০০-০৫. সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা

০০.

শুরুর আগে শেষ পর্যন্ত ঘটলো সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা। আমি আরেকটা চিঠি পেলাম লুডউইগ হোরেস হলির কাছ থেকে। শেষ চিঠিটা পেয়েছিলাম অনেক অনেক বছর আগে শী-এর পাণ্ডুলিপির সঙ্গে। তাতে মিস্টার হলি লিখেছিলেন, অপরূপা আয়শার খোঁজে লিও ভিনসি আর তিনি আবার রওনা হচ্ছেন। এবার মধ্য এশিয়ার পথে।

গেল বছরগুলোতে প্রায়ই আমার ওদের কথা মনে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কি ঘটলো জানার কৌতূহল হয়েছে। পাগলপ্রায় মানুষ দুটো বেঁচে আছে না মরে গেছে? নাকি তিব্বতের বৌদ্ধ মঠের পুরোহিতদের সান্নিধ্যে এসে ভিক্ষু হয়ে গেছে? জবাব পাইনি প্রশ্নগুলোর।

অবশেষে আজ, কোনোরকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে হাজির হয়েছে চিঠিটা। হোরেস হলির লেখা শেষবার দেখার পর বহুদিন পার হয়ে গেছে। তবু তার স্বাক্ষর আজ দেখা মাত্র চিনতে পেরেছি। তক্ষুণি পড়লাম চিঠিটা। তাতে লেখা:

প্রীতিভাজনেষু,

আমার ধারণা আপনি এখনও বেঁচে আছেন, আশ্চর্যের কথা আমিও বেঁচে আছি—যদিও আর কদিন থাকবো তা ভবিতব্যই বলতে পারে।

সভ্য জগতে ফিরে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আপনার (নাকি আমার?) শী বই-এর একটা হিন্দুস্তানী অনুবাদ আমার হাতে আসে। বইটা আমি পড়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, আপনার দায়িত্ব আপনি নিষ্ঠার সঙ্গে সমাপন করেছেন। প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছে। সুতরাং আপনাকেই আমি এ-ইতিহাসের

শেষাংশ সম্পাদনার ভার দিয়ে যেতে চাই।

আমি খুবই অসুস্থ। অনেক কষ্টে, বোধহয় মরার জন্যে, ফিরে এসেছি আমার পুরনো বাড়িতে। আমার মৃত্যু সন্নিকটে। ডাক্তারকে আমি অনুরোধ জানিয়েছি, আমার মৃত্যুর পর যেন সব কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয় আপনার কাছে। অবশ্য এখনও নিশ্চিত নয় ব্যাপারটা। একেকবার মনে হচ্ছে, এবারের পাণ্ডুলিপিটা। পুড়িয়ে ফেলাই বোধহয় ভালো। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কি ঠিক করি। যদি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেই তাহলে পাণ্ডুলিপির সঙ্গে একটা বাক্সও যাবে আপনার কাছে। কিছু খসড়া নকশা আর একটা সিট্রাম থাকবে ওতে। নকশাগুলো কখনও হয়তো কাজে লাগবে আপনার। আর সিট্রামটা হলো প্রমাণ। প্রাচীন মিসরের দেবী আইসিস-এর পূজায় ব্যবহার হতো এই সিট্রাম। আপনার কাছে জিনিসটা পাঠাচ্ছি দুটো কারণে: প্রথমত, আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে, দ্বিতীয়ত, সঙ্গের পাণ্ডুলিপিতে লেখা কথাগুলোর সত্যতা সম্পর্কে যেন নিঃসংশয় হতে পারেন সে জন্যে। আমার বক্তব্যের সপক্ষে একমাত্র প্রমাণ ওটা।

চিঠি দীর্ঘ করতে চাই না। সে শারীরিক ক্ষমতা আমার নেই, ইচ্ছাও নেই। প্রমাণগুলোই নিজেদের পক্ষে যা বলার বলবে,। ওগুলো দিয়ে আপনার যা ইচ্ছে করতে পারেন। বিশ্বাস করা না করা-ও আপনার ব্যাপার। আমি জানি ওগুলো সত্যি, সুতরাং কেউ বিশ্বাস না করলেও আমার কিছু এসে যায় না।

আয়শা কে? পুনর্জন্ম নেয়া এক সৌরভ? বাস্তবে রূপ নেয়া প্রকৃতির কোনো অদৃশ্য শক্তি? সুন্দর, নিষ্ঠুর এবং অমর কোনো আত্মগত প্রাণ? আপনিই বলুন। আমি বাস্তবের সাথে আমার কল্পনাশক্তির সম্পূর্ণটাই মিশিয়ে চেষ্টা করেছি, সমাধান করতে পারিনি।

আপনার সুখ আর সৌভাগ্য কামনা করি। বিদায়, আপনাকে এবং সবাইকে।

–এল, হোরেস হলি।

চিঠিটা নামিয়ে রাখলাম। এর বক্তব্য বিশ্লেষণ করার কোনো চেষ্টা না করে দ্বিতীয় খামটা খুললাম। কিছু অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য ছাড়া এই চিঠিটাও সম্পূর্ণ তুলে দিচ্ছি আপনাদের জন্যে।

চিঠিটা লেখা হয়েছে কাম্বারল্যাণ্ড উপকূলের এক অজ পাড়া গাঁ থেকে। তাতে লেখা:

মহাত্মন,

আমাকে আপনি চিনবেন না, আমি একজন ডাক্তার, শেষ বোগশয্যায় আমি মিস্টার হলির চিকিৎসা করেছিলাম। মৃত্যুর আগে দ্রলোক এক অদ্ভুত দায়িত্ব দিয়ে গেছেন আমাকে, তাই এ চিঠি লেখা। সত্যি কথা বলতে কি এ সম্পর্কে প্রায় কিছু না জানলেও ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলী করে তোলে আমাকে। এবং সে জন্যেই আমার নাম এবং ঠিকানা গোপন রাখা হবে এই শর্তে শেষ পর্যন্ত রাজি হই দায়িত্বটা পালন করতে।

দিন দশেক আগে মিস্টার হলির চিকিৎসার জন্যে ডাক পড়ে আমার। পাহাড়ের ওপর এক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। বহুদিন ধরে খালি পড়ে ছিলো বাড়িটা। বাড়ির তদারককারী মহিলা জানালো, দীর্ঘদিন বিদেশে কাটিয়ে সম্প্রতি ফিরেছেন বাড়িওয়ালা। তার ধারণা দ্রলোকের হৃৎপিণ্ডটা ভীষণ অসুস্থ, খুব শিগগিরই উনি মারা যাবেন। মহিলার ধারণা সত্যি হয়েছে।

ঘরে ঢুকে দেখি, বিছানায় বসে আছেন অদ্ভুতদর্শন এক বৃদ্ধ। শুনলাম ইনিই রোগী। কালো চোখ ভদ্রলোকের, কুতকুতে হলেও বুদ্ধির অদ্ভুত ঝিলিক তাতে, যেন জ্বলছে জ্বলজ্বল করে। অসম্ভব চওড়া বুকটা ঢাকা পড়ে গেছে তুষারের মতো ধবধবে সাদা দাড়িতে। চুলগুলোও সাদা, লম্বা হতে হতে কপাল এবং মুখের অনেকটা ঢেকে ফেলেছে। তার হাত দুটো অস্বাভাবিক লম্বা, তাতে শক্তিও তেমন। এই বয়েসে মানুষের দেহে এত শক্তি থাকতে পারে আমার ধারণা ছিলো না। এক হাতে দীর্ঘ একটা ক্ষত চিহ্ন। উনি জানালেন কি এক হিংস্র কুকুর নাকি কামড়েছিলো ওখানে। দ্রলোকের চেহারা কুৎসিত, কিন্তু তার মধ্যেও কোথায় যেন একটা অপূর্ব দীপ্তি লুকিয়ে আছে। কোনো সাধারণ মানুষের মুখে আমি অমন দীপ্তি দেখিনি।

আমাকে দেখে যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করলেন মিস্টার হলি। বুঝলাম, তাকে না জানিয়েই ডাকা হয়েছে আমাকে। তবে শিগগিরই ভদ্রলোকের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল আমার। চিকিৎসার শুরুতেই তাঁর শারীরিক কষ্ট অনেকখানি কমিয়ে দিতে পারলাম বলেই সম্ভব হলো সেটা। পরে বিভিন্ন সময়ে দীর্ঘ আলাপ হয়েছে তাঁর সঙ্গে। দুনিয়ার নানা দেশে তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন টুকরো টুকরোভাবে। এলোমেলো ভাবে দুটো অদ্ভুত অভিযানের কথা-ও বললেন একদিন। ভালো বুঝতে পারলাম না তার মর্ম। এই দশদিনে বার দুয়েক তাঁকে প্রলাপ বকতে শুনেছি। সে সময় যে ভাষায় তিনি কথা বলছিলেন, যতদূর বুঝতে পেরেছি তা গ্রীক এবং আরবী। ইংরেজীতেও ছিলো দু’একটা শব্দ। সম্ভবত তার আরাধ্য কোনো দেবীর কথা বলছিলেন তিনি।

একদিন কাঠের তৈরি একটা বাক্স দেখালেন ভদ্রলোক (সেটাই এই চিঠির সঙ্গে পাঠাচ্ছি আপনার কাছে), এবং আপনার নাম ঠিকানা দিয়ে বললেন, যেন তার মৃত্যুর পর ওটা পাঠিয়ে দিই আপনার কাছে। একটা পাণ্ডুলিপিও দিলেন। বললেন বাক্সের সঙ্গে ওটাও পাঠাতে হবে আপনার কাছে। পাণ্ডুলিপিটার শেষ পৃষ্ঠাগুলো পোড়া। কৌতূহলী চোখে আমি তাকিয়ে ছিলাম পোড়া পৃষ্ঠাগুলোর দিকে। দেখে তিনি বললেন (হুবহু তার কথাগুলোই তুলে দিচ্ছি এখানে)–

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর কিছু করার নেই এখন, যে ভাবে আছে ওভাবেই পাঠাতে হবে। দেখতেই পাচ্ছো, আমি ওটা নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিলাম, আগুনে রিটার্ন অভ শী ফেলেও দিয়েছিলাম, তখনই এলো নির্দেশ—হ্যাঁ, পরিষ্কার নির্ভুল নির্দেশ-ছে মেরে তুলে নিয়ে বাঁচিয়েছিলাম আগুনের হাত থেকে।

এই নির্দেশ বলতে কি বুঝিয়েছিলেন মিস্টার হলি আমি জানি না। এ সম্পর্কে আর কিছু তিনি বলেননি।

যা হোক, নাটকের শেষ দৃশ্যে চলে আসি। একদিন রাতে, প্রায় এগারোটার সময়, আমি গেছি মিস্টার হলির বাসায়। তখন ওঁর শেষ অবস্থা। বাড়িতে ঢোকার মুখে দেখা হলো তদারককারিণীর সাথে। হন্তদন্ত অবস্থা তার তখন। মিস্টার হলি মারা গেছেন কি না জানতে চাইলাম। সে জবাব দিলো, না, তবে উনি চলে গেছেন-যে অবস্থায় ছিলেন সে অবস্থায়ই খালি পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। বাড়ির ঠিক বাইরে যে ফার বন আছে সেখানে শেষ বারের মতো দেখেছে তাকে মহিলার নাতি। ছেলেটা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কারণ ওর মনে হচ্ছিলো, ভূত দেখেছেন মিস্টার হলি।

উজ্জ্বল চাঁদের আলো ছিলো সে রাতে। সদ্য পড়া তুষারে প্রতিফলিত হয়ে জ্যোৎস্না আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলো। আমি বেরিয়ে পড়লাম তাকে খোঁজার জন্যে। একটু পরেই তুষারের ওপর পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। ছাপ অনুসরণ করে গেলাম বাড়ির পেছনে, সেখান থেকে পাহাড়ের ভাল বেয়ে উঠে গেলাম চূড়ার দিকে।

পাহাড়টার চূড়ায় একটা প্রাচীন পাথরের স্তম্ভ আছে। স্থানীয় অধিবাসীরা তার নাম দিয়েছে শয়তানের আংটি। কে কখন ওটা স্থাপন করেছিলো কেউ বলতে পারে না। অনেক বারই আমি দেখছি ওটা। কিছুদিন আগে এক প্রত্নতাত্ত্বিক সমিতির সভায় ওটার উদ্ভব এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনাও শুনেছি। সেই। সভায় খেপাটে ধরনের এক ভদ্রলোক একটা প্রবন্ধ পড়েছিলেন। তাতে তিনি নানা। যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, স্তম্ভটা মিসরীয় দেবী আইসিসের। প্রতিনিধিত্ব করে, এবং ঐ জায়গাটা এককালে আইসিসের পূজারীদের তীর্থস্থান ছিলো। কিন্তু অন্য আলোচকরা অভিমতটাকে গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দেন। তারা বলেন, আইসিস ব্রিটেনে এসেছিলো এমন কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। অবশ্য আমার ধারণা, রোমান বা ফিনিসীয়রাও এনে থাকতে পারে স্তম্ভটা। কারণ, ওরাও আইসিসের পূজা করতো। তবে এ ব্যাপারে আমার জ্ঞান এত সামান্য যে এ-নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো।

আমার মনে পড়লো, আগের দিন মিস্টার হলি জিজ্ঞেস করেছিলেন পাথরটার কথা। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, এখনও ওটা অক্ষত আছে কিনা। তিনি আরও বলেছিলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে কথাটা আমার মনে দাগ কেটেছিলো, তিনি ওখানে গিয়ে মরতে চান। আমি বলেছিলাম, অতদূর হাঁটার ক্ষমতা সম্ভবত আর কখনও তিনি ফিরে পাবেন না। শুনে মৃদু হেসেছিলেন বৃদ্ধ।

যা হোক, যথাসম্ভব দ্রুত ছুটে পৌঁছুলাম শয়তানের আংটির কাছে। এবং হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম তা-ই—স্তম্ভের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, খালি পা, খালি মাথা, পরনে রাতের পোশাক। তুষারের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার হলি। কেমন একটা সম্মোহিত ভঙ্গি। মন্ত্রোচ্চারণের মতো বিড় বিড় করে কিছু বলছেন। সম্ভবত আরবীতে। ডান হাতে উঁচু করে ধরা একটা আংটা লাগানো রত্ন খচিত দণ্ড (মিস্টার হলির ইচ্ছানুযায়ী ওটাও পাঠাচ্ছি আপনার কাছে)। রত্নগুলো থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো। রাতের গভীর নিস্তব্ধতার ভেতর স্পষ্ট শুনতে পেলাম ওটার সোনার ঘণ্টার অতি মৃদু টুংটাং শব্দ।

জীবনে আমি কোনো অতিলৌকিক ব্যাপারস্যাপার বা কুসংস্কারে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু ঐ মুহূর্তে সেই আমারও মনে হলো আরও কেউ আছে ওখানে। আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্ত অনুভব করছি, অশরীরী কেউ। তারপর হঠাৎই অবয়ব নিতে শুরু করলো অদৃশ্য জিনিসটা। চমকে উঠলাম আমি। সত্যিই কিছু দেখেছিলাম, না চাঁদনী রাতে অমন এক পরিবেশে সম্মোহিত, উদ্ভ্রান্ত মিস্টার হলিকে দেখে নিছক মনে হয়েছিলো কিছু দেখেছি, জানি না। দেখলাম, প্রথমে অস্পষ্ট ছায়ার মতো কিছু একটা বেরিয়ে এলো স্তম্ভের চূড়া থেকে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে হতে জ্যোতির্ময় এক নারীর চেহারা নিলো। তার কপালে জ্বলে উঠলো উজ্জ্বল তারার মতো নীল একটা আলো

দৃশ্যটা আমাকে এমন ভাবে চমকে দিলো, আমি আর নড়তে পারলাম না। ভুলে গেলাম কেন এসেছি এই অদ্ভুত জায়গায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম

মুহূর্ত পরে বুঝতে পারলাম মিস্টার হলিও দেখতে পেয়েছেন কিছু একটা। অবয়বটার দিকে ফিরে দুর্বোধ্য স্বরে চিৎকার করলেন তিনি। একটা মাত্র উন্মত্ত আনন্দিত চিৎকার। তারপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন তুষারের ওপর। সংবিৎ ফিরলো আমার। ছুটে গেলাম তাকে ওঠানোর জন্যে। ইতিমধ্যে অদৃশ্য হয়েছে। অস্পষ্ট অবয়বটা। দুহাত ছড়িয়ে পড়ে আছেন মিস্টার হলি। মৃত। দণ্ডটা তখনও ধরে আছেন শক্ত করে।

.

এরপর ডাক্তার যা লিখেছেন তা আর উদ্ধৃত করলাম না। মিস্টার হলির মৃতদেহ . কি করে বাসায় আনা হলো তার বিস্তৃত বর্ণনা আর সেই রহস্যময় অবয়ব সম্পর্কে। তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই তাতে।

যে বাক্সটার কথা উনি লিখেছেন সেটা নিরাপদে পৌঁছেছে আমার হাতে। নকশাগুলো সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই, তবে সিসট্রাম সম্পর্কে দুচার কথা বলতে চাই। স্ফটিকের তৈরি কুক্স আনসাতা বা হাতলওয়ালা কুশের মতো দেখতে। মিসরীয়দের কাছে জীবনের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয় এই কুক্স আনসাতা। দণ্ড, কুশ এবং আংটা-এই তিনে মিলে এক জিনিস হয়ে উঠেছে ওটা। আংটার এপাশে ওপাশে ছারটে সরু সোনার তার। তিনটের সাথে আটকানো মূল্যবান রত্ন। ঝকমকে হীরা, সাগরনীল নীলকান্ত মণি আর রক্তলাল পদ্মরাগ। একদম ওপরের অর্থাৎ চতুর্থ তার থেকে ঝুলছে ছোট ছোট চারটে সোনার ঘণ্টা।

এই অদ্ভুত জিনিসটা যখন হাতে নিলাম তখন কেন জানি না একটু কেঁপে গেল আমার হাত। মিষ্টি মৃদু টুংটাং শব্দে বাজতে শুরু করলো ঘণ্টাগুলো। অপূর্ব এক সঙ্গীতে যেন পূর্ণ হয়ে উঠলো ঘর। তবু কেন যে শির শির করে উঠলো আমার শরীর বলতে পারবো না।

সব শেষে পাণ্ডুলিপির কথা—এ সম্পর্কেও আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। পাঠক নিজেই বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন, এর বক্তব্য সত্য না মিথ্যা, নাকি গৃঢ় কোনো অর্থ লুকিয়ে আছে এর ভেতর।

-সম্পাদক।

০১.

যে রাতে লিও সেই অলৌকিক দৃশ্য দেখেছিলো, তারপর বিশ বছর পেরিয়ে গেছে। ভয়ানক, হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করা দীর্ঘ বিশটা বছর। আমার মৃত্যুর আর বেশি দেরি নেই। সে জন্যে আমি দুঃখিত নই মোটেই, বরং খুশি। যে রহস্যের কিনারা এই ভুবনে থেকে করতে পারলাম না অন্য ভুবনে গিয়ে হয়তো তার সমাধান খুঁজে পাবো।

আমি, লুডউইগ হোরেস হলি, ভীষণ অসুস্থ। প্রায় মৃত অবস্থায় ওরা আমাকে নামিয়ে এনেছে ঐ পাহাড় থেকে। জানালা দিয়ে দূরে দেখতে পাচ্ছি পাহাড়টা। অন্য কেউ হলে অনেক আগেই শারীরিক, মানসিক দুভাবেই নিঃশেষ হয়ে যেতো। কিন্তু আমি কি ভাবে জানি না এখনও টিকে আছি। ভারতের উত্তর সীমান্তের এক জায়গায় বসে এ-আখ্যান লিখছি। আরও এক বা দুমাস-যতদিন

মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠছি, এখানে থাকতে হবে আমাকে। তারপর ফিরে যাবো আমার জন্মভূমিতে মৃত্যুকে বরণ করার জন্যে।

সেই অলৌকিক দৃশ্য দিয়েই শুরু করি।

১৮৮৫ সালে আমি আর লিও ভিনসি ফিরে এলাম আফ্রিকা থেকে। তখন নিঃসঙ্গতা ভীষণ ভাবে কাম্য হয়ে উঠেছিলো আমাদের কাছে। অমর আয়শার আকস্মিক মৃত্যুতে* যে ভয়ঙ্কর ধাক্কা খেয়েছিলাম তার রেশ কাটিয়ে ওঠার জন্যে এর দরকারও ছিলো।

নিঃসঙ্গতার আশায় গিয়ে উঠেছিলাম কাম্বারল্যাণ্ড উপকূলে আমার পৈতৃক বাড়িতে। দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে আমাকে মৃত ভেবে কেউ যদি বাড়িটা দখল করে না নিয়ে থাকে তাহলে ওটা এখনও আমারই সম্পত্তি। মরার জন্যে ঐ বাড়িতেই আমি ফিরে যাবো কদিন পরে।

কাম্বারল্যাণ্ডের জনহীন উপকূলের সেই বাড়িতে এক বছর কাটিয়ে দিলাম যা হারিয়েছি তার জন্যে শোক করে।.কি করে আবার তাকে পাওয়া যায় তার পথও  খুঁজেছি এই সময়ে, কিন্তু পাইনি। তবে যা পেলাম তার মূল্যও কম নয়, এখানে আমরা আমাদের হারানো শক্তি ফিরে পেয়েছি। লিওর সাদা হয়ে যাওয়া চুলগুলো আসল রং ফিরে পেয়েছে। প্রথমে ধূসর তারপর ধীরে ধীরে সোনালি হয়ে উঠেছে। আবার। হারানো সৌন্দর্যও ফিরে পেয়েছে ও।

তারপর এলো সেই রাত-আলোকোজ্জ্বল সেই মুহূর্ত।

আগস্টের এক বিষণ্ণ রাত। খাওয়া দাওয়ার পর সাগর তীরে হেঁটে বেড়াচ্ছি। আমরা-আমি আর লিও। কান পেতে শুনছি সাগরের মৃদু গর্জন। মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছি দূরে মেঘের বুকে বিদ্যুতের চমক। নিঃশব্দে হাঁটছি দুজন। হঠাৎ আমার হাত জড়িয়ে ধরলো লিও। ফোপাতে ফোঁপাতে আর্তনাদ করে উঠলো, আর পারছি না, হোরেস,-এখন আমাকে এভাবেই ডাকে ও-, এ যন্ত্রণা আমি আর সইতে পারছি না। আয়শাকে আর একটিবারের জন্যে আমি দেখতে চাই। না হলে পাগল হয়ে যাবো। আমার যা শরীর স্বাস্থ্য, আরও হয়তো পঞ্চাশ বছর বাঁচবোকিন্তু পাগল হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।

আর কি করার আছে তোমার?

শান্তি পাওয়ার সোজা রাস্তা ধরবো, শান্ত গলায় জবাব দিলো লিও। আমি মরবো। হ্যাঁ, আমি মরবো-আজ রাতেই।

ভয় পেয়ে গেলাম আমি। আত্মহত্যা করতে চাইছে লিও! ক্রুদ্ধ চোখে তাকালাম ওর দিকে।

কাপুরুষ নাকি তুমি, লিও? এটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারছে না! অন্যেরা পারছে কি করে?

অন্যেরা মানে তো তুমি, হোরেস, শুকনো হেসে জবাব দিলো ও। তোমার ওপরেও অভিশাপ আছে…যাকগে, তুমি শক্ত তাই সহ্য করতে পারছো, আমি দুর্বল তাই পারছি না। জীবন সম্পর্কে তোমার অভিজ্ঞতা বেশি সেটাও একটা কারণ হতে পারে। না, আমি পারবো না, হোরেস, কিছুতেই পিরবো না, মৃত্যু ছাড়া আর কোনো গতি নেই আমার।

এ তো পাপ, লিও। যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি চরম অপমান। কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে তোমাকে এর জন্যে। হয়তো যাকে চাও তার সাথে চিরবিচ্ছেদেই রূপ পাবে সে শাস্তি।

যে মানুষ শাস্তিঘরে নির্যাতন সইছে সে কোনো ফাঁকে একটা ছুরি যোগাড় করে যদি আত্মহত্যা করে তাহলে কি তার পাপ হবে, হোরেস? হয়তো হবে, কিন্তু সে পাপ, আমি মনে করি ক্ষমা-ও পাবে। আমি তেমনই এক মানুষ। ঐ ছুরিটা আমি ব্যবহার করবো। এ যাতনা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করবো। ও মরে গেছে। মৃত্যুর ভেতর দিয়ে আমি ওর কাছাকাছি হবো।

কেন, লিও? আয়শা হয়তো বেঁচে আছে।

না। তাই যদি হতো কোনো না কোনো ভাবে ও আমাকে জানাতে সে কথা—কোনো সংকেত বা দৈববাণী। না, হোরেস, আমি মনস্থির করে ফেলেছি, এ নিয়ে আর কিছু বোলো না আমাকে।

আরও কিছুক্ষণ আমি যুক্তি দিয়ে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লাভ হলো না। অনেক দিন ধরে যা আশঙ্কা করছিলাম তা-ই ঘটেছে। পাগল হয়ে গেছে লিও। অবশেষে শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলাম আমি।

লিও, আমাকে একা ফেলে রেখে যাবে এখানে? এতটা নির্দয় হতে পারবে তুমি? তোমাকে কোলে পিঠে করে বড় করে তুলেছি, গায়ে একটা আঁচড় লাগতে দেইনি, তার প্রতিদান দেবে এভাবে? বুড়ো বয়েসে আমাকে একা ফেলে চলে যাবে! বেশ, তোমার যদি তা-ই ইচ্ছা, যাও। কিন্তু মনে রেখো, আমার রক্ত ঝরবে তোমার মাথায়।

তোমার রক্ত! কেন, রক্ত কেন, হোরেস?

যে পথে তুমি যেতে চাইছো সেটা যথেষ্ট চওড়া। দুজন অনায়াসে যেতে পারবো ঐ পথ দিয়ে। অনেকগুলো বছর আমরা একসঙ্গে থেকেছি, একসঙ্গে অনেক কষ্ট সয়েছি, এখন ইচ্ছে করলেই কি আলাদা হতে পারবো? আমার মনে হয় না।

মুহূর্তে উল্টে গেল দাবার ছক। এবার অর্জিাকৈ নিয়ে ভয় পেতে শুরু করলো লিও।

আমি শুধু বললাম, তুমি যদি মূয়া, আমি বলছি, আমিও মরবো। তোমার মৃত্যু আমি সইতে পারবো না। সে

হাল ছেড়ে দিল লিও। বেশ, বললো ও, আমি কথা দিচ্ছি, আজ রাতে অমন কিছু ঘটবে না। চলো, জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিই আমরা।

ভয়ে ভয়ে সে রাতে বিছানায় গেলাম আমি। জানি, একবার যখন আত্মহননের ইচ্ছা জেগেছে, খুব বেশিদিন এ-থেকে নিবৃত্ত রাখা যাবে না লিওকে। ওর এই ইচ্ছা ক্রমশ দুর্দম হতে থাকবে। শেষকালে একদিন হয়তো সত্যিই নিজেকে শেষ করে ফেলবে ও।

ও আয়শা! বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকুল কণ্ঠে চেঁচালাম আমি, তোমার যদি সে ক্ষমতা থাকে, দয়া করে প্রমাণ দাও এখনও তুমি জীবিত। তোমার প্রেমিককে বাঁচাও এই পাপ থেকে। তোমার আশ্বাসবাণী না পেলে বাঁচতে পারবে না লিও। আর ওকে ছাড়া আমিও বাঁচবো না।

তারপর ক্লান্ত বিধ্বস্ত আমি ঘুমিয়ে গেলাম।

.

লিওর কণ্ঠস্বরে ঘুম ভেঙে গেল আমার।

হোরেস! ফিসফিসে উত্তেজিত গলায় ওকে বলতে শুনলাম, হোরেস, বন্ধু, বাবা, ওঠো তাড়াতাড়ি!

মুহূর্তে সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে গেলাম আমি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছে!

দাঁড়াও আলো জ্বালি আগে, আমি বললাম।

আলো লাগবে না, হোরেস, অন্ধকারই ভালো। একটু আগে একটা স্বপ্ন দেখেছি, এমন জীবন্ত স্বপ্ন আর কখনও আমি দেখিনি। এক মুহূর্ত থামলো লিও। তারপর বলে চললো, দেখলাম, আকাশের বিশাল কালো ছাদের নিচে আমি দাঁড়িয়ে আছি। চারদিকে অন্ধকার। আকাশে একটা তারাও নেই। গভীর, শূন্য এক অনুভূতি গ্রাস করেছে আমাকে। তারপর হঠাৎ অনেক উঁচুতে, অনেক দূরে ছোট্ট একটা আলো জ্বলে উঠলো। মনে হলো, আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে একটা তারার আবির্ভাব হয়েছে। ভাসমান আগুনের কণার মতো ধীরে ধীরে নেমে আসতে লাগলো আলোটা। নামতে নামতে আমার মাথার ঠিক ওপরে চলে এলো। দেখলাম লকলকে আগুনের শিখা একটা। মানুষের জিভের মতো দেখতে। আমার মাথার উচ্চতায় স্থির হলো ওটা। তারপর, হোরেস, আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, ওটার নিচে একটা অস্পষ্ট নারীমূর্তি। আলোটা তার কপালে স্থির হয়ে আছে!

বললে বিশ্বাস করবে, হোরেস, মূর্তিটা আয়শার? হ্যাঁ, আয়শার, হোরেস, ওর চোখ, ওর অপূর্ব সুন্দর মুখ, মেঘের মতো এলো চুল সব আমি স্পষ্ট দেখেছি। বিষণ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো আয়শা। সে দৃষ্টির অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ও যেন বলতে চাইছিলো, কেন সন্দেহ কর?

কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার ঠোঁট, জিভ নড়তে চাইলো না। এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম ওকে, নাড়াতে পারলাম না হাত-পা। অদৃশ্য এক দেয়াল যেন মাথা তুলেছে আমাদের মাঝখানে। হাত উঁচু করে ইশারা করলো ও, যেন পেছন পেছন যেতে বলছে আমাকে।

এরপর বাতাসে ভেসে চলে গেল আয়শা। ওহ্, আমার তখনকার অনুভূতি যদি বুঝিয়ে বলতে পারতাম, হোরেস! মনে হলো, আমার আত্মা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে এসে অনুসরণ করছে ওকে। বাতাসের বেগে পুবদিকে ধেয়ে চললাম। সাগর, পাহাড় পেরিয়ে। এখনও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, কোথা দিয়ে কোথা দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম আমরা। এক জায়গায় এসে থামলো ও। নিচে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদের রুপালি আলোয় চক চক করছে কোর-এর ধসে পড়া প্রাসাদগুলো। তার ওপাশে, খুব বেশি দূরে নয়, সেই উপসাগর, যেখান দিয়ে আমরা পৌঁছেছিলাম ওখানে।

বিস্তৃত জলাভূমির ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে ইথিওপিয়ানের মাথার ওপর থামলাম আমরা। চারপাশে তাকাতে দেখলাম ডাউ-এর সঙ্গে সাগরে তলিয়ে গিয়েছিলো যে আরবগুলো তাদের মুখ। আকুতিভরা চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। জবকেও দেখলাম ওদের ভেতর। করুণ ভঙ্গিতে একটু হেসে ও মাথা নাড়লো, ভাবখানা আমাদের সঙ্গে যেতে চায় কিন্তু জানে, পারবে না।

আবার উড়ে চললাম আমরা সাগরের ওপর দিয়ে, বালুময় মরুভূমির ওপর দিয়ে, তারপর আরও সাগর। অবশেষে নিচে দেখতে পেলাম ভারতীয় উপকূল। এবার উত্তরমুখী যাত্রা শুরু হলো আমাদের। সমভূমির ওপর দিয়ে উড়ে পাহাড়ী এলাকায় পৌঁছুলাম। অনন্ত তুষারের টুপি পরা পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে চললাম আমরা। মুহূর্তের জন্যে থামলাম এক মালভূমির কিনারে একটা দালানের ওপর। ওটা একটা মঠ। সন্ন্যাসীদের দেখলাম, বাঁধানো চাতালে বসে প্রার্থনা করছে। মঠটার চেহারা এখনও মনে আছে আমার: অর্ধচন্দ্রের মতো দেখতে। তার সামনে বসে থাকা ভঙ্গিতে বিশাল এক প্রতিমা। কেন জানি না মনে হলো তিব্বতের দূরতম সীমান্তের আকাশে পৌঁছেছি আমরা। সামনে বিস্তীর্ণ সমভূমি। কোনোদিন কোনো মানুষের পাওখানে পড়েছে কিনা জানি না। তার ওপাশে অসংখ্য পাহাড় চূড়া–শত শত। সবগুলোর মাথায় রুপালি বরফের মুকুট।

মঠটার পাশে সমভূমির ভেতর দিকে ঢুকে গেছে একটা পাহাড়, অনেকটা সাগরে ঢুকে যাওয়া পাহাড়ী অন্তরীপের মতো। ওটার তুষার ছাওয়া চূড়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। তারপর একসময় আচমকা একটা আলোক স্তম্ভ এসে পড়লো আমাদের পায়ের কাছে। এ স্তম্ভের ওপর দিয়ে পিছলে নেমে যেতে লাগলাম আমি আর আয়শা। নামার সময় দূরে তাকিয়ে দেখলাম আরেকটা বিশাল সমভূমি। অনেকগুলো গ্রাম সেখানে। বিরাট এক মাটির স্তূপের ওপর একটা নগর। অবশেষে উঁচু এক চূড়ায় পৌঁছুলাম। চূড়াটা কুক্স আনসাতা—মানে মিসরীয়দের জীবনের প্রতীক-এর মতো দেখতে। আগুনের লেলিহান শিখা বেরিয়ে আসছে ওপাশের এক জ্বালামুখ থেকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা চূড়াটার ওপর। একসময় আয়শার সেই ছায়ামূর্তি হাত তুলে ইশারা করলো নিচের দিকে। একটু হাসলো। তারপর মিলিয়ে গেল। এর পরই ঘুম ভেঙে গেল আমার।

হোরেস, আমি বলছি, সংকেত এসে গেছে। এবার যেতে হবে আমাদের।

.

অন্ধকারে মিলিয়ে গেল লিওর কণ্ঠস্বর। স্থির বসে রইলাম আমি। নড়াচড়ার শক্তিও যেন লোপ পেয়েছে। লিও এগিয়ে এসে আমার হাত ধরলো।

।ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? হাতটায় ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো ও। কথা বলছো না কেন?

না, জবাব দিলাম, এর চেয়ে সজাগ কখনও ছিলাম না। একটু ভাবতে দাও আমাকে।

বিছানা ছেড়ে উঠলাম আমি। ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম খোলা জানালার সামনে। পর্দা সরিয়ে চোখ মেলে দিলাম নিঃসীম আকাশের দিকে। লিও এসে দাঁড়ালো আমার পাশে গায়ে গা ঠেকিয়ে। অনুভব করলাম প্রবল শীতে যেমন ঠক ঠকিয়ে কাপে তেমন কাপছে ওর শরীর।

বলছো সংকেত, মৃদুকণ্ঠে আমি বললাম, কিন্তু আমি তো ভয়ানক এক স্বপ্ন। ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না একে।

স্বপ্ন না, হোরেস, ফেটে পড়লো লিও, এ হলো অলৌকিক দর্শন।

বেশ মানলাম। কিন্তু অলৌকিক দর্শনেরও তো সত্যি মিথ্যে আছে। এটা যে সত্যি তা কি করে জানছি আমরা? শোনন, লিও, আমি যতটুকু বুঝতে পারছি, আয়শাকে হারিয়ে যে নিঃসঙ্গতার বোধে তুমি আক্রান্ত হয়েছে তা থেকেই উঠে এসেছে ঐ স্বপ্ন। কিন্তু দুনিয়ার সব প্রাণীই কি অমন নিঃসঙ্গ নয়? তুমি দেখেছো। আয়শার ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে তোমার কাছে, তোমার পাশ থেকে কখনও সরেছে ওটা? তুমি দেখেছো, সাগর, পাহাড়, সমভূমি তারপর সেই স্মৃতিময় অভিশপ্ত জায়গার ওপর দিয়ে ও নিয়ে যাচ্ছে তোমাকে। কোথায়? রহস্যময়, অজানা, অনাবিষ্কৃত এক চূড়ায়। তার মানে কি? মৃত্যুর ওপারে জীবনের যে চূড়া সেদিকেই ও পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে তোমাকে তোমার স্বপ্ন।

ওহ! থামো তো! চিৎকার করলো নিও। আমি যা দেখেছি তা দেখেছি এবং সে অনুযায়ী-ই আমি কাজ করবো। তুমি করবে তা তোমার ভাবনা। কালই আমি ভারতের পথে যাত্রা করবো। তুমি গেলে যাবে, না গেলে আমার কিছু বলার নেই। আমি একাই যাবো।

অত উত্তেজিত হয়ো না লিও। তুমি ভুলে যাচ্ছো আমার কাছে কোনো সংকেত এখনও আসেনি। তুমি যে স্বপ্ন দেখেছে তা যদি আমি-ও দেখতাম আমার কোনো সংশয় থাকতো না। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে যে ছেলে আত্মহত্যা করতে চাইছিলো সে-ই যদি কয়েক ঘণ্টা পরে মধ্য এশিয়ার বরফের রাজত্বে মরতে যেতে চায় তার সঙ্গে কে যেতে রাজি হবে? তোমার কি মনে হয় আয়শা মহিলা দালাইলামা বা ঐ ধরনের কিছু একটা হয়ে পুনর্জন্ম নিয়েছে মধ্য এশিয়ায়?

এ নিয়ে কিছু ভাবিনি আমি। কিন্তু যদি আসেই আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? কোর-এর সেই গুহার কথা এর ভেতরেই ভুলে গেলে? জীবিত আর মৃত ক্যালিক্রেটিস মুখোমুখি হয়নি? আয়শা যে শপথ করেছিলো ও আবার আসবে হ্যাঁ এই পৃথিবীতে, তা-ও ভুলে গেছো? পুনর্জন্ম ছাড়া আর কিভাবে তা সম্ভব?

এ প্রশ্নের কোনো জবাব আমি দিতে পারলাম না। নিজের মনের সঙ্গে লড়াই চলছে আমার।

আমার কাছে কোনো সংকেত এখনও আসেনি, বিড় বিড় করে বললাম আমি। এ নাটকে আমারও একটা ভূমিকা আছে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় যদিও, তবু ভূমিকা তো।

হ্যাঁ, বললো লিও, তোমার কাছে কোনো সংকেত এখনও আসেনি। এলেই ভালো হতো, হোরেস, আমার মতো তুমিও নিঃসংশয় হতে পারতে…

চুপ করে গেল লিও। আমিও আর কিছু বললাম না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম দুজন আকাশের দিকে তাকিয়ে।

ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ একটা ভোর এগিয়ে আসছে। কালো মেঘ স্তূপের পর স্তূপ হয়ে জমছে সাগরের ওপর। একটা স্থূপের চেহারা ঠিক পাহাড়ের মতো। অলস ভঙ্গিতে দেখছি আমরা। প্রতি মুহূর্তে আকার বদলাচ্ছে সেটা। চূড়াটা ধীরে ধীরে জ্বালামুখের চেহারা নিলো। এবং একটু পরে তা থেকে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এলো মেঘের একটা স্তম্ভ। তার মাথায় একটা গোল পিণ্ড মতো। হঠাৎ উঠে আসা সূর্যের রশ্মি পড়লো এই মেঘের পাহাড় আর তার চূড়া থেকে উঠে আসা স্তম্ভে। সঙ্গে সঙ্গে তুষারের মতো সাদা হয়ে গেল ওগুলো। আবার আকার বদলাতে লাগলো। ধীরে ধীরে শীর্ণ হয়ে আসছে স্তম্ভটা। যেন গলে স্কুলে পড়ছে বরফের স্তূপ। থামের ওপরে পিণ্ডটাও ছোট হচ্ছে একটু একটু করে। এক সময় মিলিয়ে গেল দুটোই। পাহাড়ের চেহারার মেঘটা কেবল রইলো কালির মতো কালো।

দেখ, হোরেস, নিচু অথচ উত্তেজিত গলায় লিও বললো, ঠিক এই চেহারার একটা পাহাড়ই আমি দেখেছিলাম। এ যে চূড়ার ওপাশটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি আর আয়শা। আর ঐ পেছনে রেখেছিলাম আগুনের শিখা। হোরেস, সংকেতটা মনে হচ্ছে আমাদের দুজনের জন্যেই!

কিছু বললাম না আমি। তাকিয়ে রইলাম যতক্ষণ না পাহাড়ের মতো মেঘটা এলোমেলো হয়ে মিশে গেল অন্য মেঘের সঙ্গে। তারপর লিওর দিকে ফিরলাম। তোমার সঙ্গে যাচ্ছি আমি, লিও।

.

০২.

যোলো বছর কেটে গেছে সেই বিনিদ্র রজনীর পর। আমরা দুজন, আমি আর লিও, এখনও ঘুরছি, এখনও খুঁজছি মিসরীয়দের জীবনের প্রতীক-আকৃতির সেই পাহাড় চূড়া।

এই দীর্ঘ সময়ে অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটেছে আমাদের জীবনে। লিখতে গেলে মোটা মোটা কয়েকটা বই হয়ে যাবে। পাঁচ বছর তিব্বতের এখানে ওখানে ঘুরেছি, এর বেশির ভাগ সময় কেটেছে বিভিন্ন মঠে। অতিথি হয়ে থেকেছি। লামাদের আচার আচরণ, ঐতিহ্য সম্পর্কে যথাসম্ভব জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করেছি। একবার গ্রেফতার হই আমরা নিষিদ্ধ এক প্রাচীন নগরীতে ঢুকে পড়ার অপরাধে। বিচারে প্রাণ-দণ্ড দেয়া হয় আমাদের। ভাগ্যক্রমে এক চৈনিক রাজপুরুষের সহায়তায় পালাতে পারি আমরা।

তিব্বত ছাড়ার পর পুব, পশ্চিম আর উত্তরে হাজার হাজার মাইল পথ হেঁটেছি। চীন দেশের অসংখ্য উপজাতীয় গোত্রের সান্নিধ্যে এসেছি। অনেক নতুন ভাষা শিখেছি—শিখেছি না বলে বলা উচিত শিখতে হয়েছে। এভাবে আরও দুবছর চলে গেল, কিন্তু আমাদের ভ্রমণ শেষ হলো না। কারণ যা খুঁজছি তা এখনও পাইনি।

ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছুলাম যেখানে এর আগে কোনো ইউরোপীয়ের পা পড়েনি। তুর্কিস্তান নামের সেই বিশাল দেশের এক অংশে বিরাট এক হ্রদ আছে। নাম বলকাশ। এই হ্রদের উপকূল ধরে দীর্ঘ পথ হাঁটলাম আমরা। পশ্চিম দিকে প্রায় দুশো মাইল যাওয়ার পর এক উঁচু গিরিশ্রেণীর কাছে পৌঁছুলাম। মানচিত্রে যার পরিচয় দেয়া হয়েছে আরকার্তি-তাউ বলে। এক বছর কাটলো এখানে। অনুসন্ধান চললো। কিন্তু লাভ হলো না। আবার পুব মুখে যাত্রা। প্রায় পাঁচশো মাইল যাওয়ার পর চেরগা নামের আরেক গিরিশ্রেণীর কাছে এলাম।

এখান থেকে শুরু হলো আমাদের আসল অভিযান। চেরগা পর্বতমালার এক শাখায়—মানচিত্রে এর কোনো নাম খুঁজে পাইনি-না খেয়ে মরতে বসেছি। শীত আসছে, সব পাহাড়ী জন্তুজানোয়ার নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে পড়েছে, সেজন্যে বেশ কয়েকদিন ধরে কোনো শিকার পাইনি। কয়েকশো মাইল দক্ষিণে দেখা হয়েছিলো শেষ মানুষটার সঙ্গে। তার কাছে জেনেছিলাম এই পাহাড় শ্রেণীর কোথাও একটা মঠ আছে। অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ এক লামা-চক্র সেখানে বাস করে। লোকটা বলেছিলো, আজকের পৃথিবীর কোনো দেশের দাবি নেই সেই ভূ-খণ্ডের ওপর। সম্ভবত, ঐ জায়গার অস্তিত্বের কথাই জানে না কোনো দেশ। কোনো উপজাতীয় গোত্র-ও নেই আশেপাশে। ঐ লামারাই ওখানকার একমাত্র বাসিন্দা। কথাটা বিশ্বাস হয়নি। তবু কেন জানি না মঠটা খুঁজছি আমরা। হয়তো যে কারণে ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চায় সে কারণে।

সঙ্গে কোনো খাবার নেই; আরগাল-মানে আগুন জ্বালানোর কোনো উপকরণ নেই। চাঁদের আলোয় সারারাত ধরে হেঁটে চলেছি। একটা মাত্র ইয়াক আমাদের সঙ্গী। পথ প্রদর্শক হিসেবে যাদের সঙ্গে এনেছিলাম তাদের শেষ জন মারা গেছে এক বছর আগে।

অসম্ভব কষ্ট সহিষ্ণু ইয়াকটা। আমাদের মতো ওটারও এখন শেষ দশা। খুব যে বেশি বোঝা বইতে হচ্ছে তা নয়। কিছু রাইফেলের গুলি—এই শ দেড়েক হবে; আর তুচ্ছ কিছু জিনিসপত্র, যেমন: ছোট একটা থলেতে কিছু স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রা, সামান্য চা, আর কয়েকটা চামড়ার কম্বল ও ভেড়ার চামড়ার পোশাক-ব্যস এই আমাদের মালপত্র।

গিরিশ্রেণীকে ডান পাশে রেখে তুষারের একটা মালভূমি পেরোনোর পরপরই লম্বা একটা শ্বাস টেনে দাঁড়িয়ে পড়লো ইয়াকটা। আমাদের-ও থামতে হলো। উপায় নেই এছাড়া। চামড়ার কম্বল গায়ে জড়িয়ে তুষারের ওপর বসে রইলাম ভোরের অপেক্ষায়। একটু পরে ইয়াকটাও বসলো আমাদের পাশে।

শেষ পর্যন্ত বোধহয় ওকে মারতেই হবে, লিও, হতভাগ্য ইয়াকটার পিঠে একটা চাপড় মেরে আমি বললাম, এবং ওর মাংস কাঁচা খেতে হবে।

কাল সকালেই হয়তো শিকার পেয়ে যাবো। আশাবাদী সুর লিওর কণ্ঠে।

না-ও পেতে পারি। সেক্ষেত্রে ওকে না মারলে আমাদেরই মরতে হবে।

মরবো। আমাদের পক্ষে যদূর সম্ভব আমরাকেরেছি।

নিশ্চয়ই, লিও, যথাসাধ্য করেছি। ষোলো বছর পাহাড়ে পাহাড়ে তুষার মাড়িয়ে চলাকে যদি এক রাতের স্বপ্ন হিসেবে কল্পনা করে নেয়া যায় তাহলে ঠিকই বলেছো।

খোঁচাটা লাগলো লিওর মনে।

তুমি জানো আমি কি বিশ্বাস করি, গম্ভীর গলায় বললো ও।

তারপর দুজনেই চুপ। সত্যি কথা বলতে কি আমিও লিওর মতোই বিশ্বাস করি, খামোকা এই প্রচণ্ড পরিশ্রম করিনি; আমাদের এত কষ্ট বিফলে যাবে না।

রাত শেষ হলো। ভোরের আলোয় উদ্বিগ্নচোখে একে অপরের দিকে তাকালাম। সভ্য কেউ দেখলে নির্ঘাত বুনো জন্তু ভাবতো আমাদের। লিওর বয়স এখন চল্লিশের ওপরে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সহজাত এক গাম্ভীর্য এসেছে; ফলে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ওর চেহারা। গত বছরগুলোর কঠোর পরিশ্রমে ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে উঠেছে পেশী। চুল দীর্ঘ হয়ে নেমে এসেছে ঘাড় ছাড়িয়ে। সিংহের সোনালি কেশরের মতো লাগে দেখতে। দাড়িও লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর। মুখের যেটুকু এখনও দেখা যায় সেটুকু দেখেই বিমোহিত হতে হয়।

আর আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি-কুৎসিত, কদাকার। বয়স ষাটের ওপর হয়ে গেছে, কিন্তু শক্তি সামর্থ্য এক বিন্দু কমেনি, বরং মাঝে মাঝে মনে হয় একটু যেন বেড়েছে। শরীর আগের মতো এখনও পেটা লোহার মতো। আশ্চর্য হওয়ার মতো ব্যাপার হলো, গত ষোলো বছরে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছি বেশ কয়েকবার কিন্তু অসুস্থ হইনি একবারওনা আমি, না লিও। কঠোর পরিশ্রম আমাদের শরীরকে সত্যি সত্যিই যেন লোহায় রূপান্তরিত করেছে। নাকি আমরা অন্তত প্রাণের সৌরভ বুক ভরে টেনে নিয়েছিলাম তাই এমন হয়েছে?

রাত শেষ হতেই রাতের ভয়গুলো কেটে গেছে। অনাহারে মরার দুশ্চিন্তাও আর নেই। কাল দুপুরের পর কিছু খাইনি, প্রায় সারারাত হেঁটেছি, তবু খুব একটা ক্ষুধা বা ক্লান্তি বোধ করছি না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম আমরা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম চারপাশে। সামনে এক ফালি উর্বর জমি, তার ওপাশ থেকেই শুরু হয়েছে বিস্তৃত মরুভূমি। গাছহীন, জলহীন, বালুময়। শীতের প্রথম তুষার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে এখানে সেখানে। তার ওপাশে প্রায় আশি কি একশো মাইল দূরে মাথা তুলেছে একসারি পাহাড়। অসংখ্য বরফ ছাওয়া সাদা চূড়া অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি এখান থেকে।

সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন সেগুলোর ওপর পড়লো, আমার মনে হলো, বিশেষ কিছু একটা যেন ধরা পড়েছে লিওর দৃষ্টিতে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সে পেছন দিকে।

দেখ, হোরেস, ঐ যে ওখানে, বিবর্ণ বিরাট কিছু একটার দিকে ইশারা করলো লিও। যে জিনিসটা দেখাতে চাচ্ছি ইতিমধ্যে সেটার ওপরেও আলো পড়েছে। আমাদের যে পাশে মরুভূমি তার উল্টোপাশে প্রকাণ্ড এক পাহাড়। এখান থেকে অন্তত দশ মাইল দূরে ওটার চূড়া। পাহাড়টা ঢালু হতে হতে যেখানে এসে মরুভূমির সঙ্গে মিশেছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।

এখন পাহাড়টার চূড়া কেবল আলোকিত। কিন্তু সূর্য যত ওপরে উঠতে লাগলো ততই বন্যার তোড়ের মতো আলো নেমে আসতে লাগলো পাহাড়ের গা বেয়ে। অবশেষে আমাদের শ তিনেক ফুট ওপরে ছোট এক অধিত্যকায় পৌঁছুলো। সূর্য-রশ্মি। সেখানে, অধিত্যকার কিনারে বসে আছে বিরাট এক মূর্তি। আমাদের—মানে মরুভূমির দিকে প্রসারিত তার দৃষ্টি। বিপুলায়তন বুদ্ধ। মূর্তির পেছনে হলুদ পাথরে তৈরি অর্ধচন্দ্রাকৃতির মঠ।

শেষ পর্যন্ত! চিৎকার করে উঠলো লিও, ওহ, ঈশ্বর! পেয়েছি শেষ পর্যন্ত! দুহাতে মুখ ঢাকলো ও। ফোপাতে ফোঁপাতে হাঁটু গেড়ে বসে ধীরে ধীরে উপুড় হয়ে মুখ গুঁজে দিলো তুষারে।

কিছুক্ষণ ওভাবে ওকে পড়ে থাকতে দিলাম। নিজের হৃদয় দিয়ে আমি বুঝতে পারছি কি ঝড় চলছে ওর হৃদয়ে। ইয়াকটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। হতভাগ্য জন্তুটা আমাদের আনন্দের কণামাত্র ভাগও নিতে পারছে না। ক্ষুধার্ত চোখে চারদিকে তাকাচ্ছে কেবল। চামড়ার কম্বল আর পোশাকগুলো ভাজ করে তুলে দিলাম তার পিঠে। তারপর ফিরে এলাম লিওর কাছে। একটা হাত রাখলাম ওর কাধে।

ওঠো, লিও, মঠটা যদি জনশূন্য না হয় ওখানে আমরা খাবার এবং আশ্রয় পাবো। চলো, শিগগিরই ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে।

নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো ও। দাড়ি এবং কাপড় থেকে তুষার ঝেড়ে ফেলে আমার সঙ্গে হাত লাগালো ঠেলে ইয়াকটাকে দাঁড় করাবার জন্যে। আশ্চর্য এক প্রশান্তিময় আনন্দ-দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে ওর মুখ থেকে।

তুষার ছাওয়া ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম আমরা।

মালভূমির কিনারে পৌঁছে গেলাম এক সময়। সামনে দেখতে পাচ্ছি হলদে পাথরে গড়া মঠটা। কিন্তু ওতে মানুষজন আছে বলে তো মনে হচ্ছে না! তুষারের ওপর একটা পায়ের ছাপও নজরে পড়ছে না। জায়গাটা পোড়ো নাকি? কথাটা মনে হতেই দমে গেল বুক। চারপাশ ভালো করে দেখে মঠের ওপর দিকে দৃষ্টি ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো হৃদয়। সরু একটা ধোঁয়ার রেখা, বেরুচ্ছে চিমনি দিয়ে।

মঠের কেন্দ্রস্থলে বড়ো একটা দালান। নিঃসন্দেহে মন্দির ওটা। কিন্তু ওদিকে গেলাম না আমরা। সামনে খুব কাছেই দেখতে পাচ্ছি একটা দরজা। এর প্রায় ওপরেই ধোঁয়া উঠতে দেখেছি। এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিলাম দরজায়। সেই সঙ্গে চিৎকার।

দরজা খুলুন! দরজা খুলুন! আমরা পথিক, আপনাদের দয়া ভিক্ষা করছি।

প্রথমে কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তারপর হাল্কা একটা পদশব্দ! থেমে গেল। কাঁচ-কুচ আওয়াজ তুলে খুললো দরজা। জীর্ণ হলুদ কাপড়ে মোড়া থুথুরে এক বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

কে! কে? জিজ্ঞেস করলো বৃদ্ধ, শিং-এর চশমার ভেতর দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। কে তোমরা আমাদের শান্তি ভঙ্গ করতে এসেছো!?

পথিক, বৃদ্ধের ভাষাতে-ই জবাব দিলাম আমি। নিরীহ, শান্তিপ্রিয় পথিক, অনাহারে মৃত প্রায়, আপনাদের দয়া চাই।

শিং-এর চশমার ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণ্ণ চোখে তাকালো বৃদ্ধ আমাদের মুখের দিকে। তারপর পোশাকের দিকে। তার মতো আমাদের পরনেও জীর্ণ লামাদের পোশাক।

তোমরা লামা? সন্দেহের সুর বৃদ্ধের গলায়। কোন মঠের?

লামা অবশ্যই, জবাব দিলাম আমি। মঠের নাম পৃথিবী, যেখানে হায়, সবারই খিদে পায়।

জবাব শুনে মনে হলো বেশ খুশি হয়েছে বৃদ্ধ। মুখ টিপে একটু হেসে মাথা নাড়লো।

অপরিচিত লোকদের মঠে ঢুকতে দেয়া আমাদের নিয়ম বিরুদ্ধ। আমাদের ধর্মাবলম্বী হলেও না হয় একটা কথা ছিলো। তা যে তোমরা নও তা তোমাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি।

ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে বিমুখ করা-ও আপনাদের নিয়ম বিরুদ্ধ? বলে এ প্রসঙ্গে বুদ্ধের বহুল প্রচলিত একটি বাণী আওড়ালাম।

চমকৃত হলো বৃদ্ধ লামা। বুঝতে পারছি পেটে বিদ্যা আছে তোমাদের। এমন মানুষদের আশ্রয় দিতে রাজি হবে না আমরা। ভেতরে এসো, বিশ্ব মঠের ভাইরা। দাঁড়াও, দাঁড়াও, তোমাদের সঙ্গে ওটা কি?, ইয়াক! ও-ও মনে হয় আমাদের দয়া চায়, বলতে বলতে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার পাশে ঝোলানো একটা ঘণ্টা বাজালো সে।

কয়েক সেকেণ্ডের ভেতর আরেকজন লোক এসে দাঁড়ালো। প্রথম জনের চেয়েও বেশি এর বয়েস, অন্তত চেহারা তাই বলছে। মুখের চামড়ায় শত শত ভাঁজ। আমাদের দেখে হাঁ হয়ে গেল তার মুখ।

ভাই, প্রথম বৃদ্ধ বললো, অতবড় হাঁ করে থেকো না, অশুভ আত্মারা তোমার পেটে ঢুকে পড়বে ওখান দিয়ে। এই ইয়াকটাকে নিয়ে যাও। অন্য জন্ত গুলোর সাথে বেঁধে রাখো, আর খাবার দিও।

ইয়াকের পিঠ থেকে আমাদের মালপত্র খুলে নিলাম। দ্বিতীয় বৃদ্ধ, যার পদবী পশু-পতি, ওকে নিয়ে চলে গেল।

বৃদ্ধ সন্ন্যাসী, যার নাম কোউ-এন, পথ দেখিয়ে একটা ঘরে নিয়ে গেল আমাদের। একই সাথে বসা এবং রান্নার কাজে ব্যবহার হয় ঘরটা। মঠের অন্য সন্ন্যাসীদের দেখলাম এখানে। সব মিলে বারোজন। আগুনের সামনে গোল হয়ে বসে আছে। একজন সকালের খাবার রান্না করছে, অন্যরা আগুন পোহাচ্ছে। সব কজনই বৃদ্ধ। সবচেয়ে তরুণ যে জন তারও বয়েস পঁয়ষট্টির কম নয়। গম্ভীর ভঙ্গিতে সবার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলো কোউ-এন: যে মঠে সবারই খিদে পায় সেই বিশ্ব-মঠের লামা এরা।

আমাদের দিকে তাকালো ওরা। শীর্ণ হাতগুলো ঘষলো তালুতে তালু। লাগিয়ে। মাথা নুইয়ে সম্মান জানালো। অবশেষে কথা বললো একজন: আপনাদের আগমনে অত্যন্ত আনন্দিত আমরা।

শুধু কথায় নয়, কাজেও ওরা সে প্রমাণ দিলো। হাত মুখ ধধায়ার জন্যে পানি গরম করলো একজন। দুজন উঠে চলে গেল আমাদের জন্যে একটা কামরা। সাজিয়ে গুছিয়ে ফেলতে। অন্যেরা আমাদের গা থেকে খুলে নিলো দীর্ঘ ব্যবহারে নোংরা হয়ে যাওয়া পোশাকগুলো। পা থেকে বুটগুলোও খুলে নেয়া হলো। তার বদলে চটি দিলো পরবার জন্যে। তারপর নিয়ে গেল অতিথি কুঠুরিতে। আগুন জ্বেলে দেয়া হলো ঘরের মাঝখানে। বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়! এরপর পরিষ্কার কাপড় এনে দেয়া হলো আমাদের পরার জন্যে। তার ভেতর লিনেনও আছে। সব প্রাচীন কালের, দেখলেই বোঝা যায় খুব উঁচু মানের জিনিস, যদিও পুরনো হয়ে গেছে।

আমাদের রেখে চলে গেল সন্ন্যাসীরা। আমরা হাত মুখ ধুয়ে নিলাম-ভালো করে ধুয়ে নিলাম—প্রায় গোসল বলা যেতে পারে। তারপর লামাদের দেয়া পরিষ্কার পোশাক পরলাম। লিওর কাপড়টা একটু ছোট হয়েছে। এ ঘরেও দরজার কাছে ঝুলছে একটা ঘণ্টা। বাজাতেই এক লামা হাজির। আমাদের নিয়ে এলো রান্নাঘরে। সেখানে তখন খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এক ধরনের পরিজ আর সদ্য দোয়ানো দুধ-পশু-পতি দুইয়ে এনেছে। এছাড়া আমাদের সম্মানে বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে শুকমো মাছ আর মাখন দেয়া চায়ের। খেতে গিয়ে মনে হলো এমন সুস্বাদু খাবার জীবনে খাইনি। প্রচুর খেলাম। আমাদের গোগ্রাসে খাওয়া দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল সন্ন্যাসীদের।

বিশ্ব-মঠের সন্ন্যাসীরা দেখছি সত্যিই ক্ষুধার্ত! শেষ পর্যন্ত একজন বলেই ফেললো; লোকটার পদবী খাদ্য-পতি। এভাবে খেতে থাকলে আমাদের শীতের সঞ্চয় শেষ হতে দুদিনও লাগবে না!

সুতরাং শেষ করলাম আমরা। তারপর বুদ্ধের বাণী থেকে দীর্ঘ এক স্তোত্র আওড়ালাম।

অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধ সন্ন্যাসীরা। বিদেশীদের মুখে বুদ্ধের বাণী যেন তাদের কল্পনারও অতীত।

অতিথি-কুঠুরিতে ফিরে একটানা চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমালাম। যখন উঠলাম তখন একেবারে ঝরঝরে তাজা আমাদের শরীর।

.

পরের ছটা মাস এই পাহাড়ী মঠে কাটলো। কয়েক দিনের ভেতরেই সহৃদয় বৃদ্ধ সন্ন্যাসীদের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠলাম। আরও কদিন পর ওরা ওদের ইতিহাস শোনালো আমাদের।

সুপ্রাচীন কাল থেকে মঠটা আছে এখানে। আগে বেশ কয়েকশো সন্ন্যাসী থাকতো। দুই শতাব্দী বা তার কিছু আগে হিংস্র এক উপজাতি হামলা চালিয়ে সন্ন্যাসীদের হত্যা করে দখল করে নেয় মঠটা। সামনে মরুভূমির ওপাশে যে বিশাল পাহাড়ী এলাকা সেখানে বাস করে সেই উপজাতি। আগুনের উপাসনা করে তারা। সন্ন্যাসীদের প্রায় সবাই নিহত হয় সে হামলায়। যে দুচারজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলো তারা কোনো মতে পালিয়ে গিয়ে লোকালয়ে পৌঁছে দেয়। খবরটা। তারপর পাঁচ পুরুষেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও মঠটা পুনর্দখলের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এই মঠের খুবিলগান (প্রধান পুরোহিত) আমাদের বন্ধু কোউ-এন-এর যখন যৌবন কাল তখন প্রথম উদ্যোগ নেয়া হলো। দুশো বছর আগে যে সন্ন্যাসীরা নিহত হয়েছিলো তাদের মধ্যেও এক কোউ-এন ছিলো। আমাদের কোউ-এন-এর ধারণা সে সেই কোউ-এন-এরই পুনর্জন্ম নেয়া রূপ। তার মতে বর্তমান জীবনে তার প্রধান দায়িত্ব ছিলো মঠে ফিরে আসা। সে দায়িত্ব সে পালন করেছে। মঠটা যদি পুনর্দখল করতে পারে তাহলে তার পক্ষে নির্বাণ লাভ কষ্টসাধ্য কিছু হবে না এই ধারণা থেকে আমাদের এই কোউ-এন এক দল উদ্যোগী মানুষ নিয়ে রওনা হয়। অনেক কষ্ট আর ক্ষতি স্বীকার করে জায়গাটা পুনর্দখল করে তারা। প্রয়োজনীয় সংস্কার করে মঠটার।

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা সেটা। তারপর থেকে তারা এখানে আছে। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বলতে গেলে নেই। বছরে বা দুবছরে এক বা। দুজন পাঁচ মাসের পথ পাড়ি দিয়ে যায় লোকালয়ে। খবরাখবর, সামান্য খাবারদাবার, পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে ফিরে আসে। প্রথম দিকে দু’এক বছর পর পর বাইরে থেকে সগ্রহ করে আনা হতো সন্ন্যাসীদের। এখন লোকালয়ের বাইরে। এমন পোড়ো জায়গায় কেউ আর আসতে চায় না। ফলে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে মঠবাসীর সংখ্যা।

তারপর? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

তারপর আর কি? প্রধান পুরোহিত জবাব দিলো, অনেক জ্ঞান অর্জন করেছি আমরা। চিরবিদায়ের পর পুনর্জন্ম নিয়ে আবার যখন পৃথিবীতে আসবো তখন অনেক শান্তিপূর্ণ হবে আমাদের জীবন। জাগতিক সব মোহ, লোভ লালসাকে জয় করতে পেরেছি, এর চেয়ে বেশি আর কি চাই?

দিনের বিরাট একটা অংশ প্রার্থনা করে কাটায় আর লোকালয়ের বাইরে নারীসঙ্গ বিবর্জিত অবস্থায় আছে; এছাড়া গৃহী মানুষের সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই » এই সন্ন্যাসীদের। পাহাড়ের পাদদেশে উর্বর ভূখণ্ডে চাষ করে এরা, পশুপালন করে; গৃহকর্ম করে। তারপর এক সময় থুথুরে বুড়ো হয়ে মরে যায়। একটা ব্যাপার দেখলাম, সন্ন্যাসীর ব্রত গ্রহণ করে আর কিছু না হোক অন্তত দীর্ঘ জীবন লাভ করেছে এরা।

.

আমরা মঠে পৌঁছানোর পরপরই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর তুষার ঝড় নিয়ে শুরু হয়ে গেল শীত। সামনের বিশাল মরুভূমিতে পুরু তুষারের স্তর জমে গেল। শিগগিরই বুঝে ফেললাম, বেশ কয়েক মাস এখানে থাকতে হবে। শীতকাল শেষ হওয়ার আগে যে এখান থেকে নড়তে পারবো না তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

অত্যন্ত সংকোচের সাথে খুবিলগান অর্থাৎ মঠ-প্রধান কোউ-এনকে বললাম, আমরা যদি কয়েকটা দিন থাকি তাহলে কি আপনাদের খুব অসুবিধা হবে? ভাঙাচোরা কোনো ঘরে থাকতে দেবেন আমাদের, খাবার দাবার লাগবে না। পাহাড়ের ওপর একটা হ্রদ আছে বলেছিলেন, ওখান থেকে মাছ ধরে নেবো, তাছাড়া হরিণ-টরিণ-ও শিকার করে নিতে পারবো…

আমাকে শেষ করতে দিলো না কোউ-এন। বাধা দিয়ে বললো, হয়েছে থাক, আর বলতে হবে না। যতদিন ইচ্ছা তোমরা থাকবে এখানে। ভাঙা ঘরে থাকারও কোনো দরকার নেই, যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। আর আমাদের যদি খাবার জোটে তোমাদেরও জুটবে। আর যা-ই হোক, ক্ষুধার্ত পথিককে দয়া না দেখানোর মতো পাপ আমরা করতে পারবো না।

শিগগিরই আমরা বুঝে ফেললাম বৃদ্ধের উদ্দেশ্য। আমাদের বুদ্ধের পথের পথিক করে নিতে চায়। ওর বা ওর সঙ্গীদের মতো সংসারত্যাগী লামা বানিয়ে ফেলতে চায়।

আপাতত তাতে কোনো অসুবিধা নেই আমাদের। সুতরাং আমরা পথিক হলাম। আগেও অনেক মঠে থেকেছি, বুদ্ধের শিক্ষা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছি, এবার আরেকটু ভালো করে শিখবো, তারপর সময় হলে আমাদের পথে রওনা হয়ে যাবো।

সন্ন্যাসীদের সাথে তত্ত্ব আলোচনা আর গৃহকর্ম করে দিন কেটে যেতে লাগলো। মাঝে মাঝে আমাদের ধর্ম নিয়ে আলোচনা করি ওদের সঙ্গে, বিশ্ব নামক মঠের গল্প শোনাই। এই সন্ন্যাসীরা রুশ, চীনা আর কিছু আধা বর্বর উপজাতি ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো জাতির কথা জানে না। আমরা যখন গল্প করি তখন হাঁ করে শোনে নতুন নতুন দেশের নতুন নতুন মানুষের কথা।

এসব আমাদের শিখে রাখা উচিত, ঘোষণা করলো ওরা। কে জানে আগামী জন্মে হয়তো এসব দেশের কোনো একটার বাসিন্দা হিসেবে জন্ম হবে আমাদের।

দিন চলে যাচ্ছে। মোটামুটি সুখেই আছি। কিন্তু মনে শান্তি নেই। যার খোঁজে বেরিয়েছি কবে পাবো তাকে? বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারছি, আপাতত কিছু করার নেই, শীত শেষ না হলে এখান থেকে রওনা হতে পারবো না, তবু মনের অস্থিরতা কমে না।

এর মাঝে একদিন আশ্চর্য এক জিনিস আবিষ্কার করে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম আমি। মঠের ধসে পড়া অংশে গিয়েছিলাম। কোনো কাজে নয়, এমনি জায়গাটা দেখতে। একটা কামরায় ঢুকেই চোখ কপালে উঠে গেল। রাশি রাশি হাতে লেখা বই-এ ঠাসা ঘরটা। এক পলক দেখেই বুঝলাম নিহত সন্ন্যাসীদের সময়কার জিনিস। কোউ-এন-এর কাছে জানতে চাইলাম, বইগুলো আমরা উল্টে পাল্টে দেখতে পারি কিনা। সানন্দে অনুমতি দিলো বৃদ্ধ।

অদ্ভুত এক সংগ্রহ ওটা। এক কথায় অমূল্য। নানা ভাষায় নানা বিষয়ে লেখা এমন সব বই ওখানে আছে যার খোঁজ আজকের দুনিয়ার কেউ এখনও পায়নি। বেশির ভাগই বুদ্ধ-দর্শন সম্পর্কে। যে জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করলো তা হলো বহু খণ্ডে বিভক্ত একটা দিনলিপি। যুগ যুগ ধরে মঠের খুবিলগানরা রচনা করেছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ওগুলোয়। পড়তে শুরু করলাম একটা একটা করে। অল্প কিছু দিনের ভেতর কয়েকটা খণ্ড শেষ করে ফেললাম। শেষখণ্ডগুলোর একটার পাতা ওল্টাতে গিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক এক কাহিনী জানতে পারলাম। প্রায় আড়াইশো বছর আগে—অর্থাৎ প্রাচীন মঠটা ধ্বংস হওয়ার কিছু আগে লেখা কাহিনীটা। তার যতটুকু মনে আছে তুলে দিচ্ছি পাঠকদের জন্যে

এবছর গ্রীষ্মে, ভয়ানক এক ধূলিঝড়ের পর আমাদের মঠের এক ভাই (অর্থাৎ সন্ন্যাসী, নামটা দেয়া ছিলো, এখন আর মনে নেই আমার) মরণাপন্ন এক লোককে মরুভূমিতে পড়ে থাকতে দেখে। মরুভূমির ওপারে যে বিশাল পাহাড়ী এলাকা সেখানকার মানুষ সে। এতদিন এ দেশ সম্পর্কে নানা গুজব শুনে এসেছি, এই প্রথম ওখানকার একজনের দেখা পাওয়া গেল। আরও দুজন লোক ছিলো ওর সঙ্গে। খাবার এবং পানির অভাবে মারা গেছে দুজনই। ভীষণ হিংস্র দেখতে লোকটা, মেজাজের দিক থেকেও একরোখা। কি করে এই দুর্গম মরুভূমিতে এলো সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাইলো না। আমরা অনেক অনুরোধ উপরোধ করেছিলাম, কিন্তু একটা কথাও বের করতে পারিনি তার মুখ থেকে। শুধু এটুকু, বলেছিলো, প্রাচীন কালে বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আগে তার দেশের লোকেরা যে রাস্তা ব্যবহার করতো, সেই পথ ধরে সে এসেছে। শেষ পর্যন্ত আমরা জানতে পারলাম, মারাত্মক কোনো অপরাধ করেছিলো বলে ওকে আর ওর দুই সঙ্গীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো, তাই দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলো তারা। ওর কাছ থেকে আরও জানতে পেরেছি, ঐ পাহাড় শ্রেণীর ওপাশে চমৎকার এক দেশ আছে। অত্যন্ত উর্বর সেখানকার মাটি। তবে প্রায়ই ভূমিকম্প হয় ওখানে। অনাবৃষ্টিও সেদেশের এক প্রধান সমস্যা। এদুটো বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ব্যাপার না থাকলে বলা যেতো সুখে দিন কাটায় ওখানকার মানুষ।

লোকটা বলেছিলো, ওরা খুব যুদ্ধপ্রিয় জাতি, যদিও ওদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। দেশ শাসন করে গ্রীক রাজা আলেকজাণ্ডারের বংশধর এক পরিবার। প্রধান শাসকের পদবী খান। কথাটা সত্যি হতেও পারে, কারণ আমাদের নথিপত্র বলছে, প্রায় দুহাজার বছর আগে আমাদের এ-অঞ্চল জয়ের জন্যে এক সেনা বাহিনী পাঠিয়েছিলো ঐ গ্রীক রাজা (অর্থাৎ আলেকজাণ্ডার)।

লোকটা আরও জানায় ওদের দেশের মানুষ অমর এক পূজারিণীর উপাসনা করে, যার নাম হেস বা হে, যুগ যুগ ধরে সে তার আধিপত্য বজায় রেখেছে। আরও দূরের এক পাহাড়ে সে থাকে। সব মানুষ তাকে ভয় করে, পূজা করে। ক্ষমতা থাকলেও রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে সে কখনও হস্তক্ষেপ করে না। তার উদ্দেশ্যে কখনও কখনও বলিদান করা হয়, কেউ যদি এই পূজারিণীর রোষানলে পড়ে তবে তার আর রক্ষা থাকে না, অবশ্যই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। এই কারণে দেশের শাসকরাও তাকে ভয় করে।

এসব শুনে আমরা উপহাস করলাম লোকটাকে। বললাম, সে মিথ্যে বলছে। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, চিৎকার করে ঘোষণা করলো, আমাদের বুদ্ধ নাকি ওদের সেই পূজারিণীর মতো ক্ষমতাবান নয়। আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে সে তার প্রমাণ দেবে।

কিছু খাবার দিয়ে আমরা ওকে মঠ থেকে বিদায় করে দিলাম। যখন ফিরে আসবো তখন টের পাবে কে সত্যি কথা বলে, বলতে বলতে চলে গেল লোকটা। পরে ওর কি হয়েছিলো সে-সম্পর্কে আর কিছু জানতে পারিনি আমরা। আমাদের ধারণা, কোনো এক অশুভ শক্তি ওর ছদ্মবেশে আমাদের ভয় দেখাতে এসেছিলো।

.

পরদিন আমাদের সঙ্গে গ্রন্থ-কক্ষে যাওয়ার অনুরোধ করলাম খুবিলগান কোউ এনকে। কাহিনীটা পড়ে শুনিয়েজিজ্ঞেস করলাম, এ সম্পর্কে আর কিছু সে জানে কিনা। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে মাথা দোলালো সে। কোউ-এন-এর এই ভঙ্গিটা দেখলেই কচ্ছপের কথা মনে পড়ে যায় আমার।

সামান্য, বললো সে। খুব সামান্য। তার বেশির ভাগই ঐ গ্রীক রাজার সেনাবাহিনী সম্পর্কে।

যেটুকু জানে সেটুকুই বলতে অনুরোধ করলাম কোউ-এনকে। শান্তভাবে শুরু করলো বৃদ্ধ

তখনও পবিত্র পথের অনুসারীর সংখ্যা খুব বেশি হয়নি। এই মঠ সবেমাত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি তখন এই মঠেরই এক অধম ভাই। একদিন সকালে উঠে দেখি, সামনের মরুভূমি দিয়ে হেঁটে চলেছে এক সেনাবাহিনী, ব্যস। সেটা, একটু চিন্তা করে যোগ করলো, আমার পঞ্চাশ জন্ম আগের কথা—না, অন্য এক সেনাদলের কথা বলছি—তিহাত্তর জন্ম আগের কথা।

এখানে হো-হো করে হেসে উঠতে গেল লিও। তাড়াতাড়ি ওর পায়ে পা দিয়ে খোঁচা দিলাম। ভাগ্য ভালো হাসিটাকে হাঁচিতে পরিণত করতে পারলো ও। তা না হলে পরে যে কথাগুলো জানতে পারলাম তার একটাও হয়তো জানা হতো না।

তা কি করে সম্ভব!? অবাক গলায় বললাম আমি। মৃত্যুর সাথে সাথে স্মৃতিও কি বিলীন হয়ে যায় না?

না, ভাই হলি, সব ক্ষেত্রে তা হয় না। পুনর্জন্ম লাভের পর স্মৃতি কখনও কখনও ফিরে আসে বৈকি! বিশেষ করে যারা পবিত্র পথে অনেক দূর এগিয়েছে তাদের স্মৃতি তো প্রায়শঃই ফিরে আসে। আমার কথাই ধরো, তুমি এই অনুচ্ছেদটা পড়ার আগ পর্যন্ত ঐ সেনাবাহিনী সম্পর্কে কিছুই মনে ছিলো না। কিন্তু এখন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে সৈনিকরা, আর আমি অন্য সন্ন্যাসীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি ঐ বিরাট বুদ্ধ মূর্তির পাশে, দেখছি ওদের চলে যাওয়া। খুব বড় নয় বাহিনীটা। বেশির ভাগই পথের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মরে গেছে, নয়তো নিহত হয়ছে শক্রর হাতে। সে আমলে আমাদের দক্ষিণে এক জংলী জাতি বাস করতো, তারা তাড়া করেছিলো ওদের। প্রাণভয়ে পালাচ্ছিলো গ্রীকরা। ওদের সেনাপতি—কি যেন তার নাম…মনে করতে পারছি না।

আমাদের এই মঠে উঠে এসেছিলো ওদের সেনাপতি, বলে চললো বৃদ্ধ। তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের জন্যে ঘুমানোর মতো একটা জায়গা দাবি করেছিলো। খাবার, ওষুধপত্র আর মরুভূমির পথ ঘাট চেনে এমন একজন পথপ্রদর্শক-ও চেয়েছিলো সে। আমাদের সে সময়কার খুবিলগান তাকে জানিয়ে দিলেন, আমাদের ছাদের নিচে কোনো স্ত্রীলোককে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না, কারণ তা আমাদের আইনের পরিপন্থী। সেনাপতি রেগে গিয়ে বললো, জায়গা না দিলে আমাদের মাথার ওপরে ছাদ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই থাকবে না; পুরো মঠ জ্বালিয়ে দেবে সে, আমাদেরকেও হত্যা করবে।

তোমরা জানো দাঙ্গা হাঙ্গামায় যারা নিহত হয় পরের জন্মে তারা জন্তু জানোয়ার হয়ে জন্ম নেয়। ভয়ঙ্কর ব্যাপার সেটা! মঠে স্ত্রীলোককে আশ্রয় দেয়া-ও পাপ, তবে অত কঠিন পাপ নয়। তাই আমরা ঠিক করলাম, সেনাপতির স্ত্রীকে আসতে দেবো মঠে। পরে মহা-লামার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ক্ষমা চাইবো। আমি অবশ্য নিজের চোখে সেই রমণীকে দেখিনি, তবে ওদের পূজারিণীকে দেখেছিলাম–হায়! কেন যে দেখেছিলাম! বুক চাপড়াতে লাগলো কোউ-এন।

কেন, হায় কেন? কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

কেন? ওহ! সেনাদলের কথা ভুলতে পারলেও ঐ পূজারিণীর কথা কখনও ভুলতে পারিনি। এখনও চোখের সামনে দেখতে পাই তাকে। এই একটাই পাপ আমার জীবনে, এই পাপ আমাকে পিছিয়ে দিয়েছে, না হলে অনেক আগেই মোক্ষ সাগরের উপকূলে পৌঁছে যেতে পারতাম।

তার ঘর গুছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছিলো আমার ওপর। সবেমাত্র কাজ শেষ করেছি, এমন সময় ঘরে ঢুকলো সে। এক দিকে ছুঁড়ে দিলো মুখাবরণ। তারপর, হ্যাঁ, আমার সাথে কথা বললো সে। আমি তার দিকে তাকাতে চাইছি না বোঝার পরও অনেক প্রশ্ন করলো।

কেমন-কেমন দেখতে ছিলো? আগ্রহ লিওর কণ্ঠস্বরে।

কেমন দেখতে ছিলো? আহ…কি বলবো! দুনিয়ার সব সৌন্দর্য যেন ওর ভেতর পুঞ্জীভূত হয়েছিলো। তুষারের ওপর ভোর হতে দেখেছো? বসন্তের প্রথম ফুল? পাহাড়ের চূড়া ছাড়িয়ে আরও ওপরে সন্ধ্যাতারা? যদি দেখে থাকো তাহলে বুঝতে পারবে ওর সৌন্দর্য কেমন। ভাই, আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না, আমি বলতে পারবো না। ওহ! পাপ, আমার পাপ! আমি গড়িয়ে গড়িয়ে পেছনে চলে যাচ্ছি, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না, তোমরা আমার গোপন লজ্জা দিনের আলোয় নিয়ে আসছে। না…না, আমি স্বীকার করবো, আমি স্বীকার করবো, তোমরা দেখ, আমি কি নীচ। তোমরা হয়তো তোমাদের মতোই পবিত্র ভাবছো আমাকে, কিন্তু আসলে আমি কি তা দেখ।

সেই মেয়েমানুষটা—জানি না সত্যিই সে মেয়েমানুষ কিনা, আমার হৃদয়ে আগুন জ্বেলে দিলো, যে আগুন নেভে না, কিছুতেই নেভে না, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে ফেলে। তারপর আরও জ্বলে আরও জ্বলে। করুণ ভাবে মাথা দোলাতে লাগলো কোউ-এন। তার শিং-এর চশমার নিচ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে। ও-ও আমাকে ওর পূজা করিয়ে ছেড়েছে। প্রথমে আমার ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন করেছে। আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে বলেছি। আশা করছিলাম, ওর হৃদয়ে সত্যের আলো পৌঁছুবে। কিন্তু আমার কথা শেষ হতেই সে বললো–

তার মানে তোমার পথ ত্যাগের। বোকা! তোমার এই নির্বাণ হলো চমৎকার এক নিরর্থক ধারণা। যার কোনো ভিত্তি নেই। তারচেয়ে এসো তোমাকে মহান এক দেবী আর অনেক আনন্দদায়ক এক উপাসনার পথ দেখাই।

কি পথ? কোন্ দেবী? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

প্রেম ও জীবনের পথ, জবাব দিলো সে, যার ভেতর দিয়ে উৎপত্তি সমগ্র পৃথিবীর। হে নির্বাণপিয়াসী সন্ন্যাসী, তোমারও জন্ম এই প্রেমের ভেতর দিয়ে। আর দেবী? সে হলো প্রকৃতি।

আবার আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় সেই দেবী। রাজকীয় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো সে। সুডৌল সুউচ্চ বক্ষে হাত রেখে বললো, আমিই সে। হাঁটু গেড়ে বসো, আমাকে প্রণাম করো।

আমি তা-ই করলাম, ভাই হলি, ভাই লিও, আমি তা-ই করলাম! হাঁটু গেড়ে বসে তার পায়ে চুমু খেলাম। তারপরই সংবিৎ ফিরলো আমার। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। ছুটে পালিয়ে গেলাম সেখানে থেকে। আমার পালানো দেখে হেসে উঠলো সে। চিৎকার করে বললো: আমি তোমার সাথে সাথেই থাকবো, ও বুদ্ধের দাস। আমার রূপ বদলাতে পারে, কিন্তু আমি মরি না। যদি নির্বাণ লাভ করো, তখনও আমি তোমার সাথে থাকব। যে একবার আমার কাছে প্রণত হয় তাকে আমি কখনও ছেড়ে যাই না।

ব্যস, এখানেই শেষ, ভাই হলি ..সত্যিই ও আমাকে ছেড়ে যায়নি। তারপর যতবার পুনর্জন্ম নিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছি, ওর স্মৃতি কুরে কুরে খেয়েছে আমাকে। জানি আগামী জন্মগুলোতেও এমনই চলবে। অনন্ত শান্তি আমি কখনোই পাবো না… শীর্ণ হাতদুটো দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো কোউ-এন।

হাস্যকর দৃশ্য। মহামান্য একজন খুবিলগান, যার বয়স আশি পেরিয়ে গেছে, বাচ্চাছেলের মতো কাঁদছে। কেন? স্বপ্নে দেখা এক সুন্দরীর স্মৃতি মনে পড়ে গেছে। তাই। কিন্তু আমি বা লিও মোটেই হাসলাম না, বরং অদ্ভুত এক সহমর্মিতা অনুভব করলাম কোউ-এন-এর জন্যে। পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে সান্ত্বনা দিলাম তাকে।

কিছুক্ষণ পর সামলে নিলো বৃদ্ধ। তারপর আরও কিছু তথ্য আদায় করার চেষ্টা করলাম তার কাছ থেকে। কিন্তু লাভ হলো না খুব একটা। বিশেষ করে যে ব্যাপারটায় আমরা আগ্রহী সেই পূজারিণীয় প্রসঙ্গে নতুন প্রায় কিছুই বলতে পারলো না সে। পর দিনই সেনাদলের সঙ্গে চলে গিয়েছিলো পূজারিণী। ব্যস এটুকুই। তবে হ্যাঁ, সে সময়কার সুবিলগানকে একটা মন্তব্য করতে শুনেছিলো। কোউ-এন, তা হলো, কেন জানি না তার ধারণা হয়েছিলো, ঐ পূজারিণীই আসলে গ্রীক বাহিনীর সেনাপতি। তারই ইচ্ছায় বাহিনীটা মরুভূমি পেরিয়ে উত্তরে যাচ্ছিলো। সম্ভবত ওদিকে কোথাও নিজেকে দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলো সে।

মরুভূমির ওপারে যে পাহাড়ী এলাকা সত্যিই সেখানে কোনো জনবসতি আছে কিনা, জিজ্ঞেস করলাম কোউ-এনকে। চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বৃদ্ধ বললো, তার ধারণা আছে। বর্তমানে বা পূর্ববর্তী কোনো জীবনে, ঠিক মনে নেই, সে শুনেছে, ওরা অগ্নি উপাসনা করে। আরও বললো, এক ভাই এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিলো নির্জনে সাধনা করার জন্যে। সে নাকি ঐ পাহাড়গুলোর ওপাশে আকাশে বিশাল এক অগ্নি-স্তম্ভ দেখেছে। চোখের ভুল কিনা সে সম্পর্কে অবশ্য নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি সে।

আর কিছু না বলে ধীর পায়ে গ্রন্থ-কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল বৃদ্ধ খুবিলগান। পরের এক সপ্তাহ সে আর আমাদের সামনে আসেনি। এ প্রসঙ্গও আর কখনও তোলেনি আমাদের সামনে। আর আমরা, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠবে এই পাহাড়ের চূড়ায়।

.

০৩.

সপ্তাহ খানেকের ভেতর সুযোগ এসে গেল।

এখন শীতের মাঝামাঝি। তুষার ঝড় থেমে গেছে। সন্ন্যাসীদের কাছে। শুনলাম, এসময় নাকি ওভিস পোলি এবং আরও নানা জাতের পাহাড়ী হরিণ খাবারের খোঁজে বেরিয়ে আসে গোপন আস্তানা ছেড়ে। শোনামাত্র লাফিয়ে উঠলাম আমরা। বললাম, কালই আমরা শিকারে বেরোবো।

প্রাণী হত্যার কথায় অত্যন্ত মর্মাহত হলো বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা।

দেখুন শিকারটা আসলে মুখ্য নয়, বললাম আমি, চার দেয়ালের মাঝে আটকে থাকতে থাকতে হাত-পায়ে খিল ধরে গেছে। সেজন্যে একটু ঘুরে ফিরে আসতে চাই। সম্ভব হলে এই পাহাড়ের চূড়ায় একবার উঠবো। শরীরের জড়তা কাটবে। এর ভেতর যদি শিকার কিছু মেলে মন্দ কি? আমাদের ধর্মে তো প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ নয়।

বুঝলাম, কিন্তু ব্যাপারটা খুবই বিপজ্জনক, বললো কোউ-এন। যেকোনো মুহূর্তে আবহাওয়ার অবস্থা খারাপ হতে পারে।

খারাপ আবহাওয়ায় আমরা অভ্যস্ত, খুব একটা অসুবিধা হবে না।

ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলো বৃদ্ধ। তারপর বললো, ঠিক আছে, যাও। পাহাড়ের ঢালে একটু ওপরে একটা গুহা আছে। হঠাৎ যদি আবহাওয়া খারাপ হয়ে পড়ে, ওখানে আশ্রয় নিও।

অপেক্ষাকৃত কম বয়েসী এক সন্ন্যাসী গুহাটা চিনিয়ে দেয়ার জন্যে আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হলো।

পরদিন ভোরে ইয়াকটার পিঠে (ইতিমধ্যে আবার তরতাজা হয়ে উঠেছে, ওটা) কিছু খাবার, কাপড়-চোপড় আর একটা ছোট চামড়ার তাবু চাপিয়ে বেরিয়ে এলাম মঠ থেকে। পথ প্রদর্শক সন্ন্যাসীর পেছন পেছন মঠের উত্তর পাশের ঢাল বেয়ে উঠে যেতে লাগলাম চূড়ার দিকে। দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম গুহার কাছে।

চমৎকার গুহাটা। শীতের দিনে শিকারে বেরিয়ে আশ্রয় নেয়ার আদর্শ স্থান। ঘাস পাতায় ভর্তি হয়ে আছে। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচবার জন্যে জ্বালানীর অভাব হবে দিনের বাকি সময়টুকু আমরা গুহায় কাটিয়ে দিলাম। রাতে থাকবার জন্যে পরিষ্কার করলাম খানিকটা জায়গা। সেখানে তাঁবুটা খাড়া করলাম। তারপর ওটার সামনে বড় একটা আগুন জ্বেলে পাহাড়ের ঢালগুলো পরীক্ষা করতে বেরোলাম। সন্ন্যাসীকে বলে গেলাম, হরিণের পায়ের ছাপ খুঁজতে যাচ্ছি।

কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বাছাই করলাম কোন্ ঢাল বেয়ে চূড়ায় উঠবে। ফিরতি পথে কিছুদূর আসতেই বুনো ভেড়ার একটা পাল নজরে পড়লো। একই সঙ্গে গুলি বেরোলো আমার আর লিওর বন্দুক থেকে। দুটো ভেড়া মরলো। আগামী দিন পনেরো আর খাবারের অভাব হবে না। তুষারের ওপর দিয়ে টানতে টানতে গুহার কাছে নিয়ে এলাম ভেড়া দুটোকে। চামড়া ছাড়িয়ে গুহার ভেতর রেখে দিলাম তুষার চাপা দিয়ে।

বহুদিন পর তাজা ভেড়ার মাংস দিয়ে রাতের খাওয়া সারলাম। প্রাণী হত্যার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি যা-ই হোক না কেন, সন্ন্যাসী বাবাজীও আমাদের মতোই তুপ্তির সাথে মাংস খেলো। এরপর আগুনের সামনে গুটিসুটি মেরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা।

ভোর হলো। আবহাওয়া আগের মতোই শান্ত। আমাদের পথ প্রদর্শক বিদায় নিলো। ওকে বলে দিলাম, দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা মঠে ফিরবো। যতক্ষণ না ছোট্ট একটা চূড়ার আড়ালে লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল ততক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমি আর লিও। তারপর উঠতে শুরু করলাম ঢাল বেয়ে।

কয়েক হাজার ফুট উঁচু পাহাড়। কোনো কোনো জায়গায় প্রায় খাড়া উঠে গেছে। পাহাড়ে ওঠার যত কৌশল জানা আছে সব প্রয়োগ করে উঠে চলেছি আমরা। অবশেষে দুপুরের সামান্য আগে পৌঁছুলাম চূড়ায়। অপূর্ব এক দৃশ্য ভেসে উঠলো আমাদের সামনে। নিচে বিস্তৃত মরুভূমি। তার ওপাশে বরফের টুপি পরা পাহাড়শ্রেণী। সামনে, ডানে, বাঁয়ে যেদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়।

আঠারো বছর আগে স্বপ্নে যেমন দেখেছিলাম ঠিক তেমন ঐ পাহাড়গুলো, বিড়বিড় করে উঠলো লিও। ঠিক তেমন। হুবহু এক।

আলো ছুটে এসেছিলো কোন্‌খান থেকে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মনে হয় ওখান থেকে, উত্তর-পুব দিকে ইশারা করলো ও।

কিন্তু এখন তো কিছু দেখছি না।…চলো ফিরি, ভীষণ ঠাণ্ডা এখানে।

নামতে শুরু করলাম আমরা। গুহায় যখন পৌঁছুলাম তখন সূর্য ডুবছে।

পরের চারটে দিন একই ভাবে কাটলো। ভোরে বিপজ্জনক ঢাল বেয়ে উঠে যাই চূড়ায়। লিওর স্বপ্নে দেখা আলোকস্তম্ভের খোঁজ করি। সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে আসি গুহায়।

চতুর্থ দিন রাতে ভেতরে ঢুকে ঘুমানোর পরিবর্তে গুহার মুখে বসে রইলো লিও। বারকয়েক আমি ওকে ডাকলাম ভেতরে। ও এলো না। ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।

মাঝরাতে লিওর ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল আমার। চমকে উঠে বসলাম।

হোরেস! চিৎকার করলো ও, দেখবে এসো!

লিওর পেছন পেছন বেরিয়ে এলাম গুহার বাইরে। পোশাক পরার ঝামেলা পোহাতে হলো না, কারণ আমরা ওগুলো পরেই ঘুমাই। উত্তর দিকে ইশারা করলো লিও। আমি তাকালাম। বাইরে কালো রাত। কিন্তু দূরে, বহু দূরে অস্পষ্ট এক ফালি আলো জ্বল জ্বল করছে আকাশের গায়ে। দেখে মনে হয় মাটিতে আগুন জ্বলছে, তার আভা।

কি মনে হচ্ছে? সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলো লিও।

বিশেষ কিছু না। অনেক কিছুই তো হতে পারে। চাঁদ-না, চাঁদ না, ভোর হচ্ছে-না, তা-ও না, ভোর হতে এখনও অনেক দেরি। কিছু জ্বলছে। বাড়ি বা শ্মশান-চিতা। কিন্তু-কিন্তু এখানে ওসব আসবে কোত্থেকে? জানি না!

আমার মনে হয় ওটা প্রতিফলন। চূড়ায় থাকলে দেখতে পেতাম কি থেকে আসছে ওটা।

হ্যাঁ, কিন্তু আমরা চূড়ায় নেই, এই অন্ধকারে যাওয়াও সম্ভব নয়।

সেক্ষেত্রে, হোরেস, অন্তত একটা রাত আমাদের চূড়ায় কাটাতে হবে।

তারপর যদি তুষার ঝড় শুরু হয়ে যায়?

ঝুঁকিটা আমাদের নিতে হবে, তুমি না চাইলে আমি একাই নেবো। দেখ, মিলিয়ে গেছে আলোটা।

দেখলাম, সত্যিই তাই। ঠিক আছে, কাল এনিয়ে আলাপ করা যাবে। আপাতত প্রসঙ্গটার ইতি টেনে গুহায় ঢুকলাম আমি। কিন্তু লিও বসে রইলো বাইরে।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নাশতা তৈরি।

আমি সকাল সকাল রওনা হয়ে যেতে চাই, ব্যাখ্যা করলো লিও।

পাগল হয়েছো তুমি!? ও জায়গায় থাকবো কি করে আমরা?

জানি না, তবে আমি যাচ্ছি। আমাকে যেতেই হবে, হোরেস।

তার মানে আমাকেও যেতে হবে। কিন্তু ইয়াকটার কি হবে?

যাবে আমাদের সঙ্গে। যেখানে আমরা উঠতে পারবো, সেখানে ও-ও পারবে।

সুতরাং তল্পিতল্পা গুটিয়ে ইয়াকের পিঠে বোঝাই দিলাম আবার। রান্না করা কিছু ভেড়ার মাংস নিলাম সঙ্গে। তারপর রওনা। ইয়াকটা সঙ্গে থাকায় একটু ঘুর পথে উঠতে হলো। বিকেল নাগাদ পৌঁছে গেলাম চূড়ায়।

চূড়ায় উঠে প্রথমেই এক জায়গায় ঝুরো ঝরো তুষার সরিয়ে একটা গর্ত করে তবু খাটালাম তার ওপর। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তাঁবুর ভেতর নেমে পড়লাম আমরা ইয়াক আর তার পিঠের মালপত্রসহ। খাওয়া-দাওয়ার পর অপেক্ষা, শুরু হলো।

ওহ, কি ঠাণ্ডা! শূন্যের নিচে কয়েক ডিগ্রী হবে। আমাদের হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ভাগ্য ভালো ইয়াকটাকে এনেছিলাম। ওর লোমশ শরীরের উত্তাপ না পেলে হয়তো মরেই যেতাম।

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সেকেণ্ড, মিনিট, ঘণ্টা। চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বাতাসের একটানা শো শো আওয়াজ কেবল কানে আসছে। ঝিমুনি লেগে এলো আমার। হঠাৎ শুনতে পেলাম লিওর কণ্ঠস্বর।

দেখ, হোরেস, ঐ যে ঐ তারার নিচে!

তাকাতেই দেখলাম দূরে আকাশের গায়ে সেই আভা, গতরাতে যেখানে দেখেছিলাম ঠিক সেখানে। কাল যা দেখতে পাইনি তা-ও দেখতে পেলাম আজ। আভার নিচে আমাদের প্রায় সোজাসুজি হালকা একটা আগুনের শিখা। তার সামনে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে কালো কিছু একটা।

দেখতে দেখতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আগুন। সামনের কালো জিনিসটা এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এবং ওটা ,ওহ! গায়ের ভেতর শির শির করে উঠলো। আমার! জিনিসটা মাথা তুলে দাঁড়ানো একটা স্তম্ভের উপরিভাগ, তার ওপর বসানো রয়েছে একটা আংটা। হ্যাঁ, আর কিছু নয়, ওটা ক্রুক্স আনসাতা, মিসরীয়রা যাকে জীবনের প্রতীক বলে মনে করে!

প্রতীকটা মিলিয়ে গেল। আগুন ম্লান হয়ে এলো। তারপর আবার জ্বলে উঠলো দাউ দাউ করে। আগের চেয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলাম আংটাটা। আবার মিলিয়ে গেল। তৃতীয় বারের মতো লাফিয়ে উঠলো অগ্নিশিখা। এবার আরও উজ্জ্বল। তীব্রতম বিদ্যুৎচমকও সে উজ্জ্বলতার কাছে হার মানে। সারা আকাশ আলোকিত হয়ে উঠলো। আংটার ভেতর দিয়ে জাহাজের সার্চলাইটের মতো ঠিকরে বেরিয়ে এলো একটা আলোক স্তম্ভ। নিমেষে বিস্তীর্ণ মরুভূমি পেরিয়ে এসে আলোকিত করে তুললো আমাদের পাহাড় চূড়া। মাত্র এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর আবার অন্ধকার চারদিক। দূরে সেই আগুন আর আলোও উধাও।

অনেকক্ষণ আমরা কেউ কোনো কথা বলতে পারলাম না।

তোমার মনে আছে, হোরেস, অবশেষে নীরবতা ভাঙলো লিও, টলমলে পাথরটার ওপর দিয়ে যখন আমরা ফিরে আসছিলাম কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া আলোর রেখা মৃত্যুপুরী থেকে প্রাণ নিয়ে পালানোর পথ দেখিয়েছিলো আমাদের? আমার ধারণা সেই আলোই আবার এসেছে, এবার জীবনপুরীর পথ দেখাবে। সাময়িকভাবে যে আয়শাকে আমরা হারিয়েছি তার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের।

হতে পারে, সংক্ষিপ্ত উত্তর আমার।

নিঃশব্দে বসে রইলাম আমি আর লিও। ভোর হলো। বৃদ্ধ কোউ-এন-এর কথাই ঠিক। বাতাসের বেগ বেড়েছে। সেই সাথে একটু একটু তুষারও পড়ছে। কিন্তু বিন্দুমাত্র ভয় লাগলো না আমাদের। তীব্র কনকনে বাতাস আর তুষারপাত উপেক্ষা করে নামতে শুরু করলাম। অপূর্ব এক তৃপ্তির অনুভূতিতে ছেয়ে আছে হৃদয়। আমরা যেন এ পৃথিবীর নই। এখানকার তুচ্ছ দুঃখ, বেদনা আমাদের মনে আর দাগ কাটছে না। অপার আনন্দের সন্ধান পেয়েছি যেন আমরা। 

গুহার কাছে পৌঁছুতে পৌঁছুতে তীব্রতর হলো তুষার-ঝড়। কিন্তু না থেমে নেমে চললাম আমরা। কোন কষ্টকেই আর কষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। অবশেষে পৌঁছুলাম মঠের দরজায়। সম্পূর্ণ নিরাপদে। বৃদ্ধ খুবিলগান আলিঙ্গন করে অভ্যর্থনা জানালো আমাদের। হাঁ করে তাকিয়ে রইলো সন্ন্যাসীরা। এমন প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যেও আমরা মরিনি দেখে আশ্চর্য ওরা।

.

 অবশেষে শীত বিদায় নিলো। একদিন সন্ধ্যায় বাতাস একটু উষ্ণ মনে হলো। পরদিন সকালে উঠে দেখি আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে। তা থেকে ঝরছে তুষার নয়, জল। একটানা তিন দিন বৃষ্টি হলো। চতুর্থ দিন ঢল নামলো পাহাড় বেয়ে। এক সপ্তাহের মাথায় সামনের উর্বর জমিটুকু সবুজ হয়ে উঠলো। আমাদের যাবার সময় হয়েছে। কিন্তু কোথায় যাবে তোমরা? ম্লান মুখে, প্রশ্ন করলো বৃদ্ধ খুবিলগান। এখানে আর ভালো লাগছে না? আমাদের প্রতি কোনো কারণে রুষ্ট হয়েছে? কেন আমাদের ছেড়ে যাবে?

আমরা পথিক, আমি জবাব দিলাম, পথের মাঝে পাহাড় দেখলে তা টপকাতেই হবে।

তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের দিকে চাইলো কোউ-এন। পাহাড়ের ওপারে কি খুঁজবে তোমরা? আমার কাছে সত্য গোপন কোরো না। বলো, অন্তত প্রার্থনা করতে পারবো তোমাদের জন্যে।

মাননীয় খুবিলগান, কিছুদিন আগে গ্রন্থ-কক্ষে কিছু কথা বলেছিলেন আপনি…।

ও কথা মনে করিয়ে দিও না, ভাই, আমাকে থামিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ বললো। কেন আমাকে যন্ত্রণা দিতে চাইছো?

না, বন্ধু, আপনি ভুল ভাবছেন। আমরা যা বলতে চাইছি তা হলো, আপনার কাহিনি আর আমাদের কাহিনি এক। ঐ পূজারিণীর সান্নিধ্যে আমরাও এসেছিলাম।

আচ্ছা! তারপর? কৌতূহল বৃদ্ধের কণ্ঠস্বরে।

সংক্ষেপে আমাদের কাহিনী শোনালাম তাকে। এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে শুনলো কোউ-এন। একটা কথাও বললো না। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কচ্ছপের মতো মাথা দুলিয়ে গেল শুধু।

এবার বলুন, সব শেষে যোগ করলাম আমি, কাহিনিটা অদ্ভুত না? নাকি আমাদের মিথ্যেবাদী ভাবছেন?

বিশ্ব-মঠের ভাইরা, মৃদু হেসে বৃদ্ধ জবাব দিলো, কেন তোমাদের মিথ্যাবাদী ভাববো, বলো? প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিনই বুঝেছি তোমরা খাঁটি মানুষ। যে কাহিনি ততমরা শোনালে তা সত্যি না হওয়ারও কোনো কারণ নেই। একটা ব্যাপারেই শুধু আমি দ্বিমত পোষণ করি, তা হলো, তোমাদের ঐ সে-র। অমরত্ব—পৃথিবীতে কিছুই অমর নয়। তোমরা যাকে দেখেছিলে আর ক্যালিক্রেটিস বা আমেনার্তাস যাকে দেখেছিলো বা যার খোঁজে তোমরা চলেছে তারা এক নয়, হতে পারে না। এসবই সেই পুনর্জন্মের খেলা। যতদিন না আত্মা নির্বাণ লাভ করছে ততদিন ফিরে ফিরে পৃথিবীতে আসতে হবে। তোমাদের আয়শাও তেমনি এসেছে। ভবিষ্যতেও আসবে।

ভাই লিও, তুমি যদি তাকে পাও-ও, পাবে হারাবার জন্যে। অর্থাৎ আবার নতুন করে খোঁজ শুরু করতে হবে তোমাকে। হয়তো জনম জনম ধরে খুঁজে চলবে, কিন্তু পেয়েও পাবে না, হাতের মুঠোয় এসেও বেরিয়ে যাবে। আর, ভাই হলি, তোমার জন্যে, আমার জন্যেও, হারানো-ই সবচেয়ে বড় পাওয়া। তা-ই যদি হয়, তাহলে কেন ছুটবে মরীচিকার পেছনে? কেন নিজে তৃষ্ণার্ত থেকে পানি ঢেলে ভরবার চেষ্টা করবে ফুটো পাত্র? তাতে মাটিই কেবল ভিজবে, তোমার তৃষ্ণা তো মিটবে না?

তৃষ্ণা না মিটুক, মাটি উর্বরা হবে, আমি জবাব দিলাম। যেখানে পানি পড়ে সেখানেই প্রাণের সম্ভাবনা দেখা দেয়। আর দুঃখ তো আনন্দেরই বীজ। ভাই খুবিলগান, আর বাধা দেবেন না আমাদের।

ঠিক আছে, দেবো না। তবে আমার একটা ধারণার কথা বলি, শোনার পর যদি মনে হয় যাবে, যেও, আমি কিছু বলবো না। লিওর দিকে তাকালো কোউ এন। তোমাদের গল্প শুনে বুঝতে পারছি আজ থেকে অনেক অনেক জন্ম আগে আইসিস নামের কোনো দেবীর চরণে তুমি নিজেকে সমর্পণ করেছিলে, তাই না? তারপর এক নারী তোমাকে প্রলোভিত করে, তার সাথে অনেক দূরে পালিয়ে গিয়েছিলে। সেখানে কি হলো? প্রবঞ্চিত দেবী প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে হত্যা করলো তোমাকে। সেই দেবী নিজে না হলেও, আমার বিশ্বাস তার কোনো প্রতিনিধি তার জ্ঞান আত্মস্থ করে তারই ইচ্ছায় তার হয়ে একাজ করে। কিন্তু পরে সেই প্রতিনিধি-সে নারী বা অশুভ আত্মা যা-ই হোক না কেন-মরতে অস্বীকার করে, কারণ ইতিমধ্যে সে ভালোবেসে ফেলেছে তোমাকে। সে জানে তুমি মৃত তবু সে অপেক্ষা করতে লাগলো, এই আশায়, পুনর্জন্ম নিয়ে আবার তুমি আসবে। তারপর তুমি যখন নতুন জন্ম নিলে সত্যিই তোমার সাথে দেখা হলো তার এবং মারা গেল সে। এখন পুনর্জন্ম নিয়েছে ও, ওকে নিতেই হবে। যে তোমাকে প্রলোভিত করেছিলো সে-ও পুনর্জন্ম নিয়েছে। নিঃসন্দেহে এবারও তোমার সাথে তাদের দেখা হবে। তারপর সেই পুরনো ঘটনা নতুন বৃত্তে আবর্তিত হবে। তার মানে তোমার জন্যে আবার কষ্ট, দুঃখ, বেদনা। না, বন্ধুরা, যেও না-ঐ অভিশপ্ত গিরিশ্রেণী অতিক্রম কোরো না। এখানেই থাকো, আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করবো তোমাদের জন্যে।

না, জবাব দিলো লিও, আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারবো না।

বেশ, যাও তাহলে। তোমাদের প্রতিক্ষা করো। যখন এর ফসল তুলবে তখন আমার কথা স্মরণ কোরো। আমি জানি, বাসনার যে মদ তুমি পান করেছো তার প্রভাব বড় কঠিন।

.

০৪.

দুদিন পর সূর্যোদয় দেখলো আমরা মরুভূমির পথে হাঁটছি। পেছনে প্রায় মাইলখানেক দূরে পাহাড়ের ওপর অধিত্যকায় বসে আছে বিশাল প্রস্তর-বুদ্ধ। তার ওপাশে প্রাচীন মঠ। আকাশ ঝলমলে, পরিষ্কার। বুদ্ধমূর্তির পাশে আমাদের বন্ধু বৃদ্ধ খুবিলগান কোউ-এন-এর ঝুঁকে থাকা অবয়বটা দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। বিদায় জানানোর সময় হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিলো বৃদ্ধ। সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলো আমাদের। কিন্তু কিছু করার নেই, যে নিয়তি আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে তার অমোঘ নির্দেশ কি করে আমরা লংঘন করবো?

যতক্ষণ না ছোট হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেল ততক্ষণ একটু পরপরই ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম বৃদ্ধকে। অবশেষে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামনের দিকে চোখ ফেরালাম।

.

পাহাড়-চূড়ায় সেই রহস্যময় আলো যখন আমাদের ওপর এসে পড়েছিলো তখন কম্পাস ছিলো আমার কাছে। আলোটা কোন্‌দিক থেকে এসেছিলো দেখে নিতে পেরেছিলাম। সেদিকেই চলেছি আমরা।

আবহাওয়া চমৎকার। সামনে দুস্তর মরু। সারাদিন হেঁটে গোটা দুয়েক বুনো গাধার পাল ছাড়া আর কিছু নজরে পড়লো না। সন্ধ্যার একটু আগে একটা অ্যান্টেলোপ মারতে পারলাম। তারপর রাতের মতো যাত্রাবিরতি। যেটা নিয়ে পাহাড়-চূড়ায় উঠেছিলাম সেই ছোট্ট তাবুটা সঙ্গে আছে। ওটা খাটালাম। ইয়াকের পিঠে একটা বস্তায় কিছু শুকনো খড়কুটো এনেছি। আগুন জ্বাললাম তা দিয়ে। রাতে চা আর অ্যান্টেলোপের মাংস দিয়ে রাজসিক খাবার খেলাম। অ্যান্টেলোপটা মারতে পারায় আমাদের সাথে যে সামান্য শুকনো খাবার আছে তার ওপর একটু চাপ কমলো।

পরদিন সকালে প্রথমেই আমাদের অবস্থান যাচাই করে নিলাম। সবদিক বিবেচনা করে ধারণা হলো মরুভূমির চার ভাগের একভাগ অতিক্রম করতে পেরেছি। চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় প্রমাণিত হলো, নিখুঁত ধারণা করেছিলাম। মরুভূমির ওপাশে যে বিস্তৃত পাহাড়শ্রেণী তার পাদদেশে পৌঁছে গেছি।

তৃতীয় দিন সকালে লিও বলেছিলো, ঘড়ির কাঁটার মতো নিশ্চিন্তে চলছে সব।

আমি ওকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, শুরুটা যার ভালো তার শেষ সাধারণত ভালো হয় না। আমি ভুল বলিনি। সত্যিই এবার কষ্ট শুরু হলো। প্রথমত, পাহাড়গুলো খুব উঁচু। ওগুলোর নিচের দিকের ঢালে পৌঁছুতেই লেগে গেল দুদিন। সূর্যের তাপে তুষার নরম হয়ে গেছে, ফলে তার উপর দিয়ে হাঁটা অনেক বেশি আয়াসসাধ্য হয়ে উঠলো।

সপ্তম দিন সকালে এক সঙ্কীর্ণ শৈলপথের মুখে পৌঁছুলাম। চেহারা দেখে মনে হলো পাহাড়-শ্রেণীর অনেক গভীরে চলে গেছে ওটা। আশপাশে আর কোনো পথ না পেয়ে ঐ পথেই এগোলাম আমরা। কিছুদূর হাটার পর বুঝতে পারলাম এটা প্রাকৃতিক গিরিপথ নয়। কোনো কালে মানুষই তৈরি করেছিলো এ পথ। পাহাড়ের গায়ে অস্ত্রপাতির আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। খাড়া উঠে গেছে পথটা। চওড়া সব জায়গায় মোটামুটি সমান। এটাও একটা প্রমাণ, পথটা প্রাকৃতিক নয়।

তিন দিন এগোলাম এই পথে। এগোলাম না বলে বলা ভালো উঠলাম। গিরিপথ বেয়ে যত এগোচ্ছি ততই এক পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠে যাচ্ছি আমরা। দিনে খুব একটা সমস্যা হলো না, কষ্ট যা হওয়ার হলো রাতে। এমন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা যে তাঁবুর ভেতরে, সমস্ত পোশাক-আশাক গায়ে দিয়ে, কম্বল মুড়ি দিয়ে, ইয়াকটার গায়ে গা ঠেকিয়ে বসেও কাঁপতে হয় ঠকঠকিয়ে। সে ঠাণ্ডার স্বরূপ প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। বরফের মতো ঠাণ্ডা বললে কিছুই বলা হয় না।

অবশেষে দশম দিন বিকেলে শৈল পথের শেষ মাথায় পৌঁছুলাম। আর শখানেক গজ গেলেই গিরিপথের মুখ। সন্ধ্যা হতে বেশি বাকি নেই। ওখানেই তাবু খাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আসল কষ্ট শুরু হলো এবার। আগুন জ্বালানোর মতো কোনো জ্বালানী আর অবশিষ্ট নেই। পানি গরম করতে পারলাম না। তৃষ্ণা মেটানোর জন্যে জমা তুষার চুষতে হলো। কিন্তু তাতে কি তৃষ্ণা মেটে? তীব্র ঠাণ্ডায় চোখ জ্বলছে। সারারাতে একটুও ঘুমাতে পারলাম না দুজনের কেউ।

ভোর হলো। তারপর সূর্যোদয়। গুড়ি মেরে তাবুর বাইরে এলাম। গিরিপথের মুখ যেখানে তার শখানেক গজ ভেতরে আমাদের তাঁবু। হাত-পায়ের জড়তা কাটানোর জন্যে দৌড়ানোর ভঙ্গিতে মুখটার দিকে এগোলাম আমরা। আগে লিও, পেছনে আমি। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা বাঁক নিয়েছে শৈলপথ।

লিও-ই প্রথম মোড় ঘুরলো। পর মুহূর্তে বিস্মিত এক চিৎকার বেরোলো তার মুখ দিয়ে। এক সেকেণ্ড পর আমিও মোড় ঘুম। তারপর! সামনে আমাদের প্রত্যাশিত দেশ!

নিচে-অনেক নিচে, কমপক্ষে দশ হাজার ফুট হবে, বিছিয়ে আছে বিস্তৃত এক সমভূমি। যতদূর চোখ যায় কেবল সমান আর সমান। আকাশ যেখানে মাটির সাথে মিশেছে সেখানেও শেষ হয়নি এর বিস্তৃতি। তুষারের টুপি পরা বিরাট একটা নিঃসঙ্গ পাহাড়ই কেবল একটু ব্যতিক্রম এই দৃষ্টিক্লান্তিকর সমতলে। যদিও অনেক দূরে, তবু মোটামুটি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি পাহাড়টার অবয়ব। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোয়া উঠছে গোল চূড়া থেকে। তার মানে ওটা একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। এবং আরও দেখতে পাচ্ছি, জ্বালামুখের এপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড এক পাথরের স্তম্ভ। যার ওপর অংশের আকৃতি আংটার মতো।

হ্যাঁ, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওটা, আমরা যে অলৌকিক দৃশ্য দেখেছিলাম তার বাস্তব রূপ! দীর্ঘ যোলো বছর যার খোঁজে মধ্য এশিয়ার প্রতিটা অঞ্চল চষে ফেলেছি সেই জীবনের প্রতীক এখন আমাদের সামনে। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল আমাদের। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার চেয়েও উঁচু ওটার আংটা। এতক্ষণে বুঝলাম, কি করে এই সুউচ্চ গিরিশ্রেণী পেরিয়ে সেই অলৌকিক আলো পৌঁছেছিলো মরুভূমির ওপাশে পাহাড়ের চূড়ায়।

আলোটার উৎস সম্পর্কেও নিশ্চিত হলাম এতক্ষণে। আংটার পেছনের ধোয়াই রহস্যের সমাধান করে দিয়েছে। আগ্নেয়গিরিটা যখন জীবন্ত, নিঃসন্দেহে মাঝে মাঝে ধোঁয়ার বদলে আগুন বেরিয়ে আসে ওটার জ্বালামুখ দিয়ে। সেই আগুনের তীব্রতা কতখানি হতে পারে তা সে রাতে পাহাড় চূড়ায় বসে আমরা টের পেয়েছি।

এছাড়া সমভূমিতে আর যা দেখলাম তা হলো, প্রায় মাইল তিরিশেক দূরে বিশাল এক মাটির ঢিবির ওপর বিরাট একটা নগর। সমভূমির মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে প্রশস্ত এক নদী। তার তীরে গাছপালা ঘেরা এক জায়গায় নগরটা। চোখে ফিল্ড গ্লাস (আমাদের সামান্য যে দু-একটা যন্ত্রপাতি এখনও অবশিষ্ট আছে তার একটা এটা) লাগিয়ে দেখলাম, নগর ঘিরে ফসলের মাঠ। নগর আর মাঠের মাঝে। সীমানার কাজ করছে গাছগুলো। পরিশ্রমী কৃষকরা বীজ বোনার আগে চাষ দিয়েছে মাঠে। সেচের জন্যে খাল কেটে মাঠের ভেতর পানি নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

হ্যাঁ, আমাদের সামনে সেই আকাঙ্ক্ষিত দেশ। যোলো বছর কঠোর পরিশ্রমের পর যার খোঁজ পেয়েছি। মুহূর্তে আমরা ভুলে গেলাম সব পরিশ্রম, সব ক্লান্তির কথা। নতুন করে উদ্দীপনা জাগলো মনে। আর একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে চাই না। এক্ষুণি রওনা হতে হবে। ছুটে ফিরে এলাম তাবুর কাছে। কোনো রকমে জিনিসপত্র সব গোছগাছ করে চাপিয়ে দিলাম ইয়াকটার পিঠে। তারপর বেরিয়ে পড়লাম আকাঙ্ক্ষিত দেশের পথে।

গিরিপথ শেষ, কিন্তু পথ এখনও শেষ হয়নি। পাহাড়ের এপাশেও ঢাল বেয়ে নেমে গেছে মানুষের তৈরি রাস্তাটা। ধীর অথচ নিশ্চিত পদক্ষেপে নামতে শুরু করলাম আমরা।

যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক দীর্ঘ পাহাড়ের ঢাল। সমস্ত দিন নেমেও পাদদেশে পৌঁছুতে পারলাম না। সুতরাং বাধ্য হয়েই আরেকটা রাত তুষারের ভেতর কাটাতে হলো। ভাগ্য ভালো, কয়েক হাজার ফুট নেমে আসতে পেরেছি। সে কারণে ঠাণ্ডার মাত্রা একটু সহনীয়। এখানে ওখানে দু’একটা খানা খন্দকে সূর্যের তাপে তুষার গলা পানি দেখতে পেলাম। তৃষ্ণা মেটানো সমস্যা হলো না। ইয়াকটাও পেট ভরে নিলো প্রায় শুকনো পাহাড়ী শ্যাওলা দিয়ে।

ভোর হলো। অবশিষ্ট খাবারের খানিকটা খেয়ে নিয়ে আবার রওনা হলাম আমরা। এখন আর নিচের সমভূমিটা দেখতে পাচ্ছি না। সামনে একটা শৈল প্রাচীর আমাদের দৃষ্টি আটকে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীরের গায়ে এক জায়গায় একটা ফাটল মতো দেখা যাচ্ছে। ওই ফাটল গলে বেরিয়ে যাওয়ার আশায় সেদিকে এগোতে লাগলাম। দুপুর নাগাদ খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম প্রাচীরের। ফাটলটা অনেক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখন। মনে হচ্ছে ওখান দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবো। হাঁটার গতি একটু বাড়ালাম আমরা। কিন্তু তাড়াহুড়োর কোনো দরকার ছিলো না। মাত্র এক ঘণ্টা পরেই মুখোমুখি হলাম কঠিন সত্যটার।

শৈল প্রাচীরের ফাটল আর আমাদের মাঝখানে শুয়ে আছে খাড়া নেমে যাওয়া এক গিরিখাত। তিন চারশো ফুট গভীর। জল প্রবাহের শব্দ ভেসে আসছে নিচ থেকে। গিরিখাতের কিনারে পেীছে শেষ হয়ে গেছে পথ। তারপর গভীর খাদ। খাদের এপাশে ওপাশে উঁচু দুটো পাথরের স্তম্ভ। কিন্তু এমন জায়গায় এসে মানুষের তৈরি পথ শেষ হয় কি করে? হতাশ, বিষণ্ণ চোখে চেয়ে আছি আমরা।

হুঁ, বুঝতে পেরেছি, হঠাৎ লিও বললো, ভূমিকম্পের ফলে তৈরি হয়েছে এই খাদ। তারপরই চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এপথে।

হতে পারে, জবাব দিলাম আমি, বা এমনও হতে পারে, এখানে কোনো কালে একটা সেতু ছিলো। তারপর কালের গ্রাসে পচে, ক্ষয়ে, খসে পড়েছে। যাহোক তাতে আমাদের সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। অন্য একটা পথ খুঁজে বের করতে হবে।

হ্যাঁ, এবং তাড়াতাড়ি। যদি না এখানেই চিরতরে আটকে থাকতে চাই।

সুতরাং ডান দিকে মোড় নিয়ে গিরিখাতের পাড় ধরে এগিয়ে চললাম আবার। প্রায় এক মাইল যাওয়ার পর ছোট একটা হিমশিরার কাছে পৌঁছুলাম। হিমায়িত জলপ্রপাতের মতো খাদের ভেতর ঝুলে আছে সে। কিন্তু খাদের তলায় পৌঁছেছে। কিনা বুঝতে পারলাম না। তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি এখান থেকে খাদটা ক্রমশ আরও চওড়া ও আরও গভীর হতে শুরু করেছে।

সুতরাং আবার আগের জায়গায়ুরে এলাম। এবার পথটার বাঁ দিকে এগিয়ে চললাম গিরিখাতের পাডুধের। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলাম খাদের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা পাহাড়। ঝকঝকে তুষার ছাওয়া ঢাল উঠে গেছে চূড়ার দিকে। গিরিখাতের অবস্থা সেই এক। নির্দয়, কূর, অগম্য।

এদিকে দিনের আলো ম্লান হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি আশ্রয় নেয়ার মতো কোনো জায়গা খুঁজে বের করতে না পারলে বিপদ হবে। একটু থেমে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। প্রায় আধমাইল দূরে খাদের কিনারে বড়সড় এক পাথরের চাঙড় দেখতে পাচ্ছি। ওটার ওপর উঠতে পারলে হয়তো পথের খোঁজ পাওয়া যাবে।

অনেক পরিশ্রমের পর যখন শ দেড়েক ফুট উঁচু চাঙড়টায় উঠলাম তখন সূর্য ডুবছে। অস্পষ্ট হলদেটে আলোতে দেখলাম, এপাশে খাদটা রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানকার চেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশি গভীর এবং চওড়া। গভীরতা এত বেশি যে উঁকি দিয়েও তল দেখতে পেলাম না। তবে জল প্রবাহের মৃদু কুলু কুলু শব্দ ঠিকই সৌছচ্ছে কানে। আচমকা প্রসারিত হয়ে খাদের প্রশস্ততা এখানে দাঁড়িয়েছে প্রায় আধমাই-এ।

এবার? কিছু ভাবতে পারছি না আমি। লিওর মুখেও চরম হতাশার ছাপ। কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। এদিকে সূর্য ডুবে গেছে। দ্রুত আঁধার নেমে আসছে। এখন আর সেই পথের মুখে ফিরে যাওয়ার সময় নেই। পাথরের ওপরেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিতে হলো।  ইয়াকটাকে ভারমুক্ত করে তাবু খাটালাম। তারপর মঠ থেকে আনা খাবারের শেষটুকু খেয়ে নিলাম। কাল সকালে কোনো শিকার না পাওয়া গেলে অমাহারে থাকতে হবে। যা হোক, খাওয়ার পর সবগুলো ফারের পোশাক আর কম্বলে শরীর মুড়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম দুঃখ ভোলার আশায়।

.

ভোর হতে খুব একটা বাকি নেই, এমন সময় আচমকা ভয়ানক এক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমাদের। অনেকগুলো কামান যেন একসঙ্গে গর্জে উঠেছে। তারপরেই হাজার হাজার অন্য রকম শব্দ।

হায় ঈশ্বর! ওকি? আঁতকে উঠলাম আমি।

তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না! দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালাম। ভোরের অস্পষ্ট আলোয় কোনোরকম অস্বাভাবিকতা নজরে পড়লো না। এদিকে আওয়াজ চলছে, অসংখ্য বন্দুকধারী একসাথে গুলি ছুঁড়লে যেমন হয় তেমন। ইয়াকটার ভেতর কেমন যেন অস্থিরতা, ছুটে পালানোর প্রবণতা, কিন্তু দীর্ঘদিনের সাথীদের ফেলে পালাতে পারছে না। একটু পরেই বদলে গেল শব্দ। এখন মনে হচ্ছে প্রকাণ্ড একটা যাঁতা যেন কেউ ঘোরাচ্ছে ঘড় ঘড় শব্দে। পিলে চমকে যেতে চায়।

ভোর বেলা অত্যন্ত দ্রুত ফর্সা হয়ে আসে চারদিক। আজও হলো। তারপর দেখলাম-দুচোখে রক্তহিম করা আতঙ্ক নিয়ে দেখলাম, ধীর গতিতে নড়েচড়ে নেমে আসছে পাহাড়ের একটা পাশ। বিশাল এক হিমবাহ!

ওহ! সে দৃশ্য ভোলার নয়। আমাদের দুমাইল কি তারও বেশি দূরে ঢালের ওপর নড়ে-চড়ে, দুমড়ে-মুচড়ে, গড়িয়ে নেমে আসছে বিশাল সাদার একটা স্থূপ। প্রতি মুহূর্তে আকার বদলাচ্ছে যেন ঝঞা বিক্ষুব্ধ সাগরের ঢেউ। উপরে অনেক দূর পর্যন্ত ছিটকে উঠছে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ, তুষার কণা। জমাট বাঁধা ঝরনা যেন।

আতঙ্কে হৃৎপিণ্ড গলার কাছে উঠে আসতে চাইছে আমাদের। বাক রুদ্ধ হয়ে গেছে। কোনো রকমে লিওর দিকে চাইলাম। ও-ও একই রকম বিরত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কয়েক সেকেণ্ড লাগলো বিপদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে। তারপর সংবিৎ ফিরলো দুজনের। আবার তাকালাম সরীসৃপের মতো ধীর অথচ নিশ্চিত গতিতে এগিয়ে আসা বরফপুঞ্জের দিকে।

নাম না জানা ভয়ঙ্কর কোনো জন্তুর মতো গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে ওটা। এতক্ষণ মনে হচ্ছিলো খুব ধীর গতিতে নামছে। কিন্তু মাত্র চার মিনিটের ভেতর দুমাইল পথ অতিক্রম করতে দেখে বুঝলাম কি ভয়ানক গতি ওটার। আর কয়েক শো গজ মাত্র দূরে রয়েছে আমাদের এই দেড়শো ফুট উঁচু ছোট পাহাড়টা থেকে।

ইতিমধ্যে কখন যে আমাদের ভয় কেটে গেছে টের পাইনি। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছি ভয়ঙ্করের রূপ। আসছে। ঘোট ঘোট নুড়ি, পাথর, বরফের চাঙড়, তুষার; উঠছে, পড়ছে, ছুটছে, লাফাচ্ছে। এক মুহূর্ত বিরাম নেই।

আর মাত্র শখানেক গজ। তীক্ষ্ণ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের পাহাড় চূড়া থেকে পঞ্চাশ ফুট নিচে ওটার সম্মুখভাগ। তারমানে প্রায় একশো ফুট পুরু হিমবাহটা। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে শব্দের তীব্রতা। একটানা প্রচণ্ড গর্জনের মতো। মনে হচ্ছে কানের পর্দা ফেটে যাবে।

আর পঞ্চাশ গজ। বুঝতে পারছি না, ঠিক কি ঘটবে, যখন ওটা আছড়ে পড়বে এই পাহাড়ের গায়ে। কল্পনাও করতে পারছি না। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনও হইনি যে। অমোঘ নিয়তির মতো এগিয়ে আসছে ওটা।

শুয়ে পড়ো, লিও! কোনো মতে কথাটা বলার সুযোগ পেলাম। পর মুহূর্তে প্রচণ্ড মেঘ গর্জনের মতো শব্দ করে আছড়ে পড়লো, হিমবাহ আমাদের পাহাড়ের ওপর। ঝঞা বিক্ষুব্ধ সাগরের ঢেউ যেমন ফুলে ফেঁপে, বেঁকে-চুরে ভেঙে পড়ে পাহাড়ী উপকূলে তেমনি। গম-গম, গুরু গুরু আওয়াজ ছাপিয়ে উঠলো তীব্র বাতাসের হিস হিস শব্দ। ভয়ঙ্কর ঝাঁপটাতে গুঁড়ো গুঁড়ো তুষার ছিটকে এসে লাগলো আমাদের গায়ে। প্রায় কবর দিয়ে ফেললো আমাদের। মনে হলো একরাশ জ্বলন্ত কয়লা যেন কেউ ঢেলে দিলো গায়ের ওপর। উপুড় হয়ে মাটি কামড়ে পড়ে আছি আমরা। ভূমিকম্পের মতো কাঁপছে বুকের নিচে পাথুরে মাটি। ঘড় ঘড়, গোঁ গোঁ, গুডুম ডুম আওয়াজ সমানে চলছে। মনে হচ্ছে কোনোদিনই বুঝি শেষ হবে না এই শব্দের তাণ্ডব। বাতাসের বেগ বেড়ে গেছে ভয়ানক। ছোট্ট তবুটাকে অনেক আগেই উড়িয়ে নিয়ে গেছে। কোথায় জানি না। প্রতি মুহূর্তে ভয় পাচ্ছি, বসন্তের প্রথম বাতাস যেমন ঝরা পাতা উড়িয়ে নিয়ে যায় তেমনি আমাদেরও বুঝি উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে পেছনের অতল গিরি খাদে।

ওপর দিয়ে, পাশ দিয়ে, প্রায় শরীর ছুঁয়ে সমানে ছুটে যাচ্ছে পাথর আর বরফের চাঙড়। কিন্তু ঈশ্বরের কি করুণা, আমাদের গা স্পর্শ করলো না একটাও। বৃষ্টির মতো আমাদের গায়ে ঝরে পড়ছে নুড়ি আর বরফের কুচি। তাতে কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, তবে মরণ কষ্ট নয়। একটু একটু করে আমরা তলিয়ে যাচ্ছি বরফ আর তুষারের নিচে। আর বেশিক্ষণ এভাবে চললে মৃত্যু অবধারিত।

অবশেষে থামলো তাণ্ডব। কতক্ষণ ধরে চলেছে জানি না। দশ মিনিট হতে পারে, দুঘণ্টাও হতে পারে। কোনো ধারণা নেই আমাদের। শুধু মনে আছে, শব্দের প্রচণ্ডতা তুঙ্গে উঠতে উঠতে এক সময় আচমকা কমতে শুরু করলো। তারপর এক সময় মিলিয়ে গেল। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের সুতীব্র বেগও প্রশমিত হয়ে এলো। গায়ের ওপর থেকে তুষার আর ছোট ছোট নুড়ির স্থূপ সরিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম আমরা।

সামনে খাড়া পাহাড়ের গায়ে প্রায় দুমাইল লম্বা আধ মাইল চওড়া একটা জায়গা যেখানে একটু আগেও শত ফুট পুরু বরফের স্তর ছিলো, এখন সেখানে দাঁত বের করা কঙ্কালের মতো উলঙ্গ পাথর। আমাদের তাবুটা যেখানে ছিলো সেখানে এখন কিছু নেই। ইয়াকটা মরে পড়ে আছে এক পাশে। বেচারার মাথা উড়ে গেছে কোনো পাথর বা বরফের চাঙড়ের ঘায়ে। ধ্যাতলানো গলার কাছে রক্ত জমে আছে থকথকে হয়ে। পেছনের বিশাল গিরিখাতটার প্রায় অর্ধেক ভরে গেছে হিমবাহ আর তার বয়ে আনা পাথর, নুড়ি, ধুলোয়। ব্যস এ-ই। এ ছাড়া আর কোনো চিহ্ন নেই সেই ভয়ানক ঘটনার। এই মুহূর্তে কেউ যদি হাজির হয় সে টেরও পাবে না একটু আগে কি প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গেছে এখানে। আর আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি, সহ্য করেছি এবং এখনও বেঁচে আছি।

বেঁচে তো আছি, কিন্তু কি অবস্থা আমাদের? আলগা তুষারে ডুবে যাওয়ার ভয়ে পাহাড় থেকে নামার সাহস পাচ্ছি না। তাছাড়া একটু পরপরই দু-একটা ছোট ছোট আলগা পাথরের চাঁই গড়িয়ে নেমে আসছে ওপর থেকে। ছোট হলেও একেকটার আয়তন ছোটখাটো মানুষের সমান। গায়ে লাগলে ইয়াকটার যে দশা হয়েছে আমাদেরও তা ছাড়া অন্য কি হবে না। কিন্তু না নেমেই বা কি করবো? এই চূড়ার ওপর কতক্ষণ না খেয়ে আতঙ্কিত অবস্থায় বসে থাকবো?

ইয়াকটার চামড়া ছাড়াই এসো, হঠাৎ বলে উঠলো লিও। এরকম হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে কিছু করা ভালো। তাছাড়া রাতে যদি এখানেই থাকতে হয়, চামড়াটা কাজে লাগবে।

মনটা সায় দিতে চাইছে না। এত দিনের সাথী। মরে গেছে বলেই আজ ওকে এভাবে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর হাতিয়ার বানাবো? কিন্তু এছাড়া উপায়-ই বা কি? ওর চামড়া না পেলে তো আমরাও মরবো। ধীরে ধীরে উঠে হাত লাগালাম লিওর সাথে। মনে মনে ক্ষমা চাইলাম জন্তুটার আত্মার কাছে। আমরা এখানে নিয়ে এসেছিলাম বলেই তো এমন অপঘাতে মরতে হলো বেচারাকে।

যা হোক, মনে মনে যা-ই ভাবি না কেন শেষ পর্যন্ত ওর মাংসও খেতে হলো। কাঁচা। খানিকটা তুষার মেখে চোখ বুজে খেয়ে ফেললাম। প্রাণ বাঁচাতে হবে, সে জন্যে শক্তি দরকার। না খেলে শক্তি আসবে কোত্থেকে? কাঁচা মাংস খাওয়ার সময় জংলী জংলী একটা অনুভূতি হলো মনে। কিন্তু এছাড়া কি-ইবা করার ছিলো। আমাদের?

.

০৫.

অবশেষে দিন শেষ হলো। এখনও আমরা নামার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। সন্ধ্যায় আরও কয়েক টুকরো ইয়াকের মাংস খেয়ে গুটিসুটি হয়ে আশ্রয় নিলাম চামড়ার নিচে। ভাগ্য ভালো, আমাদের সব পোশাক-আশাক গায়েই ছিলো। না হলে তাবুটার মতো অবস্থা হতো ওগুলোর-ও। সেক্ষেত্রে আজ রাতে ঠাণ্ডায় জমে মরা কেউ ঠেকাতে পারতো না।

হোরেস, ভোরে লিও বললো, আর হাত-পা কোলে করে বসে থাকতে রাজি নই আমি। মরতে যদি হয়-ই, চলতে চলতে মরবো; তবে আমার মনে হয় না আমরা মরবো।

বেশ, তাহলে চলো রওনা হই। এখনও যদি তুষার আমাদের ভার সইতে না পারে কোনো দিনই পারবে না।

ইয়াকের চামড়া আর কম্বলগুলো ভাঁজ করে বেঁধে পিঠে তুলে নিলাম। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া ইয়াকের মাংসও নিলাম খানিকটা। তারপর শুরু করলাম নামতে।

.

হিমধসের সঙ্গে আসা ছোট বড় নানা আকারের পাথর প্রচুর পরিমাণে জমে আছে ছোট্ট পাহাড়টার গোড়ায়। ফলে ওঠার সময় যে জায়গাগুলো প্রায় খাড়া দেখেছিলাম সেগুলো এখন সহনীয় ঢলের রূপ নিয়েছে। নামতে অসুবিধা হলো না। রাতের ঠাণ্ডায় গুঁড়ো গুঁড়ো তুষার ভালো মতোই জমেছে। পা পিছলে যাচ্ছে। বা ভর দিতে সমস্যা হচ্ছে না।

প্রায় নেমে এসেছি। এপর্যন্ত ভালোই চলেছে সব। আর বিশ পা নামলেই পাদদেশে পৌঁছে যাবো। এমন সময় আলগা ধুলো আর গুঁড়ো তুষারের একটা স্কুপের মুখোমুখি হলাম। এটা পার হতেই হবে। পুরো পাহাড়টাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে চওড়া স্তূপটা। লিও দিব্যি পার হয়ে গেল। আমি ওর গজ দুয়েক ডান দিয়ে নামছি, দু-পা যেতেই আচমকা অনুভব করলাম পায়ের নিচে শক্ত স্তরটা ঝুর ঝুর করে ভেঙে গেল। পরমুহূর্তে কোমর সমান ধুলো আর তুষারের ভেতর আবিষ্কার করলাম নিজেকে। ডুবে যাচ্ছি। কয়েক সেকেণ্ড পর সম্পূর্ণ তলিয়ে গেলাম আমি তুষারের নিচে।

আমার সে মুহূর্তের অনুভূতি কল্পনা করা সম্ভব নয়, যার অভিজ্ঞতা আছে সে-ই কেবল উপলব্ধি করতে পারবে। ক্রমশ নিচে, আরও নিচে চলে যাচ্ছি। অবশেষে, মনে হলো একটা পাথরের কাছে পৌঁছুলাম। আমার নিম্নাভিমুখী গতি রুদ্ধ হলো। তারপর অনুভব করলাম, আমি নিচে নেমে আসার সময় উপরে যে শূন্য স্থান তৈরি হয়েছিলো তা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে চেপে আসা তুষারে। সেই সঙ্গে নেমে আসছে অন্ধকার। একটু পরে নিচ্ছিদ্র আঁধার গ্রাস করলো আমাকে। কেমন একটা শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি। যেন আমার গলা চেপে ধরেছে কেউ। চেতনা লুপ্ত হয়ে আসতে চাইছে। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। তাড়াতাড়ি দুপাশে ছড়িয়ে থাকা হাত দুটো নরম তুষারের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে এলাম মাথার কাছে। তারপর মুখের উল্টো দিকের তুষারে আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকলাম। ছোট্ট একটা গর্ত মতো হলো আমার মুখের সামনে। কিছুক্ষণের ভেতর খুব ধীরে ধীরে পরিশ্রুত বাতাস এসে জমতে লাগলো গর্তে। পরিপূর্ণ ভাবে না হলেও অনেকক্ষণ পর পর একবার শ্বাস টেনে প্রাণটাকে টিকিয়ে রাখলাম আমি।

কয়েক বার এমন শ্বাস নেয়ার পর বুঝতে পারলাম, এভাবে চলবে না। বাতাসের পরিমাণ এত কম যে খুব বেশিক্ষণ এখানে শ্বাস নেয়া সম্ভব নয়। তার ওপর আছে নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসা কার্বন ডাই অক্সাইড। আশা ছেড়ে দিলাম আমি। বুকের নিচে পাথরটায় হাত বাধিয়ে একবার চেষ্টা করলাম, ওপরে উঠে যাওয়ার। পারলাম না। অগত্যা মৃত্যুর জন্যে তৈরি হয়ে গেলাম মনে মনে। কিন্তু কি আশ্চর্য, মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ যেমন দেখে তেমন নিজের জীবনের অতীত স্মৃতি আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো না। আমার মন চলে গেল আয়শার কাছে। স্পষ্ট দেখলাম সেই অনিষ্টসুন্দর মুখ। ওর পাশে এক পুরুষ। অন্ধকার এক পাহাড়ী খাদে পড়ে আছি আমি। কিনারে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে আমাকে দেখছে আয়শা। ওর পরনে সেই দীর্ঘ কালো আংরাখা। চোখ দুটোয় ভয়। ওকে অভিবাদন জানানোনার জন্যে আমি উঠে দাঁড়াতে গেলাম। কিন্তু সে তীক্ষ্ণ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো-কি সর্বনেশে কাণ্ড! তুমি বেঁচে আছো, আমার প্রভু লিও কোথায়? বলো, কোথায় লুকিয়ে রেখেছো আমার প্রভুকে? বলো–না হলে মরবে!

জবাব দেয়ার জন্যে আবার উঠে দাঁড়াতে গেলাম। কিন্তু পারলাম না। মিলিয়ে গেল আয়শার মুখ।

তারপর আবার আলো দেখলাম আমি। আরেকটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এবার লিওর!

হোরেস! হোরেস, শক্ত করে ধরে রাইফেলের বাঁটটা!

কিছু একটা ঠেকলো আমার ছড়িয়ে থাকা হাতে। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরলাম ওটা। সঙ্গে সঙ্গে টান অনুভব করলাম হাতে। কিন্তু এক চুল নড়লো না আমার শরীর। তারপর আচমকা বাঁচার আকাঙক্ষা জেগে উঠলো আমার মনে। সর্বশক্তিতে হাত-পা ছুঁড়ে উঠে বসার চেষ্টা করলাম, অবশ্যই হাত দিয়ে যেটা আঁকড়ে ধরেছি সেটা না ছেড়ে। আবার টান অনুভব করলাম হাতে। আবার হাত পা ছুঁড়লাম। অকস্মাৎ প্রচণ্ড একটা ওজন নেমে গেল শরীর থেকে। শেয়াল যেমন তড়াক করে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে গর্তের ভেতর থেকে তেমনি তুষার ভ্রুপের নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছি আমি।

ফুঁপিয়ে উঠে শ্বাস নিলাম। কিছু একটার সঙ্গে ধাক্কা খেলো আমার শরীর। পর মুহূর্তে চোখ মেলে দেখলাম ছিটকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, এক পাশে লিও অন্য পাশে রাইফেলটা।

ধীরে ধীরে তুষার মোড়া শক্ত মাটির ওপর বসলাম আমি। হাপরের মতো ওঠা নামা করছে বুক। নাক মুখ দিয়ে সমানে টেনে নিচ্ছি মুক্ত বাতাস।

লিও-ও উঠলো। রাইফেলটা কুড়িয়ে এনে বসলো আমার পাশে।

কতক্ষণ ছিলাম ওর নিচে? হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

জানি না। মনে হয় বিশ মিনিটের কাছাকাছি।

বিশ মিনিট! মনে হচ্ছিলো বিশ শতাব্দী। কি করে বের করলে আমাকে?

শক্ত তুষারের ওপর ইয়াকের চামড়া বিছিয়ে শুয়ে হাত দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে এগিয়ে গিয়েছিলাম। কোথায় পড়েছিলে তা তো দেখেছিলাম। খুব বেশি দূরে নয়। একেবারে নিচে পৌঁছে তোমার আঙুলগুলো দেখলাম। তাড়াতাড়ি রাইফেলের বাটটা এগিয়ে দিলাম। ভাগজিলো ওটা ধরার মতো শক্তি তখনও ছিলো তোমার।

ধন্যবাদ, বুড়ো ছোকরা। আর কিছু আমি বলতে পারলাম না।

আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছো কেন? মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো লিও। তুমি কি ভেবেছিলে বাকি পথটুকু আমি একাই যাবো? দম নেয়া হয়েছে? তাহলে ওঠো, দেরি করে লাভ নেই। বেশ কিছুক্ষণ বরফের বিছানায় ঘুমিয়ে নিয়েছে, এবার একটু ব্যায়াম দরকার তোমার। জানো, আমার রাইফেলটা ভেঙে গেছে, তোমারটা তুষারের নিচে। ভালোই হয়েছে, কি বলো? কার্তুজগুলোর ভার আর বইতে হবে না। শুকনো হাসি ওর মুখে।

আবার আমরা রওনা হলাম। সামনে যাওয়া অর্থহীন। সুতরাং সেই আগের পাথরটার কাছেই আবার ফিরে এলাম। আমাদের নিজেদের এবং হতভাগ্য ইয়াকটার পায়ের ছাপ চোখে পড়লো। এখনও তেমনি আছে। আগের মতোই নির্দয় নিরাবেগ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে থাম দুটো-একটা খাদের এপাশে, অন্যটা ওপাশে। খাদটাও আগের মতোই খাড়া নেমে গেছে পাতালের দিকে। অগম্য।

ওদিকে সেই হিম-স্তরের কাছে চলো, বললো লিও।

নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম আমি ওর পেছন পেছন। ওখানে পৌঁছে সময় নষ্ট করলো না লিও। ঝুঁকে পরীক্ষা করলো হিমশিরার গোড়ার দিকটার অবস্থা। আমিও উঁকি দিলাম। আগেরবার যা দেখেছিলাম তার চেয়ে বেশি কিছু দেখতে পেলাম না। শ-চারেক ফুট গভীর খাদ। তার কিনার দিয়ে নেমে গেছে সরু, মোটা নানা ধরনের বরফের থাম বা শিকড়। একটা জলপ্রপাত আচমকা জমে বরফ হয়ে গেলে যেমন দেখতে হবে ঠিক তেমন। শিকড়গুলোর কোনোটা সরু হতে হতে তল পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা সেটাই জানতে চাইছি আমরা। কিন্তু বোঝা গেল না। নিশ্চিত যদি জানতাম তল পর্যন্ত পৌঁছেছে কোনোটা তাহলে সেটা বেয়ে নামার চেষ্টা করা যেতো। হতাশা, কালো হতাশা ছাড়া আর কিছু দেখছি না চোখে।

কি করবো আমরা? অবশেষে জিজ্ঞেস করলাম আমি। সামনে মৃত্যু, পেছনে মৃত্যু-পাহাড় পেরিয়ে ফিরে যাবো সে উপায় নেই, খাবার নেই এক বিন্দু। শিকার করে খাবার যোগাড় করবো তারও উপায় নেই। বন্দুক একটা হারিয়েছি, অন্যটা অকেজো। এখানে বসে থেকে না খেয়ে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। একমাত্র অলৌকিক কোনো ঘটনাই আমাদের বাঁচাতে পারে।

অলৌকিক ঘটনা! জবাব দিলো লিও। আর কি ঘটবে বলো? ছোট পাহাড়টায় উঠেছিলাম কেন? ওটায় উঠেছিলাম বলেই তো বেঁচে গেছি হিমবাহের হাত থেকে; এটাকে অলৌকিক ঘটনা বলবে না? তুষারের নিচ থেকে তোমার জ্যান্ত ফিরে আসা? আমার মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি আসা, এবং তুষারের নিচে গিয়ে তোমাকে বের করে আনা? আমি মনে করি অদৃশ্য কোনো শক্তি এতদিন আমাদের সাহায্য করেছে। আগামীতেও করবে না কেন? তুমি কি মনে করো, এই শক্তির সহায়তা না পেলে এতদিন আমরা বেঁচে থাকতাম?

থামলো ও, তারপর যোগ করলো, তোমাকে বলছি, হোরেস, সঙ্গে খাবার, বন্দুক, ইয়াক, আরও যা যা দরকার সব থাকলেও আমি ফিরে যেতাম না ফিরে গেলে কাপুরুষ প্রমাণিত হয়ে যাবো না? তখন কি ও ওর যোগ্য মনে করবে আমাকে? না, হোরেস, এগিয়ে আমি যাবোই।

কিন্তু কি করে?

ঐ পথ ধরে। খাদের পাড় থেকে স্কুলে পড়া বরফের শিকড়ের দিকে ইশারা করলো লিও!

ও তো মৃত্যুর পথ!

হোক। মৃত্যু এলে আসবে। এখানে বসে থাকলেও তো মরবো, তার চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে মরি। আমি মনস্থির করে ফেলেছি। এবার তোমার পালা।

আমিও ঠিক করে ফেলেছি। আমরা এক সাথে যাত্রা শুরু করেছিলাম, লিও, শেষ-ও করবো এক সাথে। হয়তো আয়শা জানে আমাদের এখনকার অবস্থা। আমাদের পরীক্ষা করছে, সময় হলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। শুকনো একটু হাসলাম আমি। যদি-না চলল, খামোকা সময় নষ্ট করছি।

.

নামার জন্যে সামান্য কিছু প্রস্তুতি নিতে হলো। একটা চামড়ার কম্বল আর ইয়াকের চামড়াটা সরু ফালি করে কেটে গিট দিয়ে দড়ি মতো বানালাম। কোমরের কাছে বেঁধে নিলাম এই দড়ি। একটা প্রান্ত খোলা রইলো। এতে নামতে সুবিধা হবে।

তারপর আরেকটা কম্বল টুকরো টুকরো করে কেটে আমাদের হাঁটু এবং পাগুলো ঢেকে নিলাম। শক্ত বরফ বা পাথরের কোনা লেগে ছড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না। চামড়ার দস্তানাগুলো পরে নিলাম হাতে। এগুলো হয়ে যাওয়ার পর আমাদের বাকি জিনিস-পত্র সব এক সাথে করে বেঁধে ফেলে দিলাম খাদের ভেতর। আশা করছি নিচে নেমে-যদি শেষ পর্যন্ত নামতে পারি-ওগুলো ফিরে পাবো।

ব্যস, প্রস্তুতি শেষ। এবার নামতে হবে। কিন্তু তবু আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা। ভয়ানক একটা কাজ করতে চলেছি। সফল না হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা নিরানব্বই ভাগ। একটু মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে।

লিওর দিকে তাকালাম। আমার লিও। পাঁচ বছরের ছোট্টটি, যখন আমার কাছে এসেছিলো। এখন যৌবনোত্তীর্ণ প্রায়। দীর্ঘ সময়ে কখনও আলাদা হইনি আমরা। আজ যদি মৃত্যু আসে মরণের ওপারে গিয়েও এক সাথেই থাকতে চাই।

ও-ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নির্বাক। তারপর নিচু, প্রায় ফিসফিস করে বললো, এসো।

পাশাপাশি দুটো বরফের খুঁটি ধরে নামতে শুরু করলাম। প্রথম কিছুক্ষণ মোটেই কঠিন মনে হল না কাজটাকে। দিব্যি খাদের গায়ে উঁচু হয়ে থাকা পাথরে পা বাধিয়ে নেমে যাচ্ছি দুজন। যদিও জানি, কোনোভাবে একবার হাত ফস্কালে যাত্রা করতে হবে মহাপ্রস্থানের পথে। তবে আমরাও কম নই। যথেষ্ট শক্তিশালী, এবং বাওয়া-ছাওয়ার কাজে দক্ষ। তাছাড়া এধরনের পরিবেশ সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।

প্রায় শখানেক ফুট নেমে থামলাম আমরা। খাদের গায়ে বেরিয়ে থাকা বিরাট একটা পাথরের চাইয়ে পা ঠেকিয়ে সাবধানে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম নিচের দিকে। যা দেখলাম, সত্যি কথা বলতে কি, ভয়ঙ্কর বললেও কম বলা হয়। একশো কি সোয়াশো ফুট নিচে খাদের গা তীক্ষ্ণ্ণ একটা বাঁক নিয়ে ক্রমশ ঢালু হয়ে এগিয়ে গেছে মাঝখানের দিকে। ওটার জন্যে যাদের তল দেখতে পাচ্ছি না।

আবার নামতে শুরু করলাম। এবার আর আগের মতো সহজ মনে হচ্ছে না। কারণ প্রথমত, সামান্য হলেও ক্লান্ত হয়েছি, দ্বিতীয়ত, খাদের গায়ে উঁচু হয়ে থাকা পাথরের সংখ্যা কমে গেছে অনেক। পায়ের নিচে কোনো অবলম্বন পাচ্ছি না। একেকবার মুহূর্তের জন্যে হাত ফস্কে যাচ্ছে, সড়সড় করে নেমে যাচ্ছি কয়েক ফুট; আঁতকে উঠে শক্ত করে আঁকড়ে ধরছি বরফের খুঁটি বা ভাগ্যক্রমে পায়ের নিচে পেয়ে যাচ্ছি কোনো পাথর। কোমরে বাধা দড়ি খুব সাহায্য করছে। পাথর বা বরফের খাজে ওটার আলগা মাথা বাঁধিয়ে নামছি। অন্য একটা পাথরে পৌঁছে টেনেটুনে ছাড়িয়ে নিচ্ছি মাথাটা, তারপর আবার আরেকটা খাঁজে বাধিয়ে দিয়ে নেমে যাচ্ছি।

অবশেষে পৌঁছুলাম বাকটার কাছে। অর্থাৎ প্রায় আড়াই শো ফুট নেমে আসতে পেরেছি। ধারণা করছি আর শ দেড়েক ফুট নামতে পারলেই তলে পৌঁছে যাবো। কিন্তু সত্যি কি দেড়শো ফুট, না আরও বেশি? কি করে জানা যায়?

দেখতে হবে, বললো লিও।

বুঝলাম, কিন্তু কি করে? একটাই মাত্র উপায় আছে, বিপজ্জনক ঢালু কিনারে গিয়ে উঁকি দেওয়া। একই সাথে ব্যাপারটা অনুধাবন করলাম দুজন। যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালাম আমি।

না, বাধা দিলো লিও, আমার বয়েস কম, শক্তিও তোমার চেয়ে বেশি। আমিই যাবো। এসো, আমাকে সাহায্য করো। কোমরের দড়িটা শক্ত করে একটা পাথরের কোনার সাথে বাঁধলো ও। তারপর বললো, এবার ধরো আমার গোড়ালি।

ব্যাপারটা পাগলামি মনে হলো আমার কাছে। কিন্তু উপায়ও নেই এছাড়া। সুতরাং সময় নষ্ট না করে ছোট্ট একটা খুঁজে পা আটকে বসলাম। তারপর লিওর গোড়ালি দুটো ধরে ধীরে ধীরে শরীর ঝুঁকিয়ে দিলাম। হাত প্রসারিত করে দিলাম যতদূর যায়। বুকে ভর দিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে গেল লিও। সামনের দিকে মুখ। একটু পরে ওর শরীরের অর্ধেকটা চলে গেল বাঁকের কিনারার আড়ালে।

তারপর হঠাৎ, দড়ি ছুটে গেল বলে না লিওর হাত ফস্কে গেল বলে জানি না, ওর সম্পূর্ণ শরীরের ওজন অনুভব করলাম আমার হাতে। হ্যাচকা এক টানে আমার হাত ছুটে গেল ওর গোড়ালি থেকে। আতঙ্কে হিম হয়ে গেলাম আমি। গলা চিরে তীক্ষ্ণ্ণ আর্তনাদের মত বেরিয়ে এলো একটা শব্দ: লিও!

লিও-ও-ও! আবার চিৎকার করলাম আমি। পরমুহূর্তে অস্পষ্ট একটা আওয়াজ ভেসে এলো আমার কানে-এসো। (পরে জেনেছিলাম, আসলে লিও বলতে চেয়েছিল, এসো না।)।

এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসলাম। তারপর আর কোনো ভাবনা চিন্তার ধার ধেরে এগিয়ে যেতে লাগলাম ঘষটে ঘষটে। দুসেকেণ্ডের মাথায় বাকের কিনারে পৌঁছুলাম। তিনের মাথায় টপকে ওপাশে।

 অপ্রশস্ত একটা বরফের ঢল নেমে গেছে বাঁকের কিনার থেকে। খুব খাড়া নয়। লম্বায় ফুট পনেরো হবে। ক্রমশ সরু হতে হতে সংকীর্ণ, খুব বেশি হলে মানুষের হাতের সমান মোটা একটা শৈল-তাকে গিয়ে শেষ হয়েছে ঢালটা। যে গতিতে কিনারে এসেছি সেই একই গতিতে পিছলে নেমে যেতে লাগলাম। নিজের অজান্তেই হাত দুটো ছড়িয়ে গেল দুপাশে। মুহূর্ত-পরে পা ঠেকলো শৈল-তাকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছি, এমন সময় ছড়িয়ে থাকা দুহাতের নিচে অনুভব করলাম কর্কশ কিছু একটা সম্ভবত বরফ, পাথরও হতে পারে। খপ করে খামচে ধরলাম সেটা। কোনোমতে রোধ করতে পারলাম পতনটা।

তারপর দেখতে পেলাম সব। আমার শিরা উপশিরার ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে গেল যেন! চামড়ার দড়ির প্রান্তটা আটকে গেছে শৈল-তাকের একটা খাঁজে। চার পাঁচ ফুট নিচে শূন্যে ঝুলছে লিও। ধীর অলস ভঙ্গিতে পাক খাচ্ছে ওর শরীর। নিচে হাঁ করে আছে অন্ধকার গহুর। কত নিচে যে এর তল বুঝতে পারলাম না। শুধু দেখলাম অন্ধকার যেখানে শেষ হয়েছে তারও বহু নিচে সাদা কি যেন। বরফই হবে হয়তো। কিন্তু হায়! কিছুই করার নেই আমার। যদি এক চুল নড়ি বা হাত আলগা করি ঐ গহ্বরে উল্টে পড়বো আমি নিজে। অন্যদিকে কোনোক্রমে যদি চামড়ার রশিটা খাঁজ থেকে ছুটে যায় পড়ে যাবে লিও। আমি এখন কি করবো? ওহ্, ঈশ্বর! বলো বলো, আফ্রিকি করবো?

.

সময় যেন থেমে গেছে। কতক্ষণ হয়েছে জানি না, সেই একই অবস্থায় আছি আমি। চারদিক নিস্তব্ধ। সামর্নে খাদের প্রায় কালো গা। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তারপর, হঠাৎ একটা ঝলকানি দেখতে পেলাম কালোর ভেতর, এবং মৃদু একটা শব্দ নিস্তব্ধতার ভেতর। ঝলকটা ছোরার। কোমরের খাপ থেকে খুলে এনেছে লিও। শব্দটাও বেরিয়েছে লিওর মুখ থেকেই। তীব্র আক্রোশে দুর্বোধ্য একটা চিৎকার করে চামড়ার দড়িতে ছোরা চালাচ্ছে ও। তৃতীয় পোঁচেই কেটে গেল চামড়ার সরু ফালি।

আমি দেখলাম, দুটুকরো হয়ে গেল ওটা। এক অংশ লিওকে নিয়ে চলে গেল সর্বগ্রাসী অন্ধকারের দিকে। অন্য অংশটা সৎ করে উঠে গেল ওপরে। তারপর একবার নিচে একবার ওপরে লাফাতে লাগলো দুলে দুলে।

এক সেকেণ্ড পর নিচ থেকে ভেসে এলো ভারি কিছু পতনের আওয়াজ। পেঁতলে গেল লিওর শরীর! সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম লিও আমার কাছে কি ছিলো। লিও নেই মনে হতেই সারা শরীর শিথিল হয়ে এলো আমার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সংবিৎ ফিরলো। শরীর টান করে দাঁড়ালাম। আকাশের দিকে তাকালাম একবার চিষ্কার করে উঠলাম, আসছি, লিও! মাথার ওপর দুহাত তুলে সাঁতারু যেভাবে পানিতে ঝাঁপ দেয় সেই ভঙ্গিতে লাফিয়ে পড়লাম কালো খাদের ভেতর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *