উপন্যাস

০১. অবরোহমূলক সিদ্ধান্ত বিজ্ঞান

অবরোহমূলক সিদ্ধান্ত বিজ্ঞান

ম্যান্টলপিসের কোণ থেকে বোতলটা নামিয়ে আনল শার্লক হোমস, সুদৃশ্য মরক্কো কেস থেকে বার করল ইঞ্জেকশন দেওয়ার হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ! দীর্ঘ, সাদা, কম্পিত আঙুল দিয়ে সরু উঁচটা ঠিক করে লাগিয়ে গুটিয়ে নিল শার্টের বাঁ-হাতা। চিন্তামগ্ন চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল শিরা-বার-করা বাহুর ওপর অসংখ্য ফুটো ফুটো দাগের দিকে–সবই উঁচ ফোঁটানোর দাগ চামড়ার চেহারা পর্যন্ত পালটে গিয়েছে। শেষকালে ফের ছুঁচ ফুটাল সেই দাগের ওপরেই, তীক্ষ্ণ্ণ সূচীমুখ আস্তে আস্তে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল চামড়ার তলায়, ছোট্ট পিস্টনে চাপ দিয়ে সবটুকু তরল পদার্থ চালান করল শরীরের মধ্যে এবং নরম পরিতৃপ্তির সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে এলিয়ে পড়ল মখমল মোড়া হাতল-চেয়ারের পিঠে।

দিনে তিনবার হিসেবে বহু মাস ধরে এই একই কাণ্ড দেখে আসছি আমি। কিন্তু গায়ে পড়ে বলাটা সৌজন্য-বিরোধী বলে কিছু বলিনি। বরং ভেতরে ভেতরে বিবেকের দংশন অনুভব করেছি, মুখের ওপর কিছু বলার সাহস নেই বলে এবং না-বলতে পারার জ্বালায় তিল তিল করে খিচিয়ে উঠেছে মেজাজটা। প্রতিবার এই দৃশ্য দেখেছি, মনে মনে সংকল্প করেছি, আর নয়, এবার দু-কথা শুনিয়ে ছাড়ব। কিন্তু প্রতিবারই বন্ধুবরের শান্ত, বেপরোয়া মুখচ্ছবি দেখে পিছু হটে এসেছি। দুনিয়ায় সে কাউকে পরোয়া করে না এবং স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ একেবারে পছন্দ করে না। ওকে দেখছি অনেকদিন, দেখেছি ওর সাহস কত সুদূরপ্রসারী, চিনেছি ওর কর্তৃত্বময় ব্যক্তিত্ব, পেয়েছি ওর বহু বিচিত্র অসাধারণ সম্যক পরিচয়, জেনেছি ওর বিরাট শক্তি কী বিচিত্র–তাই ঘাঁটাতে চাইনি–সাহসও পাইনি–কাপুরুষের মতো পালিয়ে এসেছি।

কিন্তু সেদিন বিকেলে কী যে হল আমার, দুপুরে খেতে বসে বোন মদ খাওয়ার ফল কি না জানি না, দিনের পর দিন এই দৃশ্য দেখে ধৈর্যচ্যুতি ঘটার জন্যেও হতে পারে অথবা ওর ধরনধারণের মধ্যে সুগভীর নিবিষ্টতা দেখার জন্যেও হতে পারে–হঠাৎ মনে হল, আর সহ্য করা যায় না।

জিজ্ঞেস করলাম, আজ কী? মর্ফিন, না কোকেন?

কালো হরফে ছাপা একটা প্রাচীন গ্রন্থ খুলে বসেছিল হোমস। আমার কথায় অবসন্ন চোখ তুলল বইয়ের পাতা থেকে।

বললে, কোকেন–সেভেন পার্সেন্ট সলিউশন। পরখ করে দেখবে নাকি।

নিশ্চয় না, ঝটিতি বললাম আমি। আফগান ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি আমার শরীর, বাড়তি বোঝা আর চাপাতে চাই না।

মৃদু হাসল হোমস। বলল, হয়তো তুমি ঠিকই বলেছ ওয়াটসন। জিনিসটার শারীরিক প্রতিক্রিয়া খারাপ হলেও হতে পারে তবে কী জান, এর আধ্যাত্মিক প্রসাদ এতই চনমনে যে বলবার নয়। মনকে কাচের মতো স্পষ্ট করে তোলে। সেটাও মুখ্য লাভ। গৌণ প্রতিক্রিয়া সে তুলনায় নগণ্য।

আন্তরিক সুরে বললাম, কিন্তু কী দাম দিতে হচ্ছে তার বিনিময়ে, সেটা কি ভেবেছ? ব্রেন উত্তেজিত হচ্ছে ঠিকই, সুষুপ্তি থেকে যেন নতুন উত্তেজনায় জেগে উঠেছে কিন্তু সেটা দেহের কোষের সর্বনাশ ঘটিয়ে তবে হচ্ছে–টিসুগুলো আরও বেশি পালটে যাচ্ছে বলেই হচ্ছে–শেষকালে আসছে একটা স্থায়ী অবসাদ, দুর্বলতা। তুমি নিজেও টের পাও একটা আচ্ছন্নতায় ঢেকে যায় তোমার সমস্ত চেতনা। ক্ষতি যা হচ্ছে, সে তুলনায় লাভটাই বরং অতি সামান্য। ঈশ্বর তোমাকে অনেক প্রতিভা দিয়ে পাঠিয়েছেন, অসামান্য সেইসব ক্ষমতার সর্বনাশ কেন করছ সাময়িক সুখের জন্য? নিছক বন্ধু হিসেবে এত কথা বললাম ভেব না যেন, ডাক্তার হিসেবেও আমার একটা কর্তব্য আছে–তোমার শরীরের সর্বনাশ ঘটলে জবাবদিহি আমাকে করতে হবে।

কথার তোড়ে হোমসের গায়ে আঁচ লাগল বলে মনে হল না–ক্ষুব্ধ হল না বিন্দুমাত্র। উলটে আঙুলের দশ ডগা একত্র করে চেয়ারের হাতলে কনুই রেখে এমনভাবে হেলান দিয়ে বসল যেন আলোচনাটা বেশ জুতসই এবং মনের মতো।

বললে, ভায়া আমার এই মনটা জড়সড় থাকতে চায় না মোটেই–বিদ্রোহ করে বসে নিশ্চলতার বিরুদ্ধে। সমস্যা দাও, জটিলতম সাংকেতিক ধাঁধা দাও, কাজ দাও, সূক্ষ্মতম বিশ্লেষণ দাও, মন আমার অমনি ঠান্ডা হয়ে যাবে, বিদ্রোহী মনকে শায়েস্তা রাখার ওই একমাত্র দাওয়াই আমার মনের খোরাকও তাই। তখন কিন্তু কৃত্রিম উত্তেজকের আর দরকার হয় না। কিন্তু একঘেয়ে জীবনযাত্রা আমার দু-চক্ষের বিষ। আমি চাই মানসিক উত্তেজনা–মন যেন সদ্য উদবেলিত থাকে নিত্যনতুন সমস্যায়, রোমাঞ্চময়, প্রহেলিকাময়। এ-পেশা নিয়েছি তো সেই কারণেই বলতে পার পেশাটা সৃষ্টিই করেছি আমি–কেননা তাবৎ বিশ্বে আমিই এক এবং অদ্বিতীয়।

এক এবং অদ্বিতীয় বেসরকারি গোয়েন্দা? বললাম ভুরু তুলে।

এক এবং অদ্বিতীয় বেসরকারি কনসাল্টিং গোয়েন্দা জবাব দিল হোমস। গোয়েন্দাগিরিতে আপিল করতে গেলে আমি ছাড়া আর গতি গোয়েন্দাগিরিতে সর্বোচ্চ আর সর্বশেষ আদালত বলতে গেলে আমিই। গ্রেগসন, লেসট্রেড অথবা অ্যাথেলনি জোন্স যখন হালে পানি পায় না–ওদের বিদ্যেবৃদ্ধিতে ওর চাইতে বেশিও সম্ভব নয়–তখন কেস নিয়ে ধরনা দেয় আমার কাছে। বিশেষজ্ঞর মতোই কেসটার খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করি, বিশ্লেষণ করি, তারপর বিশেষজ্ঞের মতোই মতামত প্রকাশ করি। এসব কেসে কৃতিত্ব দাবি করি না–খবরের কাগজেও আমার নাম বেরোয় না! কাজের মধ্যে আমার আনন্দ আমার, বিচিত্র ক্ষমতাকে উপর্যুক্ত পরিবেশে প্রকাশ করতে পারাটাই আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। জেফারসন হোপের সঙ্গে আমার কাজের ধারার কিছু অভিজ্ঞতা তোমার হয়েছে।

তা হয়েছে, বললাম সহৃদয় কণ্ঠে, জীবনে এমন চমকান চমকাইনি। অভিজ্ঞতা তোমার লিখেও ফেলেছি ছোট্ট বইয়ের আকারে। নাম হয়েছে একটু ফ্যানটাসটিক এ স্টাডি ইন

স্কারলেট।

বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল হোমস।

বলল, পাতা উলটে দেখেছি বইটার। সত্যি কথা বলতে কী, প্রশংসা করতে পারছি না তোমাকে। গোয়েন্দাগিরি জিনিসটা একটা নির্জলা বিজ্ঞান। এ-জিনিস লেখাও উচিত সেইভাবে আবেগহীন নিরুত্তাপভাবে। কিন্তু তুমি তার মধ্যে রোমান্স ছিটিয়েছ যখন তখন ফলটা হয়েছে বদখত ধরনের ইউক্লিডের পঞ্চম উপপাদ্যের সঙ্গে প্রেমের গল্প অথবা প্রেয়সীকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার গল্প মিশিয়ে দিলে যা দাঁড়ায় তোমার কাহিনিও দাঁড়িয়েছে সেইরকম।

প্রতিবাদের সুরে বললাম, সে কী কথা! রোমান্স তো ছিল জেফারসন হোপের কেসে। ঘটনাকে বিকৃত করার অধিকার তো আমার নেই।

কিছু কিছু ঘটনা চেপে যাওয়াই উচিত, অথবা লেখবার সময়ে একটু মাত্রাজ্ঞান রাখা উচিত। কেসটায় একটাই পয়েন্ট আছে উল্লেখ করবার মতো এবং তা আমাকে নিয়ে কীভাবে কার্য থেকে কারণে বিচিত্র যুক্তিতর্কের মধ্যে দিয়ে আমি উপনীত হলাম এবং রহস্য ফস করে ছাড়লাম।

খুবই বিরক্ত হলাম কথার ধরন শুনে। কাহিনিটা লিখলাম যার তুষ্টি সাধনের জন্যে, সে-ই কিনা যা মুখে আসে তাই বলছে এতদিনকার প্রচেষ্টা নিয়ে। মেজাজ খিচড়ে গেল ওর দম্ভের জন্যেও বটে। বলে কিনা কাহিনির প্রতিটি লাইন উৎসর্গ করা উচিত ছিল স্তুতিবাদে। বেকার স্ট্রিটে এক বাড়িতে একসঙ্গে থাকতে গিয়ে এই ক-বছরের মধ্যে লক্ষ করেছি বন্ধুবরের প্রশান্ত, নীতিগর্ভ আচরণের তলায় উঁকি মারে ছোট্ট অহংকার। তাই আর কোনো মন্তব্য করলাম না। জখম পা-টায় হাত বুলোতে লাগলাম চেয়ারে বসে। দীর্ঘকাল আগে একটা ডিজেল বুলেট ঢুকেছিল পায়ে। হাঁটতে কষ্ট না-হলেও ঋতু পরিবর্তনের সময়ে মাথাচাড়া দেয় পুরোনো ব্যথাটা।

কিছুক্ষণ পরে সেকেলে ব্রায়ার পাইপটায় তামাক ঠাসতে ঠাসতে হোমস বললে, সম্প্রতি মহাদেশের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়েছে আমার প্র্যাকটিস। গত হপ্তায় আমার পরামর্শ নিয়ে গেছে ফাসোয়ালা ভিলার্ড। নাম শুনেছ বোধ হয়। ফরাসি গোয়েন্দা বিভাগে ইদানীং পয়লা নম্বর লোক। সহজাত বুদ্ধি দিয়ে ঝট করে বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও ভদ্রলোকের মধ্যে একটা বড়ো রকমের ঘাটতি আছে। গোয়েন্দাগিরি একটা আর্ট। এ-আর্টে উঁচুদরের শিল্পকর্ম দেখাতে গেলে বিশেষ পড়াশুনা করা দরকার। এটি তার নেই! কেসটা একটা উইল সংক্রান্ত ঝামেলা নিয়ে। মাথা ঘামানোর মতো বেশ কিছু পয়েন্টও আছে। আমি শুধু ওঁকে দুটো সমতুল্য কেসের খুঁটিনাটি পড়ে নিতে বলেছিলাম তার কেসের সমাধান রয়েছে ওই দুটো কেসেই একটা ১৮৫৭ সালের রিগ রহস্য, আর একটা ১৮৭১ সালের সেন্ট লুই রহস্য। পরামর্শ পেয়ে ধন্য হয়ে ভদ্রলোক চিঠি লিখেছেন। চিঠিখানা পেলাম আজ সকালে। পড়ে দেখ।

বলতে বলতে একটা দলা পাকানো বিদেশি কাগজ আমার দিকে ছুঁড়ে দিল হোমস। চোখ বুলোতে গিয়ে ভুরি ভুরি প্রশংসা-বিশেষণই কেবল চোখে পড়ল। ফরাসিরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলে যেসব বাছাই করা বুলি ছাড়ে–কোনোটাই বাদ যায়নি।

বললাম, গুরুর কাছে শিষ্যের লেখা চিঠি বলে মনে হচ্ছে।

লঘুভাবে হোমস বললে, একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে পরামর্শটা সামান্য ওঁর কাছে তা অসামান্য। প্রতিভার দিক দিয়ে নিজেও বড়ো কম যান না। আদর্শ ডিটেকটিভ হতে গেলে যে তিনটি গুণ অপরিহার্য, ওঁর মধ্যে তার দুটো আছে। পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা আছে, অবরোহ মতে সিদ্ধান্তে আসার ক্ষমতা আছে। অভাব শুধু পড়াশুনার সেটা যথাসময়ে হয়ে যাবে। আমার লেখাগুলো এখন ফরাসিতে তরজমা করছেন ভদ্রলোক।

তোমার লেখা?

সে কী তুমি জান না? হেসে বললে হোমস। বেশ কয়েকটা প্রবন্ধ লেখার অপরাধে অপরাধী আমি। সবই পেশা সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর। যেমন ধর না একটা বিভিন্ন তামাকের ছাইয়ের মধ্যে পার্থক্য১২ সংক্রান্ত। এ-প্রবন্ধে একশো চল্লিশ রকম সিগারেট, চুরুট আর তামাক পাইপের বর্ণনা দিয়েছি এবং রঙিন ছবি দিয়ে দেখিয়েছি একটি ছাইয়ের সঙ্গে আর একটির ছাইয়ের তফাত কোথায়। আদালতে অপরাধীদের মামলা চলার সময়ে এই একটি প্রসঙ্গের অবতারণা ঘটে–কখনো-সখনো দেখা যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে এর জুড়ি নেই। যেমন ধর না কেন, তুমি যদি নিশ্চিন্তভাবে বলতে পার যে খুন করার সময়ে অমুক ব্যক্তি ভারতীয় লুঙ্কা চুরুট খাচ্ছিল–অনেক ছোটো হয়ে আসে তোমার তদন্তের গণ্ডি। বাঁধাকপি আর আলুর মধ্যে যে তফাত, ত্রিচিনোপল্লি চুরুটের কালো ছাই আর বার্ডস আইয়ের সাদা পেঁজা ছাইয়ের মধ্যে তেমনি অনেক তফাত, চক্ষের নিমেষে ধরা পড়ে যায় অভিজ্ঞ চোখে।

তুচ্ছ বিষয়ের পর্যবেক্ষণে তোমার জুড়ি নেই–সত্যিই প্রতিভা তোমার অসাধারণ মন্তব্য করি আমি।

তুচ্ছ হলেও ফ্যালনা কিছুই নয় গুরুত্ব বুঝে তার কদর করি। এই দেখ আমার লেখা আর একটা প্রবন্ধ–কীভাবে পায়ের ছাপ দেখে১৪ ছাপের মালিকের নাড়িনক্ষত্র জানা যায় তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছি এর মধ্যে। সেইসঙ্গে প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে পদচিহ্নের ছবি তোলবার কথাও বলেছি। এই নাও আর একটা ছোট্ট লেখা–হাতের ওপর পেশার ছাপ কীভাবে পড়ে খুঁটিয়ে লিখেছি। অদ্ভুত বিষয় কিন্তু অনেক হাতের লিথোটাইপ ছবিও১৫ দিয়েছি। স্লেটপাথর নিয়ে যারা কাজ করে, ছাপাখানায় যারা টাইপ কম্পােজ করে, যারা কাপড় বোনে, যারা হিরে পালিশ করে, যারা জাহাজের খালাসির কাজ করে, যারা ছিপি কাটে–এদের প্রত্যেকের হাত দেখলেই বলে দেওয়া যায় কার কী পেশা? সায়েন্টিফিক ডিটেকটিভের কাছে বিষয়টার ব্যবহারিক গুরুত্ব কী প্রচণ্ড। বিশেষ করে বেওয়ারিশ লাশ শনাক্ত করার সময়ে অথবা অপরাধীর পূর্ব বৃত্তান্ত উদ্ধার করবার সময়ে এই বিদ্যার প্রয়োজন হয় খুব বেশি। যাক গে ভায়া, আমার শখের কাহিনি শুনিয়ে তোমায় হাঁফ ধরাতে আর চাই না।

মোটেই না, বললাম সাগ্রহে। তোমার কাজের ধারা স্বচক্ষে দেখেছি বলেই বলছি, প্রবন্ধগুলোর গুরুত্ব আমার কাছে অনেক–তুমি যা লিখেছ তা হাতে-কলমে দেখিয়েছ আমার সামনেই। তবে এইমাত্র পর্যবেক্ষণ আর অবরোহমতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্বন্ধে বলছিলে। দুটোই প্রায় একই বস্তু নয় কি?

তাই কি? আর্মচেয়ারে মৌজ করে হেলান দিয়ে বসল শার্লক হোমস, গলগল করে নীলচে কালো ধোঁয়া ছাড়তে লাগল পাইপ থেকে। বলল, যেমন ধর, পর্যবেক্ষণ করে জানা গেল আজ সকালে তুমি উইমগোর স্ট্রিটে পোস্ট অফিসে গিয়েছিলে, কিন্তু অবরোহমূলক সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রকাশ পাচ্ছে তুমি সেখানে গেছিলে একটা টেলিগ্রাফ পাঠানোর কাজে।

বলেছ ঠিক! দুটিই খাঁটি সত্যি! কিন্তু বুঝলাম না তুমি জানলে কী করে। হঠাৎ ইচ্ছে হল

টেলিগ্রাম পাঠানোর কাউকে তো বলিনি আমি।

আমার বিস্ময় দেখে খুক খুক করে কাষ্ঠ হেসে শার্লক হোমস বললে, ব্যাপারটা জলের মতো সোজা। এত সোজা যে ব্যাখ্যা করাটাও একটা বাড়াবাড়ি। তাহলেও করব পর্যবেক্ষণ আর অবরোহমূলক সিদ্ধান্তর সীমারেখা স্পষ্ট করে বোঝানোর জন্যে। পর্যবেক্ষণের শেষ কোথায় এবং অবরোহ সিদ্ধান্তের শুরু কোনখান থেকে সেটা বোঝা তোমার একান্ত দরকার। তোমাকে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল, তোমার পায়ের পাতার ওপরদিকে একটা লালচে ডেলা লেগে রয়েছে। উইমগোর স্ট্রিট পোস্ট অফিসের উলটো দিকে ফুটপাথ খোঁড়া হয়েছে দেখছি। নীচের মাটি বেরিয়ে পড়েছে এবং সে-মাটি একটু লালচে ধরনের ধারে কাছে আর কোথাও দেখা যায় না। মাটিটা বেরিয়ে আছে এমন জায়গায় যে পোস্ট অফিসে ঢুকতে গেলে পায়ের পাতায় লাগবেই এড়ানো যায় না। পর্যবেক্ষণের দৌড় এই পর্যন্ত। বাকিটা ধাপে ধাপে চিন্তা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোর ব্যাপার।

ধাপে ধাপে কী চিন্তা করে তুমি জানলে যে আমি টেলিগ্রাম পাঠাতে গিয়েছিলাম?

সে আর এমন কী ব্যাপার। সারাসকাল তো তোমার সামনেই বসে আছি। একটা চিঠিও লিখতে দেখিনি। তোমার টেবিলেও দেখছি এক বান্ডিল পোস্টকার্ড আর বেশ কিছু ডাকটিকিট রয়েছে। তা সত্ত্বেও তুমি যখন পোস্ট অফিসে গেছ, নিশ্চয় টেলিগ্রাম পাঠানোর জন্যেই। অন্যান্য সব কারণ বাদ দিতে দিতে শেষ যে-কারণে পৌঁছোবে জানবে সেইটাই আদত সত্যি।

একটু ভেবে নিয়ে বললাম, এ-কেসে অবশ্য সত্যি জলের মতোই সোজা তোমার কথাই বলছি তোমাকে। যদি ধৃষ্টতা হিসেবে না নাও। তোমার তত্ত্বগুলোকে আরও কঠোরভাবে যাচাই করতে পারি কি?

নিশ্চয় পার। রাগ তো করবই না। বরং উপকৃত হব। কোকেনের সেকেন্ড ডোজটা আর নিতে হবে না। যেকোনো সমস্যা হাজির করতে পার, সানন্দে মাথা ঘামাব।

তোমাকেই বলতে শুনেছি দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে কোনো জিনিসের ওপর মানুষটার ব্যক্তিসত্তার ছাপ এমনভাবে আঁকা হয়ে যায় যে অভিজ্ঞ চোখে তা ধরা পড়বেই। কিছুদিন হল একটা ঘড়ি এসেছে আমার কাছে। যার ঘড়ি তার চরিত্র, স্বভাব, ঘড়ি দেখে বলতে পারবে?

মনের মধ্যে একটা চাপা আনন্দ নিয়েই ঘড়িটা তুলে দিলাম বন্ধুবরের হাতে। হামবড়াই সুরে গায়ের জোরে বড্ড তত্ত্ব আওড়ায় হোমস, থোঁতা মুখ এবার ভোঁতা করা যাবে–দর্পচূর্ণ হবে–উচিত শিক্ষা দেওয়া যাবে। ঘড়িটা হাতে নিয়ে হোমস তীক্ষ্ণ্ণ চোখে চেয়ে রইল ডায়ালের দিকে, পেছনের ডালা খুলে খুঁটিয়ে দেখল ভেতরকার কলকবজা–প্রথমে খালি চোখে, তারপর একটা শক্তিশালী আতশকাচ দিয়ে। খটাস করে ডালা বন্ধ করে ঘড়িটা যখন ফিরিয়ে দিল আমার হাতে, তখনকার সেই চোয়াল-ঝুলে পড়া শুকনো মুখচ্ছবি দেখে আনন্দ আর চাপতে পারলাম না–হেসে ফেললাম।

ঘড়িটা সম্প্রতি সাফ করা হয়েছে তেল দিয়ে। ফলে সিদ্ধান্তে আসার মতো কোনো চিহ্ন আর পড়ে নেই, বললে ও।

বলেছ ঠিক। আমার কাছে পাঠানোর আগে তেল দিয়েই সাফ করা হয়েছে ঘড়ি।

মনে মনে কিন্তু ফালতু অজুহাত দেখানোর অপরাধে অপরাধী করলাম বন্ধুবরকে। নাচতে–জানলে উঠোনের দোষ। ঘড়ি যদি তেল দিয়ে সাফ না-করাই হত, এমন কী চিহ্ন সে আবিষ্কার করত ঘড়ির কলকবজা থেকে? যত্তো সব…।

স্বপ্নচ্ছন্ন, গালা-চকচকে চোখে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে হোমস বললে, মনের মতো–হলেও ঘড়ি নিয়ে গবেষণা একেবারে বৃথা যায়নি। ভুল হলে শুধরে দিয়ো। আমার সিদ্ধান্ত–এই ঘড়িটা তোমার বড়দার। তিনি পেয়েছিলেন তোমার বাবার কাছ থেকে!

ঘড়ির পেছনে H. W. অক্ষর দুটো দেখে নিশ্চয় বলছ?

হ্যাঁ W. হল তোমার নামের আদ্যক্ষর। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেকার তারিখ রয়েছে ঘড়ির মধ্যে; অর্থাৎ এ-ঘড়ি আমাদের বাবাদের আমলের ঘড়ি। জড়োয়া জিনিস সাধারণত বাড়ির বড়ো ছেলে পায় বাবার নামেই তার নাম হয়। আমি জানি তোমার বাবা গত হয়েছেন বহু বছর আগে। তার মানে এ-ঘড়ি এসেছিল তোমার বড়দার হাতে।

ঠিক হচ্ছে। আর কিছু?

তিনি একটু অপরিচ্ছন্ন স্বভাবের মানুষ–একটু কেন বেশিই বলতে পার। হুঁশ নেই কোনোদিকে। বেপরোয়া, অবস্থা খুব সচ্ছল ছিল। কিন্তু টাকা রাখতে হয় কী করে জানতেন না। তাই মাঝে মাঝে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কেটেছে আবার কখনো টাকায় গড়াগড়ি নিয়েছেন। শেষকালে মদ ধরেন এবং মারা যান। বলার মতো আর কিছু পাচ্ছি না।

চেয়ার থেকে ছিটকে গেলাম আমি। খোঁড়াতে খোঁড়াতে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলাম ঘরময়–তিক্ততায় টইটম্বুর হয়ে উঠল ভেতরটা।

আমার দাদা বেচারার খবর আগেই নিয়েছ, এখন এমন ভান করলে যেন ঘড়ির মধ্যে থেকে সে খবর উদ্ধার করলে। সামান্য একটা পুরোনো ঘড়ি দেখে এত কথা বলা যায়, আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করাতেও পারবে না? ভণ্ডামিটুকু না-করলেই পারতে। কী অন্যায়! কী অন্যায়!

সহৃদয় কণ্ঠে হোমস বললে, ভায়া ডাক্তার, ক্ষমা করো আমাকে। ব্যাপারটাকে একটা গূঢ় সমস্যা হিসেবেই নিয়েছিলাম, ভুলে গিয়েছিলাম বিষয়টা ব্যক্তিগত এবং দুঃখ পেতে পার। তবে বিশ্বাস কর, এ-ঘড়ি হাতে আসার আগে জানতাম না তোমার একজন ভাই আছে।

তাহলে জানলে কী করে? সবই তো সত্য ঘটনা–নির্জলা সত্যি।

সেটা আমার কপাল। আমি কতকগুলো সম্ভাবনার কথা বলেছি কেবল, অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়ে যাবে ভাবিনি।

তবে কী, যা বললে তা নিছক অনুমান নয়?

অনুমান? আরে না, অনুমান আমি কখনো করি না। খুব খারাপ অভ্যেস–যুক্তিবোধের সর্বনাশ করে ছাড়ে। আমার চিন্তার ধারাটা তুমি অনুধাবন করতে পারোনি বলেই পুরো ব্যাপারটা মনে হচ্ছে এত অদ্ভুত ঘটনা যত ছোট্টই হোক না কেন, তাকে যদি ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ করা যায়–বৃহৎ সিদ্ধান্ত না-এসে পারে না। যেমন ধর না কেন, আমি তোমাকে প্রথমেই বললাম, তোমার বড়দাটির হুঁশ ছিল না কোনোদিকে। ঘড়ির তলার দিকটা লক্ষ করলেই দেখবে শুধু যে দু-জায়গায় তুবড়ে গেছে তা নয়, সারাগায়ে বিস্তর আঁচড় আর কাটার নাগ রয়েছে, যেন কঠিন বস্তুর সঙ্গে ঘড়িটাকে রেখে দেওয়ার বদভ্যেস ছিল–অর্থাৎ চাবি আর খুচরো পয়সার সঙ্গে এমন একটা রত্নখচিত ঘড়িও অবহেলায় রেখে দেওয়া হত একই পকেটে। যে-লোক পঞ্চাশ গিনি দামের ঘড়ি এত হেলাফেলাভাবে পকেটে নিয়ে বেড়ায়, সবদিকে তার হুঁশ আছে, এ-কথা কি বলা যায়? এই থেকেই আসা যায় আর একটা সিদ্ধান্তে, এত দামি বস্তুর মালিক যিনি, তার অন্যান্য জিনিসেরও অভাব নিশ্চয় নেই।

যুক্তিপ্রবাহ সুস্পষ্ট হওয়ায় মাথা নেড়ে সায় দিলাম আমি।

ইংলন্ডের বন্ধকি কারবারিদের স্বভাব হল ঘড়ি বাঁধা রাখলেই টিকিটের নম্বরটা পিন দিয়ে খুঁচিয়ে ডালার ভেতর দিকে লিখে রাখে। লেবেল লাগাবার চাইতে নিরাপদ, হারাতে পারে, কিন্তু খোদাই করা নম্বর থেকে যাবে। ডালার মধ্যে এ-রকম নম্বর দেখলাম কম করেও চারটে। সিদ্ধান্ত একটাই–হামেশাই টাকার টানাটানি গিয়েছে তোমার দাদার! এ থেকে বেরোচ্ছে। একটা শাখা সিদ্ধান্ত মাঝে মাঝে দৈন্যদশা কাটিয়ে ফের টাকায় গড়াগড়ি দিয়েছিলেন বলেই দামি ঘড়িটা ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল বন্ধকি কারবারির খপ্পর থেকে। সবশেষে তোমাকেই বলব। চাবির গর্ত যাতে আছে ভেতরকার সেই পাতটার দিকে একটু তাকাও! চাবির চারপাশে হাজার হাজার আঁচড়ের দাগ দেখছ না? চাবি ফসকে যাওয়ার দাগ। মাতাল না-হলে সুস্থির মানুষের হাত এভাবে কখনো অস্থির হয়? মাতালরা কিন্তু কখনো ঘড়ি কাছ ছাড়া করে না–রাতে শোবার সময়ে ঘড়িতে দম দেয় কাঁপা হাতে এই ধরনের দাগ ফেলে চাবির গর্তের পাশে। এখন বললা, রহস্যটা কোথায়?

কোথাও নেই, দিনের আলোর মতোই সব স্পষ্ট করে দিলে তুমি, বললাম আমি। তোমার ওপর অবিচার করার জন্যে অনুশোচনা হচ্ছে। তোমার বিস্ময়কর এই ক্ষমতায় আমার আরও একটু আস্থা থাকা উচিত ছিল। যাক গে, তোমার যা পেশা, সে-রকম কোনো কাজ এখন হাতে আছে নাকি?

একদম না। সেইজন্যেই তো কোকেন নিচ্ছি। মগজকে না-খাঁটিয়ে আমি থাকতে পারি না। তা ছাড়া জীবনের আর কী উদ্দেশ্য বলতে পার। এসো, এই জানালাটার সামনে দাঁড়াও। দুনিয়াটার এ-রকম চেহারা কখনো দেখেছ? নিরানন্দ, দুঃখময়, লাভ কোথাও নেই–কেবল লোকসান। হলদে কুয়াশা দেখেছ কীরকম ঘুরপাক খেতে খেতে রাস্তার ওপর দিয়ে গড়িয়ে পিঙ্গল রঙের বাড়িগুলোর ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে? গদ্যময়তা আর জড়বাদের এর চাইতে প্রকট রূপ আর কখনো দেখেছ? কী হবে শক্তি নিয়ে বলতে পার ডাক্তার? শক্তিকে প্রয়োগ করার উপর্যুক্ত ক্ষেত্রই যদি না-পাওয়া যায়, লাভ কী শক্তিমান হয়ে? অপরাধ জিনিসটাই আজকাল গতানুগতিক, মানুষের অস্তিত্বও গতানুগতিক, এই পরিস্থিতিতে মানুষের যে গুণ গতানুগতিক নয়–এ-সংসারে সে-গুণের কোনো চাহিদাই নেই।

গরম লেকচারের জবাব দেওয়ার জন্যে সবে মুখ খুলেছি, এমন সময়ে দরজায় ছোট্ট করে নক করে ঢুকল ল্যান্ডলেডি–হাতের তারেকাবে একটা কার্ড।

বললে বন্ধুবরকে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান একজন ইয়ং লেডি।

কার্ডটা পড়ল হোমস, মিস মেরি মর্সটান। হুম! এ-নাম তো কখনো শুনিনি–মনেই পড়ছে না। মিসেস হাডসন, ইয়ং লেডিটিকে বলুন, দয়া করে যেন ভেতরে আসেন। ডাক্তার তুমি যেয়ো না। আমি চাই তুমি থাক।