১০. সাইলাস টেম্পল চার্চের কাছে

৯১.

সাইলাস টেম্পল চার্চের কাছেই পার্ক করা জাগুয়ার লিমোজিনটার পেছনের সিটে বসে আছে। টিবিংকে এখানে নিয়ে এসে পেছনের ট্রাংক থেকে পাওয়া দড়িগুলো দিয়ে রেমি তাকে বেঁধে ফেলে রেখেছে। কি-স্টোনটার ওপর হাত বুলাতে বুলাতে সাইলাস রেমির জন্য অপেক্ষা করছে।

অবশেষে, রেমি এসে সামনের ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো, সাইলাসের পাশে।

সব ঠিক আছে? সাইলাস জিজ্ঞেস করলো।

রেমি মিটিমিটি হেসে বৃষ্টির পানি ঝাড়ার জন্যে মাথা ঝাঁকালো। ঘাড় বেকিয়ে হাত-পা-মুখ বাঁধা রিয়ারের নিচে পড়ে থাকা টিবিংয়ের দিকে তাকালো সে। তিনি কোথাও যাচ্ছেন না।

সাইলাস টিবিংয়ের গোঙানী শুনতে পেলো, বুঝতে পারলো, পুরনো ডাক্ টেপগুলো দিয়ে ওঁর মুখ আঁটকে দেয়া হয়েছে।

ফামে তা গুয়েলে! রেমি টিবিংকে চিৎকার করে বললো। কন্ট্রোল প্যানেলের একটা বোতাম টিপলো সে। পেছনের সিট থেকে সামনের সিটের মধ্যে একটা দেয়াল উঠে গেলো। টিবিং দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে তার কণ্ঠটাও নিরব হয়ে গেলো।

সাইলাসের দিকে তাকালো রেমি। আমি তাঁর তর্জন-গর্জন অনেকদিন ধরেই সহ্য করে এসেছি, আর নয়।

 

মিনিটখানেক পর, জাগুয়ারটা চলতে শুরু করতেই সাইলাসের ফোনটা বেজে উঠলো। টিচার। সে উত্তেজিত হয়ে জবাব দিলো। হ্যালো?

সাইলাস, টিচারের অতি পরিচিত ফরাসি উচ্চারণ। তোমার কণ্ঠটা শুনতে পেরে খুব স্বস্তিবোধ করছি। তার মানে, তুমি এখন নিরাপদে আছে।

সাইলাসও টিচারের কণ্ঠটা শুনে আরাম বোধ করলো। কয়েক ঘণ্টা ধরে অপারেশনটা বেশ এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত, মনে হচ্ছে, সবকিছু আবার পরিকল্পনা মতোই এগুচ্ছে। কি-স্টোনটা এখন আমার কাছে।

এটাতো অসাধারণ একটা সংবাদ, টিচার তাকে বললেন। রেমি কি তোমার সাথে আছে?

সাইলাস খুব অবাক হলো টিচারের মুখে রেমির নামটা শুনতে পেয়ে। হ্যাঁ, রেমিই আমাকে মুক্ত করেছে।

যেমনটি আমি তাকে আদেশ করেছিলাম। আমি খুব দুঃখিত, তোমাকে দীর্ঘ সময় ধরে বন্দী থাকতে হয়েছে।

শারীরিক কষ্ট কোন ব্যাপারই না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কি-স্টোনটা এখন আমাদের হাতে।

হ্যাঁ। আমি চাই, সেটা এক্ষুণি আমার কাছে দিয়ে দাও। সময়টা খুবই মূল্যবান।

সাইলাস শেষ পর্যন্ত টিচারের সাথে মুখোমুখি দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলো। হ্যাঁ, স্যার, আমি খুবই সম্মানিত বোধ করবো।

সাইলাস, আমি চাইছি রেমি সেটা আমার কাছে নিয়ে আসুক।

রেমি? সাইলাস আকাশ থেকে পড়লো। টিচারের জন্য এতো কিছু করার পর, তার বিশ্বাস হয়েছিলো, সে-ই এই মূল্যবান সম্পদটা হস্তান্তর করবে। টিচার দেখি রেমিকেই বেছে নিচ্ছেন?

আমি তোমার হতাশাটা বুঝতে পারছি, টিচার বললেন। তার মানে, তুমি আমার কথার অর্থটা বুঝতে পারছে না।

তিনি কণ্ঠটা নিচে নামিয়ে ফিসফিস্ করে বললেন। তোমাকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে, আমি তোমার হাত থেকেই কি-স্টোনটা নিতে বেশি পছন্দ করতাম একজন অপরাধীর চেয়ে বরং ঈশ্বরের একজন বান্দাকেই বেশি পছন্দ করা ভালো কিন্তু, রেমিকেই কাজটা করতে হবে। সে আমার আদেশ অমান্য করে আমাদের পুরো মিশনটাকে মহা বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

সাইলাস একটা বিপদ আঁচ করতে পেরে রেমির দিকে তাকালো। টিবিংকে অপহরণ করাটা পরিকল্পনার কোন অংশ ছিলো না। আর তাকে নিয়ে কী করা হবে, সেটা নতুন একটা সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

তুমি আর আমি হলাম ঈশ্বরের বান্দা, টিচার ফিসৃফিস্ করে বললেন। আমরা আমাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হতে পারি না। দীর্ঘ বিরতি নেমে এলো। শুধুমাত্র, এই কারণেই, আমি রেমিকে বলেছি কি-স্টোনটা নিয়ে আসতে। তুমি কি বুঝতে পেরেছো?

সাইলাস টিচারের কণ্ঠে রাগের বর্হিপ্রকাশটা টের পেয়ে অবাকই হলো। তার চেহারাটা দেখতে পাওয়াটা আর এড়ানো যাবে না। সাইলাস ভাবলো। রেমি যা করার তা করেছে। কি-স্টোনটা রক্ষা করেছে সে। বুঝতে পেরেছি, সাইলাস বললো।

ভালো। তোমার নিজের নিরাপত্তার জন্যেই, এক্ষুণি তুমি রাস্তায় নেমে পড়ো। পুলিশ খুব জলদিই লিমোজিনটা খুঁজতে শুরু করবে। আর আমি চাই না, তুমি ধরা পড়ো। লন্ডনে ওপাস দাইর একটা আবাস আছে না?

অবশ্যই আছে।

তোমাকে সেখানে স্বাগতম।

একজন ভাই হিসেবে।

তাহলে, সবার নজর এড়িয়ে ওখানে চলে যাও। কি-স্টোনটা হাতে পাবার পর তোমাকে আমি ফোন করবো।

আপনি কি লন্ডনেই আছেন?

আমি যা বলছি, তা-ই করো, সবকিছু ঠিক মতোই হবে।

জ্বি, স্যার।

টিচার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, যেনো এখন তাকে যে কাজটা করতে হবে, সেটা খুবই অপছন্দের একটি কাজ।

রেমিকে দাও, তার সাথে কথা বলবো।

সাইলাস ফোনটা রেমিকে দিলো। আঁচ করতে পারলো, এই ফোনটাই হয়তো রেমি লেগালুদেকের জীবনের শেষ ফোন।

***

রেমি ফোনটা হাতে নিতেই বুঝতে পারলো, বেচারা, এই ক্ষতবিক্ষত পাত্রীর কোন ধারণাই নেই তার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে।

টিচার তোমাকে ব্যবহার করেছে, সাইলাস। আর তোমার বিশপ হলেন দাবার একটি খুঁটি।

রেমি টিচারের ছেলে-ভোলানো ক্ষমতায় খুবই অবাক হলো, বিশপ আরিজারোসা সব কিছুই বিশ্বাস করেছেন। তিনি তার নিজের মরিয়া আচরণের জন্যে অন্ধ হয়ে গেছেন। আরিজারোসা এতোটাই উদগ্রীব যে, বিশ্বাস না করে পারেননি। যদিও রেমি টিচারকে পছন্দ করে না, তারপরেও, লোকটার আস্থাভাঁজন হয়ে, তার জন্যে কাজ করতে পেরে সে গর্বিত। আমি আমার পারিশ্রমিক পেতে যাচ্ছি।

খুব মনোযোগ দিয়ে শোনো, টিচার বললেন। সাইলাসকে ওপাস দাইর আবাসিক ভবনে নিয়ে যাও, কয়েক রাস্তা আগেই তাকে নামিয়ে দিও। তারপর, সেন্ট জেম্স পার্কে চলে আসো। জায়গাটা পার্লামেন্ট ভবন আর বিগ বেনের কাছেই। তুমি হর্স গার্ড প্যারাডে গাড়িটা পার্ক করতে পারবে। আমরা সেখানেই কথা বলবো।

এই কথা বলেই তিনি লাইনটা কেটে দিলেন।

 

৯২.

কিংস কলেজ, ১৮২৯ সালে রাজা জর্জ চতুর্থ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিলো। এতে ডিপার্টমেন্ট অব থিওলজি আর রিলিজিয়াস স্টাডি বিভাগ রয়েছে। পার্লামেন্ট-এর পাশে আবস্থিত এই জায়গাটা রাজ পরিবারের অনুদান। কিংস কলেজের রিলিজিয়ন ডিপার্টমেন্টটা কেবল ১৫০ বছরের শিক্ষকতা আর গবেষণার অভিজ্ঞতায়ই ঋদ্ধ নয়, বরং ১৯৮২ সালে তারা একটা সিস্টেমেটিক থিওলজি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে, যাতে রয়েছে এই পৃথিবীর অন্যতম উন্নতমানের ইলেক্ট্রনিক রিসার্চ লাইব্রেরি।

বৃষ্টির মধ্যে সোফিকে নিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকে ল্যাংডনের খুব আড়ষ্ট লাগছে। প্রাইমারি রিসার্চ রুমটা, টিবিং যেমন বর্ণনা করেছিলেন—একটা বড় আট কোনার ঘর। মাঝখানে বিশাল গোল একটা টেবিল। যাতে রয়েছে বারোটি ফ্ল্যাট স্ক্রিন কম্পিউটার মনিটর। ঘরের অন্য মাথায়, একজন লাইব্রেরিয়ান এইমাত্র এক কাপ চা নিয়ে এসে বসেছে।

চমৎকার সকাল, মেয়েটা উষ্ণু বৃটিশ বাচনভঙ্গীতে বললো। চা-টা রেখে তাদের কাছে এগিয়ে এলো। আমি কি আপনাদের সাহায্য করতে পারি?

ধন্যবাদ আপনাকে, ল্যাংডন জবাব দিলো। আমার নাম—

রবার্ট ল্যাংডন। মেয়েটা সুন্দর করে হেসে বললো। আমি জানি, আপনি কে।

কয়েক মুহূর্ত সে ভাবলো, ফশে হয়তো ইংলিশ টেলিভিশনেও তার ছবিটা সম্প্রচার করেছে, কিন্তু লাইব্রেরিয়ানের হাসিটা অন্য কথা বলছে। ল্যাংডন এখনও একজন সেলিবৃটির মতো এরকম পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। তারপরও বলা যায়, যদি এই পৃথিবীর কেউ তার চেহারাটা চিনতে পারে, সেটা রিলিজিয়াস লাইব্রেরিয়ানই হবে।

পামেলা গেটাম, হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে লাইব্রেরিয়ান বললো। আকর্ষণীয় চেহারা আর চমৎকার কণ্ঠ তার। হর্ন–

রিড চশমাটা তার গলায় ঝুলছে, সেটা খুবই পাতলা। আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে আমি আনন্দিত, ল্যাংডন বললো। এ হলো আমার বন্ধু, সোফি নেভু।

তারা দুজন হাত মেলালো। গেটাম ল্যাংডনের দিকে ঘুরে বললো, আমি জানতাম না আপনি আসছেন।

আরে, আমরাও কি জানতাম। যদি খুব বেশি অসুবিধা না হয়ে থাকে, আমাদেরকে আপনার একটা তথ্য খুঁজে দিতে সাহায্য করতে হবে।

গেটাম একটু ইতস্তত করলো। সাধারণত, আমাদের সেবা নিতে হলে আগে যোগাযোগ করে কিংবা দরখাস্ত করতে হয়। অবশ্য, আপনি নিশ্চয় কোন কলেজের অতিথি হয়ে এসেছেন?

ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো। আমি আসলে কাউকে না জানিয়ে এসেছি। আমার এক বন্ধু আপনার খুব সুনাম করেছেন। স্যার লেই টিবিং? নামটা বলতেই ল্যাংডনের ভেতরে একটা বিষণ্ণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। বৃটিশ রয়্যাল হিস্টোরিয়ান।

গেটামের চেহারাটা উজ্জ্বল হয়ে গেলো এবার, হেসে উঠলো সে। হায় ঈশ্বর, হ্যাঁ। আজব মানুষ। উন্মাদ! যখনই তিনি আসেন, সেই একই বিষয়। গ্রেইল। গ্রেইল। গ্রেইল। এই অম্বেষণটা ছাড়ার আগেই লোকটা মরবে, কসম খেয়ে বলছি। সে একটু ভুরু কুকালো। এসব কাজে সময় আর প্রচুর টাকা লাগে, আপনি কি বলেন? লোকটা একজন ডন কুইজোট।

আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারবেন কি? কোন সুযোগ আছে? সোফি জিজ্ঞেস করলো। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এটা।

গেটাম ফাঁকা লাইব্রেরিটার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তাদের দুজনকে চোখ টিপে ইশারা করলো। তো, আমি যে খুব ব্যস্ত আছি, সেটা তো আর বলতে পারছি না।

পারি কি? বলুন কী খুঁজতে চান?

আমরা লন্ডনে একটা সমাধি খুঁজছি।

গেটামকে দেখে সন্দেহগ্রস্ত মনে হলো। আমাদের কাছে এরকম প্রায় বিশ হাজার রয়েছে। আপনি কি আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন?

এটা একটা নাইটের সমাধি। আমরা তার নাম জানি না।

এজন নাইটের। এটাতে দেখি কাজ হয় কিনা।

যে নাইটকে আমরা খুঁজছি, তাঁর সম্পর্কে আমাদের কাছে তেমন কোন তথ্য নেই। সোফি বললো। শুধু এটুকুই আমরা জানি। সে একটা কাগজ বের করলো যাতে সনিয়ের কবিতাটার প্রথম দুটো লাইন টুকে রাখা আছে।

একজন বহিরাগতের কাছে পুরো কবিতাটা না দেখানোর সিদ্ধান্তই তারা নিয়েছিলো। কিন্তু মনে হচ্ছে, এক্ষেত্রে তারা একটু বেশি সর্তকতাই নিয়ে ফেলেছে। এর খুব একটা দরকারও নেই।

 

গেটাম বিখ্যাত আমেরিকান পণ্ডিতের চোখে তাড়াহুড়োটা টের পেলো। যেনো এই সমাধিটা খুঁজে পাওয়াটা খুবই জরুরি একটা কাজ। তার সঙ্গী, সবুজ চোখের মেয়েটাও মনে হচ্ছে খুব উদ্বিগ্ন।

হতভম্ব হয়ে গেটাম এইমাত্র তাকে দেয়া কাগজটাতে ভালো করে চোখ বুলালো।

পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট লন্ডনে আছেন শায়িত।
তাঁর কার্যকলাপ হয়েছিলো ধর্মাবতার ক্রোধের কারণ।

মেয়েটা তার সামনের অতিথিদের দিকে তাকালো। এটা কি? হারভার্ডের কোন গোলক বাধা?

ল্যাংডন জোর করে হাসলো। হ্যাঁ, সেরকমই কিছু।

গেটাম থামলো, বুঝলো, তাকে পুরো গল্পটা বলা হচ্ছে না। যাইহোক, সে কবিতাটার দিকে মনোযোগ দিলো, কৌতূহলবশত। এই কবিতাটার মতে, একজন নাইট এমন কিছু করেছিলেন যাতে ঈশ্বর নাখোশ হয়েছিলেন। তারপরও, পোপ তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাকে সমাহিত করেছিলেন, লন্ডনে।

ল্যাংডন সায় দিলো। এতে কি কিছু বোঝা যাচ্ছে?

গেটাম একটা কম্পিউটারের দিকে গেলো। খালি হাতে তো কিছু বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু দেখা যাক, ডাটাবেজ থেকে কিছু বের করে আনা যায় কিনা।

বিগত দুশতকের বেশি সময় ধরে কিংস কলেজের রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর সিস্টেমেটিক থিওলজি বিভাগটি অপটিক্যাল ক্যারাক্টার রিকগনিশন সফটওয়্যার ব্যবহার করে আসছে, সেই সাথে অনুবাদ করা, ক্যাটালগ তৈরি করা আর ডিজিটাইজ করার জন্য রয়েছে কিছু যন্ত্রপাতি। এ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল এক তথ্য ভাণ্ডার এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিওন, রিলিজিয়াস বায়োগ্রাফি, ইতিহাস, ভ্যাটিকানের চিঠিপত্র, যাজকদের ডায়রি, ইত্যাদি সমস্ত ধর্ম বিষয়ক তথ্যদি সেখানে পাওয়া যায়। বর্তমানে এই বিশাল তথ্য ভাণ্ডারটি বিট আর বাইটে রূপান্তর করার ফলে তথ্যগুলোতে প্রবেশ করা, খুঁজে বের করা, সীমাহীনভাবেই সহজসাধ্য হয়ে গেছে।

কাগজটা দেখে দেখে গেটাম কিছু টাইপ করলো। শুরুতে আমরা কিছু কি-ওয়ার্ড দিয়ে খুঁজে দেখি কী হয়।

ধন্যবাদ, আপনাকে।

গেটাম কিছু শব্দ টাইপ করলো :

লন্ডন, নাইট, পোপ

সার্চ বোতামে চাপ দিতেই বিশাল যন্ত্রটার চালু হওয়ার শব্দ শোনা গেলো। সুবিশাল হার্ডডিস্ক ড্রাইভ কাজ করতে শুরু করছে। ডাটা স্ক্যান করার হার প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ মেগাবাইট। কিছুক্ষণ পর পর্দায় একটা লেখা ভেসে এলো।

পোপের পেইন্টিং। স্যার জশুয়া রেনল্ডসর পোট্রেট সংগ্রহ।
লন্ডন ইউনিভার্সিটি প্রেস।

গেটাম মাথা ঝাঁকালো। অবশ্যই, আপনারা যা খুঁজছেন তা নয়।

সে পরের হিটটায় গেলো।

আলেকজান্ডার পোপ-এর লন্ডনের রচনাবলী
-– জি. উইলসন নাইট

আবারো সে মাথা ঝাঁকালো।

স্ক্রিনে যেসব রেফারেন্স ভেসে এলো সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ছিলো অষ্টাদশ শতকে বৃটিশ লেখক আলেকজান্ডার পোপ সংক্রান্ত। যার অসংখ্য ধর্মীয় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ কবিতায় নাইট আর লন্ডনের উল্লেখ রয়েছে।

গেটাম স্ক্রিনের লেখার নিচে গাণিতিক সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালো। কতগুলো রেফারেন্স আছে সেটার হিসাব দেয়া আছে এখানে।

আনুমানিক হিট-এর মোট সংখ্যা : ২,৬৯২

আমাদেরকে আরো নির্দিষ্ট করে কিছু কু দিতে হবে, গেটাম বললো। সে সার্চ করা থামিয়ে দিলো। সমাধি সম্পর্কে এটাই কি আপনাদের কাছে একমাত্র তথ্য? আর কিছু নেই এই ব্যাপারে?

ল্যাংডন সোফির দিকে অনিশ্চয়তায় তাকালো।

এটা কোন সামান্য খোজাখুজির ব্যাপার নয়, গেটাম আঁচ করতে পারলো। সে গত বছর রোমে ল্যাংডনকে নিয়ে কানাঘুষাগুলো শুনেছিলো। এই আমেরিকানটাকে পৃথিবীর সবচাইতে সুরক্ষিত আর গোপন লাইব্রেরিতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো–ভ্যাটিকান সিক্রেট আর্কাইভ। আর সে এও জানে, ল্যাংডন কেন সেখানে গিয়েছিলো। আজকের, এই খোজাখুজির উদ্দেশ্যও গেটামের কাছে পরিষ্কার বলে মনে হচ্ছে। গেইল।

গেটাম মুচকি হেসে চশমাটা ঠিক করে নিলো। আপনারা লেই টিবিংয়ের বন্ধু, ইংল্যান্ডে এসেছেন, আর একজন নাইটকে খুঁজছেন। সে তার হাত দুটো ভাঁজ করে বুকের কাছে রাখলো। আমি অনুমান করতে পারি, আপনারা গ্রেইল-এর খোঁজে আছেন।

ল্যাংডন আর সোফি একে অন্যের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। গেটাম হেসে ফেললো। বন্ধুরা, এই লাইব্রেরিটা হলো গ্রেইল অন্বেষণকারীদের একটা ঘাটি। লেই টিবিং তাদের মধ্যেই একজন। আমি যদি প্রতিটি সার্চের জন্য এক শিলিং করে নিতাম তবে, রোজ রোজ ম্যারি মাগদালিন, স্যাংগৃল, মেরোভিনজিয়ান, প্রায়োরি অব সাইন ইত্যাদি সব খুঁজে খুঁজে অনেক পয়সা রোজগার করতে পারতাম। চশমাটা খুলে তাদের দিকে তাকালো সে। আমার দরকার আরো কিছু তথ্য।

এই যে, সোফি নেভু বললো। আমরা যা জানি, এটাই হলো সেই জিনিস। ল্যাংডনের কাছ থেকে একটা কলম নিয়ে সে কাগজটাতে আরো দুটো লাইন লিখে গেটামকে সেটা দিয়ে দিলো।

যে গোলক তুমি খোঁজো সেটা সমাধিতেই থাকার কথা।
এটা বিবৃত করে গোলাপী শরীর আর বীজপ্রসূ গর্ভের আখ্যান।

গেটাম একটা অদ্ভুত হাসি দিলো। গ্রেইলই বটে, সে ভাবলো, গোলাপ আর তার বীজ বপন করার গর্ভের রেফারেন্সের কথাটা নোট করলো সে। আমি আপনাদেরকে সাহায্য করতে পারবো। কাগজটার দিকে তাকিয়ে সে বললো। আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি, পংক্তিগুলো কোথেকে পেয়েছেন? আর কেনই বা একটা গোলক খুঁজছেন?

আপনি জিজ্ঞেস করতেই পারেন, একটা বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দিয়ে ল্যাংডন বললো। কিন্তু সেটা খুবই লম্বা একটা গল্প, আর আমাদের হাতে সময়ও বেশি নেই।

কথাটা শুনে মনে হচ্ছে, ভদ্রভাষায় নিজের চরকায় তেল দিন কথাটার মতো।

আমরা আপনার কাছে চির ঋণী থাকবো, পামেলা, ল্যাংডন বললো, যদি আপনি খুঁজে বের করতে পারেন, কে সেই নাইট আর কোথায় তাকে কবর দেয়া হয়েছে।

খুব ভালো, গেটাম বললো, আবারো টাইপ করলো। যদি এটা গ্রেইল সংক্রান্ত ইসু হয়ে থাকে, আমাদেরকে তবে গেইল-এর কি-ওয়ার্ডগুলো দিয়ে রেফারেন্স দিতে হবে। আমি সার্চটার সুবিধার্থে সম্ভাব্য গ্রেইল সম্পর্কীয় কিছু শব্দ যোগ করে দিচ্ছি।

নাইট, লন্ডন, পোপ, সমাধি
এবং
গ্রেইল, রোজ, স্যাংগৃল, চ্যালিস

এতে কতোক্ষণ সময় লাগবে? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

পনেরো মিনিটের মতো। গেটাম হিসাব করে বললো।

ল্যাংডন আর সোফি কিছুই বললো না, কিন্তু গেটাম আঁচ করতে পারলো, কথাটা শুনে তাদের কাছে মনে হচ্ছে অনন্তকাল।

চা চলবে? টি-পটটার কাছে গিয়ে গেটাম জিজ্ঞেস করলো। লেই সবসময়ই আমার চা খুবই পছন্দ করেন।

 

৯৩.

লন্ডনের ওপাস দাইর সেন্টারটা খুবই আধুনিক একটি ভবন, ৫ ওম কোর্ট এলাকায় অবস্থিত সেটা। জায়গাটা কিংসটন গার্ডেনের উত্তর দিকে। সাইলাস এখানে কখনও আসেনি, কিন্তু ভবনটাতে ঢোকার সময় তার মনে হলো, সে একজন উদ্বাস্তু, আশ্রয়প্রার্থী। বৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও, রেমি তাকে একটু দূরে নামিয়ে দিয়েছে। হাটতে সাইলাসের কোন সমস্যা হয় না। বৃষ্টিটা ধুয়ে মুছে সাফ করার মতো মনে হচ্ছে।

রেমির অনুরোধে সাইলাস তার অস্ত্রটা একটা সুয়ারেজ ড্রেনে ফেলে দিয়েছে। এটা থেকে মুক্ত হতে পেরে তার ভালোই লাগছে। দীর্ঘক্ষণ হাত-পা বাঁধা থাকার জন্য তার পা-টা এখনও ব্যথা করছে। কিন্তু এর চেয়েও অনেক বেশি ব্যথা সাইলাস সহ্য করেছে। সে টিবিংয়ের কথা ভাবলো, তাকে রেমি হাত-পা বেঁধে লিমোজিনের পেছনের সিটে ফেলে রেখেছে। এখন হয়তো বৃটিশটা যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করেছে। মনে হয়, ইতিমধ্যেই শেষ করে ফেলা হয়েছে।

।তুমি তাকে নিয়ে কি করবে? এখানে আসার সময় সাইলাস গাড়িতে রেমিকে জিজ্ঞেস করেছিলো।

রেমি কাঁধ ঝাকিয়েছিলো। এটা টিচারের সিদ্ধান্ত। তার কণ্ঠে খুবই অদ্ভুত একটা টান ছিলো।

সাইলাস ওপাস দাইর ভবনে ঢুকতেই বৃষ্টিটা আরো জোরে পড়তে শুরু করলে তার ভারি আলখেল্লাটা ভিজে গেলো। আগের দিনের ক্ষতে পানি লাগলো। বিগত চব্বিশ ঘণ্টার পাপ থেকে নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত সে। তার কাজ শেষ হয়ে গেছে।

সামনের দরজার দিকে এগোতেই সাইলাস দেখলো দরজাটায় কোন তালা মারা নেই, সে একটুও অবাক হলো না। ভেতরে ঢুকে ফয়ারে এসে হাজির হলো। একটা ইলেক্ট্রনিক চাইমের মৃদু শব্দ ওপর তলা থেকে শুনতে পেলো। এই বেলের আওয়াজটা একেবারেই পরিচিত। এখানকার বেশির ভাগ সদস্যই দিনের বেশিরভাগ সময় প্রার্থনায় ব্যস্ত থাকে। আর সেই সময়টাতেই এই বেলটা বেজে থাকে। কাঠের ফ্লোরে মানুষের হাটা চলার শব্দ শুনতে পেলো সাইলাস।

আলখেল্লা পরা এক লোক নিচে নেমে এলো। আমি আপনার জন্য কি করতে পারি? তার দয়ালু চোখ সাইলাসের অদ্ভুত অবয়বটা দেখেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

আপনাকে ধন্যবাদ। আমার নাম সাইলাস। আমি ওপাস দাইর একজন সদস্য।

আমেরিকান?

সাইলাস মাথা নাড়লো, আমি মাত্র একদিনের জন্য এ শহরে থাকবো। আমি এখানে বিশ্রাম নিতে পারি?

আপনার জিজ্ঞেস করারও দরকার নেই। চার তলায় দুটো খালি ঘর আছে। আমি কি আপনার জন্য কিছু চা-নাস্তার ব্যবস্থা করবো?

ধন্যবাদ আপনাকে। সাইলাস বললো।

সাইলাস ওপর তলার একটা ঘরে গিয়ে তার আলখেল্লাটা খুলে ফেললো। হাটু গেঁড়ে, অন্তর্বাস পরিহিত অবস্থায়ই সে প্রার্থনা করতে শুরু করলো। শুনতে পেলো তার নিমন্ত্রণকর্তা দরজার বাইরে একটা ট্রে রেখে গেলো। প্রার্থনা শেষ করে সাইলাস খাওয়া দাওয়া করে তারপর ঘুম দিলো।

 

তিন তলার নিচে একটা ফোন বাজলে, যে লোকটা সাইলাসকে স্বাগতম জানিয়েছিলো

সে-ই ফোনটা ধরলো।

লন্ডন পুলিশ বলছি, ফোনের ওপর পাশ থেকে বলা হলো। আমরা একজন ধবল পাদ্রীকে খুঁজছি। আমাদের কাছে খবর আছে, সে এখানেই এসেছে। আপনি কি তাকে দেখেছেন?

লোকটা অবাক হলো। হ্যাঁ, সে এখানেই আছে। কি হয়েছে?

সে এখন আপনার ওখানে?

হ্যাঁ, উপর তলায়, প্রার্থনা করছে। কি হয়েছে?

সে যেখানে আছে সেখানেই থাকুক, অফিসার বললো, কাউকে কিছু বলবেন। আমি এক্ষুণি কিছু অফিসার পাঠাচ্ছি।

 

৯৪.

সেন্ট জেম্স পার্ক হলো লন্ডনের মাঝখানে একটা সবুজের সমুদ্র। এটা এমন একটা পাবলিক পার্ক, যার চারদিকে রয়েছে ওয়েস্ট মিনিস্টার, বাকিংহাম আর সেন্ট জেম্স প্রাসাদ। এক সময় এটা অষ্টম হেনরির হরিণ শিকারের উদ্যান ছিলো। এখন এটা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে, লন্ডনবাসিরা এখানে এসে পিকনিক করে আর পুকুরের পেলিকানদেরকে খাবার খাওয়ায়। এইসব পেলিকানদের পূর্ব-পুরুষ, রাশিয়ান এ্যাম্বাসেডর চার্লস দ্বিতীয়ের দেয়া উপহার ছিলো।

আজ টিচার কোন পেলিকানই দেখতে পেলেন না। ঝড়বৃষ্টির এই আবহাওয়ায় তার বদলে বরং সাগর থেকে আসা গাংচিল দেখা যাচ্ছে। সবুজ চত্বরটা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারা শত শত সাদা শরীর একই দিকে মুখ করে আছে। সকালের কুয়াশা থাকা সত্ত্বেও, পার্ক থেকে পার্লামেন্ট হাউজ আর বিগবেন ঘড়িটার চমৎকার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ভবনটার মিনার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে টিচার, ওখানেই নাইটের সমাধিটা আছে—এখানে রেমিকে আসতে বলার পেছনে আসল কারণ এটাই।

পার্কে পার্ক করা লিমোজিনটার সামনের দরজায় টিচার পৌঁছাতেই রেমি দরজাটা খুলে বের হয়ে এলো। টিচার একটু দাঁড়ালেন। তাঁর সাথে বহন করা একটা ফ্লাস্ক থেকে একটু কগনাক মদ পান করলেন।

রেমি কি-স্টোনটা এমনভাবে তুলে ধরলো, যেনো সেটা একটা ট্রফি। এটা প্রায় হারাতে বসেছিলাম।

তুমি খুব চমৎকার কাজ করেছে, টিচার বললেন।

আমরা খুব চমৎকার কাজ করেছি, টিচারের হাতে কি-স্টোনটা তুলে দিয়ে রেমি জবাব দিলো।

দীর্ঘ সময় ধরে টিচার সেটার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। একটু হাসলেন। আর অস্ত্রটা? তুমি ওটা ফেলে দিয়েছো?

যেখান থেকে পেয়েছিলাম, সেই গ্লোভ বক্সেই রেখে এসেছি।

চমৎকার। টিচার আরেকটু মদ পান করে ফ্লাস্কটা রেমির কাছে দিয়ে দিলো। আমাদের বিজয়কে উদযাপন করো। খুব সামনেই রয়েছে সমাপ্তি।

রেমি বোতলটা কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ করলো। কগনাকটার স্বাদ তার কাছে লবনাক্ত লাগলো, কিন্তু রেমি সেটা গ্রাহ্য করলো না। সে আর টিচার এখন সত্যিকারের অংশীদার। সে অনুভব করতে পারলো, এখন জীবনের অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছে সে। আমি আর কখনই চাকর হবে না। রেমি পুকুরের তীরের দিকে তাকাতেই তার মনে হলো, শ্যাতু ভিলেটা যেনো হাজার মাইল দূরে।

আরেকটু কনাক পান করতেই রেমি টের পেলো তার রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই রেমির একটু অস্বস্তিভাব শুরু হলো। বো-টাইটা আলগা করে ফ্লাস্কটা টিচারের কাছে ফিরিয়ে দিলো। হয়তো, আমি খুব বেশিই খেয়ে ফেলেছি, তার একটু দুর্বল দুর্বল লাগলো।

ফ্লাস্কটা নিয়ে টিচার বললেন, রেমি, তুমি হয়তো জানো, তুমিই হলে একমাত্র ব্যক্তি, যে আমার চেহারাটা চেনে। আমি তোমার উপর অনেক আস্থা রেখেছি।

হ্যাঁ, টাইটা আরেকটু আলগা করতে করতে সে বললো, তার খুব বেশি অস্বস্তি হতে লাগলো। আর আপনার পরিচয় আমার মৃত্যুর পর কবর পর্যন্ত যাবে।

টিচার অনেকক্ষণ নিরব রইলো। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, কি-স্টোন আর ফ্লাস্কটা পকেটে ভরে টিচার গ্লোভ বক্সটার কাছে গিয়ে ছোট্ট মেডুসা পিস্তলটা বের করে নিলেন। মুহূর্তেই, রেমির মনে একটা ভীতির উদ্রেক হলো। কিন্তু টিচার সেটা সোজা তার পকেটে ভরে ফেললেন।

সে করছেটা কি? রেমি মনে মনে ভাবলো, আচমকা সে ঘেমে উঠলো।

আমি জানি, আমি তোমার কাছে প্রতীজ্ঞা করেছিলাম, তোমাকে মুক্তি দেবো, টিচার বললেন। তার কণ্ঠটা এখন অনুশোচনার মতো শোনালো। কিন্তু, তোমার সব কিছু বিবেচনা করে, আমি এটাই করতে পারি।

রেমির গলাটা এমনভাবে কাঁপতে লাগলো যেনো ভূমিকম্প হচ্ছে। সে টালমাটাল হয়ে পড়ে যেতে লাগলো। গলাটা দুহাতে চেপে ধরলো সে। তার বমি বমি লাগছে। একটা চিৎকার দিলো, কিন্তু সেটা খুব চাপা গলায়, তাই আওয়াজটা গাড়ি থেকে একটু দূরেও শোনা গেলো না।

আমি খুন হচ্ছি।

অবিশ্বাসে রেমি টিচারের দিকে তাকিয়ে দেখে তিনি খুব ধীর-স্থিরভাবে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। রেমির চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো, শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো। আমি তার জন্যে সম্ভব সব কিছুই করার চেষ্টা করেছি। এটা সে কীভাবে করতে পারলো! হয় টিচার রেমিকে হত্যা করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কোন সাক্ষী না রাখার জন্য, না হয়, রেমি টেম্পল চার্চের ভেতর যা করেছে, তাতে সে টিচারের আস্থা হারিয়েছে, কারণ যাই হোক, রেমি সেটা আর কখনও জানতে পারবে না। ভীতি আর রাগ তার ভেতরে ঝড় তুললো। রেমি টিচারকে ধরার চেষ্টা করলো, কিন্তু তার অসাড় শরীর খুব একটা নড়লো না। আমি আপনাকে সবকিছু দিয়েই বিশ্বাস করেছিলাম।

রেমি তার হাতটা তুললো হর্ন বাজাবার জন্য, কিন্তু পারলো না, বরং দুহাতে গলাটা চেপে ধরে এক পাশে কাত হয়ে পড়ে গেলো। বৃষ্টিটা এখন খুব জোরে নামতে শুরু করেছে। রেমির দৃষ্টি অন্ধকার হয়ে গেলো। টের পেলো, পুরোপুরি চেতনা লোপ পেতে শুরু করেছে তার।

 

টিচার লিমোজিন থেকে বের হয়ে চারপাশটা চেয়ে দেখে খুব খুশি হলেন, কেউ তাঁর দিকে তাকিয়ে নেই। এছাড়া আমার কিছু করার ছিলো না, তিনি মনে মনে বললেন। অবাক হলেন, এইমাত্র যে কাজটি তিনি করলেন, সেটার ব্যাপারে তাঁর মধ্যে কোন দুঃখবোধ হচ্ছে না। রেমি তার নিজের ভাগ্য নিজেই ঠিক করে দিয়েছে। টিচার মোটামুটি ধরেই নিয়েছিলেন যে, রেমিকে শেষ করে দেয়া হবে, কিন্তু টেম্পলার চার্চে নিজেকে প্রকাশ করাতে ব্যাপারটা আরো দ্রুত সামনে এগিয়ে এসেছিলো। রবার্ট ল্যাংডনের আচমকা শ্যাতু ভিলে চলে আসাটা টিচারের জন্য একই সাথে সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই বয়ে এনেছিলো। ল্যাংডন কি-স্টোনটা সরাসরি অপারেশনের মূল প্রাণ টিবিংয়ের হাতে তুলে দেয়াটা ছিলো অবাক করা একটি ব্যাপার। তবে তার পেছনে পুলিশ চলে আসাতে এই অবাক আনন্দের ব্যাপারটা আর আনন্দঘন রইলো না। শ্যাতু ভিলের সব জায়গায় রেমির আঙুলের ছাপ রয়েছে। গোলা-ঘরের শোনার ঘাটিটাতেও। সেখানে রেমি নজরদারি করতো। তবে টিচার রেমির সাথে খুব দূরত্ব বজায় রাখাতে, সবার কাছে তিনি আড়ালেই থেকে গেছেন। শুধুমাত্র রেমিই বলতে পারতো তার ভূমিকার ব্যাপারটা। আর এখন, তাকে নিয়েও চিন্তার কিছু নেই।

আরেকটা ভুল শোধরানো গেলো, টিচার ভাবতে ভাবতে ড্রাইভিং সিটের কাছে চলে এলেন। পুলিশ বুঝতেই পারবে না কী ঘটেছে…আর তাদেরকে বলার জন্য কোন সাক্ষীও নেই। চারপাশটা তাকিয়ে দেখলেন কেউ দেখছে কিনা, তারপর ড্রাইভিং সিটে বসে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

 

মিনিটখানেক বাদে, টিচার সেন্ট জেম্স পার্কটা অতিক্রম করলেন। এখন শুধু দুজন লোক বাকি আছে, ল্যাংডন আর সোফি।

তারা আরো বেশি জটিল। কিন্তু ম্যানেজ করা যাবে। এই মুহূর্তে, ক্রিপ্টেক্সটা টিচারের কাছে আছে।

বাইরে বিজয়ীর মতো তাকিয়ে, তিনি দেখতে পেলেন তার গন্তব্যস্থলটি। পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট লন্ডনে আছেন শায়িত। টিচার কবিতাটা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গিয়েছিলেন উত্তরটা কি হতে পারে। তারপরও, অন্যেরা যে এটা বের করতে পারেনি, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। আমারতো একটা বাড়তি, অনৈতিক সুবিধা রয়েছে। মাসের পর মাস ধরে সনিয়ের কথপোকথন শোনার সময় একবার নিয়ে এই নাইটের কথাটা উল্লেখ করেছিলেন। কবিতাটার উল্লেখিত নাইটটা কেউ একবার দেখতে পেলেই চিনতে পারবে—তার পরও, এই সমাধিটা কীভাবে চূড়ান্ত পাস ওয়ার্ডটা উন্মোচিত করবে, সেটা এখনও একটা রহস্যই রয়ে গেছে।

যে গোলক তুমি খোঁজো সেটা সমাধিতেই থাকার কথা।

টিচার খুব সহজেই বিখ্যাত সমাধির ফটোটার কথা মনে করতে পারলো, বিশেষ করে ওটার সবচাইতে আকর্ষণীয় অংশটা, একটা চমক্কার গোলক। পাহাড়ের চূড়ার উপরে, বিশাল একটা সমাধি।

গোলকটার উপস্থিতি টিচারের কাছে আগ্রহী আর হতাশ দুটোই করেছিলো। একদিকে, এটা দেখে মনে হয়, একটা সাইন পোস্ট, তারপরও, কবিতাটার মতে, পাজলের হারানো অংশ হলো একটা গোলক, যা তাঁর সমাধিতে থাকার কথা ছিলো… কেবল তাই না, সেটা ইতিমধ্যেই ওখানে রয়েছে। তিনি ভালো করে সমাধিটা লক্ষ্য করে দেখলেন, উত্তরটা পাওয়া যায় কিনা।

বৃষ্টিটা এখন খুব জোরে পড়তে লাগলো। তিনি ক্রিপ্টেক্সটা এই সাত-সঁতে আবহাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে ডান দিকের পকেটে রেখে দিলেন। ছোট্ট মেডুসাটা রাখলেন বাম দিকে, যাতে সেটা কেউ না দেখে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই, তিনি লন্ডনের সবচাইতে পুরননা, নয় শত বছরের প্রাচীন ধর্মশালাতে নিরবে প্রবেশ করলেন।

 

টিচার বৃষ্টি থেকে ভেতরে ঢুকতেই, বিগিন-হিল এক্সিকিউটিভ এয়ারপোর্টের বৃষ্টি ভেজা রানওয়েতে আরিজারোসা তার প্লেন থেকে বাইরের বৃষ্টির মধ্যেই বের হলেন।

তিনি আশা করেছিলেন, ক্যাপ্টেন বেজু ফশে তাকে অভ্যর্থনা জানাবে। তার বদলে এক তরুণ বৃটিশ পুলিশ ছাতা হাতে এগিয়ে আসলো।

বিশপ আরিঙ্গাবোসা? ক্যাপ্টেন ফশেকে চলে যেতে হয়েছে। তিনি আমাকে বলে গেছেন আপনার দেখাশোনা করতে। তিনি বলেছেন, আমি যেনো আপনাকে স্কটল্যান্ড-ইয়ার্ডে নিয়ে যাই। তিনি মনে করেন, এটাই হবে সবচাইতে নিরাপদ জায়গা।

নিরাপদ? আরিঙ্গাবোসা তার হাতে ধরা ভারি বৃফকেসটার দিকে তাকালেন, যার ভেতরে রয়েছে ভ্যাটিকান বন্ডগুলো। তিনি এটার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। য়া, ধন্যবাদ আপনাকে।

আরিঙ্গাবোসা পুলিশের গাড়িতে উঠে বসলেন। ভাবলেন, সাইলাস কোথায় আছে। মিনিটখানেক বাদে, পুলিশের স্ক্যানারটা খটখট করে শব্দ করলো।

৫ ওর্‌ম কোর্ট।

আরিঙ্গাবোসা ঠিকানাটা চিনতে পারলেন মুহূর্তেই। ওপাস দাইর লন্ডনের কেন্দ্র।

তিনি ড্রাইভারকে বললেন, এক্ষুণি আমাকে এখানে নিয়ে যান!

 

৯৫.

সাচটা শুরু হবার পর থেকেই ল্যাংডনের চোখ কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে সরেনি।

পাঁচ মিনিটে। মাত্র দুটো হিট। দুটোই অপ্রাসঙ্গিক।

সে উদ্বিগ্ন হতে শুরু করলো।

পামেলা গেটাম পাশের ঘরেই আছে। গরম পানীয় তৈরি করছে সে। ল্যাংডন আর সোফি উঁকি মেরে দেখলো চায়ের সাথে কফি পাওয়া যায় কিনা, কিন্তু মাইক্রোওয়েভের শব্দ শুনে মনে হচ্ছে, তাদের অনুরোধে হয়তো, বড়জোর ইন্সট্যান্ট নেস ক্যাফে দেয়া হবে।

অবশেষে কম্পিউটারটা ঠিক জায়গায় আঘাত করতে পারলো।

মনে হচ্ছে, আরেকটা পেলেন, পাশের ঘর থেকে গেটাম বললো, শিরোনামটা কি?

ল্যাংডন স্ক্রিনে ভালো করে তাকালো।

মধ্যযুগের সাহিত্যে গ্রেইলের রূপক বর্ণনা :
স্যার গোয়াইন এবং সবুজ নাইটদের একটি দলিল।

সবুজ নাইটদের রূপক বর্ণনা, সে জবাব দিলো।

খবর ভালো না, গেটাম বললো। মিথলজির সবুজ দৈত্যদের খুব বেশি সংখ্যকের কবর লন্ডনে নেই।

ল্যাংডন আর সোফি ধৈর্য ধরে ক্রিনের দিকে চেয়ে রইলো। অপেক্ষা করলো আরো দুটো সন্দেহজনক ফলাফলের জন্য। কম্পিউটারটা আবারো একটা তথ্য হাজির করলো, যদিও সেটা ছিলো অগ্রহণযোগ্য।

ফন রিচার্ড ওয়াগনার-এর মৃত্যু

ওয়াগনারের অপেরা? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

গেটাম দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, তার হাতে কয়েক প্যাকেট ইন্সট্যান্ট কফি, এটাতো মনে হচ্ছে, আজব ম্যাচিং। ওয়াগনার কি নাইট ছিলেন?

না, ল্যাংডন বললো, হঠাৎ করেই একটু কৌতূহলী হয়ে উঠলো। কিন্তু তিনি ছিলেন ভ্রাতৃসংঘের খুবই বিখ্যাত একজন সদস্য। মোজার্ট, বেথোফেন, শেক্সপিয়ার, গরশ্যিন হুন্দি আর ডিজনির মতোই।

ভলিউমটাতে উল্লেখ করা আছে, ভ্রাতসংঘের সাথে নাইট টেম্পলার, প্রয়োরি অব সাইওন আর হলি গ্রেইলের সম্পর্কের কথা। আমি এটা একটু দেখতে চাই। পুরো লেখাটা আমি কিভাবে দেখতে পারবো?

আপনি পুরো লেখাটা চাইবেন না, গেটাম বললো। হাইপার টেক্সট-এ ক্লিক করুন। কম্পিউটার আপনার কি-ওয়ার্ডটা দেখাবে।

মেয়েটা কী বললো ল্যাংডন তার কিছুই বুঝতে পারলো না। আরেকটা নতুন উইন্ডো আবির্ভূত হলো।

… মিথলজিক্যাল নাইট, নাম পারসিফল যে…
… রূপক শোভিত গ্রেইল অন্বেষণ যা তর্কসাপেক্ষ…
… লন্ডন ফিলারমনিক…১৮৫৬ সালে…
রেবেকা পোপের অপেরা এথলজি
দেবীর…
…ওয়াগনারের সমাধি জার্মানির বায়রুথে…

ভুল পোপ, হতাশ হয়ে ল্যাংডন বললো। তার পরেও সে সিস্টেমটার সহজ সাধ্য ব্যবহার দেখে বিস্মিত হলো। লেখার বিষয় বস্তুর কি-ওয়ার্ডটা দেখেই ল্যাংডনের মনে পড়ে গেলো ওয়াগনারের পার্সিফল অপেরার কথা, যা ম্যারি মাগদালিন আর যিশু খৃস্টের বংশধরদের উৎসর্গ করে রচিত হয়েছিলো। এতে একজন নাইটের কাহিনী বিবৃত হয়েছে যে, সত্যান্বেষণে বেড়িয়েছে।

।একটু ধৈর্য ধরুন, গেটাম তাদেরকে প্রশমিত করলো। এটা হলো সংখ্যার খেলা। যন্ত্রটাকে চলতে দিন।

পরের পাঁচ মিনিট ধরে কম্পিউটার অনেকগুলো গ্রেইল রেফারেন্স হাজির করলো। তার মধ্যে একটা টেক্সট ছিলো বাদর সম্পর্কিত ফ্রান্সের বিখ্যাত ভবঘুরে রাষ্ট্রদূত বা মন্ত্রী। বাদুর ছিলেন ম্যারি মাগদালিন চার্চের ভ্রাম্যমান সেবক অথবা মন্ত্রী। সঙ্গীতের মাধ্যমে জন সাধারণের কাছে পবিত্র নারীর গল্পটা প্রচার করতো সে। তারা একটা গান গাইত আওয়ার লেডি নামেপোপ কর্তৃক সমাহিত একজন মাইট, লন্ডনে আছেন শায়িত।

তাতে একজন রহস্যময়ী সুন্দরী নারীর কাছে তারা সারাজীবনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবার কথা বলতো।

উদগ্রীব হয়ে সে হাইপার টেক্সট-এ চেক করে দেখেলো, কিন্তু কিছুই পেলো না। কম্পিউটারটা আবারো কিছু বিষয়-বস্তু হাজির করলো।

নাইট, তাসের গোলাম, পোপ, এবং পেনটাকল :
টারোট-এর মধ্য দিয়ে হলি গ্রেইলের ইতিহাস

অবাক করার মতো কিছু না, সোফিকে ল্যাংডন বললো। আমাদের কিছু কি ওয়ার্ড এর সাথে কিছু কার্ডের নামের মিল রয়েছে। সে মাউসটা নিয়ে হাইপার লিংকে ক্লিক্ করলো।

আমি নিশ্চিত নই, আপনার দাদু আপনার সাথে টারোট খেলার সময় এটা উল্লেখ করেছিলেন কি না। এই খেলাটা হলো ফ্লাশ কার্ড ক্যাটাসিজম, চার্চের শয়তানীর জন্য বিচ্ছেদ হওয়া হারানো কনে আর তার বরের কাহিনীর।

সোফি তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকালো। আমার কোন ধারণাই ছিলো না।

এটাই হলো কথা। রূপকধর্মী খেলার মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে গ্রেইলের অনুসারীরা কড়া নজরদারী থাকা সত্ত্বেও চার্চকে ধোঁকা দিতেন। ল্যাংডন প্রায়ই অবাক হয়ে ভাবে, আজকের আধুনিক যুগে কতজন কার্ড খেলোয়াড় জানে, তাদের চারটা কার্ড স্পেড, হার্ট, ক্লাব, ডায়মন্ড-আসলে গ্রেইল সংশ্লিষ্ট প্রতীক থেকে আসা টারোট-এর চারটা কার্ড সোর্ড, কাপ, সেন্টার এবং পেনটাকল থেকে সরাসরি নেয়া।

স্পেড হলো সোড় তলোয়ার। পুরুষ।
হার্ট হলো কাপ-পেয়ালা। নারী।
ক্লাব হলো সেপ্টার রাজবংশ। ফুলজাতীয় কিছু।
ডায়মন্ড হলো পেনটাকল—দেবী। পবিত্র নারী।

***

চার মিনিট পরে, ল্যাংডন যখন আশংকা করতে শুরু করেছে, তারা যা খুঁজতে চাইছে, সেটা হয়তো পাবে না, ঠিক সেই সময়েই কম্পিউটার আরেকটা নতুন তথ্য উপস্থাপন করলো।

একজন জিনিয়াসের গুরুত্ব :
একজন আধুনিক নাইটের জীবনী

জিনিয়াসের গুরুত্ব? ল্যাংডন গেটামকে বললেন। একজন আধুনিক নাইটের জীবনী?

গেটাম একটা কর্ণার থেকে উঁকি দিলো। কত আধুনিক? দয়া করে বলবেন না যে, এটা আপনাদের স্যার রুডি জুলিয়ানি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এটা দেয়া ঠিক হয়নি।

ল্যাংডনের নিজেরও আরেক জন নতুন নাইট উপাধি পাওয়া স্যার মিক জ্যাগারের ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে, কিন্তু এখন, বৃটিশ নাইটহুডের রাজনীতি নিয়ে তর্কবিতর্ক করার সময় নয়। একটু দেখুন তো। ল্যাংডন হাইপার টেক্সট-এর কি-ওয়ার্ডগুলো পর্দায় হাজির করলো।

…অনারেবল নাইট, স্যার আইজ্যাক নিউটন…
…লন্ডন শহরে, ১৭২৭ সালে এবং…
…তার সমাধি ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবিতে…
…আলেকজান্ডার পোপ, বন্ধু এবং সহকর্মী…

মনে হচ্ছে আধুনিক শব্দটা আপেক্ষিক, গেটামকে বললো সোফি। এটা একটা পুরনো বই। স্যার আইজ্যাক নিউটনের ওপরে।

গেটাম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকালো। ভালো না। নিউটন ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবেতে সমাহিত আছেন, সেটা ইংলিশ প্রটেস্টান্টদের জন্য। সেখানে একজন ক্যাথলিক পোপের উপস্থিত থাকাটা একেবারে অসম্ভব। মাখন আর চিনি?

সোফি মাথা নাড়লো।

গেটাম অপেক্ষা করলো। রবার্ট?

ল্যাংডনের হৃদপিণ্ডটাতে হাতুরি পেটা শুরু হয়ে গেলো। সে পর্দা থেকে চোখটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। স্যার আইজ্যাক নিউটন হলেন আমাদের নাইট।

সোফি বসেই রইলো। আপনি বলছেন কি?

নিউটনকে লন্ডনে সমাহিত করা হয়েছিলো, ল্যাংডন বললো। তার আবিষ্কার আর নতুন বিজ্ঞান চার্চের রাগের কারণ হয়েছিলো। তিনি প্রায়োরিদের গ্র্যান্ড মাস্টারও ছিলেন। আমরা এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারি?

আর কি, মানে? সোফি কবিতাটার দিকে ইঙ্গিত করলো।

একজন পোপ কর্তৃক সমাহিত নাইট, সেটার কি হবে? আপনি মিসেস গেটামের কাছ থেকে তো শুনেছেনই, নিউটন কোন ক্যাথলিক পোপ কর্তৃক সমাহিত হননি।

ল্যাংডন মাউসটা হাতে নিলো। ক্যাথলিক পোপের কথা কে বলছে? সে পোপ হাইপার লিংকে ক্লিক করলে কম্পিউটারের পর্দায় কিছু লেখা ভেসে এলো।

স্যার আইজ্যাক নিউটনের শেষকৃত্যে রাজা এবং অভিজাতরা উপস্থিত ছিলেন, সভাপতিত্ব করেন আলেকজান্ডার পোপ, বন্ধু এবং সহকর্মী, যিনি সমাধি দেবার পর পর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে একটি প্রশংসাসূচক বিবৃতি পড়ে শুনিয়ে ছিলেন।

ল্যাংডন সোফির দিকে তাকালো। আমাদের দ্বিতীয় হিটেই সঠিক পোপকে পেয়ে গেছি। আলেকজান্ডার। সে একটু থামলো। একজন পোপ।

পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট, লন্ডনে আছেন শায়িত।

সোফি উঠে দাঁড়ালো। তার অবস্থা হতবুদ্ধিকর।

জ্যাক সনিয়ে, দ্ব্যর্থবোধকতার একজন মাস্টার, আবারো প্রমাণ করলেন, তিনি ভংয়কর রকমেরই একজন চতুর ব্যক্তি।

 

৯৬.

সাইলাস চম্‌কে ঘুম থেকে উঠে গেলো।

তার কোন ধারণাই নেই কতক্ষণ ধরে ঘুমিয়ে আছে অথবা কিসের জন্য তার ঘুম ভাঙলো। আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম? খড়ের তৈরি ম্যাটের ওপরে উঠে বসলো। শুনতে পেলো ওপাস দাইর আবাসিক এলাকার শান্ত-নিথর শব্দ। নিচের তলায় কারোর নিচু স্বরে প্রার্থনা করার বিড়বিড় একটা শব্দ। এই সব শব্দ তার কাছে অতি পরিচিত, আর এতে সে খুব স্বস্তি বোধ করে থাকে।

তারপরও, আচমকাই, অপ্রত্যাশিতভাবে একটু বিচলিত বোধ করলো সে।

শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরেই সে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেলো। আমাকে কি অনুসরণ করা হচ্ছে? নিচের প্রাঙ্গণটা একেবারেই ফাঁকা, ঢোকার সময় সে যেমনটি দেখেছিলো। কান পেতে শুনলো। সুনশান। তবে আমার এরকম অস্বস্তি লাগছে কেন? অনেক আগেই, সাইলাস বুঝতে শিখেছিলো, নিজের ইনটুইশন, মানে সজ্ঞার ওপর আস্থা রাখা যায়। অনেক অনেক আগে, এই ইনটুইশনই তাকে ছোটবেলায়, মার্সেইর রাস্তায় বাঁচিয়ে রেখেছিলো। জানালা দিয়ে এবার নিচে তাকিয়ে দেখলো নিচের প্রাঙ্গণের এক কোণে একটা গাড়ির ছায়া দেখা যাচ্ছে। গাড়িটার ছাদে পুলিশের সাইরেন লাগানো। সিঁড়িতে কারো ওঠার শব্দ পাওয়া গেলো। একটা দরজায় তালা খোলার শব্দ হলো।

তক্ষুণি সাইলাস দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজার পেছনে লুকিয়ে পড়তেই সেটা ধপাস করে খুলে গেলো। প্রথম পুলিশ অফিসারটি ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকে পড়লো। প্রথমে বাম দিকে তারপর ডান দিকে পিস্তলটা তা করলো সে। ঘরটা খালি দেখতে পেলো। সাইলাস কোথায় আছে সেটা প্রথম অফিসার বোঝার আগেই দ্বিতীয় অফিসার ঘরে ঢুকে পড়লো। দরজার পেছন থেকে সাইলাস আচম্‌কা দ্বিতীয় জনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। প্রথম অফিসারটি ঘুরে গুলি করতে উদ্যত হতেই সাইলাস সজোড়ে তাকে লাথি মারলো। অস্ত্রটা ছিটকে পড়ে যাওয়ার আগে একটা বুলেট সাইলাসের কানের পাশ দিয়ে চলে গেলো। সজোরে সেই অফিসারের দুপায়ের মাঝখানে লাথি মারার সাথে সাথে লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তার মাথাটা প্রচণ্ড জোড়ে মাটিতে আছাড় খেলো। দ্বিতীয় অফিসারের হাটুতে লাথি মেরে তাকেও মাটিতে ফেলে দিলো সাইলাস, সঙ্গে সঙ্গে তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে।

প্রায় নগ্ন হয়েই সাইলাস সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। সে জানতো, তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে, কিন্তু সেটা কে করেছে? সে যখন ফয়ারে আসলো, সামনের দরজা দিয়ে বেশ কয়েকজন অফিসার হুড়মুর করে ঢুকে পড়লো। সাইলাস সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে, ভবনটার আরো ভেতরে ঢুকে পড়লো। নারীদের প্রবেশ পথ। প্রতিটা ওপাস দাই বিল্ডিংয়েই এটা আছে। খুবই সরু একটা পথ দিয়ে ছুটে সাইলাস রান্নাঘরে চলে গেলো। কর্মরত নারী শ্রমিকরা নগ্ন সাইলাসকে দেখে ভয় পেয়ে সরে গেলো। সাইলাস তাদের পেরিয়ে বয়লার রুমে ঢুকে পড়লো। যে দরজাটা সে খুঁজছিলো, এবার সেটা পেয়ে গেলো।

প্রচণ্ড গতিতে দৌড়ে বাইরের বৃষ্টিতে এসে পড়লো সে। সামনের দিকে দেখতে পেলো একজন অফিসার তার দিকে তেড়ে আসছে। দুজন লোকের মধ্যে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা লাগলো। সাইলাস প্রশস্ত কাঁধ আর নগ্নদেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে লোকটার বুকে আঘাত করলো। লোকটা মাটিতে আছড়ে পড়লো। সে শুনতে পেলো, পেছনে থাকা অফিসারদের চিৎকার চেঁচামেচি। যে অফিসারটা পড়ে আছে, তার হাত থেকে ছিটকে পড়া পিস্তলটা তুলে নিলো সাইলাস। সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালালো পেছনে থাকা তিন জন অফিসারের দিকে। তাদের রক্ত ছিটকে পড়লো।

পেছন থেকে একটা কালো ছায়া যেনো হুট করে উদয় হলো। লোকটার একটা হাত সাইলাসের কাঁধ শক্ত করে ধরলো। যেনো হাত দুটো শয়তানের শক্তি রাখে। লোকটা তার কানে চিৎকার করে বললো। সাইলাস, না!

সাইলাস ঘুরেই সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালালো। দুজনের চোখাচুখি হলো। বিশপ আরিঙ্গাবোসা মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই সাইলাস তীব্র আতংকে চিৎকার দিলো।

 

৯৭.

তিন হাজারেরও বেশি লোকের সমাধি রয়েছে ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবিতে। সমাধিগুলোতে সম্রাট, রাষ্ট্রনায়ক, বিজ্ঞানী, কবি আর সঙ্গীতজ্ঞদের দেহাবশেষ রয়েছে। সুন্দর করে সাজানো পাথরের সমাধিগুলোর মধ্যে সবচাইতে অভিজাত আর চিত্তাকর্ষক হলো রাণী এলিজাবেথেরটা। এটার ভেতরে একটা চ্যাপেলও রয়েছে। রাণীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি হয়েছিলো সেটা।

এটার নক্সা করা হয়েছিলো আমিয়েন, শারলে, এবং ক্যান্টারবেরির মহান ক্যাথেড্রালের স্টাইল অনুসারে। ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবিকে না ক্যাথেড্রাল না প্যারিশ চার্চ, কোনটাই বিবেচনা করা হয় না। উইলিয়াম দ্য কনকরার-এর অভিষেক অনুষ্ঠানটা ১০৬৬ সালে ক্রিসমাসের সময় এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তারপর থেকে এই জায়গাটা বিরামহীন রাজকীয় আর রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের সাক্ষী হয়ে আছে—এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর-এর অভিষেক থেকে প্রিন্স এডুজ আর সারাহ ফারগুসনের বিয়ে, পঞ্চম হেনরি, রাণী প্রথম এলিজাবেথ এবং লেডি ডায়নার শেষকৃত্য পর্যন্ত।

তারপরও, রবার্ট ল্যাংডন এখন এ্যাবির অন্য কোন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আগ্রহ দেখালো না, শুধুমাত্র একটা বাদে বৃটিশ নাইট, বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান।

পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট, লন্ডনে আছেন শায়িত।

ল্যাংডন আর সোফি দ্রুতই সেই জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। তারা এ্যাবির নতুন স্থাপনাটির সামনে এসে থামলো—একটা বিশাল মেটাল ডিকটেটর গেট বর্তমানে লন্ডনের বেশিরভাগ ঐতিহাসিক ভবনেই এটা দেখা যায়। একজন রক্ষী তাদেরকে সেখানে অভ্যর্থনা জানালো। তারা নির্বিঘ্নেই গেটটা পার হলো, কোন এলার্ম বাজলো না।

ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবির মূল জায়গাটাতে ঢুকেই ল্যাংডনের মনে হলো বাইরের পৃথিবীটা হুট করেই যেনো বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। কোন ভীড়-বাট্টা নেই এখানে। বৃষ্টি বাদলাও নেই। শুধুমাত্র নিথর এক নিরবতা। যাতে মনে হচ্ছে, ভবনটা নিজেই যেনো ফিস্ ফিস্ করছে। .

ল্যাংডন আর সোফির চোখ প্রায় সব আগত দর্শনার্থীর মতোই, সঙ্গে সঙ্গেই আকাশের দিকে গেলো। যেখানে এ্যাবির বিশাল অতল গহ্বরটা মাথার ওপরে জুড়ে আছে। ধূসর পাথরের কলামগুলো যেনো ছায়ার মধ্যে গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে, একটা প্রশস্ত পথ উত্তর দিকে চলে গেছে। যেনো অনেকটা গভীর গিরিখাদের মতো। দুপাশটা স্টেইড গ্লাস দিয়ে সাজানো। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে, এ্যাবির জমিনটা প্রিজমের মতো আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়। আজকে, এই বৃষ্টির দিনে, স্বল্প আলোতে সেটা হচ্ছে না।

এটাতো প্রায় ফাঁকাই আছে, সোফি নিচু স্বরে বললো।

ব্যাপারটা ল্যাংডনের কাছে হতাশাজনক বলে মনে হলো। সে আশা করেছিলো অনেক অনেক লোক থাকবে। এটাতো খুবই সুপরিচিত পাবলিক প্লেস। এর আগে ফাঁকা টেম্পল চার্চের ভেতরকার ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি চাচ্ছিলো না সে। জন-সমাগম আছে এমন জনপ্রিয় জায়গায় ল্যাংডন নিরাপত্তা বোধ করে। আজ এপ্রিলের বৃষ্টির এক সকাল। তাই পর্যটকদের মওসুম হওয়া সত্ত্বেও জায়গাটা ফাঁকা।

আমরা মেটাল ডিটেটর দিয়ে ঢুকতে পেরেছি, সোফি মনে করিয়ে দিলো, ল্যাংডন কথাটা বুঝতে পারলো বলে মনে হলো। যদি এখানে কেউ ঢোকে, তো অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে পারবে না।

ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো, তারপরও, সে একটু অস্বস্তি বোধ করছে। সে চেয়েছিলো সঙ্গে করে লন্ডন পুলিশকে নিয়ে আসতে। কিন্তু সোফি তাতে রাজি হয়নি। আমাদেরকে ক্রিপ্টেটা উদ্ধার করতে হবে, সোফি চাপাচাপি করেছিলো। এটাই হলো সব কিছুর মূল চাবিকাঠি।

অবশ্য, সে ঠিকই বলেছে।

লেইকে জীবিত ফিরে পাওয়ার চাবিকাঠি। হলি গ্রেইকে খুঁজে পাবার চাবিকাঠি। এর পেছনে কে আছে, সেটা খুঁজে পাবারও চাবিকাঠি।

দূভাগ্যজনকভাবে, তাদের জন্য কি-স্টোনটা পুনরুদ্ধার করার একমাত্র সুযোগটা মনে হচ্ছে এখানেই আছে…আইজ্যাক নিউটনের সমাধিতে। যার কাছেই ক্রিপ্টেক্সটা থাকুক না কেন, এই সমাধিতে এসে সংকেতটা উদ্ধার করতেই হবে। আর, তারা যদি এসে চলে গিয়ে না থাকে, তবে ল্যাংডন আর সোফি তাদেরকে মাঝ পথেই আঁটকে ফেলতে পারবে।

কবিতাটা দেখার জন্য তারা বাম দিকের দেয়ালের দিকে চলে গেলো। একটা আড়াল করা জায়গায় গিয়ে থামলো। ল্যাংডন কোনভাবেই তার মাথা থেকে জিম্মি হওয়া টিবিংয়ের ছবিটা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলো না। সম্ভবত তাঁকে এখন তার নিজের লিমোজিনেই হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। প্রায়োরিদের শীর্ষ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করার আদেশটি যে-ই দিয়ে থাকুক না কেন, সে যে তার পথের মাঝে এসে পড়া কাউকে হত্যা করতে পিছপা হবে না, সেটা একদম নিশ্চিত। মনে হচ্ছে, এটা ভাগ্যের একটি নিমর্ম পরিহাস যে, টিবিং—একজন আধুনিক বৃটিশ নাইট জিম্মি হয়েছেন, তাঁর নিজের দেশেরই লোক স্যার আইজ্যাক নিউটনের সমাধিটা খুঁজে পাওয়ার জন্য।

সেটা কোন দিকে? চারদিকে তাকিয়ে সোফি জিজ্ঞেস করলো।

সমাধিটা। ল্যাংডনের কোন ধারণাই নেই। আমাদেরকে একজন ডোসেন্ট খুঁজে বের করে জিজ্ঞেস করতে হবে।

এখানে লক্ষ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করার চেয়ে কি করতে হবে সেটা ল্যাংডন ভালো করেই জানতো। লুভরের গ্র্যান্ড গ্যালারির মতোই, ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবির একটাই প্রবেশ পথ রয়েছে যে দরজাটা দিয়ে তারা ঢুকেছিলো—ভেতরে ঢোকার পথ খুঁজে বের করা খুব সহজ, কিন্তু বের হওয়ার পথ খুঁজে বের করা কঠিন। আক্ষরিক অর্থেই একটা পর্যটকদের জন্য একটা ফাঁদ, ল্যাংডনের এক সহকর্মী কথাটা বলেছিলো। স্থাপত্য ঐতিহ্য অনুসারে, এ্যাবিটাতে একটা বিশাল আকৃতির কুশিফিক্স মাটিতে শায়িত রাখা হয়েছে। বেশির ভাগ চার্চের মতো, এটার প্রবেশ পথ মাঝখান দিয়ে না হয়ে, বরং পাশ দিয়ে রাখা হয়েছে। তারচেয়েও বড় কথা, এ্যাবিটার রয়েছে অনেকগুলো উদ্যান আচ্ছাদিত পথ, একেবারে এ্যাবির সংলগ্ন আর সেগুলো চার দিকে ছড়িয়ে গেছে। একবার ভুল জায়গায় ঢুকে পড়লে, দর্শনার্থী গোলক ধাঁধায় পড়ে যাবে, আর নিজেকে প্রাচীর বেষ্টিত অবস্থায় দেখতে পাবে।

ডোসেন্টরা গাঢ় লাল রঙের পোশাক পরা থাকে, চার্চের কেন্দ্রস্থলের দিকে এগোতে এগোতে ল্যাংডন বললো। দক্ষিণ দিকের উঁচু বেদীটার দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন দেখতে পেলো, কয়েকজন লোক কবরে ঘষামাজা করছে। এই তীর্থ যাত্রীদের দৃশ্যটা পোয়েট কর্নারের একটি সাধারণ দৃশ্য, যদিও ব্যাপারটা দেখে খুব একটা পবিত্র কিছু বলে মনে হয় না। পর্যটকরা কবর ঘষামাজা করছে।

আমি তো কোন ডোসেন্ট দেখতে পাচ্ছি না, সোফি বললো। হয়তো আমরা নিজেরাই সমাধিটা খুঁজে বের করতে পারবো।

কোন কথা না বলে ল্যাংডন তাকে নিয়ে এ্যাবির কেন্দ্রস্থলের দিকে এগোলো। সে ডান দিকটায় ইঙ্গিত করলো।

এ্যাবির মূল অংশটার বিশালত্বের দিকে তাকিয়ে সোফি একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললো, জায়গাটার পুরো আকৃতি এবার দৃশ্যমান হলো। আহ্, সে বললো, চলো একজন ডোসেন্ট খুঁজি।

 

ঠিক সেই সময়ে চার্চটা থেকে একশ গজ দূরে, কয়্যার স্ক্রিনের পেছনে, দৃষ্টির আড়ালে, স্যার আইজ্যাক নিউটনের সমাধির সামনে একজন দর্শনার্থী দাঁড়িয়ে আছেন। টিচার সমাধিটা দশ মিনিট ধরে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন।

নিউটনের সমাধিটাতে বিশাল আকৃতির একটা কালো মার্বেল পাথরের সমাধি ফলক আছে, যাতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের ভাস্কর্য রয়েছে। একটা ক্লাসিক্যাল পোশাক পরে আছেন তিনি। এক থাক বই পুস্তকের ওপর ভর দিয়ে একপাশে গর্বিতভাবে হেলে রয়েছেন

ডিভাইনিটি, ক্রনোলজি, অপটিক্স, আর ফিলোসফিয়ে ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা। নিউটনের পায়ের কাছে ডানাযুক্ত দুটো বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের হাতে একটা স্কুল ধরা। নিউটনের শরীরের পেছনে একটা সাধারণ পিরামিড জেগে আছে। যদিও পিরামিডটা খুবই অদ্ভুত, দেখে মনে হচ্ছে এটা অর্ধেক অংশ জেগে থাকা একটা পাহাড়ের মতো, এটাই টিচারকে বেশি কৌতূহলী করলো।

একটা গোলক।

টিচার সনিয়ের ছলা-কলার ধাঁধাটি নিয়ে একটু ভাবলেন। যে গোলক তুমি খোঁজো, সেটা তার সমাধিতে থাকার কথা। পিরামিডের অবয়বটা থেকে বিশাল একটা গোলক বেড়িয়ে আসছে। জিনিসটা বাসো-রিলিভো পদ্ধতিতে খোঁদাই করা, আর সেটা সব ধরনের নক্ষত্র-মণ্ডলীকেই তুলে ধরছেনক্ষত্রপুঞ্জ, রাশিচক্রের প্রতীক, ধূমকেতু, তারা, আর গ্রহসমূহ। এটার ওপরে, তারা ভরা আকাশের নিচে জ্যোর্তিবিজ্ঞানের দেবীর ছবি।

অসংখ্য গোলক।

টিচার মনে করেছিলেন, একবার তিনি সমাধিটা খুঁজে পাবার পর, হারানো গোলকটা খুঁজে পাওয়া সহজই হবে। এখন, তিনি খুব একটা নিশ্চিত হতে পারছেন না। জটিল মহাকাশটার দিকে ভালো করে তাকালেন। এখানে কি কোন গ্রহের অনুপস্থিতি আছে? নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে কি কোন জ্যোর্তিবিদ্যার গোলক বাদ দেয়া হয়েছে? তার কোন ধারণাই নেই। তারপরও, টিচার এটা না ভেবে পারলেন না যে, সমাধানটা আসলে পরিষ্কার আর সরলই হবে—পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট। কোন গোলকটা আমি খুঁজছি? নিশ্চিতভাবেই,এস্ট্রোফিজিক্স-এর উন্নত-জ্ঞান হলি গ্রেইল খোঁজার জন্য আবশ্যিক কোন শর্ত নয়, তাই না?

এটা বিবৃত করে গোলাপের শরীর আর বীজপ্রসূ গর্ভের আখ্যান।

টিচারের মনোযোগ কয়েকজন পর্যটকের আগমনে ভেঙে গেলো। তিনি ক্রিপ্টেক্সটা দ্রুত পকেটে ভরে ফেলে দর্শনার্থীদের চলে যাওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করলেন। তারা একটা পাত্রের মধ্যে কিছু দানের টাকা রেখে গেলো। তাদের হাতে চারকোল পেন্সিল আর কাগজ। এ্যাবির সদর দরজার দিকে সবাই চলে গেলো, সম্ভবত, জনপ্রিয় পোয়েট কর্নারের দিকে, চসার, টেনিসন, আর ডিকেন্স-এর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

আবারো একা, টিচার সমাধিটার আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলেন। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ভালো করে নিরীক্ষণ করলেন। সমাধি ফলকটার নিচে, উপরে, নিউটনকে পাশ কাটিয়ে, তার বই-পুস্তকগুলো এড়িয়ে, ছেলে দুটোকেও অতিক্রম করে পিরামিডটার দিকে তাকালেন। সেখান থেকে বিশাল গোলক আর তার ভেতরকার নক্ষত্রপুঞ্জ এবং অবশেষে উপরের তারা ভরা শামিয়ানার দিকে।

কোন গোলকটা এখানে থাকার কথা…যা নেই?

তিনি তাঁর পকেটে রাখা ক্রিপ্টেক্সটা স্পর্শ করলেন, যেনো সনিয়ের সুনিপূণ কারু কার্যের মার্বেলটা থেকে স্বর্গীয় উত্তর পেয়ে যাবেন। কেবল পাঁচটি অক্ষর গ্রেইল থেকে আমাকে দূরে রেখেছে।

কয়্যার স্ক্রিনের দিকে হেটে গিয়ে তিনি গভীর একটা নিঃশ্বাস নিলেন। দূরের প্রধান বেদীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সেখানে গাঢ় লাল রঙের পোশাক পরা একজন ডোসেন্ট দুজন আতিপরিচিত লোককে হাত নেড়ে এই জায়গার দিকে নির্দেশ করছে।

ল্যাংডন আর নেভু।

আস্তে করে টিচার দুহাত পিছিয়ে গিয়ে, কয়্যার স্ক্রিনের পেছনে চলে গেলেন। খুব জলদিই তারা এসে পড়লো। তিনি আগেই অনুমান করেছিলেন, ল্যাংডন আর সোফি কবিতাটার মর্মোদ্ধার করার পর নিউটনের সমাধিতে আসবে। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটে গেলো তার কল্পনার চেয়েও বেশি তাড়াতাড়ি। একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে টিচার তাঁর উপায়গুলো নিয়ে ভাবলেন। তিনি বিস্ময় আর অবাক করা ঘটনার সাথে অভ্যস্ত হয়েই বেড়ে উঠেছেন।

ক্রিপ্টেটা আমার কাছেই আছে।

পকেটে হাত ঢুকিয়ে তিনি দ্বিতীয় বস্তুটা স্পর্শ করলেন, যা তাঁকে আত্মবিশ্বাসী করে; মেডুসা রিভারটা। যেমনটি আশা করা হয়েছিলো, তাঁর লুকানো পিস্তলটার জন্য এ্যাবির মেটাল ডিটেক্টরটা, টিচার প্রবেশ করতেই বাতি জ্বলে ওঠে শব্দ করেছিলো। রক্ষীরা সঙ্গে সঙ্গেই তার দিকে তাকালে, তিনি পরিচয়-পত্রটা বের করে দেখালেন। তারা আর কিছু বলেনি।

যদিও টিচার প্রথমে ভেবেছিলেন, ক্রিপ্টেক্সটা একা একাই সমাধান করবেন, কিন্তু এখন তিনি আঁচ করতে পারলেন, ল্যাংডন আর নেভুর আগমন আসলে আর্শীবাদ হয়েই দেখা দিয়েছে। গোলকটা খুঁজে পাবার ব্যাপারে তাঁর ব্যর্থতার জন্য, এখন তিনি হয়তো তাদের অভিজ্ঞতা আর দক্ষতাকে ব্যবহার করতে পারবেন। হাজার হোক, ল্যাংডন যদি কবিতাটার মমোৰ্দ্ধার করেই থাকে, সমাধিটা খুঁজে পেয়ে থাকে, তাহলে, সে যে গোলকটা সম্পর্কেও কিছু জানে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আর ল্যাংডন যদি পাসওয়ার্ডটা জানতে পারে, তবে সেটা চাপ দিয়ে তার কাছ থেকে আদায় করাটা কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র।

এখানে নয়, অবশ্যই। অন্য কোথাও, নিরিবিলিতে। টিচার এ্যাবিতে ঢোকার সময় ছোট্ট একটা ঘোষণা সংবলিত সাইনবোর্ড দেখতে পেয়েছিলেন, সেটার কথা ভাবলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বুঝে গেলেন, কোথায় তাদেরকে ফাঁদে ফেলা যাবে।

এখন একমাত্র যে প্রশ্নটি…তা হলো, টোপ হিসেবে তিনি কী ব্যবহার করবেন।

 

৯৮.

ল্যাংডন আর সোফি চার্চের উত্তর দিকের স্তম্ভগুলোর কাছে চলে গেলো। অর্ধেক পথ পাড়ি দেবার পরও তারা নিউটনের সমাধিটার কোন চিহ্নও দেখতে পেলো না। সমাধি ফলকটা অন্যান্য সমাধির ফলকের জন্য দূর থেকে দেখা যাচ্ছে না।

নিদেনপক্ষে বলা যায়, এখানে কেউ নেই, সোফি ফিসফিস্ করে বললো।

ল্যাংডনও তার সাথে একমত হয়ে স্বস্তিবোধ করলো। নিউটনের সমাধির চার পাশটা একেবারেই ফাঁকা। ওখানে আমি যাচ্ছি, সে নিচু স্বরে বললো। তুমি এখানেই থাকো, ঘটনাক্রমে যদি কেউ–

সোফি তার সাথে ইতিমধ্যেই রওনা দিয়ে দিয়েছিলো।–আমাদের নজরদারী করতে থাকে, ল্যাংডন দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

বিশাল গোল চত্বরটার অতিক্রম করে ল্যাংডন আর সোফি মনোরম সমাধিটার সামনে এসে পড়লো। এটা দেখতে অদ্ভুত রকম সুন্দর…কালো মার্বেলের একটা সমাধি ফলক…হেলে থাকা নিউটনের একটা মূর্তি…ডানাযুক্ত দুটো বাচ্চা ছেলে…একটা বিশাল পিরামিড…আর…একটা বড়সড় গোলক।

তুমি কি এটা সম্পর্কে জানতে? সোফি বললো, তার কণ্ঠে বিস্ময়।

ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো, সেও অবাক হয়েছে।

দেখে মনে হচ্ছে, এসব নক্ষত্রপুঞ্জগুলো এটার ওপরে খোঁদাই করা হয়েছে, সোফি বললো।

জায়গাটার দিকে এগোতেই, ল্যাংডনের মনে হলো, একটা উত্তেজনায় সে ডুবে যাচ্ছে। নিউটনের সমাধিটা গোলক দিয়ে পরিপূর্ণ-তারা, ধূমকেতু, গ্রহ-নক্ষত্র। যে গোলক তুমি খোঁজো, সেটা তাঁর সমাধিতেই থাকার কথা? এখন এটা দেখে মনে হচ্ছে, একটা বিশাল গলফ মাঠের ঘাসের মধ্যে হারানো একটা ব্রেড খোজার মতো একটি ব্যাপার।

গ্রহাণুপুঞ্জ, সোফি বললো, তাকে দেখে চিন্তিত মনে হলো। অনেকগুলোই আছে।

ল্যাংডন চিন্তিত হয়ে পড়লো। গ্রহ-নক্ষত্র আর গ্রেইলের সাথে একমাত্র সংযোগটা হলো, ভেনাসের পেনটাকল। আর ইতিমধ্যেই, Venus পাসওয়ার্ডটা টেম্পল চার্চে যাবার সময় সে ব্যবহার করে ফেলেছে।

সোফি সরাসরি সমাধির দিকে চলে গেলো, কিন্তু ল্যাংডন কয়েক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে থেকে চারপাশটায় চোখ রাখলো।

ডিভাইনিটি, সোফি বললো, মাথাটা ঝুঁকে, নিউটন যেসব বইয়ের ওপর ভর দিয়ে হেলান দিয়ে রয়েছেন সেগুলোর শিরোনামগুলো পড়লো। ক্রনোলজি। অপটিক্স ফিলোসফেই ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা? সে ল্যাংডনের দিকে ঘুরলো। কিছু ধরতে পারলে?

ল্যাংডন কয়েক পা এগিয়ে এসে সেগুলো দেখলো। প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমাটিকা, যতোদূর আমার মনে আছে, মধ্যাকর্ষণ শক্তি নিয়ে, যা আমাদের গ্রহসমূহকে টেনে রেখেছে…মানে গোলক সংক্রান্ত, মানতেই হবে, এটা কোন কাজে আসবে বলে মনে হচ্ছে না।

রাশিচক্রের চিহ্নটার ব্যাপারে কি বলা যায়? গোলকের ভেতরের নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে ইঙ্গিত করে সোফি জিজ্ঞেস করলো। তুমি এর আগে পিসেজ আর অ্যাকোয়ারিস-এর ব্যাপারে বলেছিলে, তাই না?

শেষ দিন, ল্যাংডন ভাবলো। পিসেজের শেষ, আর অ্যাকোয়ারিসের সূচনাকে বলা হয় প্রায়োরিদের স্যাংগৃল দলিল-দস্তাবেজগুলো প্রকাশ করার পরিকল্পনার ঐতিহাসিক দিনক্ষণ। কিন্তু মিলেনিয়ামটা এসে চলে গেলো, কোন ঘটনা না ঘটেই, কখন সত্যটা জানা যাবে এই অনিশ্চয়তায় ইতিহাসবেত্তাদেরকে ফেলে দিয়ে।

মনে হচ্ছে এটা সম্ভব, সোফি বললো, প্রায়োরিদের সত্য প্রকাশের পরিকল্পনাটার সাথে কবিতাটার শেষ লাইনের একটা সম্পর্ক আছে।

এটা বিবৃত করে গোলাপের শরীর আর বীজপ্রসূ গর্ভের আখ্যান। ল্যাংডন একটা সম্ভাবনার কথা ভেবে কেঁপে উঠলো। সে এই লাইনটার কথা এর আগে এভাবে ভাবেনি।

তুমি আমাকে আগে বলেছিলে, সোফি বললো, যে, প্রায়েরিদের সত্য প্রকাশের পরিকল্পনাটা, গোলাপ আর তাঁর গর্ভ, সরাসরি গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের সাথে সংযুক্ততার মানে, গোলক।

ল্যাংডন তার কথাটার সাথে সায় দিলো। তার মনে হলো, একটা সম্ভাবনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তারপরও, তার ইনটুইশন বলছে, জ্যোর্তিবিদ্যা এটার মূল চাবিকাঠি নয়। গ্র্যান্ড মাস্টারের আগের সবগুলো সমাধানই শব্দ-বাক্যের চাতুর্য আর প্রতীকধর্মী ছিলো—মোনালিসা, ম্যাডোনা অব দি, রস, সোফিয়া। তাই এখন রাশিচক্র আর গ্রহ সংক্রান্ত গোলককে ঠিক আস্থায় নেয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া, জ্যাক সনিয়ে নিজেকে একজন নিখুঁত কোড লেখক হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তাই, ল্যাংডন বিশ্বাস করে, তাঁর শেষ পাসওয়ার্ডটা হবে শুধুমাত্র প্রতীকধর্মীই নয়, বরং স্ফটিকের মতোই স্বচ্ছ।

দ্যাখো! সোফি আতকে উঠে ল্যাংডনের হাতটা খামছে ধরলে তার চিন্তা-ভাবনা একটা ঝাকুনি খেয়ে গেলো। সোফির ভয়ার্ত অবস্থা দেখে ল্যাংডনের মনে হলো, কেউ হয়তো তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু, সে যখন তার দিকে ঘুরলো, দেখলো সোফি কালো মার্বেলের সমাধি ফলকটার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। এখানে কেউ ছিলো, সমাধি ফলকের কাছে ইঙ্গিত করে সোফি চাপা কণ্ঠে বললো। নিউটনের ডান দিকের পায়ের কাছে।

ল্যাংডন তার ইঙ্গিতটা ধরতে পারলো না। একজন ভুলো মনা পর্যটক সমাধি ফলকের কাছে কবরের গাঁয়ে আঁকা-আঁকি করার জন্য ব্যবহৃত চারকোল পেন্সিল। নিউটনের পায়ের কাছে ফেলে গেছে। এটা তেমন কিছু না। ল্যাংডন সেটা তুলতে যেতেই দেখতে পেলো পালিশ করা কালো মার্বেলটাতে কিছু একটা লেখা রয়েছে, সে একেবারে জমে গেলো। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলো, সোফি কেন ভয় পেয়েছে।

সমাধি ফলকে নিউটনের মূর্তিটার পায়ের নিচে, চারকোল পেন্সিলে লেখা একটা মেসেজ রয়েছে :

টিবিং এখন আমার কাছে।
চাপ্টার হাউজে যান,
দক্ষিণ দিকে বের হবার দরজার বাইরে,
পাবলিক গার্ডেনে।

ল্যাংডন কথাগুলো দুবার পড়লো, তার হৃদস্পন্দন পাগলা ঘোড়ার মতো লাফাচ্ছে এখন।

সোফি ঘুরে চারপাশটা ভালো করে দেখে নিলো।

একটা ভয়ের চাদর তাদেরকে ঢেকে দিলেও, এই লেখাগুলো দেখে ল্যাংডন মনে মনে বললো, এটা একটা ভালো খবরই। লেই তাহলে বেঁচে আছে। এখানে আরেকটা ব্যাপারও স্পষ্ট। তারা পাসওয়ার্ডটা জানে না, সে চাপা কণ্ঠে বললো।

সোফি সায় দিলো। তা না হলে তো, তারা তাদের উপস্থিতিটা জানাতো না?

তারা হয়তো লেইয়ের বিনিময়ে পাসওয়ার্ডটা চায়।

অথবা এটা একটা ফাঁদ।

ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো। আমি তা মনে করি না। গার্ডেনটা এ্যাবির দেয়ালের ঠিক ওপাশেই। একটা পরিচিত পাবলিক প্লেস। ল্যাংডন একবার এ্যাবির বিখ্যাত। কলেজ গার্ডেনটাতে গিয়েছিলো একটা ছোট ফল আর ঔষধি গাছের বাগান—এক সময় পাদ্রীরা সেখানে প্রাকৃতিক ঔষধ ফলাতো। ফলের বাগানের পরিচয় ছাড়াও কলেজ গার্ডেনটা পর্যটকদের জন্য খুবই জনপ্রিয় একটি স্পট। এ্যাবিতে না ঢুকেই সেখানে যাওয়া যায়। আমার মনে হচ্ছে, আমাদেরকে বাইরে দেখা করতে বলাটার কারণ, যাতে আমরা আস্থা রাখি, বিশ্বাস করি। নিরাপদ মনে করি।

সোফিকে সন্দেহগ্রস্ত দেখালো। তুমি বলতে চাচ্ছো বাইরে, তার মানে কোন মেটাল ডিকটেটর নেই?

ল্যাংডন ঢোক গিললো সোফির কথায় যুক্তি আছে। গোলক-পূর্ণ সমাধি ফলকের দিকে তাকিয়ে, ল্যাংডন ভাবলো, ক্রিপ্টেক্সর পাসওয়ার্ডটা সম্পর্কে যদি তার কোন ধারণা থাকতো…যা দিয়ে সে দরকষাকষি করতে পারবে। আমি লেইকে এ ব্যাপারে জড়িয়েছি, আর তাঁকে উদ্ধার করার জন্য আমাকে যা দরকার তাই করতে হবে।

লেখাটাতে চাপ্টার হাউজের বের হবার দক্ষিণ দিকের জায়গাটাতে যেতে বলা হয়েছে, সোফি বললো, হয়তো বাইরে থেকে আমরা গার্ডেনটা দেখতে পাবো? এভাবে আমরা ওখানে গিয়ে কোন বিপদে পড়ার আগেই, অবস্থাটা বুঝতে পারবো?

আইডিয়াটা ভালোই। ল্যাংডন খুব সহজেই চাপ্টার হাউজের কথাটা স্মরণ করতে পারলো, যেখানে একটা বিশাল আট কোনার ভবন রয়েছে, আধুনিক পার্লামেন্ট ভবনের আগে, সেটাই ছিলো বৃটিশ পার্লামেন্ট। অনেক বছর আগে, সে ওখানে গিয়েছিলো, তারপরও, তার মনে পড়লো, সেখানে কোথাও প্রাচীরবেষ্টিত একটি মঠ রয়েছে। সমাধিটা থেকে কয়েক হাত পিছিয়ে গিয়ে, ল্যাংডন ডান দিকের কয়্যার স্ক্রিনের দিকে তাকালো।

সেখানে সরু গিরিখাদের মতো একটা পথ রয়েছে, যার ওপরেই আছে একটা সাইনবোর্ড।

এই দিকে:
ক্লয়েস্টার
যাজকের কার্যালয়
কলেজ হল
জাদুঘর
পিক্স চেম্বার
সেন্ট ফেইথ চ্যাপেল
চাপ্টার হাউজ

ল্যাংডন আর সোফি তাড়াহুড়া করে, দৌড়াতে দৌড়াতে সাইনবোর্ডেটার নিচ দিয়ে সেই পথটাতে ঢুকে পড়লো। ঢোকার সময় তারা লক্ষ্যই করতে পারলো না, ছোষ্ট্র একটা ঘোষণা সংবলিত নোটিশ টাঙানো আছে, তাতে বলা আছে, কিছু এলাকা সংস্কার কাজে জন্য বন্ধ রয়েছে।

তারা সঙ্গে সঙ্গেই একটা উঁচু প্রাচীর ঘেরা ছাদ-খোলা প্রাঙ্গণে এসে পড়লো, সকালের বৃষ্টির মধ্যেই। তাদের মাথার ওপর প্রচণ্ড বাতাস বইছে। নিচু হয়ে আসা সংকীর্ণ গলিটাতে ঢুকতেই, যা প্রাঙ্গনের চারপাশটাকে বেষ্টন করে রেখেছে, ল্যাংডনের সেই চিরচেনা অস্বস্তিটা শুরু হলো—কোন আবদ্ধ জায়গায় তার এরকমটি হয়ে থাকে। এইসব গলিগুলোকেই কুয়েস্টার বলে। এজন্যেই আবদ্ধ জায়গার ব্যাপারে ভীতিকে বলে ক্লাস্ট্রোফোবিক।

টানেলটার ঠিক শেষ মাথার দিকে তারা এগিয়ে গেলো। ল্যাংডন চাপ্টার হাউজের সাইনটা অনুসরণ করলো। বৃষ্টিটা এখন প্রচণ্ড বেগে পড়ছে। বিপরীত দিক থেকে আরেক জোড়া নারী-পুরুষ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে তাড়াহুড়া করে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। কুয়েস্টারটা এখন একেবারে ফাঁকা।

পূর্বদিকে, ক্লায়েস্টার থেকে চল্লিশ গজ দূরে, একটা খিলানযুক্ত পথ বাম দিকে চলে গেছে অন্য আরেকটা হলওয়ের অভিমুখে। যদিও এটাই সেই প্রবেশ-পথ যা তারা খুঁজছে, কিন্তু সেটার খোলা জায়গাটা পরিত্যক্ত মাল-সামাল দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সেখানে একটা অফিশিয়াল সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে।

সংস্কার কাজের জন্য বন্ধ আছে
পিক্স চেম্বার
সেন্ট ফেইথ চ্যাপেল
চাপ্টার হাউজ

সঙ্গে সঙ্গে ল্যাংডন মাল সামালগুলোর ভেতর দিয়ে দেখতে পেলো পিক্স চেম্বার আর সেন্ট ফেইথ চ্যাপেলের প্রবেশপথটা ডান আর বাম দিকে। চাপ্টার হাউজের প্রবেশ পথটা, আরো বেশি দূরে, দীর্ঘ হলওয়ের শেষ মাথায়। এমন কি এখান থেকেও, ল্যাংডন সেটার ভারি কাঠের দরজাটা খোলা দেখতে পেলো। চাপ্টার হাউজে যান, দক্ষিণ দিকে বের হবার জায়গাটার সামনে, পাবলিক গার্ডেনে।

আমরা পূর্বদিকের কুয়েস্টারটা ফেলে এসেছি, ল্যাংডন বললো, সুতরাং বাগান থেকে দক্ষিণ দিকে বের হবার জায়গাটা ওখানেই হবে, ডান দিকে।

সোফি মাল-সামালগুলো ইতিমধ্যেই পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলো।

অন্ধকারচ্ছন্ন করিডোরটা দিয়ে তাড়াহুড়া করে ছুটতেই তাদের পেছনে বাতাস আর বৃষ্টির শব্দটা মিইয়ে গেলো। চাপ্টার হাউজ ভবনটা তাদের সামনে আবির্ভূত হলো।

এটা দেখতে অনেক বড়, সামনের দিকে এগোতেই সোফি বললো।

ল্যাংডন ভুলেই গিয়েছিলো এই ভবনটা কত বড়। এখান থেকেই তারা গার্ডেনটার দৃশ্য দেখতে পারবে।

প্রবেশস্থলটা পার হতেই, ল্যাংডন আর সোফি তীর্যক চোখে একে অন্যেকে দেখে নিলো। গুমোট ক্লয়েস্টারের পর চাপ্টার হাউজটা মনে হলো একটা কাঁচের ঘরের মতো। ঘরটার ভেতরে দশ ফুট যেতেই দক্ষিণ দিকের দেয়ালটা বুজলো, বুঝতে পারলো, যে দরজাটার কথা তাদেরকে বলা হয়েছিল, সেটা ওখানে নেই।

একটা বিশাল কানা গলিতে তারা দাঁড়িয়ে আছে।

তাদের পেছনের ভারি দরজাটার খটখট শব্দে তারা ঘুরে তাকালো। দরজাটা একটা ভোতা শব্দে বন্ধ হয়ে গেলো। দরজার পেছনে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে খুব ধীর-স্থির দেখাচ্ছে। লোকটা তাদের দিকে পিস্তলটা তাক করে ধরে রেখেছে। লোকটা একদিকে কাত হয়ে দুটো এলুমিনিয়ামের ক্রাচের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য ল্যাংডনের মনে হলো, সে স্বপ্ন দেখছে। লোকটা হলো লেই টিবিং।

 

৯৯.

সার লেই টিবিং সোফি আর ল্যাংডনের দিকে তাঁর মেডুসা রিভলবারটা তা করে ধরে রাখাতে একটু দুঃখিত হলো। আমার বন্ধুরা, তিনি বললেন, গত রাতে আপনারা আমার বাড়িতে আসার পর থেকেই আমি আপনাদেরকে সবধরনের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু, আপনাদের নাছোর বান্দার মতো লেগে থাকাটা আমাকে একটা কঠিন অবস্থার মধ্যে এনে দাঁড় করিয়েছে।

তিনি সোফি আর ল্যাংডনের চোখে-মুখে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়ার অভিব্যক্তিটা দেখতে পেলেন। তারপরও, তার দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, খুব শীঘ্রই তারা দুজনেই এই ঘটনা পরম্পরার ব্যাপারটা বুঝতে পারবে, যা তাদের তিন জনকে এরকম একটি অদ্ভুত পরিস্থিতিতে এনে ফেলেছে।

আপনাদের দুজনের কাছেই আমার অনেক কিছু বলার আছে … অনেক কিছু, যা এখনও আপনারা বুঝতে পারছেন না।

দয়া করে বিশ্বাস করুন, টিবিং বললেন, আপনাদেরকে জড়ানোর কোন ইচ্ছেই আমার ছিলো না। আপনারা আমার বাড়িতে আমার খোঁজেই এসেছিলেন।

লেই? ল্যাংডন অবশেষে মুখ খুললো। আপনি এসব কি করছেন? আমরা ভেবেছিলাম আপনি খুব বিপদে রয়েছেন। আমরা আপনাকে সাহায্য করতেই এখানে এসেছি।

আমারও বিশ্বাস ছিলো, আপনি সেটা করবেন, তিনি বললেন। আমাদের অনেক কিছুই আলোচনা করার আছে।

ল্যাংডন আর সোফি তাদের দিকে তাক করে রাখা রিভলবারটা থেকে বিস্মিত চোখটা কোনভাবেই সরাতে পারছিলো না।

এটা আপনাদেরকে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত করতে চাই যে, টিবিং বললেন, আমি যদি আপনাদের কোন ক্ষতি করতে চাইতাম, তো ইতিমধ্যেই আপনারা মারা যেতেন। আপনারা গত রাতে আমার বাড়িতে আসার পর থেকে, আপনাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সব কিছুই করেছি। আমি একজন সম্মানিত ব্যক্তি। আর আমি প্রতীজ্ঞা করেছিলাম, কেবল তাদেরকেই বলি দেবো, যারা স্যাংগৃলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

বলছেন কি এসব? ল্যাংডন বললো। স্যাংগৃলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।

আমি একটা ভয়ংকর সত্য জানতে পেরেছি, টিবিং দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। আমি জেনে গেছি, কেন স্যাংগৃল দলিল-দস্তাবেজগুলো পৃথিবীর কাছে উন্মোচিত করা হয়নি। আমি জেনে গেছি, প্রায়োরিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দলিলগুলো আর প্রকাশ করা হবে না। এজন্যেই, মিলেনিয়ামটা কোন ধরনের উন্মোচন ছাড়াই পার হয়ে গেলো। আর শেষ দিন সমাগত হবার পরও কিছুই ঘটেনি।

ল্যাংডন প্রতিবাদ করার জন্যে একটা দম নিয়ে নিলো।

প্রায়োরিদেরকে, টিবিং বলা অব্যাহত রাখলেন, সত্যটা প্রকাশ করার জন্য একটা পবিত্র দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো, স্যাংগৃল দলিলগুলো শেষ দিন সমাগত হলে প্রকাশ করতে হবে। শত শত বছর ধরে দা ভিঞ্চি, বত্তিচেলি আর নিউটনের মতো ব্যক্তিরা দলিলগুলো রক্ষা করার জন্য সবকিছুই করেছেন, আর তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটা পালন করেছেন। আর এখন, প্রকাশ হবার অনিবার্য সময়টাতে, জ্যাক সনিয়ে তার সিদ্ধান্ত বদলে ফেললেন। তিনি নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে, খৃস্টিয় ইতিহাসে খৃস্টবাদকে সবচাইতে বেশি সম্মান দিয়েছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সময়টা প্রকাশ করার জন্য সঠিক নয়। টিবিং সোফির দিকে ফিরলেন। তিনি গ্রেইলকে ব্যর্থ করেছেন। প্রায়োরিদের ব্যর্থ করেছেন। আর তিনি, যে প্ৰজন্মটি এই মুহূর্তটাকে সম্ভব করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তাদের স্মৃতিকে ব্যর্থ করেছেন।

আপনি? চোখ তুলে তাকিয়ে সোফি জোরে বললো। তার সবুজ চোখে প্রচণ্ড ক্রোধ আর ঘৃণা ছড়াচ্ছে। আপনিই তাহলে আমার দাদুর হত্যার জন্য দায়ি?

টিবিং রেগে গেলেন। আপনার দাদু আর তাঁর সেনেক্যরা গ্রেইলের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছেন।

সোফির ভেতরে একটা ক্রোধের ঝড় বয়ে গেলো। মিথ্যে বলছে লোকটা!

টিবিংয়ের কণ্ঠটা দৃঢ়। আপনার দাদু চার্চের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছিলেন। এটা নিশ্চিত যে, তারা তার ওপর সত্যটা চেপে যাবার জন্যে প্রচণ্ড চাপ দিয়েছিলেন।

সোফি মাথা ঝাঁকালো। আমার দাদুর ওপর চার্চের কোন প্রভাব ছিলো না!

টিবিং শীতল একটা হাসি দিলেন। মাই ডিয়ার, যারা চার্চের মিথ্যাকে প্রকাশ করার হুমকি দেয়, তাদেরকে নিবৃত্ত করার দুহাজার বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে চার্চের। কনস্টানটিনের সময় থেকেই, চার্চ খুব সফলভাবেই, ম্যারি মাগদালিন আর যিশু সম্পৰ্কীয় সত্যটা লুকিয়ে রাখতে পেরেছে। আমাদেরকে এখন, অবাক হলে চলবে না যে, তারা আবারো পৃথিবীকে অন্ধকারে রাখার পথটা খুঁজে পেয়েছে। চার্চ তো আর ক্রুসেডার নিয়োগ করে অবিশ্বাসীদেরকে নির্মূল করতে পারবে না, কিন্তু তাদের প্রভাব একটুও কমেনি। কমেনি তাদের ছলনা আর প্রতারণা। তিনি থামলেন, যেনো সেটা তার কথাটা বলার জন্য। মিস নেভু, কয়েকদিন ধরে আপনার দাদু আপনার পরিবার সম্পর্কে সত্য কথাটা বলতে চাচ্ছিলেন।

সোফি দারুণ বিস্মিত হলো। আপনি সেটা কীভাবে জানলেন?

আমার পদ্ধতিগুলো সম্পকে জানাটা এখানে অবান্তর। আপনার জন্য এখন যেটা জরুরি, সেটা হলো, এই কথাটা জানা, একটা নিঃশ্বাস নিলেন তিনি, যে, আপনার বাবা-মা আর ভাইয়ের মৃত্যুটা কোন দূর্ঘটনা ছিলো না।

কথাটা সোফির আবেগকে আবার জাগিয়ে তুললো, সে কথা বলার জন্য মুখ খুলতে গেলো, কিন্তু পারলো না।

ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো। আপনি বলছেন কি?

রবার্ট, এটা সব কিছুকেই ব্যাখ্যা করে, সবগুলো অংশই ঠিক ঠিক মিলে যায়। স্যাংগুলের ব্যাপারে চুপ করার জন্য খুন করার নজির অতীতেও চার্চের রয়েছে। শেষ দিন সমাগত হবার সাথে সাথেই গ্র্যান্ড মাস্টারের প্রিয় মানুষদেরকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে একটা পরিষ্কার বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছিলো। চুপ থাকো, নয়তো এরপরে তুমি আর সোফি।

ওটা একটা গাড়ি দূর্ঘটনা ছিলো, সোফি জোর দিয়ে বললো। একটা দূর্ঘটনাই!

আপনার নিষ্কলুষতাকে রক্ষা করার জন্য একটা ছেলে ভোলানো গল্প, টিবিং বললেন। বিবেচনা করুন, শুধুমাত্র দুজন সদস্যকে অক্ষত রাখা হয়েছে-প্রায়োরির গ্র্যান্ড মাস্টার আর তার একমাত্র নাতনী চার্চ কর্তৃক ভ্রাতৃসংঘকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটা যথার্থ অবস্থা। আমি কেবল অনুমান করতে পারি, বিগত বছরগুলোতে চার্চ আপনার দাদুকে হুমকি দিয়ে আসছিলো, তিনি যদি স্যাংগৃল দলিলগুলো প্রকাশ করেন, তবে আপনাকে হত্যা করা হবে। তারা আরো হুমকি দিয়েছিলো, আপনার দাদু যেনো প্রায়োরিদের পুরনো প্রতীজ্ঞাটা পুণর্বিবেচনা করার জন্য উদ্যোগ নেন, তা না হলে, তারা তাদের কাজটা সমাধা করবে।

লেই, ল্যাংডন তর্ক করে বললো। নিশ্চিতভাবেই, আপনার কাছে কোন প্রমাণ নেই যে, এসব হত্যাকাণ্ড চার্চই করেছে। অথবা প্রায়োরিদের সিদ্ধান্ত বদলাতে প্রভাব বিস্তার করেছে তারা।

প্রমাণ? টিবিং পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। আপনি প্রমাণ চাচ্ছেন, প্রায়োরিদের প্রভাবিত করা হয়েছিলো কি না? নতুন মিলেনিয়াম এসে গেছে, তারপরও দুনিয়ার সবাই অন্ধকারেই আছে। এটাই কি যথেষ্ট প্রমাণ নয়?

টিবিংয়ের কথার প্রতিধ্বনির মধ্যে সোফি আরেকটা কণ্ঠ শুনতে পেলো। সোফি, তোমার পরিবার সম্পর্কে আমাকে সত্যটা বলতেই হবে। বুঝতে পারলো, সে কাঁপছে। এটাই সেই সত্য, যা তার দাদু তাকে বলতে চেয়েছিলেন? তার পরিবারকে খুন করা হয়েছে? যে দুর্ঘটনা তার পরিবারকে কেড়ে নিয়েছিলো, সে সম্পর্কে সে আসলে সত্যিকারভাবে কতটুকু জানে? শুধু ভাসা ভাসা কিছু বিবরণ। এমন কি সংবাদপত্রেও খবরটা তেমনভাবে আসেনি। একটা দূঘর্টনা? ছেলে ভুলানো গল্প? সোফির আচমকাই তার দাদর অতি নিরাপত্তামূলক আচরণের কথাটা মনে পড়ে গেলো। তিনি কখনও সোফিকে তার ছেলেবেলায় একা ছাড়তে চাইতেন না। এমন কি বড় হবার পর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও সে টের পেতো, তার দাদু তাকে কড়া নজরে রাখছেন। সে ভাবলো, তবে কি তাকে প্রায়োরি সদস্যরা আড়াল থেকে চোখে চোখে রাখতো। দেখাশোনা করতো।

আপনি সন্দেহ করছেন, তাঁকে কুক্ষিগত করা হয়েছিলো, ল্যাংডন বললো, অবিশ্বাসে সে টিবিংয়ের দিকে তাকালো। আর তাই আপনি তাকে খুন করলেন?

আমি টৃগারটা টানিনি, টিবিং বললেন। সনিয়ে অনেক বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন, যখন চার্চ তাঁর পরিবারকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলো। তিনি আপোস করে ফেলেছিলেন। এবার তিনি সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁর ওপর অর্পিত পবিত্র দায়িত্বটা পালন না করার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। বিকল্পটি বিবেচনা করুন। কিছু একটা করতেই হোতো, পৃথিবী কি চিরদিনের জন্য অজ্ঞই থাকবে? চার্চ কি সারাজীবনের জন্য তাদের মিথ্যাটাকেই ইতিহাসের বইয়ে প্রতিষ্ঠিত করে রাখবে? চার্চকে কি হত্যা আর শঠতা করার অনুমতি দেয়া অব্যাহত রাখা হবে? না, কিছু একটা করার দরকার ছিলো। এখন আমরা, সনিয়ের ধারাক্রমটা বজায় রাখতে পারি। তিনি থামলেন। আমরা তিন জন। একসাথে।

সোফি কেবল ঘৃণাই অনুভব করতে পারলো। আপনি কিভাবে বিশ্বাস করলেন, আমরা আপনাকে সাহায্য করবো?

কারণ, মাইডিয়ার, প্রায়োরিরা যে দলিলগুলো প্রকাশে ব্যর্থ হয়েছে, তার কারণ আপনিই। আপনার দাদু, আপনার প্রতি তাঁর যে ভালবাসা ছিলো, সেটাই তাঁকে চার্চের সাথে দ্বন্দ্বে যেতে দেয়নি। তাঁর একমাত্র ভয় ছিলো, বেঁচে থাকা একমাত্র সদস্যকে হারানোর। তিনি কখনও সত্য কথাটা আপনাকে বলে যেতে পারেননি, কারণ আপনি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁকে হাত-পা বেঁধে অপেক্ষায় রাখতে বাধ্য করেছিলেন। এখন, আপনি পৃথিবীর কাছে সত্যটা প্রকাশ করার জন্য ঋণী হয়ে গেছেন। আপনি এটা করবেন, আপনার দাদুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই।

 

রবার্ট ল্যাংডন টিবিংকে বোঝানোর চেষ্টা বাদ দিলো। যদিও তার মনে একগাদা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তারপরও সে জানতো, এখন একটা জিনিসই করার আছে—এখান থেকে সোফিকে জীবিত অবস্থায় বের করে নিয়ে আসা। ল্যাংডন এর আগে টিবিংকে এই ঘটনায় জড়িত করার জন্য অপরাধ বোধে ভুগছিলো, আর এখন সেটা বদলে গিয়ে সোফিকে জড়ানোর জন্য নিজেকে দায়ি করলো। আমি সোফিকে শ্যাতু ভিলেতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমিই দায়ি।

ল্যাংডনের মনে হলো না, লেই টিবিং তাদেরকে এই চাপ্টার হাউজে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারবে। তারপরও, এটাতো ঠিক, ভুল পথে গ্রেইল অন্বেষণ করতে যেয়ে টিবিং বাকিদেরকে হত্যা করিয়েছে। ল্যাংডনের মনে হলো, এই জায়গাটাতে গুলির শব্দ হলে, সেটা বাইরে মোটেও শোনা যাবে না, মোটা দেয়াল আর প্রচণ্ড বৃষ্টির জন্যই। লেই তো এইমাত্র আমাদের কাছে নিজের অন্যায়ের কথাটা স্বীকার করেছেন।

ল্যাংডন সোফির দিকে তাকালো, সে কাঁপছে। প্রায়োরিদের নিপ করার জন্য চার্চ সোফির পরিবারকে খুন করেছে?

ল্যাংডনের হঠাৎ করেই মনে হলো, আধুনিক চার্চ মানুষ হত্যা করে না। অন্য কোন ঘটনা আছে এতে।

সোফিকে যেতে দিন, ল্যাংডন লেইর দিকে তাকিয়ে বললো। আপনি আর আমি এটা নিয়ে কথা বলি।

টিবিং একটা অতিপ্রাকৃত হাসি দিলেন। আমি দুঃখিত, এই কাজটা করতে পারছি। আমি বরং আপনাকেই যেতে দিতে পারি। ক্রাচের ওপর পুরোপুরি ভর দিয়ে নির্দয়ভাবে টিবিং সোফির দিকে অস্ত্রটা ধরলো, আরেক হাতে, পকেট থেকে কি স্টোনটা বের করে আনলেন। সেটা এমনভাবে হাতে তুলে নিলেন, যেনো ল্যাংডনকে ওটা দেবেন। বিশ্বাসের একটা টোকেন, রবার্ট।

রবার্ট খুব ঘাবড়ে গেলো, একটুও নড়লো না। লেই কি-স্টোনটা আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছেন।

নিন, টিবিং ল্যাংডনের দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে বললেন।

টিবিং এটা কেন ফিরিয়ে দিচ্ছে, সে সম্পর্কে ল্যাংডন কেবল একটা কথাই ভাবতে পারলো। আপনি ওটা ইতিমধ্যেই খুলেছেন। মানচিত্রটা সরিয়ে ফেলেছেন।

টিবিং মাথা ঝাঁকালেন। রবার্ট, আমি যদি কি-স্টোনটা সমাধান করতেই পারতাম, তবে গ্রেইলটা খুঁজে পাওয়ার জন্য উধাও হয়ে যেতাম, আর আপনাকেও এ ঘটনায় জড়াতাম না। না, আমি উত্তরটা জানি না। আর সেই কথাটা আমি খোলাখুলিই স্বীকার করতে পারি। একজন সত্যিকারের নাইট গ্রেইলে মুখোমুখি বিব্রতকর হয়। আমি যখন আপনাকে এ্যাবিতে ঢুকতে দেখলাম, বুঝেছিলাম, আপনারা একটা কারণেই এখানে এসেছেন। সাহায্য করতে। গ্রেইল আমাদের সবাইকে খুঁজে নিয়েছে। আর এখন, সে প্রকাশ হবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছে। আমাদেরকে অবশ্যই এক সাথে কাজ করতে হবে।

যদিও টিবিং সহযোগীতার কথা বলছেন, তাঁর অস্ত্রটা কিন্তু সোফির দিকেই তাক্‌ করা। ল্যাংডন সামনের দিকে এগিয়ে টিবিংয়ের কাছ থেকে মার্বেলের সিলিন্ডারটি নিয়ে নিলো। ডায়ালগুলো এখনও এলোমেলো হয়ে আছে, ক্রিপ্টেটা বন্ধই রয়েছে।

ল্যাংডন টিবিংয়ের দিকে তাকালো। আপনি কিভাবে বুঝলেন, আমি এটা ভেঙে ফেলবো না?

টিবিংয়ের হাসিটা ছিলো ভুতুরে ধরনের। আমার বোঝা উচিত ছিলো, টেম্পল চার্চের ভেতরে আপনার ভেঙে ফেলার হুমকিটা মিথ্যে ছিলো। রবার্ট ল্যাংডন কখনও কি-স্টোনটা ভাঙবে না। আপনি একজন ইতিহাসবিদ, রবার্ট। আপনি হাতে ধরে রেখেছেন দুহাজার বছরের ইতিহাস স্যাংগৃলের হারানো চাবি। এই সিক্রেটটা রক্ষা করতে গিয়ে যেসব নাইট আগুনে পুড়ে মরেছে, তাদের আত্মাটা আপনি অনুভব করতে পারেন। আপনি কি তাদের মৃত্যুগুলোকে ব্যর্থ করে দেবেন? না, আপনি সেটা করবেন না। আপনি যেসব লোককে শ্রদ্ধা করেন, তাদের সারিতে যোগ দেবেন—দা ভিঞ্চি, বত্তিচেল্লি, নিউটন তাদের সম্মানিত হবার সুযোগটা এখন আপনার পায়ের নিচে এসে পড়েছে। কি-স্টোনটার বিষয়-বস্তু আমাদের কাছে চিৎকার করে আবেদন করছে। মুক্ত হবার জন্য উদগ্রীব। সময় এসে গেছে। নিয়তি আমাদেরকে এই মুহূর্তটাতে এনে দাঁড় করিয়েছে।

আমি আপনাকে সাহায্য সাহায্য করতে পারবো না, লেই। এটা কীভাবে খোলা যায়, সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই নেই। আমি নিউটনের সমাধিটা কেবলমাত্র অল্প সময়ের জন্য দেখেছি। আর আমি যদি পাসওয়ার্ডটা জানিও… ল্যাংডন থামলো, বুঝতে পারলো, সে খুব বেশি বলে ফেলছে।

আপনি আমায় বলবেন না? টিবিং দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি হতাশ এবং বিস্মিত হয়েছি রবার্ট, আপনি আমার ঋণের ব্যাপারটা খেয়াল করছেন না। আমার কাজটা খুব বেশি সহজ হতো, যদি রেমি আর আমি আপনাদের দুজনকে শ্যা ভিলেতেই শেষ করে দিতে পারতাম। তার বদলে, আমি আপনাদের সাথে বদান্যতা দেখিয়েছি, সমস্ত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও।

এটা বদান্যতা? অস্ত্রের দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন জানতে চাইলো।

দোষটা সনিয়ের, টিবিং বললেন। তিনি আর তার সেনেকরা সাইলাসের কাছে মিথ্যে বলেছেন। তা না হলে, আমি কোন ধরনের জটিলতা ছাড়াই কি-স্টোনটা হস্তগত করতে পারতাম। আমি কীভাবে জানবো যে, গ্র্যান্ড মাস্টার এরকম চালাকি করবেন, আমাদেরকে ধোঁকা দেবেন আর কি-স্টোনটা তার অজ্ঞাত নাতনীকে দিয়ে দেবেন? টিবিং সোফির দিকে ঘৃণাভরে তাকলেন। যে কিনা, এই জ্ঞানটা ধারণ করবার জন্য এতোটাই অযোগ্য যে, তার একজন সিম্বোলজিস্ট বেবি-সিটারের দরকার। টিবিং আবার ল্যাংডনের দিকে তাকালেন। সৌভাগ্যক্রমে, রবার্ট, আপনার জড়িয়ে পড়াটা আমার জন্যে সাপে বর হয়ে গিয়েছিলো। কি-স্টোনটা আজীবন। ডিপোজিটরি ব্যাংকের লকারে বন্দী হয়ে থাকার চেয়ে, আপনি বরং সেটা ওখান থেকে নিয়ে এসে আমার বাড়িতে হাজির হলেন।

এছাড়া আমি আর কোথায়ই বা যেতাম? ল্যাংডন ভাবলো। গ্রেইল ইতিহাসবিদদের সম্প্রদায়টা তো খুবই ছোট, আর টিবিং এবং আমার, এক সাথে কাজ করার একটা ইতিহাসও রয়েছে।

টিবিংকে দেখে খুব আত্মতৃপ্ত মনে হলো এখন। যখন আমি জানতে পারলাম, সনিয়ে আপনার কাছে একটা অন্তিম-বার্তা রেখে গেছেন, তখন আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলাম যে, আপনার কাছে প্রায়োরিদের সম্পর্কে খুবই দামি তথ্য রয়েছে। হয়, সেটা কি-স্টোন সম্পর্কে, নয়তো, সেটা কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কে, আমি অবশ্য নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু আপনার পেছনে পুলিশ লেগে যাওয়াতে, আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আপনি আমার কাছে আসতে পারেন।

ল্যাংডন ঠোঁট বেকিয়ে বললো। আর যদি না আসতাম?

তবে আমি একটা পরিকল্পনা করতাম, যাতে আপনি আমার একজন সাহায্যকরী হয়ে ওঠেন। যেভাবেই হোক, কি-স্টোনটা শ্যাতু ভিলেতেই আসতো।

কী! ল্যাংডন কষ্টে পেয়ে বললো।

সাইলাস শ্যাতু ভিলেতের বাড়িতে ঢুকে আপনাদের কাছ থেকে কি-স্টোনটা চুরি করার কথা ছিলো—এভাবে প্রেক্ষাপট থেকে আপনাদেরকে সরিয়ে দেয়া যেতো। তাতে আমাকে কোন সন্দেহ করা হতো না। কিন্তু, আমি যখন সনিয়ের কোডের ঘোর-প্যাচটা দেখতে পেলাম, সিদ্ধান্ত নিলাম, আপনাদের দুজনকে অতিথি হিসেবে আরো কিছুক্ষণ আঁটকে রাখি। আমি সাইলাসকে কি-স্টোনটা পরে চুরি করতে বলতাম, ভাবলাম, কাজটা আমার পক্ষেও করা সম্ভব।

টেম্পল চার্চে, সোফি বললল, তার কণ্ঠে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হবার ছাপ দেখা গেলো।

 

সব কিছুই এখন পরিষ্কার হতে শুরু করছে, টিবিং ভাবলেন। টেম্পল চার্চই হলো সোফি আর ল্যাংডনের কাছ থেকে কি-স্টোনটা চুরি করার সঠিক জায়গা ছিলো। রেমিকে যে আদেশ করা হয়েছিলো, সেটা ছিলো খুবই পরিষ্কার-সাইলাস যখন কি-স্টোনটা পুণরুদ্ধার করবে, তখন সবার অলক্ষ্যে থাকবে, তোমাকে যেনো কেউ দেখে না ফেলে। কিন্তু, ভাগ্য খারাপ, ল্যাংড়ন কি-স্টোনটা ভেঙে ফেলার হুমকি দেয়াতে রেমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। যদি, শুধুমাত্র রেমি নিজেকে ওভাবে প্রকাশ করে না ফেলতো, টিবিং বিষণ্ণ হয়ে ভাবলেন। তার মনে পড়ে গেলো, নিজের ভূয়া অপহরণটার কথা। রেমিই ছিলো আমার পরিচয়টা জানার ব্যাপারে একমাত্র সংযোগ, আর সেও কিনা নিজেকে দেখিয়ে ফেললো।

ভাগ্য ভালো, টিবিংয়ের সত্যিকারের পরিচয়টা সাইলাস জানতো না। তাই তাকে খুব সহজেই বোকা বানানো গেছে। লিমোজিনের ভেতরে সাউন্ডপ্রুফ দেয়ালটা তুলে দেয়াতে, সাইলাস আর রেমির মাঝখানে টিবিংয়ের অবস্থানটা আরো বেশি নিরাপদ হয়ে গিয়েছিলো। টিবিং সামনের সিটে বসে সাইলাসকে ফোন করে, টিচারের ফরাসি উচ্চারণে কথা বলে, সাইলাসকে সরাসরি ওপাস দাইর ভবনে চলে যেতে বলেন। পুলিশকে একটা ছোট্ট খবর দিলেই, তারা সাইলাসকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলতে পারবে।

একটাকে সরিয়ে ফেলা গেলো।

আরেকটা খুবই শক্ত। রেমি

টিবিং এই সিদ্ধান্তটা নিতে খুব দোটানায় ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রেমি নিজেকে একটা বোঝা হিসেবেই প্রমাণ করলো। প্রতিটি গ্রেইল অন্বেষণেই একটা বলির দরকার হয়। লিমোজিনের ওয়েট-বারটা টিবিংকে পরিষ্কার একটা সমাধান দিয়েছিলো ফ্লাস্কে অল্প পরিমাণ কগনাক আর এক ক্যান বাদাম। ক্যানের নিচে থাকা পাউডারটা রেমির এলার্জিটা উস্কে দেবার জন্য যথেষ্ট। রেমি যখন লিমোজিনটা হস গার্ড প্যারাডে পার্ক করলো, টিবিং পেছন থেকে নেমে পড়েছিলেন। তারপর সামনের ড্রাইভার সিটে রেমির পাশে গিয়ে বসলেন। মিনিট খানেক বাদে, টিবিং গাড়ি থেকে নেমে এলেন। রিয়ারটাতে আবার ঢুকে সমস্ত প্রমাণ-পত্র পরিষ্কার করে ফেললেন। এরপরই, নিজের মিশনের শেষ অংশটা সমাধান করতে নেমে পড়লেন।

ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবির রাস্তাটা হাটার জন্য খুবই ছোট্ট একটা পথ। টিবিংয়ের লেগব্রেস্ কাঁচ, আর অস্ত্রটা থাকা সত্ত্বেও, মেটাল দরজার সামনে পুলিশের লোকগুলো জানতো না, তারা কী করবে। আমরা কি তাঁকে তাঁর পায়ের ব্রেসটা খুলে হামাগুড়ি দিতে বলবো? টিবিং রক্ষীদেরকে সহজ একটা সমাধান দিয়েছিলেন সাইট খেতাব পাওয়ার একটা পরিচয়-পত্ৰ। ওটা দেখার সাথে সাথেই বেচারারা তাঁকে সসম্মানে স্যালুট দিয়ে ঢুকতে দিলো।

এখন, বিস্মিত ল্যাংডন আর সোফির দিকে চোখ রেখে টিবিং একটা তাড়না অনুভব করলো, সে কীভাবে, কত অসাধারণভাবে ওপাস দাইকে এই ষড়যন্ত্রে জড়িছে। সেই কথাটা। কিন্তু সেটা পরে বলা যাবে। এই মুহূর্তে, অন্য কাজ আছে।

মে এমি, টিবিং ফরাসিতে বললেন, ভু নো ক্রভেজ পাসলো সেনগ্রাল, সেস্ত লো সেন-গ্রাল কুই ভু ভে। তিনি হাসলেন। আমাদের এক সঙ্গে চলার পথটা এর চেয়ে বেশি স্পষ্ট হতে পারে না। গ্রেইল আমাদেরকে খুঁজে নিয়েছে।

নিরবতা।

তিনি এবার তাদেরকে চাপা কণ্ঠে বললেন। শুনুন। আপনারা কি এটা শুনতে পাচ্ছেন? গ্রেইলটা শত শত বছর ধরে আমাদেরকে বলে যাচ্ছে। সে প্রায়োরিদের শঠতার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে আবেদন করছে। আমি আপনাদের দুজনকেই অনুরোধ করবো, এই সুযোগটা গ্রহণ করুন। এই মুহূর্তে, আমাদের তিন জনের চেয়ে বেশি যোগ্য লোক পাওয়া যাবে না, যারা কোডটার মর্মোদ্ধার করে ক্রিপ্টোক্সটা খুলতে পারবে। টিবিং একটু থামলেন। তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করছে। আমাদের দরকার, এক সঙ্গে একটা শপথ নেয়ার। সত্যটা উদ্ধার করে সেটা জানিয়ে দেয়া।

সোফি টিবিংয়ের চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো, আমি আমার দাদুর হত্যাকারীর সঙ্গে কোন শপথ নেবো না। আমি কেবল শপথ নিতে পারি, আপনাকে জেলে পাঠাবার।

টিবিং একটু মর্মাহত হলেন, তারপর সেটা কাটিয়ে উঠলেন। আমি দুঃখিত, আপনি এভাবে ভাবছেন, মাদামোয়াজেল। অস্ত্রটা ঘুরিয়ে তিনি ল্যাংডনের দিকে তাক করলেন। আর আপনি, রবার্ট? আপনি কি আমার সাথে আছেন, নাকি আমার বিরুদ্ধে?

 

১০০.

বিশপ ম্যানুয়েল আরিজারোসার শরীরটা অনেক ধরনের যন্ত্রণাই সহ্য করেছে, তারপরও বুকে বুলেট বিদ্ধ হবার তীব্র উত্তাপটা তাঁর কাছে একেবারেই অচেনা বলে মনে হলো। খুব গভীর আর যন্ত্রণার। শরীরের ক্ষত নয়…সেটা যেনো হৃদয়ের খুব কাছেই।

তিনি চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করলেন, কিন্তু মুখের ওপর বৃষ্টি পড়ছে বলে দৃষ্টিটা ঝাঁপসা হয়ে গেছে। আমি কোথায়? টের পেলেন একটা শক্ত হাত তাকে ধরে রেখেছে। তাঁর শরীরটাকে এমনভাবে তুলে ধরেছে যেনো একটা পুতুলকে কোলে করে রেখেছে। তার কালো আলখেল্লাটা এলোমেলো হয়ে গেছে।

একটা দুর্বল হাত দিয়ে চোখটা মুছে চেয়ে দেখলেন সাইলাস তাঁকে ধরে রেখেছে। বিশাল আকৃতির শ্বেতি লোকটা ধোয়াটে ফুটপাত দিয়ে টলতে টতে হাটছে আর চিৎকার করে হাসপাতালের জন্য ডাক দিচ্ছে। তার কণ্ঠে হৃদয় বিদীর্ণ করা আর্তনাদ। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ছে। মুখে রক্তের দাগ।

আমার বাছা, আরিঙ্গাবোসা ফিসফিসিয়ে বললেন। তুমি আহত হয়েছে।

সাইলাস তাকালো, তার মুখে তীব্র যন্ত্রণা। আমি খুবই দুঃখিত, ফাদার। তাকে দেখে মনে হলো, সে এতো কষ্টে আছে যে, কথা বলতে পারছে না।

না, সাইলাস, আরিঙ্গাবোসা জবাব দিলেন। আমিই দুঃখিত, এটা আমারই দোষ। টিচার আমাকে কথা দিয়েছিলেন কোন ধরনের খুন-খারাবি হবে না, আমিও তোমাকে সেটা মেনে চলতে বলেছিলাম। আমি খুব বেশি উদগ্রীব ছিলাম। খুব বেশিই আশংকা করেছিলাম। তুমি আর আমি প্রতারিত হয়েছি। টিচার কখনও হলি গ্রেইলটা আমাদের কাছে দেবেন না।

আরিঙ্গাবোসা পুরনো দিনের কথা ভাবতে শুরু করলেন। স্পেনে। তার শুরুর সময়কার ঘটনা। সাইলাসকে সঙ্গে নিয়ে ওভিদোতে ছোট্ট একটা চার্চ বানানো। তার। পর, নিউইয়র্কে, লেক্সিংটন এভিনুতে, ওপাস দাইর সেন্টার।

পাঁচ মাস আগে, আরিঙ্গাবোসা একটি ভয়াবহ সংবাদ পেয়েছিলেন। তার সারা জীবনের কর্মটা ধ্বংসের মুখোমুখি। কাস্তেল গানডোলফোতে তার সাক্ষাৎটি তাঁর নিজের জীবনটাকেই বদলে দিলো…এই খবরটাই, বলা চলে, পুরো বিপর্যয়টাকে নির্ধারণ করে দিয়েছে।

আরিগারোসা গানডোলফোর জ্যোর্তিবিদ্যার লাইব্রেরিতে প্রবেশ করেছিলেন মাথা উঁচু করে। আশা করছিলেন, দারুণ একটা অভ্যর্থনা পেতে যাচ্ছেন, আমেরিকাতে ক্যাথলিক মতবাদ সম্প্রসারণ করার জন্য।

কিন্তু সেখানে মাত্র তিন জন উপস্থিত ছিলো।

ভ্যাটিকানের সেক্রেটারিয়াস। ওবিস্। দাউর।

দুজন উচ্চপদস্থ ইতালিয় কার্ডিনাল। পবিত্রতার ভান করে থাকা। আত্মতৃপ্ত ভঙ্গী।

সেক্রেটারিয়াস? হতভম্ব হয়ে আরিঙ্গাবোসা বলেছিলেন।

লিগ্যাল এফেয়ার্সের দায়িত্বরত কার্ডিনাল আরিজারোসার সাথে হাত মেলালেন, তারপর ঘুরে তাকালেন বিপরীত দিকে বসা কার্ডিনালের দিকে, দয়া করে, আরাম করে বসুন।

আরিঙ্গাবোসা বসলেন, টের পেলেন কিছু একটা হয়েছে।

আমি অবান্তর কথাবার্তায় খুব একটা দক্ষ নই, বিশপ, সেক্রেটারিয়াস বললেন, সুতরাং, আপনার এখানে আসার কারণটা আমাকে সরাসরিই বলতে হচ্ছে।

প্লিজ। খোলাখুলি বলুন। আরিঙ্গাবোসা কার্ডিনাল দুজনের দিকে তাকালেন।

আপনি এব্যাপারে সচেতন আছেন যে, সেক্রেটারিয়াস বললেন। হিজ হলিনেস্ এবং রোমের অন্য সবাই, একটু দেরিতে হলেও ওপাস দাইর বির্তকিত অনুশীলনের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ব্যাপারে দারুণ চিন্তিত।

আচকা, আরিঙ্গারোসার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।

আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে চাই, সঙ্গে সঙ্গে সেক্রেটারিয়াস আবার বললেন, আপনারা আপনাদের ওপাস দাই কীভাবে চালাবেন, সেটা বদলানোর কোন ইচ্ছে হিজ হলিনেস-এর নেই।

আমিও সেরকমটি আশা করি না। তাহলে, আমি এখানে কেন?

বিশাল আকারের লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিশপ, আমি ঠিক কীভাবে এই কথাটা বলবো, বুঝতে পারছি না, তাই সরাসরিই বলি। দুদিন আগে, সেক্রেটারিয়েট কাউন্সিল, প্রায় নিরঙ্কুশভাবেই, ওপাস দাইর ব্যাপারে ভ্যাটিকানের যে অনুমোদনটা ছিলো, সেটা বাতিলের পক্ষে ভোট দিয়েছে।

আরিঙ্গারোসা নিশ্চিত ছিলেন তিনি ভুল শুনছেন। আমি বুঝতে পারলাম না, আবার বলবেন কি?

সোজা বলতে গেলে, আজ থেকে ছয়মাস পরে, ওপাস দাইকে আর ভ্যাটিকানের অঙ্গসংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হবে না। আপনারা নিজেরাই নিজেদের চার্চ হিসেবে থাকবেন। পোপ আপনাদের কাছ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। হিজ হলিনেস এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন, আর আমরা এ সংক্রান্ত আইনী কাগজপত্র তৈরি করছি।

কিন্তু…এটাতো অসম্ভব!

বরং বলা যায়, এটা একেবারেই সম্ভব আর খুব জরুরি। হিজ হলিনেস * আপনাদের আগ্রাসী নীতিমালা প্রণয়ন এবং কোরপোরাল মর্টিফিকেশন অনুশীলন করার জন্য খুবই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছেন। তিনি থামলেন। নারীদের প্রতি আপনাদের মনোভাবটাও ভ্যাটিকান ভালো চোখে দেখছে না। ভোলাখুলিভাবে বললে বলতে হয়, ওপাস দাই একটা দায় আর বিব্রতকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশপ আরিঙ্গাবোসা ক্ষেপে গেলেন। বিব্রতকর?

এতে তো আপনার অবাক হবার কথা নয়।

ওপাস দাই হলো একমাত্র ক্যাথলিক সংগঠন, যা ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। আমাদের এখন এগারোশ যাজক রয়েছে!

সত্য। আমাদের সবার জন্যেই সেটা একটা সমস্যা।

আরিজারোসা বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ালেন। হিজ হলিনেসকে জিজ্ঞাসা করুন, ১৯৮২ সালে, ওপাস দাই যখন ভ্যাটিকানকে সাহায্য করেছিলো, সেটা কি বিব্রতকর ছিলো!

সেজন্যে ভ্যাটিকান চিরদিন কতৃজ্ঞ থাকবে, সেক্রেটারিয়াস বললেন, তাঁর কণ্ঠটা শান্ত, আর অনেকেই, এটাও বিশ্বাস করে যে, ১৯৮২ সালের অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্যই আপনাদেরকে ভ্যাটিকানের অঙ্গসংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার একমাত্র কারণ।

এটা সত্য নয়। কথাটার খোচা আরিঙ্গারোসাকে দারুণভাবে ক্ষিপ্ত করে তুললো।

যা-ই হোক, আমরা ঠিক করেছি সৎবিশ্বাসে কাজ করবো। আমরা কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়ার খসড়াও করেছি। যার মধ্যে সেই টাকাটা ফেরত দেবার পরিকল্পনাও রয়েছে। সেটা পাঁচটি কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে।

আপনারা আমাকে কিনতে চাচ্ছেন? আরিঙ্গারাসা খুব জোরে বললেন। নিরবে চলে যাবার জন্য টাকা দিচ্ছেন? যখন ওপাস দাই-ই হলো একমাত্র যৌক্তিক কণ্ঠ।

একজন কার্ডিনাল চোখ তুলে তাকালেন। আমি দুঃখিত, আপনি কি বলছেন যৌক্তিক?

আরিঙ্গাররাসা টেবিলের সামনে ঝুঁকে কণ্ঠটা আরো তীক্ষ্ণ্ম করলেন। ক্যাথলিকরা কেন চার্চ ছাড়ছে, সেটা নিয়ে কি আপনারা সত্যি ভাবেন? আপনার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, কার্ডিনাল। লোকজন শ্রদ্ধাবোধ হারাচ্ছে। বিশ্বাসের দৃঢ়তা উধাও হয়ে গেছে। আমাদের মতবাদটা আজ যুদ্ধের মুখোমুখি। মিতাচার, স্বীকারেক্তি, কমিউনিয়ন, ব্যাপটিজম, মাস্-বেছে নেন—যেটা আপনাকে আনন্দিত করবে, সেটা বেছে নেন আর বাকিগুলোর কথা ভুলে যান। কোন ধরনের আধ্যাত্মিক দিক নির্দেশন চার্চ প্রস্তাবনা করছে?

তৃতীয় শতকের আইন-কানুন, দ্বিতীয় কার্ডিনাল বললেন। আধুনিক খৃস্ট অনুসারীরা অনুসরণ করতে পারে না। আজকের সমাজে সেইসব নিয়ম আর কাজ করছে না।

তো, সেগুলো তবে ওপাস দাইর জন্যই কার্যকর এখনও!

বিশপ আরিঙ্গারোসা, সেক্রেটারিয়াস বললেন, তাঁর কণ্ঠে সমাপ্তির আভাস, আগের পোপের সাথে আপনার ওপাস দাইর সম্পর্কটাকে শ্রদ্ধা করেই, হিজ হলিনেস ওপাস দাইকে ভ্যাটিকান থেকে পরিত্যাগ করার জন্য ছয় মাসের সময় দিয়েছেন। আমি বলবো, আপনি আপনার ভিন্নমত নিয়ে নিজস্ব পথে এগোন, আর নিজেদের খৃস্টিয় সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলুন।

আমি মানছি না! আরিজারোসা জানালেন।

আমি তার সাথেই এটা নিয়ে একান্তে কথা বলবো!

আমার মনে হয়, হিজ হলিনেস আর আপনার সাথে দেখা করতে চাইবেন না।

আরিঙ্গারোসা উঠে দাঁড়ালেন। তিনি আগের পোপের ব্যক্তিগতভাবে স্বীকৃতি দেয়া অঙ্গ সংগঠনকে ধ্বংস করার দুঃসাহস দেখাবেন না!

আমি দুঃখিত। সেক্রেটারিয়াসের চোখটাতে একটুও পলক পড়লো না। ঈশ্বরই দেন, তিনিই তুলে নেন।

আরিঙ্গারাসা বিস্মিত হয়ে সেই মিটিং থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন তীব্র আতংকে। নিউইয়র্কে ফিরে, বিষণ্ণ চোখে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে খৃস্টান ধর্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন।

তার কয়েক সপ্তাহ পরেই, সেই ফোনটা এসেছিলো, যা সব কিছুই বদলে দিয়ে ছিলো। ফোনের লোকটা নিজেকে টিচার হিসেবে পরিচয় দিলেন, তার কথা শুনে ফরাসি বলে মনে হলো টিচার শব্দটা তাঁদের অনুশাসনে বহুল ব্যবহৃত। তিনি বলেছিলেন, তিনি জানেন, ভ্যাটিকান ওপাস দাইয়ের প্রতি সমর্থনটা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।

এটা তিনি কীভাবে জানতে পেলেন? আরিঙ্গরোসা অবাক হয়ে ভাবলেন। তাঁর ধারণা ছিলো, খবরটা ভ্যাটিকানের গুটিকয় লোকই জানে। কিন্তু খবরটা চাউর হয়ে গিয়েছিলো।

সব জায়গায়ই আমার কান রয়েছে, বিশপ, টিচার নিচু স্বরে বলেছিলেন। আমার সেইসব কান দিয়ে আমি নির্ভূল তথ্য পেয়ে থাকি। আপনার সাহায্যে, আমি সেই পবিত্র সিক্রেটটার অবস্থান উন্মোচিত করতে পারবো, যা আপনাকে অসামান্য ক্ষমতাবান করে তুলবে…এতোটা ক্ষমতাবান, যে, ভ্যাটিকান আপনাকে নত মস্তকে সম্ভাষণ জানাবে। ধর্ম বিশ্বাসটা বাঁচানোর জন্য পর্যাপ্ত শক্তি দেবে। তিনি থামলেন। শুধুমাত্র ওপাস দাইর জন্যই নয়, বরং আমাদের সবার জন্যে।

ঈশ্বর কেড়ে নেন…এবং ঈশ্বরই দিয়ে দেন।

আরিজারোসা একটা বিজয়ের আলো দেখতে পেলেন। আপনার পরিকল্পনাটার কথা বলুন।

 

সেন্ট ম্যারি হাসপাতালের দরজাটা যখন ভোলা হলো তখনও বিশপ আরিজারোসা অচেতন ছিলেন। সাইলাস হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো। মাটিতে হাটু গেঁড়ে বসে সে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে শুরু করলো। রিসেপশনের সবাই অর্ধনগ্ন শ্বেতি লোকটা আর তার কোলে রক্তাক্ত যাজককে দেখে দারুণ অবাক হলো।

ডাক্তার এসেই আরিজারোসার নাড়ি-স্পন্দনটা পরীক্ষা করে দেখলো। উনার অনেক রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে। আমি খুব একটা আশাবাদী নই।

আরিঙ্গাবোসা একটু একটু করে চোখ খুলে সাইলাসকে দেখলেন। আমার বাছা…

সাইলাসের হৃদয়টা তীব্র যন্ত্রণা আর ক্ষোভে ফেটে পড়লো। ফাদার, যদি আমার সারাজীবনও লেগে যায়, তারপরও আমাদেরকে যে প্রতারিত করেছে তাকে আমি খুঁজে বের করবো। আমি তাকে খুন করবো।

আরিঙ্গারো মাথা ঝাঁকালেন, তাঁকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাচ্ছে দেখে ব্যথিত হলেন। সাইলাস … তুমি যদি আমার কাছ থেকে কিছু শিখে না থাকো, দয়া করে… এটা শেখো। তিনি সাইলাসের একটা হাত সজোড়ে চেপে ধরলেন। ক্ষমা হলো ঈশ্বরের মহত্তম উপহার।

কিন্তু ফাদার…

আরিঙ্গারোসা চোখ বন্ধ করলেন। সাইলাস, প্রার্থনা করো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *