২১. নটিলাস-এর রোষ

নটিলাস-এর রোষ

ভিক্তর যুগো ছাড়া আর কারো লেখনীই বোধ করি বিশে এপ্রিলের এই ভীষণ যুদ্ধের বর্ণনা দিতে অক্ষম। অন্তত আমি যে যা ঘটেছিলো তার কিছুই ফুটিয়ে তুলতে পরি নি তা খুব ভালো করেই জানি। আর ক্যাপ্টেন নেমোর বিষাদ, বিলাপ ও অস্থিরতা ফোটাবার ক্ষমতাও কবি ছাড়া আর কারো নেই; আর সেই কবিকেও নিশ্চয়ই মহাকবি যুগোর মতোই নিপুণ হতে হবে।

ইতিমধ্যে আমেরিকার সিন্ধুসলিল ছাড়িয়ে এসেছে নটিলাস; য়ুরোপের উপকূল ধরেই চলেছি এখন আমরা। নটিলাস কখনো জলের উপর ভেসে ওঠে, কখনো ডুব দিয়ে যায় অনেক দূর অবধি। পয়লা জুন নটিলাস যখন ভেসে চলেছে এমন সময় হঠাৎ যেন গুমগুম করে মেঘ ডেকে উঠলো। স্বচ্ছ নীল আকাশে মেঘের লেশমাত্র নেই; অথচ তাহলে এ কীসের শব্দ?

নেড, কোনসাইল আর আমি তখন প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়েছিলুম। হঠাৎ পুবদিকে তাকাতেই দেখি মস্ত একটা কলের জাহাজ পূর্ণবেগে আমাদের দিকে ধাবমান–কয়েক মাইল দূর থেকেও দেখা গেলো তার চিমনি দুটো দিয়ে ভলকে-ভলকে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে।

কিসের শব্দ হলল, নে? আমি জিগেস করলুম।

কামানের।

কীসের আহাজ ওটা, জানো?

দূর থেকে দেখে তো যুদ্ধজাহাজ বলেই মনে হয়। বোধ হয় আমাদের ডুবিয়ে দিতে চায়। এই জঘন্য নটিলাস-কে যদি ওরা জখম করতে পারে তো আমার কোনো ক্ষোভ নেই।

কোন দেশের জাহাজ, বুঝতে পেরেছে?

ভুরু কুঁচকে একটু তাকিয়ে নেড বললে, কোনো নিশেন তো দেখতে পাচ্ছি না। কোন দেশের জাহাজ বলা মুশকিল।

জাহাজটা ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে, বেশ দ্রুত তার গতি, কিন্তু তবু কোন নিশানেরই হদিশ পাওয়া গেলো না। নেড বলে উঠলো, নটিলাস-এর এক মাইল দূর দিয়ে গেলেও আমি সরে গিয়ে উঠবে জাহাজটায়। আপনাদেরও তা-ই করতে পরামর্শ দিই।

আমি কোনো উত্তর দেবার আগেই জাহাজের গলুয়ের কাছে খানিকটা শাদা ধোয়া জেগে উঠলো। পরক্ষণেই নটিলাস-এর পাশে জলে কী একটা যেন বিপুল শব্দে আছড়ে পড়লো-বিস্ফোরণের শব্দটা কানে এলো তার পরেই।

কী সাংঘাতিক! তাহলে ওরা যে আমাদের দিকে কামান দাগছে!

ভালোই তো! তাহলে ওরা আমাদের দেখতে পেয়েছে-জাহাজডুবির পর ভেলায় ভাসছি বলে ভুল করেনি—এই মন্ত তিমিজিলকে দেখেই তারা কামান দাগছে!

নেড ভুল বলে নি! সত্যি, এতদিনে সারা জগৎ নিশ্চয়ই এই ভুবোজাহাজের কথা জেনে গেছে। আব্রাহাম লিঙ্কন থেকে নেড যে-হারপুন ছুঁড়েছিলো, তা যে নটিলাস-এর ইস্পাতের খোল ভেদ করতে পারে নি তা দেখেই নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন ফ্যারাগুট বুঝতে পেরেছিলেন কীসের পিছনে তিনি ছুটেছিলেন। পৃথিবীর সমস্ত দেশের যুদ্ধজাহাজ নিশ্চয়ই এতদিনে এই অদ্ভুত ডুবোজাহাজটার খোঁজে হন্যে হয়ে উঠেছে।

আমাদের চারপাশে তখন বৃষ্টির মতো কামানের গোলা এসে পড়ছে। এখনো বেশ দুরে আছে বলেই কোনো গোলাই নটিলাস-এর গায়ে এসে পড়ছে না। কিন্তু আশ্চর্য! গোলার শব্দ শুনেও নটিলাস-এর লোকজনেরা কোনো কৌতূহল প্রকাশ করছে না কেন? ক্যাপ্টেন নেমোই বা কী করছেন?

নেড চেঁচিয়ে উঠলো, এই সুযোগে নটিলাস থেকে পালাতেই হবে আমাদের। আসুন, ওদের সংকেত করি। হয়ত ওরা বুঝতে পারবে যে আমরা নির্বিরোধী সৎ মানুষ। বলে পকেট থেকে রুমাল বের করে নেড নাড়তে যাবে, এমন সময় কার কঠিন হাতের ধাক্কায় নেডের মতো পালোয়ানও ছিটকে পড়লো প্ল্যাটফর্মে!

পাষণ্ড! বাজের মতো ফেটে পড়লেন ক্যাপ্টেন নেমো। তুমি কি চাও যে নটিলাস-এর খড়গ দিয়ে ওই জাহাজটাকে এফোঁড়-ওফেঁড় করার আগে তোমাকেই আমি গেঁথে ফেলি! সেই কণ্ঠস্বর যত না ভীষণ, তার চেয়েও ভীষণ তার দেহচ্ছবি। রক্তহীন শাদা তার মুখ, চোখের তারা দুটি মশালের মত উজ্জ্বল। নেডের কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে গর্জন করে উঠলেন তিনি। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে ওই জাহাজকে উদ্দেশ্য করে মেঘের মতো গর্জে উঠলেন ক্যাপ্টেন নেমোত তুমি তাহলে জানো আমি কে! তুমি তাহলে জানো নটিলাস কোন অভিশপ্ত জাতির জাহাজ। তোমাকে চিনতে আমার দেরি হয় নি, তোমার পতাকা না-দেখেও তোমাকে আমি চিনি। কিন্তু এই দ্যাখো আমার নিশেন—তোমাকে আজ দেখাই। বলেই দক্ষিণমেরুতে তিনি যে-নিশেন উড়িয়েছিলেন ঠিক তেমনি একটি কালো নিশেন উড়িয়ে দিলেন নটি লাস-এর উপর।

বোধ হয় তাঁর কথার উত্তরেই নটিলাস-এর হাতের উপর দারুণ শষে একটা গোলা এসে পড়লো-পড়েই ছিটকে তার পাশ দিয়ে সমুদ্রের জলে আছড়ে পড়লো। কঁধ ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেন নেমো। আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, নিচে যান আপনি, সঙ্গীদের নিয়ে নিয়ে চলে যান।

আপনি কি জাহাজটাকে আক্রমণ করবেন ক্যাপ্টেন? আমি চেঁচিয়ে উঠলুম।

আকাশ নয়-আমি ওকে ডুবিয়ে দেবো।

না, না, তা করবেন না–

করবোই। ঠাণ্ডা হিম তার গলা, এ-সম্বন্ধে আপনাকে কোনো মতামত দিতে হবে না। যা আপনার কোনোদিনই দেখার কথা নয়, নিয়তি আজ তারই মুখেমুখি করেছে আপনাকে। আক্রমণ ওরা করেছে-প্রত্যুত্তর হবে ভয়ংকর। নিচে চলে যান।

কোন দেশের জাহাজ ওটা? কোথাকার?

আপনি জানেন না? আরো ভালো-অন্তত জাহাজটা কোন দেশের, এই রহস্য আপনার কাছে অজ্ঞাত থেকে যাবে। মিচে যান।

এই আদেশ মান্য না করে উপায় ছিলো না। ততক্ষণে নটিলাস-এর আরো পনেরোটি মাল্লা এসে ক্যাপ্টেন নেমোক ঘিরে দাড়িয়েছে-সেই ধাবমান জাহাজটির দিকে সেই একই প্রতিহিংসার দৃষ্টি নিয়ে অপলকে তাকিয়ে আছে তারা, কোনো পরম ঘৃণায় আর রোষে তারা যেন অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে প্রত্যেকে। নিচে নামতে নামতে শুনলুম আরো একটি গোলা এসে আছড়ে পড়লো নটিলাস-এর উপর, আর সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন নেমো রোষে গর্জন করে উঠলেন : আরো হানো তোমার গোলা, আরো। যত পারো নষ্ট করে তোমার ব্যর্থ গোলা। কিন্তু এটা জেনে রেখো, নটিলাস-এর খজকে এড়াবার ক্ষমতা তোমার নেই।

আর সহ্য হলো না, ছুটে চলে এলুম আমার ঘরে। নটিলাস-এর গতি বৃদ্ধি পেলো, বোঝা গেলো নটিলাস কামানের পাল্লা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ওই যুদ্ধজাহাজ হন্যে হয়ে ঘুরুক নটিলাস-এর পিছনে, তারপর নটিলাস এক সময়। তার অমোঘ উত্তর দেবে-প্রচণ্ড সেই উত্তর চুরমার করে ফেলবে ওই জাহাজ।

এই পরিণতি অনিবার্য। আমি জানি। ক্যাপ্টেন নেমো যেন আদিম দেবতাদের মতো গর্জে উঠেছেন এখন, কোনো বন্য দেবতা চরম তার রোষ যখন পর মতে নামে, তখন নিস্তার নেই। তার চোখ অলাতচক্রের মতো জ্বলে উঠেছে, আর তাই দেখেই বুঝেছি আমি। প্রকৃতির আদি শক্তিগুলো যখন জেগে ওঠে, বাজ বরুণ আগুন যখন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তখন কে তাদের ঠেকাবার সাধ্য রাখে।

এই উন্মাদ জাহাজ ছেড়ে পালাতেই হবে আমাকে। এতদিন নেডের প্রস্তাব আমার সম্পূর্ণ মনঃপূত হয়নি, কিন্তু এখন আর কোনো সংশয় নেই।

আর সঙ্গে সঙ্গে কানে এলো জলাধাৱে জল ঢোকার শব্দ। নটিলাস জলে ডুব দিচ্ছে। আক্রমণটা তাহলে অলের তলা থেকেই হবে? রাতের অন্ধকারে নটিলাস–এর খড় আক্ষরিকভাবে একেঁড়-ওফোড় করে দেবে ওই জাহাজকে! হঠাৎ অনুভব করলুম নটিলাস যেন পাগল হয়ে উঠলো-প্রচণ্ড হয়ে হয়ে উঠলো তার গতিবেগ, থরথর করে কেঁপে উঠলো সমস্ত জাহাজ। তারপর একটা ছোট্ট ঝাঁকুনি লাগলো শুধু-আর কিছু নয়।

উন্মাদের মতো সেলুনে গিয়ে ঢুকলুম। গিয়ে দেখি জানলার পাশে ক্যাপ্টেন নেমো পঁড়িয়ে আছেন একা, গম্ভীর, নিশ্চপ, অদ্ভুত দুর্ভেদ্য, বিষন্ন। তাকিয়ে দেখছেন কেমন করে অত বড় যুদ্ধজাহাজটা ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রের জলে।

আস্তে ডুবছে জাহাজটা; একটু-একটু করে জল ঢুকছে তার পাটাতনে-তারপরেই মস্ত একটা বিস্ফোরণে গোটা পাটাতনটা চৌচির হয়ে উড়ে গেলো। তারপর জাহাজটা দ্রুত নেমে এলো সিন্ধুতলে। আর্ত মানুষ, সমরসজ্জা, মস্ত হাল, ঘূর্ণমান চাকা—সব তলিয়ে গেলো অথৈ জলে, সেখানে সিন্ধুতলের বালি তাদের জন্য সমাধি রচনা করে অপেক্ষা করে আছে।

ক্যাপ্টেন নেমোর দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখি অকম্পিত তিনি লক্ষ্য করলেন সক কিছু। সব যখন শেষ হয়ে গেলো নিজের সেই সন্ন্যাসীর ঘরে গিয়ে ঢুকলেন তিনি। দেয়ালে সারি-সারি ঝুলছে চিরযুগের বীরপুরুষদের ছবি : আর তারই তলার আরো-একটা ছবির তলায় দুই হাত প্রসারিত করে আর্ত মানুষের মতো নতজানু হয়ে বসে পড়লেন ক্যাপ্টেন নেমো।

ছবির ফ্রেমের মধ্য থেকে এক তরুণী মহিলা আর দুটি ছেলেমেয়ে অপলকে তাকিয়ে তাকিয়ে যেন দেখলো এই মস্ত মানুষটির দেহ কোন প্রবল কান্নার বেগে বারেবারে দুলে উঠলো।