০২. পিটার ফোন ধরছে না কেন

১১ অধ্যায়

পিটার ফোন ধরছে না কেন? ক্যাথরিন সলোমন সেলফোন বন্ধ করার ফাঁকে নিজের মনে ভাবে। কোথায় যেতে পারে?

গত তিনবছর ধরে, তাদের রবিবার সন্ধ্যা সাতটার সাপ্তাহিক মিটিংএ পিটার সলোমন সবসময়ে আগে এসেছে। এটা তাদের পারিবারিক একটা কৃত্যানুষ্ঠান, নতুন সপ্তাহ শুরু হবার আগে পরস্পরের নৈকট্য লাভের একটা প্রয়াস এবং পিটারও ক্যাথেরিনের ল্যাবের কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকে।

তার কখনও দেরী হয়নি, সে মনে মনে ভাবে, আর ফোনও সে সবসময়ে ধরে। তারচেয়েও চিন্তার বিষয়, পিটার যখন সত্যি সত্যি আসবে তখন ক্যাথরিন তাকে কি বলবে। আমি আজ যা জানতে পেরেছি, কিভাবেই বা সেটা আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো?

সিমেন্টের মেঝেতে তার পদক্ষেপ একটা ছন্দোবদ্ধ শব্দের জন্ম দেয় যা এসএমএসসির ভিতর দিয়ে কাটার মত ছড়িয়ে যায়। দি স্ট্রীট নামে পরিচিত এই করিডোরটা ভবনের পাঁচটা প্রকাণ্ড সংরক্ষণশালাকে সংযুক্ত করেছে। মাথার চল্লিশ ফিট উপরে কমলা রঙের একটা বায়ু নিষ্কাষণ ব্যবস্থা ভবনটার শ্বাসপ্রশ্বাসে দপদপ করছে- হাজার কিউবিক ফিটের পরিশুদ্ধ বাতাস সঞ্চালনের ছন্দোবদ্ধ শব্দ।

সাধারণত, সিকি মাইল দূরে নিজের ল্যাবের উদ্দেশ্যে হাঁটার সময়ে, ক্যাথরিন ভবনটার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দে সুস্থির বোধ করে। আজরাতে, অবশ্য, সেই একই ছন্দোবদ্ধ শব্দ তাকে অস্থির করে তোলে। আজ নিজের ভাই সম্পর্কে সে যা জানতে পেরেছে তা যে কাউকে ব্ৰিত করে তুলবে, আর পিটার যেহেতু পৃথিবীতে তার একমাত্র পারিবারিক সদস্য, ভাই তার কাছ থেকে কিছু গোপন করে থাকতে পারে সেই সম্ভাবনার উদ্রেক ক্যাথরিনকে আরও অস্থির করে তুলেছে।

যতদূর সে জানতো, আজ পর্যন্ত পিটার কেবল একবার তার কাছ থেকে কিছু লুকিয়েছিল…একটা চমৎকার রহস্য যা এই নির্দিষ্ট হলওয়ের শেষে লুকান রয়েছে। তিন বছর আগে, এই করিডোর দিয়ে ভাই তাকে নিয়ে গিয়ে, ভবনের অদ্ভুত কিছু বস্তু দেখিয়ে এসএমএসসির সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। মঙ্গলের উল্কাপিণ্ড এএলএইচ-৮৪০০১, সিটিং বুলের নিজের হাতে লেখা পিকটোগ্রাফিক ডায়েরী, চার্লস ডারউইনের নিজ হাতে সংগৃহীত নমুনা বল জারে মোম দিয়ে সিল করা।

এই সময়ে তারা ছোট জানালা সংযুক্ত ভারী একটা দরজা অতিক্রম করে। ক্যাথরিন এক ঝলকের জন্য ভিতরে কি আছে সেটা দেখতে পায় এবং তোক গিলে। ঈশ্বরের দিব্যি ভিতরে ওটা কি?

তার ভাই কথা না বলে মুচকি হেসে হাটা অব্যাহত রাখে। তিন নম্বর পড। আমরা একে সিক্ত পড় বলি। খুব অস্বাভাবিক একটা দৃশ্য, তাই না?

আমি তোমাকে আসলে যেটা দেখাতে চাই সেটা পাঁচ নম্বর পড়ে রয়েছে, শেষ না হওয়া একটা করিডোর দিয়ে তাকে নিয়ে যেতে যেতে তার ভাই তাকে বলে। এটা আমাদের নতুন সংযোজন। ন্যাচারাল হিস্ট্রির ন্যাশনাল মিউজিয়ামের বেসমেন্টে সংরক্ষিত আর্টিফ্যাক্ট রাখার জন্য এটা নির্মিত হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে পুরো সংগ্রহটাকে এখানে স্থানান্তর করার কথা রয়েছে, যার মানে ঠিক এই মুহূর্তে পাঁচ নম্বর পড খালি পড়ে আছে।

ক্যাথরিন আড়চোখে তাকায়। খালি। আমরা তাহলে এটা কেন দেখতে এসেছি?

তার ভাইয়ের ধুসর চোখে পরিচিত দুষ্টুমির ছায়া খেলে যায়। আমার কাছে মনে হয়েছে জায়গাটা যখন কেউ ব্যবহার করছে না, তখন তুমি সেটা কাজে লাগাতে পার।

আমি?

অবশ্যই। আমি ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় একটা গবেষণাগারের ডেডিকেটেড স্থান ব্যবহার করতে পার একটা স্থাপণা যেখানে এতদিন ধরে তুমি যে তাত্ত্বিক গবেষণার জন্ম দিয়েছে সেটা হাতেকলমে পরীক্ষা করে দেখতে পারবে।

বিস্মিত চোখে ক্যাথরিন তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু পিটার ঐসব পরীক্ষাই তাত্ত্বিক! তাদের হাতেকলমে পরীক্ষা করাটা বস্তুত পক্ষে অসম্ভব একটা ব্যাপার।

ক্যাথরিন, অসম্ভব বলে কিছু নেই, আর এই ভবনটা তোমার জন্য একেবারে যথার্থ। এসএমএসসি কেবল গুপ্তধনের সংগ্রহশালা না; বিশ্বের সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার এখানে অবস্থিত। আমাদের সংগ্রহ থেকে আমরা নিয়মিত নমুনা নিয়ে সেটা টাকা দিয়ে কেনা যায় এমন শ্রেষ্ঠ পরিমাণগত প্রযুক্তি দ্বারা পরীক্ষা করে দেখি। তোমার যা যা সরঞ্জাম প্রয়োজন হবে তার সবই তুমি সম্ভবত এখানে দেখতে পাবে।

পিটার, এইসব পরীক্ষা করতে যেসব প্রযুক্তির প্রয়োজন—

সবই তৈরী আছে। দেতো হাসি হেসে সে বলে। গবেষণাগার প্রস্তুত।

ক্যাথরিন থমকে দাঁড়িয়ে যায়।

তার ভাই লম্বা করিডোরের শেষপ্রান্ত ইঙ্গিত করে। আমরা এখন সেটাই দেখতে যাচ্ছি।

ক্যাথরিন তোতলাতে শুরু করে। তুমি. ..ভাইয়া তুমি আমার জন্য একটা গবেষণাগার তৈরী করেছো?

সেটাই আমার কাজ। স্মিথসোনিয়ানের জন্মই হয়েছে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে। সেক্রেটারী হিসাবে, সেই দায়িত্বটা আমাকে গুরুত্বের সাথে পালন করতে হয়। আমি বিশ্বাস করি, তোমার প্রস্তাবিত গবেষণাগুলো বিজ্ঞানের সীমানাকে অজানা সীমান্তে পৌঁছে দেবে। পিটার দাঁড়িয়ে পড়ে সরাসরি এবার বোনের চোখের দিকে তাকায়। তুমি যদি আমার বোন নাও হতে, আমি তবুও তোমার এই গবেষণা কাজে খুশী মনে সাহায্য করতাম। তোমার ধারণাগুলো অসাধারন। সেগুলো আমাদের কোথায় পৌঁছে দেয় সেটা জানার অধিকার পৃথিবীর আছে।

পিটার, আমি সম্ভবত-

ঠিক আছে, শান্ত হও…এটা আমার নিজের টাকা…আর এই মুর্তে পাঁচ নম্বর পড় কেউ ব্যবহার করছে না। তোমার গবেষণা কাজ শেষ হলে তুমি এটা ছেড়ে দেবে। আর তাছাড়া পাঁচ নম্বর পড়ের কিছু ইউনিক গুণাবলী রয়েছে যা তোমার কাজের সাথে যথাযথভাবে মানানসই।

ক্যাথরিনের কোন ধারণা ছিল না একটা বিশাল, খালি পড় কিভাবে তার গবেষণার কাজে সহায়তা করতে পারে, কিন্তু সে অনুভব করে যে সেটা শীঘ্রই দেখতে পাবে। বড় করে কিছু খোদাই করা রয়েছে এমন একটা ইস্পাতের দরজার সামনে এসে তারা দাঁড়ায়:

পড পাঁচ

তার ভাই স্লটে কার্ড কি প্রবেশ করালে একটা কী-বোর্ড জীবন্ত হয়ে উঠে। সে হাত তুলে অ্যাকসেস কোড লিখার জন্য কিন্তু থেমে যায়, ছেলেবেলায় দুষ্টুমি করার সময়ে যেমন করতো অবিকল সেভাবে চোখের ভ্রু কুচকে তাকায়। তুমি নিশ্চিত তুমি তৈরী?

সে অধৈৰ্য্য ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। আমার ভাই, সবসময়ে নাটুকেপনা।

পিছিয়ে দাঁড়াও। পিটার কি চাপে।

ইস্পাতের দরজা বিকট হিসহিস শব্দে খুলে যায়।

চৌকাঠের পেছনে কেবল গাঢ় অন্ধকার…মুখব্যাদান করা শূন্যতা। একটা ফাপা আর্তনাদ যেন ভেতরের গভীরতা থেকে প্রতিধ্বনি তুলে ছুটে আসে। ভেতর থেকে বের হয়ে আসা শীতল বাতাসের ঝাঁপটা ক্যাথরিন নিজের মুখে অনুভব করে। রাতের বেলা গ্রাণ্ড ক্যানিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকার মত একটা অনুভূতি।

একটা শূন্য বিমান ঘাটি এয়ারবাসের একটা ফ্লীটের জন্য প্রতিক্ষা করছে এমনটা মনে মনে ভাব, তার ভাই বলে, তাহলেই প্রাথমিক একটা ধারণা পেয়ে যাবে।

ক্যাথরিন টের পায় সে এক পা পেছনে সরে আসছে।

পডটার অতিকায় আয়তন কৃত্রিমভাবে উষ্ণ রাখার জন্য অনুকূল না, কিন্তু তোমার গবেষণাগারটা থারমালি ইনসুলেটেড সিণ্ডার-ব্লক কামরা, মোটামুটি একটা ঘনকের ন্যায়, সর্বোচ্চ পৃথকীকরণের জন্য একেবারে পডের শেষপ্রান্তে অবস্থিত।

ক্যাথরিন পুরো ব্যাপারটা মনে মনে ভাবার চেষ্টা করে। বাক্সের ভিতরে আরেকটা বাক্স। সে অন্ধকারের ভিতরে দেখার জন্য চোখ কুচকে তাকায় কিন্তু তাদের কেবল অন্ধকারই আরও গাঢ় হয়। কত ভিতরে অবস্থিত?

বেশ অনেকটা…একটা ফুটবল খেলার মাঠ অনায়াসে এখানে এটে যাবে। আমার উচিত ছিল তোমাকে আগেই সতর্ক করে দেয়া এই অন্ধকারে হাঁটা একটু অস্বস্তিকর। অসম্ভব অন্ধকার এই জায়গাটা।

ক্যাথরিন উৎস্যুক চোখে ইতিউতি তাকায়। লাইটের সুইচ নেই?

পড পাঁচে এখন বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়নি।

কিন্তু… গবেষণাগারে তাহলে কিভাবে কাজ করবো?

ভাই চোখ মটকে তাকায়। হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল।

ক্যাথরিনের চোয়াল ঝুলে যায়। তুমি ঠাট্টা করছে, তাই না?

একটা ছোট শহরের প্রয়োজন মেটাবার জন্য যথেষ্ট সবুজ শক্তি। তোমার গবেষণাগার ভবনের বাকি অংশ থেকে পূর্ণ রেডিও-তরঙ্গ পৃথকীকরণ উপভোগ করে। এতেও যদি সন্তুষ্ট না হও, সবগুলো পডের বহিরাবরণ ফটো-রেসিস্ট্যান্স মেমব্রেন দ্বারা সিল করা যাতে ভেতরে আর্টিফ্যাক্টের সূর্যের বিকিরন থেকে কোন ক্ষতি না হয়। স্বভাবতই, এই পডটায় নিশ্চিদ্র, শক্তি নিরপেক্ষ বাতাবরন বিদ্যমান।

ক্যাথরিন পাঁচ নম্বর পডের গুরুত্ব ধীরে ধীরে বুঝতে পারে। যেহেতু তার বেশিরভাগ কাজ এতদিন অজানা শক্তি ক্ষেত্রের পরিমানগত মাত্রার উপরে কেন্দ্রীভূত, তার গবেষণাগুলো তাই একটা বিচ্ছিন্ন স্থানে বাইরের বিকিরন বা শ্বেতশব্দর ছোঁয়া বাচিয়ে করতে হবে। মস্তিষ্কের বিকিরন বা আশেপাশে মানুষ থাকার কারণে চিন্তার বিকিরন এসব সূক্ষ বিঘ্নও হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে। এই কারণে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর বা হাসপাতালের গবেষণাগার ধোপে টিকে না, কিন্তু এসএমএসসির একটা খালি পডের চেয়ে যুৎসই স্থান আর হতে পারে না।

চল যাই গিয়ে একবার দেখি। গাঢ় অন্ধকারে পা বাড়াতে গিয়ে মুচকি হেসে তার ভাই বলে। আমাকে কেবল অনুসরণ কর।

ক্যাথরিন চৌকাঠে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থাকে। নিশ্চিদ্র অন্ধকারে প্রায় একশ গজ? সে একটা ফ্লাশলাইট নেবার কথা ভাবে, কিন্তু ততক্ষণে তার ভাই সামনে অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।

পিটার? সে ডাকে।

বিশ্বাসে ভর করে এগোও, সে পাল্টা উত্তর দেয়, গলার স্বর ইতিমধ্যে হাল্কা শোনায়। তুমি তোমার পথ খুঁজে পাবে। আমার কথা বিশ্বাস করতে পার।

ভাইয়া মজা করছ, তাই না? চৌকাঠ ছেড়ে কয়েক পা ভেতরে আসতেই ক্যাথরিনের হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে উঠে, সে অন্ধকারের ভিতরে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করে। আমি কি দেখতে পাচ্ছি না! সহসা তার পেছনের ইস্পাতের দরজা একটা শীতল হিসস শব্দ তুলে বন্ধ হয়ে গেলে সে একেবারে গাঢ় অন্ধকারে নিজেকে আবিষ্কার করে। চারপাশে আলোর কোন কণাও দেখা যায় না। পিটার??

নিরবতা।

তুমি তোমার পথ খুঁজে পাবে। আমার কথা বিশ্বাস করতে পার।

সংশয়ের দ্বিধাদ্বন্দ্বে দুলতে দুলতে সম্পূর্ণ অন্ধের মত সে একটু একটু করে সামনে এগোয়। বিশ্বাসে ভর করে এগিয়ে যাওয়ার ক্যাথরিন মুখের সামনে নিজের হাত নিয়ে এসেও কিছু দেখতে পায় না। সে সামনে এগোতে থাকে, কিন্তু পরমুহূর্তেই সে পুরোপুরি দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। আমি কোথায় চলেছি?

এটা তিনবছর আগের কথা।

এখন, ক্যাথরিন ইস্পাতের সেই একই ভারী দরজার সামনে এসে পৌঁছালে, সে টের পায় প্রথম রাতের পর সে কতটা পথ পাড়ি দিয়েছে। তার গবেষণাগার-যার ডাকনাম দি কিউব- পড পাচের বিশালতার ভিতরে তার অভয়ারণ্য, তার বাসায় পরিণত হয়েছে। তার ভাই ঠিক যেমনটা ঘটবে বলে মনে করেছিল, সেদিন অন্ধকারের ভিতরে সে পথ খুঁজে পেয়েছিল এবং তারপর থেকে প্রতিদিন- ধন্যবাদ দিতে হয় একটা সাধারণ কিন্তু বিচক্ষণ পথনির্দেশক ব্যবস্থা যা তার ভাই তাকে নিজের জন্য আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে।

তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, তার ভাইয়ের অন্য ভবিষ্যতবাণীও যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছিল: ক্যাথরিনের গবেষণা ফলাফল সত্যিই বিস্ময়কর, বিশেষ করে গত ছয়মাসের, সাফল্য চিন্তার পুরো পদ্ধতিই বদলে দেবার ক্ষমতা রাখে। ক্যাথরিন আর তার ভাই ঠিক করেছে গবেষণার ফলাফল আরও বিশদভাবে বোঝার আগে তারা পুরো বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন রাখবে। খুব শীঘ্রই একদিন, ক্যাথরিন জানে সে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক রূপান্তরের বার্তা প্রকাশ করবে।

একটা গোপন জাদুঘরে একটা গোপন গবেষণাগার, পড পাঁচের দরজায় নিজের কি-কার্ড প্রবিষ্ট করে সে ভাবে। কি-বোর্ডের আলো জ্বলে উঠলে সে নিজের পিন টাইপ করে।

ইস্পাতের দরজা হিসস শব্দে খুলে যায়।

সেই একই শূন্যতা ঠাণ্ডা বাতাসের একটা ঝলকের সাথে স্বাগত জানায়। ক্যাথরিন টের পায় তার নাড়ীর গতি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।

পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে অদ্ভুত যান।

নিজেকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করার ফাঁকে শূন্যতায় পা রাখার আগে ক্যাথরিন সলোমন তার কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকায়। আজ রাতে অবশ্য একটা বিব্রতকর চিন্তা তাকে ভেতরেও অনুসরণ করতে থাকে। পিটার কোথায়?

.

১২ অধ্যায়

ক্যাপিটল পুলিশের প্রধান ট্রেন্ট এনডারসন গত এক দশক ধরে ইউ.এস ক্যাপিটল কমপ্লেক্সের নিরাপত্তার বিষয়টা তদারক করে আসছে। মোটাসোটা, চওড়া-ছাতির একটা লোক যার মুখটা কাটা কাটা এবং মাথার লাল চুল সে ছোট ছোট করে ছেটে রাখে, সামরিক বাহিনীর ভাব সৃষ্টির জন্য। চোখে পড়ে এমন স্থানে সে পিস্তলটা রাখে যারা তার কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে সেইসব আহাম্মকদের জন্য এটা হুশিয়ারী।

ক্যাপিটলের বেসমেন্টের হাই-টেক সার্ভেলেন্স সেন্টার থেকে তার খুদে পুলিশ বাহিনীর অফিসারদের সমন্বয়ের কাজ করেই এনডারসন তার বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করেছে। এখানে সে একদল কলাকুশলীবিদের উপর নজরদারি রাখে যারা মনিটর পর্যবেক্ষন, কম্পিউটারের পাঠগ্রহণ করে এবং টেলিফোনের সুইচবোর্ডের সাহায্যে তার নেতৃত্বাধীন অসংখ্য নিরাপত্তা কর্মীর সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ বজায় রাখে।

আজকের সন্ধ্যাটা অন্যান্য দিনের চেয়ে বাড়াবাড়ি রকমের শান্তভাবে কেটেছে, এবং এনডারসন সে জন্য বেজায় খুশী। সে মনে মনে আশা করছে তার অফিসে রাখা ফ্ল্যাট স্ক্রীন টিভির পর্দায় রেডস্কীনের খেলার কিছুটা অংশ হলেও সে দেখতে পাবে। খেলাটা যেই মাত্র শুরু হয়েছে বেয়াক্কেলের মত তার ইন্টারকম জীবন্ত হয়ে উঠে।

চীফ?

এনডারসন গুঙিয়ে উঠে এবং চোখ টেলিভিশনের পর্দার দিকে স্থির রেখে সে ইন্টারকমের বাটন চাপ দেয়। বলছি।

রোটানডায় আমরা সামান্য ঝামেলায় পড়েছি। অফিসাররা আমাকে সাহায্য করার জন্য হাজির হতে শুরু করেছে কিন্তু তবুও আমার মনে হয় আপনার একবার এসে ব্যাপারটা দেখা উচিত।

ঠিক আছে। এনডারসন সিকিউরিটি নাভ-সেন্টার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়- একটা কমপ্যাক্ট নিউমডার্ন স্থাপণা যেখানে কম্পিউটারের মনিটর গিজগিজ করছে। সমস্যাটা আসলে কি নিয়ে?

টেকনিশিয়ান তার মনিটরে একটা ডিজিটাল ভিডিও ক্লিপ দেখছিল। রোটানডার পূর্ব ব্যালকনির ক্যামেরা। বিশ সেকেণ্ড আগের ঘটনা। সে ক্লিপটা। তায়।

এনডারসন টেকনিশিয়ানের কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে থাকে।

আজ রোটানডা প্রায় খালিই দেখা যায়, মাঝে মাঝে কেবল কয়েকজন পর্যটক হেঁটে যাচ্ছে। এণ্ডারসনের অভিজ্ঞ চোখ নিমেষে একলা হেঁটে বেড়ান। একটা লোকের উপর স্থির হয়, লোকটা অন্যদের চেয়ে দ্রুত গতিতে হেঁটে যাচ্ছে। মাথাটা পরিষ্কার করে কামান। পরনে আর্মির সবুজ সারপ্লাস জ্যাকেট। আহত হাত একটা স্লিংএ ঝুলছে। সামান্য বোড়াচ্ছে। শ্রান্ত অলস ভঙ্গি। সেলফোনে অজানা কারও সাথে কথা বলছে।

ন্যাড়া লোকটার পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি জোরালভাবে স্পীকারে ভেসে আসে যতক্ষণ না সে রোটানডার কেন্দ্রে পৌঁছে সহসা থমকে দাঁড়িয়ে না যায়, সেলফোনে কথা শেষ করে এবং তারপরে হাটু ভেঙে বসে পড়ে ভাবটা এমন যেন জুতার ফিতে বাঁধবে। কিন্তু জুতার ফিতার পরিবর্তে, সে তার স্লিঙের ভিতর থেকে কিছু একটা টেনে বের করে এবং সেটা মেঝেতে নামিয়ে রাখে। তারপরে সে উঠে দাঁড়ায় এবং পূর্ব দিকের এক্সিট লক্ষ্য করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দ্রুত এগিয়ে যায়।

এনডারসন ভ্রূ কুচকে লোকটা মেঝেতে কি রেখে গেল সেটা বোঝার চেষ্টা করে। খোদার দুনিয়ায় এসব কিসের আলামত? জিনিসটা প্রায় আট ইঞ্চি লম্বা। এবং সেটা সটান দাঁড়িয়ে রয়েছে। এনডারসন স্ক্রীনের দিকে হুমড়ি খেয়ে এগিয়ে যায় এবং চোখ কুচকে তাকিয়ে থাকে। জিনিসটা দেখে যা মনে হয় সেটা হওয়া সম্ভব না!

ন্যাড়া লোকটা দ্রুত হেঁটে, পূর্ব দিকের পোর্টিকো দিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়, কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাচ্চা ছেলের কথা স্পষ্ট শোনা যায়, মা, লোকটা কিছু একটা ফেলে গিয়েছে। ছেলেটা জিনিসটার দিকে এগিয়ে যায় কিন্তু সহসা থমকে থেমে দাঁড়িয়ে পড়ে। লম্বা একটা সময় নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকে সে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় এবং গগনবিদারী কণ্ঠে চিৎকার করে উঠে।

পুলিশ প্রধান সাথে সাথে ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং দরজার দিকে দৌড়ে যায়, একই সাথে ঝড়ের বেগে আদেশ দিতে থাকে। সব পয়েন্টে রেডিও এলার্ট ঘোষণা কর! ন্যাড়া মাথার স্লিং পরা লোকটাকে খুঁজে বের করে তাকে আটকাও! এখনই এই মুহূর্তে!

সিকিউরিটি সেন্টার থেকে দৌড়ে বের হয়ে, বহু ব্যবহারে মসৃণ সিঁড়ির তিনটা ধাপ সে একেকবারে টপকে যেতে থাকে। সিকিউরিটি ক্যামেরায় দেখা গিয়েছে ন্যাড়া মাথার স্লিং পরা লোকটা পূর্ব দিকের পোর্টিকো দিয়ে রোটানডা ত্যাগ করেছে। ভবন থেকে বের হবার সংক্ষিপ্ততম পথটা তাকে পূর্ব-পশ্চিম করিডোরের দিকে নিয়ে যাবে, আর সেটা ঠিক সামনেই।

আমি তাকে সামনে থেকে আটকাতে পারি।

সিঁড়ির শীর্ষে পৌঁছে এবং বাকটা ঘুরে এনডারসন তার সামনের নিরব হলওয়েটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে। এক জোড়া বয়স্ক দম্পতি হলওয়ের অপরপ্রান্ত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, হাতে হাত ধরে। কাছেই বসে থাকা এক সোনালী চুলের পর্যটক পরনে নীল ব্লেজার বেঞ্চে বসে গাইডবই পড়ছে এবং হাউস চেম্বারের বাইরের মোজাইক ছাদ গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষন করছে।

স্যার, কিছু মনে করবেন না! এনডারসন হুঙ্কার দিয়ে তার দিকে দৌড়ে যায়। আপনি কি একটা ন্যাড়া মাথার লোক হাতে স্লিং বাঁধা দেখেছেন?

বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে লোকটা বই থেকে মুখ তুলে তাকায়।

ন্যাড়া মাথা হাতে স্লিং! এনডারসন কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করে। আপনি কি তাকে দেখেছেন?

পর্যটককে ইতস্তত করতে দেখা যায় এবং ভীত চোখে হলওয়ের পূর্বদিকের দূরবর্তী প্রান্তের দিকে তাকায়। আহ…হ্যাঁ, সে বলে। আমার মনে হয় সে আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে গেছে…ঐ দিকের সিঁড়ির দিকে। সে হলের শেষ প্রান্তের দিকে ইঙ্গিত করে।

এনডারসন তার রেডিও বের করে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে নির্দেশ দিতে থাকে। সব পয়েন্টকে বলছি! সন্দেহভাজন দক্ষিণপূর্ব দিকের বহির্গমন দরজার দিকে গিয়েছে। ঘিরে ফেল! সে রেডিওটা নামিয়ে রাখে এবং হোলস্টার থেকে পিস্ত লটা বের করে এক্সিট লক্ষ্য করে দৌড়ে যায়।

.

ত্রিশ সেকেণ্ড পরে, ক্যাপিটলের পূর্ব প্রান্তের একটা নিরব এক্সিট দিয়ে, শক্তিশালী গড়নের সোনালী চুলের নীল ব্লেজার পরিহিত একটা লোক রাতের শীতল বাতাসে বের হয়ে আসে। লোকটা হাসিমুখে সন্ধ্যার শীতলতা উপভোগ করে।

রূপান্তর।

ব্যাপারটা কি সহজ।

এক মিনিট আগে, সে আর্মি সারপ্লাস জ্যাকেট পরে রোটানডা থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দ্রুত বেরিয়ে এসেছে। এক নিভৃত অন্ধকারাচ্ছন্ন কোণে, সে কোটটা খুলে ফেলেছে, এখন তার পরণে নীল ব্লেজার কোটের নীচে পরে এসেছিল। সারপ্লাস কোটটা ছুঁড়ে ফেলার আগে সেটার পকেট থেকে একটা সোনালী পরচুলা বের করে নিয়েছে এবং সেটা মাথায় সুন্দর করে আটকে নিয়েছে। তারপরে সে সটান দাঁড়িয়ে ব্লেজারের পকেট থেকে একটা গাইডবই। বের করে এবং শান্ত সমাহিত ভঙ্গিতে অন্ধকার আড়াল থেকে বের হয়ে আসে।

রূপান্তর। আমার অনেক গুণের একটা।

মাল’আখ তার পেষল পায়ে হেঁটে অপেক্ষমান লিমুজিনের দিকে হেঁটে যাবার সময়ে, সে পিঠ বাঁকা করে, তার দাঁড়িয়ে থাকা,দেহটা ছয় ফিট তিন ইঞ্চির, কাঁধ দুটো পেছনে ছুঁড়ে দেয়। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে ফুসফুসটা ভর্তি করে। সে অনুভব করে তার বুকে উল্কি আঁকা ফিনিক্সের ডানা দুটো পাখা মেলছে।

তারা যদি আমার ক্ষমতার কথা জানত, শহরের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে। আজ রাতে আমার রূপান্তর সম্পূর্ণ হতে চলেছে।

ক্যাপিটল ভবনে মাল’আখ তার দান যথেষ্ট কুশলতার সাথে দিয়েছে, প্রাচীন সব রীতিনীতির প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। প্রাচীন আমন্ত্রণ রীতি সম্পন্ন হয়েছে। ল্যাংডন আজরাতে তার ভূমিকা যদি এখনও বুঝতে না পেরে থাকে তবে শীঘ্রই সে সেটা বুঝে যাবে।

.

১৩ অধ্যায়

রবার্ট ল্যাংডনের কাছে, ক্যাপিটল রোটানডা- সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকার মতই- বরাবরই তাকে কোন কোন না কোন ভাবে বিস্মিত করে। বৌদ্ধিকভাবে, সে জানে কক্ষটা এত বিশাল যে ভিতরে স্ট্যাচু অব লিবার্টি অনায়াসে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কিন্তু কিভাবে যেন রোটানডাকে সবসময়ে তার ধারণার চেয়ে বিশাল আর ফাপা বলে প্রতিয়মান হয়, যেন বাতাসে অশরীরি আত্মরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ রাতে অবশ্য এখানে কেবলই হট্টগোল।

ক্যাপিটল পুলিস অফিসাররা হাতের কাছ থেকে বিহ্বল পর্যটকদের সরিয়ে দেয়ার ফাঁকে রোটানডা থেকে বের হবার সমস্ত পথগুলো আটকে দেবার চেষ্টা চালিয়ে যায়। ছোট ছেলেটা এখনও এক নাগাড়ে কেঁদে চলেছে। একটা উজ্জ্বল। আলো ঝলসে উঠে- এক পর্যটক কাটা হাতের ছবি তুলেছে এবং সাথে সাথে কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী লোকটাকে আটকে তার ক্যামেরা নিয়ে নেয় আর। তাকে এসকর্ট করে বাইরে নিয়ে যায়। বিভ্রান্তির ভিতরে, ল্যাংডনের মনে হয় সে একটা ঘরের ভিতর হেঁটে চলেছে, ভিড়ের ভিতর দিয়ে পিছলে গিয়ে হাতটার কাছে চলে আসছে।

পিটার সলোমনের কাটা ডান হাতটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বিচ্ছিন্ন কব্জির সমতল প্রান্ত একটা ছোট কাঠের স্ট্যাণ্ডের উপরে আটকানো কাটাতে গেঁথে দেয়া হয়েছে। তিনটা আঙ্গুল মুষ্ঠিবদ্ধ, বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনী পুরোপুরি প্রসারিত, উপরের গম্বুজের দিকে নির্দেশ করছে।

সবাই পিছিয়ে যাও! একজন অফিসার হুঙ্কার দিয়ে বলে।

ল্যাংডন এখন এতটাই কাছে যে সে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ দেখতে পায়, যা কব্জির কাটা স্থান থেকে গড়িয়ে নেমে কাঠের পাঠাতনে জমে রয়েছে। মৃত্যুর পরে কাটা ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত হয় না…যার মানে একটাই পিটার বেঁচে আছে। ল্যাংডন বুঝতে পারে না তার স্বস্তি পাওয়া না বমি করা উচিত। পিটারের হাত কব্জি থেকে কাটা হয়েছে যখন সে বেঁচে ছিল? তার গলার কাছে। পিত্ত উঠে আসে। তার প্রিয় বন্ধু এই একই হাতটা করমর্দনের জন্য বা উষ্ণ আলিঙ্গনের জন্য এগিয়ে দিত পুরোটা সময় এই কথাটাই তার মাথায় ঘুরতে থাকে।

ল্যাংডন টের পায় কয়েক সেকেণ্ডের জন্য তার মাথার ভিতরটা টিউন না করা টেলিভিশনের মত ঝিরঝির করছে সেখানে কোন চিন্তা খেলছে না। প্রথম সে পরিষ্কার ভাবনাটা সেখানে আবার ফুটে উঠে সেটা যদিও একেবারেই অপ্রত্যাশিত।

একটা মুকুট…এবং একটা তারকা।

ল্যাংডন নীচু হয়, পিটারের বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনী ভাল করে লক্ষ্য করতে। উল্কি? অবিশ্বাস্য, যে দানব কাজটা করেছে সে দেখা যাচ্ছে পিটারের বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনীতে খুদে প্রতাঁকের উল্কি এঁকেছে।

বৃদ্ধাঙ্গুলিতে-একটা মুকুট। তর্জনীর ডগায়- একটা তারা।

এটা হতে পারে না। ল্যাংডনের মনে সাথে সাথে চিহ্ন দুটোর ছাপ বসে যায়, প্রায় অপার্থিব একটা প্রেক্ষাপটের জন্ম দেয় ইতিমধ্যেই বিভৎস হয়ে উঠা দৃশ্যপট। এই দুটো চিহ্ন ইতিহাসে বহুবার একসাথে আর্বিভূত হয়েছে- এবং প্রতিবারই একই স্থানে হাতের আঙ্গুলের ডগায়। প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন আর পরম কামনীয় আইকন।

রহস্যময়তার হাত।

আজকাল আর এই আইকন দেখা যায় না, কিন্তু অতীত ইতিহাসের পাতায় পাতায় কর্ম উদ্যোগের শক্তিশালী আহবানের প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ল্যাংডন তার সামনের এই অদ্ভুত শিল্পকর্মের পরম্পরা অনুধাবন করে মনে মনে কুকড়ে যায়। পিটারের হাত দিয়ে কেউ রহস্যময়তার হাত তৈরী করেছে? অচিন্ত নীয় একটা ব্যাপার। প্রথাগতভাবে এই হাতটা সাধারণত কাঠ বা পাথরের উপরে বা কাগজে একে প্রচার করা হয়ে থাকে। ল্যাংডন কখনও সত্যিকারের হাত থেকে রহস্যময়তার হাত তৈরী করা হয়েছে বলে শোনেনি। পুরো ধারণাটাই জঘন্য।

স্যার? ল্যাংডনের পেছন থেকে নিরাপত্তা কর্মী বলে উঠে। অনুগ্রহ করে পিছনে সরে আসেন।

ল্যাংডন তার কথা শুনেছে বলে মনে হয় না। আরও উল্কি থাকার কথা। সে যদিও মুষ্ঠিবদ্ধ বাকী তিন আঙ্গুলের ডগা দেখতে পাচ্ছে না, ল্যাংডন নিশ্চিতভাবেই জানে তাদের ডগাতেও নির্দিষ্ট উল্কি আঁকা রয়েছে। সেটাই রীতি। সর্বমোট পাঁচটা প্রতীক। শতশত বছর ধরে রহস্যময়তার হাতের আঙ্গুলের ডগার চিহ্ন কখনও বদলায়নি…বা হাতটার প্রতীকি উদ্দেশ্য।  হাতটা…একটা আমন্ত্রণ ঘোষণা করে।

ল্যাংডন সহসা যে লোকটার কারণে সে এখানে এসেছে তার কথা স্মরণ করে আতঙ্কে শিউরে উঠে। প্রফেসর জীবনে একবার আসে এমন একটা আমন্ত্রণ আপনি আজ রাতে পেতে চলেছেন। প্রাচীন কালে, পৃথিবীর সবচেয়ে কাঙ্খিত আমন্ত্রণ জানাতে রহস্যময়তার হাত ব্যবহৃত হত। এই প্রতীকটা পাবার অর্থই ছিল একটা অভিজাত সম্প্রদায়ে যোগ দেবার পবিত্র সম্মানিত আহবান- এমন। একটা সম্প্রদায় বলা হয়ে থাকে যারা পরম্পরা ধরে রহস্যময় জ্ঞানর প্রহরী। হিসাবে কাজ করে আসছে। আমন্ত্রণটা কেবল বিশাল সম্মানের একটা বিষয় ছিল তাই না, এর মানে একজন মাস্টার বিশ্বাস করে তুমি গোপন জ্ঞানর অধিকারী হবার উপযুক্ত। মাস্টারের হাত হবু দিক্ষিতের উদ্দেশ্যে প্রসারিত হয়েছে।

স্যার, ল্যাংডনের কাঁধ শক্ত করে ধরে নিরাপত্তা কর্মী বলে। আমি চাই আপনি এই মুহূর্তে পিছনে সরে আসেন।

আমি জানি এর মানে কি, ল্যাংডন ব্যাপারটা সামলাতে বলে। আমি। তোমাকে সাহায্য করতে পারি।

এখনই! নিরাপত্তা কর্মী বলে।

আমার বন্ধু বিপদে পড়েছে। আমাদের দ্রুত-

ল্যাংডন টের পায় একজোড়া শক্তিশালী হাত তাকে তুলে নিয়ে কাটা। হাতটার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনে। সে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়…প্রতিবাদ করার কথা তার মনেই আসে না। একটা আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ একমাত্র সরবরাহ করা হয়েছে। কেউ একজন ল্যাংডনকে ডাকছে রহস্যময় সিংহদ্বার অবারিত করতে যার ফলে গোপন জ্ঞান আর প্রাচীন রহস্যের একটা জগৎ উন্মোচিত হবে।

কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই একটা পাগলামি।

এক বদ্ধ উন্মাদের মতিভ্রম।

.

১৪ অধ্যায়

মাল’আখের স্ট্রেচ লিমোজিন ইউ.এস ক্যাপিটল থেকে বিনা বাধায় বের হয়ে এসে, ইনডিপেনডেন্স এ্যাভিনিউ ধরে পূর্ব দিকে এগিয়ে যায়। ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া অল্প বয়সী এক প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল ভ্রু কুচকে গাড়ির টিনটেড কাঁচের ভিতর দেখতে চেষ্টা করে, আশা হয়ত কোন ভিআইপিকে দেখতে পাবে।

আমি সামনে বসে আছি, আপন মনে হেসে, মাল’আখ ভাবে। বিশাল এই গাড়িটা একাকী চালাবার সময়ে অনুভূত শক্তির দমক মাল’আখ পছন্দ করে। তার বাকী পাঁচটা গাড়ির কোনটাই আজ রাতে তার যা প্রয়োজন। সেটা দিতে অপারগ- একান্ততার নিশ্চয়তা। পরিপূর্ণ একান্ততা। এই শহরে লিমোজিন এক ধরণের অব্যক্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। চলমান দূতাবাস। ক্যাপিটল হিলের আশেপাশে কর্মরত পুলিশ কর্মচারীরা সব সময়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে কখনও ভুল করে কোন লিমোজিন থামিয়ে না জানি কোন পাওয়ার ব্রোকারের সামনে পড়ে আর তাদের বেশিরভাগই তাই ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে।

মাল’আখ এ্যানাকোশিয়া নদী অতিক্রম করে মেরীল্যাণ্ড পৌঁছালে, সে নিজেকে ক্যাথরিনের নিকটবর্তী বলে অনুভব করে, নিয়তির টানে সামনে এগিয়ে চলেছে। আজ রাতে আমাকে আরেকটা কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে…. এমন একটা কাজ যা আমি কল্পনাও করিনি। গতকাল রাতে, পিটার সলোমন যখন তার শেষ রহস্যটা বলছে, মাল’আখ তখন একটা গোপন গবেষনাগারের অস্তিত্বের কথা জানতে পারে যেখানে বসে ক্যাথরিন মির‍্যাকলকে সম্ভব করেছে হতবুদ্ধি করে দেবার মত সাফল্য মাল’আখ বুঝতে পারে যা প্রকাশিত হলে পুরো পৃথিবীকে বদলে দেবে।

তার কাজ সব বস্তুর সত্যিকারের প্রকৃতি প্রকাশ করবে।

বহু শতাব্দি ধরে পৃথিবীর চৌকষতম মস্তিষ্কসমূহ প্রাচীন বিজ্ঞানকে অবজ্ঞা করে এসেছে, অজ্ঞ কুসংস্কার বলে উপহাস করেছে, চোখ ধাঁধান নতুন প্রযুক্তি আর আত্মতৃপ্ত সন্ধিগ্ধচিত্ততার সাথে জোট বেধেছে- অনুষঙ্গ যা তাদের কেবল। সত্যের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। এক প্রজনের সাফল্য পরবর্তী প্রজন্মের প্রযুক্তি ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে। আর এভাবেই পরম্পরার পরে পরম্পরা চলে আসছে। মানুষ যত জানছে, সে ততই অনুধাবন করছে সে কিছুই জানে না।

বহু শতাব্দি ধরে মানুষ অন্ধকারে পথের সন্ধান করেছে…কিন্তু এখন, ঠিক যেমন ভবিষ্যত্বাণী করা হয়েছিল, একটা পরিবর্তন আসন্ন হয়ে পড়েছে। ইতিহাসের প্রতি পদে পদে হোঁচট খাবার পরে, মানুষ আজ একটা সন্ধিক্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছে। বহুঁকাল পূর্বেই এমন ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, প্রাচীণ পাণ্ডুলিপি, আদ্যকালীন দিনপঞ্জি, এমনকি আঁকাশের তারকামণ্ডলীতেও এই বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। পরিবর্তনের সময় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যার আগমন আন্ন। আগমনের পূর্বে জ্ঞানের একটা বিপুল বিস্ফোরন ঘটবে…

অন্ধকার দূর করতে বোধের আলো এবং মানবজাতিকে শেষ একটা সুযোগ দেবে রসাতল থেকে দূরে সরে জ্ঞানর পথে অগ্রসর হবার।

আমি এসেছি আলোকে আড়াল করতে, মাল’আখ ভাবে। এটাই আমার ভূমিকা।

নিয়তি তাকে পিটার আর ক্যাথরিন সলোমনের সাথে সংশ্লিষ্ট করেছে। এসএমএসসির অভ্যন্তরে ক্যাথরিন সলোমনের সাফল্য, নতুন চিন্তাধারার উৎসমুখ খুলে দিয়ে, নতুন বেঁনেসার সূচনা করতে পারে। ক্যাথরিনের গুপ্ততথ্য যদি প্রকাশ পায়, তবে তা প্রভাবকে পরিণত হয়ে মানবজাতিকে উদ্বুদ্ধ করবে যে জ্ঞান সে হারিয়ে ফেলেছে তা পুনরাবিষ্কার করতে, সকল কল্পনাকে পরাস্ত করে তাকে ক্ষমতাশালী করে তুলবে।

ক্যাথরিনের নিয়তি জ্ঞানের মশালে অগ্নিসংযোগ করা।

আমার নিয়তি তাকে নির্বাপিত করা।

.

১৫ অধ্যায়

গাঢ় অন্ধকারে, ক্যাথরিন সলোমন তার গবেষণাগারের বাইরের দরজা হাতড়ে বেড়ায়। দরজা খুঁজে পেলে, সীসার পাত দিয়ে মোড়ান দরজা বেশ জোর দিয়ে টেনে খুলে এবং দ্রুত ক্ষুদ্র এন্ট্রি রুমে প্রবেশ করে। শূন্য স্থানের মাঝ দিয়ে। হেঁটে আসতে কেবল নব্বই সেকেণ্ড সময় লেগেছে এবং এখনও উন্মত্তের মত তার হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হচ্ছে। তিন বছর পরে, সবাই ভাবছে আমি অন্ধকারে। অভ্যস্থ হয়ে গেছি। সবসময়ে পড় পাঁচের অন্ধকার থেকে পরিষ্কার আলোকিত পরিবেশে আসতে পারলেই ক্যাথরিন স্বস্তি পায়।

কিউবটা আদতে একটা বিশাল জানালাবিহীন কামরা। কক্ষের ভেতরের দেয়াল আর ছাদের প্রতি ইঞ্চি টাইটেনিয়ামের আস্তরন দেয়া লিড ফাঁইবারের শক্ত পলেস্তারা দিয়ে আবৃত, যা সিমেন্টের এনক্লোজারের অভ্যন্তরে নির্মিত একটা বিশাল খাঁচার আঙ্গিক দিয়েছে। ফ্রস্টেড প্লেক্সিগ্নাসের ডিভাইডার ভিতরের শূন্য স্থান নানা প্রকোষ্ঠে বিভক্ত করেছে- গবেষণাগার, কন্ট্রোল রুম, যান্ত্রিক প্রকৌশলী কক্ষ, প্রাক্ষালন কক্ষ আর একটা খুদে রিসার্চ লাইব্রেরী।

ক্যাথরিন সামান্য সময়ের জন্য প্রধান ল্যাবে দাঁড়ায়। উজ্জ্বল আর জীবাণুমুক্ত স্থানে অত্যাধুনিক পরিমাণগত যন্ত্রপাতি ঝকঝক করছে: জোড়া ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রাফস, একটা ফেটুসেকেণ্ড কম্ব, ম্যাগনেটো অপটিক্যাল ট্র্যাপ, এবং কোয়ান্টাম-ইনডিটারমিনেট ইলেকট্রন নয়েজ আরইজিস যাকে সাধারণত র‍্যানডম ইভেন্ট জেনারেটর বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

নিওটিক সাইন্স অতি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা সত্ত্বেও, আবিষ্কারগুলো নিজেরাই যেসমস্ত শীতল, হাই-টেক যন্ত্রপাতি তাদের জন্ম দিয়েছে তাদের চেয়ে অনেক বেশি রহস্যময়। ম্যাজিক আর মিথের উপাদানসমূহ বিহ্বলকারী নতুন উপাত্ত লাভের ফলে দ্রুত বাস্তবতার অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে, যা নিওটিক বিজ্ঞানের মূল মতবাদ সমর্থন করে মানব মনের গহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চল।

মূল উপপাদ্যটা আপাত দৃষ্টিতে বেশ সরল; আমরা আমাদের মানসিক আর আধ্যাত্মিক সামর্থ্যের খুব সামান্য অংশই ব্যবহার করেছি।

ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত নিওটিক বিজ্ঞান অনুষদ, এবং প্রিন্সটন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যানামোলিস রিসার্চ ল্যাব (পিইএআর)এর মত স্থাপণায় পরিচালিত পরীক্ষাসমূহ নীতিগতভাবে সমর্থন করেছে যে মানুষের চিন্তাধারা যদি ঠিকমত পরিচালিত করা যায় তবে তা ভৌত ভরকে আক্রান্ত আর পরিবর্তন করতে সক্ষম। তাদের পরীক্ষাসমূহ রাস্তায় দেখান চামচ বাঁকান কৌশলএ সীমাবদ্ধ না, বরং অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত অনুসন্ধান যার সবই একই অসাধারণ ফলাফলের জন্ম দিয়েছে। আমাদের চিন্তার তরঙ্গ বাস্তবিক পক্ষে পার্থিব পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে, সেটা আমরা বুঝতে পারি বা না পারি, আর আন্তআণবিক জগতে পরিবর্তন সাধনে সক্ষম।

পদার্থের উপরে মনের পরাক্রম।

২০০১ সালে, সেপ্টেম্বর ১১-এর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার অব্যবহিত পরের মুহূর্তগুলোয়, নিওটিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্র সামনের দিকে প্রার্থিত পরিমাণগত অগ্রগতি লাভ করেছে। চারজন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন যে এই একক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় ভয় জর্জরিত সমগ্র পৃথিবী একত্রিত হয়ে এবং পারস্পরিক বিষাদের প্রতি মনোনিবেশ করায়, সারা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত সাতত্রিশটা ভিন্ন র‍্যানডম ইভেন্ট জেনারেটরের আউটপুট সহসা লক্ষ্যনীয় মাত্রায় অপেক্ষাকৃত কম র‍্যানডম বলে প্রতিয়মান হয়। কোন না কোনভাবে, ভাগ করে নেয়া এই অভিজ্ঞতার একাত্মবোধ, লক্ষাধিক মানব মনের একাঙ্গীভূত হওয়া, এই সব মেশিনের র‍্যানডমাইজিং কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলেছে, তাদের ফলাফলে একটা পরিমিতমাত্রা এনে বিশৃঙ্খলার মাঝে শৃঙ্খলা আনয়ন করেছে।

এই বিহ্বলকারী আবিষ্কার, প্রাচীন আধ্যাত্মিক বিশ্বাস মহাজাগতিক সজ্ঞানতার সমান্তরাল একটা বোধ বলে প্রতিয়মান হয়-মানব প্রবৃত্তির একাঙ্গীভূত হওয়ার প্রবণতা যা প্রকৃতপক্ষে ভৌত পদার্থের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় সক্ষম। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে র‍্যানডম ইভেন্ট জেনারেটরে গণ প্রার্থনাসভা আর ধ্যান একই ধরণের ফলাফলের জন্ম দিয়েছে, যা নিওটিক লেখক লিন ম্যাকট্যাগার্টের বর্ণনা করা মানবিক সজ্ঞানতার দাবীকে উস্কে দিয়েছে, যা তার মতে মানব দেহের বাইরে অবস্থিত একটা অনুষঙ্গ…পার্থিব জগতকে বদলে দিতে সক্ষম এমন একটা উচ্চকোটির নিয়মতান্ত্রিক শক্তি। ম্যাকটেগার্টের বই দি এনটেনশন এক্সপেরিমেন্ট ক্যাথরিনকে অভিভূত করে এবং তার গ্লোবাল ওয়েববেসড পাঠচক্র দিইনটেনশনএক্সপেরিমেন্ট কম- এর উদ্দেশ্যই হল কিভাবে মানব প্রবৃত্তি পৃথিবীকে প্রভাবিত করে সেটা খুঁজে বের করা। আরও কিছু প্রগতিশীল পুস্তক ক্যাথরিনের আগ্রহ উস্কে দেয়।

এই ভিত্তির উপরে ভর দিয়ে ক্যাথরিনের গবেষণা সামনে এগিয়ে যায়, প্রমাণ করে যে ভাবনার মনোনিবেশ আক্ষরিক অর্থে সবকিছুকে প্রভাবিত করতে সক্ষম- উদ্ভিদের বৃদ্ধিহার, এ্যাকুরিয়ামে সাঁতার কাটতে থাকা মাছের গতিপথ, পেটট্রি ডিসে কোষের বিভাজন রীতি, পৃথক পৃথক অটোমেটেড সিস্টেমের ভিতরে সিনক্রোনাইজেশন, এবং একজনের নিজের শরীরে সংঘটিত রাসায়নিক বিষক্রিয়া। এমনকি একজনের মনের শক্তি সদ্য দানা বাঁধা স্ফটিকের কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে পারে; ক্যাথরিন গ্লাসের পানি জমাট বাঁধার সময়ে কেবল প্রেমময় চিন্তার বিচ্ছুরন ঘটিয়ে সুন্দর প্রতিসম বরফের স্ফটিক তৈরী করেছে। অবিশ্বাস্যভাবে, বিপরীত উপপাদ্যও সত্যি, সে যখন বিরূপ দূষিত ভাবনা পানিতে সংক্রামিত করে তখন বরফের ফটিক বিশৃঙ্খল, এবড়োথেবড়োরূপে জমাট বাঁধে।

মানুষের ভাবনা আক্ষরিক অর্থেই পার্থিব পৃথিবীকে বদলে দেবার ক্ষমতা রাখে।

ক্যাথরিনের পরীক্ষা যখন ক্রমশ সাহসী হয়ে উঠতে শুরু করে, তার ফলাফলও ততোধিক বিস্ময়াভিভূত প্রতিপন্ন হতে থাকে। এই গবেষণাগারে তার কাজ সন্দেহের লেশমাত্র না রেখে প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছে যে বস্তুকে ছাপিয়ে মনএর এই ধারণা কেবল নিউ-এজ সেল্ফ হেল্প মন্ত্র না। বস্তুর প্রকৃতি বদলে দেবার ক্ষমতা মনের রয়েছে এবং তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ পার্থিব জগতকে কোন নির্দিষ্ট দিকে ধাবিত হতে উৎসাহিত করার ক্ষমতা মানব মনের আছে।

আমরা আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিভূ।

সাবএটমিক লেভেলে, ক্যাথরিন দেখেছে যে পার্টিকেলসসমূহ তার ইচ্ছার অনুকূলে সায় দিয়েই অস্তিত্ব লাভ করে এবং লয় পায়। বলতে গেলে, কোন নির্দিষ্ট পার্টিকেল দেখতে তার ইচ্ছা…সেই পার্টিকেলে উপস্থাপিত হয়। হেইসেনবার্গ বহু দশক আগে এই বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন আর এখন এটা নিওটিক বিজ্ঞানের প্রাথমিক সূত্রগুলোর একটায় পরিণত হয়েছে। লিন মাকটেগার্টের ভাষায়: জীবন্ত সজ্ঞানতা কোন একটা উপায়ে কোন কিছুর সম্ভাবনাকে কোন একটা বাস্তব অবস্থায় পরিণত হতে প্রভাবিত করে। আমাদের বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ চেতনা বা সজ্ঞানতা যা এটা পোষন করে।

ক্যাথরিনের কাজের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হল পার্থিব জগতকে বদলে দিতে পারার এই মানসিক শক্তি যে অনুশীলনের মাধ্যমে জোরাল করা যায় সেটা অনুধাবন করা। অভিপ্রায় চেষ্টাকৃত প্রয়াসে অর্জিত দক্ষতা। মেডিটেশনের মত ভাবনার সত্যিকারের ক্ষমতা সক্রিয় জোরাল করে তুলতে অধ্যাবসায় অনুশীলনের প্রয়োজন। আরও গুরুত্বপূর্ণ…কিছু কিছু লোক জন্মসূত্রেই এ বিষয়ে অন্য অনেকের চেয়ে বেশী পারদর্শিতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। ইতিহাসের প্রতিটা বাঁকে, কিছু কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটেছিল যারা সত্যিকারের মাস্টারে নিজেদের পরিণত করতে পেরেছিল।

আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রাচীন মরমিবাদের এটাই হারিয়ে যাওয়া যোগসূত্র।

ক্যাথরিন বিষয়টা তার ভাইয়ের কাছ থেকে জেনেছে এবং এখন আবার ভাইয়ের কথা মনে পড়তে তার মনটা আশঙ্কায় ভারী হয়ে উঠে। সে হেঁটে ল্যাবের রিসার্চ লাইব্রেরীর ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে। কেই নেই।

লাইব্রেরীটা আসলে একটা ক্ষুদ্র পরিসরে পড়ার স্থান- দুটো মরিস চেয়ার, একটা কাঠের টেবিল, দুটো ফ্লোর ল্যাম্প, আর একদিকের দেয়াল জুড়ে মেহগনির বইয়ের তাকে প্রায় শ পাঁচেক বই সাজান। ক্যাথরিন আর পিটার এখানে তাদের পছন্দের বইগুলো এনে জড়ো করেছে, পার্টিক্যাল ফিজিক্স থেকে শুরু করে প্রাচীন মরমীবাদ সববিষয়ের বই পাওয়া যাবে। নতুন আর পুরানোর সারগ্রাহী ফিউশনে…ঐতিহাসিক থেকে কাটিং-এজ প্রযুক্তির একটা সংগ্রহে পরিণত হয়েছে। ক্যাথরিনের বেশিরভাগ বইয়ের শিরোনাম অনেকটা এরকম, কোয়ান্টাম কনশাসনেস, দি নিউ ফিজিক্স, এবং দি প্রিন্সিপ্যাল অব নিউরাল সাইন্স। তার ভাইয়ের সংগৃহীত বইগুলোর শিরোনাম একেবারে দুর্বোধ্যতায় পুরানো যেমন দি কিবালিয়ন, দি জোহর, দি ডানসিং উ লি মাস্টার্স এবং বৃটিশ মিউজিয়াম থেকে সংগৃহীত সুমেরীয়ান ট্যাবলেটের অনুবাদ।

আমাদের বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যতের চাবি, তার ভাই প্রায়ই বলতো, আমাদের অতীতে লুকান রয়েছে। আজীবন ইতিহাস, বিজ্ঞান আর মরমীবাদের বিদ্যার্থী, পিটারই প্রথম ক্যাথরিনকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত বিজ্ঞানকে প্রাচীন হার্মেটিক দর্শনের সাথে মিলিয়ে দেখতে উৎসাহিত করে। পিটার আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রাচীন মরমীবাদের ভিতরে সম্পর্কের বিষয়ে ক্যাথরিনকে আগ্রহী করে তুলেছিল যখন তার মাত্র উনিশ বছর বয়স।

তো ক্যাথ আমাকে বলো, ইয়েলে ভর্তির দ্বিতীয় বছরে ছুটিতে বাড়ি আসলে ভাই তাকে জিজ্ঞেস করেছিল। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বিষয়ে এলিস আজকাল কি পড়ছে?

ক্যাথরিন তখন তাদের বই ঠাসা পারিবারিক গ্রন্থাগারে দাঁড়িয়ে এবং সে জোরে জোরে তার চোখ বড় বড় করে দেবার মত পাঠ্যসূচী আবৃত্তি করে।

চিত্তাকর্ষক, তার ভাই উত্তর দেয়। আইনস্টাইন, বোর, আর হকিং আধুনিক জিনিয়াস। কিন্তু প্রাচীনদের কারো লেখা কি পড়ছো?

ক্যাথরিন মাথা চুলকায়। তুমি বলতে চাইছো মানে…নিউটন?

সে হাসে। চালিয়ে যাও। সাতাশ বছর বয়সী পিটার ততদিনে বিদ্বৎসমাজে নিজের স্থান করে নিয়েছে এবং সে আর পিটার খেলাচ্ছলে এধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক মহড়ার ভিতরেই বেড়ে উঠেছে।

নিউটন ছাড়া অন্যকেউ? ক্যাথরিনের মাথায় এখন আবছা হয়ে আসা নামসমূহ যেমন টলেমী, পিথাগোরাস, হার্মেস ট্রিসমেজিসটাস ভেসে উঠে। আজকাল তাদের লেখা আর কেউ পড়ে না।

তার ভাই ফেটে যাওয়া চামড়ার বাঁধাই করা পুরাতন এবং ধূলিমলিন বড় বইয়ে ঠাসা একটা তাকের উপর দিয়ে আঙ্গুল টেনে নিয়ে যায়। প্রাচীনকালের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত, আধুনিক পদার্থবিদ্যা সবেমাত্র পুরোটা অনুধাবন করতে শুরু করেছে।

পিটার, ক্যাথরিন বলে, তুমি আমাকে ইতিমধ্যে বলেছো নিউটনের অনেক আগেই মিশরীয়রা পুলি আর লিভারের ব্যবহার জানত এবং প্রথম দিকের অ্যালকেমিস্টদের দক্ষতা আজকে রসায়নবিদদের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল। মা, কিন্তু তাতে কি হয়েছে? বর্তমানের পদার্থবিদ্যা এমন সব ধারণা নিয়ে কাজ করছে যা প্রাচীন কালে অচিন্তনীয় একটা ব্যাপার ছিল।

যেমন?

বেশ…যেমন এনট্যাঙ্গলমেন্ট থিওরীর কথাই ধরা যাক! সাবঅ্যাটমিক রিসার্চ এখন তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে যে সব পদার্থই পরস্পরসংযুক্ত…পরম্পরসংবদ্ধ একীভূত অবস্থায় জটপাকিয়ে ছিল…এক ধরণের বিশ্বজনীন ওয়াননেস। তুমি কি বলতে চাইছ যে প্রাচীনকালের পণ্ডিতরা একত্রে বসে এনট্যাঙ্গলমেন্ট থিওরী নিয়ে আলোচনা করেছে?

অনিবার্যভাবে! পিটার তার চোখের সামনে থেকে লম্বা কালো চুলের গোছা সরিয়ে বলে। এনট্যাঙ্গলমেন্ট ছিল আদ্যকালীন বিশ্বাসের মর্মবস্তু। ইতিহাসের সমান বয়সী এর নামগুলো…ধর্মকারা, তাও, ব্রাহ্মণ। বস্তুতপক্ষে মানুষের প্রাচীনতম আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানই ছিল নিজের এনট্যাঙ্গলমেন্টের স্বরূপ বোঝা, পারিপার্শ্বের সাথে সে নিজে কিভাবে জড়িয়ে রয়েছে সেটা উপলব্ধি করা। সে সব সময়ে চেয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে লীন হতে…এট-ওয়ান-মেন্ট রূপ অর্জন করতে। তার ভাই ভ্রু তুলে তাকায়। আজ পর্যন্ত ইহুদি আর খ্রিস্টানরা এটনমেন্ট বা প্রায়শ্চিত্তের জন্য চেষ্টা করে চলেছে…যদিও আমরা আজ ভুলে গেছি সেটা আদতে এট-ওয়ান-মেন্ট যা আমরা খুঁজছি।

ক্যাথরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সে ভুলেই গিয়েছিল ইতিহাসে পাণ্ডিত্য রয়েছে এমন একজনের সাথে তর্ক করা মানে সময় নষ্ট করা। ঠিক আছে, মানছি, কিন্তু তুমি বড় অস্পষ্ট মন্তব্য করছো। আমি কথা বলছি নির্দিষ্ট পদার্থবিদ্যার বিষয় নিয়ে।

বেশ তাহলে নির্দিষ্ট করে বলা হোক। তার আগ্রহী চোখ এখন ক্যাথরিনকে দ্বৈরথে আহ্বান জানায়।

ঠিক আছে, পোলারিটির মত সাধারন বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক সাবঅ্যাটমিক পর্যায়ের ধনাত্মক/ঋণাত্মক ভারসাম্য। এটা নিশ্চিতরূপেই বলা যায় প্রাচীন কালে তারা এটা বুঝত-

রোসো, রোসো! তার ভাই একটা ধূলিমলিন ঢাউস বই টেনে নামায়, আর সেটাকে সশব্দে লাইব্রেরীর টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখে। আধুনিক মেরুধর্মিতা বা পোলারিটি দুহাজার বছর আগে কৃষ্ণ ভগবত গীতায় যে দ্বৈত পৃথিবীর কথা বলেছেন সেটার আধুনিক ব্যাখ্যা। এখানে আরও ডজনখানেক বই আছে, যার ভিতরে কিবালিয়নও পড়ে, যেখানে বাইনারী পদ্ধতি আর প্রকৃতির। বিপরীতধর্মী শক্তির কথা আলোচিত হয়েছে।

ক্যাথরিনকে সন্দিগ্ধ দেখায়। ঠিক আছে আমরা যদি সাবঅ্যাটমিকসের আধুনিক আবিষ্কারের কথা আলোচনা করি। উদাহরণ স্বরূপ হেইসেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্রের কথাই ধর-

তাহলে আমাদের এখানে দৃষ্টি দিতে হবে, তার লম্বা বুকশেলফের দৈর্ঘ্য বরাবর হেঁটে গিয়ে পিটার আরেকটা বই নামিয়ে বলে। হিন্দু বেদান্তের পবিত্র ভাষ্য যাকে উপনিষদ বলা হয়। প্রথম বইটার উপরে সে বিশাল ভারী বইটা নামিয়ে রাখে। হেইসেনবার্গ আর শ্ৰয়ডিঙগার এই পাণ্ডুলিপি অধ্যয়ন করেছে এবং তাদের সূত্র লিপিবদ্ধ করার সময়ে এখান থেকে সাহায্য নেয়ার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন।

আরও কয়েকমিনিট এই শোডাউন চলে এবং টেবিলের উপরে ধূলিমলিন বইয়ের স্তম্ভ লম্বা থেকে আরও লম্বা হতে থাকে। শেষপর্যন্ত ক্যাথরিন হতাশ হয়ে দুহাত উপরে তুলে হার স্বীকার করে। ঠিক আছে। আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি, কিন্তু আমি কাটিং-এজ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যাই অধ্যয়ন করতে চাই। বিজ্ঞানের ভবিষ্যত! আমার সত্যিই সন্দেহ আছে কৃষ্ণ আর ব্যস মাল্টিডায়মেনশনাল কসমোলজিক্যাল মডেল আর সুপারস্ট্রিঙ থিওরী নিয়ে আলোচনা করেছে কিনা।

তোমার কথাই ঠিক। তারা আলোচনা করেনি। তার ভাই চুপ করে থেকে কেবল মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখে। তুমি যদি সুপারস্ট্রিঙ থিওরীর কথা বল…সে আবার বইয়ের শেলফের দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজে। তাহলে তুমি এই বইটার কথা বলছে। সে চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা একটা ঢাউস আঁকৃতির বই বের করে এবং সশব্দে সেটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখে। মূল মধ্যযুগীয় আর‍্যামায়িকের তের শতকে করা অনুবাদ।

সুপারস্ট্রিঙ থিওরী আর তাও আবার তের শতকে?! ক্যাথরিন মোটেই পাত্তা দেয় না। গুলতানি থামাও ভাইয়া।

সুপারস্ট্রিঙ থিওরী একেবারেই নতুন কসমোলজিক্যাল মডেল। একেবারে সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষনের উপরে নির্ভর করে, বলা হয়েছে মাল্টিডায়মেনশনাল ইউনিভার্স তিনটা না…বরং দশটা ডায়মেনশন বা মাত্রা দিয়ে, যার প্রত্যেকটাই স্পন্দনশীল স্ট্রিঙের মত মিথস্ক্রিয়া করে অনেকটা বেহালার তারের অনুরণনের ন্যায়।

ভাই বইটা টেনে খুলে, সূচীপত্রের অলঙ্কৃত সরণীতে আঙ্গুল চালিয়ে তারপরে বইয়ের শুরুর দিকের একটা অংশ খোলা পর্যন্ত ক্যাথরিন অপেক্ষা করে। এই অংশটা পড়। পিটার ঝাঁপসা হয়ে আসা একটা পাতার ভাষ্য আর ডায়াগ্রাম দেখিয়ে বলে।

বাধ্য মেয়ের ন্যায়, ক্যাথরিন পুরো পাতাটা পড়ে। অনুবাদ প্রাচীন ধাঁচের আর তাই বেশ কষ্টকর পড়া, কিন্তু সে অবাক বিস্ময়ে দেখে আধুনিক সুপারস্ট্রি থিওর যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কথা ঘোষণা করছে প্রাচীন বইটার ভাষ্য আর ডায়াগ্রাম। পরিষ্কার ভাষায় হুবহু একই কথা বলেছে- অনুরণনশীল স্ট্রিঙের দশ মাত্রার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। সে পাঠ অব্যাহত রাখলে সহসা আতকে উঠে গুটিয়ে যায়। হা। ঈশ্বর, এখানে দেখছি কিভাবে মাত্রাগুলোর ছয়টা একত্রে জট পাকিয়ে একটা মাত্রার ন্যায় আঁচরণ করে সে কথাও লেখা রয়েছে?? সে আতঙ্কিত চিত্তে এক পা পেছনে সরে আসে। এই বইটার নাম কি?

তার ভাই একটা দেতো হাসি হাসে। এমন একটা বই আমি আশা করি যা একদিন তুমি পড়বে। সে পৃষ্ঠা উল্টে শিরোনামে ফিরে আসে সেখানে একটা। অলঙ্কৃত প্লেটে তিনটা শব্দ মুদ্রিত রয়েছে।

দি কমপ্লিট জোহর।

ক্যাথরিন যদিও জোহর কখনও পড়ে দেখেনি, সে এটা জানে যে ইহুদি মরমিবাদের মূলগ্রন্থ এটা, একটা সময়ে একে এতটাই প্রভৃবিষ্ণু বলে গন্য করা ইত যে রাবিদের মধ্যে কেবল প্রথমসারির পণ্ডিতদের পড়ার জন্য এটা সংরক্ষিত থাকত।

ক্যাথরিন বইটার দিকে তাকায়। তুমি বলতে চাইছে প্রাচীনকালের মরমীবাদীরা জানত যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দশটা মাত্রা রয়েছে?

অবশ্যই। সে পৃষ্ঠাটায় অঙ্কিত পরম্পরসংবদ্ধ দশটা বৃত্ত তাকে দেখায় যাদের বলা হত সেপিরথ। অবশ্য পরিভাষা দুর্বোধ্য হলেও কিন্তু পদার্থবিদ্যা অনেক উচ্চকোটির।

ক্যাথরিন বুঝতে পারে না কিভাবে উত্তর দেবে। কিন্তু…অধিকাংশ লোক তাহলে এটা পাঠ করে না কেন?

তার ভাই হাসে। তারা করবে।

আমি বুঝতে পারলাম না।

ক্যাথরিন আমরা একটা সুন্দর সময়ে জন্মেছি। পরিবর্তন সমান্ন। মানবজাতি একটা নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে যখন তারা প্রকৃতির দিকে এবং পুরাতন পদ্ধতির দিকে তাদের চোখ ফিরাতে শুরু করবে…জোহরের মত এই সব প্রাচীন বইয়ে লিপিবদ্ধ ধারণা এবং সারা পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন পাণ্ডুলিপির কাছে ফিরে আসবে। শক্তিশালী সত্যের নিজস্ব অভিকর্ষ রয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যা মানুষকে নিজের কাছে টেনে আনবেই। এমন একটা দিন আসবে যখন আধুনিক বিজ্ঞান স্থিরসংকল্প হয়ে প্রাচীন জ্ঞান অধ্যয়ন শুরু করবে…আর সেদিনই মানুষ এতদিন পর্যন্ত তার কাছে অধরা থেকে যাওয়া প্রশ্নের উত্তর পেতে শুরু করবে।

সেই রাতে, ক্যাথরিন বুভুক্ষের মত তার ভাইয়ের সংগ্রহের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাঠ করতে শুরু করে এবং দ্রুত বুঝতে পারে যে তার ভাইয়ের কথাই যথার্থ। প্রাচীনকালে তারা প্রগাঢ় বৈজ্ঞানিক জ্ঞানর অধিকারী ছিল। বর্তমান বিজ্ঞান আবিষ্কারএর চাইতে বোধকরি পুনরাবিষ্কার বেশি করছে। মানবসম্প্রদায়, মনে হয়, একটা সময়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সত্যিকার প্রকৃতি আয়ত্ব করেছিল…কিন্তু পরে সে সেটা খুইয়ে বসে…এবং ভুলে যায়।

সেটা স্মরণ করতে আধুনিক পদার্থবিদ্যার সাহায্য আমরা নিতে পারি! আর এই অনুসন্ধানই ক্যাথরিনের জীবনের ব্রতে পরিণত হয়। প্রাচীনকালের হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান পুনরাবিষ্কারে উচ্চকোটির বিজ্ঞান ব্যবহার করে। কেতাবি রোমাঞ্চের চেয়েও অন্যকিছু একটা তার প্রেষণা বজায় রাখে। অন্যসব কারণের পরেও ছিল তার প্রত্যয় যে আজকের পৃথিবীর এই জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে…পূর্বের চেয়ে এখন আরও বেশি।

ল্যাবের পেছনে, ক্যাথরিন তার ভাইয়ের সাদা ল্যাব কোটটা তার নিজেরটার পাশে ঝুলতে দেখে। অভ্যেসের বশে সে সেলফোনটা বের করে দেখে কোন ম্যাসেজ এসেছে কিনা। কিছু নেই। তার স্মৃতিতে একটা কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। সেটা যা তোমার ভাই বিশ্বাস করে ডি.সিতে লুকান রয়েছে…এটা খুঁজে বের করা সম্ভব। কোন কোন সময় যখন কোন কিংবদন্তি শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে টিকে থাকে…কারণ আছে বলেই টিকে থাকে।

না, ক্যাথরিন উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠে। এটা সত্যি হতে পারে না।

কোন কোন সময় একটা কিংবদন্তি কেবলই একটা কিংবদন্তি।

.

১৬ অধ্যায়

নিরাপত্তা প্রধান ট্রেন্ট এনডারসন ঝড়ের বেগে ক্যাপিটল রোটানডায় ফিরে আসেন, নিজের নিরাপত্তা কর্মীদের ব্যর্থতায় রাগে ফুসতে থাকে সে। তার অকর্মা কর্মীদের একজন এইমাত্র একটা স্লিঙ আর আর্মি-সারপ্লাস জ্যাকেট পূর্ব দিকের পোর্টিকোর কাছে এক নিভৃতস্থানে খুঁজে পেয়েছে।

উদ্ধতলোকটা স্রেফ হেঁটে এখান থেকে বেড়িয়ে গেছে?

এনডারসন বাইরের ভিডিও স্ক্যান করতে তার লোকদের লাগিয়ে দিয়েছে, তারা যতক্ষণে কিছু খুঁজে পাবে, ততক্ষণে লোকটা স্রেফ উবে যাবে।

এনডারসন এখন রোটানায় প্রবেশ করে ক্ষতির পরিমান জরিপ করতে, সে দেখে তার প্রত্যাশা মতই পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়েছে। রোটানডার চারটা প্রবেশদ্বারই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, সিকিউরিটির এক্তিয়ারে ভীড় নিয়ন্ত্রণের যতগুলো অপ্রত্যক্ষ পদ্ধতি আছে সবগুলোর সাহায্য নিয়ে কোথাও ভেলভেটের ব্যানার ঝুলছে, কোথাও নিরাপত্তাকর্মী ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে আবার কোথাও একটা সাইনবোর্ড টাঙানো যেখানে লেখা আছে এই কামরাটা পরিষ্কার করার জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ আছে। গুটিকয়েক যে প্রত্যক্ষদর্শী ছিল তাদের সবাইকে খেদিয়ে ঘরের পূর্বদিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানে নিরাপত্তা প্রহরীরা তাদের সেলফোন আর ক্যামেরা বাজেয়াপ্ত করছে। এনডারসন চায়না তাদের ভিতরে কেউ সেলফোন থেকে সিএনএনকে একটা স্ন্যাপশট পাঠিয়ে দিক।

নিরুদ্ধ করা প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন, লম্বা, মাথা-ভর্তি কালো চুল পরনে টুইডের স্পোর্টস কোট, ভীড়ের ভিতর থেকে বের হয়ে এসে প্রধান অফিসারের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। লোকটা এই মুহূর্তে নিরাপত্তা কর্মীদের সাথে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত।

আমি কিছুক্ষণের ভিতরেই তার সাথে কথা বলবো, এনডারসন দূর থেকে প্রহরীর উদ্দেশ্যে কথাটা বলেন। তার আগে, সবাইকে অনুগ্রহ করে মেইন সবিতে থাকতে বলো, যতক্ষন আমরা ব্যাপারটা সুরাহা না করি।

এনডারসন এবার ঘরের মধ্যেখানে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে এটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা হাতটার দিকে তাকায়। ঈশ্বরের মহিমা অপার। ক্যাপিটল ভবনে পনের বছর নিরাপত্তার দায়িত্ব সে পালন করে আসছে, অনেক উদ্ভট বস্তু সে দেখেছে। কিন্তু তার কোনটাই এর ধারে পাশে আসে না।

ফরেনসিকের শকুনগুলো দ্রুত এসে জিনিসটা আমার ভবন থেকে নিয়ে গেলে বাঁচি।

এনডারসন আরেকটু কাছে যায়, দেখে যে কাটা কব্জিটা একটা কাঠের পাটাতনে গোজ দিয়ে গেথে রাখা হয়েছে যাতে সেটা দাঁড়িয়ে থাকে। কাঠ আর মাংসপেশী, সে ভাবে। মেটাল ডিটেক্টরের বাবার সাধ্য নেই ধরে। একমাত্র ধাতু বলতে একটা বিশাল সোনার আংটি, যা এনডারসন ভাবে দায়সারাভাবে ডিটেক্টরের নীচ দিয়ে অতিক্রম করেছে বা সন্দেহভাজন নিজের আঙ্গুল বলে কাটা আঙ্গুলটাকে চালিয়ে দিয়েছে।

এনডারসন উবু হয়ে বসে হাতটা ভাল করে দেখার জন্য। হাতটা দেখে তার মনে হয় ষাট বছর বয়স্ক কোন লোকের হাত হতে পারে সেটা। আংটিটাতে দুই মাথা-বিশিষ্ট পাখির কারুকাজ করা সিল আর ৩৩ সংখ্যাটা খোদাই করা আছে। এনডারসন আংটিটা সনাক্ত করতে পারে না। বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তজীর ডগায় আঁকা উখিগুলো তার মনোযোগ আকর্ষণ করে।

খোদা না খাস্তা উদ্ভট কাজ।

চীফ? প্রহরীদের একজন টেলিফোন নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে। আপনার জন্য ব্যক্তিগত কল। সিকিউরিটি সুইচবোর্ড থেকে এইমাত্র পাঠান হয়েছে।

কোন পাগলের দিকে দেখছে এমন দৃষ্টিতে এনডারসন তার দিকে তাকায়। আমি একটা কিছুর ভিতরে রয়েছি এই মুহূর্তে, সে ধমকে উঠে।

নিরাপত্তা কর্মীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে মাউতপিস হাত দিয়ে চেপে ফিসফিস করে বলে, সিআইএ।

এণ্ডারসনের এবার অবাক হবার পালা। সিআইএ এরই ভিতরে খবর পেয়ে গেছে?

তাদের সিকিউরিটি অফিস থেকে।

এনডারসন কাঠ হয়ে যায়। হয়ে গেল। নিরাপত্তাকর্মীর হাতে থাকা ফোনটার দিকে সে এবার অস্বস্তির সাথে তাকায়।

ওয়াশিংটনে গিজগিজ করতে থাকা ইনটিলিজেন্স এজেন্সির ভিতরে সিআইএর অফিস অব সিকিউরিটিকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এর সাথে তুলনা করা। চলে-রহস্যময় আর অনির্ভরযোগ্য না হল না, বিশ্বাসঘাতকে পূর্ণ একটা এলাকা যারা একে চেনে সবসময়ে চেষ্টা করে তার স্পর্শ বাঁচিয়ে চলতে। আপাত দৃষ্টিতে আত্ম-বিধ্বংসী নির্দেশে চালিত, সিআইএ একটা আজব কারণে ও এস নিজেই সৃষ্টি করেছে সিআইএর উপরে গোয়েন্দাগিরি করতে। শক্তিশালী ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স দপ্তরের ন্যায়, ওএস সিআইএর সব কর্মচারীদের উপরে নজর রাখে অবৈধ আঁচরণ খুঁজে বার করতে: তহবিল তছরূপ, গোপন তথ্য পাচার, গোপন প্রযুক্তি এবং বেআইনী নির্যাতন পদ্ধতি প্রয়োগ এমন অনেক কিছু।

ব্যাটারা আমেরিকার গোয়েন্দাদের উপরে গোয়েন্দাগিরি করে।

জাতীয় নিরাপত্তার সব ব্যাপারে অনুসন্ধানের পূর্ণ অধিকার আর স্বাধীনতা থাকায়, ওএসর জোরাল আর বহুদূর বিস্তৃত। এনডারসন ভেবে পায়না ক্যাপিটলের এই ঘটনায় কেন তারা আগ্রহ দেখাচ্ছে বা এত দ্রুত তারা জানলই বা কিভাবে। তারপরে আবার, ওএসর নাকি সব জায়গায় চোখ রয়েছে। এনডারসন যতটুকু জানে, ইউ.এস ক্যাপিটলের নিরাপত্তা ক্যামেরার একটা সরাসরি লাইন তাদের ওখানেও আছে। এই ঘটনা অবশ্য ওএসর এক্তিয়ারে পড়ে না, কিন্তু ফোনকলের সময়টা এত বেশি কাকতালীয় যে এনডারসন কাটা কব্জির কথা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না।

চীফ? নিরাপত্তা কর্মীটা এবার টেলিফোনটা যেন একটা গরম আলু এমনভাবে ধরে রয়েছে। আপনার এই মুহূর্তে এই কলটার উত্তর দেয়া উচিত। কলটা…সে থেমে যায় এবং নিরবে দুটো অক্ষর উচ্চারন করে। সা-টো।

এনডারসন পারলে লোকটাকে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দেয়। ফাজলামোর জায়গা পাওনা। সে টের পায় তার হাতের তালু ঘামতে শুরু করেছে। সাটো এই ব্যাপারটা নিজে নজরদারি করছে?

অফিস অব সিকিউরিটির অধিরাজ- ডিরেকটর ইনউ সাটো- ইনটিলিজেন্স ঘরানায় একটা কিংবদন্তি। ক্যালিফোর্নিয়ার, মানজানার, জাপানী অন্তরায়ন ক্যাম্পে, পার্ল হারবারের বিভীষিকার পরে জন্মগ্রহণকারী, সাটো একজন কঠোর উত্তরজীবি, যে নিজে কখনও যুদ্ধের বিভীষিকা ভুলে যায়নি বা অপ্রতুল সামরিক ইনটিলিজেন্সের কারণে বিপদের হুমকী। এখন, ইউ.এস ইনটিলিজেন্সের সবচেয়ে গোপন আর শক্তিশালী পদে অধিষ্ঠিত হয়ে সাটো নিজেকে একজন আপোষহীন দেশপ্রেমিক আর একই সাথে তার বিপক্ষে কেউ অবস্থান নিলে তার জন্য ভীতিকর শত্রু হিসাবে প্রমাণ করেছে। কদাচিত দর্শনধারী আর সবার মনে ভীতির উদ্রেককারী, ওএস ডিরেকটর সিআইএর গভীর আড়ালে চলাফেরা করেন অনেকটা লেভিয়াথানের মত যে পানির উপরে কেবল শিকার গেলার জন্য উঠে আসে।

এনডারসন জীবনে একবারই সাটোকে সামনা সামনি দেখেছে এবং শীতল কালো চোখে তাকাবার স্মৃতি এতটাই ভয়াবহ যে কথোপকথনটা টেলিফোনে হওয়াটাকে সে আশীর্বাদ বলে মনে করে।

এনডারসন ফোনটা নিয়ে সেটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসে। ডিরেকটর সাটো, যতটা সম্ভব বন্ধুত্বপূর্ণ গলায় সে বলতে চেষ্টা করে। চীফ এনডারসন। বলছি। আমি কি ভাবে

তোমার ভবনে একটা লোক আছে যার সাথে আমি এই মুহূর্তে কথা বলতে চাই। ওএস ডিরেকটরের কণ্ঠস্বর ভোলবার নয়- অনেকটা যাতা পেষার মত। গলার ক্যানসারের সার্জারী সাটোর কণ্ঠস্বরের স্বরভেদকে বিষমভাবে ভীতিকর করে তুলেছে আর তার সাথে তাল মিলিয়ে আছে গলার বিভৎস কাটাদাগ। আমি চাই তুমি তাকে এই মুহূর্তে আমার জন্য খুঁজে বের করবে।

ব্যস হয়ে গেল? তুমি চাও কোন একজনকে আমি পেজ করি? এনডারসন সহসা আশাবাদী হয়ে উঠে যে হয়ত ফোনকলটার টাইমিং আসলেই। কাকতালীয়। আপনি কাকে খুঁজছেন?

তার নাম রবার্ট ল্যাংডন। আমার বিশ্বাস এই মুহূর্তে সে তোমার ভবনেই অবস্থান করছে।

ল্যাংডন? নামটা আবছাভাবে পরিচিত মনে হয় তার, কিন্তু এনডারসন ঠিক মেলাতে পারে না। সে এখন ভাবে সাটো কি হাতটার কথা জানে। আমি এই মুহূর্তে রোটানডায় রয়েছি, এনডারসন সামান্য ভারিক্কী নিয়ে বলে, কিন্তু আমাদের এখানে কেবল কয়েকজন পর্যটক রয়েছে…একটু অপেক্ষা করুন। সে ফোনটা নামিয়ে দলটার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে। বন্ধুরা, তোমাদের ভিতরে ল্যাংডন নামে কেউ আছে কি?

সামান্য বিরতির পরে একটা মন্দ্র কণ্ঠস্বর পর্যটকদের ভিতর থেকে উত্তর দেয়। হ্যাঁ। আমিই রবার্ট ল্যাংডন।

সাটো সবই জানে। এনডারসন ঘাড়টা বকের মত করে দেখতে চেষ্টা করে কে কথাটা বলেছে।

সেই একই লোক যে কিছুক্ষণ আগে তার সাথে কথা বলার জন্য চেষ্টা করছিলো, ভীড়ের ভিতর থেকে বের হয়ে আসে। তাকে কেমন যেন বিহ্বল দেখায়…কিন্তু তারপরেও কেন যেন পরিচিত মনে হয়।

এনডারসন আবার ফোনটা ঠোঁটের কাছে তুলে আনে। হ্যাঁ। মি. ল্যাংডন এখানে আছেন।

ফোনটা তাকে দাও, সাটো কর্কশ কণ্ঠে বলে।

এনডারসন হাফ ছেড়ে বাঁচে। যা ব্যাটা তুই বোঝ। একটু অপেক্ষা করেন। সে ইশারায় ল্যাংডনকে ডাকে।

ল্যাংডন এগিয়ে আসবার সময়ে, এনডারসন সহসা বুঝতে পারে কেন নামটা তার কাছে পরিচিত মনে হচ্ছিল। আমি এই লোককে নিয়ে লেখা একটা আর্টিকেল এই মাত্র পড়লাম। ঈশ্বরের দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে সে এখানে কি করছে?

ল্যাংডনের ছয় ফুট লম্বা লাশ, আর খেলোয়াড়সুলভ শরীর সত্ত্বেও এনডারসন তার প্রত্যাশিত শীতল আর ধারাল কোন অভিব্যক্তি খুঁজে পায়না লোকটার কাছে যে ভ্যাটিকানে একটা বিস্ফোরন আর প্যারিসে মানুষ শিকারীদের হাত থেকে বেঁচে যাবার কারণে বিখ্যাত হয়ে গেছে। এই লোকটা ফরাসী পুলিশ বাহিনীকে ঘোল খাইয়েছে…লোফার পায়ে দিয়ে? এনডারসন কোন আইভি লীগ লাইব্রেরীতে আগুনের পাশে বসে দস্তয়ভস্কি পড়ছে এমন কারো সাথে তার চেহারার বেশি মিল খুঁজে পায়।

মি. ল্যাংডন? অর্ধেক পথ এগিয়ে এসে এনডারসন জিজ্ঞেস করে। আমি চীফ এনডারসন। এখানকার নিরাপত্তার ব্যাপারটা আমিই দেখি। আপনার জন্য একটা ফোনকল রয়েছে।

আমার জন্য? ল্যাংডনের নীল চোখে অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগ ফুটে উঠে।

এনডারসন ফোনটা বাড়িয়ে দেয়। সিআইএর অফিস অব সিকিউরিটি থেকে।

বাপের জন্মেও এমন নাম শুনিনি।

এনডারসন অশুভ ভঙ্গিতে হাসে। বেশ কথা, কিন্তু স্যার সে আপনার সম্বন্ধে জানে?

ল্যাংডন ফোনটা নিয়ে কানে ঠেকায়। বলছি?

রবার্ট ল্যাংডন? ডাইরেকটর সাটোর কর্কশ কণ্ঠ খুদে স্পীকারে গমগম করে উঠে, এতটাই জোরে যে এনডারসনও শুনতে পায়।

হ্যাঁ? ল্যাংডন উত্তর দেয়।

এনডারসন কাছে এগিয়ে আসে সাটো কি বলে সেটা শোনার জন্য।

আমি ডাইরেকটর ইনউ সাটো বলছি, মি. ল্যাংডন। আমি এই মুহূর্তে একটা বিপর্যয় সামলাতে ব্যস্ত এবং আমার বিশ্বাস আমার কাজে আসবে এমন তথ্য আপনার কাছে রয়েছে।

ল্যাংডনকে আশাবাদী দেখায়। এটা কি পিটার সলোমন সংক্রান্ত? আপনি কি জানেন সে কোথায় আছে?!

পিটার সলোমন? এনডারসন একেবারে অকূল পাথাড়ে পড়ে। প্রফেসর, সাটো উত্তর দেয়। এই মুহূর্তে প্রশ্নটা আমি করছি।

পিটার সলোমন ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছে, ল্যাংডন হড়বড় করে বলতে থাকে। কোন পাগল এই মাত্ৰ-

মাফ করবেন, সাটো তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে।

এনডারসন নুইয়ে যায়। ভুল চাল। সিআইএর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার প্রশ্নের ভিতরে বাগড়া দেবার মত ভুল একজন সিভিলিয়ানের পক্ষেই করা সম্ভব। আমি ভেবেছিলাম ল্যাংডন এর চেয়ে একটু চৌকষ হবে।

ভাল করে শোনেন, সাটো বলে। আমরা যখন কথা বলছি সেই মুহূর্তে আমাদের জাতি একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আমাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে যে আপনার কাছে তথ্য আছে যা এই বিপদ কাটাতে আমাকে সাহায্য করবে। এখন আমি আবার আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। আপনার কাছে কি তথ্য আছে?

ল্যাংডনকে বিভ্রান্ত দেখায়। ডিরেকটর, আমি বুঝতে পারছি না আপনি কিসের কথা বলছেন। আমি কেবল পিটারকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারেই আগ্রহী এবং-

কোন ধারণা নেই? সাটো আবার বলে।

এনডারসন দেখে ল্যাংডন রেগে উঠছে। প্রফেসর এবার আগের চেয়ে আগ্রাসী কণ্ঠে কথা বলে। না, স্যার। বিন্দু বিসর্গ কোন ধারণা নেই।

এনডারসন খাবি খায়। ভুল। ভুল। ভুল। রবার্ট ল্যাংডন এইমাত্র ডিরেকটর সাটোর সাথে আলোচনা করতে গিয়ে একটা মারাত্মক ভুল করে বসেছে।

অবিশ্বাস্যভাবে, এনডারসন উপলব্ধি করে যে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তাকে বিস্মিত করে ডিরেকটর সাটো রোটানডার অন্যপাশের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন এবং ল্যাংডনের পেছন থেকে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে আসছে। সাটো নিজে এখানে এই ভবনে এসেছে। এনডারসন শ্বাস বন্ধ করে কি হয় সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করে। ল্যাংডন এবার বুঝবে ঠ্যালা।

.

ল্যাংডন পুলিশ চীফের ফোনটা আঁকড়ে ধরে রয়েছে এবং ওএস ডিরেকটর যখন তাকে জোর করে তখন সে নিজের ভিতরে একটা হতাশার বুদবুদ উঠছে টের পায়। আমি দুঃখিত স্যার, ল্যাংডন সংক্ষিপ্তভাবে বলে, কিন্তু আমার পক্ষে আপনার মনের কথা বোঝা সম্ভব না। আপনি আমার কাছে কি সাহায্য চান?

আমি কি চাই আপনার কাছে? ওএস ডিরেকটরের খরখর কণ্ঠস্বর ল্যাংডনের ফোনের ভিতরে খটখট শোনা যায়, ফাঁপা এবং ঝগড়াটে, অনেকটা যক্ষা আক্রান্ত মৃত্যু পথযাত্রী কোন রোগীর মত।

লোকটার কথার মাঝেই, ল্যাংডন নিজের কাঁধে কারও হাতের চাপ অনুভব করে। সে ঘুরে দাঁড়ায় এবং তার চোখের গতি নিম্নমুখী হয়ে…সরাসরি একটা খুদে জাপানী মহিলার মুখে স্থাপিত হয়। তার চোখমুখে ক্রুদ্ধ অভিব্যক্তি, গায়ের রঙ কেমন খাপছাড়া, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, দাঁতে নিকোটিনের ছোপ এবং গলায় অস্থির করে তোলা একটা অনুভূমিক কাটা দাগ। দ্রমহিলা তার গ্রন্থিযুক্ত হাতে একটা সেলফোন কানের কাছে ধরে আছে এবং যখন তার ঠোঁট নড়ে ল্যাংডন তখন তার পরিচিত ফ্যাসফেসে কণ্ঠস্বর নিজের সেলফোনে শুনতে পায়।

আমি আপনার কাছে কি চাই, প্রফেসর? শান্ত ভঙ্গিতে ফোঁটা বন্ধ করে সে গনগনে চোখে তার দিকে তাকায়। শুরুটা এভাবে হতে পারে আপনি আমাকে স্যার ডাকা বন্ধ করবেন।

ল্যাংডন অনুতপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ম্যাম আমি. ..ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমাদের সংযোগটা এত ক্ষীণ ছিল আর তাছাড়া-

আমাদের সংযোগ ভালই আছে, প্রফেসর, সে বলে। আর আলতুফালতু ব্যাপারে সময় নষ্ট করার প্রতি আমি অতি মাত্রায় সংবেদনশীল।

.

১৭ অধ্যায়

ডিরেকটর ইনউ সাটো একটা ভয়ঙ্কর নমুনা- চার ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতার একটা ক্রুদ্ধ ঘূর্ণিঝড়ের মহিলা সংস্করণ। অস্থির হাড়কাঠামো সাথে গ্রন্থিযুক্ত অবয়ব এবং তার মত ত্বকের অবস্থাকে বলা হয় ভিটিলিগো যা তার গায়ের রঙকে খসখসে গ্রানাইটের বুকে জন্ম নেয়া ছত্রাকের মত চিত্রবিচিত্র করে তুলেছে। তার পরনের নীল কোচকানো প্যান্টট তার দূর্বল শরীরে ঢোলা বস্তার মত ঝুলে আছে, গলা-খোলা ব্লাউজটা গলার ক্ষতচিহ্ন ঢাকার কোন প্রয়াসই নেয়নি। তার সহকর্মীরা লক্ষ্য করেছে যে সাটোর একমাত্র শারীরিক অভ্যেস হল নিজের বেশ মোটা গোফ একটা একটা করে টেনে তোলা।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সাটো সিআইএর অফিস অব সিকিউরিটির প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। তার আই-কিউ অফ দা চার্ট এবং প্রবৃত্তি ভীতিকর রকমের নিখুঁত আর এই দুটো গুণের সমন্বয় তার আত্মবিশ্বাসকে এমন একটা পর্যায়ে তুলে এনেছে যা বাকী সবার জন্য ভীতিকর যারা অসম্ভব। সম্ভব করতে পারবে না। গলার ক্যানসারের আগ্রাসী মৃত্যুদায়ী আক্রমনও তাকে তার পদ থেকে সরাতে পারেনি। অসুখটার কারণে সে একমাস অফিসে আসতে। পারেনি, তার স্বরতন্ত্রীর অর্ধেকটা কাটা পড়েছে, এবং ওজন এক তৃতীয়াংশ কমেছে, কিন্তু তারপরেও সে অফিসে আসে যেন কিছুই হয়নি। সাটোকে দেখে মনে হবে অবিনাশী একটা সত্ত্বা।

রবার্ট ল্যাংডন ভাবে সে বোধহয় প্রথম লোক না যে সাটোর সাথে ফোনে কথা বলে তাকে পুরুষ বলে মনে করেছে, কিন্তু ডিরেকটর তখনও গনগনে কালো চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আবার বলছি, ম্যাম আমার ভুল হয়েছিল, ল্যাংডন বলে। আমি এখনও এখানকার পরিস্থিতি নিয়েই হিমশিম খাচ্ছি- যে লোকটা দাবী করছে যে পিটার সলোমন তার কাছে রয়েছে সেই একই নোক চালাকি করে আমাকে আজ সন্ধ্যাবেলা ডি.সিতে উড়িয়ে এনেছে। সে জ্যাকেটের পকেট থেকে ফ্যাক্সটা বের করে। এটাই সে আজ সকালে আমাকে পাঠিয়েছে। আমি প্লেনের টেইল নাম্বার লিখে রেখেছি, তো আপনি যদি কাউকে পাঠিয়ে এফএএকে ফোন করেন এবং সনাক্ত-

সাটোর শীর্ণ হাত ছো মেরে কাগজটা নেয়। সে কাগজটা না দেখেই পকেটে গুঁজে রাখে। প্রফেসর, এই তদন্ত আমি পরিচালনা করছি, আমি যা শুনতে চাই সেটা বলা শুরু না করা পর্যন্ত আমার পরামর্শ শোনেন মুখটা বন্ধ, রাখেন।

সাটো এবার মনোযোগ পুলিশ প্রধানের প্রতি নিবদ্ধ করে। 

চীফ এনডারসন, সে তার বাড়াবাড়ি রকমের কাছে গিয়ে খুদে কালো চোখ তুলে তাকে বিদ্ধ করে বলে, আপনি কি দয়া করে আমাকে বলবেন এখানে কি হচ্ছে? পূর্ব দরজার প্রহরী আমাকে বললো আপনার এখানে মানুষের একটা কাটা কব্জি খুঁজে পেয়েছেন। কথাটা কি সত্যি?

এনডারসন একপাশে সরে গিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা জিনিসটা উন্মোচিত করে। হ্যাঁ, ম্যাম, মাত্র কয়েক মিনিট আগে।

সে হাতটার দিকে নির্বিকার চোখে তাকিয়ে থাকে যেন কোন ময়লা ন্যাকড়ার টুকরো। আর তারপরেও তুমি এই কথাটা আমাকে বলেনি আমি যখন ফোন করেছিলাম।

আমি. ..মানে আমি মনে করেছি আপনি জানেন।

আমাকে কখনও মিথ্যা কথা বলবে না।

তার চাহনির সামনে এনডারসন মিইয়ে যায়, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আত্মবিশ্বাসী থাকে। ম্যাম পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

আমার সে বিষয়ে সন্দেহ আছে, ততোধিক আত্মবিশ্বাসে সাটো জবাব দেয়।

ফরেনসিক টিম যেকোন মুহূর্তে এসে পৌঁছাবে। কাজটা যেই করে থাকুক তার আঙ্গুলের ছাপ হয়ত রয়ে গেছে।

সাটোকে সন্দিহান দেখায়। আমার মনে হয় যে লোকটা তোমাদের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভিতর দিয়ে হেঁটে আসবার মত বুদ্ধি রাখে সে বোধহয় হাতের ছাপ মুছে ফেলার কথাও মাথায় রাখবে।

সেটা সত্যি হতে পারে কিন্তু অনুসন্ধান করে দেখাটা আমার কর্তব্য।

আমি আসলে, এই মুহূর্তে তোমাকে সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিচ্ছি আর আমি এখন থেকে এখানের দায়িত্ব সামলাব।

এনডারসন শক্ত হয়ে যায়। এটা ঠিক ওএসর এক্তিয়ারে পড়ে না, তাই?

অবশ্যই পড়ে। এটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার একটা বিষয়।

পিটারের হাত? তন্দ্রালু চোখে তাদের কথোপকথন শোনার ফাঁকে ল্যাংডন। ভাবে। জাতীয় নিরাপত্তা? ল্যাংডন বুঝতে পারে সাটোর লক্ষ্য আর পিটারকে। খুঁজে বের করতে তার প্রতিজ্ঞা ঠিক এক বিন্দুতে সমাপতিত হচ্ছে না। ওএস ডিরেকটর মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে কথা বলছে।

এনডারসনকেও বিভ্রান্ত দেখায়। জাতীয় নিরাপত্তা? ম্যাম যথেষ্ট সম্মান পূর্বক–

আমি শেষবার যখন দেখেছি, সাটো তাকে থামিয়ে দেয়, আমি তখন তোমার চেয়ে উচ্চতর পর্যায়ে ছিলাম। আমি তোমাকে পরামর্শ দেব ঠিক আমার কথামত কাজ করতে আর কোন প্রশ্ন না করে।

এনডারসন মাথা নাড়ে আর কষ্ট করে ঢোক গিলে। কিন্তু আমাদের কি হাতের ছাপটা অন্তত নিয়ে নিশ্চিত হওয়া উচিত না যে ওটা আদতেই পিটার সলোমনের কব্জি?

আমি নিশ্চিত করছি, গা গুলিয়ে উঠা নিশ্চয়তায় ল্যাংডন বলে। আমি তার আংটি…এবং তার হাত চিনি। সে একটুক্ষন চুপ করে থাকে। যদিও উল্কিগুলো নতুন করা হয়েছে। কেউ একজন সম্প্রতি কাজটা করেছে।

আমি দুঃখিত? আজকের সন্ধ্যায় এই প্রথমবারের মত সাটোকে বিচলিত দেখায়। হাতে উল্কি করা?

ল্যাংডন সম্মতি জানায়। বৃদ্ধাঙ্গুলির ডগায় একটা মুকুট। তর্জনীর ডগায় একটা তারকা। সাটো একটা চশমা বের করে হাতটার দিকে এগিয়ে যায়, হাঙরের মত হেলতেদুলতে।

এছাড়া, ল্যাংডন বলে, যদিও অন্য তিনটা আঙ্গুল দেখা যাচ্ছে না, আমি নিশ্চিত তাদের মাথাতেও উল্কি আঁকা রয়েছে।

সাটোকে মন্তব্যটা কৌতূহলী করে তুলে এবং সে মাথা নাড়িয়ে এনডারসনকে আদেশ দেয়। চীফ আপনি কি আমাদের পক্ষে বাকী আঙ্গুল তিনটা দেখতে পারেন?

এনডারসন কব্জির পাশে উবু হয়ে বসে, সর্তক থাকে যেন স্পর্শ না করে। সে তার একপাশের গাল মেঝেতে ঠেকিয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ আঙ্গুলের দিকে তাকায়। ম্যাম তার কথাই ঠিক। সবগুলো আঙ্গুলের ডগায় উল্কি আঁকা রয়েছে অবশ্য আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কিসের-

একটা সূর্য, একটা লণ্ঠন আর একটা চাবি, ল্যাংডন নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে।

সাটো এবার পুরোপুরি ল্যাংডনের দিকে তাকায়, তার খুদে চোখে প্রশংসার আভা। এবং আপনি এটা কিভাবে জানেন?

ল্যাংডন পাল্টা তাকায়। মানুষের হাতের এমন প্রতিকৃতি, যার আঙ্গুলের ডগায় এমন প্রতিকৃতি খোদিত রয়েছে, খুব প্রাচীন একটা আইকন। এটাকে রহস্যময়তার হাত বলে অভিহিত করা হয়।

এনডারসন আঁচমকা উঠে দাঁড়ায়। এই জিনিষের একটা নাম আছে?

ল্যাংডন মাথা নাড়ে। প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম গোপন আইকনের একটা!

সাটো ঘাড় কাত করে তাকায়। ইউ.এস ক্যাপিটলের ঠিক মধ্যেখানে এটা কি করছে আমি কি সেটা জানতে পারি?

ল্যাংডন কামনা করে সে ঘুম ভেঙে দেখবে পুরোটাই একটা দুঃস্বপ্ন। প্রথাগতভাবে ম্যাম এটা আমন্ত্রণ জানাতে ব্যবহৃত হয়।

আমন্ত্রণ…কিসের? সে জানতে চায়।

ল্যাংডন ঘাড় নামিয়ে বন্ধুর কাটা হাতের চিহ্নগুলোর দিকে তাকায়। শত শত বছর ধরে রহস্যময়তার হাত একটা রহস্যময় আমন্ত্রণ জানিয়ে আসছে। মূলত- গোপন জ্ঞান গ্রহণের আমন্ত্রণ- সুরক্ষিত জ্ঞান যা কেবল কিছু অভিজাতই জানে।

সাটো তার হাত দুটো ভাঁজ করে এবং কৃষ্ণ কালো চোখ তুলে তার দিকে তাকায়। বেশ, প্রফেসর, সে কেন এখানে এসেছে সে বিষয়ে কিছুই জানে না। এমন দাবী করা একজনের পক্ষে…তুমি বেশ ভালই কাজ দেখিয়েছে।

.

১৮ অধ্যায়

ক্যাথরিন সলোমন তার সাদা ল্যাব কোট গায়ে চাপায় এবং এখানে আগমনের পরে সে সচরাচর করে থাকে তাই করতে শুরু করে- তার রাউণ্ডস ভাই যেভাবে তাদের অভিহিত করতো।

উদ্বিগ্ন অভিভাবক যেভাবে ঘুমন্ত শিশু ঠিক আছে কিনা দেখে, ঠিক একইভাবে ক্যাথরিন মেকানিক্যাল রুমে মাথা বের করে উঁকি দেয়। হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল নির্বিঘ্নে চলছে, অতিরিক্ত ট্যাঙ্কও তাদের র‍্যাকে বহাল তবিয়তে আছে।

ক্যাথরিন এবার হল ধরে হেঁটে তথ্য-সংরক্ষণ কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। বরাবরের মতই, বাড়তি দুটো হলোগ্রাফিক ব্যাকআপ ইউনিট তাদের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত ভল্টে নিরাপদে গুঞ্জন করে চলেছে। আমার সমস্ত গবেষণা, তিন ইঞ্চি পুরু ভঙ্গুর নিরোধী কাঁচের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে থেকে সে ভাবে। হলোগ্রাফিক তথ্য সংরক্ষণ অনুষঙ্গ, রেফ্রিজারেটরের মত দেখতে তাদের উত্তরসুরীদের মত না, বরং সুঠামদেহী স্টেরিও কমপনেন্টের মত দেখতে, প্রতিটা একটা কলাম আঁকৃতির ধারকের উপরে স্থাপিত।

তার গবেষণাগারের দুটো হলোগ্রাফিক অনুষঙ্গই একই রকম দেখতে আর তাদের ভিতরে সমন্বয় সামঞ্জস্য করা রয়েছে বাড়তি ব্যাকআপ হিসাবে তারা ব্যবহৃত হয় তার কাজের হুবহু কপির নিরাপত্তা কবচ হিসাবে। বেশিরভাগ ব্যাকআপ প্রটোকলে জোর দেয়া হয় ভূমিকম্প, আগুন বা চুরির হাত থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ রক্ষা করতে অন্য স্থানে দ্বিতীয় একটা ব্যাকআপ সিস্টেম রাখতে, কিন্তু ক্যাথরিন আর তার ভাই দুজনেই একমত যে গোপনীয়তার গুরুত্ব অপরিসীম; এই ভবন থেকে তথ্য একবার বাইরের কোন সার্ভারে পৌঁছালে, তারা কোন মতেই নিশ্চয়তা দিতে পারবে না যে সেটা গোপন থাকবে।

এখানে সবকিছু ঠিকঠাক মত চলছে সে বিষয়ে সন্তুষ্ট হয়ে, হলওয়ে ধরে সে ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করে। বাঁক ঘুরতেই সে ল্যাবের ভিতরে অপ্রত্যাশিত কিছু একটা লক্ষ্য করে। এর মানে কি? সমস্ত উপকরণ থেকে একটা মৃদু আভা বিকিরিত হচ্ছে। সে দ্রুত এগিয়ে আসে ব্যাপারটা ভাল করে দেখার জুন্য, সে কাছে এসে বিস্মিত হয়ে দেখে কন্ট্রোল রুমের প্রেক্সিগ্লাসের পেছন থেকে আলো। বিকিরিত হচ্ছে।

সে এখানে। ক্যাথরিন ল্যাবটা যেন উড়ে অতিক্রম করে, কন্ট্রোলরুমে কাছে পৌঁছে এক ঝটকায় দরজাটা খুলে। পিটার! দৌড়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে সে বলে।

কন্ট্রোলরুমের টার্মিনালে বসে থাকা নাদুসনুদুস মহিলা চমকে দাঁড়িয়ে যায়। হা ঈশ্বর ক্যাথরিন! তুমি আমাকে চমকে দিয়েছো!

ত্রিস ডান-পৃথিবীতে একমাত্র ব্যক্তি যার এখানে প্রবেশের অনুমতি আছে-ক্যাথরিনের মেটাসিস্টেম এ্যানালিস্ট এবং মাঝে মাঝে ছুটির দিনেও কাজ করে। ছাব্বিশ বছর বয়স্ক লাল চুলের মেয়েটা একজন জিনিয়াস ডাটা মডেলার এবং কেজিবিও বর্তে যাবে এমন একটা ননডিসক্লোজার ডকুমেন্ট স্বাক্ষর করেছে। আজ রাতে সে আপাত দৃষ্টিতে কন্ট্রোল রুমের প্লাজমা দেয়ালে তথ্য বিশ্লেষণে ব্যস্ত একটা বিশাল ফ্ল্যাট স্ক্রীন ডিসপ্লে যা দেখলে মনে হবে নাসার মিশন কন্ট্রোল রুম কানা করে নিয়ে আসা হয়েছে।

দুঃখিত, ত্রিস বলে। আমি জানতাম না যে তুমি ইতিমধ্যে এসেছে। আমি তুমি আর তোমার ভাই হাজির হবার আগেই সব কিছু শেষ করার চেষ্টা করছিলাম।

তার সাথে কি তোমার কথা হয়েছে? সে আজ বেশ দেরী করছে এবং আমার ফোনও ধরছে না।

ত্রিস মাথা ঝাঁকায়। আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুমি তাকে নতুন যে আইফোনটা দিয়েছো সেটা নিয়েই সে মগ্ন হয়ে রয়েছে।

ক্যাথরিন ত্রিশের রসিকতাবোধ উপভোগই করে এবং ব্রিসকে এখানে দেখে তার মনে একটা আইডিয়া আসে। আমি কৃতজ্ঞ তুমি আজ রাতে এখানে আছ বলে। তুমি যদি কিছু মনে না কর, তাহলে আমাকে কি একটা বিষয়ে সাহায্য করবে?

সে যাই হোক, আমি নিশ্চিত বিষয়টা ফুটবলের চেয়ে উত্তেজনাকর।

ক্যাথরিন গভীর একটা শ্বাস নেয়, মনকে প্রশমিত করতে। আমি জানি না। বিষয়টা কিভাবে ব্যাখ্যা করবো, কিন্তু আজ সকালের দিকে, আমি একটা আজব গল্প শুনেছি…

.

ত্রিস ডান জানেনা ক্যাথরিন কি গল্প শুনেছে, কিন্তু স্পষ্টতই গল্পটা তাকে বিভ্রান্ত করে তুলেছে। তার বসের সচরাচর শান্ত ধুসর চোখে আজ উদ্বিগ্নতা এবং ঘরে প্রবেশের পরে সে তিনবার চুল কানের পেছনে খুঁজেছে- সন্ত্রস্ততার স্মারক বলে ত্রিস যাকে অভিহিত করে। চৌকষ বিজ্ঞানী। বেকুব জুয়াড়ী।

আমার কাছে, ক্যাথরিন বলে, গল্পটাকে কল্পকাহিনীর মত মনে হয়েছে. প্রাচীন একটা কিংবদন্তি সম্বন্ধে। এবং তারপরেও…সে কথা থামিয়ে, আরো একবার কানের পেছনে চুল গুঁজে রাখে।

এবং তারপরেও?

ক্যাথরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এবং তারপরেও আজ আমাকে একটা বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানান হয়েছে কিংবদন্তিটা সত্যি।

ঠিক আছে। সে আসলে কি বলতে চাইছে?

আমি আমার ভাইয়ের সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাই কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে সেটা করার আগে তুমি আমাকে এ বিষয়ে কিছু জ্ঞান দিতে পার। আমি জানতে চাই এই কিংবদন্তিটা ইতিহাসের অন্য কোন অধ্যায়ে কখনও সত্য বলে সমর্থিত হয়েছে কি না।

পুরো ইতিহাসে?

ক্যাথরিন মাথা নাড়ে। পৃথিবীর যে কোন স্থানে, যে কোন ভাষায়, ইতিহাসের যে কোন সময়ে।

আজব অনুরোধ, ত্রিস ভাবে, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই সম্ভব। দশ বছর আগে কাজটা অসম্ভব ছিল। আজ, অবশ্য, ইন্টারনেটের সহায়তায়, দি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব, এবং মহান সব পাঠাগারকে ডিজিটাইজ করার প্রক্রিয়া চলমান থাকায়, ক্যাথরিনের অনুরোধ, যে কোন সাধারণ সার্চ ইঞ্জিনকে অনুবাদক্ষম মডিউল আর ভাল করে বাছাই করা কি-ওয়ার্ডে সমৃদ্ধ করে কাজে লাগিয়ে দিলেই, রাখা সম্ভব।

কোন সমস্যা নেই, ত্রিস বলে। গবেষণাগারের রিসার্চে ব্যবহৃত অনেক বইয়ে প্রাচীন ভাষায় লিখিত অনুচ্ছেদ আছে, এবং ত্রিসকে প্রায়ই বিশেষায়িত অপটিক্যাল ক্যারেকটার রিকগনিশন ট্রান্সলেশন মডিউল লিখতে যা দিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় লিখিত ভাষ্য ইংরেজীতে রূপান্তরিত হবে। পৃথিবীর বুকে সেই সম্ভবত একমাত্র মেটাসিস্টেম বিশেষজ্ঞ যে প্রাচীন ফ্রিসিয়ান, মায়েক আর আক্কাডিয়ান এর জন্য ওসিআর ট্রান্সলেশন মডিউল তৈরী করেছে।

মডিউলগুলো কাজে আসবে, কিন্তু একটা কার্যকরী অনুসন্ধানী মাকড়সা তৈরী করার মূল রহস্য লুকিয়ে আছে সঠিক কি-ওয়ার্ড নির্বাচনে। অনন্য কিন্তু বেশি মাত্রায় রক্ষনশীল নয়।

ক্যাথরিন দেখা যায় ত্রিশের চেয়ে একধাপ এগিয়ে রয়েছে এবং সে ইতিমধ্যে সম্ভাব্য কি-ওয়ার্ড একটা কাগজে লিপিবদ্ধ করে ফেলেছে। ক্যাথরিন। কয়েকটা শব্দ লিখে থেমে কিছু একটা ভাবে তারপরে আবার কয়েকটা শব্দ লিখে। ঠিক আছে, অবশেষে সে লেখা শেষ করে ত্রিসকে কাগজটা দেয়।

সার্চ স্ট্রিঙ লেখা কাগজটা ত্রিস মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখে এবং তার চোখ বড়বড় হয়ে উঠে। এটা আবার কেমন উদ্ভট কিংবদন্তির অনুসন্ধান করতে চাইছে ক্যাথরিন? তুমি চাও আমি এসব বাক্যাংশ ব্যবহার করে সার্চ দেই? শব্দগুলোর একটাকে ত্রিস চিনতেই পারে না। এটা কি ইংলিশ? তোমার কি মনে হয় আমরা এসব কিছু একটা স্থানে খুঁজে পাব? ভার্বাটিম?আমি চেষ্টা। করে দেখতে চাই।

ত্রিস আর একটু হলেই অসম্ভব বলে বসত কিন্তু অ-যুক্ত শব্দ এখানে ব্যবহার। করা নিষেধ। ক্যাথরিন মনে করে যে যেখানে পূর্বধারণা অনুযায়ী মিথ্যা নিমেষে। নিশ্চিত সত্যে পরিণত হয় সেখানে এধরণের মানসিক-স্থিতি বিপজ্জনক। ত্রিস ডান সত্যিই সন্দেহ হয় এই কি-ওয়ার্ড সার্চ আদতেই সেই কাতারে পড়ে।

ফলাফল পেতে কত সময় লাগবে? ক্যাথরিন জানতে চায়।

মাকড়সা লিখে ওয়েবে ছাড়তে কয়েক মিনিট সময় লাগবে। তারপরে, হয়ত মিনিট পনের লাগবে মাকড়সা ক্লান্ত হতে।

এত দ্রুত? ক্যাথরিনকে আশাবাদী দেখায়।

ত্রিস নড করে। প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিন পুরো দিন লাগিয়ে দেবে গোটা অনলাইন বিশ্ব পরিক্রমায়, নতুন ডকুমেন্ট খুঁজে বের করবে, উপাত্ত হজম করবে এবং সেটা তাদের সার্চেবল ডাটাবেসে শেষে যোগ করবে। কিন্তু ত্রিস এধরণের অনুসন্ধানী মাকড়সা লিখবে না।

আমি যে প্রোগ্রাম লিখব তার নাম ডেলিগেটর, ত্রিস ব্যাখ্যা করে। এটা পুরোপুরি বিধিসম্মত না, কিন্তু এটা দ্রুত কাজ করে। আসলে এটা এমন একটা প্রোগ্রাম যে অন্যদের সার্চ ইঞ্জিনকে আমাদের কাজ করার আদেশ দেয়। অধিকাংশ ডাটাবেসেই বিল্ট-ইন সার্চ ফাংশন থাকে- গ্রন্থাগার, জাদুঘর, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারী। আর কি, আমি এমন একটা মাকড়সা লিখেছি যা তাদের এসব সার্চ ইঞ্জিন খুঁজে বের করে, তোমার কি-ওয়ার্ড সরবরাহ করে তাদের সার্চ করতে বলবে। আর এভাবে, আমরা হাজার ইঞ্জিনের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে, একসাথে কাজ করব।

ক্যাথরিনকে মুগ্ধ দেখায়। প্যারালাল-প্রসেসিং।

এক ধরণের মেটাসিস্টেম। আমি কিছু খুঁজে পেলে তোমাকে ডাকব।

ত্রিস, আমি তোমার কাজের প্রশংসা করি। ক্যাথরিন তার কাঁধে চাপড় দিয়ে দরজার উদ্দেশ্যে হাঁটা দেয়। আমি লাইব্রেরীতে আছি।

ত্রিস জুত করে বসে, প্রোগ্রামটা লিখতে। তার মত এমন দক্ষতার কারো কাছে সার্চের জন্য মাকড়সা কোডিং করা অনেকটা কেরানীর পর্যায়ে পড়ে কিন্তু ত্রিস ডান অন্য ধাতুতে গড়া সে এসবের পরোয়া করে না। ক্যাথরিন সলোমনের জন্য সে সব কিছু করতে পারে। কখনও কখনও ত্রিস নিজের সৌভাগ্যকেই বিশ্বাস করতে পারে না যে সে এখানে এসে পৌঁছেছে।

বাছা, তুমি অনেকদূর এসে পড়েছে।

মাত্র এক বছর আগে, ত্রিস হাই-টেক ইণ্ডাস্ট্রির অনেক কক্ষযুক্ত ফার্মে মেটাএনালিস্টের চাকরী ছেড়ে দেয়। বেকার থাকাকালীন সময়টা সে ফ্রীলান্স প্রোগ্রামিং আর একটা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ব্লগ শুরু করে-ফিউঁচুার এপ্লিকেশন ইন কম্পিউটেশনাল মেটাসিস্টেম এনালাইসিস- যদিও তার ব্যক্তিগত ধারণা ছিল সেটা কেউ পড়ে দেখে না। তারপরে একদিন সন্ধ্যাবেলা তার ফোন বাজে।

ত্রিস ডান? মার্জিত কণ্ঠে এক মহিলা প্রশ্ন করেন। বলছি, অনুগ্রহ করে বলবেন কে কথা বলছিলেন? আমার নাম ক্যাথরিন সলোমন।

ত্রিস আরেকটু হলে মাথা ঘুরে পড়ে যেত। ক্যাথরিন সলোমন? আমি মাত্র আপনার বই–নিওটিক সাইন্স:মডার্ণ গেটওয়ে টু অ্যানশিয়েন্ট উইসডম-পড়েছি আর আমার ব্লগে এটার বিষয়ে মন্তব্য করেছি!

হ্যাঁ, আমি জানি, দ্রমহিলা মার্জিতভঙ্গিতে জবাব দেয়। আমি সেজন্যই ফোন করেছি।

অবশ্যই সে জন্য। ক্যাথরিন বুঝতে পেরে, বেকুব বনে যায়। এমনকি চৌকষতম বিজ্ঞানীও গুগল ব্যবহার করে।

তোমার ব্লগ আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছে, ক্যাথরিন তাকে বলে। আমি জানতাম না মেটাসিস্টেম মডেলিং এতদূর এগিয়েছে।

হ্যাঁ, ম্যাম, ত্রিস চন্দ্রাহত কণ্ঠে উত্তর দেয়। ডাটা মডেল বিকাশমান প্রযুক্তি যার সম্ভাবনা অপার।

পরবর্তী কয়েক মিনিট, দুই মহিলা ত্রিশের মেটাসিস্টেম নিয়ে কাজ, অগনিত ডাটা ফিল্ডের প্রবাহ বিশ্লেষণ, মডেলিং আর ভবিষ্যত্বাণী করার অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করে।

অবশ্য, আপনার বইয়ের বিষয়বস্তু আমার মাথার অনেক উপর দিয়ে হারিয়ে গেছে, ত্রিস বলে, কিন্তু আমি একটা বিষয় বুঝতে পেরেছি আমার মেটাসিস্টেমের এর সাথে কোথাও একটা যোগসূত্র রয়েছে।

তোমার ব্লগে তুমি লিখেছো নিওটিক চর্চাকে বদলে দিতে পারে মেটাসিস্টেম মডেলিং?

অবশ্যই। আমার বিশ্বাস মেটাসিস্টেম নিওটিককে সত্যিকারের বিজ্ঞানে পরিণত করতে পারবে।

বাস্তব বিজ্ঞান? ক্যাথরিনের কণ্ঠস্বরে সামান্য উম্মার আভাস। প্রচলিত ধারণার বিপক্ষে…?

এইরে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। উম, আমি আসলে বলতে চেয়েছি নিওটিক অনেক…দুর্বোধ্য।

ক্যাথরিন হেসে উঠে। শান্ত হও, আমি ঠাট্টা করছিলাম। আমি সবসময়ে এমনই করি।

আমি মোটেই অবাক হইনি, ক্রিস ভাবে। ক্যালিফোর্নিয়ার নিওটিক সাইন্স অনুষদ এর কাজের ক্ষেত্রকে গূঢ় আর রহস্যময় ভাষায় বর্ণনা করে, একে মানবজাতির স্বাভাবিক বোধ আর যুক্তিগ্রাহ্যতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের বাইরের জ্ঞানের সাথে প্রত্যক্ষ আর তাৎক্ষণিক সংযোগএর অম্বেষণ বলে অভিহিত করেছে।

নিওটিক শব্দটা, ক্রিস জেনেছে প্রাচীন গ্রীক শব্দ নিওস থেকে গৃহীত ভাষান্তরিত করলে যার একটা চলনসই মানে দাঁড়ায় অন্তজ্ঞান বা সহজাত চেতনা।

আমি তোমার মেটাসিস্টেম এর ব্যাপারে জানতে আগ্রহী, ক্যাথরিন বলে, আর এটা কিভাবে আমার বর্তমান একটা প্রজেক্টে অন্তর্ভূক্ত করা যায়। আমরা কি দেখা করতে পারি? আমি তোমার মস্তিষ্ক কাজে লাগাতে চাই।

ক্যাথরিন সলোমন আমাকে কাজে লাগাতে চায়? ব্যাপারটা অনেকটা মারিয়া শারাপোভার তার কাছে টেনিস টিপস চাওয়ার মত।

পরেরদিন একটা সাদা ভলভো ত্রিশের বাড়ির সামনে এসে থামে এবং তার ভেতর থেকে নীল জিনস পরিহিত আকর্ষণীয় আর নমনীয় চেহারার একজন ভদ্রমহিলা বের হন। ত্রিস সাথে সাথে টের পায় সে দুই ফুট লম্বা হয়ে গেছে। দারুণ, সে গুঙিয়ে উঠে বলে। স্মার্ট, ধনী আর তন্বী- আর আমারও বিশ্বাস করা উচিত ঈশ্বর মহিমাময়। কিন্তু ক্যাথরিনের অমায়িত ব্যবহার অচিরেই ত্রিসকে সহজ স্বাভাবিক করে তোলে।

তারা দুজন ত্রিশের বাসার পেছনের বারান্দা যেখান থেকে অনেকটা খোলা জায়গা চোখে পড়ে সেখানে বসে আলাপ করে।

তোমার বাসাটা অসাধারণ, ক্যাথরিন বলে।

ধন্যবাদ। কলেজে পড়ার সময়ে সৌভাগ্যক্রমে আমি আমার লিখিত কয়েকটা সফটওয়্যারের লাইসেন্স পেয়ে যাই।

মেটাসিস্টেম বিষয়ক।

মেটাসিস্টেমের পূর্বসূরী। ৯/১১ এর পরে সরকার অকল্পনীয় পরিমাণ ডাটা ফিল্ড ইন্টারসেপ্ট আর তথ্য খতিয়ে দেখে ব্যক্তিগত ই-মেইল, সেলফোন, ফ্যাক্স, টেক্সট, ওয়েবসাইট- সন্ত্রাসবাদীদের পারস্পরিক যোগাযোগের ব্যবহৃত কি-ওয়ার্ডের সন্ধানে। আমি একটা প্রোগ্রাম লিখি যা তাদের বিকল্প উপায়ে ডাটা প্রসেসে সাহায্য করে…একটা বাড়তি ইনটিলিজেন্স ভাণ্ডার কাজে লাগিয়ে। কথা শেষ করে সে হাসে। বস্তুতপক্ষে আমার সফটওয়্যারই তাদের আমেরিকার উত্তাপ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে।

আমি দুঃখিত।

ত্রিস হাসে। হাহ, পাগলের প্রলাপের মত শোনাচ্ছে, আমি জানি। আসলে আমি বলতে চাইছি সফটওয়্যারটা আমেরিকার আবেগকে পরিমাপ করতে সাহায্য করেছে। তুমি চাইলে একে এক ধরণের কসমিক সচেতনতার ব্যারোমিটারও বলতে পার। ত্রিস ব্যাখ্যা করে, কিভাবে জাতির পারস্পরিক যোগাযোগের ডাটা ক্ষেত্র ব্যবহার করে, নির্দিষ্ট কি-ওয়ার্ড আবির্ভাবের ঘনতু এবং ডাটা ফিল্ডের আবেগ সূচক এর উপর ভিত্তি করে জাতির মানসিক স্থিতি বিবেচনা করা সম্ভব। সহজ সময়ে ভাষাও সহজ থাকে, আর সঙ্কটকালে তার উল্টো। সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের ক্ষেত্র, উদাহরণ হিসাবে দেখলে, সরকারের লোকজন ডাটা ফিল্ড ব্যবহার করে আমেরিকার মানসিকতার তারতম্য যাচাই করতে পারবে এবং এই ঘটনার মানসিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দিতে পারবে।

চিত্তগ্রাহী, ক্যাথরিন চিবুক চুলকিয়ে বলে। তো তুমি ব্যক্তিমানুষের সংখ্যা পর্যালোচনা…যেন পুরোটাই একক অর্গানিজম।

ঠিক তাই। মেটাসিস্টেম। একটা একক অস্তিত্বকে তার অনুষঙ্গের যোগফল দ্বারা প্রকাশ করা। মানবদেহ, যেমন, অগণিত আলাদা আলাদা কোষের সমন্বয়ে গঠিত, প্রত্যেকটার ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আর উদ্দেশ্য রয়েছে, কিন্তু একটা একক অস্তিত্ব হিসাবে কাজ করে।

উৎসাহী ভঙ্গিতে ক্যাথরিন মাথা নাড়ে। অনেকটা পাখির ঝাক বা মাছের দলের একসাথে বিচরণের মত। আমরা একে কনভারজেন্স বা এনট্যাঙ্গলমেন্ট বলি।

ত্রিস বুঝতে পারে তার বিখ্যাত অতিথি নিজের নিওটিক ক্ষেত্রে মেটাসিস্টেম প্রোগ্রামিংএর সম্ভাবনা দেখতে শুরু করেছে। আমার সফটওয়্যার, ত্রিস ব্যাখ্যা করে, সরকারী সংস্থাগুলোকে বিশাল-মাত্রার বিপর্যয়ের সময়ে দক্ষতার সাথে মূল্যায়ন আর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে সাহায্য করে- মহামারী মাত্রার সংক্রামন, জাতীয় ট্র্যাজেডি, সন্ত্রাসী তৎপরতা, এইসব আরকি। সে দম নেবার জন্য থামে। অবশ্য, অন্য ক্ষেত্রে একে ব্যবহার করার সম্ভাবনাও আছে…যেমন জাতির মানসিক স্থিতি বিশ্লেষণ করে ভোটের ফলাফল আগাম আঁচ করা দিনের শুরুতে শেয়ার মার্কেটের গতিপথ সম্পর্কে ধারণা।

বেশ শক্তিশালী বলেই মনে হচ্ছে।

ত্রিস তার বিশাল বাসাটার প্রতি ইঙ্গিত করে। সরকারও তাই মনে করে।

ক্যাথরিনের ধুসর চোখ এবার তার উপরে নিবদ্ধ হয়। ত্রিস আমি কি তোমার কাজের নৈতিক বিড়ম্বনার কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

আপনি কি বলতে চাইছেন?

আমি বলতে চাইছি তুমি এমন একটা সফটওয়্যার তৈরী করেছে যা সহজেই অন্য কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। যাদের কাছে এটা রয়েছে তারা এমন সব তথ্য জানে যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তুমি এটা তৈরী করে কখনও ব্ৰিতবোধ করনি?

ত্রিস চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়। একেবারেই না। আমার সফটওয়্যার বলতে গেলে অন্যদের থেকে আলাদা কিছু…যেমন ফ্লাইট সিমুলেটর, কিছু না। অনুন্নত দেশের কেউ কেউ প্রাথমিক চিকিৎসা দেবার জন্য বিমান চালনা শিখতে এটা ব্যবহার করে থাকে। আবার কেউ কেউ যাত্রীবাহী বিমান আঁকাশচুম্বী দালানে উড়িয়ে এনে আছড়ে ফেলার জন্য ব্যবহার করে। জ্ঞান একটা হাতিয়ার, আর অন্য সব হাতিয়ারের মতই, এর ফলাফল ব্যবহারকারীর মতির উপরে নির্ভরশীল।

ক্যাথরিন মুগ্ধচিত্তে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। আচ্ছা তোমাকে একটা হাইপোথেটিক্যাল প্রশ্ন করি।

ত্রিস হঠাৎ বুঝতে পারে তাদের সাক্ষাৎকার এই মাত্র চাকরীর ইন্টারভিউ এ পর্যবসিত হয়েছে।

ক্যাথরিন নীচু হয়ে মেঝে থেকে বালির একটা কণা তুলে নেয়, যাতে ক্যাথরিন সেটা দেখতে পায়। আমার কাছে, সে বলে, মনে হয়েছে, তোমার মেটাসিস্টেম বালুর একটা কণা একবার ওজন করে…পুরো সমুদ্রতটের ওজন নির্ণয় করতে সক্ষম।

হ্যাঁ, তাত্ত্বিকভাবে।

তুমি জানই যে এই ক্ষুদ্র বালুর কণার ভর আছে। খুবই নগন্য যার পরিমাণ কিন্তু তারপরেও সেটা একটা ভর।

ত্রিস মাথা নাড়ে।

আর বালুর এই কণার যেহেতু ভর আছে, তারমানে মাধ্যাকর্ষণ এর উপরে ক্রিয়াশীল। আবার বলছি নগণ্য পরিমাণে কিন্তু ক্রিয়াশীল।

ঠিক।

এখন, ক্যাথরিন বলে, আমরা যদি এমন ট্রিলিয়ন বালুর কণা নিয়ে তাদের পরস্পরকে আঁকৃষ্ট করতে দেই ধর…চাঁদ গঠন করতে, তখন তাদের সমন্বিত মাধ্যাকর্ষণ পুরো সমুদ্রকে আন্দোলিত করতে, তার স্রোতকে আমাদের গ্রহের উপরে পরিচালিত করতে পারবে।

ত্রিস বুঝতে পারে না আলোচনাটা কোথায় যাচ্ছে কিন্তু তার শুনতে বেশ ভালই লাগছে।

আচ্ছা আরেকটা হাইপোথেটিক্যাল পরিস্থিতি বিবেচনা করি, বালির কণাটা ঝেড়ে ফেলে ক্যাথরিন বলে। আচ্ছা ধর আমি তোমাকে বললাম যে চিন্তা…তোমার মস্তিষ্কে জন্ম নেয়া যেকোন ক্ষুদ্র ধারণার…ভর আছে? খুবই নগণ্য পরিমাণ কিন্তু ভর নিঃসন্দেহে। তখন এর সংশ্লিষ্ট সম্ভাবনা কতখানি?

হাইপোথেটিক্যালি বলব? বেশ, নিশ্চিত সম্ভাবনা হল…যদি ভাবনার ভর থেকেই থাকে, তাহলে তার উপরে মাধ্যাকর্ষণ ক্রিয়াশীল হবে এবং তা অন্য বস্তুকে নিজের দিকে আর্কষণ করবে।

ক্যাথরিন হাসে। তুমি দুর্দান্ত। এখন আরেকটু সামনে দেখো। একসাথে অনেক মানুষ যদি একই ভাবনা নিয়ে ভাবতে শুরু করে? ঐ একই ভাবনার প্রতিক্রিয়া পরস্পরের সাথে সন্নিবেশিত হতে শুরু করবে আর সংযোগের ফলে। এই ভাবনার ভর বাড়তে শুরু করবে। আর এরফলে মাধ্যাকর্ষণও বাড়বে।

ঠিক আছে।

মানেটা হল…অনেক মানুষ যদি একই জিনিস ভাবতে শুরু করে তখন সেই ভাবনার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি উপেক্ষা করা সম্ভব না…এবং সেটা তখন বাস্তব শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। ক্যাথরিন চোখ মটকায়। আর এটা তখন আমাদের পার্থিব পৃথিবীর উপরে নিরুপনযোগ্য প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে।

.

১৯ অধ্যায়

ডিরেকটর ইনউ সাটো, হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে চোখে সন্দিহান দৃষ্টি এটে ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে এই মাত্র সে যা বলল সেসব খতিয়ে ডাবে। সে বলেছে যে সে একটা প্রাচীন সিংহদ্বার অবারিত করতে চায়? প্রফেসর, এটা জেনে আমার কি উদ্ধার হবে?

ল্যাংডন দূর্বল ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকায়। তার আবার বমি বমি পাচ্ছে এবং চেষ্টা করছে যাতে মেঝেতে পড়ে থাকা বন্ধুর কাটা কব্জির দিকে যত কম তাকান যায়। আমাকে সে ঠিক এই কথাই বলেছে। একটা প্রাচীন সিংহদ্বার…এই ভবনের কোথাও লুকান রয়েছে। আমি তাকে বলেছি আমি এমন কোন সিংহদ্বারের কথা জানি না।

তাহলে তার কেন মনে হয়েছে তুমি এটা খুঁজে বের করতে পারবে?

বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাটা হদ্দ পাগল। সে বলেছে পিটার পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। ল্যাংডন পুনরায় পিটারের ঊর্ধ্বমুখী আঙ্গুলের দিকে তাকায়, আবারও তার অপহরণকারীর শব্দ নিয়ে নির্মম খেলার কথা মনে পড়তে বিরক্তিতে মনটা বিষিয়ে উঠে। পিটার পথ দেখাবে। ল্যাংডন ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বমুখী আঙ্গুলের দিক অনুসরন করে মাথার উপরের গম্বুজটা দেখে নিয়েছে। একটা সিংহদ্বার? উপরে ওখানে? উন্মাদ।

আমাকে যে লোকটা ফোন করেছিল, ল্যাংডন সাটোকে বলে, সে আমাকে বলেছিল যে আজরাতে আমার ক্যাপিটলে আসবার কথা কেবল মাত্র সেই জানে, তাই যে তোমাকে বলেছে আমি আজ রাতে এখানে আছি তোমার তাকেই খুঁজে বের করা উচিত আগে। আমি বলবো

তথ্য আমি কোথা থেকে পেয়েছি সেটা তোমার না জানলেও চলবে, সাটো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, এই মুহূর্তে তাকে সহযোগিতা করা আমার কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয় এবং আমার কাছে আরও তথ্য আছে যার আলোকে বলা যায় যে সে যা চায় কেবলমাত্র তুমিই তাকে সেটা খুঁজে দিতে পার।

এবং আমার প্রধান বিবেচ্য বিষয় আমার বন্ধুকে খুঁজে বের করা, ল্যাংডন হতাশ কণ্ঠে উত্তর দেয়।

সাটো খুব জোরে একটা শ্বাস নেয়, বোঝাই যায় সে তার ধৈর্য্যের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। তুমি যদি সলোমনকে খুঁজে বের করতে চাও, আমাদের একটাই করনীয় আছে, প্রফেসর- সে কোথায় আছে যে লোকটা জানে তার সাথে সহযোগিতা করা। সাটো তার ঘড়ি দেখে। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। আমি তোমাকে নিশ্চিত করতে পারি এই লোকটার দাবী দ্রুত মিটিয়ে দেয়াটা আমাদের জন্য জরুরী।

কিভাবে? ল্যাংডন কণ্ঠে অবিশ্বাস নিয়ে জানতে চায়। একটা প্রাচীন সিংহদ্বার সনাক্ত করে সেটা খুলে দিয়ে। সিংহদ্বার বলে কিছু নেই, ডিরেকটর সাটো। ঐ ব্যাটা একটা হা-মুখ পাগল।

সাটো, ল্যাংডনের থেকে এক ফিট দূরে এসে দাঁড়ায়। আমি যদি ব্যাপারটা এভাবে বলি…তোমার ঐ পাগল আজ সকালে দুজন বুদ্ধিমান লোককে বেকুব বানিয়েছে। সে সোজা ল্যাংডনের চোখের দিকে তাকায় তারপরে এণ্ডারসনের দিকে। আমি যাদের নিয়ে কাজ করি তাদের ভিতরে পাগল আর প্রতিভাবানের ভিতরে পার্থক্যের মাত্রা খুবই নগণ্য। এই লোকটাকে আরেকটু শ্রদ্ধার সাথে। আমাদের অভিহিত করা উচিত।

সে একজন লোকের কব্জি কেটে নিয়েছে!

আমিও সেটাই বলছি। এমন কাজ কোন নিপ্রতিজ্ঞ বা অনিশ্চিত লোকের পক্ষে করা সম্ভব না। তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, প্রফেসর, এই লোকটা আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করে তুমি তাকে সাহায্য করতে সক্ষম। সে তোমাকে কতদূর থেকে ওয়াশিংটনে নিয়ে এসেছে- আর এত ঝামেলা করার পেছনে তার নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।

সে আমাকে বলেছে আমি এই সিংহদ্বার খুলতে পারবো বলে সে মনে করার একমাত্র কারণ পিটার তাকে বলেছে আমিই খুলতে পারবো।

আর পিটার সলোমন এটা কেন বলবে যদি সেটা সত্যি না হয়?

আমি নিশ্চিত পিটার এধরণের কিছুই বলেনি। আর যদি বলেই থাকে তবে চাপে পড়ে বলেছে। সে বিভ্রান্ত হয়ে আছে…অথবা ভীত।

হ্যাঁ, একে বলে জেরাকালীন নির্যাতন আর বড্ড কার্যকরী। মি. সলোমনের সত্য কথা বলার আরও কারণ আমরা পেয়ে গেলাম। সাটো এমনভাবে কথাটা বলে যেন এ বিষয়ে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। সেকি তোমাকে বলেছে পিটার কেন মনে করে যে কেবল তুমিই সিংহদ্বার খুলতে সক্ষম?

ল্যাংডন মাথা নাড়ে।

প্রফেসর, তোমার খ্যাতি যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে তুমি আর পিটার সলোমন তোমাদের দুজনের এসব বিষয়ে সমান আগ্রহ রয়েছে-গোপন রহস্য, ঐতিহাসিক দুর্বোধ্যতা, মরমীবাদ এবং আরও সবকিছু। পিটারের সাথে তোমার আগে যখন কথা হয়েছে তখন সে তোমাকে ওয়াশিংটন ডি.সিতে কোন গোপন সিংহদ্বারের কথা কখনও কি বলেছিল?।

ল্যাংডনের বিশ্বাস হতে চায় না যে সিআইএর একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এমন প্রশ্ন তাকে করেছে। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত। পিটার আর আমি অনেক গোপন বিষয় নিয়ে কথা বলেছি, কিন্তু আমি দিব্য দিয়ে বলতে পারি, সে যদি কখনও আমাকে বলতো যে একটা প্রাচীন সিংহদ্বার এখানে কোথাও লুকান রয়েছে, আমি তাহলে তাকে পাগলের ডাক্তারের কাছে যেতে বলতাম। বিশেষ করে, সেটা যদি আবার প্রাচীন রহস্যের সাথে জড়িত হয়।

সে মুখ তুলে তাকায়। আমি দুঃখিত? লোকটা তোমাকে সুনির্দিষ্ট করে বলেছে এই সিংহদ্বারটা কোন রহস্যের দিকে ইঙ্গিত করে?

হ্যাঁ, কিন্তু তার সেটা করার কোন কারণ নেই, ল্যাংডন হাতটার দিকে দেখিয়ে বলে। রহস্যময়তার হাত রহস্যময় তোরণ অতিক্রম করে প্রাচীন গুপ্ত জ্ঞান অর্জনের একটা নিয়মতান্ত্রিক আমন্ত্রণ- শক্তিশালী জ্ঞান যাকে প্রাচীন রহস্য…বা সবযুগের হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান।

তো তুমি শুনেছ এখানে কোন গোপনীয়তা লুকান রয়েছে বলে সে মনে করে।

ভুরি ভুরি ঐতিহাসিক এসব জানে।

তাহলে তুমি কিভাবে সিংহদ্বারের অস্তিত্ব অস্বীকার করছো?

ম্যাম মাফ করবেন, কিন্তু আমরা সবাই অমরত্বের কুয়ো এবং শাঙরি-লার কথা শুনেছি, কিন্তু তারমানে কি এই যে সে সব কিছুরই অস্তিত্ব আছে।

এণ্ডারসনের রেডিওর জান্তব আঁকুতিতে তাদের কথোপকথনে ছেদ পড়ে।

চীফ? রেডিও থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর বলে।

এনডারসন তার রেডিও এক ঝটকায় বেল্ট থেকে তুলে নিয়ে আসে। এনডারসন বলছি।

স্যার, আমরা পুরো এলাকা তল্লাশি শেষ করেছি। এমন কাউকে পাইনি যার সাথে বর্ণনা মিলে। আর কোন নির্দেশ আছে কি, স্যার?

এনডারসন সাটোর দিকে এক ঝলক তাকায়, বোঝাই যায় সে একটা ভর্ৎসনা আশা করছে, কিন্তু সাটো নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে। এনডারসন সাটো আর ল্যাংডনের কাছ থেকে দূরে সরে এসে, মৃদু স্বরে তার রেডিওতে কথা বলে।

সাটো এক দৃষ্টিতে ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তুমি বলতে চাইছো ওয়াশিংটনে লুকিয়ে রাখা যে গোপনীয়তায় সে বিশ্বাস করে…সেটা পুরোটাই কাল্পনিক?

ল্যাংডন মাথা নাড়ে। খুব প্রাচীন একটা কিংবদন্তি। প্রাচীন রহস্যের গোপনীয়তা আসলে খ্রিস্টান ধর্মের পূর্বের বিষয়। হাজার বছরের পুরানো।

আর তারপরেও এটা বেঁচেবর্তে আছে?

আরও অনেক অসম্ভব বিশ্বাসের সাথে। ল্যাংডন প্রায়ই তার ছাত্রদের সর্তক করে বলে যে আধুনিক ধর্মে যেসব গল্প সন্নিবেশিত রয়েছে সেগুলো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় উতরে যেতে পারবে নাঃ সবকিছু মুসা লোহিত সাগর দ্বিখণ্ডিত করা থেকে শুরু করে…জোসেফ স্মিথের জাদুর চশমা যা দিয়ে সে অনেকগুলো সোনার পাতে লেখা বুক অব মরমন তরতরিয়ে অনুবাদ করেছে যা সে নিউইয়র্কের উপকণ্ঠে মাটি খুড়ে বের করেছে। কোন ধারণার গ্রহণযোগ্যতা তার বৈধতার প্রমাণ হতে পারে না।

আচ্ছা। তাহলে এসব প্রাচীন রহস্য…এগুলো কি?

ল্যাংডন হাল ছেড়ে দেয়। তোমার কয়েক সপ্তাহ সময় হবে? সংক্ষেপে, প্রাচীন রহস্য একটা পূর্ণাঙ্গ গোপন জ্ঞানের কথা বলে যা অনেক আগে অর্জিত। এর একটা কৌতূহলকর দিক হল, অনুশীলনকারী, মানব মনে লুক্কায়িত প্রচণ্ড ক্ষমতা ব্যবহারের অধিকারী হয় বলে দাবী করাটা। আলোকপ্রাপ্ত দীক্ষিত যারা এই জ্ঞান অর্জন করেছে তারা শপথ নেয় সাধারনের কাছ থেকে এটা আড়াল করে রাখবে কারণ অদিক্ষিত কারও জন্য এই একই জ্ঞান বিপজ্জনক আর প্রাণনাশক বলে প্রতিয়মান হতে পারে।

কিভাবে বিপজ্জনক?

আমরা যে কারণে বাচ্চাদের কাছ থেকে দিয়াশলাই লুকিয়ে রাখি ঠিক একই কারণে। যোগ্য লোকের হাতে পড়লে আগুন আলো দেয়…কিন্তু অযোগ্য বা খল কারো হাতে পড়লে একই আগুন বিধ্বংসী হয়ে উঠে।

সাটো চোখের চশমা খুলে মনোযোগ দিয়ে দেখে। প্রফেসর, তোমার কি মনে হয় এমন শক্তিশালী তথ্যের আদতেই কোন অস্তিত্ব আছে?

ল্যাংডন বুঝতে পারে না সে কিভাবে উত্তর দেবে। তার একাডেমিক পেশায় প্রাচীন রহস্য সবচেয়ে স্ববিরোধী একটা বিষয় বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে। পৃথিবীর বুকে যত মরমীবাদী দল রয়েছে একটা ধারণাকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে সেটা হল একটা রহস্যময় গোপন জ্ঞান রয়েছে যা মানুষের ভিতরে ঈশ্বরের মত ক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে পারে: ট্যারট আর আই চিঙ মানুষকে ভবিষ্যত দেখার ক্ষমতা দেয়; এ্যালকেমী পরশপাথরের সাহায্যে মানুষকে অমরত্ব দান করে; উইকা ভবিষ্যতদ্রষ্টাদের শক্তিশালী সম্মোহনী ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দেয়। তালিকার কোন শেষ নেই।

পেশাজীবি পণ্ডিত হিসাবে, ল্যাংডন এইসব প্রথার ঐতিহাসিক নথী অস্বীকার করতে অপারগ- অসংখ্য পাণ্ডুলিপি, নৃতাত্ত্বিক অনুষঙ্গ, শিল্পকর্ম বস্তুতপক্ষে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয় প্রাচীনকালে শক্তিশালী জ্ঞান আসলেই ছিল যা তারা রূপক, পূরাণ, আর চিহ্নের ভিতর দিয়ে আমাদের জন্য রেখে গেছে, নিশ্চিত করেছে যে কেবল সঠিকভাবে উদ্যোগ নিলেই কেবল এই ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যাবে। একই সাথে বাস্তববাদী আর সংশয়বাদী হবার কারণে ল্যাংডন আজও নিশ্চিত হতে পারেনি।

আমি যদি সংশয়বাদী হই, সে সাটোকে বলে। আমি বাস্তব পৃথিবীতে কখনও এমন কিছু দেখিনি যা থেকে মনে হতে পারে প্রাচীন রহস্য কিংবদন্তি ছাড়া অন্যকিছু পুনরাবৃত্ত হওয়া পৌরাণিক আদিরূট। আমার কাছে মনে হয়েছে মানুষের পক্ষে যদি অতিন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সম্ভব হত, তবে তার নজির থাকতে বাধ্য। আর এখন পর্যন্ত, আমরা ইতিহাসে এমন কোন লোক খুঁজে পাইনি যার অতিমানবীয় ক্ষমতা ছিল।

সাটো ভ্রূ তির্যক আঁকৃতি ধারণ করে। পুরোটা কিন্তু সত্যি না।

ল্যাংডন ইতস্তত করে, বুঝতে পারে অনেক ধার্মিক লোকের কাছে মানুষ ঈশ্বরের নজির আছে, যাদের ভিতরে যীশুখ্রিস্ট অন্যতম। সর্বজনস্বীকৃতভাবে, সে বলে, অনেক শিক্ষিত লোক আছে যারা এই ক্ষমতাদারী জ্ঞানর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাদের দলে আমি পড়ি না।

পিটার সলোমন কি তাদের একজন? মাটিতে পড়ে থাকা কাটা হাতের দিকে তাকিয়ে সাটো জানতে চায়।

ল্যাংডন কাটা হাতের দিকে না তাকিয়ে পারে না। পিটার এমন একটা পরিবার থেকে এসেছে যাদের প্রাচীন আর রহস্যময় সব কিছুর প্রতি একটা আবেগ ছিল।

আমি কি প্রকারান্তে হ্যাঁ বলতে শুনলাম? সাটো জানতে চায়।

আমি আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি পিটার প্রাচীন রহস্য সত্যি বলে যদি বিশ্বাসও করত তারপরেও সে এটা বিশ্বাস করতো না ওয়াশিংটন ডিসিতে

একটা লুকান সিংহদ্বার দিয়ে সেখানে পৌঁছান সম্ভব। সে মেটাফোরিক্যাল সিম্বলিজম ভালই বোঝে, মুশকিল হয়েছে তার বন্দিকর্তা একেবারেই বোঝে না।

সাটো মাথা নাড়ে। তার মানে তুমি বলছো এই সিংহদ্বার আদতে একটা রূপক।

অবশ্যই, ল্যাংডন বলে। যাই হোক, তাত্ত্বিকভাবে। এটা খুবই প্রচলিত রূপক- একটা আধ্যাত্মিক দ্বার দিক্ষিত হতে হলে একজনকে সেটার ভিতর দিয়ে অতিক্রম করতে হবে। সিংহদ্বার বা দেওড়ি বহুল ব্যবহৃত প্রতীকি নির্মাণ যা রূপান্তরের কৃত্যানুষ্ঠানের উপস্থাপক। এখন আক্ষরিক অর্থে সিংহদ্বার খোঁজার অর্থ হল সত্যিসত্যি স্বর্গের দরজা খোঁজার সামিল।

এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় সাটো বোধহয় ব্যাপারটা মেনে নেবে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে মি. সলোমনের বন্দিকর্তা বিশ্বাস করে তুমি সত্যিকারের সিংহদ্বার খুলতে সক্ষম।

ল্যাংডন হেদিয়ে পড়ে। গোড়া মৌলবাদীরা যে ভুল করেছে সেও ঠিক একই ভুল করেছে-রূপককে আক্ষরিক অর্থে সত্যি মনে করার বিভ্রান্তি। একইভাবে, গোড়ার দিকের এ্যালকেমিস্টরা সীসাকে সোনায় পরিণত করার চেষ্টা করেছে, কখনও বুঝতে চেষ্টা করেনি সীসা থেকে সোনা মানুষের আসল সম্ভাবনার উন্মেষের একটা রূপক ছাড়া আর কিছুই না- মানে একটা ভোলা অজ্ঞ মস্তিষ্ককে আলোকিত, চৌকষ করে তোলা।

সাটো হাতটার দিকে দেখায়। লোকটা যদি শুধু চায় যে তুমি তার জন্য কোন একটা সিংহদ্বার সনাক্ত কর তাহলে সে তোমাকে সরাসরি কেন জিজ্ঞেস করতে আসল না সেটা খুঁজে দেবার প্রস্তাব নিয়ে? এত নাটক কেন? উল্কি আঁকা হাত তোমার কাছে পাঠাল কেন?

ল্যাংডন এই একই প্রশ্ন আগেই নিজেকে করেছে আর উত্তরটাও সুবিধার না। বেশ, মনে হচ্ছে আমরা যে লোকটার কথা আলোচনা করছি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হবার সাথে সাথে তার জ্ঞানের পরিধিও বিশাল। হাতটা প্রমাণ করে যে সে রহস্যের সাথে বেশ ভালভাবেই পরিচিত আর সেই সাথে গোপনীয়তার রীতিও জানে। এই ঘরটার ইতিহাসের কথা না হয় বাদই দিলাম।

আমি বুঝতে পারলাম না।

আজ রাতে সে যা যা করেছে সবই প্রাচীন প্রথার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্য রেখে করা হয়েছে। প্রথাগতভাবে, রহস্যময়তার হাত একটা পবিত্র আমন্ত্রণ আর সেজন্য সেটাকে একটা পবিত্র স্থানেই উপস্থাপিত করতে হবে।

সাটো চোখ সরু করে তাকায়। ইউ.এস ক্যাপিটল ভবনের রোটানডা এটা, প্রফেসর, কোন প্রাচীন রহস্যের পবিত্র মন্দির না।

আসলে তাই, ম্যাম, ল্যাংডন বলে। আমি অনেক ঐতিহাসিককে চিনি যারা আপনার কথার বিরোধিতা করবে।

.

সেই সময়ে, শহরের অন্যপ্রান্তে, ত্রিস ডান কিউবের ভিতরে প্লাজমা ওয়ালের আভার সামনে বসে রয়েছে। তার অনুসন্ধানী মাকড়সা তৈরী করা শেষ এবং সে ক্যাথরিনের দেয়া পাঁচটা শব্দ সমষ্টি টাইপ করে।

কোন নড়াচড়া নেই।

খানিকটা আশাবাদী হয়ে, ওয়ার্ল্ডওয়াইড সমুদ্রে মাছ ধরতে সে তার মাকড়সা ছেড়ে দেয়। অকল্পনীয় গতিতে, শব্দ সমষ্টিগুলোর সারা পৃথিবীর

ভাষ্যের সাথে তুলনা শুরু হয়…হুবহু মিল খুঁজছে।

ত্রিস ভাবতে চেষ্টা করে এসবের মানে কি, কিন্তু সলোমনদের সাথে কাজ করতে এসে সে একটা জিনিস মেনে নিয়েছে পুরো গল্পটা তুমি কখনও জানতে পারবে না।

.

২০ অধ্যায়

রবার্ট ল্যাংডন উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তার হাতঘড়ির দিকে তাকায়: সন্ধ্যা ৭:৫৮। মিকি মাউসের হাসি মুখ তাকে খুব একটা আপুত করে না। পিটারকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে। আমরা সময় নষ্ট করছি।

সাটো এক মুহূর্তের জন্য একটা পাশে সরে গিয়েছিল ফোনে কথা বলতে, কিন্তু এখন সে আবার ল্যাংডনের কাছে ফিরে এসেছে। প্রফেসর, আমার কারণে কি আপনার কোথাও বিলম্ব হচ্ছে?

না, ম্যাম, শার্টের হাতা ঘড়ির উপর টানতে টানতে ল্যাংডন বলে। আমি আসলে পিটারের কথা ভাবছি।

আমি বুঝি সেটা, কিন্তু আমি আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি তার বন্দিকর্তার মানসিক স্থিতি বুঝতে আমাকে সাহায্য করে আপনি আসলে পিটারকেই সাহায্য করবেন।

ল্যাংডন পুরোপুরি নিশ্চিত না, কিন্তু সে একটা বিষয় বুঝতে পারে ওএস ডিরেকটর তার কাঙ্খিত তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত সে কোথাও নড়তে পারছে না।

কিছুক্ষণ আগে, সাটো বলে, আপনি বলছিলেন প্রাচীন রহস্যের ধারণায় এই রোটানডা কোনভাবে পবিত্র?

হ্যাঁ, ম্যাম।

ব্যাখ্যা করেন।

ল্যাংডন বুঝতে পারে তাকে খুব বুঝেশুনে শব্দ চয়ন করতে হবে। ওয়াশিংটন ডি.সির অতীন্দ্রিয় প্রতিকতার উপরে পুরো একটা সেমিস্টার পড়িয়েছে, আর এই ভবনটারই খালি অসংখ্য মরমিয়া শরণের প্রায় শেষ না হওয়া একটা তালিকা আছে।

আমেরিকার একটা গোপন অতীত রয়েছে।

আমেরিকার সিম্বলজি সম্বন্ধে ল্যাংডন যখনই কথা বলে, তার ছাত্ররা এটা জানতে পেরে বেকুব বনে যায় যে এখন রাজনীতিবিদরা যা দাবী করে তার কোন কিছুর সাথে আমাদের জাতির পিতৃপুরুষদের সত্যি অভিপ্রায়ের কোন মিলই নেই।

আমেরিকার অভিষ্ট গন্তব্য ইতিহাসের বাঁকে হারিয়ে গেছে।

এই রাজধানী শহর আমাদের পূর্বপুরুষ যারা ভিত্তি স্থাপন করেছিল প্রথমে নাম রেখেছিল রোম। তারা পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীর নাম রেখেছিল টিবের আর মন্দির এবং সমাধিসৌধ, যেখানে ইতিহাসের সব মহান দেবদেবীর প্রতিমা সজ্জিত একটা ধ্রুপদী রাজধানী গড়ে তুলেছিল- এ্যাপোলো, মিনার্ভা, ভেনাস, হেলিওস, ভলকান, জুপিটার। অন্যসব মহান ধ্রুপদী শহরের ন্যায় এই শহরের কেন্দ্রস্থলেও প্রাচীনদের উৎসর্গ করে একটা মজবুত নিদর্শন স্থাপন করেছিল। মিশরীয় ওবেলিস্ক। কায়রো বা আলেকজান্দ্রিয়ার চেয়ে উঁচু এই ওবেলিস্ক, আঁকাশের বুকে ৫৫৫ ফিট উঠে গেছে, ত্রিশতলা ভবনের চেয়েও উঁচু, দেবতুল্য পূর্বপুরুষ যার জন্য এই শহর নতুন নাম পেয়েছে তাকে ধন্যবাদ আর শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।

ওয়াশিংটন।

এখন, কয়েক শতাব্দি পরে, আমেরিকা যদিও চার্চ আর রাষ্ট্র আলাদা করে দিয়েছে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই রোটানডা তখনও প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিকতায় উদ্ভাসিত। রোটানডায় ডজনেরও বেশি দেবতা রয়েছেন- রোমের আদি সর্বদেবতার মন্দিরের চেয়েও বেশি। অবশ্য, রোমান মন্দির ৬০৯ এ খ্রিস্টত্ব। বরণ করেছিল, কিন্তু এই মন্দিরকে কখনও গোত্রান্তিরিত করা হয়নি; এর আসল ইতিহাসের চিহ্ন চোখের সামনে এখনও বর্তমান।

আপনি হয়ত জানেন, ল্যাংডন বলে, এই রোটানডাকে রোমের অন্যতম পৃজিত মন্দিরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন পূর্বক নক্সা করা হয়েছিল। দি টেম্পল অব ভেসতা।

ভেসতাল ভার্জিনের মত? সাটোকে সন্দিহান দেখায় সে রোমের অগ্নিশিখার কুমারী অভিভাবকদের সাথে ইউ.এস ক্যাপিটলের যোগসূত্র ধরতে পারে না।

রোমে অবস্থিত টেম্পল অব ডেসতা, ল্যাংডন বলে, বৃত্তাকার, যার মেঝেতে একটা মুখ ব্যাদান করে থাকা গর্ত রয়েছে, যার ভিতর দিয়ে দীক্ষার আলোর পরিচর্যা করত কুমারী মেয়ের দল, যাদের দায়িত্ব ছিল আগুনের শিখা প্রজ্জ্বলিত রাখা।

সাটো কাঁধ ঝাঁকায়। এই রোটানডাও বৃত্তাকার কিন্তু আমি মেঝেতে কোন গর্ত দেখতে পাচ্ছি না।

না এখন আর নেই, কিন্তু বহুবছর ঠিক পিটারের হাতটা যেখানে রয়েছে সেখানে একটা বিশাল শূন্যস্থান ছিল। ল্যাংডন মেঝের দিকে ইঙ্গিত করে বলে। বস্তুত পক্ষে, আপনি এখনও মেঝেতে বেষ্টনীর চিহ্ন দেখতে পাবেন লোকজন যাতে পড়ে না যায় সেজন্য দেয়া হয়েছিল।

কি? মেঝে দেখতে দেখতে সাটো জানতে চায়। আমি কখনও শুনিনি।

মনে হচ্ছে তার কথাই ঠিক। এনডারসন একদা বেষ্টনী ছিল এমন বৃত্তাকার লোহার ঢেলার দিকে ইঙ্গিত করে। আমি আগেও এটা লক্ষ্য করেছি, কিন্তু কখনও বুঝতে পারিনি এখানে কেন দেয়া হয়েছিল।

তুমি একলাই নও, ল্যাংডন ভাবে, প্রতিদিন আসা হাজার হাজার মানুষের কথা চিন্তা করে, যাদের ভিতরে খ্যাতনামা আইন প্রণয়নকারীরাও আছে, রোটানডার কেন্দ্রের উপর দিয়ে হেঁটে যায় কোন ধারণা ছাড়াই যে এমনও দিন। ছিল যখন এখান দিয়ে হাঁটতে গেলে তারা একেবারে ক্যাপিটল ক্রিপ্ট ভূগর্ভস্থ কক্ষে আছড়ে পড়ত-রোটানডার মেঝের নীচে অবস্থিত স্তর।

মেঝের গর্ত, ল্যাংডন বলে, শেষ পর্যন্ত ঢেকে দেয়া হয় কিন্তু বহুদিন রোটানডায় আগত দর্শনার্থী নীচে প্রজ্জ্বলিত আগুন সরাসরি দেখতে পেত।

সাটো ঘুরে দাঁড়ায়। আগুন? ইউ.এস ক্যাপিটলে?

অনেকটা মশালের মত আসলে একটা অনন্ত শিখা আমাদের ঠিক নীচে অবস্থিত ভূগর্ভস্থ কক্ষে জ্বলত। মেঝের গর্ত দিয়ে সেটা দেখা যাবার কথা ছিল, যা এই ঘরটাকে আধুনিক টেম্পল অব ভেসতার মহিমা দান করবে। এই ভবনের নিজস্ব ভেসতাল ভার্জিন কুমারীও ছিল- রাষ্ট্রীয় কর্মচারী যাদের বলা হত কিপার অব দি ক্রিপ্ট- যারা সাফল্যের সাথে পঞ্চাশ বছর আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল, যতক্ষণ না রাজনীতি, ধর্ম আর ধোয়ায় দম বন্ধ হয়ে ধারণাটা নিভে না যায়।

এনডারসন আর সাটোকে দেখে মনে হবে ভূত দেখেছে।

আজকাল, কোন এক সময়ে অগ্নি শিখা জ্বলত তার একমাত্র অবশিষ্টাংশ হল তাদের একতলা নীচে ক্রিপ্টের মেঝেতে স্থাপিত চার-দিক নির্দেশিত স্টার কম্পাস- আমেরিকার অনন্ত শিখার প্রতীক, যা একদা নতুন পৃথিবীর চারপ্রান্ত আলোকিত করত।

তো প্রফেসর, সাটো বলে, তোমার যোগসূত্রটা হল যে পিটারের হাতটা রেখে গেছে সেও এসব জানে?

পরিষ্কার। এবং আরো বেশি জানে। প্রাচীন রহস্যের প্রতি বিশ্বাস। প্রতিফলিত হয় এমন অনেক প্রতীক এক ঘরে ছড়িয়ে আছে।

গোপন জ্ঞান, সাটোর কন্ঠে শ্লেষ ও অন্যকিছুর আভাস পাওয়া যায়। জ্ঞান যা মানুষকে ঈশ্বরের মত ক্ষমতাবান করবে?

হ্যাঁ, ম্যাম।

এই দেশে খ্রিস্টানদের বাড়বাড়ন্তের সাথে ব্যাপারটা ঠিক খাপ খায়না।

তাই মনে হবে, কিন্তু কথাটা সত্যি। মানুষের এই ঈশ্বরে রূপান্তরিত হওয়া একে বলা হয় এ্যাপোথেসিস, দেবত্ব অর্জন। আমি জানি না আপনি জানেন কিনা, এই ধারণাটা- মানুষের ঈশ্বরে রূপান্তর-রোটানড়ার প্রতীকতার মর্মবস্তু।

এ্যাপোথেসিস? এণ্ডারসনের চোখের দৃষ্টিতে প্রত্যাভিজ্ঞা।

হ্যাঁ। এনডারসন এখানেই কাজ করে। সে জানে। এ্যাপোথেসিস শব্দটার আক্ষরিক অর্থ দিব্য রূপান্তর- মানে মানুষ দেবতায় পরিণত হয়। প্রাচীন গ্রীক থেকে এসেছে: এ্যপো- পরিণত হওয়া, থিওস- দেবতা।

এনডারসনকে বিমোহিত দেখায়। এ্যাপোথেসিস মানে দেবহু অর্জন করা? আমার কোন ধারণাই ছিল না।

আমার মাথার উপর দিয়ে কি যায়? সাটো জানতে চায়।

ম্যাম, ল্যাংডন বলে, এই ভবনটায় সবচেয়ে বড় চিত্রকর্মটার নাম দি এ্যাপোথেসিস অব ওয়াশিংটন। আর সেটাতে পরিষ্কারভাবে জর্জ ওয়াশিংটনের দেবতায় রূপান্তর ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

সাটোর সন্দেহ যেতে চায় না। আমি কখনও এধরণের কিছু দেখিনি।

আমি নিশ্চিত, আপনি দেখেছেন। ল্যাংডন তার তর্জনী দিয়ে সোজা উপরের দিকে দেখায়। ঠিক আপনার মাথার উপরে অবস্থিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *