১.০৪ লৌহদানব বেহেমথ

১.০৪ লৌহদানব বেহেমথ

পাঁচই মে সকালবেলায় কলকাতা থেকে চন্দননগর যাবার রাস্তায় হঠাৎ এক দৃশ্য দেখে সব লোকে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলো।

সকালবেলায় ভারতের রাজধানীর রাস্তায় অদ্ভুত একটি শকট বেরুলো, যা দেখে চারপাশে কৌতূহলী ও বিস্মিত জনতার ভিড় জমে গিয়েছিলো। কারণ ওই শকটটি টেনে আনছিলো এক অতিকায় হাতি; অতিটি উচ্চতায় কুড়ি ফুট আর লম্বায় তিরিশ : তার চালচলনের মধ্যে এমন-একটা অদ্ভুত ভঙ্গি ছিলো যা দেখে রাস্তার লোকে একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিলো। তার শুঁড়টি বাঁকানো, আর শূন্যে-তোলা; মস্ত কাস্তের মতো তার দাঁত দুটি মুখ থেকে বেরিয়ে আছে; পিঠে জমকালো একটি হাওদা, অনেকটা কোনো স্তম্ভতলের মতে-মিনারের মতো ছাত তার, কাচের জানলা বসানো চারদিকে। আর এই হাতিটি দুটি আস্ত বাড়ি-না, চলন্ত বাংলো-টেনে নিয়ে আসছে-বাড়িগুলোর তলায় চারটে করে চাকা; চাকার তলার দিকটাই কেবল দেখা যায়, কারণ উপরের দিকটা শক্ত খোলে ঢাকা। দুটো বাংলোই শেকল দিয়ে এমনভাবে আটকানো যাতে চলার সময় কোনো অসুবিধেই না-হয়। কিন্তু কেমন করে একটা মাত্র হাতি অনায়াসে অমন দুটো বাংলো টেনে নিয়ে যাচ্ছে? তাজ্জব ব্যাপার! কলের মতো পা ফেলে-ফেলে সে আসছিলো প্রথমে, একটু পরেই গতি আরেকটু বৃদ্ধি পেলো—কিন্তু কোথাও কোনো মাহুত দেখা গেলো না, অঙ্কুশের কোনো বালাই-ই নেই যেন।

মাঝে-মাঝে গর্জে উঠছে হাতিটা, ভারতীয় অরণ্যে যে-বৃংহিত প্রায়ই শোনা যায়। আর একটু পরে-পরেই শুঁড়ের ভিতর থেকে ভলকে-ভলকে বেরিয়ে আসছে কালো ধোঁয়া। অথচ, তবু এটা নাকি হাতি। সবুজ-কালো রঙের আঙ্গুরের তলায় ইস্পাতের কাঠামোটা ঢাকা, চোখ দুটো—আসলে দুটি বাতি–সত্যিকার চোখের মতো। আর যেখানে তার হৃৎপিণ্ড থাকার কথা সেখানে রয়েছে স্টীম এঞ্জিন।

অর্থাৎ এটাই সেই চলন্ত বাড়ি–ব্যাঙ্কস তার প্রতিশ্রুতি রেখেছে।

প্রথম বাড়িটায় রয়েছি আমরা-কর্নেল মানরো, ক্যাপ্টেন হুড, ব্যাঙ্কস আর আমি। আর দ্বিতীয়টায় ভৃত্যমহল-সার্জেন্ট ম্যাক-নীলের তত্ত্বাবধানে। ব্যাঙ্কস তার কথা রাখতেই মানরোও তার প্রতিশ্রুতি রাখলেন, আর তাই কলকাতার রাস্তায় এই অদ্ভুত বাড়িটা পাঁচই মে সকালবেলায় ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বেরিয়ে পড়েছে।

কিন্তু, তাই বলে স্টীম এঞ্জিনটা হাতির মতো দেখতে হলো কেন? চতুষ্পদ কোনো শকটের কথা কেউ কখনও ভেবেছিলো? সত্যি-বলতে, প্রথম দেখে আমরাও সবাই তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলুম। শেষকালে ব্যাঙ্কসের কথায় সব পরিষ্কার হয়ে গেলো।

তোমরা কেউ ভূটানের রাজাকে চেনো? ব্যাঙ্কস বলেছিলো আমাদের।

আমি চিনি, বলেছিলো হুড, বরং বলা ভালো, চিনতুম—কারণ দু-মাস আগে রাজা মারা গেছেন।

মরবার আগে রাজা বেঁচে ছিলেন—বেঁচে ছিলেন মানে অন্য-সকলের চেয়ে আলাদাভাবে বেঁচে ছিলেন। জাকজমক ভালোবাসতেন রাজা, লোককে জাকজমক দেখাতে ভালোবাসতেন। কোনো মর্জি হলে তক্ষুনি তা পূর্ণ করা চাই—তার জন্যে যত টাকা লাগে, লাগুক। অদ্ভুত সব পরিকল্পনা খেলতো তার মাথায়-রাজকোষে অঢেল অর্থ না-থাকলে কবেই সেজন্যে তাকে ফতুর হয়ে যেতে হতো কে জানে! একদিন তার মাথায় হঠাৎ একটা অদ্ভুত গাড়ির কথা খেলে গেলো–সেটা নাকি দেখতে হবে হাতির মতো। সঙ্গে সঙ্গে তার একটা কাল্পনিক ছবি এঁকে আমার উপর সেটা বানাবার ভার দিয়ে দিলেন। বানানো হলো ইস্পাতের একটি কাঠামো, হুবহু হাতির মতো দেখতে–তার ভিতরে বয়লার, কলকজা ও ট্র্যাকশন-এঞ্জিনের যাবতীয় যন্ত্রপাতি বসালুম আমি। হাতির শুঁড়টা ইচ্ছেমতো বোম টিপে ওঠানো-নামানো যায়-সেটা হলো চিমনিপায়ের তলায় চাকা বসানো, আর স্টিয়ারিং-এর সঙ্গে সেগুলোর যোগ রইলো; চোখে রইলো বৈদ্যুতিক মশালের ব্যবস্থা-বাস, হস্তিগাড়ি বানানো সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। ভেবো

যে চট করে বানাতে পেরেছিলুম আমি—কাজটা অত সহজ নয়; প্রথমত প্ল্যানটা আমার ছিলো না, ছিলো এক খেয়ালি রাজার-তাই তার মর্জিমতো বানাতে গিয়ে নানা মুশকিলে পড়তে হয়েছিলো আমাকে। এই অতিকায় খেলনাটির জন্যে কত রাত যে নিঘুম কেটেছে, তার ঠিক নেই। রাজাও এত অস্থির হয়ে উঠেছিলেন যে দিনের মধ্যে বেশির ভাগ সময়ই আমার কারখানায় এসে কাণ্ড দেখতেন। কিন্তু কাজটা একেবারে সম্পূর্ণ হবার আগেই তিনি মারা গেলেন—নিজের আবিষ্কারটা আর ব্যবহার করতে পারলেন না। তার বংশধররা আবার তেমন খেয়ালি নয়, তার উপর কুসংস্কারে ভরা, তারা গাড়িটাকে ভাবলে কোনো পাগলের প্রলাপ, বিভ্রম। তারা গাড়িটাকে বেচে দিতে পারলে বাঁচে। তাই আমি নামমাত্র দামে কর্নেল মানবোর টাকায় এটা কিনে নিলুম। এখন এই রইলো চলন্ত বাড়ি বা হস্তিগাড়ি তোমাদের তাবে-আশি অশ্বশক্তি এঞ্জিনটার-আশি হস্তিশক্তির কথা না-হয় না-ই তুললাম।

শাবাশ, ব্যাঙ্কস, তুখোড়! বাহবা! হুড তারিফ করে উঠেছিলো, আমাদের মধ্যে এমন-একজন এঞ্জিনিয়ার আছে যে আসলে আবার শিল্পীও-যে আসলে লোহা আর ইস্পাতের কবিই বরং—তা কে জানতো!

রাজার মৃত্যুর পর গাড়িটা যখন আমার অধীনে এলো, তখন কেন যেন হাতিটাকে ধ্বংস করে ফেলার মতো বুকের জোর পাইনি। তাই গাড়িটাকে আমি কোনো সাধারণ চেহারা দিইনি।

ঠিকই করেছো! কী চমৎকার হবে ভাবো তো, হুড সোল্লাসে বলেছিলো, যখন আমাদের হাতি নেপালের জঙ্গলে ধুপ-ধুপ পা ফেলে যাবে—সত্যি, রাজা ছাড়া এমন ভাব কারু মাথায় আসে।

তক্ষুনি আমাদের অভিযানের ছক কেটে ফেলা হয়েছিলো—ঠিক হয়েছিলো পাঁচই মে আমরা ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে পড়বে।

এই ফাঁকে ব্যাঙ্কসের চলন্ত বাড়ির কলকজার কথা সংক্ষেপে সেরে নিই। তার পেটের মধ্যেই গাড়ির সব যন্ত্রপাতি পোরা হয়েছে—সিলিণ্ডার, পিস্টন, পাম্প, বয়লার–সবকিছু। পিছনের দিকে রয়েছে জল আর জ্বালানি। বয়লার আর জ্বালানি-খুপরির মাঝখানের জায়গাটিতে রয়েছে জ্বালানিকে অগ্নিকুণ্ডে ফেলার জন্য একটি জ্বালানিবাহী যন্ত্র। বয়লার আর জ্বালানি-খুপরি বসানো সেরা জাতের ইস্পাতের স্পিঙের উপর, যাতে বন্ধুর রাস্তাতেও তাদের উপর বেশি চোট না-পড়ে। চাকাগুলো নিরেট; যাতে পিছলে না-যায়, সেই জন্যে যথেষ্ট সাবধানে বানানো হয়েছে। এঞ্জিনের ক্ষমতা যদিও স্বাভাবিক ক্ষেত্রে আশি অশ্বশক্তি—কিন্তু প্রয়োজন হলে তাকে বাড়িয়ে দেড়শো অশ্বশক্তিতে নিয়ে গেলেও বিস্ফোরণের বা বয়লার ফেটে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর সব কলকজার বাইরে ইস্পাতের ঢাকনা বসানোযাতে রাস্তার ধুলোবালি ভিতরে ঢুকতে না-পারে।

বাড়িগুলো প্যাগোড়ার মতো দেখতে, মিনার নেই—কিন্তু গম্বুজের গায়ে নানা কাজ করা। সামনে পিছনে প্রশস্ত বারান্দা রয়েছে। দেখে মনে হয় যেন শোনগড়ের প্যাগোড়াই হঠাৎ পা গজিয়ে চলতে শুরু করে দিয়েছে। এই সঙ্গে এ-কথা বলাও ভালো যে এই আশ্চর্য বাড়িটা আবার জলেও ভাসতে পারে। কারণ বাড়িগুলোর নিচের দিক হালকা একটা ইস্পাতের নৌকোর মতো তৈরি—আর হাতির পেটে স্টীমারের যন্ত্রপাতিও ঢোকানো হয়েছে। হাতির পাগুলো যেন স্টীমারের চাকা—; ফলে ভারতের মতো বিচিত্র দেশে বেড়াবার পক্ষে জলে-ডাঙায় সমানভাবে চলে এমনি একটা উভচর গাড়ি পেয়ে আমরা সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠলুম। ভূটানের রাজাকে ধন্যবাদ, কারণ কোনো খেয়ালি কবি ছাড়া এমন যানের কথা আর কার মাথায় আসতো? বাংলো দুটি মাত্র আঠারো ফিট প্রশস্ততাই তেমন একটা জায়গা জুড়ে যাবে না। ভিতরটা ইওরোপীয় কেতায় সাজানো; যাতে কারু বিন্দুমাত্র অসুবিধে না-হয়, ব্যাঙ্কস সেদিকে সবসময় সজাগ লক্ষ রেখেছিলো।

 

কলকাতায় এসে আমি উঠেছিলুম স্পেনসার হোটেলে—সেটাই নাকি কলকাতার সবচেয়ে ভালো হোটেল। পাঁচই মে সকালবেলা হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লুম আমি। ততদিনে কলকাতা আমার বেশ চেনা হয়ে গেছে। সকালবেলায় বেড়াতে বেরুতুম, সন্ধেবেলায় স্ট্রাওে গঙ্গার হাওয়া খেতুম—দুপুরবেলাটা অবশ্য গরমে কাহিল হয়ে পড়তে হতো। এসপ্লানেড, গড়ের মাঠ, ফোর্ট উইলিয়াম, গঙ্গার ধারে শ্মশানঘাট, কলকাতার হাটবাজার, হুডার সাহেবের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বটানিক্যাল গার্ডেন, কালীঘাটের মন্দির, চৌরঙ্গির অদ্ভুত বাড়িগুলো, লাটসাহেবের বাড়ি, টাউন হল, হুগলির ইমামবাড়া, খিদিরপুর ডক–কিছুই আমি দেখতে বাকি রাখিনি!

হোটেল থেকে বেরিয়ে পাল্কিগাড়িতে করে কর্নেল মানরোর বাংলোয় গিয়ে হাজির হয়ে দেখি ক্যাপ্টেন হুডের তুলকালাম ফুর্তির আর শেষ নেই। শেষকালে যে কর্নেল মানররা তার নির্জনবাস ছেড়ে সঙ্গে যেতে রাজি হয়েছেন, এই আনন্দেই সে আটখানা।

টং করে যাবার ঘণ্টা পড়লো। স্টীম চাপাননা হয়েছে পূর্ণ মাত্রায়। এঞ্জিনচালক বসে আছে তার আসনে, রেগুলেটরে হাত দিয়ে। তীব্র সুরে বাঁশি বেজে উঠলো এঞ্জিনের।

চলো, বেহেমথ, চলো! হাত নেড়ে চেঁচিয়ে বললে ক্যাপ্টেন হুড।

আর সত্যি, বেহেমথ ছাড়া আর কী-ই বা নাম হতে পারে এই আশ্চর্য শকটের। বেহেমথ কথাটা হিব্রু থেকে নেয়া, আর হিব্রুরা শব্দটা ধার করেছে মিশরি পেহেমেউ কথা থেকে, যার মানে হলো অতিকায় জলহস্তী।

আমাদের এঞ্জিনচালকের নাম স্টর; বয়েস ৪০ হবে; স্টর একজন ইংরেজ, কয়েক মাস আগেও সে গ্রেট সাদার্ন রেলপথে কাজ করতো-ব্যাঙ্কস তাকে অত্যন্ত চালাক চতুর ও কর্মঠ দেখেই বেহেমথের চালক হিশেবে নিযুক্ত করেছিলো। ফায়ারম্যানের নাম কালু, আসলে সাঁওতাল—ধকল আর তাপ সইতে পারে বলে রেল কম্পানিতে তারা ফায়ারম্যানের কাজ পায়, লোহিত সাগরে যেমন আরবরা স্টীমারের কয়লা জোগানোর চাকরি নেয়। তা ছাড়া গৌমি নামে কর্নেল মানরোর এক গুখা ভৃত্য ছিলো। বেঁটে-খাটো, ক্ষিপ্র, চটপটে আর বিশ্বস্ত-আগে গুর্খা রাইফেলসের সেপাই ছিলো— এখনও পলটনি উর্দি গা থেকে নামায়নি;-ম্যাক-নীলের মতো গৌমিও মানরোর অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন। ক্যাপ্টেন হুডেরও এক বিশ্বস্ত অনুচর ছিলো—ফক্স নামে এক অল্পবয়েসী ইংরেজ, প্রাণখোলা আর চটপটে—সবদিক থেকেই তারুণ্যে ভরপুর। হুডের মতো, সেও খুব ভালো শিকারী—সেই জন্যেই হুডের সে এত ভক্ত। হুডের সঙ্গে অনেকবার শিকারে গেছে সে এ-পর্যন্ত সে বাঘ মেরেছে সাঁইত্রিশটি, আর ইড মেরেছে তার চেয়ে মাত্র তিনটি বেশি। এছাড়া ছিলো একটি নিগ্রো বাবুর্চি-নিকষ নিগ্রো ঠিক নয়, দোআঁশলা, ফরাশি রক্তও আছে তার ধমনীতে-নাম সিয় পারাজার। ভালো রান্না করতে পারে বলে তার গর্বের আর শেষ নেই।

সবমিলিয়ে আমাদের বাহিনীর সদস্য দশজন : সার এডওয়ার্ড মানরো, ব্যাঙ্কস, হুড, আমি—মোক্লের, ম্যাক-নীল, স্টর, কালু, গৌমি, ফক্স আর মঁসিয় পারাজার। ফ্যান আর নাইজার নামের শিকারি কুকুর দুটির কথাও অবিশ্যি উল্লেখ করা উচিত—তাদের যথাযথ স্বীকৃতি না-দিলে হুড আবার রেগে উঠবে।

হুগলি নদীর বাম তীর ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো বেহেমথ। হুগলি গঙ্গার পশ্চিম দিকের শাখা। গঙ্গা আসলে অদ্ভুত নদী : সমস্ত উত্তরাপথের সমৃদ্ধির উৎস সে, কিন্তু হুডের মতে এমন খেয়ালি, বদমেজাজি ও পাগল নদী নাকি খুব কম আছে-কখন যে দিক বদলাবে-কোথায় যে তার নতুন শাখা বেরুবে, তা নাকি কেউ বুঝতে পারে না। আগে নাকি রাজমহল আর গৌড়-দুই-ই ছিলো গঙ্গার তীরে, অথচ এখন তারা জলের অভাবে নাকি শুকিয়ে মরে।

শুনে বললুম, তাহলে তো কলকাতার কপালেও অনেক দুঃখ আছে!

কে জানে–হুড বললে।

না, না, ব্যাঙ্কস বললে, আজকাল আর ও-সব হবে না। আমরা এঞ্জিনিয়াররা আছি কী করতে-খাল কেটে সর্বত্র জল নিয়ে যাবো!

হুড কিন্তু ততক্ষণে নিজের বিষয় পেড়ে ফেলেছে, বাংলা দেশের নদীর কথা বলতেই আমার সুন্দরবনের কথা মনে পড়ে যায়। আহা, রোদে পিঠ দিয়ে কুমিরগুলো কেমন শুয়ে আছে চড়ায়। আর কী সুন্দর বাঘ : রাজার মতো–তেমনি অহংকারী, উদ্ধত আর মেজাজি!

আমাদের সব কথা হচ্ছিলো চলন্ত বেহেমথের খাবার-ঘরে বসে; ছোটোহাজরি সেরেছি আমরা একটু আগে-ফক্স দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবার টেবিল সাফ করছে তখন।

ফক্স! হুড ডাক দিলে।

বলুন, ক্যাপ্টেন!

সুন্দরবনেই তো তুমি সাঁইত্রিশ নম্বরটাকে মেরেছিলে!

হ্যাঁ ক্যাপ্টেন-ক্যানিং থেকে দু-মাইল দূরে। সেদিন সন্ধেবেলায়–

বাস, বাস্, তাহলেই হবে। সাঁইত্রিশ নম্বরের সব কথাই আমি জানি। তোমার আটত্রিশ নম্বরটির ইতিহাস জানবার জন্যই আমার কৌতূহল জাগছে।

আটত্রিশ নম্বরটি তো এখনও মারিনি, ক্যাপ্টেন?

মারোনি, কিন্তু একদিন মারবে তো। সেদিন আমিও আমার একচল্লিশ নম্বরটিকে শিকার করবো, ফক্স।

লক্ষ করার বিষয় হুড বা ফক্স-কেউ এর মধ্যে একবারও বাঘ কথাটি উচ্চারণ করলে না। দরকারই বা কী? নম্বর দিয়ে বললেই তারা পরস্পরের কথা বুঝে নিতে পারে।

একটা নাগাদ বেহেমথ চন্দননগর পৌঁছুলো। সারা বাংলা দেশে এই জায়গাটাই কেবল ফরাশিদের সম্পত্তি এখন। এককালে খুবই সমৃদ্ধ ছিলো, এখন চারধারে কেবল ক্ষয়েরই চিহ্ন। লোকজনও তেমন নেই। এলাহাবাদের রেলপথ এখান দিয়ে গেলে হয়তো আবার শহরটা একটু জীবন্ত হতো। কিন্তু ফরাশি অঞ্চল বলে রেলপথ পাতা হয়েছে ঘুরিয়ে–চন্দননগরের বাইরে দিয়ে।

আমরা ঠিক চন্দননগরের ভিতরে ঢুকিনি। শহরের তিন মাইল দূরেই আস্তানা গেড়েছিলুম। এর পরে দু-দিন ধরে একটানা চললে আমরা বর্ধমান পৌঁছুবো—তাই এখানে একটু বিশ্রাম করে নেবার পরিকল্পনা ছিলো।

মে মাসের নয় তারিখে বর্ধমানের প্রধান তোরণের কাছে পৌঁছুলুম আমরা; সেই দিনটা বর্ধমানের যাবতীয় দ্রষ্টব্য স্থান দেখে নিয়ে পরদিন রামগড়ের উদ্দেশে রওনা হয়ে পড়লুম। এই পথ দিয়ে যাবার ফলে আমরা অবশ্য মুর্শিদাবাদ, মুঙ্গের কি পাটনা দেখতে পেলুম না, কিন্তু বারাণসীর উদ্দেশে রায়গড় হয়ে গেলেই তাড়াতাড়ি পৌঁছুবো বলে আমরা এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলুম।

পনেরোই মে আমরা রামগড় পেরিয়ে গেলুম-আঠারোই মে ছোেট্ট শহর চিত্রায় থামলো বেহেমথ।

পথে তেমন-কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনাই ঘটেনি। গরম ছিলো প্রচণ্ড, কাজেই ছায়ায়-ছায়ায় দিবানিদ্রার চেয়ে আরামপ্রদ আর কী ছিলো! সন্ধেবেলায় গরম কমলে আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিতুম—কেবল কর্নেল মানরো আর সার্জেন্ট ম্যাক-নীল আমাদের আলোচনায় যোগ দিতেন না–চুপ করে বসে-বসে কী যেন ভাবতেন। হয়তো বেহেমথ ক্রমশ বিদ্রোহের ঘটনাস্থলের দিকে এগুচ্ছে বলেই স্মৃতি জেগে-ওঠার ফলে কর্নেল মানরো অমন গুম মেরে গেছেন। কে জানে!