো পুরুষ কোনো নারীকে এত ভালোবাসেনি।

এবার দেখ তাহলে, গর্বের সঙ্গে বললো আয়শা। লিওর একটা হাত নিজের মাথায় রেখে হাঁটু গেড়ে বসলো মাটিতে। দেখ, আত্মনিবেদনের প্রতীক হিসেবে আমি হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নোয়াচ্ছি আমার প্রভুর সামনে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে চুমু খেলো ওর ঠোঁটে। দেখ, স্ত্রীর মতো আমি চুমু দিচ্ছি আমার প্রভুকে।

এই পবিত্র মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করছি, আর কখনো কোনো পাপ আমি করবো না, সব সময় শুভ-সুন্দরের লালন করবে। প্রতিজ্ঞা করছি, কর্তৃব্যের সরল পথে সব সময় চলবো আমি। প্রতিজ্ঞা করছি কখনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী হবো না, এবং জ্ঞান ও সত্যই হবে আমার পথের দিশারী। আমি আরো প্রতিজ্ঞা করছি, সারা জীবন আমি তোমাকে ভালোবাসবো, ক্যালিক্রেটিস। প্রতিজ্ঞা করছি-না আর প্রতিজ্ঞা নয়, কোন্ প্রতিজ্ঞাটা বাকি রইলো? শুধু এটুকু জেনে রাখো, আয়শা কখনো মিথ্যা বলে না।

আমার প্রতিজ্ঞা শুনলে, হলি, তুমি সাক্ষী, এই শপথের মধ্যে দিয়েই আমার স্বামীর সাথে, আমার ক্যালিক্রেটিসের সাথে বিয়ে হলো আমার। আমার কুমারী জীবন শেষ। ফলাফল যা-ই হোক, ঝড় উঠুক, আলো আসুক, ভালো হোক, মন্দ হোক, জীবন আসুক, মৃত্যু আসুক, কিছুই আর করার নেই। কিছুতেই আর ছিন্ন হবে না এ বন্ধন।

তাহলে চলো এখন, একটা প্রদীপ তুলে নিয়ে এগোলো সে। আমরাও চললাম পেছন পেছন। কুঠুরির শেষ প্রান্তে পৌঁছে থামলো আয়শা। দুই দেয়াল যেখানে মিশেছে সেখানে সরু এক প্রস্থ সিঁড়ি। নামতে শুরু করলো সে। আমরাও। প্রায় পনেরো যোলো ধাপ নামার পর দেখলাম বিশাল এক পাথুরে ঢালে গিয়ে শেষ হয়েছে ধাপগুলো। চালটা প্রথমে নিচের দিকে নেমে আবার ওপরের দিকে উঠে এসেছে। অনেকটা ওল্টানো একটা চোঙের মতো। বেশ খাড়া ঢাল, তবে অগম্য নয়। বাতি হাতে নেমে যেতে লাগলাম আমরা।

প্রায় আধ ঘণ্টা লাগলো চোঙের সর্বনিম্ন বিন্দুতে পৌঁছাতে। এবার বোধহয় উল্টো দিকের ঢাল বেয়ে উঠতে হবে। কিন্তু না, আরো কয়েক পা যেতেই একটা সরু এবং নিচু পথ মতো দেখতে পেলাম! গুড়ি মেরে সেটার ভেতর ঢুকলো আয়শা। পেছন পেছন আমরাও। প্রায় গজ পঞ্চাশেক হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়ার পর আচমকা প্রশস্ত হয়ে গেল সুড়ঙ্গটা। বিশাল একটা গুহায় আবিষ্কার করলাম নিজেদের। কোর-এর বিরাট বিরাট গুহাগুলো এর তুলনায় কিছুই নয়। কোনো দিকেই দেয়াল বা ছাদ দেখতে পাচ্ছি না। অর্থাৎ ওগুলো এতদূরে যে প্রদীপের আলো পৌঁছুচ্ছে না সে পর্যন্ত। ভারি বাতাস আর আমাদের পদশব্দের প্রতিধ্বনি শুনে বুঝতে পারছি, ফাঁকা জায়গা নয়, এটা গুহাই।

ভাবলাম এবার বোধহয় থামবে আয়শা। কিন্তু না, নিঃশব্দে এগিয়ে চললো সে। অবশেষে গুহার শেষ মাথায় পৌঁছুলায় আমরা। আরেকটা মুখ এখানে। সেটা পেরোতেই আগেরটার চেয়ে অনেক ছোট একটা গুহায় এসে পড়লাম। এখানেও থামলো না আয়শা। অবশেষে আরেকটা গুহামুখ নজরে পড়লো আমাদের। তার ওপাশে অস্পষ্ট একটা আলোর আভা।

আলোটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে, খেয়াল করলাম, স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললো আয়শা। দ্রুতপায়ে এগিয়ে চললো সে। যেটাকে গুহামুখ মনে হয়েছিলো সেটা আসলে একটা সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে যত এগিয়ে যাচ্ছি আলোটা ততই স্পষ্ট এবং শক্তিশালী হয়ে উঠছে, অন্ধকার রাতে বাতিঘর থেকে যেমন ছড়িয়ে পড়ে আলোকরশ্মি অনেকটা তেমন। শুধু তাই নয়, আলোর ঝলকানির সাথে সাথে ভেসে আসছে বজ্রগর্জনের মতো প্রাণকাঁপানো শব্দ। যত এগোচ্ছি শব্দও তত বাড়ছে।

সুড়ঙ্গ শেষ হতে আরেকটা গুহায় এসে পড়লাম আমরা। অনেক উঁচু এটার ছাদ। লম্বায় পঞ্চাশ ফুট মতে, চওড়ায় ত্রিশ ফুট। মিহি সাদা বালি দিয়ে ছাওয়া মেঝে। দেয়ালগুলো আশ্চর্যরকম মসৃণ। মৃদু গোলাপী আলোয় পূর্ণ গুহাটা। অবাক কাণ্ড, একটু আগের সেই উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি বা বাজ পড়ার মতো শব্দ—কিছুই এখন নেই। বিস্মিত চোখে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি অদ্ভুত গোলাপী আলোর উৎস, এমন সময় হঠাৎ আবার শুরু হলো শব্দটা। প্রথমে যাঁতা ঘোরানোর মতো ঘড়ঘড়ে আওয়াজ। ক্রমশ বাড়তে বাড়তে বজ্রগর্জনের মতো হয়ে উঠলো। সেই সাথে গুহার ওপ্রান্তে দেখা দিলো উজ্জ্বল আলোর একটা ঘূর্ণায়মান স্তম্ভ। প্রতি মুহূর্তে আরো উজ্জ্বল হচ্ছে। রঙধনুর মতো অনেক রং তাতে। শেষ পর্যন্ত বিদ্যুৎ চমকের মতো চোখ ধাঁধানো হয়ে উঠলো আলোটা।

কিছুক্ষণ, প্রায় চল্লিশ সেকেণ্ড হবে, রইলো আলো এবং শব্দ। তারপর ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। কমতে কমতে একসময় মিলিয়ে গেল শব্দ, আগুনও। আবার আগের সেই গোলাপী আভায় ভরে উঠলো গুহা।

কাছে যাও, কাছে যাও! চিৎকার করে বললো আয়শা, উত্তেজনায় কাঁপছে তার গলা। দেখেছো, প্রাণের আগুন? এই বিশাল পৃথিবীর বক্ষ বিন্দুতে স্পন্দিত হয়ে চলেছে। এর থেকেই দুনিয়ার যাবতীয় জিনিস শক্তি পেয়েছে, প্রাণ পেয়েছে! কাছে যাও, আরো কাছে! তোমাদের নোংরা, দুর্বল শরীরগুলো পরিশুদ্ধ করে নাও।

তার পেছন পেছন আমরা এগিয়ে গেলাম গুহার শেষ প্রান্তের দিকে। এই সময় আবার আচমকা শুরু হলো শব্দ সেই সাথে চোখ ধাঁধানো আলো। আমাদের ঠিক সামনে। সত্যি সত্যিই চোখ ধাধিয়ে গেল আমাদের, কানে তালা ধরে যাওয়ার অবস্থা। তাড়াতাড়ি দুহাতে কান চেপে ধরে মুখ গুঁজে বসে পড়লাম আমরা তিনজন। আয়শা কেবল দাঁড়িয়ে রইলো, অচঞ্চল।

একটু পরেই আবার সব চুপচাপ। মাথা তুললাম আমরা।

সময় হয়েছে, ক্যালিক্রেটিস, বললো আয়শা। এবার তুমি স্নান করবে এই সুমহান অগ্নিশিখায়। সব কাপড়চোপড় খুলে ফেল। শরীরের প্রতিটি বিন্দুতে আগুনের পরশ লাগাতে হবে। নইলে সম্পূর্ণ হবে না তোমার পরিশুদ্ধি। আর হ্যাঁ, জোরে শ্বাস নিয়ে আগুন টেনে নেবে শরীরের ভেতরেও। বুঝেছো, ক্যালিক্রেটিস?

বুঝেছি, আয়শা, জবাব দিলো লিও। কিন্তু আমাকে ভীতু কাপুরুষ ভেবো, আমার সন্দেহ হচ্ছে, আগুন যে আমাকে ধ্বংস করে ফেলবে না তার নিশ্চয়তা কি? নিজেকে তো হারাবোই, তোমাকেও হারাবো।

চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলো আয়শা। তারপর বললো, হ্যাঁ, সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। ঠিক আছে, আমি যদি প্রথমে গিয়ে দাঁড়াই ওর ভেতরে, এবং অক্ষত

অবস্থায় বেরিয়ে আসি, তাহলে কি তোমার সন্দেহ দূর হবে?

হ্যাঁ, জবাব দিলো লিও। অবশ্য তোমার কথায় এমনিতেই আমি ঢুকতে পারি ওতে।

আমিও, বলে উঠলাম আমি!

কে! হলি! হেসে উঠলো আয়শা। ভেবেছিলাম কিছুতেই তুমি দীর্ঘ জীবন চাইবে না, এখন আবার কি হলো?

জানি না। আমি পরখ করতে চাই তোমার এই অনন্ত প্রাণের শিখা। তারপর যদি দীর্ঘজীবী হই তো হবে, না হলেও কিছু এসে যায় না।

বেশ, তাহলে তৈরি হও, প্রথমে আমি, তারপর তোমরা।

——–
* ক্যালিক্রেটিসের মৃত্যু সম্পর্কে পোড়ামাটির ফলকে লেখা আমেনার্তাসের ভাষ্য আর আয়শার বর্ণনার পার্থক্য লক্ষণীয়। আমেনার্তাস বলছে, জাদুর প্রভাবে হত্যা করে তাকে। কার বক্তব্য যে ঠিক, আমরা যাচাই করার সুযোগ পাইনি। তবে ক্যালিক্রেটিসের মৃতদেহের বুকে গভীর একটা ক্ষতচিহ্ন দেখেছিলাম আমরা, ওটা যদি মৃত্যুর পরে করা হয়ে না থাকে তাহলে বলা যায় আয়শার কথাই ঠিক। আরেকটা কথা, সে আর আমেনার্তাস, দুই নারীতে মিলে ক্যালিক্রেটিসের মৃতদেহ কিভাবে খাদের ওপাশে নিয়েছিলো সে রহস্যের সমাধান আমরা করতে পারিনি। হয়তো সেতু আর টলমলে পাথরের মাঝের ফাঁকটা সে সময় এত চওড়া ছিলো না।

-এল. এইচ. এইচ.।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *