১১. রবার্ট ল্যাংডন

১০১.

রবার্ট ল্যাংডন চাপ্টার হাউজের গম্বুজের নিচে টিবিংয়ের অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

রবার্ট আপনি কি আমার সাথে আছেন, নাকি আমার বিরুদ্ধে? রয়্যাল হিস্টোরিয়ানের কথাটা ল্যাংডনের মনে নিরব প্রতিধ্বনি হতে লাগলো।

ল্যাংডন জানতো, এ কথার কোন জবাব নেই। হ্যাঁ বলা মানে, সোফিকে বিকিয়ে দেয়া। আর না-র অর্থ, তাদের দুজনকেই হত্যা করা ছাড়া টিবিংয়ের আর কোন পথ নেই।

ল্যাংডন তার জীবনে কখনও অস্ত্রের সাথে লড়াই করা শেখেনি। কিভাবে এরকম পরিস্থিতিতে আচরণ করবে, তাও জানে না। কিন্তু, শ্রেণী কক্ষে সে শিখেছিলো, কীভাবে হেয়ালী করে উত্তর দিতে হয়। যখন কোন প্রশ্নের সত্যিকারের উত্তর থাকে না, তখন একটা সৎ প্রতিক্রিয়াই দেখানোর থাকে।

হ্যাঁ এবং না-র মাঝখানের ধূসর এলাকাটি।

নিরবতা।

তার হাতে ধরা ক্রিপ্টেক্সটার দিকে তাকিয়ে, ল্যাংডন ঠিক করলো, সোজা ওখান থেকে চলে যাবে।

সে তার চোখ না সরিয়েই, পিছু হটতে লাগলো। সেখান থেকে বেড়িয়ে, একটা বিশাল ভোলা জায়গায় এসে পড়লো। নিরপেক্ষ-জায়গা। সে আশা করলো, ক্রিপ্টেক্সটা নিয়ে এভাবে আসাতে টিবিংকে একটা সংকেত দেয়া গেছে, সহযোগীতা করার একটা শর্ত আছে। তার নিরব সংকেতটা বলে দিচ্ছে, সে সোফিকে পরিত্যাগ করবে না।

এই ফাঁকে চিন্তা করার সময় পাওয়া যাবে।

কিন্তু ল্যাংডন আশংকা করলো, চিন্তা করার কাজটা আসলে টিবিংয়েরই প্রত্যাশা। এজন্যেই সে ক্রিপ্টেক্সটা আমাকে দিয়ে দিয়েছে। যাতে আমি সিদ্ধান্তটার ভার অনুভব করতে পারি। বৃটিশ রয়্যাল হিস্টোরিয়ান জানেন, ল্যাংডন তার একাডেমিক কৌতূহলে ক্রিপ্টেক্সটা খুলতে চাইবে। আর সে এও জানে, ক্রিপ্টেক্সটা না খোলার অর্থ হলো, ইতিহাসটা হারিয়ে যাওয়া।

ঘরের ভেতরে অস্ত্রের মুখে থাকা সোফিকে মুক্ত করার একটাই পথ, ক্রিপ্টেক্সটার পাসওয়ার্ড বের করা, যাতে সেটা দিয়ে টিবিংয়ের সাথে দর কষাকষি করা যায়। আমি যদি মানচিত্রটা মুক্ত করতে পারি, টিবিং তাহলে দরকষাকষি করবে। এই কঠিন কাজটা করার জন্যই ল্যাংডন দূরের জানালার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। নিউটনের সমাধির অসংখ্য জ্যোর্তিবিদ্যা সংক্রান্ত ছবিগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করলো সে।

যে গোলক তুমি খোঁজো, সেটা তাঁর সমাধিতেই থাকার কথা।
এটা বিবৃত করে গোলাপী শরীর আর বীজপ্রসূ গর্ভের আখ্যান।

ল্যাংডন টাওয়ারিং জানালার কাছে গেলো, সেখানকার স্টেইড গ্লাসের মোজাইকে অনুপ্রেরণামূলক কোন কিছু আছে কিনা দেখতে। সেখানে কিছুই নেই।

নিজেকে সনিয়ের চিন্তা-ভাবনায় স্থাপন করো, সে নিজেকে বললো। এবার কলেজ গার্ডেনের দিকে তাকালো। নিউটনের সমাধিতে গোলকটার ব্যাপারে তিনি কি ভাবতেন, যেটা সেখানে থাকার কথা ছিলো? তারা, ধূমকেতু, আর গ্রহ-নক্ষত্রের চিত্রসমূহ বৃষ্টি পড়ার মতো টাপুর-টুপুর করছে। কিন্তু ল্যাংডন সেগুলো এড়িয়ে গেলো। সনিয়ে তো আর বিজ্ঞানের লোক ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানবিকতা, শিল্পকলা আর ইতিহাসের একজন মানুষ। পবিত্র নারী…চ্যালিস…গোলাপ…নিষিদ্ধ মারি মাগদালিন… দেবীদের বিলুপ্তি…হলি গ্রেইল।

কিংবদন্তী সবসময়ই গ্রেইলকে ছলনাময়ী রক্ষিতা হিসেবে চিত্রিত করেছে, অন্ধকারে নাচছে, দৃষ্টির আড়ালে, তোমার কানে কানে কথা বলছে, তোমার দিকে এক পা এগিয়েই উধাও হয়ে যাচ্ছে। কুয়াশায়।

কলেজ গার্ডেনের বন্য গাছ পালাগুলোর দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন টের পেলো হাস্যকর উপস্থিতিটা। চিহ্নগুলো সবখানেই আছে। কুয়াশার ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসা দৃশ্যের মতো, বৃটেনের সবচাইতে পুরনো আপেল গাছের ডালপালাগুলো পাঁচ পাপড়ির পাতায় ফুটছে। সবগুলোই ভেনাসের মতো জ্বলজ্বল করছে। দেবীটা এখন বাগানে। সে বৃষ্টিতে নাচছে, কালের সঙ্গীত গাইছে।

 

ঘর থেকে, স্যার লেই টিবিং খুব আত্মবিশ্বাস নিয়েই দেখতে লাগলেন, ল্যাংডন জানালার দিকে তাকাচ্ছে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো। ঠিক যেমনটি আমি আশা করেছিলাম, টিবিং ভাবলেন। সে আসবেই।

কিছুক্ষণ আগেও টিবিং আশংকা করেছিলেন, ল্যাংডনের কাছে হয়তো গ্রেইল-এর চাবিটা রয়েছে। ল্যাংডন যে রাতে সনিয়ের সাথে সাক্ষাৎ করবে, সেরাতেই টিবিং পরিকল্পনা করেছিলেন, সেটা কোন কাকতালীয় ঘটনা ছিলো না। কিউরেটরের কথা আড়ি পেতে শুনে, টিবিং নিশ্চিত ছিলেন যে, ল্যাংডনের সাথে দেখা করবার জন্য সনিয়ের ব্যগ্রতার একটা অর্থই রয়েছে।

ল্যাংডনের রহস্যময় পাণ্ডুলিপিটাতে প্রায়োরিদের নাড়ির খবর স্পর্শ করা হয়েছে। ল্যাংডন সত্যটা ধরতে পেরেছে। আর সনিয়ে সেটা প্রকাশ হবার জন্যে ভীত ছিলেন। টিবিং একদম নিশ্চিত ছিলেন, গ্র্যান্ড মাস্টার ল্যাংডনকে চুপ করার জন্য ডেকে আনতে চেয়েছিলেন।

সত্যটা অনেক দিন ধরেই বোবা হয়ে আছে, আর নয়!

টিবিং জানতেন, তাঁকে খুব দ্রুতই কাজ করতে হবে। সাইলাসের আক্রমণে দুটো লক্ষ্য পূরণ হলো। এতে করে সনিয়ে ল্যাংডনকে নিরব থাকতে বলার অনুরোধটা আটকানো গেলো এবং আরো নিশ্চয়তা পাওয়া গেলো যে, এক সময় কি-স্টোনটা টিবিংয়ের হাতেই আসবে, সেই সাথে ল্যাংডনকেও কোডটা উদ্ধারের কাজে লাগানো যাবে।

সনিয়ে আর সাইলাসের দূর্ভাগ্যজনক সাক্ষাতের ব্যবস্থা করাটা খুব সহজ কাজ ছিলো। আমার কাছে সনিয়ের গভীর ভীতিটার খবর ছিলো। গতকাল দুপুরে, সাইলাস কিউরেটরকে ফোন করে নিজেকে একজন ক্ষ্যাপা পাদ্রী হিসেবে তুলে ধরে। মঁসিয়ে সনিয়ে, আমাকে ক্ষমা করবেন আমাকে এক্ষুণি আপনার সাথে কথা বলতে হবে। আমি কখনও কনফেশনের কথা চাউর করিনি। কিন্তু এবার, আমাকে বোধহয় সেটা করতেই হবে। আমি এক লোকের কনফেশন নিয়েছি, যে, দাবি করেছে, সে আপনার পরিবারকে খুন করেছে।

সনিয়ের প্রতিক্রিয়াটা ছিলো

খুবই ঘাবড়ে যাওয়ার মতো। আমার পরিবার সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। পুলিশের চূড়ান্ত রিপোর্টেও তা বলা হয়েছে।

হ্যাঁ, একটা গাড়ি দুর্ঘটনা, সাইলাস বলেছিলো। যে লোকটার সাথে আমি কথা বলেছি, সে বলেছে, সে তাদের গাড়িটাকে জোর করে রাস্তা থেকে ছিটকে ফেলে দিয়েছিলো, একটা নদীতে।

সনিয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।

মঁসিয়ে সনিয়ে, লোকটা যদি আমার কাছে এমন কিছু না বলতে যাতে আপনার জীবনটাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়, তবে হয়তো আমি আপনার কাছে সরাসরি ফোনই করতাম না। সে একটু থেমেছিলো, সেই লোকটা আপনার নাতনী সোফির কথাও বলেছে।

সোফির নামটা উল্লেখ করাটা ছিলো চাতুর্যপূর্ণ। কিউরেটর এবার নড়েচড়ে বসলেন। তিনি সাইলাসকে অতিদ্রুত তাঁর সাথে দেখা করতে বললেন, তার সবচাইতে নিরাপদ জায়গায় লুভর অফিসে। তারপর তিনি সোফিকে বিপদটার কথা জানিয়ে ফোন করেন। রর্বাট ল্যাংডনের সাথে সাক্ষাৎকারটি সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল হয়ে যায়।

এখন, ল্যাংডনের কাছ থেকে সোফিকে আলাদা করতে পেরে টিবিং আঁচ করলেন, তিনি দুজনকে বেশ সফলতার সঙ্গেই বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছেন। ল্যাংডন পাস ওয়ার্ডটা খুঁজে বের করছে। সে বুঝতে পেরেছে, গ্রেইলটা খুঁজে পাওয়া আর সোফিকে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করার গুরুত্বটা।

সে ওটা আপনার জন্য খুলবে না, সোফি শীতল কণ্ঠে বললো। যদি সে পাস ওয়ার্ডটা খুঁজে পায়, তবুও না।

কিন্তু ল্যাংডন ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো, টিবিং গ্রেইলের জন্য সবকিছুই করতে পারে। যে কারোর চেয়ে গ্রেইলটাই তার কাছে অনেক বড়।

ঠিক এই সময়েই, ল্যাংডন জানালার কাছে চলে এলো। সমাধিটা… হঠাৎ করেই সে বললো। তার চোখে একটা আশার আলো যেনো জ্বল জ্বল করছে। আমি জানি নিউটনের সমাধির কোথায় সেটা খুঁজতে হবে। হ্যাঁ, আমার মনে হয়, আমি পাস ওয়ার্ডটা খুঁজে পেয়েছি!

টিবিংয়ের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলো। কোথায়, রবার্ট? আমাকে বলুন!

সোফি ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে বললো, রবার্ট, না! তুমি তাঁকে সাহায্য করবে, ঠিক আছে?

ল্যাংডন দৃঢ় পদক্ষেপে ক্রিপ্টেক্সটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসলো।না, সে বললো, টিবিংয়ের দিকে তাকাতেই তার চোখ দুটো শক্ত হয়ে গেলো। তোমাকে চলে যেতে দেবার আগে তো নয়ই।

টিবিংয়ের আশাটা কালো মেঘে ঢেকে গেলো। আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ, রবার্ট। আমার সাথে খেলা খেলবেন না!

কোনো খেলা নয়, ল্যাংডন বললো। তাকে যেতে দিন। তারপরে, আমি আপনাকে নিউটনের সমাধিতে নিয়ে যাবো। আমরা ক্রিপ্টেক্সটা এক সঙ্গেই খুলবো।

আমি কোথাও যাচ্ছি না। সোফি জোর দিয়ে বললো। তার চোখ রাগে কুচকে আছে। ক্রিপ্টেক্সটা আমার দাদু আমাকে দিয়েছেন, আপনাদেরকে নয়।

ল্যাংডন ঘুরে দাঁড়ালো, ভীত সন্ত্রস্ত দেখালো তাকে। সোফি, প্লিজ! তুমি বিপদে আছে। আমি তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি!

কিভাবে? যে সিক্রেটটা রক্ষা করার জন্য আমার দাদু খুন হয়েছেন, সেটা বিকিয়ে দেবার মাধ্যমে? তিনি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলেন, রবার্ট। আমিও তোমাকে বিশ্বাস করেছি!

ল্যাংডনের নীল চোখে আতংক দেখা গেলো। টিবিং মিটি মিটি হাসছেন, তাদের দুজনের এই অবস্থা দেখে।

সোফি, ল্যাংডন আবেদন জানালো। প্লিজ…তুমি চলে যাও।

সে মাথা ঝাঁকালো। যতক্ষণ না, তুমি আমাকে ক্রিপ্টেক্সটা না দাও, অথবা মাটিতে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলছে।

কি? ল্যাংডন আতকে উঠলো।

রবার্ট, আমার দাদু সিক্রেটটা তাঁর নিজের খুনির হাতে দেখার চেয়ে বরং চিরতরের জন্য সেটা হারিয়ে যেতেই বেশি পছন্দ করতেন।

খুব ভালো। টিবিং অস্ত্রটা তা করলো।

না! ল্যাংডন চিৎকার করে বললো, ক্রিপ্টেক্সটা উপরে তুলে ধরে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিতে উদ্যত হলো। লেই, আপনি যদি এরকম কিছু ভেবেও থাকেন, আমি এটা ফেলে দেবো।

টিবিং হাসলেন। এই ধোকাটা রেমির বেলায় কাজ করেছিলো। আমার বেলায় সেটা হবে না। আমি আপনাকে ভালো করেই চিনি, রবার্ট।

তাই নাকি, লেই?

হ্যাঁ, তা-ই। আপনার চেহারাটাতে আরেকটু অভিব্যক্তির দরকার রয়েছে। এটা ভাবতে আমার কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছে, এখন আমি বুঝতে পারছি, আপনি মিথ্যা বলছেন। আপনার কোন ধারণাই নেই, নিউটনের সমাধির কোথায় উত্তরটা লুকিয়ে রয়েছে।

সত্যি, রবার্ট? আপনি জানেন, সমাধির কোথায় সেটা?

জানি।

ল্যাংডনের চোখ দেখে লেই ধরে ফেললেন যে, তাতে মিথ্যের আভাস দেখা যাচ্ছে। সোফিকে বাঁচাবার জন্য একটা মরিয়া প্রচেষ্টা। টিবিং খুবই গভীর একটা হতাশা অনুভব করলেন।

আমি নিঃসঙ্গ একজন নাইট, আমার চারপাশে যতোসব ফালতু লোক। আমাকে একাই, নিজে নিজে কি-স্টোনটা খুলতে হবে।

ল্যাংডন আর নেভু এখন টিবিং আর সেই সাথে গ্রেইলের কাছেও কাছে একটা হুমকি ছাড়া আর কিছুই না। সমাধানটা যতো পীড়াদায়কই হোক না কেন, টিবিং জানেন, সেটা তিনি করতে পারবেন। একমাত্র সমস্যা হলো, ল্যাংডনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কি-স্টোনটা মাটিতে নামিয়ে রাখা, যাতে টিবিং খুব নিরাপদেই এই গোলক ধাঁধাটা শেষ করতে পারে।

বিশ্বাসের নমুনা হিসেবে, অস্ত্রটা সোফির দিকে তাক করে টিবিং বললেন। কি-স্টোনটা নামিয়ে রাখুন, তারপরে আমরা কথা বলি।

ল্যাংডনও জানতো, তার মিথ্যাটা ব্যর্থ হয়েছে।

 

সে টিবিংয়ের মুখে অন্ধকার সমাধাটা দেখতে পেলো, সে জানতো, সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমি এটা নামিয়ে রাখলেই সে আমাদের দুজনকে হত্যা করবে। সোফির দিকে না তাকিয়েই, সে তার হৃদস্পন্দনটা শুনতে পেলো। সোফি নিরবে যেনো বলছে, আকুতি জানাচ্ছে। রবার্ট, এই লোকটা গ্রেইলের উপযুক্ত নয়। দয়া করে এটা ওর হাতে তুলে দিও না। যেকোন মূল্যেই হোক।

জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কলেজ গার্ডেনের দিকে তাকিয়েই ল্যাংডন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলো।

সোফিকে রক্ষা করো।

গ্রেইলকে রক্ষা করো।

ল্যাংডন মরিয়া হয়ে প্রায় চিৎকার করেই বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, কীভাবে!

এই বিভ্রান্তিকর মুহূর্তটি এমন একটি ভাবনা সামনে নিয়ে আসলো যা তারা কখনও ভাবেনি। সত্যটা তোমার চোখের সামনে, রবার্ট। সে জানতো না, কোথা থেকে বাতাটা আসছে। গ্রেইল তোমার সাথে ঠাট্টা করছে না, সে আর্তনাদ করে ডাকছে কোন সুযোগ্য আত্মাকে।

লেই টিবিংয়ের কাছ থেকে কয়েক গজ দূরে, হাটু গেঁড়ে বসে, ক্রিপ্টেক্সটা মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে ধরে রাখলো ল্যাংডন।

হ্যাঁ, রবার্ট, টিবিং ফিসূফিস্ করে বললেন, অস্ত্রটা তার দিকে তাক করে ধরলেন। এটা নিচে নামিয়ে রাখুন।

ল্যাংডনের চোখ উপরের দিকে গেলো, চাপ্টার হাউজের গম্বুজের নিচে। নিচু হয়ে ল্যাংডন টিবিংয়ের অক্সটার দিকে একবার তাকালো।

আমি দুঃখিত, লেই।

মুহূর্তের মধ্যেই ল্যাংডন লাফিয়ে উঠে হাত দুটো আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলো। ক্রিপ্টেটা ছিটকে শূন্যে লাফিয়ে উঠলো।

 

লেই টিবিং টৃগারটা চাপ দিতে চাননি, তবুও তার মেডুসা থেকে একটা গুলি বের হয়ে ল্যাংডনের পাশ দিয়ে চলে গেলো। ল্যাংডন শূন্যে লাফ দিয়ে সরে গেলে গুলিটা ল্যাংডনের পায়ের কাছে মাটিতে কোথাও গিয়ে বিধলো। টিবিংয়ের অর্ধেক মস্তিষ্ক অটার নিশানা ঠিক করে রেগেমেগে তাকে আবার গুলি করতে উদ্যত হলো, আর বাকি অর্ধেক মস্তিষ্ক, তার চেয়েও বেশি চাইলো, গম্বুজের নিচে, চাটার হাউজের ছাদের দিকে তাকাতে বাধ্য করলো তাকে।

কি-স্টোনটা!

সময়টা মনে হলো বরফের মতো জমে গেলো, অনেকটা ধীর গতিতে, স্বপ্নের দৃশ্যের মতো, টিবিংয়ের পুরো জগৎটা শূন্যে ভাসা কি-স্টোন হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত সেটার দিকে তাকিয়ে চোখটা মাটির দিকে নেমে এলো।

টিবিংয়ের সমস্ত স্বপ্ন আর আশা মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ছে। এটা মাটিতে আছড়ে পড়তে পারে না!

টিবিং মুহুর্তেই অস্ত্রটা ফেলে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন, ক্রাচ দুটো ফেলে, দুটো হাত শূন্যে বাড়িয়ে দিলেন। এগিয়ে দেয়া হাতের মধ্যে পড়ন্ত কি-স্টোনটা আঁটকে গেলো।

কি-স্টোনটা ধরার বিজয়ী মুহূর্তটাতেও টিবিং জানতেন, সামনের দিকে খুব দ্রুতই পড়ে যাবেন তিনি। পড়ে গেলে তার হাত দুটো প্রথমে মাটিতে আছাড় খাবে, তাতে করে ক্রিপ্টেক্সটা মাটিতে সজোড়ে আঘাত পাবে।

এটার ভেতরে খুবই দুর্বল কাঁচ রয়েছে। প্রায় কয়েক মুহূর্ত টিবিং শ্বাস নিতে পারলেন না। মাটিতে আছাড় খেলে ক্রিপ্টেক্সটার ভেতরের কাঁচের ভায়ালটা ভেঙে গিয়ে ভিনেগার তরলটি প্যাপিরাসকে মণ্ড বানিয়ে ফেলবে।

একটা বন্য আতংক পেয়ে বসলো তাকে। না! ছবিটার কথা ভেবেই টিবিং আতংকিত হয়ে উঠলেন। রবার্ট, আপনি বোকা! সিক্রেটটা হারিয়ে গেলো।

টিবিং বিভ্রান্তের মতো ভাবতে লাগলেন। গ্রেইলটা হারিয়ে গেলো। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। ল্যাংডনের এরকম আচরনে অবাক হয়ে টিবিং সিলিন্ডারটি আলাদা করার চেষ্টা করলেন। ইতিহাসটা চিরতরে হারিয়ে যাবার আগে, সেটা এক ঝলক দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। কিন্তু অবাক হলেন, কি-স্টোনটার এক মাখা খুলতে গিয়ে দেখলেন সিলিন্ডারটা আলাদা হয়ে গেছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে সিলিন্ডারের ভেতরে তাকিয়ে দেখলেন, ভেতরটা একেবারেই ফাঁকা, শুধুমাত্র ভেঁজা কাঁচটা ছাড়া। কোন লণ্ডভণ্ড হওয়া প্যাপিরাস নেই। টিবিং ল্যাংডনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালেন। সোফির পাশেই সে দাড়িয়ে আছে। অস্ত্রটা তাঁর দিকে তাক করে রেখেছে।

অবাক হয়ে কি-স্টোনটার দিকে তাকিয়ে টিবিং বুঝতে পারলেন। ডায়ালগুলো আর এলোমেলো নেই। সেগুলো পাঁচটা অক্ষরের একটা শব্দ হয়ে আছে : APPLE

 

যে গোলকটা হাওয়া তুলে নিয়েছিলো। ল্যাংডন শীতল কণ্ঠে বললো, ঈশ্বরের বিরাগ ভাঁজন হয়েছিলো সে। আদি পাপ। পবিত্র নারীর পতনের একটা প্রতীক।

টিবিং অনুভব করলেন, সত্যটা তার ওপর আচমকাই,অদ্ভুতভাবে পতিত হয়েছে। যে গোলকটা নিউটনের সমাধিতে থাকার কথা, সেটা আর কিছু নয়, স্বর্গ থেকে পতিত হওয়া লাল টক টকে একটা আপেল, যা নিউটনের মাথায় পড়েছিলো, তাঁকে তাঁর মহৎ কর্ম সম্পাদন করতে প্রেরণা দিয়েছিলো। তাঁর শ্রমের ফল। গোলাপী দেহ, বীজপ্রসূ গর্ভ।

রবার্ট, টিবিং বিস্ময় আর আতিশয্যে বললেন। আপনি এটা খুলেছেন। কোথায় …মানচিত্রটা?

চোখের পলক না ফেলেই, ল্যাংডন তার টুইড জ্যাকেটের বুক পকেট থেকে খুবই পাতলা, ভাঁজ করা প্যাপিরাস বের করে আনলো। টিবিং যেখানে মাটিতে বসে আছেন, সেখান থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরেই, ল্যাংডন প্যাপিরাসটার ভাঁজ খুলে সেটার দিকে ইঙ্গিত করলো। বেশ কিছুক্ষণ পর, একটা পরিচিত হাসি ল্যাংডনের মুখে ছড়িয়ে পড়লো।

সে জানে! টিবিংয়ের মন-প্রাণ সেই জ্ঞানটার জন্য আকুল মিনতি জানাচ্ছিলো। আমাকে বলুন! টিবিং বললেন। প্লিজ! ওহ ঈশ্বর, প্লিজ! খুব বেশি দেরি হয়নি!

খুব ভারি পায়ের শব্দ শোনা যেতেই ল্যাংডন প্যাপিরাসটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলো।

না! টিবিং চিৎকার করে বললেন, বৃথাই দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন।

দরজাটা ধুম করে খুলতেই বেজু ফশে একটা ষাড়ের মতো ঢুকে পড়লো। তার ক্ষিপ্ত চোখ দুটো চারপাশটা খুঁজছে, শিকারকে খুঁজছেলেই টিবিং মাটিতে পড়ে আছেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তার অস্ত্রটা হোলস্টারে ভরে রাখলো ফশে। সে সোফির দিকে তাকালো। এজেন্ট নেভু, আপনি আর মি. ল্যাংডন নিরাপদে আছেন দেখে আমি স্বস্তি অনুভব করছি।

ফশের পেছনে পেছনে বৃটিশ পুলিশ প্রবেশ করলো। তারা অপরাধীকে ধরে হাতকড়া পড়িয়ে দিলো।

সোফি ফশেকে দেখে খুবই বিস্মিত হলো। আমাদেরকে আপনি কিভাবে খুঁজে পেলেন?

ফশে টিবিংয়ের দিকে ইঙ্গিত করলো। সে তার আইডি কার্ডটা এ্যাবিতে ঢোকার সময় দেখিয়ে ভুল করেছিলো। গার্ডরা পুলিশের কাছ থেকে আগেই তাকে খোজার খবরটা জানতে পেরেছিলো।

ওটা ল্যাংডনের পকেটে আছে! টিবিং উন্মাদের মতো চিষ্কার করে বলতে লাগলেন। হলি গ্রেইলের মানচিত্রটা।

পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাবার সময়ও পেছনে তাকিয়ে টিবিং গর্জন করতে লাগলেন। রবার্ট! আমাকে বলুন, সেটা কোথায় লুকিয়ে রাখা আছে।

টিবিংয়ের দিকে চোখ রেখে ল্যাংডন বললো, শুধুমাত্র যোগ্য লোকেরাই গ্রেইলটা খুঁজে পায়, লেই। কথাটা আপনিই আমাকে বলেছিলেন।

 

০২.

সবার অলক্ষ্যে সাইলাস নিরবে প্রবেশ করতেই কেনসিংটন গার্ডেনে যেনো কুয়াশা থিতু হয়ে গেলো। ভেঁজা ঘাসের ওপরে হাটু গেঁড়ে বসে পড়ে সাইলাস টের পেলো পাঁজরে বিদ্ধ হওয়া বুলেটটার ক্ষত থেকে রক্ত ঝড়ে পড়ছে। তারপরও, সে সোজা সামনের দিকে চেয়ে আছে।

কুয়াশার কারণে জায়গাটা স্বর্গের মতো লাগছে।

রক্তাক্ত হাত দুটো তুলে প্রার্থনা করতে শুরু করতেই দেখতে পেলো বৃষ্টির পানি তার আঙুলগুলোকে পরশ বুলিয়ে সেগুলোকে আবার সাদা করে ফেলেছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো জোরে জোরে পড়তে শুরু করলে তার মনে হলো, তার দেহটা একটু একটু করে কুয়াশায় মিশে যাচ্ছে।

আমি ভূত।

একটা দকা বাতাস তাকে অতিক্রম করে গেলো, তাতে পৃথিবীর নতুন জীবনের সুবাস ছিলো। তার শরীরের প্রতিটি সজীব কোষের সাহায্যে সাইলাস প্রার্থনা করলো। ক্ষমার জন্যে প্রার্থনা। দয়া ভিক্ষার জন্যে প্রার্থনা। আর সবচাইতে বেশি চাইলো, তার রক্ষাকর্তা…বিশপ আরিজারোসার জন্য…যেনো ঈশ্বর তাঁকে তাঁর সময়ের আগে তুলে

নেন। তাঁর অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে।

কুয়াশাটা এখন তাকে যেনো পেঁচিয়ে ধরলো, সাইলাসের নিজেকে এতোটাই হাল্কা বলে মনে হলো যে, বাতাসের একটা ঝাঁপটা বুঝি তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। চোখ বন্ধ করে সে তার চুড়ান্ত প্রার্থনাটা সেরে নিলো।

কুয়াশার কোথাও থেকে আরিজারোসার কণ্ঠটা তাকে ফিসফিস করে বললেন।

আমাদের ঈশ্বর খুবই ভালো এবং ক্ষমাশীল।

অবশেষে, সাইলাসের যন্ত্রণাটা কমতে শুরু করলো, আর সে জানতো বিশপ ঠিকই বলেছেন।

 

১০৩.

শেষ বিকেলে লন্ডনে সূর্যের মুখ দেখা গেলে শহরটা শুকাতে শুরু করলো। জিজ্ঞাসাবাদ করার ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে বেজু ফশের খুব ক্লান্ত লাগছে। হাত নেড়ে একটা ট্যাক্সি থামালো। স্যার লেই টিবিং খুবই বাক চাতুর্যের সাথে নিজেকে নির্দোষ হিসেবে দাবি করছেন।

অবশ্যই। ফলে ভাবলো। উন্মাদ। টিবিং নিখুঁতভাবেই নিজেকে প্রদর্শন করেছেন একটা পরিকল্পনা আঁটতে, যাতে মনে হয়, তিনি নির্দোষ। ভ্যাটিকান আর ওপাস দাই, দুটোকেই ব্যবহার করেছেন তিনি। এই দুটো দলই আসলে নির্দোষ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাঁর নোংরা কাজগুলো না জেনেই, ধর্মোন্মাদ এক সন্ন্যাসী আর একজন বেপরোয়া বিশপ জড়িয়ে পড়েছিলো। তার চেয়েও বেশি চালাকি করে টিবিং তার ইলেকট্রনিক আঁড়িপাতার যন্ত্রগুলো এমন এক জায়গায় স্থাপন করেছিলেন, যেখানে পোলিওতে পঙ্গু হওয়া ব্যক্তির পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব নয়। আসলে তার হয়ে তাঁর কাজের লোক রেমিই নজরদারী করতে একমাত্র ব্যক্তি, যে টিবিংয়ের পরিচয়টা জানতো—এখন সেও এলার্জিক প্রতিক্রিয়ায় মারা গেছে।

শ্যাতু ভিলে থেকে কোলেতের পাঠানো খবরগুলো শুনে মনে হচ্ছিলো টিবিংয়ের ধূর্ততা এতোটাই চমৎকারভাবে চলেছে যে, ফশের নিজেরও এটা থেকে শেখার অনেক কিছুই আছে। খুব সফলভাবেই, প্যারিসের সবচাইতে শক্তিশালী অফিসে আঁড়িপাতার যন্ত্র বসানোর মধ্য দিয়ে বৃটিশ রয়্যাল হিস্টোরিয়ান গৃক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ট্রোজান ঘোড়া। তার কয়েকজন শিকারকে খুব চমৎকার শিল্পকর্ম উপহার দিয়েছিলেন তিনি। বাকিদেরকে, নিলামে কিছু জিনিস পাইয়ে দিয়ে, তাতে নির্দিষ্ট কোন জায়গায় যন্ত্রগুলো বসিয়ে দিয়েছেন। সনিয়ের বেলায়, তাঁকে শ্যাতু ভিলে একটা ডিনার-পর্টির দাওয়াত দিয়ে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, লুভরে দা ভিঞ্চির একটা উইং নির্মানের সম্ভাব্য তহবিলের ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে। সনিয়েকে সঙ্গে করে একটা রোবোটিক নাইট মূর্তি নিয়ে গিয়েছিলেন। কেনো, গুজব ছিলো, জিনিসটা তিনিই তৈরি করেছেন। সেটা ডিনারের সময় নিয়ে আসুন? টিবিং অনুরোধ করে বলেছিলেন। সনিয়ে তাই ওটা সঙ্গে করেই নিয়ে গিয়েছিলেন আর নাইট মূর্তিটা দীর্ঘ সময়ের জন্য রেমির কাছে ছিলো। সেই সময়েই, সনিয়ের অগোচরে মূর্তিটার ভেতরে আড়িপাতার যন্ত্রটা বসিয়ে দেয়া হয়েছিলো, রেমিই করেছিলো কাজটা।

ক্যাবের পেছনের সিটে বসে ফশে চোখ দুটো বন্ধ করলো। প্যারিসে ফিরে যাবার আগে, আরেকটা জায়গায় আমাকে যেতে হবে। সেন্ট মারি হাসপাতালের রিকভারি রুমটা খুবই রৌদ্রোজ্জ্বল।

আপনি আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন, নার্স বললো, তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। অলৌকিকের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

বিশপ আরিজারোসা একটা দুর্বল হাসি দিলেন। আমি সব সময়ই আশীর্বাদ পেয়েছি।

নার্স তার কাজ শেষ করে বিশপকে একা রেখে চলে গেলো। সূর্যের আলোটা তার চেহারায় উষ্ণতা এবং অভ্যর্থনার অনুভূতি সৃষ্টি করলো। গতরাতটি ছিলো তার জীবনের সবচাইতে অন্ধকারময় রাত।

উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি সাইলাসের কথা ভাবলেন, যার দেহটা পার্কে খুঁজে পাওয়া গেছে।

দয়া করে বাছা আমার, ক্ষমা করে দিও।

আরিঙ্গারোসা তার গৌরবোজ্জ্বল পরিকল্পনার চুড়ান্ত মুহূর্তটিতে সাইলাসের সাথে মিলিত হবার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। গতরাতে, আরিঙ্গারোসা বেজু ফশের কাছ থেকে একটা ফোন পেলেন, সে বিশপকে তার পরিচিত একজন নান, সেন্টসালপিচে খুন হবার ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। আরিঙ্গাবোসা বুঝতে পেরেছিলেন, সবকিছু মারাত্মক রকমেই গড়বর হয়ে গেছে। আরো চারজনের হত্যার খবরটা তাঁর ভীতিকে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় পরিণত করে তুললো। সাইলাস! তুমি করেছে কি!

টিচারের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে বিশপ বুঝে গিয়েছিলেন তাঁকে ঝেড়ে ফেলা হয়েছে। ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়েছে। এইসব বীভৎস ঘটনার ধারাবাহিকতা বন্ধ করা জন্য তিনি ফশের কাছে সব খুলে বলেছিলেন। আর তখন থেকেই, আরিঙ্গাবোসা আর ফশে সাইলাসকে দিয়ে টিচার আর কোন খুনখারাবি করার আগেই তাকে ধরার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়।

খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে, আরিঙ্গাররাসা চোখ বন্ধ করে টেলিভিশন সংবাদে প্রখ্যাত বৃটিশ নাইট, স্যার লেই টিবিংয়ের পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার খবরটা শুনতে লাগলেন। টিচার সবার কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেছেন। টিচার আগে ভাগেই জানতে পেরেছিলেন যে, ভ্যাটিকান ওপাস দাইকে পরিত্যাগ করছে। তিনি আরিজারোসাকে তার পরিকল্পনার একটি ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। হাজার হোক, আমার মতো সবকিছু উজাড় করে আর কে গ্রেইলের জন্য ঝুঁকি নেবে? যে গ্রেইলটা অধিকার করবে সে-ই অপরিমেয় ক্ষমতার অধিকারী হবে।

লেই টিবিং নিজের পরিচয়টা খুবই চাতুর্যের সাথে রক্ষা করেছেন ফরাসি বাচনভঙ্গীতে কথা বলে, দাবি করেছিলেন মূল্য পরিশোধের জন্য এমন কিছুর, যার দরকার তার ছিলো না টাকা। আরিঙ্গাবোসা এতোটাই উদগ্রীব ছিলেন যে, সন্দেহই করেননি। বিশ মিলিয়ন ইউরো ডলারের মূল্যটা গ্রেইল অর্জনের সাথে তুলনা করলে তেমন বিশাল কিছু না। আর ভ্যাটিকান থেকে ওপাস দাইর আলাদা হবার জন্য ফেরত দেয়া বিশাল অংকের টাকা, ব্যাপারটাকে একেবারেই সহজসাধ্য করে ফেললো। অন্ধ তাই দেখে, যা সে দেখতে চায়। টিবিংয়ের অনিবার্য অসম্মানটা ছিলো, অবশ্যই, পেমেন্টটা ভ্যাটিকানের বন্ডের মাধ্যমে দাবি করাটা, যাতে কোন কিছু গড়বর হলে, তদন্ত কাজটি রোম পর্যন্ত চলে যায়।

আমি খুবই খুশি যে, আপনি ভালো আছেন, মাই লর্ড।

আরিঙ্গারোসা দরজার সামনে থেকে বলা গুরু-গম্ভীর কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারলেন, কিন্তু মুখটা ছিলো অপ্রত্যাশিত ঝজু, শক্তিশালী গঠনের, চকে উল্টো করে আঁচড়ানো চুল আর চওড়া কাঁধ, যা তার কালো স্যুটটার সাথে আঁটোসাঁটো হয়ে আছে। ক্যাপ্টেন ফশে? আরিজারোসা জিজ্ঞেস করলেন।

ক্যাপ্টেন বিছানার কাছে এসে একটা অতিপরিচিত কালো রঙের বৃফকেস চেয়ারের ওপরে রাখলো। আমার বিশ্বাস এটা আপনার।

আরিঙ্গারোসা বৃফকেসটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেটা বন্ডেপূর্ণ, তারপর সঙ্গে সঙ্গেই মুখটা সরিয়ে নিলেন। খুব লজ্জা লাগলো তার। হ্যা…আপনাকে ধন্যবাদ। একটু থেমে আবার বললেন, ক্যাপ্টেন, আমি খুব গভীরভাবে ভেবে দেখেছি, আর আপনার কাছে আমি একটু সাহায্যও কামনা করি।

অবশ্যই।

প্যারিসের সেইসব পরিবারে, সাইলাস যাদেরকে… তিনি আবারো একটু থামলেন। নিজের আবেগটা নিয়ন্ত্রনে নিলেন। আমি জানি, তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দেবার জন্য কোন বড় অংকের টাকাই যথেষ্ট নয়, তারপরও, যদি পারেন তো, এই বৃফকেসের টাকাগুলো তাদের মধ্যে বন্টন করে দেবেন…সেই সব শোকসন্তপ্ত পরিবারের মধ্যে।

ফশের কালো চোখ দুটো তাকে অনেকক্ষণ ধরেই নিরীক্ষণ করছিলো। একটা সদগুণসম্পন্ন ইচ্ছা, মাইলর্ড। আমি আপনার ইচ্ছাটার বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি।

গভীর একটা নিরবতা নেমে এলো।

টেলিভিশনে, একটা বিশাল বাড়ির সামনে বসে একজন ফরাসি পুলিশ অফিসারের প্রেস কনফারেন্স করার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ফশে লোকটা কে সেটা দেখার জন্য পর্দার দিকে মনোযোগ দিলো।

লেফটেনান্ট কোলেত, বিবিসির একজন সংবাদদাতা বললো, মেয়েটার কণ্ঠ অভিযোগকারীর মতো। গত রাতে, আপনার ক্যাপ্টেন দুজন নিরপরাধ লোককে জন সম্মুখে হত্যার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। রবার্ট ল্যাংডন আর সোফি নেভু কি আপনার ডিপার্টমেন্টের কাছে এজন্যে দোষী ব্যক্তির বিচার চেয়েছেন? এতে করে কি ক্যাপ্টেন ফশে তার চাকরিটা হারাবেন?

লেফেটেনান্ট কোলেতের হাসিটা ক্লান্ত কিন্তু শীতল। আমার অভিজ্ঞতা বলে যে, ক্যাপ্টেন বেজু ফশে খুব একটা ভুল করেন না। এ ব্যাপারে আমি তার সাথে এখনও কোন কথা বলিনি। কিন্তু, তিনি কীভাবে কাজ করেন, সেটা জানি বলেই বলছি, আমার মনে হচ্ছে, জনসম্মুখে তিনি সোফি নেভু আর মি. ল্যাংডনকে অভিযুক্ত করে আসলে সত্যিকারের খুনিকে ধরার জন্য প্রলুব্ধ করেছেন।

সংবাদদাতারা একে অন্যের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। কোলেত বলতে লাগলো। মি. ল্যাংডন আর মিস্ নেভু, এই নাটকে ইচ্ছাকৃতভাবে জড়িয়েছেন কিনা, সেটা অবশ্য আমি জানি না। ক্যাপ্টেন ফশে তার পদ্ধতিগুলো কাউকে বলেন না। আমি যা বলতে পারি, তা হলো, ক্যাপ্টেন খুব সফলভাবেই আসল খুনিকে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। আর কি! ল্যাংডন আর মিস নেভু নিরাপদে আছেন।

ফশের ঠোঁটে পাতলা একটা হাসি। সে আরিঙ্গারোসার দিকে ঘুরলো। একজন ভালো মানুষ, এই কোলেটা।

কয়েক মুহূর্ত পার হয়ে গেলো। অবশেষে, ফলে তার মাথায় আঙুল চালিয়ে চুলগুলো পেছন দিকে টেনে নিয়ে আরিঙ্গারোসর দিকে তাকালো। মাই লর্ড, প্যারিসে ফিরে যাবার আগে, আমি একটা বিষয়ে আপনার সাথে একটু আলোচনা করতে চাই। আপনার লন্ডনের অনির্ধারিত ফ্লাইটটা। আপনি পাইলটকে গন্তব্য বদলানোর জন্য ঘুষ দিয়েছিলেন। এটা করে আপনি একটি আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছেন।

আরিজারেসা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমি খুবই মরিয়া ছিলাম।

হ্যাঁ। ঠিক যেমনটি পাইলট ছিলো; আমার লোকজন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

ফশে তার পকেট থেকে একটা সুন্দর পাথরের আঙটি বের করলো।

আরিঙ্গাবোসা আঙটিটা ফিরে পেয়ে, নিজের আঙুলে ওটা পরার সময় কেঁদে ফেললেন। আপনি খুবই দয়ালু। তিনি ফশের হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলেন। ধন্যবাদ আপনাকে।

ফশে উঠে জানালার কাছে গেলো, বাইরে শহরের দিকে তাকালো। ঘুরে জিজ্ঞাসা করলো, মাইলর্ড, আপনি এখান থেকে কোথায় যাবেন?

আমার আশংকা, আমার পথটা আপনার পথের মতোই অনিশ্চিত।

হ্যাঁ। ফশে থামলো। আমার মনে হচ্ছে, আমাকে একটু আগেভাগেই অবসরে যেতে হবে।

আরিঙ্গারোসা হাসলেন। ছোট্ট একটা বিশ্বাস বিস্ময়কর কিছু করতে পারে, ক্যাপ্টেন। অল্প একটু বিশ্বাস।

 

১০৪.

রোজলিন চ্যাপেল—প্রায়শই যাকে বলা হয় কোডের ক্যাথেড্রাল-স্কটল্যান্ডের এডিনবরাহর সাত মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। একটা প্রাচীন মিথারেই মন্দিরের পাশে ১৪৪৬ সালে নাইট টেম্পলাররা এটা নির্মাণ করে। চ্যাপেলটাতে খোঁদাই করা আছে ইহুদি, খৃস্টান, মিশরীর, ম্যাসোনিক আর প্যাগান প্রতীক। সেগুলো চিন্তার খোরাক যোগায়।

চ্যাপেলটার ভৌগলিক অবস্থান, নিখুঁতভাবেই উত্তর-দক্ষিণ মধ্যরেখা বরাবর যা গ্লাস্টনবারি দিয়ে চলে গেছে। এই দ্রাঘিমাংশ রোজলাইন হলো কিং আর্থারের আইল অব আভালনের একটি ঐতিহবাহী চিহ্ন, আর এটাকে বৃটেনের পবিত্র ভূমিরূপের কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রোজ লাইন সত্যিকারের বানানটা ছিলো রোজলিন—সেখান থেকেই এসেছে।

রোজলিনের অমসৃন চূড়াটা ছায়ায় ঢেকে যেতেই ল্যাংডন আর সোফি একটা ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে চ্যাপেলটার সামনে এসে পড়লো। লন্ডন থেকে এডিনবরাহর ছোট্ট ফ্লাইটটা বিশ্রামের হলেও এখানে কী ঘটাবে বা কী দেখতে পাবে, এই ভেবে ভেবে না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে চ্যাপেলটার দিকে তাকিয়ে ল্যাংডনের মনে হলো, যেনো এলিস খোরগোশের গর্তে পড়ে গেছে। এটা স্বপ্নই হবে। তারপরও, সনিয়ের চূড়ান্ত মেসেজটা যে এর চেয়ে বেশি নির্দিষ্ট হতে পারতো না, সেটা সে জানতো।

হলি গ্রেইল প্রাচীন রোজলিনের নিচে অপেক্ষা করে।

ল্যাংডন ভেবেছিলো সনিয়ের গ্রেইল মানচিত্রটা কোন ডায়াগ্রামই হবে—একটা ড্রইংয়ে X মার্ক দিয়ে একটা জায়গা চিহ্নিত করা–আবারো প্রায়োরিদের চূড়ান্ত সিক্রেটটা উন্মোচিত হলো, সেই শুরু থেকে যেমনটি হয়ে এসেছে, তেমন করেই। সহজ সরল পংক্তির মধ্য দিয়ে। চারটা লাইনে, কোন সন্দেহ ছাড়াই, এই জায়গাটাকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। সরাসরি রোজলিন নামটা উল্লেখ করলেও পংক্তিটাতে চ্যাপেলটার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যশৈলীর উল্লেখ রয়েছে।

যদিও সনিয়ের চূড়ান্ত প্রকাশটা খুবই স্পষ্ট, তারপরও ল্যাংডনের মনে হলো, একটু ভারসাম্যহীন, আলোকিত নয়। তার কাছে, জায়গা হিসেবে এটা একেবারেই নিশ্চিত ছিলো। শত শত বছর ধরে, এই পাথরের চ্যাপেলটি হলি গ্রেইলের উপস্থিতির কথা প্রতিধ্বনি করে আসছে। এই ফিসফাটা ইদানীংকালে চিৎকারে পরিণত হয়েছে, যখন ভূমি ভেদকারী রাডার দিয়ে দেখা গেলো যে, এর নিচে আরেকটা বিস্ময়কর স্থাপত্যের অস্তিত্ব রয়েছে—একটা বিশাল ভূ-গর্ভস্থ কক্ষ। এটা যে কেবল চ্যাপেলের নিচেই আছে তা নয়, বরং এর ভেতরে ঢোকা বা বের হবার কোন পথও নেই। আর্কিওলজিস্টরা পাথর ভেদ করে রহস্যময় কক্ষের ভেতরে অনুসন্ধানের জন্য আবেদন জানিয়েছিলো, কিন্তু রোজলিন ট্রাস্ট পবিত্র স্থানটিতে এরকম কোন কিছু করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। আর এজন্যেই, অনুমান আর সন্দেহের আগুনে ব্যাপারটা আরো বেশি ঘি ঢেলে দিয়েছে। রোজালিন ট্রাস্ট কি লুকাতে চেষ্টা করছে?

রহস্য অনুসন্ধানকারীদের জন্য রোজালিন এখন তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করে, এ জায়গার একটা চৌম্বক ক্ষেত্র তাদেরকে এখানে টেনে এনেছে, আর কেউ দাবি করে, তারা পাহাড়ি এলাকায় একটা প্রবেশ পথ খুঁজতে এসেছে, যেখান দিয়ে সেই লুকানো কক্ষটাতে ঢোকা যাবে। কিন্তু বেশিরভাগই স্বীকার করে তারা শুধু এটা দেখতে আসে। হলি গ্রেইলের আকর্ষণে।

যদিও এর আগে ল্যাংডন রোজলিনে আসেনি, তারপরও, সে যখনই শুনেছে, চ্যাপেলটাকে হলি গ্রেইলের বর্তমান আবাস হিসেবে বিচেনা করা হয়, মিটি মিটি হেসেছে সে। স্বীকার করতেই হবে, রোজলিনে এক সময় গ্রেইলটা ছিলো, সেটা অনেক আগের কথা…কিন্তু নিশ্চিতভাবেই, এখন না। আজ হোক, কাল হোক, কেউ না কেউ, গোপন কক্ষটাতে ঢোকার পথ বের করবেই।

সত্যিকারের গ্রেইল একাডেমিকরা একমত পোষণ করেন যে, রোজলিন একটা ফাঁদ—এমন একটি কানা গলি, যা প্রায়োরিরা খুব নিখুঁতভাবেই প্রয়োগ করেছে। আজ, প্রায়োরিদের কি-স্টোনটা একটা পংক্তির মধ্যে দিয়ে সরাসরি এই জায়গাটাকেই নির্দেশ করেছে। তাই ল্যাংডন আর এ নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করতে পারছে না। এটাকে ল্যাংডন। এক কথায় উড়িয়ে দিতেও পারছে না। সারাটা দিন তার মনে হতবুদ্ধিকর একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো :

সনিয়ে কেন এই জায়গাটাতে আমাদের নিয়ে যেতে চাইছেন?

একটাই যৌক্তিক কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে।

রোজলিন সম্পর্কে এমন কিছু একটা আছে, যা আমরা এখনও বুঝতে পারিনি।

রবার্ট? সোফি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার দিকে ফিরে বললো। তুমি কি আসছো না? তার হাতে রোজউড বাক্সটা, ক্যাপ্টেন ফশে তাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে সেটা। ভেতরে দুটো ক্রিপ্টেক্সকেই আবার আগের অবস্থায় রাখা হয়েছে।

প্যাপিরাসটা ভাঁজ করে রাখা হয়েছে ভেতরে-কেবল ভেঙে যাওয়া ভিনেগারের ভায়ালটা ছাড়া।

দীর্ঘ পাথরের পথটা দিয়ে চ্যাপেলের দিকে যাওয়ার সময়, ল্যাংডন আর সোফি চ্যাপেলের বিখ্যাত পশ্চিম দেয়ালটা অতিক্রম করে গেলো। অনিয়মিত দর্শনার্থীরা এই দেয়ালটাকে দেখে মনে করবে, এটা চ্যাপেলেরই অংশ যেটার কাজ পুরোপুরি শেষ করা হয়নি। সত্যটা হলো, ল্যাংডন মনে করতে পারলো, আরো বেশি কৌতূহলোদ্দীপক।

সলোমন মন্দিরের পশ্চিম দেয়াল।

নাইট টেম্পলাররা রোজলিন চ্যাপেলকে ঠিক জেরুজালেমের সলোমন মন্দিরের স্থাপত্য-নক্সার আদলে নির্মাণ করেছিলেন পশ্চিম দেয়ালটাসহ একটা সংকীর্ণ আয়তক্ষেত্রাকৃতির উপাসনার স্থান, আর ভূগর্ভস্থ কক্ষ, যেখানে সত্যিকারের নয় জন নাইট সর্ব প্রথম তাঁদের সম্পদগুলো খুড়ে বের করেছিলো।

রোজলিন চ্যাপেলের প্রবেশদ্বারটি ল্যাংডনের ধারণার চেয়েও বেশি সাদামাটা। ছোট্ট কাঠের দরজাটার রয়েছে দুটো কড়া আর একটা ও চিহ্ন।

রোজলিন

রোজলিন শব্দটার বানান এসেছে রোজ লাইন শব্দ থেকে, ল্যাংডন সেটা সোফিকে বুঝিয়ে বললো। আর রোজ লাইন এসেছে চ্যাপেলের ভেতরকার মধ্য রেখাটার জন্যে। আবার গ্রেইল একাডেমিকগণ এটা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে যে, লাইন অব রোজ থেকেই সেটা এসেছে–ম্যারি মাগদালিনের বংশধারা।

রোজেজ। দেবীর গর্ভ।

চ্যাপেলটা খুব শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ল্যাংডন দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। যদিও সে রোজলিনের ভেতরকার পাথরের কাজগুলো সম্পর্কে পড়েছে, কিন্তু নিজের চোখে সেটা দেখা দারুণ উত্তেজনার একটি ব্যাপার।

প্রতীক বিদ্যার স্বর্গ, ল্যাংডনের এক সহকর্মী এটাকে এ নামেই ডাকে।

চ্যাপেলের প্রতিটি পৃষ্ঠই কোন না কোন প্রতীকে খোঁদাই করা-খৃস্টিয় ক্রুশাকৃতি, ইহুদি তারা, ম্যাসোনিক সিল, টেম্পলার ক্রশ, করনুকোপিয়াস, পিরামিড, জ্যোর্তিবিদ্যার চিহ্ন, গাছপালা, শাক-সবজি, পেনটাকল আর গোলাপ। নাইট টেম্পলাররা ছিলেন পাথরের কাজে ওস্তাদ। সারা ইউরোপেই তারা চার্চ ছড়িয়ে দিয়েছিলো, কিন্তু রোজলিনই তাদের সবচাইতে সেরা কাজ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। পাথুরে কাজের ওস্তাদেরা কোন পাথরই খোঁদাই না করে রাখেনি। রোজলিন চ্যাপেল হলো সব বিশ্বাসের মন্দির …সব সংস্কৃতির…আর সবার ওপরে, সব প্রকৃতি এবং দেবীর।

মন্দিরটা কতিপয় দর্শনার্থী ছাড়া প্রায় ফাঁকাই বলা চলে। সেইসব দর্শনার্থী একজন তরুণের বলা কিছু কথা শুনছে। সে তাদেরকে একটা সারি করে একটা দেয়ালের দিকে নিয়ে যাচ্ছে—একটা অদৃশ্য পথ মন্দিরের ভেতরের ছয়টি প্রধান স্থাপত্যিক অবস্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট। দিনের পর দিন, দর্শনার্থীরা এইসব সোজা রেখাগুলো অতিক্রম করে যায়, আর তাদের পায়ের ছাপ জমিনের ওপরে অসংখ্য প্রতীকের ছাপ ফেলে দেয়।

✡︎

ডেভিডের তারা, ল্যাংডন ভাবলো। কোন কাকতালীয় ব্যাপার নেই এখানে। সলেমনের সিল হিসেবেও এটা পরিচিত, এই ছয়মাথা বিশিষ্ট তারাটি এক সময় ছিলো স্টার গেজিং যাজকদের গোপন প্রতীক, পরে, সেটা ইসরাইলী রাজা গ্রহণ করে নেয়—ডেভিড আর সলোমন।

বন্ধ হবার সময় হয়ে গেলেও ডোসেন্ট ল্যাংডন আর সোফিকে আসতে দেখে একটা সুন্দর হাসি দিলো। তাদেরকে ঘুরে ঘুরে দেখার জন্য একটা ইঙ্গিত করলো।

ল্যাংডন মাথা নেড়ে ধন্যবাদ জানালে তাকে, তারপর মন্দিরের ভেতরে ঢুকে পড়লো। সোফি, কি কারণে জানি, দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো, তার চোখে মুখে হতবুদ্ধিকর একটা ভাব। কী হয়েছে? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

সোফি চ্যাপেলটার চারপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। আমার মনে হয় …আমি এখানে এসেছিলাম।

ল্যাংডন খুব অবাক হলো। কিন্তু তুমি বলেছিলে, তুমি এমন কি রোজলিনের নামটিও শোনননি।

তা শুনিনি… সে চারপাশটা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো। তাকে দেখে অনিশ্চিত মনে হলো। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আমার দাদু আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। আমি ঠিক জানি না। আমার খুব চেনা-চেনা লাগছে। ভেতরটার চারপাশ ভালো করে দেখার পর সে আরো বেশি নিশ্চিত হয়ে মাথা দোলাতে লাগলো।

হ্যাঁ সে মন্দিরের সামনের দিকটাতে ইঙ্গিত করলো। ঐ দুটি স্তম্ভ…আমি দেখেছি।

ল্যাংডন মন্দিরের অন্য পাশে খুব সূক্ষ্মভাবে কারুকার্য খচিত, ভাস্কর্য সম্বলিত স্তম্ভ দুটোর দিকে তাকালো। স্তম্ভ দুটোর অবস্থান যেখানে সাধারণত বেদী থাকে সেই জায়গায়। ব্যাপারটা অদ্ভুত। বাম দিকের স্তম্ভটা অপেক্ষাকৃত কম কারুকাজ করা। সেই তুলনায় ডান দিকেরটা বেশি নক্সা করা, ফুলের কাজ আছে।

সোফি ইতিমধ্যেই সেগুলোর দিকে চলে গেছে। ল্যাংডনও দ্রুত তার পিছু পিছু চললো। স্তম্ভগুলোর কাছে পৌঁছাতেই সোফি আরো বেশি নিশ্চিত হয়ে মাথা নাড়তে লাগলো।

হ্যাঁ, আমি একদম নিশ্চিত, আমি এগুলো আগে দেখেছি!

তুমি যে এগুলো আগে দেখেছে সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই, ল্যাংডন বললো, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এখানেই দেখেছো।

সে ঘুরে দাঁড়ালো। কি বলতে চাচ্ছে?

এই দুটো স্তম্ভ ইতিহাসের সবচাইতে বেশি নকল স্থাপত্যিক অবকাঠামো। রেপ্লিকা বা প্রতিরূপ সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে রয়েছে।

রোজলিনের রেপ্লিকা? তাকে সন্দেহগ্রস্ত বলে মনে হলো।

না। স্তম্ভগুলো। তোমার কি মনে আছে, একটু আগে আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, রোজলিন সলোমনের মন্দিরের অনুকরণ? এই দুটো স্তম্ভ, সলোমনের মন্দিরের দুটো স্তম্ভের একেবারে অনুকরণে নির্মিত হয়েছিলো। ল্যাংডন বাম দিকের পিলারটা দেখিয়ে বললো, এটাকে বলে বোয়াজ-অথবা ম্যাসনের স্তম্ভ। অন্যটাকে বলে জখিন অথবা শিক্ষানবীস স্তম্ভ। সে একটু থামলো। আসলে, পৃথিবীর সব ম্যাসোনিক মন্দিরেরই এ রকম দুটো স্তম্ভ রয়েছে।

ল্যাংডন তাকে এরই মধ্যে টেম্পলারদের সাথে আধুনিক ম্যাসোনিক গুপ্ত সংঘের যে নিবিড় সম্পর্ক ছিলো, সেই কথাটা বলেছিলো। যাদের প্রাইমারি ডিগ্রিগুলো হলো শিক্ষানবীস ফ ম্যাসন, ফেলোক্রাফট ফু ম্যাসন এবং মাস্টার ম্যাসন। সোফির দাদু তাঁর কবিতার শেষ পংক্তিতে, সরাসরিই মাস্টার ম্যাসনদের উল্লেখ করেছেন, যারা রোজলিনের কারুকার্য করেছিলো। এটাতে রোজালিনের মাঝখানের ছাদের কথাও বলা আছে, যাতে গ্রহ-নক্ষত্র আর তারার ছবি খোঁদাই করা।

আমি কখনও ম্যাসোনিক মন্দিরে আসিনি, সোফি বললো, এখনও স্তম্ভগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একেবারে নিশ্চিত, এগুলো আমি এখানেই দেখেছি। সে ঘুরে চ্যাপেলের ভেতরে চলে গেলো, যেনো কিছু একটা খুঁজতে, যাতে তার স্মৃতিটা মিলে যায়।

বাকি দর্শনার্থীরা চলে গেলে তরুণ ডোসেন্ট তাদের দিকে হাসি মুখে এগিয়ে এলো। ছেলেটা দেখতে খুব সুন্দর, বিশের মতো বয়স হবে। সোনালী চুলের। আমি আজকের দিনের মতো চ্যাপেলটা বন্ধ করে দিচ্ছি। আমি কি আপনাদেরকে কিছু খুঁজে বের করে দিতে সাহায্য করতে পারি?

হলি গ্রেইলের ব্যাপারটা কি? ল্যাংডন বলতে চাইলো।

কোডটা, হুট করে সোফির মুখ দিয়ে কথাটা বের হয়ে গেলো। এখানে একটা কোড আছে!

ডোসেন্ট সোফির উচ্ছ্বাস দেখে খুশি হলো। হ্যাঁ, এখানে আছে, ম্যাম।

এটা সিলিংয়ে, সে বললো, ডান দিকে দেয়ালটার দিকে ঘুরে ওখানেরই কোথাও …

ছেলেটা হাসলো। মনে হচ্ছে, রোজলিনে এটা আপনার প্রথম আসা নয়।

কোডটা, ল্যাংডন ভাবলো। সে এটার কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিলো। রোজলিনের অসংখ্য রহস্যের মধ্যে খিলানযুক্ত পথটাও আছে। শত শত পাথরের ব্লক দিয়ে সেটা তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি ব্লকই প্রতীকে খোঁদাই করা। এলোমেলো মনে হয় সেগুলো। তাতে একটা দূর্বোধ্য সংকেত তৈরি হয়েছে। কিছু কিছু লোকের বিশ্বাস এই কোডটা চ্যাপেলের নিচের কক্ষটার ভেতরে প্রবেশ করার দিক নির্দেশনা। অন্যেরা বিশ্বাস করে, সত্যিকারের গ্রেইল কিংবদন্তীটা এতে বিবৃত হয়েছে। এগুলোকে আমলে না নিয়ে ক্রিপ্টোগ্রাফাররা শত শত বছর ধরে এটার মর্মোদ্ধার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আজকের দিনে, রোজলিন ট্রাস্ট, এইসব কোডের অর্থ কেউ বের করতে পারলে তাকে পুরস্কার দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু কোডটা রহস্যই রয়ে গেছে।

আমি আপনাদের দেখাতে পারলে খুব খুশি হতাম…

 

ডোসেন্টের কণ্ঠটা আচকা থেমে গেলো।

আমার প্রথম কোড, সোফি ভাবলো, একা একা কোডে পূর্ণ খিলানযুক্ত পথ দিয়ে এগোতে লাগলো সে। রোজউড বাক্সটা ল্যাংডনের হাতে দিয়ে, সে ক্ষণিকের জন্য হলি গ্রেইল, প্রায়োরি অব সাইওন এবং বিগত দিনের সব রহস্যের কথা ভুলে গেলো। সে যখন কোড যুক্ত ছাদের নিচে এসে পৌঁছালো এবং মাথার ওপরের প্রতীকগুলোর দিকে চেয়ে দেখলো, তার অতীত স্মৃতিগুলো প্লাবনের মতো ফিরে আসলো। তার মনে পড়ে গেলো এখানে প্রথম আসার স্মৃতিটার কথা, অদ্ভুতভাবেই সেই স্মৃতিটা অপ্রত্যাশিত এক দুঃখবোধের জন্ম দিলো।

সে ছিলো খুব ছোট্ট একটি মেয়ে…তার পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর এক বা দুবছর পরের ঘটনা। স্কুলের ছুটিতে তার দাদু তাকে স্কটল্যান্ডে নিয়ে এসেছিলো। প্যারিসে ফিরে যাবার আগে তারা রোজলিন চ্যাপেলে বেড়াতে এসেছিলো। সময়টা ছিলো সন্ধ্যার পরে, চ্যাপেলটা তখন বন্ধ ছিলো। তার পরেও, তারা ভেতরে ঢুকতে পেরেছিলো।

আমরা কি বাড়ি যেতে পারি গ্র্যঁ পেয়া? সোফি মিনতি জানিয়েছিলো। তার খুব ক্লান্ত লাগছিলো।

খুব জলদিই, ডিয়ার, খুব জলদি। তাঁর কণ্ঠটা ছিলো বিষাদগ্রস্ত। এখানে আমাকে একটা কাজ করতে হবে, খুবই জরুরি। তুমি গাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করলে কেমন হয়?

তুমি আরেকটা বড় মানুষদের কাজ করবে?

তিনি মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলেন। খুব দ্রুত করবো। কথা দিচ্ছি।

আমি কি খিলানযুক্ত কোডগুলো আবারো বের করতে পারি? খুব মজার ছিলো সেটা।

আমি জানি না। আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে। তুমি এখানে একা একা ভয় পাবে না?

অবশ্যই না! সে খুব জোর দিয়ে বলেছিলো। এখনও তো খুব বেশি সন্ধ্যা হয়নি!

তিনি হেসেছিলেন। তাহলে তো খুব ভালো। তিনি তাকে খিলানযুক্ত পথে নিয়ে গেলেন, একটু আগেই যা দেখিয়েছিলেন।

সোফি সোফি সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার ওপরের কোডগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতে শুরু করেছিলো। তুমি ফিরে আসার আগেই আমি এই কোডগুলোর মর্মোদ্ধার করে ফেলবো!

তাহলে তো এটা একটা খেলা হয়ে গেলো। তিনি হাটু গেঁড়ে বসে তার কপালে চুমু খেয়ে কাছের একটা দরজা দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমি বাইরেই আছি। দরজাটা খোলা থাকলো। আমাকে যদি তোমার দরকার হয়, শুধু ডাক দিও। তিনি এই বলে বের হয়ে গিয়েছিলেন।

সোফি ফ্লোরে শুয়ে কোডের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটোতে ঘুমঘুম ভাব চলে এলো। কয়েক মিনিট পর, প্রতীকগুলো ধোঁয়াটে হয়ে গেলো। তারপর, সেগুলো উধাও হয়ে গেলো।

সোফি যখন ঘুম থেকে উঠলো তখন ফ্লোরটা খুব ঠাণ্ডা লাগছিলো তার।

গ্র্যঁ পেয়া?

কোন উত্তর এলো না। সে উঠে দাঁড়িয়ে, শরীরটা ঝাড়া দিলো। দরজাটা তখনও খোলা ছিলো। সন্ধ্যাটা ঘন অন্ধকার হয়ে গেছে। সে বাইরে এসে দেখতে পেলো, তার দাদু চার্চের ঠিক পেছনে, পাথরের একটি বাড়ির বারান্দা ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন। একজনের সাথে কথা বলছিলেন তিনি, কিন্তু ভারি পর্দার দরজার ভেতর দিয়ে খুব ভালো মতো দেখা যাচ্ছিলো না দৃশ্যটা।

গ্র্যঁ পেয়া? সে ডাক দিলো।

তার দাদু তার দিকে ঘুরে হাত নেড়ে তাকে একটু অপেক্ষা করতে বললো, তারপর, তিনি খুব ধীরে, শেষ কিছু কথা বলে বের হয়ে বাতাসে একটা চুমু ভাসিয়ে দিলেন। সোফির কাছে আসলেন অশ্রু ভেঁজা চোখে।

দাদু, তুমি কাঁদছো কেন?

তাকে কোলে তুলে নিলেন। ওহ, সোফি, তোমাকে আর আমাকে এই বছর অনেক লোকজনকেই বিদায় বলতে হয়েছে। এটা খুবই কষ্টের।

সোফি তার পরিবারের দূর্ঘটনাটার কথা ভাবলো। তার মা-বাবা, দাদি আর ছোট ভাইকে গুডবাই জানাতে হয়েছিলো। তুমি কি আরেকজন লোককে গুডবাই জানালে?

একজন প্রিয় বন্ধুকে, যাকে আমি খুব ভালোবাসি, তিনি প্রচণ্ড আবেগী কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন। আর আমার মনে হচ্ছে, দীর্ঘদিন তাকে আর দেখতে পাবো না।

 

ডোসেন্টের সাথে দাঁড়িয়ে, ল্যাংডন চ্যাপেলের দেয়ালগুলো ভালো করে দেখতে লাগলো, ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবলো, একটা কানা গলিতে বোধ হয় তারা এসে পড়েছে। সোফি তার কাছে রোজউড বাক্সটা দিয়ে ভেতরে চলে গেছে চ্যাপেলটা ঘুরে ঘুরে দেখতে। এই বাক্সটাতেই গ্রেইল মানচিত্রটা রয়েছে। কিন্তু সেটা আর এখন কোন কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। যদিও সনিয়ের কবিতায় সরাসরি স্পষ্ট করেই রোজলিনের কথা বলা আছে, তারপরও, ল্যাংডন জানে না, এখানে পৌঁছাবার পর আর কী-ই বা করার আছে। কবিতাটাতে তলোয়ার আর পেয়ালার উল্লেখ রয়েছে। যা এখানে কোথাও ল্যাংডন দেখতে পাচ্ছে না।

হলি গ্রেইল প্রাচীন রোজলিনের নিচে অপেক্ষা করে।
তলোয়ার আর পেয়ালা তার দরজায় পাহায় দেয়।

আবারো ল্যাংডনের মনে হলো, এই রহস্যের অন্য কিছু দিক এখনও উন্মোচিত হয়নি।

আমি অনাহুতভাবে উঁকিঝুঁকি মারাটা ঘৃণা করি, ডোসেন্ট বললো, ল্যাংডনের হাতে ধরে রাখা রোজউড বাক্সটার দিকে তাকিয়ে।

কিন্তু, এই বাক্সটা…আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি, আপনি কোথেকে পেয়েছেন?

ল্যাংডন একটা ক্লান্ত হাসি দিলো।এটা একটা লম্বা-ইতিহাস। ছেলেটা দ্বিধাগ্রস্ত হলো, আবারো বাক্সটার দিকে চোখ গেলো তার। এটা খুবই অদ্ভুত একটা জিনিস আমার দাদির কাছেও ঠিক এরকম একটি বাক্স রয়েছে অলঙ্কারের বাক্স। ঠিক ঢাকনার মধ্যে যে রকম গোলাপটি লাগানো আছে, সেরকমই। এমনকি কড়াটা পর্যন্ত না।

ল্যাংডন জানে, ছেলেটা অবশ্যই ভুল করছে। এরকম কোন বাক্স যদি থেকেই থাকে, তবে সেটা এই বাক্সটাই বাক্সটা প্রায়োরিদের কি-স্টোন রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছে। দুটো বাক্সের হয়তো অনেক মিল রয়েছে, কিন্তু পাশের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেলে তারা দুজনেই সেদিকে তাকালো। সোফি উত্তেজিত হয়ে, কোন কথা না বলেই এখন পাশের পাথরের বাড়িটার দিকে যেতে লাগলো। ল্যাংডন তার দিকে চেয়ে রইলো। সে যাচ্ছে কোথায়? সে খুব অদ্ভুত আচরণ করছে, এখানে আসার পর থেকেই, বিশেষ করে এটার ভেতরে ঢোকার পর থেকে। সে ডোসেন্টের দিকে তাকালো। আপনি কি জানেন, বাড়িটা কিসের?

সে মাথা নাড়লো, সোফিকে ওখানে যেতে দেখে তাকে খুব হতভম্বও দেখালো। ওটা চ্যাপেলের যাজকের বাসভজ্বন। চ্যাপেলের কিউরেটরও ওখানে থাকেন। তিনি রোজলিন ট্রাস্টের প্রধান। সে একটু থামলো। তিনি আমার দাদি হোন।

আপনার দাদি রোজলিন ট্রাস্টের প্রধান?

ছেলেটা মাথা নেড়ে সায় দিলো। আমি তার সাথেই ওখানে থাকি এবং চার্চের দেখাশোনা করি, পর্যটকদের গাইডের কাজও করি পাশাপাশি। সে কাঁধ ঝাঁকালো। আমি এখানে জন্ম থেকেই আছি। আমার দাদি আমাকে এই বাড়িতেই লালন পালন। করেছেন।

সোফির জন্য চিন্তি হয়ে ল্যাংডন চ্যাপেলের দরজার কাছে গেলো তাকে ডাকতে। সে একটু এগোতেই থেমে গেলো। ছেলেটার একটা কথা তার মনে পড়লো।

আমার দাদি আমাকে লালন-পালন করেছেন।

ল্যাংডন পেছন থেকে সোফির দিকে একবার তাকিয়ে, তার হাতে ধরা রোজউড বাক্সটার দিকে তাকালো। অসম্ভব। আস্তে করে ল্যাংডন ছেলেটার দিকে ঘুরলো। আপনি বলছিলেন আপনার দাদির কাছেও এরকম একটি বাক্স আছে?

প্রায় এরকম।

তিনি এটা কোত্থেকে পেয়েছেন?

আমার দাদু তার জন্যে ওটা বানিয়েছিলেন। আমি যখন বাচ্চা অবস্থায় তখন তিনি মারা যান। কিন্তু আমার দাদি এখনও তার কথা বলেন। তিনি বলেন, দাদু নাকি হাতের কাজে একজন জিনিয়াস ছিলেন। তিনি সব ধরনের জিনিসই বানাতে পারতেন।

ল্যাংডনের মনে একটা অসম্ভব কল্পনা খেলে গেলো। একটা যোগসূত্র উদয় হলো তার মনে। আপনি বলছেন আপনার দাদি আপনাকে লালন পালন করেছেন। আপনি কিছু মনে করবেন না, আপনার বাবা-মার কি হয়েছিলো?

ছেলেটা খুবই অবাক হলো। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তারা মারা গিয়েছে। সে একটু থামলো। ঠিক একই দিনে আমার দাদুও।

ল্যাংডনের হৃদপিণ্ডটা লাফাতে লাগলো। একটা গাড়ি দুর্ঘটনায়?

ডোসেন্টের সবুজ চোখে বিস্ময়। হা। একটা গাড়ি দূঘর্টনায়। সেদিন আমার পুরো পরিবারই মারা যায়। আমার দাদা, বাবা-মা এবং… সে একটু ইতস্তত করে মাটির দিকে চেয়ে রইলো।

আর আপনার বোন, ল্যাংডন বললো।

***

পাথরের বাড়িটা সোফির যেমনটি মনে ছিলো ঠিক তেমনি। রাত নেমে এসেছে এখন, বাড়িটা থেকে উষ্ণ আর আমন্ত্রণমূলক মরীচিকা ঝড়ছে যেনো। রুটি তৈরির গন্ধ ভারি পর্দার খোলা দরজাটা দিয়ে বাইরে ভেসে আসছে। জানালা দিয়ে সোনালী একটা আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। সোফি এগোতেই ভেতর থেকে একটা শান্ত ফেঁপানো কান্না ভেসে এলো।

দরজার ভারি পর্দার ভেতর দিয়ে সোফি একজন বয়স্ক মহিলাকে দেখতে পেলো। তিনি দরজার দিক থেকে পেছন ফিরে আছেন। কিন্তু সোফি ঠিকই দেখতে পেলো তিনি কাঁদছেন। মহিলার দীর্ঘ-অভিজাত সাদা চুল, যা অপ্রত্যাশিত একটা স্মৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট। সোফি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। মহিলা একটা ছবির ফ্রেম ধরে রেখেছেন, ছবিটা একজন লোকের। তিনি তার হাতের আঙুল পরম মমতায় ভালবাসায় ছবির লোকটার মুখে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন।

ছবিটা এমন একজনের যাঁকে সে খুব ভালো করেই চেনে।

গ্র্যঁ পেয়া।

মহিলা নিশ্চিত গতকালকে তার মৃত্যুর খবরটা শুনেছেন।

সোফির পায়ের নিচের কাঠের পাটাতনটা খ্যাচ্‌ করে উঠলে মহিলা আস্তে করে ঘুরে তাকালেন।

তার বিষণ্ণ চোখ দুটো সোফিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। সোফি দৌড়াতে চাইলো কিন্তু স্থির হয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে রইলো সে। দুজন নারী একে অন্যেকে এমন ভাবে দেখতে লাগলো যেনো অনন্তকাল অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। তারপর সমুদ্রের ঢেউরের মতো মহিলার মুখে অনিশ্চয়তা থেকে…অবিশ্বাস থেকে…আশাতে…এবং অবশেষে চরম আনন্দ আছড়ে পড়লো।

খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে এসে মহিলা তার নরম হাত দুটো দিয়ে সোফির মুখটা ধরলেন, সোফির বজ্রাহত মুখটাতে আদরের পরশ বুলিয়ে দিলেন তিনি। ওহ্, আমার আদরের বাহা…তুমি এসে গেছে!

যদিও সোফি তাকে চিনতে পারেনি তারপরও সে জানে কে এই মহিলা। সে কথা বলতে চাইলেও নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।

সোফি, মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তার কপালে চুমু খেলেন।

সোফির কথাটা ফিসফিসানিতে পরিণত হলো। কিন্তু… পেয়া বলেছিলেন তুমি…।

আমি জানি, মহিলা তার মমতাময়ী হাতটা সোফির কাঁধে রেখে খুবই অতিপরিচিত একটা চাহুনি দিলেন। তোমার দাদু আর আমি অনেক কথাই বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমরা যা ভেবেছি ঠিক তা-ই করেছি। আমি দুঃখিত। সেটা ছিলো তোমার নিজের নিরাপত্তার জন্যই, প্রিন্সেস।

সোফি তার শেষ কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই দাদুর কথা মনে পড়ে গেলো। যিনি সোফিকে প্রিন্সেস বলেই ডাকতেন।

মহিলা দুহাতে সোফিকে জড়িয়ে ধরলেন। অশ্রু ঝড়ে পড়তে লাগলো তাঁর। তোমার দাদু তোমাকে সবকিছু বলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তোমাদের দুজনের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিলো না। তিনি অনেক চেষ্টাই করেছিলেন। অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করার ছিলো, তিনি আবারো সোফির কপালে চুমু খেলেন। তারপর কানে কানে বললেন, আর কোন গোপনীয়তা নয়, প্রিন্সেস। এখন সময় এসেছে তোমার পরিবার সম্পর্কে সত্যি কথাটা জানার।

 

সোফি আর তার দাদি দরজার কাছে সিঁড়িতে বসে জড়িয়ে ধরে যখন কাঁদছিলো তখন ডোসেন্ট ছেলেটা এসে পড়লো সেখানে। তার চোখে আশা আর অবিশ্বাস জ্বলজ্বল করছে।

সোফি?

কান্না ভেজা চোখেই সোফি মাথা নেড়ে সায় দিলো, ছেলেটাকে সে চিনতে পারলো। কিন্তু একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরতেই সে তার রক্তের টান অনুভব করলো…

 

ল্যাংডন যখন সোফিদের কাছে এসে পৌঁছালো তখন সোফি বিশ্বাসই করতে পারছিলো না, কেবল গতকালই তার মনে হয়েছিলো সে এই পৃথিবীতে একা হয়ে গেছে। আর এখন যেভাবেই হোক, এই বিদেশ বিভূঁইয়ে তিন তিনজন লোকের সঙ্গ পেয়ে তার অবশেষে মনে হলো, নিজের বাড়িতেই আছে সে।

 

১০৫.

রোজলিনর ওপর রাত নেমে এসেছে।

রবার্ট ল্যাংডন ফিল্ডস্টোন হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে তার পেছনে থাকা স্বচ্ছ দরজার ভেতর থেকে পূণর্মিলনী আর হৈ হুল্লোরের শব্দ শুনতে পেলো। তার হাতে ব্রাজিলিয়ান কফির একটা মগ থাকাতে প্রচণ্ড অবসাদটা দূর হতে লাগলো, তারপরও তার মনে হলো ক্লান্তিটা বুঝি সহজে কাটবার নয়। শরীরের এই ধকলটা একেবারে গভীরে গিয়ে আঘাত হেনেছে।

আপনি কিছু না বলে চলে এসেছেন, পেছন থেকে একটা কণ্ঠ তাকে বললো।

সে ঘুরে দেখলো সোফির দাদি এসেছে, তাঁর রূপালি চুল রাতের আঁধারে জ্বল জ্বল করছে। তাঁর নাম বিশেষ করে বিগত আঠাশ বছর ধরে ছিলো ম্যারি শভেল।

ল্যাংডন একটা ক্লান্ত হাসি দিলো। আমি ভেবেছিলাম আপনাদের পরিবারকে এক সঙ্গে হবার জন্যে কিছুটা সময় দেই। জনালা দিয়ে সে দেখতে পেলো সোফি তার ভাইয়ের সাথে কথা বলছে।

ম্যারি তার পেছনে এসে দাঁড়ালেন। মি. ল্যাংডন, আমি যখন প্রথম জ্যাক সনিয়ের মৃত্যুর খবরটা পাই তখন সোফির নিরাপত্তা নিয়ে যারপরনাই উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম। তাকে আজ রাতে আমার দরজায় সামনে দেখতে পেয়ে জীবনের সবচাইতে বড় স্বস্তিটা পেয়েছি। তার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ দিলে যথেষ্ট হবে না।

ল্যাংডন কী বলবে ভেবে পেলো না। যদিও সে সোফি এবং তার দাদিকে একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলো, তারপরও ম্যারি তাকে তাদের সাথে থেকে কথা শুনে যেতে বলেছিলেন। আমার স্বামী অবশ্যই আপনাকে বিশ্বাস করতেন, মি. ল্যাংডন, আমিও সেরকমই বিশ্বাস করি।

আর তাই ল্যাংডন থেকে গিয়েছিলো, যখন সোফির দাদি সোফিকে তার মৃত বাবা-মার গল্পটা শুনাচ্ছিলো তখন সোফির পাশে দাড়িয়ে নিরব বিস্ময় দেখেছিলো সে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, তারা দুজনেই মেরোভিনজিয়ান পরিবারের-ম্যারি মাগদালিন আর যিশুখৃষ্টের প্রত্যক্ষ বংশধর। সোফির বাবা-মা এবং তাদের পূর্ব পুরুষরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য পদবী পরিবর্তন করে পান্টার্ড এবং সেন-ক্লেয়ার রেখেছিলেন। তাদের ছেলে-মেয়েরা সরাসরি রাজকীয় রক্তের ধারাক্রম বহন করে চলছে বলে প্রায়োরিরা তাদেরকে খুব সযত্নে রক্ষা করে গেছে। যখন সোফির বাবা-মা গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা গেলেন, যার কারণ সত্যিকারভাবে জানা যায়নি, প্রায়োরিরা তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিলো, রাজ বংশের পরিচয়টা বোধহয় ফাঁস হয়ে গেছে।

তোমার দাদু এবং আমি, ম্যারি দুঃখভরা কণ্ঠে ব্যাখ্যা করলেন, টেলিফোনে খবরটা শোনা মাত্রই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। তোমার বাবা-মার গাড়িটা তখন মাত্র নদীতে খুঁজে পাওয়া গেছে। তিনি নিজের চোখের পানি মুছলেন। আমাদের ছয়জনের সবাই-তোমাদের দুজনসহ-সেই রাতে গাড়িতে করে ভ্রমণ করার কথা ছিলো। সৌভাগ্যবশত, শেষ মুহুর্তে আমরা পরিকল্পনাটা একটু বদলে ফেলেছিলাম, তাই তোমার বাবা-মা একাই গাড়িতে করে গিয়েছিলেন। দূর্ঘটনার কথা শুনে জ্যাক এবং আমার পক্ষে কোনভাবেই জানা সম্ভব ছিলো না আসলে কী ঘটেছিলো …অথবা, আদৌ এটা কোন দূর্ঘটনা কিনা। ম্যারি সোফির দিকে তাকালেন। আমরা জানতাম, আমাদের নাতি-নাতনীদেরকে রক্ষা করতে হবে আর আমরা সেটাই করেছি। যেটা ভালো মনে হয়েছে আমাদের কাছে। জ্যাক পুলিশের কাছে রিপেটি করেছিলো, তোমার ভাই এবং আমি গাড়িতে ছিলাম…আমাদের মৃতদেহ দুটো নদীর স্রোতে ভেসে গিয়েছে। তারপরই, তোমার ভাই আর আমি প্রায়োরিদের সাথে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলাম। জ্যাক একজন বিখ্যাত লোক হিসেবে অদৃশ্য হবার বিলাসিতা দেখাতে পারেনি। এজন্যেই মনে করা হয়েছিলো, বড় হিসেবে সোফি প্যারিসেই জ্যাকের কাছে থেকে শিক্ষাদীক্ষা নেবে আর প্রায়োরিদের কাছাকাছি থাকবে নিরাপত্তার জন্যে। তাঁর কণ্ঠটা ফিসফিসানিতে পরিণত হলো। পরিবারকে আলাদা করার কাজটা ছিলো আমাদের জন্যে সবচাইতে কঠিন কাজ। জ্যাক আর আমি একে অন্যের সাথে দেখা করতাম খুবই অনিয়মিত আর গোপনীয়ভাবে…প্রায়োরিদের অধীনে, তাদের সুরক্ষায়। কিছু অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ভ্রাতৃসংঘের ভায়েরা সবসময়ই বিশ্বস্ত থেকেছেন।

ল্যাংডন ধারণা করলো, গল্পটা আরো গভীরে যাবে আর সেটা তার শোনা ঠিক হবে না তাই সে বেড়িয়ে এসেছিলো। এখন রোজলিনের দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন ভাবলো, এটার অমীমাংসিত রহস্যটা ভেদ না করে কোনভাবেই পালাতে পারবে না। গ্রেইলটা কি সত্যি রোজলিনের এখানেই আছে? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সনিয়ে কবিতায় যে তলোয়ার আর পেয়ালার কথা উল্লেখ করেছেন সেটা কোথায়?

এটা আমাকে দিন, ল্যাংডনের হাতের দিকে ইঙ্গিত করে ম্যারি বললেন।

ওহ, ধন্যবাদ আপনাকে। ল্যাংডন তার খালি কফির কাপটা তাঁর হাতে তুলে দিতে উদ্যত হলো।

ম্যারি তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি আপনার অন্য হাতটার কথা বলছিলাম, মি. ল্যাংডন।

ল্যাংডন তার হাতের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলে সে সনিয়ের প্যাপিরাসটা ধরে রেখেছে। সে এটা ক্রিপটেক্স থেকে আবার বের করে নিয়েছিলো এই আশায় যে, প্রথম দেখায় যা ধরতে পারেনি সেটা এবার হয়তো ধরতে পারবে। অবশ্যই আমি দুঃখিত।

কাগজটা হাতে নিয়ে ম্যারি খুবই খুশি হলেন। আমি জানি, প্যারিসের এক ব্যাংকের লোক সম্ভবত এই রোজ বাক্সটা ফিরে পেতে উদগ্রীব হয়ে আছেন। আদ্রেঁ ভার্নেট হলেন জ্যাকের খুবই প্রিয় একজন বন্ধু আর জ্যাক তাঁকে প্রচণ্ড বিশ্বাস করতেন। এই বাক্সটা যত্ন নেবার সনিয়ের অনুরোধটা রক্ষার জন্যে আদ্রেঁ নিজেকে সম্মানিত মনে করেন।

এমনকি এজন্যে আমাকে গুলিও করতে কসুর করেনি, ল্যাংডনের মনে পড়ে গেলো, সিদ্ধান্ত নিলো সে যে বেচারির নাকটা ভেঙে ফেলেছিলো সে কথা উল্লেখ করবে না। প্যারিসের কথা ভাবতেই ল্যাংডনের মনের পর্দায় ভেসে উঠলো তিন জন সেনেক, যাঁদের সবাই আগের দিন রাতে মারা গেছেন। আর প্রায়োরির? এখন তবে কি হবে?

চাকাটা ইতিমধ্যেই ঘুরতে শুরু করেছে, মি. ল্যাংডন। ভ্রাতৃসংঘ শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে এটা টিকিয়ে রেখেছে আর এই জিনিসটাই এটাকে টিকিয়ে রাখবে। সব সময়ই এরা অপেক্ষা করছে এটা সরাতে এবং নতুন করে নির্মাণ করার জন্যে।

সারা রাত ধরে ল্যাংডন সন্দেহ করেছে যে, সোফির দাদি প্রায়োরিদের কর্মকাণ্ডের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। হাজারহোক, প্রায়োরিদের সবসময়ই নারী সদস্য থাকে। চার জন গ্র্যান্ড মাস্টার ছিলেন নারী। সেন্যেরা প্রথাগতভাবেই ছিলেন পুরুষ-অভিভাবক-তার পরও, নারীরা প্রায়োরিতে অনেক বেশি সম্মানিত অবস্থান পেয়ে থাকে এবং বলতে গেলে যেকোন উচ্চপদে আসীন হতে পারে তারা।

ল্যাংডন লেই টিবিং আর ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবির কথা ভাবলো। মনে হচ্ছে এটা কতো জনম আগের কথা। চার্চ কি আপনার স্বামীকে স্যাংগৃল-এর কথা শেষ দিনের আগে প্রকাশ না করার জন্যে চাপ দিচ্ছিলো?

না। শেষ দিন-এর কিংবদন্তীটা বিকৃত মস্তিষ্কপ্রসূত। প্রায়োরি মতবাদের কোথাও এমন কোন দিনের কথা বলা নেই যেদিন গ্রেইলটা প্রকাশ করা হবে। সত্যি বলতে কী, প্রায়োরিরা সব সময়ই চেয়েছে গ্রেইলটা যাতে কোনদিনই প্রকাশ না হয়।

কখনই না? ল্যাংডন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।

এটা হলো রহস্যময়তা আর বিস্ময় যা আমাদের আত্মাকে পরিচালিত করে, গ্রেইলটা নয়। গ্রেইলের সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তার অশরীরি স্বভাবে।ম্যারি শভেল এখন রোজলিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কারো কারো কাছে গ্রেইল হলো পেয়ালা যা তাদেরকে অমরত্ব দেবে। অন্যদের কাছে এটা হলো হারানো দলিল-দস্তাবেজ এবং গোপন ইতিহাসের অন্বেষণ। আর বেশির ভাগের কাছে, আমার সন্দেহ, হলি গ্রেইল হলো একটা দারুণ আইডিয়া…একটা গৌরবোজ্জ্বল বিষয়, অর্জন করা যায় না এমন কোন সম্পদ, যা আজকের এই হট্টগোলপূর্ণ পৃথিবীতেও আমাদেরকে অনুপ্রেরণা দেয়।

কিন্তু স্যাংগৃল দলিলগুলো যদি লুকানোই থাকে তবে তো ম্যারি মাগদালিনের গল্পটা চিরতরের জন্য হারিয়ে যাবে, ল্যাংডন বললো।

তাই? দেখুন। তাঁর গল্প চিত্রকলায়, সঙ্গীতে আর বই-পুস্তকে বলা হচ্ছে। তার চেয়েও বেশি বলা হচ্ছে প্রতিদিন। পেন্ডুলামটা দুলছে। আমরা আমাদের ইতিহাসের বিপদটা আঁচ করতে শুরু করছি…এবং আমাদের ধ্বংসাত্মক পথটাও। আমরা পবিত্র নারীকে পূণরায় অধিষ্ঠিত করার কথা ভাবতে শুরু করছি। তিনি থামলেন। আপনি বলেছিলেন, পবিত্র নারী সম্পকিত একটা লেখা লিখছেন, তাই না?

হ্যাঁ।

তিনি হাসলেন। ওটা শেষ করুন, মি. ল্যাংডন। পবিত্র নারীর গান গেয়ে উঠুন। পৃথিবীর দরকার আধুনিক গীতিকবির।

ল্যাংডন নিরব রইলো, তার ওপর তাঁর কথার ওজনটা বুঝতে পারলো। খোলামেলা জায়গাটা দিয়ে দূরের গাছের সারিগুলোর ফাঁক গলে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। রোজলিনের দিকে চোখ ফিরিয়ে ল্যাংডন এর সিক্রেটটা জানতে পেরে ছেলেমানুষির মতো উৎফুল্ল বোধ করলো। জিজ্ঞেস কোরো না, নিজেকে বললো সে। এটা জিজ্ঞেস করার সময় নয়। সে ম্যারির হাতের প্যাপিরাসের দিকে তাকালো তারপর আবার রোজলিনের দিকে।

প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করুন মি. ল্যাংডন, ম্যারি বললেন, তাঁকে খুব খোশ মেজাজে দেখাচ্ছে। আপনি সেই অধিকার অর্জন করেছেন।

ল্যাংডন দারুণ চাঞ্চল্য অনুভব করলো।

আপনি জানতে চান গ্রেইলটা রোজলিনের এখানে আছে কিনা।

আপনি কি আমাকে বলতে পারবেন?

তিনি একটা ঠাট্টার মতো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কেন লোকজন গ্রেইলটাকে শান্তিতে থাকতে দিতে চায় না? হেসে উঠলেন, অবশ্যই তিনি উপভোগ করছেন ব্যাপারটা। কেন আপনি ভাবছেন এটা এখানে আছে?

ল্যাংডন তাঁর হাতের প্যাপিরাসের দিকে তাকালো। আপনার স্বামীর কবিতায় নির্দিষ্ট করে রোজলিনের কথা বলা আছে, অবশ্য তাতে তলোয়ার আর পেয়ালা গ্রেইলটা পাহারা দিচ্ছে বলেও বলা আছে। আমি কোন তলোয়ার আর পেয়ালার প্রতীক এখানে দেখতে পাচ্ছি না।

তলোয়ার আর পেয়ালা? ম্যারি জিজ্ঞেস করলেন। সেগুলো দেখতে ঠিক কি রকম?

ল্যাংডন আঁচ করতে পারলো তার সাথে ছেলেখেলা করা হচ্ছে কিন্তু সেও খেলতে শুরু করে দ্রুত প্রতীকগুলোর বর্ণনা দিয়ে দিলো।

তাঁর চোখে মুখে কৌতূহল দেখা গেলো। আহ, হ্যাঁ, অবশ্যই। তলোয়ার পুরুষকে প্রতিনিধিত্ব করে। আমার বিশ্বাস সেটা দেখতে এরকম, না? তর্জনীটা দিয়ে তিনি অন্য হাতের তালুতে একটা আকৃতি আঁকলেন।

হ্যাঁ, ল্যাংডন বললো। ম্যারি তলোয়ারের সবচাইতে অপ্রচলিত সরল আকৃতিটা আঁকলেন, যদিও ল্যাংডন এই প্রতীকটার ছবি দেখেছে।

আর উল্টোটা, তিনি বললেন, আবার নিজের তালুতে আঁকলেন, হলো পেয়ালা, যা নারীকে বোঝায়।

একদম ঠিক, ল্যাংডন বললো।

আর আপনি বলছেন, এই এখানে রোজলিন চ্যাপেলে শত শত প্রতীকের মধ্যে এই দুটোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না?

আমি তাদেরকে কোথাও দেখিনি।

আর আমি যদি আপনাকে সেগুলো দেখিয়ে দেই তবে কি আপনি একটু ঘুমাবেন?

ল্যাংডন কোন জবাব দেবার আগেই ম্যারি শভেল চ্যাপেলের দিকে হাটতে শুরু করলেন। ল্যাংডনও তাঁকে দ্রুত অনুসরণ করলো। প্রাচীন দালানটার ভেতরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে পবিত্র স্থানটার মাঝখানের দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। এই তো, মি. ল্যাংডন। তলোয়ার এবং পেয়ালা।

ল্যাংডন পাথরের জমিনটার দিকে তাকালো। সেটা একেবারে ফাঁকা। এখানে ততা কিছুই নেই….

ম্যারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চ্যাপেলের ফ্লোরের বিখ্যাত পথটা ধরে হাটতে লাগলেন। এই পথটাই ল্যাংডন আজকের রাতের প্রথম দিকে দর্শকদেরকে হাটতে দেখেছে। সে একটা বিশাল প্রতীকের দিকে তাকিয়েও কিছুই খুঁজে পেলো না। কিন্তু

এটাতো ডেভিডের তারা—

তলোয়ার এবং পেয়ালা।

একটাতে মিলেছে।

ডেভিডের তারা…নারী এবং পুরুষের যর্থাথ সম্মিলন…সলোমনের সিল…হলি অব হলির চিহ্ন দেয়া, যেখানে নারী এবং পুরুষের দেবত্ব-ইয়োহে এবং শেকিনাহ-মনে করা হয় একসাথে বসবাস করে।

কী বলবে তার জন্যে ল্যাংডনের কয়েক মিনিটের দরকার হলো। পংক্তিটা রোজলিনের দিকেই ইঙ্গিত করে। একেবারে যথার্থভাবেই।

ম্যারি হাসলেন। দৃশ্যতই।

নিহিতার্থটা তাকে কাঁপিয়ে দিলো। তো হলি গ্রেইলটা তবে কি আমাদের নিচে ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে আছে?

তিনি হাসলেন। একমাত্র চেতনার মধ্যে। প্রায়োরিদের একটা প্রাচীন প্রতীজ্ঞা ছিলো। একদিন হলি গ্রেইলকে তার নিজের দেশ ফ্রান্সে ফিরিয়ে আনা হবে যেখানে সে চিরদ্রিায় শায়িত যাবে। শত শত বছর ধরে তাকে বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় টানাহেচরা করা হয়েছে নিরাপত্তার জন্য। খুবই অপমানজনক। জ্যাক যখন গ্র্যান্ড মাস্টার হিসেবে অধিষ্ঠিত হলো তখন তাঁর প্রতীজ্ঞা ছিলো তাঁকে ফ্রান্সে ফিরিয়ে এনে রাণীর মর্যাদায় একটা সমাধি নির্মাণ করে তাঁর সম্মানকে পূণরুদ্ধার করা হবে।

তিনি কি সফল হয়েছিলেন?

তাঁর চেহারাটা খুবই সিরিয়াস হয়ে উঠলো। মি. ল্যাংডন, আজ রাতে আপনি আমার জন্যে যা করেছেন সেটা বিবেচনা করে রোজলিন ট্রাস্টের একজন কিউরেটর হিসেবে আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, গ্রেইলটা আর এখানে নেই।

ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিলো চাপাচাপি করবে। কি-স্টোনটা সেই জায়গাটাই নির্দেশ করে যেখানে হলি গ্রেইলটা লুকানো আছে এখন। কেন সেটা রোজলিনের দিকে ইঙ্গিত করে?

হয়তো আপনি এর অর্থটা ধরতে পারেননি। মনে রাখবেন, গ্রেইলটা ধোঁকাও হতে পারে। আমার স্বৰ্গত স্বামীর মতো প্রহেলিকাময়।

কিন্তু তিনি এর চেয়ে বেশি আর কতো স্পষ্ট হতে পারতেন? সে জিজ্ঞেস করলো। আমরা তলোয়ার এবং পেয়ালা চিহ্নিত একটা ভূ-গর্ভস্থ কক্ষের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি, চারিদিকে ঘিরে আছে মাস্টার শিল্পীদের ছবি। সবকিছুই রোজলিনের কথা বলছে।

খুব ভালো, আমাকে এই রহস্যময় পংক্তিটা একটু দেখতে দিন। তিনি প্যাপিরাসটার ভাঁজ খুলে জোরে জোরে কবিতাটা পড়লেন :

হলি গ্রেইল প্রাচীন রোজলিনের নিচে অপেক্ষা করছে।
তলোয়ার আর পেয়ালা তাঁর দরজা পাহারা দেয়।
মাস্টার শিল্পীদের ছবিতে প্রশংসিত হয়ে শায়িত আছে সে।
তারা ভরা আকাশের নিচে অবশেষে চিরদ্রিায়।

যখন তিনি শেষ করলেন কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত একটা রেশ থেকে গেলো, যতোক্ষণ না একটা পরিচিত হাসি তাঁর ঠোঁটে দেখা গেলো। আহ, জ্যাক।

ল্যাংডন প্রতীক্ষায় তাঁর দিকে চেয়ে রইলো। আপনি এটা বুঝতে পেরেছেন?

চ্যাপেলের ফ্লোরে আপনি যেমনটি দেখেছেন, মি. ল্যাংডন, সহজ-সরল জিনিসগুলোকে অনেকভাবেই দেখা যায়।

ল্যাংডনের বুঝতে খুব কষ্ট হলো। জ্যাক সনিয়ের সম্পর্কিত সব কিছুই মনে হচ্ছে দ্ব্যর্থবোথক, আর ল্যাংডন সেটা এখানে দেখতে পাচ্ছে না।

ম্যারি একটা ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মি. ল্যাংডন, আমি আপনার কাছে একটা স্বীকারোক্তি করছি। আমি গ্রেইলের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোনদিনই জানতে পারিনি। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, আমি এমন একজন লোককে বিয়ে করেছিলাম যে ছিলো অসামান্য প্রভাবশালী একজন…আর আমার মেয়েলী স্বজ্ঞা ছিলো খুবই প্রখর।

ল্যাংডন কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু ম্যারি আবারো বলতে শুরু করলেন।

আমি দুঃখিত, আপনার সমস্ত পরিশ্রমের পরও রোজলিন থেকে আপনি কোন সত্য উত্তর পাবেন না। তার পরও আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি এমন কিছু পাবেন যা আপনি খুঁজে ফিরছেন। একদিন এটা আপনার কাছে উদ্ভাসিত হবে। তিনি হাসলেন। আর যখন এটা ঘটবে, আমি বিশ্বাস করি, আপনি এবং বাকি সব লোক এটা গোপন রাখবেন।

দরজার দিক থেকে কারোর আসার শব্দ শোনা গেলো। তোমরা দুজনেই হাওয়া হয়ে গেলে দেখছি, সোফি আসতে আসতে বললো।

আমি চলে যাচ্ছিলাম, তার দাদি জবাব দিলেন দরজার দিকে এগোতে এগোতে। গুডনাইট, প্রিন্সেস। তিনি সোফির কপালে চুমু খেলেন। মিঃ ল্যাংডনকে বাইরে বেশিক্ষণ রেখো না।

ল্যাংডন আর সোফি দেখলো দাদি ঘরের ভেতরে চলে যাচ্ছে। সোফি তার দিকে ঘুরলো, তার দুচোখে গভীর আবেগ। ঠিক আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী সমাপ্তিটা ঘটেনি।

আমাদের দুজনের বেলায়, সে ভাবলো। ল্যাংডন দেখতে পেলো সে খুব আবেগতাড়িত হয়ে আছে। আজ রাতে সে যে খবরটা পেয়েছে সেটা তার জীবনের সবকিছু বদলে দিয়েছে। তুমি কি ঠিক আছো? অনেক ধকল গেছে।

সে নিরবে হাসলো। আমার একটা পরিবার আছে। সেখান থেকেই আমি শুরু করতে চাই। আমরা কারা এবং কোথা থেকে এসেছি সেটা বুঝতে আরো কিছু সময় লাগবে।

ল্যাংডন নিরব রইলো।

আজ রাতের পরে তুমি কি আমাদের সাথে থাকবে? সোফি জিজ্ঞেস করলো। নিদেনপক্ষে কয়েকটা দিন?

ল্যাংডন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এর বেশি কিছু চাচ্ছিলো না। সোফি, তোমার পরিবারের সাথে তোমার কিছু সময় একান্তে থাকার দরকার। সকালেই আমি প্যারিসে ফিরে যাচ্ছি।

তাকে দেখে হতাশ মনে হলেও সেই সাথে এও মনে হচ্ছে, সে জানে এটাই ঠিক কাজ। তাদের কেউই অনেকক্ষণ কথা বললো না। শেষে সোফি একটু সামনে এগিয়ে এসে তার হাতটা ধরে চ্যাপেলের বাইরে নিয়ে আসলো। তারা একটু হাটলো। এই জায়গা থেকে স্কটিশ গ্রামাঞ্চলটা ছড়িয়ে গেছে। নিরবে দাড়িয়ে রইলো দুজনে হাত ধরে, নিজেদের সাথে লড়াই করে যাচ্ছিলো তারা।

আকাশে তারাগুলো সবে দেখা যেতে শুরু করেছে কিন্তু পশ্চিম দিকে একটা বিন্দু অন্য সবকিছু থেকে বেশি জ্বল জ্বল করছিলো। সেটা দেখে ল্যাংডন হাসলো। এটা হলো ভেনাস। প্রাচীন দেবী তার স্থির এবং প্রশান্ত আলোয় জ্বল জ্বল করছে।

রাতটা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হতে শুরু করলো, একটা শীতল বাতাস নিমভূমি থেকে ধেয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরে ল্যাংডন সোফির দিকে তাকালো। তার চোখ বন্ধ আর ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। ল্যাংডনের মনে হলো, তার নিজের চোখের পাতাও ভারি হয়ে আসছে। সে তার হাতটা চেপে ধরলো। সোফি?।

ধীরে ধীরে সে তার চোখ খুলে তার দিকে তাকালো। পুর্ণিমার আলোতে তার মুখটা অপূর্ব লাগছে। একটা ঘুম ঘুম হাসি হাসলো। হাই।

ল্যাংডন অপ্রত্যাশিতভাবে একটা দুঃখবোধে আক্রান্ত হলো এটা ভেবে যে, সে সোফিকে রেখে প্যারিসে ফিরে যাচ্ছে। হয়তো আমি চলে যাবো তুমি জেগে ওঠার আগেই। সে একটু থামলো, তার গলাটা ধরে আসছে। আমি দুঃখিত, আমি এসবে খুব একটা ভালো—

সোফি তার নরম হাতটা ল্যাংডনের মুখের উপর রাখলো। তারপর সামনের দিকে হেলে, তার চিবুকে একটা প্রগাঢ় চুমু খেলো। আবার কবে তোমাকে দেখতে পাবো?

ল্যাংডন কয়েক মুহূর্ত ঘোরের মধ্যে ডুবে গেলো, তার চোখের মধ্যে হারিয়ে গেছে সে।

কখন?

সে একটু থামলো, কৌতূহলী হলো, সোফির কি কোন ধারণা আছে সে নিজেও এই একই বিষয় নিয়ে ভাবছে। আসলে পরের মাসে আমার ফ্লোরেন্সে একটা কনফারেন্সে বক্তৃতা দেবার কথা আছে। সেখানে আমার এক সপ্তাহের মতো সময় হাতে থাকবে আর হাতে তেমন কাজও থাকবে না।

এটা কি কোন আমন্ত্রণ?

আমরা খুব বিলাসবহুল জায়গায় থাকবে। তারা আমাকে ব্রুনেপ্লেসিতে একটা ঘর দেবে।

সোফি ঠাটাচ্ছলে হাসলো। মি. ল্যাংডন, তুমি খুব বেশি ভেবে ফেলেছে।

সে একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো। আমি আসলে যা বলতে চেয়েছিলা–*

ফ্লোরেন্সে তোমার সাথে দেখা করতে আমার ভালোই লাগবে, রবার্ট। কিন্তু একটা শর্তে। তার কণ্ঠ সিরিয়াস। কোন জাদুঘর নয়, চার্চ নয়, শিল্পকলা নয়, শিলালিপি নয়।

ফ্লোরেন্সে? এক সপ্তাহের জন্যে? এসব কিছুই হবে না।

সোফি তার দিকে ঝুঁকে আবারও একটা চুমু খেলো, এবারে ঠোঁটে। তাদের শরীর ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো, প্রথমে খুব আলতো করে পরে একেবারেই জড়িয়ে। যখন সে ছাড়িয়ে নিলো তার চোখ জুড়ে ছিলো প্রতীজ্ঞা।

ঠিক আছে, ল্যাংডন বললো। সেই কথাই রইলো তবে।

 

উপসংহার

রবার্ট ল্যাংডন হুট করে ঘুম থেকে জেগে উঠলো। সে স্বপ্ন দেখছিলো। তার বিছানার পাশে রাখা বার্থরোবের একটা মনোগ্রামে হোটেল রিজ প্যারিস লেখাটি লাগানো আছে। অন্ধকার ঘরটাতে একটা ডিম লাইট জ্বলছে। এখন সন্ধ্যা না ভোর? অবাক হয়ে ভাবলো সে।

ল্যাংডনের শরীরটা খুব গরম আর অসাড় মনে হলো। গত দুদিন ধরে দিনের বেশির ভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। বিছানায় ধীরে ধীরে উঠে বসে বুঝতে পারলো কিসের জন্য তার ঘুম ভেঙ্গেছে…অত একটি ভাবনা। কয়েকদিন ধরে কতোগুলো তথ্য নিয়ে সে খতিয়ে দেখেছে কিন্তু ল্যাংডন এখন নিজেকে এমন একটি অবস্থায় খুঁজে পেলো যা এর আগে ভেবে দেখেনি।

এটা কি হতে পারে?

কয়েক মুহূর্ত সে স্থির হয়ে রইলো।

বিছানা থেকে নেমে মার্বেল শাওয়ারের দিকে গেলো। ভেতরে ঢুকেই ছেড়ে দিলো শক্তিশালী জেট মেসেজটি। তখনও সেই ভাবনাটিই তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

অসম্ভব।

বিশ মিনিট পরে, ল্যাংডন হোটেল রিজ থেকে বের হয়ে প্লেস ভেঁদোমে এলো। রাত নেমে এসেছে। কয়েক দিনের ঘুমের জন্য তার ঘোর ঘোর ভাবটা এখনও কাটেনি …এখনও তার মনে হচ্ছে অদ্ভুত প্রহেলিকাময়। সে ভেবেছিলো হোটেল থেকে বের হবার আগে লবি সংলগ্ন ক্যাফে অ্যা লেইতে ঢুকে মাথাটা একটু পরিষ্কার করে নেবে। কিন্তু তার দুপা তাকে সোজা হোটেলের বাইরে প্যারিসের এই নির্জন রাতে নিয়ে এলো।

রুই দে পেতিত শাম্প-এর পূর্ব দিক দিয়ে হাটতে হাটতে ল্যাংডনের মনে হলো, তার উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। দক্ষিণ দিকে ঘুরে রুই রিশেলু ধরে এগোতে লাগলো। সে, জেসমিন ফুলের মিষ্টি বাতাস প্যালেস রয়্যালের রাষ্ট্রীয় বাগান থেকে ভেসে আসছে।

দক্ষিণ দিক দিয়েই হেটে যেতে লাগলো সে, যতোক্ষণ না যা খুঁজছিলো তা পেয়ে গেলো-বিখ্যাত রয়্যাল আর্কেড-পালিশ করা চকে মার্বেল পাথরের সুবিশাল চত্বর। সেখানে গিয়ে ল্যাংডন ভালো করে তার পায়ের নিচের জমিনটা দেখে নিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার পরিচিত জিনিসটা পেয়ে গেলো-অনেকগুলো ব্রোঞ্জের মেডেল মাটিতে খোঁদাই করা, নিখুঁতভাবে সোজা লাইনে সাজানো। প্রতিটি চাকতির ব্যস হবে পাঁচ মিটারের মতো এবং তার ওপর খোঁদাই করা ইংরেজি N এবং S অক্ষর।

নর্দ। সুদ।

সে দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে মেডেলের সোজা লাইনটার দিকে চেয়ে দেখলো। আবার লাইনটা অনুসরণ করে চলতে শুরু করলো সে। পেভমেন্টের দিকে লক্ষ্য রেখে হাটতে লাগলো ল্যাংডন। কমেদি ফ্রাসোয়ের কোণায় এসে দেখতে পেলো আরেকটি ব্রোঞ্জ মেডেল তার পায়ের নিচ দিয়ে অতিক্রম করছে। হ্যাঁ!

ল্যাংডন এটা জেনেছিলো, প্যারিসের রাস্তাগুলো কয়েক বছর আগেই এ রকম ১৩৫টি ব্রোঞ্জ মেডেল দিয়ে চিহ্নিত করা আছে, ফুটপাত, চত্বর এবং রাস্তাঘাটে শহর জুড়ে উত্তর-দক্ষিণ অক্ষে খোঁদাই করা আছে। সে এবার সিন নদীর উত্তর দিকের স্যাকরেকোয়ের একটি লাইন ধরে অনুসরণ করে শেষ পর্যন্ত প্রাচীন প্যারিসের অবজারভেটরিতে পৌঁছে গেলো। সেখানে পবিত্র পথের বিশেষত্ব আবিষ্কার করলো সে।

পৃথিবীর আদি মধ্য রেখা।
পৃথিবীর প্রথম শূন্য দ্রাঘিমাংশ।
প্যারিসের প্রাচীন রোজ লাইন।

এখন রুই দ্য রিভোলির দিকে দ্রুত ছুটতে গিয়ে ল্যাংডনের মনে হলো সে তার গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে। আর একটা ব্লকেরও কম দূরে সেটা।

হলি গ্রেইল প্রাচীন রোজলিন-এর নিচে অপেক্ষা করছে।

সবকিছু এখন খুব দ্রুতই উন্মোচিত হচ্ছে। সনিয়ের রোজলিনের প্রাচীন বানান …তলোয়ার এবং পেয়ালা…সমাধি ফলকটি অসাধরণ চিত্রে সজ্জিত।

এর জন্যেই কি সনিয়ে আমার সাথে কথা বলার দরকার মনে করেছিলেন? আমি কি আমার অজান্তেই সত্যটা জানতাম?

সম্বিত ফিরে পেতেই বুঝতে পারলো তার পায়ের নিচেই রোজলিনটা। তাকে পথ দেখাচ্ছে, গন্তব্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্যাসেজ রিসেলুর লম্বা টানেলের ভেতরে ঢুকতেই তার ঘাড়ের চুলগুলো এক অজানা আশংকায় খাড়া হয়ে গেলো। সে জানতো টানেলের শেষ প্রান্তে প্যারিসের সবচাইতে রহস্যময় মনুমেন্টটি অবস্থিত-১৯৮০তে স্ফিংসর নিজের ধারণায়, মানে ফ্রাসোয়া মিরোর অনুমোদনে তৈরি হয়েছিলো, যার সম্পর্কে গুজব ছিলো যে, তিনি গুপ্ত সংঘে যোগ দিয়েছিলেন।

আরেকটি জীবনকাল।

সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে ল্যাংডন সেই পথ থেকে বেড়িয়ে অতি পরিচিত প্রাঙ্গণে এসে থামলো। নিঃশ্বাসহীন, অবিশ্বাসে নিজের সামনে থাকা চকে স্থাপত্যের দিকে ভূরু তুলে তাকালো।

লুভর পিরামিড।

অন্ধকারে জ্বল জ্বল করছে।

সে কয়েকমুহূর্ত সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তার ডান দিকে যে জিনিসটা রয়েছে সেটার দিকেই বেশি আগ্রহী হলো। ঘুরে দাঁড়িয়েই তার মনে হলো তার পা দুটো আবার প্রাচীন রোজলিন লাইনের অদৃশ্য পথের খোঁজে চলতে শুরু করেছে। তাকে প্রাঙ্গণ পেরিয়ে কারুজেল দু লুভরর দিকে নিয়ে যাচ্ছে-ঘাসের তৈরি বড় একটা বৃত্ত, সেটার চারদিক ঘিরে রেখেছে আরেকটা বেড়া-এক সময়কার প্যারিসের প্রকৃতি পূজা উৎসবের জায়গা…আনন্দ উজ্জ্বল আচার অনুষ্ঠান করা হতো উর্বরতা আর দেবীদের নিবেদন করে।

ঘাসের এলাকাটায় প্রবেশ করতেই ল্যাংডনের মনে হলো সে অন্য একটা পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে। এই বিশাল চত্বরটা বর্তমানে শহরের সবচাইতে ন্নি ধরণের মনুমেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এখানের কেন্দ্রের মধ্যে, কাঁচের তীরের মতো বিধে আছে বিশাল আকৃতির একটা কাঁচের তৈরি উল্টো পিরামিড, যেটা সে কয়েকদিন আগে রাতের বেলায় লুভরের ভূ-গর্ভস্থ টানেলে প্রবেশ করার সময় দেখেছিলো।

লা পিরামিড ইনভার্সি।

অনেকটা টলতে টলতে ল্যাংডন লুভরের ভূ-গর্ভস্থ কপ্লেক্সে প্রবেশ করলো। অ্যাম্বার লাইটের আলোয় জায়গাটা ঘোলাটে লাগছে। তার চোখে শুধু উল্টো পিরামিডটাই ধরা পড়লো না বরং সেটার একেবারে নিচে যা ছিলো সেটাও। এখানে ফ্লোরের নিচে যে কক্ষটা আছে সেখানে একটা ক্ষুদ্র স্থাপত্য রয়েছে…যে স্থাপত্যের কথা ল্যাংডন তার লেখায় উল্লেখ করেছে।

অচিন্ত্যনীয় সম্ভাবনার রোমাঞ্চে ল্যাংডনের মনে হলো সে পুরোপুরি জেগে উঠেছে। লুতরের দিকে আবার চোখ তুলে তাকালো, তার মনে হলো জাদুঘরের বিশাল উইংগুলো তাকে জাপটে ধরছে…ওখানকার হলওয়েতে পৃথিবীর সবচাইতে সেরা শিল্পকর্মগুলো রাখা আছে।

দা ভিঞ্চি…বত্তিচেলি…

প্রসংশিত মাস্টারদের প্রিয় ছবিতে সে শায়িত আছে।

বিস্ময়ে সজীব হয়ে ওঠে সে আরেকবার কাঁচের ভেতর দিয়ে নিচে রাখা ক্ষুদ্র স্থাপত্যটার দিকে তাকালো।

আমাকে অবশ্যই নিচে যেতে হবে!

ওখান থেকে বের হয়ে সে প্রাঙ্গণটা পেরিয়ে লুভরের পিরামিডের প্রবেশপথের দিকে গেলো। সেই দিনের শেষ দর্শকটি বের হয়ে এলো জাদুঘর থেকে।

রিভলভিং দরজাটা ঠেলে ল্যাংডন পিরামিডের ভেতরের বাঁকা সিঁড়িটা দিকে অগ্রসর হলো। ঠাণ্ডা বাতাসটা টের পেলো সে। সিঁড়ির একেবারে নিচে এসে লুভরের প্রাঙ্গণের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া দীর্ঘ টানেলের ভেতরে প্রবেশ করলো এবার। লা পিরামিড ইনভার্সি র দিকে প্রত্যাবর্তন।

টানেলের শেষ মাথায় একটা বিশাল কক্ষের সামনে এসে পড়লো। সরাসরি তার সামনে, উপর থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে উল্টো পিরামিডটাকে-একটা শ্বাসরুদ্ধকর V আকৃতির কাঁচ।

পেয়ালা।

ল্যাংডন এটার সরু মাথাটা পর্যবেক্ষণ করে দেখলো, মাটি থেকে সেটা মাত্র ছফুট উঁচুতে আছে। এখানে, ঠিক তার নিচেই সেই ক্ষুদ্র স্থাপত্যটি রয়েছে।

পিমিডের একটা ছোট্ট সংস্করণ। মাত্র তিন ফুট লম্বা। এই কমপ্লেক্সের একমাত্র স্থাপত্য যা এতো ছোট আকারে তৈরি করা হয়েছে।

ল্যাংডনের লেখায়, যেখানে সে সুরের বিশাল দেবী চিত্রকর্মের সংগ্রহশালা সম্পকে আলোকপাত করেছে সেখানে এই সুন্দর পিমিড সম্পকে একটা নোট আছে। ছোট এই কাঠামোটি মাটিতে এমনভাবে উঠে এসেছে যেনো সেটা কোন হিমখণ্ডের ভেসে থাকা অংশ-বিশাল একটা পিরামিডিয় ভল্ট, লুক্কায়িত কক্ষের মতো ডুবে আছে যেনো।

ভেতরের নরম আলো জ্বলছে, দুটো পিরামিড একে অন্যের দিকে তাক করা, একই রেখায় অবস্থিত তারা, তদের মাথা প্রায় স্পর্শ করছে।

উপরে পেয়ালা। নিচে তলোয়ার।
তলোয়ার আর পেয়ালা তাঁর দরজা পাহারা দেয়।

ল্যাংডন ম্যারি শভেলর কথাটা শুনতে পেলো। একদিন এটা আপনার কাছে উদ্ভাসিত হবে।

সে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন রোজ লাইন রেখার নিচে, তার চারপাশ জুড়ে আছে মাস্টার শিল্পীদের চিত্রকর্ম। তদারকি করার জন্যে এর চেয়ে ভালো জায়গা সনিয়ের জন্য আর কি হতে পারতো? এখন শেষ পর্যন্ত তার মনে হচ্ছে, সে গ্র্যান্ড মাস্টারের পংক্তিটা বুঝতে পারছে। চোখ তুলে উপরের কাঁচের ভেতর দিয়ে দীপ্তিময় তারা ভরা রাতের দিকে তাকালো সে।

অবশেষে তারা ভরা আকাশের নিচে শায়িত আছে সে।

আঁধারের গুঞ্জনের মতো বিস্মৃত শব্দাবলী প্রতিধ্বণিত হলো। হলি গ্রেইলর সন্ধান

মানে ম্যারি মাগদালিন-এর দেহাবশেষের সামনে হাটু গেঁড়ে বসা। সমাজচ্যুত একজনের পায়ের সামনে বসে প্রার্থনা করার একটি সফর।

আচমকা এক শ্রদ্ধাভাবের উদয়ের ফলে রবটি ল্যাংডনের মনে হলো সে হাটু গেঁড়ে বসে পড়েছে।

অল্পক্ষণের জন্য সে একটা নারী কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলো…প্রজ্ঞার যুগ…পৃথিবীর গহ্বর থেকে উঠে আসলে একটা চাপা কণ্ঠ।

***

2 Comments
Collapse Comments

Wow !!

I am speechless, no word is not appropriate for this, price less writing, and I suppose those who never read this had missed something real BIG best regards to mr.dan brown.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *