উপন্যাস

১১. প্রাণ নিয়ে পালানো

প্রাণ নিয়ে পালানো

মর্মোন অবতারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পরের দিন সকালে সল্টলেক সিটিতে গিয়ে পরিচিত সেই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করল জন ফেরিয়ার। নেভাদা মাউন্টেন্স রওনা হচ্ছিল সে। তার মুখে খবর পাঠাল জেফারসন হোপের কাছে। সমূহ বিপদ। এখুনি যেন ফিরে আসে। খবর পাঠিয়ে হালকা মনে বাড়ি ফিরল জন।

খামারবাড়ির কাছাকাছি এসে অবাক হল ফটকের দু-পাশের পোস্টে দুটো ঘোড়া বাঁধা রয়েছে দেখে। আরও অবাক হল বসবার ঘরটা দু-জন যুবা পুরুষের দখলে গিয়েছে দেখে। একজনের মুখ লম্বাটে ধাঁচের, ফ্যাকাশে। দোলানো চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে দু-পা তুলে দিয়েছে স্টোভের ওপর, আর একজনের ঘাড়টা ষাঁড়ের ঘাড়ের মতো মোটা, মুখ চোখ ফুলোফুলো কর্কশ। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পকেটে দু-হাত গুঁজে একটা চলতি গানের সুর শিস দিয়ে গাইছে। ফেরিয়ার ঘরে ঢুকতে দু-জনেই মাথা হেলিয়ে অভিবাদন জানাল। তারপর কথা শুরু করলে চেয়ারে আসীন ছোকরা।

বললে, চিনতে পারছেন না নিশ্চয়। এ হল বয়স্ক ড্রেবারের ছেলে। আর আমি জোসেফ স্ট্যানজারসন। মনে পড়ছে? মরুভূমির মাঝে দয়ালু ঈশ্বর যখন দু-হাত বাড়িয়ে আপনাদের কোলে টেনে নিয়েছিলেন, তখন আপনাদের সঙ্গে যে ছিল সেই আমি।

সঙ্গী ছোকরা নাকিসুরে বললে, সবাইকে এইভাবেই কোলে টেনে নেবেন তিনি সব জাতের মানুষকে। ওঁর কাজ আস্তে হলে কী হবে–পাকা ব্যাপার।

জন ফেরিয়ারের চোখ-মুখ তখন শীতল বরফের মতোই কঠিন। কঠিন মুখে কেবল ঘাড় হেলিয়ে সায় দিলে। মক্কেল দু-জনের উদ্দেশ্য সে আঁচ করেছে।

স্ট্যানজারসন বললে, বাবাদের কথায় আমরা এসেছি আপনার মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে। দু-জনের মধ্যে যাকে হয় বেছে নিতে পারেন। ব্রাদার ড্রেবারের সাতজন স্ত্রী, আমার মোটে চারজন। কাজেই আমার দাবিই বেশি।

আরে না, না, ব্রাদার স্ট্যানজারসন, চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠল ড্রেবার! কার ক-জন বউ আছে, সেটা তো সমস্যা নয়–সমস্যা হল কে ক-জন বউকে পুষতে পারে। কারখানাটা আমাকে দিয়ে দিয়েছে বাবা। তার মানে তোমার চাইতে আমার রেস্ত এখন বেশি।

তেতে উঠে বললে অপরজন, কিন্তু আমার ভবিষ্যৎ তোমার চেয়ে ভালো। ভগবান আমার বাবাকে কাছে টেনে নিলেই আমি যে শুধু চামড়া ট্যান করার আর চামড়ার কারখানাই পাব তা নয়–তোমার বয়স্কও হব গির্জেতে অনেক উঁচু পদও পাব।

আয়নার নিজের চেহারাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে সপ্রতিভ কণ্ঠে বললে ড্রেবার তনয়, তাহলে কনেই বেছে নিক কাকে পছন্দ। সে যা বলবে তাই হবে।

দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ফুসছিল জন ফেরিয়ার। হাত নিশপিশ করছিল ঘোড়ার চাবুক দিয়ে দুই রাসকেলের পিঠ রক্তাক্ত করার জন্যে। অতিকষ্টে সামলে রেখেছিল নিজেকে।

এখন এগিয়ে এল দু-জনের সামনে। বললে কড়া গলায়, দ্যাখো ছোকরা আমার মেয়ে যদি ডাকে, তবে এস। তার আগে যেন এ-বাড়িতে আর কারো মুখ না-দেখি।

দুই তরুণ মর্মোন হাঁ করে চেয়ে রইল ফেরিয়ারের মুখের দিকে। জীবনে এত অবাক তারা কখনো হয়নি। বলে কী লোকটা! ওরা যে-মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, তার তত বর্তে যাওয়া উচিত? এর চাইতে বড়ো সম্মান এদেশে আর আছে নাকি?

এবার ফেটে পড়ল ফেরিয়ার, এ-ঘর থেকে বেরোনোর পথ দুটো—দরজা–আর জানালা। পছন্দ কোনটা?

দুই মূর্তিমান দেখলে গতিক সুবিধের নয়। জন ফেরিয়ারের বাদামি মুখে বন্য বর্বরতা ফুটে উঠেছে। দীর্ঘ শীর্ণ হাত দুটো নিশপিশ করছে। আর এক মুহূর্ত দেরি করা সমীচীন নয়। ছিটকে বেরিয়ে গেল দু-জনেই। পেছন পেছন দরজা পর্যন্ত গেল জন ফেরিয়ার।

বললে শ্লেষতীক্ষ গলায়, কোনটা পছন্দ নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিয়ে জানিয়ে আমাকে, কেমন?

এর ফল আপনাকে ভুগতে হবে! রাগে সাদা হয়ে বিকট চেঁচিয়ে বললে স্ট্যানজারসন, অবতারের কথা আর চার বয়স্কর নির্দেশ পায়ে ঠেলার ফল হাতেনাতে পাবেন। মরণকালেও ঠেলাটা টের পাবেন।

তাহলে আয় তোদের ঠেলাটা টের পাইয়ে দিই, দারুণ চেঁচিয়ে পেছন ফিরেই বন্দুক আনতে দৌড়াল ফেরিয়ার বাধা দিলে লুসি। জাপটে ধরে রইল বাবাকে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতেই ঘোড়ার খুরের আওয়াজ মিলিয়ে গেল দূরে। নাগালের বাইরে পালিয়েছে দুই মস্তান।

রাগে টগবগ করে ফুটতে ফুটতে গরজে উঠল ফেরিয়ার, শয়তান রাসকেল কোথাকার। ওদের হাতে তোকে দেওয়ার চাইতে কফিনে শুইয়ে দেওয়াও ভালো।

যা বলেছ। গলায় দড়ি দেব ওদের ঘরে যাওয়ার আগে, সমান তেজে বললে লুসি! কিন্তু মাথাটা ঠান্ডা করো তুমি। জেফারসন এসে গেল বলে।

যত তাড়াতাড়ি আসে ততই মঙ্গল। কবে যে কী ঘটবে বুঝতে পারছি না।

সত্যিই ওদের এখন পরামর্শ দরকার, সাহায্য দরকার। এ দুটি দিতে যে পারে এমন কেউ এখুনি যেন এসে দাঁড়ায় কাঠগোঁয়ার অথচ কষ্টসহিষ্ণু জন ফেরিয়ার আর তার পালিতা মেয়ের পাশে। উটার উপনিবেশের পত্তন হওয়ার পর থেকে এ-জাতীয় অবাধ্যতা কখনো ঘটেনি। বয়স্কদের আদেশ পায়ে মাড়িয়ে যাওয়ার এহেন সাংঘাতিক নজির কখনো দেখা যায়নি। লঘু পাপে যদি গুরু দণ্ড হয়ে থাকে, তাহলে এই অপরাধের শাস্তির নমুনাটা যে কী ধরনের হবে তা ভাবাও যায় না। অনেক নিগ্রহ লেখা আছে ডাকসাইটে এই বিদ্রোহীদের কপালে। টাকা দিয়ে এ-নিগ্রহ আটকানো যায় না। এর আগেও দেখা গেছে অনেক ধনবানদের কপাল পুড়েছে, রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে, ধনসম্পত্তি গির্জের খপ্পরে গিয়েছে। জন ফেরিয়ারও রেহাই পাবে না যত বোলোকই সে হোক না কেন সমাজে সে যত মান্যগণ্যই হোক না কেন–কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। ভীতু সে নয়, দুর্দান্ত সাহস তার অণু-পরমাণুতে–তা সত্ত্বেও একটা চাপা, অস্পষ্ট, ছায়া কালো করাল আতঙ্ক কুরে কুরে খাচ্ছে হৃদয়ের অন্তস্থল, শিহরন জাগছে প্রতিটি লোমকূপে। যে-বিপদ জানা আছে, সে-বিপদের সামনে দাঁড়াতে ভয় পায় না জন কেরিয়ার। কিন্তু এই উৎকণ্ঠা অসহ্য। স্নায়ু কাপছে সেই কারণেই। মেয়ের কাছে অবশ্য মনের ভয় লুকিয়ে গেল জন। যেন কিছুই ঘটেনি, মুখে এমনি একটা হালকাভাব দেখালেও মেয়ের তীক্ষ্ণ্ণ নজরে এড়াল না কিছুই। স্পষ্ট দেখল, অস্বস্তি প্রকট হয়েছে ডাকাবুকো বাবার মুখেও।

জন আশা করেছিল তার এই আচরণের জবাব দেবে ইয়ং! হয় হুমকি, নয় ভৎর্সনা আসবে পত্রবাহক মারফত। সত্যিই তা এল এবং অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল বুকের ওপর গায়ের চাপায় একটা চৌকো কাগজ পিন দিয়ে আটকানো। তাতে আঁকাবাঁকা বড়ো বড়ো হরফে লেখা :

উনত্রিশ দিন দেওয়া হল প্রায়শ্চিত্তের জন্য। তারপর—

শেষের ওই ড্যাশটাই সবচেয়ে আতঙ্ক-উদ্রেককারী, বিশ্বের করালতম বিভীষিকাও বুঝি তুচ্ছ সামান্য ওই ড্যাশটুকুর তুলনায়। হুমকিটা ঘরের মধ্যে এল কী করে কিছুতেই বুঝে উঠল

জন ফেরিয়ার। চাকরবাকর তো সব ঘুমোয় আউট হাউসে দরজা জানালা ভেতর থেকে বন্ধ। কাগজটা দলা পাকিয়ে ফেলে দিল জন–বেমালুম চেপে গেল মেয়ের কাছে। কিন্তু কলজে পর্যন্ত হিম হয়ে গেল এই ঘটনায়। তিরিশ দিন সময়ের বাকি রইল মাত্ৰ উনত্রিশটি দিন। ইয়ংয়ের দেওয়া সময়সীমা থেকে বাদ গেল একটি দিন। যে-শত্রু এহেন রহস্যময় শক্তির অধিকারী, তার সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো সরঞ্জাম বা সাহস তো জন ফেরিয়ারের নেই। যে-হাত রাত্রিনিশীথে ওই কাগজ পিন আটকে গেঁথে দিয়ে গেছে বুকের ওপর অনায়াসে সেই হাত একটা ছোরাও গেঁথে দিয়ে যেতে পারত হৃৎপিণ্ডের মধ্যে। জন ফেরিয়ার জানতেও পারত না মৃত্যু হল কার হাতে।

পরের দিন সকালে বুক ছাঁৎ করে উঠল আবার একটা ঘটনায়। এবার বুক কাঁপল আরও বেশি। প্রাতরাশ খেতে বসেছিল বাপ বেটিতে। ওপরে তাকিয়ে আচমকা সবিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল লুসি। চোখ তুলল জন ফেরিয়ার। দেখল ঘরের কড়িকাঠে সম্ভবত পোড়া কাঠ দিয়ে লেখা শুধু একটি সংখ্যা–২৮। মেয়ে অবশ্য মানেটা বুঝল না, বাবাও ব্যাপার ভাঙল না। সেই রাতেই বন্দুক নিয়ে বসে রইল পাহারায়। চোখে কিছু পড়ল না, কানেও কিছু ভেসে এল না । অথচ ভোরবেলা দরজা খোলার পর দেখলে পাল্লায় বড়ো বড়ো আকারে রং দিয়ে লেখা–২৭।

এইভাবে গড়িয়ে চলল একটার পর একটা দিন! এক-একটা রাত ভোর হয়েছে, চোখ রগড়ে জন ফেরিয়ার আবিষ্কার করেছে অদৃশ্য শত্রু বাড়ির কোথাও-না-কোথাও বেশ দৃষ্টিগোচর স্থানে লিখে রেখেছে বাকি দিনের বিজ্ঞপ্তি, মাস ফুরোতে আর কটা দিন বাকি তার হিসেব। মৃত্যু সংখ্যা কখনো আবির্ভূত হয়েছে মেঝেতে, কখনো দেওয়ালে, কখনো বাগানের ফটকে সাঁটা পোস্টারে। চৌপর দিন রাত হুঁশিয়ার থেকেও কিছুতেই জন ফেরিয়ার দেখতে পেল না বিজ্ঞপ্তিগুলো লটকে যাচ্ছে কে, কখন, কীভাবে। নিঃসীম আতঙ্ক ধীরে ধীরে গ্রাস করতে লাগল বেচারিকে। একটা অবোধ্য কুসংস্কারের মতোই বিকট ভয় পেঁচিয়ে ধরতে লাগল মনটাকে প্রতিদিন সংখ্যাগুলো দেখবার পরেই। কিন্তু আর কিছুই করার নেই। অসহায় শিকারকে শিকারি যখন তাড়া করে, তখন তার যে অবস্থা হয়–জন ফেরিয়ারের অবস্থা এখন তাই। উদ্ভান্ত, অস্থির, ভয়ার্ত। জীবনে তার বাঁচবার আশা, এখন একটাই—নেভাদা থেকে তরুণ শিকারীর প্রত্যাবর্তন।

বিশ হলো পনেরো, পনেরো এসে দাঁড়াল দশে পাত্তা নেই জেফারসন হোপের। দিনে দিনে কমে আসছে দিনের সংখ্যা, টিকি দেখা গেল না ডাকাবুকো সেই ছোকরার। বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে ঘোড়সওয়ার ছুটে গেলে অথবা গাড়ি-চালকের হাঁকডাক শুনলেই গেটের কাছে দৌড়ে আসত বৃদ্ধ কৃষক, ভাবত বুঝি এসে গেছে ত্রাতা জেফারসন। কিন্তু হাল ছেড়ে দিল যখন দেখল পাঁচ হল চার, চার থেকে তিন। আশা আর নেই, পরিত্রাণের কোনো পথ তার নেই। যে-পাহাড়ের সারি ঘিরে রেখেছে এই উপনিবেশ সে-পাহাড়ের পথ জন। ফেরিয়ারের কাছে একরকম অজানাই বলা চলে। তার ওপর সে একা। পারবে কেন অদৃশ্য অথচ সজাগ শত্রুর সঙ্গে? যে-রাস্তায় যানবাহন পথচারীর ভিড় বেশি, চার বয়স্কর হুকুমে সেইখানেও এখন পাহারা মোতায়েন হয়েছে, অনুমতি ছাড়া বেরোনোর পথ বন্ধ। শিরে উদ্যত খঙ্গর কোপ থেকে বাঁচবার পথ কোনোদিকেই নেই। তা সত্ত্বেও এ-রকম একটা সঙিন পরিস্থিতিতেও, আপন সংকল্পে অবিচল রইল জন ফেরিয়ার। জীবন যায় যাক, মেয়েকে জলে ফেলবে না।

একদিন রাত্রে ঘরে বসে এই সব সমস্যায় তন্ময় রয়েছে জন। সেদিন সকালে ২ সংখ্যাটির বিজ্ঞপ্তি দেখা গিয়েছে বাড়িতে। আগামী কাল দেখা দেবে ১। তার মানে নির্ধারিত সময়সীমার শেষ দিবস। তারপর কী হবে আর ভাবতে পারছে না বৃদ্ধ। অনেকরকম ছায়া-কালো আবছা আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে মনকে। নিজের প্রাণের পরোয়া সে করে না। কিন্তু তার মৃত্যুর পর মেয়ের কপালে কী আছে কেউ তা জানে না। অদৃশ্য এই জালের মধ্যে থেকে মুক্তির পথ কী কোথাও নেই? এ কী দয়ে পড়েছে জন ফেরিয়ার! নিজের অসহায় অক্ষমতার কথা ভেবে জীবনে এই প্রথম টেবিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল দুর্দান্ত লোকটা।

কিন্তু একী? নিশীথ রজনীতে চারদিক নিথর নিস্তব্ধ। তার মধ্যে কোত্থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল না? খুব আলতোভাবে কে যেন কী আঁচড়াচ্ছে। ক্ষীণ হলেও নিশুতি-রাতে সে-শব্দ অতি স্পষ্ট। শব্দটা আসছে সদর দরজা থেকে। হল ঘরে বেরিয়ে এসে কান পেতে শুনতে থাকে ফেরিয়ার। কিছুক্ষণ বিরতি। তার পরেই অতি ক্ষীণ, কপট শব্দটা নতুন করে ধ্বনিত হল দোরগোড়ায়। দরজার কাঠে কে যেন অতি সন্তর্পণে টোকা মারছে। গুপ্ত বিচারালয়ের মৃত্যুদণ্ড দিতে গুপ্তঘাতক আসেনি তো? শেষ দিনের সংখ্যা লিখতেও কেউ আসতে পারে। জন ফেরিয়ার আর সহ্য করতে পারল না। পল অনুপলের এই ধিকি ধিকি উৎকণ্ঠায় স্নায়ু ধ্বংস করার চাইতে একেবারেই সব শেষ হয়ে যাক। লাফিয়ে গিয়ে এক ঝটকায় খিল নামিয়ে লাথি মেরে দরজা দু-হাট করে দিল জন ফেরিয়ার।

বাইরে বড়ো শান্তির রাজ্য। নিথর নিস্তব্ধ। আকাশ পরিষ্কার, রজনী নিরুপদ্রব গগনে তারার ঝিকিমিকি। বেড়া আর ফটক নিয়ে ঘেরা ছোট্ট বাগানে কেউ নেই। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে নিয়ে পায়ের দিকে চোখ নামাতেই জন চমকে উঠল বিষমভাবে। মুখ থুবড়ে সটান শুয়ে একটা লোক–দু-হাত ছড়ানো সামনে, পা পেছনে।

জন ফেরিয়ার এমন আঁতকে উঠল এই দৃশ্য দেখে যে আর একটু হলেও বুকফাটা চিৎকার বেরিয়ে আসত গলা দিয়ে। অতি কষ্টে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দু-হাতে নিজের গলা টিপে ধরে চিৎকারটাকে আটকে রাখল গলার মধ্যে। প্রথমে ভেবেছিল সাংঘাতিকভাবে জখম বা মুমূর্ষু কেউ বোধ হয় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে ওইভাবে। কিন্তু একটু ভালো করে দেখতে গিয়ে লক্ষ করল, অবিকল সাপের মতো নিঃশব্দে, চকিতে সাঁৎ করে ঘরের মধ্যে এঁকেবেঁকে ঢুকে পড়ল আগন্তুক এবং বাড়ির ভেতরে ঢোকার সঙ্গেসঙ্গে তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে পাল্লা দুটো বন্ধ করে দিয়ে ফিরে দাঁড়াল জন ফেরিয়ারের সামনে। সংকল্প-কঠিন ভীষণাকৃতি এই মুখের অধিকারী পৃথিবীতে একজনই আছে–জেফারসন হোপ।

জয় ভগবান। দম আটকানো গলায় বললে জন ফেরিয়ার।আচ্ছা ভয় দেখাও তো তুমি? এভাবে আসার কী দরকার ছিল শুনি?

ভাঙা গলায় বললে হোপ আগে কিছু খেতে দিন। আটচল্লিশ ঘণ্টা পেটে দানাপানি দেওয়ারও সময় পাইনি। বলতে বলতে লাফ দিয়ে গিয়ে বসল টেবিলে। ফেরিয়ারের রাতের খাবার তখনও সাজানো। গোগ্রাসে গিলতে লাগল ঠান্ডা মাংস আর রুটি। পেটের জ্বালা কমবার পর বললে, লুসি ভালো আছে তো?

আছে। কী বিপদ নিয়ে দিন কাটাচ্ছি, ও তা জানে না।

শাবাশ। এ-বাড়ির চারদিকেই পাহারা। সেইজন্যেই আসতে হল এইভাবে। চোখ ওদের ছুঁচের মতো ধারালো হতে পারে, কিন্তু ওয়াশু শিকারীকে ধরার মতো চোখ ওদের নেই।

এইরকম একজন অনুরক্ত স্যাঙাতকে পাশে পেয়ে নিমেষে চাঙা হয়ে উঠল জন ফেরিয়ার। জেফারসনের দড়ির মতো পাকানো হাত চেপে ধরে বললে আবেগ ভরে, এই দুর্দিনে পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ আজ নেই–তুমি ছাড়া। তমার জন্যে সত্যিই আমার গর্ব হয়।

আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আপনার জন্যে তো এই বিপদে মাথা গলাইনি আমি–এসেছি লুসির জন্যে। তার গায়ে আঁচ লাগলে জানবেন হোপ ফ্যামিলির একজনের লাশ পড়ে থাকবে এই উটায়।

কী করা যায় বল তো?

কালকেই শেষ দিন। আজ রাতে না-বেরোতে পারলে আর পারবেন না। ইগল র্যাভিনে একটা অশ্বতর আর দুটো ঘোড়া বেঁধে রেখে এসেছি। সঙ্গে কত টাকা আছে আপনার?

মোহরে দু-হাজার ডলার, নোটে পাঁচ হাজার।

ওতেই হবে। সমান টাকা আমার কাছেও আছে! পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে কার্সন সিটি° যাব ঠিক করেছি! লুসিকে জাগান। ভাগ্যিস চাকরবাকর বাড়ির ভেতরে ঘুমোয় না।

ফেরিয়ার গেল মেয়েকে জাগাতে। সেই ফাঁকে হাতের কাছে যা পেল, তাই দিয়ে খাবারদাবারের একটা পোঁটলা বাঁধল জেফারসন। জল নিল পাথরের কুঁজোয়। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরে বলেই সে জানে পথে কুয়োর সংখ্যা খুব বেশি নেই। থাকলেও খুব দূরে দূরে। পোঁটলাপুটলি বাঁধা শেষ হতে-না-হতেই মেয়েকে বাইরে বেরোনোর পোশাক পরিয়ে নিয়ে এসে গেল ফেরিয়ার। সময় খুব কম। প্রতিটি মুহূর্ত অমূল্য। কিন্তু কাজ অনেক। তাই দীর্ঘ বিরহের পর দু-জনের আবেগ উষ্ণ মিলন সাঙ্গ হল সংক্ষেপে।

এক্ষুনি বেরোতে হবে। শান্ত, কিন্তু দৃঢ় স্বর জেফারসন হোপের। বিপদের গুরুত্ব সে উপলব্ধি করেছে, বুককেও সেই অনুপাতে শক্ত করে তুলেছে। ওরা নজর রেখেছে সদর দরজা আর খিড়কির দরজায়। কিন্তু পাশের জানালা দিয়ে খেতের মধ্যে যাওয়া যাবে। রাস্তায় পৌঁছে আরও দু-মাইল গেলেই র্যাভিন ঘোড়া রয়েছে সেখানে। ভোর নাগাদ পাহাড়ের মাঝামাঝি পৌঁছে যাব।

যদি পথ আটকায়? ফেরিয়ার শুধোয়।

হোপের হাফ হাতা হাঁটু পর্যন্ত ঝোলানো ঢিলে পোশাকের সামনে উঁকি দিচ্ছিল রিভলবারের কুঁদোটা। সস্নেহে তাতে চাপড় মেরে বলল নূর হেসে, দলে ভারী থাকলে দু-তিন জনকে সঙ্গে নিয়ে যাব।

বাড়ি সব আলো নেভানো। অন্ধকার জানলা দিয়ে পাশের খেতের দিকে তাকাল জন ফেরিয়ার। এ-খেত তার নিজের। কিন্তু জন্মের মতো ছেড়ে যেতে হবে আজ। অবশ্য অনেকদিন ধরেই সব ফেলে যাওয়ার জন্যে মনকে সে তৈরি করেছে। মেয়ের সুখ আর সম্মানের জন্য সমস্ত সম্পদ জলাঞ্জলি দিতেও সে প্রস্তুত। যেদিকে দু-চোখ যায় কেবল সুখ আর শান্তির ছবি। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে গাছের মধ্যে দিয়ে। মর্মরধ্বনি আর দুরবিস্তৃত শস্যক্ষেত্রের কোথাও এতটুকু মৃত্যুর কালো ছায়া নেই। আঁচ করাও যায় না কৃপাণ নিয়ে গুপ্তঘাতকের দল ওত পেতে রয়েছে আশেপাশে রক্তস্রোতে এই সুন্দর দৃশ্য কলঙ্কিত করার জন্যে। জেফারসনের নীরক্ত দৃঢ়সংবদ্ধ মুখেই কেবল আসছে সেই লক্ষণ–তারা আছে—আশেপাশে ঘাপটি মেরে রয়েছে–আসবার পথে স্বচক্ষে তা দেখেছে বলেই মাথা তার এত ঠান্ডা।

সোনার মোহর আর নোটের থলি ঘাড়ে নিল ফেরিয়ার, জেফারসন নিল জলের কুঁজো আর খাবারের পুঁটলি। লুসি নিল নিজের খুব দামি আর দরকারি কিছু জিনিসপত্রের একটা বান্ডিল। জানালা খুলে অপেক্ষায় রইল একটা কালো মেঘে রাতের অন্ধকারে আরও নিবিড় না-হওয়া পর্যন্ত। তারার আলোও যখন ঢাকা পড়ল মেঘের আড়ালে, জানলা গলে নেমে এল বাগানে। হেঁট হয়ে মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়ে নিরুদ্ধ নিশ্বাসে ঝোঁপের আড়ালে গা ঢেকে পৌঁছোল শস্যখেতের ধারে। একটা ফাঁকের মধ্যে দিয়ে এখন ঢুকতে হবে খেতের মধ্যে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে দু-হাতে বাপ বেটিকে চেপে ধরে জোর করে ছায়ার মধ্যে শুইয়ে দিল শিকারি জেফারসন নিজেও শুয়ে পড়ল মাঝে–কম্পিত দেহে কিন্তু নিঃশব্দে পড়ে রইল মড়ার মতো।

মাঠেঘাটে প্রান্তরে টো-টো করার ফলে বুনো বেড়াল লিংকসের মতোই তীক্ষ্ণ্ণ কান পেয়েছে জেফারসন। মাটিতে পড়তে-না-পড়তেই একটা নিশাচর পাহাড়ি পঁাচা বিষাদ কণ্ঠে ডেকে উঠল মাত্র কয়েক গজ দূরে। সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিল আর একটা প্যাচার ডাক–সামান্য তফাতে। তারপরেই একটা ছায়ামূর্তির আবছা দেহরেখা আবির্ভূত হল শস্যখেতের সেই ফাঁকটার মধ্যে থেকে এই ফাঁকেই চুপিসারে ঢুকতে যাচ্ছিল জেফারসন। আবার হাহাকার করে উঠল পাচার ডাক–ডাকছে ছায়ামূর্তি–সংকেতধ্বনি। আঁধারের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল আর একটা ছায়াকালো পুরুষ মূর্তি।

প্রথম জন বললে কর্তৃত্বব্যঞ্জক কণ্ঠে, কালকে মাঝরাতে–নিশাচর পাখি হুইপারউইল তিনবার ডাকবার সঙ্গেসঙ্গে।

ঠিক আছে। ব্রাদার ড্রেবারকে জানিয়ে দেব? বললে দ্বিতীয় জন।

দাও। ব্রাদার ড্রেবার যেন সবাইকে বলে দেয়। নাইন টু সেভেন।

সেভেন টু ফাইভ। একই সুরে প্রতিধ্বনি করল দ্বিতীয় ব্যক্তি। দু-দিকে সরে গেল দুজনে। শেষ কথাগুলো নিশ্চয় সংকেত আর পালটা-সংকেত। পায়ের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে বুনো বেড়ালের মতো লাফিয়ে উঠল জেফারসন। বাপ বেটিকে টানতে টানতে ঢুকে পড়ল ফাঁকটার মধ্যে এবং পুরোদমে ছুটতে লাগল হেঁট হয়ে। লুসির দম ফুরিয়ে গেলে মাঝে মাঝে পাঁজাকোলা করে তুলে নিতেও কসুর করল না।

হাঁপাতে হাঁপাতে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর একটা কথাই কেবল শোনা গেল কণ্ঠে তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি! সান্ত্রিদের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছি খেয়াল থাকে যেন! তাড়াতাড়ি না-করলে বেরোতে পারব না। চটপট!

হাইরোডে পৌঁছে আরও বেগে চলল তিন মূর্তি। একবারই দূর থেকে দেখা গেল একজনকে আসতে–সঙ্গেসঙ্গে লুকিয়ে পড়ল ছায়ায়–পাছে চিনে ফেলে তাই। শহরে পৌঁছনোর আগে একটা সরু এবড়োখেবড়ো পায়ে চলা রাস্তা গিয়েছে পাহাড়ের দিকে। জেফারসনের মোড় ঘুরল সেই পথে। অন্ধকারের মাঝে অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে একজোড়া খোঁচা খোঁচা পাহাড়ের চুড়ো–গলিপথ শেষ হয়েছে ইগল গিরিপথের সামনে। ঘোড়া দাঁড়িয়ে সেখানে। পথঘাট জেফারসনের নখদর্পণে। বিরাট বিরাট পাথরের চাই পাশ কাটিয়ে, একবার একটা শুকনো পাহাড়ি নদীর খাত পেরিয়ে এঁকেবেঁকে নানান দুর্গম খানাখন্দ পেরিয়ে এসে পৌঁছলো একটা নিভৃত অঞ্চলে। চারদিকে উঁচু পাথর পাঁচিলের মতো সাজানো। বাইরে থেকে দেখা যায় না। বিশ্বস্ত পশুগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে সেখানে মনিবের ফিরে আসার প্রতীক্ষায়। অশ্বতরের পিঠে, বসানো হল লুসিকে। বুড়ো ফেরিয়ার বসল দুটো ঘোড়ার একটার পিঠে, সঙ্গে রইল টাকার থলি। আর একটা ঘোড়া হাঁকিয়ে বিপজ্জনক খাড়াই পথে এগিয়ে গেল জেফারসন হোপ।

প্রকৃতির উদ্দাম মেজাজের সঙ্গে পরিচয় যার নেই, এ-পথ তাকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। একদিকে হাজার ফুট মাথা তুলে রয়েছে একটা খাড়া এবড়োখেবড়ো বিরাট পাহাড়–তারও বেশি হওয়া বিচিত্র নয়। কালো, কঠিন, রক্ত-হিম করা আগ্নেয়শিলার সুদীর্ঘ থামগুলো অমসৃণ ধারালো যেন প্রস্তরীভূত অতিকায় দানবের শিলাময় পঞ্জর। আর একদিকে বিরাট বিরাট আলগা পাথরের চাই আর আজেবাজে জিনিস এমনভাবে বিক্ষিপ্ত যে এগোনো অসম্ভব। এই দুইয়ের মাঝ দিয়ে সংকীর্ণ পথটা এতই সংকীর্ণ যে মাঝে মাঝে তিনজনকে সামনে পেছনে লাইন দিয়ে যেতে হচ্ছে–পাশাপাশি যাওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়; অভ্যেস না-থাকলে এ-পথ মাড়ানোর দুঃসাহস কারো হয় না–এগোনোর প্রশ্নই ওঠে না। তিন পলাতকের কিন্তু বুক কাঁপছে না বরং ফুর্তিতে প্রাণ নেচে উঠছে। যতই ঢুকছে বিষম বিপদসংকুল ভয়ংকর পথের গভীরে, ততই হালকা হয়ে যাচ্ছে বুকের পাষাণ-ভার কেননা পেছনে-ফেলে-আসা দুঃস্বপ্নসম ওই স্বৈরতন্ত্র ক্রমশই দূর হতে দূরে চলে যাচ্ছে কদম কদম এগিয়ে চলার সঙ্গেসঙ্গে।

সাধুদের এলাকা যে ফুরোয়নি, সে-প্রমাণ পাওয়া গেল অচিরে। সবচেয়ে খারাপ আর ধু-ধু বিজন অঞ্চলে পৌঁছেই আচমকা ওপরে আঙুল তুলে সভয়ে চেঁচিয়ে উঠল লুসি। সরু রাস্তাটার প্রায় মাথার ওপর ঝুঁকে থাকা পেল্লায় পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বন্দুকধারী একজন সান্ত্রি, নির্মেঘ আকাশের বুকে সুস্পষ্ট তার দেহরেখা। আগুয়ান তিন মূর্তিকে সে-ও দেখেছে। সামরিক কায়দায় হাঁক দিয়েছে–কে যায়? নিস্তব্ধ গিরিসংকটে পুরুষ কণ্ঠের সেই রক্ত-জল-করা চিৎকার ধ্বনি আর প্রতিধ্বনির লহরি তুলে মিলিয়ে গেল দূরে।

জিনে ঝোলানো রাইফেলে হাত রেখে জেফারসন হোপ বললে, নেভাদার অভিযাত্রী।

অন্ধকারেও দেখা গেল বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল রেখেছে নিঃসঙ্গ প্রহরী। জবাবটা যে সন্তোষজনক হয়নি, ঝুঁকে পড়ার ধরনেই তা সুস্পষ্ট।

কার হুকুমে?

চার বয়স্কর হুকুমে জবাব দিল ফেরিয়ার। মর্মোনদের কাছ থেকে সে জানে সান্ত্রির কাছে। মন্ত্রের মতো কাজ করে চার বয়স্কর নাম।

নাইন টু সেভেন, হেঁকে উঠল সান্ত্রি।

সেভেন টু ফাইভ, ঝটিতি জবাব দিল জেফারসন হোপ। বাগানের অন্ধকারে সংকেত আর পালটা সংকেত এখনও লেগে রয়েছে তার কানে।

যান। ঈশ্বর কৃপায় পথ নির্বিঘ্ন হোক, মাথার ওপর থেকে ভেসে এল কণ্ঠস্বর। এখান থেকেই রাস্তা অনেক চওড়া গিয়েছে। কদম চালে আস্তে আস্তে দৌড়ে চলল তিন ঘোড়া আর অশ্বতর। পেছন ফিরতে দেখা গেল বন্দুকে ভর দিয়ে নির্নিমেষে তাকিয়ে প্রহরী। কিন্তু আর ভয় নেই। ঈশ্বরের মনোমতো সন্তানদের সর্বশেষ পাহারায় ঘাঁটি এখন পেছনে সামনে মুক্তির পথ।