গল্পগ্রন্থ

লাল-চুলো সংঘ

লাল-চুলো সংঘ [দ্য রেড হেডেড লিগ]

গত বছর শার্লক হোমসের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম শরৎকালে। লাল-চুলো মোটাসোটা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিল হোমস। শুধু লালই নয়। আগুনের মতোই জ্বলজ্বলে চুলের বাহার দেখবার মতো। হঠাৎ ঢুকে পড়ার জন্যে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছি, হোমস আমাকে টেনে নিয়ে গেল ভেতরে।

বললাম, পাশের ঘরে বসি?

না।–মি. উইলসন, ডক্টর ওয়াটসন আমার সহযোগী। একে দিয়ে আপনারও কাজ হবে।

ভদ্রলোকের চর্বি-ঘেরা কুতকুতে চোখে কৌতূহলের রোশনাই দেখা গেল।

হোমস বসল। বলল, আমার কাজকারবারে তোমার উৎসাহ কম নয়। আমাকে নিয়ে অনেক কাহিনিও লিখেছ–যদিও তা অতিরঞ্জন-দুষ্ট। এর আগেও তোমাকে বলেছি, কল্পনা দিয়ে রাঙানো ঘটনা কখনোই বাস্তব ঘটনার মতো চাঞ্চল্যকর হতে পারে না।

তাতে আমার সন্দেহ আছে।

তাহলে আরও উদাহরণ হাজির করা যাক। মি. জাবেজ উইলসন একটা অসাধারণ কেস এনেছেন আজ। এর আগেও তোমাকে বলেছি, খুব অদ্ভুত আর অসাধারণ ঘটনার পেছনে বড়ো অপরাধ নাও থাকতে পারে থাকে কিন্তু এমন ব্যাপারের পেছনে যা চোখ এড়িয়ে যায় অতি সহজেই। এই যে কেসটা এখন শুনছি, এর মধ্যে অপরাধের ছায়াটুকুও দেখছি না। তা সত্ত্বেও বলব ইদানীংকালের মধ্যে এমন বিচিত্র মামলা আর হাতে আসেনি। মি. উইলসন, আপনার আশ্চর্য কেসটা আবার গোড়া থেকে বলুন। ডক্টর ওয়াটসনের শোনা দরকার।

লম্বা কোটের পকেট থেকে একটা নোংরা দলা পাকানো খবরের কাগজ বার করে বিজ্ঞাপনের স্তম্ভ দেখতে লাগলেন মি. উইলসন। ভদ্রলোক একটা ঢিলেঢালা টাইপের। পোশাক পরিচ্ছদও তাই। কারবারি ইংরেজের চেহারা যেরকম হয় আর কি। ওয়েস্টকোটে ঝুলছে তামার অ্যালবার্ট চেন, তাতে লাগানো একটা চৌকোনা ধাতু। চেহারার মধ্যে একমাত্র বৈশিষ্ট্য তাঁর আগুন-রাঙা লাল চুল, ভাবভঙ্গি বেশ অশান্ত।

দেখলাম, আমার মতো শার্লক হোমসও বিশ্লেষণী দৃষ্টি বুলিয়ে নিচ্ছে ভদ্রলোকের সর্বাঙ্গে। চোখাচোখি হতেই হাসল।

বলল, কিছুদিন ইনি মজুরের কাজ করেছেন, নস্যি নেওয়ার অভ্যেস আছে। রাজমিস্ত্রির কাজও করেছেন, চীনদেশে ছিলেন এবং এখন খুব লেখালেখি নিয়ে আছেন।

দারুণ চমকে উঠলেন জাবেজ উইলসন। কাগজে তর্জনী রেখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন হোমসের পানে।

বললেন, আশ্চর্য! আপনি জানলেন কী করে? সত্যিই তো মজুর হিসেবেই আমার কর্মজীবনের শুরু। জাহাজের ছুতোর মিস্ত্রি ছিলাম।

আপনার হাত দেখে জানলাম। ডান হাতটা বাঁ-হাতের চেয়ে বেশি মাংসল কাজের হাত কিনা।

নস্যি নিই জানলেন কী করে? অথবা রাজমিস্ত্রি ছিলাম?

আপনার ব্রেস্টপিন দেখে জানলাম আপনি রাজমিস্ত্রি ছিলেন। নস্যির ব্যাপারটা বলে আপনার বুদ্ধিকে খাটো করতে চাই না।

লেখা নিয়ে আছি বুঝলেন কীভাবে?

আপনার ডান হাতার তলার পাঁচ ইঞ্চি বেশ চকচক করছে। আর বাঁ-হাতার কনুইটা কালচে মেরে গেছে টেবিলে ভর দিয়ে থাকার দরুন।

চীনদেশে থাকাটা?

ডান কবজিতে একটা উল্কি আঁকিয়েছেন। মাছের টাট্টু। আঁশটা গোলাপি। এ-কাজ চীন দেশেই হয়। উল্কি নিয়ে আমি একটু কাজ করেছি, প্রবন্ধও লিখেছি। তা ছাড়া ঘড়ির চেনের ওই চীনে মুদ্রাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আপনি চীন ঘুরে এসেছেন।

অট্টহেসে জাবেজ উইলসন বললেন, ওঃ, এই ব্যাপার! আমি ভাবলাম না-জানি কী অসাধারণ ক্ষমতাই দেখাচ্ছেন।

অত খুলে না-বললেই ভালো হত দেখছি–সুনামটা আর রইল না পেয়েছেন বিজ্ঞাপনটা?

হ্যাঁ, এই দেখুন। যত গণ্ডগোল এই বিজ্ঞাপন থেকেই। ডক্টর ওয়াটসন, পড়ুন আপনি।

আমি পড়লাম :

যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্গত হপকিন্সের ইচ্ছাপত্র অনুযায়ী লাল-চুলো সংঘে আর একটা সদস্যপদ শূন্য হয়েছে। সামান্য কাজের বিনিময়ে হপ্তায় চার পাউন্ড মাইনে দেওয়া হবে। বয়স যার একুশের বেশি, চুলের রং লাল, তিনি আবেদনপত্র নিয়ে বেলা এগারোটায়, ফ্লিট স্ট্রিটের সাত নম্বর পোপস কোর্টে সংঘ-দপ্তরে ডানকান রসের সঙ্গে দেখা করুন।

হতভম্ব হয়ে বললাম, এ আবার কী বিজ্ঞাপন!

জোরে হেসে উঠল হোমস। বলল, তাহলেই দেখ ব্যাপারটা মামুলি নয় মোটেই। মি. উইলসন, এবার আপনার আর্থিক অবস্থাটা খুলে বলুন। ওয়াটসন, কাগজটার নাম তারিখ লিখে রাখো।

মর্নিং ক্রনিকল। তারিখটা দেখছি দু-মাস আগেকার ২৭ এপ্রিল, ১৮৯০।

বলুন মি. উইলসন।

আমার একটা বন্ধকি কারবার আছে। ছোটো কারবার। কর্মচারী মাত্র একজন–তাও হাফ মাইনের–তা না-হলে রাখতে পারতাম না।

নাম?

ভিনসেন্ট স্পলডিং। বয়স খুব কম নয়, তেমন ধড়িবাজও নয়–নইলে এই মাইনেতে পড়ে থাকে? দোষের মধ্যে ফটো তোলার বাই আছে। দিনরাত ক্যামেরা কাঁধে টো-টো করছে, ছবি তুলছে। নীচের অন্ধকার ঘরে ডেভলাপ করছে।

এখনও কাজ করছে আপনার?

তা করছে। সেইসঙ্গে একটা মেয়েও আছে। বছর চোদ্দো বয়স। সংসারের কাজ করে। কারণ আমি বিপত্নীক। বেশ ছিলাম এই তিনজনে–কিন্তু মাস দুয়েক আগে এই বিজ্ঞাপনটা এনে স্পলডিং বললে–আহারে, আমার যদি লাল চুল থাকত।

অবাক হয়ে জানতে চাইলাম ব্যাপারটা কী। ও তখন বিজ্ঞাপনটা দেখাল। বললে, লাল-চুলো লোকের আকাল পড়েছে বলেই নিশ্চয় বিজ্ঞাপন দিয়েছে অছিরা। চুলের রংটা পালটে নিতে পারলে সে নিজেই যেত। বছরে দু-শো পাউন্ড কি চাট্টিখানি কথা? অথচ আমার চুল টকটকে লাল হওয়া সত্ত্বেও ঘর থেকে নড়ছি না।

কিছুদিন ধরে কারবার ভালো চলছিল না। লাল চুলের দৌলতে দু-শো পাউন্ড রোজগারের খবর শুনে তাই লোভ হল।

বললাম, ঝেড়ে কাশশা, কী বলতে চাও?

ও তখন এই বিজ্ঞাপনটা দেখাল। বললে, তার চাইতে আপনি নিজেই পড়ে দেখুন। একজন লাল-চুলো আমেরিকান কোটিপতি একটা সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সেই লাল-চুলো সংঘ। ভদ্রলোকের নিজের মাথার চুল লাল ছিল বলে লন্ডনের সব লাল-চুলোদের জন্যে দরদ উথলে উঠেছিল। সামান্য গতর খাটিয়ে যাতে তারা দু-পয়সা পকেটে পায় সেই ব্যবস্থা করেছিলেন। টাকাটা দেওয়া হয় তার সম্পত্তির সুদ থেকে। দরখাস্ত করলেই চাকরিটা পাওয়া যাবে।

শুনে তো চক্ষু স্থির হয়ে গেল আমার, সেকী! লাখে লাখে লাল-চুলো দরখাস্ত নিয়ে ছুটবে যে।

স্পলডিং বললে, মোটেই না। প্রথম কথা বয়স কম হলে চলবে না। তারপর লন্ডনের বাসিন্দা হওয়া চাই কেননা ব্যাবসা করে টাকা কামিয়েছিলেন তিনি এখান থেকেই। তার চেয়েও বড়ো কথা হল, চুলের রং শুধু লাল হলেই চলবে না–আগুনরাঙা হওয়া চাই ঠিক আপনার চুলের মতো। দরখাস্ত করলেই কিন্তু পেয়ে যাবেন কাজটা–যদি দরকার মনে করেন।

দেখলাম, অনেক খবরই রাখে স্পলডিং। কথাটাও মন্দ বলেনি। আমার চুলের রংখানা দেখেছেন? ঠিক যেন আগুন। কাজেই সেদিন দোকান বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম ওকে নিয়ে।

গিয়ে মুণ্ডু ঘুরে গেল কাতারে কাতারে লাল-চুলো মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তবে হ্যাঁ, আমার মতো আগুন রাঙা চুল কারোরই নেই। যেদিকে দু-চোখ যায় কেবল লাল মাথা। এরই মধ্যে দিয়ে আশ্চর্য কৌশলে স্পলডিং আমাকে টেনে নিয়ে গেল সিঁড়ি বেয়ে অফিস ঘরের সামনে। সিঁড়িতেও লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল লাল-চুলোরা–কেউ কেউ মুখ কালো করে নেমে আসছে চাকরি না-পাওয়ায়।

অফিস ঘরে ঢুকে একজন লাল-চুলোকে টেবিল চেয়ার নিয়ে বসে থাকতে দেখলাম। আমার চাইতেও রাঙা চুল। প্রার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তৎক্ষণাৎ নাকচ করছে দেখে মনটা দমে গেল। কিন্তু আমার পালা আসতে বুকটা নেচে উঠল আমার প্রতি তার পছন্দ ভরা চাহনি দেখে। উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘাড় কাত করে বেশ করে দেখল আমাকে। দু-চারটে কথা জিজ্ঞেস করার পর এসে দাঁড়াল আমার সামনে। তারপর আচমকা আমার চুল খামচে ধরে এমন হ্যাচকা টান মারল যে চেঁচিয়ে মেচিয়ে চোখে জল এনে ফেললাম। ভদ্রলোক লজ্জিত হয়ে বললে, কিছু মনে করবেন না–নকল চুল কিনা দেখে নিলাম। দু-বার ঠকেছি কিনা—রং করা চুল নিয়েও এসেছে অনেকে।

এই বলে জানলার সামনে নিয়ে হেঁকে বললে, লোক পাওয়া গেছে–চাকরি আর খালি নেই। হতাশ হয়ে সরে পড়ল লাল-চুলোরা।

ভদ্রলোক বলল, আমি এখানকার ম্যানেজার। নাম ডানকান রস। আপনি কী করেন?

সামান্য একটা ব্যাবসা, বললাম আমি।

স্পলডিং বলে উঠল, সে-কাজ আমি আপনার হয়ে করে দিতে পারব, মি. উইলসন।

এখানকার কাজ ক-টায়?

দশটা থেকে দুটো।

ভেবে দেখলাম, বন্ধকি কারবার চলে সাধারণত সন্ধের দিকে সকালের দিকে আমার কোনো কাজই নেই। সেই ফাঁকে বাড়তি পয়সা স্বচ্ছন্দে রোজগার করতে পারব। ব্যাবসাটা

স্পলডিং দেখতে পারবে।

বললাম, আমি রাজি। কত মাইনে?

হপ্তায় চার পাউন্ড।

কাজটা কী?

খুবই সামান্য। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা দেখে স্রেফ নকল করে যাওয়া। কালি কলম কাগজ সব আপনি নিয়ে আসবেন। কিন্তু ঘর ছেড়ে একদম বেরোতে পারবেন না–কোনো অছিলাতেই নয়–অসুখবিসুখ বা হঠাৎ কাজের চাপেও ড়ুব মারা চলবে না–তাহলেই জানবেন চাকরিটা যাবে। শর্তটা পরিষ্কারভাবে লেখা আছে উইলে। বলুন, পারবেন কাল থেকে আসতে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

বিদায় জানিয়ে স্পলডিংকে নিয়ে আনন্দে প্রায় নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এলাম আমি।

বাড়ি ফিরে কিন্তু সাত পাঁচ ভাবতে গিয়ে মনটা আবার মুষড়ে পড়ল। জোচ্চোরের পাল্লায় পড়লাম কি? সামান্য এই কাজের জন্য এত টাকা কেউ দেয়? স্পলডিং অবশ্য সমানে উৎসাহ জুগিয়ে চলল আমাকে।

পরের দিন কাগজ কলম কালি নিয়ে গেলাম সংঘের দপ্তরে। ডানকান রস হাজির ছিল। আমাকে Aঅক্ষর থেকে শব্দকোষ কপি করতে বসিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু মাঝে মাঝে এসে দেখে গেল ঠিকঠাক কাজ করছি কি না। ছুটি দিল ঠিক দুটোর সময়।

শনিবারে পেলাম চারটে পাউন্ড। একদিনের জন্যেও কামাই না-করে প্রতিদিন দশটা থেকে দুটো হাজিরা নিয়ে চললাম দপ্তরে। ডানকান রস ক্রমশ আসা কমিয়ে ছিল। রোজ একবার আসাও শেষকালে বন্ধ হয়ে গেল। আমি কিন্তু প্রতিদিন দশটা থেকে দুটো পর্যন্ত নকলনবিশি চলিয়ে গেলাম স্রেফ টাকার লোভে। কী জানি বাবা, একদিন না-এলে যদি টাকাটা খোয়া যায়।

এইভাবে গেল আটটা সপ্তাহ। A প্রায় শেষ করে এনেছিলাম। এমন সময়ে আচমকা শেষ হয়ে গেল ব্যাপারটা।

আজ সকালে কাজে গিয়ে দেখি দরজায় তালা দেওয়া। এই পিচবোর্ডটা ঝুলছে পাল্লায়।

চৌকানা একটা পিচবোর্ড এগিয়ে দিলেন জ্যাবেজ উইলসন। আকারে নোটবইয়ের চাইতে বড়ো নয়। তাতে লেখা :

লাল-চুলো সংঘ
উঠে গেল
অক্টোবর ৯, ১৮৯০

জাবেজ উইলসনের মুখের চেহারা দেখেই আমি আর হোমস কেউই হাসি সামলাতে পারলাম না। যাকে বলে অট্টহাসি, তাই হেসে উঠলাম।

একে তো ওইরকম লাল চুল ভদ্রলোকের, তার ওপর আমাদের ছাদ কাপানো অট্টহাসি শুনে যেন আরও লাল হয়ে গেল চুলের গোড়া পর্যন্ত।

চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে রক্তিম মুখে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি, আমার দুর্দৈব দেখে এত মজা পাবেন আপনারা বুঝিনি।

হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল হোমস। বলল, আপনার কেস আমি নিলাম। দরজায় এই পিচবোর্ডটা দেখবার পর কী করলেন এবার বলুন!

নীচের তলায় বাড়িওয়ালা থাকেন। তার কাছে গিয়ে রক্তকেশ সংঘের নাম করতে তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। ডানকান রস নামটাও নাকি জীবনে শোনেননি। কিন্তু লাল-চুলো চেহারার বিবরণ দিতেই চিনলেন। বললেন, সলিসিটর ভদ্রলোকের কথা বলছেন তো? ওঁর নাম তো উইলিয়াম মরিস। নিজের অফিস গুছোনো না-হওয়া পর্যন্ত আমার অফিসে ছিলেন। কালকেই চলে গেছেন। ১৭ নম্বর কিং এডওয়ার্ড স্ট্রিটের অফিসে গেলেই দেখা পাবেন।

গেলাম সেখানে। গিয়ে আবার বোকা বনলাম। ঠিকানায় একটা কারখানা আছে। উইলিয়াম মরিস বা ডানকান রসের নামও কেউ শোনেনি। বাড়ি ফিরে স্পলডিংকে সব বললাম। ও বললে, দেখাই যাক না দু-দিন সবুর করে। নিশ্চয় চিঠিতে খবর আসবে। কিন্তু তাতে আমার কী লাভ বলুন? চাকরিটা তো আর পাব না। তাই ভাবলাম আপনার বুদ্ধি নিতে আসি গরিব দুঃখীদের অনেক সাহায্য আপনি করেন জানি।

বেশ করেছেন। ব্যাপারটা কিন্তু যত সহজ ভাবছেন তত সহজ নয়। বেশ গুরুত্ব আছে।

তা তো আছেই। হপ্তায় চার পাউন্ড কি চাট্টিখানি কথা। কিন্তু কথা হচ্ছে আমার পেছনে বত্রিশটা পাউন্ড খরচ করে এই ঠাট্টাটা করার কী দরকার ছিল?

স্পলডিং লোকটা আপনার কাছে কদ্দিন কাজ করছে?

মাসখানেক।

ওকে কাজে নিলেন কীভাবে?

বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। অনেকেই এসেছিল। ওর চাহিদা দেখলাম সবচেয়ে কম।

সস্তায় কিস্তি মেরেছেন বলতে পারেন। চেহারা কীরকম স্পলডিংয়ের?

মাথায় খাটো, গাঁট্টাগোট্টা। তড়বড়ে। পরিষ্কার গাল। বয়স বছর তিরিশ। কপালে একটা সাদা দাগ–অ্যাসিডে পুড়ে গিয়েছিল।

সিধে হয়ে বসল হোমস। কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পেল উত্তেজনা, ঠিক ধরেছি। দু-কানের লতিতে কি ফুটো আছে?

আছে। ছেলেবেলায় নাকি একজন বেদে জোর করে কান বিঁধিয়ে দিয়েছিল।

গম্ভীর হয়ে গেল হোমস, এখন সে কোথায়?

আমারই ডেরায়।

হুম। আজ শনিবার। আশা করছি সোমবারের মধ্যেই কিছু একটা করতে পারব।

বিদেয় হলেন জাবেজ উইলসন।

হোমস বললে, ওয়াটসন, কী বুঝলে বললো।

কিস্‌সু না। দারুণ ধোঁয়াটে।

যে-মামলা বেশি ধোঁয়াটে মনে হয়, তাতেই বরং ধোঁয়া কম থাকে। কিন্তু যা একেবারেই সাদাসিদে, রহস্য তাতেই বেশি।

মতলব কী তোমার?

আপাতত তামাক খাওয়া। পরপর তিন পাইপ তামাক না-খাওয়া পর্যন্ত একদম কথা বলব। বলে চেয়ারের ওপর পা তুলে পাইপ কামড়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। ভাবলাম বুঝি ঘুমিয়ে পড়ল। ঢুলুনি আমারও এল। তারপরেই চমকে উঠলাম ওর লাফিয়ে ওঠায়।

পাইপ নামিয়ে বললে, চলো, ঘণ্টা কয়েক সেন্ট জেমস হলে বাজনা শুনে আসা যাক। সময় হবে?

নিশ্চয়।

তবে চলো। বেরিয়ে পড়া যাক। প্রােগ্রামে দেখছি অবশ্য জার্মান বাজনাই বেশি। ফরাসি বা ইটালিয়ান বাজনার চেয়ে ভালো। নিজেকে হারিয়ে ফেলা যায়–এখন যা দরকার।

হোমস কিন্তু বাজনার আসরে আগে গেল না–গেল স্যাক্স কোবার্গ স্কোয়ারে। ভারি অপরিচ্ছন্ন অঞ্চল। কোণের বাড়িটায় বোর্ডে লেখা জাবেজ উইলসনের নাম। লাল-চুলো মক্কেলের বন্ধকি দোকান নিশ্চয়। চোখ কুঁচকে চেয়ে রইল হোমস সেইদিকে। তারপর দু-পাশের ইটের বাড়িগুলো দেখতে দেখতে এল মোড় পর্যন্ত। ফের ফিরে এল দোকানের সামনে। জোরে জোরে দু-তিনবার লাঠি ঠুকল দরজার কাছে। অমনি খুলে গেল দরজা। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বুদ্ধিদীপ্ত এক পুরুষ, দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।

বললে, আসুন।

ধন্যবাদ। স্ট্র্যান্ডে যাওয়ার রাস্তাটা বলতে পারেন? শুধোয় হোমস।

পথের হদিশ বলে দিয়ে দুম করে দরজা বন্ধ করে দিলে লোকটা।

হোমস বললে, দেখলে তো কীরকম চটপটে? এ-রকম স্মার্ট লোক লন্ডনে আছে আর তিনজন। বুকের পাটার দিক দিয়ে এ কিন্তু তিন নম্বর।

রাস্তা জানতে চাইলে কেন? চেহারাটা দেখবার জন্যে তো?

না, না।

তবে?

ট্রাউজার্সের হাঁটুটা দেখলাম।

তাই নাকি! কী দেখলে হাঁটুতে?

যা দেখব বলে এসেছিলাম।

মেঝেতে লাঠি ঠুকলে কেন?

এখন দেখবার সময় ওয়াটসন, কথা বলার সময় নয়। এদিকের রাস্তা দেখা হয়েছে, চলো এবার পেছনে যাই।

পেছনের রাস্তা কিন্তু জমজমাট পথচারী আর যানবাহনের ভিড়ে। স্যাক্স কোবার্গ স্কোয়ারের নির্জনতার ঠিক বিপরীত। দু-পাশে সারি সারি ঝলমলে দোকান।

তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইল হোমস। যেন আপন মনেই বললে, তামাকের দোকানের পরেই খবরের কাগজের দোকান; ব্যাঙ্কের পরেই রেস্তোরাঁ; তারপর বাড়ির কারখানা। চলো ওয়াটসন। এখানকার কাজ শেষ। এবার একটু চোখ বুজে তন্ময় হয়ে বাজনা শোনা যাবে।

হোমস ভালো বেহালা বাজাতে পারে, ভালো বাজনা শুনতেও ভালোবাসে। নতুন নতুন সুর তুলতে তার উৎসাহের অন্ত নেই। বাজনার আসরে বসে সে যেন অন্য মানুষ হয়ে গেল। সত্যিই নিজেকে হারিয়ে ফেলল গানের জগতে। তীক্ষ্ণ্ণবুদ্ধি রহস্যসন্ধানী বলে তখন তাকে আর মনেই হল না। এই সময়টাই কিন্তু শত্রুশিকারের পক্ষে মাহেন্দ্রক্ষণ। অসাধারণ বিশ্লেষণী শক্তি খাপখোলা বাঁকা তরবারির মতোই রহস্যকে কচুকাটা করে লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে যায় এহেন অলস মুহূর্তে! ওর চরিত্রের এই দ্বৈত রূপ আমি দেখেছি বলেই বুঝলাম শত্রুপক্ষের কপাল পুড়তে আর দেরি নেই।

বাজনা শেষ হল। রাস্তায় বেরিয়ে হোমস বললে, ডাক্তার, কেসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ–গুরুত্বটা বেড়েছে আজকে শনিবার হওয়ায়। সাংঘাতিক চক্রান্ত চলেছে এই কোবার্গ স্কোয়ারে। আমাকে একটু অন্য জায়গায় যেতে হবে কিন্তু আজ রাত্রে তোমার সাহায্যও দরকার। আসবে?

ক-টায়?

এই ধর দশটায়?

আসব–বেকার স্ট্রিটে দেখা হবে।

সঙ্গে মিলিটারি রিভলভারটা এনো দরকার হতে পারে। বলেই সাঁৎ করে মিলিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।

শার্লক হোমসের তুলনায় আমি যে কত নির্বোধ, সে প্রমাণ বারে বারে পেয়েছি। লাল-চুলো সংঘের বিচিত্র কাণ্ডকারখানার আমি যা জানি, সে-ও তা জানে; আমি যা দেখেছি, সে-ও তা দেখেছে। তা সত্ত্বেও হোমস জেনে ফেলেছে একটা ঘোর ষড়যন্ত্র চলছে এখানে এবং এমনই বিপদের সম্ভাবনা আছে যে পিস্তল পর্যন্ত সঙ্গে রাখতে হচ্ছে। অনেক ভেবেও কুলকিনারা করতে পারলাম না হেঁয়ালির হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম।

যথাসময়ে গেলাম বেকার স্ট্রিটের বাড়িতে। দেখি ঘরে হাজির হয়েছেন একজন পুলিশ ইনস্পেকটর আর একজন দামি পোশাক পরা বিষন্ন ভদ্রলোক। প্রথম জনকে আমি চিনি—স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা। নাম, পিটার জোন্স। দ্বিতীয়জন অপরিচিত।

পরিচয় করিয়ে দিল হোমস। ভদ্রলোকের নাম মি. মেরিওয়েদার। নৈশ অভিযানে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন।

ব্যাজার মুখে মি. মেরিওয়েদার কিন্তু গজগজ করতে লাগলেন, নিয়ে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু পণ্ডশ্রম হবে। সাতাশ বছরে এই প্রথম শনিবারের তাস খেলাটা হল না আমার।

হোমস বললে, তাসের চাইতেও বেশি বাজি জিতবেন আজ রাতে তিরিশ হাজার পাউন্ড কি কম হল? আর মি. জোন্স পাবেন একজনকে যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন দীর্ঘদিন।

সে আবার কে?

তার নাম জন ক্লে। মানুষ খুন বলুন, কি চুরিচামারি বলুন, ডাকাতিই হোক কি জালিয়াতি হোক–সব বিদ্যেতেই সে তুখোড়। বয়স কম, রাজবংশের ছেলে। উচ্চশিক্ষা পেয়েছে, কিন্তু নীচ পেশায় রপ্ত হয়েছে। আজ রাতেই তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব আপনার। চলুন এবার বেরোনো যাক। বলে শিকারের চাবুক নিয়ে পা বাড়াল সিঁড়ির দিকে।

পথে নেমে দুটো গাড়িতে উঠলাম চারজনে। আমি আর হোমস রইলাম পেছনের গাড়িতে। বেশ কিছুক্ষণ মনের আনন্দে নানারকম সুর ভেজে চলল গোয়েন্দা বন্ধু।

তারপর বললে, এসে গেছি। শোনো ওয়াটসন, এই মেরিওয়েদার লোকটা একটা ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর। আজকের অভিযানে ওঁর থাকা দরকার ওঁর নিজের স্বার্থে। জোন্সকে সঙ্গে নিলাম ওর বুলডগের মতো জেদ আর সাহসের জন্যে।

দিনের আলোয় ঝলমলে যে দোকান পসারির সামনে দিয়ে গিয়েছিলাম, সেই রাস্তায় নামলাম গাড়ি থেকে। মি. মেরিওয়েদার আমাদের একটা সরু গলির মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়ে ছোট্ট দরজা খুলে ভেতরে ঢোকালেন। সেখান থেকে করিডর পেরিয়ে লোহার ফটক খুলে ঘোরানো পাথরের সিঁড়ি বেয়ে মাটির তলায় নামলেন। লোহার দরজা পেরিয়ে কিছুদূর গিয়ে ঢুকলেন একটা পাতাল ঘরে–ঘরভরতি কেবল বড়ো বড়ো কাঠের বাক্স।

আসবার পথে একটা লণ্ঠন জ্বেলে এনেছিলেন মেরিওয়েদার। সেইটা মাথার ওপর তুলে হোমস বললে, বিপদটা ওপর থেকে আসছে না।

নীচ থেকেও আসবে না, বলে ঠক ঠক করে মেঝেতে লাঠি ঠুকলেন মি. মেরিওয়েদার। চমকে উঠলাম সঙ্গেসঙ্গে, আরে সর্বনাশ! মেঝেটা ফাঁপা মনে হচ্ছে না?

রেগে গেল হোমস। বললে, ঘাটে এসে তরী ড়ুববে দেখছি আপনার জন্যে। দয়া করে বাগড়া না-দিয়ে বাক্সের ওপর উঠে বসবেন?

মি. মেরিওয়েদারের মুখ লাল হয়ে গেল। গম্ভীর মুখে একটা কাঠের বাক্সে উঠে বসে রইলেন।

হোমস তখন লণ্ঠন আর আতশকাচ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেঝের ওপর। অনেকক্ষণ ধরে পাথরের জোড় পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়াল হৃষ্টচিত্তে।

বললে, হাতে এখনও ঘণ্টাখানেক সময় আছে। জাবেজ উইলসন ঘুমিয়ে কাদা না-হওয়া পর্যন্ত ওরা কাজে নামবে না। ওয়াটসন, কোথায় দাঁড়িয়ে আছ বুঝেছ তো? ব্যাঙ্কের ভল্ট এটা–মি. মেরিওয়েদার এই ব্যাঙ্কের সর্বময় কর্তা। লন্ডনের ডাকসাইটে ক্রিমিনালরা হঠাৎ এই ভল্ট নিয়ে কেন উঠে পড়ে লেগেছে উনিই ভালো বলতে পারবেন।

মি. মেরিওয়েদার খাটো গলায় বললেন, সোনার জন্যে।

সোনা?

হ্যাঁ, ফরাসি সোনা। ব্যাঙ্ক অফ ফ্রান্স থেকে আনিয়ে এই ভল্টে রাখা হয়েছে আর্থিক অবস্থা ভালো করার জন্যে। আনা হয়েছে মাসখানেক আগে, এখনও রয়ে গেছে এইসব বাক্সের মধ্যে। আমি যে-বাক্সে বসে, এর মধ্যেও সিসের পাত দিয়ে মুড়ে সোনা রাখা আছে। এত সোনা কোনো ব্যাঙ্কে থাকে না–নেইও।

হোমস বললে, ব্যাঙ্কের আড়ালে লুকিয়ে থাকুন প্রত্যেকে ওরা বেপরোয়া আমাদেরও তৈরি থাকতে হবে সেইভাবে। আপাতত আমি লণ্ঠনে ঢাকা দেব, ঘর অন্ধকার করব। কিন্তু আলো ফেলবার সঙ্গেসঙ্গে বেরিয়ে পড়বেন আড়াল থেকে।ওয়াটসন, যদি দেখ গুলি চালাচ্ছে, নির্দ্বিধায় তুমিও গুলি চালাবে।

রিভলভার বার করে কাঠের বাক্সের ওপর রেখে আড়ালে বসে পড়লাম আমি। হোমস ঘর অন্ধকার করে দিল লণ্ঠনে ঢাকা দিয়ে। সে কী অন্ধকার! পাতালঘর বলেই যেন আরও বেশি অন্ধকার। কোনো ভাষায় সে-অন্ধকারের বর্ণনা করা যায় না। তেলপোড়া গন্ধটা নাকে ভেসে আসায় বুঝলাম বাতি এখনও জ্বলছে, সময়মতো আলো দেখা যাবে।

ফিসফিস করে হোমস বললে, এদিকে তাড়া খেয়ে পালালে বেরোবার পথ কিন্তু একটাই–স্যাক্স কোবার্গের সেই বাড়ি। মি. জোন্স, যা করতে বলেছি করেছেন তো?

নিশ্চয়। একজন ইনস্পেকটর দুজন চৌকিদার নিয়ে পাহারা দিচ্ছে সেখানে।

চমৎকার। সব পথ বন্ধ। এবার শুধু প্রতীক্ষা।

প্রতীক্ষা বলে প্রতীক্ষা! ওত পেতে ছিলাম মাত্র সওয়া একঘণ্টা। কিন্তু তখন মনে হয়েছিল যেন পুরো রাতটাই কাবার হয়ে গেল। ঘর নিস্তব্ধ। ফলে প্রত্যেকের বুকের খাঁচায় সচল হৃদযন্ত্রের আওয়াজ ঘরের মধ্যে যেন ধুপধাপ শব্দে শোনা যাচ্ছে। একে তো অন্ধকার, তার ওপর উৎকণ্ঠা–স্নায়ুর অবস্থা চরমে পৌঁছেছে। হঠাৎ একটা রোশনাই দেখা গেল মেঝেতে।

সামান্য একটা আলোর রেখা। অতি ক্ষীণ। পাথরের জোড় ভেদ করে আলোক রশ্মি অন্ধকারের বুকে প্রকট হয়ে উঠল। এতটুকু শব্দ শোনা গেল না কিন্তু হলদেটে আলোর পরিধি বেড়েই চলল–দেখা গেল একটা গর্ত। মেয়েলি হাতের মতো একটা সাদা হাত বেরিয়ে এল সেই ফুটো দিয়ে। মিনিট খানেক বাদে হাতটা অদৃশ্য হল পাতালে। তার কিছু পরেই সশব্দে উলটে পড়ল একটা বড় সাইজের পাথর। চৌকোনা গর্ত দিয়ে ঠিকরে এল লণ্ঠনের আলো। বাচ্চা ছেলের মুখের মতো একটা মুখ উঁকি দিল সেই গর্ত দিয়ে। এদিক-ওদিক জুলজুল করে তাকিয়ে হাঁচড়পাঁচড় করে উঠে এল মেঝেতে–টেনে তুলল আর একজন হালকা চেহারার পুরুষকে–এর চুল টকটকে লাল রঙের।

বাতাসের মতো সুরে বললে শেষােক্ত ব্যক্তি, বেলচা আর থলি দাও–আরে সর্বনাশ! পালাও, পালাও, আর্চি–লাফিয়ে পড়ো গর্তে।

কিন্তু পালানোর আর সময় কোথায়? বাঘের মতো লাফিয়ে গিয়ে তার জামার কলার খামচে ধরল শার্লক হোমস। রিভলভারের নল ঝলসে উঠতেই সপাং শব্দে চাবুক হাঁকড়াতেই ঠিকরে গেল রিভলভার। পড়-পড় আওয়াজ হল। আর্চির জামা ছিড়ে যাওয়ায় জোন্সের হাত ফসকে গর্তে লাফিয়ে পড়েছে সে।

শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে হোমস বললে, জন ক্লে, তোমার খেল খতম হয়েছে–এবার ক্ষ্যামা দাও।

কিন্তু আমার দোস্তকে তো ধরতে পারেননি, ততোধিক শান্ত কণ্ঠে বললে লাল-চুলো লোকটা। তার জামার খানিকটা কাপড়ই কেবল পেয়েছেন।

তার জন্যে সুড়ঙ্গের ও-মুখে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন–কিচ্ছু ভেবো না।

বাঃ। চমৎকার নিখুঁত কাজ হয়েছে দেখছি।

তা হয়েছে, তোমারটাও কম নিখুঁত হয়নি। লাল-চুলোর আইডিয়া সত্যিই প্রশংসার করার মতো!

জোন্স বললে, বন্ধুর জন্যে মন কেমন করছে তো? শিগগিরই দেখা হয়ে যাবে। এবার এসো দিকি বাছাধন, হাতকড়াটা লাগিয়ে দিই।

খবরদার! খ্যাক করে ওঠে জন ক্লে। মনে রাখবেন আমার গায়ে রাজরক্ত আছে। ননাংরা হাতে ছোঁবেন না আমাকে। ততক্ষণ কবজিতে লেগে গেছে হাতকড়া। তা সত্ত্বেও তড়পানি কমল না জন ক্লে-র–বাজে কথা একদম বলবেন না। হুজুর বলে ডাকবেন। সবসময়ে দয়া করে কথাটা বলবেন।

তাই ডাকব হুজুর, মুচকি হেসে বললে জোন্স, এখন দয়া করে উঠে আসুন, থানায় যেতে হবে যে।

বাঃ, এই তো চাই, বসে বাতাসে মাথা ঠুকে আমাদের সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে জোন্সের পেছন পেছন বেরিয়ে গেল জন কে।

গদ গদ কণ্ঠে মেরিওয়েদার বললেন, মি. হোমস আপনি যে আমাদের কী উপকার করলেন! ব্যাঙ্ক লুঠের এ-রকম আশ্চর্য চেষ্টা আজ পর্যন্ত হয়নি। শুধু আপনার জন্যেই বানচাল হয়ে গেল ওদের ষড়যন্ত্র।

হোমস বললে, জন ক্লে-র সঙ্গে আমার একটু বোঝাঁপড়া বাকি ছিল–তাই তা চুকিয়ে নিলাম। এতে আমার কিছু খরচপত্র হয়েছে। ব্যাঙ্ক থেকে তা দিয়ে দিলে বাধিত হব। আমার সবচেয়ে বড়ো লাভ কিন্তু লাল-চুলো সংঘের এই অসাধারণ মামলার সুরাহা করা।

পরের দিন সকাল বেলা বেকার স্ট্রিটের ঘরে বসে মদ্যপান করতে করতে হেঁয়ালি ব্যাখ্যা করল শার্লক হোমস।

বলল, লাল-চুলো সংঘের বিচিত্র বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে শব্দকোষ নকলের অছিলায় রোজ চার ঘন্টা একটা ঘরে বসিয়ে রাখার একটাই উদ্দেশ্য নিজের বাড়ি থেকে মাথামোটা বন্ধকি কারবারিকে সরিয়ে রাখা। চার পাউন্ডের লোভ বড়ো কম নয়। জাবেজ উইলসনের মাথার লাল চুল দেখেই আইডিয়াটা মাথায় আসে শয়তানদের। দুজনে মিলে বড়ো করে লাল-চুলো সংঘের নাম করে বেচারিকে সরিয়ে রাখল বাড়ির বাইরে।

কিন্তু কেন? আর্থিক অবস্থা তার ভালো নয়, কারবারও ছোটো, কাজেই বাড়ির মধ্যে তেমন ধনদৌলত নেই। সোমত্ত মেয়েও নেই যে প্রেম করার জন্যে বাড়ির মালিককে বাড়ি থেকে সরাতে হবে। তাহলে নিশ্চয় আসল কাণ্ডটা ঘটছে অন্য কোথাও। ষড়যন্ত্র চলছে এই বাড়িতেই। তারপর যখন শুনলাম, মাটির তলার ঘরে ফটো ডেভলাপ করতে যায় কর্মচারী—তখনই রহস্য-তিমিরে আলো দেখতে পেলাম। চেহারার বর্ণনা শুনেই বুঝলাম লন্ডনের বড়ো অপরাধীদের মধ্যে সে-ও একজন। দু-মাস ধরে রোজ চার ঘণ্টা হিসেবে মাটির তলার ঘরে সে কী করেছে? নিশ্চয় সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে অন্য বাড়িতে যাওয়ার জন্যে।

অকুস্থলে পৌঁছে লাঠি ঠুকে দেখলাম সুড়ঙ্গটা বাড়ির সামনে না পেছনে। সামনে যে নয়, নিরেট আওয়াজ শুনেই বুঝলাম। কর্মচারী বেরিয়ে আসতেই দেখলাম হাঁটুতে মাটি লেগে কি না। সত্যিই লেগে আছে–ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটু গেড়ে বসে মাটি খুঁড়লে প্যান্টের যা অবস্থা, অবিকল তাই। আমরা কেউ কাউকে চাক্ষুষ দেখিনি বলেই এই ঝুঁকিটা নিলাম।

বাড়ির পেছনে গিয়ে দেখলাম রাস্তা পেরোলেই ব্যাঙ্ক। তখন আর কোনো সন্দেহই রইল না। তোমাকে বাড়ি পাঠিয়ে সোজা গেলাম স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর ব্যাঙ্ক ডিরেক্টরের কাছে।

কিন্তু জানলে কী করে যে সেইদিনই ওরা আসবে?

সংঘ তুলে দেওয়ার নোটিশ দেখে। অর্থাৎ জাবেজ উইলসনকে বাড়ি থেকে সরিয়ে রাখার দরকার নেই–সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়ে গেছে–এবার সোনা লুঠ করা দরকার। এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল। সেদিক দিয়ে শনিবার প্রশস্ত সময়–কেননা পালাবার জন্যে দুটো দিন হাতে পাওয়া যাবে। ওইসব ভেবেই শনিবারের ফাঁদ পাতলাম।

চমৎকার! এ যে দেখছি যুক্তির শেকল–ফাঁক নেই কোথাও ! বললাম সোচ্ছ্বাসে।

হাই তুলে হোমস বললে, এসব মামলা হাতে নিলে একঘেয়েমি থেকে বাঁচা যায়। এইটাই আমার বড়ো লাভ।

সেইসঙ্গে মানুষ জাতটারও কত মঙ্গল হল বল তো?

তা হয়তো হল, তবে মানুষের চেয়েও বড়ো হল তার কীর্তি–যা থেকে যাবে।

 

—————-

টীকা

১. লাল-চুলো সংঘ : দ্য রেড-হেডেড লিগ প্রথম প্রকাশিত হয় অগাস্ট ১৮৯১-এর স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে।

২. গত বছর : প্রথম প্রকাশের হিসেবে ১৮৯০ সাল। সেই সময়ে শুধুমাত্র আ স্টাডি ইন স্কারলেট এবং দ্য সাইন অব ফোর প্রকাশিত হয়েছে।

৩. অ্যালবার্ট চেন : পকেট ঘড়ি আটকানোর চেন। ইংলন্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী, প্রিন্স অ্যালবার্ট এই ধরনের চেন ব্যবহার করতেন। তাঁর নাম থেকেই চেনের নামকরণ।

৪. ফ্লিট স্ট্রিট : লন্ডনের এই ব্যস্ত রাস্তায় বহু সংবাদপত্র এবং প্রকাশন সংস্থার দপ্তর এখনও বিদ্যমান। সংবাদপত্রের জন্য এই রাস্তার খ্যাতি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে।

৫. মর্নিং ক্রনিকল : এই নামের সংবাদপত্রটি ১৮৬০ সাল নাগাদ দেউলিয়া ঘোষিত হয়ে উঠে যায়। সেক্ষেত্রে ত্রিশ বছর পরে লেখা নামটি কাল্পনিক।

৬. দু-মাস আগেকার : এই সময়কাল যে সম্পূর্ণ অবাস্তব, একটু পরেই তা বোঝা যাবে।

৭. বন্ধকি কারবার : ভিক্টোরীয় যুগে এবং তার কিছুকাল পরও ইংলন্ডে বন্ধকি কারবারের যথেষ্ট রমরমা ছিল। সমাজের প্রায় সব শ্রেণির মানুষ নিজেদের দামি জিনিস বন্ধক রেখে টাকা ধার করত এই ধরনের দোকান থেকে।

৮. কাগজ কলম কালি নিয়ে গেলাম : যারা সপ্তাহে চার পাউন্ড মাইনে দিতে পারে, তারা কেন যে কাগজ কলম কালি জোগাতে পারল না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কিছু সমালোচক।

৯. অক্টোবর ৯, ১৮৯০ : ওপরের ৬নং টীকা দ্রষ্টব্য। উইলসন কাজে লেগেছিলেন ২৯ এপ্রিল। কাজ করেছেন আট সপ্তাহ। তাহলে অক্টোবর মাসে প্রায় সাড়ে চোদ্দো সপ্তাহের হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না।

১০. সলিসিটর : সলিসিটররা আইন ব্যাবসা করতেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট বা জাস্টিস অব দ্য পিস-এর ওপরের কোনো আদালতে তারা সওয়াল করতে পারতেন না।

১১. উইলিয়াম মরিস : এই গল্প যখন প্রকাশিত হয়, সেই সময়ে লন্ডনে উইলিয়াম মরিস (১৮৩৪-১৮৯৬) নামে এক খ্যাতনামা সমাজবাদী নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন কবি, চিত্রকর এবং ব্যবসায়ী।

১২. স্যাক্স কোবার্গ স্কোয়ার : লন্ডনে এই নামে আদৌ কোনো রাস্তা বা এলাকা নেই।

১৩. স্ট্যান্ড : টেমস নদীর তটরেখা বরাবর লন্ডন শহর থেকে ওয়েস্ট এন্ড পর্যন্ত বিস্তৃত রাস্তা। এই রাস্তা এবং সাদাম্পটন স্ট্রিটের সংযোগস্থলে অবস্থিত ছিল স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের কার্যালয়।

১৪. স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড : লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তর ৪, হোয়াইট হল প্লেস ছিল স্কটল্যান্ডের রাজপরিবারের সম্পত্তি। ইংলন্ড ও স্কটল্যান্ডের সংযুক্তিকরণের আগে স্কটল্যান্ডের রাজপ্রতিনিধি বা দূত এই সম্পত্তি ব্যবহার করতেন।

১৫. পিটার জোন্স : দ্য সাইন অব ফোর উপন্যাসে অ্যাথলেনি জোন্স নামের এক গোয়েন্দার উল্লেখ পাওয়া যায়।

১৬. সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে : অতখানি লম্বা সুড়ঙ্গ খুঁড়তে যে মাটি বেরোল, সেগুলি কোথায় রাখা হল তার ব্যাখ্যা কিন্তু পাওয়া যায়নি।

১৭. সোনা লুঠ : ব্যাঙ্কের ভল্টে রাখা সোনার ওজন কিছু কম ছিল না, সুড়ঙ্গ দিয়ে অত সোনা সরানো এবং তারপর সেগুলি অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার কী ব্যবস্থা চোরেরা করেছিল, তাও অজানা রয়ে গিয়েছে।