১.০১. দু-হাজার মোহর পুরস্কার

আপরোর ইন ইণ্ডিয়া
কানপুরের দানব

১.০১. দু-হাজার মোহর পুরস্কার

জানা গিয়াছে যে সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা নবাব ধুন্ধুপ বর্তমানে বম্বাই রাজ্যের কোনো স্থানে লুক্কায়িত রহিয়াছেন। যে বা যাহারা তাঁহাকে জীবিত বা মৃত ধরিয়া দিতে পারিবে, তাহাকে বা তাহাদের দুই হাজার মোহর পুরস্কার দেওয়া হইবে… ১৮৬৭ সালের মার্চ মাসের ছয় তারিখে ঔরঙ্গাবাদের বাসিন্দারা এই বিজ্ঞপ্তিটি পড়লে। গোদাবরী নদীর তীরে নিরিবিলি একটা জীর্ণ বাংলো বাড়ির দেয়ালেও এই বিজ্ঞপ্তিটা টাঙানো ছিলো : হঠাৎ দেখা গেলো কোত্থেকে এক ফকির এসে বিজ্ঞপ্তিটির সামনে দাঁড়ালে; বড়ো-বড়ো হরফে ধুন্ধুপন্থের আগুনজ্বালা নাম ছাপা ছিলো, বম্বাইয়ের রাজ্যপালের নাম ছিলো ঘোষণাপত্রের তলায় : সেটাও ছিন্ন হলো মুহূর্তে।

কী চায় এই ফকির? সে কি ভেবেছে ওই রক্তরাঙা নামটা ছিঁড়ে ফেললেই ঈস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানি ওই অগ্নিগর্ভ মানুষটাকে ভুলে যাবে? একটা ছেড়া কাগজের মতো সময়ের ঘূর্ণিহাওয়া তাকে এতদূরে উড়িয়ে নিয়ে যাবে যে কোনোকালে কেউ আর তার সন্ধান পাবে না? না কি বিজ্ঞপ্তিটা নষ্ট করে ফেললেই ১৮৫৭ সালের এই অভ্যুত্থানের কথা মানুষ ভুলে যাবে?

এ-সব ভাবতে যাওয়াটাও পাগলামি ছাড়া আর-কিছু নয়। ক-টা সে ছিড়বে? দেয়ালে-দেয়ালে, গাছের গায়ে, স্তম্ভে-মিনারে—সর্বত্র রাশি-রাশি ঘোষণাপত্র ছড়িয়েছেন বম্বাইয়ের রাজ্যপাল। প্রাসাদ, মন্দির, সরাই—কিছুই বাদ যায়নি। তা ছাড়া উঁাড়া পিটিয়ে সারাক্ষণ চেঁচিয়েছে নকিব নগর-গ্রামের পথে-পথে, যাতে দীনতম দরিদ্রটিও পুরস্কারের এই অঙ্ক জেনে লোভে পড়ে ধুন্ধুপকে ধরিয়ে দেয়।

সত্যি যদি ধন্ধুপন্থ বম্বাইয়ের আশপাশে কোথাও আশ্রয় নিয়ে থাকেন, তাহলে এই বিপুল উদ্যোগে হয়তো তাকে ধরা পড়ে যেতেই হবে। তাহলে হাজার-হাজার ঘোষণাপত্রের মধ্যে মাত্র একটাকে ছিঁড়ে ফেলে ফকিরটি কোন পরমার্থ সাধন করলে? শুধু রোষ আর ঘৃণার তৃপ্তিসাধন, তা ছাড়া আর কী? বিরক্তিভরে ভুরু কুঁচকে ঠোঁট বাঁকিয়ে সে এবার ঢুকে পড়লো শহরে, তারপর ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো।

গঙ্গার তলদেশে সমগ্র ভারতবর্ষের দক্ষিণভাগের নাম দাক্ষিণাত্য বা দক্ষিণাপথ : বম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কতগুলি প্রদেশ নিয়ে দাক্ষিণাত্য গঠিত। আর সেই প্রদেশগুলির মধ্যে প্রধান-একটি হলো ঔরঙ্গাবাদ, একদা যা সমগ্র দক্ষিণাপথেরই রাজধানী ছিলো। সপ্তদশ শতকে মুঘল সম্রাট ঔরঙজীব যখন এখানে তার দরবার বসিয়েছিলেন তখন এখানে লোকসংখ্যা ছিলো এক লক্ষ! এখন হায়দরাবাদের নিজামের হয়ে ইংরেজরা এই প্রদেশ শাসন করে : লোকসংখ্যা এখন মাত্র হাজার পঞ্চাশ। এখানকার জল-হাওয়া আর স্বাস্থ্য ভালো, তা ছাড়া অতীত গরিমার প্রচুর জমকালো স্মৃতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এখানে। গোদাবরীর তীরে রয়েছে ঔরঙজীবের মস্ত প্রাসাদ, শাহজাহানের বেগম মমতাজের স্মৃতিসৌধ, আর বিখ্যাত চার মিনার-মুঘল স্থাপত্যকর্মের উজ্জ্বল নিদর্শন।

ঔরঙ্গাবাদের মিশ্র জনসাধারণের মধ্যে এই ফকির সহজেই আত্মগোপন করতে পারলে। ভারতে পীর-ফকির বা সাধু-সন্ন্যাসীর সংখ্যা অসংখ্য, সয়ীদ কি মুসাফির কি মুশকিল-আসান কত যে ঘুরে বেড়ায় তার সীমাসংখ্যা নেই; ভিক্ষে তারা চায় না, তারা দাবি করে; হিন্দু মুসলমান সকলেই সমভাবে তাদের শ্রদ্ধা করে। আমাদের এই ফকিরটি পাঁচ ফিট ন-ইঞ্চি লম্বা, বয়েস চল্লিশের বেশি নয়, সুন্দর কোনো মরাঠা হবে হয়তো–মুখ দেখে অন্তত তা-ই মনে হয় : সারা মুখে বসন্তের দাগ; স্বাস্থ্য উপচে পড়ছে সর্বাঙ্গে। ক্ষিপ্র ও নমনীয়; ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে তার বাঁ হাতে একটা আঙুল নেই। চুল লাল, মাথায় পাগড়ি, গায়ে নামেমাত্র ডোরাকাটা পশমের জামা, কোমরে বস্ত্রখণ্ড বাঁধা, পায়ে জুতো নেই। বুকে দুটি উল্কি-কাটা, হিন্দু পুরাণের রসের দেবতার স্মারক উল্কি দুটি : নৃসিংহাবতার, আর ভয়ংকর শংকরের ত্রিনয়ন জ্বলজ্বল করছে। বুকে।

সেদিন সন্ধেবেলায় মস্ত সাড়া পড়েছে ঔরঙ্গাবাদে, বিশেষ করে তার বস্তি এলাকায়। আবালবৃদ্ধবনিতা–ইয়োরোপীয় ও ভারতীয়, গোরা সেপাই, ভিখিরি, চাষী

সবাই হাত-পা নেড়ে পাঁচ মুখে কথা কইছে : কার ভাগ্যে শিকে ছিড়বে, কে পাবে এই বিশাল ইনাম, এই বিপুল পুরস্কার—এটা এখন তাদের চাঞ্চল্য ও উত্তেজনার হেতু।

এদের মধ্যে এই ফকিরই বোধহয় কেবল ওই বিপুল পুরস্কারের প্রত্যাশা ও লোভ করছিলো না। নিঃশব্দে হাঁটছে সে ঔরঙ্গাবাদের সরু ঘিঞ্জি রাস্তায়, মাঝে-মাঝে উৎকর্ণ হয়ে শুনছে লোকজনের কথাবার্তা, চোখের তারা দুটি কখনও জ্বলে উঠছে ধ্বক ধ্বক করে।

দু-হাজার মোহর ইনাম মিলবে ধুন্ধুপন্থকে দেখতে পেলে, বললে ভিড়ের মধ্যে উত্তেজিত একজনে।

দেখতে পেলে বোলো না, আরেকজন বললে, বলো যে ধরতে পারলে। দেখা আর ধরা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিশ।

তা ঠিক, রক্তপাত না-করে ধরা দেবার পাত্তর সে নয়।

কিন্তু এই-যে শুনলাম নেপালের জঙ্গলে সে মারা গেছে।

মিথ্যে জনরব মাত্র। ওর মতো ধূর্তলোক আর হয় না, মৃত্যুর খবর রটনা করে দিলে নিরাপদ হবে ভেবেই ওই গুজবটি ছড়িয়েছে।

বাঃ, শুনলুম যে অন্ত্যেষ্টি পর্যন্ত হয়েছে—

ওটাও একটা ধাপ্পা, লোকের চোখে ধূলো দেবার ফন্দি।

এ-কথা শুনেও ফকিরের মুখের একটি পেশীও কুঞ্চিত হলো না। কিন্তু লোকটা যখন আরো বিশদ করে সব বললে, তখন শুনতে-শুনতে তার ভুরু কুঁচকে গেলো, আর চোখ দুটো ধ্বক-ধ্বক করে জ্বলতে লাগলো।

১৮৫৯ সালে যে ধুন্ধুপন্থ তার ভাই বালাজি রাও আর গোণ্ডার রাজা দেবী বক্স সিংকে নিয়ে নেপালে একটা দুর্গম জায়গায় ছাউনি ফেলেছিলো, এ-খবর ঠিক। সেখানে সে যখন দেখলে যে চারপাশ থেকে ইংরেজ সেপাইরা তাদের ঘিরে ধরেছে, তখন তারা ভারত-চিন সীমান্তের দিকে চলে যেতে চেষ্টা করে। যাবার আগে রটিয়ে দিয়ে যায় যে তারা সবাই মারা গিয়েছে! রটনাটা লোকে যাতে সত্যি বলে মেনে নেয়, সেইজন্যে এমনকী একটা মিথ্যে অন্ত্যেষ্টির অবতারণাও তারা করেছিলো। আসলে কিন্তু বাঁ-হাতের একটা আঙুল কেটে কবর দেয়—

এত-সব তুমি জানলে কী করে?

আমি যে সেখানে ছিলাম। ধুন্ধুপস্থের অনুচরেরা আমাকে বন্দী করেছিলো। দুমাস পর আমি ওদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে আসি।

লোকটা যখন এতসব বলছিলো ফকির তখন একবারও তার উপর থেকে চোখ ফেরায়নি। বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠছিলো তার চোখ। বাঁ-হাতটা সে চট করে তার পোশাকের আড়ালে লুকিয়ে ফেললে। নাকের বাঁশি দুটো ফুলে উঠলো একটু, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দেখা গেলো ঝকঝকে দাঁতের সারি।

তাহলে ধুন্ধুপন্থকে তুমি চোখে দেখেছো? সে তোমার চেনা লোক? শ্রোতাদের মধ্যে থেকে একজন জিগেস করলে।

হ্যাঁ, দেখেছি–ধুন্ধুপন্থের প্রাক্তন বন্দী জবাব দিলে।

মুখোমুখি দেখতে পেলে তাকে তাহলে চিনতে পারবে তুমি?

নিশ্চয়ই পারবো–

তাহলে, প্রশ্নকর্তার কণ্ঠস্বরে ঈষৎ ঈর্ষা ফুটে উঠলো, দু-হাজার মোহর ইনামের সম্ভাবনা দেখছি তোমারই সবচেয়ে বেশি।

হয়তো তা-ই, লোকটি বললে, অবশ্য যদি ধুন্ধুপ শেষকালে এই বম্বাইতেই এসে হাজির হয়ে থাকে—তবে সে এখানে এসেছে বলে আমার মনে হয় না।

এখানে সে খামকা আসবে কেন? আর এত দুঃসাহসই তার হবে কেন?

হয়তো আবার আরেকটি বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে চায়—হয়তো সেপাইদের মধ্যেই আবার আগের মতোই বিক্ষোভ ছড়াবে সে; কিংবা হয়তো মধ্যভারতের জনসাধারণকে খেপিয়ে তুলবে আবার।

তা সরকারি ফতোয়া যখন বেরিয়েছে যে সে এখানে এসেই হাজির হয়েছে, তখন তা-ই বোধকরি সত্যি।

তা-ই যেন হয়; ধুন্ধুপন্থ আমার মুখোমুখি এসে পড়ুক, ভগবান ব্রহ্মা যেন তা-ই করেন, প্রাক্তন বন্দীটি দাঁতে দাঁত চেপে বললে।

ফকির কয়েক পা পেছিয়ে গেলো, কিন্তু তাই বলে ধুন্ধুপন্থের প্রাক্তন বন্দীকে সে কখনও চোখের আড়াল করলে না। তখন কালো রাত নেমে এসেছে ঔরঙ্গাবাদে, তাই বলে পথের ভিড় কিন্তু একটুও কমেনি। ধুন্ধুপন্থ সম্বন্ধে অজস্র জনরব শোনা যেতে লাগলো। পরস্পরবিরোধী কয়েকটা খবর কেমন করে যেন উড়াল দিয়ে আসতে থাকে। ধুন্ধুপন্থকে নাকি শহরের মধ্যেই কোথায় দেখা গেছে। তিনি নাকি এখনও এদিকে এসে পোঁছোননি। আর্যাবর্ত থেকে নাকি বার্তা এসেছে যে তিনি মধ্যপথেই গ্রেফতার হয়ে গেছেন। রাত নটায় জানা গেলো তিনি শহরেরই জেলখানাতে কতগুলো ঠগির সঙ্গে কয়েদ হয়ে আছেন, পরদিন সকালে সূর্যোদয়ের আগেই নাকি তাকে তান্তিয়া টোপির মতো বিনাবিচারে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। দশটার সময় খবর এলো তিনি নাকি আবার পালিয়েছেন জেলখানা থেকে। লোকের মনে আবার ইনামের আশা জেগে উঠলো।

আসলে কিন্তু সবই গুজব : সত্যের লেশমাত্র নেই। ধুন্ধুপন্থের সন্ধান এখনও কেউ পায়নি। এখনও ওই ইনাম পেতে হলে বুকের রক্ত জল করে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

যে-লোকটা বলেছিলো ধুন্ধুপন্থকে সে স্বচক্ষে দেখেছে, তারই পুরস্কারটা পাবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। অন্তত বম্বাই প্রেসিডেন্সিতে তেমন লোকের সংখ্যা খুবই কম, যারা স্বচক্ষে এই বিপুল অভ্যুত্থানের জননায়ককে দেখেছে। বরং সিন্ধিয়া, বুন্দেলখণ্ড, অযোধ্যা, আগ্রা, দিল্লি, কানপুর, লক্ষ্ণৌ এ-সব জায়গার কোনোটা হলে একটা কথা ছিলো। দশ বছর পরে, এখনও ধুন্ধুপন্থের অগ্নিগর্ভ নাম শুনলে সেখানকার লোক চমকে ওঠে। যদি নতুন করে বিক্ষোভের আগুন জ্বালবার জন্যেই তিনি চিনদেশে আশ্রয় নেবার প্রলোভন ত্যাগ করে ভারতে ফিরে আসেন, তাহলে দাক্ষিণাত্যই তার গুপ্তসংগ্রামের নিরাপদ ঘাঁটি হতে পারে-কারণ এখানে অনেকটা স্বাধীনভাবে সকলের অলক্ষে তিনি চলাফেরা করতে পারবেন। বম্বাই প্রেসিডেন্সির রাজ্যপাল কী করে যেন এই মৎলব টের পেয়ে তক্ষুনি তার মাথার একটা দাম ধরে দিয়েছেন।

কিন্তু ধুন্ধুপন্থ সম্বন্ধে কতবারই যে কত জনরব উখিত হলো! কতবার তার গ্রেপ্তারের সংবাদ পাওয়া গেলো। কতবার যে তিনি ইংরেজ গোয়েন্দা-বিভাগের চোখে ধুলো দিলেন! শেষকালে জনসাধারণের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্মালে তিনি সত্যিই প্রলয়ের দেবতা রুদ্র-শংকরের প্রসাদ পেয়েছেন।

কিন্তু তবু ঔরঙ্গাবাদ কেমন করে যেন বিশ্বাস করে ফেললো যে তিনি আশপাশেই কোথাও আছেন। আর যারা এই সরকারি ফতোয়ায় বিশ্বাস করলে, তাদের ভিতর একজন হলো সেই হতভাগ্য বন্দী, ছ-মাস যাকে ধুন্ধুপন্থের নির্যাতন শিবিরে কয়েদ করে রাখা হয়েছিলো।

বেচারা এই পুরস্কারের ঘোষণা শুনে তক্ষুনি মনে-মনে ঠিক করে ফেললো যে তাঁকে ধরতে সে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। পুরস্কারটাই একমাত্র কারণ ছিলো না তার কাছে–প্রতিশোধস্পৃহায় তার বুকের ভিতরটা যেন জ্বলে যাচ্ছিলো। পরদিন সকালেই কোতোয়ালিতে গিয়ে সে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে ধুন্ধুপস্থের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়বে–মনে-মনে এ-কথা ঠিক করে সে রাত এগারোটার সময় গোদাবরীর তীরে তার ডেরার দিকে চললো। তার ডেরা আপাতত হলো একটা ডিঙি নৌকো-গোদাবরীর তীরে সেটা নোঙর-ফেলা। আধবোজা তার চোখ, ভুরু কুঁচকেননা, শহর ছাড়িয়ে সে চলে এলো নদীর দিকে। একমনে ভাবছিলো বলেই সে কখনোই লক্ষ করলে না যে আলখাল্লা ঢাকা এক ফকির তাকে ডালকুত্তোর মতো নিঃশব্দে ও সন্তর্পণে অনুসরণ করে আসছে। ছায়ার মতো ধাবমান সেই ফকির, একবারও তাকে চোখের আড়াল করছে না।

দূরে লোকজনের সাড়া মিলিয়ে গেলো। শহরতলির নিরিবিলি রাস্তায় এসে পড়লো চিন্তামগ্ন মানুষটি। ফকিরও তার পিছন ছাড়লো না : ভাঙা দেয়ালের আড়াল দিয়ে, গাছপালার ছায়ায় লুকিয়ে, ফকির তাকে অনুসরণ করে এলো। রাস্তা নিরিবিলি হলেও এত সাবধান হওয়া ফকিরের পক্ষে জরুরি ছিলো। কারণ একটু পরেই চঁাদ উঠলো, আর হালকা জ্যোৎস্নায় যখন আঁধার ছিড়ে-ছিড়ে গেলো ফকিরকে হয়তো তখন দেখে ফেলতে পারতো লোকটা। এমনিতে খালি পায়ে হাঁটছিলো বলে তার পায়ের আওয়াজ অবশ্য শোনা যাচ্ছিলো না।

লোকটা কলের মতো নদীর পাড় ধরে তার নৌকোর দিকে এগুলো; এমন-সময় হঠাৎ খ্যাপা বাঘের মতো পিছন থেকে কে যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর। কেবল বিদ্যুতের একটা ঝলসানি দেখতে পেলে সে, একটা মালয়ী ছোরার উপর চাঁদের আলো ঝকঝক করে উঠলো! হৃৎপিণ্ডে বিদ্ধ হলো ছোরাটা, ধপ করে পড়ে গেলো সে : নির্ভুল লক্ষ্য ফকিরের! অস্ফুট স্বরে কী যেন বলবার চেষ্টা করে লোকটা, কিন্তু কষ বেয়ে কেবল এক ঝলক তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়লো। ফকির দু-হাতে সজোরে তুলে ধরলে মুমূর্মুর মুখ, আর নিজের মুখটা ফিরিয়ে নিলে জ্যোৎস্নায়।চেনো তুমি আমাকে, চিনতে পারো? ক্ষিপ্ত ও ক্ষুধিত বাঘের মতো ফকির গর্জে উঠলো।

সে! পুরো নামটা বলার ক্ষমতা তার ছিলো না—মাথাটা তার একপাশে হেলে পড়ে গেলো।

পরক্ষণেই গোদাবরীর জলে হারিয়ে গেলো মৃতদেহটা। কেমন করে মৃতদেহটা ড়ুবে যায়, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো ফকির, তারপর দ্রুত পায়ে ফিরে এলো শহরের নিশুতি রাস্তায়।

নগরতোরণের সামনে এসে দ্যাখে সমরবাহিনীর লোক কড়া পাহারা বসিয়েছে। শহর থেকে বেরুনো নিষেধ, শহরে ঢোকাও তাই। ফকির মনে-মনে কেবল বললে, ঔরঙ্গাবাদ থেকে আজ রাত্রেই আমাকে চলে যেতে হবে—যে করেই হোক।

ফিরে এলো সে। নগর-প্রাচীর ধরে এগিয়ে গেলো কিছুটা। তারপর উৎরাই

 

বেয়ে উঠলো প্রাচীরের কাছে। কিন্তু দেয়ালের গা একেবারে মসৃণ-না-আছে কোনো খাঁজ-কাটা, না-বা কোনো চোখা বা ঠেলে-বার-হওয়া পাথরের পিণ্ড; কোনো দড়ি বেয়ে হয়তো ওঠা যায়, কিন্তু তার কোমরবন্ধের কাপড়টি মাত্র কয়েক ফুট-পঞ্চাশ ফুট ওঠার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ফকির আশপাশে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কী করা যায়।

দেয়ালের আশপাশেই ক্ষীণ চন্দ্রালোকে ঝুরি-নামা মস্ত-সব গাছপালা ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে! ঘন পাতায় ঢাকা ডালপালাগুলো হাজার বাহু ছড়িয়ে দিয়েছে অন্ধকারে। লাফিয়ে একটা ডাল ধরে ঝুলে পড়তে পারলেই গাছ বেয়ে উঠে-যাওয়া অত্যন্ত সহজ হয়ে উঠবে।

ফকির আর এক মুহূর্তও ইতস্তত না-করে লাফিয়ে একটা ডাল ধরে ঝুলতেবুলতে গাছে উঠে পড়লো, তারপর একটা ডাল টেনে নামিয়ে ঠিক দেয়ালের উপর রাখলো—অতঃপর তার ভারে বেঁকে-যাওয়া ডালটা ধরে দড়ির সাঁকোর মতো ঝুলতেঝুলতে সে দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেলো। শূন্যে ঝুলছে সে ডাল ধরে, প্রায় তিরিশ ফুট নিচে মাটি, পা দুটি যেন কোনো ভর খুঁজছে-দেয়ালের শক্ত মসৃণ গা আর কত দূরে!

এমন সময় গুড়ুম করে বন্দুকের আওয়াজ হলো একটা-আলোর একটা ঝলসানি চলে গেলো তার গা ঘেঁসে! তারপর আবো-কতগুলি বন্দুক গর্জে উঠলো একসঙ্গে। নিশ্চয়ই পল্টনের লোকেরা তাকে দেখতে পেয়েছে!

তার গায়ে কোনো গুলি লাগলো না, কিন্তু যে-ডালটা ধরে সে ঝুলে পড়েছিলো গুলির ঘায়ে সেটা ভেঙে পড়লো। ফকির টাল সামলাতে না-পেরে ডিগবাজি খেলো শুন্যে। অন্যকোনো মানুষ হলে এত উঁচু থেকে পড়ে কিছুতেই বাঁচতো না; কিন্তু ফকির মাটিতে পড়েই লাফিয়ে উঠলো, যেন ছিটকে গেলো সে তীরের মতো; ওই গুলিবৃষ্টির মধ্যে অক্ষত দেহে সে মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে। ঔরঙ্গাবাদের বাইরে দুমাইল দূরে গোরা সেপাইরা ছাউনি ফেলেছিলো; সেই ছাউনি পেরিয়ে এলো সে অন্ধকারে গা ঢেকে, সন্তর্পণে। তারপর আরো-কিছুদূর এগিয়ে সে হঠাৎ ফিরে দাঁড়ালে, তার আঙুল-কাটা বাঁ-হাত বাড়িয়ে ধরলে সে শহরের দিকে, চাপা ক্রোধে গর্জন করে উঠলো : এবার যারা ধুন্ধুপস্থের কবলে পড়বে, তাদের এবার কোন শয়তান এসে বাঁচায় দেখবো! ইংরেজরা যেন জেনে রেখে দেয়, নানাসাহেবের শেষ তারা এখনও দ্যাখেনি!

নানাসাহেব! আগুনঝরা নামটা যেন রাতের অন্ধকারে সম্মিলিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে একটা প্রকাণ্ড চ্যালেঞ্জের মতো ফেটে পড়লো! কেউ যেন হাতের দস্তানাটা খুলে গোটা ইংরেজ বাহিনীকে উদ্দেশ করেই তাচ্ছিল্যভরে ছুঁড়ে দিয়েছে।

চলন্ত বাড়ির রহস্য
মঁসিয় মোক্লের-এর দিনপঞ্জি থেকে