০১. রুনিক হরফের ভোজবাজি

০১. রুনিক হরফের ভোজবাজি

জার্মেনির হামবুর্গে কনিগ স্ট্রাস স্ট্রিট নামে যে রাস্তাটা আছে, সেইখানে পুরোনো একটা ছোটো বাড়িতে থাকতেন অধ্যাপক লিডেনক। লিডেনব্রক আমার কাকা।

কাকামণির কথা বলতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে চাইনে। রসায়ন, ভূতত্ত্ব আর ধাতুবিজ্ঞানে নিত্য-নতুন গবেষণা করে অধ্যাপক লিডেনকে যে কী পরিমাণ বিখ্যাতি অর্জন করেছিলেন, আজকে তার আর কোনো বিশদ বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন নেই। যখনকার কথা বলতে বসেছি, তখন কাকামণির বয়েস পঞ্চাশের মতো। কিন্তু এতো বয়েস হলে কী হবে, উৎসাহ-উদ্দীপনা তার বিন্দুমাত্র কম ছিলো না যুবকদের চেয়ে।

ভূতত্ত্ব পড়তে আমার ভালো লাগতো বলে কাকামণি নিজে আমাকে পড়ানোর ভার নিয়েছিলেন। তার ফলে অল্পদিনের মধ্যেই অধ্যাপক লিডেনকের সহকারী বলে পণ্ডিতমহলে আমার নাম ছড়িয়ে পড়েছিলো।

আমি আর কাকামণি ছাড়া সেই পুরোনো বাড়িটায় থাকতো অনেক দিনের পুরোনো ঝি বুড়ি মাথা, আর কাকামণির ধর্মকন্যা গ্লোবেন। গ্লোবেন অবশ্য হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতো, কিন্তু সপ্তাহ-শেষে একবার করে তার বাড়ি আসাটা যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছিলো।

সেদিন ছিলো সোমবার, পনেরোই মে। কড়া করে এক কাপ কফি তৈরি করে বসেছি, এমন সময় দেখতে পেলাম, কাকামণি হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। হাতে একটা মোটা বই। কোনো দিকে দৃকপাত না করে কাকামণি সোজা পড়ার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। হাতের ছড়িটা এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, টুপিটা আছড়ে ফেলে দিলেন টেবিলের উপর। তারপর আমায় ডাকতে শুরু করে দিলেন : অ্যাকজেল! অ্যাকজেল!

কাকামণির হৈ-চৈ করার স্বভাব জানতুম বলে কফির কাপটা হাতে নিয়েই তাড়াতাড়ি পড়ার ঘরে এসে ঢুকলুম। পড়ার ঘর না বলে ওটাকে জাদুঘর বলাই উচিত। পৃথিবীর সমস্ত খনিজ পদার্থের নমুনা সে-ঘরে থাকে-থাকে সাজানে? কাকামণির সংগ্রহের বাতিক সারা জার্মেনিতে প্রসিদ্ধ ছিলো।

ঘরে ঢুকেই দেখতে পেলাম, ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে কাকামণি সেই মোটা বইটা নাচাড়া করতে করতে তৃপ্তির স্বরে বলছেন : আহা, কী চমৎকার বই!

কাকামণির মাথায় যে খানিকটা ছিট ছিলো, এ-কথা অন্য কেউ না জানলেও আমি জানতুম। পণ্ডিতদের অমন হয়েই থাকে। কিন্তু তবু আমি অবাক হলুম একটু। কেউ যা পড়তেও পারেনি, তেমনি দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন পুঁথি ছাড়া কাকামণির কাছে অন্য কোনো বইয়ের কদর ছিলো না। কাকামণির হাতের বইটাও নিশ্চয়ই তেমনি কিছু হবে।

আমাকে দেখেই কাকামণি বলে উঠলেন : কথায় বলে, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রতন। সাংঘাতিক খাঁটি কথা! সেই ইহুদি বুড়োর দোকানটা তন্নতন্ন করে খুঁজে আজ এই রত্নটা উদ্ধার করেছি। আহা কী চমৎকার বই! আর দ্যাখ, বাঁধাই ও কী চমৎকার। কত পুরোনো হয়ে গেছে, কিন্তু তবু কী মজবুত আছে এখন। জানিস, কত পুরোনো বইটা? সাতশো বছরের। অথচ বইটার চেহারা,! একদম নতুনের মতো লাগছে না? এমন বাঁধানো বই দেখলে বড়ো-বড়ো দপ্তরিরা পর্যন্ত থ হয়ে যাবে।

জিজ্ঞেস করলাম : নাম কী বইটার?

নাম? তেমনি উত্তেজিত গলায় বললেন কাকামণি : বারো শতকে টার্লেশন নামে যে পণ্ডিত ছিলেন, বইটা তারই লেখা। নাম হিমস্‌ ক্রিলো!

জার্মান তর্জমা কে করেছে?

তর্জমা! তুই কি বলছিস অ্যাকজেল! এটা সেই আসল বই-খাঁটি আইসল্যাণ্ডের ভাষায় লেখা। আহা কী সুন্দর ভাষা, আর কী সাবলীল। ঠিক যেন জার্মান বই!

ছাপা কেমন? হরফগুলো দেখতে খুব সুন্দর বোধহয়?

ছাপা! কাকামণি যেন ভূত দেখলেন : ছাপা? বলিস কী রে তুই? এ হচ্ছে পাণ্ডুলিপিটা, হাতে লেখা পুঁথি–খাঁটি রুনিক হরফে লেখা।

রুনিক? অবাক হয়ে শুধোলাম : সে আবার কী?

ততোক্ষণে ভাষা সম্পর্কে কাকামণির বক্তৃতাটা শুরু হয়ে গেছে। অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতাটা সম্পূর্ণ শুনতে হলো। শেষটায় বললেন : সেকালে এই রুনিক হরফই আইসল্যাণ্ডে চলতি ছিলো। সেখানকার লোকদের মতে, দেব অডিন নাকি স্বয়ং এই বর্ণমালা তৈরি করেছিলেন। বইটা নাড়াচাড়া করতে-করতে কথাগুলো বললেন কাকামণি। হঠাৎ বইটার মধ্য থেকে ছোটো একটা বিবর্ণ, হলদে রঙের কাগজ মেঝেয় ছিটকে পড়লো। তক্ষুনি কাকামণি উদগ্রীব আগ্রহে সেটা তুলে নিলেন। খুব সাবধানে কাগজটার ভাজ খুলে মেলে রাখলেন টেবিলের উপর। কাগজটা লম্বায় পাঁচ ইঞ্চি, চওড়ায় ইঞ্চি-তিনেক হবে। কী-সব হিজিবিজি হরফে কি যেন লেখা কাগজটায়। কিন্তু কী যে লেখা, তার কোনো মাথামুণ্ডুই বুঝতে পারলাম না।

কাকামণি ততোক্ষণে মহা উৎসাহে কাগজটার পাঠোদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমি নির্বিকার চোখে দেয়ালের ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। কিন্তু একটু বাদেই শুনতে পেলাম কাকামণির গলা : রুনিক হরফেই তো চিরকুটটা লেখা। কিন্তু কী যে লেখা, তা তো বুঝতে পারছি নে?

দুনিয়ার সব ভাষা যার সমান দখলে, তার মুখে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু অবাক হওয়ার তখনও ঢের বাকি ছিলো। ক্রমশ তাঁর চোখে-মুখে উত্তেজনার এমন সব চিহ্ন জেগে উঠলো যা দেখে বোঝা গেলো চিরকুটটার কোনো মানেই উনি বার করতে পারছেন না। আর, মানে বার করতে না পারার দরুন, কাকামণি সেদিনই প্রথম খাবার ব্যাপারে অবহেলা দেখালেন। মার্থা যখন এসে খেতে যাওয়ার কথা বললে, তখন কাকামণি খাবারের নিকুচি করেছে বলে তাকে তাড়া লাগালেন। গতিক সুবিধের নয় দেখে আমি অবিশ্যি খাবারের ব্যাপারে অবহেলা করলাম না। গোগ্রাসে গিলে এলাম গিয়ে। বলা নিষ্প্রয়োজন, কাকামণির প্লেটটাও আমি একাই সাবাড় করলাম।

খাওয়া-দাওয়া সেরে পড়ার ঘরে গিয়ে দেখি, কাকামণি ভুরু কুঁচকে আপন মনেই বিড়বিড় করে বকছেন : হরফগুলো যে রুনিক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনো মানে বুঝতে পারা যাচ্ছে না কেন? নিশ্চয়ই গোপন কোনো সঙ্কেতে চিরকুটটা লেখা। সেই সঙ্কেতটা কী বুঝতে পারলেই সব মানে স্পষ্ট হয়ে যাবে।

হঠাৎ চোখ তুলে আমাকে দেখতে পেলেন কাকামণি। তক্ষুনি একটা চেয়ার আমায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। বললেন, বোস। যা বলি, সব একটা কাগজে টুকে নে তো! রুনিক বর্ণলিপির যে হরফ আমাদের যে হরফের মানে বোঝায়, কাগজটা দেখে-দেখে তা আমি বলে যাচ্ছি। সাবধানে লিখিস। দেখিস যেন ভুল না হয়।

কাকামণি বলতে লাগলেন আর আমি লিখতে লাগলাম। লেখা শেষ হলে দেখি, অক্ষরগুলি এমনভাবে বসেছে, কোনো বাক্যই তৈরি হয় না, মানে বার করা তো দূরের কথা। লেখাগুলো এরকম :

  1. rnlls esrevel seeclde sgtssmf

vnteief niedrke kt. samn atrate

saodren emtuoel uvaect rrilsa

Atsaar .nverc ieaabs ccdrmi

eevtVI frAurV dt,iac Oseibo

Kediil

লেখা শেষ হলে কাকামণি কাগজটা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পড়বার চেষ্টা করলেন। নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন : কী মানে এর? মনে হচ্ছে এ কোনো সাঙ্কেতিক চিরকুট, ক্রিপটোগ্রাফ। অক্ষরগুলো যদি কোনোমতে ঠিক করে সাজানো যায়, তাহলেই কিস্তিমাত। কিন্তু…

কাকামণি বইটা আর কাগজটা মিলিয়ে দেখতে লাগলেন। অনেকক্ষণ ধরে কী যেন লক্ষ্য করলেন উনি। তারপর বললেন : হুঁ, যা ভেবেছি তাই। চিরকুট আর পুঁথি যে দুই হাতের লেখা, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। চিরকুটটা। বইটার ঢের ঢের পরের লেখা। চিরকুটটার প্রথম হরফ হলো ইংরিজি জোড়া নাম-টার্লেশমের বইয়ে এমন কোনো হরফই নেই। এই হরফটা প্রথম ব্যবহার করা হয় চোদ্দ শতকে-তার মানে চিরকুটটা ঐ পুঁথিটার অন্তত দুশো বছর পরে লেখা হয়েছে। একটু থেমে আবার বললেন কাকামণি : আমার মনে হয়, যার কাছে এই পুঁথিটা ছিলো, এই রহস্যময় চিরকুটটা তারই লেখা। কিন্তু কে সেই ব্যক্তি? কার কাছে ছিলো পুঁথিটা? পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে কাকামণি জানালেন : না, তার নাম তো পাওয়া যাচ্ছে না!

বইটার প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত তন্ন-তন্ন করে দেখলেন কাকামণি, যদি কারও নাম পাওয়া যায়। কিন্তু কারও নাম পাওয়া গেলো না। এত সহজে হাল ছেড়ে দেবার লোক ছিলেন না কাকামণি! আতস কাচ দিয়ে বইটার পাতাগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন। প্রথম পাতায় এক কোণে অস্পষ্ট একটু কালির দাগ দেখা গেলো। অনেক পরীক্ষার পর বোঝা গেলো কালির দাগটা কতকগুলো আবছা-হয়ে-যাওয়া অক্ষরের সমষ্টি। ভালো করে সেই অক্ষরগুলো দেখতে-দেখতে সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন কাকামণি : আরে, এ যে আর্‌ন্‌ সাক্ষ্যউজমের নাম! উনি তো আইসল্যাণ্ডের মস্ত বড় বৈজ্ঞানিক! রসায়নে আজও তার জুড়ি পাওয়া যায়নি। শোনা যায়, উনি অ্যালকেমির গবেষণায় সাফল্য লাভ করেছিলেন। বোধ হয়, সাক্‌ন্যুউজম কোনো নতুন জিনিশ আবিষ্কার করে সঙ্কেতের সাহায্যে চিরকুটটায় লিখে গেছেন। কিন্তু কী তিনি লিখে গেছেন? কী?

কিন্তু কাকামণি, সাক্‌ন্যুউজম যদি নতুন কিছু আবিষ্কার করেই থাকেন, তবে এমন রহস্যময় সঙ্কেত ব্যবহার করেছেন কেন?

নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল। কাকামণি জানালেন : গ্যালিলিয়ো যখন নতুন গ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন, তখন এমনিভাবেই সঙ্কেতলিপিতে সমস্ত তথ্য লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই সঙ্কেতের মানে আমাকে বের করতেই হবে। যতক্ষণ না এর অর্থ বার করতে পারছি, ততক্ষণ সব কাজ বন্ধ। বুঝলি অ্যাকজেল, এখন আমাদের একমাত্র কাজ হলো এই বিদঘুটে হরফগুলোর মধ্য থেকে মানে বের করা।

ভালো ছেলের মতো ঘাড় নেড়ে সায় দিতে দিতে ভাবলাম, কাকামণি যখন পুরোদস্তুর খেপে গেছেন, তখন আর রেহাই নেই, আহার নিদ্রা সব একেবারে বাতিল।

কাকামণি কিন্তু একটানা বলেই চলেছেন : কাজটা অবশ্যি মোটেই কঠিন নয়, একেবারে জলের মতো সোজা। চিরকুটটার মধ্যে একশো বত্রিশটা অক্ষর আছে, তার মধ্যে সাতাত্তরটা হলো ব্যঞ্জনবর্ণ, আর বাকিগুলি স্বরবর্ণ। সাউজম অনেক ভাষা জানতেন মস্ত বড় পণ্ডিত ছিলেন তো। সুতরাং চিরকুটটা তিনি মাতৃভাষায় না লিখে লাতিনেই লিখেছেন বলে মনে হচ্ছে, কেমন। সেকালে লাতিই ছিলো পণ্ডিতদের ভাষা। কিন্তু গোলমেলে ব্যাপার হলো, হরফগুলো ওলট-পালট করে সাজানো হয়েছে। কী ভাবে সাজানো হয়েছে, তার ধরনটা বুঝতে না পারলেই সব মাটি। ঠিক কী করে যে সাজানো হয়েছে… ভুরু কুঁচতে গেলে কাকামণির। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, সাউজম লাইনগুলো সোজা না লিখে উপর থেকে নিচের দিকে লিখে

গেছেন। এই ধরনেও তো অনেকে সঙ্কেতলিপি লিখে থাকে।

সায় দিয়ে বললাম : তা লিখে থাকে বৈকি।

তাহলে এবার চটপট দেখা যাক সান্যউজম কী লিখেছেন। এই বলে গভীর মনোযোগর সঙ্গে চিরকুটটা পড়তে লাগলেন কাকামণি। অনেকক্ষণ ভাবনা-চিন্তার পর হরফগুলো এইভাবে সাজালেন : messvnka senrA ice fdok, seg nitt amvrtn.

না, কিছুই হলো না। উত্তেজিত স্বরে বললেন কাকামণি : এই ধরনে লিখলেও তো কোনো মানে হয় না। এই বলে চেঁচিয়ে উঠে একলাফে ঘর থেকে বেরিয়ে হুড়মুড় করে নিচে নেচে সোজা রাস্তায় গিয়ে হাজির হলেন কাকামণি, যেন বিদ্যুৎবেগে পাহাড়ের চুড়ো থেকে একটা বড়ো পাথর নিচে গড়িয়ে পড়লো। আর, তাই দেখে আমি তোত একেবারে হতভম্ব।

কাকামণিকে হঠাৎ এমনি উত্তেজিতভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে মাথাও অবাক হয়ে আমায় এসে জিগেস করলে : উনি যে বেরিয়ে গেলেন বাওয়া-দাওয়া না করে?

খাওয়া-দাওয়া বোহ আজ আর কাকামণির বরাতে নেই।

মার্থাও আশ্চর্য হলো : তার মানে? রাত্তিরেও কি খাবেন না নাকি?

খাবেন বলে তো মনে হচ্ছে না। এই বলে আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আকাশ-পাতাল কত কি ভাবতে লাগলাম।

কাকামণির স্বভাব তত ভালো করেই জানা ছিলো। ঐ হেঁয়ালির কোনো সমাধান না হওয়া অবধি অন্য কোন দিকেই দৃকপাত করবেন না আর। তার মানে, ওর সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও আহার-নিদ্রা সব সমাপ্ত।

হঠাৎ মনে হলো, চিরকুটটা একবার নেড়ে-চেড়ে দেখলে কেমন হয়? দৈবাৎ কোনো হাদশও তো মিলে যেতে পারে। কাগজটা টেবিল থেকে তুলে নিলাম। না, কোনো মানেই হয় না এর! মনে-মনে নানানভাবে সাজালাম অক্ষরগুলো। কিন্তু, বৃথাও হেঁয়ালির সমাধান করা মানুষের সাধ্য নয়। কাকামণি যেভাবে অক্ষরগুলো সাজিয়েছিলেন, তার এক জায়গায় পাওয়া গেল ইংরেজি icc, আরেক জায়গায় পাওয়া গেলো ইংরেজি Sir। এ ছাড়া কতকগুলো লাতিন শব্দও দেখা গেলো-rota, mutalsile, ira, nec, atra, luco। একটা হিব্রু শব্দও পাওয়া গেলো–talsiled। আরে,-তিন-চারটে ফরাসি কথাও তত রয়েছে দেখছি,–mer, are, mire!

মাথাটা আরো ঘুলিয়ে গেলো। ইংরেজি, লাতিন, হিব্রু, ফরাশি—চারচারটে ভাষা! বাব্বা! এর মানে বের করা আমার কর্ম না। বরফ, মশায়, রাগ, নিষ্ঠুর, পবিত্র, অরণ্য, পরিবর্তনশীল, মা, ধনুক, সমুদ্র—এসব শব্দের মানে হয় কোনো? বরফ আর সমুদ্র কথাটি অবশ্য আইসল্যান্ডের কোনো লোকের লেখায় বেশ মানানসই। কিন্তু বাকি কথাগুলোর মানে কী?

ভাবতে ভাবতে craterem, terrestre-এমনি আরো কয়েকটা লাতিন কথা চোখে পড়লো।… আরে, এখন তো বেশ মানে বোঝা যাচ্ছে। শেষ লাইনের শেষ হরফে শুরু করে ডান থেকে বাঁয়ে পড়তেই সব মানে স্পষ্ট বোঝা গেলো। আর, যেই বুঝতে পারলাম, অমনি উত্তেজনায় ভরে গেলো মন। কী সর্বনাশ! এ কী লেখা চিরকুটে! একথা জানলে কাকামণিকে আর কোনোমতেই ঘরে আটকে রাখা যাবে না। তক্ষুনি ছুটে বেরুবেন উনি! অসম্ভব। কিছুতেই একথা ওঁকে জানালে চলবে না।

তক্ষুনি মনে হলো, এই চিরকুটটা আমার নষ্ট করে ফেলা উচিত, নইলে একবার যদি কাকামণি বুঝতে পারেন কী লেখা আছে এতে, তাহলে আর রেহাই নেই।

চিরকুটটা তুলে নিয়ে চুল্লিতে ফেলতে যাচ্ছি, এমন সময়ে কাকামণি ঝড়ের মতো ঘরে এসে ঢুকলেন। তাকে দেখেই সাত-তাড়াতাড়ি কাগজটা টেবিলের উপর রেখে দিলাম। কাকামণির চেহারা দেখে বোঝা গেলো, বাইরে গিয়েও তিনি মুহূর্তের জন্য স্বস্তি পাননি–চিরকুটটা তাকে ভূতের মতো তাড়া করে ফিরেছে।

চেয়ারে বসে কাকামণি কাগজ-কলম নিয়ে কি সব লিখতে লাগলেন। একবার লেখেন, তার পরেই তা ঘ্যাচ করে কেটে ফেলেন। ওঁর রকম-সকম দেখে আমার বুক দুরুদুরু করতে লাগলো। এই বুঝি পাঠোদ্ধার করে ফেলেন লেখাটার।

কিন্তু না, সে আশা করাটা রীতিমতো বাতুলতা। চিরকুটের একশো বত্রিশটা অক্ষর অসংখ্যভাবে সাজানো যায়। কতভাবে আর সাজাবেন কাকামণি! আসল সঙ্কেতটা না বার করতে পারলে চিরকাল এই গোলোকধাঁধায় পথ হাতড়ে বেড়াতে হবে। কিন্তু তবু আমার ভয় করতে লাগলো। যদি চিরকুটটার অর্থ করতে পারেন উনি।

অনেকক্ষণ কেটে গেলো। সন্ধে হলো, রাত হলো, রাত গভীর হলো, পথঘাটের সোরগোল থেমে গেলো, কিন্তু তবু হুঁশ ফিরলো না কাকামণির। একমনে উনি অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে চলেছেন।

মার্থা একবার দরজা দিয়ে উকি দিয়ে বলেছিল, খাবার তৈরি। কিন্তু কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে সে আস্তে-আস্তে চলে গেল। আমি নিরুপায়ভাবে বসে রইলাম। তারপর কখন যে চেয়ারের উপরেই ঘুমিয়ে পড়লাম, তা জানি না।

ভোরবেলা যখন চোখে-মুখে এসে বোদ পড়লো, তখন ঘুম ভাঙলো আমার। বড়মড় করে উঠে বসলাম আমি। তাকিয়ে দেখি, তখন কাকামণি ঘাড় গুঁজে হরফের পর হরফ সাজিয়ে চলেছেন। চোখদুটো রাঙা টকটকে, মুখ শুকিয়ে গেছে, আলুথালু চুল এসে পড়েছে চোখে-মুখে, সারা শরীরে রাত-জাগার ক্লান্তি। রাতটা যে ওর এইভাবে কাটবে, তা আমি জানতাম। কিন্তু কী করতে পারি আমি? যদি ওকে সব খুলে বলি, তাহলে উনি তো সঙ্গে সঙ্গে রওনা হবেন মৃত্যুর পথে। অথচ এমন ভীষণ মানসিক শ্রমেও একটা কিছু বিপদ-আপদ ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। কী করবো ঠিক করতে না পেরে চুপচাপ বসে রইলাম।

শেষ পর্যন্ত কাকামণির রকম-সকম দেখে সব কিছু খুলে বলা উচিত বলেই ঠিক করলাম। আস্তে-আস্তে জিগেস করলাম, সাক্ষ্যউজমের চিরকুটটার কোনো। মানে বের করতে পেরেছে কাকামণি?

সচমকে আমার দিকে ফিরে তাকালেন উনি, আকুল হয়ে আমার হাত ধরলেন। দেখতে পেলাম ওঁর হাতদুটি থরথর করে কাঁপছে। এবার আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম, আমি কিন্তু এর মানে খুঁজে পেয়েছি। কাকামণি।

কাকামণি চেঁচিয়ে উঠলেন একবারে : পেরেছিস? মানে করতে পেরেছিল। তুই!

সঙ্কেতটা জানিয়ে দিলাম : যদি শেষ হরফ থেকে পড়তে থাকে, তাহলে তুমিও এর মানে বুঝতে পারবে কাকামণি।

আমার কথা শেষ হবার আগেই উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন কাকামণি। মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল ওঁর চেহারা। চিরকুটটা হাতে তুলে নিয়ে এক নিশ্বাসে উনি পড়ে গেলেন :

In Sneffels joculis craterem quem delibat.
Umbra Scartaris julii intra calendas descende,
Audax viator, et terrestre centrum attinges
Quod feci, Arne Sakunussemm.

কথাগুলো লাতিন। তার মানে এই দাঁড়ায় :

হে নির্ভীক ভ্রামণিক। জুলাই মাসের গোড়ার দিকে যখন স্কাটারিস পর্বতচুড়োর ছায়া পড়বে স্নেফেল অগ্নিগিরির মুখের উপর, তখন সে-পথে অবতরণ করলে তুমি পৌঁছতে পারবে পৃথিবীর অন্তঃপুরে। আমি সে-পথে গিয়েছিলাম।–আর্‌ন্ সাক্‌ন্যুউজম।

ছোটো ছেলের মতো উল্লাসে কাকামণি রীতিমত নৃত্যকলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারপর হঠাৎ কী যেন মনে পড়তেই ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে নিস্তেজ গলায় শুধোলেন, কটা বাজলো?

দুটো।

তাই তো বলি, খিদেয় নাড়ি-ভুড়ি হজম হয়ে যেতে চাইছে কেন? ঈশ। কতো বেলা হয়ে গেছে দেখেছিস! চল, চল শিগগির খেতে চল। তারপর অনেক কাজ। মাল-পত্তর গুছোতে হবে তো।

সে কী? তার মানে?

শুধু আমার বাক্সই না, সেইসঙ্গে তোর বাক্সও গুছিয়ে নিতে হবে। এই বলে খাবার-ঘরের দিকে পা বাড়ালেন কাকামণি।