১৬-২০. বন্দীদের নিয়ে যাওয়ার পর

১৬.

বন্দীদের নিয়ে যাওয়ার পর হাত নাড়লো আয়শা। দর্শকরা উল্টোদিকে ঘুরে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে গেল গুহা ছেড়ে। তাদের রানী আর আমি রইলাম কেবল। রানীর কয়েকজন পরিচারক-পরিচারিকা এবং রক্ষীও রইলো। এই সুযোগ, ভেবে, অসুস্থ লিওকে দেখতে যাওয়ার জন্যে বললাম আয়শাকে। রাজি হলো না সে। বললো, রাতের আগে নিশ্চয়ই মারা যাবে না ছেলেটা। এ ধরনের রোগে মানুষ মরে হয় রাতে নয় ভোর বেলা। সুতরাং দিনের বাকি সময়টুকু অপেক্ষা করলে খুব একটা অসুবিধা হবে না।

আর কি করতে পারি আমি? বিদায় নেয়ার জন্য উঠলাম। কিন্তু আমাকে যেতে দিলো না আয়শা। বললো, এবার তোমাকে বিস্ময়কর কিছু জিনিস দেখাবো, হলি। থাকো আমার সাথে। এই বিশাল গুহার দিকে তাকাও। এমন কিছু আর দেখেছো জীবনে? এখানে যে জাতি বাস করতো তারা হাত দিয়ে খোদাই করেছিলো এসব। কত লোক কত সময় ধরে করেছিলো এ কাজ বলো দেখি?

নিঃসন্দেহে হাজার হাজার লোকের হাজার বছরেরও বেশি লেগেছিলো, জবাব দিলাম আমি।

ঠিক তাই, হলি। মিসরীয়দের চেয়েও প্রাচীন ছিলো সে জাতি। ওদের ভাষা সামান্য পড়তে পারি আমি। এদিকে এসো, দেখ এখানে কি লিখেছে ওরা।

বেদীর ওপর যেখানে বসেছিলো আয়শা ঠিক তার পেছনে দেয়ালে খোদাই করা একটা ছবি। হাতির দাঁতের ছড়ি হাতে এক বৃদ্ধ বসে আছে। তার নিচে খোদাই করা কতকগুলো অক্ষর। দেখতে অনেকটা চীনা অক্ষরের মতো। লেখাটা পড়ে অনুবাদ করে শোনালো আয়শা:

রাজকীয় কোর নগরীর পত্তনের চার হাজার দুশো উনষাটতম বছরে কোর এর রাজা তিসনো-এর সময় এই গুহার (অথবা সমাধিস্থানের) নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এখানকার মানুষ এবং তাদের দাসরা তিন পুরুষ যাবৎ পরিশ্রম করে পরবর্তী বংশধরদের জন্যে এই সমাধিস্থান নির্মাণ করে। স্বর্গের আশীর্বাদ নেমে আসুক তাদের কাজের ওপর এবং পরাক্রমশালী সম্রাট তিসনোর ওপর।

দেখেছো, হলি, বললো আয়শা। এই গুহা তৈরির কাজ শেষ হওয়ার চার হাজার বছরেরও বেশি আগে ওরা নগরীর পত্তন করেছিলো। প্রথম যখন আমি এখানে আসি, দুহাজার বছর আগে, তখনও এ জায়গার অবস্থা এখন যেমন দেখছো, হুবহু তেমন ছিলো। এখন বুঝে দেখ, কত পুরানো নগরটা। এবার চলো, তোমাকে দেখাই, সেই মহান জাতির যখন পতন হলো তখন তাদের অনুভূতি কেমন হয়েছিলো।

গুহার মাঝামাঝি জায়গায় আমাকে নিয়ে গেল আয়শা। মেঝেতে গোল একটা পাথর দেখালো। একই রকম অক্ষরে কি যেন লেখা এটার ওপরেও।

বলো তো, কি লেখা এতে? জিজ্ঞেস করলো আয়শা।

জানি না।

এবারও লেখাগুলো অনুবাদ করে শোনালো সে:

আমি, জুনিস, কোর-এর প্রধান মন্দিরের একজন পুরোহিত, কোর নগরীর পত্তনের চার হাজার আটশো তিন বছর পর এই কথা লিখছি। কোর-এর পতন হয়েছে। এর বিশাল কামরাগুলোয় আর কোনো ভোজোৎসব হবে না, দুনিয়ার ওপর তার কর্তৃত্ব শেষ, তার নৌবহর দুনিয়ার বন্দরে বন্দরে আর বাণিজ্য করে বেড়াবে না। কোর-এর পতন হয়েছে। এর সুউচ্চ সৌধসমূহ, বন্দরগুলো, খালগুলো সব নেকড়ে, পেঁচা আর বুনো হাঁসের বিচরণভূমি হবে। এককুড়ি পাঁচ চাঁদ আগে একটা মেঘ এসে স্থির হয় কোর-এর আকাশে। সেই মেঘ থেকে নেমে আসে মড়ক। অসহায়ভাবে মরতে থাকে তার অধিবাসীরা। বৃদ্ধ-যুবক, নারী পুরুষ; ধনী-নির্ধন, রাজকুমার-দাস কেউ বাদ যায়নি। এত প্রচুর সংখ্যায় তারা মরেছে যে, কোর-এর সন্তানদের মৃতদেহ প্রথাসিদ্ধ উপায়ে সংরক্ষণ করাও সম্ভব হয়নি। এই গুহার নিচে যে বিশাল গহুর তার ভেতরে ফেলে দেয়া হয় মৃতদেহগুলো। শেষ পর্যন্ত এই মহান জাতির বেঁচে যাওয়া সামান্য কিছু মানুষ কোনোমতে উপকূলে পৌঁছে জাহাজে চাপে, এবং পাল তুলে উত্তর দিকে রওনা হয়ে যায়। আমি, পুরোহিত জুনিস, এই উপাখ্যানের লেখক, একা কেবল বেঁচে আছি এই বিশাল নগরীতে। অন্য কোনো নগরীতে আর কেউ বেঁচে আছে কিনা জানি না। মৃত্যুর আগে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে একথা আমি লিখে রেখে যাচ্ছি, কারণ, রাজকীয় কোর-এর অস্তিত্ব বিলুপ্ত, এর মন্দিরে উপাসনা করার কেউ নেই, প্রতিটা জায়গা শূন্য; এর রাজপুত্র, সেনাধ্যক্ষ, সওদাগর, সুন্দরী রমণীরা–সবাই হারিয়ে গেছে দুনিয়া থেকে।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুক চিরে। কি ভয়ঙ্কর ঘটনা। প্রবল পরাক্রমশালী এক রাষ্ট্রের শেষ জীবিত ব্যক্তি লিখে রেখে গেছে এই ইতিহাস! কথাটা মনে হতেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো আমার শরীর।

তোমার কি মনে হয়, হলি, আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বললো আয়শা। উত্তর দিকে যারা গিয়েছিলো তারাই কি মিসরীয়দের পূর্বপুরুষ?

জানি না, আমার শুধু মনে হচ্ছে, পৃথিবীটা খুব পুরানো।

পুরানো? হ্যাঁ, তা বটে। যুগে যুগে কত জাতির বিকাশ হয়েছে। একটার চেয়ে অন্যটা উন্নত, শক্তিশালী। একটাকে পরাভূত করে মাথা তুলেছে অন্যটা। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে একটা ছাড়িয়ে গেছে অন্যটাকে। কে জানে, হাজার হাজার বছর আগে দুনিয়ার কোথায় কি ঘটেছে, ভবিষ্যতেই বা কি ঘটবে? যাকগে, চলো, এই লেখায় যে বিশাল গহূরের কথা বলা হয়েছে, সেটা দেখাই তোমাকে। জীবনে এমন দৃশ্য আর কখনো দেখোনি তুমি।

তার পেছন পেছন পাশের একটা প্রবেশ পথ ধরে এগোলাম আমি। কিছুদূর যাওয়ার পর সিঁড়ি। নামতে শুরু করলাম আমরা। অসংখ্য ধাপ সিঁড়িটায়। নামছি তো নামছি। প্রায় ষাট ফুট মতো নেমে যাওয়ার ধর শেষ হলো সিঁড়ি। উপর দিকে উঠে যাওয়া অদ্ভুতদর্শন গর্ত বা নল তৈরি-করে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে এখানে। ,

 এগিয়ে চললাম আমরা। হঠাৎ শেষ হয়ে গেল পথ। পেছন পেছন আসা কয়েকজন পরিচারিকাকে প্রদীপ উঁচু করে ধরতে বললো সে। তারপর যা দেখলাম, সত্যি সত্যি আগে কখনো তো দেখিইনি, ভবিষ্যতেও সম্ভবত দেখবো না। বিশাল একটা গর্তের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। কত নিচে সেটার তলা জানি না। গর্তের কিনারাটা পাথরের নিচু একটা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রদীপটা উঁচু হতেই আলো পড়লো ভেতরে। উঁকি দিতেই শির শির করে উঠলো শরীর। অসংখ্য মানব-কঙ্কালে ঠাসা গর্তটা। এমন ভয়ানক দৃশ্য দেখতে হবে সত্যিই কখনো কল্পনা করিনি। প্রদীপের মৃদু আলোয় দাঁত বের করে যেন ভেংচাচ্ছে সাদা হাড়ের স্তূপ।

চলুন, আয়শা, তাড়াতাড়ি বললাম আমি। যথেষ্ট দেখা হয়েছে। আর দেখতে চাই না। ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে যোগ করলাম, সেই মহা-মড়কে মরেছিলো যারা তাদের কঙ্কাল, তাই তো?

হ্যাঁ। মিসরীয়দের মতো কোর-এর লোকরাও মৃতদেহ সংরক্ষণ করতো। তবে মিসরীয়দের চেয়ে তাদের পদ্ধতি অনেক উন্নত ছিলো। মিসরীয়রা যেখানে মগজ বের করে নিতে, সেখানে কোর-এর ওরা শিরার ভেতর দিয়ে এক ধরনের তরল পদার্থ ঢুকিয়ে দিতো। সেই তরল পদার্থ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে যুগ যুগ ধরে অবিকৃত রাখতো মৃতদেহ। চলো দেখাবো তামাকে।

সেই বিশাল গহ্বর থেকে বেরিয়ে একটা ছোট দরজার মতো প্রবেশমুখের সামনে দাঁড়ালো সে। পরিচারিকাদের বাতি হাতে আগে আগে যেতে বললো।

ছোট্ট একটা কুঠরিতে ঢুকলাম আমরা। দুটো পাথরের চৌকি দুপাশে। সেগুলোর ওপর শোয়ানো হলদেটে লিনেনে ঢাকা মৃর্তি।

একটা চৌকির সামনে দিয়ে দাঁড়ালো আয়শা। আমাকে ডাকলো কাছে।

কাপড়টা ওঠাও, হলি, বললো সে।

হাত বাড়ালাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে আনলাম আবার। সাহস হলো না তোলার–কি দেখবো কে জানে? একটু হেসে আয়শা নিজেই সরিয়ে দিলো কাপড়টা। আরো সূক্ষ্ম একটা কাপড় নিচে। সেটাও সরিয়ে দিলো। তারপর দেখলাম-হাজার হাজার বছরের ভেতর এই প্রথম জীবিত মানুষের দৃষ্টি পড়লো সেই শীতল মৃতদেহের দিকে, এক মহিলা। বছর পঁয়ত্রিশেক হবে বয়েস; একটু কমও হতে পারে, নিঃসন্দেহে সুন্দরী। এখনো সম্পূর্ণ অবিকৃত রয়েছে তার সৌন্দর্য। সাদা একটা কাপড় পরে আছে। দুহাতে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আছে ছোট্ট একটা বাচ্চাকে! অসম্ভব মিষ্টি কক্ষ একটা দৃশ্য-নির্দ্বিধায় স্বীকার করছি, চোখের পানি ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না আমি। মা ও শিশু শেষ শয্যায় শুয়ে!

কাপড় দিয়ে দেহ দুটো ঢেকে দিলো আয়শা। বেরিয়ে এলাম আমরা গুহা ছেড়ে। তারপর অন্য একটা গুহায় গিয়ে ঢুকলাম। একই ভাবে সংরক্ষণ করা অনেকগুলো মৃতদেহ দেখলাম এখানেও। অবশেষে শেষ সমাধি গুহায় ঢুকলাম আমরা। এখানে একটা পাথরের চৌকিতে দুটো মৃতদেহ শোয়ানো। আমি নিজেই। এবার কাপড় সরালাম। বুকে বুকে আলিঙ্গন করে শুয়ে আছে এক যুবক আর এক তরুণী। মেয়েটার মাথা ছেলেটার হাতের ওপর, ছেলেটার ঠোঁট দুটো চুয়ে আছে মেয়েটার ভুরু। ছেলেটার গায়ের লিনেনের কাপড় খুললাম আমি। হৃৎপিণ্ড বরাবর একটা ছোরার-ক্ষত দেখতে পেলাম। মেয়েটার নিটোল একটা স্তনের নিচেও তেমন একটা ক্ষত। উপরে একটা পাথরে খোদাই করা তিনটি শব্দ। আয়শা অনুবাদ করে শোনালো, মৃত্যুর মাঝে পরিণীত।

কারা এই তরুণ-তরুণী? কেন এই করুণ মৃত্যু ওদের? চোখ বুজে ভাববার চেষ্টা করলাম কারণগুলো, কিন্তু কোনো কূল কিনারা পেলাম না। আয়শাকে জিজ্ঞেস করেও যে খুব একটা লাভ হবে তা মনে হলো না। কারণ ও এখানে আসার অনেক আগেই মৃতদেহগুলো এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

আরো দেখবে, বিদেশী অতিথি? জিজ্ঞেস করলো সে। চাও তো চলো, কোর-এর প্রবল পরাক্রমশালী রাজা তিসনোর সমাধি গুহা দেখাই তোমাকে।

না, মহান রানী, যথেষ্ট হয়েছে, বললাম আমি। মৃত্যুর এই রূপ আর সহ্য করতে পারছি না। মানুষের তুচ্ছতা বড় বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন, আয়শা!

.

১৭.

পরিচারিকারা বাতি হাতে পথ দেখিয়ে চললো। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা আয়শার ঘরের সামনে এসে পড়লাম। বিদায় চাইলাম আমি।

না, বললো সে। এসো আমার সাথে। সত্যি কথা বলতে কি, হলি, তোমার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগছে আমার। ভেবে দেখ, দুহাজার বছরেরও বেশি পেরিয়ে গেছে, এইসব ক্রীতদাস ছাড়া কখনো ভদ্রলোকের সাথে কথা বলার সুযোগ পাইনি। অন্য কেউ হলে বুক ফেটে মরে যেতো না? এসো, হলি, বসো কিছুক্ষণ আমার সাথে। আবার আমার সৌন্দর্য দেখবো তোমাকে।

সত্যিই আর কিছু না বলে ওপরের আলখাল্লা এবং মুখাবরণ খুলে ফেললো সে। প্রদীপের আলোয় ঝিকমিকিয়ে উঠলের কোমরের সোনার সাপটা।

নতুন একটা ভাব খেলা করে বেড়াচ্ছে আয়শার মুখ জুড়ে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, বদলে গেছে তার মনের রঙ। প্রগল্‌ভ হয়ে উঠেছে সে। মৃদু হেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিলো আমার ওপর। মাথা নেড়ে সামান্য দোলালো ঘন দীর্ঘ চুলের রাশি! অপূর্ব এক সুগন্ধে ভরে গেল জায়গাটা। চটি পরা নিটোল একটা পা ঠকলো মেঝেতে। গুন গুন করে গেয়ে উঠলো প্রাচীন একটা গ্রীক বিয়ের গান। সব গাম্ভীর্য খসে পড়েছে। অদ্ভুত এক মিটি মিটি হাসি তার দুচোখে।

বসো, হলি। যেখানে ইচ্ছে তোমার। যেখানে বসলে আমাকে ভালো মতো দেখতে পাবে সেখানেই বসো। কিন্তু আবার তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, বেশি দেখো না। অক্ষম বাসনায় নিজের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে খাও তা চাই না, তোমাকে পছন্দ করি আমি।

এবার বলো, সত্যিই আমার শুনতে ইচ্ছে করছে, আমি কি সুন্দরী নই? না, অত তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। সবদিক ভালো করে বিবেচনা করো, তারপর বলো। আমার চেহারা, আমার শরীর, আমার লাবণ্য, গায়ের রং, সব বিচার করো। তারপর বলো, এর কণামাত্র সৌন্দর্য আর কোনো নারীর ভেতর দেখেছো? দেখ আমার কোমর, খুব মোটা মনে হচ্ছে? আসলে মোটেই তা নয়, এই সোনার সাপটার জন্যেই অমন লাগছে। বিশ্বাস না হয় ধরে দেখ। এখানে দুহাত বেড় দিয়ে ধরো। কি ধরতে পারছো, হলি?

আর সহ্য করতে পারলাম না আমি। শত হলেও আমি পুরুষ আর সে নারী নারীর চেয়েও বেশি। হাটু গেড়ে বসে পড়লাম আমি। করুণ গলায় মিনতি করে বললাম, আমি তোমাকে পূজা করবো, আয়শা, আমার অবিনশ্বর আত্ম নিবেদন করবো তোমার উদ্দেশ্যে, আমাকে বিয়ে করো।

নিঃসন্দেহে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। সংবিৎ ফিরলো তার খিলখিল হাসি শুনে।

ওহ, এত শিগগির, হলি? অবাক লাগছে আমার, কমুহূর্তের ভেতর হাঁটু গেড়ে বসালাম তোমাকে! উহ্, কতদিন যে কোনো পুরুষকে এমন ভঙ্গিতে দেখিনি! বিশ্বাস করো, মেয়ে মানুষের কাছে এর চেয়ে তৃপ্তির আর কিছু নেই।

কিন্তু তুমি, হলি, কি করে পারলে এমন করতে? কি করে পারলে? তোমাকে বলিনি, আমি তোমার জন্যে নই? পৃথিবীতে একজনকেই মাত্র আমি ভালোবাসি, সে তুমি নও। এত পাণ্ডিত্য তোমার, তবু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি; তুমি বোকা, মায়া-মরীচিকার পেছনে ছুটছে। হঠাৎ করেই বদলে গেল তার গলার স্বর, আমার চোখের দিকে তাকাবে? চুমু খাবে আমাকে? বেশ তাতে যদি খুশি হও, তাকাও। বুকে আমার মুখের সামনে মুখ নিয়ে এলো সে। তাকালো আমার চোখের দিকে। হ্যাঁ তাকাও, ইচ্ছে হলে চুমুও খেতে পারো। প্রকৃতির নিয়মকে ধন্যবাদ, হৃদয়ে ছাড়া আর কোথাও কোনো চিহ্ন রেখে যায় না। কিন্তু তুমি যদি আমাকে চুমু দাও, আমি বলছি, নিশ্চয়ই আমার প্রেমে অন্ধ হয়ে তুমি তোমার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে খাবে, এবং মরবে! আর একটু ঝুঁকে এলো সে। কোমল রেশমের মতো চুলগুলোর মৃদু পরশ বুলিয়ে দিলো আমার মুখে। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গেলাম আমি। আচমকা হাত বাড়িয়ে দিলাম ওকে জড়িয়ে ধরার জন্যে। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সোজা হলো সে। আবার বদলে গেছে তার মুখের রং। আবার সেই পুরানো ভাবলেশহীন কাঠিন্য ফিরে এসেছে। সংবিৎ ফিরলো আমার। শির শির করে উঠলো শরীরের ভেতর। এবার নিঃসন্দেহে ভস্ম করে ফেলবে আমাকে!

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিলো সে। বললো, যথেষ্ট নষ্টামি হয়েছে, আর নয়। শোনো, হলি, তুমি ভালো লোক, সৎ, এবারও মাফ করে দিলাম তোমাকে। আগেই বলেছি, আমি তোমার জন্যে নই, তবু কেন আমার দিকে হাত বাড়ালে? আবার যদি বিরক্ত করো, আমি ঘোমটা টেনে দেবব, আর কখনো আমার মুখ দেখবে না তুমি।

উঠে গদিমোড়া আসনটায় বসে পড়লাম আমি, এখনো থর থর করে কাঁপছে শরীর। আয়শা আবার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

নাও, কয়েকটা ফল খাও, বললো সে। তারপর সেই হিব্রু মেসায়ার দর্শন সম্পর্কে বলো আমাকে।

ইতিমধ্যে অনেকটা সামলে নিয়েছি আমি। ধীরে ধীরে বলতে লাগলাম মহান যীশুর দর্শন অর্থাৎ খ্রীষ্ট ধর্ম সম্পর্কে। তার পরে আয়শার নিজের জাতি আরবদের ভেতর এক নবী এসেছিলেন, সে কথাও বললাম। মোহাম্মদ তার নাম। নতুন এক বিশ্বাসে মানুষকে দীক্ষিত করেন তিনি।

আহ্! দুই দুটো নতুন ধর্ম! আমার জানা মতেই সে-যুগে এতগুলো ধর্ম ছিলো, তারপরেও আরো দুটো! উহ্, এই মানুষ! কেবল পাপ আর পঙ্কিলতার পথে পা বাড়াবে!

এই সুযোগে আমি জিজ্ঞেস করলাম আয়শার নিজের দর্শন সম্পর্কে।

আমাদের জাতিও একজন নবী পেয়েছিলো, হলি, বললো সে। তুমি হয়তো বলবে ভণ্ড নবী, কারণ তোমার নিজের নন তিনি। তবু আমাদের কাছে তিনি নবী। সে সময় আমাদের আরবদের অনেক দেব-দেবী ছিলো। একজনের নাম ছিলো আল্লাত, অন্য একজন সাবা, অর্থাৎ স্বর্গের রক্ষক; আল উজ্জা, এবং নিষ্ঠুর মানাহ্তার উদ্দেশ্যে নরবলি দেয়া হতো। আরো আছে ওয়াদ্দ, সাওয়া, ইয়াঘুথ অর্থাৎ ইয়ামানের যোদ্ধাদের সিংহ; এবং ইয়াউক-মোরাদের অশ্ব; নাসর হামিয়ারের ঈগল, এবং আরো অনেক! সব ভাঁওতা, কি করে যে মানুষ এসব বিশ্বাস করতো। আমি যখন জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারলাম এসব মিথ্যা তখন মানুষকে জানালাম, সেকথা! কিন্তু ওরা কি করলো? আর একটু হলেই খুন করে ফেলেছিলো আমাকে। কিন্তু, হলি, এমন চুপচাপ বসে আছো কেন তুমি? কোনো কথা বলছো না, আমি একাই বকে চলেছি। বিরক্ত হয়ে উঠেছে আমার ওপর? না কি ভয় পাচ্ছে, আমার দর্শন শেখাতে শুরু করবো তোমাকে? ওহ মানুষ! আধ ঘণ্টাও হয়নি, হাঁটু গেড়ে বসে শপথ করে বললে, আমাকে ভালোবাসো। আর এখন, আমার কথাটাও বিরক্তিকর লাগছে?

কি বলবো আমি? কেন যে চুপ করে বসে আছি কি করে বোঝাবো আয়শাকে।

ও বুঝেছি, বলে চললো সে। সেই অসুস্থ ছেলেটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছো? ঠিক আছে ওকে সারিয়ে তুলবো আমি। ভয় পেও না, কোনোরকম জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করবো না। তোমাকে তো আগেই বলেছি, জাদু বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। তুমি তাহলে যাও এখন। ওষুধটা তৈরি করতে যতক্ষণ লাগে, তার পরেই আমি আসছি।

.

লিওর গুহায় ফিরে এলাম আমি। পাংশু মুখে বসে আছে জব আর উস্তেন। দুজনের মুখ দেখে লিওর অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পেতে অসুবিধা হলো না। ছুটে গেলাম আমি ওর বিছানার পাশে। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, মারা যাচ্ছে আমার লিও। জ্ঞান নেই, অস্বাভাবিক দ্রুত তালে শ্বাস বইছে, ঠোঁট দুটো নড়ছে, থেকে থেকে কেঁপে উঠছে শরীর। ডাক্তারি বিদ্যার যতটুকু জানি তাতে বুঝলাম, পৃথিবীর কোনো কিছু দিয়েই ওকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। খুব বেশি হলে আর ঘণ্টাখানেক টিকবে। উহ, আমার কি বোধ বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে, আমার ছেলে মৃত্যু শয্যায় আর আমি কোথাকার এক মেয়ে মানুষের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলাম! সত্যি কথা বলতে কি, গত আধঘণ্টায় লিওর কথা একবারও মনে পড়েনি আমার। গত বিশ বছর ধরে যাকে ঘিরে আছে আমার জীবন তাকে আমি হারাতে বসেছি অথচ আমার ভেতর কোনো বিকার নেই! ধিক আমাকে।

জব এবং উস্তেনের দিকে তাকালাম। হতাশ চেহারা দুজনেরই। ওরাও নিশ্চিত হয়ে গেছে, বাঁচবে না লিও। আমার চোখে চোখ পড়তেই জব শুকনো মুখে বেরিয়ে গেল গুহার বাইরে।

এখন আয়শাই একমাত্র ভরসা—সে যা বলেছে তা যদি গালগল্প হয়ে থাকে তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। তবে আমার বিয়ে হয় না সে ভাঁওতা দিয়েছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে তাকে ডেকে আনা উচিত, না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে হয়তো।

লিওর মুখটা আরেকবার দেখে রওনা হতে যাবো আমি, এমন সময় আতঙ্কিত মুখে, প্রায় ছুটতে ছুটতে ভেতরে ঢুকলো জব।

ও, স্যার! ভয়ানক কাণ্ড, স্যার! তড়বড়িয়ে বললো সে। কাফন পরা একটা লাশ আসছে এদিকে!

মুহূর্তের জন্যে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। তারপরই মনে পড়লো, আয়শা আসবে বলছিলো, হয়তো সে-ই তার মুখ ঢাকা আলখাল্লা পরে আসছে। বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না এ নিয়ে। কয়েক সেকেণ্ডের ভেতর দেখলাম, গুহায় ঢুকছে আয়শা।

জব চিৎকার করে উঠলো, এই যে, স্যার! লাফ দিয়ে এক কোনায় সরে গেল সে। আর উস্তেন, সম্ভবত, কে এসেছে বুঝতে পেরে শুয়ে পড়লো মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে।

ওহ, একেবারে ঠিক সময়ে এসেছে, আয়শা, বললাম আমি। মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গেছে আমার ছেলে।

এখনো যখন মরেনি, কোমল গলায় বললো সে। তখন আর কোনো ভয় নেই। ওকে ভালো করে তুলতে পারবো আমি। ঐ লোকটা কি তোমাদের চাকর? আর তোমাদের দেশে কি ওভাবেই চাকররা অতিথিদের স্বাগত জানায়?

তোমার পোশাক ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে—কেমন মৃত্যু মৃত্যু একটা চেহারা আছে এতে।

হাসলো সে। আর মেয়েটা? ওহ, বুঝেছি, এর কথাই বলছিলে, তাই না? বেশ, ওদের দুজনকেই যেতে বলো এখান থেকে; তারপর দেখি কি করা যায় তোমার অসুস্থ সিংহকে।

উস্তেনকে আরবীতে এবং জবকে ইংরেজিতে বললাম ঘর ছেড়ে চলে যেতে। জব খুশি মনে সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ পালন করলো। কিন্তু উস্তেন নড়লো না।

কি চান সে? ফিসফিস করে বললো সে। স্ত্রী হিসেবে স্বামীর কাছে থাকার পূর্ণ অধিকার আছে আমার। না, আমি যাবো না, জনাব বেবুন।

মেয়েটা যাচ্ছে না কেন, হলি? গুহার দেয়ালে কয়েকটা ভাস্কর্য দেখতে দেখতে আপন মনে বললো আয়শা।

লিওকে ছেড়ে যেতে চাইছে না ও।

চরুকির মতো পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো আয়শা। উস্তেনের দিকে হাত তুলে একটা মাত্র শব্দ উচ্চারণ করলো: যাও!

তার গলার স্বরে এমন কিছু একটা ছিলো যে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করার সাহস পেলো না উস্তেন। হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে গেল গুহা ছেড়ে।

এখন বুঝতে পারছো, হলি, একটু মোর্স বললো আয়শা। অবাধ্যতার জন্যে জংলীগুলোকে কেন অমন কঠোর শাস্তি দিয়েছিলাম? অবাধ্যতার শাস্তি কি, সকালে যদি না দেখতো, কিছুতেই ও যেহেনী এখান থেকে। চলো, দেখি ছেলেটাকে।

লিওর বিছানার দিকে এগিয়ে গেল সে। দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে লিও। এপাশ থেকে ওর মাখার সোনালি চুলগুলোই কেবল দেখা যাচ্ছে।

আকার আয়তনে তো বেশ একটা আভিজাত্য আছে ছেলেটার! বলতে বলতে ওর মুখ দেখার জন্যে ঝুঁকলো আয়শা।

পরমুহূর্তে তার দীর্ঘ ঋজু শরীরটা একটা ধাক্কা খেলো যেন। সবিস্ময়ে দেখলাম আমি টলতে টলতে পিছিয়ে আসছে সে, যেন গুলি করা হয়েছে বা ছুরি মারা হয়েছে ওকে। পিছোতে পিছোতে অবশেষে গুহার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল তার। গলা চিরে বেরিয়ে এলো ভয়ানক তীব্র তীক্ষ্ণ্ণ এক চিকার।

কি হয়েছে, আয়শা? চেঁচালাম আমি। মরে গেছে? 

ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঘিনীর মতো এক লাফে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। সাপের মতো ভয়ানক হিসহিসে এক গলায় বললো, কুত্তা! কেন আমার কাছে লুকিয়ে রেখেছিলি এতক্ষণ? বলতে বলতে এমন হিংস্র ভঙ্গিতে একটা হাত সামনে এগিয়ে দিলো যে, আমার মনে হলো, এই বুঝি ধুলোয় মিশে গেলাম।

কি? আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি। কি হয়েছে?

ওহ! এখনো তুমি বুঝতে পারোনি! একটু শান্ত শোনাছে আয়শার গলা। শোনো, হলি, শোনো: ওখানে-ওখানে শুয়ে আছে-ওখানে শুয়ে আছে আমার হারিয়ে যাওয়া ক্যালিক্রেটিস! আমার হারিয়ে যাওয়া ক্যালিক্রেটিস অবশেষে ফিরে এসেছে আমার কাছে! আমি জানতাম ও আসবে, আমি জানতাম ও আসবে! কোনো সাধারণ রমণী এই পরিস্থিতিতে যেমন করতো ঠিক তেমন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে হাসতে শুরু করলো সে। সেই সাথে বিড়বিড় করছে, ক্যালিক্রেটিস! ওহ্, ক্যালিফ্রেটিস!

পাগল, মনে মনে বললাম আমি। মেয়েটা যতক্ষণ এমন করবে ততক্ষণে না মারা যায় লিও!

এখনো যদি কিছু না করো, আয়শা, স্মরণ করিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বললাম আমি। তোমার ক্যালিক্রেটিস কিন্তু ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। এতক্ষণ চলে গেছে কিনা কে জানে?

ঠিক, একটু চমকে বললো সে। ওহ, আরো আগে কেন এলাম না আমি? এখন একদম সময় নেই হাতে, এদিকে থর থর করে কাঁপছে আমার শরীর। কাপড়ের ভাজ থেকে শিশির মতো দেখতে ছোট একটা মাটির পাত্র বের করে এগিয়ে দিলো আমার দিকে। এই যে, হলি, এটা নাও। ভেতরের তরল পদার্থটুকু ঢেলে দাও ওর গলায়। এখনো যদি মরে না গিয়ে থাকে, ভালো হয়ে যাবে। জলদি, হলি, জলদি! মারা যাচ্ছে ও!

কাঠের ছিপি দিয়ে আটকানো পাত্রটার মুখ। দাঁত দিয়ে কামড়ে খুলতে খুলতে লিওর পাশে গেলাম আমি। একপলক তাকিয়েই বুঝতে পারলাম শেষ হয়ে যাচ্ছে ও। সোনালি মাথাটা আস্তে আস্তে নড়ছে এপাশে ওপাশে। মুখটা সামান্য হাঁ হয়ে আছে। আয়শাকে ডেকে ওর মাথাটা ধরতে বললাম আমি।

এগিয়ে এলো সে। এখনো কাপছে থর থর করে। তবু কোনো রকমে ধরে স্থির করতে পারলো লিওর মাথা। হাঁ করা মুখটা এক হাতে আরেকটু ফাঁক করে শিশির তরল পদার্থটুকু ঢেলে দিলাম ওর গলায়।

একসেকেণ্ড দুসেকেণ্ড করে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অলৌকিক কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না লিওর ভেতর। সত্যি কথা বলতে কি অলৌকিক ফলাফলই আশা করেছিলাম আমি। তবে হ্যাঁ, একটু আগেও যে মরণ যন্ত্রণা ভোগ করেছিলো লিও, এখন আর তা নেই। প্রথমে মনে হলো, হয়তো মৃত্যুই ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে সেই যন্ত্রণার হাত থেকে। মলিন মুখটা স্থির হয়ে গেছে। দুর্বল হৃৎস্পন্দন আরো দুর্বল হয়েছে। কেবল চোখের পাপড়ি দুটো কেঁপে কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে। সন্দেহের দৃষ্টিতে আয়শার দিকে তাকালাম আমি। অসাবধানে ওর মুখের আবরণটা সরে গেছে। এখনো লিওর মাথা ধরে আছে সে।

দীর্ঘ পাঁচটা মিনিট কেটে গেল। এখনো কোনো পরিবর্তন নেই লিওর। আয়শার মুখ দেখে মনে হলো, সে-ও যেন আশা ছেড়ে দিয়েছে।

কি হলো? অনেক দেরি হয়ে গেছে? একটা ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

লিওর মাথা ছেড়ে দিয়ে দুহাতে মুখ ঢাকলো সে, কোনো জবাব দিলো না। ডুকরে কেঁদে ওঠার ইচ্ছে হচ্ছে আমার। এমন সময় শুনতে পেলাম গভীর একটা শ্বাস নেয়ার শব্দ। চমকে মুখ তুললো আয়শা। আমি ছুটে গেলাম লিওর পাশে। হ্যাঁ, প্রাণের চিহ্ন ফুটে উঠতে শুরু করেছে আবার ওর মুখে। বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়, যাকে মৃত ভেবেছিলাম, একটু পরেই পাশ ফিরে শুলো সে।

দেখেছো! উৎফুল্ল গলায় ফিসফিস করে উঠলাম আমি।

দেখেছি, জবাব দিলো আয়শা। এ যাত্রা বেঁচে গেছে ও। ভেবেছিলাম, বোধহয় দেরি করে ফেলেছি—আর এক মুহূর্ত, মাত্র এক মুহূর্ত যদি দেরি হতো, তাহলে হয়তো ঘটেই যেতো সর্বনাশটা! তারপরই আমাকে অবাক করে দিয়ে ই হু করে কেঁদে ফেললো সে।

অনেকক্ষণ কাদলো আয়শা।

ক্ষমা করো, হলি, লিওর সোনালি চুলে হাত বুলাতে বুলাতে অবশেষে বললো সে। আমার দুর্বলতা ক্ষমা করো। দেখতে পাচ্ছো, যত যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমি একজন মেয়েমানুষই। এ পর্যন্ত আমার অনেক রূপই তো তুমি দেখেছো। সব কি এই নারীরূপে নিচে চাপা পড়ে যায় না? ভেবেছিলাম, আবার বুঝি হারালাম আমার ফিরে পাওয়া ক্যালিক্রেটিসকে। যা হোক, এখন আর কোনো ভয় নেই। ওষুধ ধরেছে। আগামী বারো ঘণ্টা একনাগাড়ে ঘুমোবে, তারপর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে ও।

.

১২.

ওহ্,-হো, ভুলেই গেছিলাম, হঠাৎ বলে উঠলো আয়শা। ঐ মেয়েলোকটা, উস্তেন, ক্যালিক্রেটিসের কি ও? চাকর? না? কেঁপে গেল তার গলা।

কাঁধ ঝাকালাম আমি। ঠিক জানি না। যতটুকু বুঝতে পেরেছি, আমাহাগারদের প্রথা অনুযায়ী ওর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে মেয়েটার।

মেঘের মতো কালো হয়ে উঠলো আয়শার মুখ। সেক্ষেত্রে ওকে মরতে হবে! এবং এখনই!

কি অপরাধে? আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি। ও তো কোনো দোষ করেনি, আয়শা। ছেলেটাকে ভালোবাসে ও, লিও-ও খুশি মনে গ্রহণ করেছে ওর ভালোবাসা। তাহলে ওর অপরাধ কোথায়?

সত্যিই তোমার মাথায় ঘিলু বলতে কিছু নেই, হলি। কি ওর অপরাধ? আমি এবং আমার আকাঙক্ষার মাঝখানে বাধা হয়ে আছে, এ-ই ওর অপরাধ, বুঝেছো? মৃত্যু ছাড়া আর কোনো গতি নেই ওর। আমি ওর প্রেমিককে কেড়ে নেবো। তারপরও যদি ও বেঁচে থাকে, আমার ক্যালিক্রেটিস হয়তো ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। ভাববে ওর কথা, তা আমি সহ্য করতে পারবো না। আমার প্রেমাস্পদের মন জুড়ে অন্য মেয়ে মানুষ থাকতে পারবে না। আমার সম্পদ আমি একাই ভোগ করবো। সুতরাং মরতেই হবে ওকে।

না, না, চিৎকার করলাম আমি। এ পাপ-জঘন্য পাপ। পাপ থেকে অশুভ ছাড়া আর কিছু কখনো আসে না। তোমার নিজের খাতিরেই বলছি, আয়শা, এ কাজ কোরো না।

এটাকে তুমি পাপ বলছে, বোকা মানুষ? তাহলে আমাদের পুরো জীবনই তো পাপ, বেঁচে থাকার জন্যে দিনে দিনে কতকিছুই না আমরা ধ্বংস করেছি, এখনো করছি! পৃথিবীর নিয়মই হলো, শক্তিমান টিকে থাকবে। যারা দুর্বল তারা শেষ হয়ে যাবে, শক্তিমানের খোরাক হবে। হিংস্র কোনো প্রাণী যদি তোমাকে বা তোমার লিওকে গ্রাস করতে আসে তখন তুমি কি করবে? আহা, বেচারার খিদে পেয়েছে, খাক না, ভেবে চুপ করে বইবে, না হত্যা করবে তাকে? আমি কি বলতে চাইছি, বুঝেছো আশা করি?

আয়শার যুক্তির বিপক্ষে আমি কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না। কিন্তু এত সহজে উস্তেনকে মরতে দেয়াও যায় না। অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম। অবশেষে শেষ একটা চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আয়শা, বললাম আমি। জানি তোমার সাথে যুক্তিতে পারবো না। তবু বলছি একবার ভেবে দেখ, তুমিই বলেছিলে, প্রত্যেক মানুষের উচিত, ভালো-মন্দ সম্পর্কে তার হৃদয়ের যে শিক্ষা সে অনুযায়ী চলা। জোর করে যার স্থান তুমি দখল করতে যাচেছা, তার জন্যে কোনো দয়া নেই তোমার? তুমিই তো বললে, বহু-বহু যুগ পর ফিরে এসেছে তোমার প্রেমাস্পদ, এখন কি ওর ফিরে আসার এই ঘটনাটাকে উদযাপন করবে ওরই প্রেমিকাকে—আচ্ছা প্রেমিকা না বলো, যে ওর প্রাণ বাঁচিয়েছিলো তাকে হত্যা করে? অতীতে একবার এই ক্যালিক্রেটিসের সঙ্গে ভয়ানক আচরণ করেছিলে তুমি, নিজ হাতে ওকে হত্যা করেছিলে, কারণ মিসরীয় আমেনার্তাসকে ও ভালোবাসতো।

কথাটা আমি ঠিক মতো শেষও করতে পারিনি, প্রায় লাফিয়ে উঠলো আয়শা। কি করে তুমি জানলে এ কথা, বিদেশী? ঐ নাম তুমি জানলে কি করে? আমি তো তোমাকে বলিনি, চিৎকার করতে করতে আমার হাত ধরলো সে।

হয়তো স্বপ্নে দেখেছি, বললাম আমি। কত অদ্ভুত স্বপ্ন যে এই কোর-এর গুহার আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়! বোধহয় স্বপ্নটা সত্যেরই ছায়া ছিলো। সেদিন যে পাগলের মতো কাণ্ড করেছিলে তার ফল কি হয়েছে? দুহাজার বছরেরও বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে তোমাকে, তাই না? আবারও তেমন কিছু ঘটুক তাই কি তুমি চাও? আমি বলছি, এই নিরপরাধ মেয়েটাকে হত্যা করলে সেই পুরানো ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হবে আবার। যে মেয়েটা ওকে ভালোবাসে তার মৃতদেহের ওপর দিয়ে কি করে তোমাকে গ্রহণ করবে তোমার ক্যালিক্রেটিস?

শোনো, হলি, মেয়েটার সাথে সাথে তোমাকেও যদি হত্যা করি, তবু ও আমাকে ভালোবাসবে। কারণ, আমি জানি, আমার অমোঘ আকর্ষণ ও কিছুতেই কাটাতে পারবে না। তা সত্ত্বেও আমার মনে হয়, তোমার কথায় সত্যতা আছে। ঠিক আছে, মেয়েটাকে আমি ছেড়ে দেবো। কিন্তু তার আগে ওর সাথে কথা বলবো আমি। যাও, আমি মত বদলাবার আগেই ডেকে নিয়ে এসো ওকে। বলেই ও সেই সাদা কাপড়টা টেনে দিলো মুখের ওপর।

যাক, মন্দের ভালো। এতটুকুও যে রাজি হবে, আয়শা, তা ভাবিনি। তাড়াতাড়ি গিয়ে ডেকে নিয়ে এলাম উস্তেনকে। গুহায় ঢুকেই আবার আগের মতো হাত আর হাঁটুতে ভর দিলো মেয়েটা।

উঠে দাঁড়া, শিতল গলায় আদেশ করলো আয়শা। এদিকে আয়! উঠে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো উস্তেন। নীরবতা নেমে এলো গুহায়।

এ কে? বেশ কিছুক্ষণ পর লিওর দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলো আয়শা।

আমার স্বামী, অস্ফুট গলায় জবাব দিলো উস্তেন।

কে ওকে দিয়েছে তোর কাছে?

আমাদের দেশের প্রথা অনুযায়ী আমি নিজেই ওকে গ্রহণ করেছি, মহারানী।

খুব খারাপ কাজ করেছিস তুই-অচেনা অজানা বিদেশীকে গ্রহণ করেছিস। তোদের জাতির লোক নয়, সুতরাং তোদের প্রথা এখানে অচল। সম্ভবত না জেনেই তুই করেছিস এ কাজ। এবং সেজন্যেই এবারের মতো তোক ছেড়ে দিচ্ছি, নইলে তোর মরণ কেউ ঠেকাতে পারতো না। এখন, যা বলি শোন, এক্ষুণি নিজের দেশে ফিরে যা, জীবনে আর কখনো ওর সাথে কথা বলার বা ওর দিকে তাকানোর সাহস যেন না হয়। ও তোর জন্যে নয়। আবার বলছি, আমার নির্দেশ অমান্য করা মাত্র মরতে হবে তোকে। যা এখন!।

নড়লো না মেয়েটা।

যা, বলছি!

আর সহ্য করতে পারলো না উস্তেন। মুখ তুলে তাকালো। না, ও সে, আমি যাবো না। ও আমার স্বামী। আমি ওকে ছেড়ে যাবো না। আমাকে স্বামীত্যাগ করতে বলার কি অধিকার আছে আপনার?

আয়শার শরীর বেয়ে একটা কাঁপুনি নেমে আসতে দেখলাম। আর আমি শিউরে উঠলাম উস্তেনের ভয়ঙ্করতম পরিণতির কথা ভেবে।

ধৈর্য ধরো, আয়শা, ল্যাটিনে বললাম আমি। ও যা বলছে, তা স্বাভাবিক।

এখনো আমি ধৈর্য হারাইনি, হিমশীতল গলায় একই ভাষায় জবাব দিলো সে। আমি যদি ধৈর্য হারাতাম, এতক্ষণ ওর লাশ পড়ে থাকতো। তারপর উস্তেনের দিকে ফিরে আরবীতে বললো: এখনো বলছি, চলে যা, নিজের ধ্বংস যদি না চাস তো চলে যা যেখান থেকে এসেছিস সেখানে!

আমি যাবো না। ও আমার! ফোঁপাতে ফোঁপাতে চিৎকার করলো উস্তেন। আমি ওকে গ্রহণ করেছি, ওর প্রাণ বাঁচিয়েছি! ক্ষমতা থাকলে আমাকে ধ্বংস করো, তবু আমার স্বামীকে দেবো না—কক্ষনো না-কক্ষনো না!

নড়ে উঠতে দেখলাম আয়শার শরীর, এত দ্রুত যে ও কি করলো ঠিক বুঝতে পারলাম না। মনে হলো, হাত দিয়ে হাল্কা এক্টা চাপড় দিলো মেয়েটার মাথায়। পরমুহূর্তে যা দেখলাম তাতে আতঙ্কে পিছিয়ে আসতে হলো আমাকে। দেখলাম, উস্তেনের ব্রোঞ্জের মতো লালচে চুলে জির্টে আঙুলের দাগ–তুষারের মতো সাদা। দুহাতে মাথা চেপে ধরেছে মেয়েটা কেমন যেন ঝিমুনি লাগা ভাব চেহারায়।

ও ঈশ্বর! নিজের অজান্তেই শব্দ দুটো বেরিয়ে এলো আমার গলা চিরে। কিন্তু সে সামান্য একটু হাসলোঁ শুধু।

বোকা মেয়ে, বললো আয়শা। ভেবেছিস তোকে হত্যা করার ক্ষমতা নেই আমার? ওখানে একটা আয়না আছে, দেখ, লিওর মাথার কাছে ওর দাড়ি কামানোর আয়নাটার দিকে ইশারা করলো সে। হলি, ওটা দাও তো ছুঁড়ির হাতে, দেখুক ওর চুলের অবস্থা।

আয়নাটা তুলে উস্তেনের চোখের সামনে ধরলাম। এক পলক তাকিয়েই ফুঁপিয়ে উঠে মাটিতে বসে পড়লো বেচারা।

এইবার তুই যাবি, বললো আয়শা। নাকি আবার আঘাত করতে হবে? দেখ, তোর মাথায় ছাপ মেরে দিয়েছি, যতদিন না তোর সব চুল ওরকম সাদা হয়ে যাবে ততদিন তোকে দেখা মাত্র চিনতে পারবো। আর কখনো যদি তোর মুখ

আমি দেখি, মনে রাখিস, তোর হাড়গুলো পর্যন্ত ওরকম সাদা করে ছাড়বো!

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো উস্তেন। মাথায় ভয়ানক শ্বেতচিহ্নটা নিয়ে ফোপাতে ফেঁপাতে বেরিয়ে গেল গুহা ছেড়ে।

এমন ভয় পাওয়া চেহারা হয়েছে কেন তোমার, হলি? উস্তেন বেরিয়ে যেতেই জিজ্ঞেস করলো Cয়শা। তোমাকে তো বলেছি, জাদু-টা নিয়ে আমি কারবার করি না। এ হচ্ছে একটা শক্তি, যার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তোমার। মেয়েটার মাথায় চিহ্ন দিয়ে দিলাম ওর মনে আতঙ্ক ঢুকিয়ে দেয়ার জন্যে। ইচ্ছে করলেই যে আমি ওকে হত্যা করতে পারি তা বুঝিয়ে দিলাম।

যাকগে, আমি যাই এখন। কয়েকজন চাকর পাঠিয়ে দিচ্ছি, আমার প্রভু ক্যালিক্রেটিসকে নিয়ে যাবে আমার পাশের কামরায়। এখন থেকে আমি নিজে ওর দেখাশোনা করবো। তুমিও তোমার শ্বেতাঙ্গ চাকরকে নিয়ে চলে এসো ওখানে। কিন্তু সাবধান, ভুলেও যেন ক্যালিক্রেটিসের সামনে উচ্চারণ কোরো না, কি করে তাড়িয়েছি এই মেয়েলোকটাকে। আবার বলছি, সাবধান!

বেরিয়ে গেল সে গুহা ছেড়ে। হতবুদ্ধির মতো বসে রইলাম আমি। একটু পরেই কয়েকজন বোবা-কালা পরিচারক এসে নিয়ে গেল লিওকে। আমাদের সব জিনিসপত্রও নিয়ে যাওয়া হলো। আয়শার সেই পর্দা ঘেরা কুঠুরির ঠিক পেছনে আমাদের নতুন আবাস নির্দিষ্ট হলো।

.

রাতটা আমি লিওর নতুন ঘরেই কাটালাম? মড়ার মতো ঘুমোলো ও। আমিও ভালোই ঘুমালাম। যদিও প্রচুর স্বপ্ন দেখলাম, তবু মোটামুটি ঝরঝরে শরীর নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম পরদিন সকালে।

অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত সেই মুহূর্তটি এগিয়ে এলো। লিও জাগবে। আয়শা এসে গেছে। যথারীতি অবগুণ্ঠিত মুখ।

দেখবে, হলি, লিওর ওপর সামান্য ঝুঁকে বললো সে। এক্ষুণি জাগবে ও, সম্পূর্ণ সুস্থ শরীরে। অসুখ পালিয়েছে।

কথাটা তখনো শেষ করতে পারেনি আয়শা, পাশ ফিরে আড়মোড়া ভাঙলো লিও। দুহাত সামনে ছড়িয়ে দিয়ে হাই তুললো। তারপর চোখ মেলেই শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়া নারীমূর্তিটা দেখলো। সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ও টেনে নিলো তাকে। চুমু খেলো। সম্ভবত উস্তেন ভেবেছে আয়শাকে। পরমুহূর্তে আরবীতে চেঁচিয়ে উঠলো, আরে, উস্তেন, ওভাবে মুখ বেঁধেছো কেন? দাঁতে ব্যথা হয়েছে? তারপর ইংরেজিতে, উহ্, কি রাক্ষুসে খিদে পেয়েছে রে, বাবা। জব! খাওয়ার কিছু আছে নাকি?

এই যে আমি, মিস্টার লিও, সন্দেহের চোখে আয়শার দিকে তাকিয়ে বললো জব। কথা বোলো না, কথা বোলো না, তুমি অসুস্থ। যথেষ্ট ভুগিয়েছে আমাদের। এবার একটু চুপচাপ বিশ্রাম নাও। আর, এই দ্র মহিলা, আবার আয়শার দিকে তাকালো ও। দয়া করে যদি একটু সরেন, তোমার জন্যে স্যুপ নিয়ে আসতে পারি।

ভদ্র মহিলা কথাটা শুনে সচকিত হলো লিও। কেন! উস্তেন নয় ও? তাহলে উস্তেন কোথায়?

এই প্রথম আয়শা কথা বললো ওর সাথে। এবং প্রথম কথাটাই সে মিথ্যে বললো, বেড়াতে গেছে উস্তেন। তোমার দেখাশোনার জন্যে আমি এসেছি ওর জায়গায়।

একই সঙ্গে আয়শার অপূর্ব সুন্দর কণ্ঠস্বর শুনে আর কাফনের মতো পোশাক দেখে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল লিও। কিছু না বলে খেয়ে ফেললো জবের এগিয়ে দেয়া সুপটুকু। তারপর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো আবার।

সন্ধ্যার সময় দ্বিতীয় বার জাগলো ও। গত কদিনে কি কি ঘটেছে জিজ্ঞেস করলো। পরদিন সব বলবো বলে অনেক কষ্টে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিলাম ওকে। পরের বার যখন ঘুম ভাঙলো, দেখলাম প্রায় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে ও। ওর অসুখের কথা, গত কদিনে আমি কি কি করেছি এসব কিছু কিছু বললাম ওকে। আয়শার উপস্থিতির কারণে আয়শা সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে পারলাম না। শুধু বললাম ও এদেশের রানী।

পরদিন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো লিও। বল্লমের খোঁচায় হওয়া ক্ষত পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। শরীরের শক্তিও প্রায় স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে ফিরে এসেছে স্মৃতি। জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত যা যা ঘটেছিলো সব মনে পড়ে গেছে। বেচারা উস্তেনের কি হয়েছে জিজ্ঞেস করে করে প্রায় পাগল করে ফেললো আমাকে। প্রতিবারই আমি এড়িয়ে গেলাম প্রশ্নটা। সাহস পেলাম না সত্যি কথা বলার। ইতিমধ্যে আয়শা দ্বিতীয়বারের মতো সতর্ক করেছে আমাকে, যেন উস্তেন সম্পর্কে কিছু না বলি লিওকে।

এদিকে সম্পূর্ণ বদলে গেছে আয়শার আচরণ। ভেবেছিলাম, তার বিশ্বাস অনুযায়ী যে তার পুরানো প্রেমিক তাকে নিজের করে পাওয়ার প্রথম সুযোগটাই সে কাজে লাগাবে। কিন্তু তেমন কিছু করলো না সে। শান্তভাবে সেবা করে যাচ্ছে লিওর। শ্রদ্ধা মেশানো অদ্ভুত এক আচরণ করছে। নম্র বিনয়ী। যথাসম্ভব চেষ্টা করছে লিওর কাছাকাছি থাকার। আর লিওর কৌতূহল ক্রমে দুর্বার হয়ে উঠছে এই রহস্যময়ী রমণী সম্পর্কে প্রথম দিকে আমার যেমন হয়েছিলো অনেকটা তেমন।

তৃতীয় দিন সকালে পোশাক পরার সময় আবার লিও আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো উস্তেন কোথায় গেছে, উস্তেন কোথায় গেছে করে। সরাসরি আমি জানিয়ে দিলাম, আয়শার কাছে জিজ্ঞেস করো। উস্তেন কোথায় গেছে আমি জানি না।

নাশতা শেষ করে আয়শার কাছে গেলাম আমরা। যথারীতি সেই পর্দাঘেরা কুঠুরিতে বসে আছে সে। আমরা ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালো। দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলো আমাদের বলা ভালো লিওকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে।

স্বাগতম, আমার তরুণ অতিথি প্রভু, অত্যন্ত কোমল, বিনীত গলায় বললো সে। তোমাকে সুস্থ দেখে সত্যিই খুব খুশি লাগছে। বিশ্বাস করো, আমি যদি না বাঁচতাম, জীবনে আর কখনো দাঁড়াতে হতো না তোমাকে।

মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো লিও। তারপর সুস্থ করে তোলার জন্যে ধন্যবাদ জানালো আয়শাকে। যথাসম্ভব চেষ্টা করলো শুদ্ধ সুন্দর আরবী বলতে।

না না, ধন্যবাদ জানানোর মতো কিছু করিনি আমি, বললো আয়শা। তুমি এসেছো বলেই ধন্য বোধ করছি।

হুম, বুড়ো, আমার দিকে ফিরে ইংরেজিতে বললো লিও। দ্রমহিলা একটু বেশি ভদ্র মনে হচ্ছে?

কনুই দিয়ে পাঁজরে খেচা মেরে চুপ করতে বললাম ওকে।

আমার বিশ্বাস, বলে চললো আয়শা। আমার ভৃত্যরা যথাসাধ্য সমাদর করেছে তোমাদের। এখন আমি নিজে কি কিছু করতে পারি?

নিশ্চয়ই, মহামান্য, সে, তড়বড়িয়ে বললো লিও। আমার দেখাশোনা করছিলো যে মেয়েটা, ও কোথায় গেছে, বললে বাধিত হবো।

ওহ, সেই মেয়েটা–হ্যাঁ, আমি ওকে দেখেছিলাম বটে। কিন্তু এখন যে কোথায় আছে বলতে পারি না। জরুরী দরকার, যেতেই হবে, বলে চলে গেছে ও। কোথায়, সে সম্পর্কে কিছু বলে যায়নি। কখন ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কিনা তা-ও কিছু জানায়নি। অসুস্থ মানুষের সেবা করা কি চাট্টিখানি কথা? দুদিনেই হয়তো হাঁপিয়ে উঠেছিলো, পালিয়ে বেঁচেছে। এই জংলীগুলো আসলে এমনই।

গম্ভীর হয়ে গেল লিও। সম্ভবত উস্তেন সম্পর্কে কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছে না।

আশ্চর্য! আমার দিকে ফিরে ইংরেজিতে বললো ও। তারপর আয়শার দিকে ফিরে, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, ঐ মেয়েটা এবং আমি-আঁ-আমাদের ভেতর একটা সম্পর্ক…

একটু হাসলো আয়শা—সেই অপূর্ব সঙ্গীতের মতো হাসি। তারপর অন্য কথা বলে ঘুরিয়ে দিলো প্রসঙ্গ।

.

১৯.

সেদিনই বিকেলে। আমাদের মনোরঞ্জনের জন্যে এক নাচের আসরের আয়োজন করেছে আয়শা। সকালে আলাপের সময় লিওকে সে জানিয়েছিলো এই অনুষ্ঠানের কথা। বলেছিলো, আশ্চর্য এক দৃশ্য দেখাবে। সে অনুযায়ী এখন আমরা জড়ো হয়েছি আয়শার ঘরে। তার সাথেই যাবো অনুষ্ঠানের জায়গায়।

একটু আগে এসে পড়েছি আমরা। অনুষ্ঠানের আয়োজন এখনো শেষ হয়নি। সময় কাটানোর জন্যে আয়শা তার বীক্ষণকাচের কেরামতি দেখাতে লাগলো জব আর লিওকে। গামলার মতো পাত্রের তরল পদার্থে বাবা, মা, ভাই-বোনদের চেহারা দেখে উত্তেজনায় টগবগ করতে লাগলো জব। লিওকে অবশ্য খুব একটা উত্তেজিত হতে দেখলাম না। এমন কিছু যে দেখতে হবে তা যেন ওর জানাই ছিলো।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আয়শার এক পরিচারিকা এসে জানালো, মাননীয় দর্শকদের জন্যে অপেক্ষা করছে বিলালি। দয়া করে আমরা গেলেই সে শুরু করতে পারে অনুষ্ঠান। সাদা পোশাকের ওপর কালো একটা আলখাল্লা চাপালো আয়শা। তারপর রওনা হলাম আমরা।

নাচ হবে খোলা আকাশের নিচে। বড় গুহার সামনে পাথর বাঁধানো মসৃণ চত্বরে। সেখানে পৌঁছে দেখলাম গুহামুখ থেকে পনেরো কদম মতো দূরে তিনটে আসন পাতা। হেলান দেয়ার ঘ্যবস্থা আছে তিনটেতেই। মাঝখানের আসনে বসলো আয়শা। আমি আর লিও দুপাশের দুটোয়।

বেশ কয়েক মিনিট পেরিয়ে গেল। চুপচাপ বসে আছি আমরা। নর্তক নর্তকীদের পাত্তা নেই এখনো। সন্ধ্যা হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। চারদিক অন্ধকার। কিন্তু আলোর কোনো বন্দোবস্ত দেখছি না। এই অন্ধকারে ওরা নাচবৈই বা কি, আমরা দেখবোই বা কি?

আয়শাকে কথাটা জিজ্ঞেস করলো লিও।

সময় হলেই দেখতে পাবে, একটু হেসে জবাব দিলো সে।

সত্যিই দেখলাম আমরা। আয়শা কথাটা বলতে না বলতেই দেখলাম, চারদিক থেকে কালো কালো মূর্তি ছুটে আসছে, বিরাট একেকটা জ্বলন্ত মশালের মতো কি যেন তাদের প্রত্যেকের হাতে। লিওই প্রথম বুঝতে পারলো, জিনিসগুলো কি।

ও ঈশ্বর! বলে উঠলো ও। জ্বলন্ত লাশ দেখি ওগুলো!

ভালো করে তাকালাম আমি। সত্যিই তো! সমাধিগুহা থেকে মমি এনে মশাল বানানো হয়েছে আমাদের বিনোদনের জন্যে!

আমাদের থেকে বিশ কদম মতো সামনে ওরা এক এক করে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো জ্বলন্ত মমিগুলো। ছোটখাটো একটা পাহাড়ের মতো হয়ে উঠলো। শো শো, চড় চড় শব্দ তুলে পুড়ছে মমি। তীব্র আলোয় ভরে গেল পুরো চত্বরটা। হঠাৎ দেখলাম, দীর্ঘদেহী এক লোক মানুষের জ্বলন্ত একটা হাত তুলে নিয়ে দৌড় দিলো অন্ধকারের দিকে—কোনো একটা মমি থেকে খুলে পড়েছিলো হাতটা। কিছুদূর গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। পরমুহূর্তে ফস্ করে জ্বলে উঠলো বিরাট একটা প্রদীপ। প্রদীপটা আর কিছু নয়, মাটিতে পোতা খুঁটির সঙ্গে বাঁধা এক মহিলার মমি। দীর্ঘদেহী ছুটে গিয়ে তার চুলে আগুন ধরিয়ে দেয়ায় অমন লকলকিয়ে উঠেছে আগুনের শিখা।

জ্বলন্ত হাতটা দিয়ে কয়েক পা দূরে একই রকম আরেকটা প্রদীপ জ্বাললো সে, তারপর আরেকটা, আরও একটা। এই ভাবে এক এক করে মমি জ্বেলে জ্বেলে তিন দিক থেকে বৃত্তাকারে ঘিরে ফেলা হবে আমাদের।

নিরো নাকি আলকাতরায় ভেজানো জীবিত খ্রীষ্টানদের দেহ জ্বেলে তার বাগান আলোকিত করেছিলো, ঠিক সেরকম একটা দৃশ্য আমাদের সামনে। ভাগ্য ভালো, এখন যে দেহগুলো জ্বলছে সেগুলো জীবিত কারো নয়। তবু আতঙ্কে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমি। হো্ক মমি, মানুষের মতোই তো চেহারা। চোখের সামনে এগুলো পুড়তে দেখলে কেমন লাগে!

মিনিট বিশেকের ভেতর গোড়ালি ছাড়া আর সবটুকু পুড়ে গেল মমিগুলোর। পায়ের জ্বলন্ত অবশেষগুলো সরিয়ে ফেলে নতুন একেকটা মমি এনে বাঁধা হলো একেকটা খুঁটির সাথে। তারপর আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো আবার। ফস ফস শব্দ তুলে আকাশে উঠে যেতে লাগলো আগুনের শিখা।

কেমন লাগছে, হলি? জিজ্ঞেস করলো আয়শা। বলেছিলাম না, আশ্চর্য এক দৃশ্য দেখাবে। এখন দেখছো তো?

জবাব দেয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলাম না আমি। এমন সময় দেখলাম, দুই সারি ছায়ামূর্তি, একটা পুরুষদের অন্যটা মেয়ের, জ্বলন্ত মমিগুলোকে ঘিরে এগিয়ে আসছে। নারী, পুরুষ দুদলেরই পর ন চিতা বা হরিণের চামড়া ছাড়া আর কিছুই নেই। জ্বলন্ত মমির বৃত্তটা ঘুরে আমাদের সামনে চলে এলো তারা। তারপর দুই সারিতে পরস্পরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেণ্ড পরেই শুরু হলো না। সে কি নাচ! আমাদের ক্যানক্যানের নারকীয় পৈশাচিক রূপ বলা যেতে পারে। তার বর্ণনা দেয়া অসম্ভব আমার পক্ষে। শুধু এটুকু বলতে পারি, প্রচুর হাত-পা ছোড়া আর শরীর দোলানো আছে কিন্তু তাল লয়ের কোনো বালাই প্রায় নেই।

কিছুক্ষণ চললো এরকম। তারপর হঠাৎ মেয়েদের সারি থেকে বিশাল বপুধারী এক মহিলা মাতালের মতো হেলে দুলে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। কলজে কাঁপানো তীক্ষ্ণ্ণস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, আমি একটা কালো ছাগল চাই! কেউ একটা কালো ছাগল দাও আমাকে! এরপরই মাটিতে শুয়ে পড়ে কালো ছাগলের জন্যে হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো সে।

সঙ্গে সঙ্গে অন্য নর্তক-নর্তকীরা ঘিরে ধরলো তাকে।

পেত্নীতে পেয়েছে ওকে, চিৎকার করে উঠলো একজন। কেউ যাও, একটা কালো ছাগল নিয়ে এসো। মা পেত্নী, শান্ত হও! শান্ত হও! এক্ষুণি পাবে তোমার ছাগল। ওরা গেছে আনতে। দয়া করে শান্ত হও, মা পেত্নী।

কালো ছাগল দিতে হবে আমাকে, অবশ্যই দিতে হবে! আবার চিৎকার করলো মেয়েলোকটা।

ঠিক আছে, পেত্নী, এক্ষুণি পাবে তোমার ছাগল, একটু শান্ত হও, তুমি না কতো ভালো পেত্নী!

সত্যিই যতক্ষণ না একটা শিংওয়ালা কালো ছাগল নিয়ে আসা হলো ততক্ষণ চললো এরকম গড়াগড়ি, চিৎকার আর অনু্নয়।

এনেছো ছাগল? জিজ্ঞেস করলো বিশাল বপুধারিণী। কালো তো? সত্যি কালো তো?

হ্যাঁ, মা পেত্নী, রাতের মতো কালো, তারপর পাশের একজনের দিকে তাকিয়ে, তোমার পেছনে রাখো এটা, পেত্নী যেন দেখতে না পায়, ছাগলটার গায়ে একটা সাদা দাগ আছে। তারপর আবার মোটা মহিলার দিকে ফিরে, একটু ধৈর্য ধরো, পেত্নী। এই, গলা কাটো এটার! তশতরি কোথায়?

মোটা মহিলা এখনো তড়পাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে, ছাগল! কালো ছাগল! রক্ত দাও! আমার কালো ছাগলের রক্ত দাও আমাকে! ওহ! ওহ! তাড়াতাড়ি দাও! রক্ত! রক্ত!

এই সময় একটা আতঙ্কিত চিৎকার উঠলো সম্মিলিত কণ্ঠে। হতভাগ্য ছাগলটাকে বলি দেয়া হলো। একটু পরেই এক মহিলা এক তশতরি ভর্তি রক্ত নিয়ে এলো। মোটা মহিলার হাতে দিতেই সে এক চুমুকে গিলে ফেললো রক্তটুকু। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল তার তড়পানি। উঠে মৃদু একটু হাসলো। তারপর এগিয়ে গেল অন্য নর্তকীদের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেল আমাদের আর বৃত্তাকার আগুনের মাঝের জায়গাটুকু।

নৃত্যানুষ্ঠান শেষ ভেবে আয়শাকে জিজ্ঞেস করতে যাবো এবার আমরা উঠতে পারি কিনা, এমন সময় একটা বেবুন লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এলো আমাদের সামনে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উল্টো দিক থেকে এগিয়ে এলো একটা সিংহ-বলা ভালো, সিংহের চামড়া পরা এক লোক। তারপরই এলো একটা ছাগল। তারপর ষাঁড়ের চামড়া পরা একজন, ষাড়ের মুণ্ডু লাগানো তার মাথার সাথে। এরপর আরো ছাগল এবং আরো অন্যান্য জন্তুর সাজে মানুষ। সাপের চামড়া পরে লম্বা লেজ লাগিয়ে একটা মেয়েও এলো। বিচিত্র এক বুনো ভঙ্গিতে লাফাতে লাফাতে যে-যে প্রাণীর সাজ নিয়েছে সে সেই প্রাণীর ডাক ছাড়তে লাগলো।

অনেকক্ষণ ধরে চললো এই নাচ। কিম্ভুতকিমাকার অঙ্গভঙ্গি আর ডাক শুনতে শুনতে পাগল হওয়ার দশা হলো। শেষে বিরক্ত হয়ে আয়শাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি আর লিও যদি উঠে গিয়ে জ্বলন্ত মানব-মশালগুলো পরীক্ষা করে দেখি, তার আপত্তি আছে কিনা। আপত্তি থাকার কোনো সঙ্গত কারণ নেই, সুতরাং রওনা হলাম আমরা।

প্রথম মমিটা দেখা শেষ করে দ্বিতীয়টার দিকে যাচ্ছি আমি আর লিও, এমন সময় চিতার ছদ্মবেশধারী একজন এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। নারীকণ্ঠে ফিস ফিস করে উঠলো চিতাটা, এদিকে এসো।

শোনামাত্র আমরা দুজনেই চিনতে পারলাম উস্তেনের গলা। একমুহূর্ত দেরি করে, বা আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে নির্দ্বিধায় লিও এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। হঠাৎ করেই আমার পেটের ভেতরটা কেমন যেন শূন্য মনে হতে লাগলো। এরপর কি ঘটবে? চুপচাপ বসে থাকবে আয়শা? প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যে পাগল হয়ে উঠবে না?

গুঁড়ি মেরে অন্ধকারের দিকে প্রায় পঞ্চাশ পা এগিয়ে গেল চিতাটা। লিও গেল ওর সঙ্গে। পেছন পেছন আমিও।

ওহ্! উস্তেনকে বলতে শুনলাম আমি, অবশেষে খুঁজে পেয়েছি তোমাকে! শোনো, আমার সামনে ভয়ানক বিপদ, সে-যাকে-মানতেই হবে তোমার সাথে আমাকে দেখলেই হত্যা করবে। বেবুন নিশ্চয়ই বলেছে তোমাকে, কি করে নষ্ট মেয়েমানুষটা তোমার কাছ থেকে তাড়িয়েছে আমাকে? আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমার প্রভু, তুমি আমার। আমি তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছি, এখন কি তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দেবে, প্রিয়তম?

অবশ্যই না, জোর দিয়ে বললো লিও। আমি তো ভেবেই পাচ্ছিলাম না, কোথায় যেতে পারো তুমি। চলো, রানীর কাছে গিয়ে সব বুঝিয়ে বলি আমরা।

না, না, ও খুন করবে আমাদের। ওর ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই–বেবুন জানে, ও দেখেছে। আমাদের সামনে এখন একটাই পথ খোলা আছে, জলাভূমি পেরিয়ে পালাতে হবে। না হলে আমাদের দুজনকেই মরতে হবে ওর হাতে।

ঈশ্বরের দোহাই, লিও…, শুরু করলাম আমি, কিন্তু উস্তেন আমাকে থামিয়ে দিলো।

না, ওর কথা শুনো না। শিগগির চলো, এখানকার বাতাসে পর্যন্ত মৃত্যুর গন্ধ। এতক্ষণে টের পেয়ে গেছে কিনা কে জানে!

খিলখিল একটা হাসির শব্দ হলো পেছনে। চমকে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। শিউরে উঠলাম মনে মনে। হালকা পায়ে কখন যে এসে দাঁড়িয়েছে আয়শা টের পাইনি কেউ। বিলালি আর দুই পরিচারক তার সঙ্গে।

.

২০.

বেশ, বেশ! চমৎকার একটা দৃশ্য যাহোক, কোমল গলায় বললো আয়শা। চিতা এবং সিংহ প্রেম করছে!

জাহান্নামে যাক! ইংরেজিতে বলে উঠলো লিও।

মাথায় সামান্য চিহ্ন দিয়েই তোকে ছেড়ে দিয়েছিলাম, উস্তেন, এবার গলা চড়লো আয়শার, ভেবেছিলাম এতেই যথেষ্ট হবে। কিন্তু, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি, আমার কথা অমান্য করার সহ হবে তোর!

আমাকে নিয়ে আর খেলবেন না, ফুঁপিয়ে উঠলো হতভাগিনী মেয়েটা। আমাকে মেরে ফেলুন, সব শেষ হয়ে যাক।

খল খল করে হেসে উঠলো আয়শা। কেন? প্রেমের শখ মিটে গেল এত তাড়াতাড়ি! বোবা-কালা পরিচারকদের দিকে তাকিয়ে একটা ইশারা করলো সে। সঙ্গে সঙ্গে দুজন এগিয়ে গিয়ে ধরলো উস্তেনের দুহাত। ভয়ঙ্কর এক লাফ দিয়ে লিও ছুটে গেল কাছের পরিচারকটার দিকে। এক ধাক্কায় তাকে ফেলে দিলো মাটিতে। তারপর দাঁড়িয়ে রইলো ঘুসি বাগিয়ে।

আবার হাসলো আয়শা। চমৎকার! বুঝতে পেরেছি, অতিথি, বাহু দুটোয় বেশ শক্তি রাখো তুমি। তা আপাতত বেচারাকে ছেড়ে দিলে কেমন হয়? মেয়েটার কোনো ক্ষতি করবে না ওরা। ওকে আমার নিজ ঘরে নিয়ে যাবো। তোমার এত প্রিয় পাত্র যে, আমারও উচিত তার একটু সমাদর করা। নাকি?

একটু এগিয়ে হাত ধরে এক পাশে টেনে নিয়ে এলাম লিওকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে গুহার দিকে এগোলো আয়শা। আমরাও রওনা হলাম পেছন পেছন।

কিছুক্ষণের ভেতর আয়শার পর্দা ঘেরা কুঠরিতে পৌঁছে গেলাম আমরা। গদিমোড়া আসনটায় বসলো আয়শা। ইশারায় বিলালি, জব এবং পরিচারক দুজনকে চলে যেতে বললো। আগে থেকেই সুন্দরী এক পরিচারিকা ছিলো। কুঠুরিতে, সে গেল না। আয়শাও কিছু বললো না ওকে।

বলো, হলি, শুরু করলো সে। কি করে ঘটলো এ ঘটনা। কোত্থেকে এলো মেয়েটা? তোমার অনুরোধেই ওকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। তারপর তো আর এ তল্লাটে ওর থাকার কথা নয়? জবাব দাও, সত্যি কথা বলবে। এ ব্যাপারে কোনো মিথ্যা আমি সহ্য করবো না।

ঘটনাক্রমেই ব্যাপারটা ঘটছে, মহামান্য রানী। আমি এর কিছুই জানতাম না।

বেশ, তোমার কথা বিশ্বাস করলাম, হলি। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে? সব দোষ ঐ মেয়েটার।

ওর তো কোনো দোষ দেখছি না আমি, ফেটে পড়লো লিও। অন্য কারো বউ নয় ও, এদেশের প্রথা অনুযায়ী আমার সাথে বিয়ে হয়েছে ওর। তাহলে ওর দোষ কোথায়? ও যদি কোনো দোষ করে থাকে, আমিও করেছি। ওকে শাস্তি দিলে আমাকেও দিতে হবে। আর হ্যাঁ, তোমার ঐ বোবা-কালা গুণ্ডাগুলো যদি আর কখনো ওর গায়ে হাত দেয়, সব কটাকে আমি যমের বাড়ি পাঠাবো!

নীরবে শুনলো আয়শা, কোনো মন্তব্য করলো না। তারপর ফিরলো উস্তেনের দিকে।

কি বলার আছে তোর? খড়কুটোর চেয়েও অধম, আমার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এসেছিস! বল, কেন করেছিস এ কাজ।

সোজা হয়ে দাঁড়ালো উস্তেন। মাথা থেকে চিতার চামড়া খুলে ছুঁড়ে দিলো এক পাশে। তারপর দৃঢ় গলায় জবাব দিলো, কারণ, আমার প্রেম মৃত্যুর চেয়ে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী! আমি এ কাজ করেছি, কারণ ওকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। তাই আমি ঝুঁকি নিয়েছি। এখন মরলেও কোনো দুঃখ থাকবে না আমার, অন্তত একবারের জন্যে হলেও ওর মুখ থেকে শুনতে পেয়েছি, ও আমাকে ভালোবাসে।

রাগে, উত্তেজনায় প্রায় লাফিয়ে উঠলো আয়শা। পরমুহূর্তে সামলে নিয়ে বসে পড়লো আবার।

আমি কোনো জাদু জানি না, একই রকম দৃঢ় গলায় স্পষ্ট উচ্চারণে বলে চললো উস্তেন, রানী নই আমি, অমরও নই। সাধারণ মেয়েমানুষ আমি, তবু আমি ভালো করেই বুঝেছি তোমার উদ্দেশ্য! তুমি নিজে ভালোবাসো এই লোককে, তাই আমাকে ধ্বংস করে পথের কাঁটা দূর করতে চাও। আমি জানি। আমি মরবো, অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাবে, কিন্তু এ-ও জানি, ও আমার, তুমি কখনোই পাবে না ওকে। কখনোই ও স্ত্রী বলে গ্রহণ করবে না–।

পরমুহূর্তে আতঙ্ক আর প্রতিহিংসা মেশানো একটা আর্তনাদ ভেসে এলো আমার কানে। ঘাড় ফেরাতেই দেখলাম, উঠে দাঁড়িয়েছে আয়শা। থর থর করে কাপছে সে। ইশারার ভঙ্গিতে ঝট কর একটা হাত বাড়িয়ে দিলো উস্তেনের দিকে। ব্যাস, ঐটুকুই, কিছু বললো না, কোনো শব্দ করলো না, শুধু হাত বাড়িয়ে দিলো। মেয়েটার দিকে। এবং তাতেই হতভাগিনী উস্তেন রক্তহিম করা এক চিৎকার করে দুহাতে মাথা চেপে ধরলো। টলোমলো পায়ে পাক খেলো দুটো, তারপর আছড়ে পড়লো মেঝেতে। আমি, লিও—দুজনেই ছুটে গেলাম ওর কাছে—নাড়ি ধরেই বুঝতে পারলাম, সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে।

কয়েক মুহূর্ত লিও ঠিক বুঝতে পারলো না কি ঘটেছে। কিন্তু যখন পারলো তখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো ওর চেহারা। দাঁত কড়মড়িয়ে একটা শপথবাক্য উচ্চারণ করে উঠে দাঁড়ালো মৃত উস্তেনের পাশ থেকে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল আয়শার দিকে।

ক্ষমা করো, অতিথি, কোমল গলায় বললো আয়শা। আমার বিচার যদি তোমাকে আহত করে থাকে, ক্ষমা করো আমাকে।

ক্ষমা করবো? তোমাকে! গর্জে উঠলো লিও। পিশাচী, খুনী, ক্ষমা করবো তোমাকে! ঈশ্বরের নামে বলছি, সুযোগ পেলেই তোমাকে খুন করবো?

না, না, একই রকম কোমল গলায় বললো আয়শা। তুমি বুঝতে পারছে না–সময় হয়েছে, এখন সব জানা দরকার তোমার। তুমি আমার, ক্যালিক্রেটিস! তুমি আমার দুহাজার বছর ধয় আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্যে। অবশেষে আমার কাছে ফিরে এসেছো তুমি। কিন্তু ঐ মেয়েটা, উস্তেনের দিকে ইশারা করলো সে, বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তোমার আর আমার মাঝে। সেজন্যেই ওকে সরিয়ে দিতে হলো, ক্যালিক্রেটিস!

মিথ্যে কথা! আমি ক্যালিক্রেটিস নই, আমি লিও ভিনসি, ক্যালিক্রেটিস আমার পূর্বপুরুষ—অন্তত আমি সেরকমই জানি।

ওহ, তুমি জানো না কি বলছো–তুমিই ক্যালিক্রেটিস, পুনর্জন্ম নিয়ে ফিরে এসেছে আমার কাছে! তুমি আমার প্রিয়তম প্রভু।

আমি ক্যালিফ্রেটিস নই। আর শুনে রাখো, তোমার মতো পিশাচীর প্রভু হওয়ার ইচ্ছেও আমার নেই। তোমার চেয়ে ঐ জংলী মেয়েটা অনেক ভালো ছিলো!

একথা বলছো, ক্যালিক্রেটিস! তুমি একথা বলছো? বুঝেছি, অনেক দিন আগের কথা তো, কিছু মনে নেই তোমার। সত্যি বলছি, আমার রূপ যদি একবার দেখ, ভুলতে পারবে না।

আমি তোমাকে ঘৃণা করি, খুনী, দুহাত মুঠো পাকিয়ে উঠলো লিওর। তোমার চেহারা দেখার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। তুমি কেমন সুন্দরী; তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি তোমাকে ঘৃণা করি।

তবু কিছুক্ষণের ভেতরই তুমি আমার সামনে হামাগুড়ি দেবে, এবং হলফ করে বলবে, আমাকে ভালোবাসো, বিদ্রুপের হাসি হাসলো আয়শা। এখন আর তেমন কোমল শোনাচ্ছে না তার গলা। এসো এক্ষুণি প্রমাণ হয়ে যাক! দেখ!

এক টানে মুখের আবরণটা খুলে ফেললো সে। কোমরে সাপ জড়ানো, বুকের কাছে অনেকখানি কাটা সেই পোশাকটা কেবল রইলো তার পরনে। একটু এগিয়ে এসে লিওর চোখে চোখে তাকালো সে।

আমি দেখলাম, সঙ্গে সঙ্গে লিওর হাতের মুঠি শিথিল হয়ে গেল। চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠলো প্রথমে বিস্ময়, তারপর প্রশংসা, তারপর অদম্য এক কামনা।

ওহ্, ঈশ্বর! ঢোক গিললো লিও। তুমি কি নারী?

সত্যি সত্যিই নারী, এবং তোমার প্রেমিকা, ক্যালিক্রেটিস! সুগোল বাহু দুটো বাড়িয়ে দিয়ে মিষ্টি করে হাসলো আয়শা।

দেখছে লিও, পৃথিবীর আর সব ভুলে দেখছে এবং ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে। হঠাৎ করেই চোখ পড়লো উস্তেনের লাশের দিকে। কেঁপে উঠে থেমে গেল ও।

অসম্ভব! গর্জে উঠলো লিও। তুমি খুনী, ও ভালোবাসতো আমাকে!

ও নিজেও যে মেয়েটাকে ভালোবাসতো তা ইতিমধ্যে ভুলতে বসেছে লিও।

ও কিছু না, মৃদু গলায় বললো আয়শা। রাতের মৃদু বাতাসে গাছের পত্র পল্লব যেমন মর্মরিয়ে ওঠে তেমন শোনালো ওর গলা। ও কিছু না। আমি যদি পাপ করে থাকি, আমার সৌন্দর্য সে দায় বহন করবে। আমি যদি পাপ করে থাকি, তোমার প্রেমের জন্যেই করেছি। তারচেয়ে এসো ওসব পাপ-পুণ্য দূরে। সরিয়ে রাখি আমরা, আবার দুবাহু বাড়িয়ে দিলো সে। ফিস ফিস করে বললো, এসো।

লিওর দুরবস্থা দেখতে পাচ্ছি আমি। উসখুস করছে বেচারা, ছুটে পালাতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। আয়শার চোখ দুটো যেন লোহার বেড়ির চেয়েও শক্ত করে আটকে রেখেছে ওকে। তার সৌন্দর্য, ইচ্ছাশক্তি এবং আবেগ ওকে মোহাবিষ্ট করে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম সে-আয়শা, তার সম্পূর্ণ নিটোল শরীর নিয়ে ধরা দিয়েছে লিওর বাহুবন্ধনে। তার ঠোঁট দুটো সেঁটে গেছে ওর ঠোঁটের সাথে।

কতক্ষণ ওরা এভাবে রইলো আমি বলতে পারবো না। হঠাৎ দেখলাম, সাপের মতো শরীর মুচড়ে লিওর আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে এলো আয়শা। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো একটু, সেই বিদ্রুপের হাসি।

কি, বলেছিলাম না, ক্যালিক্রেটিস, কিছুক্ষণের ভেতরেই আমার সামনে হামাগুড়ি দেবে তুমি?

দুঃখে লজ্জায় দুর্বোধ্য একটা আওয়াজ বেরোলো লিওর গলা দিয়ে। চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি, এমুহূর্তে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে ওর।

আবার হাসলো আয়শা। দ্রুত হাতে মুখের ওপর আবরণ টেনে পরিচারিকার দিকে তাকিয়ে একটা ইশারা করলো। এতক্ষণ অবাক বিস্ময়ে আয়শার আচরণ দেখছিলো সে। ইঙ্গিত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল কুঠরি ছেড়ে। দুজন পুরুষ বোবা-কালাকে নিয়ে ফিরে এলো একটু পরেই। তাদের দিকে তাকিয়ে আরেকটা ইশারা করলো রানী। তিনজনে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গেল উস্তেনের মৃতদেহ। হৃদয়বিদারক দৃশ্যটা এক পলক দেখলো লিও, তারপর চোখ ঢাকলো দুহাতে।

অস্বস্তিকর এক নীরবতা নেমে এলো আয়শার পর্দাঘেরা কুঠরিতে। মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে লিও। আমিও দাঁড়িয়ে আছি হতবাক হয়ে। আয়শাও নির্বাক, নিষ্পন্দ।

অনেকক্ষণ পর আবার মুখের ওপর থেকে আবরণ সরালো আয়শা। কোমল গলায় বলতে লাগলো, হয়তো আমার কথা তুমি বিশ্বাস করতে পারছে না, ক্যালিক্রেটিস–হয়তো ভাবছো, আমি প্রতারণা করছি তোমার সাথে। কিন্তু সত্যি বলছি, ক্যালিক্রেটিস, দুহাজার বছর ধরে আমি অপেক্ষা করে আছি তোমার জন্যে, তুমি আমার সেই ক্যালিক্রটিস, নতুন করে জন্ম নিয়ে এসেছে আমার কাছে। বিশ্বাস করো, একটুও বানিয়ে বলছি না আমি।

একটু থামলো সে, তারপর আবার বললো, ঠিক আছে, এখনও যদি বিশ্বাস হয়, চলো, প্রমাণ দেখাবো। হলি, তুমিও চলো। তোমরা দুজনেই একটা করে প্রদীপ নিয়ে এসো আমার সাথে।

কিছু ভাবলাম না, বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলাম না-না আমি না লিও, দুজনে দুটো প্রদীপ তুলে নিয়ে চললাম আয়শার পেছন পেছন। পর্দা ঘেরা কুঠুরির শেষ প্রান্তে পৌঁছে একটা পর্দা উঁচু করলো সে। সরু একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। আয়শার পেছন পেছন নামতে শুরু করলাম আমরা।

নামতে নামতে অদ্ভুত একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। সিঁড়ির ধাপগুলো কেমন ক্ষয়ে যাওয়া ধরনের। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে যেমন হয় তেমন। সিঁড়ির নিচে পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। একটু ঝুঁকে পরীক্ষা করলাম ক্ষয়ে যাওয়া ধাপগুলো। ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখলো আয়শা। থেমে দাঁড়ালো সে-ও।

কার পায়ের আঘাতে অমন ক্ষয়ে গেছে সিঁড়ি, ভেবে অবাক হচ্ছে, হলি? জিজ্ঞেস করলো সে। আমার। আমার এই কোমল পায়ের আঘাতেই এ দশা হয়েছে ওগুলোর! ধাপগুলো যখন নতুন ছিলো তখনকার কথা এখনো মনে আছে আমার। তারপর দুহাজার বছর প্রতিদিন এই সিঁড়ি বেয়ে নামা-ওঠা করেছি। আমার পাদুকা তিলে তিলে ক্ষয় করে ফেলেছে নিরেট পাথর!

বলার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না আমি। তবে এটুকু বুঝলাম, যা বললো আয়শা, তা সত্যি হতেই পারে।

সিঁড়ির যেখানে শেষ একটা সুড়ঙ্গের শুরু সেখানে। সুড়ঙ্গ ধরে কয়েক পা এগোতেই একটা পর্দাটানা গুহামুখ দেখতে পেলাম। দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনলাম গুহাটা, সে রাতে এখানেই আমি দেখেছিলাম আয়শাকে, লাফিয়ে ওঠা আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে অজ্ঞাত কাউকে অভিশাপ দিয়ে চলেছিলো। পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো আয়শা। প্রদীপ হাতে অনুসরণ করলাম আমি আর লিও। রহস্য উন্মোচনের আর দেরি নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *