উপন্যাস

০৫. বিজ্ঞাপনের জবাবে সাক্ষাৎপ্রার্থী

বিজ্ঞাপনের জবাবে সাক্ষাৎপ্রার্থী

আমার শরীর দুর্বল। সকালের ধকলে তাই কাত হয়ে পড়লাম। বিকেলে আর বেরোতে পারলাম না। হোমস একাই গেল কনসার্ট শুনতে। আমি সোফায় শুয়ে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু বৃথাই। বিবিধ ঘটনা প্রবাহে মস্তিষ্ক এতই উত্তপ্ত এবং এতই উত্তেজিত। যে অস্থির হয়ে পড়লাম, অদ্ভুততম কল্পনা আর অনুমানের উৎপাতে। ঘুমোনোর চেষ্টায় প্রতিবার চোখ বোজবার সঙ্গেসঙ্গে মনের চোখে ভেসে উঠল নিহত ব্যক্তির বিকৃত বেবুন-সদৃশ মুখাবয়ব। জ্বলে পুড়ে গেলাম স্মৃতির এই জঘন্য অত্যাচারে। এহেন মুখের মালিককে যে-ব্যক্তি ধরাধাম থেকে সরিয়ে দিয়েছে তাকে মনে মনে ধন্যবাদ না-দিয়ে পারলাম না। অতীব করাল চেহারার পাপ যদি মানুষের চেহারায় কখনো বিমূর্ত হয়ে থাকে, তবে তা ক্লিভল্যান্ড নিবাসী এনক জে ড্রেবারের মুখ। তা সত্ত্বেও পাপীকে সাজা দিতেই হবে। কেননা, লম্পটকেও লাম্পট্যের শাস্তি দিলে না আইন কখনো শাস্তিদাতাকে ক্ষমা করে না।

ব্যাপারটা নিয়ে যতই মনে মনে তোলপাড় করতে লাগলাম, বন্ধুবরের অনুমিতিটা ততই অসাধারণ মনে হতে লাগল আমার কাছে! ও বলেছিল, লোকটাকে বিষ দিয়ে খুন করা হয়েছে। মনে পড়ল কীভাবে নিহত ব্যক্তির ঠোঁট এঁকেছিল হোমস। বিষ প্রয়োগে হত্যার ধারণাটা ওর মগজে প্রবেশ করেছে নিশ্চয় তখনই। বিষক্রিয়ায় হত্যাই যদি না হয় তবে তো হত্যাটা হল কীভাবে? গলা টেপার চিহ্ন নেই–অস্ত্রাঘাতের ক্ষতও নেই। মেঝের ওপরে রক্তের ওই পুকুরটা তাহলে কার? ধস্তাধস্তির চিহ্ন দেখা যায়নি–নিহত ব্যক্তির কাছেও এমন কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি যার আঘাতে হত্যাকারীর দেহ থেকে রক্তপাত ঘটতে পারে। বেশ বুঝলাম, এতগুলো ধাঁধার সমাধান না-হওয়া পর্যন্ত ঘুমোনো সম্ভব হবে না আমার পক্ষে হোমসও পারবে না ঘুমোতে। ওর প্রশান্ত আত্মবিশ্বাসী আচরণ থেকেই স্পষ্ট বুঝেছি রহস্যাবলির চাবিকাঠি এর মধ্যে ওর পকেটে পৌঁছে গিয়েছে–মনে মনে ধাঁধার একটা সমাধানও ছকে নিয়েছে কিন্তু সে-সমাধান যে আসলে কী, কিছুতেই তা ভেবে উঠতে পারলাম না।

হোমস বাড়ি ফিরল কিন্তু অনেক দেরিতে এত দেরি নিশ্চয় শুধু কনসার্ট শোনার জন্যে হয়নি। ডিনার টেবিলে খাবার সাজানো হয়ে যাওয়ার পর আবির্ভাব ঘটল মূর্তিমানের!

চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, অপূর্ব! সংগীত সম্বন্ধে ডারউইন কী বলেছিলেন মনে আছে? বলেছিলেন, মানুষের মধ্যে কথা বলার শক্তি আসার অনেক আগেই এসেছিল গান গাওয়ার শক্তি। সেই জন্যেই বোধ হয় সংগীত এত সূক্ষ্মভাবে নাড়া দেয় আমাদের। বিশ্ব যখন শৈশবাবস্থায় তখনকার কুয়াশা ছাওয়া বহু শতাব্দীর স্মৃতি এখনও রয়ে গিয়েছে প্রত্যেকের সত্তায়।

ধারণাটা খুব ব্যাপক, মন্তব্য করলাম আমি।

প্রকৃতিকে বোঝাতে গেলে ধারণাটাও প্রকৃতির মতোই ব্যাপক হওয়া দরকার। কী ব্যাপার বল তো? তোমাকে তো খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না? ব্রিক্সটন রোড রহস্যে বিচলিত হয়েছ দেখছি।

সত্যিই হয়েছি, বললাম আমি। আফগান অভিজ্ঞতার পর আমার আরও একটু শক্ত হওয়া উচিত ছিল। কেইওয়ান্দে কচুকাটা হতে দেখেছি কমরেডদের নার্ভ কাঁপেনি একটুও।

বুঝি। এ-ব্যাপারে এমন একটা রহস্য আছে যা কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করবেই। কল্পনা যেখানে নেই, বিভীষিকাও সেখানে নেই। সান্ধ্য দৈনিক দেখেছ?

না।

ঘটনাটার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ছেপেছে। শুধু একটা কথা বলেনি। মৃতদেহ তোলবার সময়ে মেয়েলোকের বিয়ের আংটি গড়িয়ে পড়ার ঘটনাটার কোনো উল্লেখ নেই। না-করে ভালোই করেছে।

কেন?

এই বিজ্ঞাপনটা দেখলেই বুঝবে। আজ সকালেই ওই কাণ্ড দেখে আসার পর সবক-টা খবরের কাগজে পাঠিয়েছিলাম বিজ্ঞাপনটা!

কাগজটা ছুঁড়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল হোমস। নির্দিষ্ট জায়গাটিতে চোখ বুলোলাম।হারানো প্রাপ্তি স্তম্ভের পয়লা বিজ্ঞাপন।হোয়াইট হার্ট মদ্যশালা আর হল্যান্ড গ্রোভের মাঝের রাস্তায় ব্রিক্সটন রোডে আজ সকালে একটা সোনার সাদাসিদে আংটি পাওয়া গেছে। আজ সন্ধ্যায় ২২১বি, বেকার স্ট্রিটস্থ ডা. ওয়াটসনের সঙ্গে আটটা থেকে ন-টার মধ্যে সাক্ষাৎ করুন।

তোমার নাম ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছি, বললে হোমস। আমার নাম ব্যবহার করলে মুখগুলো চিনতে পারত–সব ভণ্ডুল করে দিত।

তা ঠিক। কিন্তু ধর যদি কেউ আসে। আংটি তো নেই আমার কাছে।

আছে বই কী, একটা আংটি আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল হোমস-এতেই হবে। প্রায় ওইরকমই দেখতে।

বিজ্ঞাপনে কে সাড়া দেবে বলে মনে হয় তোমার?

ব্রাউন কোট পরা লালমুখো আমাদের সেই বন্ধুটি–যার জুতোর ডগা চৌকোনা–পায়ের আঙুলও তাই। নিজে না-এলেও স্যাঙাত কাউকে পাঠাবেই।

আসাটা কিন্তু খুবই বিপজ্জনক তার পক্ষে সে-খেয়াল কি তার নেই বলছ?

একেবারেই নেই! এ-মামলায় আমি যা ভেবেছি তা যদি ঠিক হয় এবং ঠিক বলেই আমার বিশ্বাস–তাহলে সোনার আংটি ফেরত পাওয়ার জন্যে যেকোনো ঝুঁকি নিতে সে প্রস্তুত। আমার ধারণা মতো, ড্রেবারের মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে আংটিটা পড়ে যায়–কিন্তু সে জানত না। বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর যখন সে জানল, দৌড়ে এল আংটি উদ্ধার করতে কিন্তু পারল না পুলিশ দেখে। দোষটা তারই। জ্বলন্ত মোমবাতি রেখে যাওয়ার দরুনই আলো দেখে পুলিশ এসে গিয়েছে। গেটের কাছে অত রাতে তাকে দেখলে পাছে পুলিশের সন্দেহ হয় তাই মদ্যপের অভিনয় করতে হল তৎক্ষণাৎ। এবার তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করো। পুরো ব্যাপারটা গোড়া থেকে নতুন করে ভাবতে গিয়ে এমন ভাবা স্বাভাবিক নয় কি যে আংটিটা হয়তো রাস্তায় কোথায় ফেলেছে… বাড়ির মধ্যে নেই! সেক্ষেত্রে তার কী করা উচিত? হারিয়ে যাওয়া জিনিস যদি কেউ খুঁজে পেয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়, এই আশায় দুরু দুরু বুকে সান্ধ্যদৈনিক দেখা। এই বিজ্ঞাপনটাও সে দেখবে। আনন্দে আটখানা হবে। ফাঁদে পা দিতে চলেছে এ-ধারণা মাথায় আসবে কেন? খুনের সঙ্গে আংটির যে সম্পর্ক থাকতে পারে, এমন কোনো যুক্তি তার মাথায় এলে তো। তাই আসবে। আসতেই হবে। এক ঘণ্টার মধ্যেই এসে পড়বে। দেখা করবে তো?

তারপর?

আমার ওপর ছেড়ে দিয়ো ! তোমার হাতিয়ার আছে?

পুরোনো মিলিটারি রিভলবার আর কয়েকটা কার্তুজ আছে।

সাফ করে নিয়ে গুলি ভরে রাখ। লোকটা কিন্তু মরিয়া, যদিও ওকে আমি আচমকা কবজায় আনব, তাহলেও খারাপ পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত থাকা ভালো।

শোবার ঘরে গিয়ে ওর কথামতো রিভলবারে গুলি ভরে নিলাম। ফিরে এসে দেখি খাবার টেবিল সাফ হয়ে গিয়েছে। হোমস ওর প্রিয়তম বেহালা নিয়ে ঘষামাজা করতে বসেছে।

আমি ঢুকতেই বললে, ষড়যন্ত্র গভীর হচ্ছে। আমার আমেরিকান টেলিগ্রামের জবাব পেলাম এইমাত্র। এ-মামলা সম্বন্ধে আমার ধারণাই সত্যি।

কী ধারণা? সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করি আমি। নতুন তার লাগালে বেহালার বাজনাটা আরও খুলবে। পিস্তলটা পকেটে রাখ। লোকটা এলে সাধারণভাবে কথাবার্তা বলবে। বাকি যা করবার আমি করব। কটমট করে চেয়ে ভয় পাইয়ে দিয়ো না।

এখনই তো আটটা বাজে, ঘড়ি দেখে বললাম আমি।

হ্যাঁ। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সে এল বলে। দরজাটা একটু খোলো—ওতেই হবে! চাবিটা ভেতরে রাখো। ধন্যবাদ। এই বইটা গতকাল হঠাৎ পেয়ে গেলাম স্টলে। অদ্ভুত বই। ভীষণ পুরোনো। ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডের লাজে ল্যাটিন ভাষায় ছাপা। বাদামি মলাটে বাঁধানো খুদে এই বই যখন ছাপার হরফে প্রথম বেরোয়, চার্লসের মাথা তখনও খাড়া ঘাড়ের ওপর।

কে ছেপেছে?

ফিলিপ দ্য ক্রয়। পুস্তনিতে ফিকে কালি দিয়ে একটা নামও দেখতে পাচ্ছি–উইলিয়াম হোয়াইট। লোকটা কে বুঝতে পারছি না। সপ্তদশ শতাব্দীর অনধিকার চর্চাকারী কোনো আইনবিদ হতে পারে। লেখার মধ্যে আইনের প্যাঁচ আছে। এসে গেছে আমাদের লোক।

কথা শেষ না হতে হতেই ঢং ঢং করে বেশ জোরে ঘণ্টা বেজে উঠল একতলায়। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল শার্লক হোমস, চেয়ারটা সরিয়ে নিয়ে গেল দরজার দিকে। হলঘরে পরিচারিকার পায়ের আওয়াজ পেলাম, খট করে ল্যাচ খোলার শব্দও ভেসে এল।

ড. ওয়াটসন এখানে থাকেন? সুস্পষ্ট কিন্তু কর্কশ কণ্ঠে উচ্চারিত হল প্রশ্নটা। পরিচারিকার উত্তর শুনতে পেলাম না। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কে যেন মচ মচ শব্দে উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে। অনিশ্চিত পদক্ষেপ–পা ঘষটে ঘষটে চলার মতো! কান খাড়া করে শুনতে শুনতে অবাক হল হোমস বিস্ময়ের ঢেউ বয়ে গেল চোখ-মুখের ওপর দিয়ে। গলিপথ বেয়ে পদশব্দ আস্তে আস্তে এসে পৌঁছল দরজার সামনে আলতোভাবে কে যেন টোকা মারল দরজায়।

ভেতরে আসুন বললাম চেঁচিয়ে।

ঘরে ঢুকল একজন অতি বৃদ্ধা, জরাজীর্ণ, বলিরেখা কুঞ্চিত ভদ্রমহিলা–যার প্রতীক্ষায় বসে থাকা সেই ভয়ংকর দুর্দান্ত ব্যক্তিটি নয়। ঘরের জোরালো আলোয় যেন চোখ ধাঁধিয়ে গেছে বুড়ির এমনিভাবে সৌজন্য বর্ষণটুকু কোনোমতে সেরে নিয়ে ঘোলাটে চোখে পিট পিট করে চেয়ে রইল আমাদের পানে এবং নার্ভাস, কঁপা আঙুলে হাতড়াতে লাগল নিজের পকেট। বন্ধুবরের পানে চেয়ে দেখি মুখখানা ভীষণ নিরাশ করে তুলেছে। অগত্যা নিজের মুখের ভাব ঠিকঠাক রাখার চেষ্টায় ব্যাপৃত হলাম আমি।

পকেট থেকে সান্ধ্য দৈনিক টেনে বার করে বিজ্ঞাপনটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বুড়ি বলল, এসেছি এই বিজ্ঞাপনটা পড়ে, আর এক দফা সৌজন্য বর্ষণ করে–ব্রিক্সটন রোডে একটা সোনার বিয়ের আংটি পাওয়া গেছে। আংটিটা আমার মেয়ে স্যালির। বারো মাস আগে বিয়ে হয়েছিল ইউনিয়ন জাহাজের ভাণ্ডারীর সঙ্গে। জামাই আমার এমনিতে ভালো, কিন্তু পেটে মদ পড়লে অন্য মানুষ। কাল রাতে স্যালি সার্কাস দেখতে গিয়ে–

এই আংটিটা? বললাম আমি।

জয় ভগবান! ঘুমিয়ে বাঁচবে আজকে স্যালি! হা! এই সেই আংটি!

আপনার ঠিকানা? পেনসিল তুলে নিয়ে বললাম।

তেরো নম্বর ডানকান স্ট্রিটে, হাউন্ডসডিচ। এখান থেকে বেশ দূরে।

আচমকা তীক্ষ্ণ্ণ গলায় বলল শার্লক হোমস, সার্কাস আর হাউন্ডসডিচের মাঝামাঝি রাস্তা তো ব্রিক্সটন রোড নয়।

ঘুরে দাঁড়িয়ে রক্ত বলয় ঘেরা ছোটো চোখে হোমসকে নিরীক্ষণ করে বুড়ি বললে, ইনি আমার ঠিকানা জানতে চেয়েছিলেন। স্যালি থাকে তিন নম্বর মেফিল্ড প্লেস, পেকহ্যাম!

আপনার নাম?

সইয়ার। স্যালির নাম ডেনিস–টম ডেনিসকে বিয়ে করার পর। ছেলে ভালো, চটপটে পরিচ্ছন্ন–যতক্ষণ সমুদ্রে থাকে ততক্ষণ! ওরকম ভাণ্ডারী সব জাহাজে পাওয়া যায় না। কিন্তু ডাঙায় এলেই মেয়েদের আর মদের পাল্লায় পড়ে–

হোমসের ইঙ্গিত লক্ষ করলাম। আংটি বাড়িয়ে দিয়ে বললাম—নিন আপনার জিনিস। মিসেস সইয়ার, এ-আংটি আপনার মেয়েরই। আসল লোকের হাতে ফিরিয়ে দিতে পেরে খুশি হলাম।

বিড়বিড় করে বিস্তর আশীর্বাদ আর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আংটিটা কাগজে মুড়ে পকেটে রাখল বুড়ি–পা ঘষে ঘষে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে বেরোতে-না-বেরোতেই তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠল শার্লক হোমস ছুটে গেল নিজের ঘরে। গলাবন্ধ আর আলস্টার চাপিয়ে ফিরে এল সেকেন্ড কয়েক পরেই। দ্রুতকণ্ঠে বললে, পিছু নিতে হবে দেখছি। বুড়ি নিশ্চয়ই খুনির স্যাঙাত–পেছনে পেছনে গেলেই খুনির দেখা পাব। আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো। বুড়ি সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর হলঘরের দরজা বন্ধ হতে-না-হতেই হুড়মুড় করে নেমে গেল শার্লক হোমস। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, বুড়ি পা টেনে টেনে চলেছে ওদিকের ফুটপাথ দিয়ে! পেছনে কিছু দূরে আঠার মতো লেগে আমার বন্ধুটি। মনে মনেই বললাম–হয় ওর থিয়োরি আগাগোড়া ভুল, আর না হয় রহস্যের নাভিকেন্দ্রে যাওয়ার অভিযান এইবার হল শুরু। আমাকে প্রতীক্ষা করতে না-বললেও চলত। নৈশ-অ্যাডভেঞ্চারের পরিণাম না-শোনা পর্যন্ত ঘুম আমার পক্ষে অসম্ভব।

ও বেরোল ন-টা নাগাদ! কখন ফিরবে জানি না। তা সত্ত্বেও গ্যাঁট হয়ে বসে পাইপ টানতে লাগলাম আর হেনরি মার্জারের বই পড়তে লাগলাম। দশটা বাজল, পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝলাম শুতে গেল পরিচারিকা। এগারোটায় শুনলাম বাড়িউলির ভারিক্কি পদধ্বনি–আমার দরজার সামনে দিয়ে গেল শোবার ঘরের দিকে। বারোটা বাজতে যখন কয়েক মিনিট বাকি, ল্যাচে চাবি ঘোরানোর তীক্ষ্ণ্ণ শব্দ ভেসে এল উপরে। ঘরে ঢুকতেই হোমসের মুখ দেখে বুঝলাম সফল হয়নি অভিযান। নৈরাশ্য আর কৌতুকের মধ্যে লড়াই লেগেছে মুখখানাকে পুরোপুরি দখলে রাখার। হঠাৎ শেষকালে জিতে গেল কৌতুক। বিষম মজায় প্রাণ খুলে অট্টহেসে ফেটে পড়ল শার্লক হোমস।

চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ে বললে, মরে গেলেও এ-খবর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কানে তুলতে পারব না। ওদের এত টিটকিরি দিয়েছি যে এই একটা সুযোগ পেলে সুদে-আসলে উশুল করে নেবে। আমি হাসছি, কেননা আমি জানি শেষ পর্যন্ত আমি জিতবই।

কী হয়েছে বলবে তো।

বলতে গেলে আমার কেচ্ছাই আমাকে বলতে হয়। তাতে অবশ্য পরোয়া করি না। ওই যে-প্রাণীটা বিদেয় হল এ-ঘর থেকে, কিছুদূর যাওয়ার পর এমন খোঁড়াতে লাগল যে বেশ বুঝলাম পায়ের পাতায় ঘা হয়ে গিয়েছে। শেষকালে আর হাঁটতে না-পেরে হাতছানি দিয়ে দাঁড় করালে একটা চার চাকার চলন্ত ঘোড়ার গাড়ি। আমি ঠিক পাশটিতে গিয়ে কানখাড়া করলাম কোচোয়ানকে কোথায় যেতে বলে শোনবার জন্যে। অবশ্য তার দরকার ছিল না। ঠিকানাটা এত জোরে বলল বুড়ি যে ওপাশের ফুটপাথে থেকেও নিশ্চয় স্পষ্ট শোনা গিয়েছিল।

তেরো নম্বর ডানকান স্ট্রিট, হাউন্ডসডিচে চলো। বুড়ি তাহলে সত্যিই বলেছে। ভেতরে উঠে বসতেই আমি জায়গা করে নিলাম পেছনে। এটাও একটা আর্ট–সব ডিটেকটিভের রপ্ত হওয়া উচিত। গন্তব্যস্থানে না-পৌছানো পর্যন্ত একবারও লাগামটান দিল না কোচোয়ান, ঊর্ধ্বশ্বাসে গেল ডানকান স্ট্রিটে। তেরো নম্বরের দরজা আসার আগেই টুপ করে নেমে পড়লাম গাড়ির পেছন থেকে, তারপর গজেন্দ্র গমনে হেঁটে গেলাম পথটা। লাফিয়ে নেমে দরজা খুলে ধরল কোচোয়ান–দূর থেকেই দেখলাম ভেতরের লোকের বাইরে আসার প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। কিন্তু কেউ এল না বাইরে। কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম পাগলের মতো হাতড়াচ্ছে শূন্য গাড়ির আসন, আর এমন সব বাছা বাছা খিস্তি ছাড়ছে যা জীবনে আমি শুনিনি। প্যাসেঞ্জারের টিকি দেখা যাচ্ছে না–সে যে গাড়ির মধ্যে এসেছে এমন কোনো চিহ্নও নেই। ভাড়া পেতে এখন বেশ কিছুদিন সবুর করতে হবে কোচোয়ান বেচারাকে। তেরো নম্বর বাড়ির মধ্যে খোঁজ নিয়ে জানলাম সইয়ার বা ডেনিস বলে কেউ কস্মিনকালেও সেখানে থাকেনি। বাড়ির মালিক একজন মান্যগণ্য ব্যবসাদার—ঘরের দেওয়ালে কাগজ সাঁটার কারবার আছে।

সবিস্ময়ে বললাম, বলছ কী! ওইরকম একটা থুথুরে শণের বুড়ি চলন্ত গাড়ি থেকে। লাফিয়ে নেমে গেল অথচ তোমার বা কোচোয়ানের চোখে পড়ল না?

থুথুরে বুড়ির কথায় আগুন! খ্যাক করে উঠল শার্লক হোমস।বুড়ি বলে যাকে ভেবেছি আসলে সে বুড়িই নয়–জোয়ান ছোঁড়া এবং পাক্কা অভিনেতা। ছদ্মবেশখানা কী নিয়েছিল বল? জবাব নেই। ও দেখেছে আমি পিছু নিয়েছি, তাই সটকান দিয়েছে এইভাবে। এতেই বোঝা গেল লোকটাকে যতখানি নিঃসঙ্গ ভেবেছিলাম ততখানি সে নয়। তার সঙ্গীসাথী আছে–এমন সঙ্গী যারা দরকার মতো বিরাট ঝুঁকিও নিতে পারে তার জন্যে। ডাক্তার, বড্ড কাহিল দেখাচ্ছে তোমাকে। যাও, এবার শুয়ে পড়ো।

সত্যিই বড্ড ক্লান্তি বোধ করছিলাম। তাই ওর হুকুম শিরোধার্য করলাম। সধূম আগুনের সামনে বন্ধুবরকে বসিয়ে রেখে গেলাম শোবার ঘরে। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমের ঘোরেও শুনলাম বেহালার তারে ছড়ি টেনে চলেছে হোমস। নীচু গ্রামে বাজাচ্ছে বড়ো বিষণ্ণ সুর। বুঝলাম অদ্ভুত সমস্যায় এখনও নিমগ্ন রয়েছে শার্লক হোমস।