উপন্যাস

০১. হুঁশিয়ারি

দ্য ভ্যালি অফ ফিয়ার (আতঙ্ক উপত্যকা)
প্রথম খণ্ড বির্লস্টোন ট্র্যাজেডি
০১. হুঁশিয়ারি

আমি ভাবতে বাধ্য হচ্ছি যে–বললাম আমি।

অধীর কণ্ঠে বলল শার্লক হোমস–আমিও তাই ভাবতাম।

মরদেহদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বেশিদিন যন্ত্রণা সয়ে আছি, এ-বিশ্বাস আমার আছে। তাও সেদিনকার শ্লেষবঙ্কিম বাধাপ্রদানে মেজাজ খিচড়ে গেল।

কড়াগলায় বললাম, হোমস, মাঝে মাঝে সত্যিই তোমাকে বরদাস্ত করা যায় না।

হোমস তখন নিজের চিন্তাতেই এমন ঝুঁদ হয়ে রয়েছে যে আমার প্রতিবাদের তক্ষুনি কোনো জবাব দিল না। প্রাতরাশ তখনও মুখে তোলেনি। খাম থেকে সদ্য-বার-করা কাগজের টুকরোটির দিকে অনিমেষে চেয়ে আছে হাতের ওপর ভর দিয়ে। তারপর খামটা তুলে নিল, আলোর সামনে ধরে খুব হিসেবি চোখে বাইরের দিকটা এবং পেটির-মতো-ঝুলে-থাকা আঠা লাগানোর জায়গাটা দেখল।

বলল চিন্তামগ্ন কণ্ঠে, এ যে দেখছি পোর্লকের হাতের লেখা। বারদুয়েক এ হাতের লেখা আগে দেখেছি, তবুও এটা পোর্লকেরই হাতের লেখা–গ্রিক eর বাহারি চুড়োটাই ধরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এ-চিঠি যদি পোর্লকের হয়, তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছে নিশ্চয়।।

কথাগুলো হোমস যেন আমাকে বলছে না, নিজের মনেই বলে যাচ্ছে। আমার বিরক্তি উবে গিয়ে কৌতূহল হল। কী বলতে চায় হোমস?

জিজ্ঞেস করলাম, পোর্লক লোকটা তাহলে কে?

ওয়াটসন পোর্লক একটা ছদ্মনাম, শনাক্তকরণের নিছক একটা চিহ্ন। কিন্তু এ-নামের আড়ালে প্রচ্ছন্ন রয়েছে ভারি পিচ্ছিল ফন্দিবাজ একটি ব্যক্তিত্ব। এর আগে একটা চিঠি লিখে স্পষ্টই জানিয়েছিল আমাকে, নামটা তার নিজের নয়–বিরাট এই শহরের লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে লুকিয়ে আমাকে ফাঁকি দিয়েছে সেই থেকে। পোর্লক গুরুত্বপূর্ণ নিজের জন্যে নয়–বিরাট এক পুরুষের সংস্পর্শে আছে বলেই যা কিছু তার গুরুত্ব। ভয়ংকরের সান্নিধ্যে থেকেও যারা অকিঞ্চিৎকর, সে তাই, যেমন হাঙরের সঙ্গে পাইলট-মাছ, সিংহের সঙ্গে শেয়াল। শুধু ভয়ংকর নয় ওয়াটসন অত্যন্ত করাল বলতে যা বোঝায়, তাই। আর, সেই হিসেবেই আসছে সে আমার আওতায়। প্রফেসর মরিয়ার্টির কথা আমার মুখে শুনেছ মনে আছে?

বিখ্যাত সেই সায়েন্টিফিক ক্রিমিন্যাল তো? বদমাশ জালিয়াতদের মধ্যে অতি বিখ্যাত—

বিড়বিড় করে হোমস বললে, কী লজ্জা! কী লজ্জা! আমার মন্তব্যটা মনে ধরেনি ওর।

আমি বলতে চাইছিলাম–বদমাশ জালিয়াতদের মধ্যে অতি সুবিখ্যাত হয়েও জনসাধারণের কাছে যে এখনও অজ্ঞাত।

শেষটা ভালোই বলেছ, সোল্লাসে বললে হোমস, তবে কী জানো আজকাল তোমার কৌতুকবোধের মধ্যে শঠতার প্যাচ থাকছে ভীষণ চমকে দাও। এখন থেকে দেখছি সাবধান থাকতে হবে। নইলে কুপোকাত হতে হবে। কিন্তু মরিয়ার্টিকে ক্রিমিন্যাল বলে তুমি আইনের চোখে অন্যায় করছ মিথ্যা অপবাদের অপরাধে অপরাধী হচ্ছ–কেননা মরিয়ার্টি নামের সঙ্গে অনেক গৌরব, অনেক বিস্ময় জড়িয়ে আছে। দুনিয়ায় এত বড়ড়া চক্রান্তকারী আর জন্মায়নি, সংসারের যাবতীয় শয়তানি সংগঠনে যার জুড়ি নেই, নীচের মহলের যাবতীয় কর্মকাণ্ড যার অঙ্গুলিহেলনে নিয়ন্ত্রিত হয়–এ সেই ব্রেন একটা জাতকে গড়তে পারে, ধ্বংসও করতে পারে–একটা গোটা জাতের ভাগ্যনিয়ন্তা হবার ক্ষমতা রাখে। মরিয়ার্টি সেই লোক। এত করেও সে ধরাছোঁয়ার বাইরে, সাধারণের সন্দেহের ঊর্ধ্বে, গালিগালাজ সমালোচনার নাগাল থেকে অনেক দুরে। নিজেকে ধোয়া তুলসীপাতার মতো পবিত্র রাখতে আর এই বিরাট কাণ্ডকারখানার পরিচালনায় তার দক্ষতা এতই তুঙ্গে পৌঁছেছে যে তোমার এই আলগা মন্তব্যটির দরুন অনায়াসেই সে তোমায় কোর্টে টেনে নিয়ে যেতে পারে এবং চরিত্রে মিথ্যা কলঙ্ক লেপনের অভিযোগে ক্ষতিপূরণ বাবদ তোমার বেশ কয়েক বছরের পেনশন পকেটস্থ করতে পারে। গ্রহাণুপুঞ্জের গতিবিজ্ঞান বইখানা কিন্তু তারই লেখা। অনেক উঁচুদরের অতি সূক্ষ্ম গণিতবিজ্ঞানের পরাকাষ্ঠা দেখা গিয়েছে এই বইটিতে। শোনা যায়, বইখানার ওপর কলম ধরবার মততা, সমালোচনা করার মতো লোকই নাকি বিজ্ঞান সংবাদদাতাদের মধ্যে পাওয়া যায়নি। এহেন লোকের দুর্নাম করা কি সম্ভব? লোকে বলবে ডাক্তার ওয়াটসনটা তো দেখছি নিজে নোংরা! প্রফেসরের গায়ে কালি ছিটোচ্ছেন? ওইরকম একজন প্রতিভার নামে যা মুখে আসে তাই বলছেন? ওয়াটসন, একেই বলে প্রতিভা! যাই হোক, ছুটকো প্রতিভাগুলো যদি আমাকে রেহাই দিত, টক্কর দেওয়া যেত বড়ো প্রতিভাটার সঙ্গে। সেদিন আসবেই জেনো৷

আন্তরিকভাবে বললাম, সেদিন যেন আমিও থাকি। কিন্তু তুমি পোর্লক সম্বন্ধে কী বলছিলে যেন?

ও হ্যাঁ, তথাকথিত পোর্লক এই বিরাট শেকলের একটা নগণ্য আংটা। শেকলটা যেখানে লেগে–সেখান থেকে কিছু দূরেই এর অবস্থান। তোমাকেই বলি, আংটা হিসেবে পোর্লক খুব শক্ত নয়। বাজিয়ে দেখেছি, শেকলটার একমাত্র কমজোরি আংটা হোল এই পোর্লক।

তাহলে সে-শেকল যত মজবুতই হোক না কেন–কমজোরি আংটার মতোই তো নিজেও কমজোরি।

ভায়া ওয়াটসন, খাঁটি কথা বলেছ। পোর্লকের অসামান্য গুরুত্ব তো সেই কারণেই। মাঝে মাঝে ওর উচ্চাশার অঙ্কুরে হাওয়া দিই, গোপন ইচ্ছাকে তাতিয়ে তুলি। দশ পাউন্ডের নোট পাঠিয়ে দিই, তাতেই বার-দুয়েক যে-অগ্রিম খবর পাঠিয়েছে তা অপরাধ নিবারণে বেশ কাজে এসেছে। অপরাধ হয়ে যাওয়ার পর আইনের কাঁটা দিয়ে শোধ তোলার চাইতে যা অনেক বেশি মূল্যবান। গুপ্ত লিখনের সংকেতটুকু ধরতে পারলে কিন্তু এ-চিঠির মধ্যেও ওই ধরনের দামি খবর মিলতে পারে।

এঁটো-না-হওয়া প্লেটের ওপর কাগজটা ফের বিছিয়ে ধরল হোমস। উঠে গিয়ে অদ্ভুত হরফ আর সংখ্যাগুলো দেখলাম আমি।

মানেটা কী হোমস?

গুপ্ত খবর পাচারের চেষ্টা।

কিন্তু গুপ্তসংকেত ছাড়া গুপ্ত লিখন তো অর্থহীন!

এক্ষেত্রে তাই বটে।

এক্ষেত্রে বললে কেন?

হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ কলমে অনেক সময়ে এমন অনেক হেঁয়ালি বিজ্ঞাপন বেরোয় যা কার লেখা ধরা মুশকিল। আমি কিন্তু গড় গড় করে তার মানে বলে যেতে পারি। গুপ্তলিখনের এসব স্থূল পদ্ধতি দেখে মজা পাই, ক্লান্ত হই না। এটা কিন্তু একেবারেই আলাদা ব্যাপার। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে একটা বইয়ের পৃষ্ঠায় কতকগুলো শব্দের নির্দেশ রয়েছে। কোন বইয়ের কোন পৃষ্ঠার কথা বলা হয়েছে না-জানা পর্যন্ত আমি অসহায়।

বির্লস্টোন আর ডগলাস শব্দ দুটো বসানো হল কেন?

বইয়ের ওই পৃষ্ঠায় এ-শব্দ নেই বলে।

বইটার নাম তাহলে সংকেতে বলা হল না কেন?

ভায়া ওয়াটসন, তোমার একটা সহজাত ধূর্ততা আছে–যা তোমার বন্ধুবান্ধবের কাছে আনন্দের খোরাক গুপ্তলিখন আর গুপ্তসংকেত একই খামের মধ্যে কি তুমিও পাঠাতে? দৈবাৎ যদি বেহাত হয় তোমার অবস্থাটা কী দাঁড়াবে ভাবো তো? কাজেই আলাদা আলাদা খামেই যাওয়া উচিত গুপ্তলিখন আর গুপ্তসংকেত–তাতে সর্বনাশের সম্ভাবনা থাকছে না। হারিয়ে গেলেও দুটো আলাদা হেঁয়ালি থেকে যাচ্ছে। ক্ষতি কিছুই হচ্ছে না। দু-নম্বর চিঠি আসার সময় কিন্তু হয়ে গেছে। হয় তাতে আরও ব্যাখ্যা থাকবে, না হয় যে-বই সম্পর্কে অঙ্কগুলো বসানো হয়েছে–সোজাসুজি তার উল্লেখ থাকবে। শেষেরটার সম্ভাবনাই বেশি।

হোমসের হিসেব সত্যি হল মিনিট কয়েকের মধ্যেই। যে-চিঠির জন্যে সাগ্রহ প্রতীক্ষা, ছোকরা চাকর বিলি সেই চিঠি নিয়ে আবির্ভূত হল ঘরে।

খাম খুলতে খুলতে বললে হোমস, একই হাতের লেখা। চিঠি বার করে উল্লসিত কণ্ঠে, সইও করেছে। ওয়াটসন, কাজ ভালোই এগুচ্ছে দেখছি।

চিঠি পড়েই মেঘাচ্ছন্ন হল ললাট।

সর্বনাশ! হতাশ হলাম। এ-রকমটা তো আশা করিনি! ওয়াটসন, যা ভেবেছিলাম তার কিছুই তো দেখছি হল না। পোর্লক লোকটার সর্বনাশ না-হলেই বাঁচি।

শোননা কী লিখেছে–প্রিয় মি. হোমস, এ-প্রসঙ্গে আর এগুবো না। ভীষণ বিপজ্জনক। আমাকে সন্দেহ করেছেন উনি। স্পষ্ট দেখছি ওঁর সন্দেহ। গুপ্তসংকেতের মূল সূত্রটা পাঠাব বলে এই খামের ওপর আপনার নাম-ঠিকানা লেখবার পরেই দুম করে এসে হাজির হলেন উনি। একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কোনোরকমে লুকিয়ে ফেলি খামটা। ওঁর চোখে পড়লে আমার কী হত আমিই জানি। কিন্তু ওঁর চোখে সন্দেহ দেখেছি। গুগুলিখন পুড়িয়ে ফেলবেন–এই পরিস্থিতিতে আপনার কাজে লাগবে নাফ্রেড পোর্লক।

চুপ করে কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে আগুনের দিকে চেয়ে বসে রইল হোমস। চিঠিখানা দলাইমলাই হতে লাগল আঙুলের ফাঁকে।

তারপর বললে, হয়তো আসলে কিছুই নয়। স্রেফ ছায়া দেখে চমকানি। জ্ঞানপাপী তো, নিজে বিশ্বাসহন্তা বলেই মনে করে সবাই সন্দেহ করছে।

উনি বলতে নিশ্চয় প্রফেসর মরিয়ার্টি?

আর কে। ওদের উনি মানে একজনই–তাবৎ দুনিয়ায় যার জুড়ি নেই।

কিন্তু উনি করবেনটা কী?

হুম! বিরাট প্রশ্ন। ইউরোপের প্রথম শ্রেণির একটা ব্রেন দুনিয়ার সমস্ত অন্ধকার নিজের পেছনে জড়ো করে তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে জানবে অনন্ত ঘটনা ঘটতে পারে। যাই হোক ভয়ের চোটে বন্ধুবর পোর্লকের ধাত ছেড়ে গিয়েছে দেখা যাচ্ছে। চিঠির হাতের লেখার সঙ্গে খামের ওপরকার হাতের লেখা মিলিয়ে দেখো। ওঁর করাল আবির্ভাবের ঠিক আগেই লেখা হয়েছিল খামের ঠিকানা স্পষ্টভাবে, দৃঢ়ভাবে। কিন্তু চিঠি লেখা হয়েছে কাঁপা-কাঁপা হাতে পড়াই যাচ্ছে না।

চিঠি লেখার দরকার কী ছিল? না-লিখলেই পারত।

ভয়ের চোটে লিখেছে। ভেবেছিল, প্রথম চিঠি পেয়ে খোঁজখবর নেবই–আরও বিপদে ফেলব বেচারাকে।

তা ঠিক, প্রথমে গুপ্তলিখনটা তুলে নিয়ে বিছিয়ে ধরলাম হাঁটুর ওপর। চেয়ে রইলাম ভুরু কুঁচকে। গুরুত্বপূর্ণ একটা গুপ্ত ব্যাপার সামান্য এই কাগজখানার মধ্যে রয়েছে, অথচ রহস্যভেদ করার ক্ষমতা মানুষের নেই ভাবলেও মাথা খারাপ হয়ে যায়।

প্রাতরাশ একেবারেই মুখে তোলেনি শার্লক হোমস। এখন তা পাশে সরিয়ে দিয়ে নিগুঢ়তম চিন্তার সঙ্গী অখাদ্য পাইপ তুলে নিয়ে অগ্নিসংযোগ করল।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে কড়িকাঠের দিকে নির্নিমেষে চেয়ে বললে, আশ্চর্য! সত্যিই আশ্চর্য! রহস্য সমাধানের সূত্র নিশ্চয় আছে কাগজটায়। কিন্তু তোমার ম্যাকিয়াভেলিয়ান*৬ বুদ্ধিমত্তায় তা ধরা পড়েনি। স্রেফ যুক্তির আলোয় গোড়া থেকে বিচার করা যাক হেঁয়ালিটার। লোকটা একখানা বইয়ের উল্লেখ করছে। যুক্তির শুরু হোক এই পয়েন্ট থেকেই।

পয়েন্টটা কিন্তু অস্পষ্ট।

মানছি, কিন্তু দেখাই যাক না পরিসরটাকে সংকীর্ণ করা যায় কিনা। মনটাকে পুরো রাখলাম পয়েন্টের ওপরে রেখেও দেখছি বিলক্ষণ দুর্ভেদ্য। কী ধরনের বই সে-সম্বন্ধে কোনো ইঙ্গিত আছে কি?

না।

বেশ বেশ অতটা হতাশ হবার কারণ দেখছি না। গুপ্ত লিখন শুরু হয়েছে একটা বড়ো  সংখ্যা দিয়ে–৫৩৪, তাই না? স্রেফ অনুমিতি হলেও এই তথ্যের ভিত্তিতে এগোনো যাক, ধরে নিলাম ৫৩৪ একটি পৃষ্ঠাসংখ্যা–যে-বইটির কথা বলতে চায় পোর্লক–সেই বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা। তাহলেও দেখ বইটা আয়তনে বেশ বড়ো–এটা কিন্তু কম পাওয়া নয়। বিশাল এই বইটা কী ধরনের সে-সম্বন্ধে আর কোনো ইঙ্গিত আছে কি? পরের চিহ্নটা দেখছি C2। ওয়াটসন, বলো কী বুঝলে?

দ্বিতীয় অধ্যায় নিশ্চয়।

মমাটেই তা নয়। একটা কথা মানছ তো যে, পৃষ্ঠাসংখ্যা দিলে পরিচ্ছদের সংখ্যা দেওয়ার আর দরকার হয় না। আরও দেখো, ৫৩৪ পৃষ্ঠাসংখ্যা যদি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে পড়ে, তাহলে প্রথম পরিচ্ছেদটা নিশ্চয় অসহ্য রকমের দীর্ঘ।

কলম! বললাম চিৎকার করে।

ব্রিলিয়ান্ট, ওয়াটসন। আজ দেখছি বুদ্ধি তোমার ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। কলম না-হলে বুঝতে হবে দারুণ ঠকলাম। তাহলে দেখো বইখানা বেশ বড়ো, দু-কলমে ছাপা প্রতিটি পৃষ্ঠা এবং প্রত্যেকটা কলম রীতিমতো লম্বা কেননা একটা শব্দের সংখ্যা দেওয়া হয়েছে দু-শো তিরানব্বই। যুক্তির দৌড় কি এবার শেষ?

আমার তাই মনে হয়।

নিজের ওপর একটা অবিচার করলে? ভায়া ওয়াটসন, এই নাও আজ একটা চমক। আর একটা মগজ-তরঙ্গ। বইটা অসাধারণ কিছু হলে পাঠিয়েই দিত আমার কাছে। তার বদলে পোর্লকের ইচ্ছে ছিল খামের মধ্যে সংকেত সূত্র পাঠাবে–প্ল্যান ভন্ডুল হবার আগে ইচ্ছে ছিল তাই। চিঠিতেও দেখো তাই লিখেছে। এ থেকে স্বভাবতই মনে হয়, ও ভেবে নিয়েছিল বইটি পেতে আমার অসুবিধে হবে না। বইখানা তার কাছেই আছে এবং ধরে নিয়েছিল আমার কাছেও আছে। ওয়াটসন, সংক্ষেপে বলি–বইটা অতি মামুলি।

কথাগুলো খুবই সম্ভাব্য মনে হচ্ছে।

তদন্ত তাহলে সংকুচিত হয়ে এল দু-কলমে ছাপা সাধারণ ব্যবহারের উপযোগী একটা বড়ো বইয়ের ওপর।

বাইবেল! বললাম বিজয়োল্লাসে।

চমৎকার বলেছ ওয়াটসন! তবে কী জানো, খুব চমৎকার বলোনি। অভিনন্দনটা আমি নিজেও যদি নিই, মরিয়ার্টির এক শাকরেদ হাতের কাছে বাইবেল নিয়ে বসে আছে, এমন কথা বলতে পারব কিনা সন্দেহ। তা ছাড়া বাইবেলের এত অসংখ্য সংস্করণ বেরিয়েছে যে দুটো কপির পৃষ্ঠাসংখ্যা এক হবে এমনটা আশা করা যায় না। সুতরাং এমন একটা বইয়ের কথা বলতে চেয়েছে পোর্লক যা ঘরে ঘরে আছে। সে জানে তার বইয়ের ৫৩৪ পৃষ্ঠা হুবহু মিলে যাবে আমার বইয়ের ৫৩৪ পৃষ্ঠাসংখ্যার সঙ্গে।

কিন্তু ৫৩৪ পৃষ্ঠাওলা বই খুব কমই আছে।

ঠিক কথা। আমাদের নাকানিচোবানির অন্ত তো সেইখানেই। তদন্ত পরিসর তাহলে ছোটো হয়ে এল এমন খানকয়েক নির্ধারিত মানের বইয়ে যা ঘরে ঘরে রাখা যায়, যে-কেউ কিনতে পারে।

ব্র্যাডশ!

একটু অসুবিধে আছে, ওয়াটসন। ব্র্যাডশ-য় যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা সংক্ষিপ্ত, জোরালো, কিন্তু সীমিত। হরেকরকম শব্দের অভাব। সাধারণ খবর পাঠানোর উপযুক্ত শব্দ ওখান থেকে জোগাড় করা কঠিন। ব্র্যাডশ তাই বাদ গেল। একই কারণে অভিধানকে নাকচ করলাম। তাহলে কী রইল বলো তো?

পাঁজি।

অতি চমৎকার বলেছ, ওয়াটসন! পয়েন্টটা ধরতে না-পারলে খুবই অবাক হতাম। পাঁজি! হুইটেকারের পাঁজি নিয়ে বসা যাক। ঘরে ঘরে আছে। পৃষ্ঠাসংখ্যাও প্রচুর। দু-কলমে ছাপা। আগেকার সংস্করণগুলোয় বাকসংযম দেখালেও শেষের দিকে একটু বাচাল হয়েছে জানি। টেবিল থেকে বইখানা তুলে নিল হোমস। এই হল ৫৩৪ পৃষ্ঠা, দু-নম্বর কলম, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ব্যাবসা-বাণিজ্য সম্পদ-সমৃদ্ধি নিয়ে অনেককিছুই লেখা হয়েছে দেখছি। শব্দগুলো লিখে নাও, ওয়াটসন। তেরো নম্বর হল মারাঠা। শুরুটা খুব শুভ বলে মনে হচ্ছে না। এক-শো সাতাশ শব্দ সংখ্যা হল গভর্নমেন্ট। কিছুটা মানে অবশ্য আছে শব্দটার, তবে আমাদের আর প্রফেসর মরিয়ার্টির দিক থেকে একটু অপ্রাসঙ্গিক খাপছাড়া। নাও, আবার চেষ্টা করা যাক। মারাঠা গভর্নমেন্ট করছে কী দেখা যাক। আরে গেলে যা। পরের শব্দ দেখছি শুয়োরের খাড়া-খাড়া শক্ত ছোটো চুল। গেল গেল, সব গেল ওয়াটসন! বারোটা বেজে গেল বুদ্ধির খেলার!

ঠাট্টাচ্ছলে বললেও ঘন ভুরুর মুচড়ে-ওঠা দেখে বুঝলাম ভেতরে ভেতরে বেচারি কীরকম হতাশ হয়েছে, মেজাজও তিরিক্ষে হয়েছে। মনটা আমারও খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু আমার তো কিছু করার নেই। অসহায়ভাবে আগুনের দিকে চেয়ে বসে রইলাম। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর নীরবতা ভঙ্গ হল শার্লক হোমসের আচমকা চিৎকারে। সহর্ষে চেঁচিয়ে উঠে তিরের মতো ছিটকে গেল তাকের দিকে এবং হলদে মলাট দেওয়া আর একখানা বই নিয়ে ফিরে এল চেয়ারে।

বললে চিৎকার করে, বেশি আধুনিক হয়ে গেছিলাম তো তাই মাশুল দিতে হয়েছে। সময়ের সঙ্গেসঙ্গে তাল মিলিয়ে না-চলে যারা এগিয়ে যায় গুনাগার দিতে হয় তাদেরই–আমরা ব্যতিক্রম নই। আজ হল গিয়ে সাতুই জানুয়ারি, কাজেই নতুন পঞ্জিকা নিয়ে পাতা উলটেছি, কিন্তু পোর্লক নিশ্চয় পুরোনো পঞ্জিকার পৃষ্ঠা দেখে লিখেছে গুপ্তলিখন। সংকেতসূত্র ব্যাখ্যা করার সময়ে অবশ্যই তা বলত। এবার দেখা যাক ৫৩৪ পৃষ্ঠায় কীরকম খবর পাওয়া যায়। তেরো নম্বর শব্দটা দেখছি দেয়ার–অনেক সম্ভাবনাময় শব্দ। এক-শো সাতাশ নম্বর সংখ্যা হল ইজ দেয়ার ইজ– উত্তেজনায় চকচক করতে থাকে হোমসের চোখ; দীর্ঘ সরু, কম্পিত আঙুলে একে-একে গুনে যায় শব্দ ডেঞ্জার। হা! হা! চমৎকার! লিখে নাও, ওয়াটসন। দেয়ার ইজ ডেঞ্জার–মে–কাম–ভেরি–সুন–ওয়ান। তারপর দেখছি একটা নাম ডগলাস রিচ–কান্ট্রি–নাউ অ্যাট–বির্লস্টোন–হাউস–বির্লস্টোন কনফিডেন্স ইজ–প্রেসিং। দেখলে তো ওয়াটসন। খাঁটি যুক্তির ফসলটা দেখলে ? সবজির দোকানে লরেলের মুকুট-টুকুট যদি পাওয়া যেত, এখুনি কিনতে পাঠাতাম বিলি ছোঁড়াকে।

হোমস গুগুলিখনের মর্মার্থ উদ্ধার করে মুখে-মুখে বলে গেছিল, হাঁটুর ওপর ফুলসক্যাপ কাগজ বিছিয়ে আমি তা লিখে নিয়েছিলাম। এখন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম বিচিত্র সেই সংবাদের দিকে।

বললাম, পোর্লক দেখছি বড়ো অদ্ভুতভাবে জোর করে টেনেহিচড়ে মানে বোঝাবার চেষ্টা করেছে।

হোমস বললে, বরং তার উলটোটাই করেছে, আশ্চর্য দক্ষতা দেখিয়েছে। খবর পাঠাতে যেসব শব্দ দরকার, তা একটিমাত্র কলমের মধ্যে খুঁজতে গেলে মুশকিল বই কী। সব শব্দ নাও পেতে পারো। তাই সংবাদদাতার ধীশক্তির ওপর কিছুটা না-ছাড়লেই নয়। উদ্দেশ্যটা সুস্পষ্ট। ডগলাস লোকটা যেই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে ঘোর ষড়যন্ত্র চলছে–শয়তানি প্যাচে ফেলার জোগাড়যন্ত্র হচ্ছে। ভদ্রলোক থাকেন মফস্সলে–বড়োলোক। কনফিডেন্স শব্দটা কনফিডেন্ট শব্দের কাছাকাছি বলে লেখা হয়েছে–অর্থাৎ পোর্লক নিশ্চিত যে ভদ্রলোকের সর্বনাশ ঘনিয়ে এসেছে। পাকা কারিগরের মতো বিশ্লেষণ করার পর এই হল গিয়ে আমাদের তদন্ত ফলাফল।

আশানুরূপ ফল না-পেলে হোমস যেমন মুখ কালো করে গুমরে মরে, মনের মতো ফল দেখা দিলে তেমনি খাঁটি শিল্পীর মতোই নৈর্ব্যক্তিক আনন্দে ঝলমলিয়ে ওঠে। সাফল্যের আনন্দে তাই আপন মনেই হাসতে লাগল খুকখুক করে। এমন সময়ে দরজা খুলে ধরল বিলি ঘরে ঢুকলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইনস্পেকটর ম্যাকডোনাল্ড।

আলেক ম্যাকডোনাল্ড এখন দেশজোড়া নাম কিনেছে। কিন্তু অষ্টদশ শতাব্দীর শেষে দিকে আলেক ম্যাকডোনাল্ডের কর্মজীবনের শুরুতে কেউ তাকে চিনত না। গোয়েন্দাবাহিনীর তরুণ কিন্তু আস্থাভাজন অফিসার হিসেবে কয়েকটা কেসের সন্তোষজনক সমাধান করেছিলেন সেই বয়েসেই। চওড়া হাড় দিয়ে তৈরি লম্বা কাঠামোয় ছিল অসামান্য শারীরিক ক্ষমতার ছাপ। বিশাল করোটি আর নিবিড় ভুরুর তলায় গভীরভাবে গাঁথা চকচকে চোখজোড়া থেকে বিচ্ছুরিত হত আতীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা। নীরব প্রকৃতির চুলচেরা স্বভাবের জেদি পুরুষ–উচ্চারণে কর্কশ অ্যাবারডোনিয়ান টান। দু-বার হোমসের সাহায্য নিয়ে কর্মজীবনে সুনাম কিনেছে–হোমস পেয়েছে কেবল কঠিন সমস্যা সমাধানের আনন্দ ধীশক্তির পরিতৃপ্তিই তার একমাত্র পুরস্কার। শখের সতীর্থকে এই কারণেই যুগপৎ সমীহ করত আর ভালোবাসত স্কচম্যান এবং সব রকমের সমস্যায় হোমসের পরামর্শ নেওয়ার সময়ে তা খোলাখুলি প্রকাশ করতে দ্বিধা করত না। মাঝারি গুণ সম্পন্ন লোক নিজের চাইতে উচ্চগুণ সম্পন্ন ব্যক্তির মেধা ধরতে পারে না। কিন্তু রতনে রতন চেনে। এক ধীমানকে নিমেষে চিনে নেয় আর এক ধীমান! সেক্ষেত্রে ম্যাকডোনাল্ডও ধীমান পুরুষ। ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা আর স্বীয় অভিজ্ঞতা বলে যে-মানুষটি সারা ইউরোপে অনন্য হয়ে উঠেছে, তার সাহায্য নেওয়ার মধ্যে যে তিলমাত্র অবমাননা নেই–এ-বোধ তার ছিল। বন্ধুত্ব করার প্রবণতা হোমসের মধ্যে না-থাকলেও বিশালকায় স্কচম্যানকে সে আমল দিত। তাই মৃদু হাসল ম্যাকডোনাল্ডকে দেখে।

বলল, আপনি দেখছি ভোরের পাখি হয়ে গেছেন, মি. ম্যাক। কপাল খুলে যায় ছোটোখাটো ব্যাপারেও। লটঘট কিছু ঘটেছে বলেই নিশ্চয় এই আগমন?

কাষ্ঠ হাসি হেসে বললে ইনস্পেকটর, আমার মনের কথাই প্রায় বলে দিলেন দেখছি। ভোরের কনকনে ঠান্ডাটা একটু কমাননা যাক। না, না ধন্যবাদ, চুরুট খাব না। সাত সকালে একটা তদন্তে বেরিয়েছি। জানেন তো সকালের কেসই শেষ পর্যন্ত মূল্যবান কেস হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কিন্তু

বলতে বলতে বিমূঢ় বিস্ময়ে টেবিলের ওপর রাখা একতাড়া কাগজের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল ইনস্পেকটর এই সেই কাগজ যার ওপর একটু আগেই হেঁয়ালি-ভরা খবরটা আমি লিখেছি।

বলল তোতলাতে তোতলাতে, ড–ডগলাস! বি–বির্লস্টোন! ব্যাপার কী, মি. হোমস? ডাকিনী বিদ্যে নাকি! এসব নাম আপনি পেলেন কোথায়?

একটা গুপ্তলিখনের পাঠোদ্ধার করলাম এইমাত্র আমি আর ডা. ওয়াটসন। কিন্তু কেন বলুন তো? নাম দেখে আঁতকে উঠলেন কেন?

হতচকিত বিস্ময়ে পর্যায়ক্রমে আমার আর হোমসের মুখ অবলোকন করে ইনস্পেকটর।

বলে, কেন উঠলাম জানেন? বির্লস্টোন ম্যানর হাউসের মি. ডগলাস বীভৎসভাবে খুন হয়েছেন আজই সকালে।

————-

* ম্যাকিয়াভেলিয়ান – ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন ইতালির প্রসিদ্ধ রাজনীতি-বিশারদ। নীতিজ্ঞানহীন।