ক্যাসিনো রয়্যাল

ক্যাসিনো রয়্যাল — জেমস বন্ড

সিক্রেট এজেন্ট

ভোর তিনটে নাগাদ ধোয়া আর ঘামের গন্ধে ক্যাসিনোর জুয়ার আড্ডা অসহ্য হয়ে ওঠে। লোভ, আশংকা আর উত্তেজনা জুয়াড়ীর নিত্যসঙ্গী–বিশেষ করে টাকার অংকটা যদি বেশি হয়। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা যেমন আত্মার তৃপ্তি ঘটায় না তেমনি শারীরিক দিক থেকেও পীড়াদায়ক।

জেমস বন্ড এই সময় অনুধাবন করলেন শরীর ও মন দুই-ই অসাড়। এর পর কাজে ইস্তফা দেবেন ঠিক করলেন। এর পরেও খেলতে থাকলে মাথা কাজও করে না বরং ভুল হয় সব থেকে বেশি।

রুলেত-এর টেবিল থেকে সন্তর্পণে উঠে পড়ল। ভিতরের ঘরে তখনো খেলা চলছে। ল্যশিফ জিতে চলেছে। বন্ড লক্ষ্য করল সেই মুখ। কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ড সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

ক্যাশের চারপাশে উঁচু বেড়া, একজন তোক দাঁড়ালে তার থুতনি অবধি পৌঁছায়। টুলে বসে ক্যাশিয়ার। তার কাছে রাখা থাকে থাক-করা চাকতি আর নোট। সেগুলো এমনভাবে রাখা যে বেড়া টপকে সেগুলো নিয়ে আবার বেড়া পার হয়ে পালানো কঠিন।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে বন্ড দশ হাজার আর এক লাখ ফ্রাঙ্কের নোটের তাড়াগুলো ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে নিচ্ছিল। সেই সঙ্গে তার মনের মণিকোঠায় ভেসে চলেছে এক ছবি–আগামীকাল ক্যাসিনো কমিটির মিটিং। মিটিং রোজই বসে। মসিয়ো ল্যশিফ জিতেছেন দুলাখ। যেমনভাবে রোজ খেলেন সে পদ্ধতিতে। মিস ফেরার চাইল্ড এক ঘণ্টার মধ্যে দশ লাখ জিতে যান। বেশ মাথা ঠাণ্ডা রেখেই তিনি খেলছিলেন। ভাই কাউন্ট দ্য ভিলোরা রুলেতে জেতেন দশ লাখ। তিনি অবশ্যই ভাগ্যবান। তারপর আসছেন ইংরেজ ভদ্রলোক মিস্টার দুদিনে, তিনি জিতেছেন তিরিশ লাখ। পাঁচ নম্বর-টেবিলে লানা খেলছিলেন প্রথমটার থেকে পরেরটা বেশি বাজি ধরে। শেফ দ্য পার্টি ডুক লোমের কাছে বিস্তারিত বিবরণ আছে। লোকটি লেগে থাকতে জানে ও সবসময় চড়া বাজি ধরে। কপাল ভাল লোকটির। সন্ধ্যার খেলায় শনা দ্য ফেরে উঠেছে এত, বাকরাতে হয়েছে এত আর রুলেতে হয়েছে এত। রুলে বেশি লোকে যাচ্ছে না, কোনমতে খরচ উঠছে।

এরপর ধন্যবাদ বিনিময় করে সভা ভঙ্গ হল। সুইং ডোর ঠেলে বাইরে এল সে। ক্যাশ লুট করার কোন বাসনা ছিল না বন্ডের, সে কেবল বিষয়টা সম্বন্ধে সামান্য কৌতূহল বোধ করছিল। ক্লোকরুমে একরাশ ফ্র্যাঙ্ক দিয়ে ক্যাসিনোর সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল বন্ড। না, ল্যশিক কোনমতেই ক্যাশ লুট করার চেষ্টা করবে না। সুতরাং এই সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা না করাই ভাল। তার চেয়ে বর্তমান চিত্রটি দেখা যাক। জুতার তলায় কাকরের মচমচ মুখটা তেতো তেতো, চোখ দুটো জ্বলছে। নাক যেন বন্ধ হয়ে আছে। বাইরে রাতের তাজা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিল বন্ড। এতক্ষণে সব অনুভূতিগুলো ফিরে আসছে। সেই সঙ্গে চিন্তাশক্তিও।

চওড়া পথ পেরিয়ে বাগানের মধ্যে দিয়ে ঢুকল হোটেল সঁপ্লেনডিডে। কেয়ারটেকারের কাছ থেকে চাবি ও টেলিগ্রাম নিল বন্ড। এল নিজের ঘরে দোতলায় ৪৫ নম্বরে। টেলিগ্রাম এসেছে জ্যামাইকা থেকে। লেখা আছে? কিংস্টন জ্যামাইকা…বন্ড সুপ্লেনডিড রয়্যাল লেজো খারাপ মাল উৎপাদন হাভানা সিগারের ফ্যাকট্রিতে ১৯১৫ এক কোটি রিপিট এক কোটি স্টপ আশা করি এই টাকায় চলবে শুভেচ্ছা। দ্য সিলভা তার মানে এক কোটি ফ্র্যাঙ্ক পাঠান হয়েছে। বিকেলে বন্ড প্যারিস মারফত লন্ডন হেডকোয়ার্টারের কাছে আরো টাকা চেয়েছিল। তারই জবাবে এই টেলিগ্রাম। প্যারিস থেকে লন্ডনে ক্লিমেন্টসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানা যায় তিনি এম-এর শরণাপন্ন হয়েছেন। এম অগত্যা রাজি হয়ে ট্রেজারির সঙ্গে ব্যবস্থা করতে আদেশ দেন।

জ্যামাইকাতে এক সময় কাজ করেছে বন্ড। তাই কিছুটা অভিজ্ঞতা ছিলই। তাকে যে ছদ্ম ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে তা হল মেসার্স ক্যাফরি নামক জামাইকার সর্বপ্রধান কোম্পানির শাসালো মক্কেলের। এই কোম্পানির ব্যবসা আমদানি ও রপ্তানি। তাই জামাইকা থেকে তার প্রতি যা নির্দেশ আসছে তাকে সেই ভাবে করতে হচ্ছে। নির্দেশ পাঠাচ্ছে ডেইলি-গ্লিনার নামক ঐ অঞ্চলের বিখ্যাত কাগজের অফিসের ডেস্ক থেকে একজন।

লোকটি স্বল্পভাষী, নাম ফসেট। কেথেন দ্বীপপুঞ্জের কচ্ছপ ধরা এক কোম্পানির হিসেবপত্র দেখত এক সময়। যুদ্ধের সময় স্বেচ্ছায় সৈন্যদলে ভর্তি ছিল সে। শেষে মাল্টার নৌ-বিভাগের গোয়েন্দা দপ্তরে কেরানির কাজ জোটে। যুদ্ধ থেমে গেল। বিষণ্ণচিত্তে কোমনে ফেরার উদোগ করছে, তখন সে সিক্রেট সার্ভিসের নজরে পড়ে। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সিক্রেট সার্ভিসের যে বিভাগে কাজ করছিল তারা ফসেটকে ফটোগ্রাফি শেখায় ও একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সাহায্যে তাকে ডেলী গ্লিনারের কাজে চাকরি দেয়।

বিভিন্ন এজেন্সী থেকে খবরের কাগজের অফিসে যে সব ফটোগ্রাফ আসতে সেগুলো বাঁচাই করা ছিল তার কাজ। ফাঁকে ফাঁকে অপরিচিত লোকের কাছ থেকে টেলিফোনে আদেশ আসত। সমস্ত ব্যাপারটা নিখুঁত ও গোপনীয় রেখে কাজ করতে হত। টাকাটা তার এক কল্পিত আত্মীয় ইংল্যান্ড থেকে তার নামে পাঠাচ্ছেন এই ভাবে ব্যাঙ্কে জমা পড়ত।

অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে যে খবর আসত সেগুলি বন্ডকে জানানো ছিল ফসেটের এখানকার কাজ। ফসেটের পাঠানো কোন খবর জ্যামাইকাতে ডাকবিভাগ কখনো সন্দেহ করবে না। ফসেট এখন ম্যারিটাইম প্রেস অ্যান্ড ফটো এজেন্সীর সংবাদদাতা, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তাকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। এর জন্য মাসে সে বাড়তি দশ পাউন্ড পাচ্ছে।

ফসেট উৎসাহিত হচ্ছিল। গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যই হয়ত সে একদিন পুরস্কৃত হবে। একটা গাড়ী কেনার প্রথম কিস্তির টাকাটা দিয়ে ফেলল সে। সবুজ রঙের আই-শেড চোখে এটে অফিসের ডেস্কে সে যখন বসে থাকত, সমীহ করে তাকাত সকলে।

বন্ড এইসব ব্যাপারগুলো বেশ মানসচক্ষে দেখতে পেল। তার কাছে কখনো আদেশ আসে না। এম-এর সঙ্গে যোগাযোগে সময় লাগে। অবশ্য এত কান্ডেরও কোন মানে নেই, সম্ভবত এই শহরেই সিক্রেট সার্ভিসের আর একদল লোক আছে যারা সোজাসুজি রিপোর্ট করছে। তবু এই পদ্ধতিতে কাজ করে একটা ধারণা হয় যে সে যেন রিজেন্ট পার্কের হেড কোয়ার্টারের ঠাণ্ডা মাথা লোকগুলো, যারা সমস্ত কলকাঠি নাড়ছে তাদের থেকে অনেক দূরে।

বন্ড দুবার পড়ল টেলিগ্রামটা। ডেস্কে রাখা টেলিগ্রাম ফর্ম থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিল, কারণ অপর পক্ষকে কার্বন কপি দিয়ে কি লাভ?

উত্তরটা গোটা গোটা অক্ষরে লিখলঃ

খবরের জন্য ধন্যবাদ যথেষ্ট হবে–বন্ড

কেয়ারটেকারের হাতে উত্তরটা দিয়ে বন্ড দ্য সিলভা লেখা টেলিগ্রামটা পকেটে পুরল। হয়ত ওরা পোস্ট অফিস থেকে এর কপি জোগাড় করে ফেলেছে। কেয়ারটেকারকে হয়ত ঘুষ দিয়ে হাত করেছে, বন্ড আসার আগে ওরা স্টিমে খামটা খুলেছে কিনা কে জানে। গুডনাইট জানিয়ে চাবি নিয়ে বন্ড সিঁড়ির দিকে চলল। লিফট নিল না, কারণ, এর সংকেত বড় মারাত্মক। সিঁড়ি পেরিয়ে সে বারান্দা অতিক্রম করে নিঃশব্দে নিজের ঘরের সামনে পৌঁছল।

সুইচটা জ্বেলে দিল। ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠল। ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিল। ঘরের মধ্যে ভাল করে দৃষ্টি দিল। খেতে যাবার আগে সে যা যা ব্যবস্থা নিয়েছিল তা সঠিক জায়গায় আছে কিনা দেখল। এই-সব তুচ্ছ ব্যাপারের দিকে খেয়াল আছে বলেই সে আজও বেঁচে আছে। সিক্রেট এজেন্টের কাজে প্রতিপদে বিপদের শঙ্খধ্বনি।

যাক, তাহলে ক্যাসিনোতে থাকা অবস্থায় কেউ তার ঘরে ঢোকেনি। এরপর বন্ড জামাকাপড় ছেড়ে গোসল সেরে নিল। সে হিসেব করে দেখল গত দুদিনের খেলায় সে জিতেছে তিরিশ লাখ। সব মিলিয়ে ওর মূলধন দাঁড়িয়েছে দু কোটি তিরিশ লাখ ফ্রাঙ্ক অর্থাৎ তেইশ হাজার পাউন্ড। জানলার বাইরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চঞ্চল, উৎসুক চোখ দুটি আপনা হতেই বন্ধ হয়ে এল। ঘুমন্ত বন্ডের মুখে নেমে এল নিষ্ঠুরতার এক কঠিন আভাস।

.

এমএর জন্য

এই ঘটনার ঠিক দুসপ্তাহ আগে সিক্রেট সার্ভিসের স্টেশন এস থেকে এম-এর কাছে নিম্নলিখিত বার্তা গেল। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এই বিভাগের প্রধান তিনি।

এম সমীপে।

এস-এর অধ্যক্ষের নিকট হইতে।

বিষয় : সিয়ো ল্য শিফকে বিধ্বস্ত করার পরিকল্পনা। ল্য শিফ ফ্রান্সে শত্রুপক্ষের প্রধান এজেন্ট এবং আলসেস এর শিল্প অঞ্চলের কমিউনিস্ট প্রভাবিত ট্রেড ইউনিয়নগুলির গুপ্ত অর্থদাতা। এই ইউনিয়ন যে আমাদের সঙ্গে শত্রুপক্ষের সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে গুপ্তচরের কাজ করতে পারে সে বিষয়ে আমরা অবগত।

এর শঙ্গে ল্যশিফের জীবন কাহিনী ও স্মার্শ গুপ্তচর সংস্থা সম্বন্ধে কিছু তথ্য দেওয়া হল।

কিছুদিন থেকে আমরা লক্ষ্য করছি ল্যশিফ অত্যন্ত বিপদজনক কাজে হাত দিয়েছে। সমস্ত দিক থেকেই সে সোভিয়েত রাশিয়ার সুযোগ্য এজেন্ট বলা যায়। কিন্তু কিছু শারীরিক ও নীতিগত দুর্বলতা আছে। এই দুর্বলতার সুযোগ আমরা মাঝে মাঝে নিতে পেরেছি। তার একজন ইউরেশীয় (১৮৬০ নম্বর) বান্ধবী আমাদেরই লোক, স্টেশন এস থেকে তাকে নির্দেশ পাঠান হয় এবং তার মারফত ল্যশিফের অনেক ব্যক্তিগত ঘটনা আমাদের গোচরে এসেছে। নানা কারণ আমাদের মনে সন্দেহ জন্মেছে সে ল্যশিফ অত্যন্ত আর্থিক দুরবস্থায় পড়েছে। ১৮৬০ নম্বর এর কয়েকটি লক্ষণ আবিষ্কার করে যে, যেমন খুব সঙ্গোপনে কিছু গহনা বিক্রি, অ্যানটিবেসের একটি বাড়ি বিক্রি এবং বাড়তি খরচ সম্বন্ধে সজাগ হয়ে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। এই কেসটিতে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন দোয়জিয়েম বুরো। এঁদের সাহায্যে অনুসন্ধান চালিয়ে কিছু বিচিত্র তথ্য সামনে এসেছে।

১৯৪৬ সালের জানুয়ারী মাসে ল্যশিফ অনেকগুলি গণিকালয়ের মালিক হয়–কর্ডন জুন নামে পরিচিত এই বেশ্যালয়ের অনেকগুলি শাখা নর্মান্ডি ও ব্রিট্রানীতে আছে। পাঁচ কোটি ফ্রাঙ্ক দিয়ে এই গণিকালয়গুলি কেনে সে। ফ্রান্সের ট্রেড ইউনিয়নগুলির সাহায্যের অর্থ এই কাজে ব্যয় করে ল্যশিফের খুব বুদ্ধির পরিচয় মেলেনি। অন্য যে কোন ব্যবসার পরিবর্তে এই ব্যবসা বেছে নেওয়ার কারণ ল্যশিফের অসংখ্য নারীর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর ফল ভাল হল না। তিন মাসও গেলনা–১৩ই এপ্রিল ফ্রান্সে একটি আইন পাস হল।

(এম ফরাসীতে লেখা এই বাক্যটি পর্যন্ত পৌঁছে বললেন। তারপর ইনটারকমের সুইচ টিপলেন।

হেড অফএস?

হ্যাঁ স্যার।

কথাটার মানে কি? বানান করে বললেন উনি।

দালালি।

 তাহলে ইংরেজিতে লিখতে ক্ষতিটা কি হয়েছিল? যদি ভাষা জ্ঞান ফলানোই উদ্দেশ্য হয় তাহলে তার জায়গা এটা নয়, খেয়াল রেখ।

 সরি স্যার।

সুইচটা বন্ধ করে এম আবার পড়তে লাগলেন।)

এই আইন জারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি সমস্ত গণিকালয় বন্ধ হয়ে গেল এবং অশ্লীল বই বিক্রিও নিষিদ্ধ হল। ল্যশিফের আর্থিক দুরবস্থা চরমে উঠল। গোপনে অশ্লীল ছবি দেখাবার চেষ্টা বিফলে গেলে তারা ঠিক করল সব কিছু বন্ধ করে দেবে। কিন্তু ইতিমধ্যে পুলিশ তার কাজকর্মের সন্ধান পেয়ে কুড়িটিরও বেশি গণিকালয় বন্ধ করে দিল। ল্যশিফের লগ্নী করা মূলধনের আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না।

ল্যাশিফ জানতেও পারেনি স্মার্শ তার পিছনে লেগেছে। একবার জানতে পারলে তার পলায়ন ছাড়া কোন দ্বিতীয় পথ থাকবে না। তার বর্তমান পরিস্থিতি যাইহোক না কেন, সে জানতে পারেনি তার প্রাণের আশংকা আছে।

ল্যশিফ ঠিক করল সে হৃতটাকা পুনরুদ্ধারের জন্য জুয়োর আশ্রয় নেবে। শেষ খবর, ইউনিয়নের তহবিল থেকে শেষ দুকোটি পঞ্চাশ লক্ষ ফ্রাঙ্কও সে তুলে নিয়েছে।

ভিক্টোরিয়া যুগের বিখ্যাত জুয়ার আজ্ঞা রয়্যাল–এবারে নানারকম কৌশলে ইউরোপ ও আমেরিকার বিত্তবান জুয়াড়ীদের এখানে আকর্ষণ করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে রয়্যাল তার পূর্ব গৌরব ফিরে পেতে চলেছে। সার্ভিসে সবচেয়ে পাকা জুয়াড়ী যে আছে তাকে যথেষ্ট টাকা দিয়ে এই লোকটিকে হারাবার জন্য নিযুক্ত করা হোক। যদি এই কাজে, কাউকে না পাঠানই সিদ্ধান্ত করা হয় তাহলে আমরা আমাদের সংগ্রহ করা সমস্ত তথ্য ও প্রস্তাব আমেরিকার সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সীর হাতে তুলে দিতে বাধ্য হব। তারা এই কাজে সাগ্রহে এগিয়ে আসবে।

স্বাক্ষরঃ এম

অ্যাপেনডিকস এ
 নাম : ল্যশিফ
ছদ্মনামঃ সংখ্যা বা সাইফার এই কথাগুলির বিভিন্ন অর্থবাচক
যেমন হের জিফার
পূর্ব ইতিহাসঃ অজানা।

প্রথম দেখা যায় ১৯৪৫ এর জুন মাসে মার্কিন অধিকৃত জার্মানীর একটি উদ্বাস্তু শিবিরে। স্মৃতিভ্রংশ ও কণ্ঠনালীর পক্ষাঘাতে আক্রান্ত। চিকিৎসার ফলে গলার স্বর ফিরে পায় কিন্তু পূর্ব ইতিহাস কিছুতেই স্মরণে আনতে পারে না। কেবল ঐ বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে যখন তাকে আলসেস-লোরেন ও স্ট্রাসবার্গে পাঠান হয় তখনকার কথা মনে আছে। রাষ্ট্রহীন ব্যক্তির পাসপোর্ট ছিল তার, নম্বর ৩০৪–৫৯৬। তখন সে ল্যশিফ নাম গ্রহণ করে।
বয়স : প্রায় ৪৫
বর্ণনাঃ উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি, ওজন ১৮ স্টোন। অত্যন্ত ফর্সা, রক্তহীন চেহারা। চুল লালচে ব্রাউন। দাড়ি গোঁফ কামানো, কটা চোখ। মুখের হাঁ ছোট, অনেকটা মেয়েলী। দামী বাঁধানো দাঁত। কান ছোট, লতি বড়, মনে হয়ে ইহুদীদের রক্ত আছে। হাত ছোট, সযত্বরক্ষিত, লোম আছে। জাতিগতভাবে ভূমধ্যসাগরীয় ও প্রাশিয়ান। পোষাক পরিচ্ছদ শৌখিন। গাঢ় রঙের ডাল বেস্টেড সুট পরে। ইংরাজি ও ফরাসী সমান ভাবে বলে। ভাল জার্মান ভাষাও জানে। মাই-এর টান আছে কথায়।
অভ্যাসঃ দামী দামী বদভ্যাস আছে। স্ত্রী সংসর্গে কোন অরুচি নেই। দ্রুতগামী গাড়ি ভাল চালায়। ছোটখাট অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। হিসাব ও অঙ্কের জ্ঞান আছে। জুয়া ভাল খেলে। সঙ্গে সশস্ত্র দেহরক্ষী থাকে–একজন ফরাসী ও একজন জার্মান। উপসংহারঃ মারাত্মক ও শক্তিশালী সোভিয়েত এজেন্ট। লেনিন গ্রাড সেকশন। তিনি একে প্যারিস থেকে পরিচালনা করেন।
স্বাক্ষর ঃআর্কাইভিস্ট

অ্যাপেনডিকস বি
বিষয় : স্মার্শ
সংবাদ উৎসঃ নিজেদের গোপন সংগ্রহ দপ্তর, কিছু তথ্য পাওয়া গেছে দোয়াজিয়েম বুরো ও ওয়াশিংটনের সি.আই.এ থেকে।
দুই রুশ কথার সমবায়ে স্মার্শ নামের উৎপত্তি। কথা দুটির অর্থ গুপ্তচরদের হত্যা কর। বেরিয়ার হাতে এই সংস্থার সর্বময় কর্তৃত্বের ভার।
হেড কোয়ার্টার : লেনিনগ্রাড।

সোভিয়েট সিক্রেট সার্ভিসের বিভিন্ন শাখা ও সিক্রেট পুলিশের সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের বিনষ্ট করা এদের কাজ। এটি সবচেয়ে কুখ্যাত সংস্থা। এর নাম শুনে সকলে আতঙ্কিত হয়।

১৯৪০ সালের ২২ শে আগস্ট মেক্সিকোতে ট্রটস্কির হত্যাকান্ড এদের দ্বারা সংঘটিত হয়। স্মার্শ এই কাজে সাফল্য লাভ করে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করে।

তারপর হিটলার যখন রাশিয়া আক্রমণ করে তখন স্মার্শের নাম আবার শোনা যায়। তখন স্মার্শ দ্রুত খ্যাতি লাভ করে।

যুদ্ধের পর এই সংস্থা থেকে অনেক অবাঞ্চিত ব্যক্তিকে বার করে দেওয়া হয়। এখন মাত্র কয়েক শ ব্যক্তি এতে আছে। প্রত্যেকে অত্যন্ত কর্মক্ষম।

এরা পাঁচটি শাখায় বিভক্তঃ
একনম্বর শাখা : দেশে ও বিদেশে সোভিয়েট গুপ্ত সংবাদ গ্রহণে নিযুক্ত।
 দুনম্বর শাখা : হাতে কলমে কাজ, তার মধ্যে হত্যাও আছে।
তিন নম্বর শাখা : বিচার, শাস্তিদান।

এ পর্যন্ত আমাদের হাতে মাত্র একজন স্মার্শ সদস্য ধরা পড়েছে। তার নাম গয়েটশেভ ওরফে গ্যারড জোনস। ১৯৪৮ সালের ৭ই আগস্ট সে হাইড পার্কে যুগোশ্লাভ রাষ্ট্রদূতাবাসের মেডিক্যাল অফিসারকে গুলি করে মারে। তদন্ত চলার সময়ে লোকটি পটাসিয়াম সায়ানাইডে তৈরি একটি কোটের বোতাম খেয়ে আত্মহত্যা করে। তার কাছ থেকে কোন সংবাদই আদায় করা যায়নি, শুধুমাত্র সে স্মার্শের সদস্য, কেবল এটুকু ছাড়া।

.

জিরো জিরো সেভেন

এস বিভাগের প্রধান নিজেই ফাইলটি নিয়ে এগিয়ে চললেন উপর তলায়। রিজেন্টপার্কের সামনে সিক্রেট সার্ভিসের গম্ভীর চেহারার অফিস বাড়ি। বারান্দা পার হয়ে শেষের ঘরটায় এসে উপস্থিত হলেন। তার উৎসাহের অন্যতম কারণ ছিল ল্যশিফের বিনাশের পরিকল্পনাটি তাঁর নিজস্ব।

এম-এর চিফ অফ স্টাফের কাছে গটমটিয়ে এগিয়ে এলেন হেড অফ এস। চিফ অফ স্টাফের বয়স কম। সে ১৯৪৪ সালের একটি নাশকতামূলক কাজে আহত হবার পর থেকে এই কাজে নিযুক্ত আছে। দুটি অভিজ্ঞতাই বেশ করুণ– তবু চিফ অফ স্টাফের মেজাজে ফুর্তির কোন অভাবই চোখে পড়ে না।

বিল, শোন, শোন, কর্তাকে একটা জিনিস রাজি করাতে চাই। যাওয়া যায়? কি বল পেনি? চিফ অফ স্টাফ জিজ্ঞেস করলেন এম-এর প্রাইভেট সেক্রেটারি মিস মানিপেনিকে। দুজন একই ঘরে বসেন।

মিস মানিপেনিকে দেখে যে কেউ আকৃষ্ট না হয়ে পারবে না, কিন্তু পিছিয়ে যাবে তার ঐ শীতল চোখ দুটি দেখে।

তা যায়। গত আধঘণ্টায় কেউ আসেনি। সুতরাং- হেড-অফ এস-এর দিকে চেয়ে মানিপেনি মুচকি হাসলেন। লোকটি তার পছন্দের তালিকায় ছিল। তাছাড়া তার বিভাগটার কথাও ভাবতে হয়।

তাহলে এই নাও। কালো ফোল্ডারটা বিলের হাতে গুঁজে দিলেন হেড অফ এস। ফোল্ডারের উপরে লাল তারা আঁটা। তার অর্থ এটা একান্তই গোপনীয়। বেশ উৎসাহী মুখ করে দেবে এটা। আমি এখানে আছি ওঁকে বোল, যদি কিছু খবর জানতে চান। আর যতক্ষণ উনি পড়ছেন তোমরা দুজনে আশা করি ওঁকে গিয়ে বিরক্ত করবে না।

ঠিক আছে স্যার। বিল একটা সুইচ টিপে ইন্টারকমের দিকে ঝুঁকে বসল।

 কি ব্যাপার? আবেগহীন গলা।

আপনার জন্য হেড অফ এস একটা জরুরী ফাইল এনেছেন স্যার।

খানিকক্ষণ চুপচাপ।

নিয়ে এস।

 চিফ অফ স্টাফ সুইচটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন।

 থ্যাঙ্কস বিল।

 চিফ অফ স্টাফ দুটো দরজা পেরিয়ে এম এর ঘরে ঢুকলেন। পরক্ষণেই তিনি বেরিয়ে এলেন। ঘরে নীল আলো জ্বলে গেল। অর্থাৎ এখন তিনি বিশ্রাম নেবেন।

কিছুক্ষণ পরে হেড অফ এস উল্লসিত হয়ে তার পরের কর্মচারিকে বললেন, ঐ শেষের প্যারাগ্রাফটার জন্য আর একটুর জন্য সব ভন্ডুল হয়ে যেত। এম তো রেগেই অস্থির। অবশেষে মত দিয়েছেন। বললেন পাগলের মত পরিকল্পনা, তবু যদি ট্রেজারী রাজি থাকে তাহলে এগোনো যায়।

ওঁর মনে হয় ওদের রাজি না হবার কারণ নেই।

উনি ওদের বলবেন যেসব পলাতক রাশিয়ান কর্নেলদের পেছনে অনর্থক টাকা ঢালা হচ্ছে তার চেয়ে এটা অনেক ভাল প্ল্যান। রাশিয়ানগুলো এখানে আমাদের আশ্রয়ে থেকে পরে ডাবল এজেন্ট হয়। তাছাড়া এম ল্যশিফকে ধরার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছেন। ওর হাতে উপযুক্ত লোকও আছে এই কাজের জন্য।

কে লোক?

ডাবল জিরোদের কেউ, খুব সম্ভব ডাবল জিরো সেভেন। ল্যশিফের দেহরক্ষীদের কাছে অস্ত্র থাকে, সুতরাং আমাদের লোকটিকে ওর মত বলবান হতে হবে। যুদ্ধের আগে মন্টি কর্পোতে দুমাস ধরে জুয়াখেলে ও সেই সঙ্গে রুমানিয়ান দলকে অদৃশ্য কালি ও কালো শেমার কারবার সবার সম্মুখে তুলে ধরেছে। এর ফল স্বরূপ জিরো জিরো সেভেন আর দোয়াজিয়েম বুরোর ভাগ্যে মিলেছে দশলক্ষ ফ্র্যাঙ্ক। আজকের এই মন্দা বাজারে এই বা আসে কোত্থেকে।

এম-এর সঙ্গে বন্ডের কথাবার্তা খুব বেশীক্ষণ স্থায়িত্ব লাভ করেনি। বন্ড হেড অফ এস-এর রিপোর্টটা পড়ে এম এর ঘরে এসে ঢুকল।

তাহলে? জিজ্ঞেস করলেন এম।

অনেক ধন্যবাদ স্যার, কাজটা আমাকে দেওয়ার জন্য। কাজটা আমার পছন্দ, তবে জিতব কিনা এখনি বলা যাচ্ছে না। খুব চড়াবাজির খেলা তো–শুরুই হবে পাঁচ লক্ষ দিয়ে মনে হয়।

এম-এর কঠিন চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল সে। এই সবই এম-এর জানা।

বাকারা খেলার হার-জিতের খেলায় সম্ভাবনা কিরকম, তাঁর নিজের লোকদের ও অপরপক্ষে কারা আছে তাদের প্রত্যেকের সম্বন্ধেই জানা তার প্রধান কাজ। বন্ড ভাবল এত কথা বলার কোন প্রয়োজন ছিল না।

হারতে তো ওরাও পারে। এম বললেন, তোমার টাকার অভাব হবে না। আড়াইকোটি, ওর যা আছে, তাই। প্রথমে এক কোটি নিয়ে যাবে, তারপর আরো এক পাঠানো হবে, তুমি ওখানে গিয়ে পর্যালোচনা করার পর। আর পঞ্চাশ লক্ষ তুমি নিজেই উপার্জন করতে পারবে। একটু হাসলেন এম। আসল খেলা শুরু হবার কয়েকদিন আগেই যাও। যাওয়া আর থাকার ব্যবস্থা সম্বন্ধে কিউ-এর সঙ্গে কথা বলে নিও। টাকা পে মাস্টার দিয়ে দেবে। আমি দোয়াজিয়েম ব্যুরোকে বলেছি তোমার কাছাকাছি থাকতে। ওদের এলাকা, যতই বল বেশি হৈ চৈ না করাই ভাল। মন্টিকার্লোতে সেবার ক্যাসিনোর ব্যাপারটায় তোমার সঙ্গে ওর ভালই বনিবনা হয়েছিল। অবশ্য ওয়াশিংটনও বলতে হচ্ছে ন্যাটোরও স্বার্থ আছে। ফনটেন ব্লোতে সি আই-এস দু-একজন ভাল লোক আছে। আচ্ছা, আর কিছু

বন্ড মাথা নাড়ল। ম্যথিস থাকলে ভাল হয় স্যার। দেখা যাক। জেতবার চেষ্টা কর। তা না হলে আমাদের মাথা হেঁট হবে। এটা ছেলে খেলা মোটেই নয়। ল্যশিফ খেলে ভাল। আচ্ছা তাহলে গুডলাক।

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। বন্ড দরজার দিকে এগোল।

 শোন।

ঘুরে দাঁড়াল বন্ড।

আমি তোমার সঙ্গে লোক দিতে চাই। দুটো মাথা একটা মাথার চেয়ে বেশি বুদ্ধি ধরে। তোমার খবর পাঠাবার জন্যও কাউকে প্রয়োজন। চিন্তা কোরনা। ভাল লোকই দেব।

একা কাজ করা অবশ্যই বন্ডের বেশি মনঃপূত, কিন্তু এম এর সঙ্গে তো আর তর্ক করা চলে না। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার মনে এই ধারণা জন্মাল যে এখন লোকটা বোকা কিম্বা অতিরিক্ত উচ্চভিলাসী না হলেই ভাল। আশা করা যায় যে সে বিশ্বাসের মর্যাদা দেবে।

.

শত্রু আড়ি পাতছে

 দুদিন আগে বন্ড রয়্যাল লেজোতে এসে পৌঁছেছে। লাঞ্চের সময় তার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। রেজিস্টারে সই করার সময় তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি।

ছদ্ম ভূমিকা গ্রহণের ব্যাপারে এমন খুব একটা কিছু বলেননি। কেবল বললেন যখন খেলার টেবিলে ল্যশিফের সঙ্গে টেক্কা দেবার চেষ্টা করবে তখন আর কারো কিছু বুঝতে বাকি থাকবে না। তবু সাধারণ লোকের কাছে পরিচয় দেবার জন্য একটা বিশ্বাসযোগ্য ভূমিকা ঠিক করে রেখ।

জ্যামাইকা সম্বন্ধে বন্ডের জ্ঞান কিছু কম নয়। তাই সে একজন বিত্তবান জ্যামাইকাবাসী বাগান মালিকের পুত্র হিসেবে নিজেকে পরিচিত করাল। সেরকমভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে কিংসটনের শ্যফারির চার্লস দা সিলভাকে তার অ্যাটনী বলে দিলেই হবে। বাকিটা দ্য সিলভা বুঝে নেবে।

দুদিনই বিকেলটা এবং রাতটা বন্ড ক্যাসিনোতে কাটিয়েছে। এভাবে তিরিশ লক্ষ ফ্র্যাঙ্ক জেতা ছাড়াও বন্ড একবার তার তাসের হাতটা ঝালিয়ে নিল, স্নায়ুরও পরীক্ষা নিল।

ক্যাসিনোর অবস্থানটা ভাল করে মনের মধ্যে গেঁথে নিল সে। ল্যশিফকে একদিন সে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং লক্ষ্য করেছে লোকটার কপালও যেমন ভাল তেমনি আন্দাজও নির্ভুল।

ঠাণ্ডা পানির শাওয়ারে গোসল সেরে জানলার সামনে লেখার টেবিলটিতে বসল সে। বাইরে ঝলমলে দিন। স্ট্রীটের মরল্যান্ডের কূলে ছোট ছোট ঢেউ আছড়াচ্ছে। ডিসেপ থেকে আসা জেলেদের নৌকাগুলো সার বেঁধে চলেছে সমুদ্রের উপর দিয়ে। সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বন্ড সকালের প্রাতঃরাশ শেষ করল। এতটাই মগ্ন ছিল যে টেলিফোনের শব্দে চমক ভাঙল। বন্ড প্যারিস থেকে যে রেডিও সেটটা আনতে চেয়েছিল সেটা নিয়ে একজন এসেছেন।

কেয়ারটেকারকে বলল, ওঁকে পাঠিয়ে দিন।

ফরাসী গোয়েন্দা বিভাগ দ্বারা নিয়োজিত এই লোকটির জন্য এই ছদ্মভূমিকাই ঠিক করা হয়েছিল। লোকটি বন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলবে। বন্ড উৎসুক চোখে চেয়ে রইল দরজার দিকে। ম্যাথিস এলেই ভাল।

এক সভ্রান্ত চেহারার ব্যবসায়ী চৌকো প্যাকেটের চামড়ার হাতল ধরে ঘরে প্রবেশ করলেন। তিনিই ম্যাথিস। বন্ড উল্লসিত হয়ে অভ্যর্থনা জানাতে গেলে ম্যাথিস বাধা দেয়। সন্তর্পণে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।

মসিয়ো, আমি এই মাত্র প্যারিস থেকে পৌঁছলাম। এই যে আপনার রেডিও, আপনি যেমন চেয়েছিলেন পাঁচ ভালভের। এখান থেকে আপনি ইউরোপের প্রত্যেকটা রাজধানী ধরতে পারবেন।

তবে তো ভালই, মুখে বলল বন্ড। ম্যাথিস বন্ডের দিকে লক্ষ্য না করে মোড়ক খুলে রেডিও সেটটা বার করল। যেখানে ম্যান্টলপিসের নিচে ইলেকট্রিক চুল্লী, সেখানেই রাখল সে।

সাড়ে এগারোটা। তাহলে রোম থেকে মিডিয়াম ওয়েভে চানসম বান্ধবদের প্রোগ্রামটা পাওয়া যেতে পারে। ওরা ইউরোপে নানা জায়গায় শো দিচ্ছে। দেখাই যাক পরীক্ষা করে।

রেডিওর পিছনে কি খুটখাট করতে লাগল ম্যাথিস। হঠাৎ ঘড় ঘড় শব্দে ঘর ভরে গেল। ম্যাথিস কাঁচুমাচু গলায় বলল, মাপ করবেন সিয়ো। ভাল করে টিউন করা ছিল না। ডায়ালটা ঠিক করে দেবার পর সঙ্গীত ভেসে এল। ম্যাথিস তখন উঠে এসে বন্ডের কাছে এল এবং এমনভাবে তার হাত চেপে ধরল যাতে করে আঙুলগুলো গুড়ো হয়ে যাবার জোগাড়।

দাঁত বার করে বন্ড বলল, এসবের মানেটা কি?

ম্যাথিসের ফুর্তির কিছু অভাব দেখা গেল না। বন্ধু তুমি ধরা পড়ে গেছ।

কি করে ওরা জানতে পারল জানি না। নিশ্চয়ই তুমি আমার কয়েকদিন আগে থেকেই ওরা তোমার খোঁজ রেখেছিল। শত্রু পক্ষের সমস্ত দলবল এখানে উপস্থিত। তোমার ঠিক উপরে আছে মুন দম্পত্তি। লোকটা জার্মান। স্ত্রী মধ্যে ইউরোপ অঞ্চলের। এই হোটেলের বাড়িটা সেকেলে ধরনের। চুল্লীর কয়েক ইঞ্চি উপরে দেখাল সে, এই যে এখানে খুব শক্তিশালী একটা রেডিও পিক আপ রয়েছে। চিমনির মধ্যে দিয়ে তারটা গেছে ওদের ঘরে মিনজদের। বৈদ্যুতিক চুল্লী পর্যন্ত। সেখানে একটা অ্যামপ্লিফায়ার আছে। ওদের ঘরে একটা রেকর্ডার আছে, আর দুটো ইয়ারফোন মুনজরা পালা করে সেটা কানে লাগিয়ে বসে থাকে। সেজন্য মুনজ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। মসিয়োও বাইরের রোদ ও জুয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে সর্বদা স্ত্রীর পাশে বসে আছেন।

আমরা ফরাসীরা খুব চালাক, জানোই তো, বাকিটা আমরা জানলাম তোমার ঘরে ঢুকে। তুমি আসার আগে আমরা এসে তোমার চুল্লীর প্যানেলটা খুলে ফেলেছিলাম।

বন্ডের ততক্ষণে দৃষ্টি গেল প্যানেলের দিকে। সত্যি তো সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আঁচড়ের দাগ রয়েছে।

এবার একটু অভিনয় করা যাক। ম্যাথিস রেডিওটা বন্ধ করে দিল। বাজনা মাঝপথে থেমে গেল। উপরের শ্রোতা। দুজনও বঞ্চিত হলেন।

আপনার পছন্দ হচ্ছে, সিয়ো? কি পরিষ্কার রিসেপসান, দেখলেন তো? ওরা বাজায় ভাল, কি বলেন? দলটা ভাল।

তোমার জ্যামাইকার কথা আর বোল না।

যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে আর কি হবে–আমি জানতাম ওরা ধরে ফেলবে, তা এত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারিনি। কি করে ফাস হল ব্যাপারটা? রাশিয়ানরা কি করে ওদের সংকেত ধরে ফেলেছে?

বন্ডের মনের কথা বুঝতে পেরেই ম্যাথিস বলল, না সঙ্কেত বোধহয় ধরতে পারেনি। আমার অবশ্য লন্ডনকে বলতে হবে ওরা সঙ্কেত বদলে ফেলেছে। শুনে যা অবস্থা হল ওদের, ম্যাথিস একটু হাসল। বন্ধুভাবাপন্ন হলেও দুদেশের সিক্রেট সার্ভিসের মধ্যে একটু তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই।

সিগারেটের ধোঁয়া কিছুটা গলধঃকরণ করে সে বলল, প্রথম কথা। তোমার সঙ্গে এবার যে কাজ করবে তাকে দেখে তুমি খুশিই হবে। মেয়েটি খুব সুন্দরী। বন্ডের থমথমে মুখ দেখে সে বলল, রীতি মত সুন্দরী বলা চলে। রেডিওর কাজেও খুব দক্ষ। সেই সঙ্গে গরমের সময়ে ও সেলসের কাজে আমাকে অনেক সাহায্য করবে। হঠাৎ যদি রেডিও খারাপ টারাপ হয়ে যায় তাহলে ওকে ডাকলেই পাওয়া যাবে।

বন্ডের গা জ্বলে যেতে লাগল। সে বিরক্ত হয়েই বলল, একটা মেয়েকে পাঠাবার কি দরকার, এটা কি পিকনিক পেয়েছে?

বন্ধু ধীরে। অত উতলা হচ্ছ কেন? তোমার মতই কাজের মানুষ সে। বরফের মত নিস্তেজ। এ দেশের না হয়েও ও যা ফরাসী বলে অবাক হবার মত। জামাইকার লোক হয়েও তুমি যদি এভাবে নীরস জীবন কাটাও, এটা কি ভাল দেখায়?

ম্যাথিস আরো জানাল, ল্যশিফ নিজের বাসায় রয়েছে। উপকূলের রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে বড় জোর মাইল দশেক। সঙ্গে রক্ষীও রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন একটা বাড়িতে এসে ঢুকেছিল যেখানে তাদের আসার আগেই অপরিচিত তিন ব্যক্তির আগমন ঘটেছে এখানে। শক্ত সমর্থ দোহরা চেহারা। ওরা একই দলের লোক সব। কাগজপত্র কিছু অগোছাল হয়নি। শুধু তাই নয় ওদের মধ্যে একজন ভাল বুলগেরিয়ান ভাষা বলে। এরা ভীষণ বোকা হয়। এরা তো প্রভুভক্ত হয় যে এরা বুঝে উঠতে পারে না যে এদের অর্থও যুগোশ্লাভদের বিরুদ্ধে দাঁড় করান হয়। এমনকি অনেক সময় গোলমেলে কেসে ওদের শিখন্ডী রূপে উপস্থিত করা হয়। খুনজখমের কাজগুলো রাশিয়ানরা সহজেই ওদের দিয়ে করিয়ে নেয়।

শুনে খুশি হলাম। যেমন এই কেসটা। আচ্ছা–আরো কোন খবর থাকে তো বল?

আর তেমন কোন খবর নেই। তুমি লাঞ্চটা হার্সিটেজের বারে কর। সেখানে মেয়েটি আসবে। ওকে রাতে তোমার সঙ্গে খেতে বল। এরপর তোমার সঙ্গে ওর ক্যাসিনোতে প্রবেশ তেমন কোন আশ্চর্যের সূচনা করবে না। ঐখানে আমিও থাকব, তবে একটু গোপনে। লিটারবলে একজন আমেরিকান আছেন যিনি সি.আই.এর লোক। যাইহোক তোমাকে যা যা বলার ছিল বলা হয়ে গেল, এবার আমার কাজ শেষ।

ম্যাথিস রেডিও সেটটা বন্ধ করে, রাত্রের মত বিদায় নিল।

বন্ড সমস্ত ব্যাপারগুলো পর্যালোচনা করে দেখল যে তার এই ভাবে ধরা পড়ে যাওয়া মোটেই আশাপ্রদ ঘটনা নয়। ল্যশিফের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো রাশিয়ানরা কখনই বরদাস্ত করবে না। তাকে সরিয়ে ফেলতে কখনই দ্বিধা বোধ করবে না। তারপর অপর বোঝা এই মেয়েটি সময় হয়ত ভালই কাটবে কিন্তু মান অভিমানের পালা চললে তো কাজ করাই একেবারে মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।

.

হেডকোয়ার্টার থেকে আসা মেয়েটি

বন্ড হোটেল থেকে যখন বেরল তখন ঘড়িতে ঠিক বারোটা। বাতাস এখন পাইন আর মিমোসার গন্ধে ভরপুর। ক্যাসিনোর সাজানো বাগান আর সুরকি বিছানো রাস্তাগুলো দেখার মত। কে জানে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে এক নাটকীয় মুহূর্ত সৃষ্টি হতে চলেছে কিনা? চমৎকার রোদে ছোট্ট শহরটির সুদিন অনেক বেশি করে চোখে পড়ছে। রয়্যাল নোজো বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে পেরিয়ে এসে আজ সে নতুন যুগকে ফিরে পেতে চাইছে।

প্রথম অবস্থায় রয়্যাল জেলেদের গ্রাম ছিল। লোজো কথাটি তখনো যুক্ত হয়নি। দ্বিতীয় সাম্রাজ্য চলাকালীন স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে রয়্যাল রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যায়। কিন্তু এই জনপ্রিয়তা বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি, তাই পতন, পতনের মূল কারণ ছিল ল্যটুকের উন্নতি।

এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে, সমুদ্রতীরের এই শহরটির অবস্থা খুবই সঙ্গীণ হয়ে পড়ে। রয়্যাল গ্রামের পিছনের পাহাড়ের ঝর্ণার পানিতে দ্রবীভূত সালফার পাওয়া যেতে লাগল। সালফার লিভারের পক্ষে খুবই ভাল। ফ্রান্সে বেশির ভাগ বাসিন্দাই লিভারের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়তো। তাই বেড়ানো ছাড়াও স্বাস্থ্যকর জায়গায় যাওয়াটা সকলের কাছেই। অভ্যাসে পরিণত হল। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বারের কাউন্টারে শোভা পেতে লাগল রয়্যালের পানীয় পানি। কিন্তু ভিকি ও পেরিয়ার মত এই দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দির জন্য রয়্যালের পানি বাজারে বেশি দিন টিকে থাকতে পারল না। অনেকগুলো মামলা হল, শহরের কাছাকাছি জায়গা ছাড়া এই পানি বিক্রি আইন করে তুলে দেওয়া হল। পূর্বের ন্যায়। রয়্যালের আর্থিক দুর্দশা আবার ফিরে এল। তবে রয়্যাল ক্যাসিনোর স্থাপত্য ভিক্টোরীয় যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে খুব জাঁকজমকের সঙ্গেই করা হল। সাদা ও সোনালি রঙ হল বাড়ির। আসবাবপত্র হল ফিকে। তা লাল কার্পেট ও পর্দা বেষ্টিত। বিরাট বিরাট ঝাড়লণ্ঠন ঝোলানো হল। বাগান নতুন ভাবে সজ্জিত হল। ফোয়ারার পানি আবার স্ব মহিমায় ফিরে এল।

ছোট শহরটি আজ যতদূর সম্ভব নিজেকে সজ্জিত করেছে অতিথি অভ্যর্থনার জন্য। বড় রাস্তায় প্যারিসের ধনরত্ন ব্যবসায়ীগণ বিনা ভাড়ায় তাদের সওদার আসর জমিয়েছে।

মহম্মদ আলি সিন্ডিকেটকে ক্যাসিনোতে আনা হল। শুরু হল তাদের নেশার পাথেয় জুয়া।

বন্ড এই তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে এই ইতিহাসের মধ্যে নিজেকে লিপ্ত করে নিয়েছে। এই জাঁকজমকের মধ্যে তার কাজের পটভূমিকা অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। গভীর ও গোপন চক্রান্তে সেও এক অংশীদার এ কথা মনে উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে নিজের কাছে বড় অসহায় মনে হয়। যাকগে। এই সব চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলাই ভাল। হার্মিটেজে যাওয়ার আগে ল্যশিফের আবাস একবার দেখে যাওয়াই সমীচীন।

বন্ডের গাড়ি গাছে ঢাকা রাস্তা দিয়ে ভট ভট শব্দ তুলে বালিয়াড়ি পেরিয়ে দক্ষিণ দিকে ছুটে চলল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সে পৌঁছে গেল হার্মিটেজের সু-সজ্জিত বার-এ। জানলার পাশের টেবিল বেছে নিল।

বিলাসবহুল ফরাসী কায়দায় সাজানো এই ঘর। মেহগনি, চামড়া আর পেতলের ছড়াছড়ি। বন্ড এবার দৃষ্টি দিল ঘরে উপস্থিত লোকজনদের প্রতি। প্যারিস থেকেই তোক বেশি এসেছে। একটু বেশি যেন সাজসজ্জা হয়ে গেছে। চনমনে কথাবার্তা, প্রাণোচ্ছল আবহাওয়া স্মরণ করিয়ে দেয় এরা যেন সকলেই নাটকের নট নটী। পুরুষরা নিয়েছে বোতল ভরা শ্যামপেন। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেয়েদের হাতে রয়েছে মার্টিনি। পাশের টেবিলে ছটফটে গোছের একটি মেয়ে তার পাশের সঙ্গীকে বলছে, ড্রাই আমার ভালই চলে। টুইডের সুট পরিহিত তার সঙ্গী নিজেকে ছিমছাম রাখতে ব্যর্থ হয়ে গেছে তার ঐ মদ্যপানে রক্তিম চোখ দুটোর জন্য।

ডেজি ঠিকই বলেছ, তবে কিনা একটুকরো লেবু…

ততক্ষণে বন্ডের চোখ বাইরে চলে গেছে। দীর্ঘদেহ ম্যাথিস ও সঙ্গে ধূসর পোশাকে কালো চুল একটি মেয়ে। পরস্পর পরস্পরের হাত ধরে রয়েছে, তবে তাদের মধ্যে খুব অন্তরঙ্গতা আছে বলে মনে হয় না। ওরা ভেতরে এল। বন্ড ওদের দেখতে পেয়েও না দেখার ভান করল। মসিয়ো বন্ড না? ম্যাথিস আশ্চর্য, গলা উচ্ছ্বসিত। বন্ড অবাক হয়ে। উঠে দাঁড়াল। আপনি একা? কারো অপেক্ষায় নাকি? আসুন পরিচয় করিয়ে দিই মাদামোয়া মেম লিন্ড। আমার। সহকর্মী। ইনিজ্যামাইকা থেকে এসেছেন।

বন্ড বলল, আমার আজ কি সৌভাগ্য। আসুন আপনারা। ওরা চেয়ারে এসে বসল। প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ম্যাথিস দুজনের ড্রিংকের অর্ডার দিল। বন্ডের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল সে, অত্যন্ত সহজ ও সাবলীলভাবে নাক মুখ দিয়ে ধোয়া ছাড়তে লাগল।

মেয়েটির উপস্থিতি বেশ ভালই লাগছিল বন্ডের। গভীর নীল চোখের ঐ নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল এক ধাক্কায় সব যেন চুরমার হয়ে যাবে। মুখে প্রসাধনের চিহ্ন মাত্র নেই। তবু মেয়েটির রূপে বন্ডের উত্তেজনা কিছু কম হচ্ছিল না, বরং উৎসাহিত হচ্ছিল এই ভেবে যে মেয়েটির সঙ্গে একইসঙ্গে কাজ করতে হবে তাকে।

ম্যাথিস বন্ডের আনমনা ভাব লক্ষ্য করছিল। সে একাই উঠে পড়ল।

মনে কিছু কোর না আমি রাতের ডিনারের ব্যবস্থাটা করে আসি। মেয়েটি মাথা হেলাল।

 বন্ড বুঝতে পারল, ম্যাথিস তাদের সুযোগ দিয়ে গেল। আজ সন্ধ্যেতে আপনি যদি একা থাকেন, তাহলে আমার সঙ্গে ডিনারে কোন আপত্তি আছে কি? মেয়েটি অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে জানাল, আপত্তি থাকবে কেন? আপনি কি আমাকে আপনার সঙ্গে ক্যাসিনোতে নিয়ে যাবেন? আমাকে সঙ্গে নিলে আপনার লাক খুলে যাবে

একসঙ্গে কাজ করতে হলে যেভাবে আলোচনা করতে হয় সেভাবেই পরস্পর মিলিত হবার জন্য স্থান-কাল ঠিক করল। বন্ডের ভয় ছিল এর কাছাকাছি আসতে তাকে কত না বাধা অতিক্রম করতে হবে, কিন্তু এখন দেখল মেয়েটি কোন রকম ভনিতা না করেই কাজের বিষয়ে খুঁটিনাটি ব্যবস্থা নিয়ে সহজেই কথা বলছে।

ম্যাথিস ফিরে আসতে বন্ড বিলটা চেয়ে নিল। হোটেলে ফিরে যেতে হবে, কারণ কয়েকজন বন্ধু লাঞ্চ করবে তার সঙ্গে। মেয়েটির সঙ্গে করমর্দন করে বেরিয়ে এল। মেয়েটি তখনও চেয়ে আছে বন্ডের গমন পথের দিকে। ম্যাথিস চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ও আমার বিশেষ বন্ধু। তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে মনে হচ্ছে, বরফ গলতে শুরু করেছে।

একটু হেসে সে বলল, বন্ডকে এ পর্যন্ত কেউ গলাতে পারেনি। মনে হচ্ছে এর পক্ষে এটা এক নতুন অভিজ্ঞতা হবে তোমার পক্ষেও। মেয়েটি এই কথার সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে বলল, চমৎকার চেহারা। কারমাইকেলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় কিন্তু ওর মধ্যে একটা নির্মম–

কথাটা তখনও শেষ হয়নি। ওদের কয়েক হাতের ব্যবধানে প্লেট গ্লাসের জানলা ঝনঝন করে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। বিস্ফোরণ এত প্রবল বেগে হয়েছিল যে তারা চেয়ারের সঙ্গে ঠুকে গেল। এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে বাইরের ফুটপাতে কি সব ভেঙে পড়ার আওয়াজ ভেসে এল। বার থেকে বোতল উল্টে গেল, চারদিকে চিৎকার, আর্তনাদ ও ছোটাছুটি। ম্যাথিস মেয়েটিকে বসিয়ে রেখে ভাঙা জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে চলে গেল।

.

হ্যাট পরা লোক দুটো

বন্ড বার থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে। রাস্তার দু-পাশে গাছের সারি, কয়েকশ গজ দূরে হোটেল। খিদেও পেয়েছে প্রচন্ড। সূর্য এখন ঠিক মাথার উপরে, তাপের জোরও বেশি। এই রোদেও গাছতলায় দুজন লোক দাঁড়িয়ে। বন্ডের সঙ্গে লোকদুটোর দূরত্ব এখন ঠিক একশ গজ।

বেঁটে চেহারা, পরনে দামী গরমের সুট, চওড়া ঈ হ্যাঁটের জন্য মুখের অনেকখানি অংশ ঢাকা পড়েছে। দুজনের কাঁধে দুটি রঙিন চৌকো ক্যামেরা কেস ঝুলছে–একটা উজ্জ্বল লাল, অন্যটি উজ্জ্বল নীল।

বন্ড ততক্ষণে তাদের প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরত্বের মধ্যে এসে গেছে। দুজনে দুজনের সঙ্গে কিছু ইশারা করল। চক্ষের নিমেষে নীল লোকটা ক্যামেরা নামিয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে আলোর প্রচন্ড ঝিলিক, বিকট বোমা ফাটার শব্দ। গাছের আড়াল থাকা সত্ত্বেও এক ঝটকায় সে কুপকাত। অর্ধসচেতনভাবে কোন মতে হাঁটুতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল। তার চারপাশে তখন বৃষ্টির মত ক্রমাগত ঝরে পড়ছে সুরকি, গাছের ডাল, রক্তমাখা জামাকাপড়ের ফালি আর মনুষ্য দেহের ছিন্নভিন্ন অংশ। চারদিক থেকে কাঁচ ভাঙার শব্দ। রাস্তার প্রায় সমস্ত গাছ পুড়ে গেছে, একটিতেও পাতা নেই। হ্যাটপরা লোক দুটোর কোন অস্তিত্বই চোখে পড়ল না। তবে লাল রঙের কিছু টুকরো রাস্তায়, গাছের গুঁড়িতে ও উঁচু মগডালে তখনও লেগে আছে। বন্ড গাছটা ধরে বমি করতে করতে উঠে দাঁড়াল, এই গাছটার জন্যই সে আজ নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বাতাসে তখনও ভেসে আসছে বারুদের গন্ধ, পোড়া কাঠ ও পোড়া মাংসের বিশ্রী গন্ধ। এই সময় ম্যাথিস এখানে উপস্থিত হল। সেই তাকে ধরে ধরে নিয়ে চলল হোটেল সৃপ্লেনডিডে। হোটেলে তখন ভিড় জমে। গেছে। ভীড় ঠেলে ওরা বন্ডের ঘরের দিকে চলল। ঘরে এসেই ম্যাথিস রেডিও চালিয়ে দিল। ম্যাথিস তাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে। ম্যাথিস টেলিফোনটা হুক থেকে খুলে নিতে ভুলল না।

আগে পুলিশকে জানিয়ে দিও জ্যামাইকা থেকে আগত ভদ্রলোক যিনি ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছিলেন, তার কিছু। হয়নি। তাকে যেন ওরা অযথা বিরক্ত না করে। আমি ওদের সব বুঝিয়ে বলব। ওরা প্যারিসকে জানায় ব্যাপারটা দুজন বুলগেরিয়ান কমিউনিস্টকে কেন্দ্র করে। প্রতিশোধ নেওয়ার ঘটনা। একজন অপরজনকে বোমা মেরেছে। তৃতীয়। বুলগেরিয়ানটির সম্বন্ধে এখন কিছু বলার দরকার নেই। ও আশেপাশেই কোথাও রয়েছে। লোকটা প্যারিসে যাবার নিশ্চয়ই চেষ্টা করবে। সমস্ত রাস্তায় যেন পাহারা থাকে। বুঝেছ?

খুব জোর প্রাণে বেঁচে গেছ। তোমার উদ্দেশ্যেই বোমা ছোঁড়া হয়। একটু উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে। যাইহোক আসল ঘটনা বার করতে আমাদের বেশি সময় লাগবে না। একটু থেকে ম্যাথিস বলল, তোমাকে ওরা এত গুরুত্ব দিচ্ছে কেন? ঐ বুলগেরিয়ান দুটো পালাল কি করে? বাক্স দুটোরই বা অর্থ কি? লাল বাক্সের টুকরো না দেখা পর্যন্ত কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ম্যাথিস এক উত্তেজনায় নড়েচড়ে বসল। ব্যাপারটা ক্রমেই বেশ জমে উঠছে। তার সামনে এখন। অনেক কাজ। বন্ড আর ল্যশিফের ব্যক্তিগত যুদ্ধের আগেই সেও এর মধ্যে নিজেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করে ফেলেছে।

এবার একটু ড্রিঙ্ক, তারপর খেয়ে একটু বিশ্রাম।

আমি যাই, পুলিশ সমস্ত ব্যাপার এলোমেলো করার আগে আমাকেই ঐ দিকে নজর দিতে হবে।

রেডিওটা বন্ধ করে ম্যাথিস বিদায় নিল। বন্ড নিস্তব্ধ ঘরে বসে রইল। সে বেঁচে আছে এটা ভাবতেই তার কেমন যেন অবাক লাগছে। ওয়েটার খাবার দিয়ে দিল। খাবারে মন দিয়েছে এমন সময় টেলিফোনের শব্দ।

আমি মাদমোয়াজেল লিন্ড। আপনি ঠিক আছেন তো।

না, না, তেমন কিছু নয়।

সাবধানে থাকবেন। ফোনটা ছেড়ে দিল।

হঠাৎ তার মনে হল, দুটো মরেছে, এখনও আর একটা রয়েছে।

আজকের খাবারের জন্য মোটা রকমের বকসিস পাওনা রইল ওয়েটারের। সারারাত ধরেই বসবে জুয়ার আসর। মনকে প্রস্তুত করে ভালভাবে তৈরি হওয়া দরকার। ঠিক তিনটে। ম্যাথিসও ঠিক সময়েই এসে গেছে। লোকটি। সুইডিশ। পা থেকে ঘাড় অবধি টিপে দিতে লাগল। আস্তে আস্তে স্নায়বিক উত্তেজনা অনেক কম মনে হল। এমনকি বা কাঁধের যন্ত্রণাও এখন অনেক কম। লোকটি চলে যেতেই বন্ডের দু-চোখের পাতা গভীর নিদ্রায় এক হয়ে গেল।

সন্ধ্যের সময় ঘুম ভাঙল। এখন শরীর অনেক বেশি ঝরঝরে। ঠাণ্ডা পানির শাওয়ার নিয়ে ক্যাসিনোতে উপস্থিত হল সে। গতরাতের পর থেকে এখানকার মুড থেকে একটু বেশি সরে গিয়েছিল সে। ঐ ভাবটা ফিরিয়ে আনা দরকার। যে কোন জুয়াড়ীর ধৈর্য আর আশাবাদীটা হওয়া ভীষণভাবে দরকার। তাস খেলার সঙ্গী হিসেবে স্বাভাবিক প্রবণতা ও আন্দাজ করার ক্ষমতা পাশাপাশি চলে বলতে গেলে।

বন্ড চিরকালের জুয়াড়ী। তাসের খসখসে শব্দ-তার মনে এক অদ্ভুত মোহ সঞ্চার করে। সবুজ টেবিলটা ঘিরে যে নীরব নাটক অনুষ্ঠিত হয় তাও তার সমস্ত সত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। গদীওয়ালা চেয়ার তার বড় প্রিয়। হাতে ধরা থাকবে শ্যাম্পেন বা হুইস্কি। রুলেতে বল আর তাসগুলো পৃথিবীতে কাউকে তোয়াক্কা করে চলে না। নিজের চেয়ার। থেকে এক ধাচের দর্শক ও অভিনেতা ভাবতে নিজেকে মন্দ লাগে না। মন্দ লাগে না অন্যের নাটকে অংশ গ্রহণ করতে, তারপর নিজের পালা এলে তখন হাঁ বা না বলা, যার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে থাকে।

এই খেলায় সবচেয়ে পছন্দের বিষয় হল এই যে কেবল সে ছাড়া আর কেউই দোষের ভাগী হবে না। ভাগ্য আমাদের চালাচ্ছে, না আমরা ভাগ্যকে চালিয়ে নিয়ে চলেছি চাকরের মত। বরাত ভাল হলেও ঠাণ্ডা মাথায় খেলে যেতে হবে, খারাপেও নির্বিকার থাকতে হবে। কোনটা বরাত আর কোনটা খারাপ খেলার ফল এই তফাৎটা বুঝে নিতে হবে। জুয়া খেলতে গেলে এই তফাৎটা জেনে রাখা প্রয়োজন। ভাগ্য নানারূপে সম্মুখীন হয়–আদর কর, উপভোগ কর কিন্তু মাথায় তুলোনা বা ধাওয়া কোর না। কোন একদিন তাকেও হয়ত ভাগ্যের কাছে বা কোন রমণীর কাছে হার মানতে হবে। আজ এই জুন মাসের সন্ধ্যায় বন্ড যখন জুয়ার আড্ডায় ঢুকল, তার মনে তখন দারুণ আশা ও গভীর আত্মপ্রত্যয়। তারপর লক্ষ ফ্র্যাঙ্ক বদলে সে পঞ্চাশ হাজার চাকতি করে নিল। রুলের এক নম্বর টেবিলে বসল, পাশের আসনে শেফ দ্য পার্টি। শেফের কার্ডটা চেয়ে নিয়ে বন্ড খেলার বিবরণ সব দেখতে লাগল। আগের খেলার সঙ্গে পরের খেলার কোন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। এক একবার চাকা ঘোরে, বলটা লাফাতে লাফাতে একটা গর্তে পড়ছে, সমস্ত ব্যাপারটি একটা পারস্পর্যহীন ঘটনা। তবু সে আগের খেলাটা বরাবর দেখে নিত। প্রত্যেকবারের খেলাই একটা সম্পূর্ণ নতুন খেলা। ব্যাংকারের পার্টনার ডান হাতে গজদন্তের বলটা তোলে, চাকার চারটে শোককে চালিয়ে ঘড়ির কাঁটা যেভাবে ঘোরে সেভাবে, আর সেই সঙ্গে, ঐ একই হাতে বলগুলো ছুঁড়ে দেয় উল্টো মুখে। বহু বছরের চেষ্টায় এই চাকতি, সিলিন্ডার আর মার্কামারা গর্তে বল ফেলার কায়দা এবং যান্ত্রিক কলা কৌশল এতটাই নিখুঁত অবস্থায় এসে উপস্থিত যে এখন চাকতির কোন খুঁত বা পার্টনারের ইচ্ছাকৃত চেষ্টা বলের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তবু রুলেতে খেলুড়েদের মধ্যে আগের খেলাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে একটা প্রথাস্বরূপ, যাতে চাকতি ঘোরার ধরনে কোন বিশেষত্ব দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সে অনুযায়ী খেলা নির্ধারণ করা হয়।

বন্ডও-এর ব্যতিক্রম ছিল না। কোন বিশেষ সংখ্যার ঘরে পর পর দুবার বল পড়ছে কিনা এই জাতীয় জিনিসে সে বিশেষ নজর দিত।

প্রথমটা ভাল না মন্দ সে নিয়ে বন্ড তেমন মাথা ঘামাত না। তার মতে জুয়া এমনই একটা খেলা যেখানে যত বেশি চেষ্টা আর বুদ্ধির প্রয়োগ করবে সেখানে ততবেশি ফল সেই অনুপাতে পাওয়ার আশা থাকে।

বন্ডের টেবিলে গত তিন ঘণ্টার মধ্যে এরকম কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল না। কেবল একটা জিনিস চোখে পড়ল, তা হল শেষের বারোটা ঘরে তেমন বল পড়েনি। চাকতি যে দিকে ঘোরে সেদিকেই বন্ডের খেলার অভ্যাস বরাবর। একবার জিরো ওঠোর পর খেলার কায়দা সে নিজেই বদল করে নেয়। সে একলক্ষ ফ্র্যাঙ্ক দিয়ে প্রথম দুজনের ওপর বাজি ধরল। এই ভাবে সমস্ত সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই তার আয়ত্তে এসে গেল।

পঁচিশের নিচে কিছু উঠলে সে একলক্ষ ফ্র্যাঙ্ক জিততে শুরু করল। কারণ ছয় জনের বাজিতে ডবল লাভ হয়। সাত বাজির খেলায় ছটা বাজি তার আয়ত্তে চলে এল। সাত বারের বার তিরিশ উঠলে, তখন তাকে হারের সম্মুক্ষীণ হতে হয়। নিজস্ব লাভ হল চারলক্ষ ফ্র্যাঙ্ক। উফুল্পের সঙ্গে সে প্রথম ও শেষ ছজনে বাজি ধরল। দুবারই হেরে বসল। দুবার চাল হবার মাঝখানের ৬ জন উঠল দুবার। চার লক্ষ ফ্র্যাঙ্ক গেল। টেবিল ছেড়ে সে যখন উঠল লাভ লোকসানের তালিকায় জমা হয়েছে দশলক্ষ ফ্র্যাঙ্ক।

সে এমন ভাবে বাজি ধরতে শুরু করেছিল যাতে করে টেবিলের অন্য সকলেরই তার প্রতি দৃষ্টি যায়। সে যেভাবে জিততে শুরু করল, তা দেখে অনেকেই তার পথ অনুসরণ করল। তার মুখোমুখি বসেছিল একজন আমেরিকান। বন্ডকে এইভাবে জিততে দেখে মনে মনে সে খুব আনন্দ উপভোগ করছিল। বন্ড যা যা করছে, সেও হুবহু তাই অনুকরণ করছে। বন্ড টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই লোকটি তার সামনে এসে তাকে অভ্যর্থনা জানাল। আপনার খাওয়া পাওনা। চলুন একটা ড্রিংকের অর্ডার দিই।

বন্ডের মনে হল এই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই সি. আই-এর লোক। বারের উদ্দেশ্যে দুজনেই হেঁটে চলল। ততক্ষণে তার বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে যে এই লোক তার পার্টনার। তাই বন্ড লোকটিকে একটা দশহাজারের চাকতি ও পরিচারকটির উদ্দেশ্যে এক হাজার ছুঁড়ে দিতে ভুলল না।

আমেরিকানটি বলল, আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভালই লাগছে। আমার নাম ফেলিক্সলিটার।

আমি বন্ড। জেমস বন্ড।

হ্যাঁ, ঠিক তাই। দেখ কি ড্রিংক করা যায়?

বন্ড লিটারকে হেগ অ্যান্ড হেস হুইস্কি অর্ডার দিতে বলল।

সঙ্গে শুধু বরফ। বারম্যানের দিকে তাকাল।

শোন। একটা ড্রাই মার্টিনি। শ্যামপেনের গেলাসে দেবে।

ঠিক আছে মসিয়ো।

দাঁড়াও, দাঁড়াও। তিন ভাগ গর্ডন, একভাগ ভডকা, কিমা লিনোট-এর আধ। ভাল করে ঝকাও। যখন বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তখন একটুকুরো লেবুর খোসা দিয়ে নিয়ে আসবে। বুঝেছ তো?

হ্যাঁ, মসিয়ো। মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে লোকটার। ড্রিংকের বর্ণনাটা তার বেশ মনে ধরেছে।

বাঃ, দারুণ হবে। লিটার মন্তব্য না করে পারল না।

বন্ড হাসল। আমি, যখন কাজে মন দিই তখন ডিনারের আগে একটা ড্রিংকই নিই। সেই একটা যেন মনোমত আর কড়া হওয়া চাই। একটু একটু কিছু খেতে আমার ভাল লাগে না, বিশেষ করে তা যদি খেতে ভাল না হয়। আমি ভাই ড্রিংকটা নিজেই আবিষ্কার করেছি। আগে একটা নাম দিই। পরে পেটেন্ট নেব।

ফিকে সোনালি রঙের তরল পানীয় ঝকানি দিতেই বুদবুদ উঠতে শুরু করে। গ্লাসের গায়ে জমা হচ্ছে কিছু কিছু জলকণা। লম্বা একচুকুম দিয়ে বন্ড বারানকে বলল, এত ভাল হবে তা ভাবিনি। আরো ভাল হত যদি ভডকাটা আলুর বদলে শস্য দিয়ে তৈরি করা হত তাহলে বোধহয় এর স্বাদ পূর্বের থেকে অনেক বেশি সু-স্বাদু হত।

তারপর ফেলিক্স-লিটারকে বুঝিয়ে বলল, তার মানে এই নয় যে আমরা এই নিয়ে ভরসা করব।

লিটার গ্লাস হাতে করে ঘরের কোণে চলল। যেতে যেতে বলল, আপনার ভেবেচিন্তে কাজ করার পদ্ধতি একে বারেই পৃথক ধরনের। তবে আজ দুপুরে যে ব্রান্ডট তৈরি করলেন এরপর আপনি এর নাম রাখবেন মলোটভ ককটেল।

লিটারের কথায় বন্ড না হেসে পারল না।

দেখলাম জায়গাটা ছড়ি দিয়ে ঘিরে রেখেছে। ওখান দিয়ে কোন গাড়ি যেতে দিচ্ছে না। ফুটপাতের উপর দিয়ে। চালিয়ে দিচ্ছে। আশা করা যায় এর ফলে কোন শাসালো মক্কেলরা ঘাবড়ে গিয়ে পালিয়ে যাবে না।

কমিউনিস্টদের ঝগড়ার গল্প লোকের মনে ধরেছে। কেউ কেউ ভাবছে গ্যাসের শেল ফেটে গেছে। সব পোড়া গাছগুলো এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মন্টিকার্লোর মত এখানেও চটপট কাজ হলে সকালের মধ্যে দুর্ঘটনার আর কোন চিহ্নই পরে থাকবে না।

বন্ড, আপনার সঙ্গে কাজ করতে পারছি বলে আমার নিজেরও খুব ভাল লাগছে। ভাগ্যিস আপনি বোমার ঘায়ে ঘায়েল হননি। আপনার অফিসের মত এরাও মনে করে ব্যাপারটা গুরুতর এবং যেভাবে আপনি এগোচ্ছেন এটাই স্বাভাবিক পন্থা। ওয়াশিংটন একটু বেশি বিরক্ত যে আমরা না করে আপনারা এই কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন। জানেন তো বড় কর্তাদের মতিমর্জি, লন্ডনেও নিশ্চয়ই এই একই ব্যাপার?

হ্যাঁ, হিংসে আছে খুব, বন্ড অভিযোগটা মেনে নেয়। সে যাই ঘটুক, আপাতত আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য। যা দরকার একবার হুকুম করবেন।

ম্যাথিস ও তার দল সব দিকেই খেয়াল রেখেছে, তবুও আমি আপনার সঙ্গেই আছি।

একদিকে ভালই হল। শত্রুপক্ষের কাছে আপনি, আমি ও ম্যাথিস তিনজনেই পরিচিত। তাই কার্যসিদ্ধির জন্য। আমাদের বিরুদ্ধে কোন পন্থা অবলন করতে এরা পিছপা হবে না। ল্যাশিফ তাহলে সত্যিই মরিয়া হয়ে উঠেছে। আপনাকে বিশেষ কোন কাজ দিচ্ছি না। শুধু ক্যাসিনোতে আমার পাশে পাশেই থাকবেন। আমার সহকারীও থাকবে, মিস লিন্ড। খেলা শুরুর আগে আমি তাকে আপনার কাছে সমর্পণ করতে চাই। আপত্তি করবেন না। মন্দ নয়। একটু মৃদু হাসি হাসল বন্ড। ল্যশিফের বডিগার্ড দুটো থেকে একদম চোখ সরাবেন না। মনে হয় না ক্যাসিনোর মধ্যে কিছু করবে বলে। তবু সাবধান থাকাই ভাল।

লিটার বলল, আমার দ্বারা যতটুকু সম্ভব আমি তাই করে যাব। এই কাজের আগে আমি মেরিন কোরে ছিলাম। মানে জানেন তার?

বুঝি বন্ডের উত্তর।

লিটারের বাড়ি টেক্সাস। ন্যাটোর গোয়েন্দা বিভাগে যুক্ত সে। কাজটা খুব সহজ নয়, কারণ এখানে বহু দেশের স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত। বন্ড ভাবছিল আমেরিকানরা মানুষ হিসেবে সত্যিই চমঙ্কার।

লিটারের বয়স পঁয়ত্রিশ। লম্বা ছিপ ছিপে-চেহারা। তার পরনের সুটটা গায়ের থেকে একটু বেশি ঢিলে ঢালা। তার গতিভঙ্গী ও কথা বলার আদব কায়দা খুবই সংযত ও ধীর। কিন্তু প্রয়োজনে খুবই নির্মম হয়ে থাকে এরা।

টেবিলের উপর এখন ভাবে ঝুঁকে রয়েছে যে, যে কোন মুহূর্তে এরা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। চিবুক, থুতনি আর ঠোঁটে রয়েছে পূর্বের সেই সদাজাগ্রতভাব। চোখ কুঁচকোবার বদভ্যাসের জন্য চোখের পাশে অসংখ্য ছোট ছোট দাগ। হাসলে সেগুলোতেও ভাজ পড়ে। অগোছালো চুলের গোছা দেখলে হঠাৎই ইস্কুলের ছেলে বলে মনে হতে পারে। প্যারিসে ওর কাজকর্ম সম্বন্ধে যতই মুখ খুলুক না কেন, স্বদেশীয় সহকর্মীদের ব্যাপারে একেবারেই নীরব। মনে হয়। নিজের সংস্থার প্রতি তার আনুগত্য অনেক বেশি। যেটা স্বাভাবিক।

লিটার আরও একটা হুইস্কি নিল। বন্ড ততক্ষণে ওকে মুনজদের কথা বলেছে, আর বলেছে ল্যশিফের ভিলার দিকটা ঘুরে আসার কথা। পরে সাতটা নাগাদ ওরা হোটেল অবধি বেড়াতে যাবে ঠিক করল। ক্যাসিনো থেকে বেরোবার আগে বন্ড ওর সবটাকা, দুকোটি চারলক্ষ ফ্রাঙ্ক ক্যাশিয়ারের কাছে জমা রেখে দিল। কেবল দশ হাজারের কয়েকটা নোট সঙ্গে রাখল।

হোটেলে যাবার পথে দেখল বোমা ফাটার জায়গাটায় জোর কদমে কাজ হচ্ছে। অনেকগুলো গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে। হোস পাইপ থেকে পানি দিয়ে রাস্তাটা পরিষ্কার করা হচ্ছে। বোমার গর্তটাও নেই। লোকজনেরা কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। নিশ্চয়ই হার্মিটেজের সামনেও ভাঙাচোরা মেরামত হয়ে গেছে। দোকান ও বাড়ির সামনের অংশে যে সমস্ত জায়গার ক্ষতি হয়েছিল তা সারিয়ে পূর্বের মত হয়ে গেছে। সন্ধ্যার স্নিগ্ধ আলোয় রয়্যাল শেজোয় আবার হারিয়ে যাওয়া শান্তি ফিরে এসেছে। কেয়ারটেকারটা কাছের লোক? জিজ্ঞেস করল লিটার। বন্ড নিজেও ঠিক জানে না। ম্যাথিস ওকে বলেছিল, তুমি ধরে নাও, ও কারো কাছ থেকে টাকা খেয়েছে। একমাত্র রাজা মহারাজা ছাড়া ওরা সকলকেই চোর জুয়াচোরের তালিকায় ফেলতে চায়। তোমাদের মঙ্গলের জন্য ওরা যা করে, তা সবটাই ওদের অভিনয়।

বন্ডকে দেখেই কেয়ারটেকারটা ছুটে এল। জিজ্ঞেস করল তার দুর্ভাগ্য জনক অভিজ্ঞতার কথা। ম্যাথিসের কথাটা মনে আসতেই সে বলল, ধাক্কাটা এখনও পুরোপুরি সামলাতে পারেনি, একটু সময় লাগবে। খবরটা যথা সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাবে। ভালই হল, ল্যশিফ খেলার সময় একটু অসাবধান হয়ে পড়বে।

.

শ্যাম্পেন আর গোলাপী

আলো বন্ড ঘরে এসে নিজের জিনিসপত্রের দিকে একবার ভাল করে চোখে বুলিয়ে নিল। না যে জায়গাকার জিনিস ঠিক সে জায়গাতেই আছে। গরম ও ঠাণ্ডা পানির শাওয়ার নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মেয়েটির সঙ্গে দেখা হতে এখনও ঘণ্টা খানেক বাকি। মন সংযত করে সব প্ল্যান ঠাণ্ডা মাথায় ছকে নিতে হবে। জিতলে বা হারলে তখন কি করনীয় সে বিষয়েও চিন্তা আছে। ম্যাথিস, লিটার ও মেয়েটি এরা কে কোন্ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে–এই ভাবতেই ভাবতেই কল্পনার লাগাম হাল্কা করে ধরে রইল। একের-পর এক দৃশ্য তার মণিকোঠায় এসে জমা হতে লাগল।

নটা বাজতে এখনও কুড়ি মিনিট বাকি। সব সমস্যা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে সে পোশাক পরতে উদ্যত হল।

কালো সার্টিনের টাইটা ঠিক করতে করতে আয়নায় তার দৃষ্টি চলে গেল। খুব ভাল করে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। ধূসর নীল চোখ দুটোয় নিজের অজান্তেই কৌতুকের আভাস উঁকি দিচ্ছে। ডান ভুরুর উপর চুলগুলো আজ যেন বড় বেশি অবাধ্য হয়ে উঠেছে। ডান গালে এই লম্বালম্বি কাটা দাগটা না থাকলেই কি চলছিল না। দাগের জন্যই তাকে আজ ঠিক গুন্ডাই লাগছে। ঠিক হোগিকার মাইকেল মেয়েটির দৃষ্টিকে তারিফ না করে পারা যায় না।

ম্যাথিস ওকে বলেছিল মেয়েটি তার সম্বন্ধে কি ধারণা পোষণ করে। তাহলে ল্যশিফের সঙ্গে সে আজ দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে। যুদ্ধের সব সম্ভাবনাগুলো আরো একবার ভাল করে ভেবে নিল।

চ্যাপটা গান মেটালের সিগারেট কেসে পঞ্চাশটা মরল্যান্ড সিগারেট ভোরল। হিপ পকেটে তা নিয়ে নিল। ভর্তি রনসন লাইটারটা নিতেও ভুলল না।

একগোছা দশহাজারের ফ্রাঙ্কের নোট নিয়ে ড্রয়ারটা বন্ধ করে দিল। হালকা শ্যামল দারের হসলারটা এমনভাবে কাঁধে ঝোলাল যাতে ওটা বগল থেকে ঠিক তিন ইঞ্চি নিচে থাকে। শার্টের গোছর নীচ থেকে বার করল চ্যাপ্টা .২৫ বেরেটা অটোম্যাটিক পিস্তল। গুলিগুলো বার করে বার দুই প্রাকটিস করে নিল। ট্রিগারও দেখে নিল। গুলি ভরে, সেফটি ক্যাচ লাগিয়ে কাঁধের হাসলারের মধ্যে নিয়ে নিল সেটা। আবারও ঘরের চারদিকে দেখে নিল সব, এখনও কিছু নিতে বাকি আছে কি না। সিল্কের সার্টের উপর সিঙ্গল-ব্রেস্টেড ডিনার জ্যাকেটটি চাপাল। শেষবারের মত আয়নায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল। নিজেকে আজ বেশ সপ্রতিভ লাগছে। এরপর অনেক নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। বাইরে এসে দরজা টানতেই লক হয়ে গেল।

বারে যেতে সবে সিঁড়িতে পা দিয়েছে, লিফটের দরজা খুলে গেল। ঠাণ্ডা গলায় নারীকণ্ঠস্বর, গুডইভনিং।

লিফট থেকে বেরিয়ে মেয়েটি ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার রূপের মোহজালে সে আটকা পড়েছে। এইবার সামনে দেখেই সে উত্তেজিত হল।

কালো ভেলভেটের বাহুল্য বর্জিত নিখুঁত পোশাক। সত্যি এরকম দোকান যে কটা আছে তা বোধহয় হাতে গুণেই বলা যায়। সরু হীরের নেকলেস, কাটা গলার ঠিক শুরুর জায়গায় হীরের ক্লিপ আঁটা। কাঁধে কালো ব্যাগ, কোমরের কাছটা ধরা। কালো সোজাচুল, টিপটা সামান্য গোল হয়ে গেছে। এত চমৎকার রূপ যে কারো হতে পারে না দেখে। ভাবা যায় না। তার দিক থেকে চোখ সরান মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। বন্ডের মধ্যে এক অজানা ধুকপুকুনি শুরু হয়ে গেছে। বাঃ ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে। রেডিওর ব্যবসা ভালই চলছে আশা করি। বন্ডের হাত ধরে মেয়েটি তাকে সোজা। নিয়ে চলল সামনের দিকে অর্থাৎ খাওয়ার আসরে। সমারোহের সঙ্গে দুজনে প্রবেশ করল। আসলে কি জানেন? কালো ভেলভেটে বসলেই দাগ হয়ে যায়। আজ রাত্রে কোন এক সময় যদি আমার আর্তনাদ কানে যায়, তখনই বুঝবেন। আমি বেতের চেয়ারে আসন গ্রহণ করেছি।

বন্ড মেয়েটির কথায় হেসে ওঠে। চলুন, যতক্ষণ না খাবার আসছে ততক্ষণ আমরা ভডকা খাই, অবশ্য ককটেলও চলতে পারে অবশ্য। আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে। এখানকার খাবার রয়্যালের মধ্যে সবচেয়ে নাম করা।

বন্ডের মনে হল মেয়েটি চট করে পানীয়ের নামটা বদলাল, এই ব্যাপারটা ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু সে কেবল মুহূর্তের জন্য। হোটেলের বাটলার নীচু হয়ে তাদের অভিবাদন জানায়। ভিড় ঠেলে তারা ভেতরে এল। সকলে ঘাড়ফিরিয়ে বন্ড ও তার সঙ্গিনীকে দেখতে লাগল। আগের চেয়ে বন্ড এখন অনেক বেশি স্বাছন্দ্য বোধ করছে।

রেস্টুরেন্টের যে অংশে ক্যানের দিকে এসে মিশেছে সেখানেই থিকথিকে ফ্যাশানেবল লোকদের ভিড়। বন্ড ভিড়ের দিকে না গিয়ে পিছনে আয়না লাগানো বারান্দার মত অনেকটা, নিভৃত নিরিবিলিতে গিয়ে বসল। সোনালী মেশানো দেওয়াল আর আসবাব সব মিলিয়ে যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ও ঝকঝকে।

কি খাবেন?

এক গ্লাস শুধু ভডকা, মেয়েটি এইটুকু বলেই মেনুর দিকে দৃষ্টি দিল।

 বন্ড লোকটিকে বলল, ছোট হলেও ভডকা ঠাণ্ডা হওয়া চাই।

দেখুন তো আমি এত কথা বলছি কিন্তু আপনার নামটাই জানা হয়নি। আপনার নামটা না জানা পর্যন্ত আপনার চমৎকার পোশাকের সামনে স্বাস্থ্য পান করা যাচ্ছে না।

ভেমপার লিন্ড, ভেসপার।

আমার নামটা বড় অদ্ভুত। আমার জন্ম এক ঝোড়ো সন্ধ্যায়, বাবার কাছ থেকে তাই শুনেছি আমি। ঐ সন্ধ্যাটির কথা স্মরণ রেখেই আমার এই নামকরণ। নামটা কেউ পছন্দ করে, আবার কেউ পছন্দ করে না। আমার এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।

নামটা সত্যিই সুন্দর। আচ্ছা আপনার নামটা আমায় ধার দেবেন? বন্ড ভেসপারকে বুঝিয়ে দিল মার্টিনির ফরমুলার কথা। ড্রিংকের একটা নাম চাই। ভেসপার, সত্যিই দারুণ হবে। সে সব পৃথিবীর মানুষ আমার এই ককটেলের স্বাদ গ্রহণ করবে, সেই সময়কে ধরে রাখার উপযুক্ত এই নাম। আপনি কি দিতে রাজি আছেন?

প্রথম ড্রিংকটা আমি আগে চেখে দেখব। বর্ণনা শুনে আমারই লোভ হচ্ছে।

 এই সব ঝামেলার সমাধান হয়ে গেলে একসঙ্গে একদিন খাব। ফলাফল ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন।

আচ্ছা এবার খাবারের কথা বলি। কিছু কি ঠিক করেছেন? খুব দামী হওয়া চাই কিন্তু, দেখুন আপনার ইতস্তত হওয়ার কোন কারণ নেই। না হলে, আপনার অপূর্ব পোশাকের অমর্যাদা করা হবে ভেসপার।

মেয়েটি বলল আমি দুটোই দারুন জিনিস বেছেছি। মাঝে মাঝে লক্ষপতি সাজতে বেশ ভালই লাগে, বিশেষ করে যদি প্রথমে ক্যাভিয়ার দিয়ে শুরু করা যায়। পরে গ্রিলড রোগন দভো, সঙ্গে নোপ সুফল। আরো পরে ফ্রেজ ছিবোয়া ক্রিম দিয়ে। দেখুন আমি কি রকম বেহায়াপনা করছি।

আপনি বেহায়া হতে যাবেন কেন? দামী খাবারের অর্ডার, এই গুণটাই বা কজনের থাকে। তাছাড়া এগুলো স্বাস্থ্যের পক্ষেও ভাল।

আপনার অনুমতি পেলে আমি আজ রাতে শ্যাম্পেন খেতে চাই। আজকের পক্ষে এটাই উপযোগী।

 হা। আমারও শ্যাম্পেন চলবে।

বন্ড আঙুল তুলে নামটা দেখাল। পরিচারক বলল, সিয়ো খুব ভাল ওয়াইন বেছেছেন। ব্লা ছ ব্লা ব্রাট ১৯৪৩। বন্ডের মুখে মৃদুহাসি। এটা আনতেই সে অনুমতি দিল। এই ব্রান্ডটা খুব দামী না হলেও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শ্যাম্পেন হিসেবে সম্মান পেতে পারে। বন্ড নিজের এই কথায় নিজেই হেসে উঠল।

কিছু মনে করবেন না। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমি বরাবরই শৌখিন। একা থাকি। একলাই খেতে হয়। এইসব করে খাওয়ার মধ্যে একটু বৈচিত্র আনা আর কি। মৃদু হাসি ভেশপারের মুখে। সব খুঁটিয়ে করা এটা আমার একটা বদভ্যাস বলতে পারেন। এইভাবে বাঁচার এক আনন্দ আছে, আছে সেই সঙ্গে পৃথক অনুভূতি।

ভডকা খেতে গিয়ে ভেসপা হঠাৎ বলে উঠল, আপনাকে আসল কথাই বলা হয়নি। ম্যাথিস খবর পাঠিয়েছে। বিষয় সেই বোমা। অদ্ভুত গল্প।

.

বাকারা

বন্ড চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। না, ধারে কাছে কেউ নেই। ক্যাভিয়ার আসতে এখনও বেশ দেরি আছে।

শুরু কর, তোমার শোনা কাহিনী।

তৃতীয় বুলগেরিয়ান ধরা পড়ে গেছে। প্যারিসে পালিয়ে যাচ্ছিল। মিত্রো চালাচ্ছিল। পথে দুজন ইংরেজকে তুলে নেয়। যাতে ওর ওপর পুলিশের চোখ না যায়। একটি মোড়ে যখন গাড়ী থামায় ওর তখন ওর মুখে ফরাসী শুনে ওদের মনে সন্দেহ জাগে। ওরা কাগজ-পত্র দেখতে চায়। পিস্তল বার করে সে তখন এক পুলিশকে গুলি চালায়। ততক্ষণে পুলিশটি মারা গেছে। অন্যজনের হাতে ও ধরা পড়ে। এটাই আশ্চর্য, কিভাবে যে ওকে ধরল। রুয়েনে নিয়ে গিয়ে চিরাচরিত পদ্ধতি তারা ব্যবহার করে। সে সব কথা বলে দেয়।

ওরা একই দলের সদস্য, ফ্রান্সে এই ধরনের নাশকতামূলক কাজের সঙ্গে এরা লিপ্ত। ম্যাথিসের বন্ধুরা বাকিদলকেও ধরার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কতক্ষণ আর পালিয়ে বেড়াবে। আপনাকে হত্যা করার জন্য কুড়িল ফ্রাঙ্ক ওদের দেওয়ার কথা ছিল। যার মাধ্যমে এই কথাবার্তা হয়, সেই এজেন্টের বক্তব্য ছিল যদি নির্দেশ মত তাদের কাজ ওরা করে যায়, তবে কখনই তারা ধরা পড়বে না।

এরপর আসল ব্যাপারে আসা যাক, এজেন্ট ওদের দুটো ক্যামেরা কেস দেয়। আপনি আগেই দেখেছেন সে দুটো। চড়া রং থাকলে নাকি কাজের সুবিধা হয়। নীল কেসের মধ্যে রাখা ছিল ধোয়া বোমা, লালের মধ্যে আসল বোমা। কথা ছিল লাল কেসটা ছুঁড়লেই অন্য নীল কেসের বোতাম টিপবে।

চারদিকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকবে, এই সুযোগে তাদের পালানোর কোন অসুবিধা হবার কথা নয়। ধোয়া কোনটা, আসলে মানুষের উদ্দেশে একটি ধাপ্পা সূচক ঘটনা বলা যায়। যাতে তারা আরো বেশি দিশেহারা হয়ে ওঠে, দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। দুটো কেসেই একই ধরনের বিস্ফোরক রাখা ছিল। এদের মধ্যে কোন তফাত ছিল না। ওরা ভেবেছিল এক ঢিলে দুটো পাখি মারবে–একদিকে আপনি ও ভাড়াকরা গুণ্ডা দুটোও মৃত্যুর কবলে পতিত হবে। তৃতীয়টির বিষয়েও ওরা নিশ্চয়ই কিছু ভেবে রেখেছিল।

বন্ড মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। সত্যিই তাকে মারার জন্য কত চিন্তা ভাবনা করে এই প্ল্যান তৈরি করেছে। তারপর, থামলে কেন?

বুলগেরিয়ানরা ভেবেছিল কোনভাবেই এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে না। তাই প্রথমেই তারা ধোয়া বোমা ছোড়ে। আপনি বলেছিলেন সহকারীর হাতটি ছিল নীল কেসের দিকে। ওরা জানত ওটা ধোয়া বোমা, কিন্তু আসলে ওটাতে শক্তিশালী বোমাই রাখা হয়েছিল। যার ফলস্বরূপ তাদের কোন অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি।

তিন নম্বর লোকটা হোটেলের পেছনে তাদের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ব্যাপার দেখেই বুঝল কোথাও গণ্ডগোল হয়েছে। সব পরিশ্রম বৃথা গেল। পরে পুলিশ যখন না ফাটা বোমাটা ওর চোখের সামনে তুলে ধরে তখন পুরো ব্যাপারটা পানির মত পরিষ্কার হয়ে যায় তার কাছে। এখনও ওর জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কিন্তু এই ব্যাপারগুলো ল্যশিফের ভূমিকা কোন ভাবেই যুক্ত হচ্ছে না। কারণ এর কোন দিন ল্যশিফের নাম এর আগে শোনেনি।

ওদের সঙ্গে কথা বলেছিল সম্পূর্ণ এক তৃতীয় ব্যক্তি। সম্ভবত ল্যশিফের দেহরক্ষীদের মধ্যে কেউ হবে। কাহিনী শেষ হতেই ক্যাভিয়ার এসে হাজির। অনেকখানি করে ক্যাভিয়ার নিয়ে দুজনে খেতে শুরু করল। খানিকক্ষণ কারো মুখেই কোন কথা নেই।

একটু পরে বন্ড এই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল। যাক আমাকে মারতে এসে তারা নিজেরাই শেষ হয়ে গেল। ভাবতে অবাক লাগছে। আজ ম্যাথিসকে পায় কে–চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়নি তার মধ্যে শত্রুপক্ষের পাঁচজন কুপকাত–এই বলে থামল সে। তারপর মুনজ দম্পতির কলকাঠি নাড়ার বৃত্তান্ত শোনাল।

আচ্ছা, তুমি এই কাজে এলে কি করে? কোন সেকশন আছ?

আমি হেড অফ এর পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট। সমস্ত প্ল্যানটা ওদেরই পরিকল্পিত। তাই তিনি এম-র মতামত নিলেন, আমাকে এই কাজে পাঠানো যায় কিনা। কাজটা হবে শুধু যোগাযোগ রেখে চলা। বন্ডের কাছ থেকে ভেসপার কিছু আশা করছিল। বন্ডকে চুপচাপ দেখে সে নিজেই বলে চলল, ম্যাথিসের সঙ্গে দেখা করে আমরা এক সঙ্গে এখানে এলাম। ডি-ওর এর পোশাকের দোকানে আমার এক বন্ধু আছে। তারই দেওয়া এই সম্মানীয় পোশাক, সকালে যেটা পরেছিলাম সেটা তারই দেওয়া। তা না হলে এদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া আমার কি সাধ্যে পড়ে?

অফিসের সবাই আমার ব্যাপারে বড়ই নির্দয়–হিংসেতে মরে যাচ্ছে ওরা। ওরা জানে না কাজটা কি টাইপের। শুধু জানে একজন ডাবল জিরোর সঙ্গে কাজ। আপনি জানেন না, আমাদের চোখে আপনার ইমেজ–আমি তো নিজেকে ধন্য বলে মনে করি যে, আপনার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। বন্ড গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, এ আর এমনকি, ডাবল জিরো নাম্বারটা পাওয়ার মধ্যে কোন আহামরি তো কিছু নেই। খুন করতে প্রস্তুত থাকতে হয় সব সময়। নিউইয়র্কে এক-জাপানী হস্তরেখাবি আর স্টকহলমে এক নরওয়েজিয়ান ডাবল এজেন্ট–এই দুজনকে হত্যার পুরস্কার আমার এই খেতাব। লোকগুলো মন্দ ছিল না। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আজ তাদের এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। সত্যিই এ এক গোলমেলে ব্যাপার। চাকরী রাখতে গেলে তাই এইসব করতেই হয়। এ ব্যাপারে এই আলোচনা একটু বন্ধ থাক। খাওয়ার প্রসঙ্গে আসি-ক্যাভিয়ারের সঙ্গে ডিম সিদ্ধ কেমন লাগছে?

সত্যি ভীষণ ভাল খেতে, এক কথায় দুর্দান্ত। মনে হচ্ছে–বন্ডের ঐ হিমশীতল দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। মেয়েটি।

আমরা সকলেই এখানে কাজ করতে এসেছি। বন্ড মনে মনে নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করল। সহকর্মীর সঙ্গে সহকর্মীর মত আচরণই করা উচিত।

এবার আমাদের কার্যপদ্ধতি সম্বন্ধে আলোচনায় বসা যাক। আমি কি করব তোমার কি করনীয় তাও বুঝিয়ে বলছি আমি। ব্যাপারটা হচ্ছে এই। সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিল বন্ড তাকে নানাবিধ সম্ভাবনার দিক।

চমৎকার সুস্বাদু আহার্য খেতে খেতে কাজের কথা চলতে লাগল। বন্ডের রূঢ় ব্যবহারে একটু দমে গিয়েছিল ভেসপার, সঙ্গে সঙ্গে একটু ক্ষুণ্ণও হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু ঝেড়ে ফেলে বন্ডের কথাই সে একমনে শুনতে থাকল।

ভেসপার তার কর্তার সাবধান বাণী উড়িয়ে দিতে পারেনি। কাজ পাগলা লোক হিসেবে পরিচিত ঘটলেও কাজ ছাড়া অন্য কারো দিকে তার মন গলে না। তার সঙ্গে কাজ করার সময় নিজেই বুঝতে পারবে। দেখবে কি নিখুঁত কাজ। ওর কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সুন্দর পুরুষালী চেহারা–ভুলেও মন দিয়ে ফেল না যেন। ওর হৃদয় আছে কিনা সন্দেহ। যাক কাজটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে বাঁচি। গুড লাক।

ব্যাপারটা ভেসপারের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। এই ব্যাপারটা তার কাছে অনেক বড় হয়ে উঠল বন্ড যখন তার প্রতি আকর্ষিত হয়েছে। সে খুশি না হয়ে পারেনি। দুজনে মিলে একসঙ্গে সময়টা উপভোগ করছে এই সামান্য কথা ফাস হতেই বন্ড একেবারে নিজেকে বদলে ফেলে। এমনভাবে নিজেকে সংযত করল যে এতটুকু মিষ্টি কথাও তার কাছে অকারণ তিক্ত হয়ে উঠছে। ভেসপারের নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। যাই হোক এই ভুল সে আর করবে না। এই কথা মনে রেখেই সে বন্ডের সঙ্গে কাজ করবে।

…আসল ব্যাপার হল ভাগ্য বা কপাল। আমার পক্ষে বা বিপক্ষেও ঐ একই জিনিস।

 বাকারা কি ভাবে খেলতে হয় তা বুঝিয়ে দিল ভেসপারকে। এটাও এক ধরনের জুয়া। ব্যাংকার বা খেলোয়াড় দুজনেরই ভাগ্যে হার জিতের সম্ভাবনা থাকে। ভাগ্য খারাপ হলে টাকায় টান পড়বে। হয় ব্যাংকার নতুবা খেলোয়াড়ের অবলুপ্তি ঘটবে।

আমাদের কাছে খবর এসেছে ল্যশিফ ইজিপসিয়ান সিন্ডিকেটের কাছ হতে বাকারা ব্যাংক কিনেছে। এই সিন্ডিকেটই চড়া হারে জুয়া চালায়। আগে থেকেই তাকে দশলক্ষ ফ্র্যাঙ্ক জমা দিতে হয়েছে।

তার মূলধন দাঁড়িয়েছে দুকোটি চল্লিশ লক্ষ। আমারও মূলধন প্রায় তাই। আন্দাজ করছি আজ দশজনের আসর বসবে।

ব্যাংকারের ডানদিকে ও বাঁদিকে এই দুই প্যানেলের সঙ্গে ব্যাংকার দুটি গেম খেলে। রয়্যালে এদের কম থাকায় ল্যাশিফ একটা প্যানেলের খেলোয়াড়দের সঙ্গেই খেলবে। তবে ব্যাংকারের জেতার সম্ভাবনা কম থাকলেও এরা একটা অতিরিক্ত সুবিধে ভোগ করে তা হল বাজির পরিমাণটা এরাই ঠিক করে।

টেবিলের মাঝের আসনে ব্যাংকার, পাশে একজন পার্টনার থাকে। সে তাসগুলো জড়ো করে আর ডাক দেয়। শেফ দ্য পার্টি থাকে একজন, সে শুধু মধ্যস্থতা করে। আমি থাকব ল্যশিফের মুখোমুখি। ওর সামনে একটা খোপের মধ্যে দুটো প্যাক তাস। ওর মধ্যে কোন কারচুপি করার কোন সুযোগ নেই। আমরা সব কর্মচারিদের সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিয়েছি। ওদের দিয়ে কিছু হবে বলে মনে হয় না। তাসগুলো মার্কামারা হলে অবশ্য সুবিধে হবে। তবে তা একেবারেই অসম্ভব যদি না পার্টনারকে হাতে রাখা থাকে। সে দিকে অবশ্য আমারও দৃষ্টি থাকবে।

এবারে আসল খেলা। ব্যাংকার প্রথমে ঘোষণা করল পাঁচলক্ষ ফ্র্যাঙ্ক। ব্যাংকারের পর থেকে এক দুই হিসেবে খেলোয়াড় চিহ্নিত হয়। এখন এক নম্বর বাজি মেনে নিয়ে টাকাটা টেবিলে ফেলতে পারে। যদি সে এ বিষয়ে ইচ্ছুক না থাকে তবে পাস দেবে। এখন দুনম্বরের পালা, সে যদি না নেয় তবে তিন নম্বর, এই ভাবে সারা টেবিল ঘুরতে থাকে। যদি কোন একজন নিতে রাজি না থাকে তবে অনেক সময় সকলে মিলে তা গ্রহণ করে। ইচ্ছে থাকলে দর্শকদের মধ্যেও কেউ যোগ দিতে পারে। এইভাবে পাঁচলক্ষ জোগাড় হয়।

টাকার পরিমাণ এতোটাই কম থাকে যে তা পেতে কোন বেগ পেতে হয় না। বাজি যখন দশ বা কুড়িলক্ষে এসে ঠেকে তখন একজন খেলোয়াড় বা অনেকে মিলও তা গ্রহণে রাজি থাকে না। এই অবস্থা উদয় হবে তখন যখন আমি বাজি ধরব। আমার লক্ষ্য থাকবে একটাই ল্যশিফের ব্যাংক যে কোন উপায়ে ফেল করান। হয় সে আমাকে কিম্বা আমি তাকে সর্বশ্রান্ত করব। অনেকক্ষণ সময়ের ব্যাপার এখানে, তবু আমাদের দুজনের মধ্যেই কাউকে পরাজয় স্বীকার করতে হবে। অবশ্য তারা আমাদের টাকা বাড়াতে বা কমাতে–দুই করতে পারে।

ব্যাংকার হওয়ার পেছনে কিছু সুবিধে কাজ করে। আমি যে ওর পেছনে লাগছি তা জানে বলেই ওর স্নায়ু শক্ত রাখা খুব মুশকিল হবে। আমার মনে হয় না, আমার মূলধনের অংক কততে আছে তা ওর জানা। আমরা শুরু করলে সমান সমান টাকা দিয়ে করব।

কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা। এর মধ্যে স্ট্রবেরীআর আভোকাডো পেয়ার এসে গেছে। সঙ্গে কফিও এল। এই সময় আলোচনা একটু অন্যদিকে মোড় নিল। এবার খেলার পদ্ধতিটা বোঝাতে লাগল বন্ড।

খেলাটা খুবই সহজ। তাসের তেতুন খেলাটা খেলে থাকলে তোমার এই খেলাটা অনেক বেশি সহজ হয়ে উঠবে। ব্যাংকারের কাছ থেকে এমন তাস নিতে হয় যাতে সবগুলো এক করলে একুশের কাছাকাছি দাঁড়ায়।

এখানে আমি দুটো তাস পাচ্ছি, ব্যাংকারও তাই পেয়ে থাকে। প্রথমে কেউ জিতে না গেলেও আমি আরও একটা তাস পেতে পারি। উদ্দেশ্য একটাই–দুটো বা তিনটে তাসে নয়ের যত কাছাকাছি যাওয়া যায়।

ছবিওয়ালা তাস ও দশগুলোর কোন দামই পাওয়া যায় না এখানে। টেক্কা একই থাকে, অন্য তাসের ক্ষেত্রে যা থাকে তাই। শেষ সংখ্যাটা সব সময় বলে দিতে হয়। যেমন নহলা আর সাত থাকলে যোত না হয়ে ঐ জায়গায় বসবে ছয়।

যে নয়ের কাছাকাছি আসতে পারে তার জয় আটকায় কার সাধ্য। ড্র হলে পুনরায় খেলা শুরু হয়।

খুব একাগ্রতার সঙ্গে ভেসপার বন্ডের কথা শুনে যাচ্ছিল, মুগ্ধ হচ্ছিল বন্ডের এই নিষ্ঠার ভাব দেখে।

ব্যাংকার আমাকে দুটো তাস দিল। আমি দেখলাম যে দুটো যোগ করে আট বা নয় হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমি তাস উল্টে দেব। জয়ী হলাম আমি। আমার যদি একবারে আট বা নয় না হয় তবে ছয় বা সাতের উপর আমি তাস চাইতে পারি, নাও পারি। পাঁচের কম হলে চাইতে পারি। পাঁচ হল মোক্ষম সংখ্যা। পাঁচ হাতে এলে হারা বা জেতার সুযোগ সমান সমান হয়ে থাকে।

আমি যখন তাস চাইব বা বলব যা আছে তখন ব্যাংকার তার নিজের তাস দেখাবে। ওর আট বা নয় উঠলে, ও তাস সামনে রেখে দেখিয়ে দেবে। জীত ওরই হল। তা না হলে ওর ও আমার একই সমস্যা দেখা দেবে। তবে আমার ফেলার টঙ দেখে ও খানিকটা অনুমান করে নিতে পারে, তাতে ওর পক্ষে তৃতীয় তাস গ্রহণ বা পরিগ্রহণ-খুব সুবিধের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় এই ক্ষেত্রে।

তাই এদিক থেকে ও আমার চাইতে অনেক বেশি সুবিধেজনক অবস্থায় অবস্থান করে। তবে একটা সমস্যা থেকেই যায় তা হল পাঁচ এলে কি করনীয়? অপর পক্ষ পাঁচ এলে কি করবেন? খেলোয়াড়দের অনেকেই তাস তোলে। আবার কখনও একেবারেই তোলে না। আমি আন্দাজকে এই সময় কাজে লাগাই।

তবে প্রথম বারের আট আর নয় থেকেই জিতের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাই লক্ষ্য রাখতে হবে আট আর নয়, আমি যেন ওর থেকে বেশি পাই।

.

খেলার টেবিলে

খেলার কথা বলতে বলতে বন্ড ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। ল্যশিফের সঙ্গে সামনা সামনি বোঝাঁপড়া হবে ভাবতেই সে রোমাঞ্চিত হচ্ছিল। নাড়ির গতি দ্রুততালে ওঠা নামা করছে। ভেসপারের ব্যবহারে সে যে এতক্ষণ অসন্তুষ্ট ছিল তার প্রায় ভুলেই গেল। কারণ জুয়ার মেজাজ তখন তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

বিল মিটিয়ে ভেসপারকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল সে। ক্যাসিনোয় এসে পৌঁছল। সুসজ্জিত ঘরগুলো একে একে তারা পেরিয়ে এল। বন্ডকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে না সে ভেতরে ভেতরে এত উত্তেজিত। ক্যাসিনোর লোকজনদের অভিবাদন গ্রহণ করল ওরা, কেউ তাদের মেম্বার কার্ড পর্যন্ত দেখল না কারণ চড়া বাজির জুয়ায় বন্ডের ইতিমধ্যেই বেশ নামডাক হয়ে গেছে। অতএব তার সঙ্গী হিসেবে কর্তৃপক্ষের কাছে সেও সমান সম্মানীয় অতিথি।

বড় ঘরটায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে লিটার টেবিল ছেড়ে উঠে এল। ভাবভঙ্গী দেখে মনে হল কতদিনের পরিচয় দুজনের। ভেসপারের সঙ্গে আলাপ পর্ব শেষ হতেই একেবারে খেলার প্রসঙ্গে চলে এল। তুমি তো বাকরা খেলবে বন্ড। তোমার অনুমতি পেলে আমি মিস লিন্ডকে রুনোতের আসর থেকে ঘুরিয়ে আনতে পারি।

আমার মত মিস লিন্ডেরও কিছু লাকি নাম্বার আছে। ওগুলো নিশ্চয়ই উঠবে এবার। ততক্ষণে তোমাদের আসরও জমে উঠবে।

বন্ড জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ভেসপারের দিকে তাকিয়ে রইল। লিটারের প্রস্তাবে ভেসপার এক পায়ে রাজি। বন্ডকে সে অনুরোধ জানায় তার কোন লাকি নাম্বার তাকে দিতে। বন্ড গম্ভীর মুখে জবাব দেয়, আমার কোন লাকি নাম্বার নেই। যে সব ক্ষেত্রে সমান সমান সুযোগ থাকে সে সব ক্ষেত্রেই আমি বাজি ধরি। আচ্ছা চলি। আমার বন্ধু লিটারকে আপনার সঙ্গে দিয়ে দিলাম। ওই আপনার খেয়াল রাখবে।

লিটার ব্যাপারটা অনুমান করতে পারে, কারণ বন্ডকে ভাল ভাবেই চেনে। মিস লিন্ড, উনি ওনার বাজির ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। চলুন যাওয়া যাক। দেখি, আসুন ১৭ নম্বর কি রকম কাজ দেয়। যার ওপর ভরসা করেই কিছু টাকা আসতে পারে। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা হবে, কি বলেন?

বন্ড এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছিল। কাজের প্রতি একাগ্র মনোযোগ নিয়ে আনার চেষ্টা। রশিদ দেখিয়ে সে দুকোটি চল্লিশ লক্ষ ফ্রাঙ্ক দুভাগে ভাগ করে কোটের পকেটে রাখল। শেষপ্রান্তে চলে এল; যেখানে পাতা আছে। বাকারার টেবিল।

দুএকজন করে আসতে শুরু করেছে। তাসগুলো উল্টো করে টেবিলে সাজান। যেগুলো আস্তে আস্তে মিশিয়ে শাফল করা হচ্ছে–অর্থাৎ এখানে জোচ্চুরির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

মসিয়ো বন্ড ৬ নম্বরটা আপনার আপনি যেমন চেয়েছিলেন। টেবিলে তখনো তিনটে আসন শূন্য। বন্ড ভিতরে ঢুকল। এপাশে-ওপাশে বসে-থাকা ব্যক্তিদের অভিবাদন গ্রহণ করল। চ্যাপ্টা গান মেটালের সিগারেট-কেস আর কালো লাইটারটা পাশে রাখল। পরিচারক দৌড়ে এসে কাঁচের একটা অ্যাশট্রে রেখে দিল।

সিগারেট ধরিয়ে একটু আরাম করে বসল সে। চারদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। ৭ নম্বরে তার ডানদিকে আছেন সঁসিয়ো সিক্সটে-ধনশালী ব্যক্তি, কঙ্গোতে ধাতুর ব্যবসা। ৯ নম্বরে লর্ড ডান ভার্স, দৃঢ়চিত্ত মনের নয়। তবু খেলছেন কারণ অর্থের দায়িত্ব সম্পূর্ণ তার আমেরিকান স্ত্রীর। প্রচুর অর্থের মালিক তিনি।

এদের দেখে বোঝাই যায় এরা খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। প্রথম চোটে কোন অঘটন না ঘটে যায়। ১ নম্বরে আছেন। জাহাজ কোম্পানির মালিক ও গ্রীক জুয়াড়ী। ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চল থেকে যারা আসে তারা মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলার চেষ্টা করে। চট করে এরা হার স্বীকার করে না। বন্ড একটা কার্ডে জিজ্ঞাসা চিহ্ন দিয়ে তার নিচে বসাল ২, ৪, ৫, ৮, ১০। হুইসারকে দিয়ে কার্ডটা শেফ দ্য পার্টির কাছে পাঠিয়ে দিল।

২ নম্বরে আছেন এক মহিলা আমেরিকান চিত্র তারকা। মনের খুব জোর–অনেক আশা নিয়েই হয়ত খেলবেন, বলা যায় না আজ ভাগ্যদেবী তার প্রতি সুপ্রসন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। ৩ নম্বরে আছেন লেডি ডান ভার্স। ৪ ও ৫ নম্বরে আছেন মিস্টার ও মিসেস ডু পন্ট। সম্পদশালী হলেও তারা যে টাকা দিয়ে খেলবেন তা বৈধ না অবৈধ–এ বিষয়ে কেউ খোঁজ খবর রাখে না। তাদের কথাবার্তা থেকে বোঝাই যায় তারা এই খেলায় যথেষ্ট পটু। মিসেস ডু পন্ট তার পাশের আসনে। বন্ড এই ভেবে খুশি হল যে প্রয়োজনে তাদের কাছে অর্থের জন্য দ্বারস্থ হতে পারে।

৮ নম্বরে আছেন ভারতীয় মহারাজা। এশিয়ার লোকদের মধ্যে জুয়াড়ী মনোভাব একেবারেই থাকে না। তবে লোকসানের মুখ যদি ধীরে ধীরে দেখেন, তবে টিকেও যেতে পারেন।

১০ নম্বরে আছেন একজন কম বয়সী ইতালিয়ান। মিলানে অনেক বস্তি আছে, যেখান থেকে ভাড়া উঠে আসে। এই খেলায় আসা তার একদমই উচিত হয়নি। ঝোঁকের মাথায় বাজি ধরে ফেলবে, তারপর চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘর ভরিয়ে তুলবে। সবার সম্বন্ধে মনে মনে সে এক ছক কষে নিল। নিঃশব্দ গতিতে প্রবেশ ঘটল ল্যশিফের। সকলের সঙ্গে মধুর সম্ভাষণ বিনিময় করল।

খেলা শুরু হল। জমা পড়েছে পাঁচলক্ষ। গ্রীক লোকটি তার টাকার চাকতিগুলো সামনে টোকা দিতেই, জমা নেওয়া পর্ব শেষ হল।

প্রথমে ল্য শিফ তাসগুলো ঠিক করে নিল। ক্রপিয়ার একটা চামচের মত জিনিস দিয়ে তাস আলগোছে এগিয়ে দিল গ্রীক লোকটির উদ্দেশ্যে। ভাবলেশহীন মুখ। বাঁ হাত দিয়ে তাস দুটো তুলে নিল। একটু আড়াল করে দেখে নিল তাস দুটোর চেহারা। ল্যাশিফের দিকে সে উচ্চারণ করল না।

গ্রীক লোকটি নির্বিকার চিত্তে বসে রইল। অন্য কোন তাস সে চাইল না। তার অর্থ দাঁড়ায় যে পাঁচতে নয়-ছক্কা নয়-সাত তার ভাগে জুটেছে। জিততে হলে ব্যাংকারকে আট বা নহলা দেখাতে হবে। তা না হলে তাকে আরও একটা তাস তুলতে হবে। ফল স্বরূপ সে তার ভাগ্য খুলে যাবে একথাও নিশ্চিত রূপে বলা যায় না। ল্যশিফ মুঠো করে হাতের তাস দুটো উল্টে দিল। চৌকা-পাততো। এবার জিত ল্যশিফের।

গ্রীক লোকটা পাঁচটা চাকতি এগিয়ে দিল। প্রত্যেকটা এক লক্ষ্যের। ল্যশিফের পাঁচ লক্ষের সঙ্গে এগুলো যোগ হল। প্রত্যেক বাজির খেলা থেকে একটা শতাংশ ক্যাসিনোয় আসে। ব্যাংকার নিজে এটা আলাদা ভাবে সরিয়ে রাখে। খেলা তখনও চলছে। আসল খেলা জমেছে।

টাকার বাক্সে গুটি ফেলে কুপিয়ের ঘোষণা করল, ১০ লক্ষ জমা হল।

খেলা চলুক–বলল গ্রীকটি।

এইভাবে চলতে থাকবে যতক্ষণ না ভীতুর দল রণক্ষেত্র পরিত্যাগ করে।

গ্রীকটি তৃতীয় তাস টানল। এখানেও তার কোন লাভ হল না। ব্যাংকারের সাতের বিরুদ্ধে তার উঠল চার।

কুড়ি লক্ষ জমা হল চেঁচিয়ে বলল ক্রুপিয়ের।

বন্ডের পাশের লোকেরা তখন একেবারেই চুপসে গেছে।

আমি আছি বলেই বন্ড বসে পড়ল।

.

সত্যের মুখোমুখি

বন্ডের এই উক্তি শুনে ল্যশিফ তার দিকে না তাকিয়ে পারল না। চোখের মনির সাদা অংশটা এমনভাবে বেরিয়ে থাকে শিফের, তাতে তার চেহারায় একটা সব সময় নির্বিকার পুতুল পুতুল ভাব ফুটে ওঠে।

জ্যাকেটের পকেট থেকে বার করল ছোট একটা সিলিন্ডার। নাকে ঢুকিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে সে নিঃশ্বাস নিল। ল্যশিফ যখন তার এই কাজে ব্যস্ত তখন বন্ড স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চেহারাটা এমনই যে তাকে অনেকেই মানুষ না বলে ভুল করতে পারে।

না শুনেই এক তাড়া নোটের বান্ডিল বন্ড টেবিলের উপর রাখল। বন্ড বুঝিয়ে দিতে চাইল প্রচুর অর্থ নিয়ে সে আজ ময়দানে নেমেছে। বাকি ভদ্রমহোদয়গণ অনুমান করতে পারছিল যে দুর্জনের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হতে চলেছে। ল্যশিফ চারটে তাস বার করল। বন্ডের দিকে তাস এগিয়ে দিল পিয়ের। বন্ড তখনও স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শিফের। দিকে। এক নজর তাসগুলো দেখে সে উল্টে দিল তাস দুটো।

চার আর পাঁচ–অর্থাৎ নয়। সব থেকে বড় সংখ্যা।

রুদ্ধশ্বাসে সবই খেলা দেখছে। সকলের মনে একটাই প্রশ্ন ২০ লক্ষের বাজি ছেড়ে দেবার কি প্রয়োজন ছিল।

শিফ তাস দুটো দেখল একবার। দুটোই গোলাম। দুটো তাসই পাশে সরিয়ে রাখল। বাকারা বলে নোটের তাড়াটা বন্ডের দিকে এগিয়ে ধরল ক্রপিয়ের। প্রথম বারেই এভাবে জয় আসবে, সে একবারও ভাবতে পারেনি।

পাশেই বসে থাকে, মিসেস ডুপন্টের মুখে করুণ হাসি। তিনি অতি কষ্টে বললেন, আমি আপনার কাছে ডাকটা পৌঁছে দিলাম। তাস দেওয়া হতেই আমার ভীষণ আফসোস লাগছিল।

খেলা শুরু হয়েছে সবে মাত্র। এর পরের বার-আপনি হয়ত অনেক বেশি ভাল পাস দেবেন–বন্ডের জবাব। মিঃ ডুপন্ট স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ভুল ত্রুটিতো এই খেলার নিত্যসঙ্গী। তাহলে আমরা এখানে একত্র হয়েছি কেন?

বন্ড এবার দর্শকদের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। প্রথমেই দৃষ্টি পড়ল রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ল্যশিফের দুই দেহরক্ষীর দিকে। প্রথমজনের বীভৎস চেহারা, জ্বলজ্বলে দুটি চোখ–দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় তারা অনেক ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে আছে, খেলা দেখতে তারা আসেনি। রেলিঙের এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বার বার পায়চারি করছে। দেখে মনে হয় এরা। অকারণে কোন মানুষকে ধরাশায়ী করতে পিছপা হবে না।

অন্য লোকটা ঠিক তার বিপরীত। বেঁটে, কালো, চ্যাপ্টা মাথা। সম্ভবত পায়ে কোন অসুবিধে আছে, তাই সঙ্গে রেখেছে বেতের ছড়ি। ক্যাসিনোর ভেতর লাঠি হাতে প্রবেশ নিষেধ। এর জন্য লোকটিকে নিশ্চয়ই বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু না ঘটলেও খেলা চলাকালীন ব্যাংকারের ভাগ্য আজ তেমন ভাল যাচ্ছে না। দুঘণ্টায় এক কোটি ফ্রাঙ্ক লোকসান। গত দুদিনে ল্যশিফের লাভ আশা করা যায় পঞ্চাশ লক্ষে পৌঁছে গেছে। রাত একটা নাগাদ বন্ডের মূলধনের পরিমাণ দাঁড়াল দুকোটি আশি লক্ষে।

বন্ড আজ প্রতিটি খেলায় পদক্ষেপ ফেলছে খুব সাবধানে। লাভের পরিমাণ তার একার পক্ষে যথেষ্ট। শিফের মুখে দেখে তার কোন প্রতিক্রিয়া বোঝার উপায় নেই। সে যেন এক কলের পুতুল। নতুন ব্যাংক শুরুর পূর্বে ক্রপিয়ারকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছে খুব চাপাস্বরে।

তাদের টেবিল ঘিরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজমান। কিন্তু আশেপাশের টেবিলগুলো তাদের থেকে অনেক বেশি সক্রিয়।

একটা নাগাদ তাদের খেলা এক নতুন মোড় নিল।

২ নম্বরের গ্রীক লোকটির অবস্থা তখন খুবই সঙ্কটজনক।

২ নম্বরে কারমেল ডিলেনি পাস দিল, ৩ নম্বরে লেডি ডানভার্সও ঐ একই ব্যাপার করলেন।

 ডুপন্ট দম্পত্তি ব্যাংকারের আটের কাছে পরাজিত হলেন।

 জমা পড়ল মোট চল্লিশ লক্ষ।

বন্ড পুনরায় একতাড়া নোট বার করল।

এক নজরে একবার সে তাসটা দেখে নিল।

না। মাত্র পাঁচ। সত্যিই অবস্থা একেবারে চরমে উঠেছে। বন্ডের তাসগুলো উল্টে দিল পিয়ের।

আশি-লক্ষ জমা পড়ল।

 বন্ডের আবার হার।

 গত দুটো খেলায় সে এক কোটি কুড়ি লক্ষ ফ্রাঙ্ক খুইয়েছে। হাতে আছে মাত্র এক কোটি ষাটলক্ষ। যা কোন মতে কাজ চালান যায়।

বন্ডের চোখের সামনে তার মূলধন প্রায় নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকল। কিন্তু শিফে পরম বিশ্বাসে খেলে যাচ্ছে। তার এমন অসহায় অবস্থা আগে বোধহয় কোনদিন হয়নি। গাল তার শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পকেট থেকে টাকা আর চাকতি সে বার করে দিল। কেউ জানতেও পারল না এই তার শেষ বাজি।

তাকিয়ে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে ফেলিক্স আর ভেসপার। শিফের দেহরক্ষীরা ঐ জায়গায় আর নেই। ভেসপার একটু মুচকি হাসি হাসল।

ল্য-শিফ পেল বিবি আর একটা কালো পাঁচ। বন্ডের দিকে তাকিয়ে সে আরও একটা ধীর হস্তে তাস তুলল। সবাই নির্বাক পুতুলের মত বসে। তার যখন ছয়, শিফের পাঁচ। এখন ব্যাংকারের করণীয় হল যে কোন একটি তাস তোলা যেগুলো অবশ্যই এক, দুই, তিন অথবা চার হওয়া চাই। অন্য তাস উঠলেই তার পরাজয় নিশ্চিত।

এই অবস্থায় বন্ডের জেতার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ল্য-শিফ তাস তুলল চার–এর থেকে ভাল তাস আর বুঝি হয় না। আজ সে সর্বদিক থেকে সর্বশ্রান্ত হয়ে পড়ল।

.

প্রাণঘাতী টিউব

 কিছুক্ষণের জন্য বস্তু স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। একটা সিগারেট ধরাল। এখন তার কাজ হোটেলে ফিরে যাওয়া। পরের দিন প্লেন ধরা। এই সব চিন্তা করে আর কি লাভ। পরের বার যেন এই রকম না হয় তার চেষ্টাই করতে হবে।

কিছুক্ষণ আগেও উৎসুক জনতাকে দেখেছে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু এখন এক ভিন্ন পরিস্থিতি। এখন এমন একজনও সাহসী ব্যক্তি আছেন কি যিনি তিন কোটি কুড়ি লক্ষ ফ্রাঙ্ককে চ্যালেঞ্জ জানাবেন?

লিটার নেই কিন্তু ভেসপার এখনও তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। মুখে সেই মধুর হাসি। ও খেলার কিছু বোঝে না, বুঝলে দেখতে বউ কি শোচনীয় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে।

এই সময় পরিচারক এসে বন্ডের হাতে একটা খাম দিয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে খামটা ছিঁড়তেই-খামের মধ্যে বেরিয়ে এল একতাড়া নোটের বান্ডিল। একটুকরো কাগজে লেখা মার্শাল এড। তিন কোটি কুড়ি লক্ষ ফ্রাঙ্ক। যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এই শুভেচ্ছা।

বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি বন্ডের। তাকিয়ে দেখে ফেলিক্স এসে গেছে। পাশে ভেসপার–ঠোঁটে তার সেই পুরোনো হাসি। নতুন করে খেলার জন্য সে মনকে প্রস্তুত করতে লাগল। এই সুযোগ ওকে কাজে লাগাতে হবে।

টেবিলের মধ্যে বাজির টাকা জমা হতে শুরু করেছে। টেবিলের উপর রয়েছে তিনকোটি কুড়িল ফ্রাঙ্ক। বন্ডের মনে হল শিফের আর অল্প কিছু এসে গেলেই সে টেবিল পরিত্যাগ করবে। তার সব আর্থিক অনটন বন্ধ হয়ে যাবে। তার পরিবর্তে পুনরায় সম্মান ফিরে আসবে। কিন্তু শিফের কোন ওঠার আগ্রহই নেই। এখন একমাত্র উপায় সব টাকার ওপর বাজি ধরা। শিফ একবার যদি ঘুণাক্ষরে জানতে পারত তবে এত টাকা সরিয়ে রেখে আবার পাঁচ লক্ষ ফ্রাঙ্ক। থেকে খেলা শুরু করত। ক্রপিয়ের খুব জোর গলায় ঘোষণা করতে থাকল। যাতে করে আসপাশের কাছ থেকে লোকেদের এখানে বসান যায়। বাকরার ইতিহাসে এত টাকার বাজি কখনো ধরা হয়নি।

ল্যশিফের ক্যাসিনোতে এত উচ্চমূল্যের বাজি কখনও ওঠেনি। বন্ড খেলা চলার সম্মতি দিল। চারিদিকে এই খবর পৌঁছে গেল। লোকজনের ভিড় ক্রমেই বাড়তে থাকল। এমনও অনেক লোক আছে যারা সারা জীবনে এত টাকা রোজগারের কথা ভাবতে পারে না।

ক্যাসিনোর একজন ডিরেক্টর শেফ দ্য পার্টির সঙ্গে নিজেকের মধ্যে সব আলোচনা সেরে নিল। শেফ দ্য পার্টি বন্ডের দিকে ফিরে বললেন, আমি খুবই লজ্জিত, কিছু মনে না করে, মসিয়ো আপনি কি বলবেন কত পড়েছে আপনার? বন্ড যে খুবই বিত্ত্ববান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তিন কোটি কুড়ি লক্ষ ফ্রাঙ্ক–কোন কম অংকের ব্যাপার নয়। এমন অনেক সময়ে হয়েছে যে সঙ্গে টাকা নেই কিন্তু ঝোঁকের মাথায় বাজি ফেলেছে। হেরে গেলে তাকে জেল দেওয়া হয়েছে। বন্ড আর কথা না বাড়িয়ে নোটের তাড়াটা টেবিলের উপর রাখল। ক্রপিয়ের টাকা গুনতে শুরু করেছিল।

শিফের সঙ্গে তার রক্ষীর দৃষ্টি বিনিময় হতেই বন্ড অনুভব করল তার শিরদাঁড়ার কাছে শক্তমত কি ঠেকল। ডান কানের কাছে কে মুখ নিয়ে এসে বলল এখন সাবধান হোন মসিয়ো, আমার হাত ধরা আছে চিরকালের সাথী আপনার শিরদাঁড়া উড়িয়ে দেবে নিঃশব্দে। দশ বলার আগে আপনার বাজি ফিরিয়ে নিন, লোক জড়ো করলেও আপনার রেহাই নেই।

লোকটার উচ্চারণ শুনে মনে হয় সে দক্ষিণ অঞ্চলের। এরা কখনই কথার খেলাপ করে না। এদের কাছে কথার দাম খুব বেশি। এখন সব পানির মত পরিষ্কার। বোঝা যাচ্ছে মোটা জুড়ির অর্থ। ব্যারেলের মধ্যে এমনভাবে রবারের আস্তরণ পরান থাকে যাতে শব্দ হয় না, কিন্তু নিঃশব্দে কাজ হয়ে যায়। টেবিলের ওপারে ল্য-শিফ তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। সে গভীর প্রতীক্ষায় বসে আছে বন্ড কতক্ষণে তার পরাজয় স্বীকার করবে।

ফেলিক্স আর ভেসপার নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত। ম্যাথিস নেই, নেই তার সঙ্গী সাথীরা, তারা বুঝতেও পারছে না এখানে কি ঘটে যেতে চলেছে। কিন্তু বন্ডও ভাবল এত সহজে সে কখনও পরাজয় মেনে নেবে না। একটা কিছু তার করা দরকার। ক্রপিয়ারের নোট গোনা শেষে হয়েছে। এবার সে ব্যাংকারের অনুমতি নিয়ে খেলা শুরু করে দেবে। এই সুযোগ সে দুটো হাত দিয়ে খুব শক্ত করে চেপে ধরল টেবিলটি–তারপর সমস্ত শক্তি এক করে পেছনে এক ধাক্কা দিল। যার ফলে চেয়ার গিয়ে আছড়ে পড়ল বেতের ছড়িটার ওপর। লোকটার হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল ছড়িটা।

 বন্ড দর্শকের সামনে এমনভাবে নিজেকে উপস্থিত করল যাতে করে দর্শক একবারের জন্যও ভাবতে পারল না এটা তার অভিনয়। চেয়ারটা একদিকে ভেঙে পড়ে আছে। প্রথমে উপস্থিত দর্শকগণ এই ঘটনায় খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল, পরে তাদের এই ঘোর কেটে যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগেনি।

তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল বন্ডের দিকে। শেফদ্যপর্টি, পরিচারক সবাই এগিয়ে এল যাতে কোন রকম বিশ্রী ঘটনার সম্মুখীন হতে না হয়।

রেলিং ধরে বন্ড কোন মতে উঠে দাঁড়াল। সে এই ব্যাপারের জন্য সত্যি খুব অপ্রস্তুত। সে এমন ভান করতে লাগল যেন গরমে, উত্তেজনায় সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি তার ফলস্বরূপ এই বিপত্তি। সকলেই তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করল। আরো বলল, মসিয়ো, আপনি কি একটু বিশ্রাম নিয়ে নেবেন?

বন্ড সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, না না এসবের কোন প্রয়োজন হবে না, সে এখন শারীরিক ও মানসিক দুই দিক থেকেই সম্পূর্ণরূপে সুস্থ। সে করজোড়ে তার এই অবস্থার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিল। নতুন চেয়ার এল। এবার তাকাল শিফের দিকে। তার সারা মুখে বিরাজ করছে নিদারুন এক আতঙ্ক। কিন্তু বন্ড যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না– কারণ নতুন জীবন ফিরে পাবার আনন্দ সে ছাড়া আর কেই বা বুঝবে।

সারা টেবিল জুড়ে সকলের কাছেই আলোচনার একটাই বিষয় এখন বন্ড। রাত প্রায় শেষের দিকে, সকাল হতে বোধহয় আর বেশি দেরি নেই।

বন্ড সকলের কথাতেই সায় দিয়ে চলেছে। সে দর্শকদের আসনে খুঁজতে লাগল রক্ষীটাকে। না নেই–সম্ভবত সভাকক্ষ ছেড়ে পলায়ন করেছে। পরিচারকের হাতে ধরা রয়েছে বেতের ছড়িটি। ছড়ির মালিকের আশায় বসে আছে।

বন্ড ফেলিক্সকে দেখিয়ে বলল, ছড়ির মালিকের সঙ্গে ওর ভালই সম্পর্ক। অতএব ফেলিক্সে দেওয়াকে মানে-তার হাতে ছড়িটা তুলে দেওয়া। ফেলিক্স ছড়িটা একবার ভাল করে পরীক্ষা করলেই তার কাছে বন্ডের এই সব রহস্যের গিট আপনা হতেই দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যাবে।

.

ভালবাসা ঘৃণা

ঘোষণা শেষ হল। জমা পড়েছে তিন কোটি কুড়ি লক্ষ। দর্শকরা আকুল নয়নে চেয়ে রয়েছে এই দুই খেলুড়েদের দিকে। বন্ডকে এখন অনেক বেশি তাজা লাগছে। অলৌকিক হারের মুখে মুখ থুবড়ে পড়েও ভাগ্যের জোরে সে এখনও বসে আছে খেলার অপেক্ষায়। চেয়ার উল্টে যে ভাবে সে নিজেকে আজ বাঁচিয়েছে, তাতে এই হারের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও তার মনের গ্লানি একেবারে ধুয়ে মুছে গেছে।

দশ মিনিটের জন্য বিরতি। ক্যাসিনোর ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনও ঘটেছে বলে মনে হয় না। এই ঘটনার পর তাকে আজ বড় বেশি বেমানান লাগছে এখানে। খাপের মধ্যে তাসগুলো তার দিকেই চেয়ে আছে। এবার তাকে জিততেই হবে। ভাল তাস তাকে তুলতেই হবে। বর্তমানকে পেছনে ফেলে ভবিষ্যতে যেতে তার এখন গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

 ঘড়ির কাঁটায় রাত দুটো। বাকরার টেবিলেই বেশি ভীড়। এখানে কারো মুখেই কোন কথা নেই। তার কানে ভেসে আসছে ক্রপিয়ের গলা, সে দূরের কোন এক টেবিলে কি ইঙ্গিত করছে? তাদের দুজনের মধ্যে একজনের গলায় আজ পৌঁছে যাবে বিজয়মাল্য।

টেবিলের ওদিকে ল্য-শিফ। কিছুই জানে না এমন এক ভান করে বসে আছে। তাসগুলো তার দিকে এগিয়ে আসতেই সে দুটো তাস তুলে নিল। সমস্ত শরীর শক্ত করে নিজেকে ধরে রেখেছে সে, একবার বিচলিত হলেই সমস্ত পরিশ্রম আজ পানি হয়ে যাবে। তাস দুটো ওলটাল। দুটোই লাল বিবি-যার কোন মূল্য নেই। ~~~ …।

ব্যাংকারের হাত রয়েছে একটা সাহেব আর একটা কালো বিবি। নিঃশ্চিন্তে ধোয়া ছাড়ল। এখনও সুযোগ আছে। ল্য-শিফের হাতে উঠল, নয়-হরতনের নহলা। এককথায় নিজের চোখকেই আজ বিশ্বাস করতে পারছে না। বন্ডের জয় আজ অনিবার্য। হাতে তিন থাকা সত্ত্বেও নয় আসা মানে এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হওয়া। বন্ধু স্থানীয় হলে সে তাকে সাহায্যই করত। কিন্তু এক্ষেত্রে একথা মাথায় আনাও পাপ। এখন সব কিছু নির্ভর করছে এই বাকি দুটো তাসের ওপর দুই বিবি, যারা মুখ আড়াল করে রেখেছেন। তাস ওলটান-পাঁচ।

ব্যাংকরের আট হল ক্রপিয়ের জানন দিয়ে দিল। বন্ডের এরকম চুপচাপ বসে থাকা দেখে, শিফের মুখে প্রাণখোলা কুটিল হাসি দেখা দিল। এবার বন্ডের পালা। সবাই তখন ধরেই নিয়েছে বন্ড আজ পরাজিত। কাঠের হাত দিয়ে তাস উল্টে দিল–নয় দুই রানী হেসে উঠলেন। শিফের চেহারা আজ দেখার মতন। বুকে বড় বেশি ব্যথা পেয়েছেন। চাকতির পাহাড় বন্ডের দিকে এগিয়ে এল। ব্যাংকার ছুঁড়ে দিয়েছে টেবিলের ওপর একতাড়া নোটের বান্ডিল।

জমাপড়ল এক কোটি-সমপরিমাণ টাকার চাকাতি টেবিলে রাখা হল। লোকটার আর ফেরার পথ নেই। পড়তে হলে এখানেই মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। একঘণ্টার আগের আমার অবস্থাই এ যেন ওর কাছে ফিরে এসেছে। কিন্তু আমার মত কোণ অলৌকিক কিছু ঘটবে না শিফের ভাগ্যে।

বন্ডের দুহাতের মাঝখানে টেবিলের সবুজ কাপড়ের ওপর ফেলা হল দুটো তাস। বন্ড এক নজরেই দুটো তাস উল্টে ধরল। নয় ক্রপিয়ের বলে উঠল। ল্য-শিফে তখন চেয়ে আছে তার হাতে ধরে থাকা কালো সাহেবের দিকে।

ল্যশিফ দেখল, সমস্ত চাকতিগুলো আরো হাজার হাজার টাকার সঙ্গে এক হচ্ছে। শিফে কোন কথা না বলে সভাকক্ষ। পরিত্যাগ করল। প্রচুর ধন্যবাদ বন্ডের কানে আসছিল। বন্ড এদিকে কোন কর্ণপাত না করে এগিয়ে চলল ফেলিক্স আর ভেসপারের দিকে। ডিরেক্টরদের ঘরে তার ডাক পড়ল। সব মিলিয়ে তার আজকের মূলধন সাতকোটি ফ্রাঙ্কে ছুঁয়ে গেল। সকলের কাছ থেকেই সে উষ্ণ অভিনন্দনের স্পর্শ পেল। তাকে আবার সন্ধ্যে বেলা খেলতে আসার আমন্ত্রণ জানান হল। বন্ড এর প্রত্যুত্তরে কোন জবাব দিল না। লিটার পকেট থেকে ৪৫ বুলেট বার করে টেবিলে রাখল। তোমার কাণ্ড থেকে আমরা অবাক না হয়ে পরিনি। ছড়িটা দেখার পর বুঝতেই পারছ ম্যাথিক্সদের মনের অবস্থা। বুলেটটা এত শক্তিশালী ছিল যে তোমাকে এমনভাবে পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ। কিন্তু মজা দেখ সব ঘটনার মূল কেন্দ্র বিন্দু হল শিফ। তুমিও জান আমিও। মজা দেখ লোকটা যেহেতু একা ঢোকে, সেই জন্য তুমি তাকে সব জেনেও সন্দেহের তালিকায় নিতে পার না। খুব ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ ফেলেছে ওরা। ওর হাতের ছাপ প্যারিসে পাঠান হয়েছে। সকালের মধ্যে কোন খবর আসবে মনে হয়।

তবু একটাই সান্ত্বনা, শুরু তোমার খারাপ হলেও শেষ তোমার ভালই হয়েছে। ল্য-শিফ তোমাকে এত সহজে ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না।

বন্ড একটু মুচকি হাসি হাসল। এই হাসি কিছুক্ষণ আগেও কত নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। সত্যি খামটা সময়ে পেয়ে আমার খুব উপকার হয়েছে। না হলে সব কিছু হারিয়ে সর্বশ্রান্ত হয়ে বসেছিলাম আমি। অসময়ে যে পাশে আসে সেই তো প্রকৃত বন্ধু–কি বল লিটার। আমি তার কাছে চিরদিনের জন্য ঋণী হয়ে থাকব।

চল লিটার, অনেকক্ষণ তো হল এবার হোটেল ফেরা যাক। এখন একটু শ্যাম্পেন হলে মন্দ হয় না কি বলেন? ভেসপার ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায়। কিন্তু তার আগে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে। শরীরটা বড়ই ক্লান্ত ঠেকছে। আপনি আগে টাকাগুলো হোটেলে রেখে আসুন। তারপর রোয়াগালাস্ত যাওয়া যাবে।

ফেলিক্সকে যাবার কথা বলল বটে কিন্তু ভেসপারকে সে একাই পেতে চাইছিল। ফেলিক্স বন্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে তার বাসনা আঁচ করে নেয়। সে বলে প্যারিস থেকে নানারকম কাজের ফিরিস্তি দিয়ে পাঠিয়েছে। সে গুলোতে এখনও হাতই পড়েনি। চল, বন্ড তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি। তোমার একা যাওয়া একটুও নিরাপদ নয়। আজকে ধনরত্নের ভাণ্ডার জাহাজে সবাই উঠতে চাইবে।

তারা সরে এসে দেখল–অভ্যর্থনার জন্য কেউ এখানে উপস্থিত নেই। বন্ড, তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে। আমি তোমার সঙ্গে থাকতে পারি। বন্ড ফেলিক্সকে আশ্বস্ত করে বলল, তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ, সঙ্গে পয়সা না থাকলে ওরা আমায় রেখে কি করবে। তুমি বরং ঘুমোও, সারাদিন যা ধকল গেল।

বন্ড ঘরের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। এখন অনেকটা সে স্বস্তিবোধ করছে। মানসিক উদ্বেগ আর নেই। মাথার পেছনে তার ডান কাঁধটা বেশ ব্যথা ব্যথা করছে। দুবার সে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। এখন আর শত্রুর প্রতীক্ষায় থাকতে মন চাইছে না।

এবার সে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে নিরীক্ষণ করল সে। হঠাৎ ভেসপারের মুখটি আয়নায় ভেসে উঠল। তাকে যত দেখছে তার প্রতি প্রবল আকর্ষণ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। আবেগহীন নীল চোখ দুটির দিকে চোখ পড়লেই বন্ডের মন চায় ঐ চোখে পানি আনতে। এইসব ভাবতে ভাবতেই সে ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। পকেটে একবার হাত বুলিয়ে দেখে নিল চেকটা সঙ্গে নিয়েছে কিনা। বারান্দায় চাঁদের আলো এসে পড়েছে। আলা পড়তে বারান্দাটা আজ বড় বেশি শূন্য মনে হচ্ছে। কারো পদধ্বনি এসে পৌঁছল না বন্ডের কাছে।

.

লা ভি আঁ রোজ

একটি সাতফুট উঁচু সোনালী ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে রোয়া গালান্তের শুরু। গোটা কতক টেবিলে তখনও জুয়ার আসর চলছে। বন্ড অতি কষ্টে লোভ সংবরণ করল। যে রকম সৌভাগ্য আজ তার ভাগ্যে জুটেছে এর পর আবার আসরে বসা মানে নিজের সম্মান নষ্ট করা। সোনালি ধাপ দিয়ে যেতে যেতে বারবার ভেসপারের হাতের স্পর্শ পাচ্ছিল বন্ড।

নাইট ক্লাবটি ঘোট। ঝড়ের মোমবাতির আলো জ্বলছে। দেওয়ালে সোনালি ফ্রেমের আয়না। দেওয়ালে গাঢ় নীল সার্টিন, সেই রঙের সঙ্গে তাল রেখে মোড়া ও আসবাবপত্রও সেই রঙের করা হয়েছে। এক কোণে পিয়ানো, ড্রামে বেজে চলেছে লা ভি আঁ রোজের মাদক সুর। সব মিলিয়ে এখানকার পরিবেশ এক অদ্ভুত মদিরতা বহন করে চলেছে।

দরজার কাছের টেবিলে বসার জায়গা পেল ওরা। দুজনেই চুপচাপ বসে বাজনা শুনতে লাগল। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বন্ড বলল, এতক্ষণ তোমার পাশে বসার সুযোগ পেয়েছি আমি। সারাদিনের পরিশ্রম বৃথা যায়নি, যার ফলস্বরূপ তোমার সান্নিধ্য।

ভেসপার বন্ডের কথায় সায় দিল। বন্ড ভেবেছিল ভেসপার হাসবে। কিন্তু সে বাজনাই শুনে যেতে লাগল। পরম নিশ্চিন্তে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে বন্ড। মেয়েটির সমস্ত সত্তা তখন বন্ডের মনে জুড়ে বসে আছে, তাই কোন সূক্ষ্ম জিনিসই তার নজর এড়াচ্ছে না। সে চাইছে মেয়েটি তার ডাকে সাড়া দিক। কিন্তু আজ সে বড় বেশি গম্ভীর। শীতল তার চাউনি। সে কি বুঝতে পেরেছে বন্ডের মনের বাসনা? তাই সে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে চাইছে?

না, তার সন্ধ্যে বেলার ব্যবহারের প্রতিশোধ নিচ্ছে ভেসপার। সত্যি তার যে একেক সময় কি হয়, দুম করে এমন সব কথা বলে ফেলে যার জন্য পরে নিজেকে নিজের কাছে ছোট হতে হয়।

দুজনে শ্যাম্পেন খেতে লাগল। বন্ড এই আবহাওয়ার পরিবর্তন চাইছিল। তাই সে নিজেই লিটার, ম্যাথিস এদের ব্যাপারে কথা বলতে থাকল। সন্ধ্যে বেলার ঘটনা বলতেও ভুলল না সে।

ভেসপার উত্তর দিচ্ছিল, কিন্তু সব সময় একটা ম্রিয়মাণ ভাব। হ্যাঁ অস্ত্রধারী লোক দুটোর দিকে দৃষ্টি পড়েছিল কিন্তু বন্ডের পেছনে ছড়ি হাতে লোকটির আসল উদ্দেশ্য যে এই ছিল তা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। ক্যাসিনোর ভেতর যে এরকম ঘটতে পারে এ বিষয়ে কোন ধারণাই ছিল না। লিটার ও তার যাওয়ার পরে এম কেসে প্যারিসে ফোন করে খেলার ফলাফল জানিয়ে দেয়। তিনি অপেক্ষায় থাকবেন।

ভেসপার এটুকু বলে থামল। শ্যাম্পেন খাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু বন্ডের দিকে একবারও তাকিয়ে দেখেনি বন্ডের মুখ। বন্ড ভেসপারের আচরণে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হচ্ছিল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। রাগে একটু বোধহয় বেশি শ্যাম্পেন পেটে পড়ে গেল। হোটেলের স্টুয়ার্ট ভেসপারের হাতে একটি চিঠি দিয়ে গেল। চিঠিটা পড়া হতেই বন্ডকে সে বলল, ম্যাথিস আমাকে সামনের হলে ডেকে পাঠিয়েছে, আপনার বিষয়ে কিছু তথ্য আছে। ইভিনিং পোশাকে নেই বলে আসতে পারছে না। চলি। ও হ্যাঁ আজকের ব্যবহারের জন্য আমি সত্যিই খুব অনুতপ্ত। আবার দেখা হবে। ভেসপার চলে গেল। বন্ড তখনও বসে রইল কারণ বিল না দিয়ে সে যায় কি করে। স্টুয়ার্ট-বিল আনতে চলে গেল।

নিজেকে এখন যেন খুব ক্লান্ত মনে হল। ভেসপার সঙ্গে থাকলে তাও কিছুটা সময় কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ও যাবার পরেই ক্লান্তি যেন সর্বশরীর অবশ করে ফেলছে। কিন্তু ম্যাথিসের এই ধরনের ব্যবহার করার কি দরকার ছিল। ম্যাথি এলে তার কাছ থেকে কিছু খবর পাওয়া যেত–বুলগেরিয়ান বা ছড়িহাতে লোকটি বা শিফেরগতিবিধি–কত খবর

কিন্তু হঠাৎ তার মনে হল ম্যাথিস এরকম কাজ করবে না। চিঠি দেবার কোন প্রয়োজনই ছিল না। যে পোশাকেই থাকুক এখানে না আসার কি ছিল। বন্ডের কি মনে হতেই সে হন হন করে চলে এল বাইরের হলে। দু-একজন হোটেলের লোক ছাড়া আর কাউকেই চোখে পড়ল না। ভেসপার বা ম্যাথিস গেল কোথায়? গাড়ীগুলোর দিকে এগিয়ে চলল সে। সব গাড়িগুলো পরীক্ষা করতে লাগল সে। হঠাৎ একটা ক্ষীণ চিৎকার–তারপরেই গাড়ীর দরজা বন্ধ হবার শব্দ।

সুরকির ঝড় বইয়ে চোখের সামনে দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেল। খোলা জানলা দিয়ে একটা কালো মত কি যেন একটা ছিটকে পড়ল ফুল গাছগুলোর ওপর। এগিয়ে এসে দেখল ভেসপারের ব্যাগ। ভিতরে হাতড়াতেই বেরিয়ে এল একটা দোমড়ানো কাগজ। তাতে লেখা সামনের হলে কি আসবে? এলে ভাল হত, তোমার সঙ্গীর বিষয়ে অনেক খবর দেওয়ার ছিল। নিচে ম্যথিসের নাম লেখা।

.

পশ্চাদ্ধাবন

–চিঠিটা যে জাল এখন সে বিষয়ে বন্ডের আর কোন সন্দেহ নেই। ভাগ্যিস সে গাড়ি এনেছিল। না আনলে আজ বড় মুশকিলে পড়তে হত। বেন্টলিটার চোখ টানতেই মুহূর্তের মধ্যে ইঞ্জিন গর্জে উঠল। ছোট রাস্তা দিয়ে শব্দ করে তার গাড়ি ছুটে চলল।

উপকূলের দিকে রাস্তা ধরে চলতে লাগল। সুন্দর চওড়া রাস্তা, মোড়গুলোতে আবার আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। গাড়ির স্পিড নব্বই মাইলে এসে পৌঁছল।

সিতোটা নিশ্চয়ই এই পথ ধরেই এগিয়েছে। মোড়গুলোতে এখনো ধোয়া আর ধুলো উড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেডলাইটের আলো নজরে পড়বে। গাড়ি আগের থেকে অনেক বেশিই স্পিডেই চলতে লাগল। রাস্তার দিকে চোখ রেখে বন্ডের মনে হচ্ছিল ভেসপারের কথা। ভেসপারের মত মেয়ে কি করে এই বোকামির শিকার হল। এম-খুঁজে খুঁজে আর লোক পায়নি, একে পাঠিয়েছে।

মেয়েদের সঙ্গে কাজ করা মানেই এই রকম বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। এর চেয়ে বাড়িতে বসে থাকলেই পারে। এখানে আসার কি দরকার। ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে চলতে হবে, এত তার জানা ব্যাপার। সারাদিনের পরিশ্রমের পর এ কি উটকো ঝামেলা। এ রকম চুরি করা এবং ব্লাকমেলের এই সব ঘটনার দ্বারস্থ হওয়া এগুলো নেহাতই মামুলি ব্যাপার। বুদ্ধির অভাব আছে বলেই এই সামান্য ভুলের শিকার হল, সেই সঙ্গে বন্ডকেও অনর্থক জড়িয়ে ফেলল।

এইসব ভাবতে ভাবতেই গাড়ি চালাচ্ছিল সে। যখন ভাবছে ভেসপারের কথা, তখনই মনটা রাগে বিষিয়ে উঠছে। ওদের মতলবটা ক্রমশ বোঝাই যাচ্ছে। ওরা চাইছে ওদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে। চার কোটি টাকা দাও। পরিবর্তে মেয়েটিকেও আমরা অক্ষত অবস্থায় ফেরত দিচ্ছি। ওরা যদি ভাবে ওদের সাজান নাটকে বন্ডের মন ভুলবে তাহলে ওরা বন্ডকে এখনও চেনেনি। ভেসপার সিক্রেট সার্ভিসের লোক, তার এই সব চাল নোদর্পণে থাকা উচিত। বন্ড এ বিষয়ে এম-এর কাছে কিছুই বলবে না। কারণ ভেসপারের থেকেও তার কাজটা অনেক বেশি জরুরী।

মেয়েটিকে ভাল লাগার এই ফল। তাকে বাঁচাতে ছুটে চলেছে শত্রুদের পেছনে। সত্যি কি বিচিত্র জীবন। কার কপালে যে কি লেখা থাকে কে জানে? এই ছেলে ভুলনোর খেলায় সে নিজেকে কখনই জড়াবে না। সে সব দিক দেখে শুনেই পা ফেলবে। ওদের গাড়িটা ধরার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জানে না কখনও চোখে পড়বে কি না। গাড়িটা নজরে পড়লে দূরত্ব বুঝে সে গুলি চালাবে। গুলির বদলে ওরাও নিশ্চয়ই গুলি চালাবে। গোলাগুলি চলতে চলতে যদি ভেসপারের শরীরে লেগে যায় তার কিছু করার থাকবে না। হোটেলে গিয়ে লম্বা ঘুম। সকালে ম্যাথিসকে পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে দেবে, সঙ্গে তার নাম লেখা চিঠিটাও দেখাবে। যদি ল্য শিফ এর মধ্যে বন্ডের সঙ্গে কোন বোঝাঁপড়ায় আসতে চায়, সে কিছু না বলেই তার মনে যা আছে তাই করে যাবে। মেয়েটার ভাগ্যে যা আছে তাই ঘটবে। সে তো তার ভাগ্য বদলাতে পারে। যদি কমিশনার এসে যা দেখেছে তার বৃত্তান্ত বলতে শুরু করে, বন্ড এটা ওটা বলে কাটিয়ে দেবে। বরং এটা বলতে পারে মদ্যপানের মাত্রাটা একটু বেশি হয়েছে বলেই ওর সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিল।

বেন্টলির স্পিডোমিটারের কাটা ১১০ মাইল অতিক্রম করে ১২০ মাইলকে ধরে ফেলল।

বন্ড ভাবল ওরা মিত্রোতে গেছে। মিত্রের বেশি ভার নেবার ক্ষমতা নেই। ওর স্পীড বড়জোর আশি ছুঁতে পারে। এই ভেবে বন্ড গাড়ির গতি অনেক কমিয়ে দিল। স্পিড় সত্তরে নামিয়ে আনল। হেড লাইটের পরিবর্তে ফগ লাইট জ্বালল। তখনই চোখে পড়ল মাইল দুয়েক আগে আরও একটা গাড়ি। তার গাড়ির চোখ ধাঁধান আলোয় গাড়িটা চোখে পড়েনি। .৪৫ ব্যারাল কস্ট আর্মি স্পেশালটা কোলের ওপর নিয়ে বসল। একশ গজ দূরে থাকতে থাকতেই গাড়ির টায়ার বা পেট্রল ট্যাঙ্ক অবশ্যই ফুটো করতে পারবে সে।

এবার বন্ড মনে যেন এক অদ্ভুত আবেগ অনুভব করল। গাড়ির স্পিড আরো বাড়িয়ে দিল। শত্রুপক্ষের কাছাকাছি আসতে পেরে সে অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছিল। এখন ভেসপারের প্রাণের আশঙ্কা আর নেই।

সামনে মিত্রো গাড়িতে তিনজন লোক আর ভেসপার। গাড়ির চালক শিফ নিজে। হালকা হাতে স্টিয়ারিং কন্ট্রোল করে আছে। পাশে ছড়ি হাতে লোকটা। গাড়ির মেঝেতে একটা লেভার বাঁ হাতে শক্ত করে ধরে আছে। পিছনের সিটে গা এলিয়ে পড়ে আছে লম্বা লোকটা–যার হাতে অস্ত্র ছিল। একেবারে উদাসীনভাব, উৎসাহহীন দুটি চোখ। বা হাত রাখা আছে ভেশপারের উরুর ওপর। ভেসপারের কালো স্কার্ট দিয়ে তাকে বস্তার মত বাধা হয়েছে। মুখের কাছে একটি ছোট ফুটো–নিঃশ্বাস নেবার জন্য। নগ্ন পা। তার শরীরে আর কোন বন্ধন নেই। নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে তার দেহ। শুধু গাড়ির তালে তালে তার শরীর ঈষৎ দুলে উঠছে।

শিফের দৃষ্টি যেমন রাস্তার দিকেও আছে তেমনি আধখানা নজর বন্ডের গাড়ির আলোর দিকেও আছে। দুটো গাড়ির মধ্যে দুরত্ব ক্রমেই কমতে থাকল। এখন এক মাইলে এসে দাঁড়িয়েছে। তার গাড়ির স্পীড এখন ষাট মাইল।

শিফের চোখে পড়ল কয়েকশ গজ দূরেই একটা কাঁচা রাস্তা। গাড়ির গতি সে তিরিশ মাইলে নামাল। বন্ডের গাড়ির হেডলাইটে মোড়টা একবারে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। শিফের আদেশে লোকটা লেভার ধরে একটা টান দিল। গাড়ির পেছনের মাল রাখার জায়গা থেকে কি সব পড়ার শব্দ। যেন গাড়ি থেকে ঝন ঝন করে অনেকগুলো লোহার চেন পড়ে গেল। লোকটা লেভারটা নামিয়ে দিল। ঝন ঝন শব্দটা আর শোনা গেল না।

বন্ডের গাড়ি মোড় নিয়েছে। শিফও আলোটা কমিয়ে মোড় নিল। গাড়ি থামিয়ে তারা তিন জনেই নীচু একটা ঝোঁপের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিল। তিন জনের হাতেই ধরা আছে রিভলভার।

বেন্টলির আলো ছুটন্ত ট্রেনের মত তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

.

গা শিউরে ওঠে

প্রচণ্ড বেগে গাড়ি ছুটছে। রাস্তার ঈষৎ বক্ৰপিঠের ওপর দিয়ে তার এই বাহনকে নিয়ে চলেছে বন্ড। খুব সাবধানে এগোচ্ছে। কারণ এই দিকের রাস্তা-ঘাট তার কাছে অজানা। সে শিফের গাড়ির কাছাকাছি চলে এল। মোড়ের কাছে এসে গাড়ির আলো দেখতে পেল না। সে ভাবল ওদের ড্রাইভার ছোট রাস্তা ধরেই পালিয়েছে। এই সব ভাবতে ভাবতেই ব্রেক কষল।

রাস্তার ডানদিকে ঝোঁপের ঝাড় চোখে পড়ল। হঠাৎ স্টিয়ারিঙের অন্য দিকে চাকার আর স্টিলের কাঁটা ঝলকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা তার ওপর উঠে গেল। প্রাণপণে ব্রেকের ওপর পা দিল সে। স্টিয়ারিং সোজা রেখে দিল। কিন্তু এক সেকেন্ড, তার পরেই চাকা থেকে রাবার বেরিয়ে চাকার ধারটা রাস্তায় ঘষে গেল, গাড়িটা ছিটকে গিয়ে পড়ল। গাড়িটা আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেল। চাকাগুলো শূন্যে বোঁ বোঁ শব্দে ঘুরতে লাগল। অবশেষে গাড়িটা উল্টে গেল। ঝনঝন করে কাঁচ ভেঙে গেল। চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

ঝোঁপের আড়াল থেকে শিফ ও তার অনুচরেরা এই সবই দেখল। পা টিপে টিপে তারা বেরিয়ে এল। শিফ লোক দুটোকে নির্দেশ দিল বন্ডকে গাড়ি থেকে উদ্ধার করার জন্য। পিস্তলের কথা না ভেবে ওর দিকে নজর দাও। সকাল হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি কর। ভিড় হওয়ার আগে কাজ শেষ করতে হবে। সাবধানে বার কর, তোমাদের হাতের চাপে বন্ডের মৃত্যু না হয়–বন্ডকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কাছে খুব প্রয়োজন। লোক দুটো প্রভুর আদেশ পালন করল। তারা গাড়ির ছাদ ফুটো করে বন্ডের অচৈতন্য দেহটাকে বাইরে নিয়ে এল। রাস্তার ওপর শুইয়ে দিল।

তেল ও ঘামে লোক দুটোর অবস্থা তখন করুণ। বন্ডের বুকে হাত দিয়ে দেখল বেঁচে আছে কিনা। তারপর তার গালে একের পর একচড় মারতে লাগল। বন্ডের দেহটা একটুর জন্য নড়ে উঠল। শিফের কথায় তারা বন্ডের অচৈতন্য দেহটা মিত্রোতে নিয়ে এসে তুলল। বন্ডের হাত দুটো শক্ত তার দিয়ে বেঁধে দিল। বন্ডের কাছে যা যা ছিল তা বের করে শিফের হাতে দিয়ে দিল। শিফ একবারের জন্যও তাকিয়ে দেখল না কি কি আছে। যে অবস্থায় ছিল সেগুলো পকেটে ভরে নিল।

তারের শক্ত বাঁধন হাতে কেটে বসতেই বন্ডের জ্ঞান ফিরে এল। সারাদেহ অবশ্য, ভীষণ যন্ত্রণা। সে বুঝতে পারল তার হাত পা কিছু ভাঙেনি। পালাবার নামও করল না সে। নিজেকে সে ওদের হাতে সঁপে দিল। বিনা বাধায় গাড়ির পেছনের সিটে গিয়ে ঢুকল।

মানসিক ক্লান্তি আর অবসাদে শরীর আরো বেশি ক্লান্ত লাগছে। চব্বিশ ঘন্টা যেতে না যেতেই এই ধাক্কা। সহ্যের তো একটা সীমা থাকে–এখানে সেই সীমাও ছাড়িয়ে গেছে। এবারে দৈব সহায় হবার কোন আশা নেই। কারণ কেউ জানেই না যে সে এখানে আছে। সকাল হওয়ার অনেক পরেই কেউ হয়ত তার খোঁজ খবর করবে। ভাঙা গাড়িটা চোখে পড়বে ঠিকই কিন্তু এই গাড়িটা কার তা বার করতেও অনেক সময়ের ব্যাপার। সত্যি সে আর চিন্তা করতে পারছে না। যা হবার হবে, তখন দেখা যাবে। হঠাৎ ভেসপারের কথা মনে পড়ল। রোগা লোকটা চোখ বন্ধ করে আছে। প্রথমে ভেসপারকে দেখে তার খুবই রাগ হল। কারণ যত নষ্টের গোড়া এই ভেসপার। তার জন্যই আজ বন্ড। এখানে। পরক্ষণেই তার নগ্ন, অসহায় পা দুটোর দিকে চেয়ে বন্ডের কি রকম মায়া হল। নাম ধরে ডাকল, ভেসপার! কিন্তু কোন শব্দ নেই, একটুর জন্য যেন মনে হল দেহটা নড়ে উঠল। তার কথা বলা দেখে রোগা লোকটা তাকে একটা সজোরে চড় মারে। আচমকা এই আক্রমণের জন্য বন্ড প্রস্তুতি ছিল না। এলোপাথাড়ি মার আসতে লাগল। লোকটি এ বিষয়ে পেশাদার না হয়ে যায় না। একটুর জন্য যে যন্ত্রণা ভুলে ছিল। কিন্তু এই আক্রমণে সে একেবারে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। লোকটি যে এত ভয়ঙ্কর তা তার চেহারা দেখলে বোঝা যায় না।

হঠাৎ গাড়ির পেছনের বুট খোলা হল। অন্য লোকটি লোহার শেকল তার মধ্যে পুরে দিল। লোকগুলো ভীষণ চটপটে। এদের কাজের গতি প্রকৃতি দেখলে সত্যি অবাক লাগে। তারপর ভাবল শুধু কি অফিসের? এই ঘটনার জন্য সেও সমান দোষী। সে নিজেকে কেন এত হাল্কাভাবে নিল। সে জানত আজকে খেলার আসরে কি কি হয়েছে? এসব চিহ্ন একত্র করে, অনেক আগে তার সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত ছিল। রোয়া গালান্তে আজকে না গেলেই কি চলছিল না। শত্রুপক্ষ তার থেকে কত চালাক কত বুদ্ধি রাখে। শ্যাম্পেন খেতে খেতে শত্রুপক্ষের কথা একবারও মনে হয়নি। অথচ শত্রুপক্ষ পালটা চাল চেলে দেখিয়ে দিল তাদের আত্মবিশ্বাসের জোর বন্ডের তুলনায় কত বেশি। অন্য লোকটি গাড়িতে উঠে বসতেই শিফ গাড়ি ছেড়ে দিল। সত্তর মাইল বেগে উপকূলের রাস্তা ধরে তাদের গাড়ি ছুটে চলল।

আলো দেখা দিয়েছে। মনে হয় পাঁচটা। ওদের যাওয়া দেখে বন্ডের মনে হল ওরা শিফের ভিলার দিকেই চলেছে।

দু-এক মাইল যাবার পরই একটা বাঁক পড়বে। এখন সমস্ত ব্যাপারটা তার কাছে পানির মত পরিষ্কার হয়ে গেল।

বন্ডের মনে হল, ভেসপারকে এখানে আনার কি দরকার ছিল? ঝামেলা যখন তার সঙ্গে, অকে সঙ্গে নিয়েছে এটাই তো যথেষ্ট। আসলে ভেসপারকে ওরা টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে।

মিনিট দশেকের মধ্যে গাড়ি বাঁ দিকে মোড় নিল। ঘাস আর আগাছায় ঢাকা কাঁচা রাস্তা। প্লাস্টার খসা পাচিলঘেরা এক বাড়ি। ঘণ্টার বোতামেও মর্চে ধরেছে, তার ওপর জিংকের অক্ষরে লেখা নিশাচর।

এই বাড়িটার স্থাপত্য কার্যে তেমন বৈশিষ্ট্য নেই। ফ্রান্সে উপকূল অঞ্চলে এই রকম অনেক বাড়ি আছে। সারা বছরই বাড়ি বন্ধ থাকে। শুধুমাত্র গরমে ভাড়া দেবার জন্য বাড়িটার চেহারা একবার বদলান হয়। এজেন্ট থাকে রয়্যালে। পাঁচ বছর অন্তর চুনকাম, তাও কেবল বাইরের দিকটা আর ঘরের দেওয়াল। শীতকালে বৃষ্টি শুরু হবে, রঙ চটে যাবে, মাছি ভনভন করবে সেই সঙ্গে বাড়িটা আবার পোড়ো বাড়িতে পরিণত হবে।

সত্যি ল্য শিফের বুদ্ধিকে তারিফ জানাতেই হয়। কালও যখন এখানে এসেছিল, কয়েক মাইলের মধ্যে বন্ডের কোন খামার পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয়নি। রোগা লোকটা এক গুঁতো মেরে বন্ডকে গাড়ি থেকে নামাল। গাড়িতে আসতেই তাদের স্বভাবের কিছুটা পরিচয় সে পেয়েছে। তাদের চরিত্র সম্বন্ধেও একটা ধারণা করে নিয়েছে। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার। পর এই সব ভেবে বন্ড যেন আরও ঘামতে শুরু করল। এখানে শিফের নির্দেশে তারা বন্ড ও ভেসপারের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে যাবে, এতে কোন ভুল নেই। এটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক অজানা আতঙ্ক বন্ডকে ঘিরে ধরল।

চাবি খুলে ল্যা-শিফ বাড়ির ভেতর চলে গেল। ভোরের আলোয় ভেসপারকে বড় বেশি অশোভন দেখাচ্ছিল। কর্সিকান লোকটার মুখ বড় খারাপ। অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে ভেসপারকে নিয়ে চলল বাড়ির ভেতর। বন্ড রোগা লোকটার সঙ্গে তাদের পথ অনুসরণ করে চলল।

দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। ডানদিকে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ল্য-শিফ। সে দেখল ভেসপারকে বারান্দা দিয়ে বাড়ির পেছন দিকটাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুহূর্তে মনস্থির করে নিল সে, তার কি করনীয়। উন্মত্তের মত পেছনের লোকটির হাঁটুর কাছে আঘাত হানল। আর্তনাদ করে উঠল সে। একমাত্র অবলম্বন তখন তার পা। এই সম্বলের উপর নির্ভর করে সে বারান্দার দিকে ছুটে চলল। সে কি করতে চলেছে, সে নিজেও জানে না। তবে লোক দুটোকে যে করেই হোক জখম করতে হবে। তার এই চেষ্টা সফল হলে ভেসপারের সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে। তাকে এও বলতে হবে যে, সে যেন কোনমতেই নিজেকে ওদের কাছে আত্মসমর্পণ না করে।

গোলমালের শব্দ কানে যেতেই কর্সিকানটা পেছন ফিরল। বন্ডের কাণ্ডখারখানা দেখে অবাক হল। বন্ড ওকে কিছু ভাববার অবকাশ না দিয়েই ডান পা-টা তার দিকে এগিয়ে ধরল। দেওয়ালের গায়ে পিঠ লাগিয়ে কোন মতে নিজেকে বাঁচাল সে। বন্ড যখন দ্বিতীয় আক্রমণ হানতে যাচ্ছে লোকটি তখন আলতো করে বা হাত দিয়ে বন্ডের জুতাটা একটু ঘুরিয়ে দিল। ব্যালান্স না রাখতে পারায় অন্য পা টাও মাটি ছেড়ে উঠে গেল। নিজের ভার আর রাখতে পারল না। সপাটে মেঝের ওপর পড়ল। কতক্ষণ সে এভাবে পড়েছিল তা জানা গেল না। তবে এইটুকুর জন্যই তার ওঠোর ক্ষমতা সে হারিয়ে বসে আছে। রোগা লোকটা এসে তাকে টেনে তুলল। হাতে ধরা পিস্তল। নির্বিকার চিত্তে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ নিচু হয়ে পিস্তলের মুখটা দিয়ে তার পায়ে সজোরে মারল। বন্ড যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল। ভাঙা ভাঙা ফরাসীতে যা বলল তার অর্থ হল, এর পরের বার এ রকম কিছু করলে তোমার বাঁচা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে চলে গেল। ভেসপার কর্সিকানটার সঙ্গে আছে। শিফের দিকে চোখ পড়তেই সে দেখল, শিফ গুটি গুটি পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে।

এতক্ষণ পরে তার মুখে কথা শোনা গেল। বন্ডের উদ্দেশ্যে তার বক্তব্য হল তুমি অযথা তোমার বৃথা সময় নষ্ট করছ। লোকটার এই ইংরাজি উচ্চারণ বেশ পরিষ্কার। গলায় কোন আবেগ নেই, নেই উত্তেজনা। নিজেকে শিফের কাছে অত্যন্ত দুর্বল মনে হল। বন্ড আর অযথা কথা বাড়াল। বাধ্য ছেলের মত তাদের অনুসরণ করল। এদের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে বন্ডের কিছু লাভ হয়নি, উল্টে গায়ে আঁচড়ের দাগ পড়েছে। লোকটার পেছন পেছন বন্ড এসে ঘরে ঢুকল। এবার সে সম্পূর্ণরূপে এদের হাতের মুঠোয় চলে এল।

.

প্রিয় বন্ধু

মস্ত বড় ঘর। আধুনিক ধরনের, জিনিসপত্র খুব বেশি নেই। তবে এটা বসার ঘর না খাবার, তা বোঝা একটু মুশকিল। দরজার উল্টোদিকে সারা দেওয়াল জুড়ে আয়না বসানো। রয়েছে ফলের পাত্র আর সঙ্গে রংকরা মোমবাতি দান। ঘরের অন্যদিকে রঙ ওঠা সোফা।

মাঝখানে কোন টেবিল নেই। একটা চৌকো কাপের্ট, তাতে জ্যামিতিক নকশা কাটা। ছাদে সাদা আলো। জানলার কাছে ওক কাঠের এক চেয়ার। বসার জায়গা লাল ভেলভেটে মোড়া। ছোট টেবিল রয়েছে। আর একটা বেতের শূন্য গদির চেয়ার।

ঝিলমিলিগুলো অর্ধেক বন্ধ। তবু তার মধ্যে রোদ ঢুকছে, কিন্তু বাইরে থেকে কেউ ঘরের ভেতর কি হচ্ছে দেখতে পাবে না। বেতের চেয়ারটা দেখিয়ে শিফ রোগা লোকটাকে বলল, ওতে হয়ে যাবে। ওকে চটপট তৈরি হয়ে নিতে বল। ও বাধা দিতে আসলে তোমরাও চুপ করে বসে থাকবে না–এটা যেন ও মাথায় রাখে।

শিফ বন্ডের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। চোখে মুখে কোন ভাবের বিকার নেই। নিরুৎসুক চাউনি। তার দিকে তাকিয়ে বলল, জামাকাপড় সব খুলে ফেল। বাড়াবাড়ি কিছু করলে তুমি জান আমরা কত হিংস্র হয়ে উঠি। আমরা কাজের লোক। কাজ নিয়েই আমরা থাকি। তোমার বাঁচা এখন তোমার হাতেই। তুমি ঠিক কর তুমি কি করবে? শিফ রোগালোকটাকে ইঙ্গিত করল। সে বুঝে গেল শিফের ভাষা। সে সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ি দিয়ে বেতের চেয়ারের সিটটা ফাঁকা করে দিল। একটানে আলোর দিকে এনে দাঁড়াল ওকে। হাতের বাঁধনটা আলগা করে দিল। তাড়াতাড়ি তুমি তোমার কাজ সারো।

বাঁধনটা এত এঁটে বসেছিল, কব্জি লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। বন্ড তখনও ভাবছে তাদের বাধা দিতে গেলে হাতে কতটা সময় পাওয়া যাবে। লোকটা বন্ডের দিকে ফিরে হাতদুটো পেছনে আটকে দিল। হাঁটু মুড়ে বন্ড বসে পড়ল। ছুরি দিয়ে সে কোটের পেছন দিকটা ফালা ফালা করে দিল। শিরদাঁড়ার ওপর ছুরির ফলার স্পর্শ অনুভব করল। হাত দুটো আলগা হয়ে গেল। কারণ কোটের তখন আর কোন অস্তিত্বই নেই। বন্ডের গা থেকে ডিনার জ্যাকেট খসে পড়ল। বন্ডের এই আচরণে রোগা লোকটা যে খুব বিরক্ত হচ্ছে তা তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। সময় নষ্ট না করে সে শার্টটা খুলে ফেলল।

শিফ কফি হাতে ঘরে ঢুকল। বেতের চেয়ারটা দেখিয়ে তাকে বসতে বলল। বন্ড বসতেই রোগা লোকটা তারের দড়ি দিয়ে হাতলের সঙ্গে হাত ও পায়া দুটোর সঙ্গে হাঁটু আটকে দিল। ছড়ি দিয়ে তাকে চেয়ারের সঙ্গে আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে দিল। এখন সম্পূর্ণরূপে সে বন্দী। শিফের চোখের ইঙ্গিতে রোগা লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শিফ সিগারেট ধরাল। মনে একটু আমেজ নিয়ে এল। এমন ভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগল, দেখে মনে হল বন্ডের প্রতি যেন তার কত স্নেহ। পরমুহূর্তে হাতটা হাঁটু স্পর্শ করল। বন্ডের সমস্ত দেহ যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। ঠোঁট বেঁকে গেল, ঘাড় হেলে পড়ল, শিরা ফুলে উঠল। হাত ও পায়ের আঙুল রক্তশূন্য। দেহটা ঝুলে পড়তেই প্রচণ্ড ঘাম হতে থাকল। অজান্তে মুখ দিয়ে আর্তনাদ বেরিয়ে এল।

বন্ড চোখের পাতা মেলতেই শিফের ঐ নিষ্ঠুর হাসি চোখে পড়ল। চিবুক বেয়ে এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে ঘাম বন্ডের নগ্ন দেহে ঝরতে লাগল।

পরম আনন্দের দিন শিফের। একের পর এক সিগারেট ধ্বংস করছে। আচ্ছা বন্ড এবার কাজের কথায় আসি বুঝতেই পারছ তোমার খেলার দিন শেষ। তুমি ছোট আছ–এখন এই বয়সেই এই মারাত্মক খেলায় কেন নিজেকে জড়াচ্ছ। ফলটা হাতে হাতেই পেয়ে যাচ্ছ। বড়দের সঙ্গে খেলার যোগ্যতা এখনও তুমি অর্জন করনি। যাই হোক ওসব বলে এখন আর কি লাভ। টাকার কথায় আসা যাক। টাকা কোথায় রেখেছ। বন্ড নিরুত্তর। আমার প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তোমাকে বেতের ঘায়ে জর্জরিত হতে হবে। দয়া মায়া আমার শরীরে নেই। তোমার শরীরের কোমল অঙ্গগুলোতে আমি এমন আঘাত হানব যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। পালাবার রাস্তা তোমার বন্ধ। এমন একজনও কেউ নেই যে তোমার এই বিপদে তোমার পাশে এসে দাঁড়াবে। তুমি যদি মুখ না খোল মেয়েটিকে এখানে নিয়ে আসব। তোমার সামনে তার ওপর অত্যাচার করব। তাতেও যদি তোমার হুশ না আসে তোমাদের দুজনকে এখানে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে, আমি বিদেশে চলে যাব। সেখানে মনের মতন কাউকে বিয়ে করে পরিবার নিয়ে সুখে দিন যাপন করব। তুমি টাকাটা না দিলেও আমার কোন ক্ষতি হবে না। বন্ড বুঝতেই পারছ, তোমার কাছে একটা পথই খোলা আছে।

বন্ড চোখ বন্ধ করল। যতক্ষণ এদের ইচ্ছে হবে মারবে। অত্যাচারের শুরুটাই বড় কষ্টের। শারীরিক কষ্ট বাড়তে বাড়তে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছে যায় যেখানে কোন অনুভূতি কাজ করে না–সে প্রাণপণে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে লাগল, যাতে আঘাতটা চরমে ওঠার আগে সে ঠিক থাকে আস্তে আস্তে অজ্ঞান আর পরিশেষে মৃত্যু তো তাকে বরণ করতেই হবে।

দেখ বন্ড, আমাদের কাছে কিছু লুকিয়ো না। কারণ আমরা জানি হোটেলের ঘরে তুমি চেকটা লুকিয়ে রেখেছ। তুমি নাইট ক্লাবে যাওয়া মাত্রই, আমার চারজন লোক তোমার ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। কিন্তু চেকের সন্ধান তারা পায়নি। বন্ড ভাবল শিফের সঙ্গে মুনজরাও হাত মিলিয়েছে। ঘরের প্রতিটি ইঞ্চি দেখা হয়েছে। যা কিছু ফিটিং ছিল তা উপড়ে ফেলা হয়েছে। চেকটা পাওয়া গেলে ভালই হত। তোমাকে এখানে আমাদের সঙ্গে থাকতে হত না। তোমার পাশে থাকত তোমার লিন্ড। শিফের মুখে লিন্ডের নাম শুনে সে চমকে উঠল। এতক্ষণ তার কথা একবারও মনে পড়েনি। বন্ড ভাবল শিফ যদি তার ওপর এই অত্যাচার করতে থাকে, তাহলে ভেসপারের ওপর কি হচ্ছে তা আন্দাজ করা যায়।

শিফ ততক্ষণে আরও একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেট মুখে নিয়েই কথা বলতে থাকল। দেখ বন্ড, তুমি নিজে একজন পুরুষ, আমিও তাই। তাই তোমার ওপর আর অন্য অত্যাচার করে কি দরকার। এর ওপর তুমি যদি কোন রকম অবাধ্যতা কর, তুমি মানুষ থাকলেও পৌরুষ তোমাকে ছেড়ে যাবে। ভাবতেই কেমন অবাক লাগে না কি বন্ড? শারীরিক কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক কষ্টও যুক্ত হয় কিন্তু এই যন্ত্রণা এত বেদনাদায়ক হয় যে তুমি নিজেই আমাকে অনুরোধ করবে তোমাকে একেবারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে।

থরথর করে কাঁপছিল বন্ড। গাল শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। অতিকষ্টে শুধু একটু পানি চাইল। শিফ উঠে দাঁড়াল। মুখ খুলে কফি ঢেলে দিল, যাতে দম না বন্ধ হয়। জড়িত স্বরে বন্ড বলে উঠল, টাকা এখন আর কোন কাজে লাগবে? পুলিশ সন্ধান পেয়ে যাবে।

বন্ড এতটাই পরিশ্রান্ত ছিল যে, দেহের ভার রাখতে পারছে না। মাথাটা সামনে ঝুলে পড়ছে বার বার। যতটুকু না সে কাহিল হল তার চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রান্তের নাটক করতে থাকল।

ধূর্ত হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে শিফের মুখে। শিফকে এখন ভীষণ হিংস্র মনে হল। শিফ আবার শুরু করল। বন্ড তোমাকে আসল কথাই বলা হয়নি। ক্যাসিনোর খেলার পরে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিল, আরও একবার আমরা মুখোমুখি হব। ইংরেজ রক্ত তোমার শরীরে। তুমি খেলতে রাজি হতে। দুর্ভাগ্য তোমার পিছু ছাড়ত না। তোমার হার হল। রয়্যাল ছেড়ে কোন এক অজানা দেশে পাড়ি দিলে। যাবার আগে লিখে গেলে যাতে চেকটা ভাঙাতে আমার কোন অসুবিধে না হয়। সত্যিই তোমার মত ভদ্রলোক আর হয় না। সব ব্যবস্থা পাকা।

বন্ডের আর কোন ভরসাই রইল না। অজানা দেশ মানে মাটির তলা কিম্বা অতল সমুদ্র। ম্যাথিস বা লিটারের এখানে আসার কোন সম্ভাবনাই নেই। তবে যত দেরি হবে শিফের ধরা পড়ার সম্ভাবনা তত বেশি। এখন হয়ত গাড়িটা কারোর চোখে পড়েছে। অসংহ্য অত্যাচার সহ্য করা যাবে যদি শিফের মত লোক ধরা পড়ে। রাগে উন্মত্ত হয়ে শিফ আবার মার শুরু করল। মুখ থেকে বেরাতে লাগল নিষ্ঠুর জান্তব আওয়াজ।

শিফ নিস্পন্দ দেহটার কাছে দাঁড়াল। সমস্ত দেহ রক্তশূন্য। চামড়াটা এখনও অল্প অল্প কাঁপছে। এক গ্লাস কফি বন্ডের মুখে আর মাথায় ঢেলে দিল। চেয়ারে বসে দেখতে লাগল বন্ডের প্রতিক্রিয়া। চোখ মেলল বন্ড। অনেক হয়েছে। শিফ নিজেও ক্লান্ত বোধ করছিল। মনে মনে ভাবল, মেয়েটাকে তোমার সামনে রেখেই আমি আমার কাজ সারব।

.

পাথুরে চোখ

এবার তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ। বন্ডের আচ্ছন্ন চেতনায় সব না ঢুকলেও এক ব্যক্তির উপস্থিতি টের পাচ্ছিল। হঠাৎ তার সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে এল। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। শিফ আশ্চর্য ভাবে মাথা নাড়ছে। কৌতূহল আর স্তম্ভিত ভাব এখন। উধাও যা আছে সে শুধু ভয়।

বিদেশী উচ্চারণে কে কথা বলছে? তার কথা শুনছে শিফ। বাধ্য ছেলের মত ছুরিটা নামিয়ে রাখল। শিফের মুখ দেখে বন্ড প্রাণপণে বোঝার চেষ্টা করল, কি ঘটছে, কিন্তু সে মুখ আতঙ্কে ভরপুর। ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে, মুখ দিয়ে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল। মনে হল কেউ শিফের দিকে রিভলবার ঠেকিয়ে আছে। সে বোধহয় বোঝবার চেষ্টা করছিল কিন্তু লোকটির মুখ দেখে সে বুঝে নিয়েছে সব চেষ্টাই বৃথা।

তোমার দুটো লোকের কেউ বেঁচে নেই। তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছ। তাই তোমার বাঁচার কোন অধিকার নেই। সোভিয়েত আমায় পাঠিয়েছে তোমার কাছে। তাদের নির্দেশ আছে তোমার মৃত্যু যেন যন্ত্রণাদায়ক হয়। কিন্তু সময়ের অভাবে তোমায় আমি গুলি করছি। তুমি যা করেছ তার তুলনায় তোমার কাছে এই পুরস্কার অনেক কম।

তার সমস্ত শরীর অসাড় অবসন্ন। তবু কোনমতে সে শিফের প্রকান্ড মুখের দিকে চেয়ে রইল। চোখ দুটো তার দিকে চেয়ে আছে, মুখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা। পা দুটো মাটিতে শেষবারের মত ঠুকছে। আর কোন শব্দ নেই। ঘরে যেন এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। শুধু টিউব থেকে হাওয়া বেরোবার মত একটা শব্দ। এই শব্দের এত জোর যে চোখের নিমেষে সবশেষ।

একটা হাত রুক্ষভাবে তার থুতনি ধরে আচমকা এক হ্যাঁচকা টান দিল। এবার সে তাকাল। কালো মুখোস। তার মধ্যে জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ। হ্যাট আর বর্ষাতিতে ঢাকা পড়ে গেছে মুখ। আর কিছু দেখার আগেই তার মাথাটা সমিনে করে দেওয়া হল।

বন্ড তোমার কপাল সত্যি ভাল। একদিনে দু-দুবার প্রাণ ফিরে পেয়েছ তুমি। তোমার বসকে বোলো স্মার্শ কাউকে সমীহ করে না। প্রথমবার তুমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছ, দ্বিতীয়বার ভুল করে তোমাকে মারার নির্দেশ দেওয়া হয়নি। আমাকে।

আমার পরিচয় রেখে গেলাম। তুমি হয়ত কোনদিন আমাদের বিরুদ্ধে খেলায় নামবে। এই বলে, বন্ডের বাধা ডানহাতটার ওপর ছুরির তিনটে আঁচড় দিল। চতুর্থ আঁচড়ে লেখা শেষ হল। বন্ড এতক্ষণ যে যন্ত্রণা ভোগ করেছে তার কাছে এ যন্ত্রণা কিছুই নয়। হাত দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরতে লাগল। ক্রমেই পদশব্দ মিলিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। নিস্তব্ধতা আবার ফিরে এল। সারা মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে, সেই রক্তের ওপর রোদ পড়ে দেওয়ালে। গোলাপী রঙের আভা চোখে পড়ছে। এটুকুই মনে আছে বন্ডের। এরপর সে চেয়ারের কোলে ঢলে পড়েছিল।

.

সাদা তাঁবু

 দুদিন পর বন্ডের জ্ঞান ফিরল। আচ্ছন্ন চেতনার মধ্যে অসংখ্য স্বপ্নের ভিড় জমা হচ্ছে কিন্তু সবগুলোই অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে সে, এত দুর্বল যে নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। তার চারপাশে লোকজনের চলাফেরা সে টের পাচ্ছিল কিন্তু জাগ্রত জগতে প্রবেশ করার কল্পিত বাসনা তার ছিল না। অন্ধকারেই ফিরে যেতে চায়।

তৃতীয় দিন সকালে মারাত্মক দুঃস্বপ্ন দেখে বিছানায় জেগে উঠল বন্ড। সর্বশরীর কাঁপছে। ঘামে জামাকাপড় ভিজে গেছে। কপালে কার হাতের স্পর্শ পেল। এই স্পর্শ সে স্বপ্নের মধ্যেও পেয়েছে। ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছে হাতটা। পারেনি, কারণ হাত দুটো বিছানার সঙ্গে আঁটা। রাগের চোটে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অশ্রাব্য গালি। এটুকু বলেই সে হাঁফাতে লাগল। নিজের এই অসহায় অবস্থা দেখে তার চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। কপালে আবার সেই হাতের স্পর্শ পেল। দুচোখে ঘুম নেমে এল। কয়েক ঘণ্টা বাদে ঘুম ভাঙল। ভয়ের পরিবর্তে শরীরে এখন সে আরাম বোধ করল। ঘরে রোদ এসে পড়েছে, দূর থেকে তটে পানি আছড়ানোর শব্দ ভেসে এল। একটু মাথা নাড়তেই কাপড়ের শব্দ তুলে সুন্দরী নার্স পাশে এসে দাঁড়াল। হাসি মুখে বন্ডের নাড়ি দেখল।

আপনার জ্ঞান ফিরে আসায় আমরা একটু স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি। আপনি এখন রয়্যালের একটা নার্সিংহোমে। আপনার দেখাশোনার জন্য ইংল্যান্ড থেকে এই কারণেই আমার আসা। আমরা দুজন এসেছি। আপনি যে সেই অজ্ঞান অবস্থায় এখানে এসেছিলেন, তার পরে আর জ্ঞান ফেরেনি। আমার নামটাই বলা হয়নি গিবসন।

চোখ বন্ধ করল বন্ড। সর্বাঙ্গে ব্যথা। দেহের মাঝখানটা অসাড় হয়ে গেছে। সব জায়গায় ব্যান্ডেজ, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, শরীরের অবস্থাটা যে কেমন এখন সে বুঝতে পারল। দরজা খুলে ডাক্তার এলেন, সঙ্গে ম্যাথিস। ম্যাথিসকে দেখে বন্ডের মন খুশিতে ভরে উঠল। তার অনেক কিছু জানার আছে।

ডাক্তারটি ফরাসী, দোয়াজিয়েম বুরোতে আছেন। বন্ডের চিকিৎসার জন্য তাকে এখানে আনা হয়েছে। আপনি বেশি কথা বলবেন না। ম্যাথিসের সঙ্গে দু-একমিনিট কথা বলবেন। ডাক্তার বললেন, এক চাষী আপনার গাড়ীটা দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। ম্যাথিস খবর পেয়ে ওটা আপনার গাড়ী শোনা মাত্র ভিলাতে লোকজন নিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে গিয়ে শিফ ও আপনাকে পান। আপনার বান্ধবী সুস্থই ছিলেন। ওরা ওর গায়ে হাত দেয়নি। এখন তিনি ওনার হোটেলেই আছেন। ওপরওয়ালাদের নির্দেশ আছে আপনি সেরে না ওঠা পর্যন্ত ও আপনার সঙ্গেই থাকবে। শিফের রক্ষীদুটোও আর বেঁচে নেই। মুখ দেখে মনে হয় হত্যাকারীকে দেখার সুযোগ ওরা পায়নি। আপনি নিশ্চয়ই হত্যাকারীকে দেখেছেন। বন্ড ঘাড় নাড়ল।

আপনার আঘাত গুরুতর হলেও প্রাণের আশংকা নেই। রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। আপনার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। কিছু দিনের মধ্যেই আপনি শরীরের সব রকম ক্ষমতাই ফিরে পাবেন। আপনার মনের জোর খুব বেশি। আপনার বেঁচে থাকাটাই এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার। ম্যাথিসকে সতর্ক করে দিয়ে এক গাল হেসে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন ডাক্তার।

ম্যাথিস থপ করে ডাক্তারের চেয়ারে বসে পড়ল। ডাক্তারকে বন্ডের বেশ মনে ধরেছে। বন্ড, প্যারিস আর লন্ডন তোমার সব খবর জানতে চাইছে। ওয়াশিংটনও পেছিয়ে নেই। এম ফোনে নিজে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। তোমাকে উনি অভিনন্দন জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন ট্রেজারি বিভাগ এখন নিশ্চিন্তবোধ করছে। বন্ড পুলকিত হল। এম নিজে ফোন করেছেন। তাঁর সে অস্তিত্ব সেটাইতো স্বীকার করা হয় না। ঐ গোপন প্রতিষ্ঠানেও খুব হৈ চৈ পড়ে গেছে-ঘরে বসেই সে-টের পেল। আচ্ছা বন্ড, তাহলে ল্যশিফকে কে হত্যা করল? স্মার্শ। শিফের হত্যা ঘটনাটা বন্ড ম্যাথিসকে বলল। কিন্তু দৃশ্যগুলো সামনে আসতেই বন্ড নিজেকে সামলাতে পারল না। শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হল। ম্যাথিস শর্ট হ্যাঁন্ডের নোট থামিয়ে দিল। এই ব্যবহারের জন্য সে ক্ষমা চাইল। সব ভাল ভাবে শেষ হয়েছে। আমরা এই প্রচার করেছি যে শিফ তার দুই সহকর্মীকে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করেছে। কারণ ইউনিয়নের টাকা নষ্ট করে জবাবদিহি করার মুখ তার ছিল না। ম্যাথিসের কথায় বন্ডের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

একটা রহস্য কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। উত্তরটা শুনেই আমি প্রস্থান করব। যার জন্য এত ঝামেলা সেই চেকটা উধাও হল কোথায়?

দরজার বাইরে একটা নাম্বার প্লেট আছে। লিটার চলে যেতেই নাম্বার প্লেটটা খুলে চেকটা তার মধ্যে পাট করে ঢুকিয়ে আবার বন্ধ করে দিয়েছি। এখনো ঐখানেই আছে। তাহলে ম্যাথিস তুমি বল-ইংরেজরা যতই বোকা হোক, চালাক ফরাসীদের তারা বোকা বানাবার ক্ষমতা ধরে।

ডাক্তার আসতেই ম্যাথিস উঠে পড়ল। ম্যাথিস হাত নেড়ে বিদায় জানাল। ডাক্তার তাকে একরকম ঠেলতে ঠেলতেই ঘর থেকে বের করে দিলেন। ক্লান্তিতে বন্ডের চোখ বুজে এল।

.

অমঙ্গলের স্বরূপ

 তিনদিন পর বন্ড নিজেকে অনেকটা সুস্থ বোধ করল। ম্যাথিস ওর সঙ্গে দেখা করতে এল। উঠে বসলেও দেহের তলার দিকটা তখনো ঘেরাটোপে আবৃত।

ম্যাথিস বন্ডের দিকে চেকটা এগিয়ে ধরল। কারণ বন্ডের সই দরকার। তোমার সই হয়ে গেলে আমি টাকাটা তোমার অ্যাকাউন্টে জমা করে দেব। স্মার্শের বন্ধুটি কিন্তু একেবারে উধাও। লোকটা ভিলায় গেলে সাইকেল বা পায়ে হেঁটে গেছে নিশ্চয়ই। এই স্মার্শের সম্বন্ধে আমরা বিশেষ কিছুই জানি না। লন্ডনও জানে না। তবে এ বিষয়ে ওয়াশিংটন যা বলছে তা হল রেফিউজিদের কাছে পাওয়া কিছু খবর। এখানে আর তার কি মূল্য আছে?

বন্ড বলল, লোকটা বার্লিনে এসেছিল। সেখান থেকে ইউরোপে চলে গেছে। কারণ ইউরোপ যাবার অনেক পথই খোলা। এতদিনে আমার সম্বন্ধে ওদের কাছে একটা ফাইল তৈরি হয়ে গেছে। আমার হাতে ওরা একটা অক্ষর লিখে ওদের বাহাদুরি প্রমাণ করতে চেয়েছে।

বন্ডের কথায় ম্যাথিস একটু অবাকই হয়ে যায়। কারণ, সে জানতো কাটাটা উল্টে এম-এর মত। ডাক্তারের ভাষায় যার কোন মূল্যই দেওয়া যায় না।

বন্ড বলল, উল্টে এম এই অক্ষরটি রাশিয়ান বর্ণমালার একটি অক্ষর। স্মার্শ কথাটির আদ্যাক্ষর। এই কথার পুরো অর্থ হল বিশ্বাসঘাতকদের মৃত্যুবরণ। আমাকে ওরা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে ছিল। এতে অবশ্য আমার কাছে কিছু আসে যায় না। কারণ আমি স্থির করেছি, আর নয় অনেক হয়েছে আমি চাকরি ছেড়ে দেব।

ম্যাথিস বন্ডের কথা শুনে একেবারে থ হয়ে যায়। বন্ড বলছে কি? যাকে নিয়ে এত হৈ চৈ-তার মুখে কিনা এই কথা। সত্যি আশ্চর্য এই জগত সংসার। তোমার হঠাৎ এ ব্যাপারে মনে এত অনীহা জন্ম নিল কেন?

দেখো ম্যাথিস শিফ যখন আমাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছিল, তখন আমার মনে হয়েছিল বেঁচে থাকার সুখই আলাদা। কারণ, মরতে আমি চাই না। শিফ আমার উদ্দেশ্যে বলেছিল আমার রেড ইন্ডিয়ান রেড ইন্ডিয়ান খেলার কি দরকার, খুব ভুল বলেনি। বয়স যখন আমরা তরুণ থাকি তখন কোনটা মন্দ–কোনটা ভাল সহজেই অনুমান করা যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা ক্রমেই জটিল রূপ নেয়। আমি দুটো দুষ্ট লোককে প্রাণে মেরেছি। প্রথমটা নিউ ইয়র্কের। এক জাপানী ভদ্রলোক আমাদের সংকেতগুলো পড়ে ফেলেছিল। আমি ঠিক পাশের উঁচু বাড়িটার চল্লিশ তলায় একটা ঘর নিলাম। সেখানে থেকে ওর কাজের প্রতি দৃষ্টি রাখতে সুবিধে হচ্ছিল। দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্ল্যান করে, জানলার কাঁচে একটা ফুটো করতে গেলাম, তবে গুলিটা ছিটকে গেল। জাপানিটা হাঁ করে জানলার কাছে আসতেই গুলিটা সোজা ওর মুখে ঢুকে যায়।

চমৎকারভাবে কাজটা শেষ করলাম। শব্দ নেই, নেই ঝামেলা। একেবারে নিখুঁত কাজ। পরের বারের খুনটা স্টকহলমে। নরওয়ে ভিয়েনাকে খুন করার আদেশ দিল। আমাদের হয়ে কাজ করার পরিবর্তে জার্মানদের সব খবর পৌঁছে দিচ্ছিল। ওর জন্য আমাদের দুজন লোককে মৃত্যু বরণ করতে হয়। এই লোককেও ঐ দুজনের মতই মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়তে হল।

এই কাজের জন্য সার্ভিসে আমি ডাবল জিরো নম্বর লাভ করলাম। ভাবলাম কত বীরত্বপূর্ণ কাজ যায় ফল স্বরূপ এই পুরস্কার। আমার খুব নাম ডাক হল। শুধু কাজ, মানে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা।

এই গল্প শুনতে ভালই লাগে। জিরো দুজন শয়তানকে খুন করেছে। কিন্তু হিরো শিফ যখন শয়তান বন্ডের কাছে এগিয়ে এল তখনই সমস্ত ব্যাপারটা ওলোট পালট হয়ে গেল। ওখান থেকে গন্ডগোলের সূত্রপাত। ম্যাথিসকে থামিয়ে বন্ড বলতে লাগল, এখানে দেশপ্রেম বলে একটা ব্যাপার কাজ করে। আমার দেশ যা করবে তাই আমায় মেনে নিতে হবে। আজ আমরা কমিউনিজমের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছি কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগেও আমাদের আজকেরই এই কনজারভেটিজমকেই বলা হত কমিউনিজম। ইতিহাসের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে–আজকের হিরো কালকে শয়তানরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে।

বন্ড তোমার কথা মেনে নিলে শিফকে তোমার বিরুদ্ধে এই কাণ্ড করেও শয়তান বলে চিহ্নিত করা যায় না। স্মার্শ ও যারা ইউরোপে ইচ্ছে মত ঘুরে বেড়াচ্ছে, কাউকে দেখে তার যখন মনে হচ্ছে সে ওদের শত্রু, তারই সে প্রাণ নিয়ে নিচ্ছে। বন্ড, তোমার মনে এই সব অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার আসতে থাকলে তুমি একদিন সত্যি সত্যি এক অ্যানার্কিস্টে পরিণত হবে।

বন্ড মৃদু হাসল। তাই যদি হয়, শিফের কথাতেই আসা যাক। শিফ আমার সঙ্গে চরম নিষ্ঠুরতা করেছে। আমার হাত থেকে ও কোনমতেই নিষ্কৃতি পেতে পারে না। একদিন না একদিন আমি তাকে খুঁজে বার করতাম। আমি যদি তাকে হত্যা করতাম তার কারণ থাকত তার ওপর আমার ব্যক্তিগত আক্রোশ। এখানে কোন নৈতিক-কারণ বা দেশের স্বার্থ জড়িত নয়।

ম্যাথিস বন্ডের কথায় হেসে উঠল। সে বলল, বলে যাও তোমার কথার মধ্যে এমন কিছু আছে হয়ত যার জন্য আমি নিজেও উত্তেজিত হয়ে পড়ছি। বন্ড ম্যাথিসের এই বিদ্রূপ আঁচ করতে পারল। কিন্তু না শোনার ভান করে আবার আগের কথায় ফিরে এল। ভাল বা মন্দ বোঝার জন্য আমরা আমাদের মনের মধ্যে দুটো জিনিস স্থাপন করেছি। একজন সৃষ্টিকর্তা আর অপর একজন শয়তান। আমি নিজে বুঝতে পারছি না কোন দল আমার কাছে প্রযোজ্য। অসৎ আচরণ থেকেও মহৎ জীবনযাপন করা যায়। এর চাক্ষুস দৃষ্টান্ত স্বয়ং শিফ। শয়তানীর মাপকাঠি না থাকলে ভালত্বের বিচার কখনই সম্ভব নয়। তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি লাভবানই হয়েছি।

ম্যাথিস হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। কে ভাল বা কেন মন্দ এই পাপপুণ্যের প্রভেদ একমাত্র অভিজ্ঞতা থেকে হওয়াই সম্ভব। তুমি স্বীকার করেছ–শিফকে কাছে পেলে তুমি কিছুতেই তাকে ছেড়ে দিতে না। লন্ডনে ফিরে যাও। সেখানে অনেক শিফের সন্ধান পাবে তুমি, যারা তোমাকে, তোমার বন্ধুকে তোমার দেশকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়ে আছে। পারবে তুমি সেখানে নিজেকে সংযত রাখতে? তুমি তোমার পরিবারের নিরাপত্তার জন্যই এদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলবে। ধারণা নিয়ে আমরা পথ চলতে পারি না। মানুষদের সঙ্গেই আমাদের বাস। তোমার মত চমৎকার। মেশিন যদি মানুষের দ্বারস্থ হয়–শুধু, আমি কেন? সবার মনই সমান ব্যথা অনুভব করবে। হাত নেড়ে আজকের মত বিদায় নিল সে।

.

ভেসপার

অষ্টমদিনে বন্ড ভেসপারের মুখোমুখি বসল। কাল নিদ্রা দেবী তার প্রতি একটু প্রসন্ন ছিলেন। আজ নিজেকে অনেক বেশি তরতাজা মনে হচ্ছে।

ভেসপার এর আগে নার্সিংহোমে এসেছে। তাকে ফুল পাঠিয়েছে প্রতিদিন। বন্ড সেই ফুল পাঠিয়ে দিয়েছে ম্যাথিসের মাধ্যমে অন্য এক রোগীর হাতে। এরপর ফুল আসা বন্ধ হয়েছে। সে ভেসপারকে দুঃখ দিতে চায়নি। এই সব মেয়েলি জিনিস তার চরিত্রে নেই। ভেষপারকে এই সব কথাই বুঝিয়ে বলতে হবে। এম-এর কাছে একটা রিপোর্ট পাঠাবে অবশ্য ভেসপারের বোকামির কথা উহ্য রেখে। শুধু শুধু একজনের অন্ন কেড়ে কি লাভ পাবে সে।

হার্মিটেজের বারে দেখা হওয়ার পর থেকেই তার প্রতি বন্ড এক শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করে। তাই সে দেখা হবে ভেবেই মনে মনে বিচলিত হচ্ছিল। সে যেমনভাবে চায় তেমনভাবে যদি স্নায়ুর কাছ থেকে না পায়? চিত্তচাঞ্চল্য যদি হিম রূপে আবির্ভূত হয়। কারণ আঘাতের ধাক্কাটা সে কাটিয়ে উঠতে পুরোপুরি পেরেছে কিনা–এই আসল পরীক্ষা এখনও বাকি। কিন্তু লন্ডন থেকে যে কোন দিন এখানে কোন লোকের আবির্ভাব ঘটতে পারে।

ভেসপারকে আজ বড় বেশি রকম সুন্দর দেখাচ্ছে। গত তিক্ত অভিজ্ঞতার কোন ছাপ তার শরীরে দাগ বসাতে পারেনি। চমৎকার বাদামী রঙে তাকে আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

বন্ড, তোমার এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। তুমি যতদিন এখানে আছ আমি রোজ সমুদ্রের কাছে একটা জায়গায় বেড়াতে যেতাম। খাবার আর বই সঙ্গেই নিতাম। ফিরতে ফিরতে বিকেল। বালিয়াড়ির উপর দিয়ে রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই সেই ভিলা। এই কথা উচ্চারণ করতেই সে থতমত খেয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই বন্ডের চোখে মুখে ফুটে ওঠে এক অজানা আশঙ্কা। সঙ্গে সঙ্গে সে প্রসঙ্গ বদলে ফেলে। বন্ডের মনে ফিরিয়ে আনতে চায় তার হারিয়ে যাওয়া মনের জোর। তোমাকে একদিন সমুদ্রের ঔ সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাব। ডাক্তার বলেছেন, সমুদ্রের চান তোমার পক্ষে ভাল।

ক্ষোভের সঙ্গে বন্ড বলে, আমার সমস্ত শরীর এখনও ক্ষত বিক্ষত। গোসল করা আমার আর হয়েছে। তুমি মজা করে গোসল কর আর সমস্ত দিনের আনন্দ একাই উপভোগ কর। বন্ডের ক্ষুব্ধ গলা শুনে ভেসপার একেবারে ভেঙে পড়ে। সে দুহাতে মুখ ঢাকে। কান্না ভেজা গলায় সে বন্ডের কাছে তার এই কর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে থাকে।

ব্যান্ডেজ বাধা নিজের হাত। হাতটা সে ভেসপার দিকে এগিয়ে দেয়। দেখ ভেসপার, আমি সেরে উঠলেই তোমার সঙ্গে তোমার ঐ আবিষ্কৃত জায়গায় যাব। চোখের পানি মুছে নিল ভেসপার। স্নেহভরে বন্ড তাকাল। সব শক্ত লোকদের এই এক দুর্বলতা, সহজেই এদের মন ভিজে যায়। খানিকক্ষণ পরে বন্ড তার কাছ থেকে সে দিনের ঘট জানতে চায়। ভেসপার মাথা নীচু করেই তার কাহিনী শুরু করে। হলে এসে কোথাও ম্যাথিসের উপস্থিতি চোখে পড়ল না। বাইরে বেড়িয়ে এলাম। দারোয়ান বলল যে লোকটা চিঠি এনেছে সে গাড়ির মধ্যে বসে। গাড়িটার দিকে এগিয়ে চললাম। ম্যাথিসের সঙ্গে সবে তখন আমার নতুন পরিচয়। ওর ধরন ধারনে আমি অভ্যস্ত নাই। হঠাৎ গাড়ির পেছন থেকে দুটো লোক আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জায়গাটা অন্ধকার ছিল বলে কিছুই চোখে পড়েনি। কিছু বোঝার আগেই ওরা আমারই স্কার্টটা দিয়ে মাথার ওপর জড়িয়ে দেয়।

দুজনে মিলে আমাকে গাড়ির পেছনের সিটে তুলল। আমি বাধা দেবার চেষ্টা করেছি। আমি কোনমতে একটা হাত খালি করে আমার ব্যাগটা বাইরে ফেলে দিলাম। ভাবলাম তাতে যদি কোন কাজ হয়। বন্ড মনে মনে ভাবছিল, ভেসপার ব্যাগটা না ফেললেও, লোকদুটো ঠিকই ফেলত। কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল বন্ড। ভেসপারকে তারা মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগায়। ভেসপার বলতে থাকে, ওরা আমার হাত পা বেঁধে চেয়ারে ফেলে রেখে নিজেরা মদের নেশায়। চুর হয়েছিল। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়ি। স্মার্শের লোকটা যখন এসেছিল তখন আমার মুখটা ফেরান ছিল। তাই আমি তাকে দেখতে পাইনি। নানারকম শব্দের আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। হাল্কা পায়ের শব্দ, তারপর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর ম্যাথিস আসে, সঙ্গে পুলিশ।

বন্ড ভেসপারকে আশ্বাস দিয়ে বলে, সৃষ্টিকর্তার অনেক কৃপা যে ওরা তোমার কোন ক্ষতি করেনি। আমার ক্ষেত্রে অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। একবার তো হাওয়ার অভাবে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। জ্ঞান ফিরতে দেখলাম, ওরা মুখের সামনে ছোট একটা গর্ত করেছে। আমাকে শেষ করেই ওরা তোমার গায়ে হাত দিল। তোমার কোন দোষ নেই। ঐরকম একটা চিঠি পেলে, তুমি কেন, যে কেউ এই ফাঁদে পা দিত।

পানিতে ভরা চোখ কৃতজ্ঞতায় ভরপুর। তুমি আমাকে মাপ করেছ এটাই আমার কাছে সব থেকে বড় পাওয়া। আমি এর বদলে প্রতিদান দেব। তোমার কাছে আমি সবদিক থেকে ঋণী। ভেসপার যাবার আগে গভীরভাবে বন্ডের দিকে তাকাল। বন্ডের চোখের পলক পড়ছে না। আস্তে আস্তে ভেসপার চলে গেল। বন্ড কান পেতে রইল, যতক্ষণ ভেসপারের পদধ্বনি শোনা যায়।

.

কালোগাড়ি

বন্ড ক্রমেই সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল। প্রথমে তাকে দাঁড়ান, তারপরে বসার অনুমতি। এখন তাকে হেঁটে চলার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চালাবার অনুমতি দেওয়া হল।

নার্সিংহোমের এই একঘেয়ে জীবনে ভেসপার উপস্থিত হত একঝলক বসন্তের হাওয়া সঙ্গে নিয়ে। খুব সহজে এরা নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। তারা কথা বলত বন্ধুর মত, আবেগের আতিশয্য থাকলেও কখনো কেউ বাইরে তা প্রকাশ করত না। দুজনেই মনে রাখত, ভেসপার তার কথা রাখবে। নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে মুক্তি পেয়ে আজ সে এতদিনবাদে মুক্তো বাতাস পেতে ছুটে চলেছে সমুদ্রের দিকে। তারা কোথায় যাচ্ছে ভেসপার তার কাছে গোপন রেখেছে। রয়্যালে নয়, শহর থেকে দূরে কোথায়ও সে থাকতে চেয়েছে। নিজেকে তার হাতে নিশ্চিন্তে সমর্পণ করে দিয়েছে বন্ড। সে যেখানেই যাবে বন্ডও সেখানেই যাবে।

গাড়িতে যেতে যেতে তার কর্মজীবনের ছোটখাটো ঘটনার কথা বলতে লাগল। কিন্তু সে দেখল সে একাই কথা বলে যাচ্ছে, ভেসপার কেমন যেন অন্যমনস্ক। বারে বারে গাড়ির আয়নার উঁকি দিচ্ছে। বন্ড বুঝতে পারল না আয়নায় কি দেখছে। কারণ পেছনে তাকিয়ে তার কিছুই চোখে পড়েনি।

মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। আতঙ্কে সে চিৎকার করে উঠল কালো গাড়ি। প্রায় চারশগজ দূরে একটা গাড়ি আসছে। বন্ড ভেসপারের কান্ড দেখে খুব জোরে হেসে ফেলল। ভেসপার রাস্তাটা আমাদের একার নয়। আমাদের ফলো করে কার কি লাভ? একজন নির্দোষ লোককে দেখে তুমি অযথা ভয় পাচ্ছ। তোমার মত মেয়ের এটা শোভা পায় না।

ভেসপারের এই ভয়ার্ত ভাব দেখে বন্ডের সত্যিই খারাপ লাগছিল। সে এখনও মারাত্মক অভিজ্ঞতার তার মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি। ভেসপারকে একটু শান্ত করতে বন্ড ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল বড় রাস্তার ধার করে গাড়ি দাঁড় করাতে।

গাড়ির আয়নার তারা চোখ রেখে বসে রইল। নানারকম মেঠো শব্দ অতিক্রম করে গোঁ গোঁ শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকল। ভেসপার বন্ডের হাত চেপে ধরল। গাড়িটা যে বেগে আসছিল, সেই বেগেই পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় লোকটা এপাশে মুখ ফিরিয়ে ছিল, কিন্তু লোকটির দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল একটি সাইনবোর্ডে। ওরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে ঝোঁপের গায়ে জ্বলজ্বলে অক্ষরে একটি রেস্টুরেন্টের নাম লেখা।

শব্দ মিলিয়ে গেল। ভেসপারের মুখ তখনও বিবর্ণ। সে বলে উঠল ওরা জেনে গেল আমাদের বাস। বন্ড অধৈর্য হয়ে তাকে থামাবার চেষ্টা করল। তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে চাইল।

অবশেষে তারা এসে গেল। বালিয়াড়ি পেরিয়ে পাইন গাছের মধ্যে সাধাসিধে ছোট্ট একটা হোটেল। ছোট দোতলা বাড়ি, জানলায় লাল হঁটের রঙের ঝালরের মত। উপসাগরের নীল পানি ঢুকে এসেছে, তটে সোনালি বালি। বন্ডের খুব পছন্দ হয় জায়গাটা। এখানে পৃথিবীর কোন কোলাহল এসে পৌঁছবে না। সকাল সন্ধ্যে পর্যন্ত নিরুদ্বিগ্ন শান্ত জীবন। এই জায়গাটা আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে ভেসপারের সান্নিধ্য পেয়ে।

গাড়ি থামতেই প্রোপাইটার ও তার স্ত্রী বেরিয়ে এলেন। এদের দেখে বন্ডের মনে হল এরা নিঃসন্তান ও অতিথিদের অপত্যস্নেহে সেবা করে। অর্থ উপার্জনের জন্য এদের যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। শীতকালে এই জনহীন হোটেলে সমুদ্রের গর্জন আর পাইন গাছের মর্মর শব্দই তখন একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে দুজনার।

ভেসপারের ঘরটা ডবল রুমের। পাশের ঘরটা বন্ডের। এই ঘর দুটো বাড়ির একেবারে কোণের ঘর। ঘরে জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। ঘর দুটির মাঝখানে রয়েছে ঝকঝকে পরিষ্কার বাথরুম।

ইংরেজরা এখানে এই সময় ছুটি কাটাতে আসেন। কিন্তু যারা আসে তারা শনিবার রয়্যালে কাটায়, তারপর সর্বস্ব খুইয়ে বাড়ি ফিরে যায়। আগেকার মত কি আর সেই দিন আছে। সবসময়ই মনে হয় একালের চেয়ে সেকালই ভাল ছিল।

বন্ড তার কথার সম্পূর্ণরূপে সমর্থন জানাল।

.

বাসনার স্রোত

ভেসপারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল প্রোপাইটার চলে যেতেই ভেসপারকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢোকে বন্ড। জ্বলজ্বল করছে দুটি চোখ। বন্ডের বাহুতে তার হাত। আর একটু কাছে এগিয়ে আসতেই ভেসপারকে বুকে টেনে নেয়। আবেগের স্রোতে তারা ভেসে চলল।

ভেসপারের মুখে কোন কথা নেই। আবেগে তার কথা বলার শক্তি একেবারে অন্তর্হিত। পরস্পর পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল। তখনও তাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে বাসনার-কামনার এক স্রোত।

কিছুক্ষণ পরে বন্ডের হাত ছাড়িয়ে সে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। বন্ডও তার পাশে এসে দাঁড়াল ও ওর হাতের ওপর চাপ দিল কিন্তু ততক্ষণে দৃষ্টি তার জানালার বাইরে চলে গেছে। ভেসপার বন্ডের সঙ্গে এল না। তাকে পোষাক ছাড়তে হবে। অগত্যা বন্ডকে একাই যেতে হবে। দরজার কাছ পর্যন্ত গিয়ে বন্ডের মনে হল ভেসপার কাঁদছে।

নিজের ঘরে গিয়ে বিছানার ওপর বসল সে। প্রবল বাসনার আবেগে আজ তার শরীর ও মন দুই অবসন্ন। কিন্তু সমুদ্রে গোসলের লোভ সামলান দায়।

চামড়ার চটি পায়ে সে হেঁটে চলল বিচের দিকে। বাড়ির সমানের দিক দিয়ে যাবার সময় ভেসপারের কথা খুব মনে হচ্ছিল। পানির ধার দিয়ে হাঁটতে লাগল। পায়ের তলায় আগুন রঙের বালি। হোটেল থেকে অনেক পথ সে চলে এসেছে। এখান থেকে বাড়িটা চোখে পড়ে না। পানির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই স্নিগ্ধ মনোরম অনুভূতির কোন বিকল্প নেই। খোলা আকাশের তলায় শুয়ে থাকতে থাকতে ভেসপারের মুখটা মনের পাতায় ভেসে উঠল। ভেসপারের প্রতি যে তার কি মনোভাব সে আজও বুঝে উঠতে পারল না। নিজের কাজে অস্বীকার করার কিছু নেই, সে তার নিজের শরীরের পটুত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হতে চাইছিল। কয়েকদিন একত্রে বাস করা, তারপরে লন্ডনে তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া। এরপর বিচ্ছেদ তো আছেই।

কিন্তু কেন জানি না গত সপ্তাহে ভেসপারের সঙ্গে তার সম্পর্ক আশ্চর্য রকম বদলে গেছে। তার সঙ্গে ব্যবহার বন্ধুর মত হলেও তার মধ্যে এমন কোন রহস্য আছে যাতে বন্ডের আকর্ষণ ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠছে। কিন্তু ভেসপারের মনের নাগালে সে আজও পৌঁছতে পারেনি। তারা যতদিন একসঙ্গে থাকুক না কেন, বন্ড তার মনের গোপন দ্বার কখনই খুলবে না।

প্রতিবারই মনে হয় এক রোমাঞ্চকর যাত্রায় চলেছে। কিন্তু নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছবার পরেও মন নিরাশ হবে না, কারণ শারীরিক ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও এই মেয়েটিকে কেউ কখনো আয়ত্ত্বে আনতে পারবে না।

.

প্রশ্নের উত্তর

ঘরে ফিরে এসে বন্ড অবাক। তার সুটকেস থেকে সমস্ত জিনিস বার করে সে যথাস্থানে রেখে দিয়েছে। বাথটবে তার গোসলের জন্য পানিও ভর্তি করা। এসব দেখে বন্ডের নিজেকে এক কচি খোকা বলে মনে হল। তোমার এত সব করার কি দরকার ছিল। বন্ড এবার ভেসপারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখে। কিন্তু ভেসপার হেসে উড়িয়ে দেয়।

হাত ধরে তারা নিচে নেমে এল। ডাইনিংরুমে কোন লোক নেই। ভেসপার খাবারের দিকে মন দিল। মেটে দিয়ে তৈরি সুস্বাদু জিনিস, ফরাসী রুটি আর বরফের টুকরোর ওপর বসানো মাখন। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে শ্যাম্পেন পান করতে লাগল। মনের কথা মুখে কেউ কিছু বলল না, তবে দুজনের চোখেই এক উদগ্র পরীক্ষা–আজ রাত্রের জন্য।

এরকমভাবে আমার অভ্যেস কেউ খারাপ করেনি। তুমি করলে বন্ড। এসব আমি পাচ্ছি এগুলো বোধহয় আমার প্রাপ্য ছিল। তুমি আমার বিষয়ে কতটুকু জান? বন্ড হেসে বলল যতটুকু না জানলে নয় ততটুকু।

বন্ড গম্ভীর হয়ে ভাবল এসব শ্যাম্পেনের ফল। কফি শেষ করে বন্ড যখন ব্র্যান্ডি খাচ্ছে, ভেসপার ব্যাগটা তুলে নিয়ে উপরে উঠে গেল। একটু বাদেই তার ঘরে আলো জ্বলে উঠল। আলো নিভতেই খাবারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বন্ড উপরে উঠে এল। বাথরুমের দরজা খুলে ভেসপারের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। চাঁদের আলো এসে পড়েছে বিছানায়, ভেসপারের তুষার শুভ্র শরীরী রহস্য আরো গাঢ় করে তুলেছে।

নিজের ঘরে ঘুম ভাঙল বন্ডের। গতরাত্রির স্মৃতি তার মনে বিচরণ করতে লাগল। বিছানা ছেড়ে চলে এল সমুদ্রের ধারে।

সূর্য উঠছে। শান্ত সমুদ্র। ছোট ছোট ঢেউগুলো ভোরের আলোয় গোলাপী হয়ে উঠেছে। গতদিনের জায়গায় এসে আবার পানিতে নেমে পড়ল। পুরো এক মিনিট পরে পানির উপরে উঠে এল সে।

গত সন্ধ্যার মত আজও সে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটি প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে পেয়েও গেল তার জবাব।

আজই সে ভেসপারকে বিয়ে করতে চাইবে। তার মন এখন অনেক সংযত। কেবল সময়ের প্রতীক্ষা। তারপরেই ভেসপার বন্ডের একান্ত কাছের মানুষ হয়ে উঠবে।

.

কালো তাপ্পি

 বন্ড যখন ফিরে এল খাবার ঘরের জানালা তখনও খোলেনি। হোটেলের ভিতর অন্ধকার। সামনের দরজার পাশের টেলিফোন বুথ থেকে ভেসপার বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলল। বন্ড ভেসপার বলেই ডেকে উঠল। সে ভাবল কোন জরুরী খবর এসেছে, তাই তারও জানা প্রয়োজন। ভেসপার পেছন ফিরে বন্ডকে দেখে চমকে উঠল। বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে রইল।

বন্ডের মনে হল, আবার কোন বিপদ নতুন করে দেখা দিয়েছে কি না? কিন্তু ভেসপার বন্ডকে থামিয়ে দিয়ে বলল যে, সে ম্যাথিসকে ফোন করেছিল। এই সময়ে করলাম যাতে ম্যাথিসকে বাড়িতে পাওয়া যায়। আমার পরার মত একটাও ভাল পোশাক নেই। বান্ধবীর ফোন নাম্বারটা জানা থাকলে তাকেই করতাম। যাইহোক গোসল কেমন হল? আমার জন্য একটু অপেক্ষা তো করতে পারতে।

বন্ড ভেসপারের কথায় বিরক্ত হল, তার এই ছেলেমানুষী দেখে। এখন ভেতরে যাও। পরে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাওয়া যাবে। বন্ড কাছে আসতেই ভেসপার তার পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। বন্ড নিজের ঘরে ফিরে এল।

তারপর থেকেই শুরু হল তিক্ততা আর প্রবঞ্চনা। তাদের প্রেমের মধ্যে ঢুকেছে এক বিষাক্ত কীট। বন্ড চেষ্টা করছিল এই অবিশ্বাসের বেড়াজাল ভেঙে ফেলতে। কিন্তু যতবারই সে এই বিষয়ে কথা বলতে গেছে, ভেসপার অনুযোগ করেছে বন্ড তাকে অবিশ্বাস করছে। অনেক কান্নাকাটির পর এই নাটকের নিস্পত্তি ঘটেছিল।

সত্যিই অবিশ্বাস ক্রমে বেড়েই চলল। আশ্চর্য, কি বিচিত্র এই জগত। কত সহজে মানুষে মানুষে সম্পর্ক ভেঙে যায়। কিন্তু এমন তো কোন ব্যবহার সে ভেসপারের সঙ্গে করেনি যার পরিবর্তে ভেসপার তাকে দিনের পর দিন এত শাস্তি দিয়ে চলেছে।

যে কোন কারণে ভেসপার প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। ভেসপারও হয়ত বন্ডের মতই কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু সে দিনের টেলিফোনের রহস্যটা কিছুতেই মীমাংসা করা যাচ্ছে না। এই টেলিফোনের রহস্যই তাদের মধ্যে এক বিচিত্র দেওয়াল তুলে দিয়েছে।

কিন্তু লাঞ্চের সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। খেতে খেতে বন্ডের কথায় সে মাথা নাড়ছে শুধু। খাবার নিয়ে সে নাড়াচাড়া করতৈ লাগল। বন্ডের চোখের দিকে একবারও তাকাল না। অত্যন্ত অন্যমনস্ক লাগছিল ভেসপারকে। ভেসপার হঠাৎ চমকে উঠল। তার হাত থেকে কাটাটা পড়ে গেল। মুহূর্তে তার মুখের রঙ বদলে গেল। সেও তখন বন্ডের পিছনে তাকিয়ে আছে।

বন্ড ফিরল। তার চোখে পড়ল একটি লোক তাদের ঠিক উল্টোদিকের টেবিলে বসে আছে। অনেকটা দূরে। লোকটার চেহারার মধ্যে কোন বিশেষত্ব নেই। মনে হয় ব্যবসা করতে, এসে হয়ত পথে এখানে হঠাৎ থেমেছে।

ভেসপার বলল, সেই গাড়ির লোকটা। যে আমাদের পিছু ধাওয়া করেছিল। তার গলা দিয়ে প্রায় আওয়াজ বেরোতে চায় না।

বন্ড দেখল লোকটা প্রোপাইটারের সঙ্গে মেনু নিয়ে কথাবার্তা বলছে। তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না। বন্ড দেখল তার এক চোখের ওপর কালো তাপ্পি মারা, মনোক্ল এর মত স্কু দিয়ে আটকানো। চেহারায় আর কোন বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল না।

বন্ড ভেসপারকে বোঝাতে লাগল, এটা হোটেল। এখানে নানা ধরনের লোক আসতে পারে। কজনের গতিবিধির ওপর তুমি নজর দেবে। মনে হল না কথাগুলো ভেসপারের কানে গেছে। রক্তশূন্য মুখে দুহাতে টেবিলের ধারটা চেপে বসে আছে।

আগন্তুক বুঝতে পেরেছে যে কেউ তাকে লক্ষ্য করছে। নির্বিকারভাবে সে তার খাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে বিদায় নিল গাড়ির শব্দ শুনল বন্ড-ক্রমে রয়্যালের দিকে চলে গেল শব্দটা।

বন্ড প্রোপাইটারের কাছে আগন্তুকের ব্যাপারে জানতে চাইলে সে লোকটির ব্যাপারে কোন রেখাপাত করতে পারল না। বন্ডের মত লোকটি তার কাছেও সম্পূর্ণ অচেনা।

.

শুভরাত্রি

পরের দুটো দিন ঐ একইভাবে কাটল। চতুর্থ দিন ভোরবেলা ভেসপার রয়্যালে চলে গেল, আবার ফিরে এল। ওকে নিতে একটা ট্যাক্সি এসেছিল।

সে দিন রাতে ভেসপার চেষ্টা করল ফুর্তির ভাব মুখে ফোঁটাতে। প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করল সে। খাবার পর বন্ডকে নিজের ঘরে নিয়ে এল–প্রেমনিবেদনের উদ্দেশ্যে। দৈহিকভাবে সাড়া পেলেও ভেসপারের আকুল কান্নার কোন অর্থই খুঁজে পেল না সে।

রবিবার দিন সেই কালো তাঞ্জি পরা লোকটার আগমণ ঘটল। লোকটার সম্বন্ধে বন্ড ভেসপারকে বলেছিল কিন্তু সে ফিরে আসছে এই ব্যাপারটা শুধু লুকিয়েছিল। অনর্থক দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে ভেসপারকে সে অসুস্থ করতে চায়নি।

প্যারিসে ম্যাথিসকে ফোন করে সে ঐ কালো গাড়িটা সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিয়েছে। দু-সপ্তাহ আগে এই গাড়িটা ভাড়া নেওয়া হয় এক নামী কোম্পানি থেকে। লোকটা সুইস। নাম অ্যাডলফ গেটলার।

সুইস পুলিশের কাছে সন্ধান নিয়ে জানা যায়, ঐ নামে ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট আছে। তবে সেটা বড় একটা ব্যবহার হয় না। তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা যেত কিন্তু সে রকম কিছু ছিল না। বলেই আর কিছু জানা যায়নি। এবার লোকটাকে দেখা মাত্র সে সোজা খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ে। বন্ড খাওয়া শেষ। হতেই ভেসপারের ঘরে এসে উপস্থিত হয়। বন্ড তাকে জোর করে খাটে বসাল। কাঠের পুতুলের মত ঠাণ্ডা মুখে বসে। রইল সে। বন্ড ওর পাশেই বসল। ভেসপারের ঠাণ্ডা হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিল। দেখ ভেসপার, এইভাবে কতদিন চলতে পারে? তুমি নিজেও কষ্ট পাচ্ছ, আমাকেও কষ্ট দিচ্ছ। তার চেয়ে আমাদের ছাড়া ছাড়ি হওয়াই ভাল। তবে তুমি যদি চাও এখনও সময় থাকতে থাকতে আমাকে সমস্ত কথা খুলে বল। যেন প্রথমদিন সকালে আমি তোমার কাছে এসেছিলাম বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। যা হয়েছে সব অতীত মনে করে ভুলে যাও। ভেসপারের চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। বন্ডের বুকে মাথা রেখে সে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। শান্ত গলায় সে বলল, আমি একটু ভাববার জন্য সময় চাই। আমি একটু ভেবে দেখি আমাদের পক্ষে কোন্‌টা ভাল। তবে তুমি বিশ্বাস কর আমি এমন বিপদে, বলতে বলতেই সে ভয়ার্ত শিশুর মত বন্ডকে আঁকড়ে ধরে রইল। খুব উত্তেজিত গলায় সে বলে উঠল কাল সকালের মধ্যে বন্ডকে সে সব কথা খুলে বলবে। এমনভাবে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল, মনে হল এই প্রথম তাকে দেখছে সে। তার নীল চোখে টলটল করছে পানি। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বন্ড নিজের ঘরে ফিরে এল।

.

রক্তাক্ত হৃদয়

একটা চিঠি হাতে সকালবেলায় প্রোপাইটার বন্ডের ঘরে এসে দাঁড়াল। তার হাবভাব দেখে এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে ওঠে। সে ম্যাডাম বলে থেমে যায়। সে বাথরুমের দরজার কাছে এসে দেখে দরজা বন্ধ। নিজের ঘরে ফিরে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে বারান্দায়।

খোলা দরজা। সারা ঘরে রোদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। চাদরের উপরে কেবল তার কালো চুল, চাদরের নিচে শয়ান দেহ। বন্ড চাদরটা সরিয়ে দিল। অনেকদিন পরে ভেসপার আজ ঘুমুছে। যেমন দেখতে তেমনি আছে, শুধু নিঃস্পন্দ দেহ আর নাড়ি স্তব্ধ।

প্রোপাইটার এসে বন্ডের কাঁধে হাত রাখুল। নিজেকে এক ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ড উঠে দাঁড়াল। তার হাত থেকে চিঠিটা নিল। বন্ড ঘরের দিকে এগিয়ে চলল, খামটা উল্টেপাল্টে দেখল সে, কয়েক ঘণ্টা আগেই জিভ দিয়ে ভিজিয়ে এই খাম বন্ধ করা হয়েছে।

চিঠিটা পড়তে শুরু করল—

বন্ড আমি তোমায় সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছি। তুমি যখন চিঠিটা পড়বে তখনও তোমার মনে আমার স্থান আছে কিন্তু পড়ার শেষে তার কোন চিহ্নই থাকবে না। আমাদের ভালবাসা থাকাকালীন তোমার থেকে আমি বিদায় নিচ্ছি।

আমি এম ডাবলিউ ডির এজেন্ট। ডবল এজেন্ট, রাশিয়ানদের হয়ে আমি কাজ করছি। যুদ্ধের এক বছর পর থেকে আমি ওদের সঙ্গে যুক্ত। আর এ এফ এর একজন পোল্যান্ড বাসীর সঙ্গে আমার মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার দুটো ডি.এম. ও ছিল। যুদ্ধের পর M তাকে ট্রেনিং দিয়ে আবার পোল্যান্ডে ফেরত পাঠান। ওরা ধরে ফেলে। যন্ত্রণা দিয়ে ওরা ওর সম্বন্ধে এবং আমার সম্বন্ধে নানারকম খবর সংগ্রহ করে। তারা শর্ত রাখল, আমি তাদের হয়ে কাজ করলে ওরা আমার প্রেমিককে নবজীবন দান করবে। সে এসবের কিছুই জানত না। শুধু চিঠি লেখার অনুমতি মিলেছিল। চিঠি আসত প্রত্যেক মাসের পনের তারিখে। আমার ফেরার সব পথ বন্ধ। পনের তারিখের মধ্যে যদি চিঠি না পৌঁছত তবে বুঝে নিতে হবে তার জন্য তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তাই আমিও কাজ ছাড়তে পারলাম না। তবে আমি ওদের কম খবর দিতাম। তুমি এলে। আমি ওদের বলতাম, রয়্যালে তোমার কি ভূমিকা। তবে তুমি আসার আগেই ওরা তোমার সম্বন্ধে সব জানতে পারে। শিফের জন্যই তোমার আগমন কিন্তু কাজটা কি তা বলিনি।

আমাকে বলা হয় ক্যাসিনোতে তোমার পেছনে না থাকার কথা। সে জন্যই লোকটা তোমাকে প্রায় খুন করে ফেলছিল। কারণ ম্যাথিস ও লিটারকে ব্যস্ত রাখাই ছিল আমার কর্তব্য। চুরি করি নিয়ে যাওয়ার ঘটনা সম্পূর্ণ সাজান।

আমি দেখলাম ওরা তোমার ওপর অকথ্য অত্যাচার করছে। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। ততদিনে আমি তোমাকে মন দিয়ে ফেলেছি। ওরা চেয়েছিল তোমার মুখ থেকে আরো তথ্য জানতে। আমি সরাসরি অস্বীকার করলাম। আমার হুকুমগুলো আসত প্যারিস থেকে। ওরা প্রথমে আমাকে ভয় দেখাল। পরে ছেড়ে দিল। তখন জানলাম পোল্যান্ডে আমার প্রেমিককে প্রাণ দিতে হল। ওদের কথায় কান দিলাম না। ওরা শেষবারের মত বলল ওদের কথামত না চললে ওর পেছনে স্মার্শকে সব সময় দেখতে পাব।

কালো তাপ্লিমারা লোকটা আমার চোখে পড়ে। ভাবলাম ওদের চোখে ধুলো দিয়ে ল্যহাত থেকে সাউথ আমেরিকা পালিয়ে যাব। ততদিনে আমার একটা সুন্দর বাচ্চা হবে। নতুন জীবন শুরু হবে আমাদের। ওদের চোখকে ফাঁকি দেবে কার সাধ্য। এখানেও হাজির। কবে এসে ও আমার প্রাণ নেবে সেজন্য বসে থাকা–আর তোমাকেও তো একই পথে ঠেলে দেওয়া। তার থেকে আত্মহত্যা অনেক সহজ ব্যাপার। আমি চললাম তোমার অনুমতি ছাড়াই কিন্তু সঙ্গে নিলাম তোমার ও আমার গোপন প্রেমের অমর স্মৃতি।

তোমার আমি কোন কাজেই আসতে পারলাম না। কেবল একটা বলতে পারি তা হল প্যারিসের ফোন নাম্বার আঁভলিদ ৫৫২০০। ৪৫০ চেয়ারিং ক্রস প্লেসের এক নিউজ এজেন্টের অফিস থেকে সব কিছু হত। তাই ওদের কাউকে আমি চিনতাম না। যাকে আমি একদিন ভালবেসেছিলাম তার জন্যই আমাকে এ পথে আসতে হল।

অনেক রাত হল। মাত্র দুটো দরজার ব্যবধান। কিন্তু আমাকে মনের জোর আনতে হবে। তুমি হয়ত আমার প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করবে, কিন্তু তোমার চোখের ঐ দৃষ্টি আমি মানতে পারব না। চিঠিটা এখানেই শেষ।

চিঠি পড়তে পড়তে যে কখন তার চোখে পানি এসে গিয়েছিল তা সে নিজেই জানে না। সার্ট আর ট্রাউজার পরে নিচে নেমে এল। লন্ডনে ডায়েল করতে করতে ভেসপারের চিঠির তথ্যগুলো সে এক এক করে সাজিয়ে নিচ্ছিল। গত চার সপ্তাহ ধরে কত অসঙ্গতি চোখে পড়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করেও তা উড়িয়ে দিয়েছিল।

ভেসপার তার কাছে এখন এক গুপ্তচর। ভালবাসা আর বেদনা মনের গোপন কুঠরীতে বন্ধ। দেশের ও সিক্রেট সার্ভিসের সে কতটা ক্ষতি করেছে সেটাই এখন বিচার্য!

হঠাৎ ম্যাথিসের কথা মনে পড়ল। ইউরোপে হাজার হাজার স্মার্শ রাজত্ব করছে। যাকে যাকে মনে হচ্ছে ওদের পদ্ধতির শত্রু, তাকেই ওরা নিষ্ঠুর ভাবে পথ থেকে সরিয়ে ফেলছে। এটার কি কোন যুক্তি আছে? বন্ড যে সব কথা বড় মুখ নিয়ে বলেছিল সেগুলোর অসারতা আজ তার সামনে প্রকাশ পেয়ে গেল। লজ্জায়, আফশোষে তার মাথা হেঁট হয়ে এল। এখনও সময় আছে। তার আক্রমণের প্রথম লক্ষ্য স্মাশ, সে যদি না থাকে এম ডবলিউ ডি চোখে অন্ধকার দেখবে। গুপ্তচর বৃত্তি করা। যদি সম্ভব না হয় যেখানেই থাক তোমাকে ঠিক খুঁজে নেব। তখন আর রক্ষে নেই। ওদের শাসনযন্ত্রের মূলেই আছে ভয়। মানুষ দিয়ে ভয় দেখিয়ে কাজ আদায় করা। এরাই হল স্মার্শ। যে হাত সেই অস্ত্র চালাচ্ছে তাকে সরাসরি আক্রমণ করবে সে। বন্ড ধ্বংস করবে সেই শক্তিকে যা তাদের আজ গুপ্তচর হতে বাধ্য করেছে।

টেলিফোন বাজল। আমি জিরো জিরো সেভেন বলছি। অত্যন্ত জরুরী খবর। ৩০৩০ একজন ডাবল এজেন্ট ছিল। মেয়েটা আজ মারা গেছে।

বন্ড লাইনটা কেটে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *