০৬. নটিলাস-এর কাপ্তেন নেমো

নটিলাস-এর কাপ্তেন নেমো

কতক্ষণ যে ঘুমিয়েছিলুম আন্দাজ নেই। ঘুম ভাঙার পর দেখলুম নেড আর কোনসাইল তখন ঘুমে অচেতন। ঘরের ভিতরটা কেমন যেন গুমোট-মততা, নিশো নিতে কষ্ট হয়। কেমন করে যে এর। ঘরের মধ্যে অক্সিজেন সরবরাহ করে তা-ই ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ এক ঝলক টাটকা সমুদ্রের হাওয়ায় মুহূর্তে ঘরের দমবন্ধকরা ভাবটা কেটে গেলো।

শুয়ে-ওয়ে কত অদ্ভুত ও বিচিত্র কথা ভাবছি, এমন সময়, নেঙ আর কোন সাইলেরও ঘুম ভেঙে গেলো। খুব খিদে পেয়েছিলো আমাদের। কিন্তু এই অদ্ভুত ড়ুবোজাহাজটির অত্যদ্ভুত লোকগুলো আবার আমাদের খেতে দেবে কি না জানি না।  নেড আর কোনাইল তোত খিদেয় রীতিমতো কাতর হয়ে পড়েছিলো। নেড তা ঘুম ভাঙার পর থেকেই ছটফট করছে, আর কোনসাইলও যথোচিত চেষ্টা সত্ত্বেও তার কাতর ভাবটা কিছুতেই গোপন রাখতে পারছে না। নানা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আমি ওদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগলুম। কিন্তু খিদের জ্বালায় নেড তখন উন্মত্তপ্রায়; ঘরময় দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে সে, ক্রমাগত লাথি মারছে সেই দেয়ালে, আর সমানে চীৎকার করে ড়ুবোজাহাজের প্রত্যেকটা আরোহীকে গোল্লায় পাঠাচ্ছে। শেষটায় ওর রকমশকম আমাকে রীতিমতো আতঙ্কিত করে তুললো।

আমার এই আশঙ্কা যে মোটেই অমূলক নয়, একটু পরেই তা টের পাওয়া গেলো। কিছুক্ষণ পরে ঘরের দরজা খুলে একটি পরিচারক ঢুকতেই নেড আচমকা তার উপর খ্যাপা নেকড়ের মতো লাফিয়ে পড়লো। অমন প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে পরিচারকটি একটা পাক খেয়েই মেঝেয় ছিটকে পড়লো। অমনি লেড তার বুকের উপর চেপে বসে টুটি টিপে ধরলো। কেলেঙ্কারি হয় দেখে আমি আর কোনসাইল নেড়কে টেনে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছি, এমন সময় পিছন থেকে কে যেন পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ ফরাশিতে বলে উঠলো। শান্ত হও, মিস্টার ল্যাণ্ড। প্রফেসর দয়া করে আমার কয়েকটি কথা শুনবেন কি আপনি?

বক্তা আর-কেউ নন–সেই অভিজাত পুরুষ, যাকে দেখেই আমার দলপতি বলে বোধ হয়েছিলো।

নেড তো এ-কথা শুনেই লাফিয়ে উঠলো। তাকিয়ে দ্যাখে টেবিলের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, বুকের উপর হাত দুটি আড়াআড়িভাবে ভাজ করা, সমস্ত ভঙ্গিমাটির মধ্যে কর্তৃত্বের ছাপ।

বিস্মিত আমার তখন স্তব্ধতা ভেঙে কথা বলার ক্ষমতা ছিলো না। তিনিই আবার বিশুদ্ধ ফরাশিতে বলতে লাগলেন, আমি ফরাশি, আলেমান, ইংরেজি ও লাতিন ভাষা বলতে পারি। কিন্তু তখন আমি কথা বলিনি এই জন্যেই যে আমি বুঝতে পারছিলাম না আপনারা সত্যি কথা বলছেন কিনা। পরে যখন দেখলুম চার ভাষায় বলা চারটে গল্পই এক, তখন বুঝলুম আপনারা মিথ্যে বলেননি। আমি ততা আর পৃথিবীর বাসিন্দা নই, আপনাদের ওই জগৎ থেকে নিজেকে আমি সম্পূর্ণ সরিয়ে এনেছি এই জলের তলায়, তবুও আপনারা এসেছেন আমাকে উত্ত্যক্ত করতে…

আমরা কিন্তু স্বেচ্ছায় আসি নি।

এই-যে আব্রাহাম লিঙ্কন হন্যে হয়ে সাত সমুদ্রে আমাকে খুঁজে বেড়িয়েছে সে কি আপনাদের অনিচ্ছাসত্বেও? আমার জাহাজ লক্ষ্য করে যে কামান ছোড়া হয়েছে, তা কি অনিচ্ছার সাক্ষী? নেড ল্যাণ্ড যে এই জাহাজ লক্ষ্য করে হারপুন ছুঁড়েছিলো তাও কি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে? রোষে তাঁর গলা গমগম করে ওঠে। স্পষ্ট গম্ভীর স্বরে তিনি বলতে থাকেন, যাক, এ সম্বন্ধে আমি কোনো বাদ-প্রতিবাদ করতে চাই নে। আপনারা এখন যুদ্ধবন্দী। নেহাত দয়া করে আপনাদের আমি সলিলসমাধি থেকে বাঁচিয়েছি। নয়তো আমার জাহাজ জলের তলায় নিয়ে গিয়ে আপনাদের অকুল সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে মেরে ফেলাই কি আমার উচিত ছিলো না?

তাহলে সেটা বর্বরোচিত হতো, কেননা কোনো সভ্যমানুষ এমন পাষাণ হতে পারে না, আমি বললুম।

প্রফেসর, তাঁর গলার স্বর তীব্র হয়ে উঠলো, আপনারা যাকে সত্য বলেন, আমি তা নই। ওই তথাকথিত সভ্যতার আগাপাশতলা দেখেছি আমি, জানি তার হামবড়া বুলি ও নৃশংস ক্রিয়াকলাপের অর্থ কী। আমাদের ওই সভ্যজগতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছি আমি, আপনাদের কোনো নিয়মকানুনই আমি মানি না। আপনাকে আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি, প্রফেসর, ভবিষ্যতে কখনো ওই সভ্যজগতের নজির আমার কাছে তুলবেন না।

প্রচণ্ড রোষে তার চোখ ঝকঝক করে উঠলো। সেই গম্ভীর গমগমে গাল শুনে বুঝতে পারলুম, নিশ্চয় এই মানুষটির জীবনে কোনো ভীষণ ইতিহাস লুকিয়ে আছে। তথাকথিত আইনকানুন তিনি মানেন না; সিন্ধুতলের কোনো গভীর আইনের বাধানিষেধও তাঁকে শাসন করতে অক্ষম। বোধহয় একমাত্র বিবেক, আর ঈশ্বর ছাড়া আর-কারো সংহিতাকেই তিনি গ্রাহ্য করেন না।

এই জাহাজে আপনাদের স্থান দিতে পারি কেবল কয়েকটি শর্তে, আবার কঠিন স্বরে বললেন তিনি, মাঝে-মাঝে এমন-সব ঘটনা ঘটবে আপনাদের দেখতে দেয়া হবে না। তখন আপনাদের আমি এই ঘরে বন্দী করে রাখবে। আর, জীবদ্দশায় আপনারা আর সভ্যজগতে ফিরে যেতে পারবেন না।

অর্থাৎ আমরা বন্দী হয়েই থাকবো?

এক অর্থে তা-ই। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই আপনারা আমার মতোই এখানে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারবেন।

তার মানে, জেলখানায় কোনো বন্দী ইচ্ছে করলে যেমনভাবে পায়চারি করতে পারে, আমাদেরও কেবল সেই অধিকারটুকু থাকবে?

সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্যের অর্থ আপনি যদি তা-ই করেন, তাহলে আমি কোনো প্রতিবাদ করতে চাই না। তবে আপনাদের আমি কখনোই পৃথিবীতে ফিরে যেতে দেবো না, কেননা আপনারা আমার গোপন অস্তিত্বের কথা জেনে গেছেন, আসলে আপনাদের এখানে রেখে আমি নিজেকেই রক্ষা করার চেষ্টা করছি।

অর্থাৎ আপনার শর্ত মেনে না নিলে আমাদের মৃত্যুবরণ করতে হবে।

অগত্যা।

এ-কথার কোনো উত্তর নেই। তবে এই জাহাজের নেতার কাছে আমরা কোনোকথার সূত্রে বদ্ধ নই।

না, তা নন। তারপর মানুষটি অপেক্ষাকৃত শান্ত স্বরে বললেন, মঁসিয় আরোনা, আপনার অন্তত এই প্রস্তাবে আপত্তি করার কিছু থাকতে পারে না। সমুদ্রের রহস্য সম্বন্ধে আপনি একাধিক বই লিখে থাকলেও আপনার জ্ঞান ও নানা অনুমান মূলত অসম্পূর্ণ। এই জাহাজে থাকলে আপনি সেই অজ্ঞাত জগৎ দেখার সুযোগ পাবেন, যার রহস্য বস্তুত এত কাল কেবল অনুমাননির্ভর ছিলো। আমাকে আপনার ধন্যবাদ দেয়া উচিত, কারণ আমার জন্যেই সিন্ধুতলের বিপুল রহস্য ভেদ করার সুযোগ পাবেন আপনি।

প্রকৃতিবিজ্ঞানের উল্লেখ যে আমাকে দুর্বল করে ফেললো, একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই; মুহূর্তের জন্য এ-কথা ভুলে গেলুম যে স্বাধীনতার বিনিময়ে আমার বৈজ্ঞানিক কৌতূহল চরিতার্থ করার কোনো অর্থ হয় না। আস্তে তাকে জিগেস করলুম, আপনাকে কী বলে সম্বােধন করবো আমি।

কাপ্তেন নেমে.. আপনি আর আপনার সঙ্গীরা আমার কাছে নটিলাস জাহাজের যাত্রী ছাড়া আর-কেউ নন। তারপর নেড আর কোনসাইলের দিকে ফিরে বললেন, এখানে, এই কেবিনেই—আপনাদের খাবার দেয়া হয়েছে। এই পরিচারকটি আপনাদের দেখাশুনো করবে।…আর মঁসিয় আরোনা, আমাদের ছোটোহারি প্রস্তুত। আসুন, আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাই।

দীর্ঘ করিডর পেরিয়ে আমাকে নিয়ে তার বাবার-ঘরে এলেন কাপেন নেমো। বিলাসবহুল মূল্যবান আশবাবপত্রে সাজানো কেবিনগুলো দেখে রীতিমতো তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। যেন জলের তলায় নতুন এক অমূল্য জগতের উপর থেকে পর্দা

উঠে গেলো।

বিস্তর বাবার সাজানো ছিলো টেবিলের উপর, কিন্তু সবই আমার অচেনা। আমার চোখমুখে কৌতূহলের ছাপ ফুটে উঠতে দেখে কাপ্তেন নেমো বললেন, বেশির ভাগ খাবারই আপনার অচেনা ঠেকবে, মঁসিয় আরোনা। কারণ যা-কিছু দেখছেন, সবই সিন্ধুতলের অবদান। পৃথিবীতে আপনারা যে-খাদ্য গ্রহণ করেন, বহুশি হলো আমি তা ত্যাগ করেছি, কিন্তু এই খেয়েই বেশ সুস্থ ও শক্ত আছি–কোনো অস্বাচ্ছন্দ্যই বোধ করি না।

এইসব খাবারই তবে সমুদ্রের দান?

হ্যাঁ, প্রফেসর। সমুদ্রই আমার যাবতীয় চাহিদা মেটায়। কখনো জাল ফেলে সব জোটাই আমি, কখনো দলবল নিয়ে জলের তলায় বেরোই শিকারে। ওটা কচ্ছপের মাংস ভাজা, আর এটা শুশুকের যকৃৎ-খেতে অনেকটা শুয়োরের মাংসের মতো লাগবে। আর এটা হলো তিমিমাছের দুধ থেকেতৈরি পনির। চিনি বানিয়েছি উত্তর সাগরের সমুদ্রের শালা থেকে। কাপ্তেন নেমো বলতে থাকেন, প্রফেসর, সমুদ্র কেবল আমাকে আহার্যই জোগায় না, বসনভূষণও দেয়। আপনি তো জানেন ঝিনুক শামুক গুগলি প্রভৃতি কতগুলো সামুদ্রিক প্রাণী এক ধরনের সূক্ষ্ম রেশমের মতো তন্তু দিয়ে নিজেদের বেঁধে রাখে—এই আঁশকে বলে বাইসাস। আপনি যে-পোশাক পরে আছেন, তা এই বাইসাস থেকে তৈরি। ভূমধ্যসাগরের কয়েকটি কঠিন বর্ম প্রাণীর দেহের রঙে এই পোশাক রঙ করা হয়েছে। আপনার শয্যায় পাতা আছে সমুদ্রের সবচেয়ে পরম ঘাস। লেখার জন্য পাবেন তিমিমাছের হাড়ের কলম, আর যে কালি দিয়ে আপনি লিখবেন তা কালামারির দেহনিংড়োনো কৃষ্ণবর্ণ তরল পদার্থ।

সমুদ্রকে আপনি ভালোবাসেন, কাপ্তেন?

বাসি। সমুদ্রই আমার সব, সর্বস্ব। তার হাওয়া শুদ্ধ, স্বাস্থ্যময়। সমুদ্র হচ্ছে বিপুল একটা মরুভূমির মত, যেখানে মানুষ কখনোই একা বোধ করে না, কারণ তার চারপাশে সে অনুভব করে প্রাণের স্পন্দন–এক অনিঃশেষ প্রাণস্রোত সেখানে অনন্ত বহমান। সমুদ্রে স্বৈরাচারীর স্থান নেই-তারা হানাহানি করে মরে ভাঙায়, জলের উপরে; ত্রিশ বা নিচে তাদের কোনো ক্ষমতাই নেই। প্রফেসর, জলের মধ্যে থাকুন দেখবেন স্বাধীনতা কেবল এই সিন্ধুতলেই আছে। এই সিন্ধুতলে কোনো স্বৈরাচারী প্রভু নেই, সেখানেই আমি আমার স্বাধীন সত্তা বজায় রাখতে পারি, সেখানেই আমি স্বাধীন, আত্মপ্রভু! কথা বলতে বলতে প্রবল আবেগে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন কাপ্তেন নেমো; উত্তেজিতভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন তিনি। কিন্তু একটু পরেই আবার নিজেকে তিনি সামলে নিলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন মসিম আয়োনা, চলুন—আপনাকে–আমার নটিলাস ঘুরিয়ে দেখাই।