উপন্যাস

১২. জোনাথন স্মলের বিচিত্র কাহিনি

জোনাথন স্মলের বিচিত্র কাহিনি

গাড়িতে উপবিষ্ট ইনস্পেকটরের ধৈর্য আছে বলে, বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসার পরেও দেখলাম বসে আছে চুপটি করে। কিন্তু মুখে মেঘ ঘনিয়ে এল শূন্যগর্ভ বাক্স দেখানোর পর।

বলল দমে-যাওয়া গলায়, পুরস্কারের বারোটা বাজল! টাকা না-পেলে কে দেবে পুরস্কার! পাওয়া গেলে আমি আর স্যাম ব্রাউন দু-জনেই পেতাম এক একটা দশ পাউন্ডের নোট।।

আমি বললাম, তাতে কী? মি, থেডিয়াস শোল্টো বড়োেলোক মানুষ। রত্ন পাওয়া না-গেলেও আপনাদের পুরস্কার দেবেন।

বলা সত্ত্বেও ঘুচল না ইনস্পেকটরের নৈরাশ্য। বললে মাথা নাড়তে নাড়তে, কাজটা কিন্তু ভালো হল না। মি. অ্যাথেলিন জোন্স ঠিক এই কথাই বলবেন।

অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হল সেই ভবিষ্যদ্বাণী। বেকার স্ট্রিটে ফিরে গিয়ে খালি বাক্স দেখানোর পর হাঁ করে শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল ডিটেকটিভ জোন্স। কয়েদি আর হোমসকে নিয়ে সবে পৌঁছেছিল জোন্স প্ল্যানটা একটু পালটে নিয়েছিল পুলিশ ফাঁড়ি হয়ে এসেছিল বেকার স্ট্রিটে। স্বভাবসিদ্ধ নির্বিকারভাবে আর্মচেয়ারে বসেছিল হোমস, উলটোদিকে ডান পায়ের ওপর কাঠের পা-খানা তুলে বসেছিল স্মল। খালি বাক্সটা দেখাতেই চেয়ারে হেলান দিয়ে হেসে উঠল হো-হো করে।

রেগে গিয়ে বললে অ্যাথেলনি জোন্স, এ-কীর্তি তাহলে তোমার, স্মল।

সোল্লাসে বললে স্মল, হ্যাঁ, আমার কীর্তি। এমন জায়গায় রেখেছি রত্নভাণ্ডার যেখানে আপনাদের হাত পৌছোবে না। এ-রত্নভাণ্ডার আমার–আমি যদি তা না-পাই ভোগ করতে দেব না কাউকেই। শুনুন মশাইরা, শুনে রাখুন! ঐশ্বর্য ভোগ করার অধিকার আছে শুধু চারজনের–আমার আর আন্দামান কারাগারের তিন আসামির আর কারোর নেই! আমি যা কিছু করেছি, এদের তরফেই করেছি আমার জন্যেও করেছি। চারের সংকেত গোড়া থেকেই ছিল–এখনও আছে। আমি জানি আমি যা করেছি ওরাও ঠিক তাই করত, বিপুল এই সম্পদ শোল্টো বা মর্সটানের বংশধরের ভোগে দেওয়ার চাইতে টেমসের জলে ছুঁড়ে দিত। ওদের বড়োলোক করার জন্যে আখমেটের সর্বনাশ করিনি আমরা। বামন টোঙ্গা যেখানে, সিন্দুকের চাবি সেখানে–সিন্দুক ভরতি হিরে মানিকও পাবেন সেখানে। যেই দেখেছি নির্ঘাত আমাকে ধরে ফেলবেন আপনারা, তখন থেকেই হিরে মানিক লুকিয়ে ফেলেছি নিরাপদ জায়গায়। কপাল মন্দ আপনাদের এ-যাত্রায় খালি হাতেই ফিরুন।

কড়া গলায় বললে অ্যাথেলনি জোন্স, স্মল, তুমি ঠকাচ্ছ আমাদের। হিরে মানিক টেমসের জলে ফেলার মতলব থাকলে পুরো সিন্দুকটাই জলে ফেলে দিতে অনেক সহজেই কাজ সারা যেত।

এবং অনেক সহজেই তা ফের জল থেকে তুলে আনা যেত। আড়চোখে ধূর্ত ঝিলিক হেসে বললে স্মল। আমার পিছু নেওয়ার বুদ্ধি যার আছে, টেমসের তলা থেকে সিন্দুক তুলে আনার বুদ্ধিও তার আছে। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। পাঁচ মাইলের ওপর ছড়ানো রয়েছে এক বাক্স হিরে মানিক–আর খোঁজা সম্ভব নয়। বুক ভেঙে গেছে মুঠো মুঠো হিরে মুক্তো ছড়াতে। কিন্তু এ ছাড়া আর পথ ছিল না। যে-মুহূর্তে দেখছি তিরের মতো এসে নাগাল ধরে ফেলছেন, সেই মুহূর্তে মনস্থির করেছি। কিন্তু এখন আর দুঃখ নেই? জীবনে অনেক উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি কিন্তু কৃতকর্মের জন্যে কখনো পস্তাইনি।

ডিটেকটিভ বললে–স্মল ব্যাপারটা খুবই গুরুতর। আদালতকে এভাবে বোকা না-বানিয়ে যদি সাহায্য করতে, আখেরে তোমারই লাভ হত–অল্পের ওপর দিয়ে বেঁচে যেতে।।

আদালত! দংষ্ট্রা বার করে গর্জে উঠল জেল-খাটা আসামি। আদালতের মহিমা খুব জানা আছে! এ-ঐশ্বর্য যদি আমাদের ভোগে না-লাগে, তবে আর কার ভোগে লাগবে শুনি? রোজগার না-করেই একদল ভোগ করবে, এই তো আপনাদের আদালতের রায়, তাই না? নিজের হাতের রোজগার করা ঐশ্বর্য তুলে দেব অপরের হাতে? এ-ঐশ্বর্য আমার রোজগার করা–কীভাবে করেছি শুনবেন। বিশ বছর কাটিয়েছি এমন এক জলাভূমিতে জ্বরের কবল থেকে যেখানে কারো নিষ্কৃতি নেই। সারাদিন হাড়ভাঙা খেটেছি, গরান গাছের তলায় সারারাত শেকলে বাঁধা থেকেছি অতি নোংরা কদর্য কুঁড়েঘরে, মশার কামড়ে ছটফট করেছি, কালাজ্বরের আক্রমণে কেঁপে মরেছি, কালামুখো পাষণ্ড পুলিশের অকথ্য অত্যাচারে মৃত্যু শ্রেয় মনে করেছি। জানেন তো সাদা মানুষদের লাথিয়ে আর যন্ত্রণা দিয়ে কী বিকট উল্লাস পায় এই বিটলে কালো পুলিশরা। আগ্রার ঐশ্বর্য মুঠোয় এনেছি এইভাবে আর আপনি কিনা আমাকে আদালতের মহিমা শোনাতে এসেছেন কেন? না, এ-ঐশ্বর্য যারা রোজগার করেনি তাদের খপ্পরে তুলে দেওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারি না। বলে। কী দাম দিয়েছি ভাবুন ঐশ্বর্য রোজগার করতে সে কি অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে? অন্যের ভোগে লাগানোর জন্যে? আমি জেলখানায় দিন শেষ করব আর একজন আমার টাকা নিয়ে রাজার হালে প্রাসাদে বসে ফুর্তি করবে–এর চাইতে বরং টোঙার বিষ-মাখানো তির চামড়ায় ফুড়ে মরতেও রাজি আছি।

সুখ দুঃখের উদাসীনতার বৈরাগ্য-মুখোশ খসে পড়েছে স্মলের মুখ থেকে কথাগুলো বলে গেল ঝড়ের মতো। যেন মত্ত প্রভঞ্জন হাহাকার রবে উড়ে এল জ্বালাময় কথার মধ্য দিয়ে। ভাটার মতো জ্বলতে লাগল দুই চোখ–কড়কড় শব্দে কাঁপতে লাগল হাতের হাতকড়া। মেজর শোল্টো কেন ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলেন এখন তা হাড়ে হাড়ে বুঝলাম। ওই চেহারা, ওই ক্রোধ, ওই আত্যন্তিক আবেগ নিয়ে নেকড়ের মতো,স্মল তাড়া করছে তাঁকে। খবর পেয়েই নিঃশেষ হয়ে এসেছিল তার জীবনীশক্তির। আতঙ্ক যার অমূলক নয়। ভয়টা ভিত্তিহীন নয়।

শান্তভাবে হোমস বললে, তুমি কিন্তু একটা কথা ভুলে যাচ্ছ। এখনও পর্যন্ত তোমার কাহিনি আমি শুনিনি। কী হয়েছে তাও জানি না। কাজেই তোমার ওপর কতখানি অন্যায় হয়েছে সে-বিচার করাও মুশকিল।

আপনার কথাগুলো স্যার, বেশ পরিষ্কার। ব্যবহারটাও ভালো। তবে আমার হাতের এই লোহার বালার জন্যেই আপনি দায়ী–ধন্যবাদ সেজন্যে। কোনো রাগ নেই জানবেন। যা হয়েছে ভালোর জন্যেই হয়েছে। আমার কাহিনি শোনার ইচ্ছে হয়ে থাকলে গোপন করব না। যা বলব তার প্রতিটা কথা জানবেন নির্ভেজাল সত্য–ঈশ্বরের নামে দিব্যি গিলে বলছি। ধন্যবাদ। গেলাসটা পাশে রাখুন। গলা শুকিয়ে গেলে ভিজিয়ে নেবখন।

আমি উস্টার্সশায়ারের মানুষ, জন্মেছি পার্শোরে। ওদিকে গেলে অনেক স্মল পরিবার দেখতে পাবেন। মাঝে মাঝে ঘুরে আসার কথা ভেবেছি বটে, কিন্তু মন থেকে সাড়া পাইনি। বাড়ির লোকের কাছে আমি ছিলাম অপদার্থ–তাই আমার শ্রীমুখ দেখেও কেউ খুশি হবে না বলেই যাইনি। ওরা ধার্মিক, সদাচারী, নিয়মিত গির্জেয় যায়, চাষবাস করে ও অঞ্চলের সবার শ্রদ্ধার পাত্র–এক ডাকেই চেনে সবাই। আমি কিন্তু ছন্নছাড়া উঞ্ছ টাইপের ছিলাম গোড়া থেকেই। আঠারো বছর বয়সে নিষ্কৃতি দিলাম আত্মীয়দের একটা মেয়েঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলাম। দেশ ছেড়ে পালাতে হল শেষ পর্যন্ত। থার্ড বাফস সৈন্যবাহিনীতে নাম লিখিয়ে পালিয়ে গেলাম ভারতবর্ষে।

তবে আমার অদৃষ্ট লিখন অনুসারে সৈন্যবাহিনীতে বেশিদিন থাকার কথা নয়। হাঁটু না-বেঁকিয়ে গজ-স্টেপ কুচকাওয়াজ শেখবার পর সবে বন্দুক চালানোটা রপ্ত করেছি, এমন সময়ে বোকার মতো সাঁতার কাটতে গিয়েছিলাম গঙ্গায়। কপাল ভালো, তাই আমার সঙ্গেই জলে নেমেছিল সার্জেন্ট জন হোল্ডার বাহিনীতে ও-রকম দক্ষ সাঁতারু আর একজনও নেই। মাঝগঙ্গায় যেতেই আমাকে তাড়া করল একটা কুমির, কচাৎ করে কামড়ে নিয়ে গেল ডান পা-খানা–ঠিক যেন হাঁটুর ওপর থেকে পা কেটে বাদ দিলে হাসপাতালের সার্জন। রক্তপড়ার জন্যে বটে, আর যন্ত্রণার জন্যেও বটে, অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম আমি। জন হোল্ডার আমাকে তীরে টেনে না-নিয়ে এলে ডুবে মরতাম নির্ঘাত। হাসপাতালে পাঁচ মাস থাকার পর কাঠের পা নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বেরিয়ে এসে দেখলাম পঙ্গু হওয়ার দরুন সৈন্যবাহিনী থেকে আমার নাম কাটা গিয়েছে এবং খেটে খাওয়ার মতো কোনো কাজ আর নেই।

 

বুঝতেই পারছেন মি. মন্দভাগ্য নিয়ে দিনগুলো তখন কাটিয়েছি। বিশ বছরও বয়স নয় তখন অথচ পঙ্গু। ঈশ্বর যা করেন ভালোর জন্যেই অবশ্য করেন–দুর্ভাগ্যটা আসলে ছদ্মরূপী সৌভাগ্য বোঝা গেল দু-দিনেই। নীলের চাষ করেছিলেন অ্যাবেল হোয়াইট নামে এক ইংরেজ। একজন কুলির সর্দার দরকার ছিল তার লোকজনদের কাজকর্ম তদারক করার জন্যে। অ্যাবেল হোয়াইটের বন্ধু ছিলেন আমার কর্নেল। দুর্ঘটনার পর থেকেই আমার ওপর একটু দুর্বলতা ছিল কর্নেলের। কথা না-বাড়িয়ে বলি, কর্নেলের জোরালো সুপারিশে পেয়ে গেলাম চাকরিটা। পা না-থাকলেও কাজটা কঠিন নয়। কেননা, তদারকি করতে হবে ঘোড়ায় চেপে এবং যেটুকুও হাঁটু ছিল, তা দিয়ে জিন চেপে ধরতে পারতাম। খেতের মধ্য দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া, কুলিদের কাজ দেখা আর কঁকিবাজির খবর মালিককে এনে দেওয়া–এই তো কাজ! মাইনেও ভালো। কোয়ার্টার চমৎকার। শেষ জীবনটা নীল কুঠিতেই কাটিয়ে দেব ঠিক করলাম। মি. অ্যাবেল হোয়াইট মানুষ খুব ভালো। প্রায় আসতেন আমার দীন কুটিরে, তামাক পাইপ টানতেন একসঙ্গে বসে। স্বদেশে সাদা মানুষেরা কেউ কাউকে দেখতে পারে না। বাইরে গেলে কিন্তু প্রত্যেকের জন্যে প্রত্যেকের প্রাণ কাঁদে।

এমন সুদিন কিন্তু বেশিদিন টিকল না। আচমকা বিন্দুমাত্র জানান না-দিয়ে শুরু হয়ে গেল সিপাই বিদ্রোহ। সারে অথবা কেন্টের মতোই যে-দেশ শান্ত নিস্তরঙ্গ ছিল, আচমকা সেই দেশে তাণ্ডবনাচ আরম্ভ করল দু-লক্ষ কালো পিশাচ নিমেষে সাক্ষাৎ নরকে পরিণত হল ভারতবর্ষ। সবই জানেন আপনারা, আমার চাইতেও বেশি খবর রাখেন–কেননা–পড়াশুনার ধাত আমার একেবারেই নেই। আমি যা দেখেছি শুধু তাই বলতে পারি। উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের সীমান্তে মথুরা বলে একটা জায়গায় ছিল আমাদের নীলের চাষ। রাতের পর রাত দেখেছি আকাশ লাল হয়ে রয়েছে জ্বলন্ত বাংলোর আভায়; আর দিনের পর দিন ছোটো ছোটো দলে ইউরোপীয়রা বউ ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমাদের খেত মাড়িয়ে গিয়েছে আগ্রার দিকে সবচেয়ে কাছের সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল সেখানে। মি. অ্যাবেল হোয়াইট ছিলেন বড়ো জেদি পুরুষ। ওঁর ধারণা ছিল, গোলমালটা হঠাৎ যেমন শুরু হয়েছে, তেমনি হঠাৎ থিতিয়ে যাবে। আসলে যা হচ্ছে, গুজব ছড়াচ্ছে তার চেয়ে বেশি। রং চড়ানো গল্পে কান না দিয়ে বারান্দায় বসে হুইস্কি আর চুরুট খেতেন–চারদিকে তখন শুধু আগুন আগুন। বাধ্য হয়ে আমি তো রইলাম, স্ত্রীকে নিয়ে ডসন-ও থেকে গেল কুঠিতে। ডসন খাতাপত্র লিখত, অফিস দেখত। ঝকঝকে পরিষ্কার। একদিনেই কিন্তু ঘনিয়ে এল বিপদ–সর্বনাশ হয়ে গেল একদিনেই। দূরের খেত থেকে ঘোড়ায় চেপে ফিরছি। সন্ধে হয়ে এসেছে, কদমচালে যেতে যেতে একটা খাড়াই নালার তলায় তালগোল পাকানো কী একটা পড়ে থাকতে দেখলাম। কাছে গিয়ে দেখি ডসনের স্ত্রী। রক্ত হিম হয়ে গেল মৃতদেহের অবস্থা দেখে। ছুরি দিয়ে ফালাফালা করে মারার পর নালার মধ্যে ফেলে যাওয়ায় খুবলে খুবলে খেয়ে গেছে লেড়ি কুত্তা আর শেয়াল। কিছু দূরে রাস্তার ওপর পড়ে ডসন নিজে। হাতে একটা রিভলবার; গুলি নেই; কিন্তু সামনে ধরাশায়ী চারজন সিপাই। ঘোড়ার রাশ ধরে ভাবছি কোনদিকে যাব, এমন সময়ে দেখলাম দূরে ঘন কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে অ্যাবেল হোয়াইটের বাংলো থেকে লকলকে আগুনের শিখাও বেরিয়ে আসছে ছাদ ফুঁড়ে। এ অবস্থায় অন্নদাতাকে বাঁচাতে যাওয়া মূর্খতা। কিছুই করতে পারব না, উলটে আমার প্রাণ যাবে। লাল কুর্তা পরে শয়ে শয়ে কালো পিশাচ তাথই তাথই নাচছে আর গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে জ্বলন্ত বাড়ি ঘিরে! আমার দিকে চোখ পড়ল জনা কয়েকের, সঙ্গেসঙ্গে শন শন করে কয়েকটা বন্দুকের গুলি বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ধানখেতের ওপর দিয়ে লম্বা দিলাম আগ্রার দিকে। মাঝরাতে পৌঁছোলাম সেখানকার পাঁচিল-ঘেরা নিরাপদ আশ্রয়ে।

দেখা গেল, নিরাপত্তা সেখানেও বিশেষ নেই। চাকভাঙা মৌমাছির মতো পাগলা হয়ে গিয়েছে সারাদেশ। ইংরেজরা দল বেঁধে এক এক জায়গায় জড়ো হয়ে স্রেফ বন্দুকের জোরে ঠেকিয়ে রেখেছে বিদ্রোহীদের। বন্দুকের জোর যেখানে নেই, সেখানে অসহায়ভাবে দলে দলে পালাচ্ছে। দশ লক্ষর বিরুদ্ধে কয়েকশো লোক যেমন কিছুই নয়–বাঁধ ভাঙা বন্যার মতো এই উন্মত্ত সিপাহীদের সামনে মুষ্টিমেয় ইংরেজও কিছু নয়। সবচেয়ে সর্বনাশ হয়েছে আমাদের ট্রেনিং নিয়ে আমাদেরই বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে সিপাহীরা যাদের আমরা লড়তে শিখিয়েছি, বন্দুক ধরতে শিখিয়েছি, কামান ছুড়তে শিখিয়েছি, বিউগল বাজাতে শিখিয়েছি–তারাই এখন আমাদের ঘোড়া, হাতিয়ার, রণকৌশল নিয়ে কাতারে কাতারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদেরই ওপর। আগ্রায় মোতায়েন ছিল থার্ডবেঙ্গল ফিউজিলীয়ার– হালকা বন্দুকধারী সৈন্যবাহিনী—কিছু শিখ,দু-দল অশ্বারোহী সৈন্য; আর একদল গোলন্দাজ। কেরানি আর ব্যবসাদারদের নিয়ে একটা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি হয়েছিল কাঠের পা নিয়ে আমি তাতে যোগ দিলাম, জুলাইয়ের গোড়ার দিকে সাহগঞ্জে খুব একচোট লড়লাম বটে বিদ্রোহীদের সঙ্গে, কিন্তু বারুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় পালিয়ে আসতে হল শহরের মধ্যে।

চারদিক থেকে তখন খারাপ খবর আসছে, আসাটাই স্বাভাবিক। ম্যাপ দেখলেই বুঝবেন আমরা ছিলাম ঠিক মাঝখানে, শ-খানেক মাইল পূর্বে লক্ষ্ণৌ, দক্ষিণে প্রায় ওইরকম দূরত্বে কানপুর। চারদিকে কেবল অত্যাচার, হত্যা, উৎপীড়ন।

আগ্রা শহরটা আয়তনে বিরাট। ছত্রিশ জাতের নিবাস। গোঁড়া ধর্মান্ধ শয়তান মৌলবাদীতে ঠাসা। সরু সরু গলিঘুজির মধ্যে প্রায় হারিয়ে গেল বললেই চলে আমাদের মুষ্টিমেয় লোকজন। যাই হোক, নদী পেরিয়ে এসে ঘাঁটি গাড়লাম আগ্রার পুরোনো কেল্লায়। প্রাচীন এই কেল্লা সম্বন্ধে আপনারা কেউ কিছু পড়েছেন কি শুনেছেন কিনা জানি না। বড়ো অদ্ভুত জায়গা জীবনে এ-রকম অদ্ভুত দুর্গ আমি দেখিনি আমি নিজেও ছিলাম একটা আশ্চর্য জায়গায়। প্রথমত, কেল্লাটা আকারে পেল্লায়। কয়েক একর জায়গা জুড়ে একখানা কেল্লা। আধুনিক অংশে শহর রক্ষার বাহিনী, মেয়েদের, বাচ্চাদের খাবারদাবারের ভাড়ার এবং সবকিছুর জায়গা করে দেওয়ার পরেও রাশি রাশি ঘর খালি পড়ে রয়েছে তখনও। তা সত্ত্বেও পুরোনো পরিত্যক্ত অংশের তুলনায় আধুনিক অংশ কিছুই নয়–সেখানে কেউ যায় না; বিছে, কেঁচো, মাকড়সা জাতীয় বহুপদী প্রাণী ছাড়া কেউ থাকে না। সেখানকার বড়ো বড়ো হল ঘর, টানা লম্বা অলিন্দের গোলকধাঁধায়, পরিত্যক্ত নাচঘর আর ধু-ধু শূন্য গলিপথে পথ হারিয়ে ফেলে নতুন মানুষরা। শুধু এই কারণেই পরিত্যক্ত সেই মহলে যাওয়া নিষেধ সকলের–তা সত্ত্বেও নতুন দল এলে উঁকিঝুঁকি মেরে মিটিয়ে আসে কৌতূহল।

দুর্গের একদিকে নদী থাকার ফলে সেদিক সুরক্ষিত। কিন্তু অন্যদিকের বিস্তর দরজা জানালায় কড়া পাহারা বসানো দরকার। এ-রকম অগুনতি প্রবেশপথ রয়েছে পেছনের পরিত্যক্ত মহলেও। আমাদের লোকবলও খুব কম, কোনোমতে কেল্লার কোণ আগলানো আর বন্দুক চালানো যায়। কাজেই অগুনতি দরজার প্রতিটিতে কড়া পাহারা বসানো সম্ভব ছিল না। তাই কেল্লার মাঝে একটা কেন্দ্রীয় প্রহরী ভবন করে প্রত্যেকটা গেটে একজন সাদা চামড়ার অধীনে জনা দু-তিন কালা আদমি মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা হল। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের একটা নিরালা দরজার ভার পড়েছিল আমার ওপর এক নির্দিষ্ট রাত-প্রহর থেকে। দু-জন শিখ সৈন্য ছিল আমার অধীনে। আমার ওপর হুকুম ছিল গোলমাল দেখলেই যেন বন্দুক ছুড়ি– আওয়াজ শুনলেই কেন্দ্রীয় প্রহরী ভবন থেকে দৌড়ে আসবে লোকজন। যেখানে ছিলাম, প্রহরী ভবন সেখান থেকে দু-শো গজ দূরে এবং এই দু-শো গজের মধ্যে এত বেশি গলিঘুজির গোলকধাঁধা যে সত্যিই আক্রমণ আরম্ভ হয়ে গেলে বন্দুক ছোড়া সত্ত্বেও সময়মতো সাহায্য এসে পৌঁছোবে কিনা সে-বিষয়ে সন্দেহ ছিল যথেষ্ট।

একে তো একখানা পা নেই, তার ওপর সেনাবাহিনীতে আনকোরা, কাজেই এই ছোট্ট দলের অধিনায়ক হতে পেরে বুকটা দশ হাত হয়ে উঠল। দু-রাত পাহারা দিলাম পাঞ্জাবিদের নিয়ে। দু-জনেই তালট্যাঙা, ভীষণ দর্শন। চিলিরানওয়ালার এককালে অস্ত্র ধরেছিল আমাদের বিরুদ্ধে। দারুণ লড়নেওয়ালা। নাম, মাহোমৎ সিং আর আবদুল্লা খান। ইংরেজি ভালোই বলত; কিন্তু আমার সঙ্গে বিশেষ কথা হত না। আলাদা দাঁড়িয়ে অদ্ভুত গুরুমুখী ভাষায় বকর বকর করত সারারাত। আমি দাঁড়াতাম গেটের বাইরে। নজর রাখতাম চওড়া এঁকাবেঁকা নদী আর আলো চিকমিকে মিরাট শহরের ওপর। নদীর ওপর থেকে ভেসে আসত ঢাকের বাদ্যি, টম টম ড্রাম পেটার খটাখট খটাখট আওয়াজ, বিদ্রোহীদের হুংকার আর উল্লাস, আফিংয়ের নেশায় জড়ানো কণ্ঠে চেঁচামেচি আর মাঝে মাঝে বন্দুকের নির্ঘোষ বিপজ্জনক প্রতিবেশীরা যে সজাগ এবং সক্রিয় সারারাত বোঝা যেত ওই চিৎকার আর আওয়াজের মধ্যে। দু-ঘণ্টা অন্তর রাতের অফিসার টহল দিয়ে দেখে যেত সব ঠিক আছে কিনা–কোনো পোস্ট বাদ দিত না।

তৃতীয় রাত্রে বৃষ্টি পড়ছিল। আকাশ অন্ধকার, মাটি প্যাচপ্যাচে। এই আবহাওয়ায় ঘন্টার পর ঘণ্টা ফটকের বাইরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা বড়ো কষ্টকর। শিখ অনুচরদের কথা বলানোর চেষ্টা করেও পারলাম না। রাত দুটোর সময়ে টহলদার অফিসার ঘুরে যাওয়ার পর একঘেয়েমি একটু কাটল। সঙ্গীরা কেউ কথা বলতে চায় না দেখে বন্দুক রেখে তামাকের পাইপ দিয়ে দেশলাই ঘষতেই ধাঁ করে শিখ দু-জন লাফিয়ে পড়ল আমার ওপর। একজন খপ করে বন্দুক তুলে নিয়ে তাক করল আমার কপালে, একজন গলায় প্রকাণ্ড ছুরি চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বললে, নড়লেই টুটি দু-টুকরো হবে।

প্রথমে ভাবলাম দু-জনেই বুঝি বিদ্রোহীর চর এবং আক্রমণ শুরু হল বলে। সিপাইরা ফটক দখল করলে পিল পিল করে ঢুকে পড়বে ভেতরে। বাচ্চা আর মেয়েদের কেটে টুকরো টুকরো–যা করেছে কানপুরে। পতন ঘটবে আগ্রা কেল্লার। ভাববেন না যেন সাফাই গাইবার চেষ্টা করছিকিন্তু সেই মুহূর্তে কেল্লার পতন ঘটতে চলেছে আশঙ্কা করে হাঁ করেছিলেন। ছুরি খেয়েও সবাইকে চেঁচিয়ে সাবধান করে দেওয়ার জন্যে। যে-লোকটা ছুরি ধরেছিল গলায়, সে যেন আমার উদ্দেশ্য আঁচ করেই বললে ফিসফিস করে, চেঁচাবেন না সাহেব। কেল্লা নিরাপদ। নদীর এপারে বিদ্রোহী কুত্তারা কেউ নেই। গলা শুনে বুঝলাম কথাটা সত্যি এবং আওয়াজ করলেই আমি মরব। তারা কী চায় আমার কাছে শোনবার জন্যে চুপচাপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলাম।

ওদের মধ্যে আবদুল্লা খানের চেহারাটাই সবচেয়ে ভীষণ–ঢ্যাঙাও বেশি। আবদুল্লাই বললে চাপা গলায়, শুনুন সাহেব, হয় এখন থেকে আপনি আমাদের একজন হবেন, নইলে খতম হবেন। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ–জান নিতে একটুও দ্বিধা করব না জানবেন। হয় আপনি খ্রিস্টের নামে ক্রুশ কাঠ ছুঁয়ে শপথ করে বলবেন আজ থেকে আমাদের একজন হয়ে গেলেন–নইলে মরবার জন্যে তৈরি হবেন। ওই খানায় লাশ ফেলে দিয়ে নদী পেরিয়ে ভিড়ে যাব বিদ্রোহী সিপাইদের দলে জাতভাইদের সঙ্গে। মাঝপথ নেই সাহেব। বলুন কী চান? বাঁচতে চান, না মরতে চান? তিন মিনিট সময় দিলাম ভাববার–হাতে সময় বেশি নেই–টহলদার অফিসার আসার আগেই যা করবার শেষ করতে হবে।

আমি বললাম, এ তো মহা মুশকিল? কী চাও তোমরা তাই এখনও বলনি। না-শুনে শপথ করি কী করে? তবে হ্যাঁ, কেল্লা দখল করার ব্যাপারে যদি আমাকে দলে টানতে চাও তাহলে আর দেরি কোরো না—স্বচ্ছন্দে টুটি কাটতে পার আমার।

আবদুল্লা বললে, কেল্লা দখলের ব্যাপার এটা নয়। আপনার জাতভাইরা যেজন্যে এদেশে এসেছে, আপনাকেও তাই করতে চাইছি। বড়োনোক করতে চাইছি। আজ রাত থেকে যদি নাম লেখান আমাদের খাতায়, মনে প্রাণে এক হয়েছি বলে শপথ করেন, তাহলে কোনো ভারতীয় যে-শপথ জীবন গেলেও ভাঙে না সেই শপথ আমরা করব। তিন সত্যি করে বলল–আমাদের লুঠের বখরা আপনিও পাবেন। হিরে মানিকের চার ভাগের এক ভাগ আপনার হবে। এর চাইতে ভালো শর্ত আর কী হতে পারে বলুন?

আমি বললাম, কিন্তু কোন হিরে মানিকের কথা বলছ, তাই তো বুঝলাম না। তোমাদের মতো আমারও খুব ইচ্ছে রাজা বাদশা হওয়ার, কিন্তু হওয়া যায় কী করে সেটা আগে বলো।

আবদুল্লা বললে, তাহলে শপথ করুন বাবার নামে, মায়ের নামে, ধর্মের নামে যে এখন বা ভবিষ্যতে কোনো অবস্থাতেই আমাদের গায়ে হাত তুলবেন না, আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন না?

আমি বললাম, শপথ করছি শুধু একটা শর্তে–কেল্লার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে চলবে না।

তাহলে আমি আমার দোস্ত দু-জনেই শপথ করছি–লুটের বখরা আপনিও পাবেন এবং সমানভাবে ভাগবাটোয়ারা হবে চারজনের মধ্যে।

কিন্তু আমরা তো মোটে তিনজন, বললাম আমি।

না, না। দোস্ত আকবরও পাবে বখরা। ওরা আসছে এইদিকেই সেই ফাঁকে গল্পটা বলি শুনুন। মাহোমৎ সিং, তুমি গেটে দাঁড়াও, এলেই খবর দেবে। সাহেব, এ-কাহিনি আপনাকে বলছি শুধু আপনি শপথ করেছেন বলে। ফিরিঙ্গিরা শপথ রাখে আপনাকে তাই বিশ্বাস করা যায়।

উত্তরপ্রদেশের একজন রাজা আছে। ভূমিস্বত্ব কম থাকলেও ঐশ্বর্য তার প্রচুর। পৈতৃক সূত্রে অনেক টাকা ত পেয়েছেই, নিজেও জমিয়েছে তিল তিল করে। লোক খুব খারাপ, ভোগ করতে জানে না, কেবল জমাতেই জানে। সোনা জমানোর বাতিক প্রচণ্ড। গোলমালের শুরুতে সাপের মুখেও চুমু খেয়েছে, ব্যাঙের মুখেও চুমু খেয়েছে, একদিকে সিপাই আর একদিকে কোম্পানিরাজের ভজনা করেছে। দু-দিনেই অবশ্য বুঝেছে দিন ফুরিয়েছে সাদা মানুষদের। দেশের নানা দিক থেকে কেবল খবর আসছে ইংরেজদের পতন ঘটছে, দলে দলে ইংরেজরা মৃত্যুবরণ করছে। তবে লোক অত্যন্ত ধড়িবাজ বলেই একটা অপূর্ব প্ল্যান এঁটেছে রাজা। অবস্থা যাই দাঁড়াক না কেন, ঐশ্বর্যের অর্ধেক যেন থেকে যায় কাছে। সোনা রুপোর যা কিছু আছে থাক প্রাসাদের তোষাখানায়। কিন্তু দামি দামি রত্ন আর বাছাই করা মুক্তো একটা লোহার বাক্সের মধ্যে নিয়ে একজন বিশ্বাসী অনুচর সওদাগরের ছদ্মবেশে আগ্রা কেল্লায় নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখুক শান্তি ফিরে না-আসা পর্যন্ত। বিদ্রোহীরা জিতলে সোনাদানা থেকে যাবে, কোম্পানি জিতলে হিরে জহরত ফিরে পাওয়া যাবে, জমানো ঐশ্বর্য এইভাবে দু-ভাগ করে দিয়ে রাজাসাহেব সিপাইদের হয়ে খুব লড়ছে–কেননা তার রাজ্যের সেপাইদের দাপট বেশি। সাহেব, নুন খেয়ে যারা নিমকহারামি করেনি। এর ফলে রাজার এই সম্পত্তিতে কিন্তু তাদেরই অধিকার জন্মাচ্ছে।

ছদ্মবেশী এই সওদাগর আখমেত নাম নিয়ে আগ্রা শহরে পৌঁছে গেছে–এখন কেল্লায় ঢোকবার ফিকিরে আছে। আমার এক পালিত ভাই পথসঙ্গী হিসেবে আখমেতের সঙ্গে রয়েছে। এর নাম দোস্ত আকবর সিন্দুকের গুপ্তকথা শুধু সেই জানে। আজ রাতেই আখমেতকে কেল্লার খড়কি দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেবে কথা দিয়েছে দোস্ত আকবর এবং তারা আসছে এই রজার দিকেই। এখুনি এসে পড়বে–এসে দেখবে পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে আমি আর মাহোমৎ সিং। এত ফাঁকা জায়গায় কেউ জানতেও পারবে না, কে এল। আখমেতের খবর দুনিয়ার আর কেউ পাবে না–কিন্তু রাজার বিপুল ঐশ্বর্য চার ভাগ হয়ে যাবে আমাদের মধ্যে। কীরকম লাগল বলুন সাহেব।

উস্টার্সশায়ারের প্রাণের দাম থাকতে পারে, কিন্তু মৃত্যু যেখানে পদে পদে বন্দুকের গুলি, রক্ত আর আগুন যেখানে ডাইনে বাঁয়ে সামনে পেছনে প্রাণ জিনিসটা এমন কিছু বিরাট বা পবিত্র সেখানে নয়। আখমেত মরুক বাঁচুক তাতে কিছু আসে যায় না, কিন্তু দেশে ফিরে পকেট বোেঝাই মোহর বাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি এবং একদিন যারা আমাকে অপদার্থ মনে করেছিল তাদের নাকের ডগার ওপর রাজার হালে দিন কাটাচ্ছি ভাবতেই পুলকিত বোধ, করলাম। কাজেই মন আমার ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আবদুল্লা ভাবলে দ্বিধায় পড়েছি, তাই আরও পীড়াপীড়ির সুরে বললে :

সাহেব, কম্যান্ডারের হাতে এ-লোক ধরা পড়লে নির্ঘাত ফঁসির দড়ি বা বন্দুকের গুলিতে মরবে, জহরত যাবে সরকারি তোষাখানায়, তাতে কারো লাভ হবে না। কিন্তু জহরত যদি আমরা নিই, বাকিটুকুই-বা সরকারের হয়ে করব না কেন? জহরতের বাক্স সরকারের তোষাখানায় যাওয়ার বদলে কেবল আমাদের পকেটে আসবে। চারজনের প্রত্যেকেই রাতারাতি বড়োলোক হয়ে যাব, জমিদার পর্যন্ত হব। কিন্তু কেউ জানবে না–কাকপক্ষীও নেই এখানে কী করলাম দেখার জন্যে। এত বড়ো সুযোগ কী পায়ে ঠেলা উচিত? আবার বলুন তো সাহেব সঙ্গে আছেন কিনা–না কি আপনাকে শত্রু হিসেবেই দেখতে হবে?

বললাম, মনে প্রাণে তোমাদের সঙ্গে রইলাম!

বন্দুকটা ফিরিয়ে নিল আবদুল্লা। বলল, এই তো চাই। আপনাকে পুরো বিশ্বাস করি আমরা। জানি, আমাদের মতো আপনার কথারও অন্যথা হবে না। আসুন এখন ভাই আর সওদাগরের অপেক্ষায় থাকা যাক।

জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ভাই তোমার মতলব জানে তো?

প্ল্যানটা তারই–তারই মাথা থেকে বেরিয়েছে। চলুন গেটে গিয়ে মাহোমৎ সিংয়ের সঙ্গে নজর রাখা যাক।

বর্ষার শুরু বলে সমানে বৃষ্টি পড়ছিল। ভারী বাদামি মেঘ ভেসে যাচ্ছে আকাশে, পাথরের ছাঁচ ছাড়া চোখে পড়ছে না, কিছু সামনের গভীর পরিখার অনেক জায়গায় জল শুকিয়ে গেছে–হেঁটে পেরিয়ে আসা যায় অনায়াসে। দু-জন পাঞ্জাবির সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি এই পরিবেশে এমন একজনের প্রতীক্ষায় যে আসছে কেবল মরতে। ভাবতেও অবাক লাগে।

আচমকা পরিখার অপর পারে ঢাকা-দেওয়া লন্ঠনের ঝিলিক দেখলাম! পীকৃত রাবিশের আড়ালে পরক্ষণেই অদৃশ্য হয়ে গেল আলো ফের দেখা গেল অন্যপাশে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।

চাপা গলায় বললাম, এসে গেছে।

ফিসফিস করে আবদুল্লা বললে, আপনি গিয়ে চ্যালেঞ্জ করবেন–কোত্থেকে আসছে, কোথায় যাচ্ছে সব জিজ্ঞেস করবেন। ঘাবড়ে দেবেন না। আমাদের সঙ্গে ভেতর পাঠিয়ে দেবেন। তারপর যা দরকার আমরা করব–আপনি এখানেই পাহারায় থাকবেন। লণ্ঠনের ঢাকা খোলবার জন্যে তৈরি থাকুন ভালো করে দেখে নিতে চাই সেই লোক কিনা!

আলোটা কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসছিল সামনে। কখনো থামছে, কখনো এগোচ্ছে। তারপর পরিখার ওপারে কালো মূর্তি দেখতে পেলাম। ঢালু পাড় বেয়ে কোনোমতে নামল নীচে, জলা জায়গা পেরোল ছপাং ছপাং শব্দে, ঢালু পাড় বেয়ে গেটের দিকে অর্ধেক উঠতেই চাপা হুংকার ছাড়লাম ওপর থেকে।

কে যায়?

বন্ধু! জবাব এল নীচে থেকে। লণ্ঠনের ঢাকা খুলে জোরালো আলো ফেললাম মুখের ওপর। সবার আগে রয়েছে একজন বিপুলকায় শিখ। কালো দড়ি লুটোচ্ছে কোমরবন্ধ পর্যন্ত। সার্কাস বা প্রদর্শনীর বাইরে সচরাচর এ-রকম তাল-ঢ্যাঙা মানুষ চোখে পড়ে না। অন্য লোকটা বেঁটে, মোটা, গোলগাল। মাথায় হলদে পাগড়ি। হাতে শাল মোড়া একটা পোঁটলা। ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে বেচারা। ঠিক যেন পালাজ্বর হয়েছে এমনিভাবে থরথর করে কেঁপে উঠছে দু-হাত–গর্ত থেকে ইঁদুর মুখ বাড়িয়ে যেমন জ্বল জ্বল করে তাকায় আশেপাশে তেমনিভাবে ভয়ার্ত মুণ্ডু ডাইনে বাঁয়ে ফিরিয়ে ঝকঝকে চোখে কী যেন দেখতে চাইছে অন্ধকারের মধ্যে। এ-লোককে খুন করতে হবে ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। তার পরেই অবশ্য রত্নপেটিকার কথা মনে এনে মনটাকে চকমকি পাথরের মতো শক্ত করে ফেললাম। আমার সাদা মুখ দেখে লোকটা আনন্দে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠে দৌড়োতে দৌড়োতে ছুটে এল আমার কাছে।

বললে হাঁপাতে হাঁপাতে, বাঁচান সাহেব, আমাকে বাঁচান। দীন দুঃখী সওদাগর আখমেতকে আশ্রয় দিন। আগ্রা ফোর্টে এসে বাঁচবার জন্যেই রাজপুতনা হেঁটে পেরিয়ে এসেছি। কোম্পানি আমার মা-বাপ বলে আমাকে ওরা বেধড়ক মেরেছে, গালাগাল দিয়ে ভূত ছাড়িয়েছে, টাকাকড়ি সব কেড়ে নিয়েছে। আজ আমার বড়ো সুদিন ফের পেয়েছি আপনাদের আশ্রয়। আমার সামান্য সম্বল আজ থেকে নিরাপদ।

কী আছে তোমার পুটলিতে? শুধোলাম আমি।

ও বলল, লোহার বাক্স। সামান্য পারিবারিক স্মৃতি রেখেছি ভেতরে। অন্যের কাছে কোনো দামই নেই আমার কাছে অমূল্য। তাহলেও জানবেন আমি ভিখিরি নই। আশ্রয় যদি দেন তো মোটা পুরস্কার পাবেন আপনি আর আপনার সরকার।

লোকটার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলার মতো ভরসাও রাখতে পারলাম না নিজের ওপর। ভয়ে ফ্যাকাশে চর্বি থলথলে মুখটার দিকে যতই তাকাই ততই মনে হয় ঠান্ডা মাথায় এ-লোককে কি মারা যায়? অসম্ভব! ধুত্তোর, যা হবার হয়ে যাক।

বললাম, ভেতরে প্রধান প্রহরীর কাছে নিয়ে যাও একে। পাঞ্জাবি দু-জন ওর দু-পাশে থেকে নিয়ে গেল ভেতরে পেছনে রইল অসুরের মতো শিখটা। অন্ধকার গলিপথের মধ্যে তালে তালে পা ফেলে নিয়ে গেল বেচারিকে। মানুষকে এভাবে মৃত্যু পরিবেষ্টিত অবস্থায় কখনো দেখিনি। লণ্ঠন নিয়ে গেটে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।

নিস্তব্ধ অলিন্দে ওদের তালে তালে পা ফেলে এগিয়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনলাম কিছুক্ষণ তারপরেই তা থেমে গেল। আচমকা ভেসে এল চেঁচামেচি ঝটাপটি, ঘুমোঘুসির শব্দ। পরক্ষণেই চুল খাড়া হয়ে গেল একটা ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ শুনে। পায়ের আওয়াজ ঊর্ধ্বশ্বাসে আসছে। আমার দিকেই এবং ফেঁস ফোঁস শব্দে ভীষণ আওয়াজ করে হাঁপাচ্ছে ছুটন্ত ব্যক্তি। লণ্ঠন ঘুরিয়ে আলো ফেললাম টানা লম্বা গলিপথে দেখলাম বাতাসের বেগে ছুটে আসছে সেই মোটকা লোকটা সারামুখে রক্ত মাখামাখি–ঠিক পেছনেই চকচকে খোলা ছুরি হাতে ব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে আসছে অসুরের মতো বিশাল চেহারার সেই কালো দাড়িওলা শিখটি। অসম্ভব বেগে দৌড়াচ্ছে খুদে সওদাগর। এত জোরে কখনো কোনো মানুষকে দৌড়তে দেখিনি। ক্রমশ পেছিয়ে পড়ছে শিখ এবং কোনোমতে আমাকে পেরিয়ে সওদাগর যদি বেরিয়ে যায় ভোলা জায়গায় ধরা মুশকিল হবে। মনটা নরম হয়ে এল বেচারার অবস্থা দেখে, পরমুহূর্তেই শক্ত হয়ে উঠল হিরে মানিকের কথা ভেবে। আমার পাশ দিয়ে উল্কার মতো বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে বন্দুকটা গলিয়ে দিলাম দু-পায়ের ফাঁকে গুলি খাওয়া খরগোশের মতো দুটো ডিগবাজি খেয়ে সে হড়কে গেল মাটির ওপর দিয়ে। উঠে দাঁড়াবার আগেই পেছন থেকে লাফিয়ে পড়ল ভীমদর্শন শিখ এবং দু-দুবার ছুরি বসিয়ে দিল বুকের বাঁ-দিকে। চেঁচানি গোঙানি কোনোটাই বেরোল না লোকটার গলা দিয়ে–আঙুল পর্যন্ত নড়ল না পড়ে রইল নিথর দেহে। আছাড় খেয়ে ঘাড় ভেঙে ফেলেছিল বোধ হয়। দেখুন স্যার, সব কথা বলব কথা দিয়েছিলাম বলেই কিছু আর লুকোচ্ছি না। প্রত্যেকটা ঘটনা হুবহু বলে যাব। আপনাদের ভালো লাগলেও বলব, খারাপ লাগলেও বলব।

জল-মিশোনো হুইস্কি এগিয়ে দিয়েছিল হোমস। কথা থামিয়ে গেলাসের দিকে হাত বাড়াল স্মল। আমার ভেতর পর্যন্ত খিচড়ে গিয়েছিল লোকটার ওপর গা রি-রি করছিল আতীব্র ঘৃণায়। এত বড়ো একটা খুনখারাপির মধ্যে এত সহজভাবে নিজেকে যে মিশিয়ে দিতে পারে, নিঃসন্দেহে সে অতি ভয়ংকর পুরুষ। তার ওপর গোড়া থেকেই পুরো ঘটনাটা বলে যাচ্ছে বেপরোয়া বাচাল ভঙ্গিমায় কিছুই যেন হয়নি। আদালতে এ-লোকের বরাতে যে-দণ্ডই জমা থাকুক না কেন, আমার তরফ থেকে এক বিন্দু সহানুভূতিও ওকে দেওয়া যাবে না। হাঁটুতে হাত রেখে শার্লক হোমস আর জোন্স নিবিষ্ট চিত্তে শুনেছে ওর কাহিনি–মুখের পরতে পরতে কিন্তু ফুটে উঠেছে। একই বিরাগ, স্মল তা লক্ষ করেছিল নিশ্চয়। তাই আরও বেপরোয়া গলায় আর ভঙ্গিমায় নতুন করে আরম্ভ করল কাহিনি।

কাজটা ভালো নয় মানছি। কিন্তু আমার অবস্থায় পড়লে রত্নের বখরা পায়ে ঠেলবার মতো মানুষ দুনিয়ায় কেউ আছে কি? দলে না-ভিড়লেই টুটি কাটা যেত। আবার দেখুন, আখমেত যদি আমার সামনে দিয়ে পালাত, তাহলেও পুরো ব্যাপার ফাস হয়ে যেত। আমি ধরা পড়তাম, কোর্ট মার্শাল হত, গুলি খেয়ে মরতাম। সমস্যাটা তাই মরণ বাঁচনের। হয় আখমেত মরবে, নয় আমি মরব। এ-রকম সমস্যায় দুনিয়ার কেউ কিন্তু মায়া দয়া দেখায় না।

হোমস সংক্ষেপে বললে, গল্পটা বলে যাও।

যাই হোক, আবদুল্লা, আমি আর আকবর লাশ বয়ে নিয়ে এলাম ভেতরে। বেঁটেখাটো হলে কী হবে, বেজায় ভারী লোকটা। দরজা আগলানোর জন্যে রইল মাহোমৎ সিং। গোর দেওয়ার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিল। আখমেতকে নিয়ে গেলাম সেখানে। অনেক গলিঘুজি পেরিয়ে বেশ কিছুদূরে পেল্লায় ফাকা হল ঘর–ইট পলেস্তারা ভেঙে ভেঙে পড়ছে। একদিকের মাটি আপনা থেকেই বসে যাওয়ায় কবরের মতো গর্ত হয়ে গেছে। আখমেতকে তার মধ্যে ফেলে ওপরে আলগা ইটের টুকরো চাপা দিলাম। তারপর ফিরে এলাম রত্নপেটিকার কাছে।

মার খোয়েই আখমেত বাক্স যেখানে ফেলেছিল পড়েছিল সেইখানেই। সেই বাক্সই রয়েছে আমাদের টেবিলে। ওপরের হাতলে বাঁধা সিল্কের দড়ি থেকে ঝুলছিল চাবিটা, তালা খুলে লণ্ঠনের আলো ভেতরে ফেলতে ঠিকরে বেরিয়ে এল একঝলক দ্যুতি। আলো পড়ছে বাক্স ভরতি হিরে মানিকের ওপর বিচিত্র বর্ণের আশ্চর্য রোশনাইতেই চোখ ধাধিয়ে গেল। পার্শোরে থাকার সময় বাচ্চাবেলায় অনেক মণিমাণিক্যের গল্প শুনেছিলাম, পড়েছিলাম! এ সেই রূপকথার মানিক যেন, বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা যায় না চোখে ধাঁধা লাগে। চোখ ভরে সেই দৃশ্য দেখবার পর উপুড় করে ঢাললাম রত্নরাশি–গুনে গুনে ফর্দ তৈরি করলাম। প্রথম শ্রেণির হিরেই ছিল এক-শো তেতাল্লিশটা, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম হিরে গ্রেট মোগলও ছিল তার মধ্যে। আর ছিল সাতানব্বইটা অতি উৎকৃষ্ট পান্না, এক-শো সত্তরটা চুনি, কতকগুলো অবশ্য আকারে ছোটো! এ ছাড়াও ছিল চল্লিশটা পদ্মরাগমণি৭, দশ দশটা নীলকান্ত মণি, একষট্টিটা অলীক পাথর, বেশ কিছু ফিরোজা মণি, অনিকস পাথর, বৈদূর্য মণি টার্কয়িজ নীলকান্ত এবং আরও অনেক দামি দামি পাথর৮–যার নাম তখন না-জানলেও পরে জেনেছিলাম। এইসঙ্গে ছিল অতি উৎকৃষ্ট শ-তিনেক মুক্তো বারোটা মুক্তো গাঁথা ছিল সোনার ছোট্ট মুকুটে। ভালো কথা, সিন্দুক ফিরে পাওয়ার পর ভেতরে কিন্তু মুক্তোর সোনার মুকুটটা পাইনি।

গোনাগুনতির পর সিন্দুকে রত্ন নিয়ে গেটে গিয়ে দেখলাম মাহোমৎ সিংকে। তারপর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফের প্রতিজ্ঞা করলাম কেউ কাউকে বিপদে ফেলে পালাবে না। দুর্দিনে পাশে দাঁড়াব এবং গুপ্তকথা প্রকাশ করব না। ঠিক করলাম দেশে শান্তি ফিরে না-আসা পর্যন্ত লুটের মাল কোথাও লুকিয়ে রাখব পরে সমানভাবে ভাগাভাগি করে নেব। সেই মুহূর্তে ভাগবাটোয়ারার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কেননা ওইরকম দামি পাথর কাছে দেখলেই সবার সন্দেহ হবে–কেল্লার মধ্যেও লুকিয়ে রাখার মতো সে-রকম জায়গা নেই। তাই বাক্স নিয়ে গেলাম যে হল ঘরে আখমেতকে কবর দিয়েছি সেই ঘরে; সবচেয়ে শক্ত একটা দেওয়াল থেকে ইট সরিয়ে রাখলাম। গর্তের মধ্যে লুকিয়ে ফেললাম সিন্দুক। জায়গাটার ঠিকানা মুখস্থ করে নিয়ে পরের দিন চারটে নকশা তৈরি করলাম, প্রত্যেকটার তলায় চারজনে সই করলাম কেননা আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে-কাজে হাত দিয়েছি তা শেষ করব একসঙ্গে এবং কেউ কাউকে ঠকাব না। বুকে হাত দিয়ে বলছি এ-শপথ আজও আমি ভাঙিনি।

এরপর ভারতবর্ষের বিদ্রোহ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আপনাদের নতুন করে তা বলার দরকার নেই। উইলসন দিল্লি আর স্যার কলিন লক্ষ্ণৌ পুনরুদ্ধার করার পর মেরুদণ্ড ভেঙে গেল বিদ্রোহীদের। আরও বাহিনী আসা শুরু হতেই সীমান্তপ্রদেশে গা ঢাকা দিল নানাসাহেব। কর্নেল গ্রেথেড একটা ঝটিকা বাহিনী এনে আগ্রা অবরোধ করলেন এবং হটিয়ে দিলেন প্যান্ডিদের আস্তে আস্তে শান্তি ফিরে এল দেশে। আমরা চারজনেও মশগুল হয়ে রইলাম লুটের মাল ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়ার সুখস্বপ্নে। স্বপ্ন অবশ্য চুরমার হয়ে গেল এক আঘাতেই–আখমেত হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার হলাম চারজনই।

ঘটনাটা ঘটল এইভাবে। প্রাচ্যের লোকগুলো বড়ো সন্দেহবাতিক হয়। বিশ্বস্ত অনুচরের জিম্মায় রত্নপেটিকা দিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারেনি রাজা–আর একজন অনুচরকে বলেছিল ছায়ার মতো প্রথমজনের পেছনে যেতে এবং সবসময়ে নজর রাখতে। কখনো যেন চোখের আড়াল না-করা হয়। হুকুমের নড়চড় হল না কোনোক্ষেত্রেই। দ্বিতীয় অনুচর ছায়ার মতো সে-রাতেও আখমেতের পেছন পেছন এসে তাকে দেখল কেল্লার ভেতর ঢুকতে। ভাবল বুঝি কেল্লায় ঠাই পেয়েছে। আখমেত। তাই পরের দিন দরখাস্ত পেশ করে নিজেও ঢুকল দুর্গে– কিন্তু আখমেতের টিকি দেখতে পেল না। অদ্ভুত ব্যাপার তো। তাই সময়মতো রহস্যটা নিবেদন করল প্রহরীদের জনৈক সার্জেন্টের কাছে এবং যথাসময়ে সার্জেন্ট গিয়ে খবরটা অধিনায়কের কানে তুলে দিল। তক্ষুনি তন্নতন্ন করে খোঁজা হল চারদিক বেরিয়ে পড়ল আখমেতের মৃতদেহ। কপাল খারাপ একেই বলে। বিপদ কেটে গেছে ভেবে লুঠের মাল ভাগাভাগির স্বপ্ন যখন দেখছি, ঠিক তখনই গ্রেপ্তার হলাম চারজনে–তিনজন ওই রাতে ফটক পাহারা দিচ্ছিলাম বলে, চতুর্থজন নিহত ব্যক্তির পথসঙ্গী ছিল বলে। বিচারকালে জহরত নিয়ে কেউ কোনো কথা বলল না। কেননা যার জহরত সেই রাজাকেই নির্বাসন দণ্ড দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছিল ভারতবর্ষের বাইরে, কাজেই পেটিকা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না কারোরই। তবে খুন যে একটা হয়েছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই এবং আমরা চারজনেই জড়িত সেই খুনের মধ্যে। শিখ তিনজনের ওপর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের হুকুম হল। ফাসিতে মৃত্যুর রায় এল আমার ওপর। শেষ অবধি অবশ্য আমাকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় অন্যদের মতো।

আমাদের তখনকার অদ্ভুত অবস্থাটা কল্পনা করুন। চারজনেরই পা একসঙ্গে বাঁধা–ইহজীবনে মুক্তির আশা নেই! অথচ চারজনের প্রত্যেকেই এমন একটা গুপ্ত খবর জেনে বসে আছি যার দৌলতে প্রত্যেকেই এক একটা রাজপ্রাসাদ বানিয়ে রাজার হালে জীবন কাটিয়ে দিতে পারি যদি একবার ছাড়া পাই। এ অবস্থায় মানুষ পাগল হয়ে যায়! আমিও পাগল হয়ে যেতাম। কিন্তু চিরকালই আমি একটু গোঁয়ার টাইপের। তাই মনের মধ্যে ধিকিধিকি আগুন নিয়েও প্রতিদিন লাথিঝাটা খেয়েছি, জেলের অখাদ্য ভাত খেয়ে ক্ষুধা তেষ্টা মিটিয়েছি–প্রতি মুহূর্তে কিন্তু মনে হয়েছে বাইরে আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে রাজ ঐশ্বর্য গিয়ে শুধু তুলে নিলেই হল! তাই মুখ বুজে সব সয়েছি আর দিন গুনছি সুদিন আসার।

অবশেষে মনে হল যেন সুদিন এসেছে। আগ্রা থেকে মাদ্রাজ পাঠানো হল আমাকে। সেখান থেকে আন্দামানের পোর্টব্লেয়ার দ্বীপে। বেশ কয়েকজন শ্বেতকায় কয়েদি ছিল উপনিবেশে। আমার ব্যবহার ভালো হওয়ায় শিগগিরই কর্তাদের প্রিয়পাত্র হয়ে গেলাম। মাউন্ট হ্যারিয়েটের২৪ সানুদেশে ছোট্ট হোপটাউনে একটা কুঁড়েঘরের সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক কিছুই পেলাম। জায়গাটা নির্জন, তার ওপর জ্বরজ্বালা লেগেই আছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হল নরখাদকের ভয়। নিজের চত্বর ছেড়ে একটু এদিক-ওদিক করলেই বিষ-মাখানো তির এসে বিধবে গায়ে। খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তা আর নর্দৰ্মা বানানো ছাড়াও চুপড়ি আলুর চাষ করতে হত আমায়, ডজনখানেক আরও কাজে ব্যস্ত থাকতে হত সারাদিন। রাত্রিবেলা শুধু সময় পেতাম গল্পগুজব করার। অন্যান্য কাজের মধ্যে ডাক্তারের কথামতো ওষুধ দেওয়ার দায়িত্বও ছিল ক্যাঁধে, সেই কাজ করতে গিয়ে ডাক্তারি বিদ্যেও কিছু কিছু শিখে নিয়েছিলাম। সর্বক্ষণ কিন্তু পালানোর সুযোগ খুঁজতাম কিন্তু তা সম্ভব ছিল না কোনোমতেই। একটা দ্বীপ থেকে আরেকটা দ্বীপ কম করে এক-শো মাইল দূরে হাওয়াও তেমন নেই ওদিককার সমুদ্রে, সুতরাং পালানোর সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।

ডক্টর সোমারটন খুব হাসিখুশি টাইপের মিশুকে ছোকরা। অন্যান্য তরুণ অফিসাররা রাত হলেই তাঁর বাড়ি গিয়ে আড্ডা মারতেন আর তাস খেলতেন। ডাক্তারখানায় বসে ওষুধ বানাতাম আমি। মাঝে মাঝে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হলে ডাক্তারখানার আলো নিভিয়ে মাঝের জানলায় দাঁড়িয়ে কথা শুনতাম আর খেলা দেখতাম। আমি নিজে তাসের ভক্ত। খেলা দেখতে ভালোবাসি মনে হয় যেন নিজেই খেলছি। আড্ডায় থাকতেন ডাক্তার নিজে, দেশি সৈন্যবাহিনীর অফিসার মেজর শোল্টো, ক্যাপ্টেন মসটান, লেফটেন্যান্ট ব্রমলি ব্রাউন! আর জনা দু-তিন জেল অফিসারপ্রত্যেকেই পাকা জুয়াড়ি, খেলতেন ঝুঁকি বাঁচিয়ে, অত্যন্ত কৌশলে। পার্টিটা ছোট্ট। কিন্তু জমাটি।

একটা জিনিস দেখে কিন্তু খটকা লেগেছিল প্রথম থেকেই। সামরিক অফিসাররা ক্রমাগত হারতেন, অসামরিক অফিসাররা ক্রমাগত জিততেন। খেলায় কারচুপি ছিল বলতে চাই না কিন্তু প্রতিবারেই দেখেছি এই একই কাণ্ড। অসামরিক জেল-অফিসাররা আন্দামানে জেল ডিউটি নিয়ে আসার পর থেকে একনাগাড়ে তাস খেলে এসেছেন একে অপরের খেলার ধারার শেষ পর্যন্ত হিসেব রাখতেন। কিন্তু সামরিক অফিসাররা অত ধার ধারতেন না, তাঁরা খেলতেন শুধু তাস পিটিয়ে সময় কাটানোর জন্যে। রাতের পর রাত চলেছে হারার পালা। সামরিক অফিসারদের পকেট যতই হালকা হয়েছে ততই তাদের রোখ চেপে গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি চোট খেয়েছিলেন মেজর শোল্টো। প্রথম প্রথম খেলতেন নোট আর সোনা ফেলে। শিগগিরই দেখা গেল মোটা টাকার দরকার হলেই ধার নিচ্ছেন অঙ্গীকারপত্র লিখে। মাঝে মাঝে জিততেন। সাহস বেড়ে যেত, তারপরেই আবার গো-হারান হারতেন, সারাদিন কালো বাজের মতো দাপিয়ে বেড়াতেন নানা কাজে আর মদ গিলতেন শরীর সইতে পারছে না জেনেও।

একরাতে রোজ যা হারতেন তার চাইতেও বেশি হারলেন। টলতে টলতে কোয়ার্টারে ফিরছিলেন ক্যাপ্টেন মর্সটান আর মেজর শোল্টো আমার কুঁড়ের পাশ দিয়ে। দু-জনেই হরিহর-আত্মা বন্ধু ছাড়াছাড়ি কখনো হত না। ঘরে বসে শুনলাম মেজর শোল্টো দুঃখ করছেন অতগুলো টাকা হেরে যাওয়া নিয়ে।

বললেন–মর্সটান আমি পথে বসেছি। সর্বস্বান্ত হয়েছি। কাগজপত্র না-আনলেই নয়।

বন্ধুর কঁধ চাপড়ে মর্সটান বললেন–ননসেন্স! আমার নিজের অবস্থাও কি খুব ভালো? তবে—

এর বেশি আর শুনতে পেলাম না দু-জনে দূরে সরে যাওয়ায়। কিন্তু যা শুনেছি তাই যথেষ্ট। নতুন মতলব উঁকি দিল মাথায়।

দিন দুয়েক পরে মেজর শোল্টোকে সকালবেলায় পায়চারি করতে দেখে ভাবলাম, কথা বলার এই-ই সুবর্ণ সুযোগ!

বললাম, মেজর, আপনার একটা উপদেশ চাই।

মুখ থেকে চুরুট নামিয়ে মেজর বললে, কী ব্যাপার, স্মল?

বললাম, আমি জানতে চাই গুপ্তধন ঠিক কার হাতে দেওয়া উচিত। পাঁচ লক্ষ পাউন্ড দামি একটা গুপ্তধনের ঠিকানা আমি জানি। নিজে যখন তা ভোগ করতেই পারব না, ভাবছিলাম কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিলে কেমন হয়। তাতে আমার জেল-মেয়াদটা তো কমতে পারে।

পাঁচ লক্ষ পাউন্ড! দম আটকে এল যেন মেজরের। খরখরে চোখে চাইলেন আমার মুখের দিকে ঠাট্টা করছি কিনা দেখবার জন্যে।

আজ্ঞে হ্যাঁ। জহর আর মুক্তো মিলিয়ে। এমন জায়গায় রয়েছে যে, যে কেউ নিতে পারে। মজাটা কী জানেন। আসল মালিককে দেশছাড়া করেছে সরকার। কাজেই এ-গুপ্তধনটা এখন যে আগে পাবে তার হবে।

আমতা আমতা করে মেজর বললেন, কাকে আর দেবে, স্মল। গভর্নমেন্টকে দিয়ো। বললেন বটে। কিন্তু তোতলামি দেখেই বুঝলাম ওষুধ ধরেছে। সহজভাবে বললাম, খবরটা তাহলে গভর্নর জেনারেলকে দিতে বলেছেন? অত তাড়াতাড়ি করার কী দরকার? পরে পস্তাতে হবে। খুলে বলো আগে শুনি।

বললাম পুরো কাহিনি, কয়েক জায়গা একটু পালটে দিতে হল যাতে জায়গাটা না-চিনতে পারেন। শেষ করার পর দেখি উনি চিন্তায় পাথর হয়ে গেলেন। ঠোট কাঁপছে দেখেই বুঝলাম ভেতরে তোলপাড় চলেছে, দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে।

অবশেষে বললেন, স্মল ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে আর কারো কাছে মুখ খুলো না। আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে।

দু-রাত পরে নিশুতি রাতে লণ্ঠন হাতে আমার কুঁড়েতে এলেন মেজর শোল্টো আর ক্যাপ্টেন মসটান।

মেজর বললে, স্মল, গল্পটা তুমি আবার শোনাও ক্যাপ্টেন মর্সাটানকে।

যা আগে বলেছিলাম, এখনও তাই বললাম। মেজর বললেন, কী মনে হয়? সত্যি? এগোনো যায়? ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন ক্যাপ্টেন মর্সটান।

মেজর তখন বললেন, শোনো স্মল, তোমার গুপ্তধন নিয়ে অনেক ভেবেছি আমরা দুই বন্ধু। একটা সিদ্ধান্ততেই এসেছি। বিষয়টা ব্যক্তিগত সরকারি মোটেই নয়। ব্যক্তিগত সমস্যার নিষ্পত্তি ব্যক্তিগতভাবেই করা উচিত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে–কী দাম চাও তুমি? তোমার হয়ে গুপ্তধন আমরা উদ্ধার করে আনতে পারি, গুপ্তধনের চেহারাটাও একটু দেখতে পার–শর্ত যদি মনের মতো হয়। খুব সহজ শান্তভাবে কথাগুলো বললেন, দেখলাম লোভ ও উত্তেজনায় চোখ চকচক করছে। মেজরের।

আমি শান্ত থাকার চেষ্টা করেও ভেতরে ভেতরে ওঁর মতোই উত্তেজিত হয়ে বললাম, এক্ষেত্রে সবাই যে-শর্ত চায়, আমারও তাই শর্ত। আমাকে মুক্তি দিতে হবে আমার তিন বন্ধুকেও জেলের বাইরে আনতে হবে। তাহলেই আপনাদের অংশীদার করে নিয়ে পাঁচ ভাগের এক ভাগ দেব আপনাদের ভাগ করে নেবেন দু-জনে।

মাথাপিছু পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড, বললাম আমি।

পাঁচ ভাগের এক ভাগ! সে আর এমন কী!

কিন্তু অসম্ভব আবদার করছ যে! মুক্তি দেব কী করে?

তাও ভেবেছি, বললাম আমি। পালাবার একমাত্র অন্তরায় হল এতখানি সমুদ্রপথ পাড়ি দেওয়ার উপযুক্ত বোট আর তদ্দিনের খাবারদাবার আমাদের নেই। কলকাতা বা মাদ্রাজে পাল তোলা হালকা বজরা অনেক আছে–একটা পেলেই কাজ চলে যাবে আমাদের। ওইরকম একটা বোট নিয়ে আসুন এখানে। রাতে অন্ধকারে উঠে পড়ব তাতে। ভারতবর্ষের উপকূলে কোথাও যদি নামিয়ে দিতে পারেন তাহলেই জানবেন আপনাদের দিক দিয়ে চুক্তি রক্ষে হবে।

একজন হলে করতাম, বললেন উনি।

আমি বললাম, করলে চারজনের জন্যেই করতে হবে নইলে নয়। শপথ করেছি আমরা, যা করব চারজনে একসঙ্গে করব।

মটান, স্মলের কথার দাম আছে। বন্ধুদের ডুবিয়ে নিজে বাঁচতে চায় না। আমার তো মনে হয় এমন লোককে বিশ্বাস করা যায়।

মর্টান বললেন, কাজটা কদর্য। তাহলেও তুমি যখন বলছ দস্তুরির টাকায় নোংরামি পুষিয়ে যাবে, তখন না হয় করা যাবে।

মেজর বললেন, স্মল তোমাকে বাজিয়ে দেখতে চাই। যা বললে তা সত্যি কিনা যাচাই করতে চাই। বাক্স কোথায় আছে বলো। ছুটি নিয়ে আমি নিজে গিয়ে দেখে আসব। প্রতি মাসেই তো রিলিফ-বোর্ট যাচ্ছে ভারতবর্ষে আমি রওনা হব সেই বোটে।

মেজর গরম হয়ে উঠতেই আমি ঠান্ডা মেরে গেলাম। বললাম, অত তাড়াহুড়ো করলে তো চলবে না। তিন বন্ধু রাজি আছে কিনা জানতে হবে। বললাম না আপনাদের, যা করব চারজনে একসঙ্গে করব।

ধাঁ করে রেগে গিয়ে মেজর বললেন, বাজে কথা বোলো না! তোমার সঙ্গে আমাদের বোঝাঁপড়া হচ্ছে, তার মধ্যে কালা আদামি তিনটে আসে কী করে?

আমি বললাম, কালো কি নীল বুঝি না আমরা চারজনে এক, একসঙ্গেই থাকব।

যাই হোক, আর একটা অধিবেশনে নিস্পত্তি হয়ে গেল সব কিছুর–এ-অধিবেশনে হাজির রইল মাহোমৎ সিং, আবদুল্লা খান, আর দোস্ত আকবর। অনেক আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত একটা ব্যবস্থা হল। দু-জন অফিসারকেই আগ্রা ফোর্টের একটা নকশা দেব-নকশায় চিহ্ন দিয়ে দেখিয়ে দেব কোথায় কোথায় আছে গুপ্তধন। আমি সত্যি বলেছি কিনা যাচাই করার জন্যে ভারতবর্ষে যাবেন মেজর শোল্টো। বাক্স দেখতে পেলে সেখানেই রেখে দেবেন। একটা ছোটো বজরায় খাবার দাবার বোঝাই করে আন্দামানে পাঠিয়ে দেবেন–বজরা এসে নোঙর ফেলবে রাটল্যান্ড দ্বীপে আমরা সেখানে গিয়ে উঠব বজরায়। মেজর শোল্টো তখন নিজের কাজে ফিরে আসবেন। তারপর ছুটির দরখাস্ত করবেন ক্যাপ্টেন মর্সটান, আগ্রায়, গিয়ে মিলবেন আমাদের সঙ্গে হীরে মানিক ভাগ বাঁটোয়ারা হবে তারপর মেজর শোন্টোর বখরাও নেবেন ক্যাপ্টেন মসটান। ছ-জনেই প্রতিজ্ঞা করলাম কোনোমতেই এ-ব্যবস্থার অন্যথা করব না। মন আর মুখ দিয়ে এভাবে সচরাচর কেউ প্রতিজ্ঞা করে না। সারারাত বসে দুটো নকশা তৈরি করে সই করলাম চারজন আবদুল্লা, আকবর, মাহোমৎ আর আমি।

লম্বা কাহিনি শুনে অধীর হয়ে পড়েছেন বুঝতে পারছি–মি. জোন্স তো ছটফট করছেন আমাকে খাঁচায় পিরবার জন্য। যদূর সম্ভব সংক্ষেপে বলছি, শোল্টো শয়তান ভারতবর্ষে গিয়ে আর ফিরে এলেন না। কিছুদিন পরেই একটা ডাক জাহাজের যাত্রীদের তালিকায় শোল্টোর নাম আমাকে দেখালেন ক্যাপ্টেন মসটান। হঠাৎ নাকি কাকা মারা গেছেন, কাকার অনেক টাকা পেয়ে সামরিক চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছেন পাঁচ স্যাঙাতকে পথে বসাতে একটুও দ্বিধা না-করে। দিন কয়েক পরে আগ্রায় গিয়ে মর্সটান দেখলেন যা ভয় করেছিলেন, তাই হয়েছে–রত্নপেটিকা সত্যিই উধাও হয়েছে। যে-শর্তের বশে গুপ্তকথা ফাঁস করেছিলাম, তার কোনোটাই -রেখে স্কাউন্ট্রেলটা একাই আত্মসাৎ করেছে বাক্স-বোঝাই রত্ন। সেদিন থেকে আমার জীবনধারণের লক্ষ্য দাঁড়িয়েছে একটাই প্রতিহিংসা। সারাদিন ভাবতাম কীভাবে নেওয়া যায় প্রতিহিংসা–সারারাত বিরাম দিতাম না সেই চিন্তায়। শয়নে স্বপনে জাগরণে ছায়ার মতো প্রতিহিংসা কামনা তাড়া করত আমাকে কুরে কুরে খেত মগজের ভেতরটা প্রতিহিংসা ছাড়া আর কোনো চিন্তা ঠাই পেত না মাথায়।

আইনকানুনের তোয়াক্কা রাখিনি–ফাঁসিকাঠের সম্ভাবনাকে আমল দিইনি। কপালে যা থাকুক, প্রতিহিংসা আমাকে নিতেই হবে। এমনকী আগ্রার রত্নও নগণ্য হয়ে গিয়েছিল আমার তখনকার উদয়াস্ত শোন্টো-নিধন চিন্তার ফলে।

এ-জীবনে আমি অনেক কিছুই করেছি। যা করব বলে মনে করেছি তাই করেছি। করতে পারিনি এমন দৃষ্টান্ত একটাও নেই। কিন্তু সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে অনেকগুলো দীর্ঘ বছর। বলেছি শুনেছেন নিশ্চয়, ওষুধপত্র ডাক্তারির কিছু কিছু শিখেছিলাম কম্পাউন্ডারি করতে করতে। একদিন কয়েকজন কয়েদি জঙ্গলের মধ্যে একজন লোককে বয়ে নিয়ে এল ডাক্তারখানায়। ডক্টর সোমারটনের সেদিন জ্বর হয়েছিল। লোকটাকে আমিই দেখলাম। আন্দামানের আদিবাসী। অসুখে ভুগে ভুগে মৃত্যু সামনে দেখে নির্জন জঙ্গলে গিয়েছিল মরবার জন্যে। লোকটা সাপের বাচ্চার মতোই বিষধর জেনেও চিকিৎসা করলাম–দু-মাস পরে দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াতে লাগল। সেই থেকে আমার ন্যাওটা হয়ে গেল সে। জঙ্গলে যেতে হত না। দিনরাত আমার কুঁড়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করত। ওর ভাষাও কিছু কিছু শিখে নিলাম তাতে ও আমার আরও বেশি ন্যাওটা হয়ে পড়ল।

লোকটার নাম টোঙ্গা! খুব ভালো নৌকা চালাতে পারত। নিজের একটা বড়ো ছিপ নৌকোও ছিল। আমার জন্য করতে পারে না হেন কাজ ছিল না টোঙ্গার কাছে এত ন্যাওটা ছিল আমার। মুক্তির পথ খুঁজে পেলাম ওর মধ্যে। শলাপরামর্শ করলাম। পুরোনো একটা ঘাটে লোকজন কেউ যায় না, পাহারাদারও নেই। কোনো এক গভীর রাতে ছিপ নৌকো নিয়ে সেখানে আসবে টোঙ্গা। বলে দিলাম অনেকগুলো লাউয়ের খোল ভরতি করে যেন জল আনে, সেইসঙ্গে মিষ্টি আলু, নারকেল আর চুপড়ি আলু।

টোঙ্গা লোকটা যেমন অনুগত, তেমনি খাঁটি। ও-রকম বিশ্বাসী অনুচর দুনিয়ায় কেউ কখনো পেয়েছে কিনা সন্দেহ। নৌকো নিয়ে বিশেষ সেই রাতটিতে ভাঙা ঘাটে হাজির হল সে। কপাল কী দেখুন। ঠিক সেইদিনই কয়েদিদের একজন গার্ড হাজির সেখানে। অতি যাচ্ছেতাই লোক, শয়তান বললেই চলে। জাতে পাঠান। সুযোগ পেলেই আমাকে অপমান করত, গালাগালি দিত, মেরে গায়ে কালসিটে ফেলে দিত। সব হজম করে গেছি–প্রতিহিংসার জন্য ভেতরটা জ্বলে পুড়ে গেছে, কিন্তু কিছু করতে পারিনি। সুযোগ পেলাম সেই রাতে। স্বয়ং ভগবানই যেন দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রতিহিংসার সুযোগ বাড়িয়ে ধরলেন আমার সামনে। আমার দিকে পেছন ফিরে ক্যাঁধে বন্দুক নিয়ে পাড়ে দাঁড়িয়েছিল সে। এদিক-ওদিক তাকালাম ঠুকে ঘিলু বার করে দেওয়ার মতো পাথরের সন্ধানে পেলাম না।

তারপরেই একটা অদ্ভুত চিন্তা এল মাথায়। অন্ধকারে বসে পড়ে বেল্ট খুলে হাতে নিলাম কাঠের পা-খানা। তিন লাফে এসে দাঁড়ালাম পেছনে। বোঁ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বন্দুক তুলল সে। ততক্ষণে নেমে এসেছে আমার কেঠো পা–এক মারেই কপাল-টপাল ভেঙে ঢুকে গেল ঘিলুর মধ্যে। জঙ্গলে সেখানে যদি কখনো যান, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘিলুর চিহ্ন এখনও দেখতে পারেন। লাঠি হাঁকিয়ে তাল সামলাতে না-পেরে আমিও হুড়মুড়িয়ে পড়লাম পাঠানের গায়ে এবং দু-জনেই ঠিকরে পড়লাম মাটিতে। উঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম সে আর নড়ছে না। উঠে পড়লাম নৌকায়। একঘণ্টা লাগল মাঝ-সমুদ্রেতে পৌঁছোতে। টোঙ্গা ওর যাবতীয় পার্থিব সম্পদ সঙ্গে এনেছিল–দেবদেবী আর অস্ত্রশস্ত্র কিছুই বাদ দেয়নি। জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল একটা লম্বা বাঁশের বর্শা আর কিছু নারকেল ছোবড়ার মাদুর। এই দুটো জিনিস দিয়ে পাল বানিয়ে তুলে দিলাম নৌকার ওপর। স্রেফ ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে দশদিন অথই জলে ভেসে রইলাম। তারপর একটা সওদাগরি জাহাজ তুলে নিল আমাদের! মালয় তীর্থযাত্রী নিয়ে জাহাজ যাচ্ছিল সিঙ্গাপুর থেকে সৌদি আরবের জেয়২৮–মক্কায় ঢোকবার মূল প্রবেশপথের দিকে। সেই ভিড়-ভাট্টার মধ্যে দিব্যি মিশে গেলাম আমি আর টোঙ্গা! চমৎকার একটা গুণ ছিল ওদের। গায়ে পড়ে আলাপ করত না, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পেটের কথা বার করবার চেষ্টা করত না।

আমার সেই একান্ত অন্তরঙ্গ পুঁচকে সাথিকে নিয়ে যেসব অ্যাডভেঞ্চারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল তার সব বলতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে, আপনাদের ধৈর্য ফুরোবে। ভেসে ভেসে বেড়াতে লাগলাম দুনিয়ায় নানান জায়গায় একটার পর একটা বাধা আসায় লন্ডন ঢোকা আর হয়ে উঠল না। লক্ষ্যচ্যুত অবশ্য হইনি–একদিনের জন্যেও প্রতিহিংসার চিন্তা আমাকে ছেড়ে যায়নি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতাম শোন্টোকে। তারপর এক সময়ে বছর তিন চারেক আগে ইংলন্ডে ফিরে এলাম। শোল্টোকে খুঁজে বের করতে বেগ পাইনি। হিরে মানিক বেচে দিয়েছে কিনা আগে সেই খোঁজ নিলাম! বন্ধুত্ব করলাম একজনের সঙ্গে। নিয়মিত খবর দিত সে। নামটা বলব না! জেলখানার ভেতরে আর কাউকে ল্যাজে বেঁধে আনতে চাই না। যাই হোক, খবর পেলাম হিরে মানিক এখনও কাছেই আছে বিক্রি করেনি। বহু চেষ্টা করলাম শয়তানটার কাছে যাওয়ার কিন্তু কোনোদিক দিয়েই পারলাম না। মহা ধড়িবাজ ছিল লোকটা তার ওপর পাহারায় রেখেছিল দু-দুটো প্রাইজফাইটার লড়াইবাজ মস্তানকে। দুই ছেলে আর খিদমতগারও পাহারা দিত দিন রাত।

যাই হোক, একদিন খবর পেলাম শোন্টো মরতে বসেছে। মরে গিয়ে আমার হাত ফসকে পালাবে ভেবে পাগল হয়ে তখুনি ছুটলাম বাগানে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম দু-পাশে দুই ছেলে নিয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। তিন জনের টক্কর একাই নিতাম ভেতরে ঢুকে তার আগেই আমার ওপর চোখ পড়তেই চোয়াল ঝুলে পড়ল শোন্টোর। বুঝলাম মারা গেল শয়তান? সেই রাতেই ঘরে ঢুকে কাগজপত্র লাট-ঘাট করলাম। রত্নগুলো লুকিয়েছে যেখানে, তার ঠিকানা যদি কোথাও রেখে থাকে, এই আশায় তন্নতন্ন করে খুঁজলাম সব কিছু। কিন্তু সে-রকম কোনো হদিশ পেলাম না। রাগে হতাশায় বুনো বর্বরের মতো খেপে গিয়েছিলাম তখন। চলে আসার সময় মনে হল শিখ বন্ধুদের সঙ্গে যদি দেখা হয়। তখন যদি বলি তাদের যে শোল্টো মরে যাওয়ার পরও আমাদের চারজনের ঘৃণার নিদর্শন তার বুকের ওপর রেখে এসেছি, তাহলে নিশ্চয় খুশি হবে ওরা। তাই নকশায় যেভাবে চারজনে সই করেছিলাম, সেই চারের সংকেত একটা কাগজে লিখে পিন দিয়ে এঁটে দিলাম ওর বুকে। বোকা বানিয়ে যাদের ঐশ্বর্য লুঠ করে এনেছে, তাদের তরফ থেকে কোনো চিহ্ন না-নিয়ে কবরে যাবে শোন্টো–এ কি হয়। একটা চিহ্ন অন্তত সঙ্গে যাক।

কালো নরখাদক হিসেবে টোঙ্গাকে দেখিয়ে দু-বেলার খাওয়া জোটাচ্ছিলাম আমি! কচমচ করে কাঁচা মাংস চিবিয়ে খেয়ে যুদ্ধ-নৃত্য নাচত টোঙ্গা–দিনের শেষে শুধু পেনিতেই ভরে উঠত আমার টুপি। পণ্ডিচেরি লজের সব খবরই কানে আসত। রত্ন নাকি এখনও পাওয়া যায়নি কিন্তু খোঁজ চলছে। কয়েক বছর গেল এইভাবে। তারপর এল সেই খবর। রত্ন পাওয়া গেছে। একদম ওপরতলায় মি. বার্থোলিমিউর রাসায়নিক গবেষণাগারে আছে রত্নপেটিকা। তখুনি চলে এলাম পণ্ডিচেরি লজে। অনেক দেখেও ভেবে পেলাম না কাঠের পা নিয়ে অত উঁচুতে উঠব কী করে। শুনি ছাদে একটা ঠেলা-দরজা আছে। মি. শোল্টো রাত্রে কখন খেতে যান, সে-খবরও পেয়েছিলাম। টোঙ্গাকে দিয়ে কাজ ফতে করবার ফন্দি আঁটলাম। ওর কোমরে এক বান্ডিল দড়ি জড়িয়ে দিলাম। দেওয়াল আর নল বেয়ে বেড়ালের মতো সর সর করে ছাদে উঠে গেল টোঙ্গা কিন্তু কপাল খারাপ আমার দেখা গেল বার্থোলোমিউ শোল্টো খেতে যাননি, ঘরে বসে আছেন। বসে বসেই মারা গেলেন টোঙ্গার বিষ-মাখানো তিরে। ঘরে ঢুকে দেখলাম পেখম তুলে ময়ূরের ফুর্তিতে নাচছে টোঙ্গা ওর ধারণা বাহাদুরির কাজ করে ফেলেছে। দেখেই রক্ত চড়ে গেল মাথায়। দড়ির আগা দিয়ে পিটিয়ে মেরেই ফেলতাম সেদিন–হাঁচড়-পাঁচড় করে সিঁড়ি বেয়ে পালিয়ে গেল বলে রক্ষে। মার খেয়ে আর রক্তখেকো পিশাচ জাতীয় গালাগাল শুনে সেদিন ও অবাকই হয়েছিল। দড়ি বেঁধে রত্নপেটিকা আগে নামিয়ে দিলাম নীচে। তারপর দড়ি বেয়ে হড়কে নেমে এলাম নিজে। আসবার আগে চারের সংকেত রেখে এলাম টেবিলের ওপর যাতে বোঝা যায়, রত্নে যাদের অধিকার সর্বাগ্রে, অনেক হাত ঘুরে রত্নপেটিকা এখন তাদেরই কাছে। নেমে যাওয়ার পর টোঙ্গা দড়ি টেনে তুলে নিয়ে জানলা বন্ধ করে যে-পথে উঠেছিল–সেই পথেই নেমে গেল নীচে।

আর কিছু বলার তো দেখছি না। একজন মাঝির কাছে শুনেছিলাম অরোরা লঞ্চকে টেক্কা মারার মতো স্পিড় নাকি এ-তল্লাটে কোনো লঞ্চেরই নেই। তাই ঠিক করলাম ওই লঞ্চেই চম্পট দিতে হবে। বুড়ো স্মিথকে অনেক টাকা দিয়ে রফা করলাম, জাহাজে তুলে দিয়ে আসতে হবে। ব্যাপারটা গোলমেলে আঁচ করে কৌতুহল দেখায়নি স্মিথ–গুপ্ত কথা জানতে চায়নি। যা বললাম তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি বলে জানবেন। সত্যি বললাম শুধু নিজে বাঁচবার জন্যে, সত্যি বলাটা বাঁচবার একমাত্র পথ বলে, আপনাদের চিত্তবিনোদনের জন্যে নয়–কেননা আপনারা আমার খুব একটা ভালো করেননি। আমি চাই দুনিয়া জানুক মেজর শেল্টো আমার সঙ্গে কী দুর্ব্যবহার করেছে। চারজনের প্রতি কী জঘন্য আচরণ করেছে ও তার জন্যে আমি দায়ী নয় মোটেই।

শার্লক হোমস বললে, কাহিনিটা সত্যিই অত্যন্ত অসাধারণ এ-রকম একটা কৌতুহলোদ্দীপক মামলার উপযুক্ত উপসংহার বটে। কাহিনির শেষের দিকে যা বললে, তার মধ্যে নতুন কিছু পেলাম না। সবই জানি একটা বিষয় ছাড়া : দড়িটা তুমিই সঙ্গে এনেছিলে। এইটুকুই কেবল জানতাম না। ভালো কথা, আমি ভেবেছিলাম টোঙ্গার কাছে বিষ-মাখানো তির আর নেই। তা সত্ত্বেও ছুটন্ত লঞ্চ থেকে একটা তির আমাদের টিপ করে ছুড়ল কেমন করে?

তিরের থলিটা হারিয়ে ফেললেও ব্রো-পাইপের মধ্যে একটা থেকে গিয়েছিল।

আ! তাও তো বটে! এটা তো মাথায় আসেনি আমার। বললে হোমস।

অমায়িকভাবে বললে কয়েদি, বলুন আর কিছু জানার নেই!

অ্যাথেলনি জোন্স বললে, হোমস, আপনার রসবোধের তারিফ করতে হয়; অপরাধের ব্যাপারেও আপনি সমঝদার ব্যক্তি, রসজ্ঞ পুরুষ। তবে কী জানেন, কর্তব্য বড়ো কঠিন। আপনার আর আপনার বন্ধুর কথা রাখতে গিয়ে সীমার বাইরে যেতে হয়েছে আমাকে। গল্পকার এই লোকটিকে তালাচাবি দিয়ে খাঁচায় না-পোরা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই। গাড়ি এখনও নীচে দাঁড়িয়ে। দু-জন ইনস্পেকটরও রয়েছে নীচের তলায়। সাহায্যের জন্য অনুগৃহীত রইলাম আপনাদের দুজনের কাছেই। বিচার আরম্ভ হলে কিন্তু আপনাদের দরকার হবে। গুডনাইট।

গুডনাইট আপনাদের দুজনকেই, বললে স্মল।

স্মল, আগে তুমি বেরোও তো, ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললে জোন্স। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে যা করেছ, আমার মাথায় সেইভাবে কেঠো পা হাঁকড়াবার সুযোগ তোমায় দিচ্ছি না।

দুই মূর্তি নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ধুমপান করলাম আমি আর হোমস। তারপর বললাম, নাটক তো শেষ হল। তোমার তদন্ত পদ্ধতি পর্যবেক্ষণের সুযোগও আমার ফুরোল–এই কেসই শেষ কেস। মিস মসটান আমাকে তার ভাবী স্বামী নির্বাচন করেছেন, আমি তাতে বর্তে গেছি।

ঠিক যা ভয় করেছিলাম। আমি কিন্তু ভায়া অভিনন্দন জানাতে পারছি না তোমাকে!

শুনে মনে বড়ো লাগল।

আহত কণ্ঠে বললাম, আমার পছন্দ তোমার মনোমতো নয় কেন জানতে পারি?

আরে, তা নয়। পছন্দ তোমার ঠিকই হয়েছে। মিস মর্সাটানের মতো মধুর স্বভাবের তরুণী খুব কমই দেখেছি আমি–যে-কাজ আমরা করেছি উনিও তাতে সাহায্য করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। এ-ব্যাপারে তিনি একটা জ্বলন্ত প্রতিভা বাবার অন্যান্য কাগজপত্রের মধ্যে থেকে আগ্রা নকশা উদ্ধার করে কীভাবে এতদিন রেখেছিলেন ভাব দিকিনি। তবে কী জান ভালোবাসা জিনিসটা আবেগপ্রসূত তা কঠিন, শীতল, নিকষ যুক্তির অন্তরায়। আমি কিন্তু শেষেরটাকেই মাথায় রাখি, প্রথমটাকেই পায়ে। বিয়ে তাই এ-জীবনে করব না–বিচারবুদ্ধি পাছে আচ্ছন্ন হয়ে যায় এই ভয়েই করব না।

হেসে ফেললাম আমি। বললাম, আশা করি আমার বিচারবুদ্ধি শেষপর্যন্ত অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। কিন্তু ভায়া তোমাকে যে ভীষণ কাহিল লাগছে!

তা তো লাগবেই, ভয়ংকর পরিশ্রমের জের শুরু হয়ে গেছে যে। সামনের সাতটা দিন স্রেফ ছেড়া ন্যাকড়ার মতো নেতিয়ে থাকব।

সত্যিই তুমি একটা আশ্চর্য মানুষ! অন্যের ক্ষেত্রে যা শুধু কুঁড়েমি তোমার ক্ষেত্রে তার পালা বদল ঘটে বিপুল প্রাণশক্তি আর প্রচণ্ড উদ্দীপনার মধ্যে।

ঠিক বলেছ। আমি প্রথম শ্রেণির নিষ্কর্মা হতে পারি, আবার দারুণ কর্মঠ প্রাণবন্ত পুরুষও হয়ে উঠতে পারি। দুটিই পাবে এই আমার মধ্যে। গ্যেটের লাইন ক-টা তাই প্রায় মনে পড়ে :

Schade dass die Natur nur einen Mensch aus dir schuf, Denn Zum Wurdigen Mann War and Zum Schelmen der Stoff.

ও হ্যাঁ, নরউড রহস্যে আমার একটা অনুমান শেষ পর্যন্ত সত্যি হল দেখছি। সত্যিই বাড়ির মধ্যে একজন স্যাঙাত পুষে রাখা হয়েছিল–নাম তার লাল রাও খাসা চাকর। জোন্স তাহলে অন্তত একজনকেও নিজে থেকে জালে টানতে পেরেছে এবং এ-ব্যাপারে কৃতিত্বের বখরা কেউ পাবে না।

আমি বললাম, ভাগবাটোয়ারা কিন্তু মোটেই ন্যায্য হল না। আগাগোড়া তুমি খেটে মরলে। কিন্তু আমি পেলাম একজন বউ, জোন্স পেল কৃতিত্ব, তোমার জন্য রইল কী?

লম্বা, সাদা হাতখানা তাদের দিকে বাড়িয়ে শার্লক হোমস বললে, কোকেনের এই বোতলটা।